৪১. অনুতাপ-দগ্ধ সুহাসের দৃঢ় সংকল্প

অনুতাপ-দগ্ধ সুহাসের দৃঢ় সংকল্প অবশ্য কাজে লাগল না। কারণ মাত্র একটা বেলার বেশী বিছানায় শুয়ে থাকল না সত্যবতী। সুহাসের অনুনয়-বিনয় এবং নবকুমারের ব্যস্ত ভৎর্সনাকে উপেক্ষা করে উঠে পড়ল সে। বলল, ঠিক হয়ে গেছি বাবা। তোমরা আর তিলকে তাল করো না।

কিন্তু এই আকস্মিক দুর্বলতার ঘটনায় গভীর একটা চিন্তা দেখা দিল সত্যবতীর মধ্যে। সে চিন্তা স্বামী-পুত্রের জন্য নয়, ওই অনাথা মেয়েটার জন্যেই। নিশ্চিন্ত হয়ে বসে আছে সত্য, কিন্তু যদি সত্যর একটা কিছু ঘটে, ওর কি হবে? অবিশ্যি মরে এক্ষুনি যাবে সত্য তা নয়, তবু বলা কি যায়! বুড়ো বয়সে আবার যখন কেঁচে-গন্ডুষের পালা পড়ল তখন ভয় আছে বৈকি। ছেলেদের জন্যে ভাবনা নেই, ওরা প্রায় মানুষ হয়ে এল, নবকুমারের মা-বাপ আছে এখনও, হয়ে যাবে কোন ব্যবস্থা, ওই মেয়েটারই অজল অস্থল অবস্থা। ওই রূপের ডালি মেয়েকে এলোকেশী নিশ্চয়ই সুচক্ষে দেখবেন না। তা ছাড়া শুধু দেখার প্রশ্নই তো নয়। এতদিন নিশ্চিন্ত হয়ে বসে থাকার জন্য নিজেকে ধিক্কার দিল সত্য এবং পরদিন নবকুমারের কাছে একটা অসমসাহসিক আবেদন করে বসল।

সত্য মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নবকুমারেরও মাথা ঘুরে গিয়েছিল এবং এই কদিন নিতান্তই বেচারার মত কিসে সত্যর সন্তোষ-বিধান হতে পারে তার চেষ্টা করছিল, কিন্তু সত্যর এই আবেদনে তার নতুন করে আবার মাথা ঘুরে গেল। অবাক হয়ে বলল, মাস্টার মশাইয়ের বাড়ি যাবে তুমি! কেন? হঠাৎ এমন কি দরকার পড়ল?

আছে দরকার।

কিন্তু নিতাই শুনলে কি আস্ত রাখবে আমায়?

আস্ত রাখবে না? সত্য মৃদু একটু ব্যঙ্গ হাসি হেসে বলে, একেবারে ভেঙেই ফেলবে?

তা প্রায় তাই। তা ছাড়া, মানে দরকারটা কি?

বললাম তো আছে দরকার।

নবকুমার মন্রতা ভোলে, ক্রুদ্ধকণ্ঠে বলে ওঠে, ওই বেধর্মী লোকটার সঙ্গে তোমার দরকারটাই বা কি তাই শুনি?

বলে ফেলেই অবশ্য ভয়ে কাঠ হয়ে যায়। কে জানে বাবা, এ কথাতেও সত্য অজ্ঞান হয়ে যাবে কিনা? কিন্তু না, অজ্ঞান হয়ে যায় না সত্য, শুধু মিনিটখানেক পাথরের চোখ নিয়ে স্বামীর দিকে তাকিয়ে থেকে বলে, একটা পরামর্শ করব।

পরামর্শ! বাপ-পিতেমোর নাম গেল হিদে জোলার নাতি! জাতে-জ্ঞাতে পরামর্শর মানুষ মিলল না, পরামর্শ করতে যাবে ওই ধর্মখোয়ানো ইয়ের সঙ্গে?

সত্য বোধ করি রাগবে না বলেই দৃঢ়সংকল্প, তাই স্থিরভাবে বলে, জাতে-জ্ঞাতে মানুষ আর পাচ্ছি কোথা? পাখী-পক্ষীর সঙ্গে তো আর পরামর্শ হয় না? যাক গে, তুমি যখন নিয়ে যেতে পারবে না, আমি নিজেই যে করে হোক

নিজেই যে করে থোক!

নবকুমার আরো ক্রুদ্ধ গলায় বলে, এই এক একবগ্গা গোঁ। যা ধরব তা করবই। বেশ এতই যদি দরকার, তাকেই তবে ডেকে আনব গলবস্ত্র হয়ে গিয়ে!

না।

না?

না-ই তো। একদিন নিজের মুখে তুমি তাকে এ বাড়িতে আসতে বারণ করেছ–

করেছি, এবার গলবস্ত্র হয়ে সে অপরাধ ক্ষয় করব।

ক্ষয় হয় না এমন অপরাধও তো জগতে আছে গো? যাক, তক্ক আমি করতে চাই না, তবে এ বাড়িতে আর পা ফেলতে বলব না তাকে, নিজেই গিয়ে যা পারব

এই তোমার জন্য একদিন দেশত্যাগী হতে হবে আমায়!

নবকুমার মুখের চেহারায় বিরক্তির চরম নমুনা দেখায়। কিন্তু সত্য নির্বিকার, বলে, দেশত্যাগী হবে বললেই কি হওয়া যায়? যায় না। যাক গে, তুমি আর এ নিয়ে মাথা খারাপ করো না। আমিই ব্যবস্থা করে নেব। তবে জানানোটা হয়ে থাকল।

মাথা খারাপ করতে বারণ করলেই কি আর নিজের দায়িত্ব ত্যাগ করতে পারে নবকুমার? মাথা সে খারাপ করছেই। শেষ অবধি ভেবে হদিস না পেয়ে হাল ছেড়ে দেয় সে, আর ইত্যবসরে সত্য স্বাধীন অভিযান চালায়। নিজেও রওনা হয় ভবতোষের বাড়ি।

পথের সঙ্গী?

আর কেউ নয়, সুহাস।

হ্যাঁ, সুহাসের সঙ্গেই গিয়েছিল সত্য। সুহাস ঠিকানাটা শুনে বলেছিল, ওমা, এ তো আমাদের ইস্কুলের কাছেই–

ঠিক আছে, তবে তোতে আমাতেই যাব।

বলেছিল সত্য, আর বোধ করি মনের নিভৃত কোণে এটুকু গুপ্ত বাসনা ছিল, ভবতোষকে একবার কনে’টা দেখিয়ে দিতে। ঘটকালি যখন করবেন, তখন অন্তত মেয়ে কেমন তা যাতে বলতে পারেন!

.

এবার আর মাধ্যম নয়, সরাসরি নিজেই কথা।

ভবতোষ যেন হা হয়ে গেলেন।

সত্য একটা অনাথা মেয়ে পুষেছে এ তিনি জানতেন, কিন্তু সে মেয়ে যে এমন মেয়ে আর এত বড় মেয়ে তা তার ধারণার বাইরে ছিল। বিহ্বল দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চোখ নামিয়ে নিয়ে বললেন, এ মেয়ের আবার পাত্তরের ভাবনা, বৌমা?

সে আপনি স্নেহ করে বলছেন। দিন তবে নাতনীর একটা ব্যবস্থা করে। আপনার সমাজে শুনেছি অনেক উদারমন ছেলে আছে যারা বিধবা বিয়ে করতে রাজী–

বিধবা!

ভবতোষ থতমত খান, বিধবা! এ মেয়ে যে লক্ষ্মী-প্রতিমা বৌমা, বিধবার মতন তো কোন লক্ষণ

সত্য সহসা বলে ওঠে, তুই একবার পাশের ঘরে যা তো সুহাস, আমার একটু কাজ আছে।

সত্যর এই দুঃসাহসিক স্পর্ধায় সুহাসও স্তম্ভিত হয়ে যায়। একেই তো এভাবে একটা পুরুষের বাসায় একা দুটো মেয়েছেলে আসাই ভয়ঙ্কর ঘটনা, তার ওপর কিনা সুহাস তুই পাশের ঘরে যা!

প্রায় হতভম্ব হয়েই চলে যায় সুহাস।

ভবতোষ হতভম্ব দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন এই কূলকিনারাহীন দুঃসাহসের দিকে। আর সত্য নিষ্কম্প মৃদুস্বরে বলে, এসেছি যখন তখন আপনার কাছে ওর সব ইতিহাসই বলব।

হ্যাঁ, সুহাসের সব ইতিহাসই বলেছিল সেদিন সত্য ভবতোষ মাস্টারের কাছে। সুহাসের জন্মের আগের বৃত্তান্ত থেকে শুরু করে পরিচয়ও বাদ দেয় নি। শঙ্করীর কুলত্যাগের পর রামকালীর স্পষ্ট স্বীকারোক্তির কথাটাও এসে পড়েছিল।

সব শুনে ভবতোষ গভীর একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলেছিলেন, এখন বুঝতে পারছি বৌমা, কোথা থেকে এ ধাতু পেয়েছ! অমন বাপ তাই–, কিন্তু কথা হচ্ছে বৌমা, এই আমাদের নতুন সমাজকে তুমি যে রকম উদার ভাবছ, ঠিক সে রকম নয়। এর মধ্যেও দলাদলি আছে রেষারেষি আছে, তা ছাড়াও যে মেয়ের বংশপরিচয় নেই, সে মেয়েকে বিবাহ করার মত মনোবলসম্পন্ন যুবক পাওয়া শক্ত।

সত্য দৃঢ়স্বরে বলে, শক্ত সহজ বুঝি না, চিরদিন জানি আমার কথা আপনি ফেলতে পারেন না, তাই জোর করতেই এসেছি। ওই মেয়েটার ব্যবস্থা আপনাকে করতেই হবে।

ভবতোষ বিচলিত স্বরে বলেন, আমি তোমার কথা ফেলতে পারব না, এ কথা তুমি জানলে কি করে বৌমা?

সত্য মুখ তুলে পরিষ্কার এবং শান্ত গলায় বলে, এক কথা জানতে খুব বেশী কিছু লাগে না মাস্টার মশাই, আমি তো মাটি পাথর নই। কিন্তু সে কথা থাক, আপনি শুধু আমায় ভরসা দিন

ভবতোষ একটু হাস্যের সঙ্গে বলেন, চেষ্টা অবিশ্যি করব বৌমা, কিন্তু জোর করে তো বলতে পারছি না। যদি নিজেকে দিয়ে হত, তা হলে নয় আজন্মের ব্রত ঘুচিয়ে একবার তোমার সুন্দরী মেয়ের জন্যে বরসাজ সেজে নিতাম।

সত্যও হেসে ফেলে। তারপর সকৌতুকে বলে, তেমন ভাগ্য ওর থাকলে তো? আমি কিন্তু বলে যাচ্ছি সব ভার আপনার ওপর রইল!

ভবতোষ আকুলতা করেন, ভবতোষ ব্যাকুল হয়ে ওঠেন, বার বার বলতে থাকেন, এ তুমি কি করলে বৌমা? আমাকে এভাবে সত্যবন্দী করে রাখলে–

সত্য বিচলিত হয় না।

সত্য দৃঢ়স্বরে বলে, আমি ঠিক জায়গাতেই ঠিক কথা বলছি মাস্টার মশাই, এখন আপনি আছেন এই ভরসা।

ভবতোষ আকাশ পাতাল ভাবতে থাকেন কোথায় সেই পাত্র যার হাতে ওই সোনার প্রতিমাটিকে দেওয়া যায়, আর যে ওর সমগ্র ইতিহাস শুনেও নিতে রাজী হয়।

ভেবে পান না।

একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, এখন চট করে মাথায় আসছে না বৌমা, দেখি। কিন্তু একটা প্রশ্ন করি, এই যে তুমি এসেছ নবকুমার জানে?

সত্য মাথা কাত করে। অর্থাৎ হ্যাঁ।

ভবতোষ উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলেন, তবে?

তবে আর কি? ওনার অমতেই করতে হবে।

কাজটা কি ভাল হবে বৌমা?

সত্য মুখ তুলে বলে, কিন্তু ওই মেয়েটার আখেরের কথা না ভেবে নিশ্চিন্দি হয়ে বসে থাকাই কি ভাল হবে মাস্টার মশাই? আমার ঘরে সংসারে হয়তো একটু মনোমালিন্য হবে, হয়তো শ্বশুরবাড়ির মানুষেরা আমার মুখ দেখবে না, কিন্তু আমার সেই সামান্য লোকসানটা কি একটা মেয়ের জীবনটা বরবাদ হয়ে যাওয়ার থেকে বেশী লোকসানের হল?

ভবতোষ এক মুহূর্ত নির্নিমেষে তাকিয়ে হঠাৎ ব্যাকুল রুদ্ধ কণ্ঠে বলে ওঠেন, সন্ধ্যে হয়ে আসছে বৌমা, তুমি বাড়ি যাও। তোমায় কথা দিচ্ছি, ওর বিয়ের ভার আমি নিলাম।\

সত্য আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখে, সন্ধ্যের চিহ্নমাত্র নেই। মাথাটা একটু নিচু করে বলে, চিরটাকাল আপনার কাছে অন্যায় আবদার করে আর পেয়ে সাহস বেড়ে গেছে মাস্টার মশাই, আমায় মাপ করবেন।

মাপ? তোমায় আর আমি কি মাপ করব বৌমা? নিজেকে যদি মাপ করতে পারতাম! সে যাক, মেয়েটি কোথায় গেল?

মেয়েটি! তাই তো!

তার তো, তদবধি আর কোন সাড়া নেই। সত্য ব্যস্তভাবে বেরিয়ে আসে ঘর থেকে আর এই প্রথম খেয়াল হয় অনেকক্ষণ ধরে সে এই তৃতীয় মানুষহীন ঘরে একজন পুরুষের সঙ্গে নিশ্চিন্তে কথা বলছে বসে বসে।

সুহাস কি বিরক্ত হল?

পাশের ঘরে চলে যেতে বলেছে বলে অপমানিত হল?

পাশের ঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল সত্য, কোথায় সুহাস?

একা চলে গেল না তো?

সহসা একটা আতঙ্কের বিদ্যুৎশখা মাথা থেকে পা পর্যন্ত যেন শিউরে উঠল সত্যবতীর। নিশ্চয় তাই!

কই?

প্রশ্ন করলেন ভবতোষ।

সত্য অফুটে বলল, কই দেখছি না তো! একা চলে গেল নাতো?

একা!

একা চলে যাবে!

ভবতোষ সন্দেহের সুরে বললেন, তাই কখনো হয়? ওই কোণের ঘরটায় আছে বোধ হয়

কোণের ঘরে? ওখানে কি আছে?

কিছু না। শুধু কতকগুলো

কথা শেষ হয় না। মুখে একঝলক আলো মেখে সুহাস সেই কোণের ঘরটা থেকে ছুটে আসে, স্বভাব-বহির্ভূত উচ্ছাসে বলে ওঠে, পিসিমা পিসিমা, দেখবে এস কত বই! উঃ, আমার আর এখান থেকে যেতে ইচ্ছে করছে না!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *