৩২.০৫ মুক্তিযুদ্ধ-জন-যুদ্ধ

মুক্তিযুদ্ধ-জন-যুদ্ধ
উপাধ্যায় পাঁচ

১. সংগ্রাম শুরু

২৫শে মার্চ হইতে ১৬ই ডিসেম্বরের ঘটনাবলী আমি সংক্ষেপে ডিংগাইয়া যাইতেছি। দুই কারণে। প্রথমত, এইসব ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ দেশী-বিদেশী খবরের কাগযে, বই-পুস্তিকায় এত বেশি বলা হইয়া গিয়াছে যে, পাঠকরা সবই জানিয়া ফেলিয়াছেন। আমি সে সবের পুনরাবৃত্তি করিতে চাই না। সে সব বিবরণীর মধ্যে যেটুকু অসংগতি ও পরস্পর-বিরোধিতা আছে, তারও অনেকগুলি পাঠকগণ নিজেরাই ধরিতে পারিয়াছেন। সেসব আলোচনার স্থানও এই পুস্তকে নাই; যোগ্যতাও আমার নাই। দ্বিতীয়ত : এই ঘটনাবলীর মধ্যে রাজনীতির চেয়ে যুদ্ধনীতিই বেশি। এর যতটুকু রাজনীতি, মাত্র ততটুকুই আমি প্রসংগত ও সংক্ষেপে উল্লেখ করিব।

ন মাসের এই মুদ্দতটাকে মোটামুটি তিন ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম দুই মাসের মুদ্দতটা ছিল একটা নির্বোধ জংগী সরকারের পক্ষে নিরস্ত্র নিরপরাধী দেশবাসীর বিরুদ্ধে সরকারী দমন নীতির নামে একটা বর্বর ও নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ। পরের পাঁচ মাস ছিল একটা বিদেশী দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে গোটা দেশবাসীর সার্বিক জন-যুদ্ধ। শেষের দুই মাস ছিল এটা জনসমর্থনহীন পাকবাহিনী ও জন-সমর্থিত ভারতীয় বাহিনীর মধ্যে একটা আন্তর্জাতিক যুদ্ধ।

প্রথম দুই মাসের নিষ্ঠুরতার অনেকখানি আমি নিজ চোখে দেখিয়াছি। ২৫শে মার্চের পাকবাহিনীর অন্যতম টার্গেট পিলখানার ই. পি. আর, ছাউনি আমার বাড়ি থনে মাত্র তিন শ’ গজ দূরে। আর একটি টার্গেট ভার্সিটি ক্যাম্পাসও এক মাইলের মধ্যে। ওখানকার গোলাগুলির আওয়ায ও আর্তনাদ কানে শুনিয়াছি। আর ই. পি, আয়, ছাউনির গোলাগুলি চোখে দেখিয়াছি। ২৫শে মার্চের মধ্যরাত থনে ২৭শের সকাল পর্যন্ত অবিরাম বত্রিশ ঘন্টা এই গুলিবিনিময় হয়। তার বেশ কিছু সংখ্যক গুলি আমার বাড়িতেও পড়ে। আমার বাড়ির দক্ষিণ-পশ্চিম দিকটা গাছ-পালার ঘন জংগলে ঢাকা। একদম পাড়াগাঁয়ের বাড়ির মত। এই কারণে ওইসব গুলির অধিকাংশ ঐ জংগলে বাধা পাইয়া ছরছর শব্দে মাটিতে পড়িয়াছে। মাত্র দু’চারটা দেওয়ালে জানালায় লাগিয়াছে। আমার বাড়ির দক্ষিণ দিকার যে সব বাড়ি আমার বাড়ির মত জংগলে সুরক্ষিত নয়, তাদের অনেক ক্ষয়-ক্ষতি ও কিছু-কিছু খুন-জখমও হইয়াছিল।

দুই রাত ও একদিন এইভাবে ঘরে বন্দী থাকিবার পর ২৭শে মার্চের সকাল ন’ টার দিকে রাস্তায় লোকজন ও কিছু-কিছু রিকশা দেখা গেল। শোনা গেল কারফিউ কয়েক ঘন্টার জন্য তুলিয়া নেওয়া হইয়াছে। ঘন্টা খানেকের মধ্যেই রাস্তায় গমনশীল বিপুল জনতা দেখা গেল। সবাই শহর ছাড়িয়া পাড়াগাঁয়ের দিকে চলিয়াছে। কাঁধে মাথায় বিছানাপত্র, হাতে হাড়ি-পাতিল। মনে হইল শহর বুঝি খালি হইয়া গেল। খবর লইবার জুনাই। ২৫শে মার্চের মধ্যরাত্রি হইতেই টেলিফোন স্তব্ধ। গুজব রটিল, যারা যেভাবে পারিতেছেন, শহর ছাড়িয়া পলাইতেছেন। আমাদেরও পলাইবার কথা উঠিল। কিন্তু হইয়া উঠিল না। আমি অসুস্থ, অচল। আমার স্ত্রী যিদ ধরিলেন, রাস্তায় পড়িয়া মরার চেয়ে ঘরে মরা ভাল। কারণ ঘরে মরিলে কাফন-দাফন হইবে। রাস্তায় মরিলে লাশ শিয়াল-কুত্তায় খাইবে। কাজেই ঘরে বসিয়াই আজরাইলের অপেক্ষা করিতে থাকিলাম। এ বিষয়ে এর বেশি বলিবার কিছু নাই। কারণ এই মুদ্দতে এ দেশের যারা ভারতে পলাইয়া যান নাই, অথবা অন্য কারণে বিদেশে ছিলেন না, তাঁদেয়ে প্রায় সবারই এই একই অবস্থা ছিল। অধ্যাপক মফিযুল্লা কবির তাঁর বই-এ তাঁদের স্বদেশে নির্বাসিত এই চমৎকার বিশেষণ দিয়াছেন। সত্যই আমরা সবাই এই মুদ্দতটায় নিজেদের দেশে নির্বাসিত, এ্যাইল, ছিলাম। এক্যাইলদের চেয়েও দুরবস্থায় কাটাইয়াছেন যাঁরা ছিলেন ফিউজিটিভ নিজের দেশেই। কারণ নিজেদের ঘরবাড়ি ফেলিয়া সপরিবারে এরা স্থান হইতে স্থানান্তরে পলাইয়া বেড়াইতেন বর্বর পাক বাহিনীর ভয়ে। এই মুদ্দতের চোখে-দেখানৃশংসতার অনেকগুলির মধ্যে দুইটির উল্লেখ না করিয়া পারা যায় না। প্রতি রাত্রে ঢাকা নগরের একাধিক স্থান হইতে আসমান ছোঁয়া আগুনের লেলিহান শিখা দেখা যাইত। অনেকগুলি দুচার ঘন্টা এবং কোনও কোনোটা সারা রাত আসমান লাল করিয়া রাখিত। পরে শোনা যাইত, বিভিন্ন বস্তি ও পুরাণ শহরের বিভিন্ন মহল্লায় পাক-বাহিনী এই অগ্নিকাণ্ড ঘটাইতেছে। বলা হইত, বস্তি ও মহল্লার বাঁশিন্দারা পলাইবার চেষ্টা করিলে পাক-বাহিনী তাদেরে গুলি করিয়া হত্যা করি। কথাগুলির সত্যতা যাচাই করিবার জু ছিল না। তবে এটা ঠিক যে এইভাবে বেশ কিছুদিন ধরিয়া রাতের বেলা ঢাকা শহরে মহাকবি দান্তের ‘ইনফার্নো’ দেখা যাইত।

২. হিটলারের পরাজয়

আরেকটি ব্যাপার দেখিয়া হিটলারের ইহুদি-নির্যাতনের কথা মনে পড়িত। প্রায় প্রতিদিন পূর্বাহে খোলা ট্রাক-বোঝাই লোক নেওয়া হইত। আমার বাসার সামনের সাতমসজিদ রোড দিয়াই এসব ট্রাক যাতায়াত করিত। উত্তর হইতে দক্ষিণে এবং দক্ষিণ হইতে উত্তরে উভয়দিকেই এসব ট্রাক যাতায়াত করিত। সব ট্রাকেই একই দৃশ্য।সট্রাকই লোক-তত্তি। লোকগুলোওধুমাখা দেখাযাইত। নিশ্চয়ই বসা। তবে কি ধরনের বসা, বাহির হইতে তা দেখা যাইত না। সবগুলি মাথা হেট করা। মাথার কালা চুল দেখিয়া বোঝা যাইত, সবাই হয়ত যুবক। অন্তত বুড়া কেউ নয়। মাথা হেট করিয়া খাকিত বোধহয় সৈন্যদের কড়া নির্দেশে। কারণ ট্রাকের উপরেই সংগীন তা-করা বন্দুকধারী দু-চার জন করিয়া সৈনিক দাঁড়াইয়া থাকিত। ভাবখানা এই যে, বন্দীরা মাথা নাড়িলেই গুলি করা হইবে। ওদের হাত-পা বাঁধা ছিল কি না, মানে তারা ইচ্ছা করিলেই ট্রাক থনে লাফাইয়া পলাইতে পারি কি না, তা বুঝিবার জু ছিল না।

লোকমুখে শোনা যাইত দুই রকম কথা। কেউ বলিত, এইসব যুবককে হত্যা করিয়া নদীতে ভাসাইয়া দেওয়া হইতেছে। আর কেউ বলিত, এদেরে দিয়া বাধ্যতামূলক শ্রমিকের কাজ করান হইতেছে। এই দুই কথার একটারও সত্যতা যাচাই করার উপায় ছিল না।

দু’চার দিনের মধ্যেই বুঝিতে পারিয়াছিলাম, সরকার আমাকে আপাততঃ রেহাই দিতেছেন। কেন এমন দয়া করিয়াছিলেন, সেটা বুঝিয়াছিলাম আরও পরে জুন মাসের শেষ দিকে। সে কথা পরে বলিতেছি। প্রথম যখনই বুঝিতে পারিলাম, আমি আপাতত নিরাপদ, তখনই আওয়ামী নেতাদের নিরাপত্তার চিন্তায় পড়িলাম। শেখ মুজিব ধরা দিয়াছেন, একথা পাকিস্তান রেডিও ও অন্যান্য রেডিও হইতেই শুনিয়াছিলাম। পাকিস্তান রেডিও যখন মুজিবের গ্রেফতারির দাবি করিয়াছে, তখন তাঁর জীবন সম্পর্কে নিশ্চিন্ত হইলাম। সহজেই বুঝিলাম, শেখ মুজিবকে প্রাণে মারিবার ইচ্ছা থাকিলে পাক-বাহিনী কদাচ তাঁর গেব্রেফতারের কথা স্বীকার করিত না। তখন অন্যান্য নেতাদের জীবনের নিরাপত্তা লইয়া বিশেষ চিন্তাযুক্ত হইলাম। আর কারও গেব্রেফতারের কথা পাক-বাহিনী স্বীকার করিতেছে না কেন? নিশ্চয়ই দুরভিসন্ধি আছে।

কয়েকদিনের মধ্যেই যে কয়জন বন্ধু-বান্ধব আমার সাথে দেখা করিলেন,তাঁদের মধ্যে নূরুর রহমান ও ইয়ার মোহামদ খাঁর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এরা দুইজনই বড়লোক, গাড়ির মালিক। কিন্তু গাড়ি না চড়িয়া ঐরা পায় হাঁটিয়া আমার সাথে দেখা করিলেন। আমাকে বুঝাইলেন, গাড়ি চড়া অপেক্ষা পায় হাঁটা অনেক নিরাপদ। রাস্তার মোড়ে-মোড়ে পাক-বাহিনী। পথচারীর উপর ওদের নযরে নাই। গাড়ি দেখিলেই থামায়। যদিও দুইজন পৃথক-পৃথকভাবে ভিন্ন-ভিন্ন সময়ে আসিলেন, কিন্তু দুইজনই একটা যুক্তি দিলেন বলিয়া আমি তাঁদের কথা সত্য বলিয়া বুঝিয়া নিলাম। এই দুই বন্ধুই খবর দিলেন, তাঁরা নিজেরা কয়েকজন প্রধান আওয়ামী নেতাকে ঢাকার বাহিরে পাচার করিয়া দিয়াছেন কাউকে টুপি আর কাউকে বোরকা পরাইয়া। তাঁরা অবশ্য নেতাদের নাম বলিয়াছিলেন : কিন্তু সুস্পষ্ট কারণেই আমি এখানে তাঁদের নাম উল্লেখ করিলাম না। যদিও এতে কোন লজ্জা বা অগৌরবের কিছু নাই; বরং গৌরবের কথা আছে।

বন্ধু বান্ধবদের সম্বন্ধে এইভাবে নিশ্চিন্ত হইয়া সামরিক সরকারের নির্বুদ্ধিতার রাজনৈতিক পরিণতি ও বর্বরতার সামরিক পরিণামের কথা ধীরভাবে চিন্তা করিবার অবসর পাইলাম। আমি লক্ষ্য করিলাম, জুন মাসের শেষার্ধ্ব হইতে জংগী সরকারের নীতির খানিকটা বদল হইতেছে। সেনাপতিদের যেন এই সর্বপ্রথম মনে পড়িল, দেশবাসীর অন্ততঃ একাংশের সমর্থন না পাইযুেদ্ধেও জিতা যায় না। এই বোধোদয় ঘটিবার আশু বাধ্যকর কারণও ঘটিয়াছিল। এই সময় মুক্তিফৌজের বিচ্ছুরা’ প্রতিরাত্রে ঢাকায় বোমা ফাটাইতে শুরু করিল। এতেই বোধহয় জংগী সরকারের মনে পড়িল, যেমন করিয়া থোক, জনগণের অন্ততঃ একাংশের সহযোগিতা পাওয়া দরকার। এই সময় হইতেই পাক বাহিনীর নেতারা দেশে সিভিলিয়ান সরকার, মহল্লায়-মহল্লায় ‘শান্তি কমিটি’, ‘রেযাকার’ ‘আলবদর” ইত্যাদি তথাকথিত স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী গঠনে তৎপর হইলেন।

. জন-যুদ্ধ শুরু

কিন্তু বড় দেরিতে এটা ঘটিয়াছিল। কাজেই এ পথে অগ্রসর হওয়ার উপায় ছিল না। পূর্ব-পাকিস্তানে আওয়ামী লীগবিরোধী অনেক পার্টি ছিল। নির্বাচনে এরা সম্পূর্ণ পরাজিত হইলেও এবং কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে এরা নিশ্চিহ্ন হইয়া গেলেও দেশে এদের সমর্থক অনেকেই ছিলেন। নির্বাচনে এঁরা সকলেই বেশ কিছু সংখ্যক ভোট পাইয়াছিলেন। এই সব দলের অনেকগুলোই সুগঠিত সংগঠন ছিল। তাঁদের নিষ্ঠাবান কর্মী-সংখ্যাও ছিল অনেক। কেন্দ্রীয় সরকার ২৫শে মার্চের আগে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যে-কোন অগণতান্ত্রিক ও বে-আইনী দমননীতিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করিলেও এসব পার্টি মনে-মনে খুশীই হইত। ধরুন, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যে সব মিথ্যা অভিযোগ আনিয়া ১লা মার্চ পরিষদের বৈঠক অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করিয়া দিয়াছিলেন, বা যে সব অভিযোগের পুনরাবৃত্তি করিয়া ৬ই মার্চ আবার পরিষদের বৈঠক ডাকিয়াছিলেন, ঐসব অভিযোগে যদি ‘৭০ সালের নির্বাচন বাতিল করিয়া পুনর্নিবাচন দিতেন, তবে পরাজিত পার্টিসমূহ সানন্দে সে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করিতেন, এবং প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ভাষাতেই আওয়ামী লীগকে গালাগালি দিয়া ভোট ক্যানভাস করিতেন। এমন নির্বাচনের ফলাফল কি হইত বলা যায় না, তবে দেশবাসী ও তোটারদের মধ্যে যে বড় রকমের বিভ্রান্তি ও মতভেদ দেখা দিত, তা নিশ্চয় করিয়া বলা যায়।

কিন্তু ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের পর, বিশেষ করিয়া জুলাই-আগস্ট মাসে, পূর্ব-পাকিস্তানের অবস্থা তা ছিল না এই কয়মাসে পাকবাহিনীর নিষ্ঠুরতায় পার্টি দল-মত-নির্বিশেষে পূর্ব-পাকিস্তানের জনগণ ও শিক্ষিত সমাজ স্তম্ভিত হইয়া গিয়াছেন। এদের মধ্যেকার আওয়ামী লীগ-বিরোধীরাও নূতন করিয়া চিন্তা করিতে বাধ্য হইয়াছেন। এদের বেশকিছু লোক আওয়ামী লীগের সংগ্রামের সমর্থক হইয়া পড়িয়াছেন। আর বাকীরা অন্ততঃপক্ষে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি সহানুভূতি ও সহযোগিতার মনোভাব হারাইয়া ফেলিয়াছেন। এক কথায়, পাঞ্জাবী নেতৃত্ব ও পাক বাহিনী ততদিনে সারা পূর্ব-পাকিস্তানকে পিটাইয়া আওয়ামী লীগের দলে ভিড়াইয়া দিয়াছে। আমি-এর আগে আমার শেরে বাংলা হইতে বংগবন্ধু পুস্তকে লিখিয়াছিলাম : ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের আগে পূর্ব-পাকিস্তানের একজনও পাকিস্তান ভাংগিবার পক্ষে ছিল না; ২৫শে মার্চের পরে একজন পূর্ব-পাকিস্তানীও পাকিস্তান বজায় রাখিবার পক্ষে ছিল না। কথাটা ছিল এই সময়কার সঠিক চিত্র। এ সময় পূর্ব-পাকিস্তানের জনতা সত্যসত্যই এক জন-যুদ্ধে লিপ্ত হইয়া পড়িয়াছে। দেশের কবি-সাহিত্যিক, লেখক-অধ্যাপক, সরকারী কর্মচারি, শিল্পপতি-ব্যবসায়ী সবাই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই জন-যুদ্ধে শরিক হইয়া পড়িয়াছেন। এমন অবস্থায় স্বাধীনতা-সংগ্রামে লিপ্ত অন্যান্য দেশে যা-যা ঘটিয়াছে, আমাদের দেশেও তাই ঘটিয়াছে। চিনে চিয়াং কাইশেকের তথাকথিত সমর্থকদের প্রায় সবাই যেমন কার্যতঃ মাও সেতুং-এর পক্ষে কাজ করিয়াছিলেন, চিয়াংবাহিনীকে-দেওয়া সমস্ত মার্কিন অস্ত্র যেমন মাও বাহিনীর হাতে চলিয়া গিয়াছিল, দক্ষিণ ভিয়েৎনামের সাহায্যে দেওয়া অধিকাংশ অস্ত্র যেমন ভিয়েৎকং-এর হাতে হস্তান্তরিত হইয়া গিয়াছে, পূর্ব পাকিস্তানের বেলাও ঠিক তাই ঘটিয়াছে। শুধু ছোট-বড় অফিসাররাই না, পাক সরকার নিয়োজিত শান্তি কমিটি, রেকার ও বদর বাহিনীর বহু লোকও তলে-তলে মুক্তিযুদ্ধের ও মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করিয়াছেন। বস্তুতঃ নিজেদের স্বরূপ ঢাকিবার মতলবেই এঁদের বেশির ভাগ শান্তি কমিটি রেকার ও বদর বাহিনীতে নাম লেখাইয়াছেন। এমনকি পাক-বাহিনীর দেওয়া অস্ত্র দিয়াই এদের অনেকে পাক সৈন্যকে গুলি করিয়াছেন। এইভাবে এই মুতের সংঘর্ষটা পূর্ব-পাকিস্তানীদের পক্ষে হইয়া উঠে একটা সামগ্রিক ও সর্বাত্মক জন-যুদ্ধ। এই পরিবেশে পাক-সরকার ও তাঁদের সৈন্য বাহিনী পূর্ব-পাকিস্তানে যা কিছু ভাল-মন্দ নীতি অবলম্বন করিয়াছিলেন তা ব্যর্থ হইতে বাধ্য ছিল। এ সম্পর্কে আমার ব্যক্তিগতভাবে জানা ও দেখা দুই একটি দৃষ্টান্ত দিলেই যথেষ্ট হইবে।

. জন-যুদ্ধের বিচিত্র রূপ

প্রথমেই উল্লেখ করিতে হয় আমার অন্যতম প্রিয় বন্ধু জনাবনূরুররহমানের নাম। ইনি বর্তমানে ভাসানী ন্যাপের ভাইস-প্রেসিডেন্ট। কিন্তু আওয়ামী লীগের জন্ম হইতেই তিনি আমাদের অন্যতম প্রধান সহযোগী। ১৯৫৬-৫৭ সালে তিনি সুহরাওয়ার্দী ক্যাবিনেটে একজন স্টেট মন্ত্রী ছিলেন এবং সেটা তিনি ছিলেন আমারই সহকর্মী রূপে। আমার দফতর শিল্প-বাণিজ্যের তিনি প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। দুই-একদিনেই তিনি যোগ্যতায় আমার এত আস্থা অর্জন করিয়াছিলেন যে আমি অনেকগুলি ডিভিশনই তাঁর হাতে হস্তান্তর করিয়া নিজের পরিশ্রম লাঘব করিয়াছিলাম।

তিনি একজন এক্সসার্ভিসম্যান। কমিশনপ্রাপ্ত অফিসার অবসরপ্রাপ্ত ক্যাপটেন। তিনি অনেক সময় আমার কাজে লাগিতেন। প্রাইম মিনিস্টারের অনুপস্থিতিতে আমি যখন তাঁর এ্যাকটিনি করিতাম, তখন প্রধানমন্ত্রীর সব দফতরের সংগে প্রতিরক্ষা দফতরও আমার অধীনে আসিত। এ সময় আমি নূরুর রহমানের সাথে প্রায়ই পরামর্শ করিতাম। তার আগে আমি যখন জেনারেল আইউবের সাথে পূর্ব ও পশ্চিম-পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা লইয়া বাহাসে লিপ্ত হই, তখন আমার জেলার তৎকালীন এস.পি জনাব সাদেক আহমদ চৌধুরীই প্রতিরক্ষা ব্যাপারে আমার প্রাইমারি শিক্ষক ছিলেন বটে, তবে নূরুর রহমান সাহেবও কিছুটা সেকেণ্ডারি শিক্ষকের কাজ করিয়াছিলেন। পরবর্তীকালে আইউব শাহি আমলে দুই পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা ব্যাপারে নূরুর রহমান সাহেব আমাকে আরও নতুন নতুন জ্ঞান দান করিয়াছিলেন।

১৯৭১ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে নূরুর রহমান এক দুঃসাহসিক কাজে ব্রতী হইলেন। কাজটা হইল ঢাকায় আগত মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দেওয়া ও রাতে শুইতে দেওয়ার জন্য বিভিন্ন ছদ্মনামে ষোলটি বাড়ি ভাড়া করিয়াছিলেন। এসব খবর আমাকে দিয়াছিলেন তিনি পরে ও কিস্তিতে-কিস্তিতে। তাঁর এই গোপন কার্যকলাপ আমার নযর আসে প্রথমে আমার কনিষ্ঠ ছেলে মহফুয আনাম (তিতুর মুক্তিযুদ্ধে যোগদান উপলক্ষ করিয়া। ততদিনে নুরুর রহমানের দুই পুত্রের উতমেই মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়া ফেলিয়াছে। তখনই আমি তাঁর কাছে জানিতে পারি, তিনি দুই-তিন মাস আগে হইতেই ঢাকায় মুক্তিযোদ্ধা রিক্রুট করিয়া আগরতলা সীমান্তে সোনাইমুড়ি ও ধর্মনগর পথে তাদেরে ত্রিপুরায় পার করিতেছেন। তথায় ট্রেনিংপ্রাপ্ত গেরিলারা বোমাবাবি ও সাবোটাশ কার্য চালাইতে ঢাকায় আসিয়া তাঁরই আশ্রয়ে থাকিতেছে। শেষ পর্যন্ত তাঁরই ব্যবস্থামত আমার ছেলেও আগরতলায় পাড়ি দিল। এ কাজে আমার ছেলেদের বন্ধু আমার পাতা ভাগিনা আবদুস সাত্তার মাহমুদ যে দুঃসাহসিকতার পরিচয় দিয়াছেন, তাতে আমি আমাদের তরুণদের প্রতি শ্রদ্ধায় নুইয়া পড়িয়াছি। এই আবদুস সাত্তার আমার কলিকাতা জীবনের প্রতিবেশী, আলিয়া মাদ্রাসার অধ্যাপক মওলানা সুলতান মাহমুদের পুত্র। সাত্তর কোহিনূর কেমিক্যালের একজন সাবেক চিফ-একযিকিউটিভ। পশ্চিমা মালিকের চাকুরি করিয়াও তিনি এ কাজের ঝুঁকি লইতেছেন দেখিয়া আমি শংকিত হইলাম। আমার আপত্তি অগ্রাহ্য করিয়া তিনি তাঁর নিজের গাড়িতে নিজে ডাইভ করিয়া আমার ছেলেকে সোনাইমুড়ি পৌঁছাইয়া দিলেন। পথে কত কৌশল ও প্রত্যুৎপন্নমতিত্বে এই অসাধ্য সাধন করিয়াছিলেন, সে এক দুঃসাহসিক ব্রোমাঞ্চকর কাহিনী। এই ধরনের অনেক কাজই সাত্তার করিয়াছিলেন নিজের ও চাকুরির তোয়াক্কা না করিয়া। অবশ্য তাঁর পূর্ব-পাকিস্তানী-প্রীতির জন্য ইতিপূর্বেই তিনি মালিকের নযরে পড়ায় তাঁকে চাকুরি হইতে বয়তরক করা হইয়াছিল। কিন্তু তাতেও তাঁর কর্মোদ্যম বিন্দুমাত্র কমে নাই। সান্ত্বনার কথা এই যে স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সরকার সাত্তারকে কোহিনূর কেমিক্যালের প্রশাসক নিযুক্ত করিয়া তাঁর যোগ্যতার মর্যাদাদান ও দেশ-সেবার সাহসিকতাকে পুরস্কৃত করিয়াছেন। তিনি এখন পরম মোগ্যতার সাথেই দেশের এই বৃহত্তম শিল্প-প্রতিষ্ঠান চালাইতেছেন।

এর পর নূরুর রহমান সাহেব ঘন-ঘন আমাকে তাঁর কার্যকলাপের রিপোর্ট দিতে লাগিলেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কোট, কম্বল, সোয়েটার ইত্যাদি গরম কাপড় সংগ্রহে আমার স্ত্রী ও পরিবারের অন্যান্যের সহযোগিতা নিতে লাগিলেন। তার মধ্যে একটি পন্থা এই ছিল যে, তিনি তাঁর গাড়ির ‘বুটে’ করিয়া বাণ্ডিল-বাণ্ডিল উল সূতা আনিয়া আমার বাড়িতে রাখিয়া যাইতেন। আমার স্ত্রী সেসব উল পুত্রবধু, বোন-ভাগিনী ও অন্যান্য বিশ্বস্ত আত্মীয় জনদের মধ্যে বিলি করিতেন। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তাঁরা সোয়েটার বুনিয়া আমার বাড়িতে পৌঁছাইতেন। নূরুর রহমান সাহেব নির্ধারিত সময়ে আসিয়া সেগুলো নিয়া যাইতেন। এ সব কাজ অতি সাবধানেই করা হইত সত্য, কিন্তু পাক-বাহিনীর গোয়েন্দাগিরিও কম যাইত না। তবে আমাদের তরুণরাও ইতিমধ্যে বেশ খবরদার হইয়া উঠিয়াছিল। তাদের জমা-করা সেই সব কাপড়-চোপড় এমনকি অস্ত্রপাতিও তারা এক-একদিন এক-এক জায়গায় লুকাইত। একবার আমার এক আত্মীয়াবিধবা মহিলা বিপদে পড়িতে-পড়িতে বাচিয়া গিয়াছিলেন। এই মহিলার জ্যেষ্ঠ পুত্র ও তার বন্ধুরা গেরিলাদের পোশাক-পাতি ও অস্ত্রশস্ত্র এই মহিলার বাড়িতে এক গুপ্ত স্থানে লুকাইয়া রাখিয়াছিল। পাক-বাহিনীর গোয়েন্দারা জানিতে পারিয়া এই বাড়ি থানা-তল্লাসি করে। কিন্তু ছেলেরা আগের দিন এই তল্লাসির আঁচ পাইয়া জিনিসপত্র সরাইয়া ফেলিয়াছিল। এতে এটাই প্রমাণিত হয় যে, সরকারী গোয়েন্দর উপর গোয়েন্দাগিরি করার কৌশলও আমাদের ছেলেরা ইতিমধ্যে আয়ত্ত করিয়া ফেলিয়াছিল।

এইসব ঘটনা যতই আমার কানে আসিতে লাগিল, আমি নুরুর রহমানের নিরাপত্তা সম্পর্কে ততই ভীত-সন্ত্র ও চিন্তানিত হইতে লাগিলাম। একদিন তাঁরে ফেলিয়াই বলিলাম তুমি এত সব করিয়াও পাকবাহিনীর হাত হইতে বাঁচিয়া যাইতেছ কেমন করিয়া? উত্তরে হাসিয়া বন্ধুবর যা বলিলেন, তার অর্থ ‘হাস্টিং উইথ দি হাউণ্ড এণ্ড রানিং উইথ দি হেয়ার’, অর্থাৎ তিনি আর্মি অফিসারদের সাথে দুস্তি বজায় রাখিয়াছেন। সাবেক ক্যাপটেন বলিয়া পাক-বাহিনীর কোনও-কোনও অফিসার তাঁকে জানিতেন। সেই সুবাদে তিনি আর্মি ক্লাবে যাতায়াত করিতেন এবং অফিসারদের সাথে বন্ধুত্ব করিতেন। তাঁদেরে খাওয়াইতেন। অর্থাৎ ভারত হইতে ফিরিয়া আসিয়া মুজিব নগরী সরকার যাকে দালালি আখ্যা দিলেন, নূরুর রহমান সাহেব সেই কাজটিই করিয়াছেন ঢাকায় বসিয়া এবং জান-মালের রিস্ক লইয়া। নূরুর রহমানের জন্য ছিল এটা ঘোরর রিস্ক। কারণ তাঁর দুই পুত্ৰই যে মুক্তিযোদ্ধা এটা গোপন রাখা আর সম্ভব ছিল না। ততদিনে দুই পুত্রই মুক্তিযুদ্ধে আহত হইয়াছিল। একজন গুরুতর রূপে। এত গুরুতর যে তাকে যুদ্ধ চলাকালেই নিজের খরচে লণ্ডনেও স্বাধীনতার পরে সরকারী খরচে জি.ডি. আরে অনেকদিন চিকিৎসা করিতে হইয়াছিল।

এই সময়কার আরেকটি ঘটনা দল-মত-নির্বিশেষে সকল পূর্ব-পাকিস্তানীর ঐক্যমত ও সংগ্রামের জন-যুদ্ধ প্রকৃতি প্রমাণিত করিয়াছিল। এই সময়ে পাকিস্তানী রেডিও-টেলিভিশন হইতে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে প্রচার করা হইতেছিল যে শেখ মুজিবের তথাকথিত বিচার হইয়া গিয়াছে এবং সে বিচারে মুজিবের ফাঁসির হুকুম হইয়াছে। এর কিছুদিন আগে সরকারীভাবে ঘোষণা করা হইয়াছিল যে সরকার মুজিবের সম্মতিক্রমে মিঃ এ, কে, ব্রোহীকে আসামী পক্ষের উকিল নিযুক্ত করিয়াছেন। এই ঘোষণা হইতে পূর্ব-পাকিস্তানীরা ধরিয়া নিয়াছিল যে উকিল হিসাবে মিঃ ব্রোহীর যোগ্যতা সত্ত্বেও শেখ মুজিব সুবিচার পাইবেন না। তার পর পরই মুজিবের ফাঁসির হুকুমের গুজব শুনিয়া সকল দলের সকল শ্রেণীর পূর্ব-পাকিস্তানীরা উদ্বেগ ও ব্যাকুলতায় অস্থির চঞ্চল হইয়া উঠে। আমি নিজেও দুশ্চিন্তায় অস্থির হইয়া পড়িয়াছিলাম। এই মূদ্দতে যে দলের যে শ্রেণীর যাঁরাই আমার সাথে দেখা করিতেন, সবাই একবাক্যে আমাকে খুব পীড়াপীড়ি করিয়া বলিতেন। শেখ মুজিবের প্রাণরক্ষার জন্য আমার সাধ্যমত সব চেষ্টা করা উচিৎ। আমি নিতান্ত অসহায়, নিরূপায়, শক্তিহীন, প্রভাব-প্রতিপত্তিবিহীন জানিয়াও তাঁরা আমাকে এই অনুরোধ করিতেন। দল-মত-নির্বিশেষে সবাই এই এক কথা বলায় দুইটা কথা প্রমাণিত হইত। এক, শেখ মুজিবের বাচিয়া থাকার রাজনৈতিক প্রয়োজন সম্বন্ধে সারাদেশে ঐক্যমত আছে। দুই, পাকিস্তানের সামরিক সরকার মুজিব হত্যার মত নিষ্ঠুর ও অদূরদশী কুকর্ম করিতে পারেন। প্রথমটায় শেখ মুজিবের প্রতি জাতীয় আস্থা সূচিত হইত। দ্বিতীয়টায় পাকিস্তান সরকারের প্রতি পূর্ণ অনাস্থা প্রমাণিত হইত।

. আওয়ামী লীগে ভাংগনের অপচেষ্টা

শেখ মুজিবের জীবন সম্বন্ধে পূর্ব-পাকিস্তানীদের মধ্যে যখন এমনি একটা সামগ্রিক আশংকা বিদ্যমান, যে-সময়ে ওয়ার্ল্ড কমিশন-অব-জুরিস্টস ও ওয়ার্ল্ডপিস কাউন্সিলসহ দুনিয়ার বিভিন্ন রাষ্ট্রনায়ক মুজিবের সামরিক বিচার ও তাঁর জীবনাশংকা লইয়া উদ্বেগ প্রকাশ করিতেছিলেন এবং অনেকেই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার নিকট তারবার্তা পাঠাইতেছিলেন, এমনি সময়ে আমাদের প্রিয় পলোলোকগত নেতা শহীদ সাহেবের একমাত্র আদরের কন্যা এবং আমাদের সকলের স্নেহ ও শ্রদ্ধার পাত্রী মিসেস আখতার সোলেমান ঢাকায় আসেন। আমার সাথে তাঁর ব্যক্তিগত কথা হয় নাই। কাজেই আমি জানিতাম না তিনি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বা পাকিস্তান সরকারের তরফ হইতে কোন মিশন লইয়া আসিয়াছেন কিনা। তবু আমি খুশী হই। কারণ এই ঘটনায় আমি মুজিবের জীবন সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত হইয়া এই সিদ্ধা করি যে মুজিবের প্রাণনাশের ইচ্ছা পাকিস্তান সরকারের নাই। তবে তাঁর জীবন নাশের হুমকি দিয়া পলিটিক্যাল ব্ল্যাকমেইল করিবার দুরভিসন্ধি তাঁদের খুবই আছে। অনেকদিন পরে আমার পরম স্নেহাস্পদ ও বিশ্বস্ত আওয়ামী নেতা যহিরুদ্দীন আমার সাথে দেখা করিলেন। আমার ধারণা ছিল, তিনি কলিকাতা চলিয়া গিয়াছেন। কারণ আওয়ামী নেতাদের মধ্যে তাঁরই কলিকাতা যাওয়ার সুবিধা ছিল সবচেয়ে বেশি। যহিরুদ্দীনের বাপ-দাদারা কলিকাতার সংগতিপূর্ণ ভদ্র পরিবার। পাকিস্তান হওয়ার পরেও তাঁর পরিবারের অনেকেই কলিকাতায় থাকিয়া যান। আজও তাঁরা প্রতিপত্তি ও সম্মান লইয়া কলিকাতায় বসবাস করিতেছেন। প্রথম চোটেই যহিরুদ্দীনের পক্ষে কলিকাতা যাওয়া খুবই স্বাভাবিক ছিল।

কিন্তু তিনি কলিকাতা যান নাই। বিভিন্ন জায়গায় তিনি চার-পাঁচ মাস আত্মগোপন করিয়াছিলেন। মিসেস সোলেমান ঢাকায় আসায় তাঁর আত্মগোপনের আবশ্যকতা আপাততঃ আর নাই। তাই তিনি গোপন স্থান হইতে বাহিরে আসিতে সাহস পাইয়াছেন।

আমি খুশী হইলাম। তাঁর সাথে একাধিকবার লম্বা আলোচনা করিলাম। মুজিবের জীবন লইয়া রাজনৈতিক দর কষাকষির পাকিস্তানী অভিপ্রায় সম্বন্ধে আমার সন্দেহ দৃঢ়তর হইল। দর কষাকষির ভাব দেখাইয়া পাকিস্তানকে হিউমারে রাখা মন্দ নয়। এ বিষয়ে যহিন্দীনের সাথে আমি একমত হইলাম। এ বিষয়ে আমার অনুমোদনক্রমে দুই-একটি বিবৃতিও তিনি দিলেন। কিন্তু পাকিস্তানী নেতাদের দাবি-মত শেখ মুজিবের বদলে নিজে আওয়ামী লীগের নেতা হইতে বা আওয়ামী লীগের নাম পরিবর্তন করিয়া নতুন নামের পার্টি করিতে তিনি রাযী হন নাই। এ বিষয়ে তৎকালে খবরের কাগযে যহিরুদ্দীনের রাজনীতি সম্পর্কে যে সব জল্পনা-কল্পনা বাহির হইয়াছিল, তার অধিকাংশই ছিল হয় ভিত্তিহীন, নয় ত বিকৃত ও অতিরঞ্জিত।

পরবর্তীকালে স্বাধীনতার পর ঐ সব বিকৃত রিপোর্টের উপর নির্ভর করিয়া আওয়ামী নেতারা যহিরুদ্দীনের প্রতি যে ব্যবহার করিয়াছেন, তা ছিল যহিরুদ্দীনের প্রতি ঘঘারতর অবিচার। আওয়ামী লীগও তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হইয়াছিল। আমি কোনও কোনও প্রভাবশালী আওয়ামী নেতার কাছে যহিরুদ্দীনের কথা তুলিয়াছিলাম। আওয়ামী লীগের প্রতি তাঁর অতীতের নিঃস্বার্থ সেবার উল্লেখ করিয়াছিলাম। তাতে এক সুরসিক আওয়ামী নেতা হাসিয়া জবাব দিয়াছিলেন : বিনা-ফিসে আওয়ামী নেতাদের রাজনৈতিক মামলায় উকালতি করাই ছিল আওয়ামী লীগের প্রতি যহিরুদ্দীনের বড় অবদান। আমরা আওয়ামী লীগাররাই এখন সরকার হওয়ায় তাঁর আর দরকার হইবে। বরঞ্চ আওয়ামী লীগ-বিরোধীদের জন্যই যহিরুদ্দীনের সেবার বেশি দরকার হইবে।’

যহিরুদ্দীনের মত দক্ষ পার্লামেন্টারিয়ান আওয়ামী লীগে আর থাকিবেননা, একথাও বলিয়াছিলাম আরেকজন বড় নেতার কাছে। জবাবে তিনিও বলিয়াছিলেন : আপনাদের আমলের মত পার্লামেন্ট আর থাকিবে কি না, তাই আগে দেখিয়া নেন।

এ কথার তাৎপর্য বুঝিয়াছিলাম আরও অনেক পরে। সংবিধান রচনার পর ১৯৭৩ সালের মার্চের সাধারণ নির্বাচনের ফলে যে পার্লামেন্ট গঠিত হইল, তাতে ‘লিডার অবদি হাউস’ আছে, কিন্তু লিডার-অব-দি অপযিশন’ নাই। মাত্র আটজন অপযিশন মেম্বরের নেতা বলিয়া জনাব আতাউর রহমান খাঁকে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ‘লিডার অব-দি-অপযিশন’ মানিয়া লন নাই। ফলে সারা দুনিয়ায় একমাত্র বাংলাদেশেই লিডার-অব-দি অপযিশন-হীন পার্লামেন্ট বিরাজ করিতেছে।

. উপ-নির্বাচনের প্রহসন

যা হোক, আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের দ্বিতীয় স্তরে জন-যুদ্ধের কথায় ফিরিয়া আসা যাক। জন-যুদ্ধ মূদ্দরে পাঁচ মাস সময়ের সরকারী দিশাহারা পাগলামির আরেকটা প্রমাণ তথাকথিত উপ-নির্বাচনের ব্যবস্থা। মিসেস আখতার সোলেমানের নরম আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে অনুপ্রবেশের চেষ্টা ব্যর্থ হইবার পরই সামরিক সরকার প্রথমে ৭৮ জন আওয়ামী এম, এন, এ. ও ১০৫ জন এম. পি. এ কে এবং পর আরও ৮৮ জন এম, পি, এ.-কে ডিসকোয়ালিফাই করিয়া তাঁদের সীটে উপনির্বাচনের হুকুম জারি করেন। পাকিস্তান সরকারের এই আহাম্মকিতে বাংলাদেশের এই সময়কার জন-যুদ্ধের বুনিয়াদ গণ-ঐক্য আরও দৃঢ়তরভাবে প্রমাণিত হইল। এই তথাকথিত উপ-নির্বাচনের জন্য প্রার্থী পাওয়া দুষ্কর হইল। গত নির্বাচনে যামানত বাযেয়াক্ত শ্রেণীর কয়েকজন ঝটপট প্রার্থী হইয়া গেলেন বটে, কিন্তু অত-অত ভ্যাকেট সীটের জন্য যথেষ্ট প্রার্থী পাওয়া গেল না। এমনকি, জমাতে ইসলামী ও পিপলস-পার্টির মত আওয়ামী লীগ-বিরোধীরাও প্রার্থী দাঁড় করাইতে সাহস পাইলেন না। একমাত্র এয়ার মার্শাল আগসর খাঁর ইতেকলাল পার্টি পূর্ব পাকিস্তানের বর্তমান অস্বাভাবিক অবস্থায় সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হইতে পারে না, এই যুক্তিতে এই উপ-নির্বাচন বয়কট করিলেন। অবস্থা এমন দাঁড়াইল যে সামরিক অফিসাররা মফস্বলে ঘূরিয়া-ঘুরিয়া প্রার্থী যোগাড়ে লাগিয়া গেলেন। অনেককে ভয় দেখাইয়া, লোত দেখাইয়া, যবরদস্তি করিয়া প্রার্থী রাযী করিলেন। অনেকের যামানতের টাকাও এঁরাই যোগাড় করিয়া দিলেন।

ফলে ৫৫ জন প্রার্থী বিনা-নির্বাচনে নির্বাচিত হইয়া গেলেন। আমার কিছু-কিছু সাংবাদিক বন্ধুকে বলিয়াছিলাম, এরা ]বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হইয়াছেন’ না লিখিয়া বিনা-নির্বাচনে নির্বাচিত লেখাই উচিৎ। উর্দুভাষী বন্ধুদের বলিলাম : বেলা ইতেখাব মুনুতেখাব। বন্ধুরা আমার রসিকতাটা উপভোগ করিলেন। অনেক সাংবাদিকরাও ‘বিনা-নির্বাচনে নির্বাচিত’ লিখিলেন।

অবিশিষ্ট আসনসমূহের জন্য ডিসেম্বরের শেষের দিকে নির্বাচনের তারিখ ঘোষিত হইল। কিন্তু অবস্থা-গতিকে সে সব উপ-নির্বাচন আর হইতে পারিল না। বিনা নির্বাচনে নির্বাচিতদের অনেকেই পিভিতে পাড়ি জমাইলেন। কারণ এটা ঠিক হইয়া গিয়াছিল যে ন্যাশনাল এসেম্বলির পয়লা বৈঠক ঢাকার বদলে পিন্ডিতেই হইবে।

৭. পাক-ভারত যুদ্ধ

এইবার আসা যাক, মুক্তিযুদ্ধের তৃতীয় স্তরের দুই মাসের আলোচনায়। নবেম্বর ডিসেম্বরের মুদ্দতটা আসলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেয়ে পাক-ভারতের আন্তর্জাতিক যুদ্ধ-মন্দুতই ছিল বেশি। নবেম্বর মাসে প্রথম দিক হইতেই, বরং অক্টোবরের শেষ দিক হইতে, ভারত সরকার পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এবং পাকিস্তান সরকার ভারতের বিরুদ্ধে পরস্পরের সীমা লংঘন ও আগ্রাসনের অভিযোগ প্রত্যভিযোগ শুরু করেন। নোয়াখালি জিলার বিলোনিয়া, ত্রিপুরা রাজ্যের ধর্মনগর, ময়মনসিংহ জিলার কামালপুর ইত্যাদি স্থানের নাম উভয় সরকারের রেডিওতে ঘন ঘন শুনা যাইতে লাগিল। শুধু স্থল সৈন্যের দ্বারা নয়, বিমান বাহিনীর দ্বারা পরস্পরের স্থল ও আকাশসীমা লংঘনের কথা বলা হইতে লাগিল। শুধু তাই নয়। উভয় পক্ষের সৈন্যবাহিনীর সংঘর্ষের কথাও প্রকাশিত হইতে লাগিল। এক পক্ষ আর এক পক্ষকে হারাইয়া দিয়াছে বলিয়া দাবি করা হইলেও স্পষ্ট ভাষায় এমন আশ্বাসও দেওয়া হইতে লাগিল যে অপর পক্ষের আক্রমণকারী সৈন্যদের মারিয়া তাড়াইয়া দেওয়া হইয়াছে বটে, কিন্তু তাড়াইতে-তাড়াইতে তাদের পিছু ধাওয়া করার বেলা অপর পক্ষের ভূমিতে প্রবেশ করা হয় নাই। বরঞ্চ পলায়মান অপর পক্ষের সৈন্যদেয়ে ধাওয়া করিতে করিতে আন্তর্জাতিক সীমায় গিয়াই আমাদের পক্ষের সৈন্যরা একদম থামিয়া গিয়াছিল। একেবারে দ্রুতগামী মোটর গাড়ির ব্রেক কষার মত আর কি। প্রতিদিন সকালে বিকালে রেডিওতে এই ধরনের সংবাদ প্রচারিত হইতে লাগিল। তার মানেই পাক ভারত সরকারদ্বয়ের মধ্যে লড়াই নাই বা লাগুক, উভয় সরকারের সৈন্যদের মধ্যে লড়াই তখন বাধিয়া গিয়াছে। ভারতের পক্ষ হইতে বলা হইল পাক-বাহিনীর লোকেরা বোমা পাতিবার উদ্দেশ্যে ভারতের ভূমিতে ঢুকিয়া পড়িতেছে। আর পাকিস্তানের পক্ষ হইতে বলা হইতে লাগিল ভারতের স্থলবাহিনী ও গোলন্দা বাহিনী পাকিস্তানের ভূমিতে ঢুকিয়া পড়িতেছে। পাকিস্তানের পক্ষ হইতে ভারতীয় অভিযোগের কোন জবাব দেওয়া হয় নাই। কারণ বোধ হয় জবাব দিবার মত তাদের কিছু ছিল না। কিন্তু ভারতীয় পক্ষ হইতে বলা হইল ভারতীয় সৈন্য শুধু বাংলাদেশের লিবারেটেড এরিয়াতেই ঢুকিয়াছে। বস্তুতঃ এটাকেই বলে অঘঘাষিত যুদ্ধ। এ সময়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে এই অঘঘাষিত যুদ্ধই চলিতেছিল। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রায় সব রাষ্ট্রনায়ক ও সংবাদপত্রই এটাকে পাক-ভারত সংঘর্ষই বলিতেছিলেন। পূর্ব পাকিস্তানের এই সময়কার দাবিকে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবিই বলা হইক, আর পূর্ণ স্বাধীনতার সংগ্রামই বলা হউক, এর পিছনে ভারতের উস্কানি আছে, ফলে সংঘর্ষটা আসলে পাক-ভারত সংঘর্ষ, বিশ্ববাসীকে ওটা দেখাইয়া পূর্ব-পাকিস্তানের সংগ্রামকে আন্তর্জাতিক রূপ দিয়া পূর্ব-পাকিস্তানীদের দাবিকে মেঘাবৃত করিবার চেষ্টা পাকিস্তানের আগাগোড়াই ছিল। পূর্ব-পাকিস্তানের যে কোনও ছোট-বড় গণ আন্দোলনকে ভারতের উস্কানি বলিয়া চিহ্নিত করার প্রয়াস পাকিস্তানী শাসকদের সনাতন নীতি। কিন্তু আগের-আগের বার পাকিস্তানের নেতারা হাজার প্রভোকেশন দিয়াও ভারতীয় নেতাদেরে চেতাইতে পারেন নাই। ভাষা আন্দোলনের সময় নূরুল আমিন সাহেব যা পারেন নাই, আগরতলা ষড়যন্ত্রের কথা বলিয়া আইউব সাহেব যা পারেন নাই, এবার ইয়াহিয়া সাহেব তা পারিলেন। ভারতীয় নেতৃত্ব এবার সত্য-সত্যই চেতিলেন। পূর্ব-পাকিস্তানের জনতার উপর ২৫শে মার্চের বর্বর হামলার জন্য সভ্য মানুষ ও সরকারের মত অনুতপ্ত না হইয়া ইয়াহিয়া সরকার রাজনৈতিক ও সামরিক সব কাজের সমর্থনে ১৯৭১ সালের ৫ই আগস্ট ‘হোয়াট হ্যাপেন্ড’ এই শিরোনামায় একটি বিশালাকারের হোয়াইট পেপার বাহির করিলেন। এতে আওয়ামী লীগ এবং দেশরক্ষা ও পুলিশ বাহিনীর উপর, এমনকি সরকারী কর্মচারীদের উপর, ঢালাও মিথ্যা অপবাদ ত দিলেনই, ভারত সরকার ও ভারতীয় নেতৃবৃন্দের উপরও সত্য-মিথ্যা অভিযোগ করিলেন। এক কথায়, পূর্ব-পাকিস্তানের গোটা ব্যাপারটাকেই ভারতের উষ্কানি, উৎসাহ, সহায়তা ও সক্রিয় সাহায্যের দ্বারা পাকিস্তান ধ্বংসের ষড়যন্ত্র বলা হইল। এই সংগে পাকিস্তানের সংহতি রক্ষার দৃঢ় সংকল্পের কথা যে ভাবে যে ভাষায় বলা হইল, তাকে ভারতের বিরুদ্ধে হমকি বলিলে অসংগত হইবে না।

কিন্তু পাকিস্তান সরকারের পক্ষেও যথেষ্ট যুক্তি ছিল। পূর্ব-পাকিস্তানের ব্যাপারে এইবারই ভারত সরকার ও তারতের নেতৃবৃন্দ বরাবরের নিরপেক্ষ নীতি পরিহার করিয়া একটু বেশি মাত্রায়, এমনকি আন্তর্জাতিক নিয়ম-কানুন ও নীতি-প্রথা লংঘন করিয়া, পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে সোজাসুজি মত প্রকাশ ও হস্তক্ষেপ করিতে শুরু করেন।

. ভারতের উদ্দেশ্য

বলা যাইতে পারে এবং বলা হইয়াছেও যে পূর্ব-পাকিস্তানে পাক সামরিক বাহিনীর বর্বরতায় পাশ্ববর্তী ভারতীয় এলাকায় প্রায় এক কোটি লোক শরণার্থী হওয়ায় ভারতের অভ্যন্তরে যে আর্থিক, সামাজিক, প্রশাসনিক ও আইন-শৃংখলার সমস্যার সৃষ্টি হইয়াছিল, তাতে এ ব্যাপারে কথা বলিবার ও পন্থা গ্রহণ করিবার সম্পূর্ণ অধিকার ভারত সরকারের ও ভারতবাসীর উপর বর্তাইয়াছিল। এর জবাবে বলা যাইতে পারে এবং বলা হইয়াছেও যে ওসব সমস্যা সৃষ্টি হইবার অনেক আগে হইতেই ভারত সরকার ও ভারতবাসীর হস্তক্ষেপ শুরু হইয়াছিল। দৃষ্টান্ত স্বরূপ ২৭শে মার্চের ভারতীয় লোকসভার প্রস্তাবের কথা বলা যায়। ২৫শে মার্চের মধ্যরাত্রে পূর্ব-পাকিস্তানে পাক বাহিনীর হামলা শুরু হয়। ২৭শে মার্চ, মানে একদিনে ভারতের ভূমিতে কোনও শরণার্থী সমস্যা সৃষ্টি হয় নাই। ভারতীয় লোকসভার প্রস্তাবেও কাজেই এ ধরনের কোনও ভারতীয় সমস্যার কথা বলা হয় নাই। প্রস্তাবে যেসব কথা বলা হইয়াছে, তার সবই ভাল-ভাল কথা। কাজেই কারও প্রতিবাদের বা আপত্তির কিছুনাই। পূর্ব-বাংলায় নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর না করার এবং তার বদলে নগ্ন শক্তি প্রয়োগের নিন্দা করা দোষের নয়। সাড়ে সাত কোটি পূর্ব-বাংগালীর সংগ্রামে সহানুভূতি ও সহায়তার আশ্বাসকেও দোষের বলা যাইতে পারে না। তবে এটাও সত্য কথা যে শরণার্থী-সমস্যা সৃষ্টি হইবার আগে হইতেই ভারত সরকার ও ভারতবাসী পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে, সুতরাং পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে, হস্তক্ষেপ করিতেছিলেন। ভারতের এ কাজকে আমি অন্যায়ও বলিতেছি না, এর নিন্দাও করিতেছি না। ইতিমধ্যে আমার লেখা একাধিক বই-পুস্তকে ও প্রবন্ধে ভারতের এ কাজের বরং সমর্থনই করিয়াছি এবং এর চেয়ে গুরুতর কিছুকরিলেও দোষের হইত না, বলিয়াছি। কিন্তু এখানে আমার প্রতিপাদ্য এই যে, শরণার্থী সমস্যায় প্রত্যক্ষভাবে জড়িত হইবার আগেই ভারতীয় নেতৃত্ব পূর্ব-পাকিস্তানের ব্যাপারে কিছু কিছু ভাল মন্দ কার্যকলাপ শুরু করিয়াছিলেন। ভারতীয় নেতৃত্বের জন্য এটা নূতন। তাঁদের সাবেক সনাতন নিরপেক্ষ নীতির এটা খেলাফ। এই কারণেই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ৫ই আগস্টের হোয়াইট পেপারে ভারত সরকার ও ভারতীয় নেতৃত্বকে পূর্ব-পাকিস্তানের পরিস্থিতির জন্য দায়ী করা সম্ভব হইয়াছিল।

যা হোক, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার এই সত্য-মিথ্যা-মিশ্রিত হোয়াইট পেপার ভারতের খুব কাজে লাগিয়াছিল। ৫ই আগস্ট পাকিস্তান সরকারের হোয়াইট পেপার বাহির হয়। আর তার তিন দিনের মধ্যে ৮ই আগস্ট রুশ-ভারত চুক্তি সম্পাদিত হয়। যদিও চুক্তিটির নাম দেওয়া হইয়াছিল শান্তি, মৈত্রী ও সহযোগিতার চুক্তি। আসলে এটা ছিল কিন্তু একটা দস্তুরমত সামরিক চুক্তি। চুক্তির মুদ্দা কথা ছিল : যদি কেউ ভারত বা সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করে, তবে তারা পরস্পরকে সাহায্য করিবে। একে অপরের প্রতিরক্ষা ব্যাপারে শত্রুপক্ষকে সাহায্য করিবে না। শান্তি-মৈত্রী সম্বন্ধে অনেক ভাল-ভাল কথার মধ্যে এই সামরিক সহযোগিতার কথাটাই ঝলমল করিয়া সকলের চোখে পড়িল। জোটনিরপেক্ষতা ও সামরিক চুক্তি-বিরোধিতা নেহরুর বহু বিঘোষিত সুপ্রতিষ্ঠিত ও কড়াকড়িভাবে প্রতিপালিত পররাষ্ট্র নীতি। তাঁরই মেয়ে মিসেস ইন্দিরা গান্ধী পিতার এই দীর্ঘদিনের নীতি পরিত্যাগ করিয়া সামরিক জোটবদ্ধ হইলেন, এতে দেশের ভিতরে-বাহিরে হৈ চৈ পড়িয়া গেল। শত্রুদের ত কথাই নাই, বহু বন্ধু ও সমর্থকও ইন্দিরা দেবীর সমালোচনায় মুখর হইয়া উঠিলেন।

কিন্তু অল্পদিনেই সমালোচকদের কণ্ঠ নীরব হইল। শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর দূরদর্শিতার তাঁরা মুখে না হইলেও মনে মনে তারিফ করিতে বাধ্য হইলেন। পাকিস্তানের জংগী সরকার যে পূর্ব-পাকিস্তানের নিতান্ত ন্যায়সংগত গণতান্ত্রিক সংগ্রামটাকে পাক-ভারতের আন্তর্জাতিক সংঘাত রূপে চিত্রিত করিবার চেষ্টা করিতেছিলেন, তার প্রধান উদ্দেশ্যেই ছিল এই সংঘাতে চীন-মার্কিন ইত্যাদি কতিপয় বন্ধুরাষ্ট্রকে পাকিস্তানের পক্ষে জড়াইয়া ফেলিবার অপচেষ্টা। মিসেস ইন্দিরা গান্ধী যথাসময়ে এই রুশ-ভারত চুক্তির লাঠি উঁচা না করিলে পাকিস্তানের চেষ্টা যে সফল হইত না, তা কেউ জোর করিয়া বলিতে পারিবেন না। পাক-ভারত যুদ্ধের শেষ অবস্থায় পাকবাহিনীর পরাজয়ের সম্ভাবনার মুখে মার্কিন সপ্তম নৌবহরের ভারত মহাসাগরে প্রবেশ ও পশ্চাদপসারণের পিছনে সোভিয়েত ভীতি মোটেই কাজ করে নাই, এ কথাও বলা চলে না। কারণ মার্কিন সপ্তম নৌবহরের ভারত মহাসাগরে প্রবেশ করার খবরের সাথে সাথে এমন খবরও দেশ-বিদেশের বেতারে প্রচারিত হইয়াছিল যে সোভিয়েত নৌবহরও মার্কিন নৌবহরের অনুসরণ করিতেছে।

৯. পাকিস্তানের আক্রমন

ভারতের বিরুদ্ধে সত্য-মিথ্যা অভিযোগ করিয়া কার্যতঃ ও পরিণামে পাকিস্তানের সামরিক শাসন-কর্তারা ভারতের সুবিধা করিয়াই দিতেছিলেন। পূর্ব-পাকিস্তানের অসন্তোষ ও বিদ্রোহ যে পরিণামে ভারতের স্বার্থেরই অনুকূল, এটা ভারত সরকার ও ভারতীয় জনগণ বরাবর বুঝিতেন। যে-কোন কান্ডজ্ঞানীরই তা বুঝিবার কথা। পাকিস্তানী শাসকদের তা বুঝা উচিৎ ছিল। কিন্তু তাঁরা তা বুঝেন নাই বলিয়াই মনে হয়। এ অবস্থা ভারতের অনুকূল হওয়ায় ভারত সরকার ও ভারতবাসী যে পূর্ব পাকিস্তানের অসন্তোষে ও বিদ্রোহে ইন্ধন যোগাইবেন, এটাও স্বাভাবিক। সবাই এমন করেন। পাকিস্তানীরাও সুযোগ পাইলে তাই করিতেন। এটা পাকিস্তানী শাসকরাও নিশ্চয় বুঝিয়াছিলেন। কিন্তু রাজনৈতিক প্রজ্ঞার অভাবে তার প্রতিকার করিতে পারেন নাই। বরঞ্চ নির্বুদ্ধিতার দরুন ভারতের উদ্দেশ্য পূরণের সহায়তাই করিয়াছেন। ফলে ২৭শে হইতে ৩০শে মার্চ পর্যন্ত ভারতীয় লোকসভার বিতর্কে ও প্রস্তাবটায় যে টুকুন ভূল ছিল, পাকিস্তানের শাসকরা ভারতের সে ভুল অসামান্য দ্রুতগতিতে সংশোধন করিয়াছিলেন। গতির সে দ্রুততায় পাকিস্তান ভারতকে অনেক পিছনে ফেলিয়া দিয়াছিল। ভারতের সে দ্রুততা ছিল বস্তুতঃ অতিআগ্রহ ও অতিব্যস্ততার ফল। ২৫শে মার্চের শেষ রাত্রে পাক-বাহিনীর হামলার মাত্র একদিন পরেই ভারতীয় লোকসভার বিতর্ক শুরু হওয়ার ব্যাপারটা, বিশেষতঃ তার ভাষা ও মর্ম সবই ছিল অতিরিক্ত ব্যস্ততার অশোভন প্রকাশ। ওটাকে নিরপেক্ষ বিদেশী রাষ্ট্র, সরকার ও নেতারা অতি সহজেই অন্যের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ বলিতে পারিতেন এবং বলিয়াও ছিলেন। মার্চ মাসে এটা না করিয়া এপ্রিল মে-জুনে করিলে ভারতকে কেউ দোষ দিতে পারিতেন না। পাক-বাহিনী যখন মিলিটারি এ্যাকশন শুরু করিয়াছে, তখন পূর্ব পাকিস্তানিদের এক বিরাট অংশ ভারত-ভূমিতে আশ্রয় লইবেই, ওটা বরাবরের জানা কথা। দুদিন অপেক্ষা করিয়া শরণার্থীদের ভিড়ের যুক্তিতে ৩০শে মার্চের প্রস্তাবের চেয়েও কঠোর প্রস্তাব গ্রহণ করিলেও ভারতকে কেউ কিছু বলিতে পারিতেন না। ২রা এপ্রিল তারিখে অর্থাৎ মিলিটারি এ্যাশনের সাতদিনের মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট পদগনী প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার নামে যে সুন্দর পত্রখানা লিখিয়াছিলেন, ভারতের প্রেসিডেন্ট ঐরূপ একখানা পত্র লিখিবার পর যদি লোকসভা বিতর্কে বসিত, তবে ব্যাপারটা কতই না সুন্দর হইত। সুন্দর হয় নাই বলিয়াই ওটা অশোভন হইয়াছে। অতি-উৎসাহ, অতি-আগ্রহ ও অতি-ব্যস্ততার সময় অমন এক আধটু অশোভন কাজ হইয়াই থাকে।

কিন্তু পাকিস্তানের শাসকা ভারতের এই ভুল সংশোধন করিয়া দিলেন ৫ই আগস্ট হোয়াইট পেপার বাহির করিয়া এবং ৩রা ডিসেম্বর ভারত আক্রমণ করিয়া পাকিস্তানী শাসকদের মাথায় এটা ঢুকেই নাই যে ভারত এটাই চাইতেছিল। কিন্তু বাইরে এই আগ্রহ চাপিয়া রাখিতেছিল। মার্চ মাসে অতি উৎসাহ দেখাইয়া ভারতীয় নেতৃত্ব যে ভুল করিয়াছিলেন, পরবর্তী আট মাস অসাধারণ ধৈর্য্য ধরিয়া সে চপলতার ক্ষতিপূরণ করিয়াছিলেন।

৩রা ডিসেম্বর (১৯৭১) বিকাল সাড়ে পাঁচটায় (ভারতীয় সময়) পাকিস্তানী বিমান বাহিনী অমৃতসর, পাঠানকোট, শ্রীনগর, অবন্তীপুর, যোধপুর, আলা ও আগ্রা ইত্যাদি ভারতীয় বিমান ঘাটিতে হাওয়াই হামলা চালায়। পাকিস্তান এটা করে কোন যুদ্ধ ঘোষণা না করিয়াই। বিনা-নোটিসে ও বিনা কারণে। জবাবে ভারতীয় বিমান বাহিনী রাত সাড়ে এগারটায় শিয়ালকোট, সারগোদা, মিয়ানওয়ালী, করাচি, রিসালপুর ও লাহোর বিমানঘাটি আক্রমণ করে।

ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ফর্মাল যুদ্ধ বাঁধিয়া যায়। ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশের রেডিও হইতে এবং বিবিসি ও ভয়েস অব আমেরিকা হইতে যথাসময়ে মোটামুটি একই ধরনের খবর শুনিলাম। স্পষ্টই প্রতীয়মান হইল পাকিস্তানই আগে হামলা করিয়াছে। ভারত জবাবী হামলা করিয়াছে।

তখনই আমার মনে হইয়াছিল পাকিস্তান ভূল করিয়াছে। ভারতের পাতা ফাঁদে পা দিয়াছে। বেশ কিছুদিন ধরিয়া পাকিস্তানের ভুলের আশায় ভারত অপেক্ষা করিতেছিল। ৩রা ডিসেম্বরের সন্ধ্যাকালে পাকিস্তান ভারতের সে আশা পূর্ণ করিল। পাকিস্তানকে দিয়া এই ভূল করাইবার জন্য ভারতকেও কিছু বুদ্ধি-কৌশল ও ফন্দি-ফিকির করিতে হইয়াছিল। সে কৌশলটা ছিল ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর ৪ঠা ডিসেম্বরের নির্ধারিত কলিকাতার গড়ের মাঠের জনসভাকে অত্যন্ত অকস্মাৎ ৩রা ডিসেম্বরে আগাইয়া আনা। মিসেস ইন্দিরার কলিকাতার জনসভার সাথে পশ্চিম সীমান্তে আগ্রাসনের একটা অচ্ছেদ্য সম্পর্ক ছিল। সেই সম্পর্মে দরুনই ইন্দিরা গান্ধী ৩রা ডিসেম্বর কলিকাতা জন-সভা করায় পাকিস্তানও ৩রা তারিখে ভারত আক্রমণ করিল। তার ফলে ঐ রাতেই মিসেস গান্ধী তাঁর বেতার ভাষণে বলিতে পারিলেন : ‘বাংলাদেশের যুদ্ধ ভারতেরই যুদ্ধ’। অতঃপর এই ঘোষণা-মতই কাজ হইল। পক্ষান্তরে যদি মিসেস গান্ধী ৩রা ডিসেম্বর কলিকাতা জন-সতা না করিয়া পূর্বনির্ধারিত ৪ঠা তারিখে করিতেন, তবে পাক-বাহিনী ৪ঠা ডিসেম্বর বিকালে পশ্চিম সীমান্ত আক্রমণ করিত। বাংলাদেশের যুদ্ধকে ভারতের যুদ্ধ ঘোষণা করিতে একদিন দেরি হইয়া যাইত। এই একদিন বিলম্বে কি অসুবিধা হইত, তা আরও কেউ-কেউ হয়ত জানিতেন। কিন্তু ভারতের প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয়ই জানিতেন। সেই কারণেই তিনি উক্ত সভার উদ্যোক্তা, পশ্চিম-বাংলা সরকার ও কংগ্রেস নেতাদের প্রতিবাদ ও জনগণের অসন্তোষ অগ্রাহ্য করিয়া নির্ধারিত দিনের মাত্র একাদশ ঘন্টায় সভার দিন-ক্ষণ আগাইয়া আনিয়াছিলেন। শ্রীমতি ইন্দিরার বক্তৃতায় সমবেত জনতা নিরাশ ও অসন্তুষ্ট হইয়াছিল। চমকপ্রদ কথা ত তিনি কিছুই বলিলেন না। তবে কেন তিনি এই সভা ডাকিয়াছিলেন? কেনইবা তিনি সেই সভার দিন আগাইয়া আনিলেন? শুধুই কি এটা প্রধানমন্ত্রীর খাম-খেয়াল? পন্ডশ্রম? না। মিসেস গান্ধী জানিতেন, তার উদ্দেশ্য সফল হইয়াছে। এমন সফল সভা তিনি জীবনে আর করেন নাই। কলিকাতা বসিয়াই তিনি খবর পাইলেন, পাকিস্তান ভারতের পশ্চিম সীমান্ত আক্রমণ করিয়াছে। তিনি মুখে গাম্ভীর্য ও দুশ্চিন্তা ফুটাইয়া এবং মনে-মনে হাসিয়া দিল্লী ফিরিয়া গেলেন। নিয়মমাফিক ইমার্জেন্সি ও যুদ্ধ ঘোষণা করিলেন।

এতে একটা জটিল ব্যাপার খুবই সহজ হইয়া গেল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারত কাজে-কর্মে চার-পাঁচ মাস আগে হইতেই প্রত্যক্ষভাবে জড়াইয়া পড়িয়াছিল। তেমনভাবে জড়াইয়া পড়িবার ন্যায়নৈতিক, রাজনৈতিক, সামরিক, অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক অনেক সংগত কারণ ছিল। সে সব কারণের কথা আমি আমার একাধিক বই-এ লিখিয়াছি। এই বইয়েও পরে বলিব। এখানে শুধু এইটুকু বলা দরকার যে ওসব কারণ সত্ত্বেও ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের মাটিতে তার সৈন্যবাহিনী নামাইতে পারিতেছিল না। আন্তর্জাতিক নিয়ম-কানুন তার প্রতিবন্ধক ছিল। অক্টোবর নবেম্বর পর্যন্ত প্রায় আশি-নব্বই লক্ষ বাংলাদেশী নাগরিক যখন ভারতে শরণার্থী হইয়াছে, তার ফলে ভারতের অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক বিপর্যয় ঘটিয়াছে, তখন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী সেটাকে সিভিল এগ্রেশন (দেওয়ানী আগ্রাসন) বলিতে পারিয়াছেন। কিন্তু সে কারণে পূর্ব-পাকিস্তানের সৈন্য নামাইতে পারেন নাই। ফর্মালি মানে দস্তর মাফিক পারেন নাই। ইনফর্মালি, বে-দস্তুরভাবে, পারিয়াছেন এবং যথেষ্ট করিয়াছেন। মুক্তি ফৌজ গঠনে, প্রশিক্ষণ ও পরিচালনে প্রচুর অর্থ ও লোক নিয়োগ করিয়াছেন। তাঁদের সহায়তায় ও আবরণে পূর্ব-পাকিস্তানের ভূমি দখলও করিয়াছেন। কিন্তু আন্তর্জাতিক কানুনহেতু এ সবই করিতে হইয়াছে মুক্তিবাহিনীর নামে। তাতে এ কাজে প্রচুর অর্থ ও দীর্ঘ সময় নষ্ট হয়। দস্তুর মাফিক, সুতরাং প্রকাশ্যভাবে, ভারত যদি পূর্ব পাকিস্তান আক্রমণ করিতে পারে, তবে এক সপ্তাহেই দখল সমাপ্ত করিতে পারে। ১৯৫৫ সালে জেনারেল আইউবের এস্টিমেট ছিল ছয় দিন। ১৯৭১ সালের ভারতীয় বাহিনী ন দিনে এ কাজ সমাপ্ত করিয়াছিল। জেনারেল আইউবের আযে খুব ভুল ছিল না।

৩রা ডিসেম্বর পাকিস্তান সরকার ভারতের পাতা ফাঁদে পা দিয়া এই কাজটিই সহজ করিয়া দিলেন। পাকিস্তান আক্রমণ করা ভারতের উদ্দেশ্য ছিল না। শুধু পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন করাই তার উদ্দেশ্য ছিল। কাজেই ৩রা ডিসেম্বর শেষ রাত্রে ভারতীয় সৈন্যবাহিনী পশ্চিম-পাকিস্তানে হামলা করিল বটে, দ্রুতবেগে অনেক জমি দখলও করিল বটে, কিন্তু তাদের আসল উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশ মুক্ত করা। এই উদ্দেশ্যেই ভারত সরকার কালবিলম্ব না করিয়া স্বাধীন স্বার্বভৌম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলেন। বাংলাদেশের জনগণ পক্ষে থাকায় ভারতীয় বাহিনী অতি সহজেই এটা সম্পন্ন করিল। দুধ পাক-বাহিনীর এক লক্ষ সৈন্য কিছুই কাজে আসিল না। ভারতীয় বাহিনী ঝড়ের বেগে অগ্রসর হইতে থাকিল। আর সে ঝড়ের মুখে পাক-বাহিনী স্রোতের মুখে তৃণখন্ডের মত ভাসিয়া গেল। কথাটা নিতান্ত ভাষার অলংকার নয়। সত্য-সত্যই ভারতীয় বাহিনীর ৩রা ডিসেম্বরের হামলার দুই-তিন দিনের মধ্যেই, মানে ৬ই/৭ই ডিসেম্বর তারিখেই ঢাকার বিমানঘাটি নীরব হইয়া গেল। দুই একবারের বেশি আকাশ যুদ্ধ হইল না। বিমান-ধ্বংসী কামানের আওয়ায় একদিনেই নিস্তব্ধ হইয়া গেল। ভারতীয় বোমারু বিমান ঝাকে-ঝাকে একরূপ বিনা-বাঁধায় তেজগাঁও বিমান বন্দরে, কুর্মিটোলা বিমানঘাঁটিতে ও ছাউনিতে বেদেরেগ হামলা চালাইতে লাগিল। খোদ ঢাকা নগরীর উপর দিয়া, বলিতে গেলে আমাদের কানের কাছ দিয়া, ভারতীয় জংগী বিমান ভন ভন করিয়া উড়িয়া যাইতে লাগিল। কিন্তু শহরের অসামরিক অঞ্চলে বোমা ফেলিল না।

৬ই/৭ই ডিসেম্বরেই চৌগাছাসহ যশোর ছাউনি ও পূর্ব দিকে কুমিল্প ছাউনির পতন ঘটিল। ৮ই ডিসেম্বর হইতে ভারতীয় প্রধান সেনাপতি জেনারেল মানিকশাহ্ পাক-বাহিনীকে আত্মসমর্পণের আহবান জানাইলেন। পাক-বাহিনীর জিতিবার আর কোনও আশা নাই, আত্মসমর্পণ করা ছাড়া তাদের গত্যন্তর নাই, আত্মসমর্পণ করিলে জেনেভা কনভেনশন অনুসারে তাঁদের প্রতি সদ্ব্যবহার করা হইবে, ইত্যাদি ভাল-ভাল আশ্বাসবাণী দিয়া এই আত্মসমর্পণের আহ্বান সারাদিন আকাশবাণী হইতে পুনরুচ্চারিত হইতে লাগিল। ইংরেজী, উর্দু, বাংলা, পুশতু ভাষায় মুদ্রিত এই আহ্বানের লাখ লাখ কপি হাওয়াই জাহাজ হইতে ছড়ান হইতে লাগিল। পাক-বাহিনীও লড়াই ছাড়িয়া আত্মসমর্পণের জন্য প্রস্তুত হইতেছে, মনে হইল। কিন্তু আত্মসমর্পণ করিল না।

অবশেষে ১৪ই ডিসেম্বর ভারতীয় বিমান গবর্নর হাউস আক্রমণ করিল। গবর্নর ডাঃ এ. এম. মালিক ও তাঁর মন্ত্রিসভা পদত্যাগ করিয়া হোটেল ইন্টারকনে নিউট্রাল যোনে আশ্রয় নিলেন।

ঢাকার জনতা তখন রাস্তায় নামিয়া উল্লাস করিতেছিল। ঝাঁকে ঝাঁকে ভারতীয় বিমানের হামলার সময়েও জনতা রাস্তায় রাস্তায়, খোলা ময়দানে ও বাড়ির ছাদে ভিড় করিয়া তামাশা দেখিতেছিল। যেন বিমান মহড়া বা ঈদের চাঁদ দেখিতেছে। জনগণের উল্লাস-ধ্বনির মধ্যে ভারতীয় বাহিনী ১৬ই ডিসেম্বর ঢাকায় প্রবেশ করিল। পাক বাহিনী আত্মসমর্পণ করিল। ভারতীয় প্রধান সেনাপতি জেনারেল মানিকশার আশ্বাসমাফিক পাক-বাহিনীর সকলকে ভারতে নিয়া যাওয়া হইল ক্রুদ্ধ জনতার রোষ হইতে তাঁদেবোঁচাইবার উদ্দেশ্যে।

বাংলাদেশ স্বাধীন হইল। পাক-বাহিনীর দখলমুক্ত হইয়া বাংলাদেশের জনতা আনন্দ-উল্লাসের মধ্য দিয়া স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলিল।

স্বস্তি আসিল। কিন্তু শান্তি আসিল না। কারণ আমাদের প্রবাসী সরকার আরও ৮/১০ দিন কলিকাতা হইতে ঢাকায় আসিলেন না। তাঁদের অনুপস্থিতিতেই জনতা উল্লাস করিতে লাগিল। ভারতীয় সৈন্য ও সেনাপতিদের সাথে জনতা কোলাকুলি করিতে লাগিল। বহুদিন পরে দোকান-পাট খুলিল। সেসব দোকনপাট হইতে ভারতীয় সৈন্যদেকৃতজ্ঞতার উপহার দেওয়া হইল। সর্বত্র উল্লাস। এত উল্লাসের মধ্যে দোকানী ও জনতা একটা মজার অভিজ্ঞতা লাভ করিল। যালেম্বু পাঞ্জাবী সৈন্যের মতই এই বন্ধু ভারতীয় সৈন্যেরাও উর্দু ভাষায় কথা কয়, কি আশ্চার্য। ওরা তবে একই অঞ্চলের একই ভাষার লোক। কিন্তু ব্যবহারে কত পার্থক্য।

ঢাকায় তখন আরও সপ্তাহখানেক কোনও সক্রিয় সরকার বা তাঁদের শান্তি-রক্ষক বা আইন-কানুন প্রয়োগকারী শাখা-প্রশাখা ছিল না। মনে হয়, তার দরকারও ছিল না। জনতা ও নাগরিকদের সবাই যেন ঐ কয় দিনের জন্য ফেরেশতা হইয়া গিয়াছিল। চোর-ডাকাত, পকেটমার-দাংগাকারীরা সবাই যেন নিজেদের উপর চুয়াল্লিশ ধারা জারি করিয়াছিল।

ক্ষণিকের জন্য মনে হইল কার্ল মার্কস এ অবস্থাকেই বোধ হয় স্টেটলেস সোসাইটি বলিয়াছেন।

হঠাৎ মনে পড়িল : ওভার অল কমান্ডে ত ভারতীয় বাহিনী আছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *