০৭. প্রজা আন্দোলনের শক্তি বৃদ্ধি

প্রজা আন্দোলনের শক্তি বৃদ্ধি
সাতই অধ্যায়

১. সমিতিতে অন্তর্বিরোধ

কেন্দ্রীয় আইন পরিষদের এই দিনে প্রজা সমিতির প্রেসিডেন্ট সার আবদুর রহিম কলিকাতা হইতে নির্বাচিত হন। ১৯৩৫ সালে জিন্না সাহেবের ইণ্ডিপেন্টে পার্টির সমর্থনে তিনি কংগ্রেসী প্রার্থী মিঃ শেরওয়ানীকে পরাজিত করিয়া আইন পরিষদের প্রেসিডেন্ট (স্পিকার) নির্বাচিত হন। এই নির্বাচনের পরে তিনি কলিকাতা ফিরিয়া প্রজা সমিতির ওয়ার্কিং কমিটির সভা ডাকিয়া বলেন যে আইন পরিষদের শিকার হওয়ায় প্রচলিত নিয়ম অনুসারে তিনি আর প্রজা সমিতির প্রেসিডেন্ট থাকিতে পারেন না। তাঁর জায়গায় অন্য লোককে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য তিনি আমাদের নির্দেশ দেন।

সার আবদুর রহিমের স্থলবর্তী নির্বাচন করা খুব কঠিন ছিল। তিনি ছিলেন সকল দলের আস্থাভাজন। তক্কালে প্রজা সমিতি বাংলার মুসলমানদের একরূপ সর্বদলীয় প্রতিষ্ঠান নি। কংগ্রেসী-অকংগ্রেসী, সরকার-ঘেষা, সরকার-বিরোধী, সকল দলের মুসলমান রাজনৈতিক নেতা-কর্মীর সমাবেশ ছিল এই প্রজা সমিতিতেই। এ অবস্থায় সার আবদুর রহিমের স্থলবর্তী নির্বাচনে ওয়ার্কিং কমিটির মধ্যে অতি সহজেই দুই দল হইয়া গেল। প্রজা সমিতির সেক্রেটারি মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁর নেতৃত্বে প্রবীণ, প্রজা নেতাদের একদল খান বাহাদুর আবদুল মোমিন সি, আই. ই.-কে সমিতির প্রেসিডেন্ট করিতে চাহিলেন। অপরদিকে আমরা তরুণরা জনাব মৌঃ এ. কে. ফযলুল হক সাহেবকে সভাপতি করিতে সহিলাম। প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হইয়া গেল। কিন্তু প্রার্থীদ্বয়ের মধ্যে নয়– তীদের সমর্থকদের মধ্যে। ধুম ক্যানভাসিং শুরু হইল। সাধারণভাবে তরুণ দল, তথাকথিত প্রগতিবাদী দল, কংগ্রেসী ও কংগ্রেস সমর্থক দল হক সাহেবের পক্ষে। তেমনি সাধারণভাবে বুড়ার দল, খান সাহেব-খান বাহাদুর সাহেবরা সবাই মোমিন সাহেবের পক্ষে। জয়-পরাজয় অনিশ্চিত। উভয় পক্ষই বুঝিলাম শত্রুপক্ষ দুর্বল নয়। কাজেই শেষ পর্যন্ত উভয় পক্ষই বিদায়ী সভাপতি সার আবদুর রহিমকে সালিশ মানিলাম। সার আবদুর রহিম এই শর্তে সালিশ করিতে রাযী হইলেন। তিনি সিলমোহর করা ইনভেলাপে তাঁর মনোনীত ব্যক্তির নাম লিখিয়া রাখিয়া দিল্লী চলিয়া যাইবেন। সেখান হইতে তাঁর টেলি পাইলে পর আমরা ইনভেলাপ খুলিব এবং তাঁর রায় মানিয়া লইব। উভয় পক্ষই এই শর্তে রাযী হইলাম। কিন্তু সার আবদুর রহিম এর পর যে কয়দিন কলিকাতা থাকিবেন, ততদিন উভয় পক্ষই গোপনে এ-ওর অজ্ঞাতে যার-তার ক্যানডিডেটের পক্ষে সার আবদুর রহিমকে জোর ক্যানভাস করিলাম। সার আবদুর রহিম ছিলেন গম্ভীর প্রকৃতির লোক। বড় একটা হাসিতেন না। তবু আমাদের কার্যকলাপে তিনি মনে-মনে নিশ্চিয়ই হাসিতে ছিলেন। সেটা বুঝিয়াছিলাম পরে।

যথাসময়ে সমিতির সিনিয়র ভাইস-প্রেসিডেন্ট মৌলবী আবদুল করিম সাহেবের ওয়েলেস লি স্কোয়ার বাড়িতে প্রজা সমিতির ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক বসিল। মৌঃ আবদুল করিম সভাপতির আসন গ্রহণ করিলেন। প্রকাশ্য সভায় কন্টাকদারের টেণ্ডার খুলিবার মত সমস্ত ফর্মালিটি সহকারে সার আবদুর রহিমের রোয়েদাদনামার সিলমোহর-করা ইনভেলাপ খোলা হইল। আমাদের সমস্ত আশা-ভরসা ও ধারণা-বিশ্বাস ধুলিসাৎ হইয়া গেল। সার আবদুর রহিম খান বাহাদুর মোমিন সাহেবকেই সভাপতি মনোনীত করিয়াছেন। মওলানা আকরাম খাঁ সাহেবের দল বিজয়োল্লাস হর্ষধ্বনি করিয়া উঠিলেন। আমরা নিরাশ স্তম্ভিত ও অবশেষে ক্রুদ্ধ হইলাম। সভাপতি মৌলবী আবদুল করিম তাঁর স্বভাবসুলভ শান্ত ও ধীরভাবে আমাদের রোয়েদাদ মানিয়া লইবার উপদেশ দিলেন, যদিও আমরা জানিতাম তিনি ব্যক্তিগতভাবে হক সাহেবের সমর্থক ছিলেন। . কিন্তু আমরা বিশ্বাস ভংগ করিলাম। উভয় পক্ষের মানিত সালিশের রোয়েদাদ মানিলাম না। আমরা সরল আন্তরিকভাবেই বিশ্বাস করিতাম প্রজা আন্দোলনের শক্তি প্রগতি ও সংগ্রামী ভূমিকার খাতিরেই হক সাহেবকে সভাপতি করা দরকার। কিন্তু আমাদের বিশ্বাস যাই থাক না কেন, সালিশ যখন মানিয়াছি তখন সালিশের রোয়েদাদও আমাদের মানা উচিৎ ছিল। রাজনৈতিক সাধুতার খাতিরে তাই ছিল আমাদের অবশ্য বর্তব্য। কিন্তু আমরা তা করিলাম না। বলিতে গেলে এই বিশ্বাসঘাতকতার নেতৃত্ব আমিই করিয়াছিলাম। আমি নূতন করিয়া যুক্তি খাড়া করিলাম: কোন গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানেরই সভাপতির পদ এমনভাবে সালিশির দ্বারা নির্ধারণ করা যায় না। এটা গণতন্ত্রের খেলাফ। সমিতির মেরদিগকে তাঁদের গণতান্ত্রিক অধিকার হইতে বঞ্চিত করার অধিকার কারও নাই। ইত্যাদি ইত্যাদি। অতএব আমরা নির্বাচন দাবি করিলাম।

২. প্রজা সম্মিলনীর ময়মনসিংহ অধিবেশন

ইতিপূর্বেই স্থির হইয়াছিল প্রজা সম্মিলনীর আগামী বার্ষিক অধিবেশন ময়মনসিংহে হইবে। কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের অনুকরণে এটা আগের বছরের সম্মিলনীতেই ঠিক হইয়া থাকিত। আগের বছরের সম্মিলনী হইয়াছিল কুষ্টিয়ায়। আমরা সমিতির সভাপতি নির্বাচন লইয়া যখন ঐরূপ প্রতিদ্বন্দিতা করিতেছিলাম তখন আগামী বার্ষিক সম্মিলনী আমাদের সামনে ছিল। কাজেই সে ব্যাপারেও আমাদের মধ্যে মতভেদ দেখা দিল। মওলানা আকরম খাঁ সাহেবের মতে আগামী সম্মিলনীর সভাপতি হওয়া উচিৎ মোমিন সাহেবের। আমাদের মতে হওয়া উচিৎ হক সাহেবের। এ ব্যাপারেও মওলানা আকরাম খাঁ সাহেবের দলের দাবি অধিকতর ন্যায়সংগত ছিল। গত সম্মিলনীর সভাপতি ছিলেন হক সাহেব। একজনকেই পর পর দুই বছর সম্মিলনীর সভাপতির করা ঠিক হইবে না। আমরা মনে মনে স্বীকার করলাম মওলানা সাহেবের এই যুক্তি সারবান। রাখীও হয়ত হইতাম আমরা। কিন্তু সমিতির প্রেসিডেন্টগিরি লইয়া মতভেদ হওয়ায় আমরা সম্মিলনীর সভাপতিত্ব বিনা শর্তে ছাড়িয়া দিতে সাহস করিলাম না। এ ব্যাপারে মওলানা সাহেবের সহিত কোনও আপোষরফা না হওয়ায় আমি অভ্যর্থনা সমিতির জেনারেল সেক্রেটারি হিসাবে অভ্যর্থনা সমিতির সাধারণ অধিবেশনে হক সাহেবকে সম্মিলনীর সভাপতি নির্বাচন করিলাম এবং সংবাদপত্রে ও হবিলে তা প্রচার করিলাম। মওলানা সাহেব ন্যায়তই ইহার প্রতিবাদ করিলেন। তক্কালে অভ্যর্থনা সমিতির পক্ষে সন্মিলনীর সভাপতি নির্বাচনের প্রথা চালু ছিল বটে কিন্তু কেন্দ্রীয় কোনও প্রতিষ্ঠান না থাকিলেই সেটা করা হইত নিখিল-বংগ প্রজা সমিতির মত প্রতিষ্ঠান থাকায় অভ্যর্থনা সমিতির সে অধিকার ছিল না। তবু জোর করিয়াই আমি তা করিয়া ফেলিলাম।

মওলানা আকরম খাঁ সাহেব গাবতঃই এবং ন্যায়তই আমার উপর কুদ্ধ হইলেন। নিখিল-বংগ প্রজা সমিতির সেক্রেটারি হিসাবে তিনি অন্যায়ভাবে সম্মিলনী অনিদিষ্টকালের জন্য স্থগিত রাখা থোষণা করিলেন। এই মর্মে সমস্ত জিলা ও মহকুমা শাখায় টেলিগ্রাম করিয়া দিলেন। আমি অভ্যর্থনা সমিতির জেনারেল সেক্রেটারি হিসাবে এই বে-আইনী স্থগিত অগ্রাহ্য করিলাম। দলে দলে প্রতিনিধিদের সফিনীতে যোগ দিতে অনুরোধ করিয়া প্রতি জিলায় ও মহকুমায় টেলিগ্রাম করিয়া দিলাম এবং সংবাদপত্রে বিবৃতি দিলাম।

মওলানা সাহেবের বিরুদ্ধতা সত্ত্বেও বিরাট সাফল্যের সঙ্গে তিন দিনব্যাপী সম্মিলনী এবং এক মাসব্যাপী কৃষি-শিল্প-প্রদর্শনী হইল। প্রদর্শনীটা এত জনপ্রিয় হইয়াছিল যে নির্দিষ্ট এক মাস মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পরও আরও পনর দিন মেয়াদ বাড়াইয়া দেওয়াইয়াছিল।

৩. সম্মিলনীর সাফল্যের হেতু

 কেন্দ্রীয় কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধতা সত্ত্বেও ময়মনসিংহ প্রজা-সম্মিলনী সফল হইবার কারণ ছিল। তার প্রথম কারণ এই যে কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধতা যখন শুরু হয় তখন সম্মিলনীর আয়োজনের কাজ সমাপ্ত হইয়া গিয়াছে। দ্বিতীয়তঃ সাধারণভাবে সারা বাংলায় এবং বিশেষভাবে ময়মনসিংহ জিলায় তৎকালে প্রজা-আলোলন জনপ্রিয়তার সর্বোচ্চ শিখরে উঠিয়াছিল। প্রজা-আলোশনের জনপ্রিয়তা ছাড়া সম্মিলনীর অভ্যর্থনা সমিতিরও একটা নিজস্ব ক্ষমতা ও মর্যাদা ছিল। সম্মিলনীর সভাপতি হক সাহেব ও অন্যান্য নিমন্ত্রিত ও সমাগত নেতৃবৃন্দের সকলেরই ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা ছিল। বস্তুতঃ নিখিল বংগ প্রজা সম্মিলনীর ১৯৩৫ সালের ময়মনসিংহ অধিবেশনের মত সাফল্যমণ্ডিত প্রাদেশিক কোনও সম্মিলনী বাংলায় আর হয় নাই, একথা অনেকেই বলিয়াছিলেন। অভ্যর্থনা সমিতিতে যেমন করিয়া সকল দলের ও সকল শ্রেণীর নেতৃ-সমাবেশ হইয়াছিল ময়মনসিংহ জিলায় তেমন আর হয় নাই। এই অভ্যর্থনা সমিতির চেয়ারম্যান ছিলেন বিখ্যাত সাহিত্যিক ও আইনবিদ ডাঃ নরেশ চন্দ্র সেনগুপ্ত। এর তিনজন ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন খান বাহাদুর মৌঃ ইসমাইল, ডাঃ বিপিন বিহারী সেন ও মিঃ সূর্য কুমার সোম এবং জেনারেল সেক্রেটারি ছিলাম আমি। কৃষি-শিল্প-প্রদর্শনী কমিটির সেক্রেটারি ছিলেন মিঃ নুরুল আমিন, প্যাল কমিটির সেক্রেটারি ছিলেন মৌঃ আবদুল মোননম খাঁ, ফাঁইনাল কমিটির সেক্রেটারি ছিলেন মৌঃ মোহাম্মদ ছমেদ আলী, একোমোডেশন কমিটির সেক্রেটারি ছিলেন মৌ তৈয়বুদ্দিন আহমদ, লান্টিয়ার কমিটির সেক্রেটারি ছিলেন মৌঃ গিয়াসুন্দিন পাঠান, লান্টিয়ার কোরের জি.ও. সি. ছিলেন মৌঃ মোয়াধ্যম হুসেন খাঁ। এতদ্ব্যতীত প্রজা সমিতি, কংগ্রেস ও আমন সকল প্রতিষ্ঠানের বিশিষ্ট কর্মীদের অনেকেই এই অভ্যর্থনা সমিতির বিভিন্ন দফতরে দায়িত্বপূর্ণ পদে কাজ করিয়াছিলেন। ফলতঃ একমাত্র জিলা বোর্ডের চেয়ারম্যান খান বাহাদুর শরফুদ্দিন আহমদ সাহেব ছাড়া এ শহরের সকল সম্প্রদায় ও দলের উল্লেখযোগ্য সকল নেতাই এই প্রজা সম্মিলনীতে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করিয়াছিলেন। একযিবিশন কমিটির সেক্রেটারি হিসাবে জনাব নুরুল আমিন এমন অসাধারণ কর্মক্ষমতার পরিচয় দিয়াছিলেন যে তাঁর আয়োজিত প্রদর্শনী দেড় মাস কাল এই শহরকে এমনকি গোটা জিলাকে কর্মচঞ্চল করিয়া রাখিয়াছিল। সরকারী-বেসরকারী বহু প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিগতভাবে বহু শিল্পী কৃষক ও ব্যবসায়ী তাঁদের প্রদর্শনযোগ্য জিনিসপত্র লইয়া এই প্রদর্শনীতে যোগ দিয়াছিলেন। দৈনিক জপ্রতি এক আনা করিয়া প্রবেশ ফি থাকা সত্ত্বেও দেড় মাস ধরিয়া এই প্রদর্শনীতে প্রতিদিন হাজার হাজার লোকের ভিড় হইত। প্যান্ডাল কমিটির সেক্রেটারি হিসাবে মৌঃ আবদুল মোননম খাঁ এমন মৌলিক পরিকল্পনা প্রতিভার পরিচয় দিয়াছিলেন যে তাঁর নির্মিত ও সজ্জিত প্যাণ্ডালের মত সুদৃশ্য সুউচ্চ বিশাল ও মনোরম প্যাণ্ডাল কংগ্রেসেরও কোন প্রাদেশিক সম্মিলনীতেও হয় নাই। সুউচ্চ জোড়া মিনারযুক্ত তিনটি বিশাল তোরণ দিয়া বিরাট প্যাণ্ডলে প্ৰবেশ করিতে হইত। প্যাণ্ডালের উপরে ঠিক মধ্যস্থলে ছিল শতাধিক ফুট উচ্চ এক সুডৌল বিশালকায় গম্বয। সোলালী কাগযে মোড়া এই গুম্বয বহুদূর হইতে দেখা যাইত। মনে হইত সত্যই কোনও সুউচ্চ মসজিদের সোনালী গম্বয। এই গম্বয এতই জনপ্রিয় হইয়াছিল যে সম্মিলনী শেষ হইবার বহুদিন পর পর্যন্ত জনসাধারণের বিরুদ্ধতার দরুন প্যাণ্ডাল ভাংগা যায় নাই। যতদিন প্রদর্শনীর কাজ শেষ না হইয়াছিল, ততদিন প্রদর্শনী গ্রাউণ্ড ও প্যাণ্ডালের সবটুকু যায়গা সারা রাত আলোক-সজ্জিত থাকিত এবং রাত-দিন লোকের ভিড় থাকিত। বস্তুতঃ ময়মনসিংহ শহরের বড় বাজার ও ছোট বাজারের মধ্যবর্তী বর্তমান বিশাল ময়দানটি প্রজা সম্মিলনীর দৌলতেই আবাদ হইয়াছিল।

. মহারাজার বদান্যতা

এর আগে এই জায়গা নালা-ডুবা, বন-জংগল ও ময়লা-আবর্জনার স্তূপ ছিল। দিনের বেলায়ও এই জায়গায় কেউ প্রবেশ করিত না। এখানে প্রবেশ করিবার দৃশ্যতঃ। কোন রাস্তাও ছিল না। সেজন্য এই শহরে কুড়ি বছর বাস করিয়াও এবং এই ময়দানের চার পাশের দোকান-পাটে কুড়ি বছর সওদা করিয়াও অনেকে জানিত না যে এই সব দোকানের পিছনেই একটা বিশাল এলাকা বন-জংগল ও ডুবা-নালায় ভরিয়া আছে। যদিও এখান হইতেই এ শহরের সমস্ত মশার উৎপত্তি হইত বলিয়া মিউনিসিপাল কর্তৃপক্ষ জানিতেন, তবু এটা ভরাট ও পরিষ্কার করিবার অর্থনৈতিক দুঃসাহস কখনও করেন নাই। মিউনিসিপ্যালিটির তৎকালীন চেয়ারম্যান কংগ্রেস নেতা, আমার পরম শ্রদ্ধেয় গুরুজন এবং প্রজা-সম্মিলনীর অভ্যর্থনা সমিতির সহ সভাপতি ডাঃ বিপিন বিহারী সেনের সঙ্গে সম্মিলনীর জন্য উপযুক্ত স্থান নির্বাচনের কথা আলোচনা করি। সার্কিট হাউস ময়দান এ শহরের একমাত্র বড় খোলা স্থান। কিন্তু এটা সরকারী জমি। এখানে কোনও সভা-সম্মিলনী করিতে দেওয়া হয় না। কাজেই পাটগুদাম এলাকাই ছিল বড়-বড় সভা-সম্মিলনী করিবার একমাত্র স্থান। উহাদের মধ্যে একটা সবচেয়ে সুবিধাজনক স্থান নির্বাচনেই ডাঃ সেনের সহায়তা নিতে। ছিলাম। তিনিই এই পরিত্যক্ত বন-বাদাড়ের দিকে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এই উদ্দেশ্যে মহারাজা শশিকাস্তের সঙ্গে দেখা করিলাম। মহারাজা শশিকান্ত উদারমনা রসিক পুরুষ ছিলেন। কিন্তু দুইটা ঘটনায় আমার উপর তাঁর রাগ থাকিবার কথা। একটা বেশ পুরান। প্রায় বছর খানেক আগের ঘটনা। একদিন মহারাজার জমিদারিতে ফুলবাড়িয়া থানার জোরবাড়ি গ্রামে একটা প্রজা-সতা হইবার কথা। আমরা কয়েকজন সভাস্থলে গিয়াছি যোহরের নামাযের শেষ ওয়াকতে বেলা সাড়ে তিনটায়। একটি পতিত জমিতে সভার উদ্যোক্তারা হোট একখানা শামিয়ানা খাটাইবার খুটি খাটা গাড়িতে ছিলেন। অতি অল্প লোকই তখন সভায় আসিয়াছে। এমন সময় অদূরবর্তী জমিদার কাঁচারি হইতে, একজন কর্মচারী দুইজন পুলিশসহ সভাস্থলে আসিয়া আমাদের জানাইলেন, স্থানটি মহারাজার খাস জমির অন্তর্ভুক্ত। ওখানে সভা হইতে দেওয়া হইবে না, এটাই মহারাজার হুকুম। সংগী পুলিশ দুইজন জমিদার কর্মচারির সমর্থন করিল। উদ্যোক্তারা আমার মত চাহিলেন। আমি শামিয়ানার খুটা খাঁটি ও টেবিল-চেয়ার লইয়া তাঁদের নিজস্ব কোনও জমিতে যাইবার নির্দেশ দিলাম। সদ্য-ধান-কাটা একটি নিচু জমিতে সভার স্থান করা হইল। পুলিশ ও জমিদারের বাধাদানের খবরটা বিদ্যুৎবেগে গ্রামময় ছড়াইয়া পড়িল। স্বাভাবিক অবস্থায় যেখানে তৎকালে এই সভায় হাজার-বার শ’র বেশি লোক হইত না, সন্ধ্যার আগেই সেখানে পাঁচ ছয় হাজার লোকের সমাগম হইল। জনতার দাবিতে অনেক রাত-তক সভা চালাইতে হইল। ঐ সভায় বক্তৃতা করিতে গিয়া সেইদিনকার ঐ ঘটনা বর্ণনা করিয়া আমি বলিয়াছিলাম পল্লী গ্রামের পতিত জমিও মহারাজার নিজের এই দাবিতে তিনি আজ একটি মাঠে আপনারা তাঁরই প্রজাসাধারণকে শান্তিপূর্ণ নিয়মতান্ত্রিক একটা সতা করিতে দিলেন না। আমি মহারাজাকে হুঁশিয়ার করিয়া দিতে চাই, এই পন্থায় প্রজা-আন্দোলন রোধ করা যাইবে না। বরঞ্চ এতে প্রজা-আন্দোলন একদিন শক্তিশালী গণ-আন্দোলনে পরিণত হইবে। আমরা জমিদারি উচ্ছেদ করিয়া এ যুলুম একদিন বন্ধ করিবই। মহারাজার লোক কেউ এই সভায় থাকিয়া থাকিলে তিনি তাঁর। কাছে এই কথা পৌঁছাইবেন যে আজ আমরা নিজেদের গ্রামে জমিদারের কাঁচারির নিকটে একটা সভা করিতে পারিলাম না, কিন্তু একদিন আসিবে, যেদিন আমরা মহারাজার রং মহল ‘শশী লজ’কে আমাদের সন্তানদের পাঠশালা বানাইব। কথাটা মহারাজার কানে যথাসময়ে উঠিয়াছিল। তিনি আমার উপর খুব চটিয়াছিলেন।

দ্বিতীয় ঘটনাটি সাম্প্রতিক। অভ্যর্থনা সমিতি গঠন করার সঙ্গে সঙ্গে আমরা চাঁদা আদায়ে শহরে বাহির হইয়াছি। ডাঃ সেন ও সূর্যবাবুর পরামর্শে আমরা হিন্দু বড় লোকদের কাছে চাঁদার জন্য ত যাইতামই, জমিদারদের কাছেও যাইতাম। এ জিলার অন্যতম বড় জমিদার নবাবযাদা হাসান আলী তখনও আনুষ্ঠানিকভাবে প্রজা সমিতিতে যোগ দেন নাই বটে, কিন্তু আমাদের আন্দোলনে তাঁর সমর্থন আছে একথা তখন জানাজানি হইয়া গিয়াছে। কাজেই কখনও ডাঃ সেনকে সঙ্গে লইয়া কোনদিন নিজেরাই জমিদারদের কাছে চাঁদা চাইয়া বেড়াইতে লাগিলাম। এমনি একদিন আমরা অভ্যর্থনা সমিতির লোকজন দল বাঁধিয়া এক জমিদারের কাঁচারি ঘরে ঢুকিলাম। জমিদার বাবু এক পাশে ইবি চেয়ারে হেলান দিয়া হুক্কা টানিতেছেন। অন্যদিকে চার-পাঁচটা চৌকিতে ঢালা ফরাসে কর্মচারিরা কাজ করিতেছেন। জমিদার বাবুর নিকট আমি সুপরিচিত। তাঁর এক পুত্র আমার ক্লাস ফ্রেণ্ড ছিলেন। আরেক পুত্র আমাদের সংসী উকিল। আমাকে দেখিয়াই তিনি সোজা হইয়া বসিলেন এবং দল বাঁধিয়া আসার কারণ জিগগাসা করিলেন। আমি বেশ একটু বিস্তারিতভাবেই আমাদের উদ্দেশ্য বর্ণনা করিলাম এবং প্রসংগক্রমে এই সম্মিলনীর সাথে ডাঃ সেন ও সূর্যবাবুর সম্পর্কের কথা হয়ত একটু অতিরঞ্জিত করিয়াই বলিলাম। তিনি সব কথা শুনিয়া অসংকোচে বলিলেন : হ, চাঁদার জন্য খুব উপযুক্ত পাত্রের কাছেই আসিয়াছ। তোমরা জমিদারের মার্গে বাঁশ দিবে, আর আমরা জমিদাররা সে কাজে চাঁদা দিব?

আমিও এই পিতৃতুল্য ব্যক্তির কথার পৃষ্ঠে অসংকোচে নির্ভয়ে সমান জোরে বলিলাম : জি হাঁ, আলবত দিবেন।

আমার কথার জোর দেখিয়া ভদ্রলোক বিস্ময়ে বলিলেন : কেন দিব? আমি বলিলামঃ তেলের দাম দিবেন।

সদাহাস্যময় ভদ্রলোক ভেবাচেকা খাইয়া গেলেন। ‘তেলের দাম?’ শব্দটা তিনি দুই-তিনবার স্বগত উচ্চারণ করিলেন। অবশেষে খাযাঞ্চি বাবুর দিকে চাহিয়া উচ্চস্বরে বলিলেন : মনসুরকে দশটা টাকা এক্ষণি দিয়া দাও ত। খরচের ঘরে লেখ? তেলের দাম বাবদ প্রজা সমিতিকে। উপস্থিত সকলে স্তম্ভিত নীরব। আমার সহকর্মীরাও। শুধু জমিদার বাবু স্বয়ং তাঁর প্রশস্ত গোঁফের নিচে মুচকি হাসিতেছিলেন। আমার গোঁফ টোফ না থাকায় আমার দন্তবিকাশ সকলের চোখে পড়িতেছিল। কিন্তু আমার সে হাসির অর্থ বোঝা গেল অসাধারণ সাফল্যে। এই ভদ্রলোক জীবনে এক সংগে দশ টাকা চাঁদা আর কোনও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানকে দেন নাই।

যথারীতি রশিদ দিয়া অতিরিক্ত নুইয়া ভদ্রলোককে আদাব দিয়া আমরা বাহির হইয়া আসিলাম। রাস্তায় নামিয়াই সহকর্মীরা আমাকে ধরিলেন : ‘ব্যাপারটা কি? তেলের দাম নিয়া কি ম্যাজিকী কথা বলিলেন, আর অমন কৃপণ ভদ্রলোক দিয়া দিলেন দশটা টাকা?’ জবাবে আমি বন্ধুদের দৃষ্টি ভদ্রলোকের কথিত বাঁশের দিকে আকর্ষণ করিলাম এবং ওকাজে তেল ব্যবহারের উপকারিতা বর্ণনা করিলাম। এতক্ষণে বন্ধুরা রসিকতাটার মর্ম বুঝিতে পারিলেন। হো হো করিয়া রাস্তার মধ্যেই এ-ওর ঘাড়ে পড়িতে লাগিলেন।

রসিকতাটা কড়ুয়া বলিয়াই বোধ হয় শহরের সর্বত্র ছড়াইয়া পড়িয়াছিল। মহারাজার সংগে দেখা করিয়াই বুঝিলাম তাঁর কানেও পৌঁছিয়াছে। আমাকে দেখিয়াই মহারাজা বলিয়া উঠিলেন? কি আমার কাছে তেলের দাম আদায় করতে আসছ নাকি? ডাঃ সেন হো হো করিয়া হাসিয়া উঠিলেন। আমরা দুজনেও উচ্চস্বরে হাসিয়া উঠিলাম। কাজেই আমার জবাব দেওয়ার দরকার হইল না। পরে বুঝিয়াছিলাম কথাটা চাপা দেওয়ার জন্যই ডাঃ সেন অতজোরে হাসিয়াছিলেন। যাহোক, ডাঃ সেনের যুক্তিতে মহারাজা মাতিলেন। পরদিন হইতে অসংখ্য লোক লাগিয়া গেল। বন-বাদাড় নালা-ডুবা আট হইয়া গেল। পাঁচ-ছয় মাস পরে সেখানে অসংখ্য আলোক-মালা সজ্জিত প্যাণ্ডালে-স্টলে হাজার-হাজার লোকের দিনরাত ব্যাপী সমাবেশ হইল।

৫. নবাব ফারুকী ও নলিনী বাবুর সহায়তা

অন্য একটি ঘটনায় ময়মনসিংহ প্রজা সম্মিলনীর অধিবেশনে চাঞ্চল্য এবং দর্শকের সমাবেশে বিস্ময়কর প্রাচুর্য ঘটিয়াছিল। সম্মিলনীর নির্ধারিত তারিখের মাত্র পাঁচ-ছয় দিন আগে বিশ্বস্ত লোকের মারফত খবর পাইলাম, জিলা ম্যাজিস্ট্রেট মিঃ ডাউ প্রজা সম্মিলনীর উপর ১৪৪ ধারা জারির আদেশ দিয়াছেন। নেতৃস্থানীয় আমাদের কয়েকজনের নামে নোটিশ লেখা হইতেছে। দুই-একদিনের মধ্যেই জারি হইবে। সংবাদদাতাদের অবিশ্বাস করিবার বা তাঁদের খবরে সন্দেহ করিবার কোনও কারণ ছিল না। কাজেই বুঝিলাম বিপদ অনিবার্য। কিন্তু নিশ্চিত আসন্ন বিপদে মূষড়াইয়া পড়িলাম না। নিছক উৎপ্রেরণামে কাউকে কিছু না বলিয়া আমি কলিকাতা চলিয়া গেলাম। কৃষিমন্ত্রী অনারেবল নবাব কে. জি, এম. ফারুকীকে প্রজা সম্মিলনী উদ্বোধন করিতে ও শ্রীযুক্ত নলিনী রঞ্জন সরকারকে প্রদর্শনী উদ্বোধন করিতে রাযী করিলাম। এসব করিবার পর হক সাহেব, ডাঃ সেনগুপ্ত, মৌঃ মুজিবুর রহমান প্রভৃতি নেতৃবৃন্দের সহিত দেখা করিলাম এবং সমস্ত অবস্থা বিবৃত করিলাম। একমাত্র মৌঃ মুজিবুর রহমান সাহেব নলিনী বাবু সম্পর্কে কিছুটা আপত্তি করিলেন। সমস্ত অবস্থা শুনিয়া ও বিবেচনা করিয়া শেষ পর্যন্ত তিনিও মন্দের ভাল হিসাবে আমার কাজ অনুমোদন করিলেন।

আমি উদ্বোধনী ভাষণ লিখিয়া দিব এই শর্তে নবাব ফারুকী সম্মিলন উদ্বোধন করিতে রাযী হইয়াছিলেন। অমন বিপদে আমি যে কোনও পরিশ্রমের শর্তে রাযী হইতাম। প্রতিদানে শুধু সেই দিনই জিলা ম্যাজিস্ট্রেটকে টেলিগ্রাম করিয়া তাঁর প্রজা সম্মিলনী উদ্বোধন করার সংবাদটা জানাইয়া দিতে অনুরোধ করিলাম। তিনি তৎক্ষণাৎ তা করিলেন। প্রাইভেট সেক্রেটারির মুসাবিদা করা টেলিগ্রামের শেষে তিনি নিজে হইতে যোগ করিলেন? সম্মিলনী যাতে সাফল্যমণ্ডিত হয় সে দিকে ন্যর রাখুন। আমিও নিশ্চিত হইয়া ফারুকী সাহেবের উদ্বোধনী বক্তৃতা মুসাবিদায় বসিয়া গেলাম। সে রাত্র আমি ফারুকী সাহেবের মেহমান থাকিলাম। অনেক রাত-তক খাঁটিয়া অভিভাষণ লেখা শেষ করিলাম। পরদিন সকালে তাঁকে পড়িয়া শুনাইলাম। তিনি খুশী হইয়া ওটা সেইদিনই ছাপা শেষ করিবার হুকুম দিলেন এবং আমাকে আরেকদিন থাকিয়া যাইতে অনুরোধ করিলেন। আমিও তাঁর অনুরোধ ফেলতে পারিলাম না। রাত্রে খাওয়ার পর তিনি খানা-কামরা হইতে সকলকে বাহির করিয়া দিলেন। দরজা বন্ধু করিলেন। তারপর পকেট হইতে ছাপা ভাষণটি বাহির করিয়া বলিলেন: এটা কিভাবে পড়িতে হইবে আমাকে শিখাইয়া দেন।

আমি তাই করিলাম। অনেক রাত ধরিয়া একাজ চলিল। আমি উচ্চস্বরে নাটকীয় ভংগিতে দুই-একবার পড়িয়া নবাব সাহেবকে ঠিক ঐভাবে পড়িতে বলিলাম। কোথায় হাত নাড়িতে হইবে, কোথায় শুধু ডান হাতের শাহা আংগুল তুলিতে হইবে, কোথায় সুর উদারা মুদারা তারায় উঠানামা করিবে, সব শিখাইলাম। নবাব সাহেব বাংলা পড়ায় খুব অভ্যস্ত ছিলেন না। কিন্তু অসাধারণ তীক্ষ্ণ বুদ্ধি, এডাল্ট করিবার অসামান্য ক্ষমতা ও কাও-জ্ঞান ছিল তাঁর প্রচুর। গলার আওয়াযটিও মিঠা ও বুলন্দ। সুতরাং দুই-তিন ঘন্টার চেষ্টায় তিনি এমন সুন্দর আবৃত্তিও করিলেন যে আমি বিশিত হইলাম। ডিনার টেবিলে দাঁড় করাইয়া রিহার্সাল দেওয়াইলাম। শেষে বলিলামঃ পরীক্ষায় পাশ।

পরদিনই আমি ময়মনসিংহে ফিরিয়া আসিলাম। প্যাণ্ডলে অভ্যর্থনা সমিতির কর্মকর্তাদের সাথে দেখা। সকলের মুখে হাসি। কর্ম-তৎপরতা দ্বিগুণিত। তাঁরা জানাইলেন, আমার আকস্মিক আত্মগোপনে সকলেই ঘাবড়াইয়া গিয়াছিলেন। ১৪৪ ধারার খবরে আকাশ-বাতাস ছাইয়া গিয়াছিল। প্যাণ্ডলে লোকজনের যাতায়াত কমিয়া গিয়াছিল। একদিন সকল কাজ বন্ধ ছিল। কিন্তু পরদিনই জিলা ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট তাঁরা জানিতে পারেন নবাব ফারুকী সম্মিলনী উদ্বোধন করিতে আসিতেছেন। ডি. এম, আরও জানান যে, তিনি সকল প্রকারে সাহায্য করিতে প্রস্তুত আছেন। তখন তাঁরা বুঝিতে পারেন আমি আত্মগোপন করিয়া কোথায় গিয়াছি।

. স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের নির্বাচনে সাফল্য

এইভাবে শত্রুদের মুখে ছাই দিয়া বিপুল সাফল্যের সঙ্গে প্রজা সম্মিলনীর কাজ সমাধা হইল। হক সাহেবের অভিভাষণ, নবাব ফারুকীর উদ্বোধনী ভাষণ, ডাঃ সেনগুপ্তের সারগর্ভ অভ্যর্থনা ভাষণ, শহীদ সুহরাওয়াদী ও মৌঃ শামসুদ্দিন আহমদের বক্তৃতা এবং প্রদর্শনীর উদ্বোধনীতে নলিনী বাবুর ভাষণ সকল দিক দিয়া তথ্যপূর্ণ ও জনপ্রিয় হইয়াছিল। এই সম্মিলনীর ফলে সারা বাংলায় প্রজা-আন্দোলনের জয়যাত্রা শুরু হইল। বিশেষ করিয়া এ জিলার প্রজা-সমিতি একটা বিপুল শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হইল। অবসরপ্রাপ্ত ডিপুটি ম্যাজিস্ট্রেট মোঃ আবদুল মজিদ ও নবাবযাদা সৈয়দ হাসান আলীর অর্থ-সাহায্যে জিলা কৃষক-প্রজা সমিতির ‘মিলন প্রেস’ নামক ছাপাখানা ও ‘চাষী’ নামক সাপ্তাহিক কাগয বাহির হইল।

এই সময় জিলার সর্বত্র লোক্যাল বোর্ড ও জিলাবোর্ডের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। পার্টি হিসাবে প্রজা-সমিতি সমস্ত লোকাল বোর্ডে প্রার্থী খাড়া করে। গোটা জিলার ৭২টি আসনের মধ্যে প্রজা-সমিতি ৬৪টি আসন দখল করে। তৎকালে লোক্যাল বোর্ডের নির্বাচিত সদস্যদের ভোটে জিলা বোর্ডের মেম্বর নির্বাচিত হইতেন। এই নির্বাচনেও প্রজা-সমিতি জয়লাভ করে। জিলা বোর্ড প্রজা-সমিতির হাতে আসে। কিন্তু আমার একটা ভুলে সব ভণ্ডুল হইয়া যায়। জিলা বোর্ডের চেয়ারম্যান কে হইবেন, সেটা ঠিক করিতে বোর্ডের নবনির্বাচিত মেম্বরদের মত নেওয়া আমার উচিৎ ছিল। কিন্তু আমি তা করিলাম না। পার্লামেন্টারী রাজনীতিতে তখন আমার বিন্দুমাত্র অভিজ্ঞতা ছিল না। আমি কংগ্রেসে প্রাপ্ত ডিসিপ্লিন-বোধ হইতে সরলভাবে মনে করিলাম, প্রজা-সমিতির টিকিটে যখন মেম্বাররা নির্বাচিত হইয়াছেন, তখন প্রজা সমিতির নির্দেশই তাঁরা বিনা-আপত্তিতে মানিয়া লইবেন। এটা ছিল আমার নির্বুদ্ধিতা। প্রজা-সমিতি তখন নবজাতশিও। প্রাচীন শক্তিশালী রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানেও অতটা। অন্ধ আনুগত্য আশা করা যাইতে পারে না। তাছাড়া যাঁরা নির্বাচিত হইলেন, তাঁরা নাবালক শিশু নন। জিলা বোর্ড শাসনে কার কি অভিজ্ঞতা আছে ও থাকা দরকার, এটা তাঁরা যেমন জানেন আমি বা প্রজা-সমিতির অনেকেই তা জানেন না। কাজেই চেয়ারম্যানের জন্য তোক বাছাই-এ তাঁদের মতামতের মূল্য খুব বেশি। কিন্তু অনভিজ্ঞতা ও নির্বুদ্ধিতাহেতু আমি তাঁদের জিজ্ঞাসা না করিয়া ওয়াকিং কমিটি দ্বারা এই বাছাই করাইলাম। অবসরপ্রাপ্ত ডিপুটি ম্যাজিস্ট্রেট মৌঃ আবদুল মজিদ সাহেবকে। ওয়ার্কিং কমিটি, চেয়ারম্যানির নমিনেশন দিল। মেম্বররা স্বভাবতঃই অসন্তুষ্ট হইলেন। প্রজা-সমিতির নির্দেশ অমান্য করিয়া নূরুল আমিন সাহেব নিজে প্রার্থী হইলেন ও অধিকাংশের ভোটে নির্বাচিত হইলেন। নির্বাচিত হইবার পর অবশ্য নুরুল আমিন। সাহেব ঘোষণা করিলেন যে তিনি এখনও প্রজা-সমিতির প্রতিনিধি আছেন ও থাকিবেন এবং জিলা বোর্ডে প্রজা-সমিতির নীতি কার্যকরী করিবেন। অনেক দিন তক তিনি করিলেনও তাই। কিন্তু জিলা বোর্ডের চেয়ারম্যান নির্বাচনে জিলা প্ৰজা সমিতির নেতৃত্বে যে ভাংগন ধরিয়াছিল, সেটা আর জোড়া লাগে নাই। তবু প্রজা আন্দোলন তার নিজের জোরেই অগ্রসর হইতেছিল। জিলা বোর্ড লইয়া নেতৃত্বের মধ্যে ঝগড়া হইলেও সাধারণ কর্মীদের মধ্যে তার ছোঁয়া লাগে নাই। অর্থনৈতিক কর্ম পন্থার দরুন ছাত্র সমাজে প্রজা-সমিতির সমর্থক যে দল দ্রুত গড়িয়া উঠিতেছিল, তাদের মধ্যেও বিন্দুমাত্র নিরুৎসাহ দেখা দেয় নাই।

৭. প্রজা-জমিদারে আপোসের অভিনব চেষ্টা

প্রজা আন্দোলনের দুর্নিবার গতি ও অদূর ভবিষ্যতে এর অবশ্যম্ভাবী পরিণতি এই সময় ময়মনসিংহের, তথা সারা বাঙলার জমিদারদের মনে একটা সন্ত্রাস সৃষ্টি করিয়াছিল। প্রমাণস্বরূপ তিনটি মাত্র ঘটনার উল্লেখ করিব? প্রথমতঃ, জমিদার সভার পক্ষ হইতে প্রজা-সমিতির সহিত আপোস-রফা করিবার প্রস্তাব আসে এই সময়। কংগ্রেস নেতা শ্রীযুক্ত সুরেন্দ্র মোহন ঘোষ, এবং জিন্ন সাহেবের ইনডিপেটে পার্টির ডিপুটি লিভার কালীপুরের জমিদার শ্রীযুক্ত ধীরেন্দ্র কান্ত লাহিড়ী এই ব্যাপারে উদ্যোগী হন। মহারাজা শশিকান্তের শশীলজে জিলা প্ৰজা-সমিতি ও জিলা জমিদার সভার নেতৃবৃন্দের মধ্যে প্রাথমিক আলাপ-আলোচনা হয়। খাযনার হার, বকেয়া খানা মাফ, নযরসেলামী ও মাথট-আওয়াব লইয়াও বিস্তারিত আলোচনা হয়। কিন্তু সেটা তেমন উল্লেখযোগ্য নয়। প্রজা আন্দোলনের ইতিহাসের ভুলিয়া-যাওয়া বুদ্বুদ হিসাবে। যার মূল্য আছে, সেটা হইতেছে আমাদের পক্ষ হইতে একটা অভিনব প্রস্তাব। প্রস্তাবটি ছিল এই লক্ষ টাকা বা তদূর্ধ আয়ের সমস্ত জমিদারিকে এক-একটি স্বায়ত্তশাসিত ইউনিটে পরিণত করিতে হইবে। প্রজাসাধারণের ভোটে একটি কাউন্সিল নির্বাচিত হইবে। সেই কাউন্সিল নিজেদের ভোটে একটি মন্ত্রিসভা গঠন করিবে। একটি মন্ত্রিসভাই জমিদারি চালাইবে। জমিদার মন্ত্রিসভার কাজে হস্তক্ষেপ করিতে পারিবেন না। ইংল্যাণ্ডের রাজার মত তিনি নিয়মতান্ত্রিক হেড়-অ-দি-স্টেট থাকিবেন। জমিদারের ব্যক্তিগত খরচের জন্য প্রিতি পার্স রূপে সুনির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা কনস্টিটিউশনে বরাদ্দ থাকিবে। উহা ননভোটেবল থাকিবে; অর্থাৎ কাউন্সিল উহা কমাইতে পারিবে না। এক লক্ষ টাকার মত আয়ের জমিদারিগুলি নিজেরা একত্র হইয়া লক্ষ টাকার উপরে উঠিবে; অথবা পার্শ্ববর্তী বড় জমিদারির শামিল হইবে। প্রস্তাবটি অদ্ভুত ও অভিনব হইলেও জমিদার পক্ষ এক কথায় উহা উড়াইয়া দেন নাই। বরঞ্চ তাঁদের একজন উৎসাহের সংগে উহা বিবেচনা করিতে এবং জমিদার সভার সাধারণ সভায় পেশ করিতে রাযী হইলেন।

কিন্তু একটি কথাতেই শেষ পর্যন্ত এই আলোচনা ভাংগিয়া গেল। সে কথাটি এই যে প্রথম পদক্ষেপ হিসাবে আপোস-রফার শর্তগুলো ময়মনসিংহ জিলাতেই সীমাবদ্ধ থাকিবে। যদি এখানে সফল হয় তবে দ্বিতীয় স্তরে বাংলার অন্যান্য জিলায় তা প্রয়োগ করা হইবে। এটা প্রজা-আন্দোলনে বিভেদ ও ভাংগন আনিবার দুরভিসন্ধি বলিয়া আমরা সন্দেহ করিলাম। তাই এদিকে আর অগ্রসর হইলাম না।

৮. দানবীর রাজা জগৎকশোর

দ্বিতীয় ঘটনা ঘটে রাজা জগৎকিশোরের সঙ্গে। রাজা জগৎকিশোর এ জিলার জমিদারের মধ্যে বয়োজ্যষ্ঠ ছিলেন। তিনি নির্বিলাস, দানশীল ঋষিতুল্য ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর দানে বহু স্কুল-মাদ্রাসা, হাসপাতাল, এমনকি মসজিদ নির্মিত ও পরিচালিত হইয়াছে। প্রজা-আন্দোলনের চরম জনপ্রিয়তার দিনে তিনি আমাকে ডাকিয়া পাঠাইলেন। রাজা জগৎকিশোরকে আমি অন্তর দিয়া ভক্তি করিতাম। ‘বেনিভোলেন্ট মার্কি’কে যাঁরা প্রজাতন্ত্রের চেয়ে উৎকৃষ্ট রাষ্ট্রব্যবস্থা মনে করেন, রাজা জগৎকিশোর তাঁদের জন্য লুফিয়া নিবার মত দৃষ্টান্ত ছিলেন। তিনি নির্বিলাস সন্ন্যাসীর জীবনযাপন করিতেন। দয়ালু বলিয়া তিনি প্রজাদের কাছে সুপরিচিত। ধর্ম ও দাঁতব্য কাজে তাঁর দান মোটা। সুতরাং নিজেকে ধার্মিক পরোপকারী বলিয়া অহংকার করিবার তাঁর অধিকার ছিল। কিন্তু সব সত্যিকার ধার্মিকের মতই তিনি নিরহংকার ছিলেন। তাই বলিয়া কেউ তাঁকে অত্যাচারী যালেম বলিবে এটাও তিনি আশা করিতে পারেন নাই। জীবনে বোধ হয় আমার কাছেই তিনি একথা শুনেন এবং মর্মাহত হন। আমি তাঁর সাথে দেখা করিতে গেলে আগে তিনি আমাকে তাঁর মর্যাদা-মাফিক জলযোগ করাইলেন। কোন প্রকার আত্ম-প্রশংসা না করিয়াও বলিলেন তার সারমর্ম এই : সব জমিদার যেমন ভাল নয়, তেমনি সব জমিদারই খারাপ নয়। দরিদ্র নারায়ণের সেবাই সব ধনী মানুষের কর্তব্য এবং জমিদারদের মধ্যেও এ সম্পর্কে সচেতন সকলে না হইলেও কিছু লোক আছেন, অতএব প্রজা-সমিতি সব জমিদারকে এক কাতারে দাঁড় করাইয়া জমিদারের প্রতি অন্যায় এবং দেশের অনিষ্ট করিতেছে। তাঁর সুরে সুস্পষ্ট আন্তরিকতা ফুটিয়া উঠিল। আমি জবাবে রাজা বাহাদুরকে ব্যক্তিগতভাবে প্রশংসা করিয়া যা বলিলাম তার সারমর্ম এই ও দরিদ্র-নারায়ণের সেবা করা পুণ্য কাজ। এই পুণ্য-কাজ করিয়াই ধার্মিক জমিদাররা স্বর্গে যাইতে পারেন। দরিদ্র-নারায়ণ না থাকিলে সেবা করিবেন কার? কাজেই দেশে দরিদ্র-নারায়ণ থাকা দরকার। যথেষ্ট দরিদ্র না থাকিলে দেদার আর্থিক শোষণের দ্বারা তা সৃষ্ট করা অত্যাবশ্যক। আপনারা তাই করিতেছেন। যেমন ধরুন, রোগীর সুষা পুণ্য কাজ। অথচ চোখের সামনে কোন রোগী না থাকায় আর্তের সেবা-সুষার মত পুণ্য কাজ হইতে আমি বঞ্চিত। আমি পরম ধার্মিক লোক। কাজেই একটা সুস্থ লোকের পিঠে দায়ের আঘাতে একটা ঘা করিলাম। সে ঘায়ে ক্ষার-নুন দিয়া ঘাটা পচাইলাম। নালি হইল। লোকটা শয্যাশায়ী হইল। সে মরে আর কি? আমি তখন তার সেবা-শুশ্রূষা করিতে বসিলাম। দিন-রাত আহার-নিদ্রা ভুলিয়া তার সেবা করিলাম। বলেন কর্তা, আমি স্বর্গ পাইবনা?

রাজা বাহাদুর স্তষ্টিত হইলেন। আমি তথ্য-বৃত্তান্ত দিয়া এই দৃষ্টান্তের সংগে জমিদারি প্রথার হুবহু মিল দেখাইলাম। আশি বৎসরের এই মহানহৃদয় বৃদ্ধের চোখ কপালে উঠিল। তিনি ধরা গলায় মৃদু সুরে বলিতে লাগিলেন : কি বলিলে? আমরা সেবার জন্য দরিদ্র-নারায়ণ সৃষ্টি করিতেছি? সুষা করিয়া পূণ্য লাভের আশায় সুস্থ লোককে আঘাত করিয়া রোগী বানাইতেছি?

এ কথাগুলি আমার নিকট রাজা বাহাদুরের প্রশ্ন ছিল না। এগুলো ছিল তাঁর আত্ম-জিজ্ঞাসা, স্বগত উক্তি। চোখও তীর আমার দিকে ছিল না। তবু আমি এ সুযোগ হেলায় হারাইলাম না। আমি বলিলাম : জি-হাঁ কর্তা, অবস্থা ঠিক তাই।

তিনি আমার কথা শুনিলেন না বোধ হয়। কারণ এ বিষয়ে আর কোন কথা বলিলেন না। স্বগত উক্তি বন্ধ করিয়া তিনি আমার দিকে চাহিয়া বলিলেন : মনসুর, আমার মনটা খুবই খারাপ হইয়া গেল। কিন্তু এ জন্য তোমাদের দোষ দেই না। বরঞ্চ তুমি আমার চোখের সামনে চিন্তার একটা নূতন দিক খুলিয়া দিয়াছ। আজ তুমি যাও, আরেক দিন তোমার সংগে আলোচনা করিব।

আর তিনি আমাকে ডাকেন নাই।

৯. গোলকপুরের জমিদার

তৃতীয় ঘটনাটি ঘটিয়াছিল এরও অনেক পরে ১৯৩৬ সালের ডিসেম্বর কি ১৯৩৭ সালের জানুয়ারি মাসে। ঈশ্বরগঞ্জ থানার জারিয়া হাই স্কুলের খেলার মাঠে নির্বাচনী সভা। তখন আসন্ন সাধারণ নির্বাচন উপলক্ষ করিয়া দেশ তাতিয়া উঠিয়াছে। প্রতিদ্বন্দিতাও আবদুল ওয়াহেদ বোকাইনগরীর মত গরিব প্রজা-কর্মী ও খান বাহাদুর নূরুল আমিনের মত প্রভাবশালী লোকের মধ্যে। কাজেই বিরাট জনতা হইয়াছে। হঠাৎ জনতার মধ্যে চাঞ্চল্য পড়িয়া গেল। গোলকপুরের জমিদার শ্রীযুক্ত সত্যেন্দ্র চন্দ্র চৌধুরী সতায় আসিয়াছেন। আমি সভাপতি। মঞ্চের উপর জমিদার বাবুর বসিবার ব্যবস্থা করিলাম। তিনি সভায় দু’চার কথা বলিতে চাহিলেন। আমি সভায় সে কথা ঘোষণা করিয়া জমিদার বাবুকে আহ্বান করিলাম। তিনি অল্প কথায় বক্তৃতা শেষ করিলেন। দেখা গেল, তিনি মহাত্মা গান্ধীর একজন ভক্ত এবং নিজে সাধু প্রকৃতির অতিশয় বিনয়ী ভদ্রলোক।

তিনি বলিলেন: ‘এ জিলার প্রজা-আন্দোলনের নেতা মনসুর সাহেব প্রাতঃ স্মরণীয় নমস্য ব্যক্তি’ বলিয়া জোড়-হাত নত মস্তকে ঠেকাইলেন। আমার প্রাতঃস্মরণীয় হওয়ার কারণও তিনি সংগে সংগেই দেখাইলেন। বলিলেন : ‘কারণ তিনি মহাত্মা গান্ধীর একজন অনুরক্ত অনুসারী লোক।‘ অপাত্রে এমন উচ্চ প্রশংসার কারণও সংগে সংগেই সুস্পষ্ট হইয়া গেল। তিনি বলিলেন : ‘অথচ এটা খুবই দুঃখের বিষয় যে মনসুর সাহেব অহিংসায় বিশ্বাসী হইয়াও তিনি জমিদারদিগকে ঘৃণা করিয়া থাকেন। এখানে তিনি রাজা জগৎকিশোরের মতই বলিলেন : সব জমিদারকে ঘৃণা করা উচিৎনয়। কারণ সব জমিদারই খারাপ নয়।‘

জমিদার বাবু মহাত্মা গান্ধীর নাম করায় তাঁর কথার জবাব দেওয়া আমার পক্ষে খুবই সহজ হইল। আমি তাঁর ভদ্রতার প্রতিদানে ভদ্রতা করিয়া আমার বক্তৃতার শুরুতেই বলিলাম : মহাত্মাজীকে ইংরাজরা যেমন ভুল বুঝিয়াছিল, আমাকেও জমিদার বাবু তেমনি ভুল বুঝিয়াছেন। মহাত্মাজী ইংরাজের অভিযোগের উত্তরে বলিয়াছিলেন : আমি ইংরাজ জাতিকে ঘৃণা করি না। ইংরাজ সাম্রাজ্যবাদকে ঘৃণা করি। ইংরাজ জাতির মধ্যে আমার শ্রদ্ধেয় বহু ব্যক্তি আছেন। আমিও মহাত্মাজীর ভাষা নকল করিয়া বলিতেছি : আমি জমিদারদেরে ঘৃণা করি না। জমিদারি প্রথাকেই ঘৃণা করি। বস্তুতঃ জমিদাদের মধ্যে আমার শ্রদ্ধেয় বহু ব্যক্তি আছেন, দাঁতব্য কাজে যাঁদের দান অতুলনীয়। আমরা শুধু জমিদারি প্রথাটারই ধ্বংস চাই। ব্যক্তিগতভাবে জমিদারদের ধ্বংস চাই না। এই প্রথার বিরুদ্ধেই যে আমাদের সংগ্রাম, এই কুপ্রথা যে ধনীকে দরিদ্র এবং ভাল মানুষকে খারাপ করিতেছে নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা হইতে তা বর্ণনা করিলাম। যে আমি জমিদারি প্রথার বিরুদ্ধে আশৈশব সংগ্রাম করিয়া আসিতেছি সেই আমিই যে জমিদারি-প্রথার চাপে খারাপ হইয়া গিয়াছিলাম, সে অপরাধ সরলভাবে স্বীকার করিলাম। এক জমিদারের দুই শরিকের মামলায় আমি কোর্টের দ্বারা সেই জমিদারির রিসিভার নিযুক্ত হইয়াছিলাম। জমিদারদের পক্ষ হইতে তাদের জমিদারি পরিচালন করিতে গিয়া ছয় মাসের মধ্যে আমি বুনিয়াদী জমিদারদের চেয়েও অত্যাচারী জমিদার হইয়া গিয়াছিলাম। এক মহালের খায়না আদায়ের জন্য শেষ পর্যন্ত আমি পুলিশের সহায়তা চাহিয়াছিলাম। জিল প্রজা-সমিতির সেক্রেটারি প্রজাদের বকেয়া খাযনা আদায়ের জন্য পুলিশের সাহায্য চাওয়ায় জিলা ম্যাজিস্ট্রেট ও এস, পি, তা হাসিয়াই খুন। শেষ পর্যন্ত তাঁরা আমাকে ও-কাজে বিরত করিয়াছিলেন। নইলে কি যে কাণ্ডটা হইয়া যাইত, সে দুশ্চিন্তা ঐ সভার মধ্যেই প্রকাশ করিলাম। উপসংহারে বলিলাম : যে প্রথা আমার মতবিরোধী লোককে অত্যাচারী বানাইয়াছিল ছয় মাসে, দেড় শ’ বৎসরে ঐ প্রথা আপনাদের কতখানি অত্যাচারী বানাইয়াছে তা আপনিই বিচার করুন। সভায় হাসির হুল্লোড় পড়িয়া গেল। জমিদার বাবুও হাসিলেন। আমার কথা তার মনে এমন দাগ কাটিয়াছিল যে তিনি বীরেন্দ্র চন্দ্র চৌধুরী ও শৈলেন্দ্র চন্দ্র চৌধুরী নামক তাঁর দুই গ্র্যাজুয়েট ছেলেকে প্রজা-কমী হিসাবে গ্রহণ করিতে আমাকে অনুরোধ করিলেন। জমিদার পুত্রকে প্রজা-সমিতিতে গ্রহণ করার সম্ভাব্য আপত্তির বিরুদ্ধে তিনি নবাবযাদা হাসান আলীর নযির দিলেন। আমি নানা। যুক্তি ও দৃষ্টান্ত দিয়া উভয়ের পার্থক্য দেখাইলাম এবং শর্তাদি আরোপ করিলাম। শেষ পর্যন্ত তাঁরা প্রজা সমিতিতে যোগ দেন নাই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *