৩২.০৯ স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম নির্বাচন

স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম নির্বাচন
উপাধ্যায় নয়

১. জন-যুদ্ধের গণতান্ত্রিক রূপ

স্বাধীনতা লাভের এক বছরের মধ্যে দেশের কনস্টিটিউশন রচনা সমাপ্ত করা বা নয়া কনস্টিটিউশন প্রবর্তনের তিন মাসের মধ্যে দেশব্যাপী সাধারণ নির্বাচন দেওয়া গণতান্ত্রিক দুনিয়ার একটা উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এই দৃষ্টান্ত স্থাপনের সকল কৃতিত্ব আওয়ামী নেতৃত্বের। সব প্রশংসা তাঁদেরই। স্বাধীনতা-সংগ্রামের জন-যুদ্ধেরই এটা ছিল গণতান্ত্রিকরূপ।

নয়া রাষ্ট্র ও নতুন জাতির এই প্রথম সাধারণ নির্বাচনে যে বিপুল উল্লাস, উদ্যম ও উদ্দীপনা দেখা দিয়াছিল, সেটাও ছিল সর্বাত্মক ও সর্বব্যাপী। আমাদের সংবিধানের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ও প্রশংসনীয় বিধান আঠার বছর-বয়স্কদের ভোটাধিকার। এ বিধানের জন্য আমরা ন্যায়তঃই গর্ববোধ করিতে পারি। আফ্রো-এশিয়ান সমস্ত রাষ্ট্রের মধ্যে বাংলাদেশই সর্বপ্রথম ভোটাধিকারকে এমন গণ-ভিত্তিক করিয়াছে।

শুধু আফ্রো-এশিয়ান রাষ্ট্রেই নয়, বহু প্রবীণ-প্রাচীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেও আজ পর্যন্ত ভোটাধিকারকে এমনভাবে তরুণদের স্তরে প্রসারিত করা হয় নাই। যে সব সত্য ও উন্নত দেশে শিক্ষার প্রসার প্রায় সার্বজনীন, তাদের কথা আলাদা। কিন্তু আমরা আফ্রো এশিয়ান দেশের যে-যেখানে শিক্ষিতের হার মাত্র শতকরা বিশ, যে-সব দেশের শতকরা আশিজনই নিরক্ষর, সে সব দেশের স্কুল-কলেজের ছাত্রদের অধিকাংশই একুশ বছরের কম বয়স্ক। এসব দেশের ভোটাধিকারকে একুশে সীমাবদ্ধ করিলে শিক্ষিত সমাজের এক বিরাট অংশকেই ভোটাধিকার হইতে বঞ্চিত রাখা হয়। এ ব্যবস্থা আরও ঘোরর অন্যায় এই জন্য যে আমাদের দেশের সকলপ্রকার জাতীয় অধিকারের আন্দোলনে ছাত্র-তরুণরাই পয়লা কাতারের সৈনিক হিসাবে ত্যাগ স্বীকার করিয়া আসিয়াছে। স্বাধীনতা লাভের পরে নাবালকত্বের অজুহাতে তাঁদেরই ভোটাধিকার হইতে, তার মানে রাষ্ট্রপরিচালক নির্বাচনের অধিকার হইতে, বঞ্চিত রাখা ন্যায়তও অসংগত, রাষ্ট্রের স্বার্থের দিক হইতেও ভ্রান্তনীতি। আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব প্রথম সুযোগেই এই অন্যায় ও ভ্রান্ত নীতির অবসান করিয়াছেন বলিয়া তাঁরা সারা দেশবাসীর বিশেষতঃ তরুণ-সমাজের, ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতার পাত্র।

২. নির্বাচনে আশা-প্রত্যাশা

এই নির্বাচনটা ছিল বাংলাদেশে পার্লামেন্টারি গণতন্ত্রের সাফল্যের প্রথম পদক্ষেপ। আওয়ামী লীগই দেশকে এই পার্লামেন্টারি পদ্ধতির সংবিধান দিয়াছে। হঠাৎ দেয় নাই; কারো চাপে পড়িয়া দেয় নাই। আওয়ামী লীগ আজন্ম পালমেন্টারি পদ্ধতির দৃঢ় সমর্থক। সেই কারণেই তাঁরা দেশকে পার্লামেন্টারি শাসন ব্যবস্থা দিয়াছেন। তাঁরা বিশ্বাস করেন, পার্লামেন্টারি পদ্ধতিই বাংলাদেশের জন্য একমাত্র উপযুক্ত পন্থা।

কাজেই আসন্ন নির্বাচনে যাতে পালামেন্টারি পদ্ধতির ভিত্তি স্থাপিত হয়, সে চেষ্টা আওয়ামী লীগের করা উচিত ছিল। তাঁদের বোঝা উচিৎ ছিল, পার্লামেন্টারি পদ্ধতির অসাফল্য কার্যতঃ আওয়ামী লীগেরই অসাফল্য রূপে গণ্য হইবে।

পার্লামেন্টারি পদ্ধতির ভিত্তি স্থাপন মানে বিরোধী দলের যথেষ্ট সংখ্যক ভাল মানুষ নির্বাচিত হউন, সে দিকে সজাগ দৃষ্টি রাখা। সে দৃষ্টিতে যথেষ্ট উদারতা ও সহিষ্ণুতা আবশ্যক। রাজনৈতিক হরিঠাকুর হিসাবে আমি আওয়ামী নেতাদের কাউকে কাউকে আগে হইতেই উপদেশ দিয়াছিলাম। মুখে-মুখেও দিয়াছিলাম, ইত্তেফাকে একাধিক প্রবন্ধ লিখিয়াও তেমন উপদেশ দিয়াছিলাম। আমি এ বিষয়ে বিশেষ ন্যর রাখিবার উপদেশ দেওয়া দরকার মনে করিয়াছিলাম দুইটি কারণে। প্রথমতঃ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই সংগ্রামের মধ্য দিয়া দেশ স্বাধীন হইয়াছে। এ অবস্থায় আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তার মধ্যে গোটা জাতির একটা ভাবাবেগ মিশ্রিত আছে। দ্বিতীয়তঃ আওয়ামী লীগ নৌকাকেই তাদের নির্বাচনী প্রতীক করিয়াছেন। নৌকা-প্রতাঁকের সাথে বাংলাদেশের ভোটারদের মধ্যে ভাবাবেগের ঐতিহ্য আছে। ‘৭০ সালের নির্বাচনে এই প্রতীক লইয়াই আওয়ামী লীগ অমন বিপুল জয়লাভ করিয়াছিল। তার আগে শেরে-বাংলার নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট ঐ নৌকা প্রতীক দিয়াই ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগকে ধরাশায়ী করিয়াছিল।

কাজেই নির্বাচনে সরকারী দল আওয়ামী লীগের বিরোধী দলের প্রতি উদার হওয়া উচিৎ ছিল। উদার হইতে তাঁরা রাযীও ছিলেন। রেডিও-টেলিভিশনে বিরোধী দল সমূহের নেতাদের বক্তৃতার ব্যবস্থা করিতেও তাঁদের আপত্তি ছিল না।

কিন্তু পর-পর কতকগুলি দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার জন্য আওয়ামী নেতারা কঠিন হইয়া পড়িলেন।

সরকারী দল হিসাবে দেশের সমস্ত দুর্দশা-দূর্ভাগ্যের জন্য সরকার দায়ী, এই মনোভাব হইতে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা হারাইবার যথেষ্ট কারণ ত ছিলই, তার উপর বছরের শুরুতেই ১৯৭৩ সালের ১লা জানুয়ারিতেই ভিয়েতনাম উপলক্ষে ছাত্রদের মিছিলের উপর গুলি চালনার দরুন দুইজন ছাত্র নিহত ও অনেক আহত হয়। পরদিন দেশব্যাপী হরতাল হয়। ফলে দৃষ্টতঃই আওয়ামী লীগ ছাত্রদের মধ্যে জনপ্রিয়তা হারায়৷ মোফর ন্যাপ ও ছাত্র-ইউনিয়নই সরকার-বিরোধী এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতেছিল। এই কারণেই ছাত্রলীগের লোকেরা ন্যাপ ও ছাত্র ইউনিয়নের অফিস পোড়াইয়া দিয়াছে বলিয়া খবর বাহির হয়। তাতেও আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা ক্ষুণ্ণ হয়। এই অজনপ্রিয়তা প্রসারিত হয় মফস্বলে সরকারের বর্ডার প্যাক্ট ও পাটনীতি উপলক্ষ করিয়া।

. হিসাবে ভুল

এই দৃশ্যমান অজনপ্রিয়তার অতিরঞ্জিত ওভার এস্টিমেট করিলেন উভয় পক্ষই। আওয়ামী লীগাররা ঘাবড়াইলেন। আর বিরোধী পক্ষ উল্লসিত হইলেন। পার্লামেন্টারি রাজনীতির খাতিরে আওয়ামী নেতৃত্ব নির্বাচনে কিছুটা উদার হওয়ার যে ইচ্ছা করিতেছিলেন, পরিস্থিতির এই অতিরঞ্জিত ভুল অর্থের ফলে সে মতের পরিবর্তন হইল। অপর দিকে বিরোধী দল সমূহের মধ্যে একটা যুক্তফ্রন্ট গড়িয়া তুলিবার যে চেষ্টা হইতেছিল তা ভণ্ডুল হইয়া গেল। ভাবখানা এই যে আওয়ামী লীগ যেখানে এমনিতেই হারিয়া যাইতেছে, সেখানে বিরোধী পক্ষের ঐক্য ফ্রন্ট করিবার দরকারটা কি? বিদ্ৰোধী দল সমূহের আস্থা ও জয়ের আশা এমন উজ্জ্বল হইয়া উঠিয়াছিল যে, একুশে জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান যখন বিশেষ করিয়া মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিবার জন্য সুহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক জনসভা করিতেছিলেন, ঠিক সেই মুহূর্তে সর্বদলীয় বিরোধী নেতা মওলানা ভাসানী সাহেব পল্টন ময়দানে এক বিশাল জনসভায় সরকার-বিরোধী বক্তৃতা করিতেছিলেন। একই সময়ে এই দুই সভায় দুই জনপ্রিয় নেতা বক্তৃতা করায় কোন সভায় বেশী লোক সমাগম হইয়াছিল, তা লইয়া তক পর্যন্ত বাধিয়াছিল।

এমন অবস্থায় একদিকে আওয়ামী লীগ নির্বাচনী প্রচারে আরও বেশী জোর দিলেন। অপর দিকে বিরোধী দলসমূহের কোন দলের নেতা প্রধানমন্ত্রী হইবেন, তাই লইয়া তাঁরা বিতর্কে অবতীর্ণ হইলেন। স্মরণযোগ্য যে, এই সময়ে কথা উঠিয়াছিল স্বয়ং মওলানা ভাসানীও নির্বাচনে দাঁড়াইবেন। বিরোধী দল নির্বাচনে জয়লাভ করিলে জনাব আতাউর রহমান খাই প্রধানমন্ত্রী হইবেন, অধিকাংশ দলের মতে এটা ঠিক হইয়াই ছিল। আওয়ামী লীগের কল্পিত আপপুলারিটি যখন বিরোধী দলসমূহের কাছে সুস্পষ্ট হইয়া উঠিল, তখন মওলানা সাহেবের দলের এক নেতা প্রকাশ্যভাবেই বলিয়া ফেলিলেন যে মওলানা সাহেবের জনপ্রিয়তার সুযোগ লইয়া যেখানে বিরোধী দল নির্বাচনে জিতিতেছে, সেখানে মওলানা সাহেব প্রধানমন্ত্রী না হইয়া অপরে প্রধানন্ত্রী হইবেন কেন?

আমি কিন্তু ঘরে বসিয়াই স্পষ্ট বুঝিতে পারিতেছিলাম, আওয়ামী লীগের ডর ও বিরোধী দলের আশা দুইটাই অমূলক। আওয়ামী লীগ নির্বাচনে নির মেজরিটিই পাইবে। আওয়ামী-বন্ধুদের কাছে মুখে-মুখে যেমন একথা বলিতেছিলাম, কাগযেও তেমনি লিখিতেছিলাম : আওয়ামী লীগ শুধু আসন্ন নির্বাচনেই নয় আগামী পঁচিশ বছরের নির্বাচনে জিতিবে এবং দেশ শাসন করিবে। আমি এ বিষয়ে আওয়ামী লীগ শাসনকে ভারতের কংগ্রেসের পঁচিশ বছরের আমলের সাথে তুলনা করিয়াছিলাম। লিখিয়াছিলাম, নেহরু-নেতৃত্বের কংগ্রেসের মত মুজিব-নেতৃত্বের আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রের পথে দৃঢ় থাকিলেই এটা অতি সহজ হইবে।

এই বিশ্বাসে আমি আওয়ামী-নেতৃত্বকে পরামর্শ দিয়াছিলাম, বিরোধী পক্ষের অন্ততঃ জন-পঞ্চাশেক নেতৃস্থানীয় প্রার্থীকে নির্বাচনে জয়লাভ করিতে দেওয়া উচিৎ। তাতে পার্লামেন্টে একটি সুবিবেচক গণতন্ত্রমনা গঠনমুখী অপযিশন দল গড়িয়া উঠিবে।

আমার পরামর্শে কেউ কান দিলেন না। বিরোধী দলসমূহের ঐ নিশ্চিত বিজয় সম্ভাবনার উল্লাসের মধ্যে আওয়ামী লীগের পক্ষে অমন উদার হওয়াটা, বোধ হয়, সম্ভবও ছিল না। রেডিও-টেলিভিশনে অপযিশন নেতাদের বক্তৃতা দূরের কথা, যান বাহনের অভাবে তাঁরা ঠিকমত প্রচার চালাইতেও পারিলেন না। পক্ষান্তরে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব হেলিকপ্টারে দেশময় ঘূর্ণীঝড় টুওর করিতে লাগিলেন। মন্ত্রীরাও সরকারী যানবাহনের সুবিধা নিলেন।

অপযিশনের স্বপ্ন টুটিল। মওলানা সাহেব অসুস্থ হইয়া হাসপাতালে ভর্তি হইলেন। প্রধানমন্ত্রী তাঁর সাথে হাসপাতালে দেখা করিয়া তাঁর চিকিৎসার সুবন্দোবস্ত করিয়া সর্বশেষ তুরুফ মারিলেন।

নির্বাচনে অপযিশনেরভরাডুবি হইল।

৪. নির্বাচনের ফল ও কুফল

৭ মার্চ নির্বাচন হইল। ৩০০ সীটের মধ্যে ২৯২টি আওয়ামী লীগ ও মাত্র ৭টি অপরপক্ষ পাইল। একটি সীটে একজন প্রার্থী মোটর দুর্ঘটনায় নিহত হওয়ায় তার নির্বাচন পরে হইল। সেটিও আওয়ামী লীগই পাইল। বিরোধী পরে ৭টির মধ্যে জাসদের ৩, জাতীয় লীগের ১ ও নির্দলীয় ৩ জন নির্বাচিত হইলেন। দুইটি ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টি কোন সীট পাইল না। জাতীয় লীগের প্রেসিডেন্ট জনাব আতাউর রহমান খাঁ নির্বাচিত হইয়া তাঁর পার্টির নামটা জীবন্ত রাখিলেন। পরে নির্বাচিত মেম্বারদের ভোটে যে ১৫টি মহিলা আসনের নির্বাচন হইল তার সব কয়টি অবশ্যই আওয়ামী লীগই পাইল। এইভাবে পার্লামেন্টের ৩১৫ জন মেম্বরের মধ্যে ৩০৮ জনই হইলেন আওয়ামী লীগের। মাত্র ৭ জন হইলেন অপযিশন।

এতে আওয়ামী-নেতৃত্বের আরও বেশি সাবধান হওয়া উচিত ছিল। সে কর্তব্য অবশ্য শুরু হইয়াছিল আগেই। নির্বাচন চলাকালেই। গোড়ার দিকে পরিস্থিতি সম্পর্কে উভয়পক্ষের ভ্রান্ত ধারণা থাকার দরুন আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব উদার হইতে পারেন নাই। কিন্তু নমিনেশন পেপার বাছাইর দিনেই আওয়ামী লীগের বিপুল জয় সুস্পষ্ট হইয়া উঠিয়াছিল। শেখ মুজিব দুটি আসন হইতেই বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হইলেন। আওয়ামী লীগের আরও ৭ জন প্রার্থী বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হইলেন। এই সময়ে আওয়ামী নেতৃত্বের উদার হওয়ার কোনও অসুবিধা বা রিস্ক ছিল না। বিরোধী দলসমূহের প্রার্থীদের মধ্যে জনাব আতাউর রহমান খাঁ, প্রফেসর মোত্মাফফর আহমদ, ডাঃ আলিমুর রাযী, জনাব নূরুর রহমান, রাজশাহীর মিঃ মুজিবুর রহমান, জনাব অলি আহাদ, মিঃ সলিমুল হক খান মিকী, মিঃ আমিনুল ইসলাম চৌধুরী, মিঃ যিলুর রহিম, হাজী মোহাম্মদ দানেশ, মিঃ বলুস-সাত্তার প্রভৃতি জন-পঁচিশেক অভিজ্ঞ সুবক্তা পার্লামেন্টারিয়ানকে জয়ী হইতে দেওয়া আওয়ামী লীগের ভালর জন্যই উচিৎ ছিল।

তিনশ’ পনর সদস্যের গার্লমেন্টে জনা-পঁচিশেক অপযিশন মেম্বর থাকিলে সরকারী দলের কোনই অসুবিধা হইত না। বরঞ্চ ঐ সব অভিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ান অপযিশনে থাকিলে পার্লামেন্টের সৌষ্ঠব ও সজীবতা বৃদ্ধি পাইত। তাঁদের বক্তৃতা বাগ্মিতায় পার্লামেন্ট প্রাণবন্ত, দর্শনীয় ও উপভোগ্য হইত। সরকারী দলও তাতে উপকৃত হইতেন। তাঁদের গঠনমূলক সমালোচনার জবাবে বক্তৃতা দিতে গিয়া সরকারী দলের মেম্বাররা নিজেরা ভাল-ভাল দক্ষ পার্লামেন্টারিয়ান হইয়া উঠিতেন। বাংলাদেশের পার্লামেন্ট পার্লামেন্টারি গণতন্ত্রের একটা ট্রেনিং কলেজ হইয়া উঠিত। আর এ সব শুভ পরিণামের সমস্ত প্রশংসা পাইতেন শেখ মুজিব।

৫. আওয়ামী-নেতৃত্বের ভ্রান্ত-নীতি

কিন্তু দেশের দুর্ভাগ্য এই যে শেখ মুজিব এই উদারতার পথে না গিয়া উল্টা পথ ধরিলেন। এই সব প্রবীন ও দক্ষ পার্লামেন্টারিয়ানকে পার্লামেন্টে ঢুকিতে না দিবার জন্য তিনি সর্বশক্তি নিয়োগ করিলেন। জনাব আতাউর রহমানকে হারাইবার জন্য আওয়ামী-নেতৃত্ব যে পন্থা অবলম্বন করিলেন, সেটাকে কিছুতেই নির্বাচন প্রচারণার সুস্থ ও স্বাভাবিক নীতি বলা যায় না। বরঞ্চ আমার বিবেচনায় সেটা ছিল খোদ আওয়ামী লীগের জন্যই আত্মঘাতী। তাঁর মত ধীরস্থির অভিজ্ঞ গঠনাত্মক চিন্তাবিদ পার্লামেন্টের অপযিশন বেঞ্চের শুধু শোভা বর্ধনই করেন না, সরকারকে গঠনমূলক উপদেশ দিয়া এবং গোটা অপযিশনকে পার্লামেন্টারি রীতি-কানুনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখিয়া পার্লামেন্টারি পদ্ধতিকে সুপ্রতিষ্ঠিত করিয়া থাকেন। এমন একজন ব্যক্তিকে পার্লামেন্টে ঢুকিতে না দিবার সর্বাত্মক চেষ্টা আওয়ামী নেতৃত্ব কেন করিলেন, তা আমি আজও বুঝিতে পারি নাই। কারণ এমন চেষ্টা যে মনোতাবের প্রকাশ, সে মনোভাব পার্লামেন্টারি পদ্ধতির সাফল্যের অনুকূল নয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের মত অভিজ্ঞ ও প্রবীণ পার্লামেন্টারি নেতা কিছুতেই এমন আত্মঘাতী নীতির সমর্থক হইতে পারেন না। যদি খোদা-না-খাস্তা শেখ মুজিব কোনও দিন তেমন মনোভাবে প্রভাবিত হন, তবে সেটা হইবে দেশের জন্য চরম অশুভ মুহূর্ত।

কিন্তু আমি দেখিয়া খুবই আতংকিত ও চিন্তাযুক্ত হইলাম যে নির্বাচন চলাকালে আওয়ামী নেতৃত্ব অপযিশনের প্রতি যে মনোভাব অবলম্বন করিয়াছিলেন, সেটা সাময়িক অবিবেচনাপ্রসূত ভুল ছিল না। তাঁরা যেন নীতি হিসাবেই এই পন্থা গ্রহণ করিয়াছিলেন। নির্বাচনের ফলে অপযিশন একরূপ শূন্যের কোঠায় পৌঁছিয়াছিল। কয়েকটি দলের এবং নির্দলীয় মেম্বর মিলিয়া শেষ পর্যন্ত তাঁরা হইলেন মাত্র ৮ জন। অপযিশন ছাড়া পার্লামেন্ট সম্পূর্ণ হয় না। কাজেই এই ছিন্ন-ভিন্ন অপযিশনকে লালন করিয়া আমাদের আইন সভাকে আনুষ্ঠানিকভাবে পার্লামেন্টের রূপ ও প্রাণ দিবার চেষ্টা শাসক দলেরই অবশ্য কর্তব্য ছিল। শাসক দল সে কর্তব্য পালন ত করিলেনই না, ভিন্ন-ভিন্ন দলের মেম্বররা নিজেরাই যখন একত্রিত হইয়া জনাব আতাউর রহমানকে লিডার নির্বাচন করিলেন, তখনও সরকারী দল তাঁকে লিডার-অব-দি অপযিশন স্বীকার করিলেন না। নির্বাচনের পরে ন মাসের বেশি সময় অতিবাহিত হইয়াছে। এর মধ্যে পার্লামেন্টের দুই-দুইটা অধিবেশনও হইয়া গিয়াছে। তবু আমাদের পার্লামেন্টে কোন লিডার-অব-দি-অপযিশন নাই। তার মানে পার্লামেন্টারি পদ্ধতির সুপ্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক রীতি-অনুসারে আমাদের আইন-পরিষদ আজও পার্লামেন্ট হয় নাই। যা হইয়াছে, সেটা আসলে একদলীয় আইনসভা। এটা নিশ্চিতরূপে অশুভ। প্রশ্ন জাগে আমরা কি একদলীয় রাষ্ট্রে পরিণত হইতেছি? কিন্তু তা বিশ্বাস করিতে মন চায় না। কারণ এটা ও আওয়ামী লীগের বিঘোধিত মূলনীতি-বিরোধীই নয়, তার নির্বাচনী প্রতীক নৌকারও তাৎপর্য-বিরোধী। নৌকা চালাইতে যেমন দুই কাতারের দাড়ী লাগে, গণতন্ত্রী রাষ্ট্র পরিচালনায়ও তাই লাগে। যদি কোনও দিন নৌকার সব দাঁড়ি এক পাশে দাঁড় টানিতে শুরু করে, তবে সেদিন নৌকা আর যানবাহন থাকিবে না। হইবে সেটা মিউযিয়মের দর্শনীয় বস্তু।

৬. ভোটারদের কর্তব্য ও দায়িত্ব

এই অবস্থার জন্য আওয়ামী লীগ-নেতৃত্ব যতটা দায়ী, আমাদের ভোটারদের, জনগণের, দায়িত্ব তার চেয়ে কম নয়। বাংলাদেশের ভোটাররা রাজনীতিক জ্ঞানে সচেতন বলিয়া একটা কথা আছে। পার্লামেন্টের নির্বাচনে তাঁদের আরও সচেতন ও কাণ্ডজ্ঞানহীন ভোট দেওয়া উচিৎ ছিল। গণ-ঐক্যের ভাবাবেগে এই নির্বাচনে সকলের একই পার্টিকে ভোট দেওয়া যে পরিণামে ভোটারদের জন্যই ক্ষতিকর, এটা তাঁদের বোঝা উচিৎছিল। একদলীয় শাসনই পরিণামে ব্যক্তি-স্বৈরতন্ত্রে রূপান্তরিত হয়। তেমন শাসনে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয় এটা ধরিয়া নিলেও জাতির মানস ও মননশীলতার যে ক্ষতি হয় তা অপূরণীয়। ভোটারদেরে এ কথা বুঝাইয়া দিবার লোকের অভাব ছিল না। বিরোধী দলের প্রার্থী ও নেতারা ত বুঝাইয়াছিলেনই আমার মত নিরপেক্ষ রাজনৈতিক হরিঠাকুরও এটা বুঝাইবার চেষ্টা করিয়াছিলাম। আমি ইত্তেফাকে লিখিয়াছিলামঃ ‘৭০ সালের নৌকা ও এবারকার নৌকার মৌলিক পার্থক্য আছে। ৭০ সালেরটা ছিল চড়িবার নৌকা। এবারকারটা চালাইবার নৌকা। নৌকা চালাইতে ডাইনে-বাঁয়ে দুই সারি দাঁড়ি লাগে। নৌকার হাইল ধরিবেন শেখ মুজিব নিজেই ঠিকই, কিন্তু দাঁড়ী হইবেন দুই কাতারের। সব দাঁড়ী একদিক হইতে দাঁড় টানিলে নৌকা সামনে চলিবার বদলে ঘুরপাক খাইয়া ডুবিতে পারে।’ এই পার্টিকে সব ভোট দেওয়ার বিরুদ্ধে এরচেয়ে বড় হুশিয়ারি আর কি হইতে পারে? হুশিয়ারি ছাড়া ভোটারদের সমর্থনে তাঁদের রাজনৈতিক চেতনার প্রমাণস্বরূপ, অনেক কথা বলিয়াছিলাম। এবারকার নির্বাচনের প্রাক্কালে অনেক রাষ্ট্র-দার্শনিক ভবিষ্যত্বাণী করিয়াছিলেন : বাংলাদেশের ভোটাররা বরাবর এক বাক্সে ভোট দেন; আর তাঁরা বরাবর সরকারের বিরুদ্ধে ভোট দেন। আমি ঐ সব রাজনৈতিক গণকদের কথার প্রতিবাদ করিয়াছিলাম। তাঁরা ‘৪৬ সাল, ‘৫৪ সাল ও ‘৭০ সালের নির্বাচনের নযির দিয়া তাঁদের কথার সত্যতা প্রমাণের চেষ্টা করিয়াছিলেন। আমি তাঁদের কথার প্রতিবাদে বলিয়াছিলাম, ঐ তিন সালের কোনওটাই সরকার গঠনের মামুলি নির্বাচন ছিল না। সেগুলি ছিল মূলনীতি নির্ধারণের ভোট। ‘৪৬ সালেরটা পাকিস্তান বনাম অখণ্ড ভারতের ভোট, ৫৪ সালের একুশ দফা ও ৭০ সালের ছয় দফা উভয়টাই ছিল আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন বনাম স্ট্রংসেন্টারের ভোট। ঐ সব নির্বাচনে এক বাক্সে ভোট না দিয়া উপায় ছিল না। কারণ উভয়টাই ছিল জনগণের দাবি। কিন্তু ‘৭৩ সালের নির্বাচনে ঐ ধরনের কোন মূলনীতি নির্ধারণের প্রশ্ন ছিল না। ওটা ছিল নিতান্তই সরকার গঠন ও রাষ্ট্র পরিচালনের প্রশ্ন। অবশ্য কোন-কোনও আওয়ামী নেতা এই নির্বাচনকে সদ্য রচিত সংবিধানের র‍্যাটিফিকেশনের ভোট আখ্যায়িত করিয়াছিলেন। তাতেও ভোটারদের কর্তব্যের কোনও ব্যত্যুবা ব্যতিক্রম ঘটিবার কথা ছিল না। আওয়ামী লীগ নিরংকুশ মেজরিটি পাইলেই তাঁরা সরকারও গঠন করিতে পারিতেন; সংবিধানটাও কার্যতঃ গ্যাটিফাইড় হইয়া যাইত। এক বাক্সে সব ভোট পড়িবার, প্রকারান্তরে অপযিশন ক্রাশ করিয়া পার্লামেন্টকে ঠুটো জগন্নাথ’ করিবার, কোনও দরকার ছিল না। বাংলাদেশের ভোটাররা এবার তাই করিয়াছেন। নির্বাচিত সরকাররা যে সব ভুল করেন, গণতন্ত্রের বিচারে সে সব ভুলের জন্যও ভোটাররাই দায়ী। আর ভোটাররা নিজেরা যে ভুল করেন, তার জন্য দায়িত্ব বহন ও ফলভোগ তাঁদের করিতেই হইবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *