ম্যানহাটানে মুনস্টোন – ০৬

ছয়

সেই রাতে একেনবাবু প্রমথকে প্রায় জোর করে আমার অ্যাপার্টমেন্টে পাঠিয়ে দিয়ে নিজে নীচে প্রমথর ঘরে শুলেন। আমি অবশ্য সবাইকে ওপরে এসে শুতে বলেছিলাম। প্রমথ সোফায় শুতে পারত। কিন্তু একেনবাবুর মনে হল নীচে শুতে কোনও অসুবধাই নেই। ইন ফ্যাক্ট একবার মনে হল উনি যেন সেটাই চাইছেন। স্ট্রেঞ্জ!
শুতে পেলাম ঠিকই, কিন্তু ঘুমটা মোটেও ভালো মত এল না। জেগে-জেগে নানা রকমের শব্দ শুনলাম। আমি ভূতফুতে বিশ্বাস করি না। তবু মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিল, যে-লোকটা সকালেও জলজ্যান্ত ছিল, তার কি কোনও অস্তিত্বই আর নেই? প্রেতাত্মার এত গল্প যে শুনেছি – সবই কি ভুয়ো?
আসলে কাঠের বাড়িতে টেম্পারেচার চেঞ্জের জন্যে সবসময়ে এ ধরণের আওয়াজ হয়। আগে খেয়াল করলেও পাত্তা দিই নি। কিন্তু কিরিট প্যাটেলের মৃত্যু আর একেনবাবুর দরজা খোলার ডেমনস্ট্রেশনের ফলে প্রত্যেকটা আওয়াজেই জেগে জেগে উঠছিলাম। প্রত্যকটা শব্দেই মনে হচ্ছিল, হয় কোনও খুনী বাড়িতে ঢুকছে কিংবা কিরিট প্যাটেলের অতৃপ্ত আত্মা হেঁটে বেড়াচ্ছে! তারওপর পাশের বাড়ির কুকুরটা রাত্রে বেশ কয়েকবার সুর করে কেঁউ কেঁউ করেছে। কুকুররা শুনেছি অনেক কিছু দেখতে পায় ও শুনতে পায়, যেগুলো মানুষ পায় না। মানছি, এর আগেও ব্যাটা এরকম চেঁচিয়েছে। কিন্তু তখন তো … যাক সে কথা।

ভোর রাত্রে ঝিমুনি এসেছিল, অ্যালার্মে ঘুম ভাঙলো। প্রমথ দরজা বন্ধ করে তখনো ঘুমোচ্ছে। হাতমুখ ধুয়ে বাইরের ঘরে এসে দেখি একেনবাবু ডাইনিং টেবিলে একটা বিশাল বোলে পাহাড় করে সিরিয়াল ঢেলে দুধ-চিনি মিশিয়ে খাচ্ছেন। আমাকে দেখে বললেন, আপনারা ঘুমোচ্ছেন দেখে, ডিস্টার্ব না করেই ঢুকে পড়লাম। এই নিন স্যার, আপনার ক্রেডিট কার্ডটা। আপনি তো কাল ভুলে মেরে দিয়েছিলেন ফেরৎ নিতে।
আমি ক্রেডিট কার্ডটা ওয়ালেটে ঢুকোলাম, একেনবাবু মুড় মুড় করে সিরিয়াল খেতে খেতে বললেন, “ঘুম থেকে উঠলেই বড্ড খিদে পেয়ে যায় স্যার।”
আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, “কি করে ঘুমোতে পারলেন আপনি? মিস্টার প্যাটেল মিস্টিরিয়াসলি ডেড, পসিবলি মার্ডারড। অ্যাপার্টমেন্ট ডোর ইজ ভার্চুয়ালি ওপন!”
“দ্যাটস ট্রু,” একেনবাবু চিবনোটা একটু থামালেন। “এনি ওয়ে স্যার, দ্য নাইট ইজ ওভার। আপনাকে একটা মামলেট করে দেব?”
“না, আমার খিদে নেই।“
“তাহলে স্যার আপনাকে একটা কফি বানিয়ে দিই। খুব বিধ্বস্ত লাগছে আপনাকে।”
আমি আপত্তি করতে যাচ্ছিলাম। একেনবাবু শুনলেন না।
“আপনি রিল্যাক্স করুন স্যার। আমি কফিটা বেশ বানাতে পারি।”
“তারজন্যে নয়, কিছুই ভালো লাগছে না আজ। রাত্রেও একদম ঘুমই নি। খালি ভাবছিলাম, কে মিস্টার প্যাটেলকে খুন করতে পারে? এভাবে খুন করে তার লাভটা কি?”
কফির জল চাপাতে চাপাতে একেনবাবু বললেন, “আপনি ধরে নিচ্ছেন কেন স্যার, কেঊ ওঁকে খুন করেছে। আমার তো মনে হয় আত্মহত্যাও একটা স্ট্রং পসিবিলিটি।”
“মোর স্ট্রং দ্যান মার্ডার? এর মধ্যে আবার আর কি ইন্ডিকেশন পেলেন যাতে মনে হয় উনি মরতে চেয়েছিলেন?”
একেনবাবু চেয়ারে এসে বসে সিরিয়ালের বোলটা সামনে টেনে নিলেন। মুড়মুড়ানির ফাঁকে ফাঁকে বললেন, “কাল বোধহয় স্যার, আমরা একটু বায়াসড হয়ে গিয়েছিলাম।”
“তার মানে?”
“লোকে যখন সুইসাইড করে – তখন কি অত র‌্যাশেনাল হয় স্যার?” আমি যখন কলেজে পড়তাম, আমার হস্টেলেরই এক ছেলে আমার ক্লাসনোট কপি করবে বলে নিয়ে গেল। কয়েক ঘন্টা বাদে শুনি, সে নাকি আত্মহত্যা করবে বলে অ্যাসিড খেয়েছে! মরতেই যদি চেয়েছিলি, তাহলে আমার ক্লাসনোট নিলি কেন? সে এক যাচ্ছেতাই ব্যাপার স্যার। সেই ক্লাসনোট আমি ফেরৎ পাই নি। ফলে পরীক্ষাটা…।”
“আপনার পয়েন্টটা কি?” আমি অসহিষ্ণু হয়ে বললাম।
“ও হ্যাঁ স্যার, যেটা বলতে চাচ্ছিলাম – অন্য পসিবিলিটিগুলোও ভাবুন। ফোনেও তো উনি কোনও দুঃসংবাদ পেতে পারেন? ধরুন, উনি জানতে পেরেছেন ওঁর ক্যান্সার হয়েছে – একেবারে ফাইন্যাল স্টেজ, বা জুয়ো খেলায় উনি সর্বস্বান্ত হয়েছেন, আরও কত কি? এইসব জেনে উনি আর বাঁচতে চান নি। এভরিথিং ইজ পসিবল স্যার, ঠিক কিনা?”
“তা বটে,” আমি স্বীকার করলাম। বলতে কি, একেনবাবুর ব্যাপার স্যাপার থেকে আমি বাস্তবিকই আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি! ক্রাইসিস অনেক সময় লোকের মধ্যে প্রচন্ড পরিবর্তন আনে। ওঁর বাজে বকা যে একদম কমেছে, তা বলতে পারব না, কিন্তু দুয়েকটা ইনসাইটফুল কথা বলে বেশ তাজ্জব করে দিচ্ছেন!

সকালে আমাকে একটু স্কুলে যেতে হল। দুপুরে যখন বাড়ি ফিরলাম প্রমথ তখন লাঞ্চ বানাচ্ছে। আমাকে দেখে হড়বড় করে খবর দিল, একেনবাবু নাকি ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টকে ফোন করে জেনেছেন নিজের ছোঁড়া গুলিতেই মিস্টার প্যাটেলের মৃত্যু হয়েছে।। রিভলবারের ট্রিগারে যে ছাপ পাওয়া গেছে, সেটা ওঁর বাঁ হাতের ইনডেক্স ফিঙ্গারের সঙ্গে একদম মিলে গেছে। তার চেয়েও বড় কথা বাঁ হাতে বারুদের গঁড়ো পাওয়া গেছে, যেটা নাকি একমাত্র সম্ভব কেউ যদি নিজের হাতে গুলি ছোঁড়ে। সুতরাং কনক্লুশন হচ্ছে আমরা প্রথমে যেটা ভেবেছি তাই, সুইসাইড।
এরকম ভাবে পুলিশকে ফোন করা একমাত্র একেনবাবুর পক্ষেই সম্ভব! অবভিয়াসলি ওপন এন্ড শাট কেস। তদন্তের কাজ শেষ। তাই উত্তরটা একেনবাবু পেয়েছেন, নইলে কপালে ধমক জুটতো।
একেনবাবু প্রমথর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। উনি যোগ করলেন, “লাকিলি স্যার, বিশেষ কষ্ট পান নি।”
প্রমথ সায় দিল। গুলিটা নাকি আড়াআড়ি ভাবে ঢুকে এদিক থেকে ওদিক চলে গেছে। ম্যাসিভ ব্রেন ড্যামেজ এন্ড অলমোস্ট ইনস্ট্যান্ট ডেথ।

লাঞ্চ খেতে খেতে মিস্টার প্যাটেলের কথাই বারবার আলোচনার মধ্যে এসে পড়ল। সবাই খুব ডিপ্রেসড বোধ করছিলাম। প্রমথ তো খাবার পর শুতেই চলে গেল, রাত্রে নাক ওর একদম ঘুম হয় নি! আমি সোফায় বসে ঝিমচ্ছি, একেনবাবু বললেন, “চলুন স্যার, কোথাও ঘুরে আসি। বাড়ি থেকে বেরোলে আপনার মনটা অন্তত একটু চাঙ্গা হবে।”
বেরোতে যে খুব ইচ্ছে করছিল তা নয়, আবার বাড়িতে থাকতেও ভালো লাগছিল না। জিজ্ঞেস করলাম, “কোথায় যাবেন?”
“চলুন না স্যার, আপনার সেই অ্যাস্ট্রলজার বন্ধুর কাছে।’
আমি একটু আসোয়াস্তি বোধ করলাম। প্রায় এক বছর কোনও যোগাযোগ নেই। কিন্তু একেনবাবুর ভীষণ ইচ্ছে ওঁকে একবার দেখেন। ওর এত উৎসাহ দেখে শেষ পর্যন্ত শৈলেন সাঁপুওকে ফোন করলাম। শৈলেন সাঁপুই আমার ফোন পেয়ে খুব খুশি। বললেন, “আরে সে কি কথা, আপনার পরিচিত – নিশ্চয় তাঁর গণনা করে দেব।”
একেনবাবু দেখি ভীষণ হাত পা নেড়ে ফিস ফিস করছেন, “চার্জ, চার্জটা জিজ্ঞেস করুন সয়ার।”
“ও হ্যাঁ, আপনার ফী-টা কি রকম?”
“দু-শো ডলার। কিন্তু আপনার বন্ধুর জন্যে কিচ্ছু লাগবে না। দরকারের সময় আপনি আমার জন্যে অনেক করেছেন। আই মাস্ট পে ব্যাক।”
“ওসব কেন বলছেন। সে যাই হোক, আপনার কখন সুবিধা?”
“আজই আসুন না সাতটা নাগাদ আমার অফিসে। প্রমথবাবুকেও নিয়ে আসবেন।”
আমি ডিরেকশনটা নিয়ে নিলাম। প্রমথ ঘুম থেকে উঠলে ওকে প্ল্যানটা বললাম। ও শুনে মন খারাপ করল। ওর আবার রাত্রে কি একটা সেমিনার।