ম্যানহাটানে মুনস্টোন – ০২

দুই

সাধারণত লোক দেখলে আমার বিতৃষ্ণা হয় না। কিন্তু মিস্টার সেনকে দেখে হল। উস্কোখুস্কো চুল ভর্তি বিশাল মাথা একটা ক্যাংলা শরীরের ওপর বসানো। গায়ে নোংরা সাদা সার্ট। ঘিয়ে রঙের কোটটা এমন কোঁচকানো যে মনে হয় দলামোচা করে কিছুক্ষণ আগে কেউ সেটার ওপর বসেছিল। প্যান্টের অবস্থাও তথৈবচ। আমেরিকায় আসছে লোকটা, কিন্তু জামাকাপড়ের ব্যাপারে এতটুকু হুঁশ নেই! গলার স্বরটাও অত্যন্ত ঘ্যানঘ্যানে, বিরক্তিকর। তারওপর কথার পিঠে ‘স্যার’ জোড়া। এয়ারপোর্ট থেকে পেরিয়ে সবে ভ্যানউইক এক্সপ্রেস ওয়েতে পড়েছি, মিস্টার সেন নিরবতা ভাঙলেন। মার্লবারোর প্যাকেট খুলে একটা সিগারেট আমার নাকের সামনে নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “চলবে স্যার?”
“আমি খাই না।” সংক্ষিপ্ত জবাব দিলাম।
“ভালোই করেন স্যার, ভেরি ব্যাড হ্যাবিট। আমিও এবার ছাড়ব।” বলে সিগারেটটা ঠোঁটে লাগাতে যাচ্ছিলেন। কি ভেবে জানি নামিয়ে নিলেন। “স্যার, আপনাকে একটা প্রশ্ন করি?”
“করুন।”
“সিগারেটের ধোঁয়া কি আপনাকে বদার করে?”
“ওয়েল, তা অবশ্য একটু করে।”
“তারমানে স্যার, আমি এখানে সিগারেট খেলে আপনি বদারড হবেন।”
“না, না, একটু আধটুতে কি আর আসুবিধা, আপনি খান।”
“নো স্যার, আই ক্যান নট বদার ইউ। আচ্ছা, গাড়িটা কোথাও থামানো যায় না। আমি তাহলে টুক করে দুটো টান দিয়ে নিতে পারতুম।”
“না, এটা হাই ওয়ে। এমার্জেন্সি স্টপিং-এর জন্যে কোনও লেন না পাওয়া পর্যন্ত থামার উপায় নেই।”
“আই সি।”
আমার খারাপ লাগল। বললাম, “আপনি খান, এক-আধটা সিগারেটে কিছু এসে যায় না।”
“থ্যাঙ্ক ইউ স্যার, থ্যাঙ্ক ইউ ভেরি মাচ। এটা আবার সময় মত না খেলে সাইনাসটা ট্রাব্‌ল দেয়।”
লোকটা উন্মাদ নাকি! সাইনাসের সঙ্গে ধূমপানের সম্পর্ক কি? মরুক গে যাক!
হঠাৎ খেয়াল করলাম, ভদ্রলোকের কোলের ওপর রাখা ব্যাগে লেখা মিস্টার ই.সেন। ই.সেন দেখে আমি খুব অবাক হলাম। এরমধ্যে রনু একদিন ফোনও করেছিল ওর বন্ধু এন.সেনের আমেরিকা আসার খবরটা আমি চিঠিতে ঠিকঠাক পেয়েছি কিনা জানতে। কি সর্বনাশ, আমি কি তাহলে ভুল লোককে গাড়ীতে তুললাম!
“আচ্ছা আপনার ফার্স্ট নেমটা কি বলুন ত?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
“একেন।”
“একেন! খুব আনইউস্যুয়াল নামটা তো!”
“একেন্দ্র থেকে একেন। বাবা-মা একেবারে মার্ডার করে গেছেন স্যার। এই নিয়ে সবার গোল লাগে।”
হঠাৎ ব্যাপারটা জলের মত পরিস্কার হয়ে গেল। রনুর আদি বাড়ি ঢাকায়। তাই একেন সেন না বলে বলেছিলো অ্যাকেন সেন। আর আমি ভেবেছিলাম এক এন.সেন আসছেন! হো হো করে হেসে উঠলাম আমি। একেন সেন অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালেন। কনফিউসানটা ওঁকে বলতেই মাথা দুলিয়ে বললেন, “ভেরি ফানি স্যার।“ সঙ্গে সঙ্গে সিগারেট থেকে বড় এক টুকরো ছাই গাড়ীর হলুদ কার্পেটের ওপর পড়ল। আমি সাবধান করার আগেই জুতো দিয়ে কালো ছাইটা কার্পেটে ঘষে ঘষে মিশিয়ে দিলেন। অর্থাৎ এখন একশো বার ভ্যাকুয়াম করলেও ওই দাগ তোলা যাবে না!