২.১৪ কিরীটীর চিঠি

কিরীটীর চিঠি

মালতী দেবীরপত্রখানা পড়ে শেষ করে জাস্টিসমৈত্র আবার কিরীটীর পত্রটি পড়তে লাগলেন।

মালতী দেবীর চিঠিখানা আগাগোড়া পড়লে এ হত্যা-মামলার অনেক কিছুই দিনের আলোর মত আপনার কাছে সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে। বেচারী মালতী দেবী! এখন বোধহয় বুঝতে পারছেন, ডাঃ সুধীনের ব্যাঙ্ক-ব্যালান্সের মোটা অঙ্কটা কোথা হতে সংগৃহীত হয়েছিল এবং কেনই বা সে ইচ্ছাকৃত অস্বীকৃতি দিয়ে নিজেকে বিপদগ্রস্ত করেছিল? ধনুর্বাণ খেলার ছলে সুবিনয় যখন সুহাসকে মারবার চেষ্টা করেন তীরের সঙ্গে বিষ মিশ্রিত করে, নিশানাথ সে-সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন, তাই তিনি পাগলামির ঝোঁকে বলতেন—That child of the past! Again he started his old game! সতীনাথের হত্যার দিন আরও তিনি বলেছিলেন একটা কথা, পাগলের প্রলাপোক্তি বলেই ধরে নেওয়া হয়েছিল, একটি দশ-এগারো বছরের কিশোর বালক—but the seed of the villainy was already in his heart! ধনুর্বাণ খেলার ছলে খেলার তীরের সঙ্গে কুঁচফলের বিষ মাখিয়ে তারই একজন খেলার সাথীকে মারতে গিয়েছিল, কিন্তু সব উল্টে গেল—বিষ মাখানোতীরটা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে একটা গরুকে মেরে ফেললে। মালতী দেবীর চিঠি হতেও প্রমাণিত হয়, সেই কিশোর বালকটি কে। আর কেউ নয়—ঐ সুবিনয় মল্লিক। পাছে কথাটা প্রকাশ হয়ে পড়ে, তাই সুবিনয়ের বিচারে নিশানাথের পৃথিবী হতে অপসারণের প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। তীরে এসে তরী ডোবানো যায় না, নিশানাথকে তাই মৃত্যুবাণ বুক পেতে নিতে হল। নির্মম ভাগ্যচক্র!

মালতী দেবীর চিঠিতেও বুঝতে পেরেছেন এবং আমিও বলছি, সতীনাথ লাহিড়ীকেও মৃত্যুবাণ বুক পেতে নিতে হয়েছে এইজন্য যে সতীনাথ ছিল সুবিনয়ের সকল দুষ্কর্মের সাথী। তার হাতে অনেক প্রমাণই ছিল—এদের মিলিত পাপানুষ্ঠানের। সতীনাথের বেঁচে থাকাটা তাই আর সম্ভবপর হল না।

কিন্তু সে-সব কথা যাক, আসুন আবার আমরা অতীতের ভুলে-যাওয়া-ঘটনার মধ্যে ফিরে যাই। আমরা জানি শ্রীকণ্ঠ মল্লিক নৃসিংহগ্রামের কাছারীবাড়িতে অদৃশ্য আততায়ীর হাতে নৃসংশভাবে নিহত হয়েছিলেন!

কে সেই অদৃশ্য আততায়ী? আর কেনই বা তিনি এমন নিষ্ঠুরভাবে নিহত হলেন? রাজা যজ্ঞেশ্বরের হত্যাকারী তাঁরই পুত্র রত্নেশ্বর। এবং রত্নেশ্বরকে বিষপ্রয়োগে হত্যার প্রচেষ্টা করেন তাঁরই মধ্যম ও কনিষ্ঠ পুত্র সুধাকণ্ঠ ও বাণীকণ্ঠ মল্লিক। অবিশ্যি এটা আমার অনুমান মাত্র। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস দেখুন, রসময় যে মুহূর্তে আর পিতার কাছ থেকে ঝগড়ার সময় শুনল, তার বাপের নতুন উইল অনুযায়ী তিনি রায়পুরের একচ্ছত্র অধীশ্বর হতে পারবেন না, একটি অংশের মাত্র অধিকারী, তখুনি তিনি আর কালবিলম্ব না করে বাপকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করলেন। হয়ত কিছু আগে পরে ঐসময়েই অর্থের লোভে দাগী আসামী পলাতক শিবনারায়ণ রসময়ের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়েছিল। সুহাসের হত্যা-মামলা যখন আপনার কোটে চলতে থাকে তখনই সাক্ষীর কাঠগড়ায় একদিন শিবনারায়ণকে দেখে আমার মনে হয়েছিল তার মুখটা যেন কেমন চেনা-চেনা লাগছে। আমার যেন কেমন একটা দোষ আছে, বিশেষ কোন ব্যক্তির বিশেষ কোন মুখ একবার দেখলেই মনের ক্যামেরার লেন্স দিয়ে সেটা আমি ধরে রাখি মনের মধ্যে। শিবনারায়ণের ছবিও মনের মধ্যে আমার ঠিক তেমনই গেঁথে গিয়েছিল। লালবাজারে ইনটেলিজেন্স ব্রাঞ্চের অ্যালবামে খুঁজলে শিবনারায়ণের ছবিও দেখতে পাবেন, আমি সেটা ইতিমধ্যে মিলিয়ে নিয়েছি। তার আসল নাম পণ্ডিত চৌধুরী। বহুকাল আগে নোট জালের সাধু (?) প্রচেষ্টার মোকদ্দমায় সে একবার বিশ্রীভাবে জড়িয়ে পড়েছিল। পরবর্তীকালে কোনমতে সেই মামলা থেকে রেহাই পেয়ে সুবিনয় মল্লিককে কেমন করে যে তর করল বলতে পারব না, তবে অনুমান করছি হয়ত সুবিনয় মল্লিকই তাঁর যোগ্য সহচরটিকে খুঁজে নিয়েছিলেন বা শিবনারায়ণ নিয়েছিল খুঁজে। আরও একটা কথা—একবার তার সঙ্গে আমার প্রচণ্ড সংঘর্ষ হয়েছিল, কিন্তু উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে তাকে বাঁধতে পারিনি সেবার। সে গল্প আর একদিন আপনাকে বলব।

আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে,আমি আগাগোড়াই বলে আসছি, রায়পুরের এই বিরাট হত্যার ব্যাপারে মূলে আছে—অর্থম অনর্থম! সুবিনয় মল্লিককে আপনি সাজা দিতে পারবেন কিনা জানি না, তবে এই বিরাট হত্যাযজ্ঞের অন্যতম প্রধান হোতা হচ্ছেন তিনিই—প্রথমে তাঁর পিতা রসময়কে হত্যা করানো শিবনারায়ণের সাহায্যে এবং তারপরে ডাঃ সুধীন চৌধুরীর পিতা সুরেন চৌধুরীকে হত্যা করবার চেষ্টা।

কিন্তু কথায় বলে না, শয়তানেরও বাপ আছে! শিবনারায়ণ সুবিনয়ের উপর আর এক চাল চাললে। সুরেন চৌধুরীকে হত্যা না করে তাকে নৃসিংহগ্রামের পুরাতন প্রাসাদের এক গুপ্তকক্ষে গুম করে রাখে। এবং তার বদলে তৃতীয় একজন ব্যক্তিকে, যে শ্রীকণ্ঠ মল্লিকের হত্যার সময় শিবনারায়ণকে সাহায্য করেছিল, তাকে হত্যা করে এক ঢিলে দুই পাখি মারল।

হত্যা করার পর মৃতদেহটি এমনভাবে ক্ষতবিক্ষত করা হয়েছিল যে তাকে আর চেনবার কোনও উপায় ছিল না। এমন কি দেহ হতে মস্তকটিকে একেবারে প্রায় দ্বিখণ্ডিত করে দেওয়ায় কেউ চিনতেই পারেনি আসলে নিহত ব্যক্তি সুরেন চৌধুরীই কিনা। অবিশ্যি তৎসত্ত্বেও একমাত্র যিনি চিনতে পারতেন তিনি সুধীনের মা, সুহাসিনী দেবী। কিন্তু স্বামীর মৃত্যুসংবাদে তখনকার তাঁর মনের অবস্থা এমন ছিল যে, সে সময় সত্য-মিথ্যা যাচাই করে দেখবার মত কোন ক্ষমতাই তাঁর তখন থাকতে পারে না। তিনি মৃতদেহ দেখেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান এবং জ্ঞান হবার পূর্বেই মৃতদেহ সরিয়ে ফেলা হয়। লোক জানল সুরেন চৌধুরীই নিহত হয়েছেন।

কিন্তু এখন কথা হচ্ছে, কেন শিবনারায়ণ সুরেন চৌধুরীকে হত্যা না করে গুম করে রেখেছিল দীর্ঘকাল ধরে! কিসের আশায়? আগেই বলেছি শিবনারায়ণ কী চরিত্রের লোক। দুটি কারণে শিবনারায়ণ সুধীন চৌধুরীকে গুম করে রেখেছিল হত্যা না করে। প্রথমত সত্যিই যদি কোনোদিন কোনো কারণে তার কীর্তিকলাপ অন্যের চক্ষে ধরা পড়েও, সে অনায়াসেই গুপ্তকক্ষ থেকে সুরেনকে এনে সাফাই গাইতে পারবে। এবং দ্বিতীয়ত সুরেন চৌধুরী তার হাতে থাকলে, সেই সঙ্গে সুবিনয় মল্লিকও তার হাতের মুঠোর মধ্যে থাকে এবং সহজেই ইচ্ছামত সুবিনয়কে দোহন করতে পারা যাবে। কখনো দোহন করতে করতে যদি সুবিনয় কোনোদিন কোনো কারণে বেঁকে বসেন, তাহলে সে-মুহূর্তে শিবনারায়ণ অনায়াসেই তার গুপ্ত বাণ (সুরেন চৌধুরী যে আসলে নিহত হয়নি) সুবিনয়ের প্রতি প্রয়োগ করতে পারবে। ক্রিমিন্যালদের সাইকোলজি বড় অদ্ভুত, না! এখন কথা হচ্ছে, এই গোপন ব্যাপার আর কেউ জানত কিনা? হ্যাঁ জানত, একজন জানত। সে আমাদের হারাধনের পৌত্র জগন্নাথ মল্লিক। চমকে উঠছেন, না? সত্যি চমকাবারই কথা।

তাহলে এবারে আমাদের নাটকের চতুর্থ অঙ্কে আসা যাক। আগেই বলেছি, এই চিঠির মধ্যে নিশ্চয়ই আপনার মনে আছে, নিলোভ হারাধনের পৌত্র জগন্নাথ সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির। যে রক্ত পিতামহ সুধাকণ্ঠের শরীরে ছিল, সেই রক্তই প্রবাহিত হচ্ছে জগন্নাথের শরীরের প্রতি শিরা ও ধমনীতে। এবং জগন্নাথ সেই দৃষিত রক্তের ডাকেই সাড়া দিয়েছে। হয়তো বলবেন, হারাধন ও জগন্নাথের পিতার শরীরেও তো সেই রক্তধারাই প্রবাহিত হচ্ছিল, কিন্তু তাঁর তো রক্তের ডাকে সাড়া দেননি! এবং তাঁদেরই ছেলে জগন্নাথ তবে কেন এ পথে এল? তার জবাবে আমি বলব, অনেক বংশে, কেউ পাগল থাকলে, পরবর্তী পুরুষে অনেক সময় সেই পাগলামি আবার ফিরে যেমন আসে এবং হয়ত মাঝখানে দু-একটা পুরুষ বাদ। যায়—এর বেলাতেও হয়ত তাই হয়েছে। জেনেটিকস-এ তাই বলে। যা হোক, যে লোভ হারাধন বা তাঁর ছেলেকে বিচলিত করতে পারিনি, সেই লোভের আগুনেই জগন্নাথ তার হাত দুটি পোড়াল। জগন্নাথকে প্রথম আমি কবে কেমন করে সন্দেহ করি, জানেন? রায়পুরে গিয়ে হারাধনের ওখানে যখন দুদিন কাটাই সেই সময়ে। লেখাপড়ায় জগন্নাথ ছেলেটি অত্যন্ত চৌকশ। হারাধনের মুখেই একদিন শুনেছিলাম, ছোটবেলা থেকেই একবার পড়বার বই পেলে জগন্নাথ আর কিছুই চাইত না। সেই জগন্নাথ হঠাৎ এম. এ. পড়তে পড়তে পড়াশুনা একদম ছেড়ে দিয়ে তার দাদুর অসুখের অজুহাত নিয়ে রায়পুরে এসে বসল। আর একটা জিনিস, জগন্নাথের সঙ্গে রায়পুরের স্টেট সংক্রান্ত কোনো কথাবার্তা বললেই বোঝা যায়, কি প্রচণ্ড একটা ঘৃণা সে পোষণ করে রায়পুর স্টেট ও তৎসংক্রান্ত লোকদের ওপরে।

জগন্নাথ শিক্ষিত ও মার্জিত রুচিসম্পন্ন উচ্চাকাঙ্ক্ষী তরুণ যুবক। মানুষের মনে যে ঘৃণার উদ্রেক হয় তা অনেক কারণে হয়, তার মধ্যে অন্যতম দুটি কারণ হচ্ছে, প্রথমত কোন কারণবশত হয়ত আপনাকে আমার একেবারেই পছন্দ নয়, আপনি নীচ ও জঘন্য প্রকৃতির, আমার সমকক্ষ একেবারেই নন—আপনার প্রতি সহজেই আমার একটা ঘৃণা জন্মাবে। দ্বিতীয়ত আমি আপনার সমকক্ষ নই, আমার সকল প্রকার ধরা-ছোঁয়া ও নাগালের বাইরে আপনি, অথচ সর্বদা আমি অনুভব করছি, আমাদের পরস্পরের মধ্যে যে বৈষম্য, সেটা নিছক ভাগ্যদোষে হয়েছে। আপনি আমার চাইতে কোনো অংশে শ্রেষ্ঠ নন—তথাপি আপনার নাগাল পাবার আমার উপায় নেই। এবং এই যে ব্যর্থতা সর্বদা আমায় পীড়ন করছে, এই ব্যর্থতা হতেই ক্রমে আপনার প্রতি আমার একটা ঘৃণার ভাব আসতে পারে এবং তখন কেবল এই কথাটাই আমি ভাবব, আমাদের পরস্পরের মধ্যে যদি কোনো পার্থক্যই হওয়া উচিত নয়, তথাপি আপনি আমার নাগালের বাইরে। এ অবিচার, এ অন্যায়। এই ধরনের ঘৃণা হতে অনেক সময় মানুষ ঘৃণার ব্যক্তিকে খুন পর্যন্ত করতেও পশ্চাৎপদ হয় না। জগন্নাথের অন্তরে এই দ্বিতীয়োক্ত ঘৃণাই প্রবল হয়ে উঠেছিল রায়পুরের রাজবাটীর সকলের বিরুদ্ধে।

হারাধনের মুখেই আমি শুনেছি, বর্তমানে হারাধনের যা সঙ্গতি আছে, তাতে সহজভাবে জগন্নাথের জীবন চলে যেতে পারে। কিন্তু জগন্নাথের মনে ছিল আরও উচ্চাশা। আমি আরও জানতে পেরেছি, ভাগ্যক্রমে নয়ই বরং বলা চলতে পারে একান্ত দুভাগ্যক্রমে, মৃত ছোট কুমার সুহাসের সঙ্গে একই কলেজে একই শ্রেণীতে জগন্নাথ পড়ত। লেখাপড়ায় সুহাসের চাইতে জগন্নাথ অনেক শ্রেষ্ঠ ছিল। অথচ সুহাসের পক্ষে যে প্রাচুর্যতা সম্ভবপর ছিল, জগন্নাথের পক্ষে সেটা ছিল দুঃসাধ্য। কারণ হারাধনের এত পয়সা নেই যে জগন্নাথকে সুহাসের মত সমানভাবে মানুষ করেন। সুহাসের বিলাত যাওয়ার সব ঠিক হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু জগন্নাথ হারাধনের কাছে সে প্রস্তাব করায়, হারাধন স্পষ্টই তার অসামর্থ্যের কথা জানিয়ে দেন। কোনো একদিন গল্পের ছলে হারাধন জগন্নাথকে শ্ৰীকণ্ঠের উইলের কথা বলেছিলেন। সেই গল্প শোনার পর হতেই হয়ত জগন্নাথের অবচেতন মনে একটা প্রবল ঘৃণা জন্ম নেয়। এবং হয়ত মনে হয়েছে, তার সৌভাগ্যক্রমে আজ যে বস্তুটা পেয়ে সুহাস ভাগ্যবান, দুর্ভাগ্যক্রমে তা হতে বঞ্চিত হয়ে জগন্নাথ নিজে ব্যর্থ ও ভাগ্যহীন। এবং ক্রমে যত দিন যেতে থাকে, নানা ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে সেটা জগন্নাথের মনে আরো প্রকট হয়ে উঠতে থাকে। সেই অবিশ্রাম ঘৃণার ছিদ্রপথেই জগন্নাথের দেহে শনি প্রবেশ করে। যে অর্থে সম্ভাবনা তার হাতে এসেও ফসকে গেছে দুর্ভাগ্যক্রমে, সেই অর্থকে করায়ত্ত করবার জন্য সে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়। গোপনে সে নৃসিংহগ্রামে গিয়ে সেইখানকার পুরাতন ভৃত্য দুঃখীরামকে অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে হাত করে।

সুরেন চৌধুরী যে নৃসিংহগ্রামের কাছারী-বাড়ির গুপ্তকক্ষে শিবনারায়ণের হাতে বন্দী হয়ে আছে সে সংবাদ দুঃখীরাম অর্থের বিনিময়ে জগন্নাথকে সরবরাহ করে। ধূর্ত জগন্নাথ তখন আর এক চাল চালে। সুবিনয় মল্লিককে সেই সংবাদ দিয়ে তাকে ব্ল্যাকমেল করতে মনস্থ করে। এবং তার পূর্বে সেই সংবাদের সত্য-মিথ্যা যাচাই করবার জন্যই জগন্নাথ নৃসিংহগ্রামে গিয়ে হাজির হয়। দুর্ভাগ্যবশত আমার নির্দেশমত সুব্রত তখন নৃসিংহগ্রামে উপস্থিত এবং সেও তখন সুরেনের অস্তিত্ব গুপ্তকক্ষে টের পেয়েছে।

জগন্নাথকে গুপ্তকক্ষের দরজার সামনে ছেড়ে দিয়ে দুঃখীরাম বিদায় নেয়। সুব্রত গুপ্তকক্ষে উপস্থিত। জগন্নাথকে নৃসিংহগ্রামে কাছারী-বাড়ির গুপ্তকক্ষে দেখে সুব্রত বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। ঠিক সেই সময়ে শিবনারায়ণও সেই কক্ষে গিয়ে প্রবেশ করল। ভেবে দেখুন নাটকের কত বড় ক্লাইমেক্স!

কূটচক্রী শিবনারায়ণ জগন্নাথকে অমনি আকস্মিকভাবে পাতালঘরে আবির্ভূত হতে দেখে কি ভেবেছিল তা সে-ই জানে, তবে সুব্রতর জবানীতে সেই মুহূর্তে শিবনারায়ণের কথা শুনে এইটেই মনে হয় যে, ব্যাপারটা শিবনারায়ণেরও ধারণার অতীত ছিল।

ধূর্ত শিবনারায়ণ সহসা ঐ মুহূর্তে জগন্নাথকে দেখে হয়ত ভেবেছিল, জগন্নাথ সুবিনয়েরই নিযুক্ত চর। এবং ঐ সময়কার শিবনারায়ণের কথাবার্তা শুনে মনে হয়, জগন্নাথের আসল পরিচয়ও যেমন সে জানত না, তেমনি জগন্নাথের ঐভাবে ঐ ঘরের মধ্যে আবির্ভাবের উদ্দেশ্যটাও বুঝে উঠতে পারেনি। চোরের মন বোঁচকার দিকেই থাকে সর্বদা, এতে আশ্চর্য হবার তেমন কিছুই নেই। ব্ল্যাকমেল করে দীর্ঘকাল ধরে শিবনারায়ণও যে সুবিনয়ের কাছ হতে কত টাকা নিয়েছে কে বলতে পারে! এতদিন সে নিশ্চিন্তই ছিল, কিন্তু হঠাৎ জগন্নাথকে দেখে মনে হয়েছিল হয়ত তার দিন ফুরিয়েছে।

জগন্নাথ ঠিক কেন ঐরাত্রে পাতালঘরে গিয়ে প্রবেশ করে তা সঠিকভাবে বোঝ না গেলেও, একটা মীমাংসায় হয়তো অনায়াসেই আমরা আসতে পারি। সেটা হচ্ছে এই, জগন্নাথ নিশ্চয়ই জানত না সুব্রত পাতালঘরের সন্ধান পেয়েছে ইতিপূর্বে এবং সেখানে সুরেন চৌধুরীর অস্তিত্ব সম্পর্কে জানতে পেরেছে। এবং এও হয়ত সে-কারণেই জানত না, ঠিক ঐ রাত্রে ঐ সময় শিবনারায়ণ ও সুব্রত পাতালঘরেই আছে। আমার ধারণা অবিশ্যি ভুলও হতে পারে, জগন্নাথ ঐ রাত্রে দুঃখীরামের সাহায্যে পাতালঘরে প্রবেশ করেছিল, সবার অলক্ষ্যে সুরেন চৌধুরীকে পাতালঘর থেকে সরিয়ে অন্যত্র কোথাও নিয়ে যাবার জন্য। এবং একবার সুরেন চৌধুরীকে সরিয়ে নিজের মুঠোর মধ্যে আনতে পারলে, তারপর সে নিশ্চিন্ত হয়ে নিজের প্ল্যান-মাফিক কাজ করতে পারবে।

আমার ধারণা, এই বিচিত্র হত্যা-নাটকের চতুর্থ অঙ্কই হচ্ছে শ্রীমান জগন্নাথের প্ল্যান বা পরিকল্পনা। আপনি হয়ত জানেন, আমরা অনেক সময় আমাদের সৎপ্রণোদিত কাজের মধ্য দিয়েও অন্যের সর্বনাশ ডেকে আনি। এক্ষেত্রে রাজা শ্রীকণ্ঠ মল্লিকও তাই করেছিলেন।  পূর্বপুরুষের, বিশেষ করে জন্মদাতা পিতার অন্যায়ের প্রতিকারের জন্য তিনি পরবর্তী জীবনে যে শেষ উইলটি করেছিলেন, যার ফলে এতগুলো নির্মম হত্যা একটার পর একটা হয়ে গেল, সেই উইলই হল কাল।

রাজা শ্রীকণ্ঠ মল্লিক যদি হত্যার কিছুদিন পূর্বে দ্বিতীয় উইলটি না করতেন, হারাধনের পৌত্র জগন্নাথকে এভাবে রায়পুরের মাকড়সার জালের মধ্যে জড়িয়ে পড়তে হত না। আমার অনুমান মাত্র, কারণ জগন্নাথ আর ইহজগতে নেই। নির্মম নিয়তির অমোঘ বিধানে সে তার দুর্নিবার লোভের উপযুক্ত মাশুলই কড়ায়-গণ্ডায় বোধ হয় শোধ করে গেছে। নাহলে একবার ভেবে দেখুন, কী তার অভাব ছিল! তার পিতামহ হারাধন মল্লিক যা রেখে যেতেন মৃত্যুর পর, জগন্নাথের বাকি জীবনটা সুখে-স্বচ্ছন্দেই কেটে যেত। কোনো আর্থিক অভাবই তার হত না কোনোদিন। তাছাড়া তার ভাগ্যে যদি রায়পুরের সম্পত্তি-লাভ থাকতই, তবে মৃত্যুর পূর্বে রত্নেশ্বর ওভাবে তাঁর পুত্রদের বঞ্চিত করে যাবেনই বা কেন? যে ধনে তার সহজ দাবি ছিল, সে ধন হতে কেন সে বঞ্চিত হবে? তাই মনে হয়, এ বিধাতার অভিশাপ ছাড়া আর কি! তাই সন্তুষ্ট সে হতে পারল না এবং মরীচিকার পশ্চাতে ছুটে গেল। পিতামহের স্নেহের নীড় থেকে ছুটে গেল আলোকশিখালোভী পতঙ্গের মত; হতভাগ্য ছুটে গেল কোথায়–না নৃসিংহগ্রামের পাতালঘরে! ভেবে দেখুন লোভের কি নির্মম প্রায়শ্চিত্ত! কী করুণ মৃত্যু!

অভিশপ্ত এই রায়পুর স্টেট ও তার বিশাল ধনসম্ভার। রাজা রত্নেশ্বর, রাজা রসময়, রাজা শ্রীকণ্ঠ, সুহাস মল্লিক, নিশানাথ মল্লিক, সতীনাথ লাহিড়ী, জগন্নাথ মল্লিক একের পর এক নিষ্ঠুরভাবে নিহত হয়েছেন এবং শিবনারায়ণ আজ বদ্ধ উন্মাদ। রাজা সুবিনয়। ধর্মাধিকরণের বিচারের অপেক্ষায়। সত্যি এ ধরনের জটিল ও নৃশংস হত্যার মামলায় ইতিপূর্বে আমি হাত দিইনি জাস্টিস মৈত্র!

জগন্নাথ পরিকল্পনা করেছিল হয়ত সুরেন চৌধুরীকে পাতালঘর থেকে উদ্ধার করে নিজের কাছে রেখে কৌশলে ভীতিপ্রদর্শন করে একই সঙ্গে রাজা সুবিনয় মল্লিক ও শিবনারায়ণের নিকট থেকে অর্থশোষণ করবে। একেবারে সাদা কথায় যাকে বলে black-mailing! এবং হয়তো অর্থশোষণ করাই তার ইচ্ছা ছিল, কেননা জগন্নাথ জানত সুবিনয়ের নিকট থেকে সম্পত্তির ভাগ পাওয়া সুদূরপরাহত। যে নিজের ভাইকেও, যাকে শিশুকাল হতে দেখে আসছে, ঐ সম্পত্তির জন্য অকাতরে খুন করতে পারে–আর যাই সে দিক সম্পত্তির ভাগ নিশ্চয়ই দেবে না! জগন্নাথের প্রয়োজন যখন অর্থের, তখন যে উপায়েই থোক অর্থ পেলেই হল— তা সে সম্পত্তি-প্রাপ্তির মধ্য দিয়েই হোক বা অন্য কোন পথে অর্থপ্রাপ্তির মধ্য দিয়েই হোক।

এখন কথা হচ্ছে, জগন্নাথের হঠাৎকেন সন্দেহ হয় যে সুরেনচৌধুরী আজও মরেননি—বেঁচে আছেন এবং হয়ত নৃসিংহগ্রামের পুরাতন প্রাসাদেই কোথাও-না-কোথায়ও আছেন। আমার ধারণা জগন্নাথ কোনক্রমে ব্যাপারটা নৃসিংহগ্রামের কাছারীর শিবনারায়ণের ভৃত্য দুঃখীরামকে টাকা খাইয়ে তাকে হাত করেই জেনেছিল। এবং যখন সে-কথা সে জানতে পারল, তখন তার মত বুদ্ধিমান ছেলে সহজেই অনুমান করতে পেরেছে, কেন শিবনারায়ণ সুরেন চৌধুরীকে গুম করে রেখেছে ঐ নৃসিংহগ্রামের প্রাসাদের কোন এক গুপ্তকক্ষে। আরও বিশদভাবে ব্যাপারটা আপনাকে বুঝতে হলে এবার তাহলে কিছুক্ষণের জন্য আবার আমাকে নাটকের তৃতীয় অঙ্কে ফিরে যেতে হয়।