১.০৩ রায়পুর হত্যা-মামলা

গত ৩১শে মে

রায়পুর হত্যা-মামলা।

অতীতের কয়েকটি পৃষ্ঠা। যেখানে এই হত্যা-রহস্যের বীজ অন্যের অলক্ষ্যে দানা বেঁধে উঠেছিল একটু একটু করে। অথচ কেউ বুঝতে পারেনি। কেউ জানতে পারেনি সেদিন।

সে-সময়টা মে মাসের শেষের দিকটা। কলকাতা শহরে সেবার গ্রীষ্মের প্রকোপটা যেন একটু বেশীই। গ্রীষ্মের নিদারুণ তাপে শহর যেন ঝলসে যাচ্ছে।

গ্রীষ্মের ছুটিতে কলেজ বন্ধ হওয়া সত্ত্বেও আজ পর্যন্ত নানা কারণে সুহাসদের রায়পুরে। যাওয়া হয়ে ওঠেনি। ব্যবস্থা সব হয়ে গেছে; আজ সন্ধ্যার পরে যে গাড়ি তাতেই সকলের রায়পুর রওনা হবার কথা।

সুধীন আজ সকাল হতেই সুহাসকে তার সব জিনিসপত্র গোছগাছ করতে সাহায্য করছে।

অতীতের সেই বিষাক্ত স্মৃতি, সুহাসের সংস্পর্শে এসে সুধীনের কাছে কেবলমাত্র স্মৃতিতেই আজ পর্যবসিত হয়েছে।

সুধীন মনে মনে জানে মল্লিক-বাড়ির সঙ্গে এতটা ঘনিষ্ঠতা মা আদপেই পছন্দ করবেন। হয়ত বা কেন, নিশ্চয়ই মা তার এই মল্লিক-বাড়ির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার কথা শুনলে বিশেষ রকম অসন্তুষ্টই হবেন। মুখে তিনি কাউকেই কিছু কোনোদিন বলেন না বটে। তাও সে ভাল করেই জানে।

সেই ছোটবেলা থেকেই সুধীন মাকে দেখে আসছে তো! সুধীন বা অন্য কারও যে কাজটা বা ব্যবহার মার মতের বিরুদ্ধে হয়, মা কখনও তার প্রতিবাদ করেন না। এমন কি একটিবারও সে সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন পর্যন্ত করেন না, কেন এমনটি হল? শুধু নির্বাক কঠিন দৃষ্টি তুলে একটিবার মাত্র অপরাধীর দিকে তাকান।

পলকহীন মৌন সেই দৃষ্টি হতে যেন একটা চাপা অগ্নির আভাস বিচ্ছুরিত হতে থাকে। কিছুক্ষণ ঐরকম কঠিন ভাবে তাকিয়ে থেকে দৃষ্টি নামিয়ে নেন। কিন্তু তারপর প্রতি কাজের মধ্যে, প্রতিটি মুহূর্তে, সেই মৌন কঠিন দৃষ্টি যেন সর্বদা সঙ্গে সঙ্গে অনুসরণ করে ফেরে।

একটা অস্বোয়াস্তি যেন নিরন্তর মনের মধ্যে কাঁটার মত খচ খচ করে বিঁধতে থাকে। এর চাইতে মা যদি কঠিন ভৎসনা করতেন, তাও বুঝি সহস্রগুণে ছিল ভাল।

পিতাকে তো সুধীনের মনে পড়েই না, এবং মনে থাকবার কথাও নয়, কারণ যে বয়সে সুধীনের পিতা নিহত হন অদৃশ্য আততায়ীর হাতে, তখন সে শিশুই।

শিশুকালের সেই স্মৃতি মনের কোণে কোনো রেখাপাতই করতে পারেনি। তবে ছোটবেলায়ও অনেকের মুখেই শুনেছে একটা দীর্ঘ ঋজু দেহ, অথচ বলিষ্ঠ, গোরাদের গায়ের মত টকে গৌরবর্ণ গায়ের রং। মাথার চুলগুলো কদমছাঁটে ছাঁটা, অত্যন্ত স্বল্পভাষী। পিতার কথা ও মার মুখ থেকে শুনেছিল, তাও মাত্র একটিবার। সেই শেষ এবং প্রথম। মনে হয়েছে সে বিষাদ-স্মৃতি মা যেন চিরটা কাল ইচ্ছে করেই সুধীনের কাছ থেকে লুকিয়ে গেছেন। কখনও আর জীবনে কোনো কারণে সে দুর্বলতা প্রকাশ হয়নি।

সেবারে সে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়েছে। কোনো দিনই জীবনে ও সেই দিনটির কথা ভুলবে না।

ছুটিতে গ্রামে মামার বাড়ীতে এসেছে ও। ওর বেশ স্পষ্টই মনে পড়ে, ওর বাবার মৃত্যুতিথি সেদিন। মা চিরদিনই ঐ দিনটায় নিরন্থ উপবাস করেন।

রাত্রি তখন বোধ করি দশটা হবে। বাইরে ঝম ঝম করে বৃষ্টি পড়ছে।

ঘরের পিছনের আমগাছটা হাওয়ায় ওলটপালট হচ্ছে, মাঝে মাঝে ঘরের টিনের চালের ওপরে আমগাছের ডালপালাগুলো আছড়ে আছড়ে পড়ছে—তারই অদ্ভুত শব্দ। বৃষ্টির ধারা। অবিশ্রাম টিনের চালের ওপরে চটুপ করে শব্দ তুলছে।

ও খাটের ওপর শুয়ে মোমবাতির আলোয় কি একখানা বই পড়ছিল। কখন এক সময় নিঃশব্দ পায়ে এসে মা ওর শয্যার পাশটিতে দাঁড়িয়েছেন, ও তা টেরও পায়নি। মা চিরদিন এত নিঃশব্দে চলাফেরা করেন, পাশ দিয়ে হেঁটে গেলেও বোঝবার উপায় নেই।

মার ডাকে ও মুখ তুলে তাকায়, সুধা! ওর মুখের দিকেই মা তাকিয়ে আছেন।

করুণ ছায়ার মতই যেন মাকে ওর মনে হয়।

ঈষৎ মলিন একখানি থানকাপড় পরা, মাথার ঘোমটা খসে পড়েছে কাঁধের ওপরে।

রুক্ষ তৈলহীন চুলের গোছা কাঁধের দু-পাশ দিয়ে এসেছে নেমে গুচ্ছে গুচ্ছে।

সারাদিন উপবাসে মুখখানা শুকিয়ে যেন ছোট ও মলিন হয়ে গেছে বাসী ফুলের মত।

মোমবাতির নরম আলো মার নিরাভরণা ডান হাতখানির ওপরে এসে পড়ছে। এত করুণ ও বিষণ্ণ লাগছিল সেই মুহূর্তটিতে—তাড়াতাড়ি বইটি একপাশে রেখে শয্যার ওপরে সুধীন উঠে বসে, কিছু বলছিলে?

মা একবার পাশটিতে এসে বসলেন, এখনও ঘুমোসনি?

একটা বই পড়ছিলাম মা।

একটা কথা তুই অনেকদিন আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিস বাবা, কিন্তু জবাব দিইনি, আজ তোকে সেই কথাটা বলব।

মা চুপ করে যান। যেন কিছুটা সংকোচ তখনও অবশিষ্ট আছে মনের কোণায় কোথাও মার।

কি কথা মা? সুধীনের বুকের ভিতরটা যেন অকারণ একটা ভয়ে অকস্মাৎ টিপ্ টিপ করে কেঁপে ওঠে। মার আজকের এ চেহারার সঙ্গে ও পরিচিত নয় যেন।

তোমার বাবার কথা। মা ক্ষীণ অথচ সুস্পষ্ট স্বরে বলেন।

বাইরে একটা বাদল রাত্রির অশান্ত হাহাকার ক্রমেই বেড়ে ওঠে।

একটা বন্দী দৈত্য যেন হঠাৎ ছাড়া পেয়ে হুঙ্কার দিয়ে ফিরছে দিকে দিকে।…তারই ভয়াবহ তাণ্ডব উল্লাস!

সুধীন মোমবাতিটার দিকে তাকিয়ে আছে, বন্ধ দরজার মধ্যবর্তী সামান্য ফাঁক দিয়ে বাইরের ঝোড়ো হাওয়া এসে মাঝে মাঝে মোমবাতির শিখাটাকে ঈষৎ কাঁপিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। মার মুখের ওপরে ডান দিকটায় মোমবাতির মৃদু আলোর সামান্য আভাস। মা বলতে লাগলেন। সেই করুণ হৃদয়দ্রাবী কাহিনী, আজও সে দিনটার কথা আমি ভুলতে পারিনি সুধী। তারও আগের রাত্রে এমনি ঝড়বৃষ্টি হচ্ছিল। কিসের যেন একটা অস্বোয়াস্তিতে সারাটা রাত আমি ঘুমোতে পারলাম না। যতবার দু চোখের পাতা বোজাই, একটা না একটা বিশ্রী দুঃস্বপ্ন দেখে তন্দ্রা ছুটে যায়। ভোরবেলাতেই শয্যা ছেড়ে উঠলাম, সারাটা রাত্রি ঘুমোতে পারিনি, শরীরটা বড় ক্লান্ত। বেলা দশটার সময় তোমার বাবার রক্তাক্ত, প্রায় দ্বিখণ্ডিত ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহখানি নিয়ে এসে রাজবাড়ির সান-বাঁধানো উঠোনের ওপরে নামাল বাহকেরা। একটা সাদা রক্তমাখা চাদরে দেহটি ঢাকা আগাগোড়া। তোমার দাদামশাই রাজা রসময় মল্লিক বারান্দার ওপরে দাঁড়িয়েছিলেন; তাঁরই নীরব আদেশে কে একজন যেন এগিয়ে গিয়ে মৃতদেহের ওপর থেকে চাদরটা সরিয়ে নিলে। সে রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত দেহ ও প্রায় দেহচ্যুত ক্ষতবিক্ষত মস্তকটি দেখে তোমার পিতা বলে আর তাঁকে চেনবারও তখন উপায় ছিল না। আমি চিৎকার করে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলাম। তিনদিন পরে যখন জ্ঞান হল, চেয়ে দেখি তুই তোর মামার কোলে বসে, আমাকে ঠেলা দিয়ে ডাকছিস মা মা বলে।

মা চুপ করলেন, চোখের কোলে সুস্পষ্ট অশ্রুর আভাস—মোমবাতির আলোয় চিকচি করছে।

বাইরে তেমনি বৃষ্টির শব্দ, দৈত্যটা তেমনি হুঙ্কার দিয়ে ফিরছে একটানা।

ইতিমধ্যে মোমবাতিটা ক্ষয়ে ক্ষয়ে প্রায় তলায় এসে পৌঁছেছে।

।ঘরের ভিতরে মৃত্যুর মত একটা অস্বাভাবিক স্তব্ধতা। বুকের ভিতরটা যেন কেমন খালি খালি মনে হয়।

মা আবার বলতে লাগলেন, তার পরদিনই, এইটুকু তোকে বুকে করে চলে এলাম দাদার আশ্রয়ে। কিন্তু মনে আমার শান্তি মিলল কই? কতদিন ঘুমের ঘোরে দেখেছি, তাঁর অতৃপ্ত দেহহীন আত্মা যেন আমার চারিদিকে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমি জানি এর মধ্যে কোথাও একটা কূটচক্রীর চক্রান্ত আছে। ভুলিনি আমি কিছুই। সেদিন হতেই বুকের মধ্যে দিবারাত্র জ্বলছে তুষের আগুন। আর এও জানি, চিতায় না শোয়া পর্যন্ত এ আগুন কোনো দিন আর নিভবে না।

তোকে আমি ঠিক বোঝাতে পারব না বাবা, সে ব্যথা যে কত বড় দুঃসহ ও মর্মান্তিক! এতদিন তোকে আমি এ-কথা বলিনি, কেবল নিজের বুকের মধ্যে চেপে চেপে গুমরে মরেছি, কিন্তু এখন তুই বড় হয়েছিস বাবা, এ কথা হয়ত তুই কানাঘুষায় শুনেছিসও, কিন্তু বু আমাকে প্রশ্ন করিসনি। আর তোর কাছ থেকে চেপে রাখা উচিত নয় বলেই আজ তোকে সবই বললাম, যারা এতবড় মর্মান্তিক অভিশাপ আমার ওপরে তুলে দিয়েছে তাদের যেন তুই ক্ষমা করিস না।

মা চুপ করলেন। এরপর সেরাত্রে মা ও ছেলে কেউই ঘুমোতে পারেনি। কারও চোখের পাতাতেই ঘুম আসেনি। ঐ মাত্র একটি দিনই মার মুখে সুধীন শুনেছিল বাবার কথা,আর কোনোদিনই শোনেনি।

সেই ঝড়জলের রাত্রি ছাড়া আজ পর্যন্ত ও সম্পর্কে মা আর ওকে কোনো কথাই বলেননি। এবং সেদিন মার ঐ কাহিনীর মধ্য দিয়েই সুধীন বুঝেছিল, মল্লিক-বাড়ির প্রতি কী অবিমিশ্র। ঘৃণা ও ক্রোধ আজও তার মার সমগ্র বুকখানাকে ভরে রেখেছে!…

নিষ্ফল আক্রোশে অহনিশি মার মনে কী দুবার দ্বন্দ্ব! এবং সেইদিন থেকে সে নিজেও মল্লিক-বাড়ির যাবতীয় স্পর্শকে বাঁচিয়ে এসেছে কতকটা ইচ্ছে করেই যেন এবং মনের মধ্যে বরাবর পোষণ করে এসেছে একটা তীব্র ঘৃণা। অলক্ষ্যে বসে বিধাতা হয়ত হেসেছিলেন, তাই পিতার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে মাতুলগোষ্ঠীর যে যোগসূত্রটা চিরদিনের মত ছিন্ন হয়ে গেছে বলে মনে হয়েছিল, সেই ছিন্নসূত্র ধরে দীর্ঘদিন পরে টান পড়ল সামান্য ঘটনাকে কেন্দ্র করে। ব্যাপারটা ঘটেছিল সুধীনেরই ফোর্থ ইয়ারে মেডিকেল কলেজে পড়বার সময়। একদিন রাত্রে আউটডোরে সুধীন যখন ডিউটি দিতে ব্যস্ত এমন সময় খেলার মাঠ থেকে মাথায় পট্টি বেঁধে সুহাস আউটডোরে এল।

রুগ্ন লম্বা ধরনের ছেলেটি। কৈশোরের সীমা পেরিয়ে সবে তখন যৌবনে পা দিয়েছে সে। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ গায়ের রং, বাঁশীর মত টিকালো নাসা, ফোঁটা ফুলের মতই সুন্দর ঢলঢল মুখখানি। ঠোঁটের ওপরে সবে গোঁফের রেখা দেখা দিয়েছে। দেখলেই যেন মনে জাগে একটা স্নেহের আকর্ষণ।

খেলার মাঠে বিপক্ষ দলের সঙ্গে মতানৈক্য হওয়ায় ক্রমে বচসা হতে হতে হাতাহাতি ও মারামারিতে পরিণত হয়। ডানদিককার কপালে প্রায় দুই ইঞ্চি পরিমাণ একটি ক্ষত-চিহ্ন।

বাড়িতে মার কাছে বকুনি খাওয়ার ভয়ে সুহাস গাড়ি নিয়ে সোজা ময়দান থেকে একেবারে মেডিকেল কলেজে চলে এসেছে ড্রেসিং করাতে।

সুধীন গোটাতিনেক স্টি দিয়ে পট্টি বেঁধে দিল।

এবং সেই সূত্রে ইমার্জেন্সি রুমেই দুজনের মধ্যে প্রথম আলাপের সূত্রপাত হল। ক্রমে সেই সামান্য আলাপকে কেন্দ্র করে গভীর হয়ে উঠতে লাগল পরস্পরের সৌহার্দ্য। এত মিশুঁকে সুহাস যে দু-চার দিনেই সুধীনকৈ আপন করে নিতে তার কোনো কষ্টই হয়নি। এবং সবচাইতে মজা এই যে, তখনও কিন্তু সুধীন সুহাসের আসল পরিচয়টুকু জানতে পারেনি।

ক্রমে আরও দেখা-সাক্ষাৎ আলাপ-আলোচনার ভিতর দিয়ে দুজনের মধ্যে যখন একটা বেশ মিষ্ট ঘনিষ্ঠতা জমে উঠেছে, সেই সর্বপ্রথম সুধীন হঠাৎ একদিন কথাবার্তার মধ্য দিয়ে জানতে পারল সুহাসের আসল ও সত্যকারের পরিচয়টা কি। এবং সুহাস যে তাদের চিরশত্রু রায়পুরের রাজবাড়িরই ছোট কুমার এ-কথাটা ভাবতে গিয়ে অকস্মাৎ সেদিন কেন যেন বুকের ভিতর তার হঠাৎ কেঁপে উঠল।

এবং সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে গিয়েছিল সেদিন সুধীনের মার মুখে এক ঝড়-জলের রাত্রে শোনা সেই অভিশপ্ত কাহিনী।

মৃদু মোমবাতির আলোয় মার সেই অদ্ভুত শান্ত কঠিন মুখখানা আজও যেন ঠিক বুকের মাঝখানটিতে একেবারে দাগ কেটে বসে আছে। স্পষ্ট করে কোনো কথা না বললেও মা যে ঠিক সেরাত্রে অতীতের সেই একান্ত পীড়াদায়ক কাহিনী শুনিয়ে ছেলেকে কি বলতে চেয়েছিলেন, সুধীন তার জবাবে কোনো কিছু না বললেও মার কথার মর্মার্থটুকু বুঝতে তার কষ্ট হয়নি।

কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি, ঘটনা যতই মর্মপীড়াদায়ক ও মর্মন্তুদ হোক না কেন, ঘটনার সঙ্গে তার কোনো সংবই ছিল না, এবং ঘটনাকে উপলব্ধি করবার মত তার সেদিন বয়সও ছিল না। সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে মনের মধ্যে কোনো প্রতিহিংসার স্পৃহাই যেন সুধীনের কোনো দিন জাগেনি। যে পিতাকে সে জানবার বা বোঝবার কোনো অবকাশই জীবনে পায়নি, যার স্মৃতিমাত্রও তার মনের মধ্যে কোনো দিন দানা বেঁধে উঠতে পারেনি, তার হত্যা-ব্যাপারে নিছক একবারে কর্তব্যের খাতিরে নিজেকে প্রতিহিংসাপরায়ণ করে তুলতে কোথাও যেন তার রুচি ও বিচারে বরাবরই বেধেছে। তাই সুহাসের সঙ্গে ভাল করে ঘনিষ্ঠতার পর যেদিন প্রথম সে সুহাসের সত্যিকারের আসল পরিচয়টুকু জানতে পারলে সে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়েই পড়েছিল।

এবং একান্তভাবে মার কথা ভেবেই সে তারপর আপ্রাণ চেষ্টা করে সুহাসকে এড়িয়ে চলবার জন্যে।

কিন্তু মুশকিল বাধল তার সরলপ্রাণ মিশুঁকে সুহাসকে নিয়েই, কারণ সুহাস ঐ ব্যপারের বিন্দুবিসর্গও জানত না। তাই সুধীন তাকে এড়িয়ে চলতে চাইলেও সুহাস তাকে এড়িয়ে যেতে দিত না, সে পূর্বের মতই যখন তখন সুধীনের বাসায় এসে হাসি গল্পে আলোচনায় সুধীনকে ব্যস্ত করে তুলতে লাগল দিনের পর দিন এবং বন্ধুত্ব ও আলাপের জেরটা টেনে সুদৃঢ় করে তুলল যেন আরও।

সুধীনের সকল চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়।

ঘনিষ্ঠতা দুজনের মধ্যে ক্রমেই বেড়ে ওঠে, এমন কি দু-তিনবার সুধীন মার অজ্ঞাতেই রায়পুর গেল।

প্রথমটায় সে অনেকবার চেষ্টা করেছে মার কাছে সব খুলে বলবার জন্য কিন্তু যখনই সেই বিস্মৃত কাহিনী ও সেরাত্রের মার মুখের সেই কঠিন ভাব মনে পড়েছে, ও সংকুচিত হয়ে পিছিয়ে এসেছে।

মার কাছে আর কোনো দিন বলাই হল না।

***

সেদিন আসন্নবর্তী রায়পুর যাত্রার জন্য আবশ্যকীয় জিনিসপত্র গোছাতে গোছাতে সুধীন ও সুহাসের মধ্যে কথাবার্তা হচ্ছিল।

সুহাস বলছিল,আজ আর তোমাকে আমি ছাড়ছি না সুধীদা। আজ সন্ধ্যার পরে একেবারে আমাকে ট্রেনে তুলে দিয়ে তবে কিন্তু তোমার ছুটি।

কিন্তু আমার হাতে যে ভাই দুটো কে আছে, দুপুরে একবার রোগী দুটি দেখে আসতেই হবে।

বেশ, ড্রাইভারকে বলে দেব, আমার গাড়ি নিয়ে রোগী দেখেই আবার চলে আসবে এখানে, দুজনে একসঙ্গে আজ দুপুরে খাব। আবদার করে সুহাস বলে।

সুধীন হাসতে হাসতে জবাব দেয়,বেশ, তাই হবে।

সন্ধ্যার ঠিক একটু পরেই সকলে স্টেশনে এসে পৌঁছল। গাড়ি ছাড়বে রাত আটটায়।

সঙ্গে সুহাসের মা মালতী দেবী, সুহাসের দাদা সুবিনয়, সুবিনয়ের একমাত্র ছেলে প্রশান্ত, স্টেটের ম্যানেজার সতীনাথবাবু, এঁরাও সকলেই চলেছেন রায়পুর।

স্টেশনে অসম্ভব ভিড়। সুহাসের পাশে পাশেই চলেছে সুধীন।

ফার্স্ট ক্লাস কুপে একটা রিজাত করা হয়েছে।

সুহাসের মা মালতী দেবী একবার বলেছিলেন, আজ অমাবস্যা, আজ রওনা না হলেই হত।

হ্যাঁ! তোমাদের মেয়েদের যেমন! আজ অমাবস্যা, কাল দিকশূল, পরশু অশ্লেষা! যত সব! এত করলে বাড়ির বার হওয়াই দায়রাগত স্বরে সুবিনয়বাবু প্রতিবাদ করেন।

কি জানি, মনটা যেন খুঁতখুঁত করছে। সেবারে এরকম অদিনে গিয়েই সুহাসের টিটেনাস হল। মালতী দেবী মৃদু স্বরে বলেন। জ্যেষ্ঠ পুত্রের কোনো কাজে প্রতিবাদ জানাতেও তাঁর ভয় করে।

স্টেশনের গেট দিয়ে ঢোকবার সময় আগে সুহাস, তার ডানদিকে সুধীন, পিছনে সুবিনয়বাবু,—বিশ্রী রকম ভিড়, ঠেলাঠেলি চলেছে, সুহাস কোনোমতে গেট দিয়ে প্ল্যাটফরমে ঢুকতে যাবে, পাশ থেকে একটি কালো মোটা গোছের লোক, বগলে একটা নতুন ছাতা, একপ্রকার সুহাসকে ধাক্কা দিয়েই যেন প্ল্যাটফরমে ঢুকে গেল! এবং কতকটা সঙ্গে সঙ্গে সেই ছাতাওয়ালা লোকটার ধাক্কা খেয়ে উঃ করে অর্ধস্ফুট যন্ত্রণাকাতর একটা শব্দ করে ওঠে সুহাস।

কি হল? সুধীন ব্যথভাবে প্রশ্ন করে সুহাসকে।

সুহাস ততক্ষণে কোনোমতে ধাক্কা খেয়ে প্ল্যাটফরমের মধ্যে এসে ঢুকেছে, তার সঙ্গে সঙ্গে সুধীন ও সুবিনয়। সুবিনয়ও এগিয়ে আসে, কি হল!

ডান হাতের উপরে কি যেন ছুঁচের মত একটা ফুটল। উঃ—এখনও জ্বালা করছে! লংক্লথের পাঞ্জাবির উপরেই সুহাস ব্যথার জায়গাটিতে কতকটা অজ্ঞাতসারেই যেন নিজে নিজে হাত বোলায়।

দেখি!… সুবিনয় সুহাসের পাঞ্জাবির হাতাটা তুলে ব্যথার জায়গাটা বেশ করে টিপে টিপে মালিশ করে দিতে দিতে বলে, কিছু না। বোধ হয় কিছুতে খোঁচা লেগেছে। ও এখুনি ঠিক হয়ে যাবেখন, একটু সাবধান হয়ে চলতে ফিরতে হয়—তোমরা যেমন ব্যস্তবাগীশ!

জায়গাটা কিন্তু অসম্ভব জ্বালা করছে! মৃদুস্বরে পুনরায় কথাটা বলতে বলতে সুহাস আবার জায়গাটায় হাত বোলাতে থাকে।

এরপর সকলে নির্দিষ্ট কামরায় এসে উঠে বসে।

কথায় কথায় তখনকার মত আপাততঃ সমস্ত ব্যাপারটা একসময় চাপা পড়ে যায়।

সুধীন ট্রেনের কামরার বাইরে জানালার উপরে হাত রেখে সুহাসের সঙ্গে তখন মৃদুস্বরে কথাবার্তা বলছিল।

গাড়ি ছাড়বার আর মাত্র মিনিট দশেক বাকি আছে।

 প্রথম ঘণ্টা পড়ল।

হাতটা এখনও জ্বালা করছে সুধীদা! মৃদস্বরে সুহাস বলে।

কই দেখি? সুধীনের প্রশ্নে সুহাস পাঞ্জাবির হাতাটা তুলে জায়গাটা দেখাল এতক্ষণে।

ট্রাইসেপ্স মাস্‌লের উপর একটা ছোট্ট রক্তবিন্দু। খানিকটা জায়গা লাল হয়ে সামান্য একটু ফুলে উঠেছে, তখন সুধীন দেখতে পায়।

সুধীন বললে, একটু আয়োডিন দিতে পারলে ভাল হত। যাক্ গে— কিছুই হয়ত করতে হবে না। কালই হয়তো সেরে যাবে।

কি করে যে কি হল ঠিক যেন বুঝতে পারলাম না। তাড়াতাড়িতে মনে হল যেন কি একটা ছুঁচের মত বিধেই আবার বের হয়ে গেল—সুহাস মৃদু ক্লিষ্ট স্বরে বললে।

সুহাসের ঠিক পাশেই মালতী দেবী বসে, মুখখানা তাঁর বেশ গম্ভীর। মৃদু স্বরে তিনি বললেন, অমাবস্যা, তখনই বলেছিলাম। আজ না বের হলেই হত। কিন্তু তোদর সব আজকালকার সাহেবীয়ানা।…এখন ভালয় ভালয় পৌঁছতে পারলে বাঁচি।

ট্রেন ছাড়বার শেষ ঘণ্টা পড়ে।

যতক্ষণ গাড়ির জানলাপথে দেখা যায়, সুহাস তাকিয়ে থাকে, সুধীনও প্লাটফরমের ওপরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রুমালটা ওড়াতে থাকে।

ক্রমে একসময় চলমান গাড়ির পশ্চাতের লাল আলোটা অন্ধকারের মধ্যে হারিয়ে যায়।

সুধীন গেটের দিকে অগ্রসর হয়।