২.১৩ রাণীমার স্বীকৃতি

রাণীমার স্বীকৃতি

রায়পুর

ইনসপেক্টারবাবু,

আপনি হয়ত অবাক হবেন কে আপনাকে এই চিঠি লিখছে, তাই প্রথমেই পরিচয়টা দিয়ে নিই, আমি রায়পুরের ছোট কুমার হতভাগ্য সুহাসের জননী মালতী। আপনি সে-রাত্রে চলে যাওয়ার পর আমি অনেক ভেবেছি, শেষটায় সব আপনাকে জানানোই মনস্থ করে এই পত্র আপনাকে লিখতে বসেছি। সুহাস আজ মৃত। কোনদিনই আর সে এ অভাগিনীকে মা বলে ডাকবে না। সুহাসের অকালমৃত্যুতে সংসার আমার কাছে একেবারে শূন্য হয়ে গেছে। আর বেঁচে থেকেই বা লাভ কি! আপনি ঠিকই বলেছিলেন, একজন নির্দোষ যদি আমারই জন্য শাস্তি পায়, ভগবানের বিচারে আমি রেহাই পাব না। আপনি কে এবং আপনার সত্য পরিচয় যে কি তা আমি জানি না। তবে আপনার সঙ্গে সে-রাত্রে কথাবার্তা বলে এইটুকুই বুঝেছি, আপনি যেই হোন, আপনার কাছে কিছু চাপা থাকবে না। সবই একদিন আপনি বুঝতে পারবেন। যাগে ওসব কথা, যা বলতে আজ কলম ধরেছি তাই বলি—সুবিনয়। ও সুহাস আমার কাছে পৃথক নয়। তাছাড়া আমার স্বামীও জানতেন সুবিনয় আমার পেটে না হলেও, সুহাসের চাইতে তাকে আমি কম ভালবাসি না। বরং সুহাসের চাইতে তাকে আমি বেশীই স্নেহ করতাম চিরদিন, এবং হয়ত—হয়ত এখনও করি। বুঝতে পারেন কি, সেই এতখানি স্নেহের প্রতিদানে সুবিনয়ই যখন সুহাসের প্রাণ নেবার ষড়যন্ত্র করছিল, কত বড় আঘাত আমি পেয়েছিলাম। আমি প্রথম সে-কথা টের পাই সুহাসের মৃত্যুর মাস ছয়েক পূর্বে। ঘটনাটা তাহলে খুলেই বলি। সুহাসের মৃত্যুর কয়েক মাস আগে, তার চোখের গোলমাল হওয়াতে চক্ষু-চিকিৎসকের নির্দেশমত তাকে চশমা নিতে হয়। চশমাটা যেদিন সতীনাথ কলকাতা থেকে তৈরী করে নিয়ে এল, আমার সঙ্গে বসে বসে সুহাস গল্প করছিল। ওর দাদা এনে চশমাটা ওর হাতে দিল। চশমাটা ছিল রিমলেস। চোখে দেবার পর দেখা গেল চশমাটা একটু ঢিলে হচ্ছে। সুবিনয় পাশেই দাঁড়িয়ে তখন। চশমাটা ঠিক বসছে না দেখে ও বলে, কিছু না, ঠিক করে দিচ্ছি। বলতে বলতে এগিয়ে এসে সুহাসের নারে উপরে বসানো চশমাটা বেশ জোরে টিপে দিল, সুহাসের নাকের দুপাশ টিপুনির চোটে কেটে গেছিল, সে উঃ করে ওঠে! সেইদিনই দ্বিপ্রহরের দিকে সুহাস অসুস্থ হয়ে পড়ে। ক্রমে জানা যায় সুহাসের টিটেনাস হয়েছে। রায়পুরে ভাল অ্যান্টিটিটেনাস সিরাম পাওয়া যাবে না বলে সতীনাথ কলকাতায় যায় এবং প্রত্যহ সেখান হতে সিরাম অ্যামপুল পাঠাতে থাকে। শুনলে আশ্চর্য হবেন, সেই অ্যামপুলগুলোর কোনটারই মধ্যে সিরাম থাকত না, থাকত স্রেফ জল। ফলে অসুখের কোন উন্নতিই হয় না। তখন আমি সুধীনকে সব কথা লিখে জানাই গোপনে এবং সুধীনই এখানে এসে সুহাসকে একপ্রকার জোর করে কলকাতায় নিয়ে গিয়ে তার চিকিৎসার সুব্যবস্থা করে তাকে সুস্থ করে তোলে। সুহাসের সেবার টিটেনাস হওয়ায় সুধীন নিজে ও অন্যান্য ডাক্তাররা বেশ একটু আশ্চর্যই হয়েছিল। শরীরের কোথাও কোন ক্ষতচিহ্ন নেই, কেমন করে টিটেনাস রোগ হল! হায়, তখন কি জানি যে চশবার যে দুটো প্লেটের মত অংশ নাকের ওপরে চেপে বসে, তাতে টিটেনাস ব্যাসিলি লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল। পরে জানতে পারি সুহাসের শরীরে প্লেগের বীজ ইনজেক্ট করার জন্যই সুহাস অসুস্থ হয়ে পড়ে। ভাবছেন নিশ্চয়ই সে কথাটা কি করে জানলাম, না? সুহাসের মৃত্যুর আগে এবারে অসুখের সময় হঠাৎ একদিন সুবিনয় ও কালীপদ মুখার্জীর মধ্যে যখন আলোচনা চলছিল গোপনে, তখন তাদের ঘরের মধ্যে প্রবেশ করতে গিয়ে কয়েকটা কথা আমার কানে আসে। সুবিনয় ডাঃ মুখার্জীকে বলছিল, মরিয়া না মরে অরি! সেবার চশমার প্লেটে টিটেনাস বীজ মাখিয়ে দিলেন, কত চেষ্টা হল, সব ভেস্তে গেল! তার জবাবে ডাঃ মুখার্জী বলেন, এবারে আর বাছাধনকে বাঁচতে হবে না, এবারে একেবারে মোক্ষম মৃত্যুবাণ ছেড়েছি। আমার টাকাটার কথা ভুলবেন না কিন্তু রাজাবাহাদুর! তাদের কথা শুনে শরীর যেন আমার পাথরের মত জমে গেল। কানের মধ্যে তখন আমার ভোঁ ভোঁ করছে। ভাবতে পারেন আমার তখন কি অবস্থা! যার হাতে নিশ্চিত বিশ্বাসে তুলে দিয়েছি আমার একমাত্র পুত্রের জীবনমরণের সমস্ত ভার, সে-ই কিনা চিকিৎসকের ছদ্মবেশে বিষপ্রয়োগ করেছে! সেইদিনই আমি একপ্রকার জোর করেই কলকাতা যাবার ব্যবস্থা করলাম এবং সুধীনকে গোপনে আমাদের কলকাতার বাসায় সেইদিনই দেখা করবার জন্য তার করে দিলাম। আমরা কলকাতায় যেদিন পৌঁছই সেইদিনই বিকেলের দিকে সুধীন আমাদের বাসায় আসে। তাকে ডেকে গোপনে সব কথা খুলে বলি। পরদিন আমি আর সুধীন অন্য ডাক্তার আনার কথা বলি। প্রথমে সুবিনয় একেবারেই রাজী হয় না, তখন আমি ও সুধীন একপ্রকার জেদাজেদি করে ডাঃ সেনগুপ্তকে ডেকে আনাই। তার পরের ঘটনা তো সবই আপনারা জানেন। ব্লাড-কালচারের রিপোর্ট পৌঁছবার আগেই আমার সর্বনাশ হয়ে গেল। আরও একটা কথা এখানে বলা প্রয়োজন মনে করি। প্রথমবার সুহাসকে টিটেনাস রোগ থেকে ভাল করবার পর, সুহাসের অনুরোধেই আমি সুধীনকে দশ হাজার টাকা ধার হিসাবে দিয়েছিলাম, তার ওষুধ সাপ্লাইয়ের ব্যবসার জন্য। কিন্তু সুধীন সে টাকা নিল বটে, তবে কারবারে আমাকে অংশীদার করে নেয়। আজ বলতে লজ্জা নেই, আমার স্বামীর মৃত্যুর পর স্টেটের একটি পয়সার ওপরেও আমার কোন অধিকার ছিল না। সুহাস যখন আমার কাছে এসে সুধীনকে টাকা দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানায়, আমি চারদিকে অন্ধকার দেখি। আমি জানতাম, কেঁদে ভাসিয়ে দিলেও সুবিনয় দশ হাজার তত দূরে থাক, একটি কপর্দকও দেবে না আমাকে। আমি তখন একপ্রকার নিরুপায় হয়েই শেষটায় সুবিনয়ের ঘরে ঢুকে, তার আয়রন সেফ খুলে ঐ দশ হাজার টাকা চুরি করে সুহাসকে দিই সুধীনকে দেওয়ার জন্য। কিন্তু এমনই দুর্ভাগ্য, সুবিনয় কথাটা জেনে ফেলে। শেষটায় আমার সুহাস ও সুবিনয়ের মধ্যে একটা লিখিত চুক্তি হয়, ওই দশ হাজার টাকা সুহাসের ভাগ থেকে কাটা যাবে। এবং তাহলেই সুবিনয় এ নিয়ে আর উচ্চবাচ্য করবে না। যদি মামলার সময় সুধীনের ব্যাঙ্কের মজুত টাকার কথা ওঠে, তখন পাছে সমস্ত কথাই আদালতে প্রকাশ পায়, আমার চুরির কথা লোকে জানতে পারে, সেই ভয়ে আমি একদিন গোপনে কারাগারে সুধীনের সঙ্গে দেখা করে অনুরোধ জানাই এ-কথা কাউকে না বলতে। সুধীন আমাকে বাঁচাতে গিয়েই সব দোষ মাথা পেতে নেয়, একটি কথাও ও-সম্পর্কে আদালতে প্রকাশ করেনি। সেদিন সে আমায় বলেছিল, মামীমা, আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন, সুহাসের মা আপনি—ফাঁসী যেতে হয় যাব তবু কাউকে এ-কথা বলব না। আপনাকে আদালতে টেনে আনব না। এ কথা আগে বলে আপনি ভালই করলেন, নচেৎ এসব কথা তো আমার জানা ছিল না।

সে তার কথা রেখেছে। হাতে আমার কোন প্রমাণ নেই বটে, তবে আমি জানি সুহাসের হত্যা-ষড়যন্ত্রের মধ্যে সুবিনয় এবং কালীপদ মুখার্জী, ডাঃ অমিয় সোম, তারিণী চক্রবর্তী সবাই লিপ্ত আছে। আপনি হয়ত ভাবছেন, এসব কথা এতদিন জানা সত্ত্বেও কোর্টে যখন মামলা চলছিল, সেই সময় সব কথা প্রকাশ করে দিই নি কেন? তার কারণ, আমি দেখেছিলাম সুহাস তো আর ফিরে আসবেই না এবং সুবিনয়ও যদি যায়, আমার স্বামীর শেষের অনুরোধতাও রক্ষা হয় না। তাছাড়া মৃত্যু দিয়ে মৃত্যুর শোধ তোলা যায় না। একজন তো গেছেই, আর একজনকেই বা কেন মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিই! সেও তো আমার স্বামীরই সন্তান। আমার বুকের দুধ সে পান না করলেও, অকাতরেই তাকে আমি আমার মায়ের স্নেহ দিতে কার্পণ্য করিনি কোনদিন। আমার চোখে সুহাস ও তার মধ্যে কোন পার্থক্যই তো ছিল না। সে আমাকে মা বলে না স্বীকার করলেও, তাকে আমি সন্তান বলেই জানি। সে যে সুহাসের সঙ্গে একই বুকের তলায় বড় হয়ে উঠেছে।

সুধীনের প্রতি যে অন্যায় হচ্ছিল, প্রতি মুহূর্তেই তা আমি বুঝতে পেরেছি। কিন্তু আমি যদি সব স্বীকার করতাম, তাহলে সুবিনয়ের ফাঁসী হত সুনিশ্চিত। তাতে করে আমার মৃত স্বামীর মুখে ও তাদের এত বড় বংশে চুনকালি পড়ত। এই বংশের দিকে চেয়ে লোকে ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিত। শেষ পর্যন্ত আমার মৃত স্বামীর কথা ভেবেই আমি চুপ করে রইলাম। মুখ খুললাম না। সুধীনের যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরের কথা শুনে অবধি নিরন্তর আমি অনুশোচনায় ও বিবেকের দংশনে দগ্ধ হচ্ছিলাম, তারপর ঠাকুরপো (নিশানাথ)-কেও যখন সুবিনয় হত্যা : করলে এবং তারই তদন্তে এসে আপনি আর একজন অভাগিনী জননীর মর্মদাহের কথা আমায় শোনালেন, আর স্থির থাকতে পারলাম না।

সুহাসের মৃত্যুর পর অনেক দিন আগেকার একটা ঘটনা আমার মনে পড়েছিল, সুহাসের তখন বছর ছয়েক বয়স, সুবিনয়ের বয়স বছর চোদ্দ হবে, ধনুর্বাণ খেলার ছলে খেলার তীরের সঙ্গে কুঁচফলের বিষ মাখিয়ে সুবিনয় সুহাসকে মারবার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সে তীর লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে একটা গরুর গায়ে বেঁধে এবং সেই বিষে গরুটা মরে। গরুটার মৃত্যুর পর, সেই তীর পরীক্ষা করে পশুর ডাক্তার সেই কথা বলেছিল— কিন্তু তীরের ফলায় কোথা হতে যে কুঁচফলের বিষ এসেছিল, সেকথা সেদিন আমরা কেউ তলিয়ে ভেবে দেখিনি। তাহলেই ভেবে দেখুন সেই ছোটবেলা হতেই সুবিনয়ের সুহাসের প্রতি একটা জাতক্রোধ ছিল। অথচ শুনে আশ্চর্য হবেন, সুহাস দাদা বলতে যেন অজ্ঞান ছিল। দাদাকে সে দেবতার মতই ভক্তিশ্রদ্ধা করত। আমার চাইতেও বোধ করি সে তার দাদাকে বেশী ভালবাসত। আপনি আমাকে সে রাত্রে একটা কথা জিজ্ঞাসা করেছিলেন, মনে আছে নিশ্চয়ই আপনার, চিৎকার শুনে আমি ঠাকুরপোর ঘরে ছুটে গিয়ে তাকে জীবিত দেখেছিলাম?ি হ্যাঁ,সেদিন আমি স্বীকার করিনি, আজ করছি অকুষ্ঠে, ঠাকুরপো তখনও বেঁচে ছিলেন এবং মরবার সময় তিনি শেষ কথা বলে যান, সুবিনয়—বিনু সে-ই আমায় শেষটায় মারলে!…এমন সময় সুবিনয় সেই ঘরে এসে প্রবেশ করে হন্তদন্ত হয়ে।

আমি ঠিক রান্নাঘর থেকে ঠাকুরপোর চিৎকার শুনিনি, তাঁর ঘরে ঢুকছিলাম, এমন সময় শুনি। আমার মনে হয় সতীনাথকে সুবিনয়ই মেরেছে,কিন্তু কেমন করে তা জানি না। আমার ধারণা মাত্র। হয়ত নাও হতে পারে। সতীনাথের মৃত্যুতে আমি এতটুকুও দুঃখিত নই, বরং খুশীই হয়েছি। এই বংশের ঐ শনি। সুবিনয়ের ঐ ছিল ডান হাত, তবে ইদানীং দেখতাম, দুজনের মধ্যে তত সম্প্রীতি ছিল না, প্রায়ই কথা-কাটাকাটি হত। আমার যতটুকু জানাবার ছিল সবটাই আপনাকে জানালাম। এতদিন পরে আমার স্বীকারোক্তি দিয়ে ভাল করলাম কি মন্দ করলাম জানি না। সুধীনকে ছাড়িয়ে আনতে যদি পারেন তবেই হয়ত এপাপের কিছুটা প্রায়শ্চিত্ত হবে। অহর্নিশি এই বিষযন্ত্রণা হতে মুক্তি পাব। আমার নমস্কার জানবেন।

ইতি

মালতী দেবী