০৪. আপনজন

আপনজন

শৈশবের কথা স্মরণ করলে অনেকগুলি মুখ মনে পড়ে। আরও মনে পড়ে তাদের সঙ্গে ভালবাসার বন্ধন। দীর্ঘদিন বিদেশে বাস করে বুঝেছি, আমাদের সমাজের বিশিষ্ট লক্ষণ মানুষে মানুষে এই স্নেহবন্ধন সহস্র রকমের ক্ষুদ্রতা, দলাদলি, ঈর্ষা-দ্বেষ সত্ত্বেও এক ধরনের আনন্দ আর শান্তির স্বাদ নিয়ে আসে, যার তুলনা পৃথিবীর অন্য কোনও সমাজে বোধ হয় নেই।

ইংল্যান্ডে এক সন্ধ্যায় ট্রেনে বাড়ি ফিরছি। কামরায় সহযাত্রী শুধু একজন মুসলমান মৌলবি। উনি জায়েনমাজ বিছিয়ে সান্ধ্য নমাজ পড়লেন। কথা বলতে গিয়ে বুঝলাম–ইংরাজি ভাষাটা ওঁর অজানা, আমার অখাদ্য হিন্দুস্তানিতে বাতচিত শুরু করলাম। মৌলবি সাহেব জানালেন বিদেশে এই ওঁর প্রথম আগমন। কেমন লাগছে এই প্রশ্নের উত্তরে চারটি শব্দে বিলাতি সভ্যতার উনি যে-মূল্যায়ন করলেন, তার চেয়ে সুষ্ঠু বর্ণনা এবং আমাদের সঙ্গে এদের মূলগত তফাত কোথায় তার নির্দেশ, আমি আর কোথাও পাইনি। ওঁর বক্তব্য—এদের “ইনসানিয়াত জেয়াদা, মুহব্বত কম।” অর্থাৎ আমাদের সমাজে “মুহব্বত জেয়াদা, ইনসানিয়াত কম।” ব্যাপকতম অর্থে সেই মুহব্বত আমাদের সমাজ এবং ব্যক্তিচেতনাকে রক্ষা করছে, শত যন্ত্রণা আর ব্যর্থতাবোধ সত্ত্বেও আনন্দের সন্ধান দিচ্ছে। যদি কোনওদিন ইনসানিয়াত অর্থাৎ যে সব গুণে মানুষ এই পৃথিবীতে সুখ-সমৃদ্ধি ধর্মময় বীরভোগ্য জীবন যাপন করতে পারে, তা আমাদের আয়ত্ত হয়, আশা করি ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তার মূল্য হিসাবে আমাদের মূল্যাতীত স্নেহবন্ধনগুলি বিসর্জন দেবে না।

‘জীবনস্মৃতি’তে রবীন্দ্রনাথ তাঁর শৈশবে দাসরাজত্বর কথা লিখেছেন। বিশাল যৌথ পরিবারের প্রাসাদোপম বাসভবনে এই সেকশ্রেণী তুর্কি সুলতানদের দাসগোষ্ঠীর মতোই অশেষ ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। যখনই ভারতীয় শাসনযন্ত্রের ছোট কর্তাদের শরণাপন্ন হতে হয় তখনই দেখা যায় যে, সম্পদ ও পদমর্যাদায় নীচের সিঁড়ির মানুষ ক্ষমতা হাতে পেলে তার ব্যবহারে কারুণ্য দেখান না। কবির শৈশব-অভিজ্ঞতাও একই জাতের নিষ্করুণতার স্মৃতিতে মলিন। ঠাকুরবাড়ির দাসগোষ্ঠী শিশু আর মা বাপের মাঝখানে এক দুর্ভেদ্য বেড়ার ভূমিকাও পালন করত।

আমাদের চারপাশে সেবকশ্রেণির যারা ছিল, তারা একেবারেই ক্ষমতাহীন মানুষ। আমার ঠাকুর্দারা চার ভাই। বড় ঠাকুর্দা রোহিণীকুমার কিছুদিন যৌথ পরিবারব্যবস্থাই চালু রেখেছিলেন। আমার ঠাকুর্দা, কনিষ্ঠ বিনোদকুমার, স্বভাব এবং আচরণে পাশ্চাত্যভাবাপন্ন ছিলেন। আমাদের গ্রাম এবং শহরের সব সম্পত্তিই এজমালি হলেও শহরের বাড়িতে ঠাকুর্দা একাই পুত্রকন্যা নিয়ে বাস করতেন। গ্রামে যেসব জ্যাঠা কাকা জেঠতুতো-খুড়তুতো ভাইবোনেরা থাকতেন, তাদের তুলনায় আমাদের শিক্ষাদীক্ষা ধরনধারণ একটু বেশি শহুরে ছিল। এই পার্থক্যর একটি লক্ষণ গ্রামবাসী আত্মীয়দের সেবকশ্রেণির সঙ্গে আচার ব্যবহারে ভেদবুদ্ধি কিছু কম ছিল। ঝি-চাকররা কনিষ্ঠদের কাকা-পিসি-দাদা-দিদি। রাঁধুনি ব্রাহ্মণ হলে বাড়ির ছেলেমেয়েরা তার পদধূলি নিত। আর ঠাকুর-চাকরের হাতে কানমলা চড়চাপড় খাওয়া তাদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার অঙ্গ ছিল। কর্তারা পারতপক্ষে ভৃত্যদের গায়ে হাত তুলতেন না, যদিও কাছারিঘরে দুর্বিনীত ‘প্রজা’ অর্থাৎ রায়তদের মারবার জন্য সওয়া হাত জুতার ব্যবস্থা ছিল। সেই জুতার স্মৃতি কীর্তিপাশার লোকগীতিতে আজও বেঁচে আছে—মিহির সেনগুপ্ত লিখিত ‘সিদ্ধিগঞ্জের মোকাম’-এ সে কথার উল্লেখ পাই। মোটকথা আমাদের পরিবারের মধ্যে যাঁদের শহুরেপনা বা পশ্চিমায়ন কিছু কম, তাঁদের আধুনিক শ্রেণিসচেতনতাও অতটা জাগ্রত ছিল না। শ্রেণিসচেতনতা অবশ্যই ছিল, কিন্তু সে কতকটা প্রাক্-আধুনিক সামন্ততন্ত্রের মনোভঙ্গিতে চিহ্নিত। সেখানে প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্কে অলঙঘ্য লক্ষ্মণগণ্ডি ছিল না। ভৃত্য সত্যিতেই পরিবারের একজন, সম্পর্কে প্রভুর ভাই বা সন্তানস্থানীয়।

আমাদের অধুনাপন্থী ‘নিউক্লিয়ার’ পরিবার এই প্রাক্-আধুনিক মনোভাব থেকে অনেক দুরে চলে এসেছিল। আমাদের যারা সেবা করে, তারা যে কখনওই আমাদের সঙ্গে একাসনে বসতে পারে না, এবং ক্রোধের মুহূর্তে তাদের গায়ে হাত তোলা গুরুজনদের বিধিদত্ত অধিকার—শৈশবে এ বিষয়ে সংশয়ের কোনও অবকাশ ঘটেনি। অবশ্যি সংস্কারলব্ধ বর্ণধর্ম শ্রেণিসম্পর্ক কিছুটা গুলিয়ে দিয়েছিল। ভৃত্যর গায়ে হাত তোলা যেত, কিন্তু পাচক ব্রাহ্মণের গায়ে কখনওই না। মুসলমান জমিদার বাড়িতে ঝিয়েদের উপরও মারধর হতে দেখেছি। ঝিকে মারধর করা সম্ভবত বাঙালি হিন্দু পরিবারে চালু ছিল না। Thank God for small mercies.

মোট কথা, গ্রামবাসী জেঠতুতো-খুড়তুতো ভাইবোনেরা হয়তো কিছুটা রবীন্দ্রনাথ বর্ণিত দাসরাজতে বাস করতেন। অনুরূপ অভিজ্ঞতা আমাদের হয়নি। পরিণত বয়সে যে-মূল্যবোধ শ্রেয় বলে মেনেছি, তার দৃষ্টিকোণ থেকে আমাদের গ্রামবাসী আত্মীয়দের প্রাক-আধুনিক শ্রেণিচেতনা তুলনায় অনেক বেশি মানবিকতা বোধে সমৃদ্ধ মনে হয়েছে। আমাদের পরিবারে ঝি-চাকরদের উপর অত্যাচার করা হত এমন না। কিন্তু তারা যে আমাদের মতো ভদ্রলোক নয়, এ কথা কখনও ভুলতে দেওয়া হত না।

এই শ্রেণিচেতনা শৈশবের স্বতঃস্ফুর্ত স্নেহ-ভালবাসার উপর ছায়া ফেলেনি। তার অন্যতর কারণ, একটি মানুষের অস্তিত্ব আমাদের পরিবারে শ্রেণিসম্পর্ক কিছুটা ওলট-পালট করে দিয়েছিল। যতিদিদি। আমার ঠাকুর্দা বজরায় বেড়াতে বের হয়ে এক স্নানরতা চতুর্দশী সুন্দরীকে দেখে তাকে বিয়ে করেন। বিনোদপত্নী সরোজিনীর রূপের খ্যাতি সে যুগে বাঙালি ভদ্রসমাজের সর্বত্র পৌঁছেছিল। দীনেশচন্দ্র সেনের ‘ঘরের কথা ও যুগসাহিত্য’-এ লেখকের মামাতো বোন সরোজিনীর রূপবর্ণনা এবং ছবি আছে। সাহেব সিভিল সার্জন ঠাকুমাকে দেখতে এসে মন্তব্য করেছিলেন, “বিনোদবাবু, আপনার স্ত্রীকে ঈশ্বর সংসার করার জন্য সৃষ্টি করেননি। অতি মূল্যবান চিনামাটির পুতুলের মতো এঁকে কাঁচের আলমারিতে সাজিয়ে রাখলে ঠিক হয়।” ছাব্বিশ বছর বয়সে চতুর্থ সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে ঠাকুমা মারা যান। ঠাকুর্দার বয়স তখন ত্রিশ। শিশুকন্যাটিকে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য একটি মানুষের প্রয়োজন হয়। সেই কাজের জন্য যার আবির্ভাব হল সে যতি। প্রসঙ্গত বলি, পরে সেই শিশুকন্যা, আমার ছোটপিসি পদ্মার সঙ্গে কংগ্রেস নেতা কিরণশঙ্কর রায়ের বিয়ে হয়।

যতি মুর্শিদাবাদের এক বর্ধিষ্ণু কৃষক পরিবারের মেয়ে। জাতে তাঁতি, তিন বছর বয়সে বিয়ে হয়ে পাঁচ বছর বয়সে সে বিধবা হয়। তারপর অনেক দুর্গতির ইতিহাস। কাগজে বিজ্ঞাপন দেখে যতির কোনও আত্মীয় ওর হয়ে দরখাস্ত করে। (যতি পড়তে পারত, কিন্তু লেখার ব্যাপারে নাম সইয়ের উপরে আর উঠতে পারেনি।) সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্যক্রমে শিশু পদ্মকে পালন করার চাকরিটি ও পেয়ে যায়। বিপত্নীক তরুণ জমিদার বিনোদকুমার দ্বিতীয়বার বিয়ে করলে সেটা কিছু অস্বাভাবিক বা নিন্দাৰ্হ ব্যাপার হত না। কিন্তু সন্তানবৎসল ভদ্রলোক আবার বিয়ে করে ছেলেমেয়েদের সৎমার হাতে দিতে প্রস্তুত ছিলেন না। তা ছাড়া একমাত্র ছেলে অমিয় বা চাঁদের প্রতি তাঁর স্নেহর কোনও সীমা ছিল না। আবার বিয়ে করলে পুত্রের সম্পত্তিতে অন্য ভাগীদার আসতে পারে—এ সম্ভাবনাও ওঁর কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি। সন্তানদের কথা ভেবে তিনি যে-আত্মত্যাগ করলেন তার ফল ভুগল একটি মানুষ। যতি ঠাকুর্দার শয্যাসঙ্গিনী হল। ভাবলে অবাক হই যে, আমার তীব্র নীতিবোধসম্পন্ন বাবা এই ঘটনায় নীতিবিরুদ্ধ কিছু দেখেননি। বরং ঠাকুর্দার তুলনাহীন স্নেহ এবং আত্মত্যাগেরই পরিচয় পেয়েছেন। যতিকে ঠাকুর্দা এক কাঠা জমি বা একশো টাকার কোম্পানির কাগজও দিয়ে যাননি। ওঁর বোধহয় প্রত্যাশা ছিল যে, ছেলে, ছেলের বউ তার ভরণপোষণের ভার নেবে। যতি আমাদের পরিবারের একজন হিসাবেই রয়ে গিয়েছিল। খাওয়াপরার তার অভাব হয়নি। কিন্তু মা’র সঙ্গে মনোমালিন্য তীব্র হয়ে ওঠায় যতিকে প্রৌঢ়ত্বের উপাস্তে নিঃসম্বল অবস্থায় নিজের গ্রামে ফিরে যেতে হয়। তার এক বছরের মধ্যেই ও মারা যায়।

পতিপুত্রহীন যতির সমস্ত স্নেহভালবাসার প্রায় একমাত্র পাত্র ছিলাম আমি। মা-বাবার প্রথম সন্তান আমার বড় দাদা তরুণ প্রতিবন্ধী ছিলেন—জন্মের সময় ফর্সেপের চাপে তার মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আমি মায়ের তৃতীয় সন্তান। প্রতিবন্ধী তরুণ প্রথম এবং আমার চেয়ে আড়াই বছরের বড় দাদা অরুণকে দেখাশোনার পর তৃতীয় সন্তানটিকে লালনপালন করার মতো সময় বা শারীরিক ক্ষমতা তার ছিল না। সেই কর্তব্যভার যতি নিজের হাতে তুলে নেয়। জীবনের প্রথম বছরগুলি আমি কার্যত মাতৃহীন ছিলাম। যতির সেই শূন্যস্থান পূর্ণ করার চেষ্টা সফল হয়নি। কারণ ওর তীব্র স্নেহ বড়ই প্রকাশমুখী ছিল। সেই গ্রাম্য আতিশয্য আমার সহ্য হত না। ওর সেবা আমি অবশ্যই নিতাম। কিন্তু প্রতিদানে ও যা পেত, তাকে নিষ্করুণ বিরক্তি ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। শিশুর করুণাহীনতায় কোনও বাধাবন্ধ থাকে না। এবং তা যে কতটা নিষ্ঠুর হতে পারে এখন মনে করলে আশ্চর্য হয়ে যাই। যতি আদর করতে এলে আমি মুখ ভেঙাতাম, খিমচে দিতাম। আর একটু বড় হয়ে গুণ যখন আরও বাড়ল, তখন ওর দৈহিক স্থূলত্ব নিয়ে স্কুলতর ঠাট্টা করতাম। বলতাম রুবাইয়ের সার্কাসে ওকে হাতি হিসাবে ভর্তি করে নেবে। যতি অসহায়ভাবে আবেদন করত, “ছি সোনা, অমন বলতে নেই।” ওর জীবনের ট্র্যাজেডি যতদিনে বোধগম্য হল, ততদিনে সে আক্ষরিক অর্থেই আমাদের মায়া কাটিয়ে চলে গেছে।

আমাদের পরিবারে যতির জায়গাটা স্পষ্টভাবে চিহ্নিত ছিল না। সে যে ভৃত্যশ্রেণির না, তার প্রমাণ সে আমাদের খাটে বিছানায় বসত, বাবাকে তার ডাকনাম ধরে ডাকত চাঁদ। কিন্তু সে যে প্রভুশ্রেণির নয়, তার প্রমাণ ওর প্রতি মা’র ব্যবহারে। ঠাকুর্দার জীবিতকালে যতি সম্ভবত শাশুড়ির ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে চেয়েছিল। সে দাবি করত যে, বিয়ের পর মাকে বরণ করে ওই ঘরে তুলেছিল। শুনেছি ও মায়ের নামে নানা নালিশ করে ঠাকুর্দার কাছে বকুনি খাওয়াত। যতির এইসব অপরাধ মা কখনও ক্ষমা করেননি। বাবার নীতিজ্ঞান ওকে অনেকদিন পর্যন্ত আশ্রয়চুত করেনি। কিন্তু আমাদের পারিবারিক জীবনে যে বিরোধের একটা অন্তঃসলিলা ধারা ছিল, সে সম্পর্কে অতি শৈশবেই আমি সচেতন হই। যতিকে সজ্ঞানে আমি কখনও ভালবাসিনি। কিন্তু মায়ের সঙ্গে এই অব্যক্ত কলহে কেন জানি না আমি মনে মনে ওরই পক্ষ নিতাম। সম্ভবত তার একটি কারণ মনের দিক থেকে আমি মাতৃহীন ছিলাম। আমাদের পরিবারে আমি ছাড়া সবাই দেখতে সুন্দর ছিল। বাবা পরম রূপবান, মা’র গায়ের রং কাঁচা সোনার মতো। আমার দেহবর্ণে আফ্রিকার ছায়া, মুখশ্রী ঠিক কার্তিকের সঙ্গে তুলনীয় না। এ নিয়ে আত্মীয়-স্বজন পরিচিত অনেকেই নির্দ্বিধায় মন্তব্য করতেন। ফলে চেহারা নিয়ে অতি শৈশবেই আমার একটা হীনম্মন্যতা জন্মায়। আমার সাড়ে পাঁচ বছর বয়সে ফরসা সুন্দর দেখতে ছোট একটি বোন জন্মাল, তখন সত্যিই আমার ধারণা হল যে এই পরিবারে আমার কোনও জায়গা নেই। আমার স্বভাব ছিল ছোটবড় সবাইকে খেপানো। ছোট বোন যখন বড় হচ্ছিল তখন তাকে খেপিয়ে এক দিকে তার আঁচড় কামড়, অন্য দিকে মায়ের হাতে প্রচণ্ড মার খেয়ে সেই ধারণা আরও বদ্ধমূল হয়। তবে মধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজে ভাল ছাত্রর বড় আদর। তাই ইস্কুলের পরীক্ষায় যখন ফাস্ট-সেকেন্ড হতে শুরু করলাম, তখন বাড়িতে আমার কদর বাড়ল। কিন্তু তাতে কোনও সুখ ছিল না, কারণ আমার তুলনায় আমার দাদা যে পড়াশুনোয় খারাপ, এ কথা তাকে ভুলতে দেওয়া হত না। বেচারা কোনও অর্থেই খারাপ ছাত্র ছিল না। কিন্তু সে পরীক্ষায় ফার্স্ট-সেকেন্ড হত না। সারাদিন বইয়ে মুখ গুঁজে থাকার লোক সে কোনও দিনই না। জীবনের রূপরস সর্বদাই তাকে হাতছানি দিত।

আমার সঙ্গে তার আচারব্যবহারের তুলনামূলক সমালোচনা আমাকে বড় বিব্রত করত। ফলে আমার ছেলেবেলার অনেকটাই একটা অস্বস্তিবোধ নিয়ে কাটে। দাদার জন্য বড় কষ্ট হত। সে কষ্ট প্রকাশ করার উপায় আমার জানা ছিল না।

আমাদের নির্ভেজাল ফুর্তি জমত সেবকশ্রেণির তিনটি মানুষের সঙ্গে–সাড়ে তিন কি চার ফুট উঁচু বসা তাদের নেতৃস্থানীয়। তাকে কেউ নেতা হিসাবে মানত, এমন না। কিন্তু তার সকলের উপর তম্বি করার ক্ষমতা ছিল অসাধারণ। খর্বকায় মানুষদের প্রতাপ এবং আস্ফালন কিছু বেশি হয়—উদাহরণ ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন এবং আমার পরিচিতর ভিতর প্রয়াত বাঙালি কৃষ্টিবীর নীরদ সি. চৌধুরী। বসা ছিল ঠাকুর্দার খাস চাকর। তার প্রধান কাজ ধুতি কোঁচানো আর কাটলেট বানানো। সারাদিন ধরে কুপিয়ে কুপিয়ে মাংসখণ্ডকে সে অসাধারণ রকমের মিহি এক বস্তুতে পরিণত করত। সেই দিনভর পরিশ্রমের শেষ ফল যে কাটলেট, তা স্মরণ করলে এখনও শিহরন হয়। তম্বি করার জন্য উপযুক্ত সাজ প্রয়োজন। তাই দর্জিকে দিয়ে বসা এক খাকি পুলিশের পোশাক বানিয়ে নিয়েছিল। কারণ তার দাবি ছিল যে, সে আসলে সি.ঐ.টি অর্থাৎ সি.আই.ডি. বা গোয়েন্দা বিভাগের লোক। কথাটা বোধ হয় সম্পূর্ণ মিথ্যে ছিল না। বাবা গাঁধীবাদী রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার সময় থেকেই নাবালক লজের উপর টিকটিকির নজর ছিল। বাড়িতে ঢোকার রাস্তার মোড়ে অনেক সময়ই দেখতাম মোড়া বা ভাঙা চেয়ার পেতে বসে একটা লোক বিরস মুখে বিড়ি ফুকছে। বিড়ি ফোঁকা ছাড়া তার আর কোনও কাজ আছে মনে হত না। নজর রাখার একটা কারণবাড়িতে যারা আসা-যাওয়া করত তারা সবাই গাঁধীবাদী নয়। কেউ কেউ সশস্ত্র বিপ্লবে বিশ্বাসী। এদেরই একজন ত্রিশের দশকে অত্যাচারী এক দারোগাকে বরিশাল শহরে প্রকাশ্য দিনের আলোয় ছুরি মেরে খুন করে। নিরক্ষর বা বিপ্লবীদের সম্পর্কে কী চমকপ্রদ তথ্য পুলিশকে জানাত বলা কঠিন। তবে এক গবেষকের কাছে বাঙালি গোয়েন্দাদের লেখা রিপোর্টের কপি দেখেছিলাম। তার ভাষা এই রকম : “বৈকাল চারি ঘটিকা অবধি তাহাকে শেড় (অর্থাৎ shadow) করিলাম। তখন সে আরেক ষড়যন্ত্রকারীর সহিত চা খাইতে বসিল।” বসার রিপোর্টের তথ্যমূল্য সে তুলনায় কম হওয়ার কথা না।

বসার আর একটা কাজ ছিল আমাদের তত্ত্বাবধান—অর্থাৎ স্নানাহার বা ঘুমের সময় হলে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে গিয়ে আমাদের নাইতে, খেতে, ঘুমাতে বাধ্য করা। এ কাজটা ওর পক্ষে সহজ ছিল না। কারণ আমাদের বয়স পাঁচ-ছয় ছাড়ালেই ও আর আমাদের সঙ্গে গায়ের জোরে পেরে উঠত না। কিন্তু বলে যা সম্ভব না, তা কৌশলে সম্ভব হত। কোস্তাকুস্তিতে হেরে গিয়ে ও আমাদের কাতুকুতুতে পরাস্ত করত। ছোট ছোট আঙুলের সেই সুড়সুড়ি এক অবর্ণনীয় যন্ত্রণার অভিজ্ঞতা। এই ব্ৰহ্মাস্ত্র ব্যবহারের আগে অবশ্যি সে অবস্থার গুরুত্বটা বোঝাতে চেষ্টা করত। ও ছোটবেলায় যাত্রায় অভিনয় করত, ফলে ওর ভাষায় একই সঙ্গে নাটকীয়তা আর ক্লাসিক গাম্ভীর্যের সমন্বয়। বসা গুরুজনদের রুদ্ররোষের সম্ভাবনা বিষয়ে আমাদের সচেতন করার জন্য বলত, “এখনও যে যাইতে আছ না, এর পর রাগরাগিণী শোন হ্যানে।” ওর শব্দশাস্ত্রে ক্রোধের প্রতিশব্দ ‘রাগ’-এর সঙ্গে রাগিণীর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। আর সময় সম্বন্ধে ওর ধারণাগুলি নিতান্তই মৌলিক এবং নিজস্ব। হয়তো এগারোটা বাজে। বসা ঘোষণা করল, “একটা বাজিয়া গ্যালে। তোমাগো নাওনের নাম নাই।” আমাদের প্রত্যুত্তর, “বসা, এখন মাত্র এগারোটা।” বসা : “তয়?” —”তয় কী?”—”এগারোটার পরই ত বারোটা। হ্যার পর একটা বাজতে আর কতক্ষণ?” দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে ওর মন্তব্যর কোনও জবাব ছিল না। নলিনীদলগত জলের মতো অস্থায়ী এই জীবন যে নিতান্ত ক্ষণস্থায়ী তা কি ভোলা যায়? আমাদের সঙ্গে লুডো খেলতে বসে ও খেলার নতুন নিয়ম চালু করেছিল। হয়তো চার দান পড়েছে ওর। চার ঘর যাওয়ার পথে আমাদের একটা খুঁটি। সেটি ও খাবেই। এ নিয়ে ধুন্দুমার। কিন্তু কার সাধ্য রোধে তার গতি!

বসার সহকর্মী এবং নানা ব্যাপারে প্রতিদ্বন্দ্বী ওড়িশানন্দন নগা বসার দেড়গুণ। কিন্তু বচসা হাতাহাতিতে দাঁড়ালে বসা চেয়ার, টেবিল, টুল—হাতের কাছে যা পেত তার উপর লাফিয়ে উঠে নগাকে আক্রমণ করত। দৃশ্যটা এতই অসম্ভব যে নগা হেসে গড়িয়ে পড়ত। তখনকার মতো কলহশান্তি।

নগা এবং পাচক ধর্ম দু’জনেই কটক জেলার লোক। ওদের মারফত ওড়িশা-সংস্কৃতির নানা দিকের সঙ্গে পরিচয় হয়। বরিশাল শহরে দু’নি শ’ ওড়িয়া বসতি করেছিল। এদের একটা বড় অংশ স্টিমার ঘাটের কুলি, তবে বেশির ভাগই ভদ্র পরিবারে ভৃত্য বা পাচক ব্রাহ্মণ, আর কেউ কেউ রাস্তার কল বা টিউবওয়েল থেকে বাড়ি বাড়ি জল সরবরাহের কাজ করত। মিউনিসিপ্যালিটির জল নেওয়ার জন্য বাড়িতে কল বা আরও ব্যয়সাধ্য টিউবওয়েল বসানোর মতো অবস্থা অনেকেরই ছিল না। ওড়িয়া শ্রোতা বা দর্শক সংখ্যায় যথেষ্ট থাকায় ওড়িশা থেকে মাঝে মধ্যে যাত্রার দল আসত। নটরা বলা বাহুল্য, এসব দলে নটী থাকত না] বাস্তবিকই গণশিল্পী, আধা শহুরে বাবু শ্রেণির না। তাদের চলাবলা ধরনধারণের সঙ্গে পরে দিল্লিতে যে রামলীলা দেখেছি তার অনেক মিল ছিল। আমি সা হাউসে ভদ্দরলোকের রামলীলার কথা বলছি না। লালকেল্লার সামনের মাঠে নিম্নবর্গীয় লীলা অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ের চাপরাশিদের রামলীলার কথা বলছি (যাতে স্কুল অফ ইকনমিকসের কালুরাম গোঁফ কামিয়ে সীতার অভিনয় করত)। কিন্তু ওড়িয়া যাত্রার বৈশিষ্ট্য ছিল গান আর নাচ। গদ্য বা পদ্যে কথাবার্তা কমই থাকত। সংস্কৃত নাটকের মতো একজন সূত্ৰধার থাকত। তবে শুধু প্রথমে না, প্রতি দৃশ্যেই সে কুশীলবদের ভূমিকা নির্দেশ করত। রাম-সীতা এসে দাঁড়ালেন। সূত্ৰধার বলল, “রাম-অ আউচি, সীতা আউচি, এবে নাচ-অ কুরু, নাচ-অ কুরু”। নৃত্য ও গীত সহ অভিনয় শুরু হত। তবে হনুমানকে কেউ পরিচয় করিয়ে দিত না, রাবণকেও না। তাদের আবির্ভাবেই তাদের পরিচয়। আর যত দূর বুঝতাম–বিভীষণের চরিত্র পরিবেশন সম্পূর্ণ নেতিবাচক ছিল না। ওড়িশার ধর্মবুদ্ধিতে যে-লোক (বা রাক্ষস) ধর্মের খাতিরে নিজ বংশের শত্রুতা করেছে সে শুধুই নিন্দনীয় বলে বর্ণিত হত না। রাম-সীতার অভিষেকের দৃশ্যে রক্ষরাজ বিভীষণের হনুমানের লেজ ধরে সানন্দ নৃত্যে নাট্যকারের নীতিগত অনুমোদনের ইঙ্গিত ছিল।

যাত্রা দেখে বাড়ি ফিরে নগা এবং ধর্ম বাছা বাছা দৃশ্যের পুনরভিনয় করত। ধর্মর পটুত্ব ছিল সঙ্গীতে, নগার নৃত্যে—বিশেষত হনুমানের ভূমিকায়। বানরসেনা হিসাবে নগার নেতৃত্বে নৃত্যাভিনয়ে আমরা যোগ দিতাম। নিজের পেশাগত স্বার্থে হাবিলদার-চর্চার (Subaltem Studies) ধারক ও বাহকদের এদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করছি, হাবিলদারত্বে আমার বাল্যেই অনুপ্রবেশ ঘটেছিল এই কথাটা তাদের চেনাগোচর করার জন্য। সত্যিতে হাবিলদার-চর্চার প্রতিষ্ঠাতা রণজিৎদা না, স্বয়ং বাল্মীকি। বানরসেনা নিম্নবর্গের প্রতীক। আর রাক্ষসরা যে আধিপত্যকামী শোষক মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রতিচ্ছবি এ কথা কি বলার অপেক্ষা রাখে? দিগ্বিজয়লোভী রাম আগাগোড়া সাম্রাজ্যবাদী ঔপনিবেশিক। না হলে বালিকে বলেন, “সসাগরা ধরণী ইন্ধাকু বংশের সম্পত্তি। আর তোমরা সব, মৃগই হও আর শাখামৃগই হও, আমাদের বধ্য”? মানে পাকা racist-ও বটে। বিভীষণকে সিংহাসনে বসানো যে কংগ্রেসের রাষ্ট্রাধিকার লাভ এবং নেহরুর প্রধানমন্ত্রী হওয়া সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী, এ তো নবজাত শিশুও বুঝতে পারে। আর সীতাকে রাম যা হেনস্তা করলেন তাতে তাঁকে পুরুষশাসিত সমাজব্যবস্থার চরম উদাহরণ ছাড়া আর কী বলা যায়? নবনীতা দেব সেনের সীতা বিষয়ক গল্পচক্র আর একবার পড়ে দেখুন। নগার নৃত্যগোষ্ঠীতে যোগ দিয়ে এসব চেতনা আমার বাল্যকালেই হয়েছিল। এখন হাবিলদার-চর্চা গোষ্ঠীর নেতৃবৃন্দের প্রতি নিবেদন, তারা যেন বাল্মীকির দাবিটা একটু বিবেচনা করেন। ভদ্রলোক মন্দ লিখতেন না। (প্রশ্ন : মুনিঋষিদের কি ভদ্রলোক বলা যায়? অপরপক্ষে ভারতবর্ষের সাহেব ঐতিহাসিকরা ভদ্রলোক কথাটা মুখ্যত গালাগালি বলে ধরে নিয়েছেন। বাঙালি ভদ্রলোক ঐতিহাসিকরাও কেউ কেউ একই কথা বলছেন। ড. অশোক মিত্র অনেকদিন আগেই ঘোষণা করেছেন—উনি ভদ্রলোক নন।)।

শাস্ত্রচর্চা আপাতত বন্ধ রেখে বাল্যকথায় ফিরে যাই। যতি, ধর্ম এবং নগা তিনজনেই রামায়ণ, মহাভারত এবং পুরাণের গল্পগুলির সঙ্গে বিশেষভাবে পরিচিত ছিল। এরা তিনজনেই পড়তে পারত। ধর্ম আর নগা ওড়িয়া ভাষায় সাক্ষর ছিল। কিন্তু ভারতীয় ঐতিহ্য। সম্পর্কে ওদের জ্ঞান বই পড়ে হয়নি। আমাদের গ্রামীণ সমাজে ওই সব প্রাচীন এবং অনেক সময় অত্যন্ত জটিল কাহিনিগুলি কীভাবে গণ-চেতনার অঙ্গ হয়ে গেছে তার ইতিহাস কেউ লেখেনি। বিদেশে পড়াতে গিয়ে বহুবার বলেছি-সাক্ষরতা বা নিরক্ষরতার সংখ্যাবিচার করে কোনও দেশের সমাজ বা রাষ্ট্রচেতনার মূল্যায়ন হয় না। যে-সাক্ষরতা Sun পত্রিকার তৃতীয় পৃষ্ঠায় নগ্নিকার ছবি দেখতে উদ্বুদ্ধ করে, তার তুলনায় ভারতীয় গ্রামবাসীর নিরক্ষরতা, যা রামায়ণ-মহাভারত-পুরাণকাহিনির কল্পনা এবং নীতিবোধে সমৃদ্ধ, নাগরিকতার প্রস্তুতি হিসাবে তা কম মূল্যবান নয়।

রামায়ণ-মহাভারতের কাহিনি নিয়ে যতি, নগা, ধর্ম এবং বসা প্রায়ই আলোচনা করত। প্রসঙ্গত বলিসাক্ষর হওয়ার অনেক আগেই যতির কাছে কৃত্তিবাসী রামায়ণ এবং কাশীদাসী মহাভারত আমাদের আদ্যোপান্ত শোনা হয়ে গিয়েছিল। অনেক কাহিনি নিয়েই যতির সঙ্গে ওড়িশানন্দনদের মতান্তর ঘটত। এখন মনে হয় যে, ধর্ম আর নগার মহাকাব্য দুটির সঙ্গে যে-ভাষানুবাদের মাধ্যমে পরিচয় হয়, অথবা ওড়িশার লোকসংস্কৃতিতে কাহিনিগুলি যে রূপে পরিচিত ছিল, তার সঙ্গে কৃত্তিবাসকাশীদাসের গরমিল অনেক। ফলে যতির সঙ্গে ওদের মতান্তরের কোনও সমাধান সম্ভব ছিল না।

কিন্তু বসার সঙ্গে কাব্য তথা শাস্ত্র বিচারের প্রকৃতি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। ওর শাস্ত্রজ্ঞান প্রধানত যাত্রাভিনয় থেকে সংগ্রহ করা, সাইজে ছোট হওয়ায় বালগোপাল, বামনাবতার, শিশু প্রহ্লাদ, বালখিল্য মুনি, যাত্রার দলে এইসব ভূমিকায় এক সময় ওর বেশ চাহিদা ছিল। কিন্তু সে অনেকদিন আগে। ফলে তার স্মৃতি কিছুটা গুলিয়ে গিয়েছিল। তার উপর ওর মৌলিক চিন্তাধারাও ঐতিহ্যলব্ধ কাহিনিগুলিকে অসামান্য নাটকীয় রূপ দিত এবং ওর নানা কৃট প্রশ্নে সবাই ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠত। যথা, “দ্রৌপদীর স্বয়ংবর সভায় দশরথ রাবণেরে কী কইছিলে?” “গঙ্গা আনয়ন করছিলে কেডা? ভীম না অর্জুন?” “দণ্ডবনে সোনার ছাগল সাজ্জিয়া আইছিলে কেডা? বিভীষণ না কুম্ভকর্ণ?” “বামনাবতার বলিরাজের মাথায় কোন ঠ্যাং চাপাইয়া দেছেলে? তৃতীয় না চতুর্থ?” এই বিচারে সকলের পরাস্ত হওয়া ছাড়া কোনও উপায় ছিল না। শুধু বসা আড়ালে গেলে ধর্ম মন্তব্য করত, “ষড়া বসা সম্পূর্ণ মূর্ষ অছি।”

ভারতবর্ষের রাজনীতি বিষয়ে আমার প্রথম পাঠ নগার কাছ থেকে পাওয়া। কারণ নগা ছিল সার্টিফায়েড স্বাধীনতাসংগ্রামী। সার্টিফিকেটটি সদাশয় উদারপন্থী ইংরাজ সরকারের পুলিশ স্বহস্তে ওর শরীরে এঁটে দিয়েছিল। মাথায় চুলের নীচে লম্বা একটা দাগ তার সংগ্রামী জীবনের স্মৃতি বহন করত। সাইমন কমিশনের সভ্যরা সারা ভারতবর্ষ ঘুরে, সর্বত্রই ‘Go back Simon, go back Simon’এই জিগির শুনে শুনে পর্যদস্ত অবস্থায় কটক শহরে এসে শান্তির মুখ দেখলেন। কারণ ট্রেন থেকে নামতেই খোলকরতাল বাজিয়ে কীর্তনের দল ওদের অভিনন্দন জানায়। অন্তত ওঁদের তাই মনে হয়েছিল। আসলে কী হয়েছিল তা সেই কীর্তনে অংশগ্রহণকারী নগা একক নৃত্যনাট্যর মারফত আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছিল। এই প্রসঙ্গে সে গলায় খোল ঝুলিয়ে পাইকদের যুদ্ধ নৃত্যের স্টাইলে উদ্দাম নাচে মেতে উঠত এবং তালে তালে তীব্ৰনিখাদে ঝঙ্কার দিত, “গোব্যাককো সাইমনো, গো-ব্যাককো সাইমনো।” এই অভিনন্দনে বিলৈতি সাহেবদের চিত্ত প্রসন্ন হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু স্থানীয় পুলিশদের ব্যাপারটা পছন্দ হয়নি। তার প্রমাণ নগার মাথায় লগুড়াঘাতের চিরস্থায়ী চিহ্ন। এর পর থেকে নগার বিপ্লবী চেতনা কখনও ম্লান হয়নি। ওর কাছ থেকেই জানতে পারি-মহাত্মা গাঁধীই কল্কি অবতার। সময় হলে খাটো ধুতি ছেড়ে যোচূবেশে সাদা ঘোড়ার পিঠে চড়ে নর্মদা তীরের মহাযুদ্ধে ইংরেজনিবহ নিধন করবেন। আর যদি কেউ ভেবে থাকে যে সেই ঘোর সমরে কটক জিলার নগেন্দ্র পরিডা অনুপস্থিত থাকবে, তো সে নেহাতই চক্ষু থাকতেও অন্ধ। ধর্মক্ষেত্রে কুরুক্ষেত্রে বর্মচর্মপরিহিত যুযুধান নগাকে কল্পনানেত্রে স্পষ্ট দেখতাম। শ্রদ্ধা ও বিস্ময়ে মন ভরে যেত।

ঘেসেড়া মেনা ছিল সম্পূর্ণ অন্য মেজাজের লোক ঈশ্বর-প্রেমে আবিষ্ট মরমিয়া মানুষ। নমাজ পড়তে তাকে কখনও দেখিনি। কিন্তু সন্ধ্যা হলেই সে গান ধরত, “আয় হাবিব, এ খোদা” আর তার সঙ্গে অঝোরে অবর্ষণ। কখনও সে মানিক পীরের গান গাইত-”সেই ত মানিক পীর নদী পারের লা” (অর্থাৎ না, অর্থাৎ নৌকা)। মানিকের উপদেশ মতো আল্লার নাম নিয়ে নবীকে সার জানলে কীভাবে অক্লেশে মাজা দুলিয়ে ভবনদী পার হওয়া যায়, এক হাত কোমরে এক হাত মাথায় দিয়ে সত্যিই মাজা দুলিয়ে নেচে নেচে বাপারটা সে বুঝিয়ে দিত। কখনও মুখে মুখে কখনও পুঁথি থেকে পড়ে সে নানা কিসসা শোনাত—সোনাভানের কিসসা, হাতেমতাইর কাহিনি, সোহরাব-রুস্তমের মর্মন্তুদ ট্রাজেডি। সেই সব কাব্যকথার কিছু কিছু কথা একটু দুর্বোধ্য মনে হত। যথা “লাখে লাখে সৈন্য মরে কাতারে কাতার।/ সুমার করিয়া দেখে পঁয়ত্রিশ হাজার।” অথবা “ঘোড়ায় চড়িয়া মর্দ হাঁটিয়া চলিল।” এখন জানি সংখ্যাতত্ত্বের কারচুপিতে লাখ লাখকে পঁয়ত্রিশ হাজারে নামানো কিছু কঠিন না। মার্জিন অফ এরর একটু বাড়িয়ে নিলেই হল। কিন্তু মর্দ যদি হেঁটেই যাবে তবে ঘোড়ায় কেন চড়ল। এই সমস্যার এখনও সমাধান হয়নি। মেনার জাগতিক আচরণেও কিছু কিছু ব্যাখ্যাতীত ঘটনা ঘটত। যেমন এক ঘোর বৃষ্টির দিনে গরু বাছুরগুলি নদীর পাড়ে ছেড়ে রেখে বাড়ি চলে এল। কারণ? “গোরুগুলা ভিজ্জিয়া যাইবে, হেইয়ার লইগগা ছাতা লইতে আইছি।” একটা কথা বলে মেনা প্রসঙ্গ শেষ করি। ধর্ম ব্যাপারে আমি গোঁড়া নাস্তিক, এ নিয়ে মনে কখনও সন্দেহের ছায়া পড়েনি। নিগুণ ব্রহ্ম আছেন কি না আছেন, জানি না। কিন্তু শত যন্ত্রণাময় মৃত্যুভয়পীড়িত জীব-জীবনের দেখভাল করছেন নভস্থিত করুণাময় কোনও পিতা–এই বিশ্বস গল্পকথা ছাড়া আর কিছু কখনও ভাবতে পারিনি। কিন্তু বিশ্বস্রষ্টার বিরহে মেনার আকুল কান্না দেখে কৈশোরে অনেক সময় মনে হয়েছে, যে-ঈশ্বরবিশ্বাস এই শুদ্ধচিত্ত সরল মানুষটিকে এমন লোকাতীত আনন্দের জগতে নিয়ে যেতে পারে, তার অংশীদার হতে পারলে হয়তো মন্দ হত না। আমরা যখন উপন্যাস পড়ি বা বর্ণনামূলক ছবি দেখি, তখন তার রসবিচারে শিল্পকর্মটি আক্ষরিক অর্থে সত্যভিত্তিক কি না তা বিচার করি না। তেমনই নাস্তিক হয়েও বহু সহস্র বছর ধরে গড়ে ওঠা মানুষের ঈশ্বরচিন্তায় অনির্বচনীয় রসের আস্বাদ পাওয়া যায়। ঈশ্বরের অস্তিত্বে অবিশ্বাস তার স্বাদ গ্রহণে বাধার সৃষ্টি করবেই—এমন কোনও অলঙ্ঘ্য নিয়ম নেই। রবীন্দ্রনাথের ‘নৈবেদ্য’ বা ‘রামকৃষ্ণকথামৃত’ থেকে যে-আনন্দ পেয়েছি, আমার নাস্তিকতা তাতে কোনও বিঘ্ন ঘটায়নি।

নিম্নবর্গীয় আর একটি মানুষের কথা বলে প্রসঙ্গান্তরে যাব। কীর্তনখোলা নদীর এক পাড়ে শহর বরিশাল। অন্য পাড়ে কাউয়ার চর। শহুরে মানুষরা রহস্য করে বলতেন বায়সদ্বীপ। আমাদের শোওয়ার ঘরের জানালায় দাঁড়িয়ে নদীর ওপারে কাউয়ার চরের গাছপালা, পাড়ে বাঁধা নৌকা, দু-একটি কুটির বেশ দেখা যেত। সে চর রহস্যের আকর। ওখানে কারা থাকে, তারা কী করে, গাছপালা-পুকুর-খাল কী রকম এ নিয়ে আমার অশেষ কৌতূহল ছিল। কিন্তু সে কৌতূহল কখনও মেটেনি। কারণ কাউয়ার চরে কেউ যেত না, যাওয়ার কোনও কারণ ঘটত না। জ্যেঠতুত দাদা কালুদার সাহায্যে হাটুরেদের ডিঙি সাময়িকভাবে বাজেয়াপ্ত করে যখন নৌকাবিহারে যেতাম, তখনও কোনও দিন কাউয়ার চর দর্শন ঘটেনি। এক-আধবার সসঙ্কোচে কালুদাকে বলেছি, “যাবা নাকি কাউয়ার চর?” নিরাসক্ত সুরে বইঠা টানতে টানতে তার প্রত্যুত্তর, “ক্যান? ওহানে আছে কী?” কী আছে জানি না বলেই যাওয়া এ কথা তাকে কী করে বোঝাব? আমার এই না দেখা Yarow অদৃষ্টই রয়ে গেল। ফলে পরিচয়-জনিত মোহভঙ্গ আমার ঘটেনি। অলস দুপুরের অন্তহীন কল্পনার জগতে যা কিছু অসম্ভব তার অকুস্থল ছিল কাউয়ার চর।

কাউয়ার চরের সঙ্গে আমাদের একমাত্র সংযোগসেতু ছিল একটি মানুষজয়নাল। সংক্ষিপ্ত হয়ে নামটি দাঁড়িয়েছিল জয়না। জয়না কাউয়ার চরের বাসিন্দা। একটি বহুছিদ্রময় ডিঙিতে করে সে নদী পার হয়ে আসত আমাদের বাগানে শ্রমসাধ্য মোটা কাজগুলি করতে। ডিঙিটি যে শতচ্ছিদ্র ছিল সে তথ্য আমাদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতালব্ধ। কাউকে না বলে ওটিকে নিয়ে কালুদা আর আমি পাড়ি জমাতাম। কালুদা বৈঠা টানত। আমি একটা এনামেলের ভাঙা বাটি দিয়ে জল সেচতাম। আমরা যে ডুবে মরিনি তা নেহাতই গুরু কৃপায়। জয়না এই দুই কাজ একসঙ্গে কীভাবে করত তার হদিশ আমরা পাইনি। ওর সত্যিকার মনিব ছিল আমাদের মালি হাসমাতালি। একটিও কথা না বলে সম্পূর্ণ নিঃশব্দে সে কাজ করে যেত। আর হুঁকো হাতে হাসমতালি তাকে অকথ্য বাপান্ত করত। জয়না শুধু একটি শব্দই কচিৎ কখনও উচ্চারণ করত। “জে”। তার ভাবার্থ “হুজুর যা বলেন”। সারাদিন ওকে কখনও কিছু খেতে দেখিনি। বোধ হয় সকালবেলা পান্তা খেয়ে বাড়ি থেকে বের হত। কিছু খেতে দিলে খুশিতে ওর মুখ উদ্ভাসিত হয়ে উঠত। এ ছাড়া ওর মুখভাবে ভাবান্তর কখনও দেখিনি।

সে ভাবান্তর একদিন দেখলাম বড় বেদনাদায়ক পরিস্থিতিতে। বাড়ি থেকে কিছু দামি বাসন চুরি গিয়েছিল। কী করে হল? গেটে দিনে রাতে দারোয়ান মোতায়েন থাকে। তাকে এড়িয়ে চোর কী করে পালাল? এ প্রশ্নের অনেক সোজা উত্তর ছিল। পেছনে ঠিকাবাসার রাস্তা, তার উলটোদিকে নদীর ঘাট। আর দারোয়ানও কিছু সদাবিনিদ্র প্রহরী নয়। সুতরাং চুরি করে পালাবার পথের কিছু অপ্রতুলতা ছিল না। কিন্তু সে কথা কেউ চিন্তা করল না। হঠাৎ হাসমাতালি বলে বসল, “ওই জয়না হারামজাদাই নেছে।” ওই নিরীহতম মানুষটার পক্ষে এ কাজ করা কতটা অসম্ভব, তা কারও মনে হল না। সবাই বলতে শুরু করল–বাইরে থেকে দেখে বোঝা যায় না। ওই মিচকে শয়তান ভালমানুষ সেজে থাকে। অতএব মিচকে শয়তানের উপর অনেক হম্বিতম্বি এবং কিছু মারধর হল। একটি কথাও না বলে অসহায় মানুষটা তার ভাঙা নৌকাটি নিয়ে কাউয়ার চরে ফিরে গেল। যাবার সময় দেখলাম তার দু গাল বেয়ে চোখের জল পড়ছে। জয়না আর কখনও ফিরে আসেনি। মহা তম্বি করে হাসমাতালি বলল, “দ্যাখছেন হুজুর, হারামজাদা আর আইলে না!” তার না-ফেরাটাই তার অপরাধের চরম প্রমাণ বলে ধরে নেওয়া হল। যে-দিন সাতপুরুষের ভিটে ছেড়ে হিন্দুস্থানে উদ্বাস্তুজীবন শুরু করার জন্য রওনা হই, সেদিন কেন জানি না জয়নালের অশ্রুসিক্ত মুখটা বারবার মনে পড়ছিল। মনে হয়েছিল, অপমানে দুর্দশায় ওর সমান হবার দিন সমাগত।

আমাদের বাড়ির চৌহদ্দির ভিতরে আমলকী গাছের ছায়ায় টিনের ছাদওয়ালা এক বাসায় একটি পরিবার বাস করতেন। সে পরিবারের কর্তা বিশ্বেশ্বর দাস, আমাদের ভুইঞা জ্যাঠা, কালেক্টরেটে হেড ক্লার্ক ছিলেন। তাঁর দুই ছেলে সুবোধ আর সুধীর—আমাদের ছোড়দা, বড়দা। তাদের স্ত্রীরা ছোট বউদি, বড় বউদি, দুই মেয়ে পচিদি, বুচিদি। ওরা যে আমাদের পরিবারের অংশ নয়, শৈশবে এ কথা বুঝবার কোনও কারণ ঘটেনি। যত দূর মনে পড়ে এদের একটিই শোওয়ার ঘর এবং একটিই খাট ছিল। দুপুরবেলা যখন তখন ওদের বাড়ি চলে যেতাম, ছুটির দিনে দেখতাম সবাই সেই অতি প্রশস্ত খাটে পাশাপাশি ঘুমাচ্ছে। ভূইঞা জ্যাঠা দাদুর আশ্ৰিতজনদের একজন, তাঁরই অনুমতি নিয়ে আমলকীতলায় ওই বাড়ি। পরে ওই বাড়ি ওঁদের ছাড়তে হয় জমিদারি সম্পত্তির অন্যতম শরিক এক জ্যাঠামশাই ওখানে বাগান করবেন দাবি করায়। কিন্তু তার অনেক আগেই ভুইঞা জ্যাঠার পরলোকপ্রাপ্তি হয়েছে।

শৈশবের অনেক সন্ধ্যাই কেটেছে ওঁর সঙ্গসুখে। ওঁর একটি চশমার খাপ ছিল। সেটি থেকে পেপারমিন্ট বের করে উনি আমাদের খাওয়াতেন। নিজে অল্প পরিমাণে আফিঙ খেতেন। আর আমাদের চিত্তবিনোদনের জন্য নানা রকম নাচ দেখাতেন ইংরাজি, ফরাসি, জাপানি। নাচগুলি বিভিন্ন শৈলীর ছিল সন্দেহ নেই, কিন্তু আমাদের চোখে একই মনে হত। খোঁচা খোঁচা সাদা দাড়ি ভরা মুখ নিয়ে সেই অনবদ্য নৃত্য চোখ বুজলে এখনও দেখতে পাই। পরে নুরেইয়েভকে নাচতে দেখেছি। কোনও তুলনা হয় না।

ছোড়দা বড়দা আমাদের বাড়ির লনে ব্যাডমিন্টন খেলতে আসতেন। দাদাকে খেলায় নেওয়া হত। আপাতদৃষ্টিতে আমাকেও নেওয়া হত, কিন্তু আসলে আমি ছিলাম এলেবেলে বা দুধভাতু অর্থাৎ সত্যিতে খেলার অংশীদার নয়। ব্যাপারটা আমি ভালই বুঝতাম। তাই কোর্টের সামনের দিকে এগিয়ে গিয়ে খেলায় বিঘ্ন ঘটাতাম। এ সময় পিছন ফিরলেই দেখতাম ছোড়দা আমাকে মুখ ভেঙাচ্ছেন, সঙ্গে সঙ্গে আমার দাদাও। চোখাচোখি হলেই মুখভঙ্গি বদলে একগাল হেসে ছোড়দা বলতেন, “অ তপু, খুব ভাল খেলতে আহ। খেল, খেল।” আর নিম্নস্বরে দাদাকে বলতেন, “আইজ খেলাডারে শ্যাষ করলে। কী আর করবা?”

ওঁর স্বভাব ছিল বাচ্চাদের খেপানো। পাঁচ বছর বয়স অবধি আমার দেহ রীতিমতো স্কুল আর দুই গাল বিশেষ রকম ফোলা ছিল। যেসব বয়োজ্যষ্ঠরা সেই ফোলা গাল তাদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি মনে করে যথেচ্ছ টিপতেন, ছোড়দা তাঁদের একজন। আমার বিরক্তি বাড়াবার জন্য সেই সঙ্গে আমাকে আদরের নাম, তপলুযা শুনলে আমার পিত্তি জ্বলে যেত, সেই নামে ডাকতেন। “আবার তপল বলে!” বলে ঘোর গর্জন করতাম। ওই গর্জন শোনার জন্যই এই নাটকাভিনয়। সবাই হেসে আকুল হত। সে কৌতুকে অংশ নেওয়ার মতো আমার মনের অবস্থা থাকত না।

ভুইঞা জ্যাঠার বাড়িতে সব সময়ই একটা হইহই আর ফুর্তির পরিবেশ ছিল। এক বীভৎস দুর্ঘটনায় সেই ফুর্তিতে ছেদ পড়ল। ভুইঞা জ্যাঠা একদিন অফিস থেকে বাড়ি ফিরলেন আর্তনাদ করতে করতে। দফতরে সিলমোহর করার জন্য লা’ বা গালা গলিয়ে রাখা হত। জ্যাঠা ভুল করে জুতাসুদ্ধ পা এক ফুটন্ত গালার পাত্রে বসিয়ে দেন। যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে উনি হাঁটতে হাঁটতেই বাড়ি ফেরেন। সরকারি কর্মচারী, সেই সুবাদে সাহেব সিভিল সার্জন স্বয়ং অস্ত্রোপচার করে জুতা থেকে ওঁর পা মুক্ত করেন। কিন্তু ভুইঞা জ্যাঠা এই ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে পারেননি। সেই যে শয্যা নিলেন, আর ওঠেননি। আমাদের সন্ধ্যাগুলি নিরানন্দ হয়ে গেল। মাঝে মাঝে ওঁর কাছে গিয়ে বসে থাকতাম। উনি চুপ করে আমার হাত দুটি ধরে থাকতেন। ওঁর দু চোখ দিয়ে অঝোরে জল পড়ত। শুধু চশমার খাপ থেকে বের করে পেপারমিন্ট দেওয়ার পুরনো প্রথাটা শেষ অবধি বজায় ছিল।

যে-মানুষটি হঠাৎ হঠাৎ এসে উদয় হয়ে আমাদের জীবনে আনন্দধাম স্থাপন করতেন তিনি হচ্ছেন শীতল জ্যাঠা। চিত্রকর, গায়ক, অভিনেতা, গল্পকথক, ডাক্তার অশেষ গুণসম্পন্ন শীতল বন্দ্যোপাধ্যায় (মাধবী মুখোপাধ্যায়ের দাদামশায়)। এঁর কথা ‘রোমন্থন’-এ লিখেছি। কিন্তু ওঁর কথা লিখে শেষ করা যায় না। ঠাকুর্দা অনেক লোককে পালন করেছিলেন। অসাধারণ সহজাত প্রতিভাসম্পন্ন এই ব্রাহ্মণবটু তাঁদের একজন। ছবি আঁকা, কীর্তন গাওয়া, ছেনিতে খোদাই করে পাথরের মূর্তি গড়া—এসব উনি কারও কাছে শেখেননি। শুনেছি ঠাকুর্দার কাছে ওঁর আঁকা ছবি দেখে ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট বেল সাহেব হ্যাভেলকে চিঠি লিখেছিলেন। হ্যাভেল ওঁকে ইতালি পাঠিয়ে আঁকা শেখাবার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু নিতান্তই গ্রামবাসী শীতল জ্যাঠা এই সৌভাগ্য বরণ করার সাহস পাননি। উনি যে লজ্জাবতী লতা ছিলেন এমনও নয়। গ্রামে-গঞ্জে শহরের বাড়িতে বাড়িতে নানা অনুষ্ঠানে উনি কীর্তন করতেন (এ বিদ্যাও কারও কাছে শেখা নয়)। হাজার হাজার লোক শুনতে আসত। আমাদের গ্রামের বাড়ির স্টেজে উনি অভিনয়ও করতেন অসাধারণ। এবং সব সময়ই ওঁকে নায়কের ভূমিকাটি দিতে হত। কিন্তু নিজের সমাজের গণ্ডির বাইরে যেতে উনি ভরসা পেতেন না। তাই বিদেশে চিত্রবিদ্যাশেখা শিল্পী হওয়া ওঁর হল না। ভরণপোষণের যাতে একটা ব্যবস্থা হয় সেই ভেবে ঠাকুর্দা ওঁকে ক্যাম্পবেল মেডিক্যাল কলেজে ঢুকিয়ে দেন। সেই সুবাদে উনি এল. এম. এস. ডাক্তার। কিন্তু ডাক্তারির চেয়ে ছবি আঁকার দিকে ঝোঁকটাই বেশি ছিল। ওঁর আঁকা কৃষ্ণলীলা তথা রামসীতা এবং পুরাণ কাহিনির ওলিওগ্রাফ অনেক বাড়িতেই দেখা যেত। রবি বর্মার ধরনে আঁকা, তুলনায় একটু অপটু হাতে। শৈশবে আমাদের ধারণা ছিল–চিত্রশিল্পের শেষ কথা শীতল জ্যাঠার আঁকা ছবি।

শীতল জ্যাঠার সব ব্যাপারেই একটা মৌলিকতা ছিল। রগুড়ে মানুষটি আমাদের কপট ক্রোধে গাল দিতেন, অভিধা মূর্খের ডিম। উনি বোধ হয় বাবার ঘনিষ্ঠতম আশৈশব বন্ধু ছিলেন। কিন্তু বাবাও মাঝে মাঝে মুখের ডিম বলে বর্ণিত হতেন। শুনেছি ঠাকুর্দাকেও শীতল জ্যাঠা মূর্খের ডিম বলতেন—তবে আড়ালে। মানুষটি সব ব্যাপারেই অ্যাডভেঞ্চারপ্রবণ ছিলেন, এবং অ্যাকসিডেন্টপ্রবণও বটে। শিলংয়ে ম্যাগনোলিয়ার মগডাল থেকে পুষ্প আহরণ করতে গিয়ে ডাল ভেঙে পড়ে, কক্সবাজারে সমুদ্রে হাঙরের ল্যাজ চেপে ধরতে গিয়ে (ওঁর ধারণা হয়েছিল ল্যাজ ধরে থাকলে কোনও মতেই হাঙর মুখ ঘুরিয়ে কামড়াতে পারবে না, শুধু শীতল বন্দ্যোপাধ্যায় বিনা সাঁতারে অনেকটা সমুদ্রবিহার করে নেবেন), কাশীতে পাতার খোলায় ঢেলে দেওয়া দুধের কেনা হুশ করে চুমুক দিয়ে খেতে গিয়ে গলায় ঠেকে বারবারই ওঁর জীবন বিপন্ন হয়েছে। কথাগুলি কল্পনাপ্রসূত নয়। অনেক ক্ষেত্রেই সাক্ষী আমার বাবা। ম্যাগনোলিয়া গাছ থেকে পড়ার সময় শীতল জ্যাঠাকে বাঁচাতে গিয়ে ভাঙা ডাল ওঁর হাতে বসে গিয়েছিল। তার ক্ষতচিহ্ন বাবা বাকি জীবন বহন করেছেন। জ্যাঠার গল্প বলার ক্ষমতা ছিল অসাধারণ, মধুমালা মালঞ্চমালার গল্প উনি মাঝে মাঝে গান করে বলতেন। আর ওঁর piece de resistance ছিল রাইডার হ্যাগার্ডের ‘শী’। বইটা আমি নিজে কখনও পড়িনি। কিন্তু শীতল জ্যাঠার কাছে শুনে মনে হত এই কাহিনি রহস্যরোমাঞ্চর শেষ কথা।

আমাদের কলকাতা প্রবাসের সময় শীতল জ্যাঠার শিল্পপ্রতিভা ব্যবসার কাজে লাগানোর চেষ্টা হয়েছিল। উনি আর বাবা একসঙ্গে একটি পুতুল এবং ম্যানিকিন বানানোর ব্যবসা খোলেন। ওঁদের তৈরি ডামি বেঙ্গল স্টোর্স ইত্যাদি বড় বড় দোকানের শোকেসে দেখা যেত। কিন্তু এই প্রচেষ্টার ফলাফল ব্যক্তিগত জীবনে সুখের হয়নি। ব্যবসা-সংক্রান্ত কোনও ব্যাপারে বাবার সঙ্গে শীতল জ্যাঠার মনোমালিন্য ঘটে। দীর্ঘদিনের বন্ধুত্বের সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায়। আমাদের জীবন থেকেও আনন্দময় মানুষটি সরে গেলেন। তখন আমরা কলকাতায় ওঁর পাশের বাড়িতেই থাকতাম। হঠাৎ আমাদের গল্পের আসর বন্ধ হয়ে গেল। আহত বিস্ময়ে ঘটনাটা মেনে নিতে হল।

আমাদের সব চেয়ে যিনি আপনজন ছিলেন তাঁর কোনও স্মৃতি আমার নেই। তিনি আমার ঠাকুর্দা, অনারেবল বিনোদকুমার রায়চৌধুরী, মেম্বার, লেজিসলেটিভ কাউন্সিল, কীর্তিপাশার বড় হিস্যার বাড়ির জমিদারির চার আনি অংশের মালিক। আমার আড়াই বছর বয়সে ওঁর মৃত্যু হয়। শুনেছি আমাকেই উনি সব চেয়ে স্নেহ করতেন। ওঁর ভরসা ছিল, ছেলের তৃতীয় সন্তান মেয়ে হবে। আমার আবির্ভাবে অনেক অশ্রুজল ফেলে শেষে তৃতীয় নাতিকে ফ্রক পরিয়ে রেখে নাতনির শখ মেটাতেন। শখ মেটাবার অন্যতম উপায়-কলকাতা থেকে ক্রমাগত বিদেশি চকোলেট আমদানি। ও বস্তু খেয়ে খেয়ে আমার যকৃৎ বিপন্ন হয়েছিল। পরে সেইসব বিচিত্র চেহারার চকোলেটের টিন আমার খেলনা রাখার পাত্র হয়েছিল। ওঁর মৃত্যুর পর আমার মরণাপন্ন অসুখ হয় কিছুটা ওঁকে না দেখার মনোকষ্টে, কিছুটা দীর্ঘদিন চকোলেট অতিভোজনের ফলে। ওঁর মুখ আমার মনে পড়ে না, কিন্তু নদীর পাড়ের বাংলো বাড়িটিতে যেন ওঁর উপস্থিতি সব কিছু ছাপিয়ে বিরাজ করত। বাবা, মা, যতি, বসা, ভুইঞা জ্যাঠা, শীতল জ্যাঠা সকলের কাছে ওঁর গল্প এত শুনতাম, চারিদিকে ওঁর এত ছবি ছিল যে, উনি নেই এ কথা কখনও মনে হওয়ার সুযোগ ছিল না। আমার প্রতিবন্ধী বড়দা তরুণ আট বছর বয়সে মারা যান। চোখের সামনে দেবশিশুর মতো সুন্দর প্রথম নাতির মৃত্যু দেখে দাদুর জীবনে বিতৃষ্ণা আসে। মৃত্যুকামনা করে উনি চান্দ্রায়ণ ব্রত করেন। শুনেছি মাসব্যাপী ব্রত যেদিন শেষ হয় সেদিনই উনি মারা যান। কথাটা সত্যি কি না জানি না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *