১.০৪ প্লেগ ব্যাসিলাই

প্লেগ ব্যাসিলাই

ব্যথা কমা তো দূরে থাক, হাতটার ব্যথা যেন ক্রমেই বেড়ে চলেছে, কেমন ঝিঁঝিন্ করে সমস্ত হাতটা যেন অসাড় মনে হয় কিছুক্ষণের মধ্যে।

সুহাস বার্থের বিস্তৃত শয্যার ওপরে গা-টা এলিয়ে দিয়ে ঘুমোবার চেষ্টা করে। কিন্তু বৃথা–!

সমস্ত রাতের মধ্যে সুহাস একটি বারের জন্যও চোখের পাতা বোজাতে পারলে না। ব্যথায় ও অস্বোয়াস্তিতে এপাশ-ওপাশ করতে থাকে।

সমস্ত হাতটা টন্ করছে। জ্বর-জ্বরও বোধ হচ্ছে। এমনি করেই রাতটা কেটে গেল।

পরের দিন সকালবেলা স্টেশনে নেমে রাজবাড়ির মোটরে করে সকলে এসে প্রাসাদে পোঁছল।

এবং সেদিনই রাত্রের দিকে সুহাসের অল্প অল্প জ্বর দেখা দেয় প্রথম।

পরের দিন সকালে রাজবাড়ির ডাক্তার অমিয় সোমকে ডেকে আনা হল, তিনি দেখেশুনে বললেন, ও কিছু না, ভয়ের তেমন কোনো কারণ নেই। সামান্য ঠাণ্ডা লেগে ইনফ্লুয়েঞ্জা মত হয়েছে, গোটা দুই অ্যাপ্রিন্ খেলেই আবার চাঙ্গা হয়ে উঠবে। হাতটার যেখানে সামান্য ফুলে লাল হয়ে ব্যথা হয়েছে, সেখানে একটু গরম সেঁক দিলেই হবে।

কিন্তু দিন দুই পরেও দেখা গেল জ্বরটা একেবারে বিচ্ছেদ হয়নি, ৯৯° থেকে ১০১°–এর মধ্যেই থাকছে। গলায় ও কোমরে সামান্য সামান্য বেদনা—হাতের ফোলাটা অবিশ্যি অনেকটা কম।

আবার ডাক্তার এলেন, সম্ভব-অসম্ভব তাঁর বিদ্যামাফিক পরীক্ষা করে তিনি নবীন উদ্যমে নতুন ঔষধপত্রের ব্যবস্থা করলেন। এবং এবারও বললেন, ভয় বা চিন্তার তেমন কোন কারণ নেই। এমনি করেই আট-দশটা দিন কেটে গেল এবং সেই আট-দশদিনেও জ্বর রেমিশন হল না। গলার দু-পাশে, বগলের নীচে, কুঁচকিতে গ্ল্যাণ্ডসগুলো ব্যথা হয়ে সামান্য বড় হয়েছে বলে মনে হল।

মালতী দেবী কিন্তু এবারে বেশ চিন্তিত হয়ে উঠলেন। হাজার হলেও মার প্রাণ তো!

সুবিনয়কে একদিন সকালে ডেকে বললেন, বিনয়, আট-দশদিন তো হয়ে গেল, কিন্তু সুহাসের জ্বর তো কমছে না কিছুতেই; কলকাতা থেকে কোনো একজন ভাল ডাক্তার এনে দেখালে একবার হত না?

সবতাতেই তোমার ব্যস্ত ছোট মা! পথে আসতে ঠাণ্ডা লেগে জ্বর হয়েছে, দু-চারদিন পরেই সেরে যাবে। তাছাড়া ডাক্তার দেখছে, ওষুধ খাচ্ছে। এতই যদি তোমার ভয় হয়ে থাকে—তবে ডাঃ কালীপদ মুখার্জীকে না হয় আসবার জন্য একটা তার করে দিচ্ছি।

তাই না হয় করে দাও। অমিয়র চিকিৎসায় তো এক সপ্তাহ প্রায় রইল, কোনো উপকারই তো দেখা যাচ্ছে না, সময় থাকতে সাবধান হওয়াই কি ভাল নয়? শেষে রোগ বেঁকে দাঁড়ালে মুশকিল হবে।

ডাঃ কালীপদ মুখার্জী কলকাতা শহরের একজন মস্তবড় নামকরা ডাক্তার।

মাসে তিনি অনেক টাকাই উপায় করেন।

রায়পুরের রাজবাড়িতে তাঁর অনেক দিন হতেই চিকিৎসাসূত্রে যাতায়াত। এককথায় তিনি স্টেটের কনসালটিং ফিজিসিয়ান।

রায়পুরের রাজবাড়িতে কখনও কোনো কঠিন কেস হলে কলকাতা থেকে কাউকে আনতে হলে সর্বাগ্রে তাঁরই ডাক পড়ে, এবং বহুবার তিনি রাজবাড়ির অনেকের অনেক দুরারোগ্য ব্যাধির চিকিৎসা করে আরাম ও সুস্থ করে তুলেছেন। এ বাড়ির সঙ্গে তিনি বিশেষভাবেই পরিচিত।

তাঁর অমতে বা তাঁর অজ্ঞাতে রাজবাড়িতে কখনও অন্য কোনো বড় ডাক্তারকে আজ পর্যন্ত ডাকা হয়নি।

বহুবার যাতায়াতের জন্য রাজবাড়ির সঙ্গে ডাঃ মুখার্জীর অত্যন্ত হৃদ্যতা জমে উঠেছে।

রাজবাড়ির একজন হিতৈষী বন্ধুও বটে তিনি।

আর দেরি না করে ঐদিনই সকালের দিকে তাঁকে আসবার জন্য একটা জরুরী তার করবার জন্য মালতী দেবী বারংবার বলতে লাগলেন।

যদিচ অমিয় ডাক্তার বার বার বলতে লাগলেন, ভয় নেই রাণীমা, সামান্য জ্বর, ও দু-চারদিন নিয়মিত ওষুধপত্র খেলেই ভাল হয়ে যাবে।

এবং সুবিনয়ও সেই সঙ্গে সায় দিতে লাগল। তথাপি রাণীমা বলতে লাগলেন, তা হোক, ডাঃ মুখার্জীকে তার করে দেওয়া হোক, কলকাতা থেকে একটিবার এসে তিনি সুহাসকে যত শীঘ্র সম্ভব দেখে যান।

এবং শেষ পর্যন্ত তার করেও দেওয়া হল। আর তার পেয়ে ডাঃ মুখার্জী রায়পুর এসে হাজির হলেন।

ডাঃ মুখার্জীর বয়স চল্লিশের কিছু উপরেই হবে। থলথলে নাদুসনুদুস গড়ন। লম্বা-চওড়া চেহারা। গায়ের রং কাঁচা হলুদের মত। সৌম্য প্রশান্ত। মাথার সামনেয় সামান্য টাক পড়েছে। দাড়িগোঁফ নিখুঁতভাবে কামানো।

দেখলেই মনে হয় যেন একটা সাহস বা নিরাপত্তার ভাব আসে রোগীর মনে।

ডাঃ মুখার্জী এসে সুহাসের কক্ষে প্রবেশ করলেন, কি হে সুহাসচন্দ্র? আবার অসুখ বাধিয়েছ? তুমি যে ক্রমে একটি রোগের ডিপো হয়ে উঠলে হে!

সুহাস ক্লান্ত স্বরে বলে, বড় দুর্বল লাগছে ডাঃ মুখার্জী।

ভয় নেই। সব ঠিক হয়ে যাবে। আশ্বাস দেন ডাঃ মুখার্জী।

পরীক্ষার পর মালতী দেবী জিজ্ঞাসা করলেন, কেমন দেখলেন ডাঃ মুখার্জী সুহাসকে?

ডাঃ মুখার্জী বলেন, ভয়ের কিছু নেই, ভাল হয়ে যাবে।

কিন্তু তবু ডাঃ মুখার্জীকে মালতী দেবী পাঁচ-ছয়দিন রায়পুরেই আটকে রাখলেন, ছাড়লেন না, বললেন, ওকে একটু সুস্থ না করে আপনি যেতে পারবেন না।

কিন্তু সুহাসের অসুখের কোনো উন্নতিই হল না পাঁচ-ছ দিনেও।

ক্রমেই সুহাস যেন বেশী অসুস্থ হয়ে পড়তে লাগল। মালতী দেবী এবারে কিন্তু বিশেষ চিন্তিত হয়ে উঠলেন, মনের মধ্যে কেমন যেন একটা আশঙ্কা থমথম করে।

শেষটায় মালতী দেবী বেঁকে বসলেন, সুহাসকে কলকাতায় নিয়ে যেতেই হবে; এ আমার মোটেই ভাল লাগছে না ডাঃ মুখার্জী কলকাতাতেই ওকে নিয়ে চলুন, সেখানে আরও দু-একজনের সঙ্গে কনাসা করুন।

ডাঃ মুখার্জী অনেক বোঝালেন, কিন্তু মালতী দেবী দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। ইতিমধ্যে হঠাৎ সুহাসের একখানা চিঠি পেয়ে ডাঃ সুধীন রায়পুরে এসে হাজির হল। সেও বললে, এ অবস্থায় কলকাতায় নিয়ে যাওয়াই বোধ হয় ভাল হবে।

অবশেষে সত্যিসত্যিই একপ্রকার জোর করেই যেন মালতী দেবী অসুস্থ সুহাসকে ডাঃ মুখার্জী ও সুধীনের তত্ত্বাবধানে কলকাতার বাসায় নিয়ে এসে তুললেন।

সুধীন কিন্তু কলকাতায় আসবার পরের পরের দিনই জরুরী একটা কাজে বেনারস চলে গেল।

আরও বড় বড় ডাক্তার ডাকা হল, সার্জেন, ফিজিসিয়ান কেউ বাদ গেল না।

নানা মুনির নানা মত। নানা চিকিৎসা-বিভ্রাট চলতে থাকে যেমন সাধারণত হয় অর্থের প্রাচুর্য থাকলে।

অবশেষে পূর্ব কলকাতার একজন প্রখ্যাতনামা চিকিৎসক ডাঃ রায় এসে রোগী দেখে ডাঃ মুখার্জীকে বললেন, রক্তটা একবার কালচার করবার জন্য পাঠানো হোক ডাঃ মুখার্জী। সবই তো করে দেখা হল।

ডাঃ মুখার্জী প্রশ্ন করলেন, রক্ত কালাচার করে কি হবে ডাঃ রায়?

রোগীর গ্ল্যাণ্ডসগুলো দেখে কেমন যেন সন্দেহ হচ্ছে, মনে হচ্ছে, প্লেগের মত, যেন গ্ল্যাণ্ডসগুলো ফুলেছে।

ডাঃ মুখার্জী হাঃ হাঃ করে উচ্চেঃস্বরে হেসে উঠলেন, প্লেগ! ঐ সমস্ত চিন্তাটা আপনার মাথায় এল কি করে—তাও আজকের দিনে!

ডাঃ মুখার্জী হাসতে লাগলেন।

হাসবেন না ডাঃ মুখার্জী। সব রকমই তো করা হল, ওটাও না হয় করে দেখলেন, এমন কি ক্ষতি! তাছাড়া আমার মনে হয় এক্ষেত্রে সেটা প্রয়োজনও। শেষের দিকে তাঁর কণ্ঠস্বরে বেশ একটা দৃঢ়তা যেন ফুটে ওঠে।

না, ক্ষতি আর কি, তবে absolutly unnecessary! কিন্তু আপনি যখন বলছেন, পাঠানো হোক। কতকটা অনিচ্ছাতেই যেন রক্ত কালচার করবার মত দিলেন ডাঃ মুখার্জী।

যাই হোক, ব্লাড নেওয়া হল কালচারের জন্য, ট্রপিক্যাল স্কুলেও পাঠানো হল। কিন্তু রক্তের কালচারের রিপোট আসবার আগেই, অর্থাৎ পরদিন সকালেই সুহাসের আকস্মিক মৃত্যু ঘটল।

ডাঃ মুখার্জী ডেথ সার্টিফিকেট দিলেন, যথানিয়মে শবদেহের দাহকার্যও সুসম্পন্ন হয়ে গেল।

***

সুহাসের মৃত্যুর দুতিনদিন পরে। সুধীন আবার বেনারস থেকে ফিরে এসে সব শুনলে, কিন্তু একটি কথাও ভাল-মন্দ কিছুই বললে না। নিঃশব্দে কেবল ঘর হতে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল—ঘরে তখন অন্যান্য সবাই বসেছিল।

এদিকে ট্রপিক্যাল স্কুলের ল্যাবরেটরী রুমে অধ্যক্ষ কর্ণেল স্মিথ কতকগুলি কালচার-টিউব নিয়ে পরীক্ষা করছেন।

বিকেল প্রায় পাঁচটা, ল্যাবরেটরীর কর্মীরা সকলেই প্রায় যে যাঁর কাজকর্ম শেষ করে বাড়ি চলে গেছেন।

এমন সময় কর্ণেল স্মিথের সহকারী ও ছাত্র ডাঃ মিত্র, কর্ণেলের সামনে একটা কালচার-টিউব নিয়ে এসে দাঁড়ালেন, স্যার!

ইয়েস, ডাঃ মিত্র—? কর্ণেল ডাঃ মিত্রের দিকে মুখ তুলে চাইলেন।

দেখুন তো–এই কালচার-টিউবটা! প্লেগ ব্যাসিলাইয়ের গ্রোথ বলেই যেন সন্দেহ হচ্ছে!

What! Plauge growth! Let me see! Let me see!

ব্যগ্রভাবে কর্ণেল কালচার-টিউবটা হাতে নিয়ে টিউবের ওপরে ঝুঁকে পড়লেন। উত্তেজনায় তাঁর চোখের তারা দুটো যেন ঠিকরে বের হয়ে আসতে চায়।

Yes! It is nothing but Plague! Yes, its Plague!

তখুনি গিনিপিগের শরীরে সেই কালচার-টিউবথেকেগ্রোথ নিয়ে ইনজেক্ট করা হল পরীক্ষার জন্য। এবং খোঁজ করে জানা গেল, রায়পুরের ছোট কুমার সুহাস মল্লিকের যে রক্ত কালচার করতে ডাঃ মুখার্জী পাঠিয়েছিলেন, এ তারই কালচার।

পরীক্ষার দ্বারা প্রমাণিত হল, সেটা যথার্থই প্লেগ ব্যাসিলাইয়ের গ্রোথ।

সেই রিপোর্ট তখুনি সঙ্গে করে নিয়ে সন্ধ্যার একটু পরেই কর্ণেল স্মিথ স্বয়ং ডাঃ রায়ের হাতে পৌঁছে দিয়ে এলেন। কারণ তিনি ডাঃ মিত্রের কাছ থেকে শুনেছিলেন, ওটা ডাক্তার রায়ের সুপারিশেই কালচারের জন্য নাকি এসেছিল, তাছাড়া অন্য কারণও ছিল।

সে যা হোক, বিদ্যুৎগতিতে সে সংবাদ ছড়িয়ে পড়ল সারাটা কলকাতা শহরে চিকিৎসকদের মহলে। এবং ক্রমে সেই কথাটা পাবলিক প্রসিকিউটার গগন মুখার্জীর কানে এসে উঠল। গগন মুখার্জী যেন হঠাৎ উঠে বসলেন। আরও দুচার দিন গোপনে খোঁজখবর চলল, তারপর আকস্মিক একদিন সন্ধ্যার ঠিক আগে—পাবলিক প্রসিকিউটার রায়বাহাদুর গগন মুখার্জী, রায়পুরের ছোট কুমার সুহাস মল্লিকের খুনের দায়ে গ্রেপ্তারী পরোয়ানা বের করে একই সঙ্গে ডাঃ মুখার্জী, সুবিনয় মল্লিক, ডাঃ অমিয় সোম এবং আরও দু-চারজনকে গ্রেপ্তার করে একেবারে হাজতে পুরলেন।

শহরে রীতিমত এক চাঞ্চল্য দেখা দিল। কারণ সংবাদটা যেমনি অভাবনীয় তেমনি চাঞ্চল্যকর।

জামিনে ওদের খালাস করার জন্য তদ্বির শুরু হল।

কিন্তু দৃঢ়প্রতিজ্ঞ গগন মুখার্জী কঠিনভাবে মাথা নাড়লেন, জামিনে কারও খালাস হবে না। যতদিন না মামলার মীমাংসা হয়, কারও জামিন মিলবে না। অভিযোগ হত্যা ও হত্যার ষড়যন্ত্র! এবং নিশ্চিত প্রমাণ-সূত্র সরকার বাহাদুরের হাতে পৌঁছে গেছে।

তদন্ত শুরু হল।

গগন মুখার্জী আবশ্যকীয় সব প্রমাণাদি যোগাড় করতে লাগলেন নানা দিক থেকে। গগন মুখার্জীর সবচাইতে বেশী রাগ যেন ডাঃ মুখার্জীর ওপরেই। কিন্তু তারও একটা কারণ ছিল বৈকি। অতীতের কুহেলী আচ্ছন্ন। অথচ কেউ সে কথা জানত না। ঐ ঘটনার বছর চার আগে, পাবলিক প্রসিকিউটার গগন মুখার্জীর বড় মেয়ে কুন্তলা আত্মহত্যা করে।

কুন্তলার শ্বশুরবাড়ির লোকেরা ষড়যন্ত্র করে তাদের পুত্রবধূ কুন্তলাকে পরিত্যাগ করে। কুন্তলার নাকি মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে এই অভিযোগে ছেলের আবার বিবাহ দেয়। কুন্তলা যে সত্যিসত্যিই পাগল হয়ে গেছে সে সাটিফিকেট দিয়েছিল ঐ ডাঃ মুখার্জীরই মেডিকেল বোর্ড যে বোর্ডে তিনি একজন পাণ্ডা ছিলেন। আসলে কিন্তু ব্যাপারটা আগাগোড়া কুন্তলার শ্বশুবাড়ির লোকের পক্ষ থেকে সাজানো। কুন্তলাকে ত্যাগ করবার একটা অছিলা মাত্র। নিষ্ফল আক্রোশে নির্বিষ সাপের মতই সেদিন গগন মুখার্জী ছটফট করেছিলেন। উপায় নেই। নিষ্করুণ ভাগ্যের নির্দেশকেই সেদিন মেনে নিতে হয়েছিল সানেত্রে।

অনেক চেষ্টা করেও ডাঃ মুখার্জীর বিরুদ্ধে তিনি কোনো অভিযোগ খাড়া করতে পারেন নি সেদিন। লজ্জায়, দুঃখে, অপমানে কুন্তলা আত্মহত্যা করে সকল জ্বালা জুড়লো।

শ্মশানযাত্রীরা শবদেহ এনে উঠোনের ওপরে নামিয়েছে—চেয়ে রইলেন—দুচোখের কোল বেয়ে অজস্র ধারায় অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগল।

কন্যার মৃতদেহ স্পর্শ করে মনে মনে সেদিন তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, মাগো, তোর দুঃখ আর কেউ না বুঝলেও, আমি বুঝেছিলাম। এর প্রতিশোধ আমি নেব।

হ্যাঁ, প্রতিশোধ! এর প্রতিশোধ তাঁকে নিতেই হবে!

আজ তিনি ডাঃ মুখার্জীকে হাতের মুঠোর মধ্যে পেয়েছেন। এতবড় সুবর্ণ সুযোগ!

***

হাজত-ঘরে ডাঃ মুখার্জী বসে কত কথাই ভাবতে লাগলেন। কিন্তু বের হবার উপায় নেই। সরকার জামিনও দেবে না বলে দিয়েছে।

আর গগন মুখার্জী মনে মনে দাঁত চেপে বললেন, এই যে যজ্ঞ শুরু করলাম, এর পূর্ণাহুতি হবে সেইদিন, যেদিন মুখার্জীকে ফাঁসির দড়িতে ঝোলাতে পারব।

কিন্তু নিয়তির কি নির্মম পরিহাস!

আর মাত্র তিনদিন আছে মামলা আদালতে শুরু হবার।

গগন মুখার্জীর বাড়ির গেটে ও চতুম্পার্শ্বে সশস্ত্র প্রহরী দিবারাত্র পাহারা দিচ্ছে তাদের রাইফেলের সঙ্গীন উঁচিয়ে, যাতে করে শত্রুপক্ষের লোকেরা কেউ মামলা শেষ হওয়ার আগে পর্যন্ত গগন মুখার্জীর কোনো প্রকার দৈহিক ক্ষতি না করতে পারে। কারণ সে ভয় তাঁর খুবই ছিল।

এমন সময় সহসা গগন মুখার্জীর একদিন সন্ধ্যার সময় জ্বর এল, জ্বরের ঘোরে তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়লেন। কলকাতা শহরের বড় বড় ডাক্তাররা এলেন, তাঁরা মাথা নেড়ে গম্ভীর স্বরে বললেন, ব্যাধি কঠিন, ভিরুলেন্ট টাইপের ম্যানিনজাইটিস্-জীবনের আশা খুব কম।

জলের মত অর্থব্যয় হল, চিকিৎসার কোনো ক্রটি হল না—কিন্তু সব প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হয়ে গেল। সাজানো দাবার ছক ফেলে, মাত করবার পূর্বেই এতদিনকার অতৃপ্ত প্রতিশোধের দুর্নিবার স্পৃহা বুকে চেপেই পাবলিক প্রসিকিউটারর গগন মুখার্জী কোনো এক অজানা লোকের পথে পা বাড়ালেন।

লোকমুখে সেই সংবাদ জেলের মধ্যে বন্দী ডাঃ মুখার্জীর কানে পৌঁছল, তিনি বোধ করি আজ অনেক দিন পরে বুকভরে আবার নিঃশ্বাস নিলেন। ঘাম দিয়ে বুঝি জ্বর ছাড়ল।