২.১০ ঘটনার সংঘাত

ঘটনার সংঘাত

সুব্রত বুঝতে পেরেছিল, আর এখানে একটি মুহূর্তও থাকা নিরাপদ নয় এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নৃসিংহগ্রাম থেকে তাকে পালাতে হবে এবং কিরীটীকে গিয়ে সব কথা জানাতে হবে। সুব্রত আস্তাবলে যেখানে ঘোড়া দুটো বাঁধা থাকে সেখানে গেল। সহিসকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে, যত শীঘ্র সম্ভব ঘোড়ার জিন চড়াতে বলে, সুব্রত আবার প্রাসাদে ফিরে এল। আর ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই হয়ত দিনের আলো স্পষ্টভাবে ফুটে উঠবে।

এদিকে সেই বন্দীকে আগেই বসিয়ে রেখে গিয়েছিল উপরের ঘরে। যেখানে বসিয়ে রেখে গিয়েছিল সুব্রত, সেখানে এসে দেখল সে নেই। গেল কোথায়? সুব্রত তাড়াতাড়ি এ-ঘর ও-ঘর খুঁজতে লাগল। উপরের সমস্ত ঘরগুলোই ও দেখলে, কোথাও সে নেই। নীচের সিঁড়ি দিয়ে নামছে, দেখলে লোকটা উঠে আসছে। সুব্রতকে দেখে সে বললে, কই থোকনকে কোথাও পেলাম না তো?

আমি জানি, আপনার খোকন কোথায় আছে! চলুন আমার সঙ্গে তাড়াতাড়ি আর দেরি হলে বিপদে পড়ব আমরা।

কিন্তু কোথায় যাব?

যেখানে আপনার খোকন আছে।

না, আমি কোথাও যাব না। তুমি জান না, থোকন আমার এখানেই আছে।

শুনুন আপনার খোকন এখানে নেই। আপনি ঘোড়ায় চড়তে জানেন?

ঘোড়ায়! হ্যাঁ, অনেক দিন ঘোড়ায় চড়েছি যে।

তবে শীগগির আসুন আমার সঙ্গে। আপনার খোকন আমার কাছে আছে।

থোকন তাহলে তোমার কাছেই আছে? ঠিক বলছ? মিথ্যা কথা বলছ না তো?

না, চলুন।

***

সুব্রত অবাক হয়ে গিয়েছিল পাগলের অশ্বচালনা দেখে। অতি দক্ষ অশ্বারোহী। পৃথিবীর বুক থেকে অন্ধকারের পদাটা উঠে যাচ্ছে, ভোরের প্রথম সোনালী আলো পদ্মের পাপড়ির মত একটি একটি করে যেন দলগুলো মেলে ধরেছে।

প্রায় দুপুর নাগাদ ওরা জঙ্গলের মধ্যে এসে পৌঁছল। ছায়াশীতল একটা বড় গাছের নীচে ওরা ঘোড়া থেকে নামল। প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে; আসবার সময় তাড়াতাড়িতে কোনোরকম আহাৰ্যবস্তুই সংগ্রহ করে আনা হয়নি। সুব্রত কেবল ফ্লাস্কটা ভর্তি করে জল এনেছিল, তাই দুজনে পান করে কিছুটা তৃষ্ণা মেটাল।

ঐ জায়গাটা থেকে রায়পুর মাত্র মাইল পাঁচ-ছয়েকের পথ। সুব্রত মনে মনে আগেই ঠিক করে রেখেছিল, সন্ধ্যা হওয়ার পরই ওরা ওখান থেকে রওনা হবে, যাতে করে ওদের শহরে পৌঁছতে পৌঁছতে অন্ধকার হয়ে যায়, তাহলে কেউ ওদের পথে দেখলেও চিনতে পারবে না। চাঁদ উঠবে সেই মাঝরাত্রে। নৃসিংহগ্রাম থেকে রওনা হবার পর থেকেই লোকটা যেন কেমন নিঝুম হয়ে গিয়েছিল, আর একটি কথাও বলেনি। আপন মনে নিঃশব্দে সুব্রতর পাশে পাশে ঘোড়া ছুটিয়ে আসছিল। ফ্লাস্ক থেকে জলপান করে লোকটা গাছে হেলান দিয়ে চোখ বুজল। দীর্ঘদিন ধরে ঘরের মধ্যে অচল অবস্থায় বন্দী থাবার পর আজ এতটা গুরু পরিশ্রম করে নিশ্চয়ই অত্যন্ত ক্লান্তিবোধ করছিল। শীঘ্রই ঐ অবস্থায় বসে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে পড়ল। সুব্রতর চোখে কিন্তু ঘুম নেই। নানা চিন্তা তার মাথার মধ্যে কেবলই পাক খেয়ে ফিরছিল। যাকে ও অন্ধকূপ থেকে উদ্ধার করে নিয়ে এল, লোকটা কে? কি এর পরিচয়? নানাভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করেও কোনো উত্তর পায়নি। অবিশ্যি একটা সন্দেহ ওর মনের কোণে মধ্যে মধ্যে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। কিন্তু—তাহলে? সেটা কি আগাগোড়াই একটা সাজানো ব্যাপার? আর তাই যদি হয়, তবে লোকটাকে এইভাবে দীর্ঘকাল ধরে প্রাণে না মেরে, লোকচক্ষুর অন্তরালে বন্দী করে রাখবারই বা কি প্রয়োজন ছিল? তারপর গুপ্তকক্ষের মধ্যে অকস্মাৎ সেই দ্বিতীয় ব্যক্তি এক যুবকের আবিভাব! এ শুধু অভাবনীয়ই নয়, বিস্ময়করও। বটে। ঐ যুবক রাজাদের স্টেটের অংশীদার এবং বোঝা যাচ্ছে সে আগাগোড়াই সুব্রতর পরিচয় জানত এবং তার প্রতি সে নজর রেখেছিল। সারাটা রাস্তা সুব্রত অশ্বচালনা করতে করতে যুবকের কথাই ভেবেছে। সতীনাথ লাহিড়ী যে রাত্রে নিহত হন, সে রাত্রে তার ঘরের মধ্যে ঢুকে কাগজপত্র হাতড়াবার পর ফিরে আসবার সময় ছাদের উপরে যে অস্পষ্ট ছায়ামূর্তি দেখেছিল এবং যার চলাটা তার চেনা-চেনা মনে হয়েছিল, কিন্তু তখন বুঝে উঠতে পারেনি এবারে সে স্পষ্ট বুঝতেই পারছে সে আর কেউ নয়, এই যুবকই। তবে কি শেষ পর্যন্ত এই একরাত্রে তার ঘরে গিয়ে ঢুকে বাক্স-প্যাট্রা সব হাতড়িয়ে এসেছিল? এতদিন তবে এই কি সর্বক্ষণ তাকে অলক্ষ্যে ছায়ার মত পিছু পিছু অনুসরণ করে ফিরছিল? আশ্চর্য, একবারও সুব্রত ওকে কিন্তু সন্দেহ করেনি এতটুকু! প্রথম থেকেই লাহিড়ীকে নিয়ে ও এত ব্যস্ত ছিল যে ঐ যুবকের দিকে নজর দেবার ফুরসুতও পায়নি। তারপর শিবনারায়ণ চৌধুরী! এইসব কারণেই হয়ত কিরীটীওকে বার বার নৃসিংহগ্রামে একটিবার ঘুরে যাবার জন্য লিখেছিল। যুবক ও শিবনারায়ণ দুজনেই রীতিমত আহত হয়েছে। সুব্রত সেখান থেকে রওনা হওয়ার পূর্বে সেই গুপ্তকক্ষের দরজা বন্ধ করে সেই ঘরের বাইরে তালা দিয়ে এসেছে। সেই গুপ্তকক্ষ থেকে বের হবার আর কোনো পথ আছে কিনা তাই বা কে জানে? ওদের যখন আবার জ্ঞান ফিরে আসবে, তখন হয়ত আবার এক নতুন নাটকের শুরু হবে সেই প্রায়-অন্ধকার গুপ্তকক্ষের মধ্যে, কারণ আসবার সময় সেই কক্ষে, একটি মাত্র প্রদীপই কেবল সে রেখে এসেছে। এবং ওদের সঙ্গে যে টর্চ ও পিস্তল ছিল, সেগুলো নিয়ে আসতে ভোলেনি।

দুটো রাত্রি মাত্র সুব্রত নৃসিংহগ্রামে ছিল, এর মধ্যে রায়পুরেই বা আবার কি ঘটল তাই বা কে জানে! এখন ফিরে যাওয়ার পর ঘটনার স্রোত কোনদিকে বইবে, তাই বা কে জানে! সমগ্র ঘটনাটি বর্তমানে এমন একটি জটিল পরিস্থিতির মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছে, যেখানে পর পর অনেকগুলো সমস্যা এসে যেন একটা ঘূণাবর্ত সৃষ্টি করেছে।

***

রাত্রি তখন প্রায় আটটা হবে, সব্রত লোকটাকে সঙ্গে নিয়ে বরাবর তার বাসার সামনে এসে দাঁড়াল। ঘোড়া দুটো সঙ্গে আনেনি, বনের শেষ সীমানায় ছেড়ে দিয়ে এসেছে। শিক্ষিত অশ্ব, ছাড়া পেয়ে আবার উল্টোপথে নৃসিংহগ্রামের দিকে চলতে শুরু করেছে ওরা দেখে এসেছে। সুব্রত জানে যথাসময়েই ফিরে যাবে তারা নৃসিংহগ্রামের আস্তাবলে।

থাকোহরি বারান্দাতেই বসেছিল। সুব্রতকে দেখে সানন্দে উঠে দাঁড়ায়।

সুব্রত বললে, চটপট করে আমাদের স্নানের জল দে বাথরুমে থাকোহরি। আর বেশ কড়া করে দুপেয়ালা চা তৈরী করে আন দেখি!

থাকোহরি ফ্যালফ্যাল করে তার মনিবের সঙ্গে যে লোকটা এসেছে, অত বেশভূষা দাড়িগোঁফ ও একমাথা রুক্ষ চুল,তার দিকে তাকিয়ে দেখছিল। এ লোকটা কোথা থেকে এল আবার? কাকে আবার সঙ্গে করে বাবু নিয়ে এলেন? কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলতেও সাহস পেলে না।

ঠাণ্ডাজলে অনেকক্ষণ ধরে স্নান করে শরীরটা যেন জুড়িয়ে গেল।

লোকটাকে দাড়িগোঁফ কামিয়ে ধোপদুরস্ত জামাকাপড় পরিয়ে দেবার পর তার চেহারা একেবারে পাল্টে গেল। লোকটা সুব্রতকে কোনো বাধা দিল না। থাকোহরিকে দিয়ে সুব্রত থানায় কিরীটীর কাছে একটা সংবাদ পাঠিয়ে দিল। রাত্রি প্রায় দশটার সময় কিরীটী ও বিকাশ এসে হাজির হল। লোকটা তখন সুব্রতর ঘরে শুয়ে গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন। সুব্রত ধীরে ধীরে নৃসিংহগ্রামের সমগ্র ঘটনা একটুও না বাদ দিয়ে ওদের কাছে বলে গেল।

সমস্ত শুনে কিরীটী বললে, কাল সকালেই আমি ওকে নিয়ে কলকাতায় চলে যাব। বিকেলের দিকে প্রায় ছটা নাগাদ একটা ট্রেন আছে, তাতেই তুই কলকাতায় চলে যাবি। এখানকার কাজ আমাদের শেষ হয়েছে। রায়পুর রহস্যের ওপরে এবারে আমরা যবনিকাপাত করব।

এই লোকটা কে, কিরীটীবাবু? বিকাশ প্রশ্ন করে।

আমার মনে হচ্ছে খুব সম্ভবত সুরেন চৌধুরী—ডাঃ সুধীন চৌধুরীর বাপ। কিরীটী মৃদুস্বরে জবাব দেয়।

সে কি! তাহলে উনি যে অনেকদিন আগে মারা গিয়েছিলেন বলে আমরা জানি, সেটা তবে সত্যি কথা নয়?

না। যদিও আসল খুনী, মানে যে সুরেন চৌধুরীকে এ পৃথিবী থেকে সরাতে চেয়েছিল, সে জানত সুরেন চৌধুরীকে হত্যা করাই হয়েছে, কিন্তু মাঝখান থেকে বোধ হয় আর একটি অদৃশ্য হাত সব ওলটপালট করে দেয়।

তাহলে যে সুরেন চৌধুরীকে হত্যা করতে চেয়েছিল, সে আজও জানে না উনি বেঁচে আছেন?

খুব সম্ভবত না।