০৬. রুবাবের কান্না

রুবাবের কান্না এই মাত্র থেমে গেল। তারপর চাপা হাসির আওয়াজ শোনা যায়। চাপা কিন্তু প্রাণদ। অন্যান্য দিনের মত এই রাত্রিও স্তব্ধ শীতলতার ভাণ্ডার, বাতাসের কারাগার। বাগিচায় হারুনর রশীদ, আবু ইস্‌হাক, মশ্‌রুর কথোপকথন-রত।

হারুন : আবু ইস্‌হাক, তোমার সঙ্গ এইজন্যে ছাড়তে পারি নে। বহুদিন পর তুমি হাসালে, সত্যি হাসালে। আবার আবৃত্তি করো।

ইস্‌হাক : আলম্পানা, আবু ইস্‌হাকও কোনদিন আমিরুল মুমেনীনকে ত্যাগ করে যেতে পারবে না। তবে শুনুন :

ইরানী মেয়ের সীনা ভাল,
মিশরী মেয়ের ঊরু।
আরবী মেয়ের নাভীর নীচে
স্বর্গ ঠারে ভুরু।

হারুন : হাহ্‌ হা, শোনো মশ্‌রুর। কিন্তু মিশরী মেয়েরা তোমাকে কতল করে ছাড়বে কবি।

ইস্‌হাক : আলম্পানা, আবু ইস্‌হাক এমন বহুবার কতল হয়ে গেছে, সুতরাং ডর নিস্ত।

হারুন : ইরানী মেয়েরা তোমাকে খুন করবে, কবি।

ইস্‌হাক : ওদের দুই সীনার উপত্যকার মাঝখানে আমার কবর হয়ে গেছে, জাঁহাপনা! লাশকে কি কেউ খুন করে?

 হারুন : শোনো, মশ্‌রুর। বিষণ্ণ রাত্রে কবি ইসহাকের সঙ্গ পেলে আর কোন চিন্তা থাকে না। কিন্তু কবি কখন কোন্ পাশালায় হারিয়ে যায়, খুঁজে পাওয়া মুশকিল।

ইস্‌হাক : আপনার বান্দা মশ্‌রুর তা জানে। শুধু মশ্‌রুর কেন, দুনিয়ার সবাই জানে, মরুরের তলওয়ারের ঝিলিক আর ইসহাকের কথার ঝিলিকের কাছে বিদ্যুৎ তুচ্ছ।

হারুন : কিন্তু কবি, তুমি আরমেনী মেয়ে সম্পর্কে কোন রুবায়ী লিখ্‌বে না?

ইস্‌হাক : জাঁহাপনা, আজ প্রথম দেখলাম আরমেনী মেয়ে, তাও দূর থেকে গাছে সওয়ার হয়ে। তাই ওরা খারিজ আছে।

হারুন : কিন্তু কি দেখলে?

ইস্‌হাক : দেখলাম মরুরের তলওয়ারের ঝিলিক হার মেনে গেল।

হারুন : আর কি দেখলে?

ইস্‌হাক : দেখলাম, কিন্তু বুঝতে পারলাম না–দেহের প্রতীক ছন্দ, না ছন্দের প্রতীক দেহ।

হারুন : আর কি শুনলে?

ইস্‌হাক : শুনলাম, আদমকে তৈরীর পর বিধাতা হয়ত যে-হাসি হেসেছিল তারই অনুরণন।

হারুন : আবু ইস্‌হাক, তুমি সত্যি সুরের কবি। মশ্‌রুর, কাল খাজাঞ্চীখানা থেকে কবিকে চার হাজার আশরফী দেওয়ার বন্দোবস্ত করবে। আমার ফরমান।

মশ্‌রুর : আসৃসামায়ো তায়তান।

হারুন : কবি, তোমাকে আর একটা কথা জিজ্ঞেস করতে চাই।

ইস্‌হাক : বলুন, আলম্পানা।

হারুন : ঝুটো চিজ কি খাওয়া যায়?

ইস্‌হাক : চিজ?

হারুন : হ্যাঁ।

ইস্‌হাক : খাওয়া যায়, আবার যায় না।

হারুন : সে কেমন?

ইস্‌হাক : অনেক জিনিস ঝুটো হয়, তা খাওয়া চলে না। হেকিমী ইলেমের বিরোধী। আবার অনেক চিজ যা কখনই ঝুটো হয় না, উচ্ছিষ্ট হয় না। সেখানে হেকিম ইলেম ‘থ’ অসহায়।

হারুন : এমন চিজ আছে?

ইস্‌হাক : কিন্তু হঠাৎ এমন অদ্ভুত সওয়াল, জাঁহাপনা?

হারুন : এমনি জিজ্ঞেস করছি। হ্যাঁ, কোন্ চিজ কোনদিন ঝুটা হয় না?

ইস্‌হাক : জীবন এবং যৌবন, জাঁহাপনা। নদী কি কেউ কোনদিন উচ্ছিষ্ট করতে পারে?

হারুন : না, পারে না।

ইস্‌হাক : জীবন যৌবন বহতা নদীর মত। কত তৃষ্ণার্ত আকণ্ঠ পান করে যাবে, তবু ঝুটা হবে না। কিন্তু জীবন যৌবন ছাড়া আর সব কিছু উচ্ছিষ্ট হয়ে যায়। যা বহতা নয়, তা-ই উচ্ছিষ্ট।

হারুন : কবি আবু ইস্‌হাক, তুমি শুধু বাদক নও, সত্যিকার কবি–বিরাট কবি। মশ্‌রুর, ইস্‌হাককে আরো পাঁচ হাজার আশরফী সওগাত দিলাম। কাল বন্দোবস্ত করো।

মশ্‌রুর : আস্‌সামায়ো তায়তান।

ইস্‌হাক : আমিরুল মুমেনীন, আপনি বান্দা-নওয়াজ তা জানি, কিন্তু গরীবের উপর এত মেহেরবান হবেন না।

হারুন : আবু ইস্‌হাক, তোমার মর্যাদা হারুনর রশীদের খাজাঞ্চীখানা দিতে পারে না। তা জানি, তবু–

ইস্‌হাক : জাঁহাপনা, শুকরিয়া—হাজার–লাখ শুকরিয়া।

হারুন : মশ্‌রুর!

মশ্‌রুর : আমিরুল মুমেনীন।

হারুন : আজকের নৈশ অভিযান এখানে শেষ হোক। আমার ঘুম পাচ্ছে। কাল তুমি শহর কোতোয়ালকে বলে রাখবে, আমার দশ-পনর জন কোতোয়াল দরকার হবে।

মশ্‌রুর : যো হুকুম, আলম্পানা।

হারুন : হ্যাঁ, কাল আবার আমাদের এখানে দেখা হচ্ছে। মজ্‌লিশ ভাঙার আগে, আবু ইস্‌হাক, তোমার রুবাবে আবার আনন্দের মওজ তোলো।

[রুবাব বেজে চলে]

কাওসুল আকদারের বাগ-বাগিচায় সুরের হিল্লোল।

বগ্‌দাদের সড়কে অবাধ রাত্রি।

গোলাম-বস্তি নিঝুম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *