৪৮. হিহি হিহি হিহি হিহি

হিহি হিহি হিহি হিহি।

অনেকগুলো মেয়ের গলার উল্লসিত হাসি একত্র হয়ে উছলে উঠলো গ্রীষ্মের দুপুরের দাবদাহকে পরাস্ত করে।

কনেকে পাঁজাকোলা করে ধরে তুলে বরের কোলে বসিয়ে দিতে গিয়েছিল ওরা, সেই ধাক্কায় বর ধরাশায়ী হয়েছে এবং বিদ্রোহিণী কনে ওদের হাত ছাড়িয়ে ঠিকরে উঠে পালাতে গিতে গাঁটছড়ার টানে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে, তাই এই হাসি উল্লসিত লহরিত!

দুটো পতনই তো বাসরের বিছানার ওপর, লাগে নি তো দুজনের একজনেরও তবে আর হাসিতে বাধা কি? এমন একটা বিয়েটিয়ে ছাড়া তো গলা খুলে হাসবার ছাড়পত্র মেলে না! আজকের গলায় গলা মেলানোর দরুন সঠিক ধরাও পড়ে না গলাটা বৌয়ের না মেয়ের! অতএব এই তো সুযোগ। যারা শুধু শাসনের ভয়ে লজ্জাশীলতার ভূমিকা অভিনয় করে চলে, তারা এমন সুযোগটা ভাল মতেই নেয়।

আজও নিচ্ছিল।

চুটিয়েই নিচ্ছিল।

সুবিধে যখন পেয়েছে।

বরকর্তার হুকুম মানতে হলে, হত না সারাদিন ধরে এমন আমোদ-আহাদ। সেই কোন সকালে বরকনেকে বিদেয় দিতে হত। বারবেলা পড়বার আগেই নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন তিনি। কেবলমাত্র কন্যাকর্তার কাতর আবেদন আর করুণ মিনতিতেই বারবেলা বাদে যাত্রা করতে রাজী হয়েছেন।

কন্যাকর্তা করজোড়ে জানিয়েছেন, বাসি বিয়েটিরের নানা ঝঞ্ঝাট, পেরে উঠবে না মেয়েরা, অনুগ্রহ করে এ বেলাটা

অতএব অনুগ্রহ করে এ বেলাটা কন্যাকর্তাকে কুটুম্ব-সেবার পুণ্য অর্জন করবার সুযোগ দিতে সসৈন্যে রয়ে গেলেন বরকর্তা। খানিকটা দূরে ঘোষেদের বৈঠকখানা বাড়িতে তাঁদের থাকার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে, কনের বাড়ির মেয়েদের কলহাস্য সেখানে পৌঁছবার ভয় নেই। সারা বেলাটা বাসি বাসরে বসে আমোদ-আহ্লাদ করছে মেয়েরা, বারবেল কাটলে তখন বাসি বিয়ে। ততক্ষণে হয়তো আসল মানুষটা এসে যাবে। বরকনে বিদেয় দেরি হলেও ভাবনা কিছু নেই। বরের বাড়ি কলকাতায় হলেও, আপাতত বিয়েটা হচ্ছে এ পাড়া ওপাড়ায়, এ বিয়ের প্রধানা ঘটকিনীর বাড়ি থেকে। সুবিধে যৎপরোনাস্তি।

এই হুল্লোড়কারিণীরা বেশীর ভাগই পাড়ার বৌ-ঝি। তবে নিতান্ত তরুণী নয়, কিছুটা মাঝবয়সী।

যদিও জ্যৈষ্ঠের দুপুর, তবু বিয়েবাড়ি বলে কথা। চেলি বালুচরী, পাশী জামদানী, যার যা আছে পরে এসেছে এবং গলদঘর্ম হচ্ছে। যদিও একখানা করে ফুল কোচানো সুতি শাড়ি এনেছে হাতে করে, খেতে বসবার সময় পরতে। তা খাওয়ার এখন বিলম্ব আছে। বরযাত্রীদের ভোগরাগ মিটলে তবে তো!

কিন্তু নিরঙ্কুশ সুখ কোথায়?

ওদের হিহি ধ্বনিতে বিরক্তচিত্ত ক্ষ্যান্ত ঠাকরুণ রঙ্গমঞ্চে এসে আবির্ভূত হন। এবং বলাই বাহুল্য মুহূর্তে সে মঞ্চে শ্মশানের নীরবতা নামে। ক্ষ্যান্ত ঠাকরুণ সেই নীরবতার প্রতি একবার তীব্র দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে বলে ওঠেন, হাসির ঘণ্টাবাদ্যি যে হাটতলা অবধি পৌঁচুচ্ছে, একটু রয়েসয়ে আমোদ করলে ভাল হয় না?

নীরবতা আরও গম্ভীর হয়।

ক্ষ্যান্ত ঠাকরুণের দৃষ্টি পড়ে মূল নায়ক-নায়িকার ওপর। একজন ধরাপড়া চোরের মত হেঁটমুণ্ড অবনতনেত্র, আর একজন রোরুদ্যমানা। কুণ্ডলী পাকানো চেলিমোড়া শরীরটা তার কান্নার উচ্ছ্বাসে কেঁপে কেঁপে উঠছে।

দৃশ্যটি অবলোকন করে ক্ষ্যান্ত ঠাকরুণ সস্মিত মুখে বলেন, ছুঁড়ি যে কেঁদে কেঁদে আধখানা হয়ে গেল কাল থেকে! তোরা একটু বুঝ দিচ্ছিস না? আপনারাই হাসি-মস্করায় মত্ত।

এবার নীরব মঞ্চে শব্দ ওঠে।

একটি ঝিউরি মেয়ে বলে ওঠে, এ কান্না কি আর বুঝ দিলে থামে পিসি! তায় আবার ও

পিসি ঝঙ্কার দিয়ে ওঠেন, নাও রঙ্গ! তোরা যে আবার মনসায় ধুনোর ধোয়া দিতে বসলি। কেঁদে কেঁদে মুখ-চোখের চেহারা যে খোলতাই হচ্ছে একেবারে। শ্বশুরবাড়িতে আর বৌ দেখে কেউ বলবে না সোন্দর মেয়ে। নে এবার ওঠা, মুখে-চোখে জল দেওয়া, এবার তোর বারবেলা কেটে এল, বাসি বে’র তোড়জোর কর। মেয়েজন্ম শ্বশুরবাড়ির জন্যে।

মেয়েটা ফিক করে হেসে ফেলে বলে, তুমি আর বলবে না কেন পিসি? শ্বশুরবাড়ি যে কী বস্তু তা তো আর জানলে না কখনো!

আমি? আমার সঙ্গে তুলনা? মরণদশা দেখো ছুঁড়ির! আমার মতন অবস্থা যেন অতি বড় শত্রুরও না হয়। ….নে আদিখ্যেতা রাখ, যোগাড়ে মন দে।

আর একবার কড়ি খেলানো হবে না পিসি?

হবে, হবেই তো! বারবেলা গেল। দেখ ততক্ষণে যদি কলকাতার মানুষরা এসে পড়ে। হুটুককার এক বে! সবই বিচ্ছিরি! তোল তোল ছুঁড়িকে, চেলির গরমে ভিরমি না যায়।

ক্ষ্যান্ত ঠাকরুণ প্রস্থান করেন।

মেয়েরা কনেকে টেনে সোজা করে বসাবার চেষ্টা করে, কিন্তু সফলকাম হয় না। কেঁদে প্রাণ বিসর্জন দেবে এই যেন তার পণ। বাস্তবিকই আর তাকে সুন্দর মেয়ে বলে চেনা সম্ভব হচ্ছে না।

কিন্তু তাতে কি!

এটা তো স্বাভাবিক ঘটনা। বিয়ের কনে কাঁদবে না?

আমোদকারিণীরা এতে বিচলিত হবে কেন? তারা আর একবার সেই ব্যর্থ চেষ্টার পুনরাভিনয় করতে বসে। জনাচারেক মিলে তুললে আর ওই ছোট মেয়েটাকে কায়দা করতে পারবে না? ছুঁড়ুক সে হাত-পা, করুক না দাপাদাপি, ওরা কেন স্ফুর্তি ছাড়বে? হিহি হিহি হিহি!

ক্ষ্যান্ত ঠাকরুণের নিষেধের সম্মানার্থে হাসিটা শুধু এবার ঈষৎ চাপা।

ওদিক থেকে তোড়জোড়ের সুর উঠছে, দৈ–দৈ কোথায়? যাত্রার দৈ দেখছি না তো?… কী অব্যবস্থা বাবা, কী অব্যবস্থা! ঘট আছে তো পান নেই, পান আছে তো দৈ নেই…ওগো অ জেঠি–প্রশ্নকারিণী তৃণভর্তি প্রশ্নবান নিয়ে নিক্ষেপ করতে করতে এগিয়ে যান, আসল মানুষের তো দর্শন নেই, কনকাণ্ডুলিটা দেবে কে? হ্যাঁগা, বাসিবিয়ের বরণে তোমাদের পানের বরণ আগে না জলের বরণ আগে?… ওমা, নতুন গামছা দিয়ে তোমরা ‘সোহাগ আঁচল’ নুটোও? কী অনাছিষ্টি বাবা! আমাদের তো হলুদ ছোপানো সুতোর গোছা দিয়ে–

কে কাকে বলে এখান থেকেই বোঝা যায়, কারণ সবই পাড়ার লোক নিয়ে কাজ।

প্রশ্নকারিণী যে ক্ষ্যান্ত ঠাকরুণের ভাইঝি অন্ন, বুঝতে বাকী থাকে না কারো। অন্নর গলাই বুঝিয়ে ছাড়ে। ঝিউড়ি মেয়ে গলা তুলবে বৈকি, যত ইচ্ছে তুলবে।

অন্নর প্রশ্নের উত্তর আসে কোনো নারী-কণ্ঠের ভারী স্বরের মাধ্যমে।…

আমাদের ওই গামছার খুঁইে সোহাগ আঁচল, যে বাঁশের যে ধারা!… জলের বরণ আগে না পানের বরণ আগে তোর পিসিকে জিজ্ঞেস কর, সেই ঠিক বিধেন দেবে।

সঙ্গে সঙ্গে ক্ষ্যান্ত ঠাকরুণের ব্যাজার কণ্ঠ বেজে ওঠে, হ্যাঁ, চিরকাল ওই বিধেন দিয়ে এলো ক্ষ্যান্ত বামনী! হাত দিয়ে তো আর পশ্য করবার আইন নেই। আমার কেবল গলাবাজির চাকরি। শাখাউলি এয়ো সোহাগীরা হাত নেড়ে সুয়ো! চল দেখি–

ওদিকে খাটো গলায় কে একজন বলে ওঠে, দেখ দেখ, এয়োদের শাঁখা সিঁদুরে দিষ্টি দেওয়া দেখ! দুগগা দুগগা, দিষ্টি তো নয়, বিষের দৃষ্টি। শনির নজর! নিজে আজন্ম বোগনো বেড়ি নাড়লেন কিনা, তাই খাওয়া-পরা দেখে হিংসেয় চোখ জ্বলে মরে।

ঝট করে উঠে যায় একজন।

বোধকরি ক্ষ্যান্তর সুয়ো সে। অথবা “সুযোগিরি” করাই তার পেশা। টাটকা-টাটকা লাগিয়ে দিয়ে যদি একটা ধুন্ধুমার কাণ্ড ঘটানো যায় সেটাই লাভ। কাজকর্মের বাড়িতে এমন হয়েই থাকে। বহুবিধ কথার চাষ চলে, এবং সেই চাষের ফসল রাম-রাবণের পালা ডেনে আনে। সে পালায় শুধু পক্ষ নেওয়ার অপরাধেও অনেক মান-অভিমানের গান হয়, অনেক সখী-বিচ্ছেদ ঘটে যায়।

তবে এ সমস্তই মেয়েমহলের ব্যাপার। পুরুষদের কানে এসব পৌঁছায় না। পৌঁছলেও তারা কান দেন না। তাদের কর্মক্ষেত্রে অন্যত্র। তাদের কর্মক্ষেত্র ব্যাপক। কোনো একটা ঘোট তুলে বিয়েটা পণ্ড করা যায় কিনা, সেই চিন্তার মাথা খাটে তাঁদের …..

বিশেষ করে মেয়ের বিয়ের!

তা বলে সকলের কি আর?

কি করে কুটুমের কাছে কন্যাকর্তার মুখটা থাকবে, কি করে বরযাত্রীদের সঙ্গে সম্প্রীতি সম্বন্ধ থাকবে, এর জন্যেও অনেকেই তৎপর হন। পরের কাজে প্রাণপাত করতে এগিয়ে আসে, এমন লোকও আছে বৈকি জগতে। নইলে আর জগৎটা এখনো টিকে আছে কিসের জোরে?

হয়তো সংখ্যায় এরাই বেশী।

কিন্তু জলের থেকে আগুনের, সুধার থেকে বিষের এবং হিতের চেয়ে অহিতের দাপটটা বেশী বলে এদের সংখ্যাই কম মনে হয়। প্রতিভার প্রাবল্য না থাকলে তো আর পাদপ্রদীপের সামনে আসা যায় না।

সে যাক, হিতৈষীর সংখ্যা যত বেশীই থাকুক, কার্যকাল কন্যাকর্তার মাথা ঘোরেই। এ বাড়ির কন্যাকর্তার মাথাও ঘুরছে, বন্ করে ঘুরছে।

কিন্তু সে মাথা ঘোরা কি কেবলমাত্র কুটুম্বর কাছে সম্মানরক্ষার চিন্তায়?

নাঃ, তার মাথা ঘোরার কারণ অন্য!

তা ছাড়া ভয়ের তো খানিকটা কেটেই গেছে, বরযাত্রীদের মানসম্মান রক্ষা করে বিয়ে তো মিটেই গেছে, আজ বাসিবিয়ে। এই তো মেয়েরা কনেকে আঁচলে ঢেকে ঘিরে খিড়কিপুকুর স্নান করিয়ে নিয়ে এল। এখন শুধু বরপক্ষকে নম নম করে কনেবিদেয় করে ফেলতে পারলেই আপাতত ভয় যায়। অবিশ্যি তেমন শত্ৰুজন থাকলে বরপক্ষের কান ভারী করে শেষরক্ষে করতে দেয় না। বরকর্তা চোখ গরম করে শুধু বর নিয়ে চলে যাবার হুমকি দেখায়…হয় অনেক কিছু।

কিন্তু এক্ষেত্রে সে সব কিছুরই আশঙ্কা নেই। এখানে শত্রুজনের আশঙ্কা নেই।

তবু কন্যেকর্তা সকাল থেকে হন্যে হয়ে ঘরবার করছে। ঘর থেকে দাওয়া, দাওয়া থেকে উঠান, উঠান থেকে বাড়ির বাইরে। ক্রমশ এগোতে এগোতে বকুলতলার মোড়।

জ্যৈষ্ঠের দুপুর, রোদ যেন গিলে খেতে আসছে, ওই বকুলতলাটুকুই যা ছায়াময়। তবু আগুনের হলকা ছিটানো বাতাস তো বইছেই। তাকে তো আর রোধ করা যায় না।

তবু নেশাগ্রস্তের মত দাঁড়িয়েই আছে মানুষটা, নড়ছে না। কেবল মাঝে মাঝে গলা বাড়িয়ে ডিঙি মেরে দূরের কি যেন দেখবার চেষ্টা করছে।

সন্দেহ নেই কোন কিছুর প্রতীক্ষা করছে। কিন্তু কিসের? আহ্লাদজনক কিছুর বলে তো মনে হচ্ছে না। ক্রমশই একটা আতঙ্কিত উদ্বেগের ছাপ ফুটে উঠছে ওর মুখে। এখন কোনো কবরেজ যদি ওর নাড়ি দেখতে তো নাড়ির চাঞ্চল্যে উদ্বিগ্ন হত।

কাঠগড়ায় এসে দাঁড়ানোর পূর্ব-মুহূর্তে কি আসামীর নাড়িতে এই চাঞ্চল্য জাগে?

কিন্তু প্রতীক্ষার তো শেষ হচ্ছে না।

ওই দূরবর্তী পথের শেষে কী আছে? কী আসবে?

একটা লালডুরে পরা ছোট মেয়ে ছুটে এসে ডাক দিল, অ বামুনকাকা, বামুন ঠাকুমা ডাকছে তোমায়?

বামুনকাকা বিরক্ত স্বরে বলে, কেন?

জানি না। বলছে যে ‘লগন’ উত্তীরনো হয়ে যাচ্ছে, এরপর কালবেলা না কি পড়ে যাবে।

যাক। বরে কনের বাবা চোখটাকে তীক্ষ্ণ করে আরো একবার দূর প্রান্তরের ওপারে দৃষ্টিটাকে পাঠাবার চেষ্টা করে। এই জ্বলন্ত মাঠের দাবদাহের ওপারে কি একমুঠো ধোয়াটে ছায়ায় আভাস পাওয়া যাচ্ছে?

নাকি দৃষ্টির ভ্রম?

ভ্রম নিরসন পর্যন্ত অপেক্ষা করা যায় না, মেয়েটা আরও একবার বলে ওঠে, এসো তাড়াতাড়ি! ভটচায মশাই নাকি রাগারাগি করছে! ডেকে নিয়ে মেয়েটা আবার ছুটে ভিতরে চলে যায়। আর কেন কে জানে, সেই দিকে তাকিয়ে কনের বাবার বুকের মধ্যেটা লঙ্কাবাটের জ্বালার মত হু-হুঁ করে জ্বলে ওঠে।

কেন?

প্রায় ওরই কাছাকাছি বয়সী নিজের সদ্য উৎসর্গীকৃত বালিকা কন্যার মুখটা স্মরণ করে? আর দণ্ড দুই পরেই মেয়েটাকে বিদায় দিতে হবে, নির্বাসন দিতে হবে একটা অপরিচিত অন্তঃপুরের অন্তরালে, স্তব্ধ হয়ে যাবে তার উচ্ছল কলকাকলী, হয়তো বাপের কাছেও অপরিচয়ের অবগুণ্ঠন টানবে?

এতে যে বিচলিত হবার কিছু নেই, এটাই যে চিরাচরিত নীতি, ওর মাও তাই করেছে, দিদিমা ঠাকুমাও করেছে, এ যুক্তি জ্বালা কমাতে পারল না, বুকের মধ্যেটা মাচড় দিয়ে উঠতে লাগলো।

আবার হয়তো শুধুই কন্যা-বিবাহ-ব্যাকুল পিতৃহৃদয়ের জ্বালাটাই সব নয়, ভয়ানক একটা অপরাধবোধও বুকের ভিতরটায় খাবল মারছে বুঝি।

অপরাধ না করেও তার বোধ কেন?

ন্যায্য কাজ করেও আতঙ্ক কেন?

লোকটা যাচ্ছেতাই রকমের ভীতু তাতে আর সন্দেহ নেই।

ভিতর থেকে আবার ছুটে আসে মেয়েটা, ভীত-ত্রস্ত গলায় বলে, অ বামুনকাকা, তোমার মা যে রসাতল করছে গো! বলছে, মহারাণী না আসা অবধি কি রাজকার্য বন্ধ থাকবে?

নাঃ, এরপর আর দাঁড়িয়ে থাকা চলে না। দ্রুতপায়েই ছুটতে হয় বামুনকাকাকে।

.

অথচ আর একটু দাঁড়ালেই হয়তো প্রতীক্ষারত মূর্তিটা দেখানো যেত। কারণ রুক্ষতপ্ত জ্বলন্ত প্রান্তরের ওপার থকে ধোয়া-ধোয়া ছায়াটা ক্রমেই এগিয়ে আসছে, একটা অবয়ব নিচ্ছে।

ওই জ্বলন্ত অনলের প্রকোপেই গরুগুলো গড়গড়িয়ে এগিয়ে আসতে পারছে না। গাড়োয়ান যতই কটুক্তি বাক্যের সঙ্গে সঙ্গে তাদের ল্যাজমোড়া দিক, তারা যেন পিছিয়েই পড়ছে।

সদু ছাইয়ের ভিতর থেকে গলা বাড়িয়ে বার বার উদ্বিগ্ন গলায় বলছে, অ ছেলে, তোমার বলদরা যে পিছুনে বাড়ছে গো! আমাদের যে বড় তাড়া–!

গাড়োয়ান ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলে, কী করবো বলেন ঠাকরেন, দেখছেন তো, চেষ্টা তো করছি সাধ্যমত। ব্যাটারা দৌড়চ্ছে কই? সূয্যি ঠাকুর একেবারে আগুন হানছে কিনা!

ক্ষুব্ধ বাক্য উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গেই গাড়োয়ান প্রবল একটা বাড়ি হানে বদল দুটো হড়বড়িয়ে এগিয়ে যায় খানিকটা। সাধন সরল এই অতর্কিত আক্রমণে টাল রাখতে না পেরে কাত হয়ে যায়, আর সত্য ছইয়ের বাঁশটা শক্ত করে চেপে ধরে শ্রান্ত গলায় বলে, থাক ঠাকুরঝি, আর সত্য ছইয়ের বাঁশটা শক্ত করে চেপে ধরে শ্রান্ত গলায় বলে, থাক ঠাকুরঝি, আর তাড়া দিয়ে কাজ নেই। শেষকালে কি গো-হত্যে হবে?

সদু দুর্গা দুর্গা করে ওঠে।

গাড়ি এবার একটু দ্রুত বেগ নেয়, পরিচিত পথের স্পর্শ পাওয়া যায়।

কিন্তু আজও এমন ঘুঘু ডাকে কেন?

সত্যর সঙ্গে হঠাৎ এমন শত্রুতা সাধবার হেতু কি ওদের?

আচ্ছা ঘুঘুর ডাক না মানুষের কান্না?

অনেকগুলো নারীকণ্ঠের হুঁ হুঁ ধ্বনি না?

এ কান্নার উৎস কোন্ দিকে? গাড়ি যত বাড়ির নিকটবর্তী হচ্ছে, শব্দটা ততই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে!

না, সত্য আর কিছু শুনবে না, ভাববে না।

যতক্ষণ না শ্মশানক্ষেত্রে গিয়ে পৌঁছেচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত কানকে আর মনকে নিষ্ক্রিয় রাখবার সাধনা করবে।

.

উলু, উলু উলু! মুহুর্মুহু উলু পড়ছে।

সমবেত নারীকণ্ঠের উলুধ্বনি বিয়ের ঘটার অভাবটা পূর্ণ করতে চাইছে যেন।

বাসিবিয়ের সবই টাটকার উল্টো।

বাসিবিয়ের কড়িখেলার সময় আগে বর কড়ি চালে, পরে কনে। বরণ আগে কনেকে করতে হয়, পরে বরকে। বরণকত্রীও বদল হওয়া রীতি। যিনি গতকাল বিয়ের বরণকার্য সমাধা করেছেন, তিনি আজ আর মঞ্চে নেই। নতুন নায়িকার সন্ধান হচ্ছে।

কে করবে তবে? অন্ন? তা অন্নই আয় মা! একখানা চেলি-টেলি জড়িয়ে আয়, বরনডালাটা ধর।… বাজুবন্ধ নেই তোর? ঝুমকোদার তাবিজ? না থাকে, আর কারুর নে পর একজোড়া বরণ করবার সময় তাবিজ বাজু পরলে শোভা ছড়ায়।

কে একজন সক্ষোভে বলে ওঠে, আহা, মা-মাগী কিছু দেখতে পেল না! কিছু করতে পেল না! মরে যাই! এখনো এসে পড়লে বাসি-বরণটা করতে পারতো!… কপালে নেই!

কপাল!

তা কপাল ছাড়া আর কোন্ সাগরে গিয়ে আত্মসমর্পণ করবে আক্ষেপের নদীরা?

কপালে গিয়েই তো সব প্রশ্নের পরিসমাপ্তি।

তাই কপালে’র হাতে সমস্ত ঘটনাকে নিবেদন করে আক্ষেপকারিণী অন্নর বাজুবন্ধের ঝুমকোর ফাস টেনে শক্ত করে দিতে এগিয়ে আসে।

আবার উলু ওঠে, ক্ষুদে একটা মেয়ে গিন্নীদের থেকেও প্রবল দাপটে শাখে ফুঁ দেয়, গিন্নীরা সকলে একত্রে কথা শুরু করেন, আর সহসাই সেই প্রবল কলকল্লোল ছাপিয়ে একটা রব ওঠে, এসেছে, এসেছে, এসে গেছে!

অনেকগুলো কণ্ঠ আহাদের রোল তুলে গাড়ির ধারে এসে দাঁড়ায়, এতক্ষণে আসা হল?… বাবা, সকাল থেকে পথপাণে চাইতে চাইতে বাড়িসুদ্ধ লোকের চোখ ক্ষয়ে গেল! আর একটুখানি আগে এসে পড়লে ‘জামাই’-বরণটা হতো শাশুড়ীর হাত দিয়ে! যাক–তবু মন্দের ভালো, শেষমেষ চোখের দেখাটাও হবে একবার!

কে এরা?

কি বলতে চাইছে?

কাকেই বা বলছে?

শেষে একটিবারের জন্যে চোখে দেখার মত করুণতম সুখের আশ্বাসের সঙ্গে এই উৎসব মুখরতা কি মানানসই?

.

সত্য কেন এমন অমঙ্গলের ভয়ে কাঁটা হয়ে আছে? চারিদিকে সবই তো মঙ্গলচিহ্ন।… দোরে মঙ্গলঘট, বার-উঠোনে আলপনার ছাপ, ভিতর-উঠোনে সামিয়ানা টাঙানো। সব কিছুই প্রখর রোদে সাদা আলোয় জ্বলজ্বল করে জ্বলছে।

সব শুভ চিহ্ন!

কিন্তু কেন? সাধন তো সত্যর সঙ্গেই রয়েছে। পাকা দেখার মত আরও কোনো ঘটা আছে নাকি এদের কুপ্রথায়? তারই আয়োজন, প্রস্তুতি…. সদু শুধু মজা দেখবার জন্যে এমন হুড়িয়ে নিয়ে চলে এলো!

উৎকট একটু মজা!

কিন্তু উলুর শব্দগুলো এত বিশ্রী লাগছে কেন? ঘুঘুর ডাকের মত কান্না-কান্না! চিরকালই তো মেয়েমানুষের এই বুনো উল্লাসধ্বনি শুনে এসেছে সত্য। খারাপ লাগে, খারাপ লেগেছে, কিন্তু শুনে বুকের ভেতরটা এমন ফোপরা ফোপরা তো লাগে নি।

সেই একটা আলোক-ঝলকানো মুখ কই? সত্যর আসার খবরে ব্যগ্র দুখানা পুষ্টনিটোল কচি হাত কেন দিগ্বিদিক জ্ঞানহারা ভঙ্গীতে ছুটে এসে সত্যকে জড়িয়ে ধরছে না?

আর….আর সেই চিরপরিচিত মুখটা? যে মুখ চিরকাল বিরাগ আর অনুরাগ–এই পরস্পর বিরোধী দুটো আকর্ষণে নিজেকে অপরিহার্য করে রেখেছে সত্যর কাছে?

ঝাপসা-ঝাপসা ছায়া-ছায়া একটা অনুভূতি নিয়ে এলোকেশীর উঠোনে এসে ঢোকে সত্য। অথবা পায়ে হেঁটে ঢোকেও না। অনেকগুলি মহিলা এবং বালক-বালিকার ঠেলাঠেলির ধাক্কায় এসে পোঁছে যায়।

আর পৌঁছেই পাথরের চোখ নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে।

.

আজন্মের দেখা বাঙ্গালি ঘরের চিরপরিচিত সেই ছবিখানা কে এঁকে রেখেছে সত্যর দেখার জন্যে? কিন্তু কে ও? কে?

.

বরকনে, কলাতলা, কুলো ডালা মাথায় এয়োর দল, এইসব চিরপরিচিত দৃশ্যের মাঝে কে ওই অপরিচিতা?

যার লাল চেলির ঘোমটা খসে পড়েছে নীতি-নিষেধ ভুলে?

ও মুখ কি কখনো দেখেছ সত্য? দেখেছে ওই একজোড়া আহত পশুর চোখ?

দেখে নি, জীবনে কখনো দেখে নি। এই অপরিচয়ের আঘাতে সত্যর চোখও তাই পাথর হয়ে গেছে।

.

কিন্তু কানটাও একেবারে পাথর হয়ে গেল না কেন সত্যর? কেন এত সব অচেনা গলার কথা কানে আসছে?

নবু, নবু এখন আবার কোথায় গেলি? এত ক্ষণ তো বৌ-বৌ করে ঘরবার করছিলি!…কনকাঞ্জুলির টাকাটা কাকে দিলি? হাতে মুখে একটু জল দাও বৌমা, গাড়ির কাপড়টা ছেড়ে এসে মেয়ে-জামাইকে আশীৰ্বাদ করো।…আহা, কাল এসে পৌঁছতে পারলে না বৌমা। একটা মাত্তর মেয়ে, বে’টা দেখতে পেলে না! আসবেই বা কি, খবর তো পেলে না সময়ে? তোমার শাউড়ী এত হুটুককারি করে দিলে বিয়েটা, যেন বিয়ে পালিয়ে যাচ্ছিল। … তা যাক, বিনি খাটনিকে সোনার চাঁদ জামাই পেয়ে গেলে! দুটিতে কেমন মানিয়েছে দেখো!…. বিয়ে খাসা হয়েছে, জ্বাজ্বল্যিমান সংসার জানাশুনোর মধ্যে!

সত্যর মাথার মধ্যে ইঞ্জিন চলছে–কথাগুলো ক্রমশ যন্ত্রের শব্দের মত ঠন ঠন করে বাজছে…যাই ভাগ্যিস নবুর সঙ্গে মেয়েটাকে পাঠিয়েছিলে, আর ঠিক সেই সময় তোমার শাউড়ীর সইয়ের মেয়ে মুক্ত এসেছিল বেড়াতে, তাই না যোগাযোগ হয়ে গেল! তোমার রূপসী মেয়ে দেখে মুক্ত একেবারে গলে গেল! বলে এ মেয়ে আমি বৌ না করে ছাড়ব না! ছেলের বুঝি আষাঢ় মাসে জন্মমাস, তাই এই জ্যোষ্টিতেই সেরে ফেলে বাঁচালো। তোমার শাউড়ীও তো মেয়ের আগে ছেলের বে দেওয়া নিয়ে নবুকে না ভূতো ন ভবিষ্যতি করছিল। নবু ভয়ে ভয়ে…ও কি অ সদু, বৌমা অমন নিশিতে পাওয়ার মত পিঠ ঘুরিয়ে চলে যাচ্ছে কোথায়? শরীর তো ভাল দেখাচ্ছে না, নাই বা গেল এখন ঘাটে। বাড়িতে এক ঘটি জল নিয়ে….ওমা ওমা, অ সদু, বৌমা যে বকুলতলার দিকে চললো! ওদিকে কি? অ নবু ওরে অ খোকারা, খোকারা তোদের মা ফের গাড়িতে গিয়ে উঠতে চায় নাকি?

পালিয়ে বেড়ানো নবু এতক্ষণে সমাজে দেখা দেয়। দেয় সদুর সামনে। ভয়-ভরা গলায় বলে ওঠে, বিয়ের কথা জানাও নি তোমাদের বৌকে?

কে জানে কেন, সদু হঠাৎ এখন কঠিন হয়! কঠিন গলায় বলে, না, জানাই নি!

তাই! তাই বুঝছি! না বলে নিয়ে এসেই এইটি হল! … নবকুমার রাগ রাগ গলায় বলে, এ কী আশ্চয্যি! আগে এলে বিয়েয় বাধা দিত, তাই জানানো হয় নি, এখন না বলে নিয়ে আসার মানে? বলতে কী হয়েছিল?

চিরদিনের সহিষ্ণু সদু হঠাৎ এমন অসহিষ্ণু হয়ে উঠল কেন? সদু যেন আরো কঠিন হচ্ছে। কঠিন আর কঠোর গলায় বলছে, বলতে কী হয়েছিল সে বোঝবার ক্ষমতা তোর থাকলে তো বলবো? ঢের দিন ঢের অন্ন খেয়েছি তোদের, তার ঋণ শুধতে বৌকে সঙ্গে এনে পৌঁছে দিয়ে গেলাম তোদের হাতে! তবে কসাইয়ের কাজটা করি নি কেন, এ বলে আর চোখ রাঙাসনে! মুখ দেখে বুঝছি আর এ ভিটেয় জলস্পর্শ করবে না ও, ফিরে যাবে! আমিও চললাম ওর সঙ্গে

সদুও দ্রুতপায়ে বেরিয়ে যায়।

বকুলতলার দিকেই যায়।

আর বিয়ের কনেটাও একটা অদ্ভুত পরিস্থিতি ঘটিয়ে বসে। হঠাৎ সেই কলতলাতেই বসে পড়ে বরের সামনেই হাউ হাউ করে কেঁদে ওঠে, কেন তোমরা এই সব করলে আমার! মা আমায় মেরে ফেলবে! মার পিছু পিছু যাবে তার উপায় নেই, আঁচলের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধা।

অমোঘ অচ্ছেদ্য বন্ধন! অনন্তকালের ওপার পর্যন্ত নাকি যার ক্ষমতা…ক্ষেত্র বিস্তৃত!

.

সমস্ত পশ্চিম আকাশটা জুড়ে লালের সমারোহ, সেই লাল ছড়িয়ে পড়েছে মাঠে পুকুরে গাছপালায়।

….লটকে পড়া গরু দুটো ঘাসজল আর পড়ন্ত বিকালের স্নিগ্ধ হাওয়া পেয়ে আবার সতেজ হয়ে গড়গড়িয়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছে গাড়িখানাকে।

আজকের সন্ধ্যার মধ্যে বামুনপাড়ার এই বড় মাঠটা পার করে নিয়ে যেতে হবে এই নির্দেশ। তারপর যদি চলা নিতান্ত অসুবিধে হয়, হাটতলার ওদিকে বিশ্রাম নিলেই হবে। ঘোড়ার গাড়ি জুটে গেলে মঙ্গল।

.

অনেক দিন আগে একদিন রামকালী কবরেজ এ গ্রাম থেকে ধুলোপায়ে বিদায় নিয়েছিলেন।

আজ রামকালী কবরেজের পিতৃভক্ত মেয়ে বাপের সেই কাজের অনুকরণ করলো।

রামকালী কবরেজের সঙ্গে ছিল নিজের পালকি। তাঁর মেয়ের তা নেই। তাই অনিচ্ছুক গাড়োয়ানটাকে ঘুষ দিতে হয়েছে। বাঁ হাতটাকে তাই তার এখন শুধু শাখা আর লোহা। মোটা হাঙরমুখো বালাগাছটা নেই।

ওটাই ছিল হাতের কাছে, হাতছাড়া হয়েছে।

কিন্তু কতই বা দাম ওটার? সত্যকে সেই তার অনন্তকালের বন্ধন থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে যাবার পক্ষে কি খুব বেশী?

ছাড়িয়ে নিয়ে, গ্রাম ছেড়ে চলেছে সত্য।

কিন্তু এই ছাড়িয়ে নিয়ে যাওয়াটা কি নিতান্ত সহজে হয়েছিল?

না, তাই কি হয়? হয় না। প্রায় গ্রামসুদ্ধ সবাই এসে গাড়িখানাকে ঘিরে ধরে নিবৃত্ত করতে চেষ্টা করেছিল বৈকি।

সত্য তাদের কথা রাখে নি।

সত্য শুধু শান্ত স্বরে একই কথা বলেছে।

বলেছে, বৃথা কেন কষ্ট করছেন! যে উপরোধ রাখতে পারবো না

শেষ পর্যন্ত এলোকেশীও এসেছিলেন। হাতজোড়ের ভঙ্গী করে বলেছিলেন, রাখতে পারবে না মানে রাখবে না, এই তো! তা আমি এই শাশুড়ী হয়ে তোমার কাছে হাত জোড় করে খাট মানছি বৌমা, অপরাধ মার্জনা করো। অন্যাই হয়েছে আমার, একশোবার অন্যাই হয়েছে স্বীকার পাচ্ছি সে কথা। বুঝতে পারি নি মেয়ে নবার নয়, একা তোমার, বুঝে তাই ঠাকমাগিরি করে ওর উবগার করতে গিয়েছিলেম!…. যাক যা হবার তা তো হয়ে গেছে, বে’ তো আর ফিরবে না, কেন আর গেরাম জানিয়ে কেলেঙ্গারটা করছো?

সত্য স্থির হয়ে বসেছিল, সত্য নিজেকে সংযত রেখেছিল। সত্য শুধু অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল।

আর নবকুমার?

এলোকেশীর ছেলে?

সে কি আসে নি মান ক্ষুইয়ে মান ভাঙাতে? নবকুমার আসবে বৈকি! নবকুমার আসবে না, এ কি হয়? শেষ অবধি এসেছিল। নবকুমারও প্রায় হাতজোড় করেছিল, যা হয়ে গেছে তার তো চারা নেই, তবে কেন–

এলোকেশীর সঙ্গে না হোক, এলোকেশীর ছেলের সঙ্গে কথা বলেছিল সত্য। বলেছিল, চারা আছে কিনা সেইটাই শুধু ভাববো বসে বসে বাকী জীবনটা ধরে।

বাকী জীবনটা ধরে!

বাকী জীবনটা ধরে শুধু এই কথাটা ভাববে তুমি?

সত্য সেই ক্ষুব্ধ হতাশ ভিক্ষুক চোখ দুটোর দিকে তাকিয়েছিল নিজের পাথর হয়ে যাওয়া চোখ দুটো দিয়ে।

তাকিয়ে থেকে কেমন একটা অনুভূতিহীন গলায় বলেছিল, বাকী জীবনটুকু কি খুব বেশী হল? অনেকগুলো জন্ম ধরে ভাবলেই কি সে ভাবনার শেষ হবে? উত্তর পাওয়া যাবে?

নবকুমার হতাশ গলায় বলেছিল, তোমার সব কথার মানে আমি কোন কালেই বুঝতে পারি না, এসবও বুঝতে পারছি না, কিন্তু একটা কথা জিজ্ঞেস করি, সুবর্ণই তোমার সব? তুড়ু খোকা এরা কেউ নয়?

কে কতখানি, সেটাও তো ভেবে বার করতে হবে!

চিরদিনই দেখলাম মায়া মমতা তোমার কাছে কিছুই নয় জেদটাই বড়। তবু মিনতি করে বলছি, এই একবারের জন্যে অন্তত সে জেদ ছাড়ো আমার মুখ চেয়ে।

আমায় মাপ করো।

সত্য মাথার কাপড়টা একটু টেনে নিয়েছিল।

নবকুমার কান্নায় ভেঙে পড়েছিল।

কোঁচার খুঁট তুলে চোখ মুছেছিল।

কিন্তু সত্য তো চিরদিনই নিষ্ঠুর।

আর আমি রাগের ঠাকুর থাকবো না প্রতিজ্ঞা করলেই কি স্বভাবটা বদলাতে পারবে?

সত্য তাই নবকুমারের মুখ থেকে চোখ না নামিয়েই বলে, তিরিশ বছর ধরে তো তোমার মুখ চেয়ে এলাম, শেষটায় একবার নিজের দিকে চাইবার ইচ্ছে হয়েছে।

তোমার সুবর্ণকে একবার আশীর্বাদও করে যাবে না?

সত্য কি বিদ্যুতের আঘাত পেল?

সত্যর মা ভুবনেশ্বরী একবার ঠিক এই রকম একটা প্রশ্নে বিদ্যুতের মত কেঁপে উঠেছিল না? সেই তার শেষ দিনে?

সত্য এবার নবকুমারের চোখ থেকে চোখ সরিয়ে নেয়। ধীর গলায় বলে, চিরকালের মতন চলে যাচ্ছি, বিদেয়কালে আর কেন মুখ দিয়ে কটু কথা বার করাতে চাও?

গাড়ি প্রায় এগোতে শুরু করে, তবু নবকুমার সঙ্গে সঙ্গে এগোয়, তোমার বাবা এত বিচক্ষণ ব্যক্তি, তিনিও তোমাকে আট বছরে গৌরীদান করেছিলেন, সে কথা তো কই মনে করছো না!

হঠাৎ সত্যর সেই পাথরের চোখে আগুন ঝলসে উঠেছিল।

মনে করছি না, এ কথা কে বলেছে তোমায়? জীবনভোর মনে করে আসছি। আর এবার বাবার কাছেই গিয়ে তার উত্তর চাইব!

নবকুমার তবু গাড়ির বাঁশ চেপে ধরে আছে, তোমায় আমি কথা দিচ্ছি তুড়ুর মা, তুমি যদি বল, কুটুমবাড়ির সঙ্গে একটা বিরোধ ঘটিয়ে সুবর্ণকে আবার তোমার কাছেই ফিরিয়ে এনে দেব–

সত্য হঠাৎ একটা কাজ করে বসে। এই খোলা মাঠে এর ওর সামনে হাতটা বাড়িয়ে নবকুমারের সেই গাড়ির বাঁশ চেপে ধরা হাতটা চেপে ধরে। উদভ্রান্ত গলায় বলে ওঠে, সত্যি বলছো? ফিরিয়ে এনে দেবে? এই পুতুল খেলার বিয়েটা মুছে ফিরিয়ে দেবে আমার সেই সুবর্ণকে?

সদু গাড়ির ছইয়ের মধ্যে বসে ছিল।

চুপ করেই বসেছিল এতক্ষণ।

এবার আস্তে বলে, মুছে ফেলব বললেই কি মুছে ফেলা যায় বৌ? এ কি মুছে ফেলার জিনিস? নারায়ণ সাক্ষীর বিয়ে

সত্য নবকুমারের হাতটা ছেড়ে দেয়। কেমন এক রকমের হাসি হেসে বলে, সব বিয়েতেই নারায়ণ এসে দাঁড়ান কিনা, সব গাঁটছড়াই জন্ম-জন্মান্তরের বাঁধন কিনা, এই প্রশ্ন নিয়ে বাবার কাছে যাচ্ছি ঠাকুরঝি!

সদু নবকুমারের দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলে, সে প্রশ্নের উত্তরও তো একজন্মে মিলবে না!…তুই আর কেন দেরি করিস নবু? তুই বাড়ি যা, কাজের পাহাড় পড়ে আছে তোর। আরো দেরি করে চেষ্টা করে আর কুটুমের সঙ্গে বিরোধ বাধাতে হবে না!

তবু শেষ চেষ্টা করে নবকুমার।

ফিরে যেতে গিয়েও বলে, আমি অপরাধী, আমায় শাস্তি দাও, তুড়ু তো কোন অপরাধ করে নি? ওর বিয়েটা দেখবে না?

নাই বা দেখলাম, দূর থেকে আশীর্বাদ করবো।

আর এগোনো যাচ্ছে না।

সব মিনতি ব্যর্থ করে দিয়ে গাড়িটা যাচ্ছে এগিয়ে।

সব অনুভূতির আলোড়ন ওঠে, আর সেটা ফেটে বেরিয়ে পড়ে, জানি, জানতাম কথা থাকবে না! কারুর উপরোধ রাখবার পাত্র তুমি নও! কিন্তু এই বলে রাখছি, কেউ তোমায় ঘাড়ে করে কাশী পৌঁছতে যাবে না!

সত্য কি তবে বাঁচলো?

শেষ মুহূর্তে হেসে চলে যাবার পথ পেয়ে? সেই বাঁচার গলায় তাই ওর সেই পরিচিত ভঙ্গীতে হেসে উঠলো, ওমা, আমি তা বলতেই বা যাবো কেন? ঘাড় থেকেই যখন নেবে যাচ্ছি চিরকালের মত! কারুর ঘাড়ে না চড়ে শুধু নিজের পা দুখানার ভরসায় মা বসুমতীর মাটি ছোঁয়া যায় কিনা, সেটাও তো আমার আর এক প্রশ্ন!

গাড়িকে দাঁড় করিয়ে রাখতে পারছে না গাড়ির চালক, গরুগুলো এগোতে চায়। নবকুমার যেতে গিয়ে ফিরে এসে হঠাৎ লাফিয়ে সেই গাড়ির মধ্যে উঠে পড়ে ক্ষিপ্তকণ্ঠে বলে ওঠে, এইজন্যেই বলে মেয়েমানুষের বিষয়-সম্পত্তি থাকতে নেই! বাপের দলিলের ভরসা রয়েছে তাই স্বামীর অন্ন ত্যাগ দিয়ে চলে যাবার সাহস! মেয়েমানুষের এত সাহস ভাল নয়। এই আমি বলে দিচ্ছি, অশেষ দুঃখু আছে তোমার কপালে। স্বামী হয়ে এই অভিশাপ দিচ্ছি তোমায় আমি।

এ অভিশাপ যে নিতান্তই ক্রোধ, ক্ষোভ, হতাশা, অপমান, লোকলজ্জা আর অপমানবোধ থেকে উদ্ভূত তা বুঝতে পারে বৈকি সত্যবতী, তাই নিজে সে এত বড় অভিশাপেও বিচলিত হয় না। বরং প্রায় হেসে ফেলেই বলে, তাই তো দিয়ে আসছে তোমরা আবহমান কাল থেকে। স্বামী হয়ে, বাপ হয়ে, ভাই হয়ে, ছেলে হয়ে। ওটা নতুন নয়। অভিশাপেরই জীবন আমাদের। তবে ওই যে দলিলের কথা বললে, জেনো ওই ছেঁড়া কাগজটার কথা আমার মনেও ছিল না। মনেই যখন করিয়ে দিলে তো বলি, বাবার দেওয়া বস্তু ফেলে দেওয়া বাবার অপমান। সাধন সরল যদি মানুষ হয়, ওরা যেন বিষয়টুকু থেকে ওই ত্রিবেণীতে মেয়েদের একটা ইস্কুল খুলে দেয়। আর… আর নাম দেয় যেন ভুবনেশ্বরী বিদ্যালয়।…একটু থামো বলে সত্য আঁচলটা গলায় জড়িয়ে স্বামীকে একটা প্রণাম করে বলে, জীবনভোর অনেক অকথা-কুকথা বলেছি তোমায়, অনেক জ্বালাতন করেছি। পার তো মাপ করো।

সদু মৃদু ধমকের সঙ্গে বলে, নবু, বাড়ি যা! বৌর পিছু পিছু ছুটে এসে কোনো লাভ নেই। ওর নাগাল তুই কোনো দিনই ধরতে পারিস নি, আজও পারবি না। শুধু এইটুকুই বলতে ইচ্ছে করছে, মুখ্যুই না হয় হয়েছিলি, কিন্তু ‘মমতা’ বস্তুটা কি এক কণাও থাকতে নেই রে? মাতৃ-আজ্ঞায় মেয়ে পার করতে বসবার সময় বৌর মুখটা একবার মনে পড়ল না? তিরিশ বছর একত্র ঘর করলি, বনের পশুপক্ষীর প্রতি যে মায়া জন্মায়, তা জন্মায় নি তোর?

নবকুমার দীপ্তকণ্ঠে বলে, এই বললে তুমি সদুদি? ওর কথা আমার মনে পড়ে নি? অবস্থাটা বুঝেছ আমার? দশচক্রে ভগবান ভূত হয়ে

নবু, নেবে যা। মেয়ে জামাই এখনো ঘরে, কুটুম্ব ক্ষেপে বসে আছে, অনেক কাজকর্তব্য আছে, সেখানে না গেলে চলবে না। মেয়েটার কথা ভাব।

মেয়েটা! আমি মেয়েটার কথা ভাববো নবকুমার পাগলের মত করে, স্নেহময়ী মা যে তার বুকে মুগুর মেরে রেখে এল সেটা তো কই ভাবছ না? এই যে সে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল, আর মা তার দিকে দৃষ্টিমাত্র না দিয়ে ঠিকরে চলে এল, বুক ফেটে গেল না তার? তার কোন অপরাধ আছে?

সত্যবতী আর কথা বলে না, শ্রান্তভাবে ছইয়ের ধারের বাঁশে মাথাটা ঠেকিয়ে চোখ বুজে বসে থাকে। সদু এবার দৃঢ়ভাবে বলে, নবু, তুই নাববি?

নেমে পড়ে নবকুমার।

পিছন দিকে না তাকিয়ে হন্ হন্ করে হেঁটে যায় কোঁচার খুঁটে চোখ মুছতে মুছতে।

.

গাড়ি এগোতে থাকে।

মাঠ পার হয়ে হাটতলায় এসে পৌঁছালো বলে। এখানে ঘোড়ার গাড়ি মিলবে। সরল দেখবে তার ব্যবস্থা। সাধন মার প্রতি বিরক্তবশত আসে নি সঙ্গে।…বাবা যত বড় গর্হিত কাজ করে থাকুন, মার নির্লজ্জ কেলেঙ্কারিও তার কাছে অধিক অসহ্য!…

গরুর গাড়ির মেয়াদ ফুরিয়ে আসছে, আকাশের দিক থেকে তাই চোখ ফেরাতে ইচ্ছে করছে। সমস্ত পশ্চিম আকাশটা জুড়ে লালের সোনা।…

আকাশের ওপারে কি সত্যই আছে আর এক জগৎ? তারা ওখানে কারো চিতা জ্বেলেছে? …এ তারই অগ্নি-আলো?

নাকি আগুন নয়, শুধু রং? সেখানের কোনো নববধূ তার লাল চেলিখানা মেলে দিয়েছে শেষ রোদ্দুরে!…

একসময় সদু একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলে, বিয়ে হয়েছে বলেই সব আশা ফুরিয়ে যাবে বৌ? একেবারে ত্যাগ দিয়ে চলে আসবে তুমি সুবর্ণকে? তুমিও তো বিয়ের পরই এতখানিটি হয়েছ!

সত্য সদুর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে। উত্তর না দিয়ে পারে না। আস্তে বলে, আমি যে কতখানিটা হয়েছি ঠাকুরঝি, তার প্রমাণ তো এই দেখছো!

এ তো মানুষের বিশ্বাসঘাতকতা বৌ। এ নিয়ে বিচার চলে না। কিন্তু সুবর্ণকে মানুষ করে তোলার যে বড় আশা ছিল তোমার!

সত্য আকাশের দিকে চোখ ফেলে। সেখানে কি সুবর্ণর মুখটাই খোঁজে?… সুবর্ণকে কি দেখতে পায় সত্য? তাই মন আচ্ছন্নের মত বলে, সুবর্ণ যদি মানুষ হবার মালমশলা নিয়ে জন্মে থাকে ঠাকুরঝি, হবে মানুষ।…. নিজের জোরেই হবে। তার মাকে বুঝবে। নইলে ওর বাপের মতন ভাবতে বসবে, মা নিষ্ঠুর! সে ভাবনা বন্ধ করি এ উপায় আমার হাতে নেই!

কিন্তু বৌ, তালুই মশাই সংসার ত্যাগ করে কাশীবাসী হয়েছেন, তাঁর ওপর আবার এই অশান্তির বোঝা চাপানোই ঠিক হবে তোমার?

সত্য এবার যেন তার নিজস্ব দৃঢ় ভঙ্গীতে ফিরে আসে। নিজস্ব ধরনে বলে, না ঠাকুরঝি, সে অন্যায় আমি করবই বা কেন? বাবার বোঝা হবো কেন? তারপর একটু হেসে বলে, অনেকদিন আগে সুবর্ণ যখন জন্মায় নি, পাঠশালা খুলে পড়ানো-পড়ানো খেলা করতাম মনে আছে তোমার ঠাকুরঝি! আবার দেখবো, সে খেলা ভুলে গেছি না মনে আছে? একটা মেয়েমানুষের ভাতকাপড় চলে যাবে না তাতে?

নিজের পেট নিজে চালাবি বৌ? এই সাহস নিয়ে ঘর ছাড়ছিস! সদু একটা নিঃশ্বাস ফেলে। বলে, পায়ের ধুলো নেবার সম্পর্ক নয় বৌ, তবু নিতে ইচ্ছে হচ্ছে, কিন্তু তখন যে বললি কাশীতে

হ্যাঁ, যাবো কাশীতে বাবার কাছে। সারাজীবন ধরে অনেক প্রশ্ন জমিয়ে রেখেছি, আগে তার উত্তর চাইতে যাবো।

সহসা স্তব্ধতা নামে। গাড়ি ধীরে ধীরে হাটতলায় এসে থামে। গরুর গাড়ির পথ শেষ হয়।

— শেষ—

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *