১৭. সকার বেকার

সকার বেকার

উনিশো সাতান্ন সনে দেশে প্লেনে চলাফেরা এখনকার মতো জলভাত হয়ে দাঁড়ায়নি। তাই দু’দিন বোম্বাই বাস করে সিরিল লুইসের উৎসাহে দু’বার (ওর ভাষায়) ‘ঝ্যানক ঝ্যানক প্যায়েলি ব্যাজে’ দেখে ভিক্টোরিয়া টার্মিনাস থেকে কলকাতা রওনা হলাম। প্রায় সাড়ে তিন বছর পর ট্রেনে যেতে যেতে রেলপথের দু’পাশে মাইলের পর মাইল রুক্ষ জমি দেখতে ভালই লাগছিল। শুনি আমাদের দেশ শস্যশ্যামলা। কবি বারবারই লিখেছেন ‘শ্যামল মাটি’। কিন্তু ইউরোপে, বিশেষত ইংল্যান্ডে, স্থলপথে ভ্রমণের সময় যে নিরবচ্ছিন্ন শ্যামলিমা চোখে পড়ে ভারতবর্ষে রেলযাত্রায় তার সঙ্গে তুলনীয় দৃশ্য কচিৎ কখনওই দেখা যায়। আমাদের দারিদ্রর মতোই ওই রুক্ষ জমি আমার চোখে কখনওই বিসদৃশ ঠেকেনি। ধনী আত্মীয়ের বাড়িতে ছুটি কাটিয়ে গরিবের ঘরে ফিরে আসার মতো একটা অনুভূতি হয়েছিল। ঠিক বোঝাতে পারব না, একটা ভাষাতীত স্বাচ্ছন্দ্যর ভাব শরীর-মন স্নিগ্ধ করে দিল।

ওই ট্রেনযাত্রায় একটি ছোটখাটো উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটল। ট্রেনের সঙ্গে ডাইনিং কার ছিল। সেখানে দুপুরের খাওয়া সেরে বসে আছি। হঠাৎ মাঠের মধ্যে ট্রেন থামল। দেখলাম বেশ কিছু লোক দুদ্দাড় নেমে পড়ল। ভাবলাম—এরা বোধ হয় স্থানীয় লোক। ট্রেনের মতিগতি জানে। বোধ হয় এই চিহ্নবিহীন মাঠের মাঝখানে রোজই ট্রেন কিছুক্ষণ দাঁড়ায়। তাই তারা খানা-কামরা ছেড়ে নিজস্ব কামরার অভিমুখে রওনা দিয়েছে। ‘মহাজন যেন গত…’ ভেবে আমিও নেমে পড়লাম। তারপর দেখলাম নড়েচড়ে উঠে মন্দগতিতে ট্রেনও চলতে শুরু করল। বাষ্পযানের গতিবেগ ক্রমেই বাড়ছে দেখে এক সহযাত্রীকে প্রশ্ন করলাম, ‘ট্রেন যে চলে যাচ্ছে মনে হচ্ছে?’

‘তা যাবেই তো!’

‘আর তোমরা?’

‘আমরা? আমরা ওই শহরটায় থাকি। ট্রেন এখানে থামলে কাছে পড়ে, তাই চেন টানা হয়েছিল’।

আর কিছু চিন্তা না করে দৌড়তে শুরু করলাম। ট্রেনের সঙ্গে রেসে এর আগে কেউ জিতেছে বলে শুনিনি। মাইল দেড়েক দৌড়ে সাতানা স্টেশন পৌঁছলাম। দেখলাম—ট্রেনটা তখনও দাঁড়িয়ে। গার্ড সাহেব এগিয়ে এসে বললেন, ‘তোমার দৌড়ের শুরুটা আমরা দেখেছি। ট্রেন এখানে বিশ মিনিট দাঁড়াবার কথা। তোমার জন্য আরও দশ মিনিট বেশি দাঁড়াতাম। রোজই কিছু হাবা ওই মাঠের মাঝখানে নেমে পড়ে।’—গার্ডের ব্যাখ্যা শুনে আত্মজ্ঞান অনেকটা বেড়ে গেল।

কলকাতা পৌঁছে দু’ সপ্তাহের মধ্যে এক বিচিত্র অবস্থায় পড়লাম। সেই অবস্থার কথা স্মরণ করে এই পরিচ্ছেদের নামটা ভেবে-চিন্তেই দিয়েছি। ‘বেকার’ কথাটা ফারসি থেকে ধার করা। ‘কার’ মানে কাজ। যার ও বস্তুর অভাব সে ‘বে-কার’, কর্মহীন। সুতরাং বাংলা ভাষাতত্ত্বর নিয়ম মানলে যে-ভাগ্যবানের কাজ অর্থাৎ চাকরি আছে, সে ‘স-কার’। আপত্তি করলে মানব না। কলকাতা পৌঁছবার পর আমি এক অক্সিমর-এর শিকার হলাম। দু-দুটি চাকরি আমার করতলগত হল। কিন্তু কোনওটিই নেওয়ার পথ সহজ না। তাই ছ’মাস আমি ‘স-কার বে-কার’। অর্থাৎ চাকরি পাওয়া সত্ত্বেও বেকার। এর চেয়ে যদি কেউ ‘শকার ব কার’ করত, তুলনায় হাল খারাপ হত না।

ব্যাপারটা সংক্ষেপে বলি। ওই যে ইস্তাম্বুলের ‘পোস্ত রেস্তাত’-এ ইন্দ্রপ্রস্থে চাকরির ইন্টারভিউর খবর পেয়েছিলাম, তার আড়ালে যে ভাগ্যদেবীর ক্রুর হাসি এবং হাতের বংশরূপী আয়ুধ প্রচ্ছন্ন তা তখন কে জানত? কলকাতা পৌঁছবার দিন দুই পরে দিল্লি রওনা হলাম। শাহজাহান রোডে ইউপিএসসি-র দফতরে ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে লজ্জায় অধোবদন হলাম। চাকরিটা জাতীয় অভিলেখগারের ডেপুটি ডিরেক্টরে। দেখি বিখ্যাত পণ্ডিত এবং অভিলেখবিশারদ শৌরীন রায় বসে আছেন। অভিলেখ (archives) বিষয়ে আমি নবজাত শিশুর মতো অজ্ঞ। শৌরীনবাবুর পাণ্ডিত্যের কথা বহুদিন ধরে শুনেছি। পরে পরিচয় হয়ে দেখেছি—সে-পাণ্ডিত্যের গভীরতা তুলনায় নীরদ চৌধুরীর চেয়েও বেশি ছাড়া কম নয়। এই মহাপণ্ডিতের সঙ্গে টেক্কা লড়ার জন্য আমার মতো অর্বাচীনকে কেন ডাকা হয়েছিল বুঝলাম না। কেন হয়েছিল-পরে শুনলাম।

অভিলেখ সম্পর্কে শৌরীনবাবুর চেয়ে বেশি জানে এরকম লোক ভারতে কেন সারা পৃথিবীতেও বিশেষ কেউ ছিল না বলেই আমার ধারণা। সুতরাং অভিলেখাগারে যখন ডেপুটি ডিরেক্টরের পদ সৃষ্টি হল (উদ্দেশ্য—ওই পদে তালিম নিয়ে পদাধিকারী ভবিষ্যতে ডিরেক্টর হবে), তখন ওয়াকিবহাল মহলে সবাই একবাক্যে বলল—ওই পদের যোগ্য একমাত্র লোক শৌরীন রায়। তখন তিনি অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর। কিন্তু ওয়াকিবহল মহল আরও এক ব্যাপারে সচেতন হলেন। ভারত সরকার কস্মিনকালে ওই পদে শৌরীনবাবুকে বসাবে না। তার আসল কারণ দুটি। এক, শৌরীনবাবু ক্ষমতাশালী লোকদের ন্যায্য কারণেই নাজেহাল করে বিশেষ আনন্দ পেতেন। দুই, এই ব্যাপারের সুযোগ নিয়ে জনৈক ক্ষমতাশালী জয়েন্ট সেক্রেটারি তাঁর ঘনিষ্ঠ কুটুম্ব অভিলেখাগারের অন্য এক অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টরের জন্য পদটি লালনের চেষ্টায় ছিলেন। এখানে উল্লেখযোগ্য—ভারত রাষ্ট্রের প্রতি নিতান্ত অনুগত এই যুগ্মসচিব অবসর নেওয়ার পরের দিনই প্রতিবেশী রাষ্ট্র পাকিস্তানে তশরিফ স্থানান্তরিত করেন। আর তাঁর যে ঘনিষ্ঠ কুটুম্বটির কথা বলেছি, সেই জনাব যুগ্মসচিবের পর পর তিনটি ভগিনীর ভার বৈধমতে গ্রহণ করেন, তবে যুগপৎ নয়। ভদ্রমহিলারা হয় ক্ষীণজীবী ছিলেন অথবা উক্ত পতিদেবতার সঙ্গ ওঁদের বেশি দিন সহ্য হয়নি। যা হোক, যুগ্মসচিব সাহেব অনেক বিবেচনা করে জাল পাতলেন। সৌরীনবাবুর ব্যক্তিগত জীবন সম্বন্ধে এক কুৎসা বাজারে চালু ছিল। যথাকালে বেশ গুছিয়ে কুৎসাটা কাজে লাগাবার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। চাকরিটি শেষ অবধি কে পাবে সে সিদ্ধান্ত নির্ভর করছিল ইউপিএসসি-র আমন্ত্রিত বিশেষজ্ঞদের উপর। তাঁদের শীর্ষস্থানীয় তিন প্রবীণ ঐতিহাসিক আলোচনা করে ঠিক করেন যে, শৌরীনবাবুকে চাকরি দেওয়া অসম্ভব হলে, তরুণ ঐতিহাসিক তপনকে দিয়ে দামাদ সাহেবকে ঠেকাতে হবে। কাজটা কঠিন নয়। কারণ ইসলামে যে ফেরেশতা লেখাপড়ার দিকটা দেখে দামাদ সুদুর অতীতেই তার সঙ্গে যাবতীয় সামাজিক সম্পর্ক ত্যাগ করেন। কারণ অশেষ গুণবান ও প্রভূত ক্ষমতাশালী শালা সাহেব ফেরেশতার কুর্দি অধিকার করে বসেন। কার্যাভাবে ফেরেশতা বরখাস্ত হন। শালা সাহেবকে সরকারি মহলে সম্ভবত তাঁর প্রতি গভীর প্রতিবশত অনেকেই ‘সাহেব’ বাদ দিয়ে শুধু ‘শালা’ বলেই বর্ণনা করতেন।

এইসব কথা বহু দিন পরে ভিতরের লোকদের মুখে শুনি। যে-বিরাট পণ্ডিতের সিদ্ধান্তে চাকরিটি আমার হয়, বহু বছর পর তাঁকে জিজ্ঞেস করি—শৌরীনবাবু থাকতে চাকরিটি কী করে আমার হল? উনি বললেন, ইন্টারভিউ শুরু হওয়ার আগেই নির্বাচকমণ্ডলীর সভাপতি প্রত্যেকের হাতে একটি কাগজ ধরিয়ে দেন। কাগজটিতে শালা সাহেবের সই। সেটির বক্তব্য—অনুল্লেখযোগ্য চরিত্রদোষের (moral turpitude) জন্য সরকার বাহাদুর শৌরীন রায়ের জীবন ও কর্ম নিয়ে তদন্ত করছেন। অভিযোগ সঠিক প্রমাণ হলে তার চাকরি যাবে। ওই কাগজটি হাতে নিয়ে শৌরীনবাবুকে চাকরি দেওয়া সম্ভব ছিল না। আমার সদ্যলব্ধ অক্সফোর্ডের ডিগ্রি ব্যবহার করে দামাদ সাহেবকে ঠেকানো হল। সালটা ছিল ১৯৫৭। ইংরাজ-তথা অক্সব্রিজ-মহিমা তখনও ভারতীয় চিত্তে সমুজ্জ্বল।

এই জুগুপ্সাজনক ঘটনা এবং তার পরিণতিতে আরও অনেক কিছু যা ঘটে–বর্তমান স্মৃতিকথায় তার স্থান হওয়ার একটিই কারণ। দিল্লিতে আমার চাকরি হওয়ার সম্ভাবনায় স্যার যদুনাথ খুব খুশি ছিলেন। কারণ পুরনো জমানার লোক হিসাবে বড় সরকারি চাকরির প্রতি ওঁর সমীহ ছিল। এবং ওঁর চোখে চাকরিটি বড় মাপের, যদিও স্বাধীন ভারতের মাপকাঠিতে ওটি নেহাতই মেজ জাতের। সে কথা থাক। দিল্লি রওনা হওয়ার আগে ওঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। উনি দুটি সাবধানবাণী উচ্চারণ করেন। দিল্লি যেতে উৎসাহ দিলেও বললেন যে-জায়গাটা বড্ড গরম, ওখানে বাস করলে আয়ুষ্কাল পাঁচ থেকে দশ বছর কমে যাবে। সেজনা যেন প্রস্তুত থাকি। প্রস্তুতিটা কীভাবে হবে তা নিয়ে প্রশ্ন করার সাহস হয়নি। দ্বিতীয় কথা, স্বাধীনতা-উত্তর ইন্দ্রপ্রস্থ রাজনৈতিক এবং সামাজিক আবহাওয়ার দিক থেকে আঠারো শতকের মোগল দরবারের সঙ্গে তুলনীয়। ওই শ্বাপদসঙ্কুল জনপদে কীভাবে চলতে হবে—তুলসীদাস থেকে একটি পঙক্তি উদ্ধৃত করে উনি তা বুঝিয়ে দেন : ‘হাঁ জী হাঁ জী করকে সব কাম করকে লো।‘ (উদ্ধৃতিটি বোধ হয় নির্ভুল হল না।) এই উপদেশ অনুসরণ করার মতো দক্ষতা আমার ছিল না। কিন্তু দিল্লি যাওয়ার আগে এবং পরে শাসন-ঘটিত এবং তার সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে যে বিচিত্র ছ্যাঁচড়ামির পরিচয় পাই, প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ হিসেবে তার কিছু বর্ণনা দেওয়া প্রয়োজন মনে করলাম। আমাদের দেশের শাসনযন্ত্র অন্য পাঁচটা দেশের তুলনায় বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত বলে আমি মনে করি না। কিন্তু চাকরি, প্রভাব এবং সরকারি আওতাধীন সম্পদ বণ্টনের ব্যাপারে কী ধরনের দলাদলি এবং ইতরামি চলত তা দেখে সত্যিই অবাক হয়েছিলাম। যত দূর বুঝি—সেই ইতরামির ট্র্যাডিশন আজও অব্যাহত আছে। ভবিষ্যদৃষ্টিসম্পন্ন উনিশ শতকের সাহিত্যিক ইন্দ্রনাথ বাঁড়ুজ্জে লিখেছিলেন, না হয় স্বাধীন হউক ভারতবর্ষ লুটে পুটে খাই। এই লুটেপুটে খাওয়ার ব্যাপারে দক্ষিণে বা বামে কেউই যাঁরা অকারণ চক্ষুলজ্জায় ভোগেন, তাঁরা সংখ্যায় নিতান্তই নগণ্য। বৈপ্লবিক আদর্শে বিশ্বাসী বামপন্থী বুদ্ধিজীবীদের দলবাজির ইতিহাস যথাস্থানে লিখব।

যা হোক, চাকরিটা আমার হয়েছে জানিয়ে শিক্ষা বিভাগ থেকে যথা সময়ে চিঠি পেলাম। কাচুমাচু হয়ে শৌরীনবাবুকে একটা চিঠি দিলাম। পত্রপাঠ ওঁর উত্তর পাই : ‘এ চাকরি আমার কখনওই হত না। আপনি নির্দ্বিধায় চলে আসুন। আমরা সত্যিই খুশি হব।’

কিন্তু নির্দ্বিধায় চলে আসার পথ খোলা ছিল না। ইংল্যান্ড ছাড়ার আগেই ভারতীয় হাই কমিশন আমাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন যে, জলপানি বাবদ আমি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছে দায়বদ্ধ। তাঁরা যে–চাকরি দেবেন তা নিতে হবে। কথাটা সত্যিতে আমি কখনও ভুলিনি। ভুলবার ইচ্ছাও ছিল না। আশা ছিল দেশে ফিরে প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়াব এবং হয়তো কোনওদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর বিভাগে অধ্যাপকের পদ পাব।

জীবন ওই ঈপ্সিত পথেই যাবে, তার প্রায় সব ব্যবস্থাই হয়ে এসেছিল। কিন্তু এক অদ্ভুত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়ে সব কিছু ভেস্তে গেল। সরকারি কলেজে চাকরির উমেদার হয়ে পশ্চিমবঙ্গের পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সামনে উপস্থিত হওয়ার আদেশ দিয়ে রাজ্যের শিক্ষা অধিকর্তার নির্দেশ পেলাম। যথা সময়ে গিয়ে দেখলাম—পরীক্ষকদের মুখগুলি পরিচিত। নির্বাচকদের মধ্যে সুশোন্ডনবাবু আছেন, যে ক্ষমতাশালী মানুষটির বিরাগভাজন হয়েছিলাম, তিনি আছেন, আর আছেন যে বিষ্যাত ঐতিহাসিকের কথায় আমার দিল্লির চাকরিটি হয়েছিল তিনি। এই তৃতীয় ব্যক্তির কাছ থেকে ওই দিনকার সিদ্ধান্তের রহস্য—যা আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল—তা জানতে পারি, প্রায় বিশ বছর পরে। তথ্য গোপন রাখার দায়িত্ব ততদিনে ঘুচে গেছে।

রাজ্য সরকার বাহাদুর ইতিহাস বিভাগে দুটি অধ্যাপকের পদ সৃষ্টি করেন—সিনিয়র এডুকেশন সার্ভিসে। পদ দুটি পেলাম যথাক্রমে অমলেশদা এবং আমি। কিন্তু ব্যাপারটা অত সহজে সমাধান হল না। বিষয় বিশেষজ্ঞ নির্বাচক দু’জন খুবই যুক্তিসঙ্গতভাবে অমলেশদাকে প্রথম এবং আমাকে দ্বিতীয় স্থান দিয়েছিলেন। ওই সিদ্ধান্ত মেনে নিলে আমি প্রেসিডেন্সি কলেজে খুব খুশি হয়েই অধ্যাপনা করতে যেতাম। অধ্যাপক জ্যাকারায় এবং সুশোভনবাবুর পদাঙ্ক অনুসরণ করা, তারক সেন, অমলেশদা এবং অমল ভট্টাচার্যর সহকর্মী হওয়ার চেয়ে শিক্ষাজগতে বড় কোনও সৌভাগ্যর কথা তখন ভাবতে পারতাম না। দিল্লিতে ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছিলাম নিতান্তই নিমরাজি হয়ে বাবা-মা এবং পুরনো শিক্ষক-সহকর্মীদের উৎসাহে। সরকারি চাকরি করার ইচ্ছে থাকলে তো অনেক আগেই ও পথে যেতাম। সুতরাং মহা উৎসাহে রাজ্য সরকারের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় ছিলাম।

সেই সিদ্ধান্ত যখন হাতে পৌঁছল তখন যেন মাথায় বাজ ভেঙে পড়ল। সরকার জানালেন—আমি অধ্যাপকের পদের জন্য মনোনীত হয়েছি এবং যত শীঘ্র সম্ভব যেন প্রেসিডেন্সি কলেজে ওই পদে যোগ দিই ইতিহাস বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হিসাবে। অর্থাৎ আমার অগ্রজপ্রতিম অমলেশ ত্রিপাঠীকে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে আমার অধস্তন হিসাবে কাজে যোগ দিতে হবে। অনেক পরে জানতে পারি যে, বিশেষজ্ঞরা নিতান্ত যুক্তিযুক্তভাবেই অমলেশদাকে প্রথম এবং আমাকে দ্বিতীয় স্থান দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। সে হিসাবে চাকরিতে অমলেশদা আমার সিনিয়র এবং প্রেসিডেন্সি কলেজে বিভাগীয় প্রধান হওয়ার কথা। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের সিদ্ধান্ত সরকারের প্রতিনিধিরা উলটে দেন এবং আরও শুনি যে এই সিদ্ধান্তের পিছনে প্রধান উদ্যোগী ছিলেন সেই ব্যক্তি যিনি অনেক দিন ধরে নানা ব্যাপারে আমার বিরোধিতা করেছেন। এই অদ্ভুত সিদ্ধান্তের কারণ কী ছিল তা আমার জানা নেই। ফারসিতে একটি আপ্তবাক্য চালু আছে—’হব্ব-এ আলি ইয়া ফিতনাহ-এ মুয়াবিয়া’। মুয়াবিয়া ছিলেন হজরত আলির প্রতিদ্বন্দ্বী। তাই বিভ্রান্ত জিজ্ঞাসুর প্রশ্ন ব্যক্তিবিশেষের যে হজরত আলির প্রতি প্রেম দেখা যাচ্ছে তা কি সত্যিতে আলির প্রতি প্রেম না মুয়াবিয়ার প্রতি বিতৃষ্ণা? মানে যে বিচিত্র সিদ্ধান্ত পশ্চিমবঙ্গ সরকার নিলেন তা কি আমার প্রতি অহেতুকি করুণার ফল না অমলেশদাকে শিক্ষা দেওয়ার প্রচেষ্টা? অমলেশদা নির্বিরোধী ভালমানুষ ছিলেন, উপরিওয়ালাদের ওঁর উপর চটার কখনও কোনও কারণ ঘটেছে বলে শুনিনি। সুতরাং এই রহস্যর কোনও সমাধান কখনও হয়নি। এই নাটের যিনি গুরু তাঁর শত্রুরা বলতে লাগল, যে ভদ্রলোক ইয়াগো শ্রেণির মানুষ। সম্পূর্ণ অকারণে লোকের অনিষ্ট করেই ওঁর আনন্দ, এবং ভব্যজনদের অপমান করেই উনি সব চেয়ে বেশি তৃপ্তি পান। আরও যাঁরা কল্পনাপ্রবণ তাঁরা গূঢ়তর উদ্দেশ্যের ইঙ্গিত দিতে লাগলেন। কেউ কেউ বললেন–কংগ্রেসের উঁচুমহলে আমার শক্ত খুঁটি আছে। তাদের ধরে আমিই এই ব্যাপারটা ঘটিয়েছি। সত্যিতে সিদ্ধান্তটা বদলানোর চেষ্টায় আমি খুঁটির শরণাপন্ন হয়েছিলাম। কিছু লাভ হয়নি।

শুনলাম অমলেশদা পদত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। দৌড়ে ওঁর বাড়ি গেলাম। বললাম, একটু অপেক্ষা করুন। সরকার এই সিদ্ধান্ত না বদলালে আমি দিল্লি চলে যাব। দীপ্তি বউদি—যাঁর আমি বিশেষ স্নেহের পাত্র ছিলাম, একবার ঘরে ঢুকে আমাকে দেখে মুখ ফিরিয়ে চলে গেলেন। কোনও কথা বললেন না। বুঝলাম কলকাতা থাকা আমার চলবে না। এই সিদ্ধান্তের আরও কারণ ছিল। অমলেশদা কলকাতার ঐতিহাসিকদের মধ্যে অতি সম্মানিত মানুষ। তাঁর এই ভাগ্যবিপর্যয়ে আমার শিক্ষক এবং এক সময়কার সহকর্মীরা অনেকেই বিচলিত। আমি যাঁদের বিশেষ স্নেহভাজন ছিলাম তাঁরাও বলতে শুরু করলেন, “দেখ, তুমি দিল্লিই চলে যাও। কাজটা বড় মাপের। ওখানে তুমি থাকলে আমরা যারা নথিপত্র নিয়ে কাজ করি তাদের সকলেরই সুবিধা হবে। আর আজকাল বাঙালির ভাগ্যে বড় চাকরি তো প্রায় জোটেই না। সে কথাটাও ভেবে দেখো”। আমার ভূয়োদর্শন তখনও নিতান্ত কাঁচা। তাই এইসব শুনে বড় অভিমান হল। মনে করলাম কলকাতায় আমাকে কেউ চাইছে না। ঠিক আছে, দিল্লি গিয়ে আমি বড় চাকরিই করব। এবং সেই মর্মে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছে আবেদন করলাম। আমি ওঁদের দেওয়া চাকরি নিতে শর্তবদ্ধ। সেই শর্ত থেকে মুক্তি পাওয়ার প্রার্থনা জানালাম। আমার যুক্তি নিতান্তই অকেজো। মহাফেজখানার কাজও জাতীয় সরকারের কাজ, দেশসেবা। সুতরাং…। এটা সত্যিতে কোনও যুক্তি ছিল না। কারণ স্টেট স্কলারশিপ পুনরুজ্জীবনের একটিই উদ্দেশ্য ছিল—সরকারি কলেজগুলিতে ভাল শিক্ষকের ক্যাডার তৈরি করা, ঢালাওভাবে দেশসেবা নয়। পশ্চিমবঙ্গ সরকার আমার দরখাস্ত নাকচ করলেন। এর পর প্রচণ্ড টানাপড়েন শুরু হল। দিল্লি যাওয়ার আমার আদৌ উৎসাহ ছিল না, কিন্তু আমি গোঁয়ার বাঙাল। কিছুতে বাধা পেলে গোঁ ধরে বসা স্বভাব। অতএব দিল্লি যাব বলে বেঁকে বসলাম। খুঁটি দড়ি যা-কিছু আমার সহায়সম্বল ছিল সব কিছুরই শরণ নিলাম। স্বয়ং বিধান রায়ের কাছেও গেলাম। কিন্তু এই দ্বন্দ্বে যে-ক্ষমতাশালী মানুষটি আমার প্রতিপক্ষ তিনি বিধানবাবুর বিশেষ প্রিয়পাত্র। তাঁকে উনি বেইজ্জত করতে পারেন না। শুনেছি তাঁকে ডেকে মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, আরে ছোঁকরাকে যেতে দেও হে। ‘দেখছি স্যার’ বলে ভদ্রলোক নতুন কৌশল চিন্তা করতে লাগলেন।

এই টানাপড়েনের ফলেই পাঁচ-ছ’ মাস ধরে আমার সকার বেকারত্ব। হাতে দু’দুটি বেশ লোভনীয় চাকরি, অথচ একটি আমি অনিবার্য কারণে চাইছি না আর অন্যটি আমার নাগালের বাইরে থেকে যাচ্ছে। এই ত্রিশঙ্কু অবস্থা থেকে কীভাবে নিষ্কৃতি পেলাম সে কথায় পরে আসছি।

সকার বেকার হয়ে এই সময়টা আমার পিতার হোটেলেই কাটে। মাথার উপর ছাদ আছে (লিনটন স্ট্রিটের প্রাচীন নবাববাড়ির ছাদ রীতিমতো মজবুত), অন্নাভাবও নেই, শুধু ট্যাঁকের অবস্থার একমাত্র তুলনা গড়ের মাঠ। বাবার কাছে বখামি করার জন্য পয়সা চাইতে লজ্জা করে। অক্সফোর্ডের ডিগ্রি নিয়ে এসে লেজও কিঞ্চিৎ স্ফীত। তাই প্রাইভেট টিউশনি করতেও অসম্মান বোধ হয়। ফলে বন্ধুবান্ধবের কাছে ধারধোর করতে শুরু করি। সেইসব ধার বোধ হয় কখনও পুরোপুরি শোধও দেওয়া হয়নি। কেউ চায়ওনি। কিন্তু এই সময়টা আমার পুরোপুরি খারাপ কেটেছে বললে ভুল হবে। ওই কমাস লেখাপড়া কিছুই করিনি। কিন্তু ওরকম চুটিয়ে আড্ডা দেওয়ার সৌভাগ্য এর আগে বা পরে কখনও হয়নি। আর সে কি আড্ডা!

আড্ডাটা জমত প্রধানত একটি মানুষের বাড়িতে। তাঁর নাম রণজিৎ গুহ, বর্তমানে যিনি সাবলটার্ন গোষ্ঠীর স্রষ্টা এবং নেতা হিসাবে জগদ্বিখ্যাত। আমরা বলতাম রঞ্জিতদা। এই সম্বোধনে উনি খুব খুশি হতেন না বলেই আমার ধারণা। উনি নিজেকে রণজিৎ বলেই পরিচয় দিতেন। রণজিৎ এবং রঞ্জিত শব্দ দুটি সমার্থক নয়। ফোন করলে উনি বলতেন ‘রণজিৎ গুহ কথা বলছি’, রণজিৎ শব্দটা রীতিমতো আন্ডারলাইন করে। তবে ব্যাপারটা আমরা খুব দ্রুক্ষেপ করতাম না। উনিও কখনও স্পষ্টত কোনও আপত্তি জানাননি। রণজিৎদার সঙ্গে আমার পরিচয় ১৯৪৩ সাল থেকে। তখন উনি কমিউনিস্ট পার্টির সভ্য এবং স্টুডেন্টস ফেডারেশনের প্রথম সারির নেতা। তুখড় বুদ্ধিমান এবং ইন্টেলেকচুয়াল হিসাবে খ্যাতিমান। দলে নতুন কর্মী জোটানোর ব্যাপারে ওঁর দক্ষতা ছিল অসাধারণ। এই দক্ষতা পরে ওঁর প্রধান কীর্তি সাবলটার্ন আন্দোলন গড়ে তোলার ব্যাপারও কাজে লেগেছিল। ওঁর জীবনী কখনও কেউ নিশ্চয়ই লিখবে। তাঁর এবং কৌতূহলী পাঠিকা পাঠকের জ্ঞাতার্থে এখানে কিছু তথ্য নিবেদন করি। কারণ অতি ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধব ছাড়া কারও কাছে ওঁকে নিজের সম্বন্ধে কথা বলতে শুনিনি।

যুদ্ধ থামবার অল্পদিন পরেই রণজিৎদা বিশ্ব গণতান্ত্রিক যুব সঙেঘর (ওয়ার্লড ফেডারেশন অফ ডেমোক্র্যাটিক ইউথ) সেক্রেটারি নির্বাচিত হন। প্রতিষ্ঠানটি বিশ্বব্যাপী সাম্যবাদী আন্দোলনের অন্যতম মুখপাত্র বা ফ্রন্ট ছিল। শত্রুরা বলত কোমিন্টার্নের তাঁবেদার। এ ব্যাপারে সত্যাসত্য যাই হোক, কলকাতার প্রগতিবাদী ছাত্ররা প্রতিষ্ঠানটিকে বিশেষ সম্মানের চোখেই দেখত। রণজিৎদা ওই প্রতিষ্ঠানের সেক্রেটারি নির্বাচিত হওয়ায় আমাদের কাছে ওঁর মানসম্মান দশগুণ বেড়ে গেল। ছাত্র ফেডারেশনের নেতা হিসাবেই ওঁর এই পদপ্রাপ্তি। যুব সঙেঘর হেড অফিস তখন প্যারিসে। রণজিৎদার প্যারিস যাওয়ার রাহাখরচা বাবদ ছাত্র ফেডারেশন চাঁদা তুলতে লাগল। আমরা ওই খাতে যে যা পারি সাধ্যমতো দিয়েছিলাম। প্যারিসে সাম্যবাদীরা যুদ্ধের শেষে একটি ‘শাতো’ অর্থাৎ কেল্লা দখল করে বসেছিল। সেই কেল্লাতে যুব সঙেঘর হেড অফিস এবং তৎসহ রণজিৎদার বাসস্থান নির্দিষ্ট হয়। এর পর ওঁর কার্যকলাপের খুঁটিনাটি উনি কখনও আলোচনা করেননি। কিন্তু কথায় কথায় জানতে পারি যে ওই সময়ে ওঁর কর্মক্ষেত্র প্রায় সারা পৃথিবীতে ছড়ানো ছিল এবং কমিউনিস্ট জগতের সব প্রধান নেতাদের সঙ্গেই উনি সাক্ষাৎ এবং আলাপ-আলোচনার সুযোগ পান। স্তালিন, মাও-জেদঙ, চৌ-এন-লাই, হো চি মিন্—এঁদের সকলের সঙ্গেই ওঁর পরিচয় হয়েছিল।

কয়েক বছর পর যখন যুব সঙেঘর সেক্রেটারি হিসাবে রণজিৎদার কাজের মেয়াদ শেষ হল, তখন উনি দেশে ফিরে আসেন। যত দূর মনে পড়ে সনটা ছিল ১৯৫২। আমি তখন সরকারি কলেজের চাকরি ছেড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর বিভাগে যোগ দিয়েছি বা শিগগিরই দেব। আমি চলে যাওয়ায় যে পদটি খালি হল, সেটি রণজিৎদা পেলেন। নিতান্তই আশ্চর্যজনকভাবে সরকার তখনকার মতো খেয়াল করলেন না যে মানুষটি কমিউনিস্ট পার্টির সভ্য। উনি যে প্যারিসে কয়েক বছর বাস করেছেন এবং ফরাসি ভাষাটা ভালভাবে। জানেন এই সংবাদে নিয়োগকর্তারা বিশেষ উত্তেজিত হয়ে পড়েন। পুলিশের রিপোর্ট আসবার আগেই উনি চাকরিতে যোগ দেন। অবশ্য রিপোর্টটি কর্তাদের হাতে পৌঁছনো মাত্রই ওঁর চাকরি খতম হয়। কর্তারা কি তখন জানতেন যে-দলের সভ্য হওয়ার অপরাধে রণজিৎদার চাকরি গেল, সেই দলই একদিন আড়াই দশক ধরে রীতিমতো নির্বাচন জিতে পশ্চিমবঙ্গে নিরঙ্কুশ রাজত্ব করবে? জানলে বেচারিদের হাত কচলে কচলে হাতের অর্ধেক চামড়া যে উঠে যেত! যা হোক ওঁকে বেশিদিন বেকার থাকতে হয়নি। তখন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় সবে গুছিয়ে বসছে। ওঁর মতো লোক পেয়ে তাঁরা লুফে নিলেন। আমি যখন সকার বেকার তখনও রণজিৎদা যাদবপুরে পড়াচ্ছেন।

ওঁর বাসস্থান তখন ফার্ন রোডের একটি ফ্ল্যাটে। ওঁর প্রথমা পত্নী পোল্যান্ডের কন্যা মার্থা তখন দেশে এসে গেছেন। ফার্ন রোডের আড্ডায় ওঁরও একটি বিশেষ স্থান ছিল। আর অন্যতর আকর্ষণ ছিল একটি আলবোলা। (আশা করি আমার স্মৃতি আমাকে বিভ্রান্ত করছে। পরে দিল্লিবাসের সময় আমি নিয়মিত গুড়ুক খেতাম। আশা করি তার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলছি না।) আলবোলা তৈরির ব্যাপারে যত দূর মনে পড়ে মাথাও সক্রিয় অংশগ্রহণ করতেন।

কিন্তু তামাকই ওই আড্ডার একমাত্র আকর্ষণ ছিল না। সপত্নীক রণজিৎদা ছাড়াও ওই আড্ডার অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ছিল সদ্য কেমব্রিজ-প্রত্যাগত অমর্ত্য সেন, অক্সফোর্ডে আমার সহপাঠী প্রয়াত পরমেশ রায় এবং অনুজপ্রতিম শ্যামলেন্দু ব্যানার্জি, এবং মাঝে মাঝে মৃণাল দত্তচৌধুরী। আরও অনেকে মাঝে মাঝে যাওয়া-আসা করতেন। তাঁদের সকলের নাম এখন মনে পড়ে না।

আগেই লিখেছি, ইংল্যান্ড বাসের সময় অমর্ত্যর সঙ্গে মাঝে মাঝে দেখা হত। ১৯৫৩ সালের ইস্টারের সময় আমরা বাসে চড়ে সাত-আট জন মিলে লেক ডিস্ট্রিক্ট বেড়াতে গিয়েছিলাম। সে দলে অমর্তও ছিলেন। এ ছাড়াও মাঝে মাঝে নানা জায়গায় দেখা হত। অমর্তও মাঝে মাঝে অক্সফোর্ড আসতেন। আমিও কেমব্রিজে বেড়াতে যেতাম। আর নানা সুত্রে কেমব্রিজে ওঁর রীতিমতো কীর্তিস্তম্ভ গড়ে উঠছে, সে খবর আমাদের কানে আসত।

সকার বেকার হয়ে আমি যখন রণজিৎদার বাড়ির আড্ডার অন্যতম প্রধান আড্ডাধারী, তখন সেই আড্ডার উজ্জ্বল রত্ন অমর্ত। কেমব্রিজে প্রথম শ্রেণিতে ট্রাইপস নিয়ে এবং অ্যাডাম স্মিথ প্রাইজ জিতে অমর্ত্য তখনই ভারতবিখ্যাত, দুনিয়ার ইংরেজি ভাষাভিজ্ঞ অর্থনীতিবিদ মহলেও উদীয়মান প্রতিভা হিসাবে স্বীকৃতি পেতে শুরু করেছেন। কলকাতায় বসে তখন তিনি ট্রিনিটি কলেজের ফেলোশিপ থিসিস লিখছেন। আর সব কিছু ছাড়াও একটি ব্যাপারে ওঁর অসাধারণত্বর পরিচয় পেলাম। রণজিৎদার বাড়িতে বেশ প্রত্যুষেই আড্ডা বসে যেত। দশটা-এগারোটা নাগাদ অমর্তও এসে যেতেন। জানতাম ঘণ্টা দুয়েক কাজ করে উনি আড্ডায় এসেছেন। ঠিক একটায় বাড়ি চলে গিয়ে খাওয়ার পর ঘণ্টা দুয়েক কাজ করে আবার সাড়ে চারটে-পাঁচটায় আড্ডায় হাজিরা দিতেন। অমর্ত্য বলতেন সত্যিকার মাথার কাজ দিনে তিন-চার ঘণ্টার বেশি করা যায় না। যে ব্যাপারটা আশ্চর্য লাগত তা এই যে মানুষটি মুহূর্তের মধ্যে আজ্ঞা ছেড়ে গভীর চিন্তাভিত্তিক গবেষণার কাজে ফিরে যেতে পারতেন। মনের এই সহজাত ডিসিপ্লিন আমি আর কারও ভিতর দেখতে পাইনি। পরে দিল্লি স্কুল অফ ইকনমিকসে এক সঙ্গে কাজ করার সময় দেখেছি—আড্ডা দেওয়ার সময় ওঁর আর নেই। বহু এবং বিচিত্র কর্মে তখন তিনি ব্যস্ত। একই সঙ্গে বহু বিষয়ে গবেষণা করছেন, সরকারি-বেসরকারি বহু কাজে তিনি জড়িত, দেশে-বিদেশে অগণ্য সেমিনার কনফারেন্সে বক্তৃতা করছেন। কলকাতায় কর্মজীবনের শুরুতে যে সহজাত ডিসিপ্লিন ওঁর চরিত্রের অসাধারণ বৈশিষ্ট্য বলে মনে হয়েছিল, সেই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যই ওঁর বিচিত্র কর্মপ্রচেষ্টায় সাফল্য এনেছে। অনেক মানুষকে দেখেছি কারণে-অকারণে সর্বদাই এত ব্যস্ত যে নিশ্বাস ফেলা কেন, তাদের মরবারও সময় নেই। এই রকম শাসরোধকারী অতিব্যস্ততা অমর্ত্যর জীবনে কখনও প্রত্যক্ষ করিনি। সঙ্কটের মুহূর্তেও দেখেছি তিনি কখনও হিমসিম খাচ্ছেন না, স্বচ্ছন্দ স্বাভাবিকভাবে নিজের কাজ এবং তার সঙ্গে যাবতীয় সামাজিক কর্তব্য করে চলেছেন। প্রসঙ্গত বলি, কলকাতায় প্রচণ্ড আড্ডার ফাঁকে ফাঁকে যে ফেলোশিপ থিসিস অমর্ত্য লেখেন তার ভিত্তিতে প্রকাশিত ‘চয়েস অফ টেকনিক’ পঞ্চাশ বছর পরে এখনও বিক্রি হয়, লোকে শ্রদ্ধার সঙ্গে পড়ে। তার প্রাসঙ্গিকতা এখনও নিঃশেষ হয়নি।

আড্ডাধারীদের মধ্যে প্রধানস্থানীয় ছিলেন আর একজন—পরমেশ রায়, অক্সফোর্ডে আমাদের সমসাময়িক, অর্থনীতির ছাত্র। এই মানুষটি বিশুদ্ধ জ্ঞানচর্চায় বিশ্বাসী এবং সর্বদাই তত্ত্বচিন্তার এক তৃরীয় জগতে বিরাজ করতেন। অর্থনীতিবিদ হলেও তাঁর আসল ভালবাসা ছিল অঙ্কশাস্ত্রর সঙ্গে। এবং সবসময়ই হাতে তাঁর উচ্চতম অঙ্কশাস্ত্রবিষয়ক কোনও বই থাকত। মুখে একটি পাইপ খুঁজে মাঝেমধ্যে পরমেশ দু-একটি মন্তব্য করতেন। বাকি সময়টা পাইপটি প্রজ্জ্বলিত রাখার চেষ্টায়ই ব্যয়িত হত। কেন জানি না, কচিৎ কখনও সে চেষ্টা সফল হত। সাধারণ সংসারী লোকের সঙ্গে ওঁর মিল সামান্যই ছিল। একটি কিছুটা ‘ইয়ে ইয়ে’ কাহিনি বলে ব্যাপারটা বোঝাবার চেষ্টা করি। অক্সফোর্ড থাকাকালীন এক খ্যাতনামা সুন্দরী পরমেশকে কিঞ্চিৎ নেকনজরে দেখতেন। অন্য কেউ হলে বর্তে যেত, কিন্তু স্বভাব-উদাসীন পরমেশের এ ব্যাপারে কোনও তাপ-উত্তাপ ছিল না। একদিন বিশেষ বিভ্রান্ত হয়ে পরমেশ তাঁর এক সমস্যার কথা নিবেদন করলেন। আগের দিন ডিনারের পর মেয়েটি পরমেশের ঘরে এসেছিল। তার পরের কাহিনি পরমেশের জবানিতেই বলি। “বুঝলে তপন, ওই জিন মেয়েটার বুদ্ধিশুদ্ধি একটু কম। কাল আমাকে জিজ্ঞেস করল, আমার ফিগার তোমার কেমন লাগে?” আমি বললাম, “ঠিকই তো আছে”। ও বলল, “ভাল করে দেখে তো বলবে।“ বলে জামাকাপড় খুলে ফেলল। তারপর জিজ্ঞেস করল, “এখন কেমন দেখছ?” বললাম, “সত্যি বলতে একটু পুরুষালী। কতকটা মাইকেল এঞ্জেলোর দিবা আর নিশার মতো।“ মনে হল কথাটা শুনে ও খুব খুশি হল না। জামাকাপড় পরে নিয়ে বের হয়ে চলে গেল। আচ্ছা, আমি তো অকারণে মিথ্যে কথা বলতে পারি না। আমি কি কিছু ভুল করেছি মনে হয় তোমার? ভাবলাম বলি, নাঃ, তোমার কিছুমাত্র ভুল হয়নি। তুমি সত্যকাম, তুমি সত্যকুলজাত।

.

দেখতে দেখতে মাস তিনেক কেটে গেল। পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাদের সিদ্ধান্তে অচল-অনড়। উল্টে চিঠি দিলেন—অমুক তারিখের মধ্যে কাজে যোগ দাও, নয়তো সুদ সহ জলপানির টাকা ফেরত দাও। দিল্লি থেকেও চিঠি এল—সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে কাজে যোগ দিলে চাকরিটি অন্য লোককে দেওয়া হবে। শুনলাম কেন্দ্রীয় সরকার পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছে লিখেছিলেন, আমাকে যেন ছেড়ে দেওয়া হয়। কোনও কাজ হয়নি। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উক্তিতে এক মারাত্মক সমাধানের ইঙ্গিত পেলাম। খোঁজ নিতে শুরু করলাম খেসারত দিতে যদি রাজি হই তবে তার পরিমাণ কী হবে। তার পুত্র পার্থসারথি মারফত শৈবাল গুপ্তের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল। ওঁর স্মরণাপন্ন হলে তিনি বললেন, “দাঁড়াও দেখছি।“ তিনি আমার আর এক শুভার্থী করুণা হাজরার পরামর্শ চাইলেন। এই দ্বিতীয় ব্যক্তি তখন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আইন বিষয়ে উপদেষ্টা। এই ধরনের একটি কেস বছর দুয়েক আগে ওঁর কাছে এসেছিল। করুণাবাবু বললেন, ‘স্টেট স্কলারশিপের দায়বদ্ধতার চুক্তিটি বহু বছরের পুরনো। তাতে খেসারতের একটা পরিমাণ উল্লিখিত আছে-পনেরো হাজার টাকা। আমি যেন ওই পরিমাণ টাকা কয়েক কিস্তিতে ফেরত দেব বলে দিল্লির চাকরি নেওয়ার অনুমতি চাই।’ ওই উপদেশ অনুযায়ী দশ বছরে আমি টাকাটা ফেরত দেব বলে দিল্লি চলে যাওয়ার অনুমতি চাইলাম। শুনলাম শিক্ষামন্ত্রী বিনা খেসারতে আমাকে ছেড়ে দিতে বলেন, কিন্তু প্রশাসন থেকে প্রবল আপত্তি হওয়ায় সেই প্রস্তাব কার্যকরী হয়নি। দশ বছরে বার্ষিক ১৫০০ টাকা কিস্তিতে টাকাটা শোধ করব এই শর্তে পশ্চিমবঙ্গ সরকার আমাকে চুক্তি থেকে মুক্তি দিলেন। তখন খুবই রাগ হয়েছিল, কিন্তু পরে সুস্থ মস্তিষ্কে ভেবে দেখেছি পশ্চিমবঙ্গ সরকার কোনও অন্যায় করেননি। বরং আমিই আইনের সুযোগ নিয়ে যে-জলপানিতে কয়েক লক্ষ টাকা খরচ হয়েছে, তার সামান্য অংশ ফেরত দিয়ে দিল্লি চলে যাই। এভাবে সবাইকে ছেড়ে দিলে স্কলারশিপের মূল উদ্দেশ্যটাই ব্যর্থ হয়ে যেত।

১৯৫৭ সালের সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ট্রেনে দিল্লি রওনা হলাম। সেখানে বিচিত্র ভবিতব্য আমার জন্য অপেক্ষা করে ছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *