২২. উক্ষতারণ, ১৯৭৩-১৯৯৩

উক্ষতারণ, ১৯৭৩-১৯৯৩

হাড় কাঁপানো শীত আর স্যাঁতসেঁতে বৃষ্টির এক রাত্রে পালম হাওয়াই আজ্ঞা থেকে ইংল্যান্ড রওনা হলাম। দিল্লি আমাকে কোনওদিনই আকর্ষণ করেনি। সুতরাং ওই শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছি একথা ভেবে কোনও দুঃখবোধ হচ্ছিল না। বরং গত দু’বছরের কথা স্মরণ করে একটা নিষ্কৃতির অনুভূতি হওয়ারই কথা। নিষ্কৃতি, অতএব এক ধরনের শাস্তি বা আনন্দবোধ হবে আশা করেছিলাম। কিন্তু শরীর-মন ক্লান্তি আর অবসাদে আচ্ছন্ন হয়েছিল। আর কিছু প্রিয়জনের সঙ্গে সম্পর্কটা আলগা হয়ে যাবে ভেবেও একটু বিষণ্ণ লাগছিল। বাচ্চাদের সঙ্গে আমার সহজেই দোস্তি জমে। চামু শ্রীনিবাসের দুই কন্যা, বয়স যথাক্রমে এগারো এবং সাত, তারা আমার প্রতিবেশী এবং বিশেষ বন্ধু। আবার যতদিনে দেখা হবে ওরা বোধ হয় তখন দুরের মানুষ হয়ে যাবে। রওনা হওয়ার ঘণ্টা দুয়েক আগে ফোনে খবর পেলাম—আঁদ্রের প্রথম সন্তান একটি কন্যা জন্মগ্রহণ করেছে। ভাবলাম—এই নবাগতা মানুষটির সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ পরিচয়ের কোনও সম্ভাবনা রইল না। আরও মনে হল—ছেড়ে যাচ্ছি তো শুধু দিল্লি না, নিজের দেশ। তথাকথিত বন্ধুটি হিসেবে ভুল করেছিলেন। এই দেশের জীবনে আমার শিকড় বড় বেশি গভীরে চলে গেছে। তা উৎপাটন করে কাঙিক্ষত জীবনে তাঁবু পাতা বেদনাহীন হবে, এমন কথা আমি কী করে ভেবেছিলাম!

হিথরো পৌঁছে ইমিগ্রেশনে যে অভ্যর্থনা পেলাম তাতে মনটা আরও দমে গেল। যে কর্মচারীটি আমাদের ইংল্যান্ড প্রবেশের দ্বার মুক্ত করবেন, বুঝলাম তিনি আমাদের কাগজপত্র দেখে রীতিমতো বিরক্ত। মনে হল—আরও একটা অশ্বেত পরিবার তাঁর পুণ্য জন্মভূমিতে বাস করতে আসছে এতে উনি মোটেই খুশি না। তিনি আমাদের হেনস্থা করবার অজুহাত খুঁজতে লাগলেন।

বিলেতে চাকরি নিয়ে দীর্ঘদিন বাস করার ব্যাপারে একটা পরম্পরবিরোধী নিয়ম ছিল। হাইকমিশনের নিযুক্ত ডাক্তার কর্মপ্রার্থীর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে একটা রিপোর্ট সিল করে তার সঙ্গে দিয়ে দেন। তারই কপি দেখে হাইকমিশন ইংল্যান্ডবাসের অনুমতি দেন। সিল করা রিপোর্টটি ইমিগ্রেশন অফিসারকে দিতে হয়। কিন্তু যিনি চাকরি করতে যাচ্ছেন তাঁর পরিবারস্থ লোকের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয় না। তাঁদের ক্ষেত্রে কী বিধেয় তা ইমিগ্রেশন অফিসারের উপর ছেড়ে দেওয়া হয়। আমাদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা আরও বিদঘুঁটে দাঁড়িয়েছিল। আমার কন্যার জন্ম ইংল্যান্ডে। সুতরাং সে কার্যত ইংল্যান্ডের নাগরিক। তার ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য পরীক্ষার কোনও প্রশ্ন ওঠে না। ইমিগ্রেশন অফিসারটি বেশ দাঁত কিড়মিড় করে স্বগতোক্তি করলেন, আই ক্যান ডু নাথিং অ্যাবাউট হার। বাট ইওর ওয়াইফ উইল হ্যাভ টু হ্যাভ এ হেলথ এক্সামিনেশন বিফোর আই অ্যাল্যাউ ইউ টু এনটার ব্রিটেন।তখন রাত সাড়ে দশটা বাজে। আমার এগারো বছরের কন্যা ক্লান্তিতে প্রায় অবসন্ন। ও কাঁদতে শুরু করল। অফিসার আরও দাঁত কিড়মিড় করে বললেন, স্টপ হার। প্লিজ-টিজের কোনও বালাই নেই। আমি বললাম, ইউ ট্রাই অ্যান্ড ডু দ্যাট।আমাদের হাওয়াই আড্ডার ডাক্তারের কাছে। পাঠানো হল। ভদ্রলোক অত্যন্ত বিব্রত, কারণ ব্যাপারটা কী হচ্ছে তা তাঁর বুঝতে বাকি থাকেনি। তিনি নামমাত্র পরীক্ষা করে আমাদের ছেড়ে দিলেন। কিন্তু ততক্ষণে রাত বারোটা বেজে গেছে। পরমেশ রায় আমাদের নিতে এসেছিল। সে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে ফিরে গেছে। একটা ট্যাক্সি ধরে অক্সফোর্ড পৌঁছলাম।

পৌঁছে যে অবস্থার সম্মুখীন হতে হল তাতে সত্যিই দমে গেলাম। কলেজ আমার জন্য যে ফ্ল্যাটের ব্যবস্থা করেছে তাতে দুটি ছোট ছোট শোওয়ার ঘর আর একটি বসবার, খাওয়ার ঘর। জানুয়ারি মাসের শীত। ফ্ল্যাটটিতে হিটিং চালিয়ে রাখা হয়নি। ফলে সব কিছু বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে আছে। ভাবলাম দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ-সাতটি নিমগাছ আর মস্ত বড় বাগানওয়ালা দোতলা বাড়ি ছেড়ে এই ফ্ল্যাটে থাকবার জন্য আমি অক্সফোর্ডে চাকরি নিয়ে এসেছি। এর চেয়ে তো ছাত্রাবস্থায়ও এখানে ভাল থেকেছি। রাতে ভাল ঘুম হল না। পরদিন কলেজ গিয়েও যে অভ্যর্থনা পেলাম তাকে ঠিক উষ্ণ বলা চলে না। মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়ে আমার ধারণা হয়েছিল যে নতুন কাজ নিয়ে যারা আসে সবাইয়ের সঙ্গে তাদের পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য ছোটখাটো একটা পার্টির ব্যবস্থা হয়। এমনকী স্কুল অফ ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজেও ফিলিপস সাহেব আমাদের পরিচয় করিয়ে দিতে ককটেল পার্টির ব্যবস্থা করেছিলেন। এখানে দেখি নবাগতর অস্তিত্ব যথাসম্ভব ভুলে থাকাই স্থানীয় সামাজিকতার প্রধান লক্ষণ। আমি ধরে নিলাম—কোনও অজ্ঞাত কারণে আমার সহকর্মীরা আমাকে দেখতে পাচ্ছেন না। বোধ হয় আমার অজান্তে আমি অদৃশ্য মানুষ হয়ে গিয়েছি।

যা হোক, প্রথমে কলেজের যাবতীয় ঐহিক ব্যাপারের ব্যবস্থাপক বারসারের সঙ্গে দেখা করে বললাম, ওই ফ্ল্যাটে থাকা আমার চলবে না। অন্যতম কারণ, শিগগিরই আমার মা-বাবা আসবেন। অতএব অন্যতর ব্যবস্থা অত্যাবশ্যক। কর্তা বললেন—চিন্তা করো না। ব্যবস্থা হবে। তারপর কলেজের অধিনায়ক অর্থাৎ ওয়ার্ডেন রেমন্ড কারের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। স্পেনের ইতিহাস বিশেষজ্ঞ বিরাট পণ্ডিত এই মানুষটির উৎকেন্দ্রিক বলে খ্যাতি ছিল। শোনা যায় একবার সুইডেনে বেড়াতে গিয়ে ওঁর টাকাপয়সা সব ফুরিয়ে যাওয়ায় ভদ্রলোক এক রেস্টুরেন্টে ওয়েটারের কাজ নিয়েছিলেন। তখন উনি নিউ কলেজের ফেলল। হাতে তোয়ালে ঝুলিয়ে কার সাহেব খাদ্য পরিবেশনে ব্যস্ত। হঠাৎ দেখেন অক্সফোর্ডের এক সহকর্মী এক টেবিলে বসে খাচ্ছেন। তোয়ালেটি মুখে জড়িয়ে উনি রান্নাঘরে আশ্রয় নেন। তবে ক্ষতি যা হওয়ার তা ততক্ষণে হয়ে গেছে। মানে ওঁর এই শ্রমিক জীবনের খবর অক্সফোর্ডে রাষ্ট্র হয়ে গেল। কেউ যে তাতে খুব অবাক হল এমন না।

কার সাহেব প্রথম সাক্ষাতেই আমাকে জিগ্যেস করলেন, আমরা না এলে তোমাদের কী হত মনে হয়? আমি গ্লাডস্টোনের এক বিখ্যাত উক্তির অনুকরণে বললাম, যদি এখনই এই প্রশ্নের উত্তর চাও তো গোটা পঞ্চাশেক সম্ভাবনার কথা বলতে হবে। একদিন সময় পেলে সংখ্যাটা গোটা দশেকে নামাতে পারি। আলোচনা এর বেশি আর এগোয়নি।

সি. এস. লুইসের মার্কিন পত্নীকে অক্সফোর্ড কেমন লাগছে প্রশ্ন করায় ভদ্রমহিলা উত্তর দিয়েছিলেন, বড্ড ঠান্ডা। আর কথাটা আবহাওয়া সম্পর্কেও সত্যি। ওখানে পড়াতে এসে নৈসর্গিক আবহাওয়ার তুলনায় মানবিক পরিবেশ অনেক বেশি শীতল মনে হচ্ছিল। ভাবলাম—এ কোথায় আইয়া পড়লাম? দিন তিনেক রোজ কলেজে লাঞ্চ খাচ্ছি। কেউ কোনও কথাবার্তা বলে না। তারপর হঠাৎ একজন সহকর্মী আমার উপস্থিতি সম্বন্ধে সচেতন হলেন। ইউ আর রায়চৌধুরী? নো? উত্তর দিলাম, ইনডিড ইয়েস। মনে মনে বললাম–আমার আবির্ভাব যে তোমার নজরে পড়েছে এ জন্য আমার ঊর্ধ্বতন চোদ্দো পুরুষ তোমার কাছে কৃতজ্ঞতাপাশে বদ্ধ। ক্রমে অবস্থার কিছু উন্নতি হল। গভর্নিং বডির মিটিংয়ে ওয়ার্ডেন আলতোভাবে আমার আগমন ঘোষণা করলেন। দু-একজন আমার দিকে তাকিয়ে সম্ভাষণ বাবদ স্মিত হাস্য করলেন। তারপর ক্রমে ক্রমে কর্মসূত্রে অনেকের সঙ্গেই পরিচয় হল।

ইতিমধ্যে বিপদ ঘনাল অন্য এক দিক থেকে এক দিন ঘুম থেকে উঠে কন্যা বললেন, এখানকার ইস্কুলে ওর দম বন্ধ হয়ে আসছে। শুধুমাত্র মেয়েদের জন্য একটি পাবলিক স্কুলে ডে স্কলার হিসেবে ওকে ভর্তি করেছি। ব্রিটেনে সরকারি স্কুলে ছাত্রছাত্রীরা বিনা মাইনেয় পড়ে। পাবলিক আর গ্রামার স্কুলগুলিতে মাইনে দিয়ে পড়তে হয়। আমার মেয়ে যে স্কুলে পড়ছিল সেখানে অনেক ছাত্রী স্কুলের বোর্ডিংয়েই থাকে। তবে আমার মেয়ের মতো বেশ কিছু ছাত্রী আবার বাড়িতে থেকেও স্কুলে যাওয়াআসা করে। আমার মেয়ের বিদেশে স্কুলে পড়তে গিয়ে কালচার শক হবে এটা আমি আশা করিনি। কারণ এর আগে আমেরিকা এবং অস্ট্রেলিয়ায় খুব খুশি হয়েই ও স্কুলে গিয়েছে। ওর বক্তব্য—এখানকার মেয়েরা যেন কেমন। তারা ওকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করে। একেবারেই ফ্রেন্ডলি না। একজন জিগ্যেস করেছে–ওর বাবা বাস চালায়, না কারি শপে রান্না করে। বালিকাটি এক রিজিয়াস প্রফেসরের কন্যা। আমি বললাম–ওর দুশ্চিন্তার কোনও কারণ নেই। ওর ভাল না লাগলে অন্য স্কুলের খোঁজ করব। সেখানেও যদি না পোষায় তো কথা দিচ্ছি, দেশে ফিরে যাব। সৌভাগ্যক্রমে এই রকম এসপার-ওসপার কিছু করার শেষ পর্যন্ত কোনও প্রয়োজন হয়নি। সপ্তাহখানেক পর মেয়ে জানাল–ঠিক আছে। কিন্তু সত্যিতে ওই স্কুলে ও খুশি ছিল না। পরে ষোলো বছর বয়সে অন্য আর একটি স্কুলে গিয়ে ও বাঞ্ছনীয় পরিবেশ খুঁজে পায়।

অক্সফোর্ডে পড়াতে গিয়ে আমি যা আশা করেছিলাম তা কি পেয়েছিলাম? এক কথায় এ প্রশ্নের উত্তর, হাঁ। তার প্রথম কারণটা নেতিবাচক। দিল্লির ইতিহাস বিভাগের শাসরোধকারী অভিজ্ঞতা থেকে মুক্তি পেয়ে আমি যদি পশ্চিমবঙ্গের কোনও মফস্বল কলেজেও পড়াতে যেতাম, তাহলেও বুক ভরে নিশ্বাস নিতে পারার অভিজ্ঞতাটাই যথেষ্ট সুখের কারণ মনে হত। এখানে প্রশাসনিক দায়িত্ব থেকে ছাড়া পাওয়াটা বিশেষ আনন্দদায়ক মনে হয়েছিল। যেটা জানা ছিল না, তা হচ্ছে অক্সফোর্ডের কমিটি প্রথা। যে-কোনও দায়িত্বপূর্ণ ব্যাপারেই সিদ্ধান্তগুলি কোনও না কোনও কমিটির হাতে। আমিও গিয়েই দেখি আমি গোটা দশেক কমিটির সভ্য। এতে কিছুটা সময় নষ্ট হত ঠিকই, কিন্তু ইংরেজরা কোনও ব্যাপারেই অকারণে বাক্যব্যয় করে না, সুতরাং কমিটির কাজ যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি হয়ে যেত। আর আমি প্রথমেই ঠিক করে নিই যে প্রশাসনিক ব্যাপারে অকারণ উৎসাহ দেখাব না। ফলে অতিরিক্ত দায়িত্ব আমার ঘাড়ে চাপানো হয়নি। একটা ব্যাপার অত্যন্ত একঘেয়ে লাগতকলেজে গভর্নিং বডির মিটিং। দু ঘণ্টা-আড়াই ঘণ্টাব্যাপী এই পাক্ষিক মিটিংয়ে নানা খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে আলোচনা হত। ঘরের কাঁচের দেওয়ালের ওপারে বাগান দেখা যেত। মিটিংয়ের সময়টা আমি প্রকৃতির পূজায় কাটাতাম।

শুধু একটি দিন গভর্নিং বডির মিটিং সত্যিই উপভোগ করেছিলাম। যখন কলেজের সব শিক্ষক বা ফেলোরাই পুরুষ, তখন প্রতি টার্মে একটা সন্ধ্যা লেডিস নাইট হিসাবে উদ্যাপিত হত। সেই দিনকার সান্ধ্যভোজনে ফেলোরা তাঁদের স্ত্রীদের নিয়ে আসতেন–কলেজেরই খরচায়। একটি মহিলা কলেজের ফেলো নির্বাচিত হওয়ায় এ ব্যবস্থার পরিবর্তন দরকার হয়ে পড়ল। আমন্ত্রণপত্রে কী লেখা হবে? ‘লেডিস নাইট’ তো আর লেখা যাবে না। প্রস্তাব হল সে জায়গায় ফেলোস অ্যান্ড দেয়ার স্পাউসেস লেখা থোক। বারসার একটু গলা ঝেড়ে বললেন উহঁই, ওটা চলবে না। স্পাউস অর্থ বিবাহিত/বিবাহিতা সঙ্গী/সঙ্গিনী। সব ফেলোরা বিবাহসংস্কারে বিশ্বাস করেন না। আর এ যুগে অবিবাহিত/অবিবাহিতা সঙ্গী। সঙ্গিনীদের বাদ দেওয়া চলবে না। এক ফেলো প্রস্তাব করলেন, তা হলে ফেলোস অ্যান্ড বেড ফেলোস লেখা হোক। তাহলে আর আপত্তির কিছু থাকবে না। আবার বারসারের গলাখাঁকারি। ওয়ার্ডে বিরক্ত। আবার কী হল? বারসার বললেন, কোনও কোনও ফেলোর বেড ফেলো একাধিক। খরচে পোষাতে পারব না। সিদ্ধান্ত হল ‘ফেলো অ্যান্ড ওয়ান ফ্রেন্ড’-কে নেমন্তন্ন করা হবে। হ্যাঙ্গাম চুকে গেল। শুধু ওয়ার্ডেন অধস্ফুট কণ্ঠে তাঁর সন্দেহ প্রকাশ করলেন। কেউ আবার রাস্তা থেকে ফ্রেন্ড তুলে নিয়ে না আসে।

মানুষে মানুষে সম্পর্কে উষ্ণতার অভাব যদি ইংরেজদের সামাজিক জীবনের নেতিবাচক দিক হয়, তবে তার কষ্টটা পুষিয়ে দেয় ওদের সুসভ্য ভদ্রতা। গভর্নিং বডির মিটিংয়ে অন্তঃসলিলা বিরোধের আভাস প্রায়ই পেতাম, কিন্তু কখনও কাউকে কণ্ঠস্বর এক ডেসিবেলও উঁচুতে তুলতে শুনিনি। একটু উষ্মর স্বর শুনলেই ওয়ার্ডেন সাবধানবাণী শোনাতেন, নাউ নাউ, লেট আস কিপ অন অ্যান ইভ কিল। আমার দিল্লির অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলের প্রচণ্ড চেঁচামেচি স্মরণ হত। আর যেখানে অন্তরঙ্গতার সম্ভাবনা নেই, সেখানে ইংরেজরা সহজভাবে মিশতে কোনও দ্বিধা করে না। আমার ধারণা হয়েছে ওরা অন্তরঙ্গতা, নিজেকে অন্যর সামনে মেলে ধরা সম্বন্ধে একটা গভীর লজ্জা বা ভয় পোষণ করে। একটা গণ্ডির ভিতরে থেকে হাত বাড়িয়ে মনোমতো মানুষের সঙ্গে করমর্দন করতে ওদের দ্বিধা নেই। এবং ওই সীমিত সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য আদর্শ পরিবেশ জোগায় কলেজ যা সামাজিক সংস্কৃতির দিক থেকে ওদের ক্লাবেরই সমগোত্রীয়।

আমি পেটুক মানুষ। কলেজের হাই টেবিলের খানা আমার অনাবিল আনন্দের কারণ হয়ে দাঁড়াল। সারা পৃথিবীতে একটা ভুল ধারণা আছে যে ইংরেজদের খাওয়া নিতান্তই অখাদ্য। আসলে কিছুদিন আগে অবধি মধ্যবিত্ত ইংরেজ কী খাচ্ছে এ নিয়ে মাথা ঘামাত না। সে সংস্কৃতি এখন সম্পূর্ণ বদলে গেছে। লন্ডনের যে পাড়ায় আমার মেয়ে থাকত সেই ইসলিংটনে ঊনচল্লিশটি দেশের খাবার রেস্টুরেন্ট এবং ডেলিকাটেসেনে পাওয়া যায়। আর তার প্রভাব ইংরেজদের রান্নায়ও পড়েছে। নানান সস আর বিজাতীয় সব তরিতরকারি পরিগ্রহণ করে মডার্ন ব্রিটিশ কুইজিন পৃথিবীর সেরা রন্ধনশৈলীগুলির একটি বলে পরিগণিত হয়েছে। কিন্তু আমি তার কথা বলছি না। ওই দেশে শ্রমিকশ্রেণি যে ব্যাঙ্গার আর ম্যাশ অর্থাৎ সসেজ এবং আলুভর্তা বা ফিশ অ্যান্ড চিপস খায়, দৈনন্দিন খাদ্যের ভিতরে স্বাদে তার সঙ্গে তুলনা হয় পৃথিবীর অন্যত্র এরকম খাওয়ার কমই খেয়েছি। পাঁচ মহাদেশে নানা খাদ্য-অখাদ্য নির্বিচারে খেয়ে ভেবেচিন্তেই একথা বলছি। আর অপেক্ষাকৃত অবস্থাপন্ন ঘরে, ফার্ম হাউসে এবং গ্রামাঞ্চলের পাব বা গুঁড়িখানায় পুদিনার সস সহ কচি ভেড়ার রোস্ট বা নোন ইয়র্কশায়ার পুডিংয়ের সঙ্গে রোস্ট বিফ, নানা রকমের সুপ আর পুডিং রসনায় সত্যিই স্বর্গের স্বাদ বয়ে আনে। এগুলি খাঁটি ইংরেজি খানা। আসলে অস্তমিত সাম্রাজ্য ছাড়া আর কোনও কিছু নিয়েই ইংরেজরা নিজেদের মাহাত্ম বিষয়ে ঢাক বাজাতে গররাজি। আত্মপ্রচার ওদের সংস্কৃতির অঙ্গ নয়। (নিজেরা নিজের ঢাক পেটায় না বলে ওরা আত্মপ্রচারের সংস্কৃতিটা একেবারেই বুঝতে পারে না। চোর ধাউর না এরকম কোনও লোক যদি নিজ মাহাত্ম প্রচার করে তো বেশির ভাগ ভদ্র ইংরেজ তার কথাগুলি আক্ষরিক অর্থে সত্যি বলেই গ্রহণ করেন। এক ব্যক্তি ঘোষণা করলেন–ভারতবর্ষের লোকসভায় বোজ তাঁকে গালিগালাজ করা হয়। সহানুভূতিতে বিগলিত রিচার্ড গমব্রিজ মন্তব্য করলেন, আহা, বেচারার কী কষ্ট।আমি বললাম—দ্যাখো, ভারতবর্ষে একশো কোটির উপরে লোক। ওঁকে গাল দেওয়া ছাড়া লোকসভার আরও দু-একটা কাজ থাকে। আর এক ব্যক্তি আত্মপ্রচারটাকে আত্মপ্রতিষ্ঠার প্রধান আয়ুধ হিসাবে ব্যবহার করে প্রচুর ফায়দা উঠিয়েছিলেন। ব্রিটেনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অসাধারণ। কিন্তু তার সদ্ব্যবহার করে ট্যুরিজম বাড়াতে ওরা দ্বিধাগ্রস্ত। ভিড়ভাড়ে অরুচি তার একটা কারণ, কিন্তু একমাত্র কারণ না। অনুরূপকারণেই ইংরেজি রান্নার মাহাত্ম্য পৃথিবীর মানুষের চেতনাগোচর হয়নি। অন্য কারণও আছে। ব্রিটিশ রেল যে খাদ্য পরিবেশন করে তা খাওয়ার চেয়ে বর্ষাধিক কাল গুয়ান্টানামোর কারাগারে বাস করা বাঞ্ছনীয়। আর বেশির ভাগ ইস্কুল-কলেজের ক্যান্টিনে, সস্তা হোটেলে যে অযত্ন করে রাঁধা আহার্য পরিবেশন করা হয় সে বস্তুই ব্রিটিশ রন্ধনশৈলীর জগদ্ব্যাপী দুর্নামের কারণ। হলফ করে বলতে পারি ব্রিটিশ রেলে যে স্যান্ডউইচ পাওয়া যায় তার চেয়ে অখাদ্য রৌরব নরকেও পাওয়া দুষ্কর। অবশ্যি ও জায়গাটা ঘুরে এসে একথা বলছি না।

কিন্তু কলেজে হাই টেবিলে খাওয়া সত্যিই অন্য এক অভিজ্ঞতা। ব্যাপারটা যাঁদের অপরিচিত তাঁদের জ্ঞাতার্থে একটু ব্যাখ্যা করি। অক্সব্রিজের কলেজে মধ্যযুগ থেকে সে কালের মঠ বা মনাস্টারির মতো সব আবাসিক অর্থাৎ কলেজের ক্ষেত্রে শিক্ষক এবং ছাত্ররা এক সঙ্গে খাওয়াদাওয়া করে। পুরনো কলেজগুলিতে একটা উঁচু পাটাতনের উপর মাস্টারদের টেবিল পাতা থাকে। আক্ষরিক অর্থে উঁচু বলেই হাই টেবিল। অপেক্ষাকৃত আধুনিক কলেজগুলিতে হাই টেবিল পাটাতনের উপর থাকে না, খাওয়ার ঘরেরই এক দিকে শিক্ষকদের আলাদা বসার ব্যবস্থা। একটু বেশি গণতান্ত্রিক কলেজগুলিতে, যেমন সেন্ট অ্যান্টনিজ, সপ্তাহে পাঁচ দিন দু’বেলাই ছাত্র-শিক্ষক সবাই এক সঙ্গে বসে খায়। কিন্তু সপ্তাহে দুদিন আনুষ্ঠানিকভাবে রাত্রে ঘরের এক দিকে মাস্টারদের টেবিল পাতা হয়। সেখানে বেশ এলাহিভাবেই চব্য-চোষ্য-লেহ্য-পেয়র ব্যবস্থা থাকে। এটাই আমাদের হাই টেবিল। চার পদ আহার্যের সঙ্গে লাল-সাদা দুরকম মদ্য থাকে, এবং তা বেশ উঁচু জাতের। তাছাড়া খাওয়ার আগে কিঞ্চিৎ শেরি বা হুইস্কি, আহারান্তে নীচতলায় শিক্ষকদের জন্য নির্দিষ্ট বিশেষ ঘরটিতে সুমিষ্ট মদ্য এবং তৎসহ নানা ফল এবং চিজ গলাধঃকরণ করা হয়। অতি সভ্য, অতি মার্জিত আনন্দসন্ধ্যা কাটাবার ব্যবস্থা। আনন্দটা অনাবিলই হয়। কারণ আমাদের পাচকটি অতি পাকা রাঁধুনি।

এতটা আনন্দ এবং মদ্যপান ইংরেজেরও ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে চলার সংস্কৃতিতে ফাটল ধরায়। কণ্ঠস্বর কিঞ্চিৎ জড়িয়ে আসে। হৃদয়ের গভীর থেকে অন্তরঙ্গ কথা সব জিহ্বাগ্রে পৌঁছয়। কেউ কেউ নর্মজীবনের উত্তেজক সব কাহিনি বলতে শুরু করেন। এই মুক্ত খোলামেলা আবহাওয়ায় বন্ধুত্বের শিলান্যাস হয়। পেটে একটু কারণবারি না পড়লে ইংরেজ স্বাভাবিক মানুষের মতো ব্যবহার করতে পারে না। সব মানুষের ধমনীতে যেমন একই লাল রক্ত, তেমনই দেব ডাইওনিসিয়াসের রাজত্বে মনুর সন্তান মাত্রেই দ্বিধামুক্ত, তাদের চিত্ত অবারিতদ্বার। তবে চিত্ত যখন ভয়শূন্য হয়, তখন মস্তিষ্কের ক্রিয়ায় অল্পস্বল্প বেচাল দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা ঘটে। তাই কলেজগুলিতে গেস্ট নাইট যেদিন থাকে, বিশেষত শুক্রবারগুলিতে, পুলিশের গাড়ি তখন আশেপাশে ঘুরে বেড়ায়। গাড়ি চালানোর ব্যাপারে পণ্ডিতবৃন্দ কোনও বেচাল করলে তখনই ক্যাঁক করে চেপে ধরে। আমাদের এক রীতিমতো বিখ্যাত সহকর্মী সেদিন সকালেই জেনেভা থেকে ফিরেছেন। আহারান্তে ব্রিটিশ আইন সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করে উনি রাস্তার ডান দিক দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছিলেন। পুলিশ ওঁকে সাদরে নিজেদের ব্ল্যাক মারিয়ায় তুলল। অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে পণ্ডিতপ্রবর বিশুদ্ধ ফরাসি ভাষায় বললেন, তোমাদের কি বুদ্ধিনাশ ঘটেছে? জেনেভা শহরে গাড়ি কি আমি রাস্তার বাঁদিক দিয়ে চালাব? পুলিশ ফরাসি বুঝল না। কিন্তু মহাশয়ের রক্তস্রোতে যে কোহলের আধিক্য ঘটেছে সে কথা বুঝতে কোনও অভিধানের শরণাপন্ন হতে হল না। ভদ্রলোক তেরো বছরের জন্য তাঁর লাইসেন্স হারালেন। হাই টেবিলে আহারান্তে মিঠে মদ খেতে খেতে জাপানের ঐতিহাসিক রিচার্ড স্টোরির রক্ষণশীল জীবনদর্শন, আফ্রিকার ইতিহাস-বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক রবিনসনের জীবনের বিচিত্র নর্মকাহিনি ইত্যাদি নানা চমকপ্রদ আখ্যান আমার চেতনাগোচর হয়।

রিচার্ড স্টোরি একদিন আমার কাছে তাঁর জীবনদর্শন সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করলেন। হোয়েনেভার ইট ইস নট নেসেসারি টু চেঞ্জ, ইট ইস নেসেসারি নট টু চেঞ্জ। যেখানে পরিবর্তনের কোনও প্রয়োজন নেই, সেখানে পরিবর্তন যাতে না হয় সেটা দেখাই প্রয়োজন। অক্সফোর্ডে এক দেওয়ালের গায়ে দীর্ঘদিন ধরে এক গ্রাফিটি অর্থাৎ দেওয়াললিপি আছে। তার কেন্দ্রে এক বৃহদাকার ডাইনোসরের রেখাচিত্র। নীচে সংক্ষিপ্ত মন্তব্য : রিমেম্বার দা ডাইনোসর। ডাইনোসরকে স্মরণ রেখো। অর্থাৎ হে পরিবর্তনবিমুখ স্থাণু অক্সফোর্ড, ডাইনোসরের কী হাল হয়েছিল তা ভুলো না। আমি সে দিকে রিচার্ডের দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম। এবার রিচার্ড সত্যি চটে গেলেন। ডাইনোসর? ডাইনোসর!! তোমার কি ধারণা প্রজাতি হিসাবে তাদের কাছ থেকে শেখার কিছু নেই? সর্ববিধ পরিবর্তন বর্জন করে তারা ধরাপৃষ্ঠে ষোলো কোটি বছর দাপিয়ে রাজত্ব করেছে। আর তোমার তথাকথিত হোমো স্যাপিয়াঁ? বিশ লক্ষ বছরও হয়নি। নানা বাঁদরামি করে নিজের দোষেই এখন ধুকতে শুরু করেছে। আর এক শতাব্দী টেকে কি না সন্দেহ। একটা বাজি রাখবে? ষোলো কোটি বছর পরে আমার সঙ্গে এসে দেখা কোরো। দেখব তখনও তোমার অবক্ষয়প্রবণ প্রজাতি টিকে আছে কি না? শিম্পাঞ্জির মাসতুতো ভাই এই ক্ষীয়মাণ প্রজাতি যে বিচিত্র বাঁদরামির ফলে আর বেশি দিন টিকবে না সে বিষয়ে আমারও সন্দেহ নেই। তবে ষোলো কোটি বছর পরে এই বন্ধু-সাক্ষাৎকারের প্রস্তাব আমি সানন্দে গ্রহণ করলাম। স্টোরি স্বর্গলাভ করেছেন। সাক্ষাৎটা কোথায় হবে দুর্ভাগ্যবশত তা বলে যাননি।

হাই টেবিলে নানা ধরনের বিশিষ্ট অতিথি আসেন। সেন্ট অ্যান্টনিস কলেজ পৃথিবীর নানা অঞ্চলে সমকালীন রাজনীতি বিষয়ে পঠন-পাঠনের বিখ্যাত কেন্দ্র। তাই আফ্রিকা থেকে জাপান অবধি আর অন্য দিকে দক্ষিণ আমেরিকা পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলের বহু জ্ঞানীগুণী মানুষ, অনেক ক্ষমতাশালী ব্যক্তি ওখানে সর্বদাই আসাযাওয়া করেন। গেস্ট নাইটের রাতগুলিতে প্রায়ই বিভিন্ন দেশের পতাকা উড়িয়ে রাষ্ট্রপ্রধান, মন্ত্রী বা রাজদূত জাতীয় সব লোকের গাড়ি কলেজ কার পার্কে দেখা যায়। পূর্ব ইউরোপের সোস্যালিস্ট দেশগুলির রাজদূতদের রবরবা দেখতাম অন্য পাঁচটা দেশের তুলনায় একটু বেশি। পুঁজিবাদীদের সমাজতন্ত্রের মাহাত্ম্য বোঝনোর এর চেয়ে উৎকৃষ্ট উপায় আর কী হতে পারে?

বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন চ্যান্সেলর ম্যাকমিলান কলেজে প্রায়ই আসতেন। ওঁর বয়স তখন নব্বইয়ের ওপরে। উনি মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে উঠে বক্তৃতা করতেন। কলেজের স্টুয়ার্ড ফ্রেডের উপর ওঁর দেখাশোনার ভার। বক্তৃতার সময় ফ্রেড ওঁর পিঠ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকত। উদ্দেশ্য—বৃদ্ধ টাল সামলাতে না পেরে পড়ে গেলে ও তাঁকে সামলাবে। বক্তৃতার সময় ওঁর হাতে একগোছা কাগজ থাকত। তা থেকে পড়ে পড়ে ম্যাকমিলান সাহেব বক্তৃতা করতেন। একদিন ফ্রেড জানাল—কাগজগুলি মসীদ্বারা অস্পর্শিত, মানে একেবারেই সাদা। শুধুমাত্র নাটকীয়তার খাতিরে ভদ্রলোক ওগুলো চোখের সামনে খুলে রাখতেন। ওঁর নাটকীয়তা নানা রূপ নিত। কলেজের সারা বছরের কাজের বৃত্তান্ত দিয়ে ওয়ার্ডেন বক্তৃতা করছেন। তাঁর বক্তৃতার এক বড় অংশ জুড়ে আছে কোন কোন রাজদূত কলেজে পদধুলি দিয়েছেন তার ফর্দ। চ্যান্সেলর সাহেব তাঁর বয়সের সুযোগ নিয়ে টেবিলে মাথা রেখে অকাতরে ঘুমোচ্ছন। বক্তৃতা শেষ হওয়া মাত্র উনি চোখ রগড়ে ঘুম থেকে উঠলেন। তারপর চমকপ্রদ বক্তৃতা। বোঝা গেল উনি মোটেই ঘুমোননি৷ প্রসঙ্গত ম্যাকমিলান বললেন–উনি রাজদূতদের লিস্টি শুনে খুবই চমৎকৃত হয়েছেন। তবে ওয়ার্ডেন এ ব্যাপারে তার পরিশ্রম ইচ্ছে হলে কিছুটা লাঘব করতে পারেন। ওঁদের পারিবারিক প্রকাশনী ম্যাকমিলান থেকে প্রতি বছর একটি বই প্রকাশিত হয়। তার বিষয়বস্তু লন্ডনস্থিত রাজদূত এবং তাদের সহকর্মীদের ফর্দ। অযথা পরিশ্রম না করে তার এক এক কপি শ্রোতাদের দিয়ে দিলে ওয়ার্ডেনেরও পরিশ্রম কমে, ম্যাকমিলান কোম্পানির বিক্রিও একটু বাড়ে।

আগেই বলেছি গেস্ট নাইটে কলেজে বিচিত্র চরিত্রের সব লোক আসতেন। এক সন্ধ্যায় দেখি এক ভুড়িম্মান বিরাটবপু ব্যক্তি একা বসে বসে তার আয়তনের উপযোগী এক সিগার কুঁকছেন। তাকে যে নেমন্তন্ন করেছে সেই সহকর্মীটিকে গিয়ে বললাম, এটা কী হচ্ছে? বেচারাকে একা একা বসিয়ে রেখেছ? সহকর্মী বললেন, অসম্ভব বোরিং। লোকটা সিগার-বেচা টাইকুন। টাকার কুমির। ভেবেছিলাম আমাদের সেন্টারের জন্য যদি সিকিটা আধলাটা দেয়। কিন্তু সে গুড়ে বালি। উপুড়হস্ত হওয়ার কোনও লক্ষণ নেই। তাই বসিয়ে রেখেছি। একটু শিক্ষা হোক। বেচারা বড়লোকটির জন্য কেমন যেন মায়া হল। পাশে গিয়ে বসলাম। ভাগ্যিস বসেছিলাম। এরকম আনন্দদায়ক একটি সন্ধ্যা আমার ভাগ্যে বেশি জোটেনি। সিগারের কথা তুলতেই তার ইতিহাস, ভূগোল, প্রস্তুতশৈলী, গুণবিচার ইত্যাদি চুরোটপুরাণের চব্বিশ তত্ত্ব উনি দেড় ঘণ্টা ধরে বলে গেলেন। মনে হল যেন আরব্য উপন্যাসের কাহিনি শুনছি। কারণ উনি যা বলছেন তার কিছুই আমার পরিচিত জগতের অংশ না। বলুন দেখি সিগারের ভালমন্দ বিচারের প্রধান মানদণ্ড কী? না, তামাকের পাতার আভিজাত্য না, কত টাইট করে সিগারটা মোড়ানো হয়েছে তার উপর সিগারমাহাত্ম্য নির্ভর করে। এই কারণেই সমঝদাররা প্রথমে কানের কাছে নিয়ে দুই আঙুলের মধ্যে সিগারটিকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তার গুণ বিচার করেন। কোনও মচমচ খচখচ যে করে না সেই সিগারোত্তম।

আর একদিন আমার পাশেই বসেছেন ইংরেজি সাহিত্য এবং ইংরেজ সমাজে বিশেষ খ্যাতনামা ব্যক্তি–একদা জন এবং বর্তমানে জ্যান মরিস। ওর পুরুষের দেহে এক নারীসত্তা লুকিয়েছিল। শল্য চিকিৎসকের সাহায্যে উনি অসীম সাহস দেখিয়ে সেই সত্তাকে প্রকাশ করেছেন। ব্যাপারটা বোধ হয় শতকরা একশো ভাগ সফল হয়নি। সেদিন হাই টেবিলে আমার অতিথি ছিলেন নবনীতা। তিনি জ্যান সাক্ষাৎকারের কাহিনি একটি প্রবন্ধে লিখেছিলেন। যদিও লেখাটা বাংলায় ছিল তবুও আমার ধারণা খবরটা শ্ৰীমতী জ্যানের কাছে পৌঁছেছিল এবং শুনে উনি খুব প্রীত হননি। ওঁর পরবর্তী বইটি সেন্ট অ্যান্টনির ফেলোদের হাতে উৎসর্গীকৃত, কিন্তু বাদে একজন। আমার কেমন ধারণা সেই একজন আমি। জ্যান মানুষ হিসেবে অত্যন্ত স্পর্শকাতর। উনি দাবি করেন যে ওঁর লিঙ্গ পরিবর্তনে ওঁর পরিবারস্থ সবারই সানন্দ সম্মতি ছিল এবং আছে। ওঁর ভূতপূর্ব পত্নী ওঁকে ননদের মতো দেখেন। আর সন্তানদের উনি এখন পিসিমা। ওঁর এক ছেলে অক্সফোর্ডের ছাত্র ছিল। সে যে খুব সুখী তা আমাদের মনে হয়নি।

স্টোরি ছাড়া সহকর্মীদের মধ্যে আর যে অল্প কয়েকটি মানুষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল তার মধ্যে ছিলেন কমনওয়েলথ ইতিহাসের অধ্যাপক রবিনসন (যিনি রবি নামে পরিচিত ছিলেন), সংস্কৃতের রিচার্ড গমব্রিচ, চিনের ইতিহাসবিদ মার্ক এলভিন আর ফ্রান্স তথা সারা দুনিয়ার মানুষের অন্তরঙ্গ ইতিহাসের কারবারি থিওডর জেলডিন–যাঁর সঙ্গে হার্ভার্ডে এক অফিস ভাগে ভোগ করেছি। রবি শ্রমিকশ্রেণির লোক। উনিশশো বিশের দশকের শেষ দিকে বিশ্বজোড়া অর্থনৈতিক সঙ্কটের সময় ওঁর বাবা দীর্ঘকাল বেকার ছিলেন। ইংল্যান্ডে কে কোন শ্রেণির লোক তা চেনার অন্যতর প্রধান উপায় মানুষের মুখের ভাষা। যে ব্যক্তি এইচ-কে হেইচ উচ্চারণ করছে এবং উক্ত ব্যঞ্জনবর্ণটি কথা বলার সময় উহ্য রাখছে তার লর্ডের ছানা হওয়াটা নিতান্তই অসম্ভব। রবি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে মহা বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করে বহু মেডেল জিতে কেমব্রিজে পড়তে যান। যুদ্ধ যে পুরনো শ্রেণিভেদের ভিত অনেকটাই ধসিয়ে দিয়েছে সে কথাটা সকলের চেতনাগোচর হতে তখনও দেরি আছে। অত্মব্রিজে পুরনো স্মবারির ঐতিহ্য তখনও দেদীপ্যমান। রবি তার শ্রেণিগত উৎপত্তি ঢাকতে সহজাত উচ্চারণ বদলাবার চেষ্টা করতেন। কিন্তু ওঁর চেষ্টাটা খুব সফল হয়নি।

শ্রেণিভেদ যে কত বেদনাদায়ক হতে পারে ভারতীয় মধ্যবিত্তর কাছে তা চেনাগোচর হওয়া কঠিন। আমরা যারা নিজেদের উদার প্রগতিপন্থী বলে মনে করি তারা কখনও কলেজে দিনমজুরের পাশে বসিনি। অথবা কোনও ঝাড়ুদারের ছেলে আমাদের ভগ্নি বা কন্যাকে বিবাহের প্রস্তাব দেয়নি। দিলে আমাদের উদারতা কতটা অবিচলিত থাকত তা আমার জানা নেই। এবার এর উলটো দিকটা চিন্তা করুন। যে ঝাড়ুদারপুত্ৰ লর্ডের বাচ্চার পাশে বসে বক্তৃতা শুনছে, সে কি খুব মানসিক স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে? পঞ্চাশের দশকেও দেখেছি অল্প কিছু শ্রমিকশ্রেণির ছেলেমেয়ে যারা অক্সফোর্ডে পড়তে আসত তারা কীরকম জড়সড় হয়ে থাকত। তার এক দশক আগে ভেদবুদ্ধিটা উচ্চশ্রেণির ব্যবহারে আরও প্রকট ছিল। রবি এক অর্থে তার শিকার ছিলেন। ওঁর বন্ধু এবং সহকর্মী জ্যাক গ্যালাঘারও শ্রমিকশ্রেণির লোক। প্রতিভার জোরে দু’জনেই অক্সব্রিজের অধ্যাপক হয়েছিলেন। কিন্তু রবি তার যৌবনের অভিজ্ঞতা কখনও ভোলেননি।

রবির কাছ থেকে জীবনদর্শনের এক মূল্যবান পাঠ পেয়েছিলাম। আফ্রিকা রণাঙ্গনে রোমেলের নাৎসি বাহিনীর সঙ্গে ইংরেজদের লড়াইয়ে উনি বোমারু উড়োজাহাজের পাইলট হয়ে লড়েছিলেন। পরে এককালীন হাজার উড়োজাহাজ নিয়ে জার্মানির শহরগুলিতে বোমাবর্ষণেও উনি অংশগ্রহণ করেন। আমি রবিকে জিগ্যেস করেছিলাম–প্রতি মুহূর্তে যখন মৃত্যুর সম্ভাবনা তখন ভয়ে হাত-পা অবশ হয়ে যায় না? ওঁর উত্তর-জার্মানিতে বোমাবর্ষণের সময় যতগুলি উড়োজাহাজ যেত তার এক তৃতীয়াংশ ঘায়েল হত। প্লেন যখন প্রথম আকাশে উড়ত, তখন পেটের ভিতর ভয়ে প্রজাপতির ধড়ফড়ানি অনুভব করা যেত ঠিকই। কিন্তু একবার রণক্ষেত্রে পৌঁছলে ভয় করা মানেই নিশ্চিত মৃত্যু। মাথা ঠিক রেখে প্রতিটি কাজ করতে হয়। সেই চরম ব্যস্ততার মুহূর্তে ভয়ের চেতনাও লোপ পায়।

উত্তর আফ্রিকার রণক্ষেত্রে রবির চালানো উড়োজাহাজটি ঘায়েল হয়। ওঁর বয়স তখন আঠেরো। ওঁর সঙ্গী গোলন্দাজ মানুষটি গুলি লেগে মারা পড়ে। রবি প্যারাশুট নিয়ে লাফিয়ে পড়েন। কিন্তু কোনও কারণে ওঁর প্যারাশুটটি খোলেনি। ফলে প্রচণ্ড বেগে মাটিতে পড়ার মুখে একটা গাছের ডালে প্যারাশুট জড়িয়ে গিয়ে উনি বেঁচে যান। নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে কয়েক সেকেন্ড উনি কি ভাবছিলেন সে কথা ওঁর মুখেই শুনি। রবি তখনও অক্ষতকৌমার্য কিশোর, নারীসঙ্গের সুযোগ ওঁর জীবনে আসেনি। ফলে আসন্ন মৃত্যুর মুখে ওঁর একটাই দুরন্ত ইচ্ছা হয়েছিল–স্ত্রীসঙ্গের। রবি বলতেন–অনেক সময়ই আমাদের নানা তুচ্ছ বিষয়ে বিফলমনোরথ হওয়াটা গভীর দুঃখের কারণ হয়। তখন যদি আমরা মৃত্যুর পটভূমিতে আমাদের জীবনের দিকে তাকাই তা হলে কোনটা আমাদের সত্যিকার কাম্য আর কোন জিনিসটা সমাজ কর্তৃক মগজধোলাইয়ের ফলে চাইছি সে কথাটা স্পষ্ট হয়ে যায়। সেই সত্যদৃষ্টির আলোয় জীবনটা চালনা করলে কষ্ট অনেক কম পেতে হয়। এটা আধ্যাত্মিক উত্তরণের উপদেশ না, নিতান্তই ভুয়োদর্শনের কথা। রবি রবিনসনও পরলোকগত। ওঁর চলাফেরা ক্রিয়াকর্মে কিছুরই তোয়াক্কা না রেখে চলার একটা ভঙ্গি ছিল। কোনও অতীন্দ্রিয় সম্ভাবনায় বিশ্বাস না রেখেও জীবনের ছোট বড় অভিজ্ঞতা থেকে প্রজ্ঞা অর্জন করা সম্ভব ওঁকে দেখে এই বিশ্বাস আমার হয়েছে।

চৈনিক ইতিহাসে বিশেষজ্ঞ মার্ক এলভিন বিচিত্র চরিত্রের মানুষ। একজন সহকর্মী ওঁর বাচনভঙ্গী বোমাবর্ষণের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। মিনিটে দুশো শব্দের সেই বক্তৃতার প্রতিটি কথা তত্ত্ব এবং তথ্যে ঠাসা। একটি বাজে কথা নেই। কিন্তু মস্তিষ্কে তা ধারণ করে রাখতে গোটা তিন-চার মাথা থাকলে সুবিধে হত। অক্সফোর্ডে চাকরি পাওয়ার সময় ইন্টারভিউতে ওঁর অসাধারণ ক্রিয়াকলাপ এখনও প্রবাদকাহিনি হয়ে আছে। প্রথম প্রশ্নটি শোনামাত্র এলভিন সাহেব একটি ব্ল্যাকবোর্ড আনতে বলেন। তারপর সেই ব্ল্যাকবোর্ডে আঁক কষে, চিনা ভাষায় পৃষ্ঠাখানেক লিখে, অবিশ্বাস্য রকমের পাণ্ডিত্যের ফুলঝুরি বোমাপটকা সব কিছু ফুটিয়ে-ফাটিয়ে ঝাড়া প্রায় এক ঘণ্টা বক্তৃতা করেন। মুহ্যমান সিলেকশন কমিটি টু শব্দটি করার সুযোগ পাননি। বক্তৃতার শেষে সর্বসম্মতিক্রমে পদটি ওঁকেই দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ ছাড়া আর কী-ই বা উপায় ছিল।

মার্ক এলভিনের কাছে অনেক কিছু শিখেছি। কেমব্রিজ ইকনমিক হিস্ট্রিতে আমার লেখা পরিচ্ছেদগুলি ওঁর লেখা এবং চিন্তাধারা দ্বারা প্রভাবিত। চিনের ইতিহাসের সঙ্গে ভারতীয় ইতিহাসের তুলনামূলক আলোচনার জন্য বেশ কিছুদিন আমরা একটা যৌথ সেমিনার চালিয়েছিলাম। শেষে সেই সেমিনারের আলোচ্য বিষয়ের পরিধি আরও বাড়িয়ে সমগ্র এশিয়া তার বিষয়বস্তু ভেবে নেওয়া হয়। এই আলোচনাচক্র বিশেষ জনপ্রিয় হয়েছিল।

অক্সফোর্ডে ছাত্রাবস্থায় দেখেছি ভারতীয় ইতিহাসচর্চা আর সব দেশের ইতিহাস পঠন-পাঠন থেকে সম্পূর্ণ বিযুক্ত হয়ে শূন্যে ঝুলে থাকত। প্রধানত কিছু ভারতীয় ছাত্র কলিন ডেভিসের তত্ত্বাবধানে ডক্টরেট ডিগ্রির জন্য গবেষণা করত। আর ইতিহাসে অনার্স পরীক্ষার পাঠক্রমে ওয়ারেন হেস্টিংসের রাজত্বকাল বিষয়ে একটি স্পেশাল পেপার ছিল–যার মুখ্য আলোচ্য ভারতে ইংরেজ শাসন, ভারতীয়দের ইতিহাস নয়। তখন এমনিতেই স্নাতকোত্তর ছাত্রদের পঠন-পাঠন ব্যাপারটা অনেকটাই তাদের উপরেই ছেড়ে দেওয়া হত। আর ভারতীয় ইতিহাসের মতো প্রান্তিক বিষয়ের ক্ষেত্রে অবহেলাটা আরও প্রকট ছিল। পড়াতে এসে দেখলাম সে অবস্থার কোনও পরিবর্তন হয়নি। গোপাল সাহেব অনেক কোশেশ করে ওয়ারেন হেস্টিংস বিষয়ক স্পেশাল পেপারটি তুলে দিয়েছেন। তার জায়গায় অন্য কোনও বিষয় পড়ানোর ব্যবস্থা হয়নি। সুতরাং আমি দেখলাম দু-তিনটি গবেষণারত ভারতীয় ছাত্রর গবেষণা পরিদর্শন করা ছাড়া কার্যত আমার কোনও কাজ নেই। ওদিকে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মমাফিক কর্তব্য বছরে ছত্রিশ ঘণ্টা বক্তৃতা করা। স্নাতকোত্তর ছাত্রদের নিয়ে একটা সেমিনার চালিয়ে বছরে তিন আষ্টে (প্রতি টার্মে আট সপ্তাহ এবং বছরে টার্ম তিনটি) চব্বিশ ঘণ্টা কাটানো অবশ্যই যায়। তাতেও চুক্তি অনুযায়ী বারো ঘণ্টা বাকি থাকে। আমি জাত মাস্টার। একুশ বছর বয়স থেকে পড়াচ্ছি। পড়াতে আমার ভাল লাগে। পড়ানোর ক্ষেত্রে তানানা করে চালিয়ে দিয়ে শুধু গবেষণা করে আমার আত্মিক পেট ভরবে না। অতএব অন্য পথ দেখতে হবে, এ কথা ক’দিনেই বুঝলাম।

যখন দেখলাম যে আমার নিজের কর্মসূচি নিজেরই তৈরি করে নিতে হবে, তখন এক দুমুখি প্রচেষ্টা শুরু করি। প্রথম, ভারতীয় ইতিহাস বিষয়ে একটি নতুন পাঠক্রম তৈরি করা। দ্বিতীয়, ভারতীয় ইতিহাসের প্রান্তিকতা দূর করার চেষ্টা। নতুন পাঠক্রম চালু হতে পুরো এক বছর লাগবে। সেই সময়টা আমি ভারতচর্চার নানা দিক নিয়ে কিছু বক্তৃতা করি। অক্সফোর্ডে শিক্ষকদের এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা আছে। কিন্তু প্রথম বছরটা আমার প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়ায় অন্যান্য দেশের ইতিহাস পঠন-পাঠনের সঙ্গে ভারতীয় ইতিহাসচর্চার যোগসূত্র গড়ে তোলা। তুলনামূলক এশিয়ার ইতিহাস নিয়ে সেমিনার ছাড়াও, আরও দুটি সেমিনারে আমি সক্রিয় অংশ নিতে শুরু করি। সে দুটি হচ্ছে যথাক্রমে কমনওয়েলথের ইতিহাস এবং আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ইতিহাস। ভারতবর্ষ যে কমনওয়েলথের সব চেয়ে বড় দেশ এবং অবশ্যই আন্তর্জাতিক অর্থনীতিতে বহু শতাব্দী ধরে শামিল—এই দুই সুপরিচিত তত্ত্ব অক্সফোর্ডের ইতিহাস পঠন-পাঠনে যাতে হাতকলমে স্বীকৃতি পায় সেই চেষ্টাই আমার স্বেচ্ছাবৃত কর্তব্য হয়ে দাঁড়াল। চেষ্টাটা কত দুর সফল হয়েছিল জানি না। তবে ব্যক্তিগত উপস্থিতি মারফত বিষয়টির উপস্থিতি অন্য বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের চেতনাগোচর করতে পেরেছিলাম মনে হয়।

এক সময় শ্রীমতী ইন্দিরা গাঁধীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা অর্জুন সেনগুপ্ত দু’বছরের জন্য অক্সফোর্ডে একটা ফেলোশিপ নিয়ে এসেছিলেন। তার সাহায্যে কিছুদিন পরে ভারত সরকার থেকে একটি অনুদান পাওয়া যায়। সেই অনুদানের ভিত্তিতে সেন্ট অ্যান্টনিস কলেজে একটি সেন্টার অফ ইন্ডিয়ান স্টাডিজ স্থাপন করা হয়। এই সেন্টারটি প্রায় পনেরো বছর চালু ছিল। তারপর সরকারি অনুদানটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সেন্টারটিও তুলে দিতে হয়। যতদিন সেন্টারটি চালু ছিল ততদিন তার আওতায় ভারতবর্ষ বিষয়ক বহু আন্তর্জাতিক আলোচনাচক্র এবং সঙ্গীত, নৃত্য, সিনেমা থেকে শুরু করে বিখ্যাত ভারতীয় পণ্ডিতদের এনে বক্তৃতামালা ইত্যাদি নানা সাংস্কৃতিক উদ্যোগ অনুষ্ঠিত হয়। উল্লেখযোগ্য এই যে পূর্ববর্তী পরিচ্ছেদে বর্ণিত গোষ্ঠীচক্র এই সেন্টারের ব্যাপারে বিশেষ বাধা দিয়েছিলেন। তাদের উদ্দেশ্য অবশ্যই মহৎ ছিল। দেশের টাকা কেন বিদেশে যাবে? আমি উত্তর দিয়েছিলাম—ভারতীয় দূতাবাসে একটি কালচারাল অ্যাটাশে রাখতে যা খরচ হয় তার দশমাংশ ব্যয় করে আমরা দশগুণ ফল ফলাতে পারব। আমার বিশ্বাস এই আস্ফালন মিথ্যা প্রমাণ হয়নি। সেন্টারের কর্মসূচি মারফত অক্সফোর্ডের ছাত্র ও শিক্ষকরা ভারতীয় সংস্কৃতির নানা দিক সম্পর্কে অবহিত হন।

এখানে আরও একটি কথা উল্লেখ করা ভাল। আমরা ভারতীয়রা মোটেই ঘরকুনো না। আমরা বেড়াতে খুবই ভালবাসি, তবে যথাসম্ভব পরের, বিশেষত সরকারি পয়সায়। আমাদের দেশপ্রেমিক পণ্ডিত ব্যক্তিদের (বিশেষ করে যাঁদের শিকড় গভীরে চলে গেছে, তাদের) প্রায়ই বিদেশে দেখা যেত, এবং প্রায়শ নানা ডেলিগেশনে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমাদের গৌরী সেন অর্থাৎ ভারত সরকারের পয়সায়। ভারতবর্ষ যে একশো কোটি লোকের দেশ যে-কোনও কনফারেন্সে ভারতীয় ডেলিগেশনের আকার দেখে তা বোঝ যেত। ক্ষমতাপন্ন গোষ্ঠীর আবিষ্কৃত জিনিয়াসরা অবশ্যই এইসব ডেলিগেশন আলো করে থাকতেন। আর এ বাবদ অর্থব্যয় তো নিতান্তই দেশের স্বার্থে। সুতরাং এতে যে আপত্তি করবে সে নির্ভেজাল মিরজাফর।

কমনওয়েলথ সেমিনারে অংশগ্রহণ করতে গিয়ে প্রথম প্রথম একটা ব্যাপারে বেশ অস্বস্তি বোধ হত। এই সেমিনারে শিক্ষক এবং ছাত্র যারা অংশগ্রহণ করতেন, দেখলাম তারা প্রায় সবাই সাম্রাজ্যপূজারী। বাল্যকাল থেকে ওই সাম্রাজ্যের বীভৎস দিকটা আমার চেতনার অঙ্গ। সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্ত ডায়ার ও পাঞ্জাবকাহিনি-তে লাহোর-অমৃতসরের রাস্তায় টিকটিকিতে বান্ধা স্কুলের ছেলেদের বেত মারার ফোটো দেখে অনেক রাত বিনিদ্র কাটিয়েছি। আর এখানে এসে শুনি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মতো সর্বজনহিতায় প্রতিষ্ঠান পৃথিবীর ইতিহাসে আর দেখা যায় না। এক সহকর্মীর ঘরের বাইরে মস্ত এক পোস্টার। বক্তব্য ইট টেকস এ গ্রেট মাইন্ড টু অ্যাপ্রিসিয়েট এ গ্রেট এম্পায়ার। সে রকমের গ্রেট মাইন্ড ভদ্রলোকের অবশ্যই ছিল। তার পূজ্য বস্তুটি যে অন্য লোকের বিবমিষার কারণ হতে পারে এ চিন্তা তাঁর অন্তরে কী করে জায়গা পাবে? এক মার্কিন ঐতিহাসিক তথ্যপ্রমাণ দিয়ে দেখিয়েছেন যে ব্রিটেনের সবচেয়ে বেশি প্রতিক্রিয়াশীল শ্রেণিই সাম্রাজ্যবাদের আদর্শ তাদের ধর্ম বলে গ্রহণ করেছিলেন। এবং যেহেতু দেশের যাবতীয় সংবাদমাধ্যম থেকে শুরু করে স্কুল কলেজ পর্যন্ত সর্বত্র এই শ্রেণির লোকের প্রচণ্ড প্রভাব, দেশের আমজনতাকেও সাম্রাজ্যের মাহাত্ম এরা বিশ্বাস করিয়ে ছেড়েছে। শুধু তাই না, পৃথিবীর সর্বত্র—এমনকী আমাদের এই হতভাগ্য দেশেও, এখনও বহু লোকের বিশ্বাস যে ইংরেজরা আমাদের জাতীয় মঙ্গল যেভাবে দেখভাল করেছে, তার কোনও তুলনা নেই। বাছারা বিদেয় নেওয়ায় নাকি দেশের অবস্থা নেহাতই বেহাল হয়েছে। অন্ধত্ব যাদের এই পর্যায়ে পৌঁছেছে তাদের নিয়ে কিছু করার নেই। এই প্রসঙ্গে বলি–ভারতবর্ষর ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে যে ইংরেজ ঐতিহাসিকের খ্যাতি সবচেয়ে বেশি–সেই ক্রিস বেইলি সম্প্রতি তথ্যপ্রমাণ দিয়ে দেখিয়েছেন যে ঔপনিবেশিক শাসনের অন্ত না ঘটলে ভারতবর্ষের আর্থিক কোনও উন্নতি সম্ভব হত না। প্রমাণ—একশো বছর ধরে ভারতীয় অর্থনীতিতে কৃষি আর শিল্পের পারস্পারিক অনুপাতে সত্যিতে কোনও পরিবর্তনই হয়নি। সেই পরিবর্তনের ভিত গাড়েন বহুনিন্দিত নেহরু সরকার!

কমনওয়েলথ সেমিনারের মুখ্য দায়িত্ব রবি রবিনসনের। তিনি শ্রমিক দলের সমর্থক। বিলেতের শ্রেণিভিত্তিক সমাজ তার চোখে নিতান্তই ঘৃণিত। গ্যালাঘারের সঙ্গে যৌথ প্রচেষ্টায় লেখা তাদের ইম্পিরিয়ালিজম অফ ফ্রি ট্রেড নামের বিখ্যাত প্রবন্ধ সাম্রাজ্যবাদের স্বরূপ উদঘাটন করেছিল। কিন্তু এই মানুষও দেখলাম সেমিনারে সাম্রাজ্যের যাঁরা সমালোচক সেইসব লোকদের বিশেষ ডাকেন না। হবসবমকে ওই সেমিনারে দেখব আশা করেছিলাম। তা কখনও ঘটেনি। যখন হবসবমের বামপন্থী সহযোগী টেরেন্স রেঞ্জার অক্সফোর্ডে অধ্যাপক হয়ে এলেন, তখন একদিন মাত্র তিনি কমনওয়েলথ ইতিহাসের সেমিনারে বক্তৃতা করেন। তার বক্তৃতা শেষ হলে এক ব্যক্তি বেশ শোনা যায় এই রকম স্বরেই বললেন, এইসব লোককে অক্সফোর্ডের মতো জায়গায় কারা আমদানি করছে?

সাম্রাজ্যের ইতিহাসের ঘন অন্ধকার দিক সম্পর্কে দেখলাম প্রায় কোনও ইংরেজই অবহিত নন। ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়ার ঠিক চার বছর আগে ১৯৪৩-এর দুর্ভিক্ষে যুক্ত বঙ্গে যে ত্রিশ লক্ষ লোক না খেতে পেয়ে মারা গেছে, সে কথা অক্সফোর্ডের ছাত্র বা অধ্যাপক কেউই শুনেছেন বলে মনে হল না৷ অ্যাটেনবরার তৈরি মহাত্মার জীবনী বিষয়ক ছবিটি মুক্তি পাওয়ার পর নানা রকম অদ্ভুত মন্তব্য শুনেছি। কেউ কেউ বললেন জালিয়ানওয়ালাবাগের দৃশ্যটি কাল্পনিক। এক চরম দক্ষিণপন্থী শিক্ষক মন্তব্য করলেন, ডায়ার গুলি চালিয়ে ঠিক কাজই করেছিল, কারণ সভায় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বহু শিখ এসেছিল। তারা ছত্রভঙ্গ না হলে সভার পর শহরে সশস্ত্র বিদ্রোহ হত। যাঁদের রাজনীতি উগ্র দক্ষিণপন্থী নয়, তাঁরা ছবিটি দেখার পর নিশ্ৰুপ হয়ে গিয়েছিলেন। তাদের স্বজাতির মানুষ যে অমন সব নৃশংস কাজ করতে পারে—এটা তাদের কল্পনারও অতীত ছিল। সাম্রাজ্যবাদী প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীগুলি সাম্রাজ্যের লজ্জাকর ইতিহাস জনসাধারণের কাছ থেকে সযত্নে গোপন রাখতে সক্ষম হয়েছে। অ্যাটেনবরার ছবিটি প্রকাশ হওয়ার পর বুঝলাম নিজেদের লজ্জাকর ইতিহাস মানুষের চেতনাগোচর হলেও লোকে ওদিকে চোখ বুজে থাকতেই ভালবাসে। ছেচল্লিশ সাতচল্লিশের দাঙ্গায় আমরা হিন্দু-মুসলমান-শিখ সকলেই যে পশ্বাচার করেছি তা নিয়ে কি আমাদের কোনও লজ্জার লক্ষণ আছে? অ্যাটেনবরার ছবি মুক্তি পাওয়ার পর কমনওয়েলথ সেমিনারে ইংরেজ জনসাধারণের সাম্রাজ্যর ইতিহাস বিষয়ে অন্ধত্ব নিয়ে একটি বক্তৃতা করি। আমার বক্তব্য জনপ্রিয় অবশ্যই হয়নি, কিন্তু আলোচনায় কেউ ইংরেজের সহজাত ভদ্রতার সীমা লঙ্ঘন করেননি।

প্রতিক্রিয়াশীল ইংরেজের মতামত অনেক সময় রীতিমতো কৌতুকজনক হয়। আমার এক সহকর্মী বিদ্বান ব্যক্তি হলেও সাধারণ বুদ্ধির দিক থেকে ইংরেজিতে যাকে নাইভ বলে তার এক চরম নিদর্শন। তিনি আমাকে একদিন হঠাৎ প্রশ্ন করেন—আগে তো ছাত্র হিসেবে অক্সফোর্ডের অভিজ্ঞতা হয়েছে। এখন পড়াতে এসে কেমন লাগছে? উত্তরে আমি বলি, খুবই ভাল লাগছে, তবে দু-একটা জিনিস রুচিতে বাধে। যেমন? যেমন ছাত্রদের সঙ্গে এক ঘরে বসে তারা যখন সাদামাটা কিছু খেয়ে পেট ভরাচ্ছে তখন হাই টেবিলে চৰ্য-চোষ্য খাওয়া। সহকর্মীটি বললেন—তুমি যদি ইংরেজ হতে তা হলে এ কথা তোমার মনে হত না। তবে কী মনে হত? মনে হত যে যোগ্যতা অর্জন করলে ওরাও এক দিন হাই টেবিলে খাবে। বটে। বটে! আমি বললাম, এ ব্যাপারে কিন্তু আমরা হিন্দুরা আরও এগিয়ে গিয়েছি। কীরকম? আমরা আমাদের অচ্ছুৎদের বলি–সদাচার পালন করে থাকলে আর দশ-বিশ জন্ম পর তোমরা নিশ্চয়ই ব্রাহ্মণের পা ছোঁয়ার অধিকার পাবে। ও কটা দিন একটু ধৈর্য ধরে থাকো।

রীতিমতো পড়ানো শুরু করতে প্রায় এক বছর বাকি। সে সময়টা নিজেকে ব্যস্ত রাখার জন্য কিছু বক্তৃতা দেওয়া ছাড়া আরও একটি কাজ করি। আমি স্বেচ্ছায় বাংলা শেখাতে আরম্ভ করলাম, যদিও আমার ছাপানো কর্মসূচিতে কথাটা ছিল না। শিখতে এলেন সংস্কৃতের শিক্ষক গমব্রিজ এবং তার কয়েকটি ছাত্র। ওঁদের অক্ষর পরিচয় হতে মাত্র অল্প কদিন লাগল। তারপর সোজা কিছু গল্প কবিতা পড়াব ঠিক করলাম। সংস্কৃত শব্দবহুল রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতা বেছে নিলাম–ব্রাহ্মণ। সেই যে ‘অন্ধকার বনচ্ছায়ে সরস্বতী তীরে…’। সংস্কৃতজ্ঞানের কল্যাণে শব্দগুলি ওদের প্রায় সবই জানা। সুতরাং গমব্রিজ গড়গড় করে অনুবাদ করে গেলেন। শুধু শেষ দুটো লাইনে ‘অব্রাহ্মণ নহ তুমি তাত’র জায়গাটায় এসে উনি ‘তাত’ অনুবাদ করলেন সানসাইন। একটু বোধ হয় বাড়াবাড়ি হয়ে গেল। রবীন্দ্রনাথ ছাড়া আর পড়ালাম ‘আবোলতাবোল’। হিজিবিজবিজ তথা তকাইয়ের আত্ম তথা বংশপরিচয় জেনে সবাই খুব খুশি।

গমব্রিজের বাবা জগদ্বিখ্যাত স্যার আর্নেস্ট। বোধ হয় বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ আর্ট ক্রিটিক এবং নন্দনতাত্ত্বিক। একদিন রিচার্ড গমব্রিজের বাড়ি বেড়াতে গিয়েছি। সঙ্গে আমাদের অতিথি নবনীতা। স্যার আর্নেস্ট সেদিন ছেলের বাড়িতে উপস্থিত। ওঁকে দেখে নবনীতা বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে একটা খাতা থেকে একটি পাতা ছিঁড়ে নিয়ে অটোগ্রাফ দাবি করলেন। দুই টানে একটি গাছের পাতা এঁকে তার নীচে সই করে স্যার আর্নেস্ট সত্যিকার বিস্ময়ভরা কণ্ঠে জিগ্যেস করলেন, তুমি আমাকে কী করে চিনলে! আমি তো ভারতবর্ষ সম্বন্ধে কিছুই জানি না।নবনীতা উত্তর দিলেন, স্যার আর্নেস্ট, হাওয়ায় ভেসে আপনার নাম দু-চারজন মানুষের কানে পৌঁছেছে।

.

পড়ানোর ব্যাপারে নানা উঞ্ছবৃত্তি করতে করতে একটা বছর কেটে গেল। ইতিমধ্যে আমার পেশ করা নতুন স্পেশাল পেপারের পাঠক্রম, যা ওয়ারেন হেস্টিংসের পরিবর্তে পড়ানো হবে তা মঞ্জুর হয়েছে। আমি প্রথমেই ঠিক করেছিলাম আমার যেসব বিষয়ে ব্যক্তিগত উৎসাহ কিছু বেশি তা নিয়ে নতুন পাঠক্রম তৈরি করব না। যে বিষয় ছাত্রছাত্রীদের কাছে আকর্ষণীয় হতে পারে তা নিয়েই পাঠক্রম হবে। এই কথা মাথায় রেখে গাঁধীজির নেতৃত্বে ভারতবর্ষের জাতীয় আন্দোলনের কয়েকটি বছরকে (১৯১৯-১৯৩৪) কেন্দ্র করে নতুন পাঠক্রম পেশ করেছিলাম। অক্সফোর্ডে ইতিহাসে স্পেশাল পেপারে পাঠক্রমের কেন্দ্রে থাকে তথ্যের উৎস যেসব দলিলপত্র তার এক নির্বাচিত লিস্ট। পরীক্ষায় তার থেকে উদ্ধৃতি তুলে ছাত্রদের মন্তব্য করতে বলা হয়। এই উদ্ধৃতিগুলিকে বলা হয় গবেট। কথাটা বাংলা গবেটের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। মোট কথা পাঠক্রমের উদ্দেশ্য ছাত্রদের মূল উপাদান থেকে নির্ভরযোগ্য তথ্য নিষ্কাশন করার শিক্ষা। যেসব ঐতিহাসিক দলিল ওই পেপারের জন্য পাঠ্য নির্দিষ্ট হয় ১৯১৮-১৯ সনে পঞ্জাবের ঘটনাবলি বিষয়ে রিপোর্টগুলি তাদের কেন্দ্রস্থলে। একই ঘটনা নিয়ে একই তথ্যের ভিত্তিতে বিচারক যে সম্পূর্ণ পরস্পরবিরোধী সিদ্ধান্তে আসতে পারেন, এই রিপোর্টগুলি তার চরম নিদর্শন। তাই ওগুলি তথ্য বিচার শেখার জন্য বিশেষ উপযোগী।

দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্যে যে তথ্যের মূল্যায়নে আকাশপাতাল তফাত হয়ে যায় আমার এক সহকর্মীর সঙ্গে একত্রে ক্লাস নিতে গিয়ে সে কথাটা বারবারই নজরে আসত। একটা উদাহরণ দিই। ক্লাসটা ছিল গবেট নিয়ে আলোচনার। ছেলেমেয়েরা নির্দিষ্ট গবেট সম্বন্ধে তাদের মন্তব্য লিখত। ক্লাসে তা নিয়ে আলোচনা হত। একটা গবেট ছিল চম্পারন সত্যাগ্রহের সময় ওখানকার তরুণ ইংরেজ ডেপুটি কমিশনারের একটা মন্তব্য থেকে উদ্ধৃতি। ভদ্রলোক বলছেন–ওখানকার কৃষকরা আগে মহাজনের চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতেও ভয় পেত আর আন্দোলনের পরে তারা বড়লাটের সামনেও সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলতে পারে। গবেট আলোচনায় প্রথম কাজ বক্তার অবস্থান এবং বিশ্বাসযোগ্যতা নির্ধারণ। এ প্রসঙ্গে আমি বললাম–তরুণ ডেপুটি কমিশনার তখনও ইংরেজ আমলাতন্ত্রের সাম্রাজ্যবাদী মনোভঙ্গি সম্পূর্ণ রপ্ত করেননি। তাই তার দৃষ্টি তখনও স্বচ্ছ। সুতরাং তার উক্তি নির্ভরযোগ্য। আমার সহকর্মী বললেন, ‘লোকটি সবে এসেছে। ভারতবর্ষ তার কাছে অপরিচিত। কাঁচা বয়সের কাঁচা কথা। ওর উক্তিটা সেইভাবে দেখলেই ভাল হয়।’ওঁর লেখা ইতিহাস আর আমি যা লিখি তাতে কোথায় ফারাক হবে এর থেকে আন্দাজ করতে পারেন।

ভারতবর্ষের জাতীয় আন্দোলন বিষয়ে ক্লাসে পড়াতে গিয়ে বেশ অসুবিধেই হত। শুনেছিলাম ইংল্যান্ডে তরুণ সম্প্রদায় প্রগতিপন্থী। সাম্রাজ্যের মহিমায় তারা বিশ্বাস হারিয়েছে। শিক্ষক হিসেবে ওখানে প্রায় তেত্রিশ বছর কাটিয়েছি। তার মধ্যে বিশ বছর গেছে বক্তৃতা, টিউটোরিয়াল, সেমিনার মারফত প্রত্যক্ষভাবে বিদ্যাদানে। এতগুলি বছরে সাম্রাজ্যের মহিমা বিষয়ে সন্দেহ পোষণ করে এরকম যে কটি ছাত্রছাত্রী পেয়েছি, সংখ্যায় তারা পাঁচ-ছটির বেশি হবে না। বোধ হয় অত্মব্রিজ বাদ দিলে অন্য সব বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রগতিবাদী তথা সাম্রাজ্যবিরোধী ছাত্রছাত্রী সংখ্যায় এর চেয়ে অনেক বেশি। সাম্রাজ্যের ব্যাপারে প্রগতিবাদী শ্রমিক দলের সমর্থক সহকর্মীদের মনেও নানা দ্বিধাদ্বন্দ্ব রয়েছে মনে হত। একজন বললেন—ইংরেজদের বদলে ফরাসিদের রাজত্ব হলে স্বাধীন হওয়ার জন্য তোমাদের অনেক রক্তক্ষয় করতে হত। আলজেরিয়া আর ভিয়েতনামের ইতিহাস দেখ। আমি ঔপনিবেশিক যুগে ভারতের আর্থিক দুর্দশার কথা উল্লেখ করলাম। তার উত্তর দ্যাখো, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আগে কোথাওই শিল্পায়ন বা সক্রিয়ভাবে আর্থিক উন্নয়নের চেষ্টা। হয়নি। এ ব্যাপারে ইংরেজদের বিশেষ দোষ দেওয়া চলে না। রবি রবিনসন একদিন জিগ্যেস করলেন–তোমার কি মনে হয় আমরা ইচ্ছে করলে আরও কিছুদিন ভারতবর্ষ ধরে রাখতে পারতাম না? আমি বললাম নিশ্চয়ই পারতে। তবে আলজেরিয়ায় ফরাসিদের যে হাল হয়েছিল আমাদের দেশে তোমাদেরও তাই হত। এক জেলডিন (যার রাজনৈতিক মতামত রক্ষণশীল বলেই আমার ধারণা) একবার ভারতবর্ষ ঘুরে এসে বললেন–ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসন যে অর্থনৈতিক শোষণের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল এবং তা নিয়ে মানুষের মনে এখনও সঞ্চিত ক্ষোভ আছে, এ কথা আমি এর আগে কখনও ঘুণাক্ষরেও শুনিনি। অথচ এই অক্সফোর্ডেই আমি তিন বছর ইংল্যান্ডের ইতিহাস পড়েছি।

যেসব ছাত্রছাত্রী ভারতবর্ষে জাতীয় আন্দোলনের ইতিহাস পড়তে আসত তাদের অধিকাংশের চেতনায় এই সাম্রাজ্যপ্রীতির শিকড় বহু দূর চলে গিয়েছিল। বাড়িতে, ইস্কুলে, খবরের কাগজে, গির্জায় এরা জ্ঞান হওয়া অবধি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের গুণগান শুনে আসছে। এদের কাছে সাম্রাজ্যমহিমায় আস্থা প্রায় খ্রিস্টধর্মে বিশ্বাসের সঙ্গে তুলনীয়। সে বিশ্বাসে ঘুণ ধরানো আমার কর্তব্যের মধ্যে পড়ে না। আমি পসিটিভিস্ট ঐতিহাসিক। তার মানে ইতিহাসচর্চায় তথ্য থেকে আপেক্ষিক সত্যে পৌঁছনো সম্ভব মনে করি। কিন্তু সে সত্য আপেক্ষিক, ধ্রুব নয়। শিক্ষক হিসেবে আমার কাজ ছাত্রদের তথ্যের নির্ভরযোগ্যতা বিচার এবং একই তথ্যের পরস্পরবিরোধী ব্যাখ্যার তুলনামূলক মূল্যায়ন করতে শেখানো। ইতিহাসে পরম্পরালব্ধ ধ্রুবজ্ঞানে আমার বিশ্বাস নেই। সুতরাং সেরকম কোনও অবিসংবাদিত সত্য আমি পরিবেশন করতাম না। শুধু আমার বক্তৃতায় আমার বিচার অনুযায়ী সাম্রাজ্যের স্বরূপ উদঘাটন করতে কখনও দ্বিধা করিনি। এ কাজে আমি কতটা সফল হয়েছিলাম জানি না। ছাত্রছাত্রীরা মন দিয়ে শুনেছে, কখনও নানাভাবে তাদের যে আমার ব্যাখ্যা শুনতে ভাল লেগেছে সে কথা জানিয়েছে। কিন্তু টিউটোরিয়ালে এবং পরীক্ষার খাতায় তাদের প্রশ্নোত্তর দেখে বুঝতাম আমার ব্যাখ্যা তারা গ্রহণ করেনি।

প্রথম ডিগ্রির জন্য ইতিহাস পড়তে এসে যাঁরা ভারতীয় ইতিহাসে স্পেশাল পেপারটি নিত তারা প্রায় সবাই ব্রিটিশ ভারতীয় ছাত্রদের আমি ওই স্পেশাল পেপারটি নিতে উৎসাহ দিতাম না। কারণ ইংরেজ ছাত্র-ছাত্রীদের ভারতবর্ষ সম্বন্ধে কোনও জ্ঞানই থাকত না। আমরা যেসব কথা প্রায় মাতৃদুগ্ধ পান করার সঙ্গে সঙ্গেই আত্মস্থ করি, তারা তার বিন্দুবিসর্গও জানে না। জাতিভেদ প্রথা বোঝতে আধ ঘন্টা সময় ব্যয় করলে ভারতীয় ছাত্রদের তা শুনে ঘুমিয়ে পড়ার সম্ভাবনা। তাই তাদের বলতাম–বাছারা অন্য কিছু পড়ো। পশ্চিমে এসেছ, এদের ইতিহাস আর সংস্কৃতি বিষয়ে জ্ঞান একটু বাড়িয়ে নিয়ে যাও।

স্নাতকোত্তর ছাত্রদের মধ্যে ছবিটা এর উলটো। খুব অল্পসংখ্যক শ্বেতাঙ্গ ছাত্রকেই আমি ডক্টরেটের দুয়ার পার হতে সাহায্য করেছি। তার একটা কারণ–ভারতীয় ইতিহাসে ডক্টরেট নিয়ে চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা খুব কম ছিল। এখন অবস্থাটা কিছুটা বদলেছে। একটা ঘটনা উল্লেখ করি। তা থেকে ব্যবসা-বাণিজ্যের জগতে পি.এইচ.ডি ডিগ্রিটা (অক্সফোর্ডে যার নাম ডি.ফিল) কী চোখে দেখা হত সে বিষয়ে কিছুটা ধারণা পাওয়া যাবে। আমার এক ইংরেজ ছাত্র ডি.ফিলের জন্য গবেষণা শুরু করেছিল। মাঝপথে সে ফোর্ড কোম্পানিতে একটা মোটা মাইনের চাকরি পেয়ে গেল। চাকরিটা নেওয়ার সিদ্ধান্তের সঙ্গে সঙ্গে সে আরও এক বিষয়ে মনস্থির করে। ওর গবেষণার কাজ অনেকটা এগিয়ে গিয়েছিল। সে কাজটা যাতে বিফলে না যায়, সেই উদ্দেশ্যে ও একটি ছোট থিসিস লিখে এম.ফিল ডিগ্রি অর্জন করে। ফোর্ড কোম্পানিতে চাকরির ব্যাপারে ও আমার কাছে একটি প্রশংসাপত্র বা ক্যারেক্টার চায়। ও যে সৎ এবং বুদ্ধিমান ব্যক্তি এ কথাটাই আমাকে লিখতে হবে। কিন্তু ও যে একটা গবেষণালব্ধ ডিগ্রি পেয়েছে সে কথাটা আমাকে চেপে যেতে বলল। কারণ ব্যবসাজগতে শাস্ত্রচর্চা জাগতিক বুদ্ধির পরিপন্থী বলেই ধরা হয়। অক্সফোর্ডে দু-তিন বছর থেকে সহবৎ শিক্ষা করেছ, কেতাদুরস্ত হয়েছ–ভাল কথা। কিন্তু রিসার্চ ডিগ্রি নিয়েছ তো গেছ। অন্য পথ দ্যাখো। ব্যবসার জগৎ কঠিন ঠাই। যারা মুখ গুঁজে বই পড়ে সময় কাটায় এ জগৎ তাদের জন্য নয়।

আমার কাছে যেসব কৃতী ছাত্র গবেষণা করে ডিগ্রি নিয়েছে তাঁদের অধিকাংশই দক্ষিণ এশিয়ার লোক–ভারতীয়, পাকিস্তানি, সিংহলবাসী বা বাংলাদেশি। এঁদের মধ্যে অনেকেই আজ খুবই খ্যাতিমান। এবং এদের সম্বন্ধে আমি বিশেষ গর্বিত। এই কলকাতা শহরেই আমার সাতজন ছাত্রছাত্রী আছেন। তারা সবাই সুপ্রতিষ্ঠিত এবং বিখ্যাত। যতদিন আমার স্ত্রীর শারীরিক ক্ষমতায় কুলাত, প্রতি বছর গ্রীষ্মের প্রারম্ভে উনি নিজে বেঁধে পঞ্চাশ-ষাট জন ছাত্র এবং বন্ধুবান্ধবকে খাওয়ালে। বাড়ির বাগানে প্রচণ্ড হইচই করে পার্টি হত। লোকে বলত—এই খাওয়ার লোভেই আমার কাছে ছাত্ররা গবেষণা করতে আসে৷ একবার দিল্লি থেকে সদ্য আগত এক ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা হয়। তিনি আমার স্ত্রীর পরিচয় পেয়ে বললেন–হ্যাঁ, হ্যাঁ। আপনি খুব ভাল রাঁধেন শুনেছি। দিল্লিতে সবাই বলেছে আপনার সঙ্গে দেখা করতে।তারপর কিয়ৎকাল মৌন থেকে মহাশয় বললেন, আপনার কথা কিন্তু কেউ কিছু বলেনি। কেনই বা বলবে?

আমি যখন অক্সফোর্ডে পড়াচ্ছি তার অনেকগুলি বছরই ব্রিটেনের রাজনীতিতে রক্ষণশীল প্রতিক্রিয়ার যুগ। এই সময়েই শ্ৰীমতী থ্যাচারের অভ্যুদয় এবং টানা আঠেরো বছর টোরি রাজত্বের কাল। কোনও দেশে বাস করলে সেখানকার রাজনীতির ব্যাপারে নিরপেক্ষ থাকা কঠিন। বিশেষত একই সময়ে থ্যাচার এবং রেগানের আবির্ভাব বিশ্ব রাজনীতিতে প্রতিক্রিয়াশীল আদর্শের জয়যাত্রা ঘোষণা করে। এই দুটি মানুষ এবং তাদের রাজনীতি আমার জুগুপ্সার উদ্রেক করেছিল। উদারপন্থী সংবাদপত্র গার্জিয়ান-এর একটি সমীক্ষা থেকে জানা যায় যে ব্রিটেনের জনসংখ্যার একটি বিরাট অংশ আমার এই জুগুপ্সায় শামিল। একাধিক পত্রপত্রিকায় থ্যাচারকে ‘দা মোস্ট হেঁটেড পার্সন ইন ব্রিটেন’ বলে বর্ণনা করে। একটা মানুষের ছবি টেলিভিশনে দেখলে যে শারীরিক অসুস্থতা বোধ করা যায় থ্যাচার রাজত্বে ইংল্যান্ডে বাস করে আমার এ কথা চেতনাগোচর হল। শেষে আমি টেলিভিশনে মানুষটির ছবি দেখা গেলেই চ্যানেল বদলাতাম। অকারণে অপ্রীতিকর অভিজ্ঞতা সহ্য করার কোনও হেতু নেই। গার্ডিয়ানের সমীক্ষা থেকে জানলাম যে মহিলা শুধু আমার না, বহু মানুষেরই বিবমিষা উদ্রেক করতেন। রক্ষণশীলরাও অনেকেই ওঁর ধরনধারণ বিশেষ অপছন্দ করতেন। এক শ্রেণির লোকের ধারণা—অচল কোম্পানিগুলিকে তাদের স্বাভাবিক মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়ে, অযোগ্য মানুষদের রাষ্ট্রের ঘাড়ে চেপে জীবিকা উপার্জনের পথ বন্ধ করে, ট্রেড ইউনিয়নগুলির ঠ্যাং ভেঙে এবং অবাঞ্ছিত মানুষের ব্রিটেন প্রবেশ বন্ধ করে উনি ব্রিটিশ অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পুনরুজ্জীবন ঘটান। আর বাম এবং উদারনীতির সমর্থকরা ভাবেন ইংল্যান্ডের শিল্প এবং শিক্ষাব্যবস্থার সর্বনাশ, অর্থনৈতিক বৈষম্য চরমে ওঠা, জাতিবৈরর ব্যাপারে উস্কানি দেওয়া–এই হল মহিলার বাস্তবিক অবদান। উনি নিজের স্বাভাবিক বাচনভঙ্গি—যা ঠিক অভিজাতসুলভ ছিল না–ঢাকবার জন্য মাস্টার রেখে এক অদ্ভুত আওয়াজ গলা থেকে বের করার শিক্ষা নেন। উটের এবং উদবেড়ালের ডাক ছাড়া ওরকম বিশ্রি আওয়াজ আমি আর কোথাও শুনিনি। ওঁর অবৃদ্ধি স্বামীটি সাধারণ্যে নানা বেচাল কথাবার্তা বলে দম্পতিটির ভাবমূর্তি আরও নষ্ট করনে। সংক্ষেপে বলতে গেলে আমার চোখে থ্যাচার রাজত্বের বীভৎসতা ভারতে ইংরেজ শাসনের অন্ধকার দিকটির সঙ্গে তুলনীয় মনে হত।

ওঁর জনপ্রিয়তা যখন প্রায় মাটিতে ঠেকেছে, তখন আর্জেন্টিনা ব্রিটিশ উপনিবেশ ফকল্যান্ড আক্রমণ করে ওঁকে বাঁচিয়ে দেয়। পার্লামেন্টের সভ্য টম ডিইলের মতে—এ যুদ্ধ এড়ানো যেত। কিন্তু সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে আর্জেন্টিনার জাহাজ বেলগ্রানো ডুবিয়ে দিয়ে থ্যাচার শান্তির পথ বন্ধ করে দেন। এবং তার সঙ্গে আর একবার ভোটে জেতার ব্যবস্থাও পাকা হয়ে যায়। কোনও দেশ ন্যায়যুদ্ধে জিতলে জনগণের বড় উল্লাস হয়। আর কোথাকার কোন আর্জেন্টিনা, সে মহান ব্রিটেনের সাম্রাজ্যের উদ্বৃত্ত লেজটুকু দখলের চেষ্টা করেছে। সেই লেজরক্ষার লড়াইয়ের চেয়ে মহৎ প্রচেষ্টা আর কী হতে পারে? শ্রীমতী থ্যাচার আর একবার ভোটে জিতে আরও কিছুদিন দেশের সর্বনাশ করার মওকা পেলেন। লোকে সর্বধ্বংসী হুনরাজ এট্টিলার সঙ্গে তুলনা করে ওঁকে ‘এট্টিলা দি হেন’ আখ্যা দিল। শেষে যখন ওঁর প্রতি মানুষের বিদ্বেষ ওঁর দলের পক্ষে বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়াল, তখন টোরি নেতৃবৃন্দই ওঁকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করে। সানয়নে থ্যাচারের ডাউনিং স্ট্রিট ত্যাগ করার দৃশ্য দেখে সহানুভূতিতে অভিভূত হয়েছিলাম–এমন কথা বললে মিথ্যা ভাষণ হবে। জীবনে আর একবার ব্যক্তিবিশেষের দুর্গতি দেখে বিমল আনন্দ পেয়েছিলাম। অযোধ্যা কাণ্ডের পর দিল্লির রাস্তায় জলুসে শামিল হয়ে মুরলীমনোহর জোশী ওয়াটার ক্যাননের তোড়ে রাস্তায় গড়াগড়ি দিল। বিদেশে বসে টেলিভিশনের পর্দায় এই দৃশ্য দেখে মনে হয়েছিল–আহা, এমন কেন রোজ হয় না। এ লোকগুলির তো প্রাপ্য শাস্তি কোনও দিনই হবে না। তিহার জেলে এদের ঘানি টানার সম্ভাবনা সুদূরপরাহত। জলের তোড়ে রাস্তায় গড়াগড়ি যাচ্ছে, সেটুকুই হোক। জোশীর পাশে যদি আডবাণী, নরাধম মোদী, তোগাড়িয়াকেও ধরাশায়ী দেখা যেত, তা হলে সুখের অবধি থাকত না। ধর্মের কল বাতাসে অন্তত একটু নড়ক। প্রসঙ্গত বলি–ঐতিহাসিক জ্ঞানেন্দ্র পাণ্ডে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের সময় অকুস্থলে উপস্থিত ছিলেন। উনি খবরের কাগজে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে লিখেছেন মসজিদ ধ্বংস হওয়ার মুহূর্তে ওই লোকটা (মুরলীমনোহর জোশী) দু আঙুল তুলে চার্চিলীয় ভঙ্গিতে বিজয় ঘোষণা করেছিল।

সত্তরের দশকের অক্সফোর্ডের ইতিহাসে দুটি অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটে। প্রথম, বাংলাদেশে স্বাধীনতা যুদ্ধের অল্পদিন পরে অক্সফোর্ডের কিছু রক্ষণশীল পণ্ডিত ব্যক্তি জুলফিকার আলি ভুট্টোকে সাম্মানিক এল.এল.ডি (ডক্টর অফ ল) ডিগ্রি দেওয়ার প্রস্তাব করেন। বাংলাদেশে খানসেনার অত্যাচারের পিছনে ভুট্টোর অবদান কারও অজানা ছিল না। তার উপর অল্পদিন আগেই বাংলাদেশের কসাই নামে পরিচিত টিক্কা খানকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ভুট্টো প্রধান সেনাপতির পদ দিয়েছে। রিচার্ড গমব্রিজের নেতৃত্বে প্রস্তাব বাতিল করার জন্য আন্দোলন শুরু হল। এ ব্যাপারে আমার কিঞ্চিৎ অবদান ছিল। কিন্তু আন্দোলনটা যাতে হিন্দুস্তান-পাকিস্তান বিরোধ বলে ব্যাখ্যা করা না হয়, সেই জন্য আমার যা কাজ তা আড়ালে থেকেই করি।

ভুট্টো বলেছিলেন–যখন কিছু লোকের আপত্তি হচ্ছে তখন ব্যাপারটা ওখানেই থেমে যাক। ওঁর সাম্মানিক ডিগ্রির দরকার নেই। কিন্তু অক্সফোর্ডে প্রধান-স্থানীয় যাঁরা প্রস্তাবটা দিয়েছিলেন, তারা ওঁকে আশ্বাস দেন কুছ পরোয়া নেই, সব ঠিক হো জায়গা। এই মহাশয়রা নিজেদের ক্ষমতা এবং প্রভাবে একটু বেশি আস্থা পোষণ করতেন। অক্সফোর্ডের পার্লামেন্ট কনগ্রিগেশনে প্রথমবার ভোটের ফল সম্পর্কে কিছু সন্দেহের কারণ ছিল। তাই আবার ভোট হল। এবার বিপুল ভোটে ভুট্টোকে ডিগ্রি দেওয়ার প্রস্তাব নাকচ হয়। এই বিষয়ে কনগ্রিগেশনে বিতর্কের সময় ডিগ্রি দেওয়ার সপক্ষে মহারথীরা যেসব উক্তি করেন। তা শুনে তাঁদের প্রতি আমার শ্রদ্ধা বাড়েনি। অনেক বক্তৃতাই ইংরেজদের কুখ্যাত কপটতার চরম নিদর্শন বলে মনে হয়েছিল।

কিন্তু এই প্রসঙ্গে ব্রিটিশ চরিত্রের অসাধারণ মহত্ত্বের দিকটা সম্পর্কেও কিছু বলা প্রয়োজন মনে করি। ভুট্টোঘটিত ব্যাপার যখন ঘটে তখন ভাইস চ্যান্সেলর ছিলেন বিখ্যাত ঐতিহাসিক স্যার জন হ্যাবাক। আমাদের ইংল্যান্ডের সঙ্গে এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামে উনি তিন মাসের জন্য দিল্লি স্কুলে এসেছিলেন। সেই সূত্রে আমাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব হয়েছিল। ওঁর প্রশাসনের সময় ভুট্টোকে ডিগ্রি দেওয়ার প্রস্তাব নাকচ হওয়ায় উনি বেশ অপদস্থ হয়েছিলেন। এই নাটকে নাটের গুরু ছিলেন রিচার্ড গমব্রিচ। ফলে ওঁর রিচার্ডের প্রতি ব্যক্তিগত বিরাগ থাকার কথা। তা যে ছিল না—এমন কথা বলতে পারি না। কিন্তু বিরাগ বা অনুরাগ ওঁকে কর্তব্য থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। এইসব ঘটনার অল্পদিন পরে এশিয়ার ধর্ম ও নীতি বিষয়ে অধ্যাপকের পদটি যে পদে এক সময় রাধাকৃষ্ণন ছিলেন খালি হয়। ওই পদের জন্য অন্যতম প্রার্থী গমব্রিচ। আর সিলেকশন কমিটির অন্যতম সভ্য আমি। একদিন হবাক আমাকে তলব করলেন। উনি প্রশ্ন করলেন যে, পদটির জন্য গমব্রিচের যোগ্যতা সম্পর্কে আমার কী মত। আমি বললাম আমি তো ওঁকে খুবই যোগ্য ব্যক্তি বলে মনে করি। হ্যাবাকক বললেন যে ভুট্টোঘটিত ব্যাপারে অনেকেই গমব্রিচের উপর খুব বিরক্ত। ওঁর আশঙ্কা–সেই কারণে তার উপর অবিচার হতে পারে। যদি সত্যিই রিচার্ড যোগ্য প্রার্থী হয় তবে তার প্রতি অবান্তর কারণে অবিচার যাতে না ঘটে তা দেখা ওঁর কর্তব্য। আমাদের দেশে অনুরূপ ক্ষেত্রে এই ন্যায়নিষ্ঠা সম্ভব বলে আমি মনে করি না।

অক্সফোর্ডের ইতিহাসে দ্বিতীয়বার বিশ্ববিদ্যালয়ের মন্ত্রিসভা হেবডোমেডাল (অর্থাৎ সাপ্তাহিক) কাউন্সিল-এর প্রস্তাব বাতিল হয় যখন কর্তারা থ্যাচার শ্রীমতীকে সাম্মানিক এল.এল.ডি দেওয়ার প্রস্তাব করেন। তখন ওঁর রাজত্বের ছ বছর পার হয়ে গেছে। এর আগে অক্সফোর্ডের ছাত্র যে-ই ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন তাকেই সাম্মানিক এল.এল.ডি উপাধি দেওয়া হয়েছে। শুনেছি ম্যাগি থ্যাচার অক্সফোর্ডে কর্তাব্যক্তি স্থানীয় বন্ধুদের প্রশ্ন করেন যে তার ক্ষেত্রে এ প্রথার ব্যতিক্রম হচ্ছে কেন? বন্ধুরা আসল কারণটা তাকে বলতে বোধ হয় সাহস পাননি। তার নাম শুনলে অধিকাংশ নরনারীর পিত্তি জ্বলে যায় এ কথাটা কী করে বলা যায়? সুতরাং কর্তারা নাকি বলেন–রাজ্য শাসনের সপ্তম বছর নাগাদ সব প্রধানমন্ত্রীই কিছুটা জনপ্রিয়তা হারান। সুতরাং ঠিক এই সময়ে প্রস্তাবটা ভোলা বোধ হয় ঠিক হবে না। সম্ভবত কর্তারা অল্পদিন আগেই কনগ্রিগেশনের হাতে যে প্যাদানি খেয়েছেন স্মৃতির কোটরে সে কথাটা তখনও সঞ্চিত ছিল। জনপ্রবাদ–থ্যাচার একথা মানতে চাননি। আর কিছু লোক আছে, যাদের কিছুতেই শিক্ষা হয় না। সেই রকম এক অতি উদ্ধত অধ্যাপকের পরামর্শেই নাকি শেষ পর্যন্ত হেবডোমেডাল কাউন্সিলে প্রস্তাবটি পাস হয়।

ব্যস, অনেকেই এই প্রস্তাবে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন। প্রতিপ্রস্তাব তখনই জারি হল। ভদ্রমহিলা কতভাবে ব্রিটেনের শিক্ষাব্যবস্থার সর্বনাশ করেছেন, সে কথা বিস্তৃতভাবে বিবৃত হল। এই মুদিনন্দিনী যে জাতির ভবিষ্যতের হিসাব আর মুদিখানার দৈনন্দিন লাভ লোকসানের খতিয়ানে মৌলিক পার্থক্য আছে সেকথা বোঝেন না, আকারে প্রকারে সেটা ব্যাখ্যা করা হল। বৈজ্ঞানিকরা বলতে লাগলেন–ব্যয়সঙ্কোচ করে থ্যাচার ইংল্যান্ডে বিজ্ঞানচর্চা দশ বছর পিছিয়ে দিয়েছেন। গবেষণার ক্ষেত্রে সে প্রধান প্রধান দেশগুলির সঙ্গে আর কখনও সমান তালে চলতে পারবে তার সম্ভাবনা নেই। ভোটের দিন দেখি হল একেবারে ভর্তি। যে বৈজ্ঞানিকদের কখনও দেখতে পাওয়া যায় না, কারণ তাদের কেউ কেউ চব্বিশ ঘণ্টাই ল্যাবরেটরিতে কাটান, তারাও দেখি অ্যাপ্রন পরেই ভোট দিতে চলে এসেছেন। বিপুল ভোটে প্রস্তাবটি পরাজিত হল। শুনেছি এই অপমানের খবর পেয়ে মহিলা অশ্রুবর্ষণ করেছিলেন। আশা করি কথাটা সত্যি। থ্যাচারকে ডিগ্রি দেওয়া নিয়ে বিতর্কে এক বিখ্যাত রক্ষণশীল ঐতিহাসিক শিক্ষার ব্যাপারে ব্যয়সঙ্কোচ নীতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আবেগে কম্পমান গলায় বললেন, আওয়ার স্লো-ও-ও-রিয়াস এম্পায়ার ইস নো মোর। আহা কী শোকের কথা! আর বলছ কী? “এ কী কথা শুনি আজ মন্থরার মুখে?” তোমাদের গ্লো-ও-ও-ও-রিয়াস এম্পায়ার থেকে ফায়দা ওঠাতে বলে তোমাদের এত রবরবা ছিল। এ কথা তো সাধারণ্যে তোমাদের মুখে কখনও শুনিনি। তোমরা তো জানি নেহাৎ বহু জনহিতায় খেটেখুটে অনেক রক্তপাত করে সাম্রাজ্য স্থাপন করেছিলে। এখন এসব কী অশোভন কথা! ছিঃ!

এখানে একটি মানবিক সত্য লিপিবদ্ধ করা প্রয়োজন মনে করি। সেন্ট অ্যান্টনিস কলেজ ঠান্ডা লড়াইয়ের অন্যতম বৌদ্ধিক ঘাঁটি হিসাবে প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল। সুতরাং ওখানকার শিক্ষককুলের মধ্যে যে বড় একটি অংশ রাজনৈতিক তথা সামাজিক মতামতে রক্ষণশীল হবে একথা ধরেই নিয়েছিলাম। সত্যিতে শ্রমিক দলের সমর্থক এবং অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে প্রগতিবাদী সহকর্মীদের অনেকেই সোভিয়েত রাষ্ট্রের সম্পূর্ণ বিরোধী ছিলেন। তাঁদের মতে ওই অগণতান্ত্রিক অত্যাচারী রাষ্ট্রের সপক্ষে বলার কিছুই নেই। পরবর্তী কালে স্টালিনের রাজত্বকাল সম্বন্ধে যেসব তথ্য পাওয়া গেছে, তাতে এই মত ভ্রমাত্মক বলা কঠিন। কিন্তু এইসব পণ্ডিত ব্যক্তি যখন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে সোভিয়েত রাষ্ট্র তথা স্টালিনের অবদান সম্পূর্ণ অস্বীকার করতেন, তখন তাদের মতামত ঠিক প্রাড়বিবাকোপম নিরপেক্ষতায় ভাস্বর বলে মনে হত না। আমার ধারণা সোভিয়েত রাশিয়া হিটলারের অগ্রগতি না ঠেকালে ইউরোপে জার্মানির অপ্রতিহত প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হত। যদি স্টালিনের একনায়কত্ব নানা দোষের আকর হয় তবে সেই একনায়কত্বই যে যুদ্ধে সোভিয়েত সাফল্যের অন্যতম প্রধান কারণ এবং সেই কারণে যুক্তশক্তির শেষাশেষি জয়লাভের অন্যতর স্রষ্টা–একথা অস্বীকার করা যায় কী করে? কিন্তু আমার কোনও সহকর্মীই একথা স্বীকার করতে রাজি ছিলেন না।

যে মানবিক সত্যের কথা বলব বলে এইসব কথা উত্থাপন করেছি সেটি এই। যাঁদের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল তারা প্রায় সবাই রাজনৈতিক মতামতের দিক থেকে রক্ষণশীল মত ও পথের বিভিন্নতা মানুষে মানুষে সম্পর্কে অলঙ্ঘ্য বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। আশৈশব যারা নানা সুবিধাভোগী শ্রেণির স্বচ্ছ জীবনযাত্রার আওতায় রক্ষণশীল পরিবারের সামাজিক আদর্শ এবং বিশ্বাসের ছত্রচ্ছায়ায় মানুষ হয়েছেন হঠাৎ তাদের বামপন্থী চিন্তাধারায় শামিল হওয়া অথবা পূর্বপুরুষের অর্জিত সাম্রাজ্যকে নেহাতই দুর্নীতির আকর মনে করা প্রায় অসম্ভব। ব্রিটেনে অনেক ক্ষেত্রে যে এই অসম্ভব ব্যাপার ঘটেছে তা ওদের সমাজের উৎকর্ষেরই নজির। আমার রক্ষণশীল বন্ধুদের সঙ্গে আমি রাজনৈতিক আলোচনা এড়িয়ে চলতাম। আমার মতামত কী তা তারা ভালই জানতেন। কিন্তু এ নিয়ে আমাদের মানবিক সম্পর্ক কখনও ব্যাহত হয়নি। একটি ছোট ঘটনা আমার স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে আছে। এক দিন হাই টেবিলে নতুন এক ছোঁকরা টোরি এম.পি ইংরেজ আমলে ভারতবর্ষের অর্থনৈতিক ইতিহাস বিষয়ে আমাকে জ্ঞান দিতে শুরু করেন। আমার সহকর্মীরা দেখলাম বিশেষ বিব্রত বোধ করছেন। ডিনারের পর বেশ কয়েকজন এসে আমার কাছে এই কাণ্ডজ্ঞানহীন ব্যবহারের জন্য ক্ষমা চেয়ে গেলেন। এবং এরা সবাই ছিলেন টোরি দলের সমর্থক।

অক্সফোর্ডে কাজ করতে গিয়ে আমার সবচেয়ে বড় উপকার হল আমার কাজের ব্যাপারে। যে কলমের কালি শুকিয়ে গিয়েছিল সেই কলম আবার প্রাণবন্ত হয়ে উঠল। ষোলো বছরের মৌনতা ভেঙে আবার আমি লিখতে শুরু করলাম। ওখানে যাওয়ার অল্পদিন পরেই কেমব্রিজের হিস্টোরিকাল ম্যাগাজিন থেকে আমন্ত্রণ পেলাম ভারতবর্ষের আধুনিক ইতিহাস, বিশেষত জাতীয় আন্দোলনের ইতিহাস বিষয়ে সাম্প্রতিক কালে প্রকাশিত বইগুলির একটি বিশ্লেষণী আলোচনামূলক প্রবন্ধ লেখার। এই আমন্ত্রণের উত্তরে আমি ইন্ডিয়ান ন্যাশনালিজম অ্যাস অ্যানিম্যাল পলিটিকস নাম দিয়ে একটি প্রবন্ধ লিখি। প্রবন্ধটি ভারতীয় ইতিহাসের ছাত্রদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। লেখাটির মূল বিষয় ছিল কেমব্রিজের ভারতীয় ইতিহাস বিষয়ে গবেষকদের যে থিসিস তার সমালোচনা। ওঁদের মতে ঔপনিবেশিক যুগে ভারতীয় রাজনীতির মূল উদ্দেশ্য ছিল ইংরেজের সঙ্গে সহযোগিতা বা অসহযোগিতার পথে গোষ্ঠীস্বার্থ উদ্ধারের সন্ধান। জাতীয়তাবাদও এই স্বার্থসন্ধানের অন্যতর প্রকাশ। এই তত্ত্ব কেন গ্রহণযোগ্য নয় তা আমি নানা যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করি। আমি শুনলাম আমার কেমব্রিজের সহকর্মীরা লেখাটা পড়ে দুঃখিত হয়েছিলেন। আমি যে তাঁদের বিশ্লেষণী অবদানের প্রশংসা করেছি, সে কথা ওঁরা খেয়াল করেননি, এতে আমি একটু আশ্চর্যই হয়েছিলাম। সমালোচনা মানেই আক্রমণ না—দেখলাম ব্রিটিশ পণ্ডিতরা এ কথা অনেক সময়েই বোঝেন না।

আগেই লিখেছি ষাটের দশকে ধর্মা কুমার এবং আমি কেমব্রিজ ইকনমিক হিষ্ট্রি অফ ইন্ডিয়া সম্পাদন করার দায়িত্ব গ্রহণ করে চুক্তিতে সই করেছি। অথচ ছ’সাত বছরে বলতে গেলে কাজ কিছুই এগোয়নি। ১৯৭৪ সনে কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস চরমপত্র দিলেন আর দু বছরের মধ্যে বইটির পাণ্ডুলিপি ওঁদের হাতে না পৌঁছলে ওঁরা চুক্তিটা বরবাদ হয়ে গেছে বলে ধরে নেবেন। এবার সত্যিতে উঠেপড়ে লাগতে হল। কাজটা সোজা না। নিজেদের লেখাটা না হয় লেখা গেল, কিন্তু মার্কিন মুলুক থেকে সোভিয়েত রাষ্ট্র তথা জাপান পর্যন্ত ছড়িয়ে যে সহকর্মীদের লেখা দেওয়ার কথা, তাঁদের নিয়ে কী করা যাবে? আর সর্বোপরি আছেন আমার বন্ধু এবং প্রথম খণ্ডর সহ-সম্পাদক ইরফান হাবিব! তিনি চিঠির উত্তর দেওয়া ধর্মবিরুদ্ধ জ্ঞান করেন। তবে কী করে সম্পাদনার কাজ এগোবে? শরিয়ত বা মার্কসবাদ–কোথাওই যে চিঠি লেখার বিরুদ্ধে কোনও ফতোয়া নেই একথা ওঁকে কে বোঝাবে? এক বন্ধু বললেন—চিঠিটা ইরফানপত্নী সায়েরাকে লেখো, তাতে উত্তর পাওয়ার সম্ভাবনা হয়তো একটু উজ্জ্বল হবে। সে চেষ্টা করলাম। কিছু কাজ হল। তারপর আবার যথা পূর্বম তথা পরম। এবার চরমপন্থা অবলম্বন করলাম। এক গ্রীষ্মের ছুটিতে ইরফানের বাড়ি গিয়ে উঠলাম। আরব্য উপন্যাস বর্ণিত সমুদ্রের বৃদ্ধের মতো তাঁর স্কন্ধারূঢ় হলাম দেখে এবার ইরফান তৎপর হলেন। ইরফান অভিজাত মুসলমান ঘরের ছেলে। তা ছাড়া যখনই আলিগড় গিয়েছি মনে হয়েছে আঠারো শতকের মোগল দরবারে পৌঁছেছি। ঘরে কেউ ঢুকলেই সবাই উঠে দাঁড়াচ্ছেন। কোমর পর্যন্ত নুয়ে সেলাম বিনিময় হচ্ছে। ভাষায় লখনভি বিনয়৷ আচার-ব্যবহারে সকলেই বিনয়চন্দ্র পাপোশ। ইরফানও বামপন্থী হওয়া সত্ত্বেও একই সংস্কৃতির লোক। চিঠি লেখার বালাই নেই, কিন্তু দেখা হলে সেজন্য শত কোটি ক্ষমাভিক্ষার ব্যাপারে কোনও ত্রুটি দেখতে পাবেন না। যা হোক, সর-এ-জমিন উপস্থিত হওয়ায় এবার কাজ হল। এক ধাক্কায় সম্পাদনার কাজ অনেকটা এগিয়ে গেল। কেমব্রিজ ইকনমিক হিস্ট্রি লেখার ব্যাপারে দ্বিতীয় সমস্যা ছিল সাইমন ডিগবিকে নিয়ে। সুলতানি আমল সম্বন্ধে এই অভিজাত ইংরেজ বটুর (ওঁর পূর্বপুরুষ সত্যিই গোলাপের যুদ্ধে তলোয়ার ঘুরিয়েছেন) তুলনীয় পাণ্ডিত্য সম্ভবত আর কারও নেই। বিদ্যোম্মাদ এই ব্যক্তি কোনও নতুন তথ্য আবিষ্কার করলে সত্যিই নাচতে থাকতেন। উনি একবার দিল্লিতে জামে মসজিদের পাশের চাঁদ হোটেলে কিছুদিন ছিলেন। সেখানে দেখা করতে গেলে উনি আমাকে কফি খাওয়ার আমন্ত্রণ জানালেন। দেখলাম একটি বদনা থেকে কফির জন্য জল ঢালা হচ্ছে। আরও দেখলাম বদনাটি সর্বজনের ভোগার্থে নিবেদিত পায়খানায়ও যাতায়াত করছে। সাইমন নির্বিকার। উনি আমাদের সম্পাদিত বইয়ে একটি পরিচ্ছেদ লিখতে রাজি। এই মহাপণ্ডিত ব্যক্তিটির লেখার ব্যাপারে বড়ই গড়িমসি৷ তাই শর্ত হল উনি বোজ আমার সঙ্গে লাঞ্চ খাবেন এবং সেই সময় অন্তত একটি পৃষ্ঠা আমার করতলগত করবেন। শর্তানুসারে ডিগবি দিনে এক পাতা রেটে লেখা দিয়ে যাচ্ছেন। বেশ নিশ্চিন্ত আছি। কোথাও কোনও উদ্বেগের ছায়া নেই। কিন্তু হঠাৎ একদিন ওঁর ঘরে গিয়ে দেখি—পণ্ডিতবর গত রাত্রে পাকিস্তান চলে গেছেন। একটা চিঠি আর আমাদের ব্যবহারের জন্য দিস্তা দশেক নোট রেখে গেছেন। লুপ্ত ধন উদ্ধারের মতো সেই নোট থেকে ইরফান ওঁর বক্তব্য পুনর্নির্মাণ করেন।

যা হোক, দু’বছরের মাথায় গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি কেমব্রিজ ইউভার্সিটি প্রেসের করকমলস্থ করি। বইটি বের হয় তার প্রায় ছ’ বছর পরে। বই ফেলে রাখা প্রকাশকদের ‘বেল্লাস’ (ঢাকাই কুট্টিদের ভাষায়; সাধারণ বাংলায় বিলাস) বলে আমার ধারণা।

ওই কাজটা ঘাড় থেকে নামলে বাঙালি মানস বিষয়ে আমার পরিকল্পিত বইটির কাজে হাত দিই। সে কাজ এখনও শেষ হয়নি। অনেক অধ্যয়ন, অনেক গবেষণার ফলে পর্বতপ্রমাণ তথ্য সংগৃহীত হয়েছে। কিন্তু বইটির জন্য নানা বিকল্প কাঠামোর কথা ভেবেছি। কোনওটাই মনোমতো হয় না। জেলডিনকে সমস্যাটার কথা বলায় তিনি বললেন—চোখ বুজে লিখতে শুরু করো। ব্রেল কখনও অভ্যাস করিনি। হঠাৎ চোখ বুজে লিখি কী করে? ফলে এই চরম সমাধান আমার কাছে দুরধিগম্য মনে হয়েছে। আশঙ্কা হচ্ছে, এই বই শেষ হওয়ার আগেই আমার আয়ুষ্কাল শেষ হবে, আমি এন্তেকাল ফরমাব। তা হলে অবশ্যি আর কিছু করার থাকবে না। তবে যতদিন সেটা না ঘটছে, আমি আশা ছাড়িনি। বিশ্বকর্মার নন্দন কীভাবে ছুছুন্দর রূপ পরিগ্রহ করেন সে কথা স্মরণ রেখে কিঞ্চিৎ ভয়ে ভয়ে এগুচ্ছি।

তা ছাড়া ওই বই লেখার জন্য যে ছুতোরখানা বসিয়েছি তার থেকে ছিটকে যাওয়া কিছু কাষ্ঠখণ্ড দিয়ে খান দুয়েক বই লিখেছি। তার একটি—ইউরোপ রিকনসিডার্ড—আমি পড়ানো থেকে অবসর নেওয়ার আগেই প্রকাশিত হয়। বিষয়—তিন বাঙালি মনীষী পশ্চিমি সভ্যতা সম্বন্ধে কী ভেবেছিলেন তার বিশ্লেষণ।

এইখানে আমার ব্যক্তিগত জীবনের দু-একটি তথ্য উল্লেখ করা দরকার। যে বছর ইংল্যান্ড চলে আসি তার পরের বছর বাবা মারা যান। ওঁর খুব ইচ্ছে ছিল একবার ইউরোপ আসেন। যৌবনে বিলেতে এসে ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য জন্য জাহাজের টিকিটও কাটা হয়েছিল। বিলেত যাত্রার জন্য কেনা ওঁর নাম-ঠিকানা লেখা ট্রাঙ্ক আমরা ছোটবেলায় দেখেছি। উনি বিলেত রওনা হলেই ওঁর পুত্র-অন্ত-প্রাণ পিতা হার্ট ফেল করবেন সাহেব ডাক্তার একথা বলায় বাবা বিলেত যাওয়ার পরিকল্পনা ত্যাগ করেন। আমি অক্সফোর্ড পৌঁছে ওঁর ইংল্যান্ডে আসার সব ব্যবস্থা করেছিলাম। কিন্তু ঠিক এই সময় ওঁর ফুসফুসে ক্যানসার ধরা পড়ে। ওঁর বিলেত আসা এবারও হল না। অসহ্য যন্ত্রণা পেয়ে ১৯৭৪-এর জানুয়ারি মাসে বাবা মারা গেলেন। আমি মৃত্যুর সময় ওঁর কাছে ছিলাম। মৃত্যুতে ওঁর শান্ত অভিজাত মুখাবয়ব বড় মহৎ দেখাচ্ছিল। জীবনভর নানা ব্যর্থতার ছাপ সেখানে ছিল না। একটা জান্তব দুঃখ মনপ্রাণ আচ্ছন্ন করল। কিন্তু প্রায় সব শোকই বোধহয় অল্পস্থায়ী। শৈশবে মাকে কাছে পেতাম না, তাই সমস্ত আবেগ এই পরম সুপুরুষ মানুষটিকে ঘিরে গড়ে উঠেছিল। কিন্তু কৈশোরে পৌঁছতেই একটা দূরত্ব এসে যায়। বুঝতাম এতে উনি কষ্ট পেতেন। কষ্ট আমারও কম হত না। কিন্তু দ্বিধা ভেঙে পরস্পরের কাছে আসার চেষ্টা দু’জনের কারওই করা হয়ে ওঠেনি।

উনিশ শো আশির দশকে মৃত্যু যেন মহাসমারোহে আমার জীবনে আসন পাতল। ১৯৮৩ সনের ১ জানুয়ারি কাজ থেকে অবসর নেওয়ার পরের দিন আমার বন্ধু এবং ভগ্নিপতি শৈলেন সেন হঠাৎ হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান। লেখাপড়াপ্রিয় মানুষটি আয়কর বিভাগে চাকরি করে খুশি ছিলেন না। যদিও আমলাতন্ত্রের সিঁড়ির খুব উঁচু ধাপে উঠেই শৈলেন অবসর নিয়েছিলেন, কিন্তু ওই দশটা-পাঁচটা একঘেয়ে কাজ ওঁর কাছে নিতান্তই অপ্রীতিকর ছিল। বহু বই সংগ্রহ করে, গল্ফগ্রিনের সদ্য-পাওয়া বাড়িতে বড় একটা পাঠকক্ষ বানাবেন মনস্থ করে, মহা উৎসাহে তিনি অধ্যয়ন আর গবেষণাকেন্দ্রিক অবসর উদযাপনের জন্য প্রস্তুত হয়েছিলেন। কিন্তু ওঁর ঈপ্সিত জীবন একটি দিনও ভোগ করার সুযোগ উনি পাননি। আয়কর বিভাগের অনেকেই অবসর নেওয়ার পরে ব্যবসা বাণিজ্যঘটিত প্রতিষ্ঠানে চাকরি নেয়। একদিন শৈলেনের দফতরে ওঁর এক সহকর্মী এক গণককে নিয়ে উপস্থিত। সে হাত দেখে বলে, স্যার, আপনি জীবনের শেষ দিন অবধি কাজ করে যাবেন। শৈলেন হেসে বলেন, গণকঠাকুর, এ যাত্রা আপনার হিসেব ভুল হল। অবসর নেওয়ার পর আমি একটি দিনও আর চাকরি করব না। শেষ অবধি গণকের হিসেবই ঠিক প্রমাণ হল।

১৯৮৯ সনে মা মারা গেলেন। আমি তখন দিল্লি পৌঁছেছি। কোনও বিশেষ কারণ ছাড়াই দুটো দিন বেশি দিল্লি থেকে যাওয়া মনস্থ করি। সেদিন সন্ধ্যাবেলা দাদার ফোন এল—মা স্ট্রোক হয়ে সেদিন সকালে মারা গেছেন। আমি কলকাতা পৌঁছবার আগেই ওঁকে দাহ করা হয়। তেষট্টি বছর বয়সে মাতৃবিয়োগ ঠিক ট্র্যাজেডির পর্যায়ে পড়ে না। কিন্তু খবরটা পেয়ে বারবারই মনে হয়েছে—চেষ্টা করলে ওঁকে আর একটু বেশি স্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যে রাখতে পারতাম। বোধহয় কলকাতা এলে ওঁর সঙ্গে আর একটু বেশি সময় কাটানো কর্তব্য ছিল। কিন্তু এইসব কাজ মানুষ কর্তব্যজ্ঞানে করে না।

মা’র মৃত্যুর বছরখানেক পরে দাদাও হৃদরোগে মারা গেলেন। বহু গুণসম্পন্ন মানুষটি জীবনের নানা ক্ষেত্রেই সফল হওয়ার যোগ্যতা নিয়ে জন্মেছিলেন। যে কাজেই হাত দিতেন প্রথমে উজ্জ্বল সাফল্য নিয়ে তা শুরু হত। কিন্তু কখনওই শেষরক্ষা হত না। ম্যাঙ্গানিজ রপ্তানি করবেন বলে উনি একটা খনি কিনেছিলেন—বেশ বিশ্বাসযোগ্য বিশেষজ্ঞকে দেখিয়ে। কিন্তু এক ইঞ্চির নীচে আর কোনও খনিজ দ্রব্যের খোঁজ সেখানে পাওয়া গেল না। এই ধাক্কা আর উনি সামলে উঠতে পারেননি। ওঁর বহুমুখী ক্ষমতা সাফল্যের ভিত তৈরি করতে পারেনি। শেষ বয়সে উনি দু’খণ্ড গল্পের বই লিখেছিলেন। আমার ধারণা লেখাটা উচ্চশ্রেণিরই হয়েছিল। প্রথম রচনাটি দেশ পত্রিকায় উচ্চ প্রশংসা পেয়েছিল। কিন্তু ওই শেষ। দ্বিতীয় বইটির আর কোথাও সমালোচনাই হল না। এক বিখ্যাত লেখককে অকারণে চটানোয় ওঁর সাহিত্যিক জীবনের সমাপ্তি ঘটে।

বাবা আর দাদার জীবনের দিকে তাকিয়ে সীমিত সাফল্য থেকে আমার সুখানুভূতি কখনও সম্পূর্ণ হয়নি। সম্পূর্ণ যুক্তিহীনভাবে বারবারই মনে হয়—অন্য কারও প্রাপ্য আমার ভাগ্যে এসে জুটেছে। আমার অতি নিকটের দুটি মানুষ জীবন থেকে তাঁদের যা পাওয়ার তা পাননি। আর দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে গিয়ে বারবারই বহু মানুষের সাক্ষাৎ পেয়েছি যাঁরা আমার তুলনায় অনেক বেশি জ্ঞানীগুণী। কিন্তু ভাগ্যের হাতে তাঁদের কোনও পুরস্কার, কোনও স্বীকৃতিই মেলেনি। দ্য রেস ইস নট অলওয়েস উইদ দা ফাস্টেস্ট।

আমার ঘনিষ্ঠতম বন্ধু অমল দত্তও ১৯৮৬ সনে চলে গেলেন। চিরতরুণ এই মানুষটি সরকারি চাকরির উচ্চতম সোপানে উঠে অবসর নেওয়ার পর ঢাকায় ইউনাইটেড নেশনস এর অধীনস্থ জুট কমিশনারের পদে নিযুক্ত হন। রবি চক্রবর্তী আর আমি ঢাকার গুলশন নামে সম্রান্ত পাড়ায় ওঁর বাড়িতে গিয়ে কয়েকদিন ছিলাম। দীর্ঘদিন অসুস্থ থেকে ওঁর প্রথম স্ত্রী অরুণা মারা যান। তার দু বছর পর অমল একটি মারোয়াড়ি মহিলাকে বিয়ে করেন। রোমান্টিক মানুষটি জীবনে দ্বিতীয়বার গভীরভাবে প্রেমে পড়েছিলেন। কিন্তু ওঁর এই দ্বিতীয় বিবাহও সুখের হয়নি বলেই আমার ধারণা। সম্ভবত সেই অ-সুখ ওঁর অকালমৃত্যুর অন্যতর কারণ। ওঁর মৃত্যুসংবাদ পেয়ে একটা দিনের কথা মনে পড়ছিল। ওঁর সেদিন আই.এ.এস. পরীক্ষার ফল বের হয়েছে। অরুণার সঙ্গে বিয়ের দিনও ঠিক হয়েছে। আনন্দে আপ্লুত মানুষটি বারবারই বলছিলেন, আই হ্যাভ নো রাইট টু বি সো হ্যাপি। ওঁর এই সুখ অল্পদিনই স্থায়ী হয়েছিল। কিন্তু নানা দুঃখে জর্জর ওঁর জীবনে জীবনরস কখনও শুকিয়ে যায়নি।

আরও একটা দুঃখ আমার জন্য জমা ছিল। ব্যাপারটা এত ব্যক্তিগত যে তা নিয়ে আলোচনা করতে পারলাম না। শেকসপিয়ারের নাটকে মুর্যের মতো দুঃখের মুহূর্তে আমার সমস্ত মানবজাতি তথা নিজেকেই পরিহাসের বস্তু বলে মনে হয়েছিল। এই বিচিত্র আবেগের ফল–’রোমন্থন’, যা পড়ে অনেকে হেসেছেন, আমিও সে হাসিতে যোগ দিয়েছি।

অক্সফোর্ডে বিশ বছর পড়ানোর উপান্তে যখন পৌঁছেছি তখন ইউনিভার্সিটি আমাকে পুরস্কৃত করার সিদ্ধান্ত নেয়। একই সপ্তাহে এক নয়, দু-দুটি মূল্যবান পুরস্কারের খবর আমার কাছে পৌঁছয়। আমার সারা জীবনের ইতিহাসচর্চার পুরস্কার হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি ডি.লিট আমাকে দেওয়া হয়। আর দ্বিতীয় পুরস্কার, অ্যাড হোমিনেম চেয়ার। শুধুমাত্র ব্যক্তিগত গুণাগুণ বিচার করে হাতে গোনা কিছু শিক্ষককে অধ্যাপকের পদে তোলা হয়, প্রায় তিন হাজার শিক্ষকের মধ্যে থেকে এক বছরে মাত্র অল্প কয়েকজন এই সম্মানে সম্মানিত হন। একদিন হাই টেবিলে ডিনারের পর আমাদের নতুন ওয়ার্ডেন লর্ড ড্যারেনডর্ফ আমাকে আড়ালে নিয়ে খবরটা দিলেন। এই ব্যাপারে কমনওয়েলথ ইতিহাসের অধ্যাপক প্রিয় বন্ধু জুডিথ ব্রাউনের কিছু হাত ছিল। আমি তাঁকে সংবাদটি জানালাম। জুডিথ বললেন, চলো, হাসিকে বলবে। শুনে ওর মুখের অভিব্যক্তি কী হয় আমার তা দেখতে ইচ্ছে করছে। সত্যিতে এই খবর দুটি পেয়ে আমার ছেলেমানুষের মতো আনন্দ হয়েছিল। ম্যাট্রিকের ফল বের হবার পর যে রকম উল্লসিত হয়েছিলাম এই আনন্দ তারই সমতুল্য। পরদিন পথে যেতে যেতে মনে হয়েছিল—আমার যারা সত্যিতেই সার্থকসাধন সব সহকর্মী,—যেমন কিথ টমাস বা থিওডর জেলডিন, তাঁদের কি সাফল্যের আনন্দে মনটা সব সময়েই এই রকম উৎফুল্ল হয়ে থাকে। আমার বীণা তো নিতান্তই ছিন্নতন্ত্রী। তার সুর ক’জনের কানেই বা পৌঁছেছে! অ্যাড হোমিনেম চেয়ার যাঁরা পান তাঁদের নিজের উপাধি নিজে বেছে নেওয়ার অধিকার দেওয়া হয়। আমি প্রফেসর অফ ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি অ্যান্ড সিভিলাইজেসন এই উপাধি গ্রহণ করি। করে একটু লজ্জাবোধই হয়েছিল। ভারতীয় সভ্যতার আমি কী-ই বা জানি!

অক্সফোর্ডে পড়াবার সময় বহুবার অন্য দেশে গিয়েছি। কখনও স্যাবাটিকাল ছুটির সময় পড়াবার আমন্ত্রণে, কখনও ছুটকো বক্তৃতা দিতে, কখনও বা কনফারেন্স বা সেমিনারে। তিন মাস কাটে অস্ট্রেলিয়ার রাজধানী ক্যানবারায়, ওখানকার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে। অস্ট্রেলিয়ার অসাধারণ সব জন্তুজানোয়ার, বিচিত্ৰদৰ্শন বহুবর্ণ সব পাখি (যাদের বাজারে দাম হাজার হাজার পাউন্ড) দেখতাম নির্দ্বিধায় ক্যাম্পাসে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যে লাচিয়েনস নয়া দিল্লির স্থপতি তিনিই ক্যানরারও স্রষ্টা। শহর দুটি একই ধাঁচে গড়া। এক ক্যানবারার মাঝখানে একটি মনুষ্যনির্মিত বিরাট হ্রদ আছে। দিল্লিতেও যমুনার জল টেনে এনে এখন যেখানে ইন্ডিয়া গেট সেখানে একটি হ্রদ সৃষ্টি করার পরিকল্পনা ছিল। অর্থাভাবে হয়ে ওঠেনি। ক্যানবারায় সবই আছে। শুধু মানুষ কিছু সংখ্যায় কম। ওখানে বিবাহবিচ্ছেদের হার শুনলাম পৃথিবীতে সর্বোচ্চ। বোধ হয় সংখ্যায় অত কম মানুষ দেখতে দেখতে ব্যক্তিমানুষের কাছে প্রজাতিটাই অসহ্য হয়ে ওঠে। শেষাশেষি ঘরে প্রজাতির যে নমুনাটি আছে সেটিকেও রাস্তায় বের করে দেবার ইচ্ছা জন্মায়। এমন হবারই কথা।

ওই বিশ বছরের মধ্যে নানা দেশে ঘুরেছি। তার মধ্যে দুটি ভ্রমণের স্মৃতি বিশেষ উজ্জ্বল হয়ে আছে। তার প্রথমটির অকুস্থল মেক্সিকো বা ওই দেশবাসীর উচ্চারণে মেহিকে। এক মাসের জন্য পড়াতে গেলাম কলেখিও দে মেহিকোয়। সেখানে কেউই ইংরেজি বোঝে না। ফলে বিচিত্র উপায়ে পড়াতে হল। একটি বা দুটি বাক্য বলার পর দোভাষী তা অনুবাদ করতেন। এক ঘণ্টার ক্লাস দু ঘণ্টা সময় নিত। কিন্তু মেক্সিকো আমার মনে বিশেষ ছাপ ফেলেছিল অন্য কারণে। মনুমেন্ট ভ্যালিতে গিয়ে মনে হয়েছিল–পৃথিবীর বাইরে কোনও গ্রহে এসে পড়েছি। মেক্সিকোর প্রাচীন সভ্যতার পুরাকীর্তি সব দেখে আমার ধারণা হল যে এদের অনুভূতির জগৎ বাকি মনুষ্য প্রজাতির থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। ওদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলি আমাদের চোখে চরম নিষ্ঠুরতায় চিহ্নিত। একটা উদাহরণ দিই। দেবতার উদ্দেশে নরবলি ওদের ধর্মীয় প্রথার অন্তর্গত। সাধারণত রাজসভায় কেউ স্বপ্নাদেশ পেতেন–অমুক ব্যক্তিকে দেবতারা অধিগ্রহণ করতে চান। ব্যস, মাসখানেক তাকে খাইয়ে দাইয়ে দেবতার মতো সম্মানে লালন করা হত। তারপর নির্দিষ্ট দিনে বলিটি মহা বীরত্ব দেখিয়ে ওদের পিরামিডের সিঁড়ি বেয়ে উঠে যেতেন। উপরে নরবলির পাটাতনে তাঁকে শুইয়ে পাথরের ছুরি দিয়ে বক্ষচ্ছেদ করে হৃৎপিণ্ডটি বের করে নেওয়া হত। এই নিবেদন দেবতাদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য এক ভয়ানকদর্শন দেবদূতের হাতে একটি বিরাট ভাণ্ড। মানুষের হৃৎপিণ্ড আর রক্তে সেই ভাণ্ড পূর্ণ করা হত। শুধু এই দেবদূত না, আজটেকদের যাবতীয় দেবদেবীর মুখে এবং দৃষ্টিতে যে মনোভঙ্গির প্রকাশ দেখেছি, মনে হয়েছে আমাদের প্রজাতির মানসিকতার সঙ্গে তার কোনও মিল নেই। এরা অন্য কোনও গ্রহের অন্য কোনও প্রজাতির প্রাণী। পরম দক্ষতার সঙ্গে মেক্সিকোর শিল্পী সেই মনুষ্যেতর প্রজাতির ছবি এঁকেছেন। আমাদের নন্দনবোধ তাতে উদ্দীপিত হয় না। একটা নাম-না জানা ভয়ে প্রাণ যেন শুকিয়ে ওঠে। হাজার বছর পরে কোনও একদিন মানুষ যখন গ্রহান্তরের প্রাণীর সাক্ষাৎ পাবে, তখন কি সেই অজানা প্রজাতি মেক্সিকোর দেবতাদের রূপ নিয়ে দেখা দেবে?

মেক্সিকো বাসের দ্বিতীয় উল্লেখযোগ্য অভিজ্ঞতা ওদের আহার্য। লঙ্কা খাওয়ার ব্যাপারে চাটগাঁ-নোয়াখালির লোক ওদের তুলনায় নিতান্তই শিশু। আর লঙ্কা খাওয়াটা ওরা উচ্চাঙ্গের শিল্পের স্তরে উন্নীত করেছে। এ ব্যাপারে ওরা প্রচণ্ড শ্রেণিভেদে বিশ্বাসী। নয় রকম লঙ্কা আছে। কোন রান্নায় কোনটা ব্যবহার হবে সে ব্যাপারে নিয়মগুলি রঘুনন্দন স্মৃতির মতোই অলঙ্ঘনীয়।

.

১৯৮৬ সনে পাকিস্তান সরকার পৃথিবীর নানা জায়গায় কায়েদ-এ-আজম মহম্মদ আলি জিন্নার নামে কিছু অধ্যাপকের পদ সৃষ্টি করার সিদ্ধান্ত নেন। তার একটি সেন্ট অ্যান্টনিস কলেজের জন্য বরাদ্দ হয়েছিল। পাকিস্তানের শিক্ষাসচিব এ নিয়ে আলোচনার জন্য অক্সফোর্ড আসেন। কলেজের পক্ষ থেকে আমাকে ভার দেওয়া হয় ব্যাপারটা সুরাহা করার। প্রথমে আমি আপত্তি করি। কারণ আমি ভারতবর্ষের নাগরিক। এই আলোচনায় পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ আমার উপস্থিতি পছন্দ নাও করতে পারেন। কিন্তু ওয়ার্ডেন বললেন, তুমি এই কলেজের ফেলে। এ ব্যাপারে তোমার অন্য কোনও পরিচয় নেই। গো অ্যান্ড স্লগ ইট আউট। আলোচনাটি ভালভাবেই উতরে গেল। যাওয়ার আগে শিক্ষাসচিব বললেন, একবার পাকিস্তান এসো না। আমি বললাম, সত্যি? আমি কিন্তু ভারতবর্ষের নাগরিক। উত্তর পেলাম কুছ পরোয়া নেই। আমি তোমাকে আমন্ত্রণ জানিয়ে চিঠি দিচ্ছি। তুমি এসো।

আমন্ত্রণপত্র যখন এল, পাকিস্তান দূতাবাসে গিয়ে বুঝলাম যে ব্যাপারটা আমলাদের মোটেই মনপসন্দ হয়নি। সবাই জ্বলন্ত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাচ্ছিল। ব্যবহার ইংরেজি ভাষায় যাকে বলে কার্ট। তবে ভিসা পেয়ে গেলাম ন্যূনতম বাক্যবিনিময়ের ভিত্তিতে।

অল্প ক’দিনের মধ্যে যে যে জায়গা দেখতে চেয়েছিলাম, পাকিস্তানের ফৌজি সরকার সুষ্ঠুভাবে তা সব দেখার ব্যবস্থা করে দেন। সব কিছুতেই মিলিটারি ডিসিপ্লিনের ছাপ। কোনও অসুবিধে হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। বেশ ধীরেসুস্থে রসেবশে লাহোর, ইসলামাবাদ, করাচি, তক্ষশিলা, মহেঞ্জোদারো, হরপ্পা সবই দেখলাম। একটা জিনিস দেখা বাকি ছিল–পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ ভারতবর্ষ এবং ভারতবাসীদের কী চোখে দেখে। ফেরার দিন দুই আগে লাহোরে নতুন পরিচিত বন্ধুদের বললাম—যদি কর্তাদের আপত্তি না থাকে তো একদিন আনারকলি বাজারে একা ঘুরতে চাই। যে সরকারি কর্মচারীটি আমার দেখভাল করছিলেন তিনি বললেন–ওঁদের উপর নির্দেশ আছে, আমাকে যেন কোনও কাজে বাধা দেওয়া না হয়। আমি জিজ্ঞেস করলাম–বিপদের আশঙ্কা আছে কোনও? স্পষ্ট উত্তর পেলাম–একদম না। তবে আমি যদি চাই তো ওরা কাছেপিঠেই থাকবে–যাতে নিশ্চিন্ত বোধ করি। সে রকমই ব্যবস্থা হল।

ওদেরই কাছে খোঁজ নিয়ে এক বিখ্যাত কাবাবের দোকানে গিয়ে বসলাম। আমি মুখ খুলতেই বোঝা গেল আমি স্থানীয় লোক নই। ছ-সাত ফুট লম্বা কিছু পাঠান আর পঞ্জাবি আমাকে ঘিরে ধরল। কোত্থেকে আসছ? ‘হিন্দুস্তান। মুসলমান না হিন্দু?’ ‘হিন্দু’। ‘কোন অঞ্চলের?’ ‘বাঙালি’। এবার প্রশ্ন—ভারতবর্ষে মুসলমানদের উপর এত অত্যাচার হচ্ছে কেন? বললাম কোথাও কোথাও দাঙ্গা এখনও হচ্ছে ঠিকই, তবে অত্যাচার কথাটা বোধ হয় একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। (অযোধ্যা আর গুজরাত কাণ্ডের পরে হলে আর একথা বলার মুখ থাকত না।) প্রমাণ–এখনও কি তোমাদের দেশে হাজার হাজার মুহাজির আসছে? নিয়মিত অত্যাচার হলে তো আসত। আরও একটা কথা বলি। তোমাদের চেয়ে আমাদের দেশে বেশি মুসলমান আছে, জানো? চোখে অবিশ্বাসের দৃষ্টি। তারপর প্রশ্ন-’তোমরা নাকি সব মসজিদ ভেঙে ফেলছ?’ এবার আমি আপত্তি জানালাম। বললাম আমি খরচা দেব। ইদের সময় তোমরা একজন কাউকে পাঠিয়ে দাও। ইদের নমাজের দিন তাকে আমি দিল্লির জামে মসজিদে নিয়ে যাব। এত সংখ্যক মুসলমান একসঙ্গে নমাজ পড়ছে এ তুমি হজের সময় মক্কার বাইরে কোথাও দেখবে না। বাবরি মসজিদ তথা গুজরাট-কাণ্ডর পর ওই প্রশ্ন হলে এত আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে উত্তর দিতে পারতাম না।

আমার যা বুঝবার তা বোঝা হয়ে গেছে দেখে বিল চাইলাম। এক মুহূর্তে হাওয়া বদলে গেল। দীর্ঘাকার লোকগুলি আমাকে শুধু মারতে বাকি রাখল। তুমি ভেবেছ কী, আঁ! এ দেশে মেহমানরা কাবাবখানায় খেয়ে পকেট থেকে পয়সা দেয় না। আর খাও-ও তো নি তুমি কিছুই। জানি, বংগালিরা কমজোর হয়। তাই বলে লাহোরের মশহুর কাবাবখানায় এসে কিছু না খেয়ে চলে যাবে? এর পর সত্যিকার অত্যাচার শুরু হল। কাবাব যে পরিমাণ এল তা আমার ঊর্ধ্বতন চতুর্দশ পুরুষও খেয়ে শেষ করতে পারতেন না। আরও কঠিন পরীক্ষা আমার ভাগ্যে ছিল। সমঝদার খদ্দেররা বললেন, আরে, আসল জিনিসই তো খাওয়া বাকি আছে। এখানকার মশহুর চা-ই তো খাওনি। এক ফোঁটা পানি না দিয়ে সেই চায়ে তৈয়ার হয়। বিরাট গুম্ফবান সাত ফুট উঁচু মালিক গম্ভীর স্বরে বললেন, হাঁ-আঁ-আঁ! এক বৃন্দ ভি নেহি! সেই পানিহীন প্রায় সলিড চা এল। আইসবার্গের সাইজের মোটা মোটা সর ভাসছে। দেখেই আমার অন্নপ্রাশনের ভাত উঠে আসার জোগাড়। পড়েছি মোগলের হাতে। অতএব ওই অপেয় পানীয় পান করতে হল। এর চেয়ে ওরা যদি আমাকে গলা টিপে মারত তো কষ্ট কম পেতাম। ধুকতে ধুকতে উঠে দাঁড়িয়ে বিদায় চাইলাম। এবার আর এক পরীক্ষা। বিরাট বিরাট সব মানুষ আমাকে ভল্লুক-আলিঙ্গনে আবদ্ধ করতে লাগল। আমার ধারণা ভল্লুকের দেহবাস তুলনায় কম তীব্র। প্রাণবায়ু কণ্ঠাগত। ওদের চোখ দেখলাম সত্যিই অশ্রুসজল। কানে শুনলাম, ‘বুরা না মানিয়েগা। হাম তো সব একই হ্যায়’। আমরা সব এক? সমস্ত মনুষ্য জাতিও তো এক। এই জ্ঞান আমাদের গণ্ডমূর্খ প্রজাতির কোনও দিন কি হবে?

এই রচনার মুখবন্ধেই বলেছি সনাতন অক্সফোর্ডও আর ১৯৫০-এর দশকের অক্সফোর্ড নেই। এবং ১৯৮০-র দশক থেকে আরও দ্রুত পরিবর্তন শুরু হয়েছে। প্রথম বাহ্যিক চেহারার কথাই ধরি। একটি রাস্তা মোটরগাড়ি শূন্য করা হয়েছে। এ তো অতি সুসংবাদ। কর্নমার্কেট পঞ্চদশ শতকে ফিরে গেলে তার চেয়ে আনন্দের আর কী হতে পারে! কিন্তু তা তো ঘটেনি। যে লায়ন্স কর্নারে সম্ভবত তাঁর জাসুসি কাহিনির খাঁটি আবহাওয়ার সন্ধানে পর্যবেক্ষণরতা আগাথা ক্রিস্টিকে দেখেছিলাম, সেই লায়ন্স কর্নার অনেকদিন আগেই উঠে গেছে। ফুলার্সের চা-ঘর তার ভুবনবিজয়ী শশার স্যান্ডুইচ সহ অদৃশ্য হয়েছে। সে যুগে অতি আধুনিক এসপ্রেসো কফির আজ্ঞা–যেখানে এক রথসচাইল্ড কন্যা শখের ওয়েট্রেস হয়ে কাজ করতেন, সেই লা রোমাও অন্তর্হিত। ১৯৯০-এর দশকে কর্নমার্কেট জুড়ে এক অতি আধুনিক এবং অতি কুৎসিত শপিং আর্কেড তৈরি হয়েছে। অক্সফোর্ডের পুরনো ছোটখাটো স্টেশনটির জায়গায় এক বীভৎস বিরাট ইস্টিশন দাঁড়িয়ে আছে। কলেজগুলি তাদের সংখ্যায় বর্ধমান ছাত্রগোষ্ঠীর জন্য নতুন নতুন বাড়ি তুলেছেন। বলা হয় সেগুলি শহরটির মধ্যযুগীয় পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়েই তৈরি। এ কথার অর্থ আমার বোধগম্য হয়নি। উত্তর অক্সফোর্ডে পুরনো ভিক্টোরীয় যুগের বাড়িগুলি ভেঙে সব ফ্ল্যাটবাড়ি তৈরি হচ্ছে। তার ঘরগুলি বেড়ালের লেজ ধরে ঘোরানো চলে এত প্রশস্তও নয়। এরাও শুনি শহরের বাস্তশিল্পের ঐতিহ্য মেনেই বানানো। তা হবে! বাজারগুলি থেকে ছোট ছোট ফল, তরকারি, মাছ-মাংসের দোকানগুলি উঠে গিয়ে তার জায়গায় সব সুপার মার্কেটের রাজত্ব। ব্যাঙের ছাতার মতো নানা ট্রেডি রেস্তোরাঁ আজ গজাচ্ছে কাল উঠে যাচ্ছে। সেসব জায়গায় খাদ্যের দাম জেয়াদা, সোয়াদ বুরা। ভালর মধ্যে তিন-তিনটি থাই রেস্টোরেন্ট রীতিমতো সুখাদ্য পরিবেশন করছে। লেবাননও তার সুখাদ্যের দুয়ার মেলে ধরেছে। কিন্তু নয়া ব্রিটিশ কুইসিনের নামে যেসব বিপণি স্থাপিত হয়েছে, কেন যে ওল্ড টেস্টামেন্টের সদাক্রুদ্ধ দেবতা আগুন আর জ্বলন্ত কয়লা বৃষ্টি করে তাদের ধ্বংস করেন না, এ কথা আমার বুদ্ধির অগম্য।

কিন্তু অক্সফোর্ড যতই বদলাক, একটু খোসা ছাড়ালেই সেই অক্সফোর্ডেই আছে। ব্রড স্ট্রিট, লং ওয়াল স্ট্রিট, হাই স্ট্রিটের চেহারা পরিবর্তনহীন। নিউ কলেজের অতি সুন্দর ক্লয়েস্টার আর ভোজনকক্ষে কোনও স্থূল হস্তাবলেপন হয়নি। ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউটের জানালা দিয়ে স্বপ্নমগ্ন মিনার-খচিত নভোমণ্ডলের যে ছবি দেখতে পাই, সেও তো অব্যয়। মার্টন স্ট্রিটের পঞ্চদশ শতকীয় চেহারা একই আছে। আর পার্কসের ভিতর দিয়ে চারওয়েল একই ভাবে বয়। সেখানকার গাছগুলির পাতা হেমন্ত সমাগমে এখনও তাম্ৰাভ হয়ে ওঠে। গ্রীষ্মে নৌকোর আশ্রয়ে তরুণ-তরুণীরা আগের মতোই পরস্পরে মগ্ন হয়। না, অক্সফোর্ড যতই বদলাক, সেই অক্সফোর্ডই থাকে। লা প্ল সা শাঁজ….

কথাটা ঠিক, আবার ঠিকও না। পঞ্চাশের দশকে যত দূর জানি সরকারি ইস্কুল থেকে মুষ্টিমেয় ছাত্রই আসত। তার মধ্যে শ্রমিকশ্রেণির ছেলেমেয়ে প্রায় হাতে গোনা যেত। এখন বোধ হয় সরকারি স্কুল থেকে যেসব ছাত্র আসে তারা মোট ছাত্রসংখ্যার প্রায় চল্লিশ দশমাংশ বা তারও বেশি। আর শ্রমিকশ্রেণির থেকে আসা ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা বেশ বেড়েছে। অভিজাত স্কুলের ছেলেরা আগের মতো তাদের পরিচয় নির্দ্বিধায় ঘোষণা করে না। যখন ছাত্র ছিলাম তখন গ্রীষ্মের মরসুমে প্রায়ই দেখতাম স্বর্ণমণ্ডিত তরুণরা সকালবেলা শ্যাম্পেন ব্রেকফাস্ট খাচ্ছেন। বহু দিনের মধ্যে তুলনীয় দৃশ্য চোখে পড়েনি। শ্রমিকশ্রেণির ছাত্রছাত্রীরা আগের মতো কুঁকড়ে থাকে না। বড় ঘরের ছেলেরা অত বুক ফুলিয়ে চলে না। অক্সফোর্ড ইউনিয়ন নামে ছাত্রদের বিখ্যাত ডিবেটিং ক্লাব তার আগের মর্যাদা হারিয়েছে। এখন আর ওখানকার সভ্য হওয়া কেউ আবশ্যিক মনে করে না। অন্য পাঁচটা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো এখানেও ছাত্র ইউনিয়ন হয়েছে। সেখানে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল রীতিমতো পাঞ্জা লড়ে।

ছাত্রছাত্রীদের মনোভঙ্গিতেও একটা বড় পরিবর্তন এসেছে। আগে দেখতাম পরীক্ষার ফল নিয়ে অনেকেই খুব মাথা ঘামাত না। পড়তে এসেছে, যা ভাল লাগত তাই পড়ত। অনেকেই একাধিক ভাষা জানত। ধনী ঘরের ছেলেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে মাথা ঘামাতে হত না। মধ্যবিত্তরাও জানত অক্সফোর্ডের ডিগ্রি ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার গ্যারান্টি। এখন সে যুগ বদলে গেছে। অনেকেই পরীক্ষার কথা ভেবে খুব খেটে পড়ে। পড়ানোর ব্যাপারেও পরীক্ষার দিকে নজর দেওয়া হয়, যা কি না আগে একেবারেই রেওয়াজ বহির্ভূত ছিল। আর একটা পরিবর্তন ঘটেছে। পঞ্চাশের দশকে ধনী ছাত্ররাই বিদেশভ্রমণে যেত। মধ্যবিত্তরা কচিৎ কখনও। এখন সবাই ছুটিতে বেড়াতে যায়। তার জন্য পয়সা রোজগারও করে। ফলে পড়ার জন্য বাকি সময়টা একটু কমের দিকেই থাকে।

আর এক ব্যাপারে মস্ত পরিবর্তন হয়েছে। কে কী পরবে–মাস্টার-ছাত্র কেউই তা নিয়ে বেশি মাথা ঘামান না। গাউন পরা তো পরীক্ষার সময় ছাড়া অন্য সময়ে উঠেই গিয়েছে। সকালবেলা সাইকেলবাহন গাউন পরা ছাত্রছাত্রীদের ক্লাসে যাওয়ার দৃশ্য বড় ভাল লাগত। এখন শুধু পরীক্ষার সময়ে ওই দৃশ্য চোখে পড়ে। আর পরিধেয় সম্বন্ধে সবারই বড্ড বেশি বেপরোয়া ভাব। টাই পরা তো প্রায় উঠেই গিয়েছে। সন্ধেবেলা ইভনিং ড্রেস পরে দলে দলে স্ত্রী-পুরুষ সান্ধ্যভোজ বা কনসার্টে চলেছে–এমন দৃশ্যও বর্তমান দশকে নিতান্তই বিরল। দৈনন্দিন জীবনে আর একটু রং আর একটু চাকচিক্য বজায় থাকলে বোধ হয় মন্দ হত না।

অ্যাট্টিলার নারী অবতার ম্যাণি থ্যাচারের রাজত্বে শিক্ষার মান নিচু করার জন্য যেসব বিচিত্র ব্যবস্থা হয়, তার অভিঘাত অক্সফোর্ডের জীবনেও অত্যন্ত স্থূলভাবে দেখা দেয়। এক নতুন শব্দ বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনে অন্ধকার ছায়া ফেলল। তার নাম অ্যাকাউন্টেবিলিটি। অর্থাৎ হিসাব দাও। সব কিছুরই হিসেব দিতে হবে। মহিলা রোজ সন্ধ্যায় পিতৃদেবকে হিসেব মেলাতে দেখেছেন। সুতরাং রাজ্যভার কাঁধে নিয়ে উনি যে সকলের কাছে হিসেব চাইবেন–এ আর বিচিত্র কী? মাস্টার পণ্ডিতদের কাছে কীসের হিসেব চাওয়া হবে? ভাল পড়ানোর হিসেব হয় না, মেধা বা পাণ্ডিত্য বাটখারায় মাপা যায় না, বিদ্যার জগতে মহান সৃষ্টির মাহাত্ম্য দৈর্ঘ্য-প্রস্থ মেপে নিক্তিতে ওজন করে বিচার হয় না। তবে? এসব সামান্য আপত্তিতে ভবি ভুলবার নয়। গুণ মাপা কঠিন হতে পারে, কিন্তু ওজন মাপার তো নানা উপায় আছে। বছরে ক’ঘণ্টা ক্লাস নিয়েছ, ক’টা মিটিংয়ে অংশগ্রহণ করেছ, ক’টা বই, ক’টা প্রবন্ধ লিখেছ, প্রবন্ধগুলি দৈর্ঘ্যে ক’পাতা–এসবের তো হিসেব সম্ভব। সেই হিসেবই দাও। তার ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের মান নির্ণয় করা হবে। আমার মনে হল এই স্ত্রীলোক বিশ্ববিদ্যালয় করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। মার্কিন শিক্ষাজগতের পাবলিশ অর পেরিশ-এর আদর্শ ব্রিটিশ শিক্ষাজগতে ভিত গাড়ল। আশ্চর্য ব্যাপার এই ম্যাগি যে সুশিক্ষার মূলে কুঠারাঘাত করছেন তাতে কেউ বিশেষ আপত্তি করলেন না। অনেক দিন ইংরেজদের দেখে আমার ধারণা জন্মেছে–এঁরা অতি নিয়মনিষ্ঠ জাতি। কর্তারা যে হুকুমই দিন, সেটা মেনে চলাই ওঁদের স্বভাব যতদিন না সেটা সম্পূর্ণ অসহ্য হয়ে ওঠে। তখন এঁরা সশস্ত্র বিদ্রোহ করেন। ইতিহাসের নজির এই। যেসব বিচিত্র ব্যবস্থা চালু হতে লাগল, তাতে সবাই লাঠিসোটা দা-কুড়াল হাতের কাছে যা পাওয়া যায় তাই নিয়ে ডাউনিং স্ট্রিটের দিকে ধাবিত হল না কেন–এটা আমার কাছে রহস্যাবৃত রয়ে গেছে।

নয়া জমানার একটা উদাহরণ দিই। সেল্ফ অ্যাসেসমেন্ট নামে এক বিচিত্র অনুষ্ঠান চালু হল। এটা নাকি ব্যবসার জগতে খুবই চালু। আর ব্রিটিশ বিশ্ববিদ্যালয়গুলির ব্যবসাজগৎ থেকে দক্ষতার ব্যাপারে শিক্ষা নেওয়া নিতান্ত প্রয়োজন। সুতরাং ম্যানেজমেন্ট পণ্ডিতরা কী করে পরস্পরকে সেল্ফ অ্যাসেসমেন্টে সাহায্য করতে হবে আমাদের তা শেখাতে এলেন। শিক্ষকরা পরস্পরকে ‘সেল্ফ অ্যাসেস’ করবেন। যেমন ধরুন সংস্কৃতের অধ্যাপক ইজিপ্টোলজির অধ্যাপককে। তাঁরা রোজই কমনরুমে এগারোটার সময় একসঙ্গে কফি খান। তা বললে চলবে না। যিনি ইন্টারভিউ নিচ্ছেন তিনি ইন্টারভিউইর ঠিক মুখোমুখি না, একটু ট্যারচা হয়ে পায়ের উপর পা তুলে বসবেন (বিশ্বাস করুন, আমি একটুও বাড়াচ্ছি না)। তারপর সেল্ফ অ্যাসেসমেন্ট শুরু হবে। এই দিব্যজ্ঞান আমরা ম্যানেজমেন্ট এক্সপার্টদের পদতলে বসে লাভ করলাম।

অধ্যাপকরা অবসর নেওয়ার সময় ওখানে একটি সুন্দর প্রথা আছে। ফ্যাকাল্টি বোর্ডের সভাপতি অবসরমুখিন অধ্যাপকের কাছে তাঁর দীর্ঘদিন অক্সফোর্ডে পড়ানোর অভিজ্ঞতা বিষয়ে একটি লিখিত মন্তব্য চান। আমি লিখেছিলাম–এখানে পড়াতে এসে সত্যিই আমার স্বপ্ন সফল হয়েছে। যা আশা করেছিলাম সবই পেয়েছি। তার বেশিও অনেক কিছু ভাগ্যে জুটেছে। কিন্তু বিদায়ের মুহূর্তে মা কী হইতেছেন এবং হইলে দেখে বড় আহত বোধ করেছি। ব্রিটেনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মান ও খ্যাতি জগদ্ব্যাপী। বলতে বাধা নেই, প্রতিযোগিতার মুখে বিশ্ববাসীর চোখে ওদেশের শিল্পবাণিজ্য তুলনীয় সম্মানের যোগ্য নয়। তবে কেন আমাদের ম্যানেজমেন্ট বিশেষজ্ঞদের কাছে আমাদের ঘর সামলাবার জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষা নিতে হবে? কেন আমরা সবাই এই নয়া নীতি বিনা প্রতিবাদে মেনে নিলাম? চিঠি পেয়ে ভদ্রলোক উত্তর দেন–উনি আমার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত। কিন্তু আমরা সম্পূর্ণ নিরুপায়। সত্যিই কি অক্সফোর্ড অতটা নিরুপায় ছিল? শুধু একমুঠো টাকার জন্য। আমরা আমাদের ঐতিহ্য বিপন্ন করলাম। সে টাকা সারা পৃথিবীতে ছড়ানো আমাদের ছাত্রছাত্রী সমর্থকরা তুলে দিতেন না?

ইতিহাস বিভাগে নতুন পাবলিশ অর পেরিশ নীতি নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। একজন বললেন, আমাদের প্রজন্মের শ্রেষ্ঠ ঐতিহাসিক কিথ টমাস তাঁর প্রথম বইটি লিখতে আঠেরো বছর সময় নিয়েছিলেন। এখনকার দিনে হলে তাঁর চাকরি চলে যেত–দীর্ঘদিন কিছু না লেখার অভিযোগে। প্রত্যুত্তরে এক ব্যক্তি মন্তব্য করলেন উই ক্যান নট অ্যাফোর্ড দ্যাট সর্ট অফ থিং এনি লংগার। কেন রে বাবা? এমন কী ঘটেছে যাতে কিথ টমাসের মতো অসামান্য প্রতিভাবান লোককে নিশ্চিন্তে দীর্ঘদিন বসে তাঁর অসাধারণ সৃষ্টির কাজ করতে দিতে পারি না? কেন তার মতো মানুষদের বছরে দু-তিনটে প্রবন্ধ লিখতে বাধ্য করা হবে? এসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মতো সময় কারও নেই।

১৯৫০-এর দশক থেকে আর এক ব্যাপারে অক্সফোর্ড অনেক দূরে চলে এসেছে। যত দূর জানি–সেই সময় মাত্র দু’জন বাঙালি স্থায়ীভাবে ওই শহরে বাস করতেন। তাঁদের মধ্যে একজন প্রবাদপুরুষ দার্শনিক বসন্ত মল্লিক, একদা রবার্ট গ্রেভস-এর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তিনজন ইংরেজ মহিলা ওঁর ভরণপোষণের ভার নিয়েছিলেন। উনি তাঁদের রহস্য করে মাই গোপিস বলে উল্লেখ করতেন। কিন্তু ১৯৭৩ সনে অক্সফোর্ড পৌঁছে দেখি—গোটা তিরিশ মধ্যবিত্ত বাঙালি হিন্দু পরিবার ওখানে বাস করছেন। বাংলাদেশি দোকানদার, সবজি বিক্রেতা, রেস্টোরেস্টের মালিক ইত্যাদি বেশ কিছু আছেন। তাঁরা এই হিসেবের মধ্যে পড়েন। আমরা প্রথমেই ঠিক করেছিলাম আমরা কোনও বাঙালি গেটোর (ghetto) শামিল হব। বিদেশে কোনও বাঙালির সঙ্গে দেখা হলেই সাধারণত প্রথম প্রশ্ন ‘কোথায় থাকেন’-এর পর অবশ্যম্ভাবী দ্বিতীয় প্রশ্ন ওখানে ক’জন বাঙালি আছে।এ প্রশ্নের উত্তরে আমি একবার বলেছিলাম, আমি লোকগণনা বিভাগে কাজ করি না। উত্তরটা আমার জনপ্রিয়তা বাড়ায়নি। কোনও ব্যক্তি বাঙালি–সেই হেতু তার কণ্ঠলগ্ন হওয়া আমার পক্ষে আবশ্যিক, এ তত্ত্বে আমি বিশ্বাসবান নই। হলে আমাকে উনত্রিশ কোটি কণ্ঠ আঁকড়ে ধরতে হত। সহ্য হত না। আমার বাহু বড় দুর্বল। কলকাতা শহরেই কমবেশি বেশ কয়েক লক্ষ বাঙালির বাস। এখানে শুধুমাত্র বাঙালি এই কারণে কেউ বন্ধুত্ব পাতায় না, পাতালে জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠত। মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক নানাভাবে গড়ে ওঠে। এক ভাষা বলি–শুধু এই কারণে বন্ধুত্ব স্থাপন নিতান্তই কৃত্রিম ব্যাপার। অস্বাস্থ্যকরও বটে। বিদেশে শুধু এই ভাষার ভিত্তিতে সব বাঙালিগোষ্ঠী গড়ে ওঠে। তাদের প্রধান আনন্দ হয়ে দাঁড়ায় যাকে এক বন্ধু ‘কারি এক্সচেঞ্জ ক্লাব’ বলে বর্ণনা করেছিলেন তাই। প্রতি সপ্তাহান্তে কারও না কারও বাড়িতে বহু পদসমৃদ্ধ ভোজনামোজন তার প্রায় একমাত্র লক্ষ্য। মাঝে মাঝে মাছের ঝোলের সঙ্গে রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশিত হয়। কিন্তু এই মাছভাত আর রবীন্দ্রসঙ্গীতের দুর্ভেদ্য দেওয়াল স্থানীয় বিদেশি সংস্কৃতিকে ‘দূর হটো, দুনিয়াওয়ালে’ বলে সম্পূর্ণ নির্বাসিত করে। স্থানীয় সাহিত্য, সঙ্গীত, শিল্প, নাটক, সিনেমা ইত্যাদির সঙ্গে কারি ক্লাবের সভ্যদের সাধারণত কোনও পরিচয় ঘটে না। ওদেশে ত্রিশ বছর বাস করছেন এই রকম একজন উচ্চশিক্ষিত পেশাদার বাঙালি মহিলা ন্যাশনাল গ্যালারির প্রসঙ্গ উঠলে প্রশ্ন করেছিলেন—’ওখানে বুঝি অনেক বই আছে?’ পরস্পরকে আঁকড়ে ধরে বহু প্রবাসী বাঙালি এক দ্বৈপায়ন জীবনযাপন করেন। আমি যা বলছি তা আমার সীমিত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে। তার ব্যতিক্রম অবশ্যই থাকতে পারে। এ জীবন থেকে শত হস্ত দূরে থাকা আমার বাঞ্ছনীয় মনে হয়েছে। আর অক্সফোর্ড এসেই শুনি–অতুলবাবু হাসিকে কত লক্ষ টাকা দিয়েছিলেন তা নিয়ে উত্তপ্ত আলোচনা চলছে। তবে শেষাশেষি দু’লাখ টাকাটাই আসল অঙ্ক এরকম একটা সমঝোতা হয় বলে শুনতে পাই। অচিন্ত্য সেনের নির্ভরযোগ্য সাক্ষ্য এ ব্যাপারে কাজে লেগেছিল সন্দেহ নেই। আমাদের জীবন সম্বন্ধে এই উগ্র কৌতূহলও বাঙালি গেটো থেকে আমাদের দুরে থাকতেই উৎসাহিত করে। এই সিদ্ধান্ত আমাদের জনপ্রিয়তা বাড়ায়নি। যথাকালে কিছু অক্সফোর্ডবাসী বাঙালির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল। তবে তার কারণ তাঁদের বাঙালিত্ব না, মনের মিল।

অক্সফোর্ডের বাঙালিদের কথা বলতে গিয়ে দুটি মানুষের কথা বিশেষ করে মনে পড়ছে। তার একজন, অধ্যাপক বিমলকৃষ্ণ মতিলাল, যিনি টরন্টো থেকে স্পন্ডিং প্রফেসর হয়ে অক্সফোর্ড আসেন। আর দ্বিতীয় ব্যক্তি, প্রবাদপুরুষ নীরদচন্দ্র চৌধুরী। বিমল শান্ত, সংযত, লাজুক প্রকৃতির মানুষ। বিদ্যা, তার চেয়েও ধীশক্তিতে অসাধারণ ব্যক্তি। ওঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল, কিন্তু ঠিক বন্ধুত্ব হয়নি। ওঁর চিন্তার ধরনটা ছিল সম্পূর্ণ অ্যাবস্ট্রাক্ট। তার সঙ্গে তাল রেখে চলার মতো বিদ্যাবুদ্ধি আমার ছিল না। এই মানুষটিকে অক্সফোর্ডের সবচেয়ে সম্মানিত দার্শনিকরা ডামেট এবং স্ট্রসনের মতো লোক বিশেষ শ্রদ্ধার চোখে দেখনে। কিন্তু উনি নিজেকে অবাঞ্ছিত মানুষ বলে মনে করতেন। কারণ ওঁর কথ্য ইংরেজি পাবলিক স্কুল বয়দের মতো ছিল না। ওঁকে অনেকবার বোঝাবার চেষ্টা করেছি–ওঁর আত্মজ্ঞান সত্যভিত্তিক না। অতি বুদ্ধিমান মানুষটি ভাবতেন–ওঁকে প্রবোধ দেওয়ার চেষ্টা করছি। নেহাতই অল্প বয়সে ওঁর হাড়ের ভিতরকার মজ্জায় ক্যানসার ধরা পড়ে। সেদিন আমিই ওঁকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলাম। পরীক্ষার পর ডাক্তার নির্দ্বিধায় বললেন বিষয়-আশয় সংক্রান্ত যা ব্যবস্থা করার করে ফেলুন। আপনি আর বছর তিনেক বাঁচবেন। ঠিক তিন বছরের মাথায় উনি মারা যান। মৃত্যুর দুদিন আগে ওঁর শেষ প্রবন্ধটি লিখে এক ছাত্রের হাতে দেন ‘দেশ’ পত্রিকায় পাঠিয়ে দেবার জন্য। বিমল মরতে চাননি। ওঁর আরও অনেক কাজ বাকি ছিল। কিন্তু অবাঞ্ছিত মৃত্যুকে তিনি শান্ত চিত্তে মেনে নিয়েছিলেন। মহাভারত থেকে দুর্যোধনের মৃত্যুর দৃশ্যটি উনি একদিন আমাকে পড়ে শুনিয়েছিলেন। অন্যায় যুদ্ধে বীরের মৃত্যুর বিবরণ সম্ভবত ওঁকে নিজের অকালে আসন্ন মৃত্যুর কথা স্মরণ করিয়ে দিত।

নীরদবাবুর মতো বিচিত্র চরিত্রের মানুষ আমি আর কাউকে দেখিনি। এখানে একটা কথা বলা প্রয়োজন মনে করি। ওঁকে যতটা ঘনিষ্ঠভাবে চেনার সুযোগ আমি পেয়েছিলাম তেমন আর কেউ পায়নি বলেই আমার বিশ্বাস। অনেকেই ওঁর পাণ্ডিত্য আর অসাধারণ স্মৃতিশক্তির কথা বলে। ওঁর চেয়ে বেশি পাণ্ডিত্য আমি বাঙালিদের মধ্যে সুখময় চক্রবর্তী, রবি দাশগুপ্ত এবং অমলেশ ত্রিপাঠীর মধ্যে দেখেছি। এবং সম্ভবত স্মৃতির ব্যাপারে ত্রিপুরারিবাবু ওঁকে ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু এক ক্ষেত্রে ওঁর সঙ্গে তুলনীয় কাউকে আমি দেখিনি। জীবন ওঁর কাছে অন্তহীন আকর্ষণের বস্তু ছিল। ওঁর স্মৃতির ভিত্তি সেই আকর্ষণজাত কৌতূহলে। ওঁর প্রতিবেশী ইংরেজ ভদ্রলোকের কাছে শুনি কীভাবে তাঁর নীরদবাবুর সঙ্গে পরিচয় হয়। একদিন দরজায় ঘণ্টা শুনে বের হয়ে এসে ভদ্রলোক দেখেন–থ্রি পিস স্যুট, বোলার হ্যাট আর বো টাই পড়ে নীরদবাবু দাঁড়িয়ে আছেন। উনি একটি অনুরোধ নিয়ে গিয়েছিলেন। ওঁর শোওয়ার ঘর থেকে ভদ্রলোকের বাগানের একটি ফুলগাছ চোখে পড়ে। উনি জানতেন যে ওই ফুলের পাপড়ির উপরের আর নীচের রং আলাদা। নীচের রংটি কী সেই কৌতূহল মেটাবার জন্য তিনি এসেছেন। নীরদবাবুর বয়স তখন পঁচানব্বই।

দেশভ্রমণ করার মতো সম্বল ওঁর ছিল না। কিন্তু পুস্তকের পৃষ্ঠা থেকে ওঁর বিশ্বদর্শন হয়েছিল। বিশেষ করে ইউরোপ সম্পর্কে এ কথাটা খাঁটি সত্য। ঈজিপ্ট থেকে ফিরে ওঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছি। উনি ভ্যালি অফ কিংস সম্পর্কে পুত্থানুপুঙ্খ সব প্রশ্ন করতে লাগলেন। আমি টুরিস্ট হিসেবে গিয়েছি। যদিও আমরাও এম.এ ক্লাসে মিশরের ইতিহাস পড়েছি, কিন্তু অত খুঁটিয়ে পড়া হয়ে ওঠেনি। ওঁর প্রশ্ন শুনে মনে হল–উনি যেন কালই ও-দেশ থেকে ঘুরে এসেছেন। ওঁর ঘরে আমি মিশর-বিষয়ক কোনও বই দেখিনি। তাই জিগ্যেস করলাম–আপনি শেষ কবে মিশর সম্বন্ধে পড়াশুনো করেছেন? হিসেব করে বললেন–সত্তর বছর আগে। ওঁর স্মৃতিশক্তি না, অন্তহীন জীবনরস মিশরের ইতিহাস ওঁর চেতনায় বাঁচিয়ে রেখেছে। আর একবার বার্লিন থেকে ফিরেছি। তারপর ওঁর ব্যগ্র সব প্রশ্ন। ওদের বিখ্যাত মিউজিয়াম পশ্চিম না পূর্ব বার্লিনে? প্রাচীন ব্যাবিলনের রাজপ্রাসাদ কি এখনও ওখানে আছে? আর নেফরতিতির অসমাপ্ত মূর্তিটি? শেষোক্ত বস্তুটির একটা ছবি নিয়ে এসেছিলাম। দেখালাম। বললেন, আবার কখনও গেলে আমার জন্য একটি আনবেন। এনেও দিয়েছিলাম। তারপরই ওঁর স্বভাবসিদ্ধ ছেলেমানুষি শুরু। টেম্পেরা রং করে ছবিটিতে কিছু বস্তুসংযোগ করে দ্বিমাত্রিক ছবিটিকে ত্রিমাত্রিক করার ব্যর্থ প্রয়াস। বললেন, হাত দিয়ে দেখুন, একদম জীবন্ত মনে হবে। আবক্ষমূর্তির ছবি। কোথায় হাত দিয়ে তার ত্রিমাত্রিকতা পরীক্ষা করব? সাড়ে তিনি হাজার বছর আগেকার এই অসাধারণ সুন্দরীর শ্লীলতা অক্ষুণ্ণ রইল।

ওঁর মৌলিকতার দিকটা পাঠক বা সমালোচক কেউই যথেষ্ট খেয়াল করেনি। ওঁর অনেক ধ্যানধারণা উদ্ভট সন্দেহ নেই। কিন্তু ওঁর মৌলিকতার ইতিবাচক দিকটা ভুললে ক্ষতিটা আমাদেরই। একটা কথা উনি বারবারই বলনে। রবীন্দ্রনাথের দশটি গল্প বিশ্বসাহিত্যের চিরন্তন সম্পদ। সে গল্পগুলি বিশিষ্টভাবে বাঙালি হয়েও বিশ্বজনীন। কবি নিতান্তই বাঙালি কবি, বিশ্বকবি পরিচয়টা ওঁর অনিষ্ট করেছে। বাংলার জলপথ, ছায়াঘেরা গ্রাম ওঁর চেতনার কেন্দ্রস্থলে। মনে হত মানুষটির নিজের শৈশবচেতনা, ওই উদার জলপথ আর ছায়াঘেরা গ্রামের স্মৃতি, ওঁর চিন্তাকে প্রভাবিত করেছিল। রবীন্দ্রনাথের রচনা ওঁর জীবনে কতটা জায়গা জুড়ে ছিল, ওঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয় না হলে তা জানতে পারতাম না। একদিন ওঁর প্রিয় ছোটগল্প ‘দৃষ্টিদান’ পড়ে শোনাচ্ছেন। শেষ অংশে পৌঁছে হঠাৎ হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলেন। বললেন, আমি এ আর পড়তে পারি না।ওঁকে দিয়ে ওঁর প্রিয় দশটি গল্প অনুবাদ করাবার বহু চেষ্টা করেছি। কিন্তু বললেই উনি বিশ্বভারতীকে গাল পাড়তে শুরু করতেন। সেখানেই আমার প্রস্তাবের ইতি।

ওঁর সঙ্গে আলোচনায় অনেক সময়েই ওঁর প্রিয় নেতি ও ইতিবাচক কয়েকটি কথা বারবার ফিরে আসত। তার আলোচনায় লাভ নেই। ওঁর লেখার সঙ্গে যাঁরা পরিচিত, তাঁরা এইসব কথা অনেকবারই পড়ে থাকবেন। কিন্তু মাঝে মাঝে ওঁর মাথায় যেসব চিন্তা আসত সেগুলি অসাধারণ স্বকীয়তায় ভাস্বর। এক সন্ধ্যায় গিয়ে দেখি উনি কুমারসম্ভবম পড়ছেন। বললেন–একটা কথা মনে হচ্ছে। কালিদাস ও অন্যান্য প্রাচীন সংস্কৃত কবিদের রচনায় দুটি প্রায় সম্পূর্ণ পৃথক জগতের ছবি আছে। ওঁরা যখন নরলোকের কথা লেখেন তখন তাতে সমসাময়িক জীবনের বর্ণনা। আর দেবলোকের বিবরণীতে প্রাচীন ভারতের যে ছবি এঁদের মনে জাগরূক ছিল তারই প্রতিফলন। আর একদিন কবি ভবভূতির বিখ্যাত আত্মঘোষণার এক অভিনব ব্যাখ্যা দিলেন। কবি লিখেছেন। “কালোহ্যয়ং নিরবধি বিপুলা চ পৃথী”, সুতরাং কখনও কোথাও তাঁর সমানধর্মা কেউ হবে। শ্লোকটিকে সাধারণত এক অসামান্য আত্মশ্লাঘার অভিব্যক্তি বলে ধরা হয়। নীরদবাবুর মতে সংস্কৃত সাহিত্যে সূক্ষ্ম অথচ বলিষ্ঠ আদিরসের প্রকাশ আছে, কিন্তু রোমান্টিক প্রেম বলতে যা বুঝি তার কোনও স্থান নেই। ব্যতিক্রম উত্তররামচরিত। সমসাময়িকরা ওই অপরিচিত অনুভূতির বিবরণ বুঝতে পারেননি। উক্ত শ্লোকটি সেই বোঝা নিয়ে আক্ষেপ, অহমিকার প্রকাশ না। অনেক বলেছিলাম—এই কথা প্রবন্ধাকারে প্রকাশ করতে। কে কার কথা শোনে!

এই অসাধারণ মানুষটির ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে এসে আমি নানা দিক থেকে লাভবান হয়েছিলাম। কিন্তু প্রদীপের নীচেই যে ঘন অন্ধকার ছিল তার কথা না লিখলে অর্ধসত্য প্রচারের দোষে দোষী হব। বঙ্কিমের এক ভক্ত লিখেছিলেন–ওঁর দম্ভের কথা না বললে ওঁর চরিত্রচিত্ৰণ অসম্পূর্ণ থাকে, বিবরণীটা মিথ্যাভাষণ হয়ে দাঁড়ায়। নীরদবাবুর জীবনে ওঁর ‘দোষের দিক’ আলোচনা না করলেও মিথ্যাভাষণই হয়। শুধু ওঁর দোষগুলি ঠিক ব্যক্তিগত গুণাগুণের ফর্দে পড়ে না। বিদেশি শাসনে আমাদের জীবনভরা ব্যর্থতা আর অপমান আমাদের চেতনায় নানা বিকৃতির সৃষ্টি করেছিল। প্রচণ্ড জীবনীশক্তিসম্পন্ন ক্ষুদ্রকায় মানুষটির ব্যবহারে সেই বিকৃতিগুলি বড় বেশি প্রকট ছিল। ওঁদের প্রজন্মে অসাধারণ প্রতিভাসম্পন্ন বাঙালি সংখ্যায় কিছু কম ছিল না। কিন্তু ভিক্টোরীয় যুগের সীমিত সুযোগসুবিধে এডওয়ার্ডীয় যুগে শেষ হয়ে গেছে। প্রতিভাবান মানুষগুলি বিদেশি শাসনে তাঁদের প্রাপ্য সাফল্য, সম্মান বা আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য অনেকেই পাননি। তাঁদের এই ব্যর্থ সম্ভাবনার ইতিহাস নীরদবাবুর চোখে বাঙালির আত্মহননপ্রবণতার রূপ নিয়েছে। কী তীব্র দারিদ্র আর অপমানের মধ্যে ওঁর প্রথম জীবন কাটাতে হয়েছে, তা নীরদবাবু নিজেই লিখেছেন। ওঁদের প্রজন্মে অসংখ্য পরাজিত ব্যর্থকাম মানুষের ভিড়ে অল্প কিছু মানুষ জীবনযুদ্ধে জয়ী হয়েছিলেন। নীরদবাবু সেই মুষ্টিমেয় লোকেদের একজন। কিন্তু দীর্ঘ সংগ্রামের ক্ষতচিহ্ন ওঁর সর্বাঙ্গে। ওঁর দোষ বলতে সেই ক্ষতচিহ্নগুলিই বুঝি। তসলিমা নাসরিন ওঁর সঙ্গে দেখা করে চলে আসবার সময় গেটে দাঁড়ানো বৃদ্ধ ব্যক্তিটিকে ‘দুঃখী মানুষটি’ বলে বর্ণনা করেছেন। এই বর্ণনা লেখিকার সুপরিচিত সত্যদৃষ্টিরই প্রকাশ।

আমার সঙ্গে ওঁর প্রথম পরিচয় ১৯৪৬-৪৭ সালে কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলির অধিবেশনের সময়, দিল্লিতে আমার পিসেমশায় কিরণশঙ্করবাবুর বাসায়। তারপর ওঁর মোরি গেটের বাড়িতে গিয়েছিলাম উনি কোন পদ্ধতিতে ওঁর বিরাট পাণ্ডিত্য অর্জন করেছেন সে কথা জানতে এবং তা থেকে শিক্ষা নিতে। কিন্তু খুব কিছু লাভ হয়নি। দিল্লিতে ১৯৫৭ সন থেকে ১৯৭২ অবধি পনেরো বছর বাস করার সময় আমি আর ওঁর খোঁজ করিনি। আবার সাক্ষাৎ হল অক্সফোর্ডে। সেখানে ওঁর জীবনের শততম বছর অবধি কতবার যে ওঁর সঙ্গে সন্ধ্যা কাটিয়েছি, তার কোনও হিসেব রাখিনি।

নীরদবাবুর লেখা প্রধানত ইউরোপে যাকে বেল্ লেতর বলে সেই শ্রেণির। সুন্দর এবং পাণ্ডিত্যপূর্ণ ভাষায় নানা বিষয়ে ওঁর নিজস্ব মতামত উনি প্রকাশ করেছেন। বক্তব্য তথ্যপ্রমাণ বা যুক্তি দিয়ে সমর্থন করার চেষ্টা উনি করতেন না। ওঁর ভাবটা ছিল–এই আমার মত। এটা আমার সত্যদৃষ্টিপ্রসূত। ইচ্ছে হলে গ্রহণ করো, না করো তো ক্ষতি তোমাদের, আমার না। ভারতবর্ষের বর্তমান এবং সনাতন সভ্যতা সম্পর্কে ওঁর মতামত অনেক সময় উদ্ভট মনে হত। কিন্তু বহু সময়ই বর্তমান ভারত বিষয়ে ওঁর অন্তর্দৃষ্টিগুলি অসাধারণতায় উজ্জ্বল। এবং আমাদের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি সম্পর্কে যেসব নির্মম কথা লিখেছেন, তার সত্যতা অস্বীকার করা চলে না।

কিন্তু এইসব রচনা শুধু মাত্র সত্যসন্ধানী দৃষ্টির প্রতিফলন ভাবলে ভুল হবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ওঁর লেখা পড়বে। তাই সেসবের ব্যক্তিগত এবং সামাজিক পটভূমি আমি যেটুকু বুঝেছি তা লিপিবদ্ধ করা প্রয়োজন মনে করছি। এবং সেই প্রসঙ্গে আমি যা বলব তা কারও কারও কাছে নিন্দাসূচক মনে হতে পারে। এই কথাগুলিই একদিন ছোট একটি আচ্ছায় কয়েকজন পরিচিত মানুষকে বলছিলাম, তাঁদেরই নানা প্রশ্নের উত্তরে। একজন প্রতিবাদ করে বললেন, মশায়, আপনি মৃত ব্যক্তির নিন্দা করছেন। উত্তরে বলি, আমার পেশা ইতিহাস লেখা। আমি যদি মৃত ব্যক্তিদের কখনওই নিন্দা না করি, তাহলে তো আমার কলম তুলে রাখতে হয়। নীরদবাবুর নিকটাত্মীয়রা আমার বন্ধু এবং প্রিয়জন। এখন যা লিখব তা তাঁদের কাছে অপ্রিয় মনে হতে পারে। কিন্তু কথাগুলি বিদ্বেষপ্রসূত না, আশা করি একথা তাঁরা বিশ্বাস করবেন। নীরদবাবু বাঙালি সংস্কৃতিতে প্রবাদপুরুষ। আবারও বলি—ওঁকে আমার চেয়ে বেশি ঘনিষ্ঠভাবে দেখার সুযোগ আর কারও হয়নি বলেই আমার বিশ্বাস, ওঁর পূত্রদেরও না। কারণ বয়স্যভাবে সন্তানদের পাওয়ার সৌভাগ্য কম লোকেরই হয়। ওঁর মতো কোপনস্বভাব মানুষের সে সৌভাগ্য নাগালের বাইরে ছিল। এসব কারণে যে কথাগুলি লিখতে যাচ্ছি তা লেখা আমার কর্তব্যের মধ্যে পড়ে বলেই মনে করি।

প্রচণ্ড আবেগপ্রবণ মানুষটি সব ব্যাপারেই অসাধারণ ছিলেন। ওঁর জীবনজিজ্ঞাসা যেমন সাধারণ মানুষের তুলনায় বহু গুণ তীব্র, ওঁর ঘৃণা করার প্রবণতাও তেমনই অসামান্য ছিল। এই তীব্র ঘৃণার সামাজিক পটভূমি বুঝবার এবং ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করব।

একবার তাঁর লেখার এক বিশিষ্ট ভক্তকে পরিচয় করিয়ে দিতে নিয়ে গিয়েছিলাম। বের হয়ে এসেই সরল প্রকৃতির মানুষটি প্রশ্ন করলেন, এত বড় মানুষটির এত হীনম্মন্যতা কেন? বিদেশি শাসনের অবহেলিত জীবনে শিক্ষিত বাঙালি নানাভাবে তাঁদের অপমানবোধ আর ব্যর্থতার প্রতিষেধক খুঁজতেন। তার অন্যতর প্রকাশ ছিল আত্মমহিমা প্রচার আর বংশগৌরবের দাবিতে। নীরদবাবু লিখেছেন—ওঁর সাফল্যের একটি কারণ, ওঁর আত্মপ্রচার। কথাটা ঠিক না। উনি যদি আত্মপ্রচার কিছুটা কম করতেন তাহলে সেই অনুপাতেই পাঠক/পাঠিকা ওঁর বক্তব্য আরও শ্রদ্ধার সঙ্গে গ্রহণ করত।

ওঁর বংশগৌরবের দাবি আমাকে অনেক সময়েই রবীন্দ্রনাথের ‘ঠাকুর্দা’ গল্পের নায়ক প্রখ্যাত নয়নজোড়ের রায়চৌধুরী বংশের কৈলাসচন্দ্রের কথা মনে করিয়ে দিত। নীরদবাবুর পিতাঠাকুর মফস্বল আদালতে মোক্তারি করতেন। কিছু অসম্মানের কাজ না। স্বয়ং মতিলাল নেহরুও বস্তুত মোক্তারই ছিলেন। কিন্তু নীরদবাবুর কাছে এ পরিচয় যথেষ্ট নয়। তাই ওঁর বর্ণনায় উনি ভূস্বামী বংশের সন্তান, ওঁর পত্নীর পদবি দেবী চৌধুরানী (ময়মনসিংহের বিরাট জমিদার বা রাজপরিবারগুলিতেও অনুরূপ পদবির ব্যবহার বেশি ছিল না), উনি আর ওঁর মনিব শরৎ বসু সমশ্রেণির লোক ইত্যাদি ইত্যাদি। ওঁর আত্মপরিচয়েও বিচিত্র অতিরঞ্জনের ছাপ। সাম্মানিক ডি.লিট ডিগ্রি নিয়ে শেলডোনিয়ান হল থেকে বের হয়ে এসেই উনি এক ইংরেজকে বললেন–’আই টেক দিস ডিগ্রি অ্যাস অ্যান ইংলিশম্যান।’ আমি পালাবার পথ খুঁজতে লাগলাম। উনি বাড়িতে ট্রাউজারের নীচে ধুতি পরতেন। ওই ধুতিই যে ওঁর প্রকৃত এবং একমাত্র পরিচয়, বিরাট প্রতিভাধর মানুষটির এই সচেতনতা ছিল না।

পারিবারিক গরিমা বিষয়ে অতিসচেতনতার বীজ ওঁদের পরিবারে ওঁর জন্মের আগেই উপ্ত হয়েছিল মনে হয়। নিজেদের সামাজিক অবস্থান সম্বন্ধে অনিশ্চয়তাবোধই এই স্পর্শকাতরতার জনক বলে আমার ধারণা। ওঁদের গ্রামের বাড়িতে টিন বা অ্যাসবেস্টসের ছাদ। সেই ছাদ থেকে পিতাঠাকুর শ্যান্ডেলিয়ার বা ঝাড়লণ্ঠন ঝুলিয়েছিলেন। সম্পদশালী মানুষ ছাড়া অন্য লোকের বাড়িতে ও বস্তু দেখা যায় না। পূর্ববঙ্গের গ্রামাঞ্চলে তো নয়ই। আর টিনের ছাদ থেকে ঝোঝুল্যমান হলে জিনিসটা ঠিক সুদৃশ্য হয় না। ওঁর কোনও পূর্বপুরুষ সম্পর্কে একটি কাহিনি উনি অনেকবার বলেছেন। বাড়ির উঠোনে কেউ লাউগাছের চারা পুঁতেছে দেখে তিনি নাকি তৎক্ষণাৎ ওটি উৎপাটনের আদেশ দেন। ওঁর বক্তব্য, আমার বাড়িতে যদি লাউগাছ হয়, তবে কে লাউ কিনে খাবে? নীরদবাবুর আত্মজীবনী থেকে এই ধরনের কিছু কিছু তথ্যের ভিত্তিতে আমার ধারণা জন্মেছে যে, ওঁদের পরিবারের অবস্থিতি ছিল গ্রামীণ ভদ্র সমাজের অনির্দিষ্ট অঞ্চলে (এ ধারণা অবশ্যই ভুল হতে পারে)। এবং তা নিয়ে দুশ্চিন্তা ওঁদের ঐতিহ্যের অন্তর্গত। আমার এক ব্রাহ্মণবংশীয়া ছাত্রীকে উনি নানাভাবে অপমান করতেন। সে অক্সফোর্ডে ডক্টরেটের জন্য পড়াশোনা করছে, কেন জানি না এটা ওঁদের ভাল লাগত না। বারবারই বলতেন, ‘ওকে বলো না এটা ছেড়ে দিতে। একদিন উত্যক্ত হয়ে সে বলে, দাদু, আপনারা তো নন্দী। পূর্ববঙ্গে নন্দীরা সাধারণত তেলি হয়। আপনারা শুনি কায়স্থ। বলুন তো আপনারা কোন শাখার কায়স্থ?’ এ প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে ওঁর প্রায় ভিরমি খাওয়ার জোগাড় হয়েছিল। বিশ শতকের বাংলায় ওঁর মতো প্রতিভাশালী মানুষের সামাজিক অবস্থান আর জাতপাতের উপর নির্ভরশীল নয়, এই উপলব্ধি ওঁর হয়নি। নীরদচন্দ্র চৌধুরী কায়স্থ না তেলি, কোনও শিক্ষিত বাঙালি কি এটা আলোচনার বিষয় মনে করবে?

আত্মগরিমা ঘোষণার অপর পিঠ নিজেদের তুলনায় আর সবাইকে ছোট করা। যে কোনও ভারতীয়র সঙ্গে দেখা হলেই তাকে নানা জামাই ঠকানো প্রশ্ন করতেন। উদ্দেশ্য ওঁর এবং ওঁর পরিবারের নিরঙ্কুশ শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করা। বাঙালি জীবনে এই প্রবণতা ওঁদের একচেটিয়া নয়। কোন বাড়িতে কী খাওয়া হয়, পরা হয়, সে বিষয়ে আলোচনা আমাদের। কৈশোর-যৌবনে প্রচুর শুনেছি। জীবনযাত্রার মান দিয়ে মানুষের রুচি এবং সংস্কৃতি বিচার এবং তার ভিত্তিতে পরিবারবিশেষের সামাজিক অবস্থান নির্ণয় (যা সবসময়েই নিজেদের তুলনায় নিম্নস্তরে) মধ্যবিত্ত বাঙালি জীবনের এক করুণ প্রহসন। সাম্প্রতিক কালে এই ব্যাধি থেকে আমরা কিছুটা মুক্ত হয়েছি বলে মনে হয়। নীরদবাবু বারবারই বলতেন—আমার চেয়ে যারা চারগুণ রোজগার করে আমি তাদের থেকে ভাল থাকি। আমার স্ত্রী একবার বহু যত্নে রান্নাঘরের জানালায় টবে লাল পুঁইয়ের একটি চারা লালন করেছিলেন। সেটি যেদিন চিংড়ি মাছ সহযোগে রান্না হয়, ওঁদের জিগ্যেস করি খাবেন কি না। মাসিমা খুবই উৎসাহিত। অক্সফোর্ডে বসে তাজা পুঁইশাক খাওয়া রীতিমতো সাধনার ফল। কিন্তু নীরদবাবু তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন। ‘ওসব ছোটলোকি জিনিস আমার বাড়িতে ঢুকবে না। আমরা মাঝে মাঝেই আলোচনা করি আপনার হাড়ে একটা ছোটলোকামি আছে’। বিনীতভাবে নিবেদন করলাম, ‘তা হবে। আমাদের কীর্তিপাশার জমিদারবাড়িতে কিন্তু বেশ বড় পুঁইমাচা ছিল’।

উনি মাঝে মাঝে শ্রেষ্ঠত্বের নতুন নতুন মাপকাঠি আবিষ্কার করতেন। একদিন স্থির করলেন–হুঁইস্কি খাওয়া ছোটলোকি, কারণ বস্তুটি ভারতীয়দের প্রিয় পানীয়। মোরি গেটের বাড়িতে উনি আমাকে ওন্ড স্মাগলার হুইস্কি খাইয়েছিলেন, একথা উল্লেখ করায় উনি ভীষণ চটে গিয়েছিলেন। ওঁর পুত্রও একটি প্রবন্ধে লিখেছেন যে প্লেনে যখন সকলে হুইস্কি খাইতেছিল তখন উনি একটি সাদা বোর্দো লইয়া খাইলেন। তিনশো লোক কী খাইতেছিল সে তথ্য উনি কীভাবে সংগ্রহ করলেন তা লেখেননি। আসল কথা ওই বোর্দো পান ওঁদের পারিবারিক রুচিজ্ঞান তথা শ্রেষ্ঠত্বর সূচক। ওঁরা যখন মেডেলসন বা বাখের রচিত স্বর্গীয় সঙ্গীত শোনেন, অন্য ভারতীয়রা তখন সব উলওয়ার্থ জাতীয় হেঁদো ডিপার্টমেন্ট স্টোরে সস্তায় খেলো জিনিসের সন্ধানে ঘুরে বেড়ায়। পাশ্চাত্যায়নের অন্যতর মাপকাঠি নাকি চিজে রুচি। ওঁরা স্বাদে গন্ধে তীব্র গরগনজোলা অবধি সানন্দে ভোগ করেন। অন্য ভারতীয়দের দৌড় বড়জোর আমুল চিজ অবধি। ওঁর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে নাসিম খান গার্ডিয়ান পত্রিকায় ওঁর এইসব উক্তি উদ্ধৃত করেন। নীরদবাবুর চল্লিশ বছর ভারতীয় খাদ্য স্পর্শ না করার কাহিনিও রূপকথা। মাসিমার রান্না দেশি আহার্য অনেকবার খেয়েছি। ওঁর বাংলা রান্না বিষয়ক বইটি মোটেই স্মৃতিভিত্তিক নয়। কোনও কারণে ওঁদের ধারণা ছিল যে ভারতীয় খাদ্য না ছোঁয়া সামাজিক শ্রেষ্ঠত্বর নজির। এই প্রসঙ্গে আমার বালিগঞ্জ স্কুলের সহপাঠীর সেই প্রশ্ন ‘তোরা পরিজ খাস?’–স্মরণ হত।

নীরদবাবুর এই ওয়ান আপম্যানশিপে বেচারি মাঝে মাঝে বিপদে পড়তেন। ওঁর তখন শিরে সংক্রান্তি। অর্থাভাবে দেশে ফিরে যেতে প্রস্তুত হচ্ছেন। রয়্যাল সোসাইটি অফ লিটারেচার থেকে ওঁকে সাহায্য দেওয়ার প্রস্তাব হয়েছে। তা নিয়ে আলোচনা করতে একজন বংশানুক্রমিক লর্ড ওঁর বাড়িতে আসবেন। উনি যথারীতি তাঁকে লাঞ্চে নেমন্তন্ন করেছেন। দামি বাসনপত্র, কাঁটাচামচ সব বের হয়েছে। ওঁর কাছে রাখা পুরনো শ্যাম্পেনের বোতল যখন বের হল, তখন লর্ড সাহেবেরও চক্ষুস্থির। বাজারে তার দাম তখন হাজার পাউন্ডের মতো। বস্তুটির প্রশংসা করায় নীরদবাবু বললেন, এর চেয়ে নিচু স্তরের পানীয় আমি সাধারণত ছুঁই না। লর্ড সাহেব বললেন, আমার এটা সাধ্যের বাইরে। পয়সায় কুলায় না জ্যাকি কেনেডি ওঁকে রিক্স-এ লাঞ্চ খেতে ডেকেছেন। কথায় কথায় নীরদবাবু বললেন, আমেরিকা গেলে সোশ্যাল রেজিস্টারে নাম নেই, এমন লোকের সঙ্গে আমি দেখা করি না। সোশ্যাল রেজিস্টার আমেরিকার উচ্চতম পরিবারগুলির ফর্দ। জ্যাকির উত্তর, এক সময় আমিও তাই করতাম। এখন আর সম্ভব হয় না। জ্যাকি তখন ওনাসিস-এর উত্তরাধিকারিণী।

এ প্রসঙ্গে নবনীতার সঙ্গে নীরদবাবুর প্রথম আলাপের ঘটনাটি উল্লেখযোগ্য। আমিই নবনীতাকে ওঁর কাছে নিয়ে গিয়েছিলাম। ওঁর প্রথম প্রশ্ন, ‘কী করা হয়?’ ‘কম্প্যারেটিভ লিটারেচার পড়াই’। ‘ওটা একটা ধাপ্পা! কোথায়?’ ‘যাদবপুরে।’ ‘ওটা আর একটা ধাপ্পা।‘ এবার জোড় হস্তে নবনীতা বললেন, ‘একটা কথা বলতে পারি? আপনার অপরিসীম পাণ্ডিত্য। তার সঙ্গে কোনওভাবেই আমাদের তুলনার কোনও প্রশ্ন ওঠে না। কিন্তু ষোলো বছর বয়স থেকে এই কুড়ি বছর হল আমি তুলনামূলক সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করছি। এটাই আমার জীবিকা। যদি বলি এই একটা বিষয় আমি আপনার চেয়ে বেশি জানি, খুব কি অন্যায় বলা হবে?’ এর পর আলোচনা আর বেশি এগোয়নি। পরে দেখা হলে উনি বললেন, ‘মেয়েটা দজ্জাল, না? আমার উত্তর, সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই।’

নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা থেকে অন্যকে অপমান করা বেশি দুরের পথ না। অনেক অসহায় বেচারা মানুষের ওঁর কাছে নেহাতই অকারণে অপমানের অভিজ্ঞতা বারবারই হয়েছে। একটা চরম উদাহরণ দিয়ে প্রসঙ্গান্তরে যাব। এক নিতান্ত ছা-পোষা গেরস্ত ভদ্রমহিলা বাঙালিদের এক জমায়েতে ওঁকে এসে বললেন, ‘একদিন আপনার বাড়ি যাব।’ ওঁর উত্তর, ‘আসবেন। সকাল থেকে দরজা খোলার পর কুকুর-বেড়াল সবই তো ঢোকে। আমি কি আটকাতে পারি?’

এই কথাগুলি বলার একটা উদ্দেশ্য আছে। ওঁর লেখায় অনেক সময়ই বাঙালি তথা ভারতীয়দের সম্পর্কে কঠোর উক্তি পাই। আগেই লিখেছি–তার সবটা নিরপেক্ষ বিশ্লেষণের ফল না। ওঁর তত্ত্বচিন্তার পিছনেও আছে ওঁর ইতি এবং নেতিবাচক গভীর আবেগ। ওঁর স্ত্রীর মৃত্যুর পর একদিন উনি অঝোরে কাঁদছেন। ওঁর একটি লেখা থেকে ওঁদের দাম্পত্য জীবন সম্বন্ধে দুটি লাইন পড়ে শোনালেন। তার বক্তব্য—ওঁদের জীবনে প্রেমের ফল ফললেও, অবকাশের অভাবে প্রেমের ফুল ফুটতে পারেনি। তার কারণ অপরিসীম দারিদ্র। বইটি বন্ধ করে বললেন–এর জন্য উনি বাঙালিদের কখনও ক্ষমা করতে পারবেন না। ওঁর অনেক লেখাতেই এই অক্ষমতার প্রকাশ। ওঁর দুর্ভাগ্যের কারণ যে বাঙালি জাতি না, ওঁর বহু প্রশংসিত ইংরেজ শাসন—এ কথাটা ওঁকে কখনও মানাতে পারিনি। কিন্তু উপযুক্ত অক্ষমতা সত্ত্বেও ওঁর রচনা বহু দিন মানুষ গভীর অভিনিবেশ নিয়ে পড়বে। আর এই বিরাট মাপের মানুষটিকে কেউ সহজে ভুলবে না। ভুললে লোকসানটা মানবজাতির, বিশেষ করে আমাদের বাঙালি তথা ভারতীয়দের।

অক্সফোর্ডে বাঙালিদের কথা লিখতে গিয়ে এক তৃতীয় বাঙালির কথা উল্লেখ না করলে আলোচনা অসম্পূর্ণ থাকে। তিনি অমর্ত্য সেন। আমি দিল্লি ছাড়ার আগেই উনি লন্ডন স্কুল অব ইকনমিকসে অধ্যাপক হয়ে চলে গেছেন। ওঁর অক্সফোর্ডে আগমন সম্পর্কে শুধু দুটি ঘটনার উল্লেখ করব। উনি প্রথমে আসেন প্রফেসর অফ ডেভেলপমেন্ট ইকনমিকস হয়ে। নির্বাচকমণ্ডলীর অন্যতর সভ্য পিটার ম্যাথায়াসের কাছে শুনেছি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে সংক্ষিপ্ততম অধিবেশন ওই অমতাঁর নির্বাচন নিয়ে। মণ্ডলীর সভাপতি নির্বাচকদের তাদের মনোনীত প্রার্থীদের নাম উল্লেখ করতে বলেন। প্রথম জন বললেন, ‘সেন।‘ তারপর বাকি পাঁচজনও একই নাম উচ্চারণ করলেন। দু’-মিনিটে সভা সমাপ্ত। পরে যখন অমর্ত্য ড্রামন্ড প্রফেসর হলেন, তখন উনি নির্বাচক সমিতির অন্যতম সভ্য। বাকি সভ্যরা যৌথভাবে ওঁকে পদটি গ্রহণ করতে অনুরোধ করেন। প্রসঙ্গত বলি–ড্রামন্ড চেয়ার ইংল্যান্ডে অর্থনীতি বিষয়ে সবচেয়ে সম্মানিত পদ। অক্সফোর্ডে অমর্ত্য সেন বিষয়ে আর কিছু বলতে চাই না। অক্সফোর্ডে বাঙালি বিষয়ক অনুচ্ছেদও এখানেই শেষ।

১৯৯৩ সনের অক্টোবর মাসে আমি অক্সফোর্ডে অধ্যাপকের পদ থেকে অবসর নিই। তার আগে আমার শেষ কাজ জুন মাসে বিদায়ী অভিভাষণ–ভ্যালেডিক্টরি অ্যাড্রেস। আমার বক্তব্যর বিষয় ছিল শ্যাডোস অফ দা স্বস্তিকা–ভারতবর্ষের জীবনে আগ্রাসী হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার আবির্ভাব, যা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে নাৎসি আদর্শে অনুপ্রাণিত। কীভাবে অযোধ্যাকাণ্ডের ফলশ্রুতি হিসাবে লোকসভায় গৈরিকপন্থীদের সংখ্যা দুই থেকে এক লাফে ১১৯-এ উঠেছে তার কারণ ব্যাখ্যা করেছিলাম। তার সঙ্গে আমি দুটি ভবিষ্যদ্বাণী করি। এক, দেশে গৈরিক রাজত্ব আসন্ন। দ্বিতীয় কথা, ওই রাজত্বের আওতায় নাৎসিবাদের নগ্ন রূপ প্রকাশ পাওয়ার আশঙ্কা। বক্তৃতাকক্ষে একটি আসনও খালি ছিল না। বক্তৃতার শেষে শ্রোতারা দাঁড়িয়ে উঠে সম্বর্ধনা জানালেন। এই সামান্য স্বীকৃতি আমাকে প্রচুর তৃপ্তি দিয়েছিল। তাই কথাটা লিখলাম। আমার বামপন্থী বন্ধুরা বলেছিলেন–আমি অকারণে বেশি ভয় পাচ্ছি। ভয়টা যে অকারণ ছিল না–ভাজপার সিংহাসন আরোহণ আর গুজরাতে পশুশক্তির আবির্ভাবে তা প্রমাণ হয়েছে। আমার এই দুঃস্বপ্ন সত্য প্রমাণ হওয়ায় আমার কোনও আনন্দ নেই। শুধু ক্ষীণ আশা রাখি আমাদের রাজনীতিতে এই পশুশক্তির বিনাশ মৃত্যুর আগে দেখে যাব। আশা করি, কিন্তু ভরসা করি না.

আমার বিচারে ভারত-রাষ্ট্র এবং হিন্দু সমাজ-সংস্কৃতির এত বড় শত্রুর আগে কখনও আবির্ভাব হয়নি। পৃথিবীর চোখে ধর্মান্ধতায় এরা আমাদের তালিবানের সঙ্গে তুলনীয় করে তুলেছে। এদের মূর্খ গুন্ডাবাহিনী দেবীর নগ্নিকা চিত্র ছিঁড়ে ফেলতে সযত্ন। যাঁরা তার প্রতিবাদ করেছেন তাঁদের জনে জনে অশ্লীল চিঠি লিখে এরা অপমান করেছে। কালীমূর্তি কি এরা কখনও দেখেনি? অথবা আমাদের মন্দিরগাত্রে পরম সুন্দর কামবন্ধ? কাশীধামে বিধবাদের উপর সুপরিচিত অত্যাচারের কাহিনি নিয়ে সংবেদনাময় ছবি তোলায় এদের আপত্তি। শুনেছি পথের পাঁচালী’তে দেশের দারিদ্র চিত্রিত বলে বিদেশে ছবিটা দেখানো নিয়ে আপত্তি হয়েছিল। প্রাচীন ভারতীয়রা গো-মাংস খেতেন এ কথা লেখায় সে বই পোড়ানো হয়েছে। আমাদের বিরাট উদার ঐতিহ্য নয়া ‘হিন্দুত্ব’র নামে অন্ধ বর্বরতায় নামিয়ে আনা হচ্ছে। যেমন জার্মান সভ্যতা এবং সংস্কৃতির সব চেয়ে বড় শত্রু নাৎসিরা, নাৎসি আদর্শে অনুপ্রাণিত এই বর্বরতা তেমনই হিন্দু সভ্যতা-সংস্কৃতির পরম শত্রু। যাঁরা হিন্দু পরিচয়ে গর্ব বোধ করেন, বিশেষ করে তাঁদের এই অপশক্তির বিরুদ্ধে সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে দাঁড়াবার সময় হয়েছে। “গৌরব সে কহ হাম হিন্দু হ্যায়”–এই নারা সম্পূর্ণ গ্রহণযোগ্য, যদি তার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া যায় “ইয়ে লোগ হিন্দু নহি, খতরনাক জানোয়ার হ্যায়।” এরা একবার সিংহাসনচ্যুত হয়েছে বলে নিশ্চিন্ত হওয়ার কোনও কারণ নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *