০১. রাজনীতির ক খ

রাজনীতির ক খ
পয়লা অধ্যায়

১. পরিবেশ

পথ চলিতে-চলিতে গলা ফাটাইয়া গান গাওয়া পাড়া-গাঁয়ে বহুৎ পুরান রেওয়াজ। খেতে-খামারে মাঠে-ময়দানে ভাটিয়ালি গাওয়ারই এটা বোধ হয় অনুকরণ। আমাদের ছেলেবেলায়ও এটা চালু ছিল। আমরা মকতব-পাঠশালার পড়ুয়ারাও গলা ফাটাইতাম পথে-ঘাটে। তবে আমরা নাজায়েয গান গাইয়া গলা ফাটাইতাম না। গানের বদলে আমরা গলা সাফ করিতাম ফারসী গযল গাইয়া, বয়েত যিকির করিয়া এবং পাঠ্য-পুস্তকের কবিতা ও পুঁথির পয়ার আবির্তি (আবৃত্তি) করিয়া। এ সবের মধ্যে যে পয়ারটি আমার কচি বুকে বিজলি ছুটাইত এবং আজো এই বুড়া হাড়ে যার রেশ বাজে তা এই :

আল্লা যদি করে ভাই লাহোরে যাইব
হুথায় শিখের সাথে জেহাদ করিব।
জিতিলে হইব গাযী মরিলে শহিদ
জানের বদলে যিন্দা রহিবে তৌহিদ।

একটি চটি পুঁথির পয়ার এটি। তখনও বাংলা পুঁথিতে নযর চলে নাই। ‘মহাভা-মহাভা-রতে-রক’র মত বানান করিয়া পড়িতে পার মাত্র। কারণ তখন আমি আরবী-ফারসী পড়ার মাদ্রাসা নামক মকতবের তালবিলিম। চাচাজী মুনশী ছমিরদ্দিন ফরাসী ছিলেন আমাদের উস্তাদ। শুধু পড়ার উস্তাদই ছিলেন না। খোশ এলহানে কেরাত পড়া ও সুর করিয়া পুঁথি পড়ারও উস্তাদ ছিলেন তিনি। চাচাজী এবং হুসেন আলী ফরাযী ও উসমান আলী ফকির নামে আমার দুই মামুও পুঁথি পড়ায় খুব মশহুর ছিলেন। মিঠা দরা গলায় তারা যে সব পুঁথি পড়িতেন তার অনেক মিছরাই আমার ছিল একদম মুখস্থ। উপরের পয়ারটি তারই একটি। কেচ্ছা-কাহিনীর শাহনামা। আলেফ-লায়লা, কাছাছুল আম্বিয়া, শহিদে কারবালা, মসলা মসায়েলের ফেকায়ে-মোহাম্মদী ও নিয়ামতে-দুনিয়া ও আখেরাত ইত্যাদি পুঁথি কেতাবের মধ্যে দু’চার খানা ছোট-ছোট জেহাদী রেসালাও ছিল আমাদের বাড়িতে। পশ্চিম হইতে জেহাদী মৌলবীরা বছরে দুই-তিনবার আসিতেন। আমাদের এলাকায়। থাকিতেন প্রধানতঃ আমাদের বাড়িতে। তারাই বস্তানিতে লুকাইয়া আনিতেন এ সব পুস্তক। আমাদের বাড়িতে থাকিয়া এরা মগরেবের পর ওয়াজ করিতেন। চাঁদা উঠাইতেন। লেখাপড়া-জানা লোকের কাছে এই সব কিতাব বিক্রয় করিতেন নাম মাত্র মূল্যে।

এ সবের পিছনে একটু ইতিহাস আছে। আমার বড় দাদা অর্থাৎ দাদার জ্যেষ্ঠ সহোদর আশেক উল্লা ‘গাযী সাহেব’ বলিয়া পরিচিত ছিলেন। তিনি শহিদ সৈয়দ আহমদ বেরেলভীর মোজাহিদ বাহিনীতে ভর্তি হন। কিভাবে এটা ঘটিয়াছিল, তার কোন লিখিত বিবরণী নাই। সবই মুখে মুখে। তবে জানা যায় দাদা জেহাদে যান আঠার-বিশ বছরের যুবক। প্রায় ত্রিশ বছর পরে ফিরিয়া আসেন প্রায় পঞ্চাশ বছরের বুড়া! প্রবাদ আছে তিনি বাংলা ভাষা এক রকম। ভুলিয়া গিয়াছিলেন। অনেক দিন পরে তিনি বাংলা রফত করিতে পারিয়াছিলেন। তার সম্বন্ধে আমাদের পরিবারের এবং এ অঞ্চলের আলেম-ফাযেল ও বুড়া মুরুব্বীদের মুখেই এসব শোনা কথা। আমার জন্মের প্রায় ত্রিশ বছর আগে গাখী সাহেব এন্তেকাল করিয়াছিলেন। তাঁর সম্বন্ধে এ অঞ্চলে বহু প্রবাদ প্রবচন ও কিংবদন্তি প্রচলিত আছে। তিনি বালাকুটের জেহাদে আহত হইয়া অন্যান্য মোজাহেদদের সাহায্যে পলাইয়া আত্মরক্ষা করেন। বহুদিন বিভিন্ন স্থানে ঘুরা ফেরা ও তবলিগ করিতে করিতে অবশেষে দেশে ফিরিয়া আসেন। পঞ্চাশ বছরের বুড়া জীবনের প্রথমে বিয়া-শাদি করিয়া সংসারী হন। এক মেয়ে ও এক ছেলে রাখিয়া প্রায় পয়ষট্টি বছর বয়সে মারা যান। বন্দুকের গুলিতে উরাতের হাড়ি ভাংগিয়া গিয়াছিল বলিয়া তিনি একটু খুঁড়াইয়া চলিতেন। তাছাড়া শেষ জীবন পর্যন্ত তিনি সুস্থ সবল ছিলেন এবং গ্রামের যুবকদের তলওয়ার লাঠি ও ছুরি চালনার অদ্ভুত-অদ্ভুত কৌশল শিক্ষা দিতেন। ঐ সব অদ্ভুত উস্তাদী খেলের মধ্যে কয়েকটির কথা আমাদের ছেলেবেলাতেও গায়ের বুড়াদের মুখে-মুখে বর্ণিত হইত। অনেকে হাতে-কলমে দেখাইবার চেষ্টাও করিতেন। ঐসব কৌশলের একটি ছিল এইরূপ : চারজন লোক চার ধামা বেগুন লইয়া চার কোণে আট-দশ হাত দূরে দূরে দাঁড়াইত। দাদাজী তলওয়ার হাতে দাঁড়াইতেন চারজনের ঠিক কেন্দ্রস্থলে। তামেশগিররা চারদিক ঘিরিয়া দাঁড়াইত। একজন মুখে বুড়া ও শাহাদত আংগুল ঢুকাইয়া শিস দিত। খেলা শুরু হইত। ধামাওয়ালা চারজন একসংগে দাদাজীর মাথা সই করিয়া ক্ষিপ্র হাতে বেগুন ছুরিতে থাকিত। দাদাজী চরকির মত চক্রাকারে তলওয়ার ঘুরাইতে থাকিতেন। একটা বেগুনও তার গায় লাগিত না। ধামার বেগুন শেষ হইলে খেলা বন্ধ হইত। দেখা যাইত, সবগুলি বেগুনই দুই টুকরা হইয়া পড়িয়া আছে।

দাদাজী জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত পুলিশের নযরবন্দী ছিলেন। সপ্তাহে একবার থানায় হাযির দিতে হইত। তখনও ত্রিশাল থানা হয় নাই’ কতোয়ালিতেই তিনি হাযিরা দিতে যাইতেন।

আশেক উল্লা সাহেব ছিলেন আছরদ্দিন ফরাযী সাহেবের তিন পুত্রের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। তিনি তখন মাদ্রাসার ছাত্র। এই সময় আমাদের গ্রাম ধানীখোলা ওহাবী আন্দোলনের ছোট খাট কেন্দ্র ছিল। ডব্লিও, ডরিও, হান্টার সাহেবের ‘স্ট্যাটিসটিক স-অব-বেংগল’ নামক বহু তথ্যপূর্ণ বিশাল গ্রন্থের ৩০৮ পৃষ্ঠায় ধানীখোলাকে ‘ময়মনশাহী’ জিলার পঞ্চম বৃহৎ শহর বলিয়া উল্লেখ করা হইয়াছে। ঐ পুস্তকের ৩০৯ পৃষ্ঠায় লেখা হইয়াছে : “জিলার সমস্ত সম্পদ ও প্রভাব ফরাযীদের হাতে কেন্দ্রিভূত। তাদের মধ্যে কয়েকজন বড়-বড় জমিদারও আছেন। এঁরা সবাই ওহাবী আন্দোলনের সমর্থক। অবশ্য এদের অধিকাংশই গরীব জোতদার। এদেরই মধ্যে অল্প-কয়েকজন উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের বিদ্রোহী ধর্মান্ধদের শিবিরে যোগ দিয়াছিল।”

হান্টার সাহেব-বর্ণিত এই ‘অল্প-কয়েকজন’ আসলে কত জন, কোথাকার কে কে ছিলেন, পূর্ব-পাকিস্তানের ইতিহাসের ভবিষ্যৎ গবেষকরাই তা ঠিক করিবেন। ইতিমধ্যে আমি সগৌরবে ঘোষণা করিতেছি যে আমার বড় দাদা গাযী আশেক উল্লা ছিলেন তাঁদের মধ্যে একজন। আমাদের পারিবারিক প্রবাদ হইতে জানা যায়, টাংগাইল (তৎকালীন আটিয়া) মহকুমার দুইজন এবং জামালপুর মহকুমার একজন মোজাহেদ-ভাই তার সাথী ছিলেন। দাদাজী জীবনের শেষ পর্যন্ত তাদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করিয়াছিলেন। ভাগ্যক্রমে দাদাজীর এন্তেকালের প্রায় ষাট বছর পরে আমি তাঁরই এইরূপ এক মোজাহেদ-ভাইর প্রপৌত্রীকে বিবাহ করিয়াছি।

ঐ সব বিবরণ হইতে বুঝা যায় ধানীখোলা এই সময় ওহাবী আন্দোলনের। ছোট খাট আখড়া ছিল এবং সেটা ছিল আমাদের বাড়িতেই। আমার আপন দাদাজী আরমাল্লা ফরাজী সাহেবের এবং আরও বহু মুরুব্বি আলেম-ফাযেলের মুখে শুনিয়াছি যে শহীদ সৈয়দ আহমদ বেরেলভী সাহেবের সহকর্মীদের মধ্যে মওলানা এনায়েত আলী এবং তার স্থানীয় খলিফা মওলানা চেরাগ আলী ও মওলানা মাহমুদ আলী এ অঞ্চলে তবলিগে আসিতেন এবং আমাদের বাড়িতেই অবস্থান করিতেন। এদের প্রভাবে আমার প্রপিতামহ আছরদ্দিন ফরাযী সাহেব তার জ্যেষ্ঠ এবং তৎকালে একমাত্র অধ্যয়নরত পুত্রকে মোজাহেদ বাহিনীতে ভর্তি করান। তার ফলে প্রতিবেশীও আত্মীয়-স্বজনের চক্ষে আমার পরদাতার মর্যাদা ও সম্মান বাড়িয়া যায়। তাই অবশেষে পারিবারিক মর্যাদায় পরিণত হয়।

আমরা ছেলেবেলায় এই ঐতিহ্যেরই পরিবেশ দেখিয়াছি। জেহাদী মওলানাদের আনাগোনা তখনও বেশ আছে। বিশেষতঃ মগরেবের ও এশার নমাযের মাঝখানে মসজিদে এবং এশার নমাযের পর খানাপনা শেষে বৈঠকখানায়, যেসব আলোচনা হইত তার সবই জেহাদ শহিদ হুর বেহেশত দুখ ইত্যাদি সম্পর্কে। এই সব আলোচনার ফলে আলেম-ওলামাদের সহবতে আমার শিশু-মনে ঐ সব দুর্বোধ্য কথার শুধু কল্পিত ছবিই রূপ পাইত। ফলে আমার মধ্যে একটা জেহাদী মনোভাব ও ধর্মীয় গোঁড়ামি দানা বাঁধিয়া উঠিতেছিল।

দাদাজী সম্বন্ধে কিম্বদন্তিগুলি আলেম-ফাযেল মোল্লা-মৌলবীদের মুখে বরঞ্চ কিছুটা সংযত হইয়াই বর্ণিত হইত। কিন্তু পাড়ার বুড়ারা চোখে দেখা বলিয়া যে সব আজগৈবি কাহিনী বয়ান করিতেন, তাতে আমার রোমাঞ্চ হইত এবং দাদাজীর মত ‘বীর’ হওয়ার খাহেশ দুর্দমনীয় হইয়া উঠিত। আমি জেহাদে যাইবার জন্য ক্ষেপিয়া উঠিতাম। কান্নাকাটি জুড়িয়া দিতাম। বেহশতে হুরেরা শরাবন-তহুর পিয়ালা হাতে কাতারে কাতারে শহিদানের জন্য দাঁড়াইয়া আছে, অথচ আমি নাহক বিলম্ব করিতেছি, এটা আমার কাছে অসহ্য মনে হইত। অবশ্য ঐ বয়সে হুরের আবশ্যকতা, তাদের চাঁদের মত সুরতের প্রয়োজনীয়তা অথবা শরাবন তহুরার স্বাদের ভাল-মন্দ কিছুই আমি জানিতাম না। তবু এইটুকু বুঝিয়া ছিলাম যে ঐগুলি লোভনীয় বস্তু। তা যদি না হইবে, তবে হুরের সুরতের কথা শুনিয়া রোমাঞ্চ হয় কেন?

কিন্তু জেহাদের খাহেশ আমার, মিটিল না। মুরুব্বিরা অত অল্প বয়সে বেহেশতে গিয়া দুরের কবলে পড়িতে আমাকে দিলেন না। তারা বুঝাইসেন শাহাদতের পুরা ফযিলত ও হুরের সুরত উপভোগ করিতে হইলে আরও বয়স হওয়া এবং লেখা-পড়া করা দরকার।

অতএব মন দিয়া পড়াশোনা করিতে ও চড়া গলায় সুর করিয়া জেহাদী কেতাব পড়িতে লাগিলাম। কেতাবের সব কথা বুঝিতাম না। তাই উস্তাদ চাচাজীকে জিগ্গাস করিতাম : চাচাজী, লাহোর কই শিখ কি? চাচাজী বুঝাইতেন? লাহোর হিন্দুস্থানেরও অনেক পশ্চিমে একটা মুল্লুক। আর শিখা শিখেরা আর দুশমন। হিন্দুদের মত দুশমন? না, হিন্দু-সে বতর। চাচাজীর কাছে আগে শুনিয়াছিলাম, ফিরিংগীরাই আমাদের বড় দুশমন। কাজেই জিগাইতাম : ফিরিংগীর চেয়েও চাচাজী জবাব দিতেন : ফিরিংগীরা তবু খোদা মানে, ঈসা পয়গাম্বরের উম্মত তারা। শিখেরা তাও না। ধরিয়া নিলাম, শিখেরা নিশ্চয়ই হিন্দু। সে যুগে হানাফী-মোহাম্মদীতে খুব বাহাস মারামারি ও মাইল মোকদ্দমা হইত। চাচাজী মোহাম্মদী পক্ষের বড় পাণ্ডা। তাঁর মতে হানাফীরা হিন্দু-সে বদৃতর। সেই হিন্দুরা আবার নাসারা-সে বতর। তার প্রমাণ পাইতে বেশী দেরি হইল না।

২. আত্মমর্যাদা-বোধ

আমাদের পাঠশালাটা ছিল জমিদারের কাছারিরই একটি ঘর। কাছারিঘরের সামন দিয়াই যাতায়াতের রাস্তা। পাঠশালায় ঘড়ি থাকিবার কথা নয়। কাছারিঘরের দেওয়াল-ঘড়িটাই পাঠশালার জন্য যথেষ্ট। কতটা বাজিল, জানিবার জন্য মাস্টার মশায় সময়-সময় আমাদেরে পাঠাইতেন। ঘড়ির কাঁটা চিনা সহজ কাজ নয় যে দুই-তিন জন ছাত্র এটা পারিত, তার মধ্যে আমি একজন।

কিছু দিনের মধ্যে একটা ব্যাপারে আমি মনে বিষম আঘাত পাইলাম। অপমান বোধ করিলাম। দেখিলাম, আমাদের বাড়ির ও গাঁয়ের মুরুব্বিরা নায়েব আমলাদের সাথে দরবার করিবার সময় দাঁড়াইয়া থাকেন। প্রথমে ব্যাপারটা বুঝি নাই। আরও কিছু দিন পরে জানিলাম, আমাদের মুরুব্বিদেরে নায়েব-আমলারা ‘তুমি’ বলেন। নায়েব-আমলারা আমাদেরেও ‘তুই তুমি’ বলিতেন। আমরা কিছু মনে করিতাম না। ভাবিতাম, আমাদের মুরুব্বিদের মতই ওরাও আদর করিয়াই এমন সম্বোধন করেন। পরে যখন দেখিলাম, আমাদের বুড়া মুরুব্বিদেরেও তারা ‘তুমি’ বলেন, তখন খবর না লইয়া পারিলাম না। জানিলাম, আমাদের মুরুব্বিদেরে ‘তুমি’ বলা ও কাছারিতে বসিতে না দেওয়ার কারণ একটাই। নায়েব-আমলারা মুসলমানদেরে ঘৃণা-হেকারত করেন। ভ ভদ্রলোক মনে করেন না। তবে ত সব হিন্দুরাই মুসলমানদেরে ঘৃণা করে! হাতে নাতে এর প্রমাণও পাইলাম। পাশের গায়ের এক গণক ঠাকুর প্রতি সপ্তাহেই আমাদের বাড়িতে ভিক্ষা করিতে আসিত। কিছু বেশী চাউল দিলে সে আমাদের হাত গণনা করিত। আমাদেরে রাজা-বাদশা বানাইয়া দিত। এই গণক ঠাকুরকে দেখিলাম একদিন নায়েব মশায়ের সামনে চেয়ারে বসিয়া আলাপ করিতেছে। নায়েব মশাই তাকে ‘আপনি’ বলিতেছেন। এই খালি-পা খালি-গা ময়লা ধুতি-পরা গণক ঠাকুরকে নায়েব বাবু এত সম্মান করিতেছেন কেন? আমাদের বাড়িতে তাকে ত কোন দিন চেয়ারে বসিতে দেখি নাই। উত্তর পাইলাম, গণক ঠাকুর হিন্দু ব্রাহ্মণ। কিন্তু আমাদের মোল্লা-মৌলবীদেরেও ত নায়েব-আমলারা ‘আপনে’ বলেন না, চেয়ারে বসান না। আর কোনও সন্দেহ থাকিল না আমার মনে। রাগে মন গিরগির করিতে থাকিল।

কাছারির নায়েব-আমলাদের বড়শি বাওয়ায় সখ ছিল খুব। সারা গায়েব মাতব্বর প্রজাদের বড় বড় পুকুরে মাছ ধরিয়া বেড়ান ছিল তাঁদের অভ্যাস। অধিকারও ছিল। গাঁয়ের মাতব্বরদেরও এই অভ্যাস ছিল। নিজেদের পুকুর ছাড়াও দল বাঁধিয়া অপরের পুকুরে বড়শি বাইতেন তাঁরাও। কিন্তু পুকুরওয়ালাকে আগে খবর দিয়াই তারা তা করিতেন। কিন্তু নায়েব-আমলাদের জন্য পূর্ব অনুমতি দরকার ছিল না। বিনা-খবরে তারা যেদিন-যার-পুকুরে-ইচ্ছা যত-জন খুশি বড়শি ফেলিতে পারিতেন।

একদিন আমাদের পুকুরেও এমনিভাবে তারা বড়শি ফেলিয়াছেন। তাদের নির্বাচিত সুবিধাজনক জায়গা বাদে আমি নিজেও পুকুরের এক কোণে বড়শি ফেলিয়াছি। নায়েব বাবুরা ঘটা করিয়া সুগন্ধি চারা ফেলিয়ো হরেক রকমের আধার দিয়া বড়শি বাহিতেছেন। আর আমি বরাবরের মত চিড়ার আধার দিয়া বাহিতেছি। কিন্তু মাছে খাইতেছে আমার বড়শিতেই বেশী। নায়েব বাবুদের চারায় মাছ জমে খুব। কিন্তু মোটেই খায় না। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করিয়া নায়েব বাবু উচ্চসুরে আমার নাম ধরিয়া ডাকিয়া বলিলেন : তোর আধার কিরে?

‘তুই’ শুনিয়াই আমার মাথায় আগুন লাগিল। অতিকষ্টে রাগ দমন করিয়া উত্তর দিলাম : চিড়া।

নায়েব বাবু হাকিলেন : আমারে একটু দিয়া যা ত।

সমান জোরে আমি হাকিলাম ও আমার সময় নাই, তোর দরকার থাকে নিয়া যা আইসা।

নায়েব বাবু বোধ হয় আমার কথা শুনিতে পান নাই। শুনিলেও বিশ্বাস করেন নাই। আবার হাকিলেন : কি কইলে?

আমি তেমনি জোরেই আবার বলিলাম : তুই যা কইলে আমিও তাই কইলাম।

নায়েব বাবু হাতের ছিপটা খুঁড়িয়া ফেলিয়া লম্বা-লম্বা পা ফেলিয়া পানির ধার হইতে পুকুরের পাড়ে উঠিয়া আসিলেন। ওঁদের বসিবার জন্য পুকুর পাড়ের লিচু গাছ তলায় চেয়ার-টেয়ার পাতাই ছিল সেদিকে যাইতে-যাইতে গলার জোরে ‘ফরাযী! ও ফরাযী! বাড়ি আছ?’ বলিয়া দাদাজীকে ডাকিতে লাগিলেন। আমি বুঝিলাম, নায়েব বাবু ক্ষেপিয়া গিয়াছেন। সংগী আমলারাও নিশ্চয়ই বুঝিলেন।

তারাও যার-তার ছিপ তুলিয়া নায়েব বাবুর কাছে আসিলেন। আমি নিজের, জায়গায় বসিয়া রহিলাম। কিন্তু নযর থাকিল ঐদিকে। দাদাজীর ডাক পড়িয়াছে কিনা! তামেশগির পাড়ার লোকেরাও নায়েব বাবুকে ঘিরিয়া দাঁড়াইয়াছে। নায়ের বাবু আবার গলা ফাটাইয়া চিৎকার করিলেন : “ফরাজী, তোমারে কইয়া যাই, তোমার নাতি ছোকরা আমারে অপমান করছে। আমরা আর তোমার পুকুরে বড়শি বাইমু না। মুক্তাগাছায় আমি সব রিপোর্ট করুম।”

চিৎকার শুনিয়া আমার বাপ চাচা দাদা কেউ মসজিদ হইতে কেউ বাড়ির মধ্যে হইতে বাহির হইয়া আসিলেন। সকলেই প্রায় সমস্বরে বলিলেন : কেটা আপনেরে অপমান করছে? কার এমন বুকের পাটা?

নায়েব বাবু সবিস্তারে বলিলেন, আমি তাকে তুই বলিয়াছি। আমার মুরুব্বিদের এবং সমবেত প্রতিবেশীদের সকলেই যেন ভয়ে নিস্তব্ধ হইয়া গেলেন। দাদাজী হুংকার দিয়া আমার নাম ধরিয়া ডাকিলেন : এদিকি আয়। পাজি, জলদি আয়।

আমি গিয়া দাদাজীর গা ঘেষিযা দাঁড়াইতে চাহিলাম। দাদাজী খাতির না করিয়া ধমক দিয়া বলিলেন : ওরে শয়তান, তুই নায়েব বাবুরে ‘তুই’ কইছস?

আমি মুখে জবাব না দিয়া মাথা ঝুকাইয়া জানাইলাম : সত্যই তা করিয়াছি।

দাদাজী গলা চড়াইয়া আমার গালে চড় মারিবার জন্য হাত উঠাইয়া, কিন্তু মারিয়া, গর্জন করিলেন : বেআদব বেত্তমি, তুই নায়েব বাবুরে ‘তুই’ কইলি কোন্ আক্কেলে?

এবার আমি মুখ খুলিলাম। বলিলাম : নায়েব বাবু আমারে তুই কইল কেন?

দাদাজী কিছুমাত্র ঠাণ্ডা না হইয়া বলিলেন : বয়সে বড়, তোর মুরুব্বি। তানি তোরে তুই কইব বইলা তুইও তানরে তুই কইবি? এই বেত্তমিযি তুই শিখছস কই? আমরা তোরে তুই কই না? নায়েব বাবু তানার ছাওয়ালরে তুই কয় না?

আমি দাদাজীর দিকে মুখ তুলিয়া নায়েব বাবুকে এক নযর দেখিয়া লইয়া বলিলামঃ আপনে বাপজী কেউই ত বয়সে ছোট না, তবে আপনেগরে নায়েব বাবু ‘তুমি’ কয় কেন?

দাদাজী নিরুত্তর। কারও মুখে কথা নাই। নায়েব-আমলাদের মুখেও না। আমার বুকে সাহস আসিল। বিজয়ীর চিত্তচাঞ্চল্য অনুভব করিলাম। আড়-চোখে লোকজনের মুখের ভাব দেখিবার চেষ্টা করিলাম। কারও কারও মুখে মুচকি হাসির আঁচ পাইলাম।

দাদাজী হাতজোড় করিয়া নায়েব বাবুর কাছে মাফ চাহিলেন। বড়শি বাইতে অনুরোধ করিলেন। আমাকে ধমক দিয়া বলিলেন : যা বেত্তমিয শয়তান, নায়েব বাবুর কাছে মাফ চা। বাপের বয়েসী মুরুব্বিরে তুই কইয়া গোনা করছস।

আমি বিন্দুমাত্র না ঘাবড়াইয়া বলিলাম : আগে নায়েব বাবু মাফ চাউক, পরে আমি মাফ চামু।

মিটানো ব্যাপারটা আমি আবার তাজা করিতেছি দেখিয়াই বোধ হয় দাদাজী কুঁদিয়া উঠিলেন। বলিলেন : নায়েব বাবু মাফ চাইব? কেন কার কাছে?

আমি নির্ভয়ে বলিলাম : আপনে নায়েব বাবুর বাপের বয়েসী না? আপনেরে তুমি কইয়া তানি গোনা করছে না? তারই লাগি মাফ চাইব নায়েব বাবু আপনের কাছে।

দাদাজী আরও খানিক হৈ চৈ রাগারাগি করিলেন। আমারে ফসিহত করিলেন। উপস্থিত মুরুব্বিদেরও অনেকে আমাকে ধমক-সালাবত দেখাইলেন। আমাকে অটল নিরুত্তর দেখিয়া পাড়ার লোকসহ আমার মুরুব্বিরা নিজেরাই নায়েব বাবুও তার সংগীদেরে জনে-জনে কাকুতি মিনতি জানাইলেন। কিন্তু নায়েব বাবু শুনিলেন না। সংগীদেরে লইয়া মুখে গজগজ ও পায়ে দম্ দম্ করিয়া চলিয়া গেলেন।

আমাদের পরিবারের সকলের ও পাড়ার অনেকের দুশ্চিন্তায় কাল কাটিতে লাগিল। আমার মত পাগলকে লইয়া ফরাযী বাড়ির বিপদই হইয়াছে। এই মর্মে সকলের রায় হইয়া গেল। বেশ কিছুদিন আমিও দুশ্চিন্তায় কাটাইলাম। প্রায়ই শুনিতাম, আমাকে ধরিয়া কাছারিতে এমন কি মুক্তাগাছায়, নিয়া তক্তা-পিষা করা হইবে। দাদী ও মা কিছুদিন আমাকে ত পাঠশালায় যাইতেই দিলেন না। পাঠশালাটা ত কাছারিতেই।

৩. মনের নয়া খোরাক

ইতিমধ্যে দুইটি ঘটনা ঘটিল। এর একটিতে আমার শিশু মনে কল্পনার দিগন্ত প্রসারিত হইল। অপরটিতে আমার সাহস বাড়িল। যতদূর মনে পড়ে সেটা ছিল ১৯০৭ সাল। একদিন চাচাজী মুনশী ছমিরদ্দিন ফরাযী সাহেব শহর হইতে কিছুসংখ্যক চটি বই ও ইশতাহার আনিলেন। বাড়ির ও পাড়ার লোকদেরে তার কিছু কিছু পড়িয়া শুনাইলেন। তাতে আমি বুঝিলাম শহরে বড় রকমের একটা দরবার হইয়া গিয়াছে। কলিকাতা হইতে বড় বড় লোক আসিয়া ঐ দরবারে ওয়ায করিয়াছেন। ঐ সব পুস্তিকায় তা ছাপার হরফে লেখা আছে। আমি সযত্নে ঐ সব পুস্তিকা জমা করিয়া রাখিয়া দিলাম। পাঠশালার পাঠ্য বই পড়ার ফাঁকে ফাঁকে ঐ সব পুস্তিকা পড়িবার চেষ্টা করিতাম। বুঝিতাম খুব কমই। কিন্তু যা বুঝিতাম কল্পনা করিতাম তার চেয়ে অনেক বেশী। বেশ কিছুদিন পরে বুঝিয়াছিলাম ওটা ছিল মুসলমান শিক্ষা সম্মিলনী। এতে যারা বক্তৃতা করিয়াছিলেন তাঁদের মধ্যে শিক্ষা বিভাগের ডাইরেক্টর বা এমনি কোনও বড় অফিসার মিঃ শার্প এবং হাইকোর্টের বিচারপতি জাষ্টিস শরফুদ্দিনও ছিলেন। ওঁরা আসলে কারা, তাদের পদবিগুলির অর্থ কি, তা তখন বুঝি নাই। ফলে আমি ধরিয়া নিলাম মুসলমান নবাব বাদশাদের একটা দরবার হইয়া গেল। এই বিশ্বাসের উপর কল্পনার ঘোড়া দৌড়াইতে লাগিলাম।

এর কয়েক দিন পরেই দ্বিতীয় ঘটনা। বৈলর বাজারের পাট হাটায় একটা বিরাট সভা। আমাদের পাঠশালার শিক্ষক জনাব আলিমদ্দিন মাস্টার সাহেবের উৎসাহ ও নেতৃত্বে আমরা ভলান্টিয়ার’ হইলাম। সভায় কয়েকদিন আগে হইতেই আমাদের ট্রেনিং ও সভামঞ্চ সাজানোর কাজ চলিল। ‘ভলান্টিয়ার’, ও ‘খোশ আমদেদ’ কথা দুইটি এই প্রথম শুনিলাম। মুখস্থ করিলাম। নিজের মনের মত অর্থও করিলাম। এইভাবে সভার আগে ও পরে কয়েকদিন ধরিয়া কল্পনার রাজ্যে বিচরণ করিলাম। সভার উচা মঞ্চে দাঁড়াইয়া যারা বক্তৃতা করিলেন এবং যারা কাতার করিয়া বসিয়া রহিলেন, তারা সকলে মিলিয়া আমার কল্পনার চোখের সামনে আলেফ-লায়লার হারুন রশিদ বাদশার দরবারের ছবি তুলিয়া ধরিলেন। ঠিক ঐ সময়েই আলেফ-লায়লা পড়িতেছিলাম কিনা। আর দেখিবই না বা কেন? কাল আলপাকার শেরওয়ানী ও খয়েরী রং-এর উচা রুমী টুপি ত দেখিলাম এই প্রথম। চৌগা-চাপকান-পাগড়ি অনেক দেখিয়াছি। কিন্তু এ জিনিস দেখিলাম এই পয়লা। বড় ভাল লাগিল। গর্বে বুক ফুলিয়া উঠিল। মুসলমানদের মধ্যেও তবে বড় লোক আছে।

ভলান্টিয়ারের ব্যস্ততার মধ্যে বক্তৃতা শুনিলাম কম। বুঝিলাম আরও কম। তবে করতালি ও মারহাবা-মারহাবা শুনিয়া বুঝিলাম বক্তৃতা খুব ভাল হইয়াছে। কিন্তু আমার মন ছিল সভায় যে সব বিজ্ঞাপন ও পুস্তিকা বিতরণ ও বিক্রয় হইয়াছিল তার দিকেই বেশী। বিলি-করা সবগুলি এবং খরিদ-করা কয়েক খানা আমি জমা করিয়াছিলাম। তার মধ্যে মুনশী মেহেরুল্লা সিরাজগঞ্জীর ‘হিতোপদেশ মালা’ ও মওলানা খোন্দকার আহমদ আলী আকালুবীর ‘শুভ জাগরণ’ আমাকে খুবই উদ্দীপ্ত করিয়াছিল। ফলে কয়েক দিন পরে আমি নিজেই এক সভা ডাকিলাম।

খুব চিন্তা-ভাবনা করিয়াই সভার জায়গা ঠিক করিলাম। কারো বাড়িতে ত দূরের কথা, বাড়ির আশে-পাশে হইলেও তার গর্দান যাইবে। কাজেই জায়গা হইল বাংগালিয়ার ভিটায় নদীর ধারে। তার আশে-পাশে এক-আধ মাইলের মধ্যে কারও বাড়ি-ঘর নাই। হাটে-বাজারে ঢোল-শহরত করিলে জমিদারের কানে যাইবে। অতএব এক্সারসাই বুকের পাতা ছিঁড়িয়া আশে-পাশের চার-পাঁচ মসজিদের মুছল্লী সাহেবানের খেদমতে ‘ধানীখোলার প্রজা সাধারণের পক্ষে’ দাওয়াত-নামা পাঠাইলাম। কারও ঘড়ি নাই। তবু সভার সময় দিলাম বিকাল চারটা। পাঠশালা চারটায় ছুটি হয়। কাজেই সময়ের আশায় আছে।

৪. প্রজা আন্দোলনের বীজ

উদ্যোক্তারা আগেই সভাস্থলে গেলাম। লোক কেউ আসে নাই। আমরা ব্যাটবল-তিরিকাট (ক্রিকেট) লইয়া রোজ মাঠে যাইতাম। রাখালদেরে লইয়া খলিতাম। কাজেই আমাদের চার-পাঁচ জনকে একত্রে দেখিয়া রাখালরা জমা হইল। কিন্তু ব্যাটল না দেখিয়া ফিরিয়া যাইবার উপক্রম করিল। আমরা বলিলাম সভা হইবে। সভার তামাশা দেখিতে তারা থাকিয়া গেল। এক দুই তিন চার করিয়া প্রায় শ খানেক লাক সমবেত হইল। কিন্তু মাতব্বররা একজনও আসেন নাই। কাকে সভাপতি করিয়া সভার কাজ শুরু করিব তাই ভাবিতেছিলাম। এমন সময় পঁচিশ-ত্রিশ জন লোক পিছনে লইয়া সভায় আসিলেন আমাদের গ্রামের শ্রেষ্ঠ মাতব্বর যহিরুদ্দিন তরফদার সাহেব। ইনি আবুল কালাম শামসুদ্দিনের চাচা। পাঁচ গ্রামের মাতব্বর। জ্ঞানী পণ্ডিত ও সুবক্তা। তাঁকে সভাপতির পদে বরণ করিয়া আমি প্রস্তাব করিলাম। তিনি আসন গ্রহণ করিলেন। সভায় বসার কোনও চেয়ার-টেবিল ছিল না। কাজেই আসন গ্রহণ করিলেন মানে এক জায়গা হইতে উঠিয়া আরেক জায়গায় বসিলেন। পতিত জমি। দুর্বা ঘাস। কাপড় ময়লা হওয়ার কোনও ভয় ছিল না। কাজেই সবাই বসা। জীবনের প্রথম জনসভায় বক্তৃতা করিতে উঠিলাম। বয়স আমার তখন ন বছর। পাঠশালার বার্ষিক সভায় মুখস্থ কবিতা আবৃতি ও লিখিত রচনা পাঠ ছাড়া অন্য অভিজ্ঞতা নাই। কি বলিয়াছিলাম মনে নাই। তবে বক্তৃতা শেষ করিলে স্বয়ং সভাপতি সাহেব ‘মারহাবা মারহাবা’ বলিয়া করতালি দিয়াছিলেন। তার দেখাদেখি সভার সকলেই করতালি দিয়াছিল। আমার পরেই সভাপতি সাহেব দাঁড়াইলেন। কারণ ‘আর কেউ কিছু বলতে চান?’ সভাপতি সাহেবের এই আহ্বানে কেউ সাড়া দিলেন না। সভাপতি সাহেব লম্বা বক্তৃতা করিলেন। মগরেবের ওয়াক্ত পর্যন্ত সভা চলিল। পেন্সিল ও একসারসাইয় বুক পকেটে নিয়াছিলাম। সভাপতি সাহেবের ডিক্টেশন মত কয়েকটি প্রস্তাব লিখিলাম। তাতে কাছারিতে প্রজাদের শ্ৰেণীমত বসিবার আসন দাবি এবং শরার বরখেলাফ কালী পূজার মাথট আদায় মওকুফ রাখিবার অনুরোধও করা হইল। সর্ব সম্মতিক্রমে প্রস্তাব পাস হইল। কাগযটি সভাপতি সাহেব নিজের পকেটে নিলেন। বলিলেন আরও কয়েকজন মাতবর লইয়া তিনি জমিদারের সাথে দরবার করিবেন। সভাপতি সাহেবের বক্তৃতায় জমিদারদের অত্যাচার-জুলুমের অনেক কাহিনী শুনিলাম। অনেক নূতন জ্ঞান লাভ করিলাম। সে সব কথা ভাবিতে ভাবিতে বাপজী চাচাজী ও অন্যান্য মাতব্বরের সাথে বাড়ি ফিরিলাম।

অল্পদিন পরেই আমাদের অন্যতম জমিদার মুক্তাগাছার শ্রীযুক্ত যতীন্দ্র নারায়ণ আচার্য চৌধুরী বার্ষিক সফরে আসিলেন। তাঁর কাছে আমার বিরুদ্ধে এবং ঐ সভা সম্পর্কে অতিরঞ্জিত রিপোর্ট দাখিল করা হইল। যতীন বাবু আমাকে কাছারিতে তলব করিলেন। পিয়াদা আমাকে নিতে আসিলে আমি তাকে বলিলাম : কর্তার কাছে আমার কোনও কাজ নাই। আমার কাছে কর্তার কাজ থাকিলে তিনিই আসিতে পারেন। তৎকালে জমিদারদেরে কর্তা বলা হইত। সম্বোধনেও বিবরণেও। পিয়াদা আমাদের গায়ের লোক। আমার হিতৈষী। আমার গর্দান যাইবে ভয়ে একথা খোদ কর্তাকে না বলিয়া নায়েব আমলাকে রিপোর্ট করিল। আমার বিরুদ্ধে ওদের আখ্যে ছিল। প্রায় বছর খানেক আগে মায়েব বাবুকে তাদের সামনে আমি তুই এর বদলে তুই বলিয়াছিলাম। নায়েব-আমলারা সে কথা ভুলেন নাই। কর্তাকে আমার বিরুদ্ধে ক্ষেপাইবার আশায় পিয়াদার রিপোর্টটায় রং চড়াইয়া তুই এর পুরান ঘটনাকে সেদিনকার ঘটনারূপে তার কাছে পেশ করেন।

কর্তা ছিলেন আদত রসিক সুজন। তিনি আমার বয়সের, কালচেহারার ও পাঠশালায় পড়ার কথা শুনিলেন। সব শুনিয়া প্রকাশ্য দরবারে হো হো করিয়া হাসিয়া উঠিলেন। বলিলেন : “ছোকরা গোকুলের শ্রীকৃষ্ণ। আমাদের কংশ বংশ ধ্বংস করতেই ওর জন্ম। আমার ডাকে সে ত আসবই না। হয়ত আমারই ওর কাছে যাইতে হৈব।”

সমবেত প্রজারা ও আমার মুরুব্বিরা এটাকে কর্তার রসিকতা বলিয়া বিশ্বাস করিলেন না। কর্তার চাপা রাগ মনে করিলেন। আমার নিরাপত্তা সম্বন্ধে চিন্তাযুক্ত হইলেন। সভার সভাপতি তরফদার সাহেব কিন্তু আদত কথা ভুলিলেন না। আমার প্রতি কর্তার মনোভাব নরম করিবার উদ্দেশ্যে মোলায়েম কথায় আমাদের দাবি-দাওয়া পেশ করিলেন। তার কুশলী মিষ্টি কথায় কর্তার মন সত্যই নরম হইল। তিনি সভায় গৃহীত প্রস্তাবের কয়েকটি মনযুর করিলেন। বাকীগুলি অন্যান্য জমিদারদের সাথে সলাপরামর্শ করিয়া পরে বিবেচনা করিবেন বলিলেন! যে কয়টি দাবি তখনই মনযুর হয় তার মধ্যে কাছারিতে প্রজাদের বসিবার। ব্যবস্থাই সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। সাধারণ প্রজাদের বসিবার জন্য চট ও মাতব্বর প্রজাদের জন্য লম্বা বেঞ্চির ব্যবস্থা হয়। তবে বেঞ্চি উচ্চতায় সাধারণ বেঞ্চের অর্ধেক হয়। সাধারণ বেঞ্চ উচ্চতায় চৌকির সমান। চৌকির সমান উচা বেঞ্চিতে প্রজারা বসিলে আমলা-প্ৰজায় কোনও ফারাক থাকে না বলিয়া এই ব্যবস্থা হয়। আমাদের মুরুব্বিরা এই ব্যবস্থাই মানিয়া লন। তবে সাধারণ প্রজাদের জন্য চটের বদলে পার্টির ব্যবস্থা করিতে অনুরোধ করা হয়। তখনই এ দাবি মানিয়া নেওয়া হইল লো বটে কিন্তু কয়েক বছর পরে হইয়াছিল। এইভাবে ধানীষোলায় প্রথম প্রজা আন্দোলন সফল হয়।

৫. প্রজা আন্দোলনের চারা

দুই বছর পরের কথা। তখন আমি পাঠশালার পড়া শেষ করিয়া দরিরামপুর মাইনর স্কুলে গিয়াছি। গ্রাম্য সম্পর্কে আমার চাচা মোহাম্মদ সাঈদ আলী সাহেব (পরে উঁকিল) এই সময় শহরের স্কুলে উপরের শ্রেণীতে পড়িতেন। তার উৎসাহে আমি আবার একটা প্রজা সভা ডাকি। এই সভার বিবরণী তকালে সাপ্তাহিক ‘মোহাম্মদী’ ও ‘মিহির ও সুধাকরেট ছাপা হয়। ঐ সভায় সাঈদ আলী সাহেবের রচিত একটি প্রস্তাব খুবই জনপ্রিয় হয়। তাতে দাবি করা হয় যে কাছারির নায়েব-আমলা সবই স্থানীয় লোক হইতে নিয়োগ করিতে হইবে। যুক্তি দেওয়া হয়, এতে স্থানীয় শিক্ষিত লোকের চাকরির সংস্থান হইবে। জমিদারের খাজনা সহজে বেশী পরিমাণ আদায় হইবে। কাছারিতে বসার সমস্যাও সহজেই সমাধান হইবে। এটাকে ক্ষুদ্র আকারে ‘ইণ্ডিয়ানিয়েশন-অব-সার্ভিসেস’ দাবির প্রথম পদক্ষেপ বলা যাইতে পারে। চাকুরির ব্যাপারে উচ্চস্তরে সরকারী পর্যায়ে যা হইয়া থাকে এখানেও তাই হইল। ইংরাজ সাম্রাজ্য দিল তবু চাকুরি দিল না। জমিদারও তেমনি জমিদারি দিল তবু চাকুরি দিল না। চাকুরিজীবীরা বরাবর এ-ই করিয়াছে। ভবিষ্যতেও করিবে। ‘শির দিব তবু নাহি দিব আমামা’ সবারই জেহাদী যিকির চিরকালের।

আরও তিন বছর পরে। ১৯১৪ সাল। ময়মনসিংহ শহরে মৃত্যুঞ্জয় স্কুলে অষ্টম শ্রেণীতে পড়ি। এই সময় জামালপুর মহকুমার কামারিয়ার চরে একটা বড় রকমের প্রজাসম্মিলনী হয়। সম্মিলনীর আগের বিজ্ঞাপনাদি ও পরে ‘মোহাম্মদ’ ও ‘মোসলেম হিতৈষী’ নামক সাপ্তাহিক দুইটিতে সম্মিলনীর বিবরণী পড়িয়া আমি আনন্দে উহূল্প হই। এই বিবরণী হইতেই আমি প্রথম মৌঃ এ. কে. ফযলুল হক, মৌলবী আবুল কাসেম, খান বাহাদুর আলিমুজ্জামান চৌধুরী, বগুড়ার মৌঃ রজিবুদ্দিন তরফদার, ময়মনসিংহের মওলানা খোন্দকার আহমদ আলী আকালুবী (পরে আমার শ্বশুর), মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ, মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী প্রভৃতি নেতা ও আলেমের নাম জানিতে পারি। এঁরা নিশ্চয়ই বড় বড় পণ্ডিত ও বড় লোক। সকলেই গরিব প্রজার পক্ষে আছেন জানিয়া আমার অন্তরে উৎসাহ ও সাহসের বিজলি চমকিয়া যায়। এই সব বিজ্ঞাপন ও কার্যবিবরণী আমি সযত্নে বাক্সে কাপড়-চোপড়ের নিচে লুকাইয়া রাখি। এতে বিভিন্ন প্রস্তাব ছাড়াও বক্তাদের বক্তৃতার সারমর্ম দেওয়া ছিল। মাঝে মাঝে এইসব কাগ্য বাহির করিয়া মনোযোগ দিয়া পড়িতাম। তাতে প্রজাদের দাবি-দাওয়ার ব্যাপারে ও জমিদারী জুলুম সম্পর্কে আমার জ্ঞান বাড়ে। খাজনা মাথট আবওয়াব গাছ কাটা পুকুর খুদা জমি বিকি-কিনি ইত্যাদি অনেক ব্যাপারেই ঐ সম্মিলনীতে প্রস্তাব পাস হইয়াছিল। তার সব কথা আমি তখন বুঝি নাই সত্য, কিন্তু এটা বুঝিয়াছিলাম যে আমি নিজ গ্রামে প্রজাদের বসিবার আসন ও আমলাগিরি চাকুরির যে দাবি ও তুই-তুংকারের যে প্রতিবাদ করিয়াছিলাম, প্রজাদের দাবি তার চেয়ে অনেক বেশী হওয়া উচিৎ।

নিয়মতান্ত্রিক প্রজা-আন্দোলনের ইতিহাসে কামারিয়ার চর প্রজা সম্মিলনী এবং তার উদ্যোক্তা জনাব খোশ মোহাম্মদ সরকার (পরে চৌধুরী) সাহেবের নাম সোনার হরফে লেখা থাকার বস্তু। এই সম্মিলন চোখে না দেখিয়া শুধু রিপোর্ট পড়িয়া প্রজা-আন্দোলনের এলাকা সম্বন্ধে আমার দৃষ্টি প্রসারিত হয়। এর পর আমি বঙ্কিম চন্দ্রের বাংলার কৃষক রমেশ দত্তের বাংলার প্রজা প্রমথ চৌধুরী ‘রায়তের কথা’ ইত্যাদি প্রবন্ধগ্রন্থ এবং লালবিহারীদের ইংরাজি নভেল ‘বেংগল পেমেন্ট লাইফ’ পড়ি। শেষোক্ত বইটি আমাদের স্কুলের পাঠ্য ছিল।

স্কুলের ছুটি-ছাটা উপলক্ষে অতঃপর গ্রামের বাড়িতে গিয়া এই সব নূতন নূতন কথা বলিতে শুরু করি। আমাদের নেতা জহিরুদ্দিন তরফদার সাহেব ছাড়াও বৈলর গ্রামের পণ্ডিত ইমান উল্লাহ সাহিত্য-রত্ন সাহেব আমাকে এ ব্যাপারে যথেষ্ট উৎসাহ ও উপদেশ দিতেন।

৬. সাম্প্রদায়িক চেতনা

আরেকটা ব্যাপার আমাকে খুবই পীড়া দিত। জমিদাররা হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সব প্রজার কাছ থনেই কালীপূজার মাথট আদায় করিতেন। এটা খাজনার সাথে আদায় হইত। খাজনার মতই বাধ্যতামূলক ছিল। না দিলে খাজনা নেওয়া হইত না। ফরাযী পরিবারের ছেলে হিসাবে আমি গোঁড়া মুসলমান ছিলাম। মূর্তি পূজার চাঁদা দেওয়া শেরেকী গোনা। এটা মুরুব্বিদের কাছেই শেখা মসলা। কিন্তু মুরুব্বিরা নিজেরাই সেই শেরেকী গোনা করেন কেন? এ প্রশ্নের জবাবে দাদাজী, বাপজী ও চাচাজী তারা বলিতেন : না দিয়া উপায় নাই। এটা রাজার জুলুম। রাজার জুলুম নীরবে সহ্য করা এবং গোপনে আল্লার কাছে মাফ চাওয়া ছাড়া চারা নাই। এ ব্যাপারে মুরুব্বিরা যদিস-কোরআনের বরাত দিতেন।

কিন্তু আমার মন মানিত না। শিশু-সুলভ বেপরোয়া সাহস দেখাইয়া হাম্বি তাধি করিতাম। মুরুব্বিরা ‘চুপচুপ’ করিয়া ডাইনে-বাঁয়ে নযর ফিরাইতেন। জমিদারের লোকেরা শুনিয়া ফেলিল না ত!

কালীপূজা উপলক্ষ্যে জমিদার কাছারিতে বিপুল ধূমধাম হইত। দেশ-বিখ্যাত যাত্রাপার্টিরা সাতদিন ধরিয়া যাত্রাগান শুনাইয়া দেশ মাথায় করিয়া রাখিত। হাজার হাজার ছেলে-বুড়া সারা রাত জাগিয়া সে গান-বাজনা-অভিনয় দেখিত। সারাদিন মাঠে-ময়দানে খেতে-খামারে এই সব নাটকের ভীম-অর্জনের বাখানি হইত। দর্শক শ্রোতারা প্রায় সবাই মুসলমান। কারণ এ অঞ্চলটাই মুসলমান প্রধান। আমাদের পাড়া-পড়শী আত্মীয়-স্বজন সবাই সে তামাশায় শামিল হইতেন। শুধু আমাদের বাড়ির কেউ আসিতেন না। আমার শিশুমন ঐ সব তামাশা দেখিতে উসখুস করিত নিশ্চয়। পাঠশালার বন্ধুদের পাল্লায় পড়িয়া চলিয়া যাইতাম তার কোন-কোনটায়। কিন্তু বেশীক্ষণ থাকিতে পারিতাম না। বয়স্ক কারও সংগে দেখা হইলেই তারা বলিয়া উঠিতেন : ‘আরে, তুমি এখানে তুমি যে ফরাযী বাড়ির লোক! তোমার এসব দেখতে নাই।’ শেষ পর্যন্ত আমি ঐ সব তামাশায় যাওয়া বন্ধ করিলাম। কিন্তু বোধহয় কারো নিষেধে ততটা নয়। যতটা শিশু-মনের অপমান-বোধে। কারণ সে সব যাত্রা-থিয়েটারের মজলিসেও সেই কাছারির ব্যবস্থা। ভ ভদ্রলোকদের বসিবার ব্যবস্থা। মুসলমানদের ব্যবস্থা দাঁড়াইয়া দেখার।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *