৩২.০৬ মুজিবহীন বাংলাদেশ

মুজিবহীন বাংলাদেশ
উপাধ্যায় ছয়

১. অতিদ্রুত স্বাধীনতা

এটা স্বীকার করিতেই হইবে, ভারতের সহায়তায় আমরা বড় তাড়াতাড়ি স্বাধীনতা পাইয়া ফেলিয়াছিলাম। বস্তুতঃ নয় মাস সংগ্রামে স্বাধীনতা আর কোনও জাতি পায় নাই। ভারত সক্রিয় সহায়তা না করিলে আমরাও পাইতাম না পাকিস্তান সরকার ভুল করিলে ভারত সরকার তেমন সাহায্য করিবেনই, এটাও একরূপ জানা কথাই ছিল। পাকিস্তানের সামরিক শাসকরা এবারই প্রথম এমন ভুল করিয়াছিলেন। ফলে আমাদের স্বাধীনতা যে কল্পনাতীত অল্প সময়ে আসিতেছে, এটা ৩রা ডিসেম্বর তারিখে আমার মত অ-বুদ্ধি লোকের কাছেও স্পষ্ট হইয়া উঠিয়াছিল।

স্বাধীনতার পদধ্বনিতে লোকের আনন্দিত হইবার কথা। কিন্তু আমি উল্টা ঘাবড়াইতে ছিলাম। মুজিব-বিহীন আওয়ামী নেতৃত্ব কি ভাবে দেশ চালাইবেন, তা আমি ভাবিয়া পাইতাম না। তাই স্বাধীনতা যতই আগাইয়া আসিতেছিল, আমার ভাবনা ততই বাড়িতেছিল। মুজিবের মুক্তি ও স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের জন্য আমি ততই সর্বান্তঃকরণে প্রার্থনা করিতেছিলাম। ততদিনে ইয়াহিয়া ঘোষণা করিয়াছেন যে মুজিব বাঁচিয়া আছেন ও ভাল আছেন।

কিন্তু আমার মোনাজাত কবুল হইল না। যদিও আমার মোনাজাত ছিল স্বাধীনতা ও মুজিব একসংগে আসুক, কিন্তু মুজিবকে পিছে ফেলিয়া স্বাধীনতা আগেই আসিয়া পড়িল। মুজিবের অনুপস্থিতিতে যে সব অশুভ ঘটনা ঘটিতে পারে বলিয়া আমার আন্দাষ ছিল, আসলে তার চেয়ে অনেক বেশী অশুভ ঘটনা ঘটিতে লাগিল। এ সব ঘটিতে লাগিল চিন্তায় ও কাজে উভয়তঃই। এটা শুরু হইল প্রবাসী সরকার দেশে ফিরিবার আগেহইতেই।

প্রথম ঘটনাটা ঘটিল স্বাধীনতার প্রায় শুরুতেই-১৮ই ডিসেম্বরে। ঐ দিন বাংলাদেশের স্বাধীনতা উদযাপনের জন্য দিল্লির রামলীলা ময়দানে এক বিরাট জন সভা হইল। সে সভায় ভারতের দেশরক্ষা মন্ত্রী শ্রী জগজীবনরাম বক্তৃতায় বলিলেন : এতদিন পাকিস্তানের গর্বের বিষয় ছিল, সে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র। গত পরশু হইতে সে গৌরব বর্তাইয়াছে বাংলাদেশের উপর। বাংলাদেশই এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র। আকাশবাণীর খবর অনুসারে মিঃ রামের এই উক্তি সেই বিরাট জনসভায় বিপুলভাবে অভিনন্দিত হইয়াছিল। কিন্তু বাংলাদেশের সদ্য-দীক্ষিত একজন অফিসার মিঃ রামের ঐ উক্তির তীব্র প্রতিবাদ করিয়া বলিলেন : মিঃ রামের স্মরণ রাখা উচিৎ ছিল বাংলাদেশ একটি সেকিউলার রাষ্ট্র, মুসলিম রাষ্ট্র নয়। আমি বুঝিলাম এটা যদি বাংলাদেশ সরকারের সরকারী অভিমত হয়, তবে বিপদের কথা। বাংলাদেশের পরিচালন-ভার এমন সব ‘অতি-প্রগতিবাদী’ লোকের হাতে পড়িতেছে যাঁরা ইসলামী রাষ্ট্র ও মুসলিম রাষ্ট্রের পার্থক্য বুঝে না বা বুঝিতে চাহেন না।

. অতি প্রগতিবাদী নেতৃত্ব

প্রবাসী সরকার ঢাকায় ফিরার সংগে সংগে প্রমাণিত হইল যে এটা সরকারী অভিমত। দেশে ফিরিয়াই তাঁরা যা দেখাইলেন, তাতে রেডিও-টেলিভিশনে কোরান তেলাওয়াত, খোদা হাফেয, সালামালেকুম বন্ধ হইয়া গেল। তার বদলে ‘সুপ্রভাত, ‘শুভ সন্ধ্যা’, ‘শুভরাত্রি’ ইত্যাদি সমোধন প্রথা চালু হইল।

মুসলমানদের মধ্যে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হইল। গুজব রটিতে লাগিল, আযান নিষিদ্ধ হইয়া যাইবে। কেউ বলিলেন : অমুক জায়গায় জনসভায় বক্তৃতা চলিবার সময় নিকটস্থ মসজিদ হইতে আযান দিতে গিয়া মুয়াযিন সাহেব বাধাপ্রাপ্ত হইয়াছেন। যথাসম্ভব নেতৃস্থানীয় লোকজনকে ব্যাপারটা জানাইলাম। তাঁরা আযানের ব্যাপারটা ভিত্তিহীন জানাইলেন। কিন্তু রেডিও টেলিভিশনের ব্যাপারটায় তর্ক জুড়িলেন। আমাদের আশংকা দৃঢ় হইল। দুশ্চিন্তা বাড়িল।

এই সংগে যোগ দিল পাকিস্তান ও চীনের উদ্যোগে উথাপিত জাতিসংঘে বাংলাদেশে ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর অবস্থান সম্বন্ধে প্রতিবাদ ও তদুত্তরে ভারত সরকারের তরফের উক্তিসমূহের বিভ্রান্তিকর পরিণাম। ভারত সরকারের প্রতিনিধি জাতিসংঘে বলিলেন : প্রয়োজনের এক দিন বেশীও ভারতীয় সৈন্য বাংলাদেশে থাকবে না। এই প্রয়োজনের মেয়াদটার আভাস পাওয়া গেল দিল্লি হইতে ভারত সরকারের মুখপাত্রের কথায়। তাঁরা বলিলেন : শরণার্থীদের নিজ নিজ বাড়ি-ঘরে পুনর্বাসন করিতে যেটুকু সময় লাগিবে, ততদিনই ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর বাংলাদেশে মোতায়েন থাকা দরকার হইবে।

এই সময়ে ভারতের প্রধান সেনাপতি জেনারেল মানিকশাহবাংলাদেশে আসিলেন। তিনি অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নয়রুল ইসলামের মেহমান হইলেন। দুইজন একত্রে টেলিভিশন ক্যামেরাও ও সংবাদপত্র রিপোর্টারদের সামনে দাঁড়াইলেন। আমাদের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করিলেনঃ ‘ভারতীয় সৈন্যবাহিনী বাংলাদেশের মাটিতে আছে আমার অনুরোধে, আমাদের সহায়তার জন্য। জাতিসংঘে ভারতীয় প্রতিনিধি আমাদের রাষ্ট্রপতির ঘোষণার পুনরুক্তি করিলেন।

. অহেতুক ভুল বুঝাবুঝি

এই সব কারণে বাংলাদেশের জনগণের মনে ভারত সরকারের অভিপ্রায় সম্বন্ধে সন্দেহ সৃষ্টি হইতে লাগিল। এই ধরনের সন্দেহ সৃষ্টির সুযোগ দিলেন বাংলাদেশ সরকার ও নেতৃবৃন্দ নিজেরাই। স্বাধীনতা লাভের পরেও দশ-দশটা দিন তাঁরা ভারতে অবস্থান করিলেন। পাকিস্তান ও তার বন্ধু রাষ্ট্রসমূহের জন্য এটা ছিল মস্তবড় সুযোগ ও অকাট্য প্রমাণ। তাঁরা বলিতে লাগিলেন : ভারত যে পূর্ব-পাকিস্তান দখল করিয়াছে, তা এবার প্রমাণিত হইয়া গেল। নইলে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার ঢাকায় যান না কেন? আসলে ভারত সরকারই যাইতে দিতেছেন না।

এ সব সন্দেহ ও অভিযোগ খন্ডনের কোনও প্রমাণ আমার হাতে নাই। পাকিস্তানী-বাহিনীর আত্মসমর্পণের সংগে-সংগেই যে কতিপয় উল্লেখযোগ্য নেতা ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করিয়া আমাদের সাথে দেখা করিয়াছিলেন, তাঁরা মন্ত্রী-স্তরের লোক ছিলেন না। তবু তাঁরা সবই প্রভাবশালী নেতা। খবরাখবরও তাঁরা রাখিতেন বলিয়াই আমার বিশ্বাস। তাঁদের সহিত বিস্তারিত খুটিনাটি আলোচনা করিয়া আমার এই ধারণা হইয়া ছিল যে, ভারত সরকারের ইচ্ছায় নয়, বাংলাদেশ সরকারের নিজেদের ইচ্ছামতই তাঁদের ঢাকায় আসায় বিলম্ব ঘটিতেছে।

বাংলাদেশ সরকারের এমন ইচ্ছাটাও আমার বিবেচনায় অহেতুক বা অযৌক্তিক ছিল না। সহজ কথায়, এ বিলম্বের সংগত কারণ ছিল। ঘটনার দুই বছর পরে এখন অবশ্য তৎকালীন মন্ত্রীরা বা তাঁদের সহকর্মীরা এ ব্যাপারে প্রকৃত ব্যাপার নাও প্রকাশ করিতে পারেন। কথাটা যুক্তি সংগত বা উচিৎ বিবেচিত নাও হইতে পারে। আবার বিভিন্ন ব্যক্তি বিভিন্ন উক্তিও করিতে পারেন। এক রকমের কথা বলার একমাত্র উপায় এ বিষয়ে সরকারী বিবরণ দেওয়া; সে কাজটা আজও হয় নাই। হইবে কি না, হইলে কবে হইবে; তারও কোন নিশ্চয়তা নাই। শোনা যায়, সরকারের প্রচার দফতর হইতে স্বাধীনতা-সংগ্রামের ইতিহাস রচনার চিন্তা ভাবনা হইতেছে। তাতে অবশ্যই বেশ সময় লাগিবে। কয়েক বছর লাগিয়া যাইতে পারে। ততদিনে অবস্থার পরিবর্তনও হইতে পারে। সে পরিবর্তিত পরিবেশে আমাদের সরকারের মনোভাবেরও পরিবর্তন হওয়াটা বিচিত্র নয়। তা ছাড়া, অনেকদিন পরে ভারতের কাছে আমাদের কৃতজ্ঞতা-বোধটাও কিছুটা পুরাতন হইয়া যাইবে। তেমন অবস্থায় আমাদের সরকারের ঢাকা ফিরার বিলটার কারণ সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী দুই রকমে বলা হইতে পারে। ভারতের সাথে আমাদের বন্ধুত্ব বর্তমানের মত গাঢ় থাকিলে এক ধরনের কৈফিয়ত দেওয়া হইবে। আর সে বন্ধুত্বে কিছুটা ফাটল ধরিলে অন্যরূপ কৈফিয়ত দেওয়া হইবে। ধরুন, বন্ধুত্বটা ঘাঢ় থাকিবে। সে অবস্থায় সরকারী বিবরণে বলা হইতে পারে : ভারত সরকারের মেহমানদারির পীড়াপীড়িতেই আমাদের বাড়ি ফিরিতে দেরি হইয়াছে। এটা বিশ্বাসযোগ্য কথাও। হিন্দু ও মুসলমান আমরা উভয় সম্প্রদায়ই অতিশয় অতিথিপরায়ণ। গিরস্থরা মেহমানকে সহজে ছাড়িতে চান না। আমাদের উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যেই বাপ-দাদার আমল হইতে প্রবাদ বাক্য চালু আছে : গিরস্থরা মেহমানদের বলিয়া থাকেন : আসিয়াছেন আপনার ইচ্ছায়, যাইবেন আমার ইচ্ছায়। এই ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী ভারতের হিন্দু গৃহস্বামী যদি বাংলাদেশের মুসলমান মেহমানদেরে বলিয়া থাকেন : আসিয়াছেন আপনাদের ইচ্ছায়, যাইবেন আমাদের ইচ্ছায়, তবে ঐ একই ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী মুসলমান মেহমানরা স্বভাবতঃই তা মানিয়া চলিতে বাধ্য ছিলেন।

আর যদি কোনও কারণে বর্তমানের বন্ধুত্বের চির ধরে, তবে সে চিরের কারণে অথবা সেই বিদ্যাসাগরী ‘উপকারীর মাথায় লাঠির’ সনাতন নীতি অনুসারে আমাদের সরকার বলিতে পারেন : ‘ভারত সরকার আমাদের পায়ে বেড়ি দিয়া আটকাইয়া রাখিয়া ছিলেন।‘ উদ্দেশ্য? আমাদের সম্পদ বিশেষতঃ পাক-বাহিনীর পরিত্যক্ত যুদ্ধ-সরঞ্জাম নিজেরা একা কুক্ষিগত করিবার লোভে।

স্পষ্টতঃই এ দুইটার একটাও নির্ভেজাল সত্য হইবে না। ঘটনা পুরান হইবার আগেই তা লিপিবদ্ধ করাই সত্য রক্ষার একমাত্র উপায়। নিরপেক্ষ দর্শক হিসাবে এটা করা আমার উচিৎও। আমার পক্ষে সম্ভবও। কিন্তু অসুবিধা এই যে, আমার কোনও প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নাই। যা কিছু সবই শোনা কথা। আর সে সব শোনা কথার উপর নির্ভরশীল অনুমান। অগত্যা তাই লিখিতেছি।

৪. বিলম্বের হেতু

সদ্য-প্রত্যাগত বন্ধু-বান্ধবের সাথে আলোচনা করিয়া যা বুঝিয়াছিলাম, তাতে আমার এই বিশ্বাস জন্মিয়াছিল যে, পাক বাহিনীর আত্মসমর্পণের সাথে সাথে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার প্রধানতঃ দুইটি কারণে ঢাকা ফিরাটা বিলম্বিত করিতে চাহিতেছিলেন। একতখনও তাঁরা ঢাকায় আসা নিরাপদ মনে করিতেছিলেন না। দুই, কিছুদিন দেরি করিলে শেখ মুজিবকে নিয়াই তাঁরা ঢাকায় ফিরিতে পারিবেন। প্রথম। কারণটি বর্ণনায় কিছু বেশী কথা বলিতে হইবে। তাই সেটা পরে বলিতেছি। দ্বিতীয় কারণটিই আগে আলোচনাকরিতেছি।

মুজিবের নিরাপত্তা, তাঁর মুক্তির আশা ও সম্ভাবনার কথা যুদ্ধ চলিতে থাকা অবস্থাতেও দেশ-বিদেশের বেতারে ও খবরের কাগজে এবং শেষ পর্যন্ত জাতিসংঘেও উঠিতেছিল। বাংলাদেশে পাকিস্তান-বাহিনীর আত্মসমর্পণের পরদিনই পশ্চিম সীমান্তে ভারত একতরফাভাবে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করায় এবং পাকিস্তান সরকার খপ্‌ করিয়া তা গ্রহণ করায় মুজিবের মুক্তির সম্ভাবনা আরও উজ্জ্বল হইয়াছিল। তারপর ১৯শে ডিসেম্বর ইয়াহিয়ার বদলে ভুট্টোর প্রেসিডেন্ট হওয়ার খবরটা অন্যান্য দেশসহ ভারতেও ছড়াইয়া পড়িয়াছিল। এটাকে অনেকে মুজিবের মুক্তির পূর্ব লক্ষণ বলিয়া মনে করিলেন। কারণ ভুট্টো প্রেসিডেন্ট হইয়াই শেখ মুজিবকে জেলখানা হইতে প্রেসিডেন্ট হাউসের নিকটবর্তী এক বাড়িতে গৃহবন্দী রূপে আনাইয়াছেন, এমন খবরও বিভিন্ন বেতারে প্রচারিত হইয়াছিল। পরদিন হইতেই ভুট্টো বলিতে শুরু করিলেন, যদি দেশবাসী চায়, তবে তিনি শেখ মুজিবকে মুক্তি দিবেন। সংগে সংগে তিনি জনমত যাচাইয়ের জন্য জনসভায় ভোট নিতে লাগিলেন। প্রত্যেক সভায় বিপুল জনতা রায় দিলঃ শেখ মুজিবের মুক্তি চাই। এর সাথে যোগ হইল লাহোর করাচি ইসলামাবাদ ও পেশোয়ারের সমস্ত দৈনিক পত্রে মুজিবের মুক্তির দাবিতে সম্পাদকীয় লেখা হইতে লাগিল।

এ সব খবরই মুজিব নগরী বাংলাদেশের সরকারের কানে যাইতেছিল। মুজিবের আশু মুক্তির আশা করা, সুতরাং তাঁদের পক্ষে অবাস্তব আশা ছিল না। স্বাধীনতা লাভের আনন্দের দিনে একাএকা দেশে ফিরার থনে নেতাকে সাথে লইয়া ফিরার আশায় দু’চার দিন দেরি করা নিশ্চয়ই দোষের নয়।

এবার প্রথম কারণটার আলোচনা করা যাউক। এ কারণ ঢাকায় প্রবাসী সরকারের নিরাপত্তা-বোধের অনিশ্চয়তা। একটা অঘোষিত স্বাধীনতার সংগ্রাম যখন ইচ্ছায় অনিচ্ছায় সশস্ত্র সংগ্রামে পরিণত হয়, এবং নেতাদের অনুপস্থিতিতে যখন সে সংগ্রাম জন-যুদ্ধে রূপান্তরিত হয়, তখন সংগ্রামের নেতৃত্বের অবস্থান সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা করা খুব সহজ নয়। স্বাধীনতা-সংগ্রাম দীর্ঘস্থায়ী হইলে সে নেতৃত্ব সংগ্রাম চলিত থাকা অবস্থায় দানা বাঁধে এবং সুস্পষ্ট রূপ ধারণ করিয়া স্থির বিন্দুতে অবস্থান করে। আলজিরিয়া ও ভিয়েতনামে এটা ঘটিয়াছিল কালক্রমে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে এটা ঘটিতে পারে নাই। প্রথমতঃ নেতা শত্রুর হাতে বন্দী থাকায় এবং দ্বিতীয় মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে পূর্ব-সংগঠিত ঐক্য না থাকায় প্রাথমিক অস্পষ্টতা কাটিতে সময় লাগিতেছিল। এই অবস্থায় আন্তর্জাতিক কারণে ভারতের বিপুল শক্তিশালী দেশরক্ষা বাহিনী আমাদের মুক্তিসংগ্রামের সাহায্য করায় কল্পনাতীত দ্রুততার সংগে আমাদের স্বাধীনতা হাসিল হইয়া যায়। এ অবস্থায় ভারতীয় বাহিনীকে বাদ দিলে তৎকালে রাষ্ট্রক্ষমতা যাদের হাতে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল, তাঁরা ছিলেন বেংগল রেজিমেন্টের নেতৃত্বে পূর্ব-পাকিস্তানের ই. পি. আর.ও পুলিশ বাহিনী। রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের ঐতিহ্য পাক-বাহিনীর ও পাক ব্যুরোক্র্যাসির মধ্যে বেশ কিছুদিন ধরিয়া গড়িয়া উঠিয়াছিল। এ সব কথা মুক্তি-সংগ্রামের রাজনৈতিক নেতাদের ভূলিয়া যাওয়ার কথা নয়। ভারতীয় নেতারা এ বিষয়ে আরও বেশী সচেতন ছিলেন।

৫. মুজিব বাহিনী

কথাটা যখন উঠিলই, তখন কিছুকাল আগের কথাটাও বলিয়া রাখা ভাল। বাংলাদেশ সরকারের দেশে ফিরার বিলম্ব উপলক্ষ করিয়া যখন বিদেশে এবং জাতিসংঘ সার্কেলে নানা কুকথা উঠিতেছিল এবং সে সব কথা ভিত্তি করিয়া ঢাকা নগরীতে সন্দেহ-অবিশ্বাস দানা বাঁধিতেছিল, তখনও আমি সে সব সন্দেহে অবিশ্বাসে বিচলিত হই নাই। ভারত সরকারের সদিচ্ছায় তখনও আমার আস্থা অটল ছিল। তার ভিত্তি ছিল আমার একটা পূর্ব অভিজ্ঞতা। মাত্র ছয় মাস আগে এক ব্যাপারে আমি নিজেই ভারত সরকারের মতলব সম্পর্কে সন্দিহান হইয়া পড়িয়াছিলাম। অল্প দিন পরেই আমার সে সন্দেহ দূর হইয়াছিল। আমি উপলব্ধি করিয়াছিলাম, যে কাজটাকে আমাদের অনিষ্টকর ভাবিয়াছিলাম, সেটা ছিল আসলে আমাদের হিতকর। ব্যাপারটা এই জুলাই-আগস্টের দিকে আকাশবাণীর কলিকাতা কেন্দ্র ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র হইতে পর পর কয়েকটা সংবাদে আমি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হইলাম। সংবাদ কয়টি ছিল এইরূপঃ মুক্তিফৌজের বদলে মুক্তিবাহিনী করা হইয়াছে। কয়েকদিন পরে শুনলাম, আলাদা করিয়া মুজিব-বাহিনী গঠন করা হইয়াছে। এ সব পদক্ষেপকে আমি অশুভ ইংগিত মনে করিলাম। ধরিয়া নিলাম, মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে বিভক্তি ও দলাদলি সৃষ্টি করা হইতেছে। যদি ভারত সরকারের উদ্যোগে এই পদক্ষেপ নেওয়া হইয়া থাকে, তবে নিশ্চয়ই তাঁদের মতলব ভাল হইতে পারে না।

মুক্তিযোদ্ধাদের কেউ কেউ মাঝে মাঝে আমার সাথে দেখা করিতেন। প্রথম দিকে আমি তাঁদেরে সন্দেহ করিতাম। বন্ধুবর নূরুর রহমানের মধ্যস্ততায় আমার সন্দেহ দূর হয়। তখন তাঁদের সাথে আলাপ করিতাম। সশস্ত্র সংগ্রাম বা গেরিলা যুদ্ধের আমি কিছুই জানিতাম না। কাজেই আমাদের আলোচনা মোটামুটি থিওরিটিক্যাল ও প্রপাগান্ডা বিষয়-বস্তুর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকিত।

এঁদেরই দুই-একজনের সংগে মুজিব-বাহিনী গঠনের কথাটা পাড়িলাম। তাঁদের

• মধ্যে একজন নিজেই মুজিব-বাহিনীর পোক বলিয়া দাবি করায় আমার আলোচনার সুবিধা হইল। তাঁদের রিক্রুটমেন্ট, ট্রেনিং, অধ্যয়ন ইত্যাদি খুঁটিনাটি বিষয় তিনি আমাকে জানাইলেন। কয়েকদিনের মধ্যেই অপর যে একজন তাঁর বর্ণনা সমর্থন করিলেন তিনি ছিলেন একজন এম, এস, সি, এবং এক কলেজের লেকচারার। উভয়ের কথায় মিল হওয়ায় আমি নিঃসন্দেহ হইলাম। তাঁদের কথা হইতে আমি এই বুঝিলাম যে, নির্বাচিত প্রতিনিধি আওয়ামী লীগের মাধ্যমে পার্লামেন্টারি পদ্ধতি বাঁচাইয়া রাখিবার মহৎ উদ্দেশ্যেই ভারতীয় নেতৃত্ব মুজিব-বাহিনী গঠন করার প্রয়োজন বোধ করিয়াছিলেন। সশস্ত্র সংগ্রামে দেশের স্বাধীনতা আসিলে দেশের রাষ্ট্র ক্ষমতা সশস্ত্র বাহিনীর হাতে যাইতে বাধ্য, ভারতীয় নেতারা তা বুঝিতেন। সশস্ত্র লড়াই করিয়া এত-এত প্রাণ বিসর্জন দিয়া স্বাধীনতা লাভের পর রাষ্ট্রক্ষমতা আর্মড-চেয়ার’ পলিটিশিয়ানদের হাতে তুলিয়া দিবেন, পাকিস্তানী আইউবী ঐতিহ্যবাহী বেংগল রেজিমেন্ট বাহিনীর কাছে এমন আশা করা একরূপ দুরাশা। তার উপর আট-দশ হাজার ট্রেনিংপ্রাপ্ত সৈন্যের সংগে আরও আশি-নব্বই হাজার মুক্তি ফৌজ যোগ দিয়াছেন। এদের অধিকাংশই ছাত্র। ছাত্রদের মেজরিটি আবার ছাত্র ইউনিয়নের লোক। ছাত্রলীগাররা সেখানে মাইনরিটি। রাজনীতিতে শুধু ছাত্রলীগাররাই আওয়ামী লীগের সমর্থক। ছাত্র ইউনিয়নীরা প্রায় সবাই ন্যাপ। ন্যাপ মানেই কমিউনিস্ট। কারণ কমিউনিস্ট পার্টি আমাদের দেশে বরাবর নিষিদ্ধ ছিল। ছাত্র ইউনিয়নীদের বিপুল মেজরিটি বিপ্লবে বিশ্বাস করেন। পার্লামেন্টারি গণতন্ত্রকে তারা বুর্জোয়া গণ বলেন। কাজেই এই বামপন্থী ছাত্রদের দ্বারা-গঠিত মুক্তিবাহিনী স্বাধীনতা লাভের পর সশস্ত্র বাহিনীর ক্ষমতা দখলই সমর্থন করিবেনা আওয়ামী লীগকে করিবেন না। এটা ভারতীয় নেতৃত্বের বাঞ্ছনীয় হইতে পারে না। গোটা পাকিস্তানে সামরিক শাসন পাক-ভারত শান্তি ও মৈত্রীর পক্ষে প্রতিবন্ধকতা করিয়াছে। স্বাধীন বাংলাদেশে সামরিক শাসন কায়েম হউক, এ সম্ভাবনাকে ঠেকাইয়া রাখা ভারত সরকার নিজেদের কর্তব্য বিবেচনা করিয়া ঠিক কাজই করিয়াছেন। শেখ মুজিবের নেতৃত্বে পরিচালিত আওয়ামী লীগ সেকিউলার গণন্ত্রী দল, এ বিশ্বাস কংগ্রেস নেতৃত্বের বরাবরই ছিল। তাই স্বাধীনতা লাভের পর বাংলাদেশ মুজিব-নেতৃত্বের আওয়ামী লীগের দ্বারা পরিচালিত হউক, এটাই ছিল ভারতীয় নেতৃত্বের কাম্য। তাই তাঁরা সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রেক্ষিতে সাবধানতা হিসাবেই রাজনৈতিক মতাদর্শে অনুপ্রাণিত ডেমোক্র্যাটিক পলিটিক্স ওরিয়েন্টেড মুজিব বাহিনী গঠন করিয়াছিলেন এবং স্বভাবে তাঁদের ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করিয়াছিলেন।

ওঁদের কথা আমার পসন্দ ইয়াছিল। তাই তাঁদের রিপোর্টে আমি বিশ্বাসও করিয়াছিলাম। তাঁরা এটাও বলিয়াছিলেন যে পলিটিক্যাল মোটিভেশন হিসাবে ‘মুজিববাদ’ কথাটারও জন্ম হইয়াছিল ওখান হইতেই।

মুজিব বাহিনীতে ত বটেই সাধারণ কমিশনড র‍্যাংকে রিক্রুটমেন্টের বেলাতেও ছাত্রলীগারদেরেই প্রাধান্য দেওয়া হইত। রিক্রুটমেন্ট বোর্ডের উপর এ বিষয়ে নির্দেশ দেওয়া ছিল। উল্লেখিত তরুণ বন্ধুরা অতিশয় সংকোচের সাথে আমাকে এ সংবাদটাও দেন যে এই কারণে আমার ছোট ছেলে মহফু আনাম (তিতু)র কমিশন পাওয়ায় অসুবিধা হইতেছে। মহফুয আনাম ছিল ছাত্র ইউনিয়নের লোক। সে ছাত্রলীগের ছিল না। এটা গোপন করার উপায় ছিল না। কারণ ছাত্র-সমাজে সে ছিল মশহুর। সে নিখিল পাকিস্তান ইউনির্ভাসিটি ডিবেটে পরপর তিন বছর চ্যাম্পিয়নরূপে ছিল সুপরিচিত। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতি সংসদের জেনারেল সেক্রেটারি হিসাবে ছিল দাগী ইউনিয়নিস্ট। এই কারণেই সে শক্তিশালী বাধার সম্মুখীন হইতেছে।

বন্ধুদের কাছে খবরটা পাইয়া দুঃখিত হওয়ার বদলে খুশীই হইয়ামি। ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক উভয় কারণেই। এখানেই আগেকার কথা একটু প্রাসংগিক হইয়া পড়ে।

মহফুজ আনাম সম্পর্কে মাতাপিতার স্বাভাবিক দুর্বলতা ছাড়াও আমাদের একটা অভিজ্ঞতাভিত্তিক ধারণা ছিল, সে একেবারেই কোমলপ্রাণ দার্শনিক। বাড়িতে সে গরু-ছাগল ও দূত্রের কথা, একটা মুর্গি যবেহও সহ্য করিতে পারিত না। চাকর-বাকর, কুলি-রিকশাওয়ালাকেও ‘আপনি’ বলিত। একবার এক ছোকরা তার হাতঘড়ি চুরি করে। তাকে হাতে-নাতে ধরিয়া ফেলিয়া তার কঠোরতম ভাষায় তাকে বলিয়াছিল : ‘আপনি আমার ঘড়ি চুরি করিলেন কেন?’

এমন সদাশিব যখন মুক্তিফৌজে যোগ দিবার সংকল্পের কথা আমাদের জনাইল, তখন তার মা একমাত্র এই শর্তে রাযী হইলেনঃ ‘তুমি অন্ত্রের যুদ্ধে যাইবা না। শুধু লেখায় ও বক্তৃতায় প্রচার করিবা।‘ আমিও তাঁর সমর্থন করিলাম। আমাদের শর্তে রাজী হইয়া সে ভারতে চলিয়া গেল। আমার অনুরোধে নূরুর রহমান সাহেব মুক্তিবাহিনীর কর্তৃপক্ষের কাছে এ মর্মে একটি পত্রও পাঠাইলেন।

যথাসমন্ত্রে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র হইতে মহফুষ আনামের ইংরেজী বক্তৃতা শুনিলাম। আমরা নিশ্চিত হইলাম। প্রথম প্রথম সে ছদ্মনামে বক্তৃতা করিত। কিন্তু আমরা তার গলা চিনিতাম। তারপর প্রায় মাস খানেক কলিকাতা, মাদ্রাজ, বেই, দিল্পি, আলীগড়, এলাহাবাদ ইত্যাদি ইউনিভার্সিটিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের যুক্তি-যুক্ততা ও ন্যায়-নৈতিকতার উপর বক্তৃতা করিয়া খুব নাম করে। বিভিন্ন রাজ্যের সংবাদ পত্রে তার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা হয়। তার কিছু-কিছু আমাদের হাতে ও আসে।

এই অবস্থায় পুরুষ নিশ্চিন্ততার মধ্যে যখন আমরা খবর পাইলাম যে তিতু কমিশন পাইবার চেষ্টা করিতেছে, তখন নিশ্চয়ই ভাবনায় পড়িলাম। কিন্তু রাজনৈতিক কারণে সে বাধা পাইতেছে শুনিয়া খুশী হইলাম। পরে অবশ্য তিতু কমিশন পাইয়াছিল। কিন্তু এর কোনও কথাই আমার স্ত্রীকে জানাইলাম না। আমার খুশী হওয়ার ব্যক্তিগত কারণ ছিল এটা। কিন্তু বিজয়ী সশস্ত্র বাহিনীর হাতে গণতন্ত্র বিপন্ন না হয়, সে বিষয়ে ভারত সরকার ছিদ্রহীন সাবধানতা অবলম্বন করিতেছে, আমার আদর্শগত আনন্দের কারণও এটাই।

এই অভিজ্ঞতার দরুনই আমি দেশে-বিদেশে ভারতীয় মতলব সম্বন্ধে বিরুদ্ধ প্রচারের দ্বারা প্রভাবিত হই নাই। তবু সত্য কথা এই যে শেখমুজিবের অবর্তমানে বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রী ও আওয়ামী নেতৃবৃন্দ যে মেরুদন্ডহীনতার ও অদূরদর্শিতার পরিচয় দিয়াছিলেন, তারই কুফলে ভারত বাংলাদেশ-মৈত্রীর গাথুনিতে ফাটল ধারাইবার মত কিছু শিকড়ের বীজ ছাড়াইয়া পড়িয়াছিল। এর কুফলের হাত হইতে ভারত বাংলাদেশ মৈত্রীকে বাঁচাইবার জন্য পরবর্তীকালে শেখ মুজিবের অনেক চেষ্টা চরিত্র করিতে হইয়াছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *