২.০৮ জবানবন্দির জের

জবানবন্দির জের

রাস্তায় চলতে চলতে কিরীটী কিছু কিছু বাদ দিয়ে আনুপূর্বিক সমস্ত কথা বিকাশকে বলে গেল। বললে, রায়পুর-হত্যারহস্য যতটুকু জট পাকাবার তা পাকিয়েছে বিকাশবাবু, এবারে সেই জট আমাদের একটি একটি করে খুলতে হবে। রায়পুর রাজপরিবারের পুরাতন ইতিহাস, মনে হচ্ছে সে যেন একখানি উপন্যাস। যার কিছুটা আজ আপনি রাজাবাহাদুরের মুখে শুনলেন, বাকিটা আমি যা খোঁজ করে জেনেছি তা এই— আপনি শুনলেন, শ্ৰীকণ্ঠ মল্লিকরা ছিলেন তিন ভাই, জ্যেষ্ঠ শ্রীকণ্ঠ, মধ্যম সুধাকণ্ঠ ও কণিষ্ঠ বাণীকণ্ঠ। এঁদেরই পিতা ছিলেন রাজা রত্নেশ্বর মল্লিক। রত্নেশ্বরের পিতার আমলে একটা খুনের মামলায় এঁদের সম্পত্তি প্রায় যায় যায় হয়েছিল, সেই সময় যিনি তাঁর প্রাণ দিয়ে সকল অপরাধ নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে এঁদের পূর্বপুরুষকে বাঁচিয়েছিলেন, সেই তিনিই হচ্ছেন এঁদের পূর্বতন নায়েবজী শ্রীনিবাস মজুমদারের পিতামহ। রত্নেশ্বরের পিতা অকৃতজ্ঞছিলেন না, তাই হয়ত এর প্রতিদানেনৃসিংহগ্রাম মহালটির অর্ধাংশ মজুমদার বংশকে লেখাপড়া করে দিয়ে যান। পরে অবিশ্যি আবার শোনা যায় রত্নেশ্বর সে অংশটুকু কিনে নেন নামমাত্র মূল্য দিয়ে, বলতে পারেন কতকটা মজুমদার মশাইকে বিক্রি করতে বাধ্য করেছিলেন রত্নেশ্বর এবং অর্থের লোভে পিতার ঋণ তিনি সম্পূর্ণ অস্বীকার করলেন।

হয়ত মল্লিক বংশের ধ্বংসের মৃত্যুবীজ সেই দিনই সবার অলক্ষ্যে রোপিত হয়েছিল অলঙঘ নির্দেশে এবং ক্রমে একদিন সেই বিষই এদের পুরুষানুক্রমে রক্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল। সত্যি কি মিথ্যা জানি না, হারাধন মল্লিক বলেন রত্নেশ্বরই নাকি তাঁর বৃদ্ধ পিতাকে দুধের সঙ্গে বিষপ্রয়োগে হত্যা করেন। কিন্তু দৈত্যকুলে প্রহ্লাদ হয়ে জন্ম নিলেন রত্নেশ্বরের জ্যেষ্ঠ পুত্র শ্রীকণ্ঠ মল্লিক। তিনি দুই পুরুষ আগেকার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে চাইলেন, কিন্তু তাঁর সে মনস্কামনা পূর্ণ হবার আগেই নিজ বংশের বিষের ক্রিয়ায় জর্জতির হয়ে ছটফট করতে করতে তিনি মৃত্যুকে বরণ করলেন। সংক্রামক ব্যাধির মতই পাপের বিষ তখন এদের বংশকে বিষাক্ত করে ফেলেছে, অনিবার্য ধ্বংসের দিকে তখন এঁরা ছুটে চলেছে নিষ্ঠুর নিয়তির এক অলঙ্ঘ্য নির্দেশে। রায়পুর রাজবংশের এক করুণ অধ্যায়ের সূচনা শুরু হয়ে গিয়েছে।

আপনার কি মনে হয় কিরীটীবাবু, শ্ৰীকণ্ঠ মল্লিকের হত্যা, সুধীনের পিতার হত্যা, সতীনাথের হত্যা, নিশানাথের হত্যা সব একই সূত্রে গাঁথা? প্রশ্ন করে বিকাশ।

