০২. জন্মস্থান : মাতুলালয় : কুমিল্লা শহর

জন্মস্থান : মাতুলালয় : কুমিল্লা শহর

আমার জন্ম মাতুলালয়ে–কুমিল্লা শহরে। ঈসাই সন ১৯২৬, যে বছর সাইমন কমিশন ভারতবর্ষে আসবেন ঘোষিত হল। ওই ঘটনাটা আমার বাল্যজীবনে প্রাসঙ্গিক, কারণ যেসব রাজনৈতিক কর্মী বাড়িতে সব সময় যাওয়া-আসা করতেন, বিশুদ্ধ শ্বেতবর্ণ ওই কমিশনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মিছিলে নেমে তাঁদের অনেকেই প্রচণ্ড মার খেয়েছিলেন। তাদের মাথায় বা উর্ধ্বাঙ্গের নানা জায়গায় সেই প্রহারের চিহ্ন আমার শৈশব ও বাল্যস্মৃতির অঙ্গীভূত। আমরা যে ইংরেজের গোলাম এবং বেয়াদবি করলে মার খাওয়াই গোলামের ভাগ্যলিপি—এ কথাটা অতি শৈশবেই পরিচিত কংগ্রেস ভলান্টিয়ররা আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। যথাস্থানে সে বিষয়ে বলব।

আপাতত মামাবাড়ির কথা বলি। আমার দাদামশায় ঊনচল্লিশ বছর বয়সে ছাব্বিশ বছর বয়স্কা পত্নী এবং সাতটি সন্তান রেখে পরলোকগমন করেন। সপ্তম সন্তানটি তখনও মাতৃগর্ভে। দাদামশায়ের মৃত্যুকাহিনি বৈচিত্র্যচিহ্নিত। ওঁর প্রথম যৌবনে কোনও গণৎকার ভবিষ্যদ্বাণী করেন যে উনি ঊনচল্লিশ বছর বয়সে মারা যাবেন। এই কথাটি আক্ষরিক অর্থে সত্য বলে মেনে নিয়ে দাদামশায় তার সমস্ত জীবনের বিলিব্যবস্থা তদনুসারেই করেছিলেন। আটত্রিশ পেরিয়ে ঊনচল্লিশে যে দিন পা দিলেন, সে দিনই হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে তিনি মারা যান। গণকের জয়জয়কার। আমার ধারণা ঘটনাটা ইচ্ছামৃত্যুরই শামিল। বিশ-পঁচিশ বছর ধরে ‘অমুক দিনে আমি মারা যাব’ এ রকম দৃঢ় বিশ্বাস থাকলে, ওই দিনটিতেই মারা যাওয়া কিছু অলৌকিক ঘটনা না। জন্মদুঃখী আমার দিদিমা অসাধারণ বুদ্ধি আর অদম্য প্রাণশক্তি নিয়ে আরও ষাট বছর বেঁচে ছিলেন।

তার সাত সন্তান লালনপালনের ভার নেন দাদামশায়ের ছোট ভাই, ও অঞ্চলে বিখ্যাত আইনজীবী রায়বাহাদুর ভূধর দাস। রায়বাহাদুর তার পরবর্তী জীবনের পরিচয়। প্রথম জীবনে স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে বিখ্যাত অভয়াশ্রমের আওতায় তিনি বিপ্লববাদে দীক্ষা নিয়েছিলেন। শুনেছি একবার তিনি শাড়ি পরে আত্মগোপন করে পুলিশের পাতা জাল থেকে নিস্তার পান। সেসব পুলিশ নিতান্তই হাবা ছিল সন্দেহ নেই। কারণ ভদ্রলোক প্রায় সাত ফুট লম্বা ছিলেন এবং বঙ্গরমণীরা কখনও এতটা উচ্চতা অর্জন করেছেন, ইতিহাসে এমন নজির নেই। সম্ভবত পসার এবং সম্পদ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ওঁর চিত্তে রাজভক্তির উদয় হয়। ভূধরবাবু পাবলিক প্রসিকিউটার নিযুক্ত হন। উপরি পাওনা রায়বাহাদুর খেতাব। ওঁর মক্কেলরা ওঁকে অন্য এক উপাধি দিয়েছিল—ভোন্দর দাস, ওরফে ভোন্দর মোক্তার (যদ্যপি উনি পাস করা উকিলই ছিলেন)। কারণ ভূধর শব্দটা কুমিল্লা অঞ্চলের গ্রামবাসী মুসলমানদের অভিধানে সুলভ ছিল না। মক্কেল প্রদত্ত ভোন্দর অর্থাৎ ভোঁদড় উপাধি পরিবারস্থ সবাই সম্মান জ্ঞানেই গ্রহণ করেছিলেন। মামারা সগর্বে আত্মপরিচয় দিতেন, ‘আমরাই তো ভোন্দরের ছাও।’ এই ভোঁদড়শাবক পরিচয় শ্লাঘারই বিষয় ছিল।

ভোন্দর মোক্তারের নানা কীর্তি কুমিল্লা অঞ্চলে জনপ্রবাদের অঙ্গ ছিল। শুনতাম ওঁর কাছে মামলায় হেরে যাওয়া প্রতিদ্বন্দ্বী এক উকিলকে তাঁর গ্রাম্য মক্কেল তিরস্কার করে বলেন, ভোন্দর মোক্তার যখন ষাঁড়ডার মতো গর্জনটা দিল, তহন যদি আফনে ম্যাড়াডার মথন মটকাডাও মারথেন, হেইলে হয়থ মামলাডা বাছথ। অর্থাৎ ভূধর দাসের বৃষগর্জনের প্রত্যুত্তরে উকিলবাবু যদি মেষসুলভ ম্যা ম্যা ধ্বনিও করতেন, তাহলেও হয়তো কিছু আশা ছিল।

এই সিংহতেজা মানুষটিকে নিজের দাদামশায় বলে জানতাম। মামলার কাজে বরিশাল এলে বসবার ঘরে সোফায় শুয়ে উনি ঘুমাতেন। আর ওঁর বিশাল ভূঁড়িটি ঢাকজ্ঞানে বাজিয়ে আমি নির্মল আনন্দ পেতাম। কিন্তু এই কলাচর্চায় মা বাবার অনুমোদন ছিল না। ফলে আমার সঙ্গীত শিক্ষার ওইখানেই শুরু এবং শেষ।

দেশবিভাগের কিছু পরে দাদামশায় এবং ভোঁদড়শাবকরা পশ্চিমবঙ্গে চলে আসেন। শুধু এক মামা পিতার বিশাল সম্পত্তি আঁকড়ে পূর্ব পাকিস্তানে রয়ে যান। মুক্তিযুদ্ধের সময় খানসেনারা তাঁকে খুন করে–শরীরের সমস্ত রক্ত নিষ্কাশন করে নিয়ে।

কুমিল্লা শহরে ভূধর দাসের প্রাসাদোপম বাংলো বাড়ি ছিল–বিশাল কম্পাউন্ডের মাঝখানে সাহেবি কায়দায় তৈরি, সামনে চওড়া গাড়িবারান্দা। মানে ত্রিশের দশকে বাংলা ছবিতে নায়িকার অভিজাত পিতারা যে ধরনের বাড়িতে থাকতেন, কতকটা সেই স্টাইলে। আমার মা এবং মামামাসিরা কাকার আশ্রয়ে ওই বাড়িতেই মানুষ হয়েছিলেন। অন্য সহায়হীন ভ্রাতৃবধূ আর ভাইপো-ভাইঝিদের হৃদয়বান মানুষ ভূধর দাস অবহেলা করেননি। কিন্তু দরিদ্র আশ্রিতজনের ভাগ্যে যে তুচ্ছতাচ্ছিল্য ছোটবড় অপমান বরাদ্দ থাকে, কর্মব্যস্ত মানুষটি তা থেকে ওদের বাঁচাতে পারেননি। উনি ভাইপোদের সযত্নে লেখাপড়া শিখিয়ে জীবিকা উপার্জনের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। ভাইঝিদের বহু ব্যয়ে বড় ঘরে বিয়ে দিয়েছিলেন। ওঁর বাড়ির পাশেই বেশ কিছুটা জমিবাগান নিয়ে আমার দিদিমা এবং মামাদের বড় একতলা বাড়ি ছিল, সম্ভবত ওঁরই অর্থসাহায্যে।

কিন্তু ভূধরবাবু সম্পর্কে ওঁদের নালিশের অন্ত ছিল না। শুনতাম দিদিমা নাকি স্বামীর মৃত্যুর পর প্রায় সাতদিন অজ্ঞান ছিলেন। সেই সময়ের মধ্যে সদ্যবিধবা বউদির টিপসই আদায় করে ভূধরদাদু বড় ভাইয়ের রেখে যাওয়া সত্তর হাজার টাকার কোম্পানির কাগজ আত্মসাৎ করেন। গিরিশ ঘোষের নাটকোপযোগী এই কাহিনি যদি সত্যি হয়, তবু সাত ভাইপো-ভাইঝির ভরণপোষণ, শিক্ষাদীক্ষা, বিয়েসাদিতে সে টাকা উনি কতগুণে শোধ দেন, তার হিসাব মিলাননা আজ আর সম্ভব না।

প্রায় একশো বছর আগের এই সব তুচ্ছ পারিবারিক প্রসঙ্গ নিয়ে কেন আজ শব্দব্যয় করছি ঠিক জানি না। একটা কারণ কিছুটা আন্দাজ করতে পারি। নানা দোষগুণ নিয়ে ভূধরবাবু বিরাট মাপের মানুষ ছিলেন। ওই ধরনের প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী, হয়তো কিছুটা দাম্ভিক, কর্মকুশল মানুষ আমাদের সমাজে আর দেখা যায় না। সাফল্যের চূড়ায় যে নিঃসঙ্গতা, তা তাঁকে ঘিরে ছিল। লোকে কানাঘুষা করত—উনি নাকি ওঁর বিখ্যাত এক সহকর্মীর পত্নীর প্রেমাসক্ত ছিলেন। আদালত-ফেরতা রোজই তাঁর সঙ্গে কিছুটা সময় কাটাতেন। যতদূর জানি, নিঃসঙ্গ মানুষটির ‘অবৈধ’ প্রেম এর বেশি এগোয়নি। বাইরে থেকে মনে হত মানুষটি কঠিন প্রকৃতির, আবেগহীন, দুরধিগম্য। কিন্তু বহু নিরাড়ম্বর দানধ্যানে ওঁর হৃদয়ের অন্যতর পরিচয় ছিল। কিন্তু আবেগ প্রকাশের ক্ষমতা অথবা ইচ্ছা ওঁর ছিল না। তাই ছেলেপেলেরা ওঁকে ভয় পেত। আমি পেতাম না, কারণ বুঝতে পেরেছিলাম যে, ভুড়িতে ঢাক বাজানো ব্যাপারটা ওঁর অপছন্দ ছিল না। বোধ হয় অর্বাচীন শিশুর নির্বোধ দুঃসাহস ওঁকে যন্ত্রণাময় নিঃসঙ্গতা থেকে ক্ষণিক মুক্তি দিত। আমার ঠাকুর্দা আমার জ্ঞান হওয়ার আগেই মারা যান, আর নিজের দাদামশায় তো মা’র শৈশবেই গতাসু। ভূধরদাদু আদর না। দিলেও প্রশ্রয় দিতেন। শাসনহীন স্নেহের সঙ্গে ওই আমার প্রথম পরিচয়। তার প্রতিদানে যে-তীব্র অহেতুকী ভালবাসা বোধ করতাম, তা শুধু শিশুহৃদয়েই লালিত হতে পারে। আর পারে কৈশোর প্রেমে। বড় হয়ে যখন গলসওয়ার্দির ‘ওল্ড ইংলিশ’ নাটকটি পড়ি, তখন তার দোষেগুণে ভরা কেন্দ্রীয় চরিত্রটিতে দাদামশায় ভূধর দাসের প্রতিচ্ছবি দেখতে পাই। চরিত্রটিতে আরও একটি প্রিয় মানুষের ছায়া দেখতে পেতাম। তিনি শের-ই-বাংলা ফজলুল হক।

আমাদের মামাবাড়িতে বেশি যাওয়াআসা ছিল না। মা আমাদের নিয়ে দু-লি বছরে একবার যেতেন। বাবাকে কখনও যেতে দেখিনি। আমাদেরও ওখানে গিয়ে খুব একটা ভাল লাগত না। তার একটা কারণ আমার আবাল্য বিদ্রোহী দাদা, অরুণ ওরফে অতু, খেতে বসলেই মা ওকে নিয়ে তাঁর নানা অভিযোগ আর দুঃখের কথা বলতে শুরু করতেন। চোখের জল ফেলতে ফেলতে খাওয়া ছেড়ে দাদা উঠে যেত। মাতুল পরিবারে ওর সপক্ষে এবং বিপক্ষে নানা মন্তব্য হত। শুধু দিদিমা (আমরা বলতাম আজিমা), যাঁর স্নেহে কখনও কোনও সীমা বা বাছবিচার ছিল না, মাকে বকতে থাকতেন। ভাল ছেলের উজ্জ্বল নিদর্শন আমার সঙ্গে তুলনা করে দাদার নিকৃষ্টতা প্রমাণে মা সচেষ্ট হতেন। এই আবেগময় নাটকে নিতান্ত সঙ্কুচিত হয়ে পর্দার আড়ালে আশ্রয় নিতাম। ভোজনপ্রিয় দাদার অসমাপ্ত খাওয়া এবং অহেতুক অপমান বড় কষ্ট দিত। নিজের প্রশংসাটা এই পরিস্থিতিতে আরও যন্ত্রণাদায়ক ছিল।

আমাদের মধ্যবিত্ত সমাজে সন্তানপালন সম্পর্কে কিছু নিতান্তই অশ্রদ্ধেয় ধারণা এখনও চালু আছে। তার একটি হচ্ছে সন্তানের পক্ষে কী মঙ্গলজনক তা মা বাপের চেয়ে কেউ ভাল বোঝ না। কিন্ডারগার্টেনে পড়াতে হলেও তার জন্য শিক্ষা নিতে হয়, অথচ সন্তানপালনের গুরুদায়িত্ব নেওয়া হয় শুধুমাত্র সাধারণ বুদ্ধি বা তার অভাবের ভরসায়। মা বাপের নিরঙ্কুশ সদিচ্ছা আর স্নেহ–শিশুপালনের জন্য যে বিশেষ জ্ঞানের প্রয়োজন হয়—তার সমস্ত ঘাটতি নাকি পূরণ করে। তাঁদের নিজেদের জীবনের অতৃপ্তি ব্যর্থতাবোধ সহনশক্তির অভাব পরিমিত সুবুদ্ধি যে সন্তানপালনে বিপর্যয় ঘটাতে পারে, ভূরি ভূরি প্রমাণ সত্ত্বেও এ কথা স্বীকার করতে আমাদের দ্বিধা হয়। আর, সব সন্তানকে মা বাপ সমান চোখে দেখে এ কথারও কোনও বাস্তব ভিত্তি নেই। শৈশবে আমরা মা বাবার স্নেহের অভাব কখনও বোধ করিনি। কিন্তু ছোটবেলা থেকেই দেখেছি, দাদার প্রতি ওঁদের একটা পুঞ্জীভূত বিরক্তিবোধ আর আশাভঙ্গের মনোভাব ছিল, যদিও সে কোনও অর্থেই খারাপ ছাত্র বা বখে যাওয়া ছেলে ছিল না। বড় হবার পর মনে হত মানুষটার সারা জীবন কেটেছে মা বাপের অনুমোদন লাভের ব্যর্থ চেষ্টায়। ওর জীবনের বহুমুখী সম্ভাবনা বোধহয় প্রধানত এই কারণেই ফলপ্রসূ হয়নি।

মামাবাড়িতে সমবয়স্ক মামাতো ভাইদের কাছে দাদা খুব প্রিয় ছিল না। তার এক কারণ, জমিদার বাড়ির ছেলে বলে আমাদের কিছুটা দেমাক ছিল এবং দাদা অনেক সময় তা বেশ স্থূলভাবেই প্রকাশ করত। শৈশবের স্মবারি যে কী ভয়ঙ্কর হতে পারে, প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা না থাকলে তা ধারণা করা কঠিন। আমাদের দেমাকের দ্বিতীয় উপজীব্যটা সম্ভবত মামাতো ভাইদের কাছে আরও বেদনাদায়ক ছিল। আমাদের পরিবারে সাহেবি ভাবাপন্ন ঠাকুর্দার সময় থেকে, পরবর্তী কালে বাবার স্বদেশি ধরনধারণ সত্ত্বেও, জীবনশৈলী কিছুটা পশ্চিমায়িত ছিল। আমরা পিড়িতে বসে কাঁসার থালাবাটিতে অনুগ্রহণের অভ্যেস ছেড়ে টেবিলে চিনামাটির বাসন এবং কাঁচের গ্লাস সহযোগে খানা খেতাম। খাদ্যটা প্রধানত ভাত ডাল-মাছ হলেও, জমিদার ইসমাইল চৌধুরির বিবির কাছে শেখা মোগলাই কোমা, রেজালা বিরিয়ানি এবং স্টিমার কোম্পানির বাবুর্চিদের প্রশিক্ষণে বামনাবতার বসা—এবং পরে আন্দামান-ফেরত আফছারিয়া রন্ধিত সুপ-রোস্ট-পুডিং জাতীয় বিলাতি ভোজ্য আমাদের খাদ্যতালিকার অন্তর্ভুক্ত ছিল। কারণে অকারণে সেইসব তথ্য মামাতো ভাইদের কাছে ঘোষণা করে দাদা তাদের হীনম্মন্যতা উস্কে দিত। ফলে মাঝেমাঝেই তাদের সঙ্গে অপ্রিয় বাক্য আদানপ্রদান হত।

তারপর দাদা তর্জনী আস্ফালন করে এক সাবধানবাণী উচ্চারণ করত যা আমার কাছে নিতান্তই দুর্বোধ্য ঠেকত : যদি রোহিণী সেনের রক্ত গায়ে থাকে তো ওদের সঙ্গে কথা বলবে না। কখনও কখনও রোহিণী সেনের জায়গায় অশ্বিনী দত্তের নাম উল্লিখিত হত। রক্ত গায়ে থাকতে কী বোঝায় তা আমার জানা ছিল না। ত্রিশের দশকের গোড়ার দিকে জিনস বা ডি-এন-এ তত্ত্ব বোধ হয় আবিষ্কৃত হয়নি। হলেও পাঁচ বছর বয়সে বিষয়টা আমার সম্পূর্ণ আয়ত্ত ছিল না। কিন্তু রোহিণী সেন বা অশ্বিনী দত্ত কারও রক্তই বৈধ পথে আমাদের ধমনীতে প্রবহমান হওয়া সম্ভব ছিল না—এ তত্ত্ব বড় হয়ে বুঝেছি। বরিশালের প্রবাদপুরুষ অশ্বিনী দত্তর সঙ্গে আমাদের কোনও আত্মীয়তা ছিল না, যদিও ওঁরা আমাদের পরিবারের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। নেহাতই আত্মগরিমা বাড়াবার জন্য দাদা ওঁর নামও টেনে আনত। আর বিদ্যাবত্তা এবং ইতিহাসচর্চার জন্য খ্যাতিমান আমাদের পরিবারের সবচেয়ে বিখ্যাত মানুষ রোহিণীকুমার সেন ছিলেন আমার ঠাকুর্দার বড় ভাই। সুতরাং তাঁর রক্ত আমাদের শরীরে আসা দ্বাপর বা ত্রেতা যুগে শাস্ত্রসম্মত হলেও কলির গোড়ার দিকেই তদঘটিত প্রথাটা উঠে গেছে। উনিশ বা বিশ শতকে ব্যাপারটা ঘটলে নেহাতই কেলেঙ্কারি বলে গণ্য হত। আসলে ওই দুই বিখ্যাত ব্যক্তির নাম টেনে এনে দাদা বোঝাতে চাইত—আমরা কংস রাজার বংশধর, এ কথা কখনও ভুললে মহান কীর্তিপাশা পরিবারের অবমাননা হবে। যে সময়ের কথা বলছি, সে সময় আমার স্মৃতিশাস্ত্র এবং পারিবারিক ইতিহাস, দুই বিষয়েই ধারণা কিছুটা অস্পষ্ট ছিল। তাছাড়া তখন দাদার মতামত স্মৃতিশ্রুতিরই তুল্য ছিল। ফলে বিব্রত মুখে মামাতো ভাইদের এড়িয়ে চলতাম। মাতুলালয়বাস অসহনীয় হয়ে উঠত।

কিন্তু জীবনযাত্রার মান যদি শ্লাঘার বিষয় হয়, তাহলে মামাবাড়ির তুলনায় আমাদের চালিয়াতি করার খুব কোনও কারণ ছিল না। সে যুগের হিসাবে ওঁরা সম্পন্ন গৃহস্থ, আমরা সংকটাপন্ন জমিদার, ‘জলসাঘর’-এর বিপন্ন নায়ক বিশ্বম্ভর রায়ের হাল হতে খুব আর দেরি নেই। ছোটমামা ছিলেন কন্ট্রাক্টর–দুটো ট্রাক আর একটি বাসের মালিক, মাসিক আয় আট দশ হাজার টাকা, যা আজকালকার হিসাবে কয়েক লাখের সঙ্গে তুলনীয়। আজিমার রাজত্বে ভোজনের ব্যবস্থা স্মরণ করলে মনে হয় সেই বিপুল রোজগারের সিংহভাগ পেটপুজোয় খরচ হত, কারণ আমার কোনও সঞ্চয় বা কু-অভ্যাস দুটোর একটাও ছিল না।

একটি ট্রাক খাটত মাছের ব্যবসায়। কাঁচা টাকা ছাড়া মেছো কোম্পানি থেকে রোজ দুটি পাঁচ থেকে দশসেরি মাছ পাওনা ছিল। যাঁরা সের কাকে বলে ভুলে গেছেন, তাঁরা শব্দটাকে কে. জি. বা কিলোগ্রামে অনুবাদ করে নিন, তার সঙ্গে মনে মনে হিসাব করুন দশ কেজি ওজনের মাছ বাড়িতে শেষ কবে দেখেছেন। ওই মহামৎস্য ছাড়াও উপরি পাওনা ছিল দিনান্তে ট্রাক পরিষ্কার করার সময় পড়ে থাকা কুচো মাছ, তাতে দুটি মাঝারি সাইজের বালতি ভরে যেত। নেট ওজন পাঁচ-ছ সেরের কম নয়। কুচো মাছ মানে হেলাছেদ্দা করার মতো কিছু নয়—মাঝারি সাইজের চিংড়ি, পাবদা, বাচা, পার্শে ইত্যাদি। এই বিপুল পরিমাণ মাছ রোজ রাঁধা এবং খাওয়া হত, মুক্ত হস্তে ঘানিতে ভাঙা সরষের তেল খরচা করে। বাড়ির স্ত্রী-পুরুষ, যাবতীয় কাজের লোক, বাস-ট্রাকের কর্মীরা—কেউই বাদ পড়ত না। এই মৎস্যপুরাণের এখানেই ইতি নয়। মাছের ট্রাক ফিরত মধ্যাহ্নভোজনের পরে। অতএব দুপুরের খাওয়ার আলাদা ব্যবস্থা করা আজিমার মতে আবশ্যিক। ত্রিশের দশকে কুমিল্লায় মাছ নিতান্তই সস্তা। তাই রোজই বাজার থেকে আয়তনে তিমিঙ্গিতুল্য রুই কাতলা চিতল মহাশোল জাতীয় কোনও না কোনও মাছ আসত, এক বা একাধিক। মা-মাসিরা এই অপচয়ে মৃদু আপত্তি জানালে আজিমা তা নস্যাৎ করে দিতেন : ‘ক’স কী? ধনেরা না খাইয়া থাকব?’ ধনেরা অর্থাৎ আমরা নাতি-নাতনিরা না খেয়ে থাকব এমন আশঙ্কার কোনও হেতু ছিল না। কারণ দিন পনেরো মাতুলালয়বাসের পর যখন বাড়ি ফিরতাম, তখন খোদার খাসি জাতীয় পুরুষ্টু প্রাণীরা আমাদের দেখে ঈর্ষিত হত সন্দেহ নেই। আর শরীরে তখন মাংসের তুলনায় মাছের অংশ অনেক বেশি।

আমাদের আয়তনবৃদ্ধির মাছ ছাড়া অন্য কারণও ছিল। মামাবাড়িতে মধু এবং দুধের স্রোতস্বিনী না থাকলেও, দুধের সরবরাহটা একটা নাতিবৃহৎ জলাশয় ভরার জন্য পর্যাপ্ত ছিল। মনে হয়। আজিমার দুটি অত্যন্ত নাদুসনুদুস গাভী ছিল। তাদের দেখলে গোমাতার সুযোগ্যা কন্যা উমা ভারতী আনন্দাশ্রুতে আপ্লুত হতেন, আদর্শ গোরুর সন্ধানে হল্যান্ড দৌড়তে হত না। এই কামধেনুরা মাথা পিছু বোজ গড়ে ত্রিশ সের দুধ দিতেন। সেই দুধে ঘি, মাখন, মিষ্টান্নাদি তৈরি করার পরেও প্রায় সের দশ বারো উদ্বৃত্ত থাকত। মধ্যাহ্নভোজনের পর সে। বস্তু এক জগদ্দল কড়াইয়ে কাঠকয়লার উনোনে ঢিমে আঁচে চাপানো থাকত। ঘণ্টা তিনেক পর সেই দুধ যে-জিনিসে পরিণত হত তাকে অমৃতবৎ বললে কিছুমাত্র অতিভাষণ হবে না। খাদ্যের লাইনে ইন্দ্রলোকে ওর চেয়ে বেশি সুস্বাদু কিছু পাওয়া যায়, একথা বিশ্বাস করতে আমি নারাজ। যে-দুধ রূপান্তরিত হয়নি, তা আমার চক্ষের বিষ ছিল। আর ছোটবেলায় অভ্যেস ছিল, খাওয়ার সময় নিজের থালা ছাড়া অন্য কোনও দিকে দৃকপাত না করা–কতকটা অর্জুনের ধনুর্বিদ্যা শেখার আদর্শে। ফলে খাওয়ার শেষে আজিমা যখন দুধ বিতরণ করতেন, তখন প্রবল শিরঃকম্পনে নিজের অনীহা ঘোষণা করতাম। হঠাৎ একদিন চোখে পড়ল মাতামহী-বর্ণিত ‘দুধ’ আসলে সেই পাটকিলে রঙের রাবড়ি। দিনের পর দিন কী ভুল করেছি ভেবে প্রাণটা হাহাকার করে উঠেছিল।

আজিমার শরীরমনে আলসেমির কোনও স্থান ছিল না। দুপুরের খাওয়া শেষ হলেই উনি সারা বছরের জন্য নানা মুখরোচক খাদ্য-আচার, মোরব্বা, বড়ি, আমসত্ত্ব, নাভু, জ্যাম, জেলি ইত্যাদি তৈরি করতে বসতেন। তাছাড়া দৈনিক বরাদ্দ দুগ্ধজাত তথা ময়দা, ডাল, নারকেলের মিষ্টি তো ছিলই। তারপর আক্ষরিক অর্থেই বারো মাসে তেরো পার্বণের প্রস্তুতিও একটা বড় কাজ ছিল। সংকটচণ্ডী, মঙ্গলচণ্ডী, মাঘমঙ্গল, পাঁচুঠাকুর ইত্যাদি নানা ব্ৰত মারফত সব দেবদেবী উপদেবতা অপদেবতাদের সন্তুষ্ট রাখার চেষ্টা বছর ধরেই চলত। প্রতিটি ব্রতেরই নিয়মকানুন স্বতন্ত্র, বিচিত্র এবং অনেক সময়ই অত্যন্ত কষ্টকর। সংকটচণ্ডীর ব্ৰতটা মনে আছে। ওই ব্রতের অনুষ্ঠান ঘণ্টা তিনেক ধরে চলত এবং সব কাজই করতে হত ডান হাতে। আর সেই দক্ষিণ হস্তটি ব্যবহার করতে হত হাঁটুর নীচ দিয়ে। এটাই ছিল ‘সংকটে বসা’, উদ্দেশ্য ঘণ্টা তিনেক ওইভাবে ‘সংকটে’ বসে পরিবারস্থ সবাইকে সারা বছর সংকটমুক্ত রাখা। মানুষ যন্ত্রণা পেলে স্বর্গস্থ দেবতারা খুশি হন, এই ধারণা অনেক ধর্মবিশ্বাসের মূল কথা। বোধ হয় ধরাতলবাসী দেবতাদের আচরণ থেকেই ধারণাটা জন্মেছে।

ব্রতপালনের অন্যতর অঙ্গ বিচিত্র শিল্পচর্চা। এঁটেল মাটি দিয়ে নানা সাইজের পুতুল বা মূর্তি তৈরি করা হত। আর প্রতি ব্রতে আলপনাও ছিল বিশিষ্ট চেহারার। কোন ব্রতে তা মনে নেই, আজিমা নিজের হাতে মাটি দিয়ে এক বিরাট কুমির বানাতেন। কৃষ্ণনগরের কুমোররা তা দেখলে নিশ্চিত হতমান হতেন। ব্ৰতসংক্রান্ত যে-শিল্পে আমাদের সব চেয়ে বেশি আগ্রহ ছিল সেটা অবশ্যই রন্ধনশিল্প। প্রতি ব্রতে যেসব বিচিত্র আহার্য প্রস্তুত হত বছরের অন্য কোনও সময় তা পাওয়া যেত না।

আজকাল দেখি সবাই সব সময় ভীষণ ব্যস্ত, কিছু করারই কেউ সময় পান না। আজিমাকে কখনও সময়ের অভাব বলে অনুযোগ করতে শুনিনি। ওঁর হাতে সর্বদাই অন্তহীন সময়। রান্নাবাড়ি, মিঠাই বানানো, ব্রতপার্বণ এসব ছাড়া ওঁর আর একটি বড় কাজ ছিল কাঁথা সেলাই আর পশমের জামা বোনা। ওঁর তিন ছেলে আর চার মেয়ে এবং তাঁদের জনা বিশেক সন্তানসন্ততি সকলেরই গায়ে ওঁর বোনা উলের সোয়েটার শোভা পেত। প্রতি শীতেই আমাদের একটি নতুন সোয়েটার পাওনা ছিল। ওঁর আর এক শখ ছিল বাগান। সে বাগানে সারা বছরই নানারকম সুগন্ধি দেশি ফুল আর বহুবর্ণ বিদেশি মরসুমি ফুল ফুটত। যেসব ফলের গাছ পূর্ব-দক্ষিণ বঙ্গের মাটিতে গজানো সম্ভব, তার প্রায় সবই আজিমা পুঁতেছিলেন। যা গজানো সম্ভব নয়, তাদেরও সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেননি। যথা আঙুর। বাগানে সুদৃশ্য একটি আঙুরের লতা ছিল। তাতে বেশ বড় বড় কালো রঙের ফল হত, যদিও স্বাদে জামিরের মতো টক। অবশ্যি এই সামান্য ব্যাপারে আজিমা দমতেন না। অসহ্য রকমের টক আঙুর প্রচুর চিনি সহযোগে লোভনীয় জ্যামে পরিণত হত।

আজিমার সারা জীবনই নানা দুঃখে ভরা। বেশির ভাগ সময়টা উনি ছোটছেলের কাছেই থাকতেন। জীবনের শেষ পর্যায়ে ছেলের সঙ্গে মনোমালিন্য হওয়ায় সেই ছেলের প্রথম পক্ষের তিন ছেলেমেয়েকে নিয়ে আজিমা বাড়ি থেকে বের হয়ে আসেন। বোধ হয় ভরসা ছিল মা-মরা ছেলেমেয়েগুলি জ্যাঠা বা পিসিদের কাছে আশ্রয় পাবে। কিন্তু ঘটনাটা ঘটে দেশবিভাগের পরে। যাঁদের ভরসায় উনি ছোটছেলের আশ্রয় ছেড়েছিলেন, কারও অবস্থাই তখন খুব সচ্ছল না। তিনটি অপোগণ্ড শিশুর ভার নিতে কেউ কোনও উৎসাহ দেখাল না। সবারই উপদেশ–ওদের বাপের কাছে ফিরিয়ে দাও, তুমি একা এসো, মাথায় করে রাখব। জেদি মানুষটি সত্মার হাত থেকে বাচ্চাগুলিকে বাঁচাবেন বলেই ঝগড়া করে বের হয়ে এসেছিলেন। ওই সদুপদেশ ওঁর কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি। তখন ওঁর বয়স আশির উপরে। সোজা মুখ্যমন্ত্রী বিধান রায়ের দরবারে হাজির হয়ে উনি হাবড়ায় উদ্বাস্তুদের জন্য তৈরি বাড়িগুলির একটি দাবি করেন। সেই বাড়ির গৃহ এবং উদ্যানসজ্জার জন্য নানা জিনিস এবং গাছপালা চেয়ে এক লম্বা ফর্দ আজিমা মেয়ে-জামাইদের কাছে পাঠান। সেই ফর্দে উনি আঙুরলতার উল্লেখ করতে ভোলেননি। হাবড়ার বাড়ির একচিলতে বাগানে আঙুরলতা লকলকিয়ে বেড়ে ওঠে। শুনেছি ফলও ধরেছিল প্রচুর। তার স্বাদগ্রহণ করার সুযোগ আমার হয়নি।

আজিমার প্রাণশক্তি বোধ হয় অন্তহীন ছিল। শত আঘাতেও তা ক্ষুণ্ণ হত না। উনি বেঁচে থাকতেই ওঁর দুই ছেলে আর দুই জামাই মারা যান। খবরগুলি ওঁর কাছ থেকে গোপন করা হত। কিন্তু কোনওভাবে উনি বুঝতে পারতেন। ওঁর মেজছেলের মৃত্যুর দিনটায় উনি আমাদের কাছে ছিলেন। সবাই দুঃসংবাদটা চাপা দিতে ব্যস্ত। হঠাৎ আজিমা জিগ্যেস করলেন, ‘কালু নাই, না?’ সবাই চুপ করে রইল। দরজায় পিঠ দিয়ে বসে উনি কিছুক্ষণ খুব কাঁদলেন। তারপর উঠে যেকাজ করছিলেন, সেই কাজে আবার হাত দিলেন।

কুমিল্লা শহরে আমার শৈশব আর বাল্যের অনেকগুলি দিন কেটেছে। শহরে বা তার কাছেপিঠে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিল কয়েকটি অতিবৃহৎ দিঘি, যাদের স্থানীয় নাম ছিল সাগর, আর শহরের অদূরে ময়নামতীর পাহাড় অর্থাৎ টিপি। সেই টিপির নীচে অনেক পুরাবস্তু লুকিয়ে ছিল। যতদূর মনে পড়ে, আর্কিয়োলজিকাল সার্ভে ত্রিশের দশকেই ওখানে খননের কাজ শুরু করে। পাকিস্তানি আমলে সে কাজ আরও এগিয়ে যায়। আমাদের বাসস্থান বরিশাল জেলা প্রায় হল্যান্ডের মতোই উচ্চাবচতাহীন সমতল। কুমিল্লা শহরে সবচেয়ে উঁচু জায়গা ছিল চাঁদমারি—অর্থাৎ পুলিশদের বন্দুক ছোঁড়া অভ্যেস করার জন্য মাটি ফেলে তৈরি ঢিপি, উচ্চতায় বিশ-পঁচিশ ফুট, আগাছার কৃপায় রীতিমতো মনোরম। ছেলেবেলায় চাঁদমারি আরোহণ করে অ্যাডভেঞ্চারের স্বাদ পেতাম। চাঁদমারির তুলনায় ময়নামতী হিমালয়সদৃশ। আর হেমেন রায়ের ময়নামতীর ‘মায়াকানন’ পড়ে জায়গাটা মঙ্গলগ্রহের অন্তর্গত বলে অনেক দিন বিশ্বাস ছিল। সুতরাং পাহাড়টি ছিল আমার স্বপ্নভূমি। বিমল, কুমার, রামহরি সেখানে আমার সাগরে, এভারেস্ট অভিযাত্রীরা অনুচর মাত্র। আর ‘চাঁদের পাহাড়’-এর ডিয়েগো আলভারেজের সঙ্গে সেখানে রোজই দেখা হত। এহেন ময়নামতী ছাড়া কুমিল্লায় আমার দ্বিতীয় আকর্ষণ ছিল ধর্মসাগর। দিঘির সঙ্গে আমরা বরিশালেও অপরিচিত ছিলাম না। কিন্তু এ বিশাল রাজকীয় ব্যাপার, সাগর অভিধা সামান্যই অতিরঞ্জন।

সেই ধর্মসাগরের পারে বিখ্যাত সার্কাসওয়ালা রামমূর্তি তাঁবু ফেললেন। মামাতো ভাইবোনদের সঙ্গে সার্কাসের জন্তুজানোয়ার দেখতে গেলাম। দেখলাম বিরাট এক হাতি গাছের সঙ্গে দড়ি দিয়ে বাঁধা। ফিরে এলে বড়রা প্রশ্ন করলেন, ‘ক’ কী দেখলি।’ চার বছর বয়স্ক প্রতিমা জুরির ফোরম্যানের মতো সকলের হয়ে উত্তর দিল, আমমূর্তিরে দেইখা আইলাম। গাছের লগে বাঁইধা থুইছে। হে খালি দোলে আর দোলে।

কুমিল্লা শহরে আমার এক অস্তিত্ববাদী বন্ধু জুটেছিল সার্তের আবির্ভাবের বেশ কিছুকাল আগে। তার নাম কেউ জানত না, সম্ভবত সে নিজেও না। কিন্তু তা বলে যে পরিচয়হীন ছিল এমন নয়। শতচ্ছিদ্র আলখাল্লা পরা মানুষটি ভিক্ষে করতে এসে কোমরে হাত দিয়ে উদ্দাম নৃত্য সহযোগে যে বিচিত্র সঙ্গীত পরিবেশন করত তাতে তার গভীর আত্মজ্ঞান এবং পিতৃবংশ সম্পর্কে যথোচিত গৌরববোধের পরিচয় পাওয়া যেত। গানটি নিম্নরূপ :

আমি রহিমচাঁদা করিমচাঁদা ফটিকচাঁদার ভাই।
আমি বাজারেতে যাই।
কত কিলগুতা খাই।
আমার পিঠের চামড়া নাই।

দুঃখে অনুদ্বিগ্নমনা যোগীচিত্ত মানুষটি সত্যিকারের ভিক্ষাজীবী ছিল না। গৃহস্থের আঙিনায় নৃত্যগীত পরিবেশনের ন্যায্য মূল্য হিসাবেই যা দেওয়া হত, তা থলিস্থ করে আভূমি সেলাম জানিয়ে সে নাচতে নাচতে চলে যেত। কিলওঁতাজনিত পৃষ্ঠদেশের চর্মহীনতা তার জীবনবোধ কিছুমাত্র ক্ষুণ্ণ করেনি। ছ-সাত বছর বয়স অবধি আমি সেই দার্শনিক নৃতাশিল্পীর রুদ্রতাণ্ডবে যোগ দিতাম। এমন যোগ্য শিষ্য সে আর পায়নি। আত্মপ্রশংসা আমার স্বভাববিরুদ্ধ। তবু বলি উক্ত শিল্পে আমার রীতিমতো পারদর্শিতা জন্মেছিল। কিন্তু হঠাৎ একদিন আমার নৃত্যগুরু অন্তর্ধান হলেন। ফলে আমার শিক্ষা অসমাপ্ত রইল। না হলে উদয়শঙ্করের খ্যাতি যে নিষ্প্রভ হত এ বিষয়ে সন্দেহের কোনও কারণ নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *