৩১. পুনশ্চ

পুনশ্চ

১. কৈফিয়ত

‘আমার-দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’ বাহির হইবার পর দেশের রাজনীতিক জীবনে একটা বিরাট পরিবর্তন ঘটিয়াছে। সে পরিবর্তন আইউব শাহির অবসান। গণ আন্দোলনের ফলেই এই ডিক্টেটরের পতন ঘটিয়েছে। কিন্তু সে পতনের ফল জনগণ ভোগ করিতে পারে নাই। কারণ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয় নাই। পুনরায় মার্শাল ল প্রবর্তিত হইয়াছে।

কাজেই আমিও আমার বই-এর ‘পুনশ্চ’ লিখিতে বসিলাম। চিঠি-পত্রেই পুনঃ লেখার রেওয়াজ আছে। বই-এ পুস্তকে পুনশ্চ লেখার রেওয়াজ নাই। তবু পুস্তকটিকে আপ-টু-ডেট করিবার জন্যই এই ‘পুনশ্চ’ লেখা আবশ্যক হইয়া পড়িয়াছে। একটি আলাদা অধ্যায় না লিখিয়া ‘পুনশ্চ’ লিখিলাম কেন, বিভিন্ন পাঠক তার বিভিন্ন কারণ আৰিার করিতে পারেন। কিন্তু আমার নিজের বিবেচনায় কারণ মাত্র তিনটি।

এক, আমার বই এর শেষ অধ্যায়ের নাম কালতামামি। সে ‘কালতামামিতে’ আমি ‘ইন্টারিম রিপোর্ট দিয়াছি’, ‘ফাইনাল রিপোর্ট’ দেই নাই। তারপরে দুই বছর চলিয়া গিয়াছে। আরেকটা মার্শাল ল হইয়াছে। সেটা আজও চলিতেছে। তাই ফাইনাল রিশোরে সময় আসে নাই। পাকিস্তানের ইতিহাসেই নতুন অধ্যায় যোগ হয় নাই। এ অবস্থায় আমার বই-এ একটা নূতন অধ্যায় যোগ করা ভাল দেখায় না।

দুই, ইকারিম রিপোর্টকে ‘ফাইনাল রিপোর্ট’ না করা পর্যন্ত আরেকটা অধ্যায় লেখাও যায় না। শুধু আরেকটা অধ্যায় যোগ করার জন্যই যদি ‘ইনটারিম রিপোর্টকে’ ‘ফাইনাল রিপোর্ট’ করিতে চাই,তবে শেরে-বাংলার স্বনামধন্য আফিমুদ্দিন দারোগার ‘ফাইনাল রিপোর্টের মতই ফাইনাল রিপোর্ট লিখিতে হয়। পাঠকরা প্রায় সবাই আফিমুদ্দিন দারোগা সাহেবকে জানেন। শেরে-বাংলা তাঁর সন্তুর বছরের রাজনীতিক জীবনের হাজার-হাজার জনসভায় লক্ষ-লক্ষ শ্রোতার কাছে এই দারোগা সাহেবের ফাইনাল রিপোর্টের কথা বলিয়াছেন। তাতে দারোগা সাহেব হইয়াছেন যেমন মশহুর, তাঁর ‘ফাইনাল রিপোর্ট’টিও হইয়াছে তেমনি চিরস্মরণীয়। এই রিপোর্টে দারোগা সাহেব লিখিয়াছিলেন : ‘কেস টু নো ক্লু; সাইনড আযিমুদ্দিন।‘ আমার ইন্টারিম রিপোর্টকে ফাইনাল রিপোর্ট করিতে হইলে দারোগা সাহেবকেই অনুকরণ করিতে হয়। কারণ কেস মোটামুটি একই। কিন্তু ফার্দার ক্লু’র আশায় আমি তা করিলাম না। আমার রিপোর্টওফাইনাল হইল না। নয়া অধ্যায়ও লেখা হইল না।

তিন, আমাদের শাসকগোষ্ঠীর প্রায় সকলের স্বীকৃত মতেই পাকিস্তান রাষ্ট্র ও পাকিস্তানী জনগণ পুনঃ পুনঃ ধ্বংসের কাছাকাছি আসিয়া পড়িতেছে। প্রতিবারই একজন রক্ষা কর্তা আসিয়া আমাদের সে ‘আসন্ন ধ্বংস’ হইতে ‘রক্ষা’ করিতেছেন। কিন্তু প্রতিবারই আমরা ধ্বংসের অধিকতর নিকটবর্তী হইতেছি। প্রতিবারই পরের বারের রক্ষাকর্তা আসিয়া বলিতেছেন। এমন ঘোর সংকট পাকিস্তানের জীবনে আর হয় নাই। এ কথার তাৎপর্য এই যে আগের বারের রক্ষা-কা, যে পরিমাণ বিপদ হইতে আমাদিগকে রক্ষা করিয়াছিলেন, পরের বারের রক্ষাকর্তার সামনের বিপদ তার চেয়ে অনেক বেশী ঘোরতর। এ কথার মানে এই যে আগের বারের রক্ষা কর্তা, আমাদিগকে বিপদ হইতে রক্ষা করিতে গিয়া আরও বেশী বিপদে ফেলিয়াছেন। গোলাম মোহাম্মদ হইতে জেনারেল আইউব, জেনারেল আইউব হইতে জেনারেল ইয়াহিয়া সবাই পাকিস্তানকে আসন্ন ধ্বংসের হাত হইতে রক্ষাও যেমন করিয়াছেন, দেশকে তেমনি ধ্বংসের আরও কাছে পাইয়াছেন। দুই-দুইবারই মার্শাল ল’ প্রবর্তনের প্রয়োজন হইয়াছে। আগের বারে গোলাম মোহাম্মদ যা করিয়াছিলেন, সেটাও কার্যতঃ মার্শাল ল’ই ছিল। কাজেই দেখা যায় পুনঃ পুনঃ মার্শাল ল’ই আমাদের বরাত। বর্তমান মার্শাল ল’ উঠাইবার জন্য প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া স্পষ্টতঃই আন্তরিক চেষ্টা করিতেছেন। তা সত্ত্বেও আমাদের বরাতের দোষেই নেতাদের কার্য কলাপে ‘ঠকের বাড়ির নিমন্ত্রণে’র মত যা ঘটিতে পারে তারই নাম পুনশ্চ।

২. রাজনৈতিক ঘুর্ণীঝড়

১৯৪৮, ১৯৫৮, ১৯৬৮ এই তিনটি সালই আমাদের জাতীয় জীবনের জন্য বিভিন্ন ধরনের ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৪৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জাতির পিতা কায়েদে-আযমের আকস্মিক জীবনাবসান। দশ বছর পরে ১৯৫৮ সালের অক্টোবর মাসে পাকিস্তানে গণতন্ত্রের অবসান। আরও দশ বছর পরে ১৯৬৮ সালের অক্টোবর মাসে গণতন্ত্র হত্যাকারী জেনারেল আইউবের স্বৈরাচারের অবসান।

প্রথম দুইটি সাল সম্বন্ধে কোনও অস্পষ্টতা ও দ্বিমত নাই। কিন্তু তৃতীয়টির বেলা তেমন স্পষ্টতা নাই বলিয়া দ্বিমত হইতে পারে। দৃশ্যতঃ জেনারেল আইউকের পতন ঘটে ১৯৬৯ সালের মার্চ মাসে। কিন্তু যাঁরাই ঘটনাবলী অবলোকন পর্যবেক্ষণ ও অনুধাবন করিয়াছেন তাঁরাই জানেন যে ছয় মাস আগেই ১৯৬৮ সালের অক্টোবরে আইউবের পতন অবধারিত ও সুনিশ্চিত হইয়া গিয়াছিল। প্রেসিডেন্ট আইউবের ফুসফুসের সাংঘাতিক ব্যারামটা আসলে তাঁর অসুখের কারণ নয়, পরিণাম। আইউব বুদ্ধিমান ব্যক্তি। দেওয়ালের লিখন তিনি পড়িতে পারিয়াছিলেন। বিপদ আসন্ন তিনি বুঝিতে পারিয়াছিলেন অনেক আগেই। জুয়ারী যেমন ডেম্পারেট হইয়া মরি বাঁচি যা থাকে কপালে বলিয়া সর্বস্ব দিয়া শেষ ‘দান’ ধরে,আইউব তার শেষ ‘দান’ ধরিয়াছিলেন ‘উন্নয়ন দশকে’। ‘শেষ দানে’ জুয়ারীর ভাগ্য পরিবর্তনও হইতে পারে; আবার পতন ত্বরান্বিতও হইতে পারে। প্রেসিডেন্ট আইউবের বেলা এই পরেরটাই ঘটিল।

নিমজ্জমান তরী ভাসাইয়া রাখিবার উদ্দেশ্যে প্রেসিডেন্ট আইউব ‘উন্নয়ন দশক’ উত্যাপনের আয়োজন করিলেন বছরের শুরুতেই। আইউব ও তাঁর ফন্দিবায উপদেষ্টাদের সমবেত চেষ্টায় আয়োজনটাও হইল নিখুঁত। উদ্যাপনটাও চলিল বিপুল জাক-জমকে। বছর দীঘালি উৎসবের আয়োজন হইয়াছিল। খবরের কাগজের খরিদ করা পৃষ্ঠাকে-পৃষ্ঠায়, দালান-ইমারতের গাত্র-চূড়ায় অফিস-আদালতের ভিতর বাহিরে, সরকারী-বেসরকারী চিঠি-পত্রে, কভার-লেটারহেডে, রেলস্টেশনে ও বিমানবন্দরের আষ্টেপৃষ্ঠে, রাস্তা-ঘাটে, নদী-বন্দরে, ট্রেনে-বাসে, মানুষের বুকে-পিঠে, এক কথায় আসমান-জমিনের মধ্যেকার সকল স্থানে উন্নয়ন দশকের আগুন দাউ দাউ করিয়া জ্বলিয়া উঠিল। আগে কেউ বুঝিতে না পারিলেও এইবার সবাই বুঝিল, ‘উন্নয়ন’ সত্যই হইয়াছে। উন্নয়নের আলোকসজ্জায় রাত হইল দিন। কাজেই দিনও রাত হইবার সময় হইল আসন্ন।

ন বছরের নিরবচ্ছিন্ন জুলুম-সেতম, বঞ্চনা-প্রবঞ্চনা, নির্লজ্জ উন্নতশির দুর্নীতি, দুঃসাহসিক স্বজনপ্রীতি, রাষ্ট্রীয় তহবিলের বেপরোয়া ছিনিমিনি, জনমতের প্রতি গর্বিত বুড়া আংগুল প্রদর্শন ইত্যাদি-ইত্যাদি নজিরবিহীন সুশৃংখল অরাজকতা দেখিয়া পাকিস্তানের গণ-মন যখন স্তম্ভিত অসাড় ও নিষ্পন্দ, ঠিক সেই সময়ে কাটা ঘায়ে নূনের ছিটা দিয়া, জুতা মারার পরেও আরও অপমান করিয়া ও ‘মড়ার উপর খাড়ার ঘা’ মারিয়া প্রেসিডেন্ট আইউব ও তাঁর সহকর্মীরা দেশের সেই অসাড় নিস্পন্দ দেহে ইলেকট্রিক শক ট্রিটমেন্ট করিলেন। আগড়তলা মামলা এই থিরাপির শেষ বড় ডোয়। এর আশু ফল ফলিল। কুম্ভকর্ণের নিদ্রা ভংগ হইল। আসহাব-কাহাফের ঘুম টুটিল। তারা জাগিল। চোখ কচলাইতে-কচলাইতে নয়। চমকিয়া উঠিয়া। বিছানায় বসিয়া নয়। লাফ দিয়া দাঁড়াইয়া। ঘুমন্ত জনতার নিদ্রা ভংগ হয় এমনি করিয়াই।

ফল হইল এক বিস্ময়কর। অচিন্তনীয়। গণ-ঐক্যের ভাংগা কিল্লায় নিশান উড়িল। উন্নয়ন দশকের শেষ বছর শেষ হইবার আগের পাকিস্তানের রাষ্ট্র দেহের বিডি পলিটিক) বিভিন্ন প্ৰত্যংগে ব্রন ফোড়া ও ইপারশন দেখা দিল। মেলিগন্যান্ট টাইপের। শেষ পর্যন্ত গণ-বিক্ষোভের আকারে বিষফোড়া ফাটিয়া পড়িল। ১৯৬৮ সালের অক্টোবর হইতে ১৯৬৯ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত চার-চারটা মাস দেশবাসী কাটাইল সুখের দায় দুঃস্বপ্নের মধ্যে। একের পর আরেকটা বিক্ষোভের বিফোরণ ফাটিতে লাগিল উপরে নিচে ডাইনে বাঁয়ে।

শেষ পর্যন্ত ১৯৬১ সালের পয়লা ফেব্রুয়ারি প্রেসিডেন্ট আইউব ঘোষণা করিলেন রাজনৈতিক নেতাদের সাথে তিনি আলোচনা করিতে রাখী আছেন। এতদিনের ‘ধিকৃত ঘৃণিভজনগণ-কবর্জিত’ নেতাদের সাথে ডিক্টেটরআইউবের আলোচনা? দেশবাসী যা বুঝিবার বুঝিল। আইউবের ভক্তরাও কি বুঝিলেন না? নিশ্চয় বুঝিলেন। তাদের মধ্যে সন্ত্রাস সৃষ্টি হইল। ইতিমধ্যে রাজনীতিক নেতারা প্রায় সব দল মিলিয়া ডিমোক্র্যাটিক এ্যাকশন কমিটি (ডাক) গঠন করিয়াছিলেন। তাঁরা প্রেসিডেন্টকে জানাইলেন : আলোচনায় বসিতে তাঁরাও রাখী।

ভারপর ৫ই ফেব্রুয়ারি প্রেসিডেন্ট আইউব আরেক বিবৃতিতে ডাকের প্রেসিডেন্ট নবাবজাদা নসরুল্লা খাঁর দেশপ্রেমের মুখ-রা তারিফ করিয়া গোলটেবিল বৈঠকে নি+যোগ্য নেতাদের তালিকা করিবার ভার একচ্ছত্রভাবে তাঁর উপর দিয়া দিলেন। তিনি সে দায়িত্ব গ্রহণ করিলেন। ১৬ই ফেব্রুয়ারি সে কথা নবাবজাদা নসরুল্লা খাঁ ‘ডাকের’ পক্ষ হইতে যাবেদাভাবে প্রেসিডেন্ট আইউবকে জানাইয়া দিলেন। সবই চলিতে লাগিল ‘একডিং টু প্ল্যান’। এরমধ্যে কোথায় কি ঘটিল জানা গেলনা। হঠাৎ ২১শে ফেব্রুয়ারি (পূর্ব-বাংলার ভাষা-আন্দোলনের ঐতিহাসিক শহীদ দিবস এক অঘোষিত বেতার-ভাষণে সকলকে বিস্মিত করিয়া প্রেসিডেন্ট আইউব ঘোষণা করিলেনঃ তিনি প্রেসিডেন্ট পদের জন্য আর কনটেস্ট করিবেন না। তিনি সম্ভবত উপদিষ্ট হইয়াছিলেন যে এমন ঘোষণায় তাঁর বিরুদ্ধে জনগণের ক্রোধ প্রশমিত হইবে; বিক্ষোভ নরম হইবে। হয়ত কোনও-কোনও কোয়ার্টার হইতে অনুরোধ আসিবে না সার আপনি মেহেরবানি করিয়া অন্ততঃ আরেকটা টার্ম দেশবাসীকে নেতৃত্ব দান করুন। কিন্তু কেউ কিছু বলিলেন না। বিক্ষোভ নরম হওয়ার বদলে আরও গরম হইল। ভক্তবৃন্দের সন্ত্রাস দিশাহারা আতংকে পরিণত হইল। চাচা আপন বাঁচা বলিয়া ভক্তেরা ছুটাছুটি শুরু করিয়া দিলেন।

২৬শে ফেব্রুয়ারি গোলটেবিল বৈঠকের তারিখ আগেই স্থির করা হইয়াছিল। ন্যাপ-নেতা মওলানা ভাসানী ও পিপলস পার্টির নেতা জনাব তুই গোল টেবিলে যোগ দিবেন না জানাইলেন। আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান বৈঠকে যোগ দিতে রাধী হইলেন। কিন্তু আগড়তলা মামলার আসামী হিসাবে যোগ দিতে সম্মত হইলেন। ‘ডাক’ নেতারাও শেখ মুজিবকে ছাড়া আলোচনায় যোগ দিবেন না, জানাইয়া দিলেন। শেষ পর্যন্ত আগড়তলা মামলা প্রত্যাহার করিয়া শেখ মুজিবকে গোলটেবিলে যোগদানের ব্যবস্থা করা হইল। কারামুক্ত স্বাধীন ব্যক্তি হিসাবে শেখ মুজিবুর রহমান গোল টেবিলে যোগ দিলেন। তাঁর মর্যাদা ও জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী হইল।

নির্ধারিত দিন-ক্ষণে যথারীতি গোল টেবিল বৈঠক বসিল। যথারীতি পারস্পরিক শুভেচ্ছা ও তারিফ-তারুফের শিষ্টাচারের পর আসন্ন ঈদের দরুন সম্মিলনী মুলতবি হইল। ১০ই মার্চ পরবৰ্তী বৈঠকের দিন স্থির হইল।

দুইদিন আগেই ৮ই মার্চ লাহোরে নেতৃবৃন্দের প্রতি বৈঠক বসিল। একটি সর্বসম্মত দাবি রচনা করাই ঐ বৈঠকের উদ্দেশ্য। সে উদ্দেশ্যে একটি সাব কমিটিও গঠিত হইল। ফেডারেল পার্লামেন্টারি পদ্ধতি, সার্বজনীন প্রত্যক্ষ ভোট, জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রতিনিধিত্ব, পশ্চিম পাকিস্তানের ইউনিট বাতিল ইত্যাদি বিষয়ে নেতারা একমত হইলেন। কিন্তু আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন ও পশ্চিম পাকিস্তানের সাব-ফেডারেশন সম্বন্ধে তাঁরা একমত হইলেন না। শেষ পর্যন্ত মাত্র দুইটি বিষয়ে সর্বসম্মত একটি প্রস্তাব লইয়া নেতারা ১০ই মার্চ পিণ্ডিতে গোলটেবিলে যোগ দিলেন। সম্মিলনীর বৈঠক তিন দিন চলিল। নেতাদের মধ্যে প্রচুর মতভেদ দেখা দিল। প্রেসিডেন্ট আইউব ১৬ই মার্চ সম্মিলনীর সমাপ্তি ঘোষণা করিলেন। পরবর্তী কোন বৈঠকের ব্যবস্থা না করিয়াই এটা করা হইল। তার মানে অশুভ লক্ষণ। সম্মিলনী ব্যর্থ হইয়াছে। কনফারেন্স হল হইতে বাহির হইয়াই আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিব ‘ডাক’ হইতে প্রতিষ্ঠানের সম্পর্কচ্ছেদের কথা ঘোষণা করিলেন। তাঁর সাথে যেন পাল্লা দিয়াই ‘ডাক’ প্রেসিডেন্ট নবাবজাদা নসরুল্লা ‘ডাক’ ভাংগিয়া দেওয়া ঘোষণা করিলেন। দুই নেতার কেউই যাঁর-তাঁর পার্টির কোনও বৈঠক দিয়া অন্যান্যের মতামত জিগ্‌গাসা করিলেন না। তার আর দরকার হইল না। গোলটেবিল বৈঠরে ফলে বিভিন্ন দলের নেতাদের মধ্যে ঐক্য বৃদ্ধি পাওয়ার বদলে অনৈক্যই বৃদ্ধি পাইল। সেটা বুঝা গেল পরবর্তী কয়েক দিনের মধ্যে। গোল টেবিলের ব্যর্থতার জন্য তাঁরা পরস্পরকে দোষাদুষি করিতে লাগিলেন। এতদিনের এত ত্যাগের এত সাধনার গণ-ঐক্য ভাংগিয়া খান-খান হইয়া গেল।

কিন্তু কোন অজ্ঞাত কারণে নেতাদের এই অনৈক্যের সুবিধা প্রেসিডেন্ট আইউব পাইলেন না। নেতাদের অনৈক্য ছাত্র-জনতার মধ্যে সংক্রমিত হইল। গণ-আন্দোলন আর রাজনৈতিক আন্দোলন থাকিল না। হইয়া উঠিল তা অরাজনৈতিক উচ্ছৃংখলতা, বন্য হিংস্রতা। এ কারণে অথবা ফলস্বরূপ প্রেসিডেন্ট আইউব প্রধান সেনাপতি জেনারেল ইয়াহিয়াকে ২৪শে মার্চের লিখিত পত্রে দেশের শাসন-ভার গ্রহণের নির্দেশ দিলেন। বেতারে নিজের পদত্যাগের কথা ঘোষণা করিলেন।

১৯৬৯ সালের ২৫শে মার্চ আবার মার্শাল ল’ ঘোষিত হইল। জেনারেল ইয়াহিয়া চিফ মার্শাল ল এডমিনিস্ট্রেটর ও প্রেসিডেন্ট হইলেন। ‘৬২ সালের শাসন বাতিল হইল। চার মাসের মধ্যেই জুলাই মাসে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ঘোষণা করিলেন : তিনি অতিসত্বর দেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করিবেন। দেশময় সফর করিয়া সকল দলের নেতাদের সাথে আলাপ-আলোচনা করিয়া আরও চার মাস পরে ২৮শে নবেম্বর তিনি ঘোষণা করিলেন : আগামী ১৯৭০ সালের ৫ই অক্টোবর সার্বজনীন প্রত্যক্ষ ভোটে জনসংখ্যার ভিত্তিতে আইন-পরিষদ গঠিত হইবে। ইতিমধ্যেই ওয়ান ইউনিট ভাংগিয়া দেওয়া হইবে। নব-নির্বাচিত আইন-পরিষদ চার মাসের মধ্যে শাসনতন্ত্র রচনা করিতে বাধ্য থাকিবে। ঐ ঘোষণার চার মাস পরে ১৯৭০ সালের ২৮শে মার্চ তারিখে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া আগামী শাসনতন্ত্রের ফ্লেম ওয়ার্ক’ ঘোষণা করিলেন। তাতে তিনি কেন্দ্রীয় পরিষদের মোট সদস্য সংখ্যা ৩১৩ জন নির্ধারিত করিয়া দিলেন। পূর্ব-পাকিস্তানের জন্য তিনি ৭ জন মহিলা সদস্যসহ ১৬৯ জন ও পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রদেশের জন্য আলাদাভাবে ৭ জন মহিলা-সদস্যসহ মোট ১৪৪ জন মেম্বর নির্দিষ্ট করিয়া দিলেন। ঐ সংগে তিনি আরও ঘোষণা করিলেন যে ২২শে অক্টোবর তিনি পূর্ব-পাকিস্তান পরিষদের জন্য ১০ জন মহিলাসহ মোট ৩১০ ও পশ্চিম পাকিস্তানে বিভিন্ন প্রদেশের পরিষদের জন্য ১১ জন মহিলাসহ ৩২১ জন মেম্বর নির্ধারিত করিয়া দিয়াছেন। কেন্দ্রীয় আইন সভা গণ-পরিষদরূপে চার মাসে শাসনতন্ত্র রচনা শেষ করিবে। তার পরে মেজরিটি পার্টি বা কোয়েলিশন মন্ত্রিসভা গঠন করিবে। মার্শাল ল উঠিয়া যাইবে। নির্বাচিত সরকারের হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা হস্তান্তরিত হইবে। ইহাই বর্তমানে আমাদের দেশের নেট রাজনৈতিক পরিস্থিতি।

. আইউবের ভুল

জেনারেল আইউবের ভুল ভ্রান্তি ও স্বৈরাচারের সমালোচনা করিবার জন্য এই পুনশ্চের অবতারণা করা হয় নাই। আইউব আজ পরাজিত পদচ্যুত। তিনি আজ শক্তিহীন। সম্ভবতঃ অসুস্থ। আজ তাঁর নিন্দা করা অতি সহজ। সে জন্য আজ সবাই তাঁর নিন্দা করিতেছেন। নিন্দার তিনি যোগ্যও। কিন্তু আমার বিবেচনায় নিন্দার চেয়ে তিনি আফসোসের পাত্ৰই বেশি। তাঁর এক কালের সমর্থক অনুচররাও তাঁর নিন্দা করিতেছেন। এটা শুধু আইউবের দুর্ভাগ্য নয়। জাতিরও দুর্ভাগ্য। কারণ এতে আমাদের জাতীয় চরিত্র প্রকট। ক্ষমতায় থাকা পর্যন্ত যাঁরা অন্যায়কারীকে জিন্দাবাদ দেন, তাঁরা আসলে অন্যায়কারীর পূজা করেন না। নিজেদের স্বার্থেরই পূজা করেন। ওঁরাই যখন গদি চ্যুতির পর তাঁর নিন্দায় অন্য সবাইকে ছাড়াইয়া যান, তখনও তাঁরা দেশের স্বার্থে তা করেন না, নিজেদের স্বার্থেই করেন। এরা সাধারণ স্বার্থপর ক্ষুদ্র অন্তরের বিষয়ী মানুষ। সব দেশেই সব জাতিরই মধ্যেই এই ধরনের কিছু লোক থাকে। থাকিবেও। কারণ মানুষ মানুষই, ফেরেশতা নয়। পাকিস্তানের দুর্ভাগ্য এই যে এই ধরনের লোকের সংখ্যা অন্য দেশের চেয়ে বেশী। এত বেশী যে আইউবও তার পরিমাণ আন্দায করিতে পারেন নাই। পারিলে তিনি হুঁশিয়ার হইতে পারিতেন।

আইউবের দূর্ভাগ্য এই যে যে-দৃষ্টিশক্তির জোরে তিনি জনগণের অদৃশ্য অযোগ্যতা আবিষ্কার করিতে পারিলেন, তার জোরে তিনি নিজের অনুচরদের সুস্পষ্ট যোগ্যতা দেখিতে পারিলেন না। স্পষ্টতঃই তাঁর লং সাইটের মত শর্ট সাইটটা তেজী না। গোড়ায় তিনি পাকিস্তান রক্ষার জন্য নয়, বরঞ্চ ব্যক্তিগত ক্ষমতা-লোভেই, পদাধিকারের অপব্যবহার করিয়া রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করিয়াছিলেন। কিন্তু সে ক্ষমতা দখলের পরে তিনি সত্য-সত্যই দেশের ভাল করিতে পারিতেন। তিনি বুদ্ধিমান ছিলেন। তাঁর বিদ্যা-বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতা ছিল। একাদিক্রমে আট বছর পাকিস্তানের প্রধান সেনাপতি এবং ঐ সংগে প্রায় বছর খানেক দেশরক্ষা মন্ত্রী থাকার ফলে তাঁর একটা আন্তর্জাতিক ‘পুল’ গড়িয়া উড়িয়াছিল। ঐ সংগে তিনি একটা ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন। এতসব গুণের অধিকারী হইয়াও কোনও লোক নির্বিঘ্নে দশ বছর দেশ শাসন করার সুযোগ পাইলে তিনি ভাল না হইয়া পারেন না। গোড়াতে যতই খারাপ হউন, মহান দায়িত্বই তাঁকে মহৎ করিয়া তুলে। আইউবের দোষ এইখানে যে তিনি দশ দশটা বছরেও মহৎ হইয়া উঠিতে পারেন নাই। ক্ষমতা মানুষকে খারাপ করে, চূড়ান্ত ক্ষমতা চূড়ান্তভাবেই খারাপ করে। লর্ড এ্যাকটনের এই কথাটা আইউব আগেই জানিতেন নিশ্চয়। তাঁর মত বুদ্ধিমান বিদ্বান লোকের পক্ষে ক্ষমতার মোহে অন্ধ হওয়া উচিৎ ছিল না। তিনি বলিবেনঃ তাঁর স্বার্থপর স্তাবকেরা তাঁকে ভাল হইতে দেন নাই। তাঁর এতদিনের পূজারীরা বলিবেনঃ আইউবকে সুবুদ্ধি তাঁরা দিয়াছিলেন; আইউব তাঁদের পরামর্শ মানেন নাই।

দুই পক্ষের কথাই আংশিক সত্য আংশিক অসত্য। প্রথমতঃ স্তাবকের তুলনায় সুপরামর্শদাতার সংখ্যা ছিল নগণ্য। দ্বিতীয়তঃ সুপরামর্শ যাঁরা দিয়াছেন, তাঁরাও দেশ বা আইউবের ভালর জন্য দেন নাই, নিজেদের স্বার্থেই দিয়াছেন। কাজেই সুপরামর্শ হিসাবে ও-সবের কানাকড়ি দাম ছিল না। সভা-সমিতির জনতা দেখিয়া আইউব ঠিকই ভুল বুঝিয়াছিলেন যে ঐ বিপুল জনতা তার সমর্থক। সব ডিক্টেররাই কুস্তিগিরের মতই তামাশার বস্তু। তাঁরাও ঐ ভুল করিয়াছেন। কিন্তু এটাও তাঁরা জানিতেন যে স্তাবক-অনুচররা সবাই নিজ নিজ স্বার্থের জন্যই তাঁদের স্তাবকতা করিতেছেন। আইউবের ল হইয়াছিল এইখানে যে এত এত স্বার্থপর লোকের মধ্যে বাস করিয়াও তিনি নিজের আসল স্বার্থটা বুঝিতে পারেন নাই। তাঁর আসল স্বার্থ ছিল দেশবাসীর ভাল করিয়া নিজেকে অমর করা। রাষ্ট্রের সব ক্ষমতা তাঁর মধ্যে কেন্দ্রীভূত গোটা জাতির ভাগ্য তাঁর হাতে নিহিত। এই হিসাবে তাঁর ভালমন্দ জনগণের ভাল-মন্দের সাথে ওতপ্রোতভাবে গ্রথিত। তিনি একা এখানে সমস্ত স্তাবক হইতে পৃথক। স্তাবকেরা তাঁর কাঁধে বন্দুক রাখিয়া যাঁর-তাঁর স্বার্থের পাখি মারিয়া যাইতেছেন। সব রাষ্ট্র-ক্ষমতা তাঁর হাতে কেন্দ্রীভূত থাকায় দেশের অনিষ্টের জন্য তিনি ছাড়া আর কেউ দায়ী নন। এই অবস্থা ও পরিবেশেই তিনি স্তাবকদের স্বার্থ শিকারের বন্দুকটা নিজের কাঁধে লইয়ছিলেন। এইখানেই তিনি ছিলেন স্তাবকদের অনুসারী। স্তাবকরা তাঁর অনুসারী ছিলেন না। স্তাবকদের কথা না রাখিয়া তাঁর উপায় ছিল না।

সব ডিক্টেটরের পরিণতি এই। গোড়াতে তাঁরা সত্যিই ডিক্টেটর থাকেন। কিন্তু শেষ দিকে ডিক্টেটররা হইয়া পড়েন অনুচরদের দ্বারা ডিক্টেটেড। ক্ষমতা, স্বার্থ ও সম্পদ হাসিলের পর ডিক্টেটররা ও-সব রক্ষার জন্যই স্তাবক-অনুচদের উপর নির্ভরশীল হইয়া পড়েন। ওরা তখন হইয়া উঠেন ডিক্টটরের সব ক্ষমতা ও সম্পদের শরিক। কাজে-কর্মে ব্যবহার-আচরণে ওরা তখন ডিক্টেটরকে বুঝাইয়া দেন তাঁরাও ঐ ক্ষমতা ও সম্পদের অংশ চান। ‘না’ বলিবার তখন উপায় থাকে না। দিতেই হয় তা যত অন্যান্য পন্থায় হউক না কেন? অবস্থা শেষ পর্যন্ত এমন দাঁড়ায় যে বিবেকের দংশনে অথবা পরিতৃপ্তিতে ডিক্টেটর যদি ক্ষমতা ও সম্পদ বর্জন করিতে চান, তিনি তা পারেন না। ডিক্টেটর তখন বড় দেরিতে বুঝিতে পারেন যে তিনি নিজেই ডিক্টেটরি যন্ত্রের গোলাম হইয়া পড়িয়াছেন। তিনি আর সে যন্ত্র চালান না। যন্ত্রই এখন তাঁকে চালায়। তিনি ক্ষুধার্ত সিংহের পিঠের সওয়ার। সে পিঠ হইতে নামার আর উপায় নাই। নামিলে তাঁর বাহন ঐ সিংহই তাঁকে খাইয়া ফেলিবে। সব ডিক্টেটরই পরিণামে এমনি করিয়া নিজের শিকার নিজেই হইয়া পড়েন।

আইউবের সবচেয়ে মারাত্মক ভুলটা হইয়াছিল এই যে তিনি জনগণকে না চিনিয়া তাদের পরিচালক হইতে গিয়াছিলেন। দেশবাসীকে ঘৃণা করিয়া তিনি দেশের নেতা বনিতে চাহিয়াছিলেন। জনতার সমবেত বুদ্ধির চেয়ে নিজের বুদ্ধিকে শ্রেষ্ঠ মনে করুন যাঁরা, তাঁরা দুই রকমে মানুষের নেতা হইতে পারেন। এক, বই-পুস্তক লিখিয়া তাঁরা চিন্তা-নায়ক হইতে পারেন। দুই, ত্যাগ ও সংগ্রামের পথে সশরীরে গণ-যুক্তি আন্দোলনের নেতৃত্ব করিতে পারেন। সারাজীবন সুখের সরকারী চাকরি করিবেন, পান হইতে চুনটি খসিতে দিবেন না, আর শেষ জীবনে জোর করিয়া রাষ্ট্র-নায়ক হইবেন, তা হয় না। আইউব তাই করিতে চাহিয়াছিলেন। অমন চিন্তা-নায়ক, সফল অফিসার ও অভিজ্ঞ রাজনীতিক সবই দেশের জন্য দরকার। কিন্তু একের কাজ অপরের সাজে না।

৪. আগড়তলা ষড়যন্ত্র মামলা

জেনারেল আইউবের সর্বশেষ ও সব চেয়ে আত্মঘাতী ভুল হইয়াছে, তথাকথিত আগড়তলা ষড়যন্ত্র মামলা করা। যদি মামলায় বর্ণিত সব বিবরণ সত্য হইত, তবু আইউব সরকারের এই মামলা পরিচালনা করা উচিত হইত না। দেশরক্ষা বাহিনীর পূর্ব-পাকিস্তানী অফিসারদের বিরুদ্ধে সে অবস্থায় বিভাগীয় দণ্ডবিধান করিলেই যখে হইত। তানা করিয়া ঢাক-ঢোল পিটাইয়া পূর্ব-পাকিস্তানী অফিসারদের বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলা স্বাধীন করিবার অভিযোগে একটা রাজনৈতিক চাঞ্চল্যকর মামলা দায়ের করা হইল। তার উপর মামলার তদন্তাদি কার্য শেষ করিয়া আসামীদের বিরুদ্ধে চার্জশিট করিবার পর পূর্ব-বাংলার সবচেয়ে জনপ্রিয় সর্বাপেক্ষা নির্যাতিত এবং তথাকথিত ঘটনার সময়ের আগাগোড়া জেলখানায় বন্দী, তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে নূতন করিয়া মামলার আসামী ত করা হইলই, এক নম্বর আসামী করা হইল। এই একটি মাত্র ঘটনায় মামলাটির অন্তর্নিহিত রাজনৈতিক দূরভিসন্ধি ধরা পড়িল। তিন তিনজন সিনিয়ার পূর্ব-পাকিস্তানী সি. এস. পি. অফিসারকে কেন আসামী করা হইয়াছিল, মুজিবুর রহমানকে আসামী করা হইতে গণ-মনে তা সুস্পষ্ট হইয়া পড়িয়াছিল। তিনজন সি. এস. পি অফিসারই কেন্দ্রীয় সরকারের সেক্রেটারি হইবার যোগ্যতা অর্জন করিয়াছিলেন। বিশেষতঃ ঐ তিন জনের মধ্যে একজন তাঁর মনীষা পাণ্ডিত্য ও শিষ্টাচারের জন্য অফিসারদের মধ্যে এবং সাধারণ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় শ্রদ্ধেয় ও সম্মানিত ব্যক্তি ছিলেন। তার উপর ইনি হইলেন পূর্ব বাংলার সবচেয়ে জনপ্রিয় সাবেক প্রধান মন্ত্রী জনাব আতাউর রহমান খাঁর কনিষ্ঠ সহোদর। এইভাবে এই মোকদ্দমা বাংগালী মিলিটারি অফিসারদেরেই শুধু নয় পূর্ব বাংলার সবচেয়ে জনপ্রিয় দুইজন রাজনৈতিক নেতাকেই কার্যতঃ পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার ষড়যন্ত্রে জড়ান হইল। এটা ত গেল মামলার বিশ্রী চেহারার দিক।

পরিবেশ ও সময়টাও ছিল তেমনি বিষ্ফোরক। অবস্থাগতিকে মার্শাল-লর প্রেসিডেনশিয়াল শাসনটা চেহারা ও প্রকৃতিতে হইয়া পড়ে পূর্ব-পাকিস্তানীদের উপর পশ্চিম পাকিস্তানীদের সার্বিক ও সামগ্রিক শাসন। তার উপর প্রেসিডেন্ট আইউব মাত্র কয়েকদিন আগে পূর্ব-পাকিস্তানীদেরে ভারতের আদিম অধিবাসী ধর্ম-কৃষ্টিতে হিন্দু প্রভাবিত স্বাধীনতায় অনভ্যস্ত ও স্বায়ত্তশাসনের অযোগ্য নাহক সন্দেহরায়ণ ক্ষুদ্র অন্তঃকরণের লোক ইত্যাদি বলিয়া গালি দিয়াছিলেন। দুই অঞ্চলের অধিবাসীদের মধ্যে শুধু আর্থিক ও রাজনৈতিক অসাম্যই সৃষ্টি করেন নাই, গৃহযুদ্ধ ও অস্ত্রের যুক্তিরও ডর দেখাইয়া দুই পাকিস্তানের অধিবাসীদের মধ্যে আমর-তোমরা মনোভাব তীব্র করিয়াছিলেন। এমনি সময়ে এবং এই পরিবেশে আগড়তলা মামলা দায়ের করায় পূর্ব বাংলায় দল-মত নির্বিশেষে জনগণের মনে এই প্রতিক্রিয়া হইল যে গোটা পূর্ব বাংগালীর বিরুদ্ধেই এই মামলা দায়ের করা হইয়াছে। সকল দলের রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে অমন সংঘবদ্ধ প্রতিরোধের ভাব গড়িয়া উঠিল যে তাঁরা প্রায় সমস্বরেই বলিলেন : আগড়তলা মামলা প্রত্যাহার না করা পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট আইউব-প্রস্তাবিত গোলটেবিল বৈঠকে তাঁরা যোগ দিবেন না। ছাত্র-জনতার ফাটিয়া পড়া বিক্ষোরে সামনে নেতাদের অমন করা ছাড়া গত্যন্তর ছিল না।

নিখিল-পাকিস্তান গণ-আন্দোলনের অংশ হিসাবেই পূর্ব-বাংলার ছাত্র তরুণদের নেতৃত্বে এই সার্বজনীন গণ-আন্দোলন চলিতেছিল। আগড়তলা মামলা এই আন্দোলনের বহিতে বিশেষ ইন্ধন যোগাইল।

শেষ পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট আইউব গণ-আন্দোলনের চাপে জন-মতের সামনে মাথা হেট করিলেন। আগড়তলা মামলা প্রত্যাহৃত হইল। বড় দেরিতে জন-মতের সামনে মাথা হেট করিয়া মামলা প্রত্যাহার করা হইয়াছিল বলিয়াই একজন সম্মানিত বিচারপতিকে অপমান সহিতে হইয়াছিল। ঐ বেশি দেরি হওয়ার কারণেই জন মতের কাছে আইউবের মাথা হেট করাটা যথেষ্ট গ্রেসফুল হয় নাই। তাই আইউবের পতন তাতে প্রতিরুদ্ধ হয় নাই। ব্যক্তি বিশেষের পতনে জাতির বিশেষ কিছু আসে যায় না। আইউবের পতনেও আসিয়া যাইত না। কিন্তু জাতির দুর্ভাগ্য এই যে ঘটনাটা দুই অঞ্চলের মধ্যে তিক্ততা দুরপনেয় করিয়া তুলিয়াছে। এইদিক হইতে আইউবের আমলটা হইয়া পড়িয়াছে পাকিস্তানের ইতিহাসের সবচেয়ে অন্ধকার যুগ।

. নেতাদের ভুল

পাকিস্তানের সমস্ত দুর্ভাগ্যের জন্য দায়ী দেশের নেতৃবৃন্দ, এ কথা পুনরাবৃত্তির অপেক্ষা রাখে না। পাকিস্তানের মত এমন সমস্যাহীন নয়া রাষ্ট্র আর হয় না। এক ভৌগোলিক সমস্যা ছাড়া বলিতে গেলে পাকিস্তানের আর কোন সমস্যাই ছিল না। একটু বুদ্ধি খরচ করিয়া গণতান্ত্রিক পন্থাতেই এ সমস্যার সমাধান করা যাইত। তা না করিয়া নেতারা কেকল নিত্য-নতুন সমস্যা সৃষ্টিই করিয়া গিয়াছে। ফলে আজ আমাদের জাতীয় জীবনে সমস্যার অন্ত নাই।

নেতাদের গোড়ার ভুল এই যে যে-একক মনীষা ও নেতৃত্বের বলে তাঁরা পাকিস্তান পাইলেন, সেই কায়েদে-আযমের ওসিয়তের বরখেলাফে পাকিস্তানের রাজনীতিকে তারা ভুল পথে চালাইলেন। নেশন-স্টেট হিসাবে পাকিস্তান গড়িবার প্রথম শর্ত যে পাকিস্তানী নেশন তৈয়ার করা, তাই তাঁরা করিলেন না। ফলে নেতারা নিজেরা গণতন্ত্রী হইলেন না। জনগণকে গণতন্ত্রের পথে শক্তিশালী করিলেন না। তার অবশ্যম্ভাবী পরিণাম স্বরূপ সরকারী কর্মচারিরা রাজনীতি করিতে লাগিলেন। নেতারাই তাঁদেরে রাজনীতি করাইলেন। অবস্থা-গতিকে সরকারী কর্মচারিরাই আমাদের দেশে শিক্ষিত সম্প্রদায়ের ক্রিম। ক্ষমতাসীন অফিসার ও রাজনৈতিকের মধ্যে একমাত্র পার্থক্য এই যে একজন নিয়োজিত আরেকজন নির্বাচিত। বিনা-নির্বাচনের রাজনীতিই যদি করিতে হয়, তবে আর অপেক্ষাকৃত কম ডিগ্রীধারী পলিটিশিয়ানদের নেতৃত্ব কেন? অপেক্ষাকৃত উচ্চ ডিগ্রিওয়ালা অফিসাররাই ভাল। অতএব তাঁরা নিজেরাই রাষ্ট্রনায়কত্ব গ্রহণ করিয়াছেন। স্থায়ী সরকারী কর্মচারিদের যে-রাজনৈতিক নিরপেক্ষতাই পার্লামেন্টারি শাসনতন্ত্রের বুনিয়াদ, পাকিস্তানে আজ সে বুনিয়াদই ভাংগিয়া পড়িয়াছে। সরকারী কর্মচারি অপেক্ষা রাজনৈতিক নেতাদের দোষেই এটা ঘটিয়াছে।

পলিটিশিয়ানদের এই দুর্বলতাই দেশের প্রধান সেনাপতির পক্ষে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের পথ পরিষ্কার করিয়া দিয়াছে। তাঁদের এই দুর্বলতাই আইউবী আমলকে দশ বছরস্থায়ীকরিয়াছে। এই নিরংকুশ একনায়কত্বের দরুন আইউব তাঁর উন্নয়ন দশকে শাসনযন্ত্রের সমস্ত কাঠামোই এমন তছনছু করিয়াছেন যে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার পর এর সবগুলিই আবার কেচে গণ্ডুষ করিতে হইবে।

কিন্তু কাজটা শুধু কঠিন নয়। প্রায় অসম্ভব। অবাধ্যতা, উচ্ছংখলতা কর্তব্যে অবহেলা, স্তাবকতা, উচ্চাকাংখা, রেষারেষি ও স্বজনপ্রীতি সব মিলিয়া আজ আমাদের শাসনযন্ত্র ঘূণে ঝর-ঝরা হইয়া গিয়াছে। ভাংগিয়া পড়ার অবস্থা। সাম্প্রতিক কালে বর্তমান শাসনামলে ৩০৩ জন উচ্চপদস্থ কর্মচারির আচরণই তার প্রমাণ। এ সম্পর্কে আমার নেতা শহীদ সাহেবের একটা কথা মনে পড়িতেছে। ১৯৬১ সালের শেষের দিকে একবার তাঁকে জানান হয় যে পশ্চিমা গণন্ত্রী দেশ সমূহের চাপে জেনারেল আইউব গণতন্ত্র পুনঃপ্রর্বতনে রাযী হইয়াছেন এবং তারই প্রথম পদক্ষেপ হিসাবে শহীদ সাহেবের নেতৃত্বে বিভিন্ন দলের নেতাদের হাতে ক্ষমতা ফেরত দিতে রাযী হইয়াছেন। অবশ্য শহীদ সাহেবের এন্তেকালের পরে আইউব সাহেব তার প্রভু নয় বন্ধু বই-এ এই গুজবের তীব্র প্রতিবাদ করিয়াছেন। কিন্তু গুজবটার সত্য মিথ্যা বিচার করে এর উল্লেখের উদ্দেশ্য নয়। শহীদ সাহেবের অভিমতটাই এখানে বিচার্য। তিনি এ অফার আসিবার খবর পাইয়া আমাদের সকলের সাথে সমবেত ও পৃথকভাবে আলোচনা করেন। তাঁর জিগগাস্য ছিলঃ অমন অফার আসিলে তিনি সে দায়িত্ব নিবেন কি না? আমরা সবাই প্রায় এক বাক্যে বলিলাম : যে রাষ্ট্রক্ষমতা পুনরুদ্ধারের জন্য আমরা প্রত্যক্ষ সংগ্রাম ও গণ-আন্দোলনের কথা ভাবিতেছি, আইউব সেটা স্বেচ্ছায় ফিরাইয়া দিতে চাহিলে তা না নেওয়া হইবে জনগণের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা। এই যুক্তিতে আমরা সর্বসম্মত রায় দিলাম : তেমন অফার আসিলে তা নিতেই হইবে। তখন শহীদ সাহেব বলিলেন : এই তিন বছরে আইউব শাসনযন্ত্রে এমন অচিন্তনীয় বিশৃংখলা ঢুকাইয়াছেন যে আমার ভয় হয়, শাসন-তার হাতে নিয়া আমরা গণতান্ত্রিক মামুলি উপায়ে সরকার চালাইতে পারি না; কঠোর হস্তে এমন ওলট-পালটের দরকার হইবে যে এক পার্টি-ডিক্টেটরশিপ ছাড়া তেমন কঠোরতা সম্ভব নয়। তেমন অবস্থা আমাদের দেশে নাই। করিতে গেলে গণতন্ত্র থাকিবে না।

লিডারের কথায় ও মুখ-তাবে অমন অতি নৈরাশ্য দেখিয়া ব্যক্তিগতভাবে আমি দুঃখিত হইয়াছিলাম। সৌভাগ্য বশতঃ আইউব শেষ পর্যন্ত তেমন অফার দেন নাই।

শহীদ সাহেব যখন এ-কথা বলিয়াছিলেন, তারপরে আরও সাত বছর আইউবের ঐ ডিক্টেটরি চলিয়াছে। শাসনযন্ত্রে আরও বেশী ঘূণে ধরিয়াছে। শহীদ সাহেবের ঐ আশংকার কারণ গভীরতায় ও ব্যাপকতায় আরও বাড়িয়াছে। শাসনযান্ত্রিক ব্যাপারেও ব্যক্তিগতভাবে আমি শহীদ সাহেবের মতের মূল্য বরাবরই দিতাম। চিন্তার সেই অভ্যাস বশতঃই আজও আমার মনে হয়, আমাদের শাসন মেরামতের স্তর পার হইয়া গিয়াছে। জেনারেল ইয়াহিয়ার আন্তরিক চেষ্টায় গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠার শুভ দিন যতই আসন্ন হইতেছে, গণতান্ত্রিক পাকিস্তানের সুখ-সৌভাগ্যের কথা ভাবিয়া যতই উৎফুন্ন হইতেছি, কল্যাণমূলক রাষ্ট্র জনগণের জীবনের রংগীন ছবির গোলাবী কল্পনায় যতই রোমাঞ্চ বোধ করিতেছি, শাসনযন্ত্রে উচ্ছংখলতার দিকে চাহিয়া ততই আতংকিত হইতেছি। সত্যই কি শাসনযন্ত্রে বিপ্লবী পরিবর্তন না আনিলে নির্বাচিত সরকার জন কল্যাণের কিছু করিতে পারিবেন না? গণতন্ত্র কি এবার সত্য-সত্যই ফেল করিবে? যদি তাই হয় তবে তার প্রতিকারের জন্য সুশৃংখল সংঘবদ্ধ আদর্শবাদী তেমন শক্তিশালী পার্টি ডিক্টেটরশিপ পাইব কোথায়?

এমনি জটিল সমস্যার সামনে দেশকে নিক্ষেপ করিয়াছে জেনারেল আইউবের দশ বছরস্থায়ী ব্যক্তি-ডিক্টেটরশিপ। পার্লামেন্টারি আমলে এ বিপদ আমাদের ছিল না। যতই অযোগ্য ও দিশাহারা হউন আমাদের পার্লামেন্টারি নেতারা পার্লামেন্ট অফিশিয়ালদেরে অত খারাপ করিতে পারেন নাই। অধিকাংশ অফিসারই তখন বৃটিশ ঐতিহ্যের রাজনীতিক নিরপেক্ষতা রক্ষা করিয়া চলিয়াছেন।

ব্যক্তি-ডিক্টেটরশিপ ও পার্টি-ডিক্টেটরশিপ উভয়টাতেই অসাধারণ মনীষার দরকার। গণতন্ত্র অসাধারণ প্রতিভাধর নেতৃত্বের দরকার নাই। এইখানেই ডিক্টেটরশিপের চেয়ে গণতন্ত্র শ্রেষ্ঠ। আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে গণতান্ত্রিক চেতনার অভাবই গণতন্ত্রকে ডিক্টেটরশিপের পদানত করিয়াছিল।

রাজনৈতিক নেতাদের অন্তর্নিহিত এই দুর্বলতার জন্যই আইউবী স্বৈরাচারের অবসান করিতে দশ বছর লাগিয়াছে। এটাও করিয়াছে প্রধানতঃ ছাত্র-তরুণদের নেতৃত্বে জনসাধারণ। নেতাদের কৃতিত্ব এতে সামান্যই আছে। নিঃস্বার্থ সংগ্রামী ছাত্র তরুণদের নেতৃত্বের গণআন্দোলনের ফলে ডিক্টেটর আইউব মাথা নত করিতে বাধ্য হইলেন। তিনি নেতাদের সাথে গোল টেবিল বৈঠকে বসিতে রাযী হইলেন। দেশের নেতৃত্বের ঐ অন্তর্নিহিত দুর্বলতাই শেষ পর্যন্ত গোল টেবিল বৈঠক ব্যর্থ করিয়া দিল।

গোলটেবিল বৈঠক ফেল হইবার অনেক কারণ ছিল। তার মধ্যে সবচেয়ে বড় কারণ এই যে এটা আসলে গোলটেবিল সম্মিলনীই ছিল না। প্রেসিডেন্ট আইউব ও নেতাদের কেউই এই সম্মিলনীর প্রাপ্য মর্যাদা তাকে দেন নাই। এটাকে জাতির ভাগ্য নির্ধারণের একটা পবিত্র ঘটনা বলিয়া কেউ মনেই করেন নাই। করেন নাই বলিয়াই এই সম্মিলনীর কোন সিরিয়াস প্রস্তুতি ও ম্যাজিষ্টিক গাম্ভীর্য ছিল না। একদিকে প্রেসিডেন্ট আইউব ফাটিয়া-পড়া গণ-আক্রোশের মুখে। আত্মরক্ষার তাগিদে রাজনৈতিক নেতাদের সাথে একটা যাবে-তাবে বোঝাঁপড়া করিতে চাহিয়াছিলেন যত পারেন কম দাম দিয়া। অপর দিকে ক্ষুধার্ত নেতারা প্রেসিডেন্ট আইউবের বর্তমান বিপদের সুযোগে গদি দখল করিতে চাহিয়াছিলেন যতটা পারেন বেশী দাম আদায় করিয়া। উভয়পক্ষের মনেই ছিল ত্রস্ত-ব্যস্ততার তাগিদ। তাঁদের প্রতি কাজে যে ব্যস্ততা ফাটিয়া পড়িতেছিল। একদিকে কনফারেন্সে সমবেত নেতাদের সাথে আন্দোলনের ম্পিয়ারহেড ছাত্র-জনতার কোন যোগাযোগ ছিল না। নেতারা আন্দোলনকে শক্তিশালী সুসংহত ও নিয়ন্ত্রিত করিবার কোন চেষ্টাই করেন নাই। এইভাবে আন্দোলনে নেতাদের কোন অবদান ছিল না বলিয়া স্বভাবতঃই তার উপর কোনও প্রভাব তাঁদের ছিল না। ছিল না বলিয়াই কনফারেন্সের মূদ্দতের জন্য কোনও আর্মিস্টিস্‌ও ঘোষণা করেন নাই। এদিকে নেতাদের ব্যস্ততা ও তাড়াহুড়ায় ছাত্র-তরুণরা স্বভাবতই সন্দিগ্ধ হইয়া পড়ে। তাদের আশংকা হয়, নেতাদের অনেকেই গদির দামে গণতন্ত্র ও গণ-স্বার্থ বিক্রয় করিয়া আইউবের সাথে আপোস করিয়া ফেলিতেছেন। মওলানা ভাসানী ও মিঃ জুলফিকার আলী ভুট্টোর মত জনপ্রিয় নেতৃদ্বয় সম্মিলনীতে যোগ না দেওয়ায় ছাত্র-তরুণ ও জনতার এই সন্দেহ আরও দৃঢ় হয়। কাজেই সম্মিলনীর বৈঠক চলিতে থাকা অবস্থায়ও দেশের সার্বিক কল্যাণের কথা চিন্তা করিবার ও সুষ্ঠু সিদ্ধান্ত নিবার উপযুক্ত আবহাওয়া সম্মিলনীর বৈঠকে বা বাহিরে দেশের মধ্যে সৃষ্ট হয় নাই।

এ ভুলটা প্রধানতঃ নেতাদের। প্রেসিডেন্ট আইউবের ভুল ততটা নয়। প্রেসিডেন্ট আইউব স্বভাবতঃই অতিমাত্রায় ত্রস্ত-ব্যস্ত হইয়া পড়িয়াছিলেন। কিন্তু নেতারা ইচ্ছা করিলেই তার প্রতিকার করিতে পারিতেন। সম্মিলনীতে কাকে-কাকে দাওয়াত দিতে হইবে, তা ঠিক করিবার তার প্রেসিডেন্ট নেতাদের উপর সম্পূর্ণরূপে ছাড়িয়া দিয়াছিলেন। সে দায়িত্ব পালনে নেতারা চরম শোচনীয় অযোগ্যতার পরিচয় দিয়াছেন। সে অযোগ্যতার ও অদূরদর্শিতার সবচেয়ে বড় প্রমাণ এই যে সম্মিলনীতে (১) কোনও মাইনরিটি প্রতিনিধিকে, (২) কোনও নারী প্রতিনিধিকে দাওয়াত দেওয়া হয় নাই। পাকিস্তানের বারকোটি অধিবাসীর মধ্যে দেড়কোটি মুসলমান। পূর্ব পাকিস্তানে এরা গোটা বাসেন্দার প্রায় এক-পঞ্চমাংশ। মুখে এদেরে সমান-অধিকারভোগী নাগরিক বলা হয়। গত দুই-দুইটা শাসনতন্ত্রেই এদের সকল প্রকার নাগরিক অধিকারের সুস্পষ্ট বিধান করা হইয়াছে। পার্লামেন্টারি আমলের কয়েক বছর কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারে যথেষ্ট-সংখ্যক মাইনরিটি মন্ত্রী নেওয়া হইত। তাঁরা সকলেই যোগ্যতা ও আনুগত্যের সাথে মেম্বরগিরি ও মন্ত্রিগিরি করিয়াছেন। কিন্তু ১৯৫৮ সালে মার্শাল ল হওয়ার পর হইতে এগারটি বছর পাকিস্তানের রাজনীতি হইতে গোটা মাইনরিটি সম্প্রদায় মুছিয়া গিয়াছে। এই দশ বছরে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় ও আইন পরিষদে একজন হিন্দুরও স্থান হয় নাই। পূর্ব পাকিস্তানের মন্ত্রিসভায় প্রায় দুই ডজনের মধ্যে একজন মাত্র অমুসলমান মন্ত্রী কিছুদিনের জন্য নেওয়া হইয়াছিল। শিক্ষা-দীক্ষায় উন্নত, দেশের স্বাধীনতার জন্য যুগ-যুগ ধরিয়া উৎসগীকৃত-প্রাণ, চরম প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও আজও পাকিস্তানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে জনসেবায় নিযুক্ত হিন্দুদের প্রতি এমন উপেক্ষা অবহেলা দেখাইয়া আমরা কিরূপে তাঁদের মনে পাকিস্তানী জাতির অনুগত ও গর্বিত মেম্বর হিসাবে ‘আমরাত্ব’ ও ‘আমাদেরত্ব’ সৃষ্টি আশা করিতে পারি? অবশ্য গত এগার বছরের ব্যাপারের জন্য গণন্ত্রী নেতারা দায়ী ছিলেন না। ডিক্টেটর আইউবের খেয়াল খুশী মতই রাষ্ট্র চলিয়াছে। মানিলাম। কিন্তু এ বঞ্চনা ও মাইনরিটির প্রতি এই অবিচারের প্রতিকারের প্রথম সুযোগ ছিল গোল টেবিল বৈঠকের আয়োজন। সেখানে নেতারা কি করিয়াছেন? প্রেসিডেন্ট আইউব নেতাদের হাতেই নিমন্ত্রিতদের সংখ্যা, প্রকৃতি ও নাম ঠিক করিবার ভার দিয়াছিলেন। রাউও টেবিল সফল হউক বা বিফল হউক, তাঁর কোনও ক্ষমতা থাকুক বা না থাকুক, গোটাজাতির রাজনৈতিক ভাগ্য নির্ধারণের মহান উদ্দেশ্য লইয়াই ঐ সম্মিলনী বসিয়াছিল। পাকিস্তানের শতকরা দশজন ও পূর্ব পাকিস্তানের শতকরা বিশজন অধিবাসীকে বাদ দিয়া, আলোচনায় শরিক না করিয়া, জাতির ভাগ্য নির্ধারণ করা উচিত বা সম্ভব, নেতারা কি রূপে তা ভাবিতে পারিলেন?

তারপর ধরুন, নারীর প্রতিনিধিত্বের কথা। আর আর দেশের মতই পাকিস্তানেও নারী-পুরুষের সংখ্যা সমান। পাকিস্তানের নারীরা শিক্ষা-দীক্ষায় রাজনৈতিক কৃষ্টিক সাহিত্যিক জীবনে অন্যান্য বহু নয়া রাষ্ট্রের তুলনায় অনেক উন্নত। পাকিস্তান আন্দোলনে ও পরবর্তীকালের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নারীজাতির অবদান সামান্য নয়। দুই দুইটা শাসনতন্ত্রে যতই কম হউক নারী জাতির জন্য আসন রিযার্ভ ছিল। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াও প্রস্তাবিত আইন পরিষদে কয়েকটি আসন নারীর জন্য রিজার্ভ রাখিয়াছেন। এর বাহিরে সাধারণ আসনেও নারীর ক্যানডিউেট হওয়ার অধিকার স্বীকৃত হইয়াছে। কালক্রমে সাধারণ আসনেও নারীরা নির্বাচিত হইবেন। অথচ আশ্চর্য এই যে গোলটেবিল বৈঠকে প্রতিনিধিত্বের বেলা নারী জাতির কথা নেতাদের একবার মনেও পড়িল না। বর্তমান যুগে নারী জাতিকে বাদ দিয়া, আলোচনায় নারীকে অংশ গ্রহণের অধিকার ও সুযোগ না দিয়া, যে-দেশের নেতারা জাতির রাষ্ট্রীয় সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভাগ্য নির্ধারণ করিতে চান, তাঁরা ব্যর্থ হইতে বাধ্য। আমাদের গোলটেবিল ব্যর্থ হইবার এটাও একটা বড় কারণ।

৬. প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ভুল

জেনারেল ইয়াহিয়াও আমাদের জাতীয় ইন্টেলিজেন্‌শিয়ার অংশ। সেই হিসাবে আগের-আগের নেতাদের মত ভুল তিনিও করিয়াছেন এবং করিতেছেন। এটা দুর্ভাগ্যবশতঃ আমাদের শিক্ষিত সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক চিন্তা-ধারার মৌলিক ত্রুটি। কাজেই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া যদি ভুল করিয়া থাকেন, তবে সেটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার একটি মাত্র ভুলেরই বিচার আমরা এখন করিতে পারি। আর সব ভুলের বিচারের সময় এখনও আসে নাই। সেগুলি আদৌ তুল কি না, তাও বলা যায় না। কারণ তাঁর কাজ আজও সমাপ্ত হয় নাই। যখন হইবে তখনই দুইটি কথা মনে রাখিয়াই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার কাজের বিচার করিতে হইবে।

সে দুইটি কথার একটি এই যে, যে-মার্শাল ল’র বলে তিনি চিফ মার্শাল ল এডমিনিস্ট্রেটর ও প্রেসিডেন্ট হইয়াছেন, সে মার্শাল ল তাঁর ইচ্ছাকৃত সৃষ্টি নয়। এইখানে আমাদিগকে জেনারেল আইউবের মার্শাল ল’ এবং জেনারেল ইয়াহিয়ার মার্শাল ল’র বুনিয়াদী পার্থক্যটা উপলব্ধি করিতে হইবে। জেনারেল আইউব মার্শাল ল’ করিয়াছিলেন রাজনৈতিক অভিষ্ট হাসিলের জন্য আগে হইতে চিন্তা-ভাবনা করিয়া। সে কাজ করিতে গিয়া তিনি আনুগত্যের শপথ ভাংগিয়া নিজের উদ্দেশ্য সফল করিয়াছেন। পক্ষান্তরে জেনারেল ইয়াহিয়া পূর্বকল্পিত কোন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য লইয়া মার্শাল ল করেন নাই। সে কাজ করিতে গিয়া তাঁর আনুগত্যের শপথও ভাংগিতে হয় নাই। বরঞ্চ তিনি আনুগত্যের শপথ অনুসারেই মার্শাল ল করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন। জেনারেল আইউব রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ও দেশরক্ষা বাহিনীর সুপ্রীম কমাণ্ড হিসাবে প্রধান সেনাপতি জেনারেল ইয়াহিয়ার রাষ্ট্রীয় মনিব ছিলেন। তাঁরই কাছে জেনারেল ইয়াহিয়া খাঁর আনুগত্য। সেই প্রেসিডেন্ট ও সুপ্রিম কমাণ্ড লিখিতভাবে জেনারেল ইয়াহিয়াকে আদেশ দিয়াছিলেন। দেশের শাসন-তার তাঁহার নিজের হাতে নিতে। জেনারেল ইয়াহিয়া

প্রেসিডেন্টের এই আদেশ মানিতে বাধ্য ছিলেন। না মানিলে বরঞ্চ অবাধ্যতা হইত ও আনুগত্যের খেলাফ কাজ করা হইত। কাজেই স্পষ্টতঃই জেনারেল ইয়াহিয়া ব্যক্তিগত ক্ষমতালোভে রাষ্ট্রের শাসনভার নেন নাই। বরঞ্চ বলা যায় অনিচ্ছা সত্ত্বেও নিয়াছেন।

দ্বিতীয় ব্যাপারটা হইতে প্রথমটা পরিষ্কার বোঝা যায়। তিনি প্রথম হইতেই গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার দ্বারা জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি-সরকারের হাতে রাষ্ট্র ক্ষমতা তুলিয়া দিবার সকল প্রকার চেষ্টা করিয়াছেন। সে চেষ্টায় তিনি দেশময় ভ্রমণ করিয়াছেন। রাজনৈতিক দলসমূহের নেতাদের সাথে পৃথক ও সমবেত আলাপ আলোচনা করিয়াছেন। এই আলাপ-আলোচনায় তিনি নেতাদের বিভিন্ন ও পরস্পর বিরোধী মতবাদের ভিতরে একটা সমঞ্জস মধ্যপন্থা আবিষ্কারের চেষ্টা করিয়াছেন। শেষ পর্যন্ত নির্ধারিত মেয়াদে ও তারিখে সার্বজনীন ভোটে প্রত্যক্ষ নির্বাচনে আইন পরিষদ গঠনের ব্যবস্থা করিয়াছেন। সেই আইন পরিষদকে প্রাথমিক পর্যায়ে গণ পরিষদ রূপে শাসনতন্ত্র রচনার দায়িত্ব দিয়াছেন। মার্শাল ল’র অস্বাভাবিক ও অগণতান্ত্রিক অবস্থা হইতে গণতন্ত্রে ফিরিয়া যাইবার এর চেয়ে উত্তম আর কোন রাস্তা নাই। কাজেই এই পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া নির্ভুল পথে অগ্রসর হইয়া ঠিক-ঠিক কাজই করিয়াছেন।

কিন্তু এই দিকে না গিয়া অন্য দিকে তাঁর যাওয়া উচিত ছিল। সেটা না করাই তাঁর প্রথম ভুল। এই ভুল ‘৫৬ সনের শাসনটি পূনর্বহাল না করা। চীফ মার্শাল ল এডমিনিস্ট্রেটর হিসাবে তিনি এটা করিবার সম্পূর্ণ অধিকারী ছিলেন। এটা করিতে তাঁর জনমত যাচাই করিবার দরকার ছিল না আইন বা নীতির কোনও দিক দিয়াই।

অথচ এটা করা দরকার ছিল। দরকার ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রের ও সরকারের লেজিটিমেসি (বৈধতা) ও কন্টিনিউটি (সিলসিলা)র জন্য। ১৯৫৮ সালের ৭ই অক্টোবর পর্যন্ত পাকিস্তান রাষ্ট্র ও সরকারের লেজিটিমেসি ও কনটিনিউটি বজায় ছিল। খাজা নাজিমুদ্দিনের বেআইনীভাবে প্রধানমন্ত্রী হওয়া, গোলাম মোহাম্মদের খাজা সাহেবকে ডিসমিস করা এবং শেষ পর্যন্ত গণ-পরিষদ ভাংগিয়া দেওয়া, কোনটাতেই রাষ্ট্রের বা সরকারের লেজিটিমেসি ও কনটিনিউটি ব্যাহত হয় নাই। গণ-পরিষদ ভাংগার দরুন যে সংকট দেখা দিয়াছিল, সুপ্রীমকোট সেটা রেগুলারাইয করিয়া দিয়াছিল। রাষ্ট্রের ও সরকারের লেজিটিমেসি ভংগ ও কনটিনিউটি ছিন্ন হয় প্রথম ১৯৫৮ সালের ৭ই অক্টোবর হইতে। এই দিন ইস্কান্দর-আইউবের ষড়যন্ত্রে পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র বেআইনী বেদাঁড়াভাবে বাতিল করা হয়।

পাকিস্তানের মত ভৌগোলিক আকৃতির নয়া জাতির ও নয়া নামের নয়া রাষ্ট্রের জন্য লেজিটেমেসি ভাংগা কনটিনিউটি ছিন্ন করা অত্যন্ত বিপজ্জনক। ইতিহাস তার সাক্ষী। কাজেই যথাসম্ভব শীঘ্র ও প্রথম সুযোগেই এই লেজিটিমেসি ও কন্টিনিউটি পুনর্বহাল অত্যাবশ্যক। সেটা আজও হয় নাই। ১৯৬২ সালে আইউব ব্যক্তিগতভাবে যে শাসনতন্ত্র দিয়াছিলেন, তার দ্বারা এই কাজটি হয় নাই। ঐ শাসনতন্ত্র নিজেই বেদাঁরা ও কেইনী ছিল। ফলে ‘৫৮ সালের ৭ই অক্টোবর পাকিস্তান রাষ্ট্রের ও সরকারের যে লেজিটিমেসি ও কনটিনিউটি ছিন্ন হইয়াছিল, ‘৬২ সালের তথাকথিত শাসনতন্ত্রে তা জোড়া লাগে নাই। রাষ্ট্র ও সরকারের বেদাঁরা ও বেআইনী অস্তিত্ব চলিতেই থাকে। ১৯৬৯ সালের ২৫শে মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া যে মার্শাল ল ঘোষণা করেন তাতে আইউবের ঘোষিত মার্শাল ল’র বর্ধিত মেয়াদই চলিতে থাকে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া সোজাসুজি পাকিস্তান রাষ্ট্রকে ‘৫৮ সালের ৭ই অক্টোবরের লেজিটিমেসি ও কনটিনিউটিতে পুনর্বহাল করিতে পারিতেন। ‘৫৬ সালের শাসনতন্ত্র পুনর্বহাল করিলেই এটা ঘটিত। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া একটি মাত্র ঘোট ঘোষণায় ইহা করিতে পারিতেন। এতে এক সংগে দুইটা ব্যাপার ঘটিয়া যাইত। এক, পাকিস্তান রাষ্ট্রের ও সরকারের লেজিটিমেসি ও কন্টিনিউটি (বৈধতা ও সিসিলা) পুনর্বহাল হইয়া যাইত। দুই, এই অক্টোবরের শাসনত্ম বাতিলের বেআইনী কাজটি অননুমোদিত ও নিন্দিত হইয়া যাইত। এই দ্বিতীয় ঘটনাটির দ্বারা ভবিষ্যতের সম্ভাব্য শাসন বাতিলের আশংকা তিরোহিত হইয়া যাইত। পাকিস্তান রাষ্ট্র ও পাকিস্তানের জনগণ কোনও প্রকার শাসনবিরোধী বিপ্লব’ চায় না, এটা প্রতিষ্ঠিত হইয়া যাইত।

কিন্তু প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া এটা করেন নাই স্পষ্টতঃই এই জন্য যে ৫৬ সালের শাসনতন্ত্র আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের অভাব-হেতু পূর্ব-পাকিস্তানে এবং ওয়ান ইউনিটের বিধান হেতু পশ্চিম পাকিস্তানে অজনপ্রিয় ও অগ্রহণযোগ্য ছিল। এই পরিস্থিতিটা চিফ মার্শাল ল এডমিনিস্ট্রেটর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার জন্য দুঃসাধ্য ও অসমাধ্য সমস্যা ছিলনা। তিনি তাঁর আইন-উপদেষ্টাদের দ্বারা ঠিকমত উপদিষ্ট হইলে সহজেই এর সমাধান করিতে পারিতেন। চিফ মার্শাল ল এডমিনিস্ট্রেটর হিসাবে খুব ন্যায় সংগতভাবে ও জোরের সাথে তিনি সমস্ত দলের নেতাদিগকে বলিতে পারিতেন : ‘রাষ্ট্রের ও সরকারের লেজিটিমেসি ও কনটিনিউটির জন্য আমি ‘৫৬ সালের শাসনক্স পুনরুজ্জীবিত করিয়া রাষ্ট্রকে পূর্বের বৈধ অবস্থায় পুনর্বহাল করিতে বাধ্য। এ কাজে আপনারা আমার সহযোগিতা করুন। আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন ও ওয়ান-ইউনিট রদ-বদলের বিধান সম্বন্ধে আপনারা একমত হইয়া সুপারিশ করুন। আমি রাষ্ট্রের প্রধান হিসাবে সুপ্রিম কোর্টে রেফারেন্স করিয়া সে সব সুপারিশ আইনসিদ্ধ বাধ্যকর করিয়া লই।‘ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার চার মাসের শর্তের মতই এই কথার প্রতিক্রিয়াও শুভ হইত। ঐ ধরনের সুপারিশের ভিত্তিতে ‘৫৬ সালের শাসনতন্ত্র বহাল হইলে একদিকে যেমন লেজিটিমেসি-কনটিনিউটি জোড়া লাগিত, অপর দিকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার লিগ্যাল ফ্রেম ওয়ার্ক ঘোষণার কোন দরকার হইত না। লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্কের বেশীর ভাগই ৫৬ সালের শাসনতন্ত্রেই আছে।

পক্ষান্তরে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ও-পথে না গিয়া নিজ দায়িত্বে পঞ্চশিলা ঘোষণা করায় ৫৬ সালের শাসনতন্ত্রের সবগুলি মূলনীতি ঠিক থাকিল বটে, কিন্তু প্রথমতঃ রাষ্ট্র ও সরকারের লেজিটিমেসি-কনটিনিউটি পুনর্বহাল হইল না। দ্বিতীয়ত : ৫৮ সালের ৭ই অক্টোবর শাসন বাতিলটা অনুমোদিত হইয়া গেল। ভবিষ্যতের জন্য খারাপ নযির স্থাপিত হইল। ভাবী রাজনৈতিক উচ্চাকাংখী পলিটিক্যাল এ্যাডভানচারিস্টদের জন্য একটা সুন্দর আশকারা হইয়া থাকিল।

অনেকে আশংকা করিয়া থাকে যে ‘৫৬ সালের শাসন বাতিলের আইউবী বিপ্লব বাতিল করিয়া রাষ্ট্র ও সরকারকে ১৯৫৮ সালের ৭ই অক্টোবর অবস্থায় ফিরাইয়া নিলে তকালের মন্ত্রী-মেষরা বকেয়া শুদ্ধ বেতন-ভাতা ও মন্ত্রীগিরি-মেগিরি দাবি করিয়া বসিবেন। তাতে রাষ্ট্রের কোষাগারে বিপদ ঘটিতে পারে। কথাটা নিতান্তই বাজে। আঞ্চলিক প্যারিটি ও স্বায়ত্তশাসন এবং ওয়ান ইউনিটের মত জটিল ও রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান চিফ-মার্শাল ল এডমিনিস্ট্রেটর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া করিতে পারিলে ঐ তুচ্ছ ব্যাপারটাই পারিতেন না, এটা কোনও কাজের কথা নয়।

কিন্তু প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া এই সোজা পথে না গিয়া অধিকতর জটিল গণতন্ত্রের পথে যাওয়ায় ভাল কাজটিই করিয়াছেন। তবে এই ভাল কাজটি করিতে গিয়াই তিনি এমন কয়টি কাজ করিয়াছেন বা আপাততঃ ও দৃশ্যত ভাল। কিন্তু যার পরিণাম ভাল নাও হইতে পারে। যদি এসব কাজের পরিণাম ভাল হয়, তবে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খুব দুঃসাহসিক পুণ্যের কাজই করিয়াছেন। সেজন্য পাকিস্তানের ইতিহাসে তাঁর নাম সোনার হরফে লেখা থাকিবে। কিন্তু যদি পরিণাম ভাল না হয়, তবে ইতিহাসে তাঁর বদনাম থাকিবে। সে বদনাম জেনারেল আইউবের বদনামের চেয়ে কম হইবে না।

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার এমন কাজের মধ্যে দুইটি প্রধান। এক, দুই অঞ্চলের মধ্যে সম-প্রতিনিধিত্বের স্থলে জনসংখ্যা ভিত্তিক প্রতিনিধিত্বের পুনঃপ্রতিষ্ঠা। দুই, পশ্চিম পাকিস্তানের ওয়ান ইউনিট ভাংগিয়া দিয়া প্রদেশগুলিকে পূর্ব অবস্থায় পুনর্বহাল করা। দৃশ্যতঃ দুইটি কাজই জনমতের দাবি পূরণের উদ্দেশেই করা হইয়াছে। কিন্তু আসলে এটাই জনমতের দাবি ছিল কি না তা যেমন বিচার করিতে হইবে, নয়া ব্যবস্থায় দেশের সমস্যা মিটিল কি না, লাভ কি ক্ষতি হইল তাও বিচার করিয়া দেখিতে হইবে।

এটা বিচার করিতে হইলে মনে রাখিতে হইবে যে এই দুইটি বিষয় পাকিস্তান রাষ্ট্রীয় কাঠামোর প্রতিষ্ঠিত পাঁচটি সতু ও রুকনের অন্যতম। দীর্ঘদিনের অনিশ্চয়তা ও চিন্তা-বিভ্রান্তির পরে এই পাঁচটি সতু ও রুকন চূড়ান্তরূপে মীমাংসিত হইয়া গিয়াছিল।

(১) পাকিস্তান পার্লামেন্টারি ফেডারেল রিপাবলিক।

(২) দুইটি পূর্ণ স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল। তার মানে পশ্চিমা ওয়ান ইউনিট।

(৩) দুই অঞ্চলের সার্বিক প্যারিটির প্রথম স্তর হিসাবে প্রতিনিধিত্বের প্যারিটি। তার মানে যুক্ত নির্বাচন প্রথা।

(৪) উর্দু ও বাংলা দুইটি সম-মর্যাদার রাষ্ট্র ভাষা।

(৫)করাচি ফেডারেশনেরক্যাপিটাল।

প্রেসিডেন্ট আইউব তাঁর ডিক্টেটরির শুরুতেই এই পাঁচটি সতুনের দুইটি (এক নর ও পাঁচ নর) ভাংগিয়া ফেলেন। পার্লামেন্টারি ফেডারেল পদ্ধতির বদলে তিনি প্রেসিডেনশিয়াল ইউনিটরি ব্যবস্থা করিয়া ফেলেন। রাজধানী ব্রাচি হইতে মিলিটারি হেড কোয়ার্টার পিণ্ডিতে লইয়া যান। মার্শাল ল করিতে জনমত লাগে না। কাজেই রাজধানী স্থানান্তরিত করতে ও রাষ্ট্রের প্যাটার্ন বদলাইতেও জন-মতের দরকার নাই। এটাই ছিল আইউবের এটিচুড। বাকী থাকিল তিনটি সতুন। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ভাংগিলেন আরও দুইটি (দুই নম্বর ও তিন নম্বর)। বাকী থাকিল মাত্র চার নম্বরেরটি উর্দু ও বাংলা রাষ্ট্রভাষা।

পাকিস্তান নয়া রাষ্ট্র নামেও জাতিত্বেও। তেইশ বছরের কুশাসন ও ভুল পরিচালনার ফলে আমাদের রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় জীবনের বিদ্যমান সমস্যাগুলির এই পাঁচটি বাদে আর একটাও মিটান হয় নাই, বরঞ্চ নিত্য-নতুন সমস্যা সৃষ্টি করা হইয়াছে। বহুদিনের ঝাঁকাঝাঁকি ও টানা-হেঁচড়ায় ঐ পাঁচটি ব্যাপারের মীমাংসা হইয়াছিল। আসল সমস্যাগুলি মিটাইবার রাস্তা পরিষ্কার হইয়াছিল।

অবশিষ্ট সমস্যাগুলির মীমাংসা করার বদলে মীমাংসিত বিষয়গুলি পুনরায় উন্মুক্ত করা খুবই ঘোরতর বিপজ্জনক কাজ হইয়াছে। এর ফলে পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভিত্তিমূলে ফাটল ধরিয়াছে। এ সবের মধ্য করাচি হইতে রাজধানী স্থানান্তরের কথাটা আগেই আলোচনা করিয়াছি। নতুন কথার মধ্যে শুধু এইটুকু বলিলেই চলিবে যে রাজধানীর সেটড ব্যাপারটা যখন আনসেটলড হইয়াছে, তখন ন্যায্যতঃ যেখানে রাজধানী থাকা উচিৎ সেই মেজরিটির অঞ্চল পূর্ব-পাকিস্তানেই তাকে আনিতে হইবে। ন্যায়তঃ রাজধানী ঢাকাতেই হওয়া উচিৎ ছিল গোড়াতেই। শুধু জাতির পিতা কায়েদে-আযমের সম্মানে পূর্ব-পাকিস্তানীরা করাচি রাজধানী রাখিতে রাযী হইয়াছিল। কায়েদে আযমের সম্মান রাখিতে যদি পশ্চিম-পাকিস্তানীরা রাযী না হয় তবে আমরা আমাদের ন্যায্য দাবি ছাড়িব কেন? বস্তুতঃ কাউন্সিল মুসলিম লীগ তাদের সাত দফা দাবির মধ্যে ঢাকায় রাজধানী স্থাপনের দাবি করিয়াছেন। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া এদাবির জবাবে তাঁর ব্যক্তিগত মত প্রকাশ করিতে গিয়া বলিয়াছেন : রাজধানী বারেবারে পরিবর্তন করা যায় না। প্রথমতঃ এ ব্যক্তিগত মত গণ-পরিষদেরউপর বাধ্যকরনয়। দ্বিতীয়তঃ এ কথার জবাবে বলা যায় যে দেশবাসীর কোনও নির্বাচিত আইন পরিষদ রাজধানী বারেবারে দূরের কথা, একবারও বদলায় নাই। প্রেসিডেন্ট আইউব তাঁর ব্যক্তিগত খেয়াল-খুশীমত একবারই রাজধানী বদল করিয়াছেন। এই পরিবর্তন ঠিক রাখতে হইলেও আসন্ন নির্বাচিত পার্লামেন্টের এতে নিশ্চয়ই অনুমোদন লইতে হইবে। সে অনুমোদনের বেলা ঢাকা ও করাচির কথা নিশ্চয়ই বিবেচনা করিতে হইবে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বা অন্য কোনও নেতা এটাকে ‘ক্লোযড’ প্রশ্ন বলিতে পারেন না।

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার আগের ঘোষণায় বুঝা গিয়াছিল প্রেসিডেনশিয়াল প্যাটার্ন হইতে পার্লামেন্টারি পদ্ধতিতে ফিরিয়া আসা তাঁর মতে একটা সেটলড় প্রশ্ন। কিন্তু পরবর্তীকালে ঘোষণায় তিনি পার্লামেন্টারি কথাটা না বলায় সংবাদপত্র রিপোর্টারা ঐ অমিশনের কারণ জিগ্‌গাসা করিয়াছিলেন। জবাবে প্রেসিডেন্ট বলিয়াছেন বারে বারে একই কথার পুনরাবৃত্তি করা তিনি দরকার বোধ করেন না ইডিওলজি ফেডারেল ও ম্যাক্সিমাম প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন কথাগুলি বহুবার পুনরাবৃত্তি করিতে আপত্তি না হইলে পার্লামেন্টারি কথাটার পুনরাবৃত্তিও নিশ্চয়ই দোষের হইত না। এ বিষয়ে আমার আশংকা মিথ্যা হউক, এই মুনাজাত করি। কিন্তু সে আশংকার কথাটা না বলিয়া পারিতেছিনা। বর্তমান সরকারের বিশ্বস্ত কেউ-কেউ আমাকে বলিতেছিলেন যে নিজ পার্লামেন্টারি ও নিভাজ প্রেসিডেনশিয়াল সিস্টেম পাকিস্তানের উপযোগী নয়। এখানে তুর্কী শাসনতন্ত্রের অনুকরণে উক্ত দুই সিস্টেমের মিশ্রনে একটি নয়া প্যাটার্ন বাহির করিবার চেষ্টা হওয়া উচিৎ। উক্ত ভদ্রলোকেরা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ও তাঁহার আইন উপদেষ্টাদের মনের কথা বলিয়াছেন কি না কে জানে?

পশ্চিম-পাকিস্তানের ওয়ান ইউনিট ও দুই অঞ্চলের প্রতিনিধিত্বের প্যারিটি বাতিল করিয়া প্রেসিডেন্ট জনমতের প্রতি শ্রদ্ধা দেখাইয়াছেন। কথাটা বিচার-সাপেক্ষ। পশ্চিম পাকিস্তানের মাইনরিটি প্রদেশেসমূহ ওয়ান ইউনিটের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ ছিল; তাহাদের নেতাদের বিপুল মেজরিটি বরাবর ওয়ান ইউনিটের বিরুদ্ধে আন্দোলন করিয়া আসিতেছেন। ইহা ঠিক কথা। ওয়ান ইউনিট-বিরোধী এই আন্দোলনটা নিরর্থক ছিল না। উহার বিরুদ্ধে মাইনরিটি প্রদেশসমূহের বাস্তব ও গুরুতর অভিযোগ ছিল। সে অভিযোগের প্রতিকারের পন্থা হিসাবে সকল প্রদেশই যার তা স্বায়ত্তশাসিত পূর্বাবস্থায় ফিরিয়া যাইতে চাহিতেছিল, একথাও ঠিক। কিন্তু গোটা পশ্চিম পাকিস্তান ও সংলগ্ন দেশীয় রাজ্যসমূহের সাধারণ স্বার্থের বিষয়গুলি এজমালিতে পরিচালনের পন্থা হিসাবে সবগুলি স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশ ও দেশীয় রাজ্যগুলির সমন্বয়ে একটি যোনাল ফেডারেশন করিবার আবশ্যকতা কেউ অস্বীকার করেন নাই। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া এই দিককার কথাটা একদম বিচার না করিয়া শুধু সবগুলি প্রদেশকেই পূর্বাবস্থায় ফিরাইয়া নেন নাই, বরঞ্চ ওয়ান ইউনিট গঠনের আগে যে-সব দেশীয় রাজ্য স্বায়ত্তশাসিত ছিল, সেগুলির বেশির ভাগকেই পার্শ্ববর্তী প্রদেশের সহিত সংযুক্ত করিয়া ফেলিয়াছেন। এটা আইনের বিচারে ঠিক হয় নাই। রাজনীতির বিচারে ঠিক হইয়াছে কি না অয়দিন পরেই বুঝা যাইবে। দৃষ্টান্ত স্বরূপ বলা যায়, বাহওয়ালপুর হইতে প্রতিবাদ উঠিয়াছে। এটা কতদূর গড়াইবে কে জানে? প্রেসিডেন্টের আইন-উপদেষ্টারা তাঁহাকে কি উপদেশ দিয়াছেন জানি না। কিন্তু ১৯৪৭ সালের ভারত স্বাধীনতা আইন অনুসারে এইসব দেশীয় রাজ্য পাকিস্তানেই এক্সিড করিয়াছিল, কোনও একটি প্রদেশে এক্সিড করে নাই। তারপর ১৯৫৪ সালের অক্টোবর মাসে বড়লাটের অর্ডিন্যান্স-বলে পশ্চিম পাকিস্তান প্রদেশ গঠিত হওয়ার পর ঐসব দেশীয় রাজ্য পাকিস্তান সরকারের সহিত দস্তখতী চুক্তি বলে পশ্চিম পাকিস্তান প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত হইয়াছিল। পশ্চিম-পাকিস্তান প্রদেশ ভাংগিয়া যাওয়ার পর প্রদেশসমূহের মতই দেশীয় রাজ্যগুলিও পূর্বেকার অবস্থায় ফিরিয়া গিয়াছে। এ অবস্থায় ঐসব দেশীয় রাজ্যের সহিত নূতন চুক্তি না করিয়া তাদেরে পাশ্ববর্তী কোনো প্রদেশের অংগ করা যায় না। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার মধ্যস্থতায় এরূপ কোনও চুক্তি তাদের সাথে হইয়াছে কিনা, সরকারী ঘোষণায় তা প্রকাশ নাই।

তারপর ধরুন, রাজনৈতিক দিকটার কথা। ওয়ান ইউনিট ভাংগিয়া দিবার সময় উহাদের সমন্বয়ে একটা যোনাল ফেডারেশনের সম্ভাবনার কথা ত কোথাও বলাই হয় নাই, বরঞ্চ তেমন কোনও যোনাল ফেডারেশন না হওয়ার ব্যবস্থাই করা হইয়াছে বলিয়া মনে হয়। প্রথমতঃ ট্রাইবাল এরিয়াগুলিকে আলাদা করিয়া ঐগুলি কেন্দ্রীয় সরকারের শাসনাধীনে আনা হইয়াছে। দ্বিতীয়তঃ ঐসব এলাকার উন্নয়নের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের পরিচালনাধীন কর্পোরেশন গঠনের কথা বলা হইয়াছে। এতে এটাই বোঝা যায় যে সিন্ধু উপত্যকা পরিকল্পনা, তারবেলা, মংলা, সুইগ্যাস, রেল, পোস্ট, টেলি, ইনফর্মেশন, ব্রডকাস্টিং, পানি বিদ্যুৎ ইত্যাদি বিষয় কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে রাখিবার জন্য বর্তমান সরকার মনের দিকে তৈয়ার হইয়াই গিয়াছেন। সকল প্রদেশ ও দেশীয় রাজ্যসমূহের সমন্বয়ে একটি যোনাল ফেডারেশন না হইলে পশ্চিমাঞ্চলের ঐ সব বিষয় কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে না আনিয়া উপায়ান্তরও নাই। পশ্চিমাঞ্চলে যদি তা হয় তবে পূর্বাঞ্চলে কি হইবে?

এইখানেই পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রদেশের ঐক্য ও বিভক্তির সাথে পূর্ব পাকিস্তানের ভাগ্য ওতপ্রোতভাবে জড়িত হইয়া পড়ে। এইখানেই লাহোর প্রস্তাব, আঞ্চলিক নাম প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন, দুই অঞ্চলের প্যারিটি, পশ্চিম-পাকিস্তানের ওয়ান ইউনিট, সব কথা অনিবার্যরূপে প্রাসংগিক হইয়া পড়ে। পূর্ব-পাকিস্তানের স্বার্থের কথা বিচারে পশ্চিম পাকিস্তানের গঠন-প্রকৃতি-আকৃতির কথা অবান্তর এ কথা আর বলা চলে না। আবশ্যিকভাবেই এটা ‘বান্তর’ হইয়া পড়ে। একটু পরেই এসব বিষয়ই যথাসম্ভব সংক্ষেপে আলোচনা করিব। তার আগে আরেকটা ব্যাপারের দিকে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়া রাখিতেছি। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া আসন্ন নির্বাচিত আইন পরিষদের মতামতের অপেক্ষা না করিয়া নিজ দায়িত্বে যে দুইটি ব্যাপাত্র দশ বছরের প্রচলিত ব্যবস্থা বাতিল করিয়াছেন, তার একটি ওয়ান ইউনিট, অপরটি পারিটি। ওয়ান ইউনিটের বিরুদ্ধে পশ্চিম-পাকিস্তানের মাইনরিটি প্রদেশসমূহে ঘোরর আপত্তি উঠিয়াছিল এ কথা আগেই বলিয়াছি।

কিন্তু প্যারিটির বিরুদ্ধে পূর্ব-পাকিস্তানে তেমন কোন আন্দোলন হইয়াছিল, তা বলা যায় না। পূর্ব-পাকিস্তান-ভিত্তিক যতগুলি জনপ্রিয় গণ-প্রতিষ্ঠান ও ছাত্র প্রতিষ্ঠান আছে তাদের ছয় দফা, সাত দফা, এগার দফা ও চৌদ্দ দফা নামে বহু পার্টি-প্রোগ্রাম আছে। আইউবী আমলের গোটা দশ বছরব্যাপি যুলুমের প্রতিবাদে এই সব প্রতিষ্ঠান অনেক দাবি-দাওয়া স্পষ্ট ভাষায় দেশবাসী ও গভর্ণমেন্টের সামনে পেশ করিয়া আসিয়াছে। তার একটিতেও প্যারিটি বাতিল করিয়া জনসংখ্যাভিত্তিক প্রতিনিধিত্ব চাওয়া হয় নাই। বরঞ্চ প্রতিনিধিত্বের প্যারিটিকে ভিত্তি করিয়াই ঐসব পার্টি দুই অঞ্চলের স্বকীয়তা, দুই ভাষা, দুই কৃষ্টি, দুই অর্থনীতি ও দুই স্বত্র রাষ্ট্রীয় সত্তার বাস্তবায়নের পন্থা হিসাবেই লাহোর-প্রস্তাব-নির্দেশিত আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসন দাবি করিতেছিল।

পক্ষান্তরে যাঁরা শক্তিশালী কেন্দ্রের নামে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসেনর বিরোধিতা করিতেছিলেন, তাঁরাই প্রতিনিধিত্বের প্যারিটির বিরূপ সমালোচনা করিতেছিলেন। তাঁরা বলিতেছিলেন যে প্রতিনিধিত্বের প্যারিটি যাঁরা প্রবর্তন করিয়াছেন, তাঁরা কার্যত পাকিস্তানের দুই স্বতন্ত্র সত্তা মানিয়া লইয়া পাকিস্তানের এক ও অবিভাজ্যতার মূলে কুঠারাঘাত করিয়াছেন। বস্তুতঃ তাঁদের মতে প্রতিনিধিত্বের প্যারিটি প্রবর্তন করিয়া পূর্ব-পাকিস্তানের পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে দুর্নিবার করিয়া ভোলা হইয়াছে।

এমনি সময়ে সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী কেন্দ্রের দাবিদার প্রেসিডেন্ট আইউবের এক পূর্ব-পাকিস্তানী সমর্থক, তাঁর সাবেক মন্ত্রী, হঠাৎ একদিন পূর্ব-পাকিস্তানের পক্ষ হইতে প্যারিটির স্থলে জনসংখ্যা-ভিত্তিক প্রতিনিধিত্বের দাবি করিয়া বসেন। যেমন দাবি অমনি স্বীকার। যেই ইজাব অমনি কবুল। পূর্ব-পাকিস্তানের এই ন্যায় সংগত দাবি মানিয়া লইবার জন্য পশ্চিম-পাকিস্তানের সকল নেতা যেন এক পায় খাড়াই ছিলেন। কি উদ্দেশ্যে তাঁরা পূর্ব-পাকিস্তানের উপর ঐ অবিচারের প্রতিকার করিতে উন্মুখ হইয়াছিলেন, পরের দিনই তা প্রকাশ হইয়া পড়িল। তাঁরা বলিতে লাগিলেন। এখন যখন পূর্ব-পাকিস্তানের জনসংখ্যাভিত্তিক প্রতিনিধিত্বের দাবি মানিয়া নেওয়া হইল, তখন আর আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি করা হয় কোন মুখে?

এই কথার সংগে সংগে তারা আরেকটি কথা বলিলেন। সেটি উচ্চ পরিষদের কথা। এটি সম্বন্ধে পরে আলোচনা করিতেছি। এখানে শুধু এইটুকু বলিয়া রাখিতেছি যে উচ্চ পরিষদ সৃষ্টি করিয়া তদ্বারা পূর্ব-বাংলার মেজরিটি কনট্রোলই যদি করা হইল, তবে নিম্ন পরিষদে এই মেজরিটি লইয়া পূর্ব-বাংলার কি লাভ হইল? প্রকারান্তরে সেই প্যারিটিই হইয়া গেল না কি? তাতে পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্ত্বশাসনের আবশ্যকতা ও যৌক্তিকতা কিছু হ্রাস পাইল কি?

এ অবস্থায় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার শুত ও প্রশংসনীয় কাজটি করিতে গিয়া আমাদের জাতীয় জীবনের রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে এবং সর্বোপরি দুই অঞ্চলের সম্পর্কের মধ্যে কি কি জটিলতা সৃষ্টি করিলেন এবং তার ফল পরিণামে কি কি ভক্ত ও অবাঞ্ছনীয় রূপ ধারণ করিতে পারে, নিচে সংক্ষেপে তারই আলোচনা করিতেছি।

৭. আঞ্চলিক বনাম প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া তাঁর ঘোষণায় পাকিস্তান ফেডারেশনের ইউনিটগুলির জন্য সর্বাধিক প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের কথা বলিয়াছেন। তার মানে এই যে ইউনিটগুলির নাম তিনি প্রদেশ রাখিয়াছেন। এক কানাডা ছাড়া দুনিয়ার আর সব ফেডারেশনের অংগরাজকে ‘স্টেট’ বলা হয়। শুধু কানাডাতেই ওদের ‘প্রভিন্স’ বলা হয়। অস্ট্রেলীয় ফেডারেশনের শাসনতান্ত্রিক নাম কমনওয়েলথ-অব-অস্ট্রেলিয়া। আমাদের প্রতিবেশী ভারত ঠিক ফেডারেশন নয়। শাসনতান্ত্রিক নাম তার ইউনিয়ন। তবু তার অংগরাজ্যগুলিকে ‘স্টেট’ বলা হইয়াছে। ‘প্রভিন্স’ বলা হয় নাই।

সুতরাং নামে কিছু আসে যায় না। ফেডারেশন ও ফেডারেটিংইউনিটগুলির মধ্যে ক্ষমতা বন্টনটাই আসল কথা। তবু আমাদের বেলা ‘স্টেট’ ও ‘প্রভিন্স’ দুইটা শব্দই খুব উপযোগিতার সাথে ব্যবহার করা যাইতে পারে।

কিন্তু প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ওয়ান ইউনিট ভাংগিয়া পূর্ব-পাকিস্তানকে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রদেশগুলির সমপর্যায়ের ও সমমর্যাদার প্রদেশ করিয়া ফেলিয়াছেন। অতএব প্রদেশগুলির স্বায়ত্তশাসনকে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন বলিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার বাধে নাই।

স্মরণীয় যে পূর্ব-পাকিস্তানের রাষ্ট্রনেতা ও চিন্তা-নায়করা বরাবর পূর্ব-বাংলার দাবিকে ‘আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসন’ বলিয়াছেন, ’প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন’ বলেন নাই। কারণ অতি সোজ। পূর্ব-বাংলা কোনও অর্থেই একটি প্রদেশ নয়। ইউনিটরি রাষ্ট্রের অংগরাজ্য হিসাবে না, ফেডারেল রাষ্ট্রের অংগরাজ্য হিসাবেও না। বলা যাইতে পারে, পূর্ববাংলার রাষ্ট্রনেতাও চিন্তা-নায়ক প্রভিনশিয়াল অটনধি দাবির বদলে ‘স্টেট অটনমি’ দাবি করিতে পারিতেন। তা কেন করেন নাই? তাঁরা ‘আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসন’ ‘রিজিওনাল অটনমি’ দাবি করিতেছেন কেন? দুই কারণে। এক, দুনিয়ার জন্য ফেডারেশনের অংগরাজ্যের স্বচ্ছন্দে ও নিজেদের সুবিধার খাতিরে যেসব বিষয় ফেডারেশনের হাওলা করিয়াছে, পূর্ব-বাংলা ভৌগোলিক কারণে তার সবগুলি ফেডারেশনকে দিতে পারেনা। পূর্ব-বাংলা ঐ কারণে আরও ম বিষয় ফেব্রশনের হতে দিতে বাধ্য। এই জন্যই ‘স্টেট অটনমি’ বলিলেও পূর্ব-বাংলার দাবি সবটুকু বোঝা যাইত না। দুই, পূর্ব-বাংলার নিজের স্বায়ত্তশাসনের কথা ভাবিবার সময় পশ্চিম-পাকিস্তানের প্রদেশগুলির স্বায়ত্তশাসনের কথা ভুলিয়া যায় নাই। তাদেরও পূর্ণ বায়ত্তশাসনের কথা ভাবিয়াছে। কিউপায়ে তাদের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনকে বাস্তবে প্রয়োগ করা যায়, সে চিন্তাও পূর্ব-বাংলা করিয়াছে কতকটা নিজের স্বার্থেই। এটা ঘটিয়াছে এইরূপে পশ্চিম-পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রদেশের মধ্যে যে পারস্পরিক সম্পর্ক আছে ও থাকিতে পারে,পূর্ব-বাংলার সাথে তাদের তেমন সম্পর্ক নাই ও থাকিতে পারেনা। সোজা কথায় পশ্চিম-পাকিস্তানের প্রদেশগুলি যে অর্থে পাকিস্তানের অংগরাজ বা প্রদেশ, পূর্ব-বাংলা সে অর্থে পাকিস্তানের অংগরাজ্য বা প্রদেশ নয়। পাকিস্তান কায়েম হওয়ার দিন পূর্ব-বাংলাকে পশ্চিম অঞ্চলের চারটি প্রদেশের মতই একটি প্রদেশ কলা হইয়াছিল বটে, কিন্তু ভৌগোলিক বাস্তবতার দিক হইতে পূর্ব-বাংলা একাই পশ্চিম অঞ্চলের চারটি প্রদেশ ও সবগুলি দেশীয় রাজ্যের যোগফলের সমান। পূর্ব-বাংলা একাই একটি অঞ্চল। তাকে পাকিস্তান ফেডারেশনের একটি স্টেট বলা যাইতে পারে। আর পশ্চিম-পাকিস্তানের সকল প্রদেশ মিলিয়া আরেকটি অঞ্চল। একে পাকিস্তান ফেডারেশনের আরেকটি স্টেট বলা যাইতে পারে। শাসনতন্ত্র রচনার সময় শাসনতান্ত্রিক বিধানে শান-ক্ষমতা ও অর্থনৈতিক অধিকার বন্টনে এই দুই পৃথক আঞ্চলিক পার্থক্যের মাপকাঠিতেই বিচার ও সিদ্ধান্ত করিতে হইবে। এই বাস্তব-জ্ঞান হইতেই পূর্ববাংলার রাজনৈতিক চিন্তা-নায়করা বরাবর এটাকে আঞ্চলিক কার্যত বলিয়াছেন; প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন বলেন নাই। স্পষ্টতই ও-দুই জিনিস এক বস্তু নয়।

লাহোর প্রস্তাবই পাকিস্তান প্রস্তাব এটা সর্বজনস্বীকৃত। এই প্রস্তাবই পাকিস্তানের দুই উইংকে দুইটি ‘রিজিওন’ করিয়াছে। তাই পূর্ব-পাকিস্তানের রাষ্ট্রনেতারা পূর্ববাংলার স্বায়ত্তশাসনকে রিজিওনাল অটনমি বলিয়া থাকেন। পরবর্তী অনুচ্ছেদে লাহোর প্রস্তাবের মর্ম আলোচনা করা হইবে। তা হইতেই পাঠক বুঝিবেন, পূর্ব পাকিস্তানের দাবিকে রিজিওনাল অমি বলিয়া এ অঞ্চলের রাষ্ট্র নেতারা পাকিস্তান প্রস্তাবের প্রতি পূর্ণ আনুগত্যই দেখাইতেছেন।

ফেডারেশন খ ইউনিটসমূহের মধ্যে বিষয় বন্টনের মূলনীতি এই যে, যে সব বিষয়ে সকল ইউনিটেরমত্ব ও স্বার্থ এক বা কমন এবং যে সব বিষয় ইজমালিতে পরিচালন করিলে ফলের দিকে বেশি ও খরচের দিকে কম হয়, সেইগুলিই ফেডারেশনের হাতে দেওয়া হয়। আর যেসব বিষয়ে সকল ইউনিটে ও স্বার্থ এক ও কমন নয়, যেগুলির ইজমালি পরিচালনে কোনও বিষয়ে সুবিধা নাই, সে সব বিষয়ই ইউনিটসমূহের যার-তার পরিচালনাধীনে রাখা হয়।

এর মধ্যে ব্যতিক্রম দুইটি। দেশরক্ষা ও পররাষ্ট্র। সুস্পষ্ট কারণেই এই দুইটি বিষয় সকল প্রকার ফেডারেশনেই ফেডারেল সরকারের হাতে রাখা হয়। পূর্ব পাকিস্তানী নেতারা তাদের স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে বরাবর এই দুইটি বিষয়ই ফেডারেল সরকারের হাতে রাখিয়াছেন। তাছাড়া যদিও কারেন্সি ফেডারেল সরকারে রাখাটা বাধ্যতামূলক নয়, তথাপি পাকিস্তান রাষ্ট্রের ঐক্যের প্রতীকরূপে কারেন্সিও ফেডারেল সরকারের হাতে রাখা হইয়াছে। এইভাবেই ইতিহাস-বিখ্যাত যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা রচিত হইয়াছিল। এটাই পূর্ববাংলার জাতীয় দাবি। ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে শতকরা সাড়ে সাতান্নবইটি ভোট দিয়া পূর্ব-পাকিস্তানীরা একুশ দফার দাবি সমর্থন করিয়াছে।

এই তিনটি বিষয় ছাড়া আর সব বিষয় ইউনিটের হাতে থাকিবে। পূর্ব-বাংলার বেলা সে একাই এই ইউনিট। এ দাবি পূর্ববাংলার অন্যায়ও নয়; কেন্দ্রকে দুর্বল করার অভিপ্রায়ও এতে নাই। এর অতিরিক্ত আর কোনও বিষয়েই পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মা ও স্বার্থ এক ও কমন নয়। সাধারণতঃ যেসব বিষয় ফেডারেশনের হাতে থাকা উচিত এবং অন্যান্য ফেডারেশনে যেসব বিষয় কেন্দ্রের হাতে আছে তার মধ্যে যোগাযোগ, রেলওন্ত্রে, ডাক ও তার, ইনফরমেশন ও ব্রডকাস্টিং, ইরিগেশন, পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস ও প্ল্যানিং-এর নাম করা যাইতে পারে। কিন্তু ভৌগোলিক দ্বিধাবিভক্তির দরুন পাকিস্তানে এর একটাও কেন্দ্রীয় বিষয় হইতে পারে না। সুখের বিষয় ও আশার কথা এই যে খুব দেরিতে হইলেও পশ্চিম-পাকিস্তানের নেতারা এটা বুঝিতে পারিয়াছেন। তাই তিন বিষয়ের ফেডারেশন করিতে তাঁরা মোটামুটি রাযী হইয়াছেন। কোন-কোন বিষয়ে, বিশেষতঃ কর ধার্যের ক্ষমতা লইয়া, যেটুকু বিরোধ ও মতভেদ আজও দেখা যায়, জাতীয় ঐক্যবোধ ও বাস্তব জ্ঞান লইয়া সকলে আলোচনায় বসিলে সে-সব বিষয়েও সমঝোতা হইয়া যাইবে।

পূর্ব-পাকিস্তানের এই দাবির ঐতিহাসিক তাৎপর্য বুঝিতে গেলে পাকিস্তানের বুনিয়াদ যে লাহোর প্রস্তাব সেটি ভাল করিয়া বুঝিতে হইবে। পরের অনুচ্ছেদে সে আলোচনাই করিতেছি।

৮. লাহোর প্রস্তাব

লাহোর প্রস্তাবের আরেক নাম পাকিস্তান প্রস্তাব। পাকিস্তান রাষ্ট্র এই প্রস্তাব হইতেই জন্ম ও রূপ লাভ করিয়াছে। কৃতজ্ঞতার নিদর্শন স্বরূপ আমরা লাহোর প্রস্তাব পাশের জায়গাটিতে এক সুউচ্চ, সুরম্য পাকিস্তান মিনার নির্মাণ করিয়াছি।

কিন্তু বিস্ময়কর মজার কথা এই যে পাকিস্তানের শাসনন্ত্র রচনার কাজে লাহোর প্রস্তাবের নাম শুনিলে আমরা অনেকেই চটিয়া যাই। মুসলিম-মেজরিটির দেশে বাস করিয়া যাঁরা ইসলামের নাম শুনিলেই চটিয়া যান, তাঁরা নিশ্চিয়ই নিন্দার্হ। কিন্তু পাকিস্তানের নাগরিক হইয়া যাঁরা পাকিস্তান প্রস্তাবের নাম শুনিলে চটিয়া যান, তাঁরা কি নিন্দার্হ নন? অথচ তাই ঘটিতেছে। লাহোর প্রস্তাবের নাম শুনিলেই আমাদের রাষ্ট্রনেতাদের অনেকেই তেলে-বেগুনে জ্বলিয়া উঠেন। এর হেতু কি? একদিকে পূর্ব-পাকিস্তানের রাষ্ট্র-নেতাদের অনেকেই শাসনতন্ত্র রচনার কথা বলিতে গিয়া লাহোর প্রস্তাবের নাম উল্লেখ করেন। অপরদিকে পশ্চিম-পাকিস্তানের অধিকাংশ নেতা লাহোর প্রস্তাবের নামোল্লেখ সহ্য করিতে পারেন না।

পশ্চিম-পাকিস্তানী নেতাদের এই লাহোর-প্রস্তাব-বিরোধী মনোভাবের মূল কারণ মাত্র একটি। লাহোর প্রস্তাবে ভারতের উত্তর-পূর্ব ও উত্তর-পশ্চিম মন্ডলে (যোনে) দুইটি স্বাধীন রাষ্ট্রের কথা বলা হইয়াছে। এই কারণে পশ্চিম-পাকিস্তানী নেতাদের অধিকাংশের মনে লাহোর প্রস্তাব সম্পর্কে একটা কমপ্লেক্স একটা ফোবিয়া আছে। পূর্ব-পাকিস্তান হইতে লাহোর প্রস্তাবের নাম উঠিলেই ওঁরা মনে করেন যে পূর্ব-পাকিস্তানীরা বুঝি দুই স্বাধীন পাকিস্তানের কথা বলিতেছে।

ধারণাটা সম্পূর্ণ ভুল। পূর্ব-পাকিস্তানের কোনও পার্টি বা নেতা এক পাকিস্তান ভাংগিয়া দুইটি স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্র গড়িবার কল্পনাও করেন না। লাহোর প্রস্তাবে ‘স্টেটস’ শব্দ থাকা সত্ত্বেও কায়েদে আযমের নেতৃত্বে উভয় অঞ্চলের নেতৃবৃন্দ জানিয়া বুঝিয়াই এক পাকিস্তান কায়েম করিয়াছেন। পাকিস্তান রাষ্ট্র ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতার দরুন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিচারে একটা অভিনব এক্সপেরিমেন্ট। আমাদের জাতীয় নেতৃত্ব এই অভিনবত্ব সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন থাকিয়াই এই এক্সপেরিমেন্টে হাত দিয়াছেন। এই অভিনব এক্সপেরিমেন্টকে সফল করিতে আমরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। আমাদের পথে প্রাকৃতিক ও ভৌগোলিক যত বাধাই থাকুক, রাজনৈতিক দূরদশী মনীষার দ্বারা সে সব বাধা আমরা অতিক্রম করিবই। এক অখন্ড নেশন-স্টেট হিসাবে পাকিস্তানকে আমরা সফল ও চিরস্থায়ী করিবই। কোন বিঘুকেই আমাদের জাতীয় সংকল্প ব্যর্থ করিতে দিব না যদি পশ্চিমা ভাইএরা ব্যর্থ না করেন।

তবু আমরা পূর্ব-পাকিস্তানীরা শাসনতন্ত্রের কথা বলিতেই লাহোর প্রস্তাবের নাম করি কেন। উত্তর অতি সোজা। এই প্রস্তাবটিই পাকিস্তান-সৌধের স্টিল ফ্রেম। লাহোর প্রস্তাবে দুই উইং-এ দুই স্বাধীন রাষ্ট্র স্থাপন ছাড়াও আরও কথা আছে। রাষ্ট্রের রূপরেখা সম্পর্কে তাতে গুরুত্বপূর্ণ মূল্যবান নির্দেশ আছে। কিন্তু পশ্চিমা ভাইএরা তা পড়িয়া দেখিবার বা বুঝিবার চেষ্টা করেন না বলিয়াই মনে হয়। কারণ পড়িবার তাঁদের দরকার নাই। বিনা-লাতে মানুষ কিছু করেও না, পড়েও না। পশ্চিমা ভাইএরা পাকিস্তান পাইয়াছেন। পাকিস্তানের রাজধানী পাইয়াছেন। সরকার পাইয়াছেন। সরকারী সব চাকরি পাইয়াছেন। দেশরক্ষা বাহিনীর, সুপ্রিম কোর্টের, স্টেট ব্যাংকের, ন্যাশনাল ব্যাংকের, সব ইনশিওরেন্স কোম্পানীর, পি. আই. এ. ইত্যাদির সদর দফতর পাইয়াছেন। বিদেশী মিশন পাইয়াছেন। সবই তাদের। একটার ঠাই তিনটা রাজধানী ভাংগা-গড়ার কন্ট্রাকদারি তাঁরাই করিয়া থাকেন। সরকারী-বেসরকারী সব খরচা সেখানেই। অতএব আল্লার ফজলে তাঁরা সুখেই আছেন। সুখে থাকিলে মানুষ গরিব আত্মীয়ের কথা ভাবে না। কাজেই পূর্ব-পাকিস্তানীরা কেমন আছে, কি চায়, কি খায়, সে-সব কথা ভাবিবার অত সুখে তাঁদের সময় কই? কেউ স্মরণ করাইয়া দিলেও উৎপাত মনে করেন। গরিব শরিক অংশ চাহিলে মুতাওলীরা ‘ওয়াকফ আল্লার সম্পত্তি’ ও ‘মুসলমান ভাই-ভাই’ বলেন। ওয়ারিসী আইনের কথা ওয়াকফনামার কথা তাঁরা ভাবিতে যাইবেন কেন? বরঞ্চ তাঁরা মনে করেন, ওসব না থাকিলেই ভাল হইত।

সারা দুনিয়াই আল্লার। পাকিস্তানও আল্লার। আমাদের বাতিল দুইটা শাসনতন্ত্রেই একথা বলা হইয়াছে। আয়েন্দাতেও বলা হইবে। সেই হিসাবে পাকিস্তান ওয়া সম্পত্তি ঠিকই। তা যদি হয় তবে লাহোর প্রস্তাবই এই ওয়াফের তৌলিয়তনামা। এই তৌলিয়তনামার তৃতীয় দফাটিই আমাদের বিবেচ্য। এই দফায় তিনটি প্যারা। প্রথম প্যারায় দুইটি বিধান। একটি বিধানে ‘স্টেট’ বা একাধিক স্বাধীন রাষ্ট্রের কথা বলা হইয়াছে। একাধিকের স্থলে এক পাকিস্তান করিয়া আমরা বরাবরের জন্য সে তর্কের মীমাংসা করিয়া ফেলিয়াছি। দ্বিতীয় বিধানে যে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর সুনির্দিষ্ট রূপরেখা বর্ণনা করা হইয়াছে, এক পাকিস্তান করায় সেই রূপরেখার কি কি পরিবর্তন স্বতঃই ঘটিয়াছে, তা আমাদের বিচার করা দরকার। এই প্রস্তাবে তিনটি শব্দ ব্যবহার করা হইয়াছে। এক, ‘যোন’ বা মন্ডল; দুই, ‘রিজিওন’ বা অঞ্চল; তিন, ‘ইউনিট’ বা প্রদেশ। বলা হইয়াছে, উত্তর-পূর্ব ও উত্তর-পশ্চিম দুই যোন বা মন্ডলের মুসলিম মেজরিটি এলাকাগুলির সীমাসরহদ্দ প্রয়োজনীয় পুনর্বিন্যাস করিয়া ‘রিজিওন’ গঠিত হইবে। রিজিওনগুলির অন্তর্ভুক্ত ইউনিটগুলো ‘সভারেন’ ও ‘অটমাস’ হইবে। মূল প্রস্তাবে ‘রিজিওন’ বা অঞ্চলগুলিতে স্বাধীন-স্বাধীন রাষ্ট্র হওয়ার কথা। পরবর্তী ব্যবস্থায় যখন দুই রিজিওন মিলিয়া এক স্বাধীন রাষ্ট্র হইল, তখন স্বভাবতঃই এবং স্বতঃই রিজিওন বা অঞ্চল দুইটিই পাকিস্তান রাষ্ট্রের ‘কনস্টিটিউয়েন্ট ইউনিটের স্থান দখল করিল। ‘ইউনিটের’ বর্ণিত অধিকার দুইটি ‘সভারেইনটি’ এবং ‘অটনমিও’ স্বতঃই ‘রিজিওনের’ উপর বর্তাইল। ‘রিজিওন’ গঠনের বেলা তাদের প্রচলিত সীমা-সরহদ্দের পরিবর্তন হইতে পারে লাহোর প্রস্তাবে তা অনুমান করা হইয়াছিল। সে পুনর্বিন্যাস এমন সাংঘাতিক হইবে, তা মুসাবিদাকারীরা নিশ্চয়ই ধারণা করিতে পারেন নাই। কিন্তু পুনর্বিন্যাসের অনুমানটা তাঁদের ঠিকই হইয়াছে। পূর্বের ‘রিজিওন’ পুনর্বিন্যস্ত সীমার বাংলা-আসাম লইয়া হইবে, এটা তাঁরা অনুমান করিয়াছিলেন। কার্যতঃ তাই হইয়াছে। বাংলার অংশ ও আসামের অংশ লইয়া পুনর্বিন্যস্ত সীমার মধ্যে পূর্ব রিজিওন গঠিত হইয়াছে। ঠিক, তেমনি বিভক্ত পাঞ্জাব ও গোটা অন্য তিনটি প্রদেশ এবং দেশীয় রাজ্যগুলি লইয়া পশ্চিম রিজিওন গঠিত হইয়াছে।

অতএব দেখা গেল, লাহোর প্রস্তাবই দুই যোনে দুইটি রিজিওন সৃষ্টি করিয়াছে। লাহোর প্রস্তাবই দুই রিজিওনকে ‘অটমাস’ ও ‘সভারেন’ ইউনিট করিয়াছে। তাহোর প্রস্তাবের বলেই আমাদের অটনমির নাম রিজিওনাল অটনমি বা আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন; প্রভিনশিয়াল অটনমি বা প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন নয়। লাহোর প্রস্তাবের ‘সভারেনটি’ কথাটাই পাকিস্তান রাষ্ট্রকে ফেডারেশন করিয়াছে। অন্য কিছুতেই নয়। রাজধানীসহ সবগুলি কেন্দ্রীয় সংস্থা। ঘরের দরজায় পাইয়া পশ্চিমা নেতারা ঈংসেন্টারের নামে ইউনিটরি স্টেট করিতে চান। প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের নামে এক রিজিওনকে অন্য রিজিওনের প্রদেশ করিতে চান। এ অবস্থায় লাহোর প্রস্তাবই ফেডারেল পাকিস্তান ও অটমাস রিজিওনের একমাত্র রক্ষাকবচ। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্রমাত্রেই জানেন, ফেডারেশনে সভারেনটি থাকে ফেডারেটিং ইউনিট বা অংগ-রাজ্যগুলিতেই। রাজধানীর অবস্থিতি বৈগুণ্যে পূর্ব-বাংলার হক-সনদ লাহোর প্রস্তাব। রাজধানী এপারে আসিলে এটাই হইবে পশ্চিম-পাকিস্তানের হক-সনদ। খোদ পশ্চিম-পাকিস্তানের অস্তিত্ব নির্ভর করিতেছে লাহোর প্রস্তাবের উপর। পশ্চিমা ভাইদের বিবেচনার জন্য এই কথাটাই এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করিব।

সকলেরই স্মরণ আছে যে ১৯৪৭ সালের ভারতীয় স্বাধীনতা আইনের বলে পাকিস্তান স্থাপিত হইয়াছে। এই আইনের তিন ধারার ২ উপধারা মতে রেফারেণ্ডামের মাধ্যমে আসামের সিলেট জিলা ‘পূর্ব-বাংলার’ অন্তর্ভূক্ত হইয়াছে। পক্ষান্তরে উক্ত আইনের ১৯ ধারায় ৩ উপধারা মতে রেফারেন্ডামের মাধ্যমে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ পাকিস্তানের অন্তর্ভূক্ত হইয়াছে, পশ্চিম-পাকিস্তানের অন্তর্ভূক্ত হয় নাই। এ কথার তাৎপর্য এই যে সীমান্ত প্রদেশের উপর পশ্চিমাঞ্চলের প্রদেশগুলির যে দাবি, পূর্ব-বাংলার দাবিও অবিকল তাই। তার মানে সীমান্ত প্রদেশের উপর পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যান্য প্রদেশগুলির কোনও বিশেষ অধিকার নাই। পূর্ব-বাংলার মোকাবিলায় সীমান্ত প্রদেশকে পশ্চিম পাকিস্তানের অংশ বলা বেআইনী ও শাসনতন্ত্র বিরোধী হইবে। এ অবস্থায় পূর্ব-বাংলার সাথে প্যারিটির পাল্লা দিবার উদ্দেশ্যে সীমান্ত প্রদেশকে পশ্চিম-পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করিয়া যে ওয়ান ইউনিট করা হইয়াছিল, তা সম্পূর্ণরূপে অবৈধ বে-আইনী ও যবরদস্তিমূলক হইয়াছিল। লাহোর প্রস্তাবই পশ্চিম পাকিস্তান প্রদেশকে এই অবৈধতা হইতে বাঁচাইয়াছে। লাহোর প্রস্তাবই পশ্চিম যোনের সমস্ত প্রদেশগুলির সমন্বয়ে একটি মাত্র রিজিওন করিয়াছে। সীমান্ত প্রদেশ সম্বন্ধে যে কথা, পশ্চিম যোনের দেশীয় রাজ্যগুলি সম্বন্ধেও সেই কথা। ভারতীয় স্বাধীনতা আইনের ২ ধারার ৪ উপধারায় দেশীয় রাজ্যগুলি কে ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্রদ্বয়ের যেকোন একটিতে সংযোজিত হইবার অবাধ অধিকার দেওয়া হইয়াছিল। সেই ধারা বলে উত্তর-পশ্চিম যোনের দেশীয় রাজ্যগুলি পাকিস্তান রাষ্ট্রে সংযুক্ত হইয়াছিল। কোনও একটি যোনের বা প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত হয় নাই।

কাজেই দেশীয় রাজ্যগুলিকে গোটা পাকিস্তান রাষ্ট্রের বদলে খাস করিয়া পশ্চিম পাকিস্তানের অংশ দাবি করিতে গেলে লাহোর প্রস্তাবের আশ্রয় লওয়া ছাড়া উপায়ান্তর নাই। অতএব, ‘স্টেটস্’ শব্দের ‘এস’ হরফ বাদ দিয়া হিসাব করিলে লাহোর প্রস্তাব পূর্ব-পাকিস্তানের চেয়ে পশ্চিম-পাকিস্তানের স্বার্থের জন্যই বেশি দরকার।

সুতরাং দেখা গেল, লাহোর প্রস্তাব ১৯৪০ সাল ও ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের জন্য যেমন সত্য ছিল, আজ ১৯৭০ সালেও তেমনি সত্য আছে। লাহোর প্রস্তাব সত্য-সত্যই পাকিস্তান রাষ্টীয় সৌধের ইস্পাতের কাঠাম। এ কাঠাম ভাংগিলে কারও রক্ষা নাই।

. পশ্চিম পাকিস্তানে ওয়ান ইউনিট

পূর্ব-পাকিস্তানের পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন পশ্চিম-পাকিস্তানের ইউনিটির উপর নির্ভরশীল, একথা আজ সবাই বুঝিতে পারিয়াছেন। পূর্ব-পাকিস্তানের দাবি মোতাবেক কেন্দ্রকে তিন সাবজেক্ট দিয়া অবশিষ্ট সব সাবজেক্ট পশ্চিমাঞ্চলের কোনও প্রদেশই একা বা স্বভাবে নিতে পারে না। সেজন্য তাদের একটি যোনল সাব ফেডারেশন করিতেই হইবে। কিন্তু পনর বছরের ওয়ান ইউনিটের তিক্ত অভিজ্ঞতায় মাইনরিটি প্রদেশগুলি পাঞ্জাবের সাথে কোনও ঐক্য করিতেই রাযী না। চুন খাইয়া তাদের মুখ পুড়িয়াছে। দই দেখিয়াও তাদের ভয় হইতেছে। তাই তারা সাব ফেডারেশনের বদলে নিখিল-পশ্চিম-পাকিস্তানী বিষয়গুলির জন্য ওয়াপদা পি.আই.ডি.সি. ইত্যাদির মত অটনমাস বডি স্থাপনের কথা ভাবিতেছেন।

কিন্তু একটু চিন্তা করিলেই প্রদেশসমূহের নেতারা বুঝিতে পারিবেন, ঐ ব্যবস্থা কোনও সমাধান নয়। প্রথমতঃ স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাগুলিকেও কোনও-না কোন প্রদেশ বা কেন্দ্রের হাতে থাকিতে হইবে। দ্বিতীয়তঃ, ঐ ব্যবস্থায় গণতান্ত্রিক শাসনের স্থলে আমলাতান্ত্রিক একাধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হইবে। এই কারণেই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ওয়ান ইউনিট ভাংগিয়া সাবেক প্রদেশগুলি পুনর্বহাল করিলেও রেল, পি.আই.ডি.সি. ওয়াপদা, সি ইত্যাদি বিষয়গুলি কোনও প্রদেশকে না দিয়া নিজ হাতে অর্থাৎ কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে রাখিয়াছেন। প্রকারান্তরে এতদিনের প্রাদেশিক বিষয়গুলি এখন কেন্দ্রীয় বিষয় হইয়া গিয়াছে। এই অবস্থার পরিবর্তন আনিতে হইলে যোনাল সাব-ফেডারেশনই একমাত্র সমাধান।

১৯৫৪ সালে বড়লাটের অর্ডিন্যান্সে যে ইউনিট করা হইয়াছিল এবং যা ১৯৫৫ সালের পশ্চিম-পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা আইনে বলবৎ করা হইয়াছিল, তেমন ইউনিট আর হইবে না। মাইনরিটি প্রদেশসমূহ তা মানিবেও না। কিন্তু উপরোক্ত কারণে বিভিন্ন প্রদেশের স্বার্থেই তাদের সমন্বয়ে একটি মাত্র রাষ্ট্রীয় সংস্থা হওয়া অত্যাবশ্যক।

পশ্চিমাঞ্চলের সকল প্রদেশের সমন্বয়ে একটি মাত্র সাব-ফেডারেশন করা অত্যাবশ্যক আরও কতকগুলি কারণে। সংক্ষেপে সে কারণগুলির দিকেও আমি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করিতেছি। পূর্ব-পাকিস্তানের আঞ্চলিক পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের মত পূর্ব-বাংলার স্বার্থের কোনও প্রত্যক্ষ সম্পর্ক এই কারণগুলির সাথে নাই। এগুলি বিশেষ করিয়া পশ্চিম-পাকিস্তানেরই স্বার্থের কথা। পশ্চিম-পাকিস্তানের স্বার্থও গোটা পাকিস্তানেরই স্বার্থ এই হিসাবে এসবে পূর্ব-পাকিস্তানের স্বার্থ রহিয়াছে নিশ্চয়ই।

(১) পশ্চিমাঞ্চলের দেশীয় রাজ্যসমূহ পশ্চিম-পাকিস্তান প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত হইয়াছে। কোনও বিশেষ প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত হয় নাই। সকলেরই স্মরণ আছে, ১৯৫৪ সালের ২২শে নবেম্বর তারিখে পাকিস্তান সরকার পশ্চিমাঞ্চলের সবগুলি প্রদেশের সমবায়ে পশ্চিম-পাকিস্তান প্রদেশ গঠনের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। ২৪শে নবেম্বর সীমান্ত প্রদেশের আইন পরিষদ, ৩০শে নবেম্বর পশ্চিম-পাঞ্জাব আইন পরিষদ ও ১১ই ডিসেম্বর সিন্ধু আইন পরিষদ ঐ এক ইউনিট গঠনের প্রস্তাব সমর্থন করেন। অতঃপর ১৪ই ডিসেম্বর বেলুচিস্তান, বাহওয়ালপুর, খায়েরপুর ইত্যাদি দেশীয় রাজ্যের শাসকগণ যার-তাঁর রাজ্যের পক্ষ হইতে চুক্তি স্বাক্ষর করিয়া ঐসব রাজ্যকে পশ্চিম পাকিস্তান প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত করিতে সম্মত হন। এই চুক্তির বলে ঐসব দেশীয় রাজ্যকে এক ইউনিটের শামিল করিয়া ১৯৫৫ সালের ৮ই আগস্ট তারিখে গণ পরিষদে পশ্চিম-পাকিস্তান প্রদেশ প্রতিষ্ঠা নামে একটি বিল পেশ করা হয়। ঐ বিল ৩০শে সেপ্টেম্বর পাশ হয়। ৩রা অক্টোবর উহা বড়লাটের অনুমোদন লইয়া পাকিস্তান গেযেটে প্রকাশিত হয়।

এতে দেখা গেল যে পশ্চিম-পাকিস্তানের সবগুলি দেশীয় রাজ্য পশ্চিম পাকিস্তানে ওয়ান ইউনিট গঠনের পর পাকিস্তান সরকারের সাথে চুক্তিপত্র স্বাক্ষর করিয়া পশ্চিম-পাকিস্তান প্রদেশের সহিত সংযুক্ত হইয়াছিল। এখন ওয়ান ইউনিট ভাংগিবার পর অন্যান্য প্রদেশের মতই তারাও আইনতঃ পূর্ব অবস্থায় ফিরিয়া গিয়াছে। অতঃপর তারা ইচ্ছা করিলে নিজ-নিজ স্বাতন্ত্র রক্ষাও করিতে পারে। অথবা তাদের ইচ্ছামত ও পঙ্গমত ভিন্ন ভিন্ন প্রদেশের সাথে সংযুক্ত হইতে পারে। যাই করুক, নূতন চুক্তিপত্র স্বাক্ষর করিয়া নূতন-নূতন আইন করিতে হইবে। এতে সমস্যা ও জটিলতা বাড়িবে। অথচ যদি সাব-ফেডারেশনরূপে পশ্চিম-পাকিস্তান ইউনিট বজায় থাকে তবে পূর্ব চুক্তি মোতাবেক তারা এক ইউনিটের শামিল থাকিয়া যাইবে। নতুন জটিলতা বা সমস্যার সৃষ্টি হইবে না।

(২) ফেডারেল রাজধানী করাচি হইতে পিণ্ডি স্থানান্তরিত করার পর করাচি শহরকে পশ্চিম-পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করা হইয়াছিল। কোনও একটি প্রদেশের সাথে সংযুক্ত করা হয় নাই। এক ইউনিট ভাংগার পর কাচির অধিকার লইয়া তর্ক উঠিয়াছে। যদিও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া তাঁর সর্বশেষ ঘোষণায় করাচিকে সিন্ধু প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত করিয়া দিয়াছেন, তবু এটাকে চূড়ান্ত মীমাংসা বলা যায় না। ফেডারেল ক্যাপিটালকে কায়েদে-আযমের অভিপ্রায়মত করাচিতে ফিরাইয়া আনিবার দাবির কথাও বাদ দেওয়া সহজ নয়। তেমনি করাচির উপর সারা পশ্চিম-পাকিস্তানের দাবিও তুড়ি মারিয়া উড়াইয়া দেওয়া যাইবে না। তাঁর উপর আছে করাচির স্বতন্ত্র একটি প্রদেশ হইবার দাবি। এ দাবিও কম জোরদার নয়। এসবই জটিল ও সমস্যা-সংকুল প্রশ্ন। পশ্চিম-পাকিস্তানকে যোনাল ফেডারেশনের আকারে বজায় রাখিতে পারিলে এসব জটিলতার উদ্ভব হইবে না।

(৩) পশ্চিম-পাকিস্তানের ইউনিটি ভাংগিয়া প্রদেশগুলিকে পূর্বাবস্থায় বহাল করিবার পর যার-তার পূর্ব নাম গ্রহণ করিবে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সর্বশেষ ঘোষণায় যার-তার পূর্ব নাম বহাল হইয়া গিয়াছে। যোনাল ফেডারেশনের দ্বারা সে নাম বজায় না রাখিলে ‘পশ্চিম-পাকিস্তান’ নামে কোন শাসনতান্ত্রিক রাষ্ট্র-সংস্থা আর থাকিবে। সে অবস্থায় পূর্ব-বাংলাকে পূর্ব-পাকিস্তান বলিবার কোনও যুক্তিসংগতি থাকিবে। সে পরিস্থিতি ঘটিলে পূর্ব-পাকিস্তান ও পশ্চিম-পাকিস্তান নামের দুইটি অঞ্চলের যুক্তনাম যে পাকিস্তান আছে, সে অবস্থাও আর থাকিবে না।

এই তিন নম্বর দফাটির আরেকটি রাষ্ট্রীয় গুরুত্ব রহিয়াছে। যদি অবস্থা-গতিকে পূর্ব-পাকিস্তান ও পশ্চিম-পাকিস্তান নামে পাকিস্তান রাষ্ট্রের শাসনতান্ত্রিক নামধারী দুইটি ইউনিট নাও থাকে, তবু পাকিস্তানের ভৌগোলিক আকৃতির পরিপ্রেক্ষিতে দিক নির্দেশক পরিচিতি হিসাবে পূর্বাঞ্চলীয় পাকিস্তান, ইংরাজীতে ইস্টাণ পাকিস্তান ও পশ্চিমাঞ্চলীয় পাকিস্তান, ইংরাজীতে ওয়েস্টার্ণ পাকিস্তান, বলিতেই হইবে। এতে অচিন্তনীয় ও অভিনব ধরনের বিভ্রান্তি ও জটিলতা দেখা দিতে পারে।

এই সম্পর্কে ইস্ট পাকিস্তান বা পূর্ব-পাকিস্তান এবং ওয়েস্ট পাকিস্তান বা পশ্চিম-পাকিস্তান এই দুইটি শাসনতান্ত্রিক রাষ্ট্র-নামের প্রয়োজনীয়তার দিকে পাঠকদের দৃষ্টি আর একবার আকর্ষণ করিতেছি। পূর্ব-পাকিস্তানের অধিকাংশ চিন্তাবিদ ও রাষ্ট্রনায়ক পাকিস্তানের শাসন রচনার বেলা লাহোর প্রস্তাবের কথা বলেন। পক্ষান্তরে পশ্চিম-পাকিস্তানী অনেক নেতা লাহোর প্রস্তাবের নামে চটিয়া যান। তাঁরা ভুলিয়া যান লাহোর প্রস্তাবের ‘স্টেটস’ শব্দটার ‘এস’ বাদ দিয়া দুইটার বদলে এক পাকিস্তান করিয়াছি বটে, কিন্তু ভৌগোলিক দুই খণ্ডকে এক খণ্ড করিতে পারি নাই। তাঁরা ভুলিয়া যান লাহোর প্রস্তাবের ‘এস’টাই শুধু কার্যতঃ বাদ গিয়াছে; আর সবই ঠিক আছে। এ অবস্থায় পশ্চিমের খণ্ডও পাকিস্তান, পূর্বের খণ্ডও পাকিস্তান। ভূগোলের বিচারে পাকিস্তান দুইটা। মাত্র এক খণ্ডই পাকিস্তান, অপর খও তার প্রদেশ বা উপনিবেশ, অবস্থা তা নয়। অবস্থাগতিকে পশ্চিমের অনেক নেতাই তা বুঝেন না। ভিন্ন রাষ্ট্রের দ্বারা বিযুক্ত দুই খণ্ডে বিভক্ত রাষ্ট্র পাকিস্তানের মত আর একটিও নাই, এই যুক্তির জবাবে এক পশ্চিম-পাকিস্তানী নেতা বলিয়াছেন : ‘কেন থাকিবে না? যুক্তরাষ্ট্র ও আলাস্কাও ত কানাডার দ্বারা বিযুক্ত।‘ যদি আরও কোনও পশ্চিমা নেতা আমেরিকা-আলাক্কা দিয়া দুই পাকিস্তানের সম্পর্ক বিচার করেন, তবে সেটা পাকিস্তানের জন্য সত্যই চিন্তার কথা।

পশ্চিম-পাকিস্তানের যোনাল ফেডারেশন হওয়ার পক্ষে আরও একটা বড় যুক্তি আছে। সে যুক্তি এই যে ফেডারেল ভিত্তি ছাড়া আর কোনও উপায়েই পশ্চিম পাকিস্তানের সমস্ত প্রদেশকে ঐক্যবদ্ধ করা যায় না। কারণ পশ্চিম-পাকিস্তানের প্রদেশগুলির জনসংখ্যার অবস্থা এই যে পাঞ্জাব একাই পশ্চিম-পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৬০ জন লোকের অধিবাস। আর তিন প্রদেশ একত্রে মিলিয়া মাত্র শতকরা ৪০ জনের অধিবাস। এ অবস্থায় জনসংখ্যার ভিত্তিতে সংযুক্ত পশ্চিম পাকিস্তানের আইন পরিষদ গঠিত হইলে তাতে পাঞ্জাবের নিরংকুশ একাধিপত্য হইবে। এই অবস্থার প্রতিকারের জন্যই ওয়ান ইউনিট গঠনের সময় পাঞ্জাব দশ বছরের জন্য তার মেজরিটি কোরবানি করিয়া মাইনরিটি হইয়াছিল। পাঞ্জাবের প্রতিনিধিত্ব ছিল ৪০। আর মাইনরিটি প্রদেশগুলির ছিল ৬০। মাইনরিটি প্রদেশগুলিকে প্রলুব্ধ করা ছাড়া এই অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থার আর কোনও যুক্তি ছিল না। পাঞ্জাবের এত বড় ত্যাগে কৃতজ্ঞ না হইয়া মাইনরিটি প্রদেশগুলি বরঞ্চ সন্দিগ্ধ হইয়াছিল। তাই ওয়ান ইউনিট টিকে নাই। যদি গোড়া হইতেই ওয়ান ইউনিট ফেডারেল ভিত্তিক হইত তবে উহা টিকিত। ভবিষ্যতে উহা করিলেও টিকিবে। ওটা যখন হইবে একটা ফেডারেশন, তখন ওতে জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রদেশসমূহের প্রতিনিধিত্ব হইবে কেন? ফেডারেশনের প্রচলিত ও সর্বসম্মত নীতি অনুসারে যোনাল ফেডারেশনের আইন পরিষদ হইবে বিভিন্ন প্রদেশের সমান সংখ্যক প্রতিনিধি লইয়া। সেখানে জনসংখ্যার প্রশ্ন উঠিতেই পারে না। জনসংখ্যা নির্বিশেষে সকল প্রদেশের সমান প্রতিনিধি লইয়া যোনাল ফেডারেশনের আইন-পরিষদ গঠিত হইলে কোনও প্রদেশই তাতে আপত্তি করিবে না বলিয়াই আমার দৃঢ় বিশ্বাস। অতএব পশ্চিমাঞ্চলের ঐক্যের খাতিরে জন সংখ্যায় বিপুল মেজরিটি হইয়াও পাঞ্জাব এই প্যারিটি ভিত্তিক প্রতিনিধিত্ব মানিয়া লইবে, এটা আশা করা যায়। এই সাবফেডারেশনের নাম হইবে স্টেট-অব ওয়েস্ট পাকিস্তান। পশ্চিম-পাকিস্তান নেতাদের সকলের, বিশেষতঃ পাঞ্জাবী নেতাদের, স্মরণ রাখা উচিত যে লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে যদি পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলে দুইটা স্বতন্ত্র পাকিস্তান হইত তবে তারাও হইত দুইটি ফেডারেশন।

কিম্বা ডাঃ ইকবাল বা চৌধুরী রহমত আলীর প্রস্তাবমত যদি পাকিস্তান শুধু পশ্চিম ভারতেই হইত তবু সেটা হইত স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশসমূহের সময়ের ফেডারেশন। কস্টিটিউয়েন্ট ইউনিটগুলি হইত অটমাস ও সভারেন। দুই এর বদলে এক পাকিস্তান হওয়ায় দুই কোণে দুই স্বায়ত্তশাসিত ইউনিট হইয়াছে। পূর্ব-পাকিস্তানকে এক করিয়াছে ভূগোল। পশ্চিম-পাকিস্তানকে এক করিতে পারে লাহোর প্রস্তাব। কাজেই পশ্চিমা ভাইএরা লাহোর প্রস্তাবের নাম শুনিলেই যে আঁতকিয়া উঠেন, এটা তাঁদের আহমকি।

পক্ষান্তরে মাইনরিটি প্রদেশের অনেকের আশংকা যোনাল ফেডারেশন হইলে প্রদেশগুলির স্বায়ত্তশাসনের কোনও বিষয়ই থাকিবে না। এটা তাঁদের ভূল। ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনে প্রদেশগুলি ছিল স্বায়ত্তশাসিত। সাব-ফেডারেশন হওয়ার পরেও ‘৩৫ সালের প্রাদেশিক তালিকার বিষয়গুলি তাদের ত থাকিবেই, আরও কিছু বেশিও থাকিতে পারে। এই প্রসংগে বিষয়গুলির বিচার করা যাক।

১৯৩৫ সালের আইনে ফেডারেল তালিকায় ছিল ৫৯টি, কারেন্ট তালিকায় ৩৬টি ও প্রাদেশিক তালিকায় ৫৪টি। ‘৫৬ সালের শাসনতন্ত্রে ফেডারেল তালিকায় ছিল ৩০টি, কারেন্ট তালিকায় ১৯টি ও প্রাদেশিক তালিকায় ৯৪টি। আইউবী। শাসনতন্ত্রে শুধু ফেডারেল তালিকায় ছিল ৪৯টি। বাকি সবই ছিল প্রাদেশিক। এই তিনটি শাসনতন্ত্রের তালিকা বিচার করিলে দেখা যাইবে যে মোট বিষয়ের সংখ্যা মোটামুটি ১৫০। এর মধ্যে ৫৬ সালের শাসনতন্ত্রেই সবচেয়ে কম সংখ্যা ৩০ কেন্দ্রে রাখিয়াছে। আমাদের নয়া শাসনতন্ত্র হইবে পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন ভিত্তিক। তাতে সর্বসম্মত তিনটি বিষয়ের সাথে প্রয়োজনীয় আরও তিন-চারটি যোগ করিলেও সাতটির বেশি ফেডারেল বিষয় হইবে না। বাকি ১৪৩টি বিষয়ের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বেশিসংখ্যক প্রাদেশিক বিষয় যে ‘৫৬ সালের ১৪টি, তাই প্রদেশগুলিকে দিলেও সাব-ফেডারেশনের ভাগে পড়িবে ৪৯টি। এর সাথে আরেকটি বিষয় সাব ফেডারেশন তালিকায় আসিবে। সেটি সাব-ফেডারেশনের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্ট। এটি হইবে পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রাদেশিক হাইকোর্টের আপিল আদালত।

সে অবস্থায় নিখিল-পাকিস্তান ফেডারেশনের সর্বোচ্চ আদালতের নাম হইবে ফেডারেল কোর্ট। এই অঞ্চলের দুইটি সুপ্রিম কোর্ট হইতে আপিল আসিবে পাকিস্তান ফেডারেল কোর্টে। তাছাড়া এটি হইবে শাসনতান্ত্রিক আদালত।

অতএব দেখা গেল যে পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন-ভিত্তিক পাকিস্তান ফেডারেশনের স্বার্থে পশ্চিম-পাকিস্তানে একটি যোনাল ফেডারেশন হওয়া অপরিহার্য এবং প্রদেশগুলির স্বায়ত্তশাসন বজায় রাখিয়াও সেটা করা সম্ভব।

বলা যাইতে পারে পশ্চিম পাকিস্তানে যোনাল ফেডারেশন না করিয়াও ত পূর্ব-বাংলার পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দাবি পূরণ করা যায়। তা যদি হয়, তবে পশ্চিমে যোনাল ফেডারেশন হইল কি হইল না, তা লইয়া পূর্ব-বাংগালীদের মাথা ব্যথা কেন? হ, এটা একটা অল্টারনেটিভ বটে। দুই উইং-এ ‘প্রদেশ’ থাকিল পাঁচটাই। কিন্তু পূর্ব বাংলা প্রদেশকে পশ্চিমা দেশগুলির চেয়ে অনেক বেশি স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হইল। এতে কি আপত্তি আছে? আপত্তি দুইটা। এক, পূর্ব বাংলার গ্রহণযোগ্য-মাফিক স্বায়ত্তশাসন দিতে হইলে সেটা নামে প্রাদেশিক হইলেও কাজে আঞ্চলিক হইতে হইবে। পূর্ব-বাংলার দাবিমত সেটা ফেডারেল তিনটি বিষয় ছাড়া আর সব। দুই, এইভাবে দুই অঞ্চলের প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের পরিমাণে এত পার্থক্য থাকিলে কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা, রাজ, বাজেট ও কেন্দ্র-প্রদেশের সম্পর্কে এত জটিলতা দেখা দিবে যে তাতে পাকিস্তানের ঐক্য ও নিরাপত্তা বিপন্ন হইতে বেশি দিন লাগিবে না। নেতারা পরীক্ষা করিয়া দেখিতে পারেন।

১০. প্যারিটি বনাম জনসংখ্যা

আগেই বলিয়াছি, পশ্চিম-পাকিস্তানে ওয়ান ইউনিটের বিরুদ্ধে যেরূপ আন্দোলন হইয়াছিল, পূর্ব-পাকিস্তানে প্যারিটির বিরুদ্ধে তেমন কোনও আন্দোলন ছিল না। পূর্ব পাকিস্তানের জনপ্রিয় পার্টিসমূহের কোন একটিরও মেনিফেস্টোতে প্যারিটি-বিরোধী কোনও দফা ছিল না। আজও নাই। এটা ঐতিহাসিক সত্য যে পূর্ব-পাকিস্তানের সংখ্যা-গুরুত্ব কাটিয়া যেদিন বড়লাটের অর্ডিন্যান্স-বলে প্রতিনিধিত্বে দুই অঞ্চলের মধ্যে প্যারিটি প্রবর্তিত হয়, সে দিন পূর্ব-বাংলার জনমত ত দূরের কথা আইন পরিষদের মতও নেওয়া হয় নাই।

তবু শেষ পর্যন্ত আঞ্চলিক পূর্ণ-স্বায়ত্তশাসন, যুক্ত-নির্বাচন, বাংলা রাষ্ট্রভাষা ও কেন্দ্রীয় সর্ব-ব্যাপারে প্যারিটির স্বীকৃতির বিনিময়ে প্রতিনিধিত্বের প্যারিটি পূর্ব-বাংলা মানিয়া লইয়াছিল। শেষ পর্যন্ত লাহোর-প্রস্তাব-ভিত্তিক দুই অঞ্চলের পূর্ণ অটনমি ও সমতার অন্যতম নিদর্শন হিসাবে প্রতিনিধিত্বের প্যারিটিকে নীতি হিসাবেই মানিয়া নেওয়া হইয়াছিল। প্যারিটি চলিত থাকার দশ বছরের মধ্যে কেন্দ্রের দ্বারা পূর্ব-বাংলার উপর অত-সব অন্যায় অবিচারের মধ্যেও পূর্ব-পাকিস্তানীরা শুধু পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন ও চাকরি-বাকরিসহ সকল ব্যাপারে সমান অধিকারই দাবি করিয়াছে। কোনও নেতা বা পার্টিই প্রতিনিধিত্বে সংখ্যাগুরুত্ব দাবি করেন নাই।

প্যারিটি যদি শুধু পূর্ব-পাকিস্তানীদের মেজরিটি নষ্ট করিবার উদ্দেশ্যেই করা হয়, তবে স্পষ্টতঃই তাতে কেউ রাযী হইতে পারেন না। পাকিস্তানের রাজধানীসহ কেন্দ্রীয় সমস্ত শক্তি ও অর্থ-সংস্থাই পশ্চিম-পাকিস্তানে অবস্থিত। এ অবস্থায় জনসংখ্যাই পূর্ব পাকিস্তানের একটিমাত্র শক্তি। পাকিস্তানের বয়সের তেইশটি বছরে পূর্ব পাকিস্তান তার এই সংখ্যা শক্তি নিজের কাজে লাগায় নাই। গোটা পাকিস্তানের নামে কার্যতঃ পশ্চিম-পাকিস্তানের খেদমতেই লাগাইয়াছে। পশ্চিম-পাকিস্তানের নেতারা তার বদলা দিবেন দূরের কথা, কৃতজ্ঞতাও স্বীকার করেন নাই। বরঞ্চ সেন্সেশনের এলম লাগাইয়াছেন। তথাপি যদি পাকিস্তানের স্বার্থে পুনরায় প্যারিটি প্রবর্তনের দরকার হয়, তবে পূর্ব-পাকিস্তানীরা তা মানিতে আবার রাযী হইবে। কিন্তু সে পাকিস্তানের স্বার্থ মানে পূর্ব-পাকিস্তানের স্বার্থও বুঝিতে হইবে। এই দিক হইতে বিষয়টার বিচার করা যাউক।

পাকিস্তানের স্থায়িত্বের সবচেয়ে গ্যারান্টি দুই অঞ্চলের জনগণের সমান শরিকানার মনোভাব। যেদিন উভয় অঞ্চলের জনগণের প্রত্যেকে অনুভব করিবে : পাকিস্তান আমার সম্পদ; এতে আমাদের সমান অধিকার, সেইদিনই রাষ্ট্র হিসাবে পাকিস্তান এবং জাতি হিসাবে পাকিস্তানীরা অক্ষয় হইয়া যাইবে। গত তেইশ বৎসরে আমরা এই মনোভাবটিই সৃষ্টি করিতে পারি নাই। সৃষ্টি হইতে দেই নাই বলিলেই ঠিক কথা বলা হইবে।

আমাদের ভৌগোলিক দূরত্ব, ভাষা-কৃষ্টি, গোষ্ঠী ও ঐতিহ্যের স্বাতন্ত্রের দরুন আমাদের জাতীয় ঐক্য-বোধ সহজাত নয়। আমাদের নেশনহুড আপ্রায়রি নয়। এটা ইতিহাসের ওয়ারিসি নয়। আমরা আগেই রাষ্ট্র গড়িয়াছি। পরে রাষ্ট্রীয় জাতীয়তা গড়িতেছি। এটা আমাদের তৈয়ার করিয়া নিতে হইবে। সেজন্য আমাদের মধ্যে একটা সার্বিক ও সার্বজনীন আমরা চৈতন্য ও আমাদের বোধ সৃষ্টি করিতে হইবে। তার প্রথম পদক্ষেপ হইবে আমাদের দুই উইং-এর মধ্যে সাম্য ও সমতার নিশ্চিত, নিরাপদ ও অপরিবর্তনীয় অনুভূতি। উর্দু ও বাংলাকে সমান মর্যাদার দুইটি রাষ্ট্রভাষা করিয়া আমরা এই সমতাবোধ সৃষ্টির চমৎকার শুভ সূচনা করিয়াছি। এই সমতা বোধকে সম্পূর্ণ ও স্থায়ী করিতে হইলে আমাদের জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় জীবনের সকল ক্ষেত্রে দুই উইং-এর জনগণকে সমান অধিকারী ও ক্ষমতাবান হইতে হইবে। এটা হইতে পারে কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালনে, দেশরক্ষায়, পার্লামেন্টে আইন প্রণয়নে, এক কথায়, রাষ্ট্রশাসনের সামগ্রিকতায়, দুই অঞ্চলের সমতা সুস্পষ্ট ও নিশ্চিত করিয়া। এ সুস্পষ্টতা ও নিশ্চয়তা দিতে পারে শুধু শাসনতান্ত্রিক বিধান।

শাসনতান্ত্রিক বিধান ছাড়াই কতকগুলি কনভেনশন গড়িয়া উঠিতেছিল। পার্লামেন্টারি পদ্ধতি ব্যাহত না হইলে আরও হইত। যথা : প্রেসিডেন্ট ও প্রাইম মিনিস্টার পর্যায়ক্রমে দুই উইং হইতে হওয়া, কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় দুই উইং হইতে সমান সংখ্যক মন্ত্রী নেওয়া ইত্যাদি কনভেনশন গড়িয়াই উঠিয়াছিল। তবু শাসনতান্ত্রিক বিধানের দ্বারা এইগুলি এবং প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট, প্রাইম মিনিস্টার ও ডেপুটি প্রাইম মিনিস্টার অপর উইং হইতে লইবার নিশ্চিত ও তর্কাতীত ব্যবস্থা করা যাইতে পারে। কেন্দ্রীয় চাকরি-বাকরিতেও তেমনি করা যাইতে পারে। করা উচিত।

কিন্তু তাতেই আমাদের সমস্যা মিটিবে না। এ সবের সাথে দুই উইং-এর মধ্যে আর্থিক বন্টনে সমতাও আনিতে হইবে। পাকিস্তানের রাজধানীসহ সমস্ত কেন্দ্রীয় সংস্থা ও বিদেশী মিশনাদি পশ্চিম-পাকিস্তানে অবস্থিত। দুই অঞ্চলের মধ্যে মবিলিটি অব-লেবার-ক্যাপিটাল না থাকায় ঐ সবের খরচের সুবিধা শুধু পশ্চিম-পাকিস্তান পাইতেছে। দুই অঞ্চলের আর্থিক অসাম্যের মূল কারণ এই। এইসব ব্যয় যাতে দুই অঞ্চলের সমান অংশ থাকে, তার নিশ্চিত ব্যবস্থা করিতে হইবে। এই উদ্দেশ্যে অনেকে রাজধানী ঢাকায় আনার দাবি করেন। এ দাবি অন্যায় নয়। কিন্তু ঢাকায় রাজধানী হইলে ঐ একই কারণে পশ্চিম-পাকিস্তানীরা কেন্দ্রীয় ব্যয়ের আয় হইতে বঞ্চিত হইবে। এই অসুবিধা দূর করার জন্য অনেকে কুড়ি বছরের জন্য ঢাকায় রাজধানী আনিতে চান। তার মানে, কুড়ি বছর পরে রাজধানী আবার পশ্চিম-পাকিস্তানে যাইবে। স্পষ্টতঃই এটা স্থায়ী ব্যবস্থা নয়। কাজেই অবাস্তব ও অযৌক্তিক। কায়েদে আযমের করাচিতে রাজধানীকে চিরস্থায়ী করিয়া এবং উপকূল বাণিজ্য জাতীয়করণ ও নিম্নশ্রেণীর ভাড়া সাবসিডাইযড করিয়া জনগণের স্তরে জাতীয় সংহতি প্রসারিত করিলে রাজধানীর তর্ক স্থায়ীভাবে মিটিয়া যাইবে। আর কেন্দ্রীয় সরকারের সাকূল্য ব্যয় দুই অঞ্চলের মধ্যে সমানভাবে বিতরণের শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থা করিলেই দুই উইং-এর আর্থিক অসাম্যের মূল কারণ দূর হইবে। এটা করা সম্ভব। শাসনতান্ত্রিক বিধানের বলে শাসনযান্ত্রিক সংস্কারই এই পন্থা। পাকিস্তানের স্থায়িত্ব ও নিরাপত্তার খাতিরে কোনও ব্যবস্থাই দুঃসাধ্য বিবেচিত হওয়া উচিৎ নয়।

কিন্তু এ সবই সম্ভব দুই ‘উইং’-এর বোঝা পড়া ও আদান-প্রদানের মধ্যে দিয়া। দুই অঞ্চলের এই সার্বিক সমতা আনিতে হইলে পশ্চিম-পাকিস্তানীরা হয়ত প্যারিটি নয়ত উচ্চ-পরিষদের মাধ্যমে পার্লামেন্টের প্রতিনিধিত্বের সমতা চাহিবেন। এটা অসংগত দাবিনয়। পূর্ব-পাকিস্তানীদের উচিত উপরোক্ত শর্তে এই দাবি মানিয়া লওয়া। আমার দৃঢ় বিশ্বাস তারা মানিবেও। ১৯৫৫ সালে পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন ও সর্বক্ষেত্রে প্যারিটির বিনিময়ে প্রতিনিধিত্বের প্যারিটিতে রাযী হইয়া হক সাহেব ও সুহরাওয়ার্দী সাহেব পাঁচদফা মারী চুক্তিতে দস্তখত করিয়াছিলেন। সার্বিক প্যারিটি ও পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন দিয়া সেই চুক্তির পশ্চিম পাকিস্তানী অংশ রক্ষিত হয় নাই বলিয়াই পূর্ব-পাকিস্তানীদের কেউ-কেউ এতদিন পরে জনসংখ্যা ভিত্তিক প্রতিনিধিত্ব দাবি করিয়াছে। পূর্ব-বাংলার মেজরিটির বিনিময়ে যদি পশ্চিম-পাকিস্তানীরা এবার উপরে-বর্ণিত ব্যবস্থা করিয়া দুই অঞ্চলের মধ্যে স্থায়ী সমতা স্থাপন করিতে রাযী হয়, তবে পূর্ব-পাকস্তানীরা নিশ্চয় তাদের মেজরিটি, ত্যাগে সম্মত হইবে। কারণ পূর্ব পাকিস্তানীরা তাদের মেজরিটি দিয়া পশ্চিম-পাকিস্তানের উপর প্রাধান্য করিতে চায় না, নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করিতে চায় মাত্র। পশ্চিম-পাকিস্তানীদের সম্মতিতে সেসব স্বার্থ যদি শাসনতন্ত্রে সুরক্ষিত হইয়া যায়, তবে মেজরিটি দিয়া পূর্ব-পাকিস্তানীরা কি করিবে?

প্রথম গণ-পরিষদে বাংলার প্রতিনিধি ছিলেন ৪৪ জন, পশ্চিম-পাকিস্তানের ছিলেন ২৮ জন। তবু ঐ গণ-পরিষদ পশ্চিম-পাকিস্তানীদের মতের বিরুদ্ধে নিজেদের সংখ্যাগুরুত্ব খাটায় নাই। বরঞ্চ এত উদার নিখিল-পাকিস্তানী মনোভাব দেখাইয়াছে যে তাতে পূর্ব-বাংলার ন্যায্য হকও কোরবানি হইয়া গিয়াছে।

তাছাড়া দুই উইং-এর মধ্যে মেজরিটি-মাইনরিটি কমপ্লেক্স দূর করিবার জন্যই প্রতিনিধিত্বের প্যারিটি হওয়া দরকার। মেজরিটি ও মাইনরিটি কমপ্লেক্সে উইং-এর জন্য পৃথক-পৃথকভাবে এবং পাকিস্তানের জন্য সামগ্রিকভাবে অনিষ্টকর। অতীতে পূর্ব-পাকিস্তানীদের এই মেজরিটি কমপ্লেক্স তাদের আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের গুরুত্ব বুঝিতে দেয় নাই। পূর্ব-পাকিস্তানী মুসলিম লীগ নেতারা বলিতেন, বিশ্বাসও করিতেন : ‘করাচি বসিয়াই আমরা সারা পাকিস্তান শাসন করিব, ঢাকায় ক্ষমতা আনিবার দরকার কি?’ বস্তুতঃ জনসংখ্যা ভিত্তিক প্রতিনিধিত্ব পুনঃপ্রবর্তিত হওয়ার সাথে-সাথে অনেক পশ্চিম-পাকিস্তানী নেতা এই কথাটাই বলা শুরু করিয়াছেন। অথচ পূর্ব-পাকিস্তানের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের প্রয়োজন রাজনৈতিক কারণে নয়, ভৌগোলিক কারণে। মেজরিটি-কমপ্লেক্স-ওয়ালারা এটা বুঝিতে পারেন নাই। এই মেজরিটি-কমপ্লেক্সের প্রতিক্রিয়ায় পশ্চিম-পাকিস্তানী নেতাদের মধ্যে একটা মাইনরিটি-কপ্লেক্স সৃষ্টি হইয়াছে। এই কমপ্লেক্স তাদের মধ্যে নাহক, কিন্তু স্বাভাবিক, এটা পূর্ব-বাংলা-বিরোধী মনোভাব সৃষ্টি করিয়াছে। ফলে পূর্ব-পাকিস্তানের প্রতি জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে পশ্চিমা শাসকরা হাইল হইয়াছেন। পূর্ব-পাকিস্তানের সমস্ত দূর্গতি পশ্চিম-পাকিস্তানী নেতাদের এই মনোভাবের ফলে। পূর্ব-বাংলার মেজরিটিই পশ্চিমা ভাইদের মধ্যে ঐ মনোভাবের স্রষ্টা।

অথচ পূর্ববাংলার এই মেজরিটি এ অঞ্চলের কোনও কাজে অতীতেও লাগে নাই, ভবিষ্যতেও লাগিবে না। এই মেজরিটির জোরে আমরা পাকিস্তানের রাজধানী ও দেশরক্ষা বাহিনীর হেড কোয়ার্টার কার্যতঃ পূর্ব-পাকিস্তানে আনিতে পারিনা। বস্তুতঃ পাকিস্তানীদের মতে কোন কিছুই করিতে পারিব না। এমনকি ভোটের জেরে শাসনও রচনা করিতে পারি না। পশ্চিমা ভাইদের সম্মতিই যদি অপরিহার্য হয়, অবে মেজরিটি আমাদের কোন কাজে লাগিবে?

আরেক দিক হইতে দুই উইং-এ প্রতিনিধিত্বের প্যারিটি হওয়া আবশ্যক। এটা দুই উইং-এর প্রতিনিধিত্বের চিরস্থায়ী নিশ্চয়তা। জনসংখ্যা পরিবর্তনশীল। জনসংখ্যার ভিত্তিতে দুই উইং-এর প্রতিনিধিত্ব থাকিলে সেটাও হইবে পরিবর্তনশীল। তার মানে অনিশ্চয়তা। সুস্পষ্ট কারণেই দুই উইং-এর মধ্যে গণতন্ত্রের মামুলি নিয়ম চলিতে পারে না। প্রতিনিধিত্বের অনিশ্চয়তা দুই উইং-এর সম্পর্কেও অনিশ্চয়তা ও তিক্ততা সৃষ্টি করিতে পারে। যার-তার সংখ্যাবৃদ্ধির প্রতিযোগিতায় অসাধু পন্থা গ্রহণ করিতে পারে। সত্য-সত্যই যদি তা না-ও হয়, তবু আন্তঃআঞ্চলিক সন্দেহ ও তিক্ততা বাড়িবে। পশ্চিম-পাকিস্তানের আয়তন অনেক বেশি। মাইল-প্রতি বসতি কম। কাশ্মির, সীমান্ত এলাকা ও ভারত হইতে আগত লোক-সমাগমে যদি ভবিষ্যতে পশ্চিম-পাকিস্তানের লোসংখ্যা বাড়িয়াও যায়, তবু সেন্সাস রিপোর্টের সত্যতা সম্বন্ধে পূর্ব-পাকিস্তানীরা ভুল বুঝিতে পারে। আগামী শাসনতন্ত্রে সেন্সাস যদি ফেডারেশনের বিষয় থাকে, তবে সেন্সাস কমিশনের হেড অফিস ও অফিসাররা পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত হইবেন এবং চূড়ান্ত সংখ্যা প্রকাশের ক্ষমতাও তাঁদের হাতেই থাকিবে। পক্ষান্তরে সেন্সাস যদি অংগ-রাজ্যের বিষয় হয়, তবে দুই উইং-এর সেন্সাসেই মেনিপপালেশন হইতে পারে। ফলে কেউ কারোটা বিশ্বাস করিবে না। এইভাবে ভুল বুঝাবুঝির সম্ভাবনা রহিয়াছে। তাছাড়া সত্য-সত্যই যদি পূর্ব-পাকিস্তান লোকসংখ্যায় মাইনরিটি হইয়া যায় তবে সে অবস্থায় বর্তমানে পূর্ব-পাকিস্তানের একমাত্র শক্তি যে সংখ্যাধিক্য তারও অবসান হইবে। সকলদিক হইতে পূর্ব পাকিস্তানীরা অসহায় হইয়া পড়িবে। সে উপায়হীনতা আমাদের বরাতে অনেক বিপদ আনিতে পারে। কি কি বিপদ-হইতে পারে তা চোখে আংগুল দিয়া দেখাইবার দরকার নাই। পাঠকগণ তা অনুমান করিতে পারেন।

১১. এক চেম্বার না দুই চেম্বার?

জনসংখ্যার ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় পরিষদ গঠিত হইতে যাইতেছে। তাই প্রশ্ন উঠিয়াছেঃ এক চেম্বার, না দুই চেম্বার? প্রশ্নটা উঠিয়াছে স্বাভাবিকভাবেই। পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের প্রতিনিধিত্বের প্যারিটি যখন উঠিয়া গিয়াছে তখনই ধরিয়া নেওয়া হইয়াছে, দুই চেম্বারের পার্লামেন্ট হইতে হইবে। সভ্য জগতের বড়-বড় প্রায় সব দেশেই দুই চেম্বারের পার্লামেন্ট প্রচলিত আছে। ফেডারেল পদ্ধতির রাষ্ট্রে ত আছেই,ইউনিটরি পদ্ধরি রাষ্ট্রও আছে। তাই অনেকে ধরিয়া লইয়াছেন যে পাকিস্তান যখন ফেডারেল রাষ্ট্র তখন এরও পার্লামেন্ট দুই কক্ষ-বিশিষ্ট হইতে বাধ্য। এই দিক দিয়া কথাটা দৃশ্যতঃ ন্যায়সংগত। তাই এটা প্রধানতঃ পশ্চিম পাকিস্তানী নেতাদের কথা হইলেও পূর্ব-পাকিস্তানের কোনও-কোনও নেতাও এর সমর্থন করিতেছেন। এক চেম্বারের পার্লামেন্টে পূর্ব-পাকিস্তানীদের নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকিবে। সেই মেজরিটির জোরে তারা দেশের শাসন ব্যাপারে পশ্চিম-পাকিস্তানীদের উপর অবাধ কর্তৃত্ব করিবে। এই ভয় হইতেই পশ্চিম-পাকিস্তানী নেতারা দুই পরিষদের কথা তুলিয়াছেন এটা কারো-কারো জন্য সত্য হইলেও সকলের জন্য সত্য নয়। দুনিয়ার সব ফেডারেল রাষ্ট্রেই দুই চেম্বারের পার্লামেন্ট আছে যে কারণে, ঠিক সেই কারণেই তাঁরাও দুই চেম্বারের কথা বলিতেছেন, এটা ধরিয়া লওয়া যাইতে পারে। আর যদি এটাও সত্য হয় যে পশ্চিম-পাকিস্তানী নেতারা পূর্ব-পাকিস্তানের মেজরিটি চেক করিবার উদ্দেশ্যেই দুই চেম্বারের কথা ভাবিতেছেন, তবু তাঁদের দোষ দেওয়া যায় না। কারণ, ফেডারেল রাষ্ট্রে বড় অংগরাজ্যের যুলুম হইতে ছোট অংগরাজ্যগুলিকে বাঁচাইবার রক্ষাকবচ হিসাবেই দুই চেম্বারের বিধান করা হইয়াছে।

দুনিয়ার রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ক্রমবিকাশ আলোচনা করিলে দেখা যাইবে যে পার্লামেন্টে একটি উচ্চ পরিষদ সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য দুইটি। এক, গণতন্ত্রের মোটরের ব্রেক, ঘোড়ার লাগাম। দুই, ফেডারেল রাষ্ট্রে হোট-ঘোট অংগরাজ্যের রক্ষাকবচ। পাকিস্তানে প্রধানতঃ পূর্ব-পাকিস্তানের মেজরিটির মোকাবেলায় পশ্চিম-পাকিস্তানের হোট-ঘোট অংগরাজ্যগুলিকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যেই দুই চেম্বারের কল্পনা করা হইয়াছিল। পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র রচনার ইতিহাস আলোচনা করিলেই তা বোঝা যাইবে। এ ব্যাপারে লিয়াকত আলী, নাফিমুদ্দিন ও মোহাম্মদ আলী এই তিন প্রধানমন্ত্রী শাসনতন্ত্রের তিনটি মূলনীতির প্রস্তাব করিয়াছেন। লিয়াকত আলীর মূলনীতিতে ছিল নিম্ন পরিষদে জনসংখ্যার প্রতিনিধি; উচ্চ পরিষদে পাঁচ প্রদেশের সমান-সমান প্রতিনিধি নাযিমুদ্দিনের ফরমূলায় ছিল দুই চেম্বারই প্যারিটি-ভিত্তিক। এই ব্যবস্থায় পশ্চিম-পাকিস্তানের রক্ষাকবচ ডবল করা হইয়াছিল। মোহাম্মদ আলী-ফরমূলায় ছিল নিম্ন পরিষদ জনসংখ্যার ভিত্তিতে। উচ্চ পরিষদে পাঁচ প্রদেশের প্রত্যেকে দশ জন করিয়া। এতে দুই পরিষদকে সমান ক্ষমতা দেওয়া হইয়াছিল। অধিকন্তু ব্যবস্থা করা হইয়াছিল, দূই পরিষদের যুক্ত বৈঠকে ‘পূর্ব-বাংলা’ ও ‘পশ্চিম যোন’-এর মধ্যে প্যারিটি হইবে। অনাস্থা প্রস্তাবে ও প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দুই অঞ্চলের প্রত্যেকটির অন্ততঃ শতকরা ত্রিশ জনের ভোট পাইতে হইবে। অবশেষে চৌধুরী মোহাম্মদ আলীর নেতৃত্বেনয়া গণ-পরিষদ ঘাড়ের পিছন ঘুরাইয়া প্যারিটি প্রবর্তনের বদলে সোজাসুজি প্যারিটি ভিত্তিক এক চেম্বারের পার্লামেন্ট করিলেন।

এই বিশ্লেষণে বোঝা গেল যে পাকিস্তানের রাষ্ট্রনেতারা বরাবরই দুই অঞ্চলের প্রতিনিধিত্বে সংখ্যা-সাম্য রাখার পক্ষপাতী ছিলেন। পূর্ব-বাংলার মেজরিটির উপর একটা চেক। শুধু নাযিমুদ্দিন-ফরমূলাতে আরও একটা বেশি চেকের ব্যবস্থা ছিল। ঐ ফরমূলায় নিম্ন পরিষদের দুই অঞ্চলের প্রতিনিধিত্বে প্যারিটি থাকা সত্ত্বেও একটা প্যারিটি-ভিত্তিক উচ্চ পরিষদ রাখা হইয়াছিল। পূর্ব-বাংলার মেজরিটি চেক করা ছাড়াও তাতে আরেকটা উদ্দেশ্য ছিল। সেটা গণতন্ত্রের মুখে লাগাম।

রাষ্ট্র বিজ্ঞানীরা বলিয়া থাকেন, উচ্চ পরিষদ গণতন্ত্রের মোটরের চাকার ব্রেক, ঘোড়ার লাগাম। এটার দরকার আছে। গণতন্ত্র সাধারণতঃ দ্রুত সংস্কারকামী। কারণ ‘স্টেটাস কো’, প্রচলিত সমাজ ও আর্থিক ব্যবস্থা, অনেক ক্ষেত্রেই জনগণের স্বার্থ বিরোধী। তাই জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা বিপ্লবাত্মক আইন করিয়া অতি দ্রুত সংস্কার সাধন করিতে চান। এতে ক্রন্ত-ব্যস্ততার দরুন অনেক সময় ভুল ও অনিষ্টকর আইন করা হইয়া যায়। উচ্চ পরিষদ এই বেপরোয়া আইন-কানুন ধীরে সুস্থে বিচার-বিবেচনা করিয়া ওগুলির ভালমন্দ দেখিতে ও দেখাইতে পারেন। এক কথায় নিজ গণতন্ত্রের দ্রুত গতি একটু মন্থর করিয়া দেওয়াই উচ্চ পরিষদের কাজ। নাযিমুদ্দিন সাহেবের ফরমূলা এই কাজটিও করিতে চাহিয়াছিল। তিনি দুই অঞ্চলের প্যারিটি করিয়া পূর্ববাংলার মেজরিটি চেক করিয়াছিলেন এবং উচ্চ পরিষদ দিয়া গোটা পাকিস্তানের গণতন্ত্রের ঘোড়ার মুখে লাগাম লাগাইবার ব্যবস্থা করিয়াছিলেন। এটাও দোষের ছিল না। এই উদ্দেশ্যে উচ্চ পরিষদ গঠন করার রেওয়াজ সারা দুনিয়াতেই আছে তবে এটা বোঝা গেল যে এক নাযিমুদ্দিন-ফরমূলা ছাড়া আর কোনও ফরমূলায় দুই অঞ্চলের সংখ্যা-সাম্য ব্যতীত উচ্চ পরিষদের আর কোনও উদ্দেশ্য ছিল না। তা যদি তাঁরা চাহিতেন, তবে প্রাদেশিক পরিষদেও দুই চেম্বারের ব্যবস্থা করিতেন। আমাদের প্রতিবেশী ভারতে এবং বন্ধু রাষ্ট্র আমেরিকায় অনেক অংগ-রাজ্যেই দুই চেম্বারের পরিষদ আছে।

এখন এই দুই শ্রেণীর উচ্চ পরিষদের মধ্যে প্রথমটির আলোচনা করা যাক আগে। বোঝা গেল অবাধ গণতন্ত্র পূর্ণ অবস্থার অভাবেই গোড়াতে উচ্চ পরিষদের প্রবর্তন হইয়াছিল। উচ্চ পরিষদ ছাড়া পার্লামেন্টকে তখন সত্যই ব্রেকহীন মোটর ও লাগামহীন ঘোড়া মনে করা হইত। ধরিয়া লওয়া যাক, গণতন্ত্রের বিকাশের প্রাথমিক স্তরে এটার দরকার ছিল। নব-লব্ধ স্বাধীন ক্ষমতার অতি উৎসাহে ভুল করা অসম্ভব ছিল না। মাথার উপরে উচ্চ পরিষদের মত একটা প্রবীণ মুরুব্বির না হয় তখন দরকার ছিল। কিন্তু আজও কি দরকার আছে? সব সভ্য দেশেই এর প্রচলন দেখিয়া মনে হইবে, বোধ হয় আজও দরকার আছে। কাজেই ব্যাপারটা একটু তলাইয়া দেখা দরকার।

দুই দিক হইতে এর বিচার করা যাইতে পারে। এক, কিভাবে উচ্চ পরিষদ গঠিত হইবে। দুই, তার ক্ষমতা কতটুকু থাকিবে? গঠন-পদ্ধতির কথাই আগে ধরা যাউক। এর আকার যে ছোট হইবে, এটা ধরিয়া লওয়া যায়। প্রশ্ন এই, এটা নির্বাচিত হইবে কি না? নির্বাচিত হইলে প্রত্যক্ষ না পরোক্ষ ভোট হইবে? নির্বাচিত না হইয়া মনোনীত হইতে পারে। যথা : ইংলণ্ডে লর্ড সভা। ওতে নির্বাচন নাই। ওটা বংশানুক্রমিকও। রাজা যদি কাউকে লর্ড পদবি দেন, তবে তিনিও লর্ড সভার মেম্বর হইবেন। নির্বাচিত উচ্চ পরিষদ যদি পরোক্ষ নির্বাচনে হয় তবে নিম্ন পরিষদ সদস্যদের ভোটে অথবা উভয়ের যুক্ত ভোটে হইতে পারে। যদি প্রত্যক্ষ ভোটে হয়, তবে ভোটারদের ও প্রার্থীদের এলাকা সংকীর্ণ করিয়া তা করা যাইতে পারে। যেমন ধরুন, শুধূ আয়করদাতারাই ভোটার হইবেন। আর বিজ্ঞানী, দার্শনিক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, অধ্যাপক, শিক্ষক প্রভৃতি বিশেষজ্ঞরাই প্রার্থী হইতে পারিবেন।

তারপর ধরুন ক্ষমতার কথা। উচ্চ পরিষদের ক্ষমতা নিম্ন পরিষদের সমান থাকিতে পারে; কমও থাকিতে পারে। এমন ব্যবস্থাও করা যাইতে পারে যে উচ্চ পরিষদ নিজেরা কোনও ট্যাক্স বসাইতে বা আইন করিতে পারিবে না। শুধু নিন পরিষদের রচিত আইন বা বসানো ট্যাক্স ঠেকাইয়া পুনর্বিবেচনার জন্য নিম্ন পরিষদে ফেরত পাঠাইতে পারিবে।

ইংলণ্ডের লর্ড-সভার অনুকরণে মনোনীত উচ্চ পরিষদ আর কোনও দেশে নাই। ভবিষ্যতেও হইবে না এটা ধরিয়া নিলাম। বাকী থাকিল পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ নির্বাচনের উচ্চ পরিষদ। যদি আইন পরিষদের মেম্বরদের দ্বারা পরোক্ষ নির্বাচনে উচ্চ পরিষদ হয়, তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মন্ত্রীদের দলের লোকই নির্বাচিত হইবেন। কারণ স্পষ্টতঃই তাঁরাই মেজরিটি। তাতে উচ্চ পরিষদ নিম্ন পরিষদের ছায়া হইবে মাত্র। দৃশ্যতঃই এমন উচ্চ পরিষদের দরকার নাই। আর যদি তা সংকীর্ণ নির্বাচকমন্ডলীর দ্বারা নির্বাচিত হয়, তবে সেটা হইবে আমের চেয়ে আটি বড় করা। গোটা দেশবাসীর নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাজে বাধা দিবার ক্ষমতা দেশের এক অংশের বা এক শ্রেণীর হাতে তুলিয়া দেওয়া। ক্ষমতায় যদি তাঁরা নিম পরিষদের সমান হন, তবে কথায়-কথায় ডেডলক হইবে। দেশের শাসনকার্য সাবলীল গণতান্ত্রিক উপায়ে পরিচালিত হইবে না। আবশ্যকতার দিক দিয়াও এমন উচ্চ পরিষদের দরকার নাই। প্রথমতঃ, একই ব্যক্তি সব বিষয়ের বিশেষজ্ঞ হইতে পারেন না। বরঞ্চ এক ব্যাপারের বিশেষজ্ঞ লোক অন্য ব্যাপারে একেবারে উখি হওয়ারই সম্ভাবনা বেশি। দ্বিতীয়তঃ বিশেষজ্ঞদের উপদেশ ও সহযোগিতা সরকার সব সময়ই নিতে পারেন। তার জন্য বিশেষজ্ঞদের আইন পরিষদের মেম্বর হওয়ার দরকার নাই।

তারপর অর্ডিন্যান্স ছাড়া অন্য কোনও উপায়ে ত্রস্ত-ব্যস্ততার সাথে আইন পাশ করা আজকাল সম্ভব নয়। খোদ আইন পরিষদের ভিতরেই জনমত যাচাই এর জন্য সার্কুলেশন মোশন আছে; সিলেক্ট কমিটি আছে; জেনারেল ডিসকাশন, ক্লয-বাই ক্লয ডিসকাশন ও থার্ড রিডিং-এর ব্যবস্থা আছে। বাইরে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ সংবাদপত্রের আলোচনা-সমালোচনা আছে। সভা-সমিতির বক্তৃতা-মঞ্চ আছে। এতসব আট-ঘাট পার হইয়া একটা বিল আইনে পরিণত হইতে এক সেশন পার হইয়া আরেক সেশনে চলিয়া যায়। এতে প্রায়শঃ বছর কাল কাটিয়া যায়। ফলে এ-ব্যও আইন পাশ হওয়ার আশংকা আজকাল একরূপ নাই বলিলেই চলে। এর পরেও যদি কখনো এমন কোনও আইন হইয়াই যায়, তবে তাতে বাধা দেওয়ার জন্য হাইকোট-সুপ্রিম কোর্টে রীটের ব্যবস্থা আছে। ভারতে ব্যাংক জাতীয়করণের আইনটিই এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এ ব্যাপারে উচ্চ পরিষদ কাজে লাগে নাই। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট কাজে লাগিয়াছে।ফলে, উচ্চ পরিষদ অনাবশ্যক প্রমাণিত হইয়াছে।

তারপর থাকিল ফেডারেল রাষ্ট্রে হোট অংগ-রাজ্যের রক্ষাকবচের কথা। এখানেও উচ্চ পরিষদ অনাবশ্যক হইয়া পড়িয়াছে। সব গণতান্ত্রিক দেশেই আজ দলীয় রাজনীতি কায়েম হইয়াছে। মেম্বাররা দলীয় শৃঙ্খলা মানিয়া চলেন। পার্টি ওয়ারি ভোট দেন। প্রদেশ-ওয়ারি ভোট দেন না। পাকিস্তানেও তাইহইতে বাধ্য। এখানেও নিখিল পাকিস্তান-ভিত্তিক অনেক পার্টি আছে। তাদের মেম্বাররাও পার্টি আনুগত্য অনুসারেই ভোট দিবেন। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান-ভিত্তিতে ভোট দিবেন না। কাজেই এখন আর এক অঞ্চলের মেজরিটির দ্বারা অপর অঞ্চলের উপর যুলুম হওয়ার আশংকা নাই। তা ঠেকাইবার জন্য কাজেই উচ্চ পরিষদেরও আবশ্যকতা নাই।

তবু-যে দুনিয়ার সব দেশের পার্লামেন্টে উচ্চ পরিষদ দেখা যায়, সেটাকে ফ্যাশন বা অভ্যাস বলা যাইতে পারে। বিলাতের পার্লামেন্টকে মাদার-অব-পার্লামেন্টস-অব দি ওয়ার্ল্ড বলা হয়। গোড়াতেই ইংলন্ডের হাউস অব-লর্ডসের অনুণেই বিভিন্ন দেশে উচ্চ পরিষদের প্রবর্তন হইয়াছিল। সেটাই আজ অভ্যাসে পরিণত হইয়াছে। কিন্তু ইংলণ্ডে কোনও লিখিত কনস্টিটিউশন না থাকায় কমন্স সভা আইন করিয়া লর্ড সভার ক্ষমতা দিনের পর দিন কাড়িয়া লইতেছে। লিখিত শাসনতন্ত্র দেশে একাজ সহজ হইবে না। শুধু জটিলতা বাড়িবে। ফেডারেল স্টেটে হোট-ঘোট অংগরাজ্যের স্বার্থরক্ষাই বর্তমানে উচ্চ পরিষদ রাখার একমাত্র যুক্তি। শাসনতন্ত্র ফেডারেশন অংগরাজ্যের অধিকারের সীমানির্দেশ করিয়া আদালতকে সে সীমারক্ষার ক্ষমতা দিলেই এই সমস্যার উচ্চ পরিষদের চেয়ে তাল সমাধান হইবে। এই সব কারণে পাকিস্তানে উক্ত পরিষদের দরকার নাই। এর পরেও যদি উচ্চ পরিষদ করা হয়, তবে সেটা হইবে বিনা-কাজে সাদা হাতী পোকা মাত্র। পাকিস্তানের মত গরিব রাষ্ট্র সে বিলাসিতা না থাকাই ভাল।

১২. পাকিস্তানী জাতীয়তাবাদ

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া তাঁর লিগ্যাল মেওয়ার্কে পাকিস্তান রাষ্ট্রের নাম, প্রিয়েম্বল, ডিরেকটিত প্রিন্সিপলস ও ইসলামী বিধান সম্পর্কে ৫৬ সালের শাসন ও ‘৬২ সালের (সংশোধিত) শাসনতন্ত্রের বিধানসমূহ গণ-পরিষদের জন্য বাধ্যতামূলক করিয়া অন্ততঃ একটি ব্যাপারে পাকিস্তান রাষ্ট্রের ক্ষতি করিয়াছেন। এইসব বিধান পাকিস্তানী নেশন গঠনের বাধা সৃষ্টি করিয়াছে। পাকিস্তান রাষ্ট্রের স্থায়িত্বের দিক হইতে পাকিস্তানী নেশনের ব্যাপারটা গুরুতর সুদূরপ্রসারী প্রশ্ন। এমন ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার পক্ষে ‘৫৬ সাল ও ‘৬২ সাপের শাসনতন্ত্রের অনুসরণ করা উচিৎ ছিল না। ‘৬২ সালের শাসনতন্ত্র ব্যক্তির দান; গণ-প্রতিনিধিদের দ্বারা রচিত নয়। ‘৫৬ শাসনতন্ত্রের আইন গত বুনিয়াদ ছিল বটে, কিন্তু এটা প্রকৃত অর্থে প্রস্তাবিত ‘৭০ সালের রচিত শাসনতন্ত্রের মত গণতান্ত্রিক পন্থায় রচিত হয় নাই। সার্বজনীন ভোটের প্রত্যক্ষ নির্বাচিত তিন শ’ তেরজন প্রতিনিধির গণ-পরিষদে এবারই প্রথম পাকিস্তানের শাসনন্ত্র রচিত হইতেছে। এই শাসনতন্ত্র পাকিস্তানী নেশনহুডের বুনিয়াদে রচিত না হওয়া খুবই পরিতাপের বিষয় হইবে।

পাকিস্তান একটি নেশন-স্টেট, জাতি-রাষ্ট্র। জাতি-রাষ্ট্রের অধিবাসীরা জাতি ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে যার-তার রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় জাতি, নেশন। এই হিসাবে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে পাকিস্তানের সব বাঁশিন্দা লইয়াই পাকিস্তানী নেশন। এটা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পয়লা সবক। কিন্তু আমাদের দেশের অনেক রাজনীতিবিদ এটা মানেন না। তাঁরা বলেন, শুধু মুসলমানদের লইয়াই পাকিস্তানী জাতি গঠিত। পাকিস্তান মুসলিম জাতীয়তাবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত। এটা তাঁদের ভুল। মুসলিম জাতি নামে কোনও রাষ্ট্রীয় জাতি বা নেশন হইতে পারে না। পাকিস্তানের সব বাঁশিন্দারাই যদি মুসলমান হইত, তবু তাদের মুসলিম জাতি বলা যাইত না। কারণ নেশন হইতে গেলেই একটি রাষ্ট্র লাগে। রাষ্ট্র হইতে গেলেই একটি ভূখণ্ড বা টেরিটরি লাগে। সেই টেরিটরির নাম অনুসারেই রাস্ট্রীয় জাতির নামকরণ করা হয়। ধর্মের ভিত্তিতে কোনও নেশন হয় না। ধর্মের নামানুসরে রাষ্ট্রেরও নাম হয় না। কাজেই নেশনেরও নামে হয় না। এটা কার্যতঃ অসম্ভব। কারণ দুনিয়ায় ষাট কোটি মুসলমান আছে। তারা প্রায় ত্রিশটি মুসলিম প্রধান দেশের শাসক। তাদের একটাও মুসলিম রাষ্ট্র বা ইসলামী রাষ্ট্র নামে পরিচিত নয়। অধিবাসীরাও মুসলিম নেশন নামে নিজ দেশের বাজাতিসংঘে স্বীকৃত নয়। ধর্মের দিক দিয়া এই ষাট কোটি মুসলমানই এক জাতি। কিন্তু সে জাতির নাম নেশন বা কম নয়। সে জাতির নাম মিল্লত। দুনিয়ার সব মুসলমান এক মিল্লতের অন্তর্ভুক্ত হইয়াও রাষ্ট্রীয় জাতি বা নেশন হিসাবে পৃথক, স্বতন্ত্র এবং সম্পূর্ণ ভিন্ন-ভিন্ন স্বার্থের অধিকারী। কারণ তাদের টেরিটরি ও নাগরিক অধিকার সীমাবদ্ধ। সে অধিকার লইয়া তাদের মধ্যে বিরোধ ও গোলাগুলিও হইয়া থাকে। টেরিটরিয়াল নামেই তাদের নেশন গঠিত। তাদের ন্যাশনালিযম ও টেরিটরির চতুঃসীমা এক ও অভিন্ন।

তারপর অবিভক্ত ভারতে মুসলিম-অমুসলিম মিলিয়া এক নেশন হইতে পারি নাই বলিয়া পাকিস্তানেও পারিব না, একথাও ঠিক নয়। অখন্ড ভারতে যা পারি নাই, পাকিস্তানে তা পারিব বলিয়াই দেশ ভাগ করিয়া পাকিস্তান বানাইয়াছি। এটাই পাকিস্তান ও অখন্ড ভারতের মৌলিক ও বুনিয়াদী পার্থক্য। অখণ্ড ভারতে হিন্দু মেজরিটি। পাকিস্তানে মুসলিম মেজরিটি। গণতন্ত্রে মেজরিটি শাসন। মুসলমানরাও হিন্দুদের মতই গনতন্ত্রে বিশ্বাসী। কিন্তু গণতান্ত্রিক অখণ্ড ভারতে হিন্দু মেজরিটির শাসনে আমরা মুসলমানরা আস্থা স্থাপন করিতে পারি নাই। আমাদের বিচারে হিন্দুরা ধর্মীয় ব্যাপারে সংকীর্ণ ও সামাজিক ব্যাপারে অনুদার। আমাদের বিবেচনায় এই সংকীর্ণতা ও অনুদারতার দরুন হাজার বছর এক দেশে বাস করিয়াও আমরা এক সমাজ, সুতরাং এক জাতি হইতে পারি নাই। এই কারণে এদের মেজরিটি শাসনে মুসলমানদের সাংস্কৃতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হইবে, এই আশংকা মুসলমানদের ভিত্তিহীন ছিল না। তাই মুসলিম ভারতের নেতা কায়েদে আযম হিন্দু নেতাদেরে বলিলেন : চল, ভারতভূমিতে একটির বদলে দুইটি রাষ্ট্র করি। একটিতে তোমরা শাসন কর, আরেকটিতে আমরা করি। চল, আমরা প্রতিযোগিতা করি, কে কত উদার, কে কেমন গণন্ত্রী, কে কি রকম জাতীয়তাবাদী। এরই নাম পাকিস্তান দাবি। কায়েদে-আযম সারাজীবন এই একই গণতান্ত্রিক জাতীয়তাঁর কথা বলিয়াছেন। পাকিস্তান গণ-পরিষদের উদ্বোধনী বক্তৃতায়ও তিনি সেই কথাই বলিয়াছেন। এই কথাটাই তাঁর রাজনৈতিক আদর্শের শেষ বাণী লাস্ট টেস্টামেন্ট, ওসিয়ত। ওটাই পাকিস্তানী জাতীয়তার মূলসূত্র। নেশন-স্টেট হিসাবে উহাই পাকিস্তানের বুনিয়াদ। এই মূলসূত্র অনুসারে ধর্ম-বর্ণ-জাতি গোষ্ঠী-নির্বিশেষে পাকিস্তানের সকল অধিবাসী হইবে পাকিস্তানী জাতির মেম্বর। পাকিস্তানে ধর্মে-বর্ণে, উচ্চে-নীচে, শরিফে-রযিলে, কালায়-ধলায় কোনও ভেদাভেদ, কোনও অসাম্য থাকিবে না। পাকিস্তান হইবে সাম্যের রাষ্ট্র। জনগণ হইবে এর মালিক। জনগণের সকলে ও প্রত্যেকে হইবে পাকিস্তানের সভারেনটির সমান অংশীদার। এই সাম্যের দিক হইতে পাকিস্তান হইবে ভারতের চেয়ে ত নিশ্চয়ই দুনিয়ার সব রাষ্ট্র হইতেই শ্রেষ্ঠ। এমন রাষ্ট্রকে সকল পাকিস্তানী অন্তর দিয়া ভালবাসিবে। এর নাগরিকতায় গৌরববোধ করিবে। এমন নাগরিকতা কেউ হারাইতে চাহিবেনা। প্রাণের বিনিময়ে তা রক্ষা করিবে। এখানে ধর্মে-ধর্মে কোন বিরোধ থাকিবে না। সম্প্রদায়ে-সম্প্রদায়ে কোন সংঘাত হইবে না। সকল ধর্মবিশ্বাসই হইবে এখানে নিরাপদ। এমনি করিয়া পাকিস্তান হইবে আদর্শ রাষ্ট্র। পাকিস্তানী নেশন হইবে আদর্শ জাতি। পাকিস্তানে এটা করিবার ক্ষমতা আমাদের মুসলমানদের হাতে। কারণ আমরা এখানে মেজরিটি। অখন্ড ভারতে এটা আমরা করিতে পারিতাম না। কারণ সেখানে ছিলাম আমরা মাইনরিটি।

দ্বিতীয়তঃ, পাকিস্তানে আমরা মুসলমানরা পৃথক নেশন থাকিলে এখানকার অমুসলামন মাইনরিটিরাও থাকিবে পৃথক-পৃথক নেশন। তাতে পাকিস্তান সুসংবদ্ধ এক-নেশন-স্টেট থাকিবে না। হইবে অসংবদ্ধ মালটি-নেশনে-টে। জাতিসংঘের মানবাধিকার নীতি বলে তারা আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার, এমন কি পাকিস্তানের মধ্যে তাদের ন্যাশনাল হোমল্যান্ড দাবি করিতে পারিবে। এতে কি পাকিস্তানের আন্তর্জাতিক বিরোধীদের লীলাভূমি হইয়া উঠিবে না? পাকিস্তানী নেশনের অংশীদার হইতে না পারিলে মাইনরিটিরা কি স্বাভাবিকভাবেই অন্য দেশীয় ধর্মভ্রাতাদের সহিত রাজনৈতিক মিতালি পাতিবার আশকারা পাইবে না? পাকিস্তান রাষ্ট্রের অহিতকামীরা, বিশেষতঃ ভারতের সাম্প্রদায়িকতাবাদী রাষ্ট্রনেতারা, সে পরিস্থিতির সুযোগ গ্রহণ করিবেন না?

তৃতীয়তঃ, ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তানে যদি বহু নেশন থাকিতে পারে, তবে রেশিয়াল ও ভাষা-ভিত্তিক বহু নেশনও থাকিতে পারে। বস্তুতঃ মুসলিম জাতীয়তার দাবিদার পাকিস্তানের রাষ্ট্র-নেতারা রেশিয়াল ও লিংগুইস্টিক ন্যাশনালিযমের দাবিকে উষ্কানী দিতেছেন ও জোরদার করিতেছেন। বাংগালী-সিন্ধী-পাঠান-পাঞ্জাবী-বেলুচী জাতীয়তার দাবি উঠিতেছে। মুসলিম-হিন্দু-খৃষ্টান-বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদের প্রতিক্রিয়ায়। ফলে মুসলিম জাতীয়তাবাদের মতই বাংগালী-সিন্ধী-পাঠান-পাঞ্জাবী, জাতীয়তাবাদ ও পাকিস্তানী জাতীয়তাবাদের প্রতিবন্ধকতা করিতেছে। অথচ উভয় পক্ষের কথাতেই আংশিক সত্য নিহিত রহিয়াছে।

একদিকে পাকিস্তানের বিপুল মেজরিটি মুসলমান। তাদের ধর্ম ইসলাম। ইসলামী মূল্য-বোধ তাদের জীবনাদর্শের মাপকাঠি। সকলে সব সময়ে দৈনন্দিন জীবনে নিত্যনৈমিত্তিক কাজে সে মূল্য-বোধ প্রয়োগ করিতে পারি আর না পারি, ওটা আমাদের ধার্মিক ও কৃষ্টিক জীবনাদর্শ ও মূলনীতি। সে আদর্শ রূপায়ণের ও নীতি পালনের কোনরূপ শাসনতান্ত্রিক ও শাসনযান্ত্রিক প্রতিবন্ধকতাই আমরা বরদাশত করিব না। এই সবই ঠিক। বস্তুতঃ ভারতীয় মুসলমানদের ধর্মীয় স্বাধীনতার ও কৃষ্টিক স্বকীয়তার পূর্ণ বিকাশ লাভে কোন রাীয় ও সামাজিক বিঘ্ন সৃষ্টি করিতে কেউ না পারে, পাকিস্তান সৃষ্টির অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য তাই।

অন্যদিকে পাকিস্তানের অধিবাসীরা রেশিয়ালি বিভিন্ন জাতে বিভক্ত। ভাষা সাহিত্যে ও কৃষ্টি-শিয়ে তারা স্ব। এই রেশিয়াল জাত হিসাবে তারা বাংগালী, সিন্ধী, পাঠান, পাঞ্জাবী, বেলুচ নামে বিভক্ত। এই রেশিয়াল ঐতিহ্যে ও স্বাতন্ত্র্য তারা লজ্জিত নয়। বরঞ্চ আরব, তুর্কী, ইরানীর মতই গর্বিত। কিন্তু পাকিস্তানে এরা ন্যাশনালিটি মাত্র। কেউই নেশন নয়। তারা সবাই পাকিস্তান নেশনের অন্তর্ভুক্ত। এই হিসাবে রেশিয়াল স্বাতন্ত্র্যর বিচারে পাকিস্তান মালটি-নেশন স্টেট নয়, মালটি ন্যাশনালিটি স্টেট। দুনিয়ার অধিকাংশ নেশন-স্টেটই গোড়াতে মান্টি-ন্যাশনালিটি স্টেট ছিল। দীর্ঘদিন একই গণতান্ত্রিক শাসনাধীনে থাকিয়া তারা আজ এমনভাবে এক নেশনে পরিণত হইয়াছে যে গোড়ার সে স্বাতন্ত্র ও পার্থক্য আজ খুজিয়া বাহির করিতে হয়। শুধু মার্কিনী জাতিই নয়, ইংরেজ, জার্মান, ফরাসী জাতিও গোড়াতে বিভিন্ন রেশিয়াল জাতের সমন্বয়ে গঠিত হইয়াছিল। শুধু মার্কিন মুল্লুকেই ইংলিশ, আইরিশ, ফরাসী, জার্মান জাতিসমূহের সময় হয় নাই, খোদ ইংরেজ জাতি ও এংলো স্যাকসন ও নর্মানদের মিশ্রণে গঠিত হইয়াছে। ফ্যাংকিং, টিউটনস, প্রশিয়ানস, অরিয়ানস লইয়া জার্মান জাতি গঠিত হইয়াছে। গণতান্ত্রিক সাম্যের দেশ পাকিস্তানেও আমরা একদিন পাকিস্তানী নেশনে সংগঠিত ও পরিণত হইতে পারি। এটা তবেই সম্ভব যদি আমরা রাস্ত্রীয় সামাজিক আর্থিক ও কৃষ্টিক সমস্যা না বাড়াই। যদি বর্তমান সমস্যাগুলোর সুই সমাধান করি। যদি আমাদের ভৌগোলিক আঞ্চলিকতাকে রাজনৈতিক কৌশলে ডিংগাইতে পারি। যদি সমস্ত প্রদেশ অঞ্চলে, সকল ভাষা-কৃষ্টি এবং সমুদয় শিল্প সাহিত্যকে ইউনি-কালার করিবার জন্য রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার না করি। যদি আমরা পাকিস্তানকে হাজার ফুলের গুলবাগিচা বানাই।

এখানেই আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের ভুলে আমাদের লেখক-সাহিত্যিক চিন্তানায়করা জাতিকে দুই বিপরীত দিক হইতে টানিতেছেন। একদল পাকিস্তানীদেরে মক্কা-মদিনা-দামেশক-বাগদাদের দিকে টানিতেছেন। আরেক দল মঙ্কো-পিকিং কলিকাতা-শান্তিনিকেতনের দিকে টানিতেছেন। পাকিস্তানের দিকে কেউ টানিতেছেন। পাকিস্তানের রূহ তাঁরা সবাই পাকিস্তানের বাইরে তালাশ করিতেছেন। পাকিস্তানের ভিতরে সে রূহের সন্ধান কেউ করিতেছেন না। ‘উর্দু-ফারসীতে’, ‘মাদেরেওতন’ বলা গেলেও বাংলায় দেশ-জননী বলা যাইবে না : এক দল বলিতেছেন ধর্মের দোহাই দিয়া। দেশকে যদি ‘মা’ বলা নাই যায়, তবে চন্ডীকেই ‘মা’ বলিব : বলিতেছেন আরেক দল রেশিয়াল ঐতিহ্যের দোহাই দিয়া। একটা আরেকটার প্রতিবাদ, প্রতিধ্বনি। দুইটাই ব্যক্তির মত। জাতির মত নয় একটাও। এসব ব্যক্তিগত বাদানুবাদ ও রুচিঅভিরুচির গলার জোর খতম হইবে না যতদিন অবাধ গণ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জন-মতের বাদশাহি প্রতিষ্ঠিত না হইবে।

মুসলিম মেজরিটির দেশে গণতন্ত্রই ইসলাম বাঁচাইয়া রাখিবে। নেতাদের চেষ্টায় শাসনতন্ত্র বিধান করিয়া ইসলাম রক্ষা করা যাইবে না। পাকিস্তানে গণতন্ত্রের বিপদই আসলে ইসলামের বিপদ।

নিরংকুশ গণতন্ত্রই পাকিস্তান বাঁচাইয়া রাখিবে। পাকিস্তানের ইষ্ট-অনিষ্টই আমাদের বিচার্য। কারণ মানুষ এটা করিতে পারে। ইসলাম আল্লার-দেওয়া ধর্ম। মানুষ তার অনিষ্ট বা ধ্বংস সাধন করিতে পারে না। কিন্তু পাকিস্তান মানুষের তৈয়ারী রাষ্ট্র। মানুষ এটার অনিষ্ট করিতে, এমন কি, এর ধ্বংস সাধনও করিতে পারে। পাকিস্তান সৃষ্টির আগেও ইসলাম ছিল। খোদা-না-খাস্তা, পাকিস্তানের যদি কোনও অশুভ পরিণতি ঘটে, তবে তার পরেও ইসলাম থাকিবে। সে অবস্থায় ইসলামের কিছু হইবে না : কিন্তু পাকিস্তানী মুসলমানের বরাতে দুঃখ আছে। তবু যে আমরা পাকিস্তান বাঁচাইয়া রাখিবার চেষ্টার বদলে ইসলাম বাঁচাইয়া রাখিবার চেষ্টা করিতেছি, এ সবই আমাদের রাজনৈতিক চিন্তার অপরিচ্ছন্নতার লক্ষণ। পাকিস্তানে বসিয়া পাকিস্তানী জাতীয়তাবাদ না বোঝা তারই প্রমাণ। যতদিন এই অপরিচ্ছন্নতা না ঘুচিবে, ততদিন গণতন্ত্রের নামে ‘কনট্রোলড’, ’ব্যাসিক’ ও ‘গাইডেড’ ডেমোক্র্যাসির কথা এবং জাতীয় পরিচিতির নামে ‘মুসলিম জাতি’ ‘বাংগালী জাতি’ ‘সিন্ধী’ জাতির কথা শুনিতে হইবেই। চিন্তার এই অপরিচ্ছন্নতা দূর হইবে নিরংকুশ গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠায়। তেমন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হইতে পারে সার্বজনীন প্রত্যক্ষ নির্বাচনে সার্বভৌম পার্লামেন্ট গঠনে। সে গণতন্ত্রকে কোনও বিশেষ বিধানেই সংকুচিত করা চলিবে না। নিরংকুশ অসংকুচিত সার্বজনীন গণতান্ত্রিক নির্বাচন হইতে পারে শুধুমাত্র ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে পাকিস্তানী জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে। পাকিস্তানের নিরাপত্তাও নিহিত হইয়াছে সেইখানেই।

শেষ কথা

আমার কথা প্রায় শেষ। যা-কিছু বলিয়াছি, তাতে পাকিস্তানের জাতীয় সমস্যাগুলির দিকে যদি নেতৃবৃন্দের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ও সচেতন মন আকর্ষণ করিতে পারিয়া থাকি, তবে আমার কাজও প্রায় শেষ।

গত তেইশ বছরে নেতারা এ সমস্যাগুলির সুষ্ঠু সমাধান করিতে পারেন নাই। কাজেই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াও পারেন নাই। এতে বিয়ের কিছু নাই। সমাধানের বদলে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া কতকগুলি মিটানো ব্যাপারে আবার তাজা করিয়াছেন। এতেও আশ্চর্যের কিছু নাই। নেতারা নিজেরাই এসব লইয়া গিরো দেওয়া ও গিরো খুলার কাজ বহুবার করিয়াছেন। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াই বলুন, আর সাবেক প্রেসিডেন্ট আইউবই বলুন, পলিটিশিয়ানদের মতই তাঁরাও দেশের ইন্টেলিজেনশিয়ারই অংশ। অতএব তাঁরাও আমাদের জাতীয় রাজনৈতিক চিন্তা-ধারার আকারেরই প্রতিবিম্ব।

এ সবের মধ্যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার বিশেষত্ব এই যে তিনি আইউবের কাড়িয়া-নেওয়া গণতন্ত্র দেশবাসীকে আবার ফিরাইয়া দিতেছেন। এটাই আজ পাকিস্তানী রাজনীতির সবচেয়ে বড় কথা। এই কথারও সুন্দরতম দিক এই যে তিনি জনগণের স্তরে দেশের শাসনতন্ত্র রচনার সুযোগ করিয়া দিয়াছেন। এটাই নেতাদের মহা পরীক্ষা। এ পরীক্ষায় পাস করিতেই হইবে। কোনও অজুহাতেই এ পরীক্ষায় ফেল করা চলিবে না। গণ-পরিষদের সার্বভৌমত্বের অভাবে শাসনতন্ত্র রচনা করিতে পারিলাম না বলাও যা, উঠানের দোষে ভাল নাচিতে পারিলাম না বলাও তাই। ও কথা বলা না গেলে, এ কথাও বলা চলিবে না।

গণতন্ত্রই জনগণের সার্বভৌমত্ব দিয়া থাকে। গণতন্ত্রহীন পরিবেশে জনগণের সার্বভৌমত্ব থাকে না। জনগণের সার্বভৌমত্ব না থাকিলে তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদেরও সার্বভৌমত্ব থাকিতে পারে না। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায়ই জনগণের সার্বভৌমত্ব আসিবে। জনগণের সার্বভৌমত্বই তাদের নির্বাচিত পার্লামেন্টকে সার্বভৌমত্ব দিবে। অতএব আগে গণতন্ত্র। তারপরে সার্বভৌমত্ব।

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার-দেওয়া লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্কের অনেক ত্রুটি আছে। কিন্তু সেটা বড় কথা নয়। এই ত্রুটিপূর্ণ ফ্রেমওয়ার্কের মধ্য দিয়াই জনগণের নির্বাচিত সরকারের হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা হস্তান্তরিত হইতে পারে। এটাই বড় কথা। নির্বাচিত পার্লামেন্ট ও প্রতিনিধিত্বমূলক সরকারের হাতে ক্ষমতা আসিলে তাঁদের সার্বভৌমত্ব চ্যালেঞ্জ করিবার কেউ থাকিবেন না। তখন সেই সার্বভৌম পার্লামেন্টে ফ্রেমওয়ার্ক ও তজ্জনিত শাসনতান্ত্রিক দোষত্রুটি সবই সংশোধন করা যাইবে। এইভাবে নির্বাচিত পার্লামেন্ট ও প্রতিনিধিত্বমূলক সরকারের রাজনৈতিক মুক্তি ঘটিলে তাঁদের ‘মনিব’ যে জনগণ, তাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তি আপনিই সাধিত হইবে। যে নির্বাচিত পার্লামেন্ট ও প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার মেহনতী জনতার অর্থনৈতিক মুক্তি আনিবেন না, জনগণ ব্যালট-বাক্সের বিপ্লবের মাধ্যমে তাঁদের অপসারণ ঘটাইবে। অন্য কোনও প্রকারের বিপ্লব দরকারই হইবে না।

কিন্তু একাজে নেতাদের খুব সাবধান হইতে হইবে। দুইশ’ বছরের গোলামী শুধু আমাদের ভাতের দৈন্যই ঘটায় নাই, ভাবের দৈন্যও ঘটাইয়াছে। অভাব আমাদের চতুর্দিকে। কোনটা ফেলিয়া কোনটা আগে মিটাইব? গরিবের সংসার আমাদের এমন দিকভ্রান্তি স্বাভাবিক। কিন্তু নেতৃত্বের পরীক্ষাও এইখানেই। দিকভ্রান্তিতে পথভ্রষ্ট হইলে চলিবে না। আগে-পরের বিচার-বুদ্ধি হারাইলে সব ভণ্ডুল হইয়া যাইবে। অনেক নেতা ইতিমধ্যে এই ভুলই করিতে শুরু করিয়াছেন। এক দল বলিতেছেন : আগে পরিষদের সার্বভৌমত্ব চাই। এদের জবাব আগেই দিয়াছি। অপর দুইটি দলের একদল এক প্রান্ত হইতে বলিতেছেন : ‘ভাতের আগে ধর্ম চাই; দুনিয়ার আগে দিন চাই। অপর প্রান্ত হইতে আরেক দল বলিতেছেন : ভোটের আগে ভাত চাই।’ দুই দলের উদ্দেশ্যই সাধু। ধর্মই যদি না থাকিল, আত্মাই যদি মরিয়া গেল, দুনিয়াবী সুখ-সম্পদ দিয়া তবে কি করিব? অপর পক্ষে খোরাকির অভাবে যদি রাষ্ট্রের মনিব জনগণই মারা গেল, তবে এই ফাঁকা গণতন্ত্র কার কাজে লাগিবে?

কিন্তু প্রশ্ন এই ধর্মই হউক, আর ভাতই হউক, আমরা চাহিতেছি কার কাছে? গোলামের ধর্ম, আর ভিক্ষার চাউলই কি আমাদের কাম্য? কখনই না। ভোটের অভাব হইলেই যদি ভাত আসিত, তবে ভোটাধিকারহীন আইউব শাহির দশ বৎসরে আমাদের পাকঘর তাতে ভাসিয়া যাইত। আর আযাদিহীন ধর্ম-সাধনাই যদি আমাদের কাম্য হইত, তবে ইংরাজ-শাসিত ভারত দারুল-হার্ব হইত না, দারুল ইসলাম হইত। আগে গণতন্ত্র কায়েম হউক। আমরা নিজ হাতে গরিবের খানা পাকাইব। পেট ভরিয়া খাইয়া সুস্থ দেহে শান্ত মনে ধর্ম-কাজ করিব। অতএব আগে চাই গণতন্ত্র।

নেতারা বুঝুন, মার্শাল ল অথরিটি হিসাবে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার যা কর্তব্য ছিল, তা তিনি করিয়াছেন। এখন নির্বাচিত পরিষদের, সুতরাং নেতাদের কর্তব্য শাসন রচনা করা। অনুমোদনের প্রশ্ন লইয়া তাঁদের মাথা ঘামাইবার দরকার নাই। তাঁরা জনগণের গ্রহণযোগ্য একটি শাসনতন্ত্র রচনা করুন। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার উহা গ্রহণযোগ্য হইবেই। জনগণের অনুমোদিত শাসনতন্ত্র প্রেসিডেন্ট অনুমোদন করিতে বাধ্য হইবেন।

অতএব দেখা যাইতেছে গণতন্ত্রের চাবিকাঠি এখন আর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার হাতেনাই। এটা এখন নেতাদের, তথা নির্বাচিত পরিষদের হাতে। জনগণের গ্রহণযোগ্য শাসনত্ম রচনার মধ্যেই সে গোপন চাবিকাঠি নিহিত। এ দায়িত্ব মামুলি গণতান্ত্রিক দায়িত্ব নয়। কারণ পাকিস্তান মামুলি ফেডারেল রাষ্ট্র নয়। ভৌগোলিক বিছিনতাই এটাকে করিয়াছে অসাধারণ। পাকিস্তান একটা, কিন্তু তাঁর পাকস্থলী দুইটা। দুই রিজিওনের ফ্রন্টিয়ার এক না হওয়ায় তাদের ইন্টিরিয়ারও কাজেই এক না। ইন্টিরিয়ার দুইটা হওয়ায় দুই পাকস্থলীর মুখও দুইটা। এই দুই মুখেই দুই পাকস্থলী ভরিতে হইবে। ইসলামী ভ্রাতৃত্ব জাতীয় ঐক্য ও স্ট্রং সেন্টার কোনও যুক্তিতেই এক পেট ভুখা রাখা চলিবে না। পাকিস্তানের শাসনতন্ত্রে এই সমস্যার সমাধান থাকিতে হইবে।

দেশকে এমন শাসন দিতে পারে শুধু সার্বভৌম জনগণই, এটা ঠিক। কিন্তু এটাও তেমনি ঠিক। যে সার্বভৌমত্ব বাইরের কারও দেওয়া-নেওয়ার ব্যাপার নয়। ব্যক্তির যেমন আত্মমর্যাদা বোধ, জাতির তেমনি সার্বভৌমত্ব। উভয়টাই নিজের কাছে। ব্যক্তির আত্মমর্যাদার যা ডিগনিটি, জাতির সার্বভৌমত্বের ভাই ম্যাজেস্টি। সুরুজের কিরণের মতই ওরা স্ব-প্রকাশ।

পাকিস্তানের নেতাদের এই ডিগনিটি ও পাকিস্তানী জনগণের এই ম্যাজেষ্টি সুরুজের কিরণের মতই আত্ম-শক্তিতে প্রকট হউক, পাকিস্তানের জীবনে অমাবস্যার পুনশ্চ আর কোনও দিন না ঘটুক, এই মুনাজাত করিয়া এই পুনশ্চ লেখা শেষ বারের মত শেষ করিলাম। আল্লাহ পাকিস্তানের হেফাযত করুন। আমিন, সুম্মা আমিন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *