০৪. তৃতীয় রাত্রি

তৃতীয় রাত্রি।

স্থান, কাওসুল আারের উদ্যান। এই রঙ্গমঞ্চে দুইজন পরিচিত অভিনেতাই উপস্থিত, আরো দুই রাত্রি যাদের সঙ্গে দেখা।

–জাঁহাপনা।

–মশ্‌রুর, তোমার হদিস বাতাও।

মশ্‌রুর : জাঁহাপনা, জায়গা বিশেষে কানের চেয়ে চোখের কিমৎ বেশী। আমি আজ হদিস মুখে বলব না, আপনাকে শোনাব না। আপনার মেহেরবান দুই আঁখিপটে সব ছবি পড়বে, আপনি দেবেন। এখন আমাকে অনুসরণ করুন।

হারুন : কোন্ দিকে মশ্‌রুর?

মশ্‌রুর : সেই দেওয়ালের কাছেই। কিন্তু একটু দূরে। একটা বাদাম গাছের ডালের কাছে।

হারুন : তা-ই চলো।

মশ্‌রুর : বান্দার গোস্তাখি মাফ করবেন, জাঁহাপনা। আর একটা আরজ। আপনাকে তলীফ করে সামান্য উঁচুতে গাছের ডালে চড়তে হবে।

হারুন : তক্‌লীফ কি? তুমি জানো না, ছেলেবেলায় আমি পিতার চোখে ধুলো দিয়ে কতদিন এইসব গাছে চড়েছি। আমার কোন কষ্ট নেই।

মশ্‌রুর : তা আমি শুনেছি নাদার। দুই জনে অন্ধকারে লেবাস পর্যন্ত গোপন করে এগোতে লাগলেন। গাছের পাকা পাতা ঝরে। আমিরুল মুমেনীন কান খাড়া করেন।

হাঁটতে হাঁটতে তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘মশ্‌রুর, আজ এত রাত্রি, সেই হাসির রণন ত পাচ্ছি না।’

মশ্‌রুর : জাঁহাপনা, বান্দাকে এই বিষয়ে আর কোন সওয়াল করবেন না। আপনার সতর্ক, নেঘাবান চোখের কাছে সব হাজির হবে।

হারুন : মশ্‌রুর, তুমি ধাঁধায় ফেললে। হঠাৎ প্রহরীদের সঙ্গে দেখা হোয়ে গেলে?

মশ্‌রুর : না, ওরা আজ এদিকে আসবে না। আমি মানা করে দিয়েছি।

হারুন : তা বুঝেছি। মশ্‌রুর কোন কাঁচা কাজ করে না।

মশ্‌রুর : জাঁহাপনা, এই সেই বাদামের দারাখৎ (বৃক্ষ), এই গাছের ডালে আমাদের চড়তে হবে।

হারুন : আচ্ছা, জুতা খোলর প্রয়োজন হবে না। আমার আবা শুধু খুলে এক পাশে রেখে দিই। আলম্পানা, আমি খুলে নিচ্ছি।

প্রায় পনর হাত ঊর্ধ্বে খাড়ী ডালে মশ্‌রুর ও আমিরুল মুমেনীন উঠে বলেন।

মশ্‌রুর : জাঁহাপনা, একবার রাত্রির বগ্‌দাদ–আপনার গড়া বগ্‌দাদকে এই উঁচু থেকে দেখে নিন। চমৎকার। কত আলো চারদিকে। এই রাত্রি তবু মানুষের স্পন্দন, হৃৎস্পন্দনের মতই ধুকধুক করছে। দজ্‌লা নদীর বুকে গুফার উপর আলোর ঝিকিমিকি দেখুন। গুফাদারেরা গজল গাইছে, দাঁড় টানছে। আমিরুল মুমেনীনের গড়া বগ্‌দাদ, এক-কথায় অপূর্ব।

হারুন : মশ্‌রুর, মহলের মিনার থেকে কত রাত বগ্‌দাদকে দেখেছি। কিন্তু আজকের দেখা কোনদিন ভুলতে পারব না। গাছপালার মধ্যে বসে যেন আদিম দুনিয়া থেকে দেখছি মানুষের গড়া জিনিসকে। ইনসান-ও স্রষ্টা। আর ইনসানের তৈরী চিজ বিধাতার চিজের চেয়ে কিছু নগণ্য নয়। আমার বগ্‌দাদের এই ইমারৎ, সব কিছু হয়ত আজরাইলের থাবায় লয় পেয়ে যাবে, কিন্তু বগ্‌দাদ অমর উপকথায় পরিণত হবে। আজরাইল সেখানে পৌঁছতে পারবে না।

মশ্‌রুর : আলহামদোলিল্লাহ্‌, জাঁহাপনা।

হারুন : বগ্‌দাদ দুনিয়ার দুর্ভেদ্য অন্ধকারে রোশনাই হোয়ে থাকবে, মশ্‌রুর।

মশ্‌রুর : আলহামদোলিল্লাহ্‌। সকল প্রশংসা আল্লার।

হারুন : কিন্তু মশ্‌রুর, সেই হাসির ত কোন আলাম-চিহ্ন-পাওয়া যাচ্ছে না।

মশ্‌রুর : জাঁহাপনা, আমার হাত থেকে এই কাঁচখানা গ্রহণ করুন, কিমিয়ার কাছ থেকে আনা।

হারুন : কেন?

মশ্‌রুর : এটা চোখে দিলে গাঢ় অন্ধকারেও আবৃছা কিছু দেখতে পাবেন। আর ওই দিকে তাকান। ওই যে খুবানীর ডাল ঝুলে রয়েছে সেদিন যে-জায়গাটা আপনার নেঘাবান চোখে পড়েছিল, সেদিকে তাকিয়ে থাকুন, আলম্পানা।

হারুন : বেশ। কিন্তু কিছুই ত দেখতে পাচ্ছি না।

মশ্‌রুর। দেখতে পাবেন, নুরুল্লাহ্। আর খুব আস্তে কথা বলবেন। আশেপাশে দেখুন। আমার কাছে-ও একটা কাঁচ আছে। চোখে লাগাই। হারুন কিছু দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। সব অন্ধকার।

মশ্‌রুর : আমিরুল মুমেনীন, ঐ ঝুলন্ত ডালের সোজাসুজি দেওয়ালের ওপাশে অর্থাৎ বাগানের দিকে দেখুন।

হারুন : হ্যাঁ, দেখতে পাচ্ছি। অবশ্য ঝাপ্সা। একজন আওরৎ. হ্যাঁ, আওরৎ-ই আসছে। ওড়না, সদরীয়া, নেকাব–সবই আছে। আমার মহলের আওরৎ কোন বেগম, কোন্ বাঁদী, মশ্‌রুর?

মশ্‌রুর : বান্দাকে নাচার করবেন না, জাঁহাপনা। শুধু আপনার মেহেরবান চোখে দেখুন।

হারুন : কিন্তু আমার চোখ মেহেরবান নয়। আমার মহলের বেগম না–বাঁদী? একি মশ্‌রুর, ডাল ধরে ঝুলে ও-যে দেওয়ালের উপর চড়ল, তারপর ওদিকে ঝাঁপিয়ে পড়ল–ইশারায় কী যেন বললে। নিচে কি কেউ দাঁড়িয়ে আছে? ও কি মহলে বেগম, না বাঁদী?

মশ্‌রুর : জাঁহাপনা, আমি কোন জবাব দেব না। একটু সবুর করুন। বান্দাকে আর গোস্তাখির গোনায় গোনাগার করবেন না।

হারুন : সবুর। মশ্‌রুর, গোয় আমার খুন টগবগ ফুটছে।

মশ্‌রুর : আলম্পানা, সবুৎ (প্রমাণ) বা একটা কাজের সব না দেখে আপনি গোস্বা হোতে পারেন না।

হারুন : তা সহী (ঠিক)।

মশ্‌রুর : আলম্পনা, এবার ডাইনে বিশ-তিরিশ হাত দূরে একটু কোনাকোনি আপনার নেঘাবান চোখ সরান। ওটা গোলামদের বস্তী। ঐ এক ঝরোকায় আলো জ্বলছে মিটিমিটি। ওদিকে তাকান। চোখে কাঁচ লাগাতে ভুলবেন না।

হারুন : ওখানে কেন?

মশ্‌রুর : দেখুন, আলি-শান।

হারুন : মশ্‌রুর, তুমি শুধু তেলেসমাতি ধাঁধা সৃষ্টি করছ।

মশ্‌রুর : এবার দেখুন।

হারুন : ও ত গোলাম বসতের ঘর। কিছু মাটি উঁচু করে ফেলে দিওয়ানের মত বানিয়েছে। উপরে বিছানা পাতা। বেশ রঙীনই মনেহয়। গোলামের ঘরে–এই তাকিয়া? আর ত কিছু দেখা যাচ্ছে না।

মশ্‌রুর : জাঁহাপনা, আপনি শুধু দেখে যান।

হারুন : আমি ত দেখছি-ই।

পাশাপাশি উপবিষ্ট মশ্‌রুর ও হারুনর রশীদ। কত রাত্রি কে জানে? গাছের কয়েকটা ডাল এক জায়গা থেকে বেরিয়েছে। এমন খড়ি। বেশ হেলান দিয়ে এখানে বসা যায়। কিন্তু কৌতূহলী মানুষ ত আরামের স্বাদ-প্রার্থী নয়। আমিরুল মুমেনীন ও মশ্‌রুর শিরদাঁড়া সটান মনোনিবেশে দৃশ্য দেখতে লাগলেন। শোনার ক্ষেত্র নেই, বলা বাহুল্য।

গোলাম-বসতের সাধারণ মাটির ঘর যেমন হয়, এই ঘরের মশালা তার চেয়ে অন্য কিছু নয়। কিন্তু তবু পরিপাটি আছে। মাটির দিওয়ান জানালার পাশে। মরুভূমির লু’হাওয়া থেকে বাঁচার জন্য সমস্ত ঘরের জানালা উঁচুতে। যেন সোজাসুজি বাতাস মুখে না লাগে। গাছের পাতার তৈরি দুই পাল্লা। কখনও বন্ধ, কখনও খোলা থাকে। নিচের রাস্তা থেকে কিছু দেখা যায় না। অনেক উপর থেকে ঘরের মেঝে চোখে পড়ে।

হঠাৎ মেটে দিওয়ানের উপর এক হাব্‌সী নওজোয়ান এসে শুয়ে পড়ল, ঠোঁটে মিটিমিটি হাসি। তার পেছনেই এলো আরমেনী এক তরুণী। সে বসে পড়ল এক পাশে। হাতে একগোছা আঙুর। গুচ্ছ সমেত সে হাব্‌সী নওজোয়ানের ঠোঁটের উপর ধরে ও নাড়াতে থাকে। হাব্‌সী আঙুরের লোভে ঠোঁট বাড়ায়। তরুণী তখন দ্রাক্ষাগুচ্ছ উপরে তুলে নেয় আর মিটিমিটি হাসে। হাব্‌সী জোয়ান এবার বালিশ থেকে আরো উর্ধ্বে মুখ তোলে, কিন্তু আঙুর গুচ্ছ তেমনই আরো উপরে সরে যায়।

কথা শোনা যায় না, তবু কেউ কাছে থাকলে শুনতে পেত বৈকি।

তরুণী : তুমি বড় লোভী, তাতারী? তোমার সবুর সয় না।

যুবক : মেহেরজান, সবুর করা যায় না। ভাল মেওয়া দেখলে জিভে পানি এম্নি আসে।

তরুণী : এসো, আর একবার চেষ্টা করো, তোমার ঠোঁটের কাছে আঙুর ঝুলিয়ে ধরি।

যুবক : তোমার ঠোঁটে আরো বেশী মেওয়া আছে।

তরুণী: বেশ, তাই খাও। কিন্ত আঙুর পাবে না।

যুবক : আঙুরে আমার প্রয়োজন নেই। ও আমার আমাদের নসীবে জুটে না। বেগম জুবায়দার মেহেরবানী, আঙুর-ও জুটছে।

তরুণী : শুধু আঙুর? আর কিছু না?

যুবক : সেই মেওয়া—

উভয়ের হাস্যধ্বনি আর কামরার ভেতরে আবদ্ধ থাকে না। এই প্রাণ হাসি শুধু এই মুহূর্তে পাওয়া যায়–হৃদয় যেখানে হৃদয়ের বার্তা উপলব্ধি করে, সান্নিধ্যের ব্যগ্রতায় নিজের অস্তিত্ব আর আলাদা রাখতে নারাজ। বাতাস হয়ত লোভেই ছুটে আসে তার তরঙ্গে নতুন সুর জুড়ে দিতে। বাতাসকে এখানে আমন্ত্রণ দিতে হয় না।

যুবক : মেহেরজান, আগে এই মেওয়া দাও। তারপর তোমার মেওয়া দিও।

তরুণী : আবার চেষ্টা করো।

যুবক : না। আমি এই মুখ গুঁজে শুয়ে পড়লাম।

তরুণী : আহা, রাগ করো না। আজ আমিও সবুর করতে পারব না। ভয় হয়। খলিফার কানে গেলে—

যুবক : ভেবে লাভ নেই, মেহেরজান। বেগম সাহেবা যখন আমাদের আশ্রয় দিয়েছেন, আমি আর ডরাই না।

তরুণী: এসো, আঙুর খাও। আমি ত তোমার জন্যে আনি। বেগম সাহেবা আমাকে রোজ অনেক কিছু খাওয়ান।

যুবক : মেহেরজান, তুমি ভারী সুন্দর, তোমার কথার মতই সুন্দর। বিধাতা তোমাকে ঝুটো করেই দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন।

তরুণী: ঝুটো?

যুবক : বিধাতা ত সব জানেন। তোমার ভূত-ভিবষ্যৎ। এই আঠারো বছরে তুমি কি দাঁড়াবে তা ত তিনি জানতেন। সেই কল্পনার মূর্তিতে তিনি কি তোমার ঠোঁট আস্ত রেখেছেন, মেহেরজান?

তরুণী : তিনি কি করেছেন জানি না, তুমি ত—

আবার সেই উতরোল হাসি ওঠে এই জীর্ণগৃহের মধ্যে। ফিরদৌস (বেহেশতের নাম) ত দূরে নয়। বুকের কপাট খুললে যে হাওয়া বেরোয় তারই স্নিগ্ধতা আর শীতলতা দিয়েই বেহেশ্‌ত তৈরী। আজকের হাসি সহজে থামা জানে না। লয়ান্তরের মত তারি মধ্যে তরুণী মুখের কথা ছড়িয়ে যায়।

তরুণী : বিধাতার উপর খালি চুম্বনের অপবাদ কেন? রসিক কী সেখানেই শুধু থেমে থাকতে পারে?

যুবক : আহ মেহেরজান—

যুবক আর দিওয়ানে শুয়ে থাকে না। ধড়মড় উঠে পড়েই সে তরুণীকে জড়িয়ে ধরে বুকের মধ্যে। তারপর বিধাতার উপর যে অপবাদ দিয়েছিল সে তারই অভিনয় শুরু করে। চারি চক্ষুর মিলন, বহু শতাব্দীর প্রবাদ। ঠোঁটের কথা কেন কেউ কোনদিন উল্লেখ করে নি?

যুবক : (ফিস্‌ফিস্ কন্ঠে) তোমার বুকের মেওয়া কি কম মধুময়, মেহেরজান।

তরুণী : তুমি যে কতদিনের দুর্ভিক্ষে উপবাসী। খালি খাওয়া ছাড়া আর কোন কথাই নেই মুখে।

যুবক : উপবাসী, অনাহারী। নিশ্চয়ই তোমার মত ইফতারীর জন্য আমি সারা জন্ম উপবাসী থাকতে রাজী। কিন্তু আর কথা বলব না।

তরুণী : তুমি আমার সদরিয়া, কাঁচুলী খুলছ কেন? তোমার দুই হাত আমি ভেঙে দেব। খাওয়া ছেড়ে এবার চাওয়া ধরেছ।

যুবক : মেহেরজান, তুমি সত্যি, সত্যি মেহেরজান। প্রাণে করুণা ঢেলে দিতে পারো।

তরুণী : আমার খোলা সীনায় তোমার ঠোঁট তাতারী। আগে আমার ঠোঁটে ছিল তোমার ঠোঁট। তোমার অধঃপতন ঘটছে, ক্রমশঃ নীচের দিকে নামছে। কোথায় গিয়ে যে থাম্‌বে–যাও।

কৃত্রিম ক্রোধ ও হাসির যুগল-ডানায় সওয়ার মেহেরজান। বাহুপাশ ছাড়িয়ে, দিওয়ানের পাশে দাঁড়ায়। সমস্ত শরীর নগ্ন। পরনে শুধু ঘাগরা।

তাতারীও সামনে এসে দাঁড়িয়ে তরুণীর চোখের দিকে তাকায়। নিস্তব্ধ মুহূর্ত। তারপর মেহেরজানের ঘাড়ে হাত দিয়ে সে-ও হাসতে থাকে। দুইজনে হাসে। যেন স্মৃতির রোমন্থন লীলায় দু’জন ভেসে যাচ্ছে। এই সুখ-সমুদ্রের প্রবাহ অনন্তকালের রেখায় হয়ত মিশে গেছে। কবে? তারা কেউ জানে না।

হঠাৎ কিছুক্ষণ পরে যেন উভয়ের সম্বিত ফিরে আসে। হাব্‌সী যুবক মেহেরজানকে বুকে জড়িয়ে শূন্যে তুলে নিয়ে এসে আলতোভাবে দিওয়ানে রাখলে। তারপর বাতি নিভিয়ে দিল।

অন্ধকারে দুই জনে অনেকক্ষণ হাসতে থাকে। কেন? সে তারা-ই ভাল জানে, আর জানে বিধাতা। প্রেমিক-প্রেমিকার কুহর শুনেছো কোন দিন? না শুনে থাকো, লেখক তোমাকে আর কিছু বোঝাতে পারবে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *