২০. বিবাহ—তদঘটিত বিভ্রাট—সংসারযাত্রার শুরু

বিবাহ—তদঘটিত বিভ্রাট—সংসারযাত্রার শুরু

আগের পরিচ্ছেদে আমার স্মৃতিকথা ১৯৭০ সন অবধি পৌঁছেছে। সেই কাহিনিতে ১৯৬০ সনের ২২ জুলাই থেকে অন্যতম কুশীলব আমার পত্নী হাসি, ওরফে প্রতিমা। তাঁর আকস্মিক আবির্ভাব এবং আমার নড়বড়ে সংসারের হাল ধরার বিষয় এ যাবৎ কিছু বলা হয়নি। ও বিষয়টা আর ফেলে রাখলে সংসারে অশান্তি হবে। অতএব এ সম্বন্ধে আমার বক্তব্য অবিলম্বে পেশ করা প্রয়োজন।

আমাদের বিয়ে নিয়ে কলকাতা শহরে এবং বাঙালি সমাজে বেশ হইচই হয়েছিল। আমি এমন কিছু কীর্তিমান পুরুষ না। এবং বিবাহসংস্কার বাঙালি সমাজচেতনায় বিশেষ অপকর্মের ফর্দে পড়ে না। এবং জ্ঞানত আমি বিয়ে করে কোনও অবৈধ কাজ করিনি। ঘটনাটা বিধবাবিবাহর ছিল ঠিকই। কিন্তু বিদ্যাসাগর মশায় পরাশর সংহিতার নজির দেখিয়ে প্রমাণ করে গেছেন যে, ব্যাপারটা শাস্ত্রসঙ্গত এবং ১৮৫৬ সনে কোম্পানি বাহাদুর ওঁর যুক্তি মেনে নিয়ে হিন্দুর বিধবাবিবাহ আইনসঙ্গত বলে ঘোষণা করে গেছেন। মানে আমাদের বিয়ের ঠিক ১০৪ বছর আগে। সুতরাং আমার ধারণা হয়েছিল যে এ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক শতখানেক বছর আগে পূর্বপুরুষরা মিটিয়ে দিয়ে গেছেন। ও নিয়ে আর মাথা ঘামানোর প্রয়োজন নেই। এটা যে কত বড় ভুল তা বাঙালি সমাজ আমাদের হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে দিয়েছিল।

বিধবাবিবাহ ঘটলেই যে এখনও বাঙালিরা ‘গেল গেল’ বলে আওয়াজ তোলে এ কথা সম্ভবত ঠিক না। কিন্তু খুব যে আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উদ্বাহু হয়ে নৃত্য করে এমনও নয়। মোট কথা বাঙালি ভদ্রসমাজে ব্যাপারটা কখনওই ঠিক স্বীকৃতি পায়নি। উনিশ শতকে এ নিয়ে যে-উদ্দীপনা দেখা দিয়েছিল তার রেশ অনেক দিন হল মিলিয়ে গিয়েছে। পরবর্তী একশো বছর বিধবাবিবাহ সংখ্যায় কমই ঘটেছে এবং কোনও পরিবারে ব্যাপারটা ঘটলে মানুষ রে রে করে তেড়ে আসেনা ঠিকই, কিন্তু একটা দেখিনি-দেখিনি ভাব করে থাকে। মুসলমানদের মধ্যে বিধবাবিবাহ বিশেষ সৎ কাজ। বিদ্যাসাগর মশায়কে ঘিরে উনিশ শতকীয় সংস্কার আন্দোলন শেষ হয়ে যাওয়ার পর এমন চিন্তা বাঙালি হিন্দু ভদ্রলোকের মস্তিষ্কে এসেছে এই ধরনের নজির নেই। ব্যতিক্রম যা দেখা যায় তা ব্যতিক্রমই। সুতরাং বিধবাবিবাহ করছি দেখে পরিচিত-অপরিচিত সবাই আমাকে মাথায় তুলে নাচবে, এমন চিন্তা আমার মাথায় আসেনি। কিন্তু বস্তুত যা ঘটল, তাও আমার কল্পনার বাইরে ছিল।

কাহিনিটা তবে আদ্যোপান্তই বলি। আমার স্ত্রী হাসি (এই নামেই ওঁকে সবাই চেনে, তাই এই নামটাই ব্যবহার করছি।) কাশীর এক প্রবাসী বাঙালি পরিবারের মেয়ে। ওঁর জ্যাঠামশায় এবং তার আগে তাঁর পিতাঠাকুর কাশী নরেশের দেওয়ান ছিলেন। হাসির বাবা ক্যাপ্টেন কাননবিহারী সেন রায় ডাক্তার। প্রথম মহাযুদ্ধে মেসোপটেমিয়া এবং ইউরোপে পশ্চিম রণাঙ্গনে ডাক্তারি করে ক্যাপ্টেন উপাধি অর্জন করেছিলেন। বাকি জীবন উত্তর প্রদেশের নানা শহরে, বিশেষত লখনউয়ে, ইন্ডিয়ান মেডিকাল সার্ভিসের কর্মচারী হিসাবে কাজ করেন।

কাননবিহারীবাবুর তিন কন্যার রূপের খ্যাতি ছিল। হাসি যখন শান্তিনিকেতনের ছাত্রী (রবীন্দ্রনাথ জীবিত থাকতে ১৯৩৬ সনে পাঠভবনে ছাত্রী হিসাবে ভর্তি হন এবং ১৯৪৪ সনে শান্তিনিকেতন থেকেই স্নাতক হয়ে বের হন।) এবং পরে বিখ্যাত আইনজীবী প্রয়াত অতুল গুপ্ত মশায়ের দ্বিতীয় পুত্র অমল গুপ্তর পত্নী, তখন বাঙালি এলিট সমাজে উনি অসাধারণ সুন্দরী বলে পরিচিত ছিলেন। আমার বয়স আশি হতে চলল। আমার স্ত্রী আমার চেয়ে বয়সে অল্প বড়। সুতরাং পরশুরামের উদোর আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে নির্দ্বিধায় বলতে পারি ওঁর রূপের খ্যাতিটা অমূলক ছিল না। এত বয়সেও শুধু আমার না অন্য অনেকের চোখেও উনি রূপসী। শুনেছি বসুন্ধরা বীরভোগ্যা। আমি বীর না, চামচিকে-টিকটিকিদেরও সমীহ করে চলি। সুতরাং আমার মতো বেড়ালের কপালে এত বড় শিকে ছেঁড়ায় আমি ভাগ্যের প্রতি এই অহেতুকী করুণার জন্য বিশেষ কৃতজ্ঞ।

কিন্তু সেই করুণার গ্রহীতা হতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল। সে কথায় আসা যাক। অতুলবাবুদের সঙ্গে আমাদের কুটুম্বিতা ছিল। আমার পিসেমশায় কিরণশঙ্কর রায়ের ভগ্নিকে উনি বিবাহ করেছিলেন। কিন্তু ও-বাড়িতে আমার যাওয়াআ ছিল অন্য সুত্রে। অতুলবাবুর বড় ছেলে ডক্টর প্রতুল গুপ্ত স্নাতকোত্তর বিভাগে আমার শিক্ষক, এবং তার চেয়েও বড় কথা, আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। জাগতিক ব্যাপারে বেশ আনাড়ি এই মানুষটির আমি একান্ত সচিব এবং উপদেষ্টা হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম—বিশেষ করে যখন আমি ওঁর সহকর্মী হলাম তখন থেকে। আমার ভাবী পত্নীকে ওই বাড়িতে আমি অনেকবার দেখেছি। দু-একবার কথাও বলেছি কিন্তু কেন জানি না আমার মতো অকিঞ্চন ব্যক্তির সঙ্গে এই সামান্য আলাপ-পরিচয়ের ওঁর কোনও স্মৃতি নেই। এটা আমার বিশেষ দুঃখের কারণ।

অমলবাবু তেরো বছর বিবাহিত জীবন যাপন করে নিতান্ত অল্প বয়সে হৃদরোগে মারা যান। হাসির বয়স তখন ত্রিশের কোঠায়। সাদার্ন এভিনিউর একটি একতলার ফ্ল্যাটে উনি থাকতেন। ওঁর সঙ্গে থাকতেন বিপত্নীক প্রতুলবাবুর ন-দশ বছরের মেয়ে ঈশানী এবং হাসির মামাতো বোন মাধবী। হাসি সাউথ পয়েন্ট স্কুলের শিশু বিভাগে পড়াত। তবে ওদের খরচের সিংহভাগ—মানে মাসে দু’ হাজার টাকা আসত অতুলবাবুর কাছ থেকে। ওই সংখ্যাটার এই কাহিনিতে প্রাসঙ্গিকতা আছে। সে কথা যথাস্থানে বলব।

মাঝে মাঝে সন্ধেবেলা আমি প্রতুলবাবুর সঙ্গে লেকে হাঁটতে যেতাম। একদিন উনি বললেন, চল, ঈশানীকে দেখে যাই। এইভাবেই হাসির সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ-পরিচয় হয়। অন্তত ওঁর স্মৃতিতে তাই। এর পর দ্বিতীয় সাক্ষাৎ মাস দেড়েক পরে। প্রতুলবাবু দিল্লিতে কোনও একটা চাকরির ইন্টারভিউ দিতে যাবেন—আমাকে বললেন, তুমিও চলো হাওড়া স্টেশন অবধি। যাওয়ার পথে উনি হাসিকে তুলে নেন। স্টেশন থেকে ফেরার পথে হাসি তাঁর ফ্ল্যাটে নেমে গেলেন। আমিও ওঁর সঙ্গে সঙ্গে নামলাম। এবং আধ ঘণ্টাখানেক কথাবার্তার পর আমি আমার বিবাহপ্রস্তাব পেশ করলাম। ও এতই হকচকিয়ে গিয়েছিল যে প্রথমে কোনও কথাই বলতে পারেনি। অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমি কিছুদিন ভেবে দেখতে চাই। এই ভেবে দেখার ব্যাপারটা আমি ওকে নিশ্চিন্তে করতে দিইনি। রোজই বিকেলে গিয়ে হাজিরা দিতাম। দিন পনেরো পরে ও আমার প্রস্তাবে সম্মতি জানাল। আমাদের রোমান্সের আদ্যোপান্ত ইতিহাস এই। এখানে আর একটা কথা বলা দরকার। দিল্লি থেকে দিন সাতেক পরে প্রতুলবাবু ফিরলেন। আমি যে হাসির কাছে বিবাহপ্রস্তাব করেছি সে কথা ওঁকে জানালাম। উনি বললেন, এ তো স্বাভাবিক। এ নিয়ে আমার বলার কিছু নেই। ওঁর এই পাশ্চাত্যায়িত ভদ্রলোকসুলভ উক্তিতে আমি নিতান্তই নির্বোধের মতো নিশ্চিন্ত বোধ করলাম। ভাবলাম ওঁদের দিক থেকে কোনও বাধা আসবে না। এই সিদ্ধান্তের অন্যতর কারণ ওঁদের পরিবারের আধুনিক উদারচেতা ভাবমূর্তি। বহুদিন ধরে বাঙালির যাবতীয় প্রগতিমুখিন সামাজিক চিন্তার পথিকৃৎদের একজন অতুলবাবু। আর প্রতুলবাবুর মতো নিপাট ভদ্রলোক আমি অন্তত বেশি দেখিনি। ওঁর কথা আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ না করার কোনও কারণ আমি দেখতে পাইনি।

আমার এই আকস্মিক বিয়ের প্রস্তাব এবং আমাকে প্রায় না চিনে হাসির সেই প্রস্তাব মেনে নেওয়ার একটু ব্যাখ্যা প্রয়োজন। প্রথম দর্শনে প্রেমের নিদর্শন ইতিহাস এবং সাহিত্যে অনেক আছে। কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে সেরকম কিছু ঘটেনি। আমাকে যাঁরা চেনেন, তাঁরা আমার এই আকস্মিক প্রস্তাবে আশ্চর্য হওয়ার মতো কিছু দেখেন না। অনেক ভেবেচিন্তেই এই বইয়ের নাম দিয়েছি ‘বাঙালনামা। বাঙাল-চরিত্রে একটি বিশেষ প্রবণতা হট করে কিছু করে বসার। এটা ঠিক অবিমৃশ্যকারিতা নয়, পৌরুষেরই এক বিচিত্র প্রকাশ। আর বরিশালের বহুশ্রুত একটি উক্তি—’যেয়া ধরুম হেয়া করুম। অর্থাৎ যা ধরব, তা করব। কিছু একটা ইচ্ছে হলে বরিশালবাসী বিনা দ্বিধায় সে ব্যাপারে ওই অঞ্চলের ভাষায় হুম্মত করিয়া লাফাইয়া পড়ে। আমিও জাতীয় চরিত্রের সম্মান বজায় রেখে নির্দ্বিধায় হুম্মাত করে লাফিয়ে পড়েছিলাম। এরকম কাজ বরিশালবাসী মাত্রেই অনুমোদন করবেন। না হইলে আর পুরুষ হইয়া জন্মাইছ কান? সাত হাত ঘোমটা টান্নিয়া থাকলেই পারো? (নারীবাদীরা মার্জনা করবেন। আমরা বরিশালবাসীরা রাজনৈতিক কেন, কোনওরকম শুদ্ধতার জন্যই বিখ্যাত নই)। তবে বরিশালে যাঁরা ঘোমটা টেনে থাকতেন অন্য অঞ্চলের পুরুষের তুলনায় হেনাগোও বিক্রম কিছু কম আছেলে না। বাবার পিসিমারা একটা হাঁক দিলে বহু বীরপুরুষের অন্তরাত্মা শুকিয়ে যেত। হ্যাঁ, বরিশাল বলে কথা। এ কি কোলকাতার এলেম গেলেম মলেম মলেম করা পুরুষালি। হালুম-হুঁলুমটা এ অঞ্চলে, সুন্দরবনের উত্তরে বড় শোনা যায় না। আর আমরা তো কথা শুরুই করি ওই আওয়াজ দিয়ে।

এ গেল আমার ব্যবহারের সরল ব্যাখ্যা। হাসি কেন আমার প্রস্তাব মেনে নিল তার পিছনে বাঙালি জীবনের এক করুণ ইতিহাসের পটভূমি আছে। হাসির প্রথম বিবাহে বিবাহিত জীবন খুবই সুখের ছিল এবং অকালবৈধব্য ওর জীবনের সুখ-শান্তির উপর সত্যিতেই যবনিকা টেনে দিয়েছিল। ওকে দেখতাম সর্বদাই ম্লানমুখ—যেন সব আশা-ভরসা বিসর্জন দিয়ে এক দুঃখময় ছায়ালোকে বাকি জীবন কাটাবার সম্ভাবনা সম্পূর্ণ মেনে নিয়েছে। আর সেই দুঃখময় ছায়ালোকেও যে বাকি জীবন মানসম্মান বজায় রেখে কাটাতে পারবে তার সম্ভাবনাও যেন ক্ষীণ হয়ে আসছিল। বিবাহবিচ্ছেদের শিকার আমার এক বান্ধবী আমাকে বলেছিলেন—ওঁর মনে হয়েছিল—মাথার উপর থেকে ছাদ যেন খসে পড়ল। রোদ বৃষ্টি ঝড়ঝঞ্জার মধ্যে ওঁর স্বামী যেন ওঁকে খোলা মাঠে ঠেলে ফেলে দিলেন। স্বামীহীন নারী বাঙালি সমাজে যেন সকলেরই ভোগ্যবস্তু। বারো বছর বয়স্ক বন্ধুপুত্র থেকে শুরু করে বাহাত্তর বছর বয়সের পিতৃবন্ধু অনেকেই ওঁকে শয্যাসঙ্গিনী হওয়ার উদার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন।

হাসি খোলামেলা মুক্ত সামাজিক পরিবেশের মানুষ ছিল না। স্কুলে পড়ালেও তার জীবন ছিল অন্তঃপুরবাসিনীর। ফলে ওকে পুরোপুরি বে-আব্রু হতে হয়নি। কিন্তু ওর রূপ ওর পরম শক্ত হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বহুদিনের পারিবারিক ডাক্তার থেকে শুরু করে মাতুল-স্থানীয় ঘনিষ্ঠ আত্মীয় পর্যন্ত অনেকেই ওর দিকে নেকনজর দিতে শুরু করে। আর উর্বরমস্তিষ্ক কিছু শিক্ষিত আড্ডাবাজরা নানা গল্প বাজারে ছাড়তে লাগলেন। ওই ধরনের রসালো মিথ্যা গল্প রটানোর প্রবণতা বাঙালি সমাজের বাইরে বেশি দেখিনি মনে হয়—এটা এক দিকে চণ্ডীমণ্ডপি কুৎসাপরায়ণতারই উত্তরসাধক। অন্য দিকে এই প্রবণতায় রিরংসাসিক্ত যৌন ব্যর্থতাবোধের কুৎসিত প্রকাশ। একজন ক্যালকাটা ক্লাবে বসে হলফ করে বললেন কাল তিনি স্বচক্ষে দেখেছেন গ্র্যান্ড হোটেলে এক ব্যারিস্টারের সঙ্গে হাসি গালে গাল লাগিয়ে নাচছে। বেচারা উক্ত হোটেলে একবারই গিয়েছিল। স্বামীর সঙ্গে লাঞ্চ খেতে। ওর মনে হতে শুরু করে যে, ওর সামনে বোধ হয় মাত্র দুটো পথই খোলা। পণ্ডিচেরি চলে যাওয়া অথবা অ্যাসিড দিয়ে নিজের মুখ পুড়িয়ে দেওয়া। এই সময় ওর পরিবারের পরিচিত কিন্তু ওর কাছে সম্পূর্ণ অচেনা একটি মানুষ বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এল। ওর ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধবের মধ্যে দু-একজনের সঙ্গে ব্যাপারটা নিয়ে ও আলোচনা করেছিল। ওর অগ্রজপ্রতিম কঙ্কর সেন (ক্ষিতিমোহন সেনের পুত্র), আরতি শ্ৰীমল, পারমিতা বিশ্বনাথন, তাঁর দুই বোন এবং রাধামোহন ভট্টাচার্য তাঁদের মধ্যে প্রধান-স্থানীয়। বাঙালি সমাজে ভাল ছাত্রর কদর কিছু বেশি। বন্ধুরা ওকে আমার প্রস্তাব মেনে নিতেই উৎসাহ দেন। তাঁদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। আমি যে ওকে বিয়ে করে নিয়ে গিয়ে ওর বাকি জীবনের অভিজ্ঞতার তুলনায় নিতান্ত দারিদ্রের মধ্যে ফেলব—এ কথা বলে ওকে নিবৃত্ত করতেও পারতেন। অতুলবাবুরা বিশেষ ধনী ছিলেন আর আমি তখন আটশো টাকা মাইনেয় মাস্টারি করি। হাসির কোনও দিনই কোনও বৈষয়িক জ্ঞান ছিল না। আমি কত মাইনে পাই বলায় ওর কোনও ভাবান্তর দেখিনি। সম্পন্ন পিতার ঘর আর রীতিমতো ধনী শ্বশুরবাড়ি থেকে এই গরিবের ঘরে এসে ও কখনও কোনও অভিযোগ করেনি। শুধু মাসের পনেরো-বিশ তারিখ নাগাদ যখন মাসখরচার টাকা ফুরিয়ে যেত, হঠাৎ এসে বলত বাড়িতে আর টাকা নেই। ব্যাঙ্কেও যে নেই, সে কথা আর ওকে বলতাম না। বাকি মাসটা ধারধোর করে চালাতাম। নতুন মাস শুরু হত সেই ধার শোধ দিয়ে। আমার সৌভাগ্য—বিয়ের এক বছর পর লন্ডন যাওয়ার সুযোগ পাই। না হলে কতদিন এই দেনা-ধারণোধ-আবার দেনা করার বিষচক্র চালু থাকত জানি না।

আগের কথায় ফিরে যাই। প্রতুলবাবুকে যখন আমরা বিয়ে করব ঠিক করেছি জানাই, তখন ওঁর নিজের জীবনেও একটা তোলপাড় চলছিল। লাজুক, একটু ভীরু প্রকৃতির মানুষটি কখনওই নিজের ইচ্ছেগুলি সজোরে প্রকাশ করতে পারতেন না। স্ত্রীবিয়োগের পর থেকেই ওঁর জীবন বহু বন্ধু সত্ত্বেও গভীর নিঃসঙ্গতায় ভরা ছিল। আর ওঁর মনে ওঁর সঙ্গে বিদ্যাবুদ্ধির দিক থেকে সমস্তরের কোনও নারীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার জন্য একটা তীব্র বাসনা ছিল। উনি শেষবার যখন লন্ডন যান, তখন একজন বাঙালি মহিলার সঙ্গে ওঁর ঘনিষ্ঠতা হয়। এ ব্যাপারে ওঁর চেয়েও মহিলাটির দিক থেকেই উৎসাহটা বেশি ছিল। দেশে ফেরার পর ওঁর পরিবারের দিক থেকেও ওঁদের দুজনের বিয়ে হলে ভালই হয়, এই রকমের ইঙ্গিত স্পষ্টই পাওয়া যায়। ব্যক্তিগত জীবনে আমি তখন ওঁর বন্ধু এবং উপদেষ্টা। আমি দেখতাম—উনি বয়সে বড় হলেও ওঁর চেয়ে আমার ভূয়োজ্ঞান অনেক বেশি। আমার কাছে বিষয়টা উত্থাপন করায় আমিও ওঁকে উৎসাহই দিলাম। আমারও মনে হয়েছিল ওঁর জীবনের সমস্যার এ ছাড়া কোনও সমাধান নেই। প্রচণ্ড প্রতিভাশালী পিতার সামনে উনি নিজেকে নিতান্তই হেয়। জ্ঞান করতেন। আর ওঁদের বিলাসবহুল জীবন যে নিতান্তই ওঁর বাবার অর্থের উপর নির্ভরশীল, এ চিন্তাও ওঁকে বিশেষ পীড়া দিত।

মহিলাটির চাপে প্রতুলবাবু তাঁর পুনর্বিবাহের ব্যাপারে একটা সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হন। ওঁদের এনগেজমেন্ট পাকা করার জন্য ১২৫ রাসবিহারী অ্যাভিনিউর বাড়িতে একটি পার্টির ব্যবস্থা হয়। ছেলেমেয়েরা বড় হচ্ছে, স্ত্রী তো অল্প ক’বছর আগেই মারা গেছেন, তাই বন্ধু এবং পরিচিত জনের কাছে ওঁর ভাবমূর্তি কী দাঁড়াবে—এসব ভেবে কিছুটা উদ্বিগ্নচিত্তেই উনি এই পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন। এবং নিজের অপ্রস্তুত ভাবটা কাটাতে ওখানে উনি এক মারাত্মক কাজ করে বসলেন। উনি বললেন, নিজের সুখের জন্য উনি এই বিয়ে করতে যাচ্ছেন না। হাসি বিয়ে করবে ঠিক করেছে। তার পর ওঁর ন-দশ বছরের মেয়ে ঈশানী কার কাছে থাকবে, কে তার দেখাশোনা করবে এই ভেবেই উনি বিয়ে করতে রাজি হয়েছেন।

ব্যস, যেন আগুনে ঘি পড়ল। ওঁর মা প্রায় উন্মাদের মতো ব্যবহার শুরু করলেন। সেকেলে মানুষ। এটা ওঁর কাছে অপ্রত্যাশিত না। কিন্তু আমি যাতে অবাক হয়েছিলাম তা এই যে, ওঁরা তাঁকে কোনও সামলাবার চেষ্টা না করে বরং কিছুটা উস্কানিই দিলেন। পরিবারের একজন, যাঁর সাধারণ্যে ভাবমূর্তি অত্যন্ত উদার এবং প্রগতিশীল, বললেন, লোকটা নিশ্চয়ই টাকার জন্যই এ কাজ করতে যাচ্ছে। হাসির টাকাটা নিয়ে নিতে পারলে ও নিশ্চয়ই পিছিয়ে যাবে। অর্থ ছাড়াও যে মানুষের আর দু-একটা কাম্য থাকে লোকটি বোধ হয় সে কথা ভুলে গিয়েছিলেন। এই নাটকের কুশীলবরা প্রায় সবাই প্রয়াত তাই এসব কথা লিখতে খুব যে উৎসাহ পাচ্ছি তা নয়। বিশেষত প্রতুলবাবু আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। এত গোলমাল সত্ত্বেও সেই বন্ধুত্বে ভাঙন ধরেনি। কিন্তু আমার এই লেখার প্রধান উপজীব্য একটি যুগের ছবি। আমাদের শিক্ষিত সমাজে কী পরিমাণ ভণ্ডামি এবং কুরুচি ভদ্রতার মুখোশ পরে ঘুরে বেড়াত বর্তমান কাহিনিটি পুরোপুরি না বললে সে বিষয়ে আমার ব্যক্তিগত সাক্ষ্য অসম্পূর্ণ থাকবে।

আমাদের বিয়ের সম্ভাবনা ঘোষিত হবার পর হাসির উপর নানা রকম চাপ শুরু হয়। প্রতুলবাবুও নাকি বলতে শুরু করেন যে, আমাকে না-জেনে না-শুনে হঠাৎ এই বিয়ের প্রস্তাবে রাজি হওয়াটা সুবুদ্ধির কাজ হচ্ছে না। আর ওঁর মা রোজ টেলিফোনে মা বাপ তুলে অকথ্য গালিগালাজ শুরু করেন। এক আত্মীয় মামলা করে ওর সামান্য পুঁজিটুকু নিয়ে নেওয়া যায় কি না তার অন্ধিসন্ধি খুঁজতে লাগলেন। প্রতুলবাবুর বৈঠকখানা ঘরে সহানুভূতিতে ভরা দীর্ঘশ্বাসের ঝড় উঠতে লাগল। অতুলবাবুর কানে যখন কথাটা উঠল উনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, এ জিনিস সহ্য করা ছাড়া আমাদের উপায় নেই। যে মানুষটা দুই পুত্র, এক কন্যা এবং এক পুত্রবধূর মৃত্যু চোখের সামনে ঘটতে দেখেছেন এবং সব শোক সহ্য করে নিজের দৈনন্দিন কর্তব্যে অবিচলিত থেকেছেন, সেই আদর্শ পুরুষের বিচার করার অধিকার আমার নেই। কিন্তু আমার অপরিণত বুদ্ধিতে একটা ধারণা বা আশা ছিল যে ওঁর মতো মানুষ মানবিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে যা ঘটতে চলেছে তার মধ্যে শুভ কিছু দেখবেন, তাঁর কন্যাসমা ভাগ্যহতা পুত্রবধূকে কল্যাণকামনা করে আশীর্বাদ করবেন, যেমন বেশ কয়েক দশক আগে রাধারাণী দেবীর প্রাচীনপন্থী শ্বশুর শাশুড়ি ওঁদের করেছিলেন। পরে আমার এক অতি শ্রদ্ধেয় বন্ধুকে এই কথা বলায় তিনি মন্তব্য করেন, সব পরীক্ষা সবাই পাস হয় না।

ওঁদের সম্মানে এবং হৃদয়ে আঘাত লাগায় ওঁরা কিছুটা অসংযত যুক্তিবিরুদ্ধ ব্যবহার করছিলেন, সে ব্যাপারটা কিছুটা বুঝতে পারি। এবং সেসব শুধুই দোষের হয়েছে এরকম ভাবার মতো উগ্র যুক্তিবাদী আমি না। কিন্তু চারপাশের মানুষ (এদের সবগুলিকে মানুষ বলে স্বীকার করতে আমার এখনও দ্বিধা আছে।) এবং বৃহত্তর বাঙালি সমাজে যে প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছিল তাতে সত্যিতেই স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম। একদল বলতে লাগলেন, এই যদি হাসির মনে ছিল, তবে ও শোকের ভেক ধরে ঘুরছিল কেন? মানুষ সত্যিতেই শোকে মুহ্যমান হতে পারে এবং তা সত্ত্বেও অন্তহীন দুঃখ আর অপমানের জীবন থেকে মুক্তির কোনও উপায় দেখলে ভাগ্যের সেই দান উপেক্ষা করতে পারে না, এ জাতীয় অমানুষদের মাথায় এমন চিন্তা আসবার কথা না। কেউ কেউ বলতে লাগলেন—আহা, এমন দেবতুল্য দয়ার সাগর শ্বশুরের প্রাণে ও এত বড় আঘাত দিতে পারল! একজন প্রগতিপন্থী অধ্যাপক মন্তব্য করলেন, তেরো বছরের স্মৃতি হাসি দু’বছর যেতে না যেতে ভুলে গেল। এই ব্যক্তি পরে আমার কাছে হাত কচলাতে এলে উনি কী বলেছিলেন সে কথাটা আমি উদ্ধৃত করি। ভদ্রলোক তাঁর অদৃশ্য লেজটি গুটিয়ে নিক্রান্ত হন। এই দ্বিতীয় শ্রেণির ধর্মধ্বজরা শোকপ্রকাশ করে ক্ষান্ত না হয়ে শ্বশুরের দয়ার একটা সংখ্যাগত হিসেবও স্থির করলেন। তাঁদের রটনা অনুযায়ী অতুলবাবু হাসিকে তার স্বামীর মৃত্যুর পর দু’ লাখ টাকা হাতে ধরে দিয়েছিলেন। প্রগতিশীল লেখক অচিন্ত্য সেন স্পষ্ট চেনা যায় এমন ভাষায় আমাদের বিয়ে নিয়ে একটি গল্প লেখেন। তাতেও শ্বশুর অকৃতজ্ঞ পুত্রবধুকে দু’লাখ টাকা ধরে দিচ্ছেন, এই গল্পকথাটিরই উল্লেখ আছে। তেরো বছর পর অক্সফোর্ডে এসেও আমরা যে অতুলবাবুর দেওয়া দু’লাখ টাকা নিয়ে লম্বা দিয়েছিলাম তা নিয়ে কানাঘুষো শুনি। বাঙালির সামাজিক স্মৃতি এবং কৌতূহল সত্যিই প্রশংসনীয়। আমার বন্ধু ও সহকর্মী অর্জুন তাঁর কাকা অচিন্ত্যবাবুকে ওই কুরুচিপূর্ণ কাহিনিটি কেন লেখেন তা জিজ্ঞেস করেছিলেন। লেখক নাকি উত্তর দেন যে ওঁদের অনেক সময় পাঠকদের চাহিদা মেটাতে তাদের রুচি অনুযায়ী লিখতে হয়। গল্পটি এক পূজাসংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। এর পর আর কিছু বলার থাকে না।

সেই দু’ লাখ টাকার ভূত এখনও মাঝে মাঝে আমাদের ধাওয়া করে, তাই এ বিষয়ে সত্যি কথাটা পাঠিকা/পাঠকদের কাছে নিবেদন করছি।

গুপ্তবাড়ির যৌথ পরিবারব্যবস্থা থেকে পৃথক হয়ে অমলবাবু সস্ত্রীক সাদার্ন অ্যাভিনিউতে একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে বাস করতেন। পুত্রের মৃত্যুর পর অতুলবাবু হাসি এবং প্রতুলবাবুর মেয়ে ঈশানীর ভরণপোষণের জন্য মাসে দু’ হাজার টাকা করে দিতেন। তখনকার দিনের হিসাবে টাকাটা অনেকই বটে। কিন্তু এ ছাড়া কোনও টাকা উনি হাসিকে দেননি। স্ত্রী হিসেবে না, ‘নমিনি’ হিসাবে ও অমলের প্রভিডেন্ট ফান্ড এবং ইনসিওরেন্স থেকে আশি হাজার টাকা পেয়েছিল। এই টাকাটাই গ্রাস করা চলে কি না তাই নিয়ে পরিবারের কেউ কেউ জল্পনাকল্পনা করছিলেন। তবে আইনত তার কোনও উপায় ছিল না। কারণ ও-টাকাটা একান্তই হাসির নিজস্ব সম্পত্তি, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের ভাষায় বলতে গেলে নহি। কিসিকা বাপকা। ঘটনার পঁয়তাল্লিশ বছর পরে এ ব্যাপারে কৌতূহলী এখনও কেউ যদি বেঁচে থাকেন, তাঁদের আমার বিবৃতি বিশ্বাসযোগ্য মনে হবে কি না জানি না। হাসির গয়নাপত্র অধিকাংশ গুপ্তবাড়িতে রয়ে গিয়েছিল। শুনেছি ওর শাশুড়ি তার অধিকাংশই একে-তাকে বিলিয়ে দিয়েছিলেন। এর মধ্যে ওর বাবার দেওয়া গয়নাগাটিও ছিল। অচিন্ত্যবাবুর জনপ্রিয় কাহিনিটিতে এই ব্যাপারের কোনও উল্লেখ নেই।

বাঙালি নিন্দুকের উর্বর মস্তিষ্কে আরও অনেক কাহিনির জন্ম হয়েছিল। আবার বলি– অবশ্যই বাঙালি মাত্রেই নিন্দুক না। কিন্তু বোধ হয় অন্য পাঁচটা সংস্কৃতির তুলনায় আমাদের সংস্কৃতিতে ‘গসিপ-প্রবণতা’ অনেকটা বেশি। সেই প্রবণতা কত বিষাক্ত হতে পারে তার প্রমাণ আমরা যথেষ্টই পেয়েছিলাম। একদল রটাতে শুরু করলেন যে অনেক দিন ধরেই আমাদের গুপ্ত এবং অবৈধ প্রণয় চলছিল। আমার কন্যা আবির্ভূতা হওয়ার পর অনেক পরিচিত মানুষই ওর জন্মের তারিখ জেনে নিয়ে মনে মনে হিসেব করতেন ওর মাতৃগর্ভে আবির্ভাব আমাদের বিবাহের আগে না পরে। সুকন্যাকে প্রথম দেখে অবশ্যি নবনীতা আমাদের এক ব্যাপারে আশ্বস্ত করেছিলেন, তপনদা, ও যে আপনার মেয়ে এ বিষয়ে কেউ সন্দেহ প্রকাশ করতে পারবে না। (অর্থাৎ এরকম সন্দেহও প্রকাশিত হচ্ছিল।) শুনে বেশ নিরাশ হয়েছিলাম। কন্যা যদি আমার পেঁচামুখই উত্তরাধিকার সূত্রে পায়, তবে আর সুন্দরী স্ত্রী বিয়ে করে কী সুবিধে ফুল? সৌভাগ্যক্রমে নবনীতার বক্তব্যটা শতকরা একশো ভাগ সত্যি প্রমাণিত হয়নি। কন্যার মুখে মায়ের মুখের আদল যথেষ্টই আছে।

যখন এইসব বিচিত্র গোলমাল চলছে, তখন একদিন বাসস্টপে প্রতুলবাবুর সঙ্গে দেখা। উনি নিজে থেকেই এগিয়ে এসে বললেন, ‘শুনেছ তো, কীসব হচ্ছে?’ আমি বললাম, আপনারা একটু আপনাদের মাকে বুঝিয়ে বলতে পারেন না যে যা ঘটছে তা আপনাদের পরিবারের উপযুক্ত না? উনি সংক্ষেপে এবং ঠিকই বললেন, কারও সাধ্য নেই।

জানতাম ওঁরা সেদিন বিবাহ রেজিষ্ট্রি করার নোটিস দিতে যাচ্ছেন। আমি আমার শুভেচ্ছা জানালাম। উনি ওঁর স্বভাবসিদ্ধ নৈরাশ্যের ভঙ্গিতে বললেন, আমি এর মধ্যে শুভ সম্ভাবনা কিছু দেখছি না। রেজিষ্ট্রি অফিসে যাওয়ার পথে উনি নাকি ওঁর বাগদত্তাকে বলেন যে, অল্পদিন পরেই উনি যে এক বছরের জন্য আমেরিকা যাবেন তখন মহিলাটি ওঁর সঙ্গে যেতে পারবেন না। কলকাতায় থেকে শ্বশুর-শাশুড়ির দেখভাল করতে হবে। ভদ্রমহিলা ভীষণ চটে উত্তর দেন যে, শ্বশুর-শাশুড়ির সেবা তিনি অবশ্যই করবেন কিন্তু গুপ্তবাড়ির নার্স হওয়ার জন্য উনি বিয়ে করতে যাচ্ছেন না। প্রতুলবাবু এবার একটু ভারসাম্য হারালেন। বললেন, তুমি আমাকে না, অতুল গুপ্তর টাকাকে বিয়ে করতে চাইছ। বিবাহসম্ভাবনার সেইখানেই ইতি। ভদ্রমহিলা মাঝপথে গাড়ি থামিয়ে নেমে গেলেন। আমার ধারণা প্রতুলবাবু চরিত্রের এক মৌলিক দুর্বলতার ফলে জীবনে স্থায়ী সুখের সম্ভাবনা থেকে বঞ্চিত হলেন। এর পর ওঁর জীবনে নানা দিক থেকে সাফল্য এসেছিল। কিন্তু উনি কখনও সুখের মুখ দেখেছেন, এমন আমার মনে হয়নি।

কলেজ খুলে যাচ্ছিল। আমি হাসিকে বললাম—অবস্থা অসহ্য হয়ে উঠলে ওর ছোটমামার বাড়ি গিয়ে থাকতে। যাঁরা এই দুর্যোগে আগাগোড়া আমাদের সঙ্গে ছিলেন, তাঁদের মধ্যে প্রধানস্থানীয়/স্থানীয়া ওর ছোটমামা পরিমল রায় এবং তাঁর স্ত্রী আভা, হাসির জ্যাঠতুতো দিদি দেবলীনা এবং তার স্বামী নীতীশ মজুমদার আর অনাত্মীয়দের মধ্যে অমিতা সেন, তাঁর ভাই কঙ্করদা, রাধারাণী দেবী আর রবীন্দ্রকুমার দাশগুপ্ত। তার অল্পদিন আগে অমর্ত্য-নবনীতার বিয়ে হয়েছে। ওরা দিল্লি চলে গিয়ে আশুবাবুর অশোক রোডের কোয়ার্টার্সে বাস করছে। আমাদেরও পরে কয়েক দিনের জন্য ওই বাসায় আশ্রয় নিতে হয়েছিল। আর একটি অপ্রত্যাশিত জায়গা থেকে সমর্থন এসেছিল। আমাদের বিয়ের খবর পেয়ে হাসির ছোটবোন সোনালীর প্রথম স্বামী হরিসাধন দাশগুপ্তর বিধবা মা ওঁর গলার সোনার হারটি খুলে তাঁর আশীর্বাদ সহ পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। ওই অত্যন্ত পুরনোপন্থী মানুষটির মনে কোথায় যেন গভীর মানবিকতাবোধ জাগ্রত ছিল। ভাগ্যহীনা সুন্দরী মেয়েটার কপালে সুস্থ স্বাভাবিক জীবনযাত্রার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে, এই চিন্তা ওঁকে আনন্দ দিয়েছিল। হাসিদের ফ্ল্যাটটি ছিল ওদের বিশাল বাড়ির উলটোদিকে। সকাল-সন্ধ্যা যেতে আসতে ম্লানমুখী মেয়েটিকে উনি দেখতে পেতেন।

আমি দিল্লি রওনা হওয়ার আগে আমার পুরনো বন্ধু হরিসাধনকে বলে গেলাম বিয়ে রেজিষ্ট্রির নোটিস দিয়ে রাখতে। আমি এক মাস পর ফিরে এসে বিয়ে করব। কিন্তু দিল্লি পোঁছবার কয়েকদিন পরে একদিন সকালবেলা অমর্ত্য আর নবনীতা আমাদের মডেল টাউনের ফ্ল্যাটে এসে উপস্থিত। ওরা বলল—খারাপ খবর আছে। কঙ্করদা মারফত হাসি খবর পাঠিয়েছে—এ বিয়ে ও করতে পারবে না। ও পণ্ডিচেরি চলে যাবে ঠিক করেছে। ওর উপর চাপটা অসহ্য হয়ে উঠেছে। আমি হরিসাধনকে ফোন করে বললাম—আমি আসছি। এবং হাসিকে নিয়ে দিল্লি ফিরে আসব। অমর্ত্যদের কাছ থেকেই টাকা ধার করে প্লেনের টিকিট কিনে কলকাতা রওনা হলাম।

এয়ারপোর্টে হরিসাধন আর হাসি দাঁড়িয়েছিল। দ্বিতীয় ব্যক্তিটি পণ্ডিচেরি চলে যায়নি দেখে নিশ্চিন্ত হলাম। ওদিকে অবস্থা দেখলাম সহ্যের সীমা সম্পূর্ণ ছাড়িয়ে গেছে। হাসিকে ছেড়ে তার আত্মীয়স্বজনকে ডেকে ডেকে গালিগালাজ শুরু হয়েছে। এবার আর দেরি না করে ট্রেনের টিকিট করে ফেলোম। ইতিমধ্যে আমার মা বাবার সম্মতি পেয়ে গিয়েছি। তাঁরা খুব খুশি হয়েই সুন্দরী পুত্রবধূকে গ্রহণ করেছেন। শুধু অতুলবাবুর পরিবারের সঙ্গে বিরোধে ওঁরা বিব্রত এবং উদ্বিগ্ন। দু’দিন পর দিল্লি রওনা দেব। অবস্থা অসহ্য হওয়ায় হাসি তার মামার বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। এমন সময় বন্ধুবর কুমার মুখার্জি বললেন, ‘বিয়ে করে যেয়ো না। বিপদে পড়বে।‘ ওঁরাই রেজিস্ট্রার ডেকে ব্যবস্থা করলেন। ১৯৬০ সনের ২২ জুলাই এক বিব্রত বিষণ্ণ সন্ধ্যায় কুমারের শম্ভুনাথ পণ্ডিত স্ট্রিটের ফ্ল্যাটে অল্পকটি শুভার্থী আর ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের উপস্থিতিতে আমরা মালাবদল করে রেজিস্ট্রারের অনুমোন সহ বিয়ে করলাম। বাবা তখন অসুস্থ। সিঁড়ি ভেঙে তিনতলা উঠতে পারলেন না। আমার মা, বোন, বউদি এবং ছোটভাই এই বিবাহে উপস্থিত ছিলেন। কী করে যেন গুপ্তভবনে আমরা কোথায় বিয়ে করছি সে সংবাদ পৌঁছে গিয়েছিল। আমরা যখন রেজিস্টারে সই করছি। তখনও ফোন আসতে লাগল যে এখনই পুলিশ আসবে। আমরা ওঁদের সম্পত্তি হরণ করেছি, সেই লুপ্ত সম্পত্তি উদ্ধারের জন্য। বিয়ের পর আমার ছোট ভাই অপুর ব্যবস্থামতো স্কাইরুমে গিয়ে অল্প কয়েকজন কিছু খাওয়াদাওয়া করলাম। অধ্যাপক রবি দাশগুপ্ত এবং রাধামোহনবাবু, তাছাড়া আমার বিশেষ ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা বিয়ের সময় উপস্থিত ছিলেন। বিয়ের পরদিনই আমরা দিল্লি রওনা হয়ে গেলাম।

আমাদের ফ্ল্যাটে খাট-পালং কিছুই ছিল না। দড়ির চারপাইয়ে ঘুমোতাম। তাই বাধ্য হয়েই অমিতাদির আমন্ত্রণ গ্রহণ করে দু-তিনদিনের জন্য ওঁদের অশোক রোডের ফ্ল্যাটে উঠতে হল। সেখানে অমর্ত্য-নবনীতার বিয়ে উপলক্ষে পার্টি হচ্ছিল। এ পাটি আমাদের বিয়েরও সামাজিক স্বীকৃতি উপলক্ষে বলে ঘোষিত হল। এ নিয়ে অমিতাদির পরে অনেক কথা শুনতে হয়েছিল। ওঁর অপরাধ—উনি অতুলবাবুর মতো দেবতুল্য মানুষের ঘর ভাঙতে সাহায্য করেছিলেন। দেবতুল্য মানুষের সুখ শান্তির জন্য প্রয়োজন হলে সাধারণ জীবদের বলি দেওয়া নীতিসঙ্গত কাজ—এই বিশ্বাস দেখলাম শিক্ষিত বাঙালি সমাজে অনেকেরই ছিল।

আশুবাবুর বাড়িতে পার্টিতে একটি স্মরণীয় ঘটনা ঘটল। দিল্লি কলেজের এক অধ্যাপক তাঁর কৌতূহলপ্রবণতার জন্য বিখ্যাত ছিলেন। এঁকে নিয়ে পরিমল রায়ের লেখা একটি বিখ্যাত রম্যরচনা আছে। মাস খানেক আগে ওঁর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল। তখন উনি আমি বিয়ে কেন করিনি, শিগগিরি করার ইচ্ছে আছে কি না ইত্যাদি অনেক প্রশ্ন করেছিলেন। না, ওঁর বিবাহযোগ্য কন্যা ছিল না। প্রশ্নগুলির উৎস নিতান্তই মানবিক কৌতূহল। ওঁর শেষোক্ত প্রশ্নটির আমি নেতিবাচক উত্তরই দিয়েছিলাম। আশুবাবুর বাড়ির পার্টিতে আবার ওঁর সম্মুখীন হলাম। আমার স্ত্রীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলাম। এবার প্রশ্ন, “গত মাসে আপনার সঙ্গে দেখা হয়েছিল, মনে আছে?” “আজ্ঞে হ্যাঁ”। “তখন বলেছিলেন আপনার শিগগিরই বিয়ে করার কোনও ইচ্ছা নেই?” “আজ্ঞে হ্যাঁ।“ তবে মত বদলালেন কেন? এ প্রশ্নের কোনও জবাব নেই। মনে মনে বললাম, আমার স্ত্রীকে দেখে তোমার প্রশ্নের যদি জবাব না পেয়ে থাক, তবে কোনও উত্তরই তোমার তুষ্টিসাধন করবে না।

মডেল টাউনের ফ্ল্যাটে আমরা দড়ির খাঁটিয়ায় শুতাম। ভাবলাম বিবাহের পর ওই ব্যবস্থা পরিবর্তন করার প্রয়োজন। অল্প কিছু আসবাবপত্র কেনার পর অমিতাদির আতিথ্য ছেড়ে নিজেদের ফ্ল্যাটে চলে এলাম। কিন্তু দিল্লি এসেই কুৎসা আর গুজব থেকে নিষ্কৃতি পেলাম, এমন নয়। হাসির নিতান্ত নিরীহ বাবা সব শুভার্থীদের কাছ থেকে চিঠি পেতে লাগলেন–লোকে আমাদের নামে কী বলছে তার বিশদ বর্ণনা দিয়ে। নিয়মনিষ্ঠ মানুষটি সেইসব চিঠি সযত্নে আমাদের কাছে পাঠিয়ে দিতেন। চিঠিগুলি পড়ে আমার স্ত্রী বিপর্যস্ত বোধ করত। আমি এবার ওকে আমি পড়বার আগে কোনও চিঠি পড়তে মানা করলাম। স্মরণীয় ব্যাপার এইসব পত্ৰলেখকরা কেউ কেউ এর আগে আমার সঙ্গে তাঁদের কন্যার বিবাহ প্রস্তাব এনেছিলেন। তার অন্যতম কারণ কলকাতার স্নবমণ্ডলে ভুল ধারণা ছিল যে আকাইভসে ডেপুটি ডিরেক্টরের কাজটা খুব বড় চাকরি। আর তখনও আমাদের সদ্য ঔপনিবেশিকতামুক্ত দেশে অক্সব্রিজের কদর খুব বেশি।

আমার এই পুতুল নিয়ে খেলার সংক্ষিপ্ত অভিজ্ঞতার দু-একটি ঘটনা উল্লেখযোগ্য। আমার এক অগ্রজস্থানীয় বন্ধু আমাকে সম্ভাব্য পাত্র হিসাবে এক বাড়িতে নিয়ে যান। বাড়ির কৃর্তা কলকাতার শিক্ষাজগতে পরিচিত নাম, তাঁর পত্নী অতি বিখ্যাত ব্যক্তির কন্যা। মেয়েটি বেশ সুন্দরী। সুতরাং নিজের উৎসাহেই দ্বিতীয়বার গেলাম। এবার কন্যার পিতা সোজাসুজি প্রশ্ন করলেন—দেশ থেকে টাকাপয়সা আমরা কী আনতে পেরেছি? বুঝলাম ওঁদের ধারণা আমরা বিরাট জমিদার এবং দেশ থেকে বহু অর্থ নিয়ে এসেছি। শুধু আমার মাইনের ভরসায়। ওঁরা বিয়ের সম্বন্ধের কথা ভাবছিলেন না। আমি জানালাম—আমরা কপর্দকহীন হয়ে হিন্দুস্তানে এসেছি। আর কোনও দিনই আমরা ধনী ছিলাম না। তৃতীয় দিন যখন গেলাম–দরজা খুলে বসালেন ওঁর স্ত্রী। তিনি বললেন, দ্যাখো বাবা, মেয়েকে একভাবে মানুষ করেছি। শুধু সরকারি চাকরির মাইনের উপর নির্ভর করে ও সংসার চালাতে পারবে না। সুতরাং এ ব্যাপারটা আর না এগোনোই ভাল। সেলাম ঠুকে বিদায় নিলাম। একবার ভাবলাম জিগ্যেস করি আপনার স্বামীও তো মাস্টারি করতেন। আপনাদের কি তা হলে ওঁর শ্বশুরের টাকায় চলত?

আর একবার আমার এক বন্ধু হঠাৎ মডেল টাউনে তাঁর এক পিসেমশায়কে নিয়ে উপস্থিত। তখন খালেক আর আমি ছাদের উপর ইসমাইলের ভাজা মুরগির ঠ্যাং সহ বিয়ার খেতে ব্যস্ত। বিব্রত হয়ে কিংকর্তব্য স্থির করার জন্য গুরু শ্রীবারট্রান্ড রাসেলকে স্মরণ করলাম। নাঃ, সত্য গোপন করা চলবে না। বিয়ার পান যতই পাপকাজ হোক, মিথ্যাচার করব না। ফলে পিসেমশায়কে জিগ্যেস করলাম, একটু খাবেন? ভদ্রলোকের বোধ হয় আর একটু হলেই পক্ষাঘাত হত। কোনও মতে নিজেকে সামলে এই দুর্জনসঙ্গ ত্যাগ করে শ্যালকপুত্র সহ বিদায় নিলেন। পথে যেতে যেতে বলেন, বেশ ভালই অভ্যর্থনা হল। আর এক ভদ্রমহিলা যিনি আমাদের বিয়ের কথা শুনে বাড়ি বাড়ি গিয়ে নিন্দা করেছিলেন, তিনিও এক সময় তাঁর মেয়ের সঙ্গে আমার সম্বন্ধ এনেছিলেন। ভদ্রমহিলা বিখ্যাত লেখিকা, চলন বলন দেখতে-শুনতে রীতিমতো চিত্তাকর্ষক। সম্বন্ধটা যদি ওঁর সঙ্গে হত, তবে নিশ্চয়ই বেশ আগ্রহী হতাম। কিন্তু মেয়েটা তখন একেবারেই বাচ্চা। ক্র্যাডল স্ন্যাচিংয়ে আমার উৎসাহ ছিল না। কলকাতার নিন্দা-তথা-গুজব্যযন্ত্র বেশ কিছুদিন চালু ছিল। আগেই লিখেছি, ঘটনার এক যুগ পরেও অক্সফোর্ড এসে তার প্রতিধ্বনি শুনেছি। বিধবাবিবাহ আইন চালু হওয়ার একশো বছর পরে আমাদের বিয়ে নিয়ে এত গণ্ডগোল কেন হয়েছিল, তা আমি আজও ঠিক বুঝতে পারিনি। কয়েকটি নেতিবাচক সম্ভাবনা বিচার করে আমি এর ব্যাখ্যা খুঁজেছি। হাসি যদি কোনও সাধারণ ঘরের বধু হত তাহলে এ নিয়ে ঝড় উঠত না। সমৃদ্ধ উদারপন্থী মহানুভব পরিবারের বন্ধু হয়ে তাঁদের দাক্ষিণ্যের সুযোগ পুরোপুরি নিয়ে সে তাঁদের সম্মানহানি করেছে, ঘর ভেঙেছে এইটাই ছিল নিন্দাবান্দার মূল কথা। ওই পরিবারকে ঘিরে একটি স্তাবকমণ্ডলী ছিল। তাঁরাই এই অপপ্রচার শুরু করেন। আশ্চর্যের বিষয়—ওর সামনে বিকল্প কী ছিল এ প্রশ্ন ওঁদের কারও মাথায় আসেনি। দ্বিতীয় কথা–গুপ্ত পরিবার যদি ব্যাপারটা অন্যভাবে নিতেন, মানে আমাদের কল্যাণকামনা করে আশীর্বাদ জানাতেন, তা হলেও ব্যাপারটা অন্য রকম দাঁড়াত। স্তাবকমণ্ডলী ওঁদের মাহাত্মের নতুন এই উদাহরণ বাড়ি বাড়ি প্রচার করতেন এবং সোৎসাহে আমাদের বাসর সাজানে। অতুলবাবুর পত্নীর প্রবল ব্যক্তিত্ব এবং প্রাচীনপন্থী মনোভাব এই সম্ভাবনা অঙ্কুরেই নাশ করেছিল। আর ওঁদের কারও কারও মনে পরিবার নিয়ে মর্যাদাবোধ কিছুটা বেশি তীব্র ছিল। অতুল গুপ্তর পুত্রবধুর পক্ষে পুনর্বিবাহের চেয়ে চিরবৈধব্য শ্রেয় এই ধরনের একটা প্রচ্ছন্ন মনোভঙ্গি ওঁদের স্বাভাবিক মানবিকতাবোধ ব্যাহত করেছিল। একই সময় ওঁরা বাড়ির প্রৌঢ় বড়ছেলের বিয়ের সম্ভাবনায় উৎফুল্ল আর তরুণী ভ্রাতৃবধুর পুনর্বিবাহ নিয়ে তোলপাড় করছেন, এ ব্যাপারটাতেও ওঁরা কিছুটা বিব্রত ছিলেন। স্তবকমণ্ডলী হাসির সামান্য পুঁজি নিয়ে নেওয়ার অপচেষ্টাকে দু’ লাখ টাকা দানের গল্পকথা দিয়ে চাপা দেওয়ার চেষ্টা করে। অচিন্ত্যবাবু ওই অসত্য কাহিনিকে অমরত্ব দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। মজার ব্যাপার এই যে, কখনও কারও মুখে গুপ্ত পরিবার বা তাঁদের স্তাবকমণ্ডলীর কোনও সমালোচনা শুনিনি। আমার ধারণা বিধবাবিবাহ সম্বন্ধে বাঙালির মনে যে দ্বিধা রয়ে গেছে, এই ব্যবহারের প্রধান কারণ তাই। বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকে এই মনোভাব প্রকাশ করার সাহস শিক্ষিত সমাজে বিশেষ কারও ছিল না। শুধু আমার সহকর্মী এক পণ্ডিত ব্যক্তি ঘৃণার সঙ্গে বলেছিলেন, তপন একটা বিধবারে বিয়ে করে দিল্লি চলে গেছে। টা’-টা লক্ষণীয়। এত সৎসাহস বেশি লোকের ছিল না। তাই দু’ লাখ টাকার কাহিনিটি সৃষ্টি করতে হল। আর একটি কথা বলে এই প্রসঙ্গ শেষ করব। কথাটা বিশেষ করে নারীবাদীদের লক্ষ করেই লিখছি। নিন্দাটা হয়েছিল প্রধানত হাসির। আমাদের সমাজে পুরুষ কখনও বিশেষ দোষী হয় না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *