১.১১ মৃত্যবাণ

মৃত্যবাণ

কিরীটীর চিঠি পাওয়ার পরদিনই, যে আসন্ন ঝড়ের ইঙ্গিতটা সুব্রত মনে মনে অনুভব করছিল, অকস্মাৎ সেটা সত্য হয়ে দেখা দিল। রাত্রি তখন প্রায় এগারোটা হবে। প্রাসাদের দিক থেকে সহসা একটা আর্ত চিৎকার রাত্রির স্তব্ধ বুকখানাকে কাঁপিয়ে তুললে। মুহূর্তে চারিদিক হতে লোকজন ছুটে এল। এমন কি রাজাবাহাদুর পর্যন্ত। সকলে এসে দেখলে লাহিড়ী মশাই তীব্র যন্ত্রণায় প্রাসাদের অন্দর ও বাহিরের সংযোগস্থলে বাঁধানো আঙিনার উপর পড়ে ছটফট করছেন। মাঝে মাঝে আগাগোড়া সমগ্র শরীরটা আক্ষেপে কুঁকড়ে কুঁকড়ে উঠছে। আলো নিয়ে এসে দেখা গেল, লাহিড়ীর বুকের বাঁদিকে, একেবারে হৃদপিণ্ড ভেদ করে, একটা বিঘত পরিমাণ ইস্পাতের সরু ছাতার শিকের মত তীক্ষ্ণ তীর বিধেঁ আছে।

তখুনি ডাক্তারের ডাক পড়ল, কিন্তু ডাক্তার আসবার আগেই লাহিড়ী মশাইয়ের মৃত্যু ঘটল। রাজবাড়ির ডাক্তার অমিয় সোম কিছুই করতে পরলেন না। তীব্র যন্ত্রণায় লাহিড়ীর সমগ্র দেহটা বারকয়েক আক্ষেপ করে একেবারে স্থির হয়ে গেল। সমগ্র মুখখানা যেন নীলাভ বিকৃত হয়ে গেছে। ডাঃ সোম বললেন, তীরের ফলার সঙ্গে কোনো সাংঘাতিক বিষ মাখিয়ে, সেই তীর বিদ্ধ করে হতভাগ্য লাহিড়ীর মৃত্যু ঘটানো হয়েছে।

সংবাদটা পেতে সুব্রতর দেরি হল না। শরীরটা একটু অসুস্থ থাকায় সুব্রত সেদিন আর হারাধনের ওখানে যায়নি। খাওয়াদাওয়ার পর শয্যায় শুয়ে একখানি ইংরেজী উপন্যাস পড়ছিল। পুরাতন রাজবাড়ি থেকে নতুন রাজবাড়িও তেমন বিশেষ দূর নয়। লাহিড়ীর আর্ত চিৎকার। সুব্রতরও কানে গিয়েছিল। অকুস্থানে এসে দেখলে, রাজাবাহাদুর যেন কেমন হয়ে গেছেন। এ কি সাংঘাতিক ব্যাপার! একেবারেই বলতে গেলে তাঁরই প্রাসাদের মধ্যে খুন!

সুব্রতকে আসতে দেখে রাজাবাহাদুর ব্যগ্রভাবে বলে উঠলেন, এই যে কল্যাণবাবু, আসুন। এই দেখুন কি ভয়ানক ব্যাপার!

কি হয়েছে?

লাহিড়ী খুন হয়েছে।

খুন হয়েছে? সে কি!

হ্যাঁ দেখুন না, তাকে নাকি বিষাক্ত তীর দিয়ে কে মেরেছে।

বিষের তীর!

হ্যাঁ, কিন্তু আমি যে এর মাথামুণ্ডু কিছু বুঝতে পারছি না কল্যাণবাবু। এত রাত্রে কেনই বা লাহিড়ী প্রাসাদে এসেছিল, আর প্রাসাদের মধ্যেই বা কে তাকে এইভাবে নৃশংসভাবে খুন করলে!

সুব্রত তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ভূপতিত লাহিড়ীর মৃতদেহটার দিকে তাকিয়ে দেখছিল। ডান পাশে কাত হয়ে ধনুকের মত বেঁকে লাহিড়ীর প্রাণহীন মৃতদেহটা অসাড় হয়ে পড়ে আছে। বাঁ দিককার বুকে তখনও তীরের খানিকটা ফলা বিদ্ধ হওয়ার পর বের হয়ে আছে। ক্ষীণ একটা রক্তের ধারা গায়ের জামাটা সিক্ত করে শান-বাঁধানো চত্বরের ওপরে এসে পড়েছে। মুখের দিকে তাকালেই স্পষ্ট বোঝা যায়, মৃত্যুর পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করেছে লোকটা। চোখমুখে এখনও তার সুস্পষ্ট আভাস।

মৃত্যুর পূর্বের তীব্র যাতনার আক্ষেপে বোধ হয় দুহাতের আঙুলগুলো দুমড়ে আছে বীভৎস মৃত্যু!…

কিন্তু সুব্রত ভাবছিল, লাহিড়ীও তা হলে নিহত হল! যে নাটক সে সুহাস মল্লিকের হত্যার সঙ্গে সঙ্গে শেষ হয়ে গিয়েছিল ভেবেছিল, আবার শুরু হল কি নতুন করে অন্য একটা অধ্যায়?

কে জানত লাহিড়ীর গোনা দিন এত কাছে এসে গিয়েছিল। আকস্মিক ভাবে ঘটনার স্রোত যে এইভাবে মোড় নেবে, কয়েক মুহূর্ত আগেও সুব্রত কি তা ভেবেছিল!

এ শুধু অভাবনীয় নয়, আকস্মিক।

তার সাজানো দাবার ক সহসা যেন অপমৃত্যুর অদৃশ্য হাতের ধাক্কা লেগে ওলটপালট হয়ে গেল।

এটা সেই গত ৩১শে মে সুহাস মল্লিকের দেহে যে হত্যাৰীজ ছড়ানো হয়েছিল তারই বিষক্রিয়া, না এ আবার এক নতুন নাটক শুরু হল!

সহসা রাজাবাহাদুরের কণ্ঠস্বরে সুব্রত যেন চমকে জেগে ওঠে।

এখন আমি কি করি বলুন তো কল্যাণবাবু? অসহায় বিপর্যস্তের মত রাজাবাহাদুর সুব্রতর মুখের দিকে চেয়ে প্রশ্ন করেন।

সর্বপ্রথম থানায় একটা সংবাদ দেওয়া প্রয়োজন, থানার লোক এসে মৃতদেহ না দেখা পর্যন্ত মৃতদেহ ওখান হতে নড়ানো যাবে না।

অ্যাঁ! আবার সেই থানা-পুলিস! রাজাবাহাদুরের কণ্ঠস্বরে ভয়মিশ্রিত উৎকণ্ঠা, কিন্তু কেন? কি তার প্রয়োজন?

বুঝতে পারছেন না, এ স্বাভাবিক মৃত্য নয়, খুন! পুলিস কেস।

আবার সেই পুলিস-কেস! তাহলে কি হবে?

আপনি স্থির হয়ে বসুন, আমিই থানায় খবর পাঠাবার ব্যবস্থা করছি।

সুব্রত ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল।

রায়পুরের থানা-অফিসার বিকাশ সান্যালকে সুব্রত ভাল ভাবেই চেনে। এবং এ কথাও বিকাশবাবু জানেন, কেন সুব্রত কল্যাণ রায় ছদ্মবেশে রায়পুরের রাজবাটিতে এসে আবির্ভূত হয়েছে। কেননা ইতিপূর্বে সুব্রত বিকাশবাবুর সঙ্গে গোপনে একদিন দেখাসাক্ষাৎ করে আলাপ-পরিচয় করে এসেছে।

সুব্রতরচেষ্টাতেই তখুনি সান্যালের ওখানে সংবাদ পাঠানোহল রাজবাড়ির একজন পেয়াদাকে দিয়ে।

লোকজনের ভিড় ক্রমেই বাড়ছে। ইতিমধ্যে লাহিড়ী মশাইয়ের মৃত্যুসংবাদটা আগুনের মতই প্রাসাদের বাইরে ও ভিতরে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। সকলেই উৎসুক ভাবে নানা প্রশ্ন একে ওকে জিজ্ঞাসা করছে।

সকলে যখন নানা আলোচনায় ব্যস্ত, ভিড়ের মধ্যে একফাঁকে সকলের অলক্ষ্যে সুব্রত গা-ঢাকা দিয়ে সরে পড়ল কিছুক্ষণের জন্য। নূতন প্রাসাদ হতে পুরাতন প্রাসাদ মিনিট চারেকের পথ হবে মাত্র। সুব্রত জোরপায়ে হেঁটে পুরাতন প্রাসাদে লাহিড়ী মশাইয়ের বাসভবনে এসে হাজির হল।

পুরাতন প্রাসাদের দক্ষিণ অংশে, উপরে ও নীচে গোটাচারেক ঘর নিয়ে লাহিড়ী থাকত। লোকজনের মধ্যে একটি ভৃত্য ও একটি রাধুনী বামুন।

তারাও গোলমাল শুনে অরক্ষিত অবস্থাতেই বাড়ি ফেলে রেখে নতুন প্রাসাদের দিকে ছুটে চলে গেছে ব্যাপার কি জানবার জন্যে।

লাহিড়ীর বাড়িটা অন্ধকার। সব আলোইনেভানো। কেবল বাইরে বারান্দায় একটা হ্যারিকেন দপ দপ করে জ্বলছে।

সুব্রত দ্রুতপদে খোলা দরজাপথে বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করে।

পকেট থেকে টচটা বের করে জ্বালাতেই চোখে পড়ে নীচের সুসজ্জিত বাইরের ঘরটি। তারই পাশ দিয়ে উপরে ওঠবার সিঁড়ি। মুহূর্তমাত্র ইতস্তত না করে সুব্রত অন্ধকার সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেল।

পাশাপাশি দুটো ঘর, সামনে ছোট একফালি বারান্দা।

কয়েকটি ফুলের টব।

কৃষ্ণপক্ষের রাত্রি। নিঝুম অন্ধকারে চারিদিক যেন থমথম করছে।

টর্চ বাতি জ্বালিয়ে সুব্রত দেখলে, সামনের দরজার গায়ে একটি তালা ঝুলছে, অন্য দরজাটি পরীক্ষা করে দেখলে, সেটি ভিতর থেকে বন্ধ। লোকটা সাবধানী ছিল, সে বিষয়ে কোনো ভুলই নেই। কিন্তু এখন উপায়? যেমন করেই হোক ঘরের মধ্যে প্রবেশ তাকে করতেই হবে আজ রাত্রেই এবং এই মুহূর্তেই।

সুব্রত তালাটা টেনে দেখলে, ভাল বিলিতি তালা, সহজে ভাঙা যাবে না। বাড়িতে গিয়ে তালা খোলবার যন্ত্রগুলো আনা ছাড়া আর অন্য কোনো উপায় নেই।

সুব্রতর কোয়াটার এখান হতে যদিও খুব বেশীদূর নয়, মিনিট তিন-চারের রাস্তা, কিন্তু তা ভিন্ন আর উপায়ই বা কি!

সুব্রত আবার ছুটল নিজের বাসার দিকে। মিনিট দশেকের মধ্যেই তালা খোলবার যন্ত্রপাতিগুলো নিয়ে এল; কতকগুলো সরু মোটা বাঁকানো ও সোজা লোহার শিক।

মিনিট পাঁচ-সাতের চেষ্টায় তালাটা খুলে গেল।

আনন্দে সুব্রতর চোখের তারা দুটো অন্ধকারে ঝক্ঝক্ করে ওঠে। দরজাটা খুলে এবারে সুব্রত ঘরের মধ্যে গিয়ে প্রবেশ করে। বেশ প্রশস্ত ঘরখানি। আসবাবপত্র ঘরের মধ্যে সামান্যই, একটা ফোলডিং ক্যাম্পখাট, একটি বইয়ের আলমারি ও কয়েকটি ছোট-বড় বাক্স। সবার উপরে একটি এ্যাটাচি কেস।

প্রথমেই সুব্রত অ্যাটাচি কেসটা খুলে ফেললে। কতকগুলো কাগজপত্র, হিসাবের খাতা, ক্যাশমেমো ও ব্যাঙ্কের চেকবই।

অ্যাটাচি কেসটা একপাশে সরিয়ে রেখে সুব্রত একটা স্টীল ট্রাঙ্কের তালা ভেঙে ফেললে, বিশেষ কিছুই তার মধ্যে নেই, কতকগুলো জামাকাপড়। আর একটা ট্রাঙ্কও খুললে, তার মধ্যেও বিশেষ কিছু পাওয়া গেল না।

হতাশ হয়ে সুব্রত উঠে দাঁড়াল। পরিশ্রমে কপালের উপরে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে গেছে তখন।

অ্যাটাচি কেস থেকে কতকগুলো কাগজপত্র ও হিসাবের খাতাটা পকেটে ভরে বাকি সব জিনিসপত্র সুব্রত সেই অবস্থায়ই ফেলে, যেমন ঘর হতে বের হতে যাবে, হঠাৎ সামনের ছাদের দিকে নজর পড়তে ও চমকে দাঁড়িয়ে গেল, অস্পষ্ট ছায়ামূর্তির মত ঘরের সম্মুখের ছাদ দিয়ে কে যেন এগিয়ে আসছে।

সুব্রত চট করে হাতের টর্চবাতিটা নিভিয়ে দিল। এবং অন্ধকারে ঘরের জানালার পিছনে গিয়ে সরে দাঁড়াল।

কে ঐ ছায়ামূর্তি!

কেউ কি অলক্ষ্যে থেকে তার সমস্ত কার্যকলাপ লক্ষ্য করছে! স্তিমিত তারার আলোয় তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ছাদের দিকে তাকাল।

পুরাতন রাজপ্রাসাদের একটা অংশকে বিভিন্ন কর্মচারীদের বাসের ও অফিসের জন্য ছোট ছোট ফ্ল্যাটের মত অংশে বিভক্ত করা হয়েছে পার্টিশন তুলে। তারই এক অংশ হতে অন্য অংশে ছাদ দিয়ে যাতায়াত করা যায়। যদিচ বিভিন্ন অংশের মধ্যবর্তী দরজাগুলো বন্ধ থাকে প্রায় সর্বদাই।

ব্যবধান মাত্র একমানুষ সমান প্রাচীরের। কারও পক্ষে সেটা পার হয়ে আসা এমন কিছুই কষ্টসাধ্য ব্যাপার নয়।

কিন্তু ছাদ থেকে লাহিড়ীর ঘরে প্রবেশের দরজাটা বন্ধ। ছায়ামূর্তি যেই হোক, এ ঘরের মধ্যে এলে সহসা প্রবেশ করতে পারবে না। সম্ভবও নয়।

হঠাৎ সুব্রত লক্ষ্য করলে ছায়ামূর্তি ছাদের বাঁদিকে সরে গেল, তাকে আর দেখা যাচ্ছে না। লোকটার চলার ধরন সুব্রতর যেন চেনা-চেনা বলেই মনে হয়। কিন্তু সামান্য আলোয় সুব্রত ভাল করে বুঝে উঠতে পারে না।

এদিকে এখানে আর বেশী দেরি করা মোটেই উচিত নয়, এতক্ষণে হয়ত থানা থেকে বিকাশবাবু এসে গেছেন ঘটনাস্থলে, এখুনি হয়ত তার খোঁজ পড়বে।

সুব্রত ত্বরিত পদে নেমে এল।