১.০৮ আরও সূত্র

আরও সূত্র

সুব্রত সে দিনও জাস্টিস মৈত্রের বাড়িতে মামলার প্রসিডিংস পড়ছিল।

রায়বাহাদুর অনিমেষ হালদার ডাঃ মুখার্জীকে প্রশ্ন করছিলেন, ডাঃ মুখার্জী, আপনি তাহলে আগাগোড়া কোনো সময়েই সন্দেহ করেননি যে, সুহাস মল্লিকের প্লেগ হতে পারে?

না।

ডাঃ সেনগুপ্ত যখন সে বিষয়ে আপনাকে ইঙ্গিত করেন, তখনও নয়?

না।

কিন্তু কর্ণেল স্মিথের রিপোর্টে প্রমাণিত হয়েছে, সুহাস মল্লিকের প্লেগই হয়েছিল, এ কথাটা নিশ্চয়ই এখন আপনি অস্বীকার করছেন না?

স্বীকারও করছি না।

তার মানে?

তার মানে, যে ব্লাড-কালচারের রিপোর্টের ওপরে ভিত্তি করে কর্ণেল স্মিথ রিপোর্ট দিয়েছেন, সেটা যে মৃত সুহাসমল্লিকেরইব্লাড-কালচার রিপোর্ট, সেটা প্রমাণিত হত যদি তখনই মৃতদেহের ময়না তদন্ত করা হত! ব্যাপারটা যে আগাগোড়াই সাজানো নয় বা কোনো ভুলভ্রান্তি হয়নি, তারও তো কোনো প্রমাণ নেই।

না, তা নেই বটে, কিন্তু কর্ণেল স্মিথ এর উত্তরে কি বলেন?

এবারে অ্যাডভোকেট হালদার কর্ণেল স্মিথকে প্রশ্ন করছেন।

আমি oath নিয়ে বলতে পারি, যে ব্লাড-কালচার রিপোর্ট আমরা দিয়েছি সেটা মৃত মিঃ সুহাস মল্লিকেরই রক্তের কালচার রিপোর্ট। সে প্রমাণও আমরা দিতে পারি। কর্ণেল স্মিথ জবাব দেন।

মিঃ লর্ড, আমি একটা প্রশ্ন কর্ণেল স্মিথকে করতে পারি কি? ডাঃ মুখার্জী বললেন।

ইয়েস, করুন।

কর্ণেল স্মিথ, একটা কথা আপনাকে জিজ্ঞাসা করছি-বললেন ডাঃ মুখার্জী, যদি সত্যিই সুহাস মল্লিকের শরীরের রক্ত কালচার করে প্লেগই প্রমাণিত হয়ে থাকে ধরে নেওয়া যায়, তবে প্লেগের বীজাণু কি করে এবং কোথা থেকে সুহাসের শরীরে এল, এর জবাব আপনি দিতে পারেন কি?

কি করে এল এবং আসতে পারে কিনা, সেটা আমার বিবেচ্য নয়। আদালতই সেটা দেখবেন।

মিঃ হালদার : এমন কি হতে পারে না কর্ণেল স্মিথ যে, প্লেগ বীজাণু সুহাসের শরীরে inject করা হয়েছিল?

কর্ণেল স্মিথ : আমার মনে হয় সুহাসের শরীরে প্লেগ জার্ম ইনজেকশন করাই হয়ত হয়েছিল, সেটাই স্বাভাবিক এক্ষেত্রে।

ডাঃ মুখার্জী: ব্যাপারটা অনেকটা একটা রূপকথার মত শোনাচ্ছে না কি? আজ প্রায় চল্লিশ-পঞ্চাশ বৎসরের মধ্যে বাংলাদেশের কোথাও কোনো প্লেগ কেস হয়েছে বলে শোনা যায়নি, এক্ষেত্রে প্লেগ জার্ম সংগ্রহ করে কারও শরীরে সেটা ইনজেকশন করা, ব্যাপারটা শুধু অসম্ভবই নয়, হাস্যকর নয় কি?

কর্ণেল স্মিথ : আমার সহকর্মী মাননীয় ডাঃ মুখার্জী বলবেন কি তাঁর সহকারী রিসার্চ স্টুডেন্ট ডাঃ অমর ঘোষ হঠাৎ এক মাসের ছুটি নিয়ে বম্বেতে গিয়েছিলেন কিনা এবং কেনই বা গিয়েছিলেন?

হ্যাঁ, গিয়েছিলেন।

তিনি কি কারণে বম্বেতে গিয়েছিলেন?

তা আমি কি করে বলব? তিনি ছুটি নিয়ে কোথায় যান না যান, সেটা দেখবার আমার কোনো প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না।

আচ্ছা এ কথা কি সত্যি যে বম্বে রিসার্চ ইন্সটিটিউটে ডাঃ অমর ঘোষ ডাঃ মুখার্জীরই একটি পরিচয়পত্র নিয়ে কাজ করতে গিয়েছিলেন কর্ণেল কৃষ্ণমেননের কাছে?

কোথায় কথাটা শুনলেন জানি না এবং ডাঃ ঘোষকে আমি কোনো পরিচয়পত্র দিইনি।

কর্ণেল কৃষ্ণমেনন, ডাইরেক্টর অফ বম্বে প্লেগ ইনস্টিটিউট আপনার পরিচিত বন্ধু, কথাটা কি সত্যি?

হ্যাঁ।

এর পর সাক্ষী দেওয়ার জন্য ডাঃ অমর ঘোষ ও কর্ণেল কৃষ্ণমেননের ডাক পড়ে আদালতে।

প্রথমে ডাঃ ঘোষকে প্রশ্ন করা হয়।

রায়বাহাদুর অনিমেষ হলদার জেরা করেন, ডাঃ ঘোষ, আপনি ডাঃ মুখার্জীর অধীনে ট্রপিক্যাল ইন্সটিউটে রিসার্চ করেন?

হ্যাঁ।

কত দিন আগে?

আজ প্রায় দু বৎসর হবে।

আপনি গত ডিসেম্বরের প্রথম দিকে বম্বেতে গিয়েছিলেন?

হ্যাঁ।

বম্বেতে আপনি প্লেগ রিসার্চ ইনস্টিটিউটে কাজ করবার জন্য ডাঃ মুখার্জীর কোনো পরিচয়পত্র নিয়ে গিয়েছিলেন?

না।

তা যদি না হয়, তাহলে কি করে আপনি বম্বে প্লেগ রিসার্চ ইনস্টিটিউটে প্রবেশঅধিকার পেলেন? আমরা যতদূর জানি, একমাত্র গভর্ণমেন্টের স্পেশাল পারমিশন ব্যাতিরেকে কারও সেখানে প্রবেশ নিষেধ।

কর্ণেল কৃষ্ণমেননের সঙ্গে দেখা করে আমি তাঁর অনুমতি চেয়ে নিয়েছিলাম দিনকয়েকের জন্য।

কত দিন কাজ করেছিলেন?

দিন কুড়ি মত হবে।

কর্ণেল কৃষ্ণমেননের সঙ্গে এই ঘটনার পূর্বে আপনার কোনো পরিচয় ছিল কি?

হ্যাঁ, গত বছরের ডিসেম্বর মাসে মেডিক্যাল কনফারেন্সে কর্ণেল কৃষ্ণমেনন কলকাতায় এসেছিলেন, সেই সময় তাঁর সঙ্গে আলাপ-পরিচয় হবার সৌভাগ্য হয়েছিল।

এ কথা কি ঠিক কর্ণেল কৃষ্ণমেনন?

হ্যাঁ। কৃষ্ণমেনন জবাব দেন।

আপনি ঠিক বলছেন, আপনার কাছে ডাঃ ঘোষ কোনো লেটার অফ ইনট্রোডাকশান পেশ করেননি?

না।

ডাঃ ঘোষ, ৩১শে মে শিয়ালদহ স্টেশনে সুহাস মল্লিক অসুস্থ হবার দিন সাতেক আগে হঠাৎ আপনি বম্বে হতে কলকাতায় ফিরে আসেন—এ কথা কি সত্য?

হ্যাঁ।

হঠাৎ কুড়িদিন কাজ করেই আবার আপনি ফিরে এলেন যে?

আমার ছুটি ফুরিয়ে গিয়েছিল।

কলকাতায় ফেরবার পর আপনাকে প্রায়ই ঘন ঘন দুপুরের দিকে ডাঃ মুখার্জীর কলকাতার বাসভবনে যাতায়াত করতে দেখা যেত কয়েকদিন যাবৎ, এ কথা কি সত্যি?

হ্যাঁ, আমি প্রায়ই তাঁর কাছে যেতাম, আমি একটা থিসিস সাবমিট করব, সেই সম্পর্কেই আলোচনা করবার জন্য ডাঃ মুখার্জীর ওখানে আমার যাওয়ার প্রয়োজন হত।

সন্ধ্যা হয়ে এসেছিল, সুব্রত সেদিনকার মত উঠে পড়ল। সারাটা দিন আদালতের কাগজপত্র ঘেঁটে মাথাটা যেন কেমন টিপ টিপ করছে।

***

সেই দিন সন্ধ্যায় আবার কিরীটী বলছিল, দেখা যাচ্ছে সমগ্র হত্যাকাণ্ডটাই আগাগোড়া একটা চমৎকার পূর্বপরিকল্পিত ব্যাপার। কিন্তু আসামী ডাঃ সুধীন চৌধুরী যেন একটা পরিপূর্ণ মিস্ট্রি, তাঁর প্রত্যেকটি statement থেকে স্পষ্টই বোঝা যায়, কাউকে তিনি যেন সযত্নে shield করবার চেষ্টা করছেন আগাগোড়া।

তোর তাই মনে হয়! সুব্রত প্রশ্ন করে।

তাই।

কিন্তু আজ পর্যন্ত প্রসিডিংস থেকে যতদুর জানা গেছে, তাতে করে ডাঃ সুধীন চৌধুরীকে বাঁচাতে পারে এমন কেউই নেই। ভদ্রলোক একেবারে গলা-জলে।

আমাদের এখন তাকে সেই গলা-জল থেকে টেনে তোলবার চেষ্টা করতে হবে।

এখন কি তুই মনে করিস কিরীটী, ডাঃ সুধীন চৌধুরীকে বাঁচাতে পারবি?

চেষ্টা করতে দোষ কি! হয়তো গলা-জলের মধ্যেও একটা ভাসমান কাষ্ঠখণ্ড দেখা দেবে! কিন্তু সে কথা যাক, আপাতত আমাকে কাগজপত্র ছেড়ে কিছুদিন ঘোরাফেরা করতে হবে।