এখনও সেটা বুঝতে পারেননি বিকাশবাবু? সব একসূত্রে গাঁথা—একই উদ্দেশ্যে একের পর এককে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়েছে রাজপরিবারের লোকেদরে এবং অন্য যারা খুন হয়েছে বাইরের তারাও সেই বিষচক্রের মধ্যে গিয়ে পড়েছে এবং যদি ঐ একের পর এক হত্যার মূল অনুসন্ধান করেন তো দেখতে পাবেন সবেরই মূলে রয়েছে এক মোটিভ বা উদ্দেশ্য, সব একই—অর্থম অনর্থ। কিন্তু যাক সে কথা। আমি শুধু সূত্রগুলো এখান থেকে ওখান থেকে একত্রে এক জায়গায় জড়ো করছি। সময় এলে ঐ সূত্রগুলো আপনার হাতে তুলে দেব। আপনি বোধ হয় জানেন না বিকাশবাবু, একটি অভাগিনী মায়ের কাতর মিনতিই আমাকে এই রায়পুর হত্যা-রহস্যের মধ্যে টেনে নিয়ে এসেছে। অবিশ্যি আইনের দিক থেকে তার ওপরে আগেই যবনিকা পড়েছে।

আপনি কি সত্যিই মনে করেন, ডাঃ সুধীন চৌধুরীকে খালাস করে আনতে পারা যেতে পারে?

মনে করি না বিকাশবাবু, সে বিষয়ে আমি স্থিরনিশ্চিত। কিন্তু তাহলেও বলতে দ্বিধা নেই, প্রথমে যখন এ কেসটা কতকটা ঝোঁকের মাথায়ই আমি হাতে নিই, তখন সব দিক ততটা ভাল করে বিবেচনা করে উঠতে পারিনি, আজ কিন্তু যেন মনে হচ্ছে, সুধীনকে মুক্ত করতে পারি তো আর একজনকে তার জায়গাতে যেতে হবেই। হয়তো একটা ভূমিকম্পও উঠবে, ফলে অনেক কিছুই ওলটপালট হয়ে যাবে।

কথা বলতে বলতে ওরা থানার কাছে এসে পড়েছিল; কিরীটী হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললে, রাত্রি প্রায় আড়াইটে। এখানকার কাজ আমার প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, কাল-পরশু নাগাদই বোধ হয় আমি চলে যাব। কাল সকালে একবার হারাধন মল্লিকের সঙ্গে দেখা করতে হবে। আপনিও আমার সঙ্গে থাকবেন কিন্তু। তারপর কতকটা যেন আত্মগত ভাবেই বললে নিম্নকণ্ঠে, তারপর বাকি থাকল একজন—

কার কথা বলছেন?

বলব পরে। কিন্তু হারাধন লোকটার কথাই ভাবি, অমন নিলোভ সত্যাশ্রয়ী লোক আজকালকার যুগে বড় বিরল মিঃ সান্যাল। হ্যাঁ ভাল কথা, হারাধনের নাতি জগন্নাথের সঙ্গে আপনার আলাপ আছে?

সুব্রতবাবু ওঁর খুব প্রশংসা করেন। বলেন, অমন ছেলে নাকি হয় না, একেবারে দাদু-অন্ত প্রাণ।

হ্যাঁ। কিরীটী মৃদুস্বরে জবাব দেয়।

ঐদিন রাত্রে শুতে যাবার আগে কিরীটী বলে, তারিণী চক্রবর্তী, মহেশ সামন্ত ও সুবোধ মণ্ডলকে কাল বিকেলের দিকে একবার এদিকে ডাকিয়ে আনতে পারেন? তাদের আমি কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাই।

বেশ তো। নিশ্চয় আনাব।

***

পরের দিন গোটা নয়েকের সময় কিরীটী ও বিকাশকে ঘরে প্রবেশ করতে দেখে হারাধন সানন্দে ওদের আহ্বান জানালেন, আসুন আসুন। চা আনতে বলি?

তা মন্দ কি! হারাধনের ব্যাপার দেখে মনে হল যে, যেন এতক্ষণ উদগ্রীব হয়ে ওদেরই পথপানে চেয়েছিলেন। হারাধন চিৎকার করে ভৃত্যকে চা আনতে আদেশ দিলেন।

গতরাত্রের সব সংবাদ শুনেছেন বোধ হয় মল্লিক মশাই?কিরীটী মৃদুস্বরে বলে।

হ্যাঁ। শেষকালে নিশাও গেল। সব যাবে একে একে, এ আমি জানতাম কিরীটীবাবু। নিশা আমার চাইতে বছর আটেকের ছোট। বোলপুরে চাকরি করবার সময় মাঝে মাঝে চিঠিপত্র দিত। কিন্তু ইদানীং এখানে আসবার পর অনেক সময় ভেবেছি, যদি একবার দেখা হয়! তা আর হল না। শেষের দিকে হারাধনের কণ্ঠস্বর অশ্রুভারাক্রান্ত হয়ে যায় যেন।

মল্লিক মশায়? কিরীটী কিছুক্ষণ পরে হঠাৎ ডাকে।

অ্যাঁ! কিছু বলছিলেন?

হ্যাঁ, আপনি কি সত্যি-সত্যিই ভেবেছিলেন নিশানাথও খুন হবেন?

নিশ্চয়ই। এ-কথা তো আমি হাজার বার বলেছি, সেইদিন থেকে, যখনই শুনেছি এই বৃদ্ধ বয়সে সে রূপালী চক্রের মধ্যে এসে ধরা দিয়েছে। কেউ থাকবে না, বুঝলেন কিরীটীবাবু, কেউ থাকবে না। রাজা রত্নেশ্বরের বংশে কেউ বাতি দিতে থাকবে না। এ বিধাতার অভিশাপ।

জগন্নাথ চায়ের ট্রেতে করে তিন পেয়ালা গরম চা নিয়ে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল।

কিরীটী আড়চোখে তাকিয়ে দেখল, জগন্নাথের মুখখানা যেন বেশ গম্ভীর। কিরীটী হাত বাড়িয়ে ট্রে থেকে চায়ের কাপ একটা তুলে নিতে নিতে মৃদুস্বরে বললে, জগন্নাথবাবু, আপনার দাদুকে নিয়ে আজ বা কাল হোক যে কোনো একসময় সময় করে রাজাবাহাদুর সুবিনয় মল্লিকের সঙ্গে দেখা করে আসবেন। তাঁদের আজকের এতবড় দুঃসময়ে সব ভুলে যাওয়াই ভাল। দূরসম্পকীয় হলেও, আপনারাই এখন তাঁর একমাত্র আত্মীয় অবশিষ্ট রইলেন তো।

না না, জগন্নাথ প্রবল প্রতিবাদ করে ওঠে, ও বাড়ির সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্কই আর নেই। রাজা শ্রীকণ্ঠ মল্লিকের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই সব ধুয়ে মুছে গেছে।

তা কি আর সত্যিই হয়, জগন্নাথবাবু? এ কি জলের দাগ যে এত সহজে মুছে যাবে? এ যে রক্তের সম্পর্ক, কিরীটী বলতে থাকে, জানেন তো, ইংরাজীতে একটা প্রবাদ আছে,—blood is thicker than water! ঝগড়া মিটিয়ে ফেলুন। অতীতে কে একজন ভুল করেছিলেন বলেই যে সেই ভুলের জের টেনে বেড়াতে হবে আজও বংশ-পরম্পরায় তার কি মনে আছে?

রক্তের দাগ বলেই তো মুছে ফেলবার নয় কিরীটীবাবু! জগন্নাথ জবাব দেয়।

কিন্তু–

কিরীটীকে বাধা দিয়ে জগন্নাথ মৃদু অথচ দৃঢ় কণ্ঠে বলে, বড়লোক আত্মীয় সাপের চেয়েও সাংঘাতিক কিরীটীবাবু। আপনি ধারণাও করতে পারবেন না, গরীব আত্মীয়দের ওরা কত হীন চোখে দেখে; দেখা-সাক্ষাৎ করতে গেলেই ওরা ভাবে যে হাত পাততে গেছি আমরা ওদের কাছে! আরও একটা কথা হচ্ছে, ওদের ঐ ধনগরিমার দৃষ্টি দিয়ে ওরা আমাদের মনে করে যেন কৃতার্থ করে দিচ্ছে, কিছুতেই সেটা যেন আমি সহ্য করতে পারি না, গায়ে যেন ছুঁচ বেঁধায়— তাছাড়া যে প্রাসাদে আমাদের সমান অধিকার একদিন ছিল, সেখানে আজ মাথা নীচু করে প্রবেশ করতে পারবো না। না–মরে গেলেও না। … উত্তেজনায় জগন্নাথ যেন হাঁপাতে থাকে।

কিরীটী আর কিছু বলল না।

.

সন্ধ্যার দিকে মহেশ সামন্ত ও সুবোধ মণ্ডল এল থানায়। তারিণী চক্রবর্তী ছিল না, আগের দিন কোনো এক মহালের কাজে গেছে।

প্রথমেই কিরীটী সুবোধকে ডাকলে, বসুন মণ্ডল মশাই।

আজ্ঞে স্যার, গরীব দাসানুদাস হই আমরা আপনাদের, আপনাদের সামনে উপবেশন করব, এ কি একটা লেহ্য কথা হল স্যার? কি আজ্ঞা হয় বলুন!

মণ্ডলের কথার বাঁধুনিতে কিরীটী না হেসে থাকতে পারলে না। বলে, মহাশয় বুঝি বৈষ্ণব? মাছ-মাংসও বুঝি চলে না? কিন্তু গলায় কষ্ঠি কই?

এ দাসের স্যার, সত্যি কথা বলতে কি, কোনো ধর্মের প্রতি আস্থাও যেমন নেই অনাস্থাও তেমন নেই। বোঝেনই তো স্যার, রাজবাড়ির বাজার-সরকার আমি!

তা তো দেখতেই পাচ্ছি। তা সংসার-ধর্ম করেছেন, না এখনও বাজার-সরকারী করে সময় করে উঠতে পারেননি?

আজ্ঞে স্যার, সে দুঃখের কথা আর বলবেন না, তিন-তিনটি সংসার করেছিলাম, কিন্তু একটি কাশীবাসিনী, দ্বিতীয়া পিত্রালয়বাসিনী, কনিষ্ঠা উদ্বন্ধনে প্রাণত্যাগ করেছেন।

কেন চতুর্থী?

রামঃ, আর রুচি নেই স্যার।

আহা, আপনি তো তা হলে দেখতে পাচ্ছি রীতিমত একজন বিচক্ষণ ব্যক্তি!

হেঁ হেঁ, কি যে বলেন স্যার, আমরা হলাম আপনাদের দাসানুদাস, কীট হতেও কীট।

তা দেখুন মণ্ডল মশাই, আমি কয়েকটা প্রশ্ন আপনাকে করতে চাই, ঠিক ঠিক যেন জবাব পাই, বিনয়ে বিগলিত হয়ে আবার সব না গোলমাল করে ফেলে অযথা নিজেকে বিপদগ্রস্ত করে ফেলেন! তবে হ্যাঁ, গরীব লোক আপনি সেকথা আমি ভুলবো না।

তা মনে রাখবেন বইকি স্যার, এ অধীন তো আপনাদের পাঁচজনের দয়াতেই বেঁচে-বর্তে আছে—তা কি আজ্ঞা হচ্ছে?

আপনাদের ম্যানেজার সতীনাথ লাহিড়ী মশাই যে রাত্রে খুন হন, সেই রাত্রির কথা নিশ্চয়ই আপনার মনে আছে?

সহসা যেন কিরীটীর কথায় মণ্ডলের মুখখানি কেমন পাংশুবৰ্ণ ভাব ধারণ করে, কিন্তু মুহূর্তে সে নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, তা…তা আছে বইকি স্যার!

আচ্ছা মণ্ডলমশাই, দারোগাবাবুর কাছেসেরাত্রে আপনি আপনার জবানবন্দিতে বলেছিলেন, সতীনাথ লাহিড়ী মরার আগে যে চিৎকার করে উঠেছিলেন, সেই চিৎকার শুনেই আপনি ঘর থেকে বের হয়ে যান। অথচ তারিণী খুড়োর পাশের ঘরে থেকেও আপনি জানতে পারেননি, কখন তারিণী চক্রবর্তী ঘর থেকে বের হয়ে যান? আপনি তখন জেগেই ছিলেন, কেমন তাই না?

না, বোধ হয় তো আমি ঘুমিয়েই ছিলাম।

বেশ ভাল করে মনে করে দেখুন, মনে হচ্ছে যেন আমার, বোধ হয় কেন—নিশ্চয়ই আপনি জেগেই ছিলেন, মোটেই ঘুমোননি!

আজ্ঞে স্যার, তা কি করে হয়? ঘুমিয়ে থাকলেও জেগে থাকা কি করে সম্ভব বলুন?

সম্ভব এইজন্য যে চিৎকারটা আপনি বেশ পরিষ্কারই শুনতে পেয়েছিলেন। ঘুমিয়ে থাকলে কি কেউ চিৎকার শুনতে পায়? এবং শব্দটা শুনতে পেয়েছিলেন বলেই এটাও জানেন, আপনার তারিণী খুড়ো কখন ঘর থেকে বের হয়ে যান! বুঝলেন মণ্ডল মশাই, একে বলে আইনের লজিক। ঠিক আপনি বুঝতে পারবেন না, কারণ লজিক তো আর আপনি পড়েননি। যাহোক আমাদের লজিকে বলে চিৎকারটা যখন শুনেছেন, এবং জেগে না থাকলে যখন চিৎকারটা শোনা যায় না, তখন আপনি কি করে ঘুমিয়ে থাকতে পারেন? অতএব জেগেই ছিলেন। কেমন,এবার হল তো? বেশ, এবারে বলুন তো, শুধু যে আপনার তারিণী খুড়োকেই ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে শুনেছিলেন তা নয়, আরও কাউকে বারান্দা দিয়ে হেঁটে যেতেও শুনেছিলেন যার পায়ের জুতোর তলায় লোহার নাল বসানো ছিল।

সুবোধ বোকার মত ফ্যালফ্যাল করে কিরীটীর দিকে তাকিয়ে থাকে। কি যে জবাব দেবে কিছুই যেন বুঝে উঠতে পারে না।

মণ্ডল মশাই, আপনি যে একজন নিরীহ গোবেচারী গোছের লোক তা আমি জানি। কারও সাতেও নেই আপনি, কারও পাঁচেও নেই। অথচ কেমন বিশ্রীভাবে আপনি এই খুনের মামলায় জড়িয়ে যাচ্ছেন তা যদি ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারতেন, তাহলে হয়ত ভুলেও বলতেন না যে আপনি সেরাত্রে বোধ হয় ঘুমিয়ে ছিলেন। তাছাড়া এ-কথা কে না বোঝে, খুনের মামলায় জড়িয়ে যাওয়া কত বড় সাংঘাতিক ব্যাপার! চাই কি যোগসাজস আছে প্রমাণ হয়ে গেলে, সারাটা জীবন কাষ্ঠঘানি ঘুরিয়ে সরিষা হতে বিশুদ্ধ সরিষার তৈলও উৎপাদন করতে হতে পারে। এবং সেও আর চারটিখানি কথা নয়, কি বলুন!

স্যার, একটা বিড়ি পান করতে পারি? গলাটা কেমন যেন শুকিয়ে যাচ্ছে।

আহা, নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই। সে কি কথা? ম্যাচ আছে, না দেব?

কিরীটী লক্ষ্য করে দেখলে, বিড়ি ধরাচ্ছে বটে সুবোধ কিন্তু কি এক গভীর উত্তেজনায়। হাত দুটো তার ঠকঠক করে কাঁপছে।

মণ্ডল মশাই, এবারে বোধ হয় আপনি বসতে পারবেন, ঐ চেয়ারটায় বসুন। তারপর আপনার আর কষ্ট করতে হবে না, আমিই বলছি শুনুন। যদি কোথাও ভুল থাকে দয়া। করে শুধরে দেবেন। সেইদিন রাত্রে মানে যেদিন আপনাদের ভূতপূর্ব ম্যানেজার লাহিড়ী মশাই খুন হন, সেদিন এই রাত্রি দশটা কি পৌনে দশটার সময়, প্রথমে আপনি একটা শব্দ শুনতে পান, ঠিক যেন জুতো পায়ে দিয়ে কেউ বারান্দা দিয়ে হেঁটে বাইরের দিকে চলে যাচ্ছে। জুতোর শব্দ ঠিক অনেকটা আপনাদের ছোট্টু সিংয়ের লোহার নাল বসানো নাগরাই জুতোর শব্দের মত। কিন্তু কিছু আপনি মনে করেননি, তার কারণ আপনি ভেবেছিলেন ছোট্টু সিং-ই বাইরে যাচ্ছে। তারপর অনেকক্ষণ আপনি কান পেতে অপেক্ষা করেছেন, কারণ আপনি জানতেন, রাত্রে মানে ঠিক সন্ধ্যার পর হতে ঐ দরজার প্রহরা ছেড়ে ছোষ্ট্র সিংয়ের বাইরে কোথাও যাওয়ার হুকুম নেই এবং যদি সে হুকুম না মেনে দরজা ছেড়ে মুহূর্তের জন্যও কোথাও যায় ও,সেকথা যদি ম্যানেজারবাবু জানতে পারেন, তাহলে তার চাকরি তো যাবেই জমানো মাইনেটাও কাটা যাবে। এখানে হপ্তায় দুবার হাট করে রাজবাড়ির সাতদিনের মত অনেক কিছু জিনিস কিনেকেটে আপনি আনেন, কিন্তু ম্যানেজারবাবু আপনাকে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করতেন না বলে তিনি ছোট্টু সিংকে আপনার সঙ্গে যেতে আদেশ দেন। কাজে-কাজেই ছোট্টু সিংয়ের ওপরে আপনার সন্তুষ্ট না থাকা খুবই স্বাভাবিক। এবং আপনি সর্বদা চেষ্টা করছিলেন কি করে ছোট্টু সিংকে জব্দ করা যেতে পারে। কি, আমি কিছু মিথ্যে কথা বলছি, বলুন?

আজ্ঞে,…আ…আপনি…

সত্যি কথা বলছি, এই তো?… বেশ, শুনে সুখী হলাম। যাক্, আপনি ফিরতি শব্দ শোনার জন্য তাই জেগেই ছিলেন। কারণ জুতোর শব্দ শুনে প্রথম হতেই আপনি সন্দেহ। করেছিলেন যে, ছোষ্ট্র সিংয়েরই পায়ের শব্দ এবং সে কাউকে না জানিয়ে দরজা অরক্ষিত রেখে কোথাও যাচ্ছে। কেমন তাই না?

আ…আপনি কে?

সুবোধবাবু! সহসা কিরীটীর এতক্ষণের পরিহাস-তরল কণ্ঠ যেন যাদুমন্ত্রে কঠিন হয়ে ওঠে।

সুবোধ মণ্ডল ভীষণ রকম চমকে উঠে কিরীটীর মুখের দিকে তাকাল।

ময়াল সাপের গল্প শুনেছেন কখনও মণ্ডল মশাই? আপনি ময়াল সাপের খপ্পরে পড়েছেন। কিন্তু কোনো ভয় নেই আপনার। আপনাকে আমি ছেড়ে দিতে পারি, কিন্তু সে কেবল একটি শর্তে… আপনি সব কথা আমার কাছে এই মুহূর্তেই অকপটে আগাগোড়া খুলে বলবেন। তবেই, নচেৎ–

আজ্ঞে!–মণ্ডলের গলার স্বর কাঁপতে কাঁপতে থেমে যায়।

বলুন লোকটা যখন আবার ফিরে আসে, আধঘণ্টা পরে, তখন শব্দ শুনেই আপনি বাইরে এসে তাকে দেখতে পান কিনা?

হ্যাঁ—কিন্তু তাকে আমি চিনতে পারিনি। অন্ধকারে তাকে আমি ভাল করে দেখতে পাইনি।

সত্যি কথা বলছেন?

আজ্ঞে মা কালীর দিব্যি।

তারিণী খুড়ো যখন ঘর হতে বের হয়ে যান চিৎকার শুনে, তাও আপনি জানেন, কেমন না?

হ্যাঁ।

আপনি চিৎকার শুনে বের হননি কেন?

খুড়োকে যেতে দেখে আমি দাঁড়িয়ে গিয়েছিলাম।

দরজা বন্ধ ছিল না?

আজ্ঞে না, খোলাই ছিল। খুড়ো দরজা ঠেলতেই দরজা খুলে যেতে দেখেছি।

মহেশ সামন্ত—সে বুঝি তারিণীর পরেই যায়?

হ্যাঁ, ঠিক খুড়োর পিছুপিছুই গেছে।

আচ্ছা, আপনি এবার যেতে পারেন মণ্ডল মশাই। আপনার কোনো ভয় নেই। আমাকে আজ আপনি যা বললেন ঘুণাক্ষরেও কেউ তা জানতে পারবে না। এবং জানতে পারলেও, আপনি যাতে বিপদে না পড়েন সে ব্যবস্থা আমি করব কথা দিচ্ছি।

আপনি—

আমি কে, তাই জানতে চান তো? এবং কি করে আমি এসব জানলাম, না?

আজ্ঞে!

এইটুকু শুধু জানুন, জানাটাই আমার কাজ। গোপন রহস্য উদঘাটন করি বলেই আমার আর এক পরিচয় রহস্যভেদী!

সুবোধ মণ্ডল চলে যাবার পর, আরও আধঘণ্টা কিরীটী মহেশকে বসিয়ে রেখে, অবশেষে বিকাশকে ডেকে মহেশকে ছেড়ে দিতে বললে। তার আর জবানবন্দি নেওয়ার কোনো প্রয়োজন ছিল না।