তারাবাঈ ১৪ পরিচ্ছেদ

গভীর নিশীথে সুড়ঙ্গপথে বেহুঁশ অবস্থায় তারাবাঈকে হরণ করিয়া লইয়া মালোজী এক পর্বত গুহায় লুকাইয়া রাখিলেন। কিন্তু সেখানে আফজাল খাঁর চরগণ আশু অনুসন্ধান পাইতে পারে বলিয়া পিত্রালয় রায়গড়ে পাঠাইবার কথা হয়। কিন্তু সেখানে রাখিলে পাছে আফজাল খাঁ রায়গড় আক্রমণ করিয়া বসেন, এই ভয়ে শিবাজী তাহাকে মাতুলালয়ে রাখিতে আদেশ করেন। কঙ্কন প্রদেশের বিঠ্‌ঠলপুরের এক গিরি-উপত্যকার তারার মাতুলালয়। স্থানটি নিতান্ত দুর্গম, অথচ প্রাকৃতিক দৃশ্যে নিতান্তই মনোরম। তারার মাতামহ মলহর রাও একজন বড় জোতদার এবং হায়দ্রাবাদ নিজামের তহশীলদার। সুতরাং বিঠঠপুলপুরে তিনি একজন মতা ও প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তি। তারাকে এখানে বিশেষ যত্নে গোপনে রাখা হইল। তারার মনের গতি পরিবর্তনের জন্য নানাবিধ অবলম্বন করা হইল। কোনও রূপে একটি সন্ধি স্থাপিত হওয়া মাত্রই মালোজীর সঙ্গে তারার উদ্বাহ-ক্রিয়া সম্পন্ন হইবে, এই আশায় সকলেই উদ্বিগ্ন রহিল।

তারা সহস্র যত্ন এবং আদর পাইলেও কিছুতেই আফজাল খাঁর অতুল গরিমাপূর্ণ সৌন্দর্য এবং প্রেমের মাদকতা ভুলিতে পারিল না। স্বাধীন বনচারী বিহঙ্গকে পিঞ্জারাবদ্ধ করিতে তাহার মানসিক অবস্থা যেরূপ হয়, তারার অবস্থাও তদ্রুপ।

তারার প্রাণের ব্যাকুলতা এবং চাঞ্চল্য দিনের পর দিন বাড়িয়া যাইতে লাগিল। পলায়ন করিবার জন্য নানা চেষ্টা করিয়াও কোনও সুযোগ করিয়া উঠিতে পারিল না।

জীবন, তারার কাছে নিত্যই দুর্বহ বলিয়া বোধ হইতে লাগিল। তারার মনের কথা, প্রাণের ব্যথা, ব্যক্ত করিবার জন্য একটি লোকও নাই। তাহার প্রণয়-দেবতা আফজাল খাঁর কোনও সংবাদ না পাইয়া সে আরও অধীর চঞ্চল হইয়া উঠিল। সে কাহারও সহিত মিশিত না বা কথা কহিত না। মনের অশান্তি ও চাঞ্চল্য হাজার চেষ্টা করিয়াও তারা লুকাইতে পারিত না। তাহার মনের প্রতি অণুপরমাণু তুষানলে যে দগ্ধ হইতে লাগিল।

হায়! সে দুঃখ এবং সে জ্বালা ব্যক্ত করিবার ভাষা নাই। তারার মাতামহী তাহার মানসিক শান্তি বিধানের জন্য অনেক চেষ্টা ও তদ্বির করিলেন। অনেক হোম এবং যজ্ঞ করিলেন। তারার বিত্তরঞ্জনের জন্য গান-বাদ্যের বন্দোবস্ত করিলেন। কিন্তু জলের পিপাসা কি দুগ্ধে নিবারিত হয়? ক্ষুধার পেট কি কখনও কথায় ভরে? তারার কিছুতেই শান্তি হইল না।তারার কিছুতেই শান্তি হইল না।

তারা পুড়িয়া পুড়িয়া ছাই হইতে লাগিল। ক্রমশঃ সুবর্ণ কান্তি বিমলিন হইতে লাগিল। তারার উজ্জ্বল কটাপূর্ণ চক্ষু ক্রমশঃ উদাস ও কাতর-দৃষ্টিপূর্ণ হইয়া উঠিল। কেশ বেশ এবং অঙ্গরাগে তাহার আর কিছুই যত্ন রহিল না। কিছুদিন মধ্যে তারাতে কিছু কিছু উম্মাদের লক্ষণও পরিদৃষ্ট হইতে লাগিল।

বায়ু শান্তির জন্য নানা প্রকার আয়ুর্বেদীয় তৈল এবং ঔষধের ব্যবস্থা হইল। কিন্তু তাহাতে বিশেষ কোনও সুফল পরিদৃষ্ট হইল না। তারার নধর ও পুষ্ট তণু ক্রমশঃ ক্ষীণ ও শ্রীহীন হইতে লাগিল। সকলেই বুঝিল, প্রেমাস্পদ লাভের দারুণ নৈরাশ্যেই তারার শরীর-মন ভাঙ্গিয়া পড়িতেছে। তারার মাতামহী অম্বুজা বাঈ তারাকে চক্ষের তারার ন্যায় দেখিতেন। তারার শোচনীয় বিষন্ন অবস্থা অবলোকন করিয়া তিনি যার-পর-নাই মর্ম-পীড়িত হইলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *