৩৩. কালের খাতায় কয়েকখানা পাতা

কালের খাতায় কয়েকখানা পাতা ডান দিক থেকে বাঁ দিকে চলে আসে, গড়িয়ে যায় অনেকগুলো দিন।

অনভ্যস্ত জীবন প্রায়-ধাতস্থ হয়ে এসেছে নবকুমারের। গতিতে বেশ খানিকটা ক্ষিপ্রতার সঞ্চার হয়েছে, বাড়িতে অফিসের গল্প করতে শিখেছে, অফিস যাওয়ার সময় কৌটো ভর্তি পান, আর পানের সঙ্গে দোক্তা নিতে শিখেছে।

ইতিমধ্যে ছেলেরা স্কুলে কয়েকবার ক্লাস বদলেছে, আর সত্যবতীরা একবার বাসা বদলেছে।

বাসা বদলাবার অবশ্য অতি সূক্ষ্ম গোপন একটা ইতিহাস আছে, সে ইতিহাসে শুধু সত্যবতীর আর ভবতোষ মাস্টারের মধ্যেই নিবদ্ধ।

বেশ চলছিল সংসার।

তাড়াহুড়ো করে স্বামীর আর স্বামীর বন্ধুর অফিসের ভাত রাঁধছিল সত্য। পান সাজছিল দু কৌটো করে। তারা বেরোতে না বেরোতে ছেলেদের নাওয়া-খাওয়া নিয়ে ব্যস্ত হচ্ছিল, “দুর্গা দুর্গা” উচ্চারণ করে ছেলেদের স্কুলে পাঠাচ্ছিল, তারপর সারাদিনের অবসরে সংসারের বাকী কাজগুলো সেরে তুলে মন দিয়ে শিখছিল লেখাপড়া। বাংলা ইংরাজী দুই-ই।

বইয়ের যোগানদার ভবতোষ, পাঠশিক্ষকও ভবতোষ। নিয়মিত নয়, মাঝে মাঝে দুরূহ জায়গাগুলো বুঝে নিত সত্য। ঘরের মধ্যে উঁচু চৌকিতে বসতেন মাস্টার, চৌকির সামনে মাটিতে সত্যর দুই ছেলে বসত মাদুরে নিজেদের বই খাতা নিয়ে, আর সত্য মাদুর থেকে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে মেজেয় বসত মাথায় কাপড় টেনে।

কিন্তু কথা চিরদিনই স্পষ্ট সত্যর।

তাই দূরত্ব সত্ত্বেও তার প্রশ্ন বুঝতে অসুবিধে হত না ভবতোষের।

এই পড়াশোনার মাঝখানে হঠাৎ একদিন সত্য বলে বসল, আমাদের জন্যে অনেক তো করলেন আপনি, আর একটু কষ্ট করতে হবে।

ভবতোষ বিচলিত হয়ে বললেন, কষ্ট কিসের, কষ্ট মানে?

কষ্ট তো বটেই। এযাবৎ অনেক কষ্ট করলেন। সে যা হোক, আপনি পিতৃতুল্য, আমি আপনার মেয়ের মত, তাই কিন্তু আমি হচ্ছি না

সত্যর বড় ছেলে লক্ষ্য করল, হঠাৎ যেন মাস্টার মশাইয়ের মুখটা কেমন বদলে গেল। কি রকম যেন ভয়-পাওয়া ভয়-পাওয়া মুখ হয়ে গেল।

সত্যর অবশ্য মাথায় ঘোমটা, মুখী নীচু।

ভবতোষ অস্ফুটে কি যেন বললেন। সত্য পরিষ্কার গলায় উত্তর দিল, হ্যাঁ, সেই কথাই বলছি– কিন্তু আমি হচ্ছি না। আপনি কায়েত ঠাকুরপোর জন্যে অন্য একটা ব্যবস্থা করে দিন। এখেনে তো শুনছি মেস-ঘর না কি যেন আছে, মাথাপিছু খাই-খরচা দিয়ে বেটাছেলেরা এক জোট হয়ে থেকে আপিস-কাছারি করে।

কায়েত ঠাকুরপো অর্থে নিতাই।

সামনে শুধু “ঠাকুরপো” বললেও আড়ালে তার সম্পর্কে অপরকে বোঝাতে কায়েত ঠাকুরপো বলেই উল্লেখ করে সত্যবতী। কিন্তু সেটা কেবলমাত্র বোঝাতেই।

নবকুমারের সঙ্গে তা ঠিক ভাইয়ের মতই ছিল সে এ বাড়িতে, আর নেহাত ভাতের ছোঁয়াটা বাদে অত বামুন-কায়েতের ভেদাভেদও ছিল না সত্যর কাছে। খুব সৌহার্দ্যই তো ছিল।

হঠাৎ কি হল?

ভবতোষ তাই অন্যমনস্ক ভাবে বললেন, সে তো আছে।

হ্যাঁ, সেই কথাই বলছি। ওনার থাকার জন্যে ব্যবস্থা একটা আপনাকে নিয্যসই করতে হবে।

ভবতোষ মাথা চুলকে বলেন, তা না হয় দিলাম, কিন্তু হঠাৎ? মানে সে কিছু বলেছে? ইয়ে এখানে থাকবে না বলে–

না, তিনি কিছু বলেন নি, সত্য দৃঢ় গলায় বলে, আমিই বলছি। আর এটা আপনাকে করতেই হবে।

ভবতোষ মুহূর্ত কয়েক চুপ করে থেকে আস্তে বলেন, তুমি যখন বলছ বৌমা; অবশ্যই ন্যায্য কোন কারণ আছে। তবু মানে বুঝতে পারছি না বলে কেমন যেন চিন্তায় পড়ছি।

এবার আর উত্তর এল না সত্যর দিক থেকে।

ভবতোষ উঠে দাঁড়ালেন।

তারপর বললেন, নবকুমারেরও এই মত তো?

সত্য বলল, ঘর-সংসারের সুবিধে-অসুবিধেয় বেটাছেলের মতামত চলে না। ব্যবস্থা হয়ে গেলে বললেই হবে।

ভবতোষ বুঝলেন। বুঝলেন কোন একটা গোলমেলে ব্যাপার ঘটেছে। কিন্তু নিতাই ছেলেটা তো–হল কী!

আচ্ছা হঠাৎ বলা-কওয়া নেই, নিতাইকে তিনি বলবেন কি করে, ওহে তোমার জন্যে মেসের ঘর যোগাড় করেছি, কাল থেকে থাকো গে যাও সেখানে!

সে কথা বলেও ফেললেন।

নিতাইকে আগে একটু না জানালে–

হ্যাঁ, সে একটা চিন্তা বটে। কিন্তু কি আর হবে? বলতেই যখন হবে, সে ব্যবস্থা আমিই করব।

ভবতোষ অগত্যাই বিদায় নিলেন।

বড় ছেলে বলল, কাকাবাবু কেন এখানে থাকবেন না মা?

সত্য গম্ভীরভাবে বলল, ছেলেমানুষ সব কথায় থাকতে নেই খোকা। যখন যা হবে দেখতেই পাবে। কেন, কি বিত্তান্ত অত ভাবতে বসো না।

.

তা তারা শুধু দেখতেই পেল।

দেখল বাবা কোথায় যেন পালিয়ে থাকল, মা চুপচাপ দরজা ধরে দাঁড়িয়ে রইল আর নিতাইকাকা নিজের তোরঙ্গ আর বিছানা নিয়ে আস্তে আস্তে একটা ভাড়াটে ঘোড়ার গাড়িতে গিয়ে উঠল।

পরিস্থিতিটি এমন থমথমে যে, একটিও প্রশ্ন করতে সাহস হল না তাদের।

তা সাহস প্রথমটায় নবকুমারেরও হয় নি। তাই সে সকাল থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছিল। অনেক রাত্রে বাড়ি ফিরে প্রায় চোরের মত চুপি চুপি তাকিয়ে দেখল নিতাইয়ের ঘরটার দিকে। দেখল দরজায় শেকল তোলা।

বুকটা ধক করে উঠল।

মনে হল তার অন্তর নামক জায়গাটাতে যেন অমনি একটা শেকল তোলা দরজা দাঁড়িয়ে রয়েছে মুখ গম্ভীর করে। সে দরজা আর বুঝি কোনদিন খুলবে না। সেই বন্ধ ঘরের মধ্যে রয়ে গেল নবকুমারের অনেকখানিটা সুখ, অনেকখানিটা আনন্দ।

ঈশ্বর জানেন সত্যর হঠাৎ কেন এই খেয়াল!

নিতাইয়ের কোন ব্যবহারে যে সে রাগ করেছে তাও তো মনে হচ্ছে না। নিজের চক্ষে কাল দেখেছে নবকুমার, রান্নাঘরে নিতাইয়ের ভাত বাড়তে বসে টপটপ করে চোখের জল পড়ছে সত্যর। আর এও লক্ষ্য করেছে নিতাই যা যা খেতে ভালবাসে, সেই সবই আজ কদিন ধরে রাধছে সে।

তবে?

হিসেবটা মিলছে কোন্‌খানে?

তবে কি খরচপত্রের কথা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে সত্য?

কিন্তু তাতেই বা প্রশ্নের উত্তর কোথায়? নিতাই তো সংসার-খরচের ভাগ না দিয়ে ছাড়ে না।

গোলকধাঁধার মধ্যে কাটাতে হয়েছে নবকুমারকে।

সত্যকে প্রশ্ন করে সদুত্তর জোটে নি। সে বলেছে, এ তো ভাল ব্যবস্থাই হচ্ছে। দু’ বেলা বাড়া ভাতটা পেলে ঠাকুরপোর আর বৌ এনে বাসা করার চেষ্টা থাকবে না।

নবকুমার বেঁজে উঠে বলেছিল, ওর পরিবারের কথা ও বুঝবে। সে চেষ্টা যে করতেই হবে তার কোন মানে আছে? গা-সুদ্ধ বৌ কি তোমার মতন বাসায় আসার জন্যে পা তুলে বসে আছে?

সত্য অবশ্য এ কথায় মর্মাহত হয়ে নিথর হয়ে যায় নি। প্রথম প্রথম যেমন হত। কারণ যে কোন বিষয়ে সামান্যতম অসুবিধে বা অপছন্দ হলেই সত্যের “বাসায় আসার” বাসনা নিয়ে খোটা দেওয়ার অভ্যাস নবকুমারের গোড়া থেকেই। বহুবিধ স্বাচ্ছন্দ্য-সুখের আস্বাদ পেলেও এবং বহুবার মনে মনে সত্যকে তারিফ করলেও, ওটা যেন ওর একটা মুদ্রাদোষের মতই।

প্রথম প্রথম সত্য অভিমানে পাথর হয়ে যেত। আর সেই পাথর-মূর্তি অসহ হওয়ায় শেষ অবধি নবকুমারকেই মিটমাট করতে হত। বলতে হত, ঘাট হয়েছে বাবা, শতেকবার ঘাট হয়েছে। এই নাক মলছি, কান মলছি, আর যদি ও কথা মুখে আনি। ঠাট্টার কথা বুঝতে পার না, এই এক আশ্চর্য!

তা ঠাট্টা বলেই বুঝিয়ে বুঝিয়ে ক্রমশ জিনিসটাকে গা-সহা করে এনেছিল নবকুমার। এখন এমন হয়েছে যে ওই খোঁটাটাকে আর গ্রাহ্যের মধ্যেই আনে না সত্য। সেদিনও তাই আনে নি।

শুধু ভ্রুকুটি করে বলেছিল, পা তুলে আছে কি নেই, সেটা তো যতক্ষণ না অন্তর্যামী হচ্ছ টের পাবে না। তবে মানুষের সংসারেও নেয্য হিসেব একটা আছে। বিয়েটা করে লোকে ঘরকন্না করবার জন্যেই।

আরো খানিক বাক্যব্যয় করেছিল নবকুমার। অনেকটা একতরফা। তবু তার মনে আশা ছিল শেষ পর্যন্ত নিতাইয়ের যাওয়ার কথাটা হাওয়ায় ভাসবে। কিন্তু দেখল ক্রমশই সেটা পাকতে থাকল।

কেউই কিছু বলে না, তবু যেন কোথায় কি হতে থাকে। খেতে বসে দু বন্ধুতে কথাও হয় না তা নয়। কিন্তু সে যেন শুকনো-শুকনো আঠা ছাড়া। অথচ নিতাইকে স্পষ্টাস্পষ্টি জিজ্ঞেস করতেও সাহসে কুলোয় না।

সত্যকেও না।

কিন্তু আজ এই দুঃখের আবেগে ওর সাহস জেগে উঠল। ওখান থেকে তাড়াতাড়ি সরে এসে তীব্রস্বরে বলে ফেলল, বিনি দোষে নিরপরাধ মানুষটাকে বাড়ি থেকে বিদেয় করে দিতে মনটা একবার কাঁদলও না? ধন্যি মেয়েমানুষ বটে!

সত্য তখন প্রদীপের সামনে হেঁটমুণ্ডে বসে একখানা বইয়ের পাতা ওল্টাচ্ছিল, স্বামীর এই মন্তব্যে একবার মাত্র মাথাটা তুলল, তার পর নীরবেই আবার মাথা নীচু করল।

নবকুমারের তখন ভিতরে আলোড়ন চলেছে, তাই সবই খারাপ লাগছে। অতএব ওই বইয়ের পাতা ওল্টানোতেও গা জ্বলে গেল তার। বলল, মা যা বলে ঠিকই বলে। মেয়েছেলের অধিক বিদ্যে সর্বনাশের মূল!

সত্য চট করে বইটা মুড়ে ফেলে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, মাতৃবাক্য অবিশ্যিই বেদবাক্য। অতএব আমিই বসে বসে তোমার সর্বনাশ সাধন করছি। তা তার তো আর চারা নেই। বিদ্যেটা তো আর ঘটিবাটি নয় যে, অসুবিধে ঘটাচ্ছে বলে সরিয়ে রাখব। কিন্তু বিনাদোষে কিনা, আর মনটা কাঁদছে কিনা, সে সংবাদ তুমি সঠিক পেয়েছ?

মন! হু! পাষাণেও বরং প্রাণ আছে, তোমার মধ্যে নেই।

বন্ধুকে যে নবকুমার কতখানিটা ভালবাসে তা সত্যর অজানা নয়, তাই এত বড় দোষারোপেও বিচলিত হয় না সে। বোঝে, রাগে দুঃখে বলে ফেলেছে। আর সেটাই তো স্বভাব নবকুমারের। রাগের মাথায় কড়া কথা বলে বসে, আর রাগ ভাঙলে খোশামোদ করতে বসে।

তাই সত্য অবিচলিত ভাবে বলে, তা পাষাণীই যখন, তখন মন কাঁদার কথা উঠছে কেন? তবে বিনাদোষে, এ কথা ভাববার হেতু? যে মানুষ গুরুর নামে কলঙ্ক দিতে পারে, তাকে আমি অন্তত নিরপরাধী বলতে পারব না।

গুরুর নামে!

নবকুমার স্তম্ভিত ভাবে বলে, তার মানে?

মানে তোমায় বোঝাতে পারব না। মেয়েমানুষের বাড়া পেট-আলগা মানুষ তুমি, এখুনি জগৎসংসার সকল বাত্রা জেনে ফেলবে। তবে এই বিশ্বাসটুকু রেখো আমার ওপর, অন্যায় কাজ আমাকে দিয়ে হবে না। অবিবেচনার কাজও না।

.

না, এর বেশী নবকুমার জানতে পারে নি।

পারবার কথাও নয়।

বুদ্ধি দিয়ে বুঝে ফেলবে এত ক্ষমতা তার নেই। আর সত্য তো হাত জোড় করে বলেছে, আমায় আর কিছু জিজ্ঞেস করো না। আমি সে কথা মুখে আনতে পারব না।

না, সত্যিই পারবে না।

মুখে আনবার কথা নয়।

তবু নিতাই একদিন মুখে এনেছিল। ভবতোষ মাস্টার সত্যকে পড়া দিয়ে চলে যাওয়া মাত্র বলে উঠেছিল, সম্পৰ্কটা মাস্টার বানিয়েছে ভাল! গুরু-শিষ্য! কিন্তু যতক্ষণ পড়া বুঝোয় ততক্ষণ তো গুরু বসে বসে শিষ্যকে চোখ দিয়ে গিলতে থাকে।

সত্য তীব্র স্বরে বলেছিল, ঠাকুরপো!

তা রাগ করলে আর কি হবে? যা হক কথা তাই বলছি। মাস্টার মশাইয়ের রীত-চরিত্তির আমার আর আজকাল ভাল মনে হয় না। ছুতোয়-নাতায় হরঘড়ি এ বাসায় আসার বহর দেখে বুঝতে পারেন না? নিছক হিত করতে আসা নয়, কারণটা অন্য। আমি এই ভবিষ্যদ্বাণী করছি, সময়ে সাবধান না হলে ওই মাস্টার হতে একদিন বিপদ আসবে।

সত্য কঠিন গলায় প্রশ্ন করেছিল, কথাই যদি তুললে ঠাকুরপো তো বলি–সে বিপদ যে তোমার দ্বারাই আসবে না, তার নিশ্চয়তা কি?

আমার দ্বারা! আমার দ্বারা মানে?

নিতাই সিদুরে-আমের মত লালচে হয়ে ওঠে।

কিন্তু সত্য কঠোরা।

মানে ঘরে গিয়ে বোঝ গে। জিজ্ঞেস করো গে আপনার মনকে। কে কাকে চোখ দিয়ে গিলছে, সে খবর তোমার চোখে পড়ে কেমন করে তাই তোমায় শুধুই আমি!

পড়বে না? নিতাই উত্তেজিত হয়, নবর মতন কানা মানুষ ছাড়া সবাইয়ের চোখেই পড়ে।

নিজে চোখ না ফেললে পড়ে না, এই আমারও সাদা বাংলা। কিন্তু এমন মন্দ কথা যখন তোমার মনে উঠতে পারে ঠাকুরপো, তখন আমার মনে হয় আর একত্র থাকা ঠিক নয়।

ঠিক নয়! নিতাই অবাক হয়ে বলে, একত্র থাকা ঠিক নয়?

না।

নিতাই ফুঁসে উঠে বলেছিল, আমাকে সরালেই তোমাদের বিপদ সরবে?

বিপদ!

সত্য সহসা হেসে উঠেছিল, আমার আবার বিপদ কিসের? আগুনে যদি হাত দিতে আসে ঠাকুরপো, বিপদটা আগুনের হয়, না হাতের হয়? রামায়ণ মহাভারতের কাহিনীও কি কখনো শোন নি? সতীনারীর উপাখ্যান? তোমায় যে সরে যেতে বলছি, সে তোমারই ভালর জন্যে।

নিতাই আর কোনও কথা খুঁজে না পেয়ে বলেছিল, চমৎকার! বিচারটা ভাল!

সত্য বলেছিল, এখন তুমি নানা কারণেই অন্ধ ঠাকুরপো, তাই জ্ঞানগম্যি নেই। পরে বুঝবে। তবে এ সম্পর্কে অধিক কথায় আর কাজ নেই। কুকথা হচ্ছে ছারপোকার বংশ, একটা থেকে একশোটা ছানা জন্মায়। ওকে মূলেই ধ্বংস করে দেওয়া বুদ্ধির কাজ।

তারপর সেই ভবতোষ মাস্টারের কাছে মেস খুঁজে দেওয়ার প্রস্তাব।

কিন্তু নিতাইয়ের অনুযোগ কি বাস্তবিকই অমূলক?

নিছক অমূলক বললে ভুল বলা হবে।

ভবতোষ মাস্টারের চোখের শ্রদ্ধা সমীহ আর স্নেহভরা মুগ্ধ বিহ্বল দৃষ্টি যে আত্মহারা হয়ে সত্যবতীর আনত মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে, এ কি সত্যবতীর অনুভবের মধ্যে ধরা পড়ে না?

পড়ে। পাথরের দেবতাও ভক্তের নিবেদন বোঝে।

তবু সত্যবতী গ্রাহ্য করে না। সত্যবতী বোঝে এ দৃষ্টির মধ্যে অনিষ্টের আশঙ্কা নেই। সত্যবতী জানে এ দৃষ্টি সত্যবতীর কেশাগ্রেরও ক্ষতি করতে পারবে না। যেমন পারবে না নিতাইয়ের ঈর্ষাকাতর জ্বালাভরা দৃষ্টি। দুটোকেই সমান অগ্রাহ্য করেছিল সত্যবতী। কিন্তু নিতাইয়ের এই স্পষ্টাস্পষ্টি জ্বালা প্রকাশে বিবেচনার পথ নিল সে। কে জানে কোনদিন যদি নির্বোধ নবকুমারের কানে তুলে বসে নিতাই এই নীচ সন্দেহের কথাটা!

যদি মাস্টারমশাইয়ের কানে ওঠে?

ছি ছি!

উনি স্নেহ করেন।

উনি শুরু।

উনি নিজেও জানেন না, এর মধ্যে কোন দোষ আছে। তাই ওঁর নিজেরও ক্ষতি হচ্ছে না।

কিন্তু নিতাইয়ের কথা স্বতন্ত্র। নিতাইয়ের মধ্যে যা আছে, সেটা নির্ভেজাল শ্রদ্ধা নয়।

সে আপনি আপনার ক্ষতি করতে পারে।

তার জন্যে ব্যবস্থার দরকার।

তাই নবকুমারের কাছে দৃঢ়স্বরে বলতে পারে সত্যবতী, আমার দ্বারা কোন অবিবেচনার কাজ হবে না, কোন ছোট কাজ হবে না, এ বিশ্বাস রেখো।

.

নিতাই চলে যেতেই নবকুমার বলতে শুরু করল, বাড়িটা যেন গিলে খেতে আসছে! বলতে লাগল, চার-চারখানা ঘরে দরকার কি?

ওই শেকল-বন্ধ ঘরটা যে ওর বুকে শেলের মত বিধছে সেটা বুঝতে পারে সত্য। তাই একদিন নরম গলায় বলে, আর একটা বাসা দেখলে হয় না?

কেন, আর একটা বাসার কি দরকার?

নবকুমার খাপপা হয়ে ওঠে।

দরকার আর কি, একটু হাওয়া বদল! তা ছাড়া এ বাসার ভাড়াটাও তো কম নয়। এদিকে বাজার দিন দিন অগ্নিমূল্য হচ্ছে। ওদিকে ছেলেদের বইখাতা ইস্কুলের মাইনে বাড়ছে।

তা সে তো তোমার পক্ষে ভালই। একটা মানুষ দু বেলা দু মুঠো ভাতের বদলে একমুঠো করে টাকা ধরে দিচ্ছিল–

সত্য বিনাবাক্যে উঠে গিয়ে গিয়েছিল। আর মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিল, ঠিক আছে, আর নবকুমারকেও বলা নয়, ভবতোষ মাস্টারকে অনুরোধ জানানো নয়, নিজেই হাল ধরবে সে। ঝিকে দিয়ে বাসা যোগাড় করবে। ঝি পাঁচবাড়ি ঘোরে, অনেক সন্ধান রাখে।

তা সত্যর হিসেব ভুল হয় নি।

মুক্তারামবাবু স্ট্রীটের এ বাসা ঝি পঞ্চুর মা-ই যোগাড় করে দিয়েছে। বাড়িওয়ালা মস্ত বড়লোক, বনেদী ঘর। আগে যখন আরো বোলবোলাও ছিল, তখন আমলা-গোমস্তাদের জন্যেই ছোট ছোট অনেক বাসা বানিয়ে দিয়েছিল। এখন কর্মচারীর সংখ্যা কম, তাই দু-পাঁচখানা বাসায় ভাড়া বসিয়েছে।

তারই একখানার সন্ধান এনে দিল পঞ্চুর মা। নবকুমার বাসা দেখে এসে সন্তোষ প্রকাশ না করে পারল না। কারণ ছোট হলেও বাসাটা ভাল। রাস্তার ধার। ভবতোষ মাস্টার ক্ষুণস্বরে বললেন, বাসা বদলের দরকার ছিল, আমায় জানাও নি তো নবকুমার?

নবকুমার বাড়ির মধ্যে’র শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে বলল, আজ্ঞে আপনার ওপর আর কত বোঝা চাপাব? আমাদের জন্যে তো আপনার কাজের অন্ত নেই। এটা যখন ঝি’র দ্বারা হয়ে গেল–

আমার বাসা থেকে একটু দূর হয় গেল, এই আর কি! ভবতোষ নিঃশ্বাস ফেললেন।

তবু বাসা বদল হল।

আর সত্য আর একটু স্বাবলম্বী হয়ে উঠল। ফি-হাত মাস্টারমশাইয়ের মুখাপেক্ষিতার অভ্যাসটা কাটাতে শুরু করল।

তবে এ বাড়ির একটা অসুবিধে, বাড়িওলারা ধনী হলেও জাতে ছোট। কাজেই বামুন-ভক্তিটা প্রবল। যখন তখন পালাপার্বণ হলেই বামুনবাড়ি সিধে পাঠায় তারা, বামুনের মেয়ের জন্যে পান সুপুরি মিষ্টি, লালপাড় শাড়ীর উপটৌকন পাঠায়।

ফেরত দেওয়াও চলে না, কেবল নেওয়াও লজ্জার।

নবকুমার অবশ্য লজ্জায় বলে না। বলে, এতে তোমার এত কিন্তু কিসের? কথায় আছে লাখ টাকায় মুন ভিখিরি! তা ছাড়া ওরা হল গে সোনার বেনে, বামুনকে দান করে পুণ্যি সঞ্চয় করছে।

তা হোক। সত্য ঝঙ্কার দেয়, আমরা তো আর পরিবর্তে কিছু দিতে পারছি না? নিতে আমার মাথা কাটা যায়।

তোমার সবই উল্টো। বলি পরিবর্তে তো তুমি আশীর্বাদ দিচ্ছ?

আশীর্বাদ!

হি হি করে হেসে ওঠে সত্য, আমার আশীর্বাদের অপেক্ষাতেই যে ছিল এত দিন! আর ওদের ওই রাজ্যিপাট আমার আশীর্বাদেই হয়েছে! যাই বল, এ একটা বিপদ হয়েছে।

লোকের যা প্রার্থনার, তোমার তাতেই বিপদ, আর লোকের যাতে ভয়, তোমার তাতেই আহাদ, এই তো দেখলাম চিরটাকাল। কোন বিধাতা যে গড়েছিল তোমায় তাই ভাবি।

এই ধরনের কথা প্রায়ই হয়।

আবার মাঝে মাঝে পঞ্চুর মা বলে, বড় বাড়ির গিন্নী পেরায় আমাকে বলে, হ্যাঁলা, সবাই আমার সঙ্গে দেখা করতে আসে, কই সাত নম্বর বাসার গিন্নী তো কই আসে না একদিনও? আমি বলি, ও রাণীমা, গিন্নী কোথায়? সে নেহাৎ ছেলেমানুষ বৌটি। তা যাই বল বাপু, তোমার এক আধদিন যাওয়া কোত্তব্য। সকল প্রেজারাই যখন যায়–

সকল প্রেজারাই যখন যায়!

সত্য দপ্ করে জ্বলে উঠে বলে, তা আমি তো আর ওনাদের প্রজা নই পঞ্চুর মা! ভাড়া দিই, থাকি!

তা সে একই কথা! পঞ্চুর মা বিগলিত স্বরে বলে,খাজনা দিলে প্রজা, ভাড়া দিলে ভাড়াটে। গিন্নীর যেন একটু গোসা-গোসা ভাব দেখলাম, তাই বলছি। মানে বড়মানুষ তো? রাতদিন তোয়াজ পাচ্ছে, তাতেই অঙ্খর ভাব। মনে করে, সাত নম্বর কেন তোয়াজ করে গেল না? একদিন গেলেই ও গোসাটা কাটে।

আমার সময় কোথা? সত্য গম্ভীর ভাবে বলে।

ওমা শোন কথা! পঞ্চুর মা বিস্ময় রাখবার জায়গা পায় না, এই গলির এপার ওপার, একটু একবার যেতে তোমার সময় হবে না? তা হলে বলি বৌদিদি, অঙ্খার তোমারও কম নয়।

তা হলে বুঝেছিস? হেসে ফেলে সত্য।

বুঝেছি। বুঝেই আছি। তবে কিনা তোমার হিতের জন্যই বলছি। জলে যখন বাস, কুমীরের সঙ্গে ভাব রাখাই ভাল।

 দেখ পঞ্চুর মা, ওসব তোয়াজ করা-টরা আমাকে দিয়ে হবে না। তা সে কুমীরের কামড় খেতে হয় তাও ভাল।

আহা-হা, তা কেন! কামড়ের কথা হচ্ছে না। তোমরা হলে গে জগতের সেরা, উঁচু বামুন। তোমাদের মান্যির কাছে কি আর পয়সার মান্যি? তবে কিনা কালটা কলি, এই আর কি। কলি কালে পয়সাই মোক্ষ। নইলে এই এগারো নম্বর বাসার চক্কোত্তি-গিন্নী অমন করে দত্ত-গিন্নীর পায়ে তেল দেয়?

যাক পঞ্চুর মা, ওসব কথা তুলিস নে। আমার মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। বড়মানুষের বাড়ি যাওয়া আমার পোষাবে না, এই হচ্ছে সাদা বাংলা। তা তাতে এখানের বাস ওঠাতে হয় তাও ভাল।

পঞ্চুর মা মানুষটা ভাল। লাগানে-ভাঙানে নয়। আর বোধ করি সত্যর এই তেজস্বিতাকে সে সমীহ করে। তাই গিয়ে বড় বাড়ির গিন্নীর কানে তোলে না কথাটা। নইলে ও-বাড়িতে তো আর নিত্য গতায়াত।

কারণ ঝি-খেটে খেলেও পঞ্চুর মা মালির মেয়ে। তার বোনঝি ওই বড় বাড়িতে ফুলের যোগানদার, বোনঝির সেখানে অশেষ প্রতিপত্তি। পঞ্চুর মা সেই সুবাদে দৈনিক জলপানিটি বরাদ্দ করে নিয়েছে ও বাড়িতে

আর রাজ্যের ঝি আর মালিনী তাতিনী নিয়েই তো আসর গিন্নীর।

তাই সে ভাবে, একটা দিন গেলে যদি বড় বাড়ির গিন্নীর মনটা প্রসন্ন হয়, গেলেই বা। কিন্তু সত্য উড়িয়ে দেয়।

বলে, বড়মানুষের বাড়ির চৌকাঠ ডিঙোতে আছে? বাপ!

তবু সত্যকে একদিন বড় বাড়ির চৌকাঠ ডিঙোতে হল।

ওদের রাঁধুনী বামনী আর গিন্নীর খাস ঝি এসে কর্তার নাতির মুখে-ভাতে’র নিমন্ত্রণ করে গেল। নতুন কাঁসার রেকাবিতে চারজোড়া সন্দেশ, আর নতুন পেতলের ঘটিতে সেরটাক তেল দাওয়ায় নামিয়ে দিয়ে বলল, নাতির মুখের পেসাদ নেমন্তন্ন করে গেলাম। বাড়িসুদ্ধ সব যাওয়া চাই। বাড়ির যেন উনুন না জ্বলে।

সত্য মৃদু গম্ভীর ভাবে বলে, কবে অন্নপ্রাশন?

এই তোমার গে পরশু।

সত্য আরও গম্ভীর ভাবে বলে, তবে? ছুটির দিন তো না? বাবুকে দশটায় আপিস যেতে হয়। উনুন না জ্বললে চলবে কেন? অত সকাল সকাল তো আর যজ্ঞিবাড়িতে ভাত মিলবে না?

তা জানি না। রাধুনী খরখরে গলায় বলে ওঠে, পাড়ার কারুর ঘরে উনুনের ধোয়া উঠতে দেখলে গিন্নী আর রক্ষে রাখবে না, এই হচ্ছে সংবাদ।

তা হলে বাবুকে সেদিন পান্তা খেতে হবে! সত্য নিশ্চল দাঁড়িয়ে বলে।

আর রাঁধুনী বামনী গালে হাত দিয়ে থ’ হয়ে যায়। তারপর খরখরিয়ে ওঠে, ওমা এ যে সব্বনেশে মেয়ে গো! রাণীমা তো ঠিকই বলেছে, আর সকল বাড়ি শুধু ঝি গেলেই বোধ হয় হত, সাত নম্বরে বামুনদি তুমি সঙ্গে যেও। ওনার বড় দেমাক, কি জানি যদি শুদ্দ্ররের মুখের নেমন্তন্ন না নেন।

তা ভাল! চোখে না দেখেও মানুষ চিনতে পারেন! তোমাদের রাণীমা তো খুব গুণী!

রাঁধুনী বোধ করি কথাটার নিহিতার্থ হৃদয়ঙ্গম করতে না পেরেই বলে, গুণী, সে কথা আর বলতে! একবার কেন একশোবার! গেলেই জানতে পারবে কি দয়া-দাক্ষিণ্যে! আর রূপও তেমনি। যেন জগদ্ধাত্রী প্রিতিমা!

গিন্নীর খাসদাসী সঙ্গে।

কাজেই জানা কথা এই যে স্ততিগান একেবারে ব্যর্থ হবে না।

সত্য বলে, তা দাঁড়াও। ঘটিটা রেকাবটা নিয়ে যাও।

শুনে ঝি বামনী দুজনেই হেসে ওঠে, ওমা! বলে কি গো? নিয়ে যাব কি গো! ও তো সামাজিক বিলোনোর জন্যে। একেবারে ব্যাপারীদের কাছে বায়না দিয়ে এক মাপের এক গড়নের অমন হাজারখানেক আনানো হয়েছে। এসব বুঝি দেখনি কখনো?

সত্য আর দ্বিরুক্তি না করে জিনিস দুটো ঘরে উঠিয়ে রাখে। এই হাসির শব্দ যেন ছুরির মত বিধতে থাকে।

দেখবে না কেন?

রামকালী চাটুয্যের মেয়ে সত্য অনেক কিছুই দেখেছে। বাসন বিলোনোও দেখেছে বৈকি। কিন্তু সেটা কখন কিভাবে বিলানো হয় তা তার জানা ছিল না।

ভাবল, কি জ্বালা! যদি বা পাঁচ টাকায় এমন মনের মত বাসাটি পাওয়া গেল, তার সঙ্গে জুটল এই পিঁপড়ের কামড়!

এতদিন ওদের বাড়িতে না গিয়ে চলেছে, আর চলল না দেখা যাচ্ছে। সামাজিক নেমন্তন্ন বলে কথা।

.

গাড়ি-পালকির পথ নয়, তবু এসব কাজে পালকিতে চেপে যাওয়াই রেওয়াজ। পঞ্চুর মা বলে, আমি এই বাসন কখানা মেজে ফেলে বাসা থেকে কাঁচা কাপড় পরে আসছি বৌদিদি, তুমি সাজগোজ করে নাও ততক্ষণ, আর খোকাঁদেরও পোশাক-আশাক পরিয়ে–

খোকারা তো এখন ইস্কুলে চলল। বলল সত্যবতী।

ওমা, সে কি কথা! নেমন্তন্ন খাবে না ওরা?

ইস্কুল কামাই করে?

পঞ্চুর মা অবাক হয়ে বলে একদিন তোমার ইস্কুল কামাইটা এমন মারাত্মক হল বৌদিদি? পাড়াসুদ্ধ ছেলে কেউ আজ ইস্কুলে যাবে নাকি? বলে বিশ দিন থেকে দিন গুনছে সবাই। বড়মানুষের বাড়ির নেমন্তন্ন, কত ভালমন্দ সামগ্রীর আয়োজন, বারো মেসে সংসারে তোমার গে সেসব চোখেও দেখতে পায় না কেউ_

সত্য ঈষৎ কঠিন সুরে বলে, তা বারো মাস যখন দেখতে পায় না, একদিন পেয়েই বা কি রাজ্যলাভ হবে? তুই বাসা থেকে ঘুরে আয়, আমি একাই যাব।

জানিনে বাবা! তোমার মতিগতি কেমন! বলি ছেলেরা না গেলে মাথা পিছু ছাঁদাটাও তো বেবাক লোকসান।

লাভ-লোকসানের হিসেব তোর সঙ্গে করতে বসতে পারছি না পঞ্চুর মা, কাজ সেরে বাসা থেকে ঘুরে আয়।

পঞ্চুর মা তথাপি হাল ছাড়ে না।

বলে, তা বৌদিদি, খোকারা ইস্কুল থেকে ফিরেও যেতে পারে। খ্যাঁট তো তোমার গে এই দুপুর থেকে সাঁজ সনধে অবধি চলবে?

তুই থামবি? বলে ধমক দিয়ে সরে যায় সত্য।

নবকুমার কোটের পকেটে পানের কৌটোটা ভরে নিতে নিতে বলে, ছেলেদের নিয়ে গেলেই পারতে!

কেন?

কেন আবার কি! নেমন্তন্ন–

নাঃ, বড়লোকের বাড়ি না যাওয়াই ভাল। ছেলেবুদ্ধি ছেলেমন, অত জাঁকজমক দেখে এসে শেষে নিজেদের তুচ্ছ মনে করতে শিখবে।

তোমার যত সব উদ্ভট কথা! মাথাতে আসেই যে কি করে! যাক, যাবে একটা টাকা নিয়ে যেও। সামাজিক আশীর্বাদটা দিতে হবে তো?

সত্যর জোড়া ভুরু নেচে ওঠে।

কৌতুকের হাসিতে মুখ উজ্জ্বল দেখায়।

একটা টাকা! ধুৎ! এতদিন ধরে এত সিধে শাড়ি কাপড়চোপড় পেয়ে আসছি, যদি তার শোধ দেবার সুযোগ পাচ্ছি, টাকা দিয়ে সারব কেন?

তবে কী দেবে? গিনির মালা?

নবকুমারও রহস্য করে।

গিনীর মালা? না। বেআন্দাজী কিছু করতে যাব না। এইটে দেব।

সত্য তোরঙ্গ খুলে একটা জিনিস বার করে। মুঠোয় চেপে রহস্যভরে বলে, হাত গুনে বল, কি এটা?

হাত গুনতে জানি না। আপিসের বেলা হয়ে যাচ্ছে। দেখাবে তো দেখাও।

সত্য মুঠো খুলে ধরে।

আর ঝকমক করে ওঠে সোনার জলুস।

কড়িহার একগাছা। ভরি পাঁচেকের কম নয়।

নবকুমার হেসে ফেলে বলে, ইস, তা আর নয়! প্রাণ ধরে পারবে?

নিশ্চয়। আমার প্রাণ অত হালকা নয়।

পাগলামি করো না।

পাগলামি নয়, সত্যিই দেব।

ওই অতবড় সোনার হারছড়া দিয়ে দেবে? বড়মানুষের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার সাধ!

পাল্লা নয়। সত্য গম্ভীর ভাবে বলে, মান-সম্মান রক্ষে। বলে কিনা প্রজা!

ওদের কাছে তোমার মান? ওরা হল গে লাখপতি।

তাতে আমার কি? এবার নবকুমার বোঝে, রহস্য নয়, সত্যি। ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে।

বলে, সর্বনাশা বুদ্ধি না হলে এমন কাণ্ড কেউ করতে যায় না। বলে, একটা টাকায় যেখানে মেটে, সেখানে এতবড় একগাছা সোনার হার! এ শুধু বদ্ধ পাগলেই করে। তা ছাড়া উড়নচণ্ডে হয়ে সোনাদানা নষ্ট করবার অধিকারই বা দিয়েছে কে সত্যকে? এলোকেশী যদি টের পান, রক্ষে রাখবেন?

সত্য গম্ভীর ভাবে বলে, এ তোমার মায়ের জিনিস নয়।

নয় মানে! তোমার বাবা যে কালে সালঙ্কারা কন্যে দান করেছে–

এ আমার বিয়ের সময়ের জিনিস নয়। সেসব তোমার মা সঙ্গে দেনও নি। এবারে নিত্যনন্দপুরে যেতে ছোট খোকার নাম করে পিস্ঠাকুমা দিয়েছেন।

দিয়েছেন বলেই বিলোতে হবে? না না, ওসব বদখেয়াল ছাড়।

তা হলে আমার যাওয়া হয় না।

যাওয়া হয় না! চমৎকার! বলি এত যদি টেক্কা দেওয়ার শখ, নিজের জন্যেও তাহলে হীরে মুক্তো জরি বেনারসী যোগাড় করো?

তা কেন? সত্য দৃঢ়ভাবে বলে, বামুনের মেয়ের শাখা আর লালপাড় শাড়ীই মস্ত আভরণ!

তা শেষ পর্যন্ত সেই মস্ত আভরণেই সজ্জিত হয়ে ও বাড়িতে গিয়ে হাজির হল সত্য পঞ্চুর মার সঙ্গে। একখানা নতুন কাঁসার রেকাবিতে সেই কড়িহারছড়া আর একটু ধানদুর্বো নিয়ে।

নৌকতার বহর দেখে পঞ্চুর মাও তাজ্জব হয়ে গেছল। গালে হাত দিয়ে বলেছিল, হ্যাঁগো বৌদিদি, বড় বড় কুটুমবাড়ি থেকেও তো দুটো একটা টাকাই দেয়। আর তোমার মতন এই পাড়াপড়শী প্রেজারা চারগণ্ডা কি জোর আটগণ্ডা পয়সা। একটা টাকা হল তো খুব বেশী হল। আর তুমি।

হোক হোক, চল তুই।

.

ছেলে কোন্ ঘরে? সত্য শুধোল একজনকে।

সম্ভবত সে দাসী। কারণ পঞ্চুর মা তাড়াতাড়ি আগবাড়িয়ে এসে একগাল হেসে বলে, এই যে সুখদার পিসি! নিয়ে এলাম আমাদের বৌদিদিকে। সাত নম্বরের বাড়ির

ও!

সুখদার পিসি ভুরুর ইশারায় দিকনির্দেশ করে বলে, ওই উদিককার দালানে বসাও গে!

বসবে বসবে! তা অগ্রে খোকাবাবুকে আশীর্বাদ করে

সুখদার পিসীর এতক্ষণে বোধ করি হাতের জিনিসটার প্রতি নজর পড়ে। ঈষৎ বিস্ময় এবং সমীহ মিশ্রিত স্বরে বলে, তা তবে ওপরতলায় নে যাও। মোক্ষদার কাছে আছে ছেলে।

মোক্ষদা এ বাড়ির খোদ ঝি।

গিন্নীর পরের পদটাই তার।

বাড়ির বৌ-ঝিরা পর্যন্ত তার ভয়ে তটস্থ। আর অন্য ঝিদের তো সে দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। মোক্ষদার জিম্মাতেই আছে ছেলে। কারণ ছেলের সর্বাঙ্গে আজ গয়না।

ন্যাড়া মাথা, সর্বাঙ্গে অষ্ট অলঙ্কার, আর সলমা-চুমকির-কাজ-করা ভেলভেটের পোশাকের জ্বালা, হাঁ হাঁ করে কাঁদছিল ছেলেটা।

“মুখ-দেখানি”র থালা সামনে নিয়ে ক্রন্দনরত ছেলেটাকে কোলে চেপে ধরে বসেছিল মোক্ষদা কালো মোষের মত চেহারাখানি নিয়ে।

পঞ্চুর মার সঙ্গে সত্যকে দেখেই বাজখাই গলায় বলে ওঠে, এই বুঝি তোর মনিব পঞ্চার মা? যাক পা’র ধুলো পড়ল তা হলে?

সত্যর ভুরু কুঁচকে ওঠে।

তবু সে ধীরভাবে এগিয়ে গিয়ে ধানদুর্বো নিয়ে ছেলের মাথায় দিয়ে হারসমেত রেকাবিটা নামিয়ে দেয় মুখ-দেখানির থালার কাছে। যে থালায় টাকার চাইতে আধুলি, ও আধুলির চাইতে সিকির সংখ্যাই বেশি।

সঙ্গে সঙ্গে ভুরু কুঁচকে ওঠে মোক্ষদারও। এটা কি পঞ্চার মা?

পঞ্চার মা বলে তটস্থ ভাবে, এই খোকাবাবুর আশীৰ্বাদ মোক্ষদাদি! বৌদি বলে একটা টাকা নিয়ে গিয়ে আর কি হবে পঞ্চুর মা! বড়মানুষের বাড়ি, সমুদুরে পাদ্য-অর্ষি–তাই।

বাজে বাজে বকছিস কেন মিথ্যে? তীব্র স্বরে ধমকে ওঠে সত্যবতী। তীব্র তবে মৃদু।

মোক্ষদা একবার সত্যর আপাদমস্তক দেখে নেয়, একবার হারছড়া হাতে তুলে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে অনুভব করে। তারপর বিরস স্বরে বলে, এ হার তুমি উঠিয়ে নিয়ে যাও গো সাত নম্বরের গিন্নী। এদের ঘরের ছেলেপেলে গিল্টির গয়না পরে না।

গিল্টির গয়না!

পঞ্চুর মার বুকটা বসে যায়।

নিব্বোধ ছুঁড়ির নির্বুদ্ধি দেখে এ পর্যন্ত সে মনে মনে হাসছিল। ভাবছিল শহুরে বড়মানুষ তো দেখে নি কখনো, তাই তরাসে বেআন্দাজী একটা নৌকতা করে বসেছে। তা বসুক। পঞ্চুর মার মুখটা বড় হবে বোনঝির মনিববাড়িতে।

কিন্তু এ কী!

এ যে মুখে চুনকালি! ছি ছি, ই কি মুখ্যুমি। তুই এই দত্তবাড়িতে নিয়ে এলি গিল্টির গয়না!

প্রায় হতভম্ব হয়েই তাকিয়ে থাকে সে। কিন্তু ততক্ষণে উত্তর দিয়েছে সত্য। তীক্ষ্ণ তবে মৃদু।

তুমি বুঝি এখানে নতুন কাজে ঢুকেছ?

নতুন? আমি নতুন কাজে ঢুকেছি? মোক্ষদা আগুনের মতন গনগনিয়ে ওঠে, ওমা আমার কে গো! তুমি আজ নতুন পদান করেছ বলে মোক্ষদাও নতুন হয়ে গেল! এই বাড়িতে কাজ করতে করতে চুল পাকালাম। বলি এ প্রশ্ন যে?

প্রশ্ন তুমিই করালে বাছা! এতদিন এদের ঘরে কাজ করছ, সোনা চেনো না?

মোক্ষদা কালো মুখ আরও কালি করে বলে, তোমার কথাবাত্রা তো বড় চ্যাটাং চ্যাটাং! যা পঞ্চার মা, বড় রাণীমার কাছে নে যা। সেখেনে মুখটায় একটু লাগাম রেখে কথা কোয়ো গো ভালমানুষের মেয়ে। সে আর দাসীবাদীর এজলাশ নয়।

পঞ্চুর মা খানিক এগিয়ে ফিসফিস করে বলে, মোক্ষদার বড় দাপট মা! ওকে একটু তোয়াজ করে কথা কইতে হয়। যাই, দেখি আমার বুনঝিটা কোথায়। তাকে সঙ্গে পেলে বুকে একটু ভরসা পাই। খাস মালিনী তো সে। এই বিরাট বাড়ির যত মেয়েছেলে সব্বার খোঁপার জন্য রোজ বরাদ্দর ফুলের সাজ, রকমারি মালা, জরির ফুল, রাংতার চাঁদতারা, সব ওই আমার বুঝি…অ শৈল, কই, কই কোথায় লো–

পঞ্চুর মা ঝপ করে এগিয়ে যায়।

আর সত্যবতী দালানের একটা থামের কাছে দাঁড়িয়ে দেখতে থাকে তাকিয়ে তাকিয়ে বাড়ির বাহার, কারুকার্য, সাজসজ্জা!

দালানের ছাতটা কী উঁচু!

যেন কোথায় থামতে হবে ভুলে গিয়ে যথেচ্ছ উঠে গেছে উপর দিকে। সেই ছাদের নীচে ঝুলছে প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড ঝাড়লণ্ঠন, সত্য গুনে ফেলল, চকমিলানো দালানের চার কোণায় চারটে, আর মাঝামাঝি একটা করে, সবসুদ্ধ আটটা ঝাড়।

আগাগোড়া দালান শ্বেতপাথরে মোড়া, শুধু কিনারায় কিনারায় কালো পাড়। থামের মাঝখানে প্রতিটি খিলেনের মাথা থেকে ঝুলছে নানা মাপের পাখীর খাঁচা, পাখীর দাঁড়। হরেক রকমের পাখী। আশ্চর্য! এত পাখী কেন? এত পাখী পুষে কি হয়?

দালানের কোণে কোণে একটা করে পাথরের নগ্ন নারীমূর্তি। সত্য তাদের দিকে তাকিয়ে চোখটা তাড়াতাড়ি ফিরিয়ে নিল। ভাবল, মাগো মেয়েগুলোকে দেখে মনে হচ্ছে যেন জলজ্যান্ত! তার পর মনে মনে ফিক করে একটু হেসে ভাবল, বেচারীরা বোধ হয় রক্তমাংসেরই ছিল, হাজার লোকের চোখের সামনে অমন করে দাঁড়িয়ে থাকতে হওয়ায় লজ্জায় পাথর হয়ে গেছে।

বাইরে থেকে বাড়ির ভেতরের এতটা শোভা-সৌন্দর্য ঠিক বোঝা যায় না। ভিতরে ঢুকলে দেখে তাজ্জব বনতে হয়। ছেলেবেলায় বাবার কাছে নবাব-বাড়ির অনেক গল্প শুনেছে সত্য, আর অসীম কৌতূহলী চিত্তের অসংখ্য প্রশ্ন-শরাগাতে রামকালীকে বলতেই হত অনেক কিছু বিশদ করে। দত্তদের অন্তঃপুরে এসে সত্যর সেই ছেলেবেলায় শোনা নবাববাড়ির কথা মনে পড়ল। শোনা গল্পের সঙ্গে মনের রং আর কল্পনা মিশিয়ে নিয়ে এই ধরনের ছবিই একে রেখেছিল সত্য তার ধারণার জগতে।

তাই ভাবল, বাবা, এ যে দেখছি একেবারে নবাবী কাণ্ড!

এস গো বৌদিদি, উধ্বশ্বাসে ছুটে এল পঞ্চুর মা, এই সময় চল। এখন একটু ভিড় কম আছে।

সত্য আস্তে বলে, কাজের বাড়ি তো, কিন্তু এত বড় দালানের মানুষজনের চিহ্ন নেই কেন রে পঞ্চুর মা! বাড়ির গিন্নীটিন্নীই বা কোথায়?

ওমা শোন কথা! পঞ্চুর মা বিস্ময়ের চরম অভিব্যক্তি স্বরূপ গালে হাত দেয়।…

কি হল? মুচ্ছো গেলি যে!

তা মুচ্ছো যাওয়ার মতন কথাই যে বললে বৌদিদি। এ কী তোমার আমার মতন গরীবগুরবোর ধর যে নাতির অন্নপ্রাশনে ঠাকমা কোমর বেঁধে কাজ করে বেড়াবে? এ বাড়ির গিন্নীরা নীচের তলায় নাবে নাকি?

নীচের তলায় নামে না? সত্য হেসে ফেলে বলে, কেন, পায়ে বাত বুঝি?

বকো না বৌদিদি। হাসিও না। নীচের তলায় নাবার ওনাদের দরকার? বাহান্ন গণ্ডা দাসীবাদি মোতায়েন নেই? তা ছাড়া তোমার গে সংসারে কত অবীরে বেধবা প্রিতিপালিত হচ্ছে, তারাই সংসারের কন্না করছে। আর সরকার মশাই তো আছেনই। অবিশ্যি একেবারে নাবে না তা নয়, নাবে। পালপানে ঠাকুরদালানে আসে। তা তার জন্যে আলাদা সিঁড়ি আছে ভেতর ঘর দিয়ে। ইদিকটা হল গে, না সদর না অন্দর, দুইয়ের মাঝখান। মানুষজনের কথা বলছ? সে তোমার গিয়ে ইদিকে বড় নেই। ভিড় দেখতে চাও তো দেখ গে যাও ভেতরবাড়ির উঠোনে দালানে।… এ তো আর চালা বেঁধে ভিয়েন বসানো নয়, পেরকাণ্ড পেরকাণ্ড টানা লম্বা পাকা ভিয়েন-ঘর। তার ছেচতলায় মেছুনীরা বসেছে মাছ কুটতে। ভগবান জানেন কত মণ মাছ, তবে সে যা বঁটি, দেখে ভিরমি লেগে যায়। মদ্দ ছেলেরা পেরথমে ন্যাজা মুড়ো খণ্ড করে বাগিয়ে দিয়েছে, তারপর মেছুনীরা বসেছে ‘খামি’ করতে। দেখাব, সবই দেখাব তোমায় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে। আমি শৈলর মাসী বলে আমায় কেউ কিছু বলে না। আর বলবেই বা কেন? আমি বলব, আমার মনিব গো! গাঁ-ঘরের মানুষ, এত সব সাহেবী কেতা, শহুরে কাণ্ড তো কখনো দেখো নি, তাই

কথা হচ্ছিল এ-হদ্দ ও-হদ্দ দালানটা পার হতে হতে। তিন মুড়ো পার হলে তবে একেবারে শেষ মুড়োয় সিঁড়ি, সিঁড়ির কাছবরাবর এসে পৌঁছেও ছিল, হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে তীব্র তীক্ষ্ণ অথচ চাপা গলায় বলে ওঠে সত্য, পঞ্চুর মা!

কী হল গো? পঞ্চুর মা থতমত।

দেখ, কথা যখন কইতে জানিস না, হম্বি-দীর্ঘি জ্ঞান যখন নেই, তখন মেলা কতকগুলো কথা কইতে আসিস নে।

ওমা! কথার ভুল আবার কখন হল?

সে জ্ঞান থাকলে তো বুঝবি। তা তোকে এই পষ্ট কথায় সাবধান করে দিচ্ছি, আমাকে নিয়ে মিছে কতকগুলো বকবক করবি না। যা করতে এসেছিস তাই কর।

বাববাঃ! ধন্যি মেজাজ! মেজাজে তুমিও তো দেখছি রাজরাজড়ার থেকে কিছু কম যাও না। এদের এসব ঘরবাড়ি, বোটকখানা আর বাবুদের ঐশ্বয্যির দবৃদবা এই কলকাতা শহরে একদিন এমন রাষ্ট্র ছিল যে শুনতে পাই নাকি খাস বিলিতী সাহেবরা সুদ্ধ দেখতে আসত। আর তুমি কিনা-

হ্যাঁ, আমি ওই রকমই! ও বাবা, এ কে?

ও বাবা, এ কে? বলেই হঠাৎ থেমে দাঁড়ায় সত্য, তারপরই ঈষৎ এগিয়ে গিয়ে নিরীক্ষণ করে দেখে অনুচ্চস্বরে হেসে উঠে বলে, দেখ কাণ্ড! কে বলবে সত্যি সেপাই নয়!

পঞ্চুর মা এবার একটু গৌরব অনুভব করে, অঙ্খরি মানুষটা হয়েছে তা হলে জব্দ! স্বীকার পেয়েছে যে অবাক হয়েছে!

সিঁড়িতে উঠতে যেতেই ঠিক পাশে বন্দুক কাঁধে যে সেপাইটা খাড়া দাঁড়িয়ে আছে বীরের ভঙ্গীতে, প্রথম দিন সেটাকে দেখে পঞ্চুর মাও ঘাবড়ে গিয়ে দশ পা পিছিয়ে এসে দুগগা নাম জপ করতে শুরু করেছিল। দেখে শৈলের কি হাসি! সে রকম হাসি পঞ্চুর মার হাসতে ইচ্ছে করছে, তবে নেহাৎ নাকি মানুষটা বেখাপ্পা মেজাজী, তাই সাহস হয় না। শুধু একটু মুচকি হেসেই ক্ষান্ত হয়ে বলে, ওই দেখ, যত দেখবে তত আশ্চয্যি হবে। এখানেএক কুটুমবাড়ি তত্ত্ব নে গেছিলুম, তা সে বললে বিশ্বেস করবে না, তাদের বাগানে ফোয়ারার ধারে এমন একটা মেয়েছেলের মূর্তি বসানো আছে যে, দেখে লজ্জায় জিভ কেটে ছুটে পালাতে হয়। আমি বলে উঠেছিলুম পয্যন্ত মরণ মাগীর! এই বারবাড়িতে এমন বে-বস্তর হয়ে নাইতে এসেছে কেন? শ্বেতপাথরে গড়া তো, আমি ইনতাম করেছিলুম, বোধ হয় তোমার গে মেম-বাইজীটাইজী হবে। তা আমার কথা শুনে এ বাড়ির এক দাসী হাসতে হাসতে হাতের বারকোশখানাই ফেলে দিল। পথের ওপর মেঠাই গড়াগড়ি!

 সত্য এই হাসির নাটকে অংশগ্রহণ করে না, ঈষৎ কঠিন গলায় বলে, তা সেরকম মূর্তির অভাব তো এখানেও নেই। দেখে লজ্জায় জিভ কাটতে হয়েছে তো আমাকেও। তা এই বুঝি শহুরে বড়মানুষদের বাড়ির বাহার? রুচি-পছন্দকে বলিহারি যাই! পয়সা থাকে দেবদেবীর মূর্তি গড়িয়ে প্রিতিষ্ঠি কর না! তা নয় যত অসভ্যতা! বাপ-বেটায় মায়ে-পোয়ে একসঙ্গে আনাগোনা করতে হয় না এনে দিয়ে? দেখে লজ্জা লাগে না!

পঞ্চুর মা সত্যবতীর এই অবোধ নীতিজ্ঞানের মন্তব্যে একটি অবহেলা-মিশ্রিত পরিতৃপ্তির হাসি হেসে বলে, তা এসব তো আর হেঁজিপেঁজির ঘরের কাণ্ড নয়! এ তোমার গিয়ে বিলেত থেকে সায়েব কারিগর এসে পড়েছে। এর মান ময্যেদা আলাদা।

তাই বুঝি? তা বেশ। মানময্যেদার নিদর্শনটা দেখলাম ভাল। এখন চ দিকি, দায় সেরে ফিরতে পারলে বাঁচি।

সিঁড়িতে উঠতে উঠতে পঞ্চুর মা ফিস ফিস করে বলে, বললে তুমি শুনবে না বোধ হয়, তবু আমার কত্তব্য আমি করি, বলে রাখি তোমায়, যতই তুমি বামুনের মেয়ে হও, গিন্নীকে একটু মান সম্মান দিও। জোড়হস্ত দেখাই অব্যেস তো ওনাদের, বেতিকেরম দেখলে চটে যাবে।

সত্য আর একবার থমকে দাঁড়ায়, তেমনি তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলে, তবে দেখিয়ে দে জোড়হস্তটা কেমন ভাবে করতে হবে। শুধু জোড়হস্ত? না গলবস্তুর চাই? ধন্যি বটে পয়সার মহিমা! বলি এত যে ওদের স্তোত্তরপাঠ করিস, নিজের অবস্থা কিছু ফিরেছে তাতে? বাসন মেজে তো খাস। জোরহস্ত করবি ভগবানের কাছে, করবি মানুষের মতন মানুষের কাছে, পয়সার কাছে করতে যাস কেন মরতে?

সত্য বুদ্ধিমতী, তবু সত্য নেহাতই নির্বোধ। যে মরার কথা সে বলেছে, সে মরা কি একা পঞ্চুর মার? কে না যায় সে মরণে মরতে? কে না চায় সেই মৃত্যুসাগরে ডুবতে?

নইলে চক্রবর্তী-গিন্নী কেন দত্ত-গিন্নীকে অবিরত তেল দেয়? দত্তরা যে সোনার বেনে, আর সোনার বেনেরা যে জল অচল এ কথা কি জানে না চক্রবর্তী-গিন্নী?

সত্য যখন সিঁড়ি ভেঙে উঠে গিয়ে বড়গিন্নির ঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল তখন চক্রবতী-গিন্নী বিগলিত বিনয়ে, মুখের চেহারায় জোড়হাতের ভঙ্গী ফুটিয়ে বলছিলেন, তাই তো বলছি মা, তোমার মতন এমন উঁচু নজর কটা লোকের আছে? ঘরে তাই বলাবলি করি, হ্যাঁ, দরাজ প্রাণটা এনেছিল বটে দত্তদের গিন্নী!

সত্য এসে দাঁড়াতেই কথা ছেদ পড়ল। ঘরের মধ্যে যারা ছিলেন তাঁদের সকলেই চোখ পড়ল তার উপর। মোসাহেবের স্ত্রীলিঙ্গ কি আমার জানা নেই, যদি কিছু থাকে তো এঁরা দত্ত-গিন্নীর তাই। সেই সক্কাল বেলা থেকে অর্থাৎ যখন থেকে দত্ত-গিন্নী সভা করে আঁকিয়ে বসেছেন, তখন থেকে এঁরা তাকে ঘিরে বসে আছেন এবং চাটুবাক্যের প্রতিযোগিতা চালাচ্ছেন।

কাজ-কর্মের দিনে এইভাবেই গুছিয়ে বসেন দত্ত-গিন্নী, অথবা বসেন আরও সব বড়লোকের গিন্নীরা, এই ধরনের চাটুকারিণী পরিবৃতা হয়ে। নিমন্ত্রিত যাঁরা আসেন, তাঁরা পাতে বসবার আগে একে একে দুইয়ে দুইয়ে এসে দেখা করে যান। ওঁরা মানুষ বুঝে ওজন করে কথা বলেন।

এখানেও আজ চলছিল সেই পর্ব।

সত্য এসে দাঁড়াল সেই পর্বের পার্বণী যোগাতে।

সমস্ত দৃশ্যটার ওপর চোখ বুলিয়ে নিল সত্য।

দেখলে প্রকাণ্ড চারচৌকো ঘর, তার মেঝেটা শতরঞ্জ খেলার ছকের মত চৌকো সাদা-কালো পাথরে মোড়া। সমস্ত দেয়ালটায় একটা কালচে সবুজ রং আর নীচে থেকে হাততিনেক উঁচুতে টানা লম্বা একটা পাঁচরঙ্গা রঙের নকশার পাড় আঁকা। ঘরের মধ্যেও ছাতের নীচে ঝাড়লণ্ঠন। জানলাদরজাগুলো যৎপরোনাস্তি চওড়া আর উঁচু, তাতে পাখী-খড়খড়ির পাল্লা, আর তার পিঠ-পিঠ ফিকে নীল-রঙা কাঁচের শার্সি পাল্লা।

দেয়ালের ধারে ধারে সাজানো মেহগনী কাঠের আলমারি টেবিল, স্ট্যাণ্ড দেওয়া প্রকাণ্ড দাঁড়া আরশি, দাঁড়ানো ঘড়ি। আলমারির সামনে টেবিলে ওপর দেওয়ালের ব্র্যাকেটে নানাবিধ পুতুল খেলনা টাইমপিস ফুলদানি, উঁচুতে দেওয়ালের গায়ে অয়েল-পেন্টিং।

এত বড় ঘরটা আগাগোড়া জিনিসে বোঝাই। ঘরের ঠিক মাঝখানটায় একটা মস্ত চৌকো পালঙ্ক, পালঙ্কের গদিটা প্রায় হাতখানেক পুরু, একখানা ধপধপে সাদা চাঁদর তাতে টান টান করে পেতে গদির তলায় তলায় গোঁজা। সেই পালঙ্কের উপর চারিদিকে গির্দে তাকিয়া সাজিয়ে শ্বেত হস্তীর মত বিপুল বপুখানি নিয়ে বসে আছেন দত্তবাড়ির বড়গিন্নী।

বড়গিন্নী যে বিধবা সে কথা জানা ছিল না সত্যবতীর, কিন্তু এ কেমন বিধবা? সত্যর মনের মধ্যে প্রশ্নের প্রাবল্য। এ কি রকম সাজসজ্জা? বড়গিন্নীর পরনে দর্শকের দৃষ্টি-পীড়াকারী অতি মিহি চন্দ্রকোণার থানধুতি, আর আঁচলে বড় থোলোয় চাবি, সামনের চুল “আলবোট” ফ্যাশান, পিছনে একটি বড়ির মত খোঁপা।

বড়গিন্নীর নীচের হাত শূন্য ফাঁকা, কিন্তু উপর হাতে বোধ করি নিরেট সোনার মোটা মোটা প্লেন তাগা। গলায় গোছা করা গোট হার। কোলের কাছে রূপোর ডাবরভর্তি সাজা পান।

পালঙ্কের ধারে দাঁড়িয়ে বাজুর ওপর থেকে হাত বাড়িয়ে দাসী বা কোনও আশ্রিতা একখানি ঝালরদার পাখা দুলিয়ে দুলিয়ে বাতাস করছে। পালঙ্কের নীচে পায়ের কাছে একখানা জলচৌকির উপর সোনার মত ঝকঝকে একটা বড় পেতলের পিকদানি, আশেপাশে চাটুকারিণীর দল। অবস্থা সম্পর্কে এবং মর্যাদা হিসাবে কেউ পালঙ্কের উপরেই বড়গিন্নীর গা ঘেঁষে বসেছেন, কেউ আলগোছে একটুখানি বসেছেন পালঙ্কের কিনারায়, কেউ কেউ বা পালঙ্ক ঘিরে আশেপাশে দাঁড়িয়ে। তারে মধ্যে সধবা আছে, বিধবা আছে, বয়স্কা আছে, তরুণী আছে।

শূন্য প্রকোষ্ঠের উপরভাগে বাহুতে মোটা সোনার তাগা ভারী বিসদৃশ লাগল সত্যর, আর বিসদৃশ লাগল বিধবা মানুষের এরকম পানের ডাবর কোলে করে খাটগদিতে বসে থাকা। ইতিপূর্বে কোন বিধবাকে কখনো খাটগদিতে বসে থাকতে দেখেনি সত্য।

মনটা হঠাৎ কেমন বিমুখ হয়ে গেল। ভাবতে চেষ্টা করল বটে, মরুক গে, এই যদি কলকাতা শহরের চালচলন হয়, আমার কি? কিন্তু চেষ্টাটা ফলবতী হল না। মন সেই মোটা তাগা পরা হোট ছেলেদের পাশবালিশের মত মোটা মোটা ন্যাড়া হাত দুখানার দিকে তাকিয়ে সিঁটিয়ে রইল।

বড়গিন্নী চোখের কেমন একটা ইশারা করলেন, সঙ্গে সঙ্গে দ্রুতভঙ্গিতে একজন জলচৌকিতে বসানো সেই পিকদানিটা উঠিয়ে নিয়ে তার মুখের কাছে ধরল। বড়গিন্নী পিচ করে একটু পিক ফেলে বললেন, কে এসে দাঁড়াল র‍্যা? চিনতে পাচ্ছি না তো?

এগিয়ে এল পঞ্চুর মা, বলে উঠল, ওই যে আপনার সাত নম্বর বাড়ির

অ। তাই বলি চিনতে পারছি না কেন? আসে নি তো কখনো? তা এসো বাছা, একটু এগিয়ে এসো। পায়ের ধুলো দাও খানিকটা।

“পায়ের ধুলো” নামক জিনিসটা যে নিজে থেকে দেওয়া যায় এ হেন অভিনব কথা সত্য জীবনে এই প্রথম শুনল। তার জানার জগতে জানা আছে ওটা যার নেবার ইচ্ছে হয়, সে এসে মুণ্ডু হেঁট করে আহরণ করে নেয়।

কিংকর্তব্য বুঝতে না পেরে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে।

কই গো দাও?

জনৈকা ধামাধারিণী তীব্রকণ্ঠে বলে ওঠেন, পার তলা থেকে এক ফোঁটা ধুলো নিয়ে এনার মাথায় দিয়ে দাও।

সত্য গম্ভীর ভাবে বলল, পায়ে ধুলো নেই।

পায়ে ধুলো নেই!

এইটা একটা কথা হল?

তা ছাড়া দত্তগিন্নীর প্রার্থিত বস্তু, তাও সোনা নয় দানা নয়, নেহাতই তুচ্ছ বস্তু! সেই বস্তুর প্রার্থনা যে এভাবে অগ্রাহ্য করা যায়, এ তো অভাবনীয় কথা!

দত্তগিন্নী গালে হাত দিয়ে কোনরকমে বিস্ময় এবং অবহেলার ভাব কমিয়ে ফেলে ব্যাঙ্গহাসি হেসে বললেন, সেই যে বলে না, অভাগা যদ্যপি চায়, সাগর শুকায়ে যায়, আমার ভাগ্যে যে দেখছি তাই হল! এক ফোঁটা পদরজও দুর্লভ হল!

সত্য অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখে সেই আকার-অবয়ব-বর্জিত মেদপিণ্ডের মুখের দিকে। এই মাংসের তালের মধ্যে থেকে বয়স উদ্ধার করা কঠিন, কিন্তু যিনি পৌত্রের অন্নপ্রাশন দিতে বসেছেন, নেহাৎ কিছু ছেলেমানুষ তিনি নন, কোন্ না সত্যর দিদিমার বয়সী! সত্যর সঙ্গে এ আবার কোন ধরনের রসিকতা তার?

ঝড়ের আগে এঁটো পাত সদৃশ একটি মহিলা বলে ওঠেন, মানুষ বুঝে কথা কইতে হয় বাছা! কইবার আগে তাকিয়ে দেখতে হয় কাকে কি বলছি!

বলা বাহুল্য সত্য নীরব।

শুধু তাঁর প্রকৃতি অনুযায়ী চোয়ালের পেশীগুলো দৃঢ় আর কঠিন হয়ে ওঠে।

সোনার হার দিয়ে নৌকতা করেছ, তুমিই না?

এবার সত্য মুখ খোলে।

নরম গলায় বলে, নৌকতা বলছেন কেন? খোকাকে যৎসামান্য কিছু আশীর্বাদ বৈ তো নয়।

তা সে যাই হোক, দত্তগিন্নী অসন্তুষ্ট স্বরে বলেন, ও হার তোমাকে ফিরে নিয়ে যেতে হবে।

নিয়ে যেতে হবে!

সত্য অবাক হয়ে বলে, ছেলেকে দেওয়া জিনিস কী করব নিয়ে গিয়ে?

কী করবে সে তোমার বিবেচনা। তবে পেরজার দানের সোনা আমরা নিই না।

আবার সেই প্রজা!

সত্যর সমস্ত শরীরের মধ্যে যেন একটা বিদ্যুৎপ্রবাহ বয়ে যায়, তবু সে কষ্টে আত্মসংবরণ করে বলে, তাহলে দেখছি আপনাদের এই সব প্রজা-পাঠকদের নেমন্তন্ন করাটাই ভুল, নৌকতা না দিয়ে কে আর কোন কাজে যায় বলুন? তা ছাড়া ব্রাহ্মণে কি আশীর্বাদ ফিরিয়ে নিতে পারে?

ব্রাহ্মণ!

দত্তগিন্নী একটু মলিন হন।

ওমা! এ যে দেখছি কাঠ-কাঠ কথা! দত্তগিন্নী বলেন, পোড়ারমুখী মোক্ষদা তো তা হলে ঠিকই বলেছে! যাক্, তুমিই তো হলে জিতলে। অতিথি নারায়ণ, যা বলবে শুনতেই হবে। তবে কাজটা ভাল হয় নি তোমার। বামুনের মেয়ে তুমি, তোমাদের পায়ের ধুলো আমাদের শিরোভূষণ, বলব না তোমায় আমি কিছু, শুধু এইটুকু বলব, পুঁটিমাছও মাছ, রুইমাছও মাছ, তবু কে আর তাদের এক সমান বলবে বল? যা বলেছি তো অতিথি নারায়ণ! ওরে সুবাস, একে সঙ্গে করে বামুনের পাতার ঘরে বসিয়ে দিগে যা।

অর্থাৎ এখানেই বাক্য ইতি।

সত্য ধীরে ধীরে সরে আসে আর হঠাৎ মনে হয় তার কোথায় যেন তার একটা হার হল।

সত্য কি খাবে না?

চলে যাবে?

বলবে শরীর খারাপ?

কিন্তু কিছু বলার আগেই দত্তগিন্নী ফের কথা বলেন, তোমাদের ছেলেদের আনো নি?

না।

কেন? সগুষ্টি নেমন্তন্ন হয়েছিল না?

সত্যর জোড়া ভুরু চির অভ্যাসমত কুঁচকে ওঠে, আর গলায় ফিরে আসে মৃদু কঠিন স্বর। সেই স্বরে উত্তর দেয়, না, নেমন্তন্ন আপনার ত্রুটি কিছু হয় নি। তবে সগুষ্টির এসে মাথা মুড়োবার সময় হলে আর উপায় কি! যা আমি তো এসেছি, তাতেই হবে। কথাতেই আছে, শিরে জল ঢাললে সর্বাঙ্গে পড়ে।

ঘরে যারা উপস্থিত ছিল তারা সাত নম্বর বাড়ির ভাড়াটের এ হেন স্পর্ধাযুক্ত কথায় বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায় এবং ভাবলেশশূন্য মেদপিণ্ডেও কঠিন একটা ভাবের খেলা ফোটে। তা তিনিও দত্তবাড়ির বড়গিন্নী। তাই নিজেকে সামলে নিয়ে বলেন, বামুনদির কথার তো খুব বাঁধুনী! নেকাপড়া জানা বুঝি? ভাল ভাল। দেখি নি তো এর আগে, দেখে বড় আমোদ পেলুম। তা যাক, খেও ভাল করে। আর ছেলেদের ছাঁদাটা নিয়ে যেও।

সত্য চলে যাচ্ছিল সেই সুবাস না কে তার সঙ্গে, হঠাৎ মুখ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে তীক্ষ্ণ একটু হাসির সঙ্গে বলে, আমি পাড়াগাঁয়ের মেয়ে শহুরে রীতির কিছু জানি নে। নেমন্তন্ন করে ডেকে এনে অপমান করাই বুঝি কলকেতার চাল?

ওমা, শোন কথা!

দত্তগিন্নীর দুধের মত সাদা মুখখানায়ও হঠাৎ কালি মেড়ে যায়, আমতা আমতা করে বলেন, তোমরা হলে গে কুলের কুলীন, সব বামুনের সেরা বামুন, যাকে বলে জাত সাপ। তোমাদের অপমান্যি করবে, এত সাধ্যি কার আছে বল ভাই বামুনদি? যদি দোষত্রুটি কিছু হয়ে থাকে নিজগুণে মার্জনা করে আমার খোকাকে একটু আশীর্বাদ করে যাও।

সত্য স্থির স্বরে বলে, আশীর্বাদ তো অবিরতই করব। কিন্তু আমাকে একটু শীগগীর ছেড়ে দিতে হবে, তাড়া আছে।

শূদ্দুর-বাড়ি বামুনের খাওয়া।

দিনদুপুরে মোটা মোটা খানকতক লুচি, আলুনি খানিকটা কুমড়োর ঘ্যাঁট আর আলুনি বেগুনভাজা। অবশ্য হরেকরকম মিষ্টি আছে, আছে দই ক্ষীর।

তা কোনটাই সত্যর কাছে আকর্ষণীয় নয়। তবু খেয়ে দায় সেরে নিয়ে তাড়াতাড়ি পঞ্চুর মার সন্ধান করে। কিন্তু কোথায় পণুর মা? সে তখন ঢপের আসরে গিয়ে বসেছে। তিনতলার ওপর প্রকাণ্ড হলে সে আসর বসেছে। নাতির ভাতে “ঢপ-কীত্তন” দিয়েছেন দত্তগিন্নী।

মানদা ঢপি এসেছে।

আর নাকীসুরে টেনে টেনে কী একটা গানের গোড়াবাঁধুনি শুরু করছে।

পঞ্চুর মার তল্লাস করতে এসে দাঁড়ায় তার বোনঝি শৈল।

ময়লা রং, কালো ফিতেপাড় শাড়ি পরনে, সাদা ধবধবে সরু সিথির দুপাশে পাতাকাটা চুল, সর্বাঙ্গ নিরাভরণ তবু মনে হয় মেয়েটা খুব সেজেছে তো! এটা মনে হয় হয়তো মাজাঘষা গড়নের জন্যে, হয়তো বা পানেরাঙ্গা ঠোঁটের জন্যে।

শৈল বার্তা শুনে অবাক হয়ে বলে, ওমা, চলে যাবে কী গো? ঢপ শুনবে না?

না।

কী আশ্চয্যি! শোনবার লেগে লোকে মরে যায়, আর তোমার এত অগেরাহ্যি? মনে ভাবছ বুঝি শুনলেই প্যালা দিতে হবে? তা তুমি দিলেও পার, না দিলেও পার, ওটা হচ্ছে ইচ্ছেসাপেক্ষ।

তুমি পঞ্চুর মাকে ডেকে দেবে?

ও বাবা! দিচ্ছি দিচ্ছি! মাসি তাই বলছিল বটে—

শোন তোমার মাসিকে বল একেবারে যেন একখানা পালকি ডেকে তবে আসে!

পালকি! ও বাবা!

শৈল পানেরাঙা ঠোঁটের একটা অপরূপ ভঙ্গি করে ওদিকে এগিয়ে যায়।

.

তীব্র তীক্ষ্ণ সরু গলায় গানের আওয়াজ এ বাড়ি থেকেও শোনা যাচ্ছে। শুধু এ বাড়ি কেন, দূরে অদূরে বোধ করি পাড়ার সব বাড়ি থেকেই শোনা যাচ্ছে। সুরের জন্যে যত না হোক, গলার জন্যই ‘মানদা ঢপি’ বিখ্যাত! তীক্ষ্ণ শানানো গলা, গলায় সেই সুর–গান থামবার পরেও বাতাসের গায়ে ঝনঝনিয়ে আছড়ায়।

সত্য কখনও ঢপকেত্তন শোনে নি।

ছেলেবেলায় সেজঠাকুর্দার সঙ্গে কখনো কখনো হরিসভায় কেত্তনগান শুনতে যেত, সে অন্যরকম। তার গানের থেকে অনেক জোরালো ছিল খোল করতালের জগঝম্প। আরও ছোটয় বাবার সঙ্গে একবার যেন হালিশহরে না কোথায় নৌকো করে গিয়েছিল কালীকীর্তন শুনতে, আবছা মনে পড়ে। আর কবে কোথায়?

বারুইপুরে পানের চাষ অনেক আছে বটে, গানের চাষ নেই।

আজ যদি মেজাজটা অমন না বিগড়ে যেত, দু দণ্ড বসে গান শুনে আসত সত্য, কিন্তু হল না। শোনা। যাচ্ছেতাই হয়ে গেল মন মাথা।

নিজের বাড়ির দাওয়ায় দাঁড়িয়ে একটু শোনবার চেষ্টা করল, তা সে ওই সুরের একটা রেশ ছাড়া কিছুই কানে এল না। একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে নিঃশ্বাস ফেলে সরে এল সত্য। এ নিঃশ্বাস গান শুনতে পাওয়ার জন্য অবশ্য নয়, কারণ অন্য।

জগতে পয়সার প্রাধান্য দেখে আর পয়সার গরম দেখে মনটা উদাস হয়ে যাচ্ছে তার। কী আশ্চর্য এই কলকাতা শহর! গুণের নয়, বিদ্যেবুদ্ধির নয়, মানুষ মনিষ্যত্বর নয়, শুধু মাত্র পয়সার জয়জয়কার। এই শহরকে সেই শৈশবকাল থেকে কত ভক্তি কত সমীহর চোখে দেখে এসেছে যে সত্য!

খানিকটা উদাস-উদাস হয়ে বসে থেকে সত্য আবার ভাবল, তা একটা মাত্র সংসার দেখে, একটা মানুষের আচার-আচরণ দেখেই বা আমি এমন আশা-ছাড়া হচ্ছি কেন? এত বড় বিরাট পুরীতে কত মানুষ কত হালচাল! এই শহরেই রাজা রামমোহন ছিলেন, বিদ্যেসাগর আছেন, বঙ্কিমচন্দ্র আছেন, পিরীলি ঠাকুরবাড়ির মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর আছেন, আরও কত সব আছেন। ভবতোষ মাস্টার তাঁদের সব জীবনকথা, মহিমার কথা কত শুনিয়েছেন সত্যকে, সে সব ভুলে গিয়ে সত্য কিনা ওই দত্তগিন্নীকে দিয়ে কলকাতার বিচার করছে?

মনটা ঝেড়ে ফেলে উঠল। আজ পঞ্চুর মা আসবে না, তার কাজগুলো সব করে নিতে হবে।

তা একটু না গুছিয়ে নিতেই তুড়ু, আর খোকা ইস্কুল থেকে ফিরল দুমদাম করে।

মা! ভীষণ নেমন্তন্ন খেলে তো?

সমস্বরে বলে উঠল দুজনে।

সত্য হেসে ফেলে বলে, হ্যাঁ! শুধু ভীষণ? একবা বিভীষণ! নে নে, ইস্কুলের জামাকাপড়ে সর্বজয় করিস নে। মুখ-হাত ধা।

খাবার আছে? খাবার? মণ্ডা-মেঠাই, খাজাগজা, ছানাবড়া, অমৃতি? ভাবতে ভাবতে আসছি আমরা 

ওদের কণ্ঠে অসহিষ্ণুতা দেদীপ্যমান।

সত্যর মনটা একটু মায়া-মায়া হয়ে আসে, এই দেখ ছোট ছেলেদের কাণ্ড! সারাদিন পড়া লেখা ফেল করে মণ্ডা-মেঠাইয়ের চিন্তা করছে। কিন্তু মায়াকে প্রশ্রয় দিলে চলবে না এখন। তাই সবিস্ময়ে ভাব দেখিয়ে বলে, ওমা স্বপ্ন দেখছিস নাকি? ওসব আবার আমি কোথায় পাব?

ওরা কিন্তু এ বিস্ময়কে আমল দিল না, মার হাত ধরে ঝুলে পড়ে হৈ-হৈ করে উঠল, ইস তাই বৈকি! চালাকি হচ্ছে! ও বাড়ি থেকে ছাঁদা আনো নি বুঝি?

ছাঁদা!

সত্যর মায়া-মায়া মুখটা কঠিন হয়ে ওঠে, তীক্ষ্ণ প্রশ্ন করে, ছাঁদার কথা কে বলেছে?

বাঃ, বাবা তো আপিস যাবার সময় বলল, তোদের মা কত ছাঁদা আনবে দেখিস।

ভুলে বলেছেন। নয়তো ঠাট্টা করেছেন। সত্য বলে।

কিন্তু তুড়ুর মন এখন আক্ষেপ-উদ্বেল। সে বলে, তুমি শুধু শুধু আমাদের ইস্কুলে পাঠালে, কেউ বুঝি আর ইস্কুলে গেছে? পাড়ার ওরা দিব্বি পেট ঠেসে খেলো আবার জনাজনতি ছাঁদা আনল। আর আমরা হুউউ–যোল রকম নাকি মিষ্টি করেছে ওরা

সত্য গম্ভীর ভাবে বলে, সেটা আবার কি করে জানলি, আপিস যাবার সময় তাও বুঝি বলা হয়েছে?

না, সে কথা বাবা কি করে জানবে? বলেছে পঞ্চুর মা।

ও, তা আজ দেখছি তোদের মাথার মধ্যে শুধু ওই ছাঁদার গল্পই ঘুরছে। হ্যাংলার মতন আবার ছাঁদা আনব কি! যাঃ চল, বাড়িতে যা আছে তাই দিই গে।

তুড়ু বয়সে বড় হলে কি হয়, খোকার থেকে সে হাঁদা। তাই সে সহসা বলে ওঠে, চাই না আমি ও মুড়ি-মুড়কি আর নাড়ু খেতে! পঞ্চুর মা ঠিকই বলেছে।

হঠাৎ নিজের কথায় শিউরে উঠে চুপ করে যায় সে।

কিন্তু চুপ করিয়ে রাখবার মেয়ে সত্য নয়। সে তীব্র জেরায় কী বলেছে পঞ্চুর মা তা আদায় করতে চেষ্টা করে। আর তুড়ু কাঠ হয়ে গেলেও খোকা বলে বসে, পঞ্চুর মা বলেছে একদিন ইস্কুল কামাই হলে কী এত রাজ্যি লোপাট হয়? অমন ভোজটা থেকে ছেলে দুটোকে বঞ্চিত করল! মা না রাক্ষুসী।

কী! কী বললি? বল বল আর একবার!

সত্য যেন দিশেহারা হয়ে গেছে। সত্য নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। এই হল শেষটা! এই রকম হচ্ছে তার ছেলেরা? এর জন্যে এত কাণ্ড করে দেশ থেকে চলে এসেছে সত্য?

তার যে একান্ত বাসনা ছিল তার ছেলেরা সভ্য হবে মার্জিত হবে।

সত্যই কি তবে অসভ্য হবে, অমার্জিত হবে? মারবে ছেলেদের?

না, সত্য ছেলেদের মারে নি।

শুধু একবার সেই তীব্র প্রশ্ন করে চুপ করে গেছে। চুপ করে বসে আছে। ছেলেরা যে মুড়ি মুড়কিও খায় নি, তা আর তার মনেও নেই। ও শুধু ভাবছে। ঘরে পরে বিপদ, কার আওতা থেকে তবে রক্ষে করবে ছেলেদের?

খানিক পরে নবকুমার এল।

আড়চোখে একবার দেখে নিল সত্যর জলদগম্ভীর মুখটা, তারপর ইশারায় খোকাকে ডেকে বাইরে নিয়ে গিয়ে প্রশ্ন করল, কী হয়েছে সত্যর।

হ্যাঁ, বেগতিক দেখলে এই রকমই ওদের প্রশ্ন করে জেনে নেয় নবকুমার। নেয় খোকার কাছে বেশী, জানে তুড়ুটা বোকা, গুছিয়ে বিশদ বলতে সে পারেও না।

কারণ শুনে নবকুমার বুঝতে পারে না, এই তুচ্ছ ব্যাপারে এত বিচলিত হবার কি হল সত্যর!

ছেলেরা তো আর মাকে রাক্ষুসী বলে নি? বলেছে পঞ্চুর মা!

তাই ঘরে ঢুকে কাষ্ঠহাসি হেসে বলে, কি, আবার কি হল?

সত্য সেই ভাবেই বসে থাকে, কথা বলে না।

নবকুমার বলে, বাবা রে, চিরটা দিন এক রকমে গেল! তোমার কাষ্ঠ-কঠিন স্বভাবের গুণেই পঞ্চুর মা ও কথা বলেছে। তা সেইটুকু বলেছে বলে এত শাস্তিও করতে হয় ছেলে দুটোকে? ইস্কুল থেকে নাচতে নাচতে আসছে বড়মানুষের বাড়ির ভালমন্দ দুটো খাবে বলে, তার বদলে কিনা উপোসের সাজা! ধন্যি বটে!

উপোসের সাজা! মানে? ওঃ, তাই তো! ছেলেদের খেতে দেওয়া হয় নি!

মুহূর্তে মনটা ভিতরে ভিতরে দ্রব হয়ে গিয়ে “হায় হায়” করে ওঠে। ছেলেদের খেতে না দিয়ে বসে আছে সে? রাগের চোটে খেয়ালই হয় নি? ইস্! পঞ্চুর মা দেখছি নেহাৎ ভুল বলেও নি। কচি ছেলে ওরা, ওদের আর ভালমন্দ বোধ কতটুকু? ওদের বাপ বুড়ো মিনসেই যদি বড়মানুষের বাড়ির খাবারের মোহময় ছবি এঁকে ওদের সামনে ধরে! রাগটা কমে গিয়ে “হায়-হায়” এলেও মুখে হারে না সত্য। গম্ভীরমুখে বলে, তা সামান্য দুটো মুড়ি-নাড়ু, নাই বা দিলাম, মণ্ডামেঠাই খাজাগজার গল্প করগে না ছেলেদের কাছে, খুব পেট ভরবে।

কথা কয়েছে। বাচা গেল।

নবকুমারের ভয়টা অনেক ভাঙে।

সত্য যখন মুখ খুলেছে, বুঝতে হবে অবস্থা একেবারে মারাত্মক নয়।

কথা না কয়ে চোয়ালের হাড় শক্ত করে নিঃশব্দে বসে থাকাটাকেই বড় ভয় নবকুমারের। অফিসে নবকুমারের কর্মদক্ষতা আর বুদ্ধিমত্তার এত সুনাম, নিম্নবতীরা এত ভয়-ভক্তি করে তাকে, সেখানে নিজেকে তো “বেশ একজন” মনে হয় কিন্তু বাড়িতে এলেই যে কী হয়! সেই চির অসহায়তা!

তবু আজ এখন সত্য মুখ খুলেছে।

তাই নবকুমারও সাহসে ভর করে বলে, আহা, খিদেয় কাহিল হয়ে গেছে একেবারে! আপিস ইস্কুল থেকে ফিরে খিদে যা জোর লাগে জানি তো!

অর্থাৎ এ সুযোগে নিজের কথাটাও ঢুকিয়ে দিল নবকুমার।

আর রাগ নিয়ে বসে থাকা চলে না। সত্য উঠে পড়ে।

নবকুমারও আর বেশী সময় নেই বুঝে তাড়াতাড়ি বলে ওঠে, রাগ তো দেখালে এত, বলি ছাদায় এত ঘেন্না কিসের? ছাঁদা আবার কে না আনে? কেন, তোমার বাপের বাড়ির দেশে ছাঁদার চল নেই বুঝি? আমরা তো বাবা ছেলেবেলায় ওই ছাঁদার আশাতেই নেমন্তন্ন যেতাম। ছোট পেটে কতই আর খেতে পারতাম বল? বাড়িতে এসে পরদিন সকালে সেই ছাঁদার সরা খুলে।

থাক হয়েছে, গল্প রাখ-মুখ ধোও গে বলে সত্য উঠে যায়। মনটা হঠাৎ যেন নরম হয়ে গেল। সত্যি এতে রাগের কি ছিল? তাদের ছেলেবেলায় তারাও তো–! কেন চল থাকবে না তার বাপের বাড়ির দেশে? তাদের বাড়ির কাজকর্মেই তো কত সরা সাজানো, মালসা সাজানো, হাঁড়ি সাজানো দেখেছে, লোকে খাওয়াদাওয়ার পর নিয়ে গেছে। রামকালী নিজে দাঁড়িয়ে তদারক করেছেন, মাথাপিছু ঠিকমত যাচ্ছে কিনা। সঙ্গের ঝিটা মুনিষটা রাখালটা পর্যন্ত বাদ যেত না। আবার সত্যরাও পিস্ঠাকুমার সঙ্গে যখন এ-বাড়ি ও-বাড়ি নেমন্তন্ন গেছে, তারা দিয়েছে, নেওয়া হত না তা তো নয়।

আর একটা উৎসব ছিল বিশেষ আকর্ষণীয়। সেটা হচ্ছে আটকৌড়ে। গ্রামে কারও বাড়িতে ছেলে জন্মালেই আটদিনের মাথায় ডাক পড়ত অপর বাড়ির কুচো ছেলেদের কুলো পিটোতে। সে সম্মানটা অবশ্য শুধুই ছেলেদের।

তবে খই-মুড়কি আটভাজার সম্ভার থেকে মেয়েরা বঞ্চিত হত না। আঁটসাট করে বেড়াবিনুনি বাঁধা, কোমরে ডুরেশাড়ির আঁচল জড়ানো, পাড়া সচকিত করে মল বাজিয়ে যাওয়া নিজের সেই চেহারাটা যেন চোখের ওপর দেখতে পেল সত্য।

ফিরত সেই ডুরেশাড়ির আঁচলটা কৌশলে কোঁচড়ে পরিণত করে, তাতে খাজা গজা আটভাজার বোঝাই দিয়ে। তার মধ্যে কেউ কেউ বা আবার আটটা করে পয়সা মিশিয়ে রাখত, বাড়ি এসে কি মহোল্লাসে সেই পয়সা খোঁজার ধুম!

কই, নিজেকে বা অপরকে তো তখন হ্যাংলা মনে হত না? কেন হত না? আজই বা কেন-

স্বামী-পুত্রের খাবার গোছাতে গোছাতে কারণটা ভাবল সত্য, নির্ণয়ও করল একটা। ওদের খেতে দিয়ে উপস্থাপিত করল সেই কথাটা।

বলছিলে আমাদের নিত্যেনন্দপুরে ছাঁদার চল ছিল কিনা? থাকবে না কেন, খুবই ছিল। তবে কথাটা হচ্ছে–সেই দেওয়ার মধ্যে নেমন্তন্ন-কত্তার অহঙ্কারটা ফুটে উঠত না। বরং যেন দিতে পেরেই কেতত্থ। তাই যারা নিত, তাদের মধ্যে মান অপমান ঘুলোত না। এই তোমার দত্তবাড়ির বাপু সবতাতেই যেন অহঙ্কার। একখানি একখানা তিজেলে বাহান্ন প্রস্থ মিষ্টি সাজিয়ে রেখেছিল তো আসনের পাশে, তা সেটা মানুষ পালকিতে তুলিয়ে দেবে তো? তা নয় বাড়ির লোকেরা কে কোথায় ঠিক নেই, কাকস্য পরিবেদনা, একটা দাসীমতন মেয়েমানুষ ভাঙা কাঁসি গলায় চেঁচিয়ে উঠল, ওগো বামুন মেয়ে, তোমার ছাঁদা পড়ে রইল যে! দেখত অভব্যতা! নেব আমি হাতে তুলে?

সত্যর স্বামী-পুত্রের মনে সেই বাহান্ন রকম কী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করল কে জানে, তবে নবকুমারকে স্ত্রীর কথায় “তা সত্যি” বলে সায় দিতেই হল। তার পর কথাটা সে নিজেই পাড়ল, তা’পর–সত্যিই সেই সোনার হারছড়াটা দিয়ে এলে নাকি?

তা সত্যি দেব না তো কি মিথ্যে দেব? দেব বলে নিয়ে গেলাম।

নবকুমার আক্ষেপ-নিঃশ্বাস গোপন করে উদাসভাবে বলে, তোমার জিনিস তুমি ফেলে দিতে পার, বিলোতে পার, সে কথা না তবে পাড়ার দু-একজনকে শুধিয়েছি সকালে, কেউ আধুলিটা কেউ সিকিটা দিয়েছ, টাকার উর্ধ্বে কেউ ওঠে নি।

সত্য এ প্রসঙ্গে যবনিকাপাত করে দিতে বলে, যাক গে বাপু, কচি ছেলেকে দেওয়া জিনিসের কথা নিয়ে কচকচানিতে কাজ নেই, ছাড়ান দাও ও কথায়। এবারে পুরুষ বেটাছেলের মতন একটা কাজ কর দিকি? একখানা বাসা খোঁজ।

বাসা? আবার বাসা খুঁজব? বদলাবে এ বাসা?

তাই তো স্থির করেছি।

মনে করেছি নয়, ইচ্ছে করেছি নয়, সংকল্প করেছিও নয়, একেবারে স্থির করেছি!

নবকুমার মনে মনে নিজের হার নিশ্চিত জেনেও লড়াইয়ে নামে, তা স্থির করবে বৈকি, মাথাটাই অস্থির যে! তাই নিত্যি নতুন স্থির করা! বলি এই ভাড়ায় এমন বাসা আর পাবে? দত্তদের নাকি নেহাৎ পয়সায় দৃকপাত নেই তাই বাসাগুলো এত সস্তায় ছেড়েছে! অপর কেউ হলে দেড়া দাম হাঁকত। ওসব কু-মতলব ছাড়।

সত্যর সেই জোড়া ভুরুর নীচের গভীর কালো চোখ জোড়া সহসা একটি কৌতুক-রসাশ্রিত বিদ্যুকটাক্ষে ঝিলিক মেরে ওঠে, সত্য বামনী কবে তার মতলব ছেড়েছে?

নবকুমার সেই মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। সত্যর হাসিটা দুর্লভ বলেই কি এত অপূর্ব?

না, এ অপবাদ নবকুমার দিতে পারে না–সত্য বামনী কখন তার মতলব ছেড়েছে। শুধু নবকুমারই বুঝতে পারে না, অকারণ সুস্থ শরীর ব্যস্ত করে কী সুখ পায় সত্য!

সঙ্গে সঙ্গে হাঁ করে তাকিয়ে থাকা চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বেজার মুখে বলে নবকুমার, কেন, এ বাসা আবার কি অপরাধ করল?

সে তোমাকে বললে তুমি বুঝবে না।

না, আমি তো কিছুই বুঝব না। যত বোঝার কত্তা তুমি। বাসা-ফাসা বদলানো হবে না। বারে বারে এক কেত্তন! পাখী-পক্ষী নাকি, যে রাতদিন বাসা বদলাবো? হবে না বলে দিচ্ছি–ব্যস।

তা বেশ, হবে না। সত্যি, কর্তার কথাই বজায় থাক।

বলে সত্য উঠে যায়।

.

এ বাসা বদলানোর ইচ্ছে যে সত্যরই খুব আছে তা নয়। বাড়িটা সব দিক দিয়ে সুবিধেয়। কিন্তু ওই মাথার ওপর প্রভু নিয়ে প্রজা হয়ে থাকাটাই তার বরদাস্ত হচ্ছে না। আর মজাটাও দেখ নিজের বাড়িতে নিজের মতন থাকব তা নয়, ঝিটা এবাড়ি ওবাড়ি করে যন্ত্রণা ঘটাতে থাকবে। ওকে ছাড়িয়ে দিলেও কতকটা সুরাহা হয় বটে কিন্তু সেটাও ঠিক মনের সঙ্গে খাপ খায় না। মানুষটা দুষ্টুপাজী নয়। উপকারীও আছে। দোষের মধ্যে হচ্ছে অবোধ। আর অবোধ বলেই অতিরিক্ত কথা হয়। সেই কথার জ্বালাতেই ছেলে দুটোর কুশিক্ষা জন্মাচ্ছে।

তা সেই কথাই বলে ছাড়িয়ে দিতে হবে পঞ্চুর মাকে। বলতে হবে, আমার ছেলেদের যদি তুমি শেখাও মা নয়, রাক্ষুসী, তা হলে তোমায় কি করে রাখি বল তো বাছা? সামনের মাস থেকে অন্য কাজ দেখ।

সেই কথাই ঠিক করে মনে মনে।

এবাড়ি ওবাড়ি আনাগোনার কথা তুলে খেলো হবে না। আসুক কাল সকালে।

.

কিন্তু কাল সকাল অবধি অপেক্ষা করতে হল না সত্যকে, সেই সন্ধ্যাতেই এসে হাজির হল পঞ্চুর মা, সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত এক বার্তা নিয়ে।

এ কী!

এ কোন্ বিপদ অপেক্ষা করছিল সত্যর জন্যে?

সন্ধ্যের আগে দুপুরের কথাটা তা হলে বলে নিতে হয়।

.

দত্তগিন্নী পিচ করে পিক ফেলে বলেন, হ্যাঁলা পঞ্চার মা, তোর মনিবগিন্নী বয়সে তো কাঁচা, ওর এত অঙ্কার কিসের বল্ দিকিনি?।

দত্তগিন্নীর চির মোসাহেব “ভাগ্নে-বৌ” হি-হি করে হেসে উঠে বলে, ওই কাঁচা বয়সেরই অহঙ্কার গো মামী! নইলে অহঙ্কার করবার আর কিছু তো দেখছি না।

দত্তগিন্নী ভারীমুখে বললেন, উঁহু, এ বাপু বয়সের দেমাক নয়, এ হচ্ছে স্বভাবের দেমাক। সংসারের ওর আর কে আছে রে পঞ্চার মা?

পঞ্চুর মা এ বাড়িতে কোনদিনই পঞ্চার মা বৈ পঞ্চুর মা শোনে না, তাই ওই অগ্রাহ্যের ভঙ্গী তার গা-সহা। অতএব বিনয়ে বিগলিত হয়েই সে উত্তর দেয়, আর কে? ওই উনি, ওনার সোয়ামী, আর দুটো সাত আট বছরের খোকা!

অঃ! তাই! কথাতেই আছে, মেঘা খেয়ে রোদ হয় তার বড় চড়চড়ানি, আর বৌ হয়ে গিন্নী হয় তার বড় ফড়ফড়ানি। তা শাশুড়ীমাগী বুঝি মরেছে?

পঞ্চার মা কৌতুকের ভঙ্গীতে বলে, বালাই ষাট! মরবে কেন? শাশুড়ী আছে শ্বশুর আছে, আছে সবাই। দেশ-গেরামে আছে। উনি বাসায় এসেছেন স্বামীপুত্তুর নিয়ে। সোয়ামী সাহেবের আপিসে চাকরি করে।

বটে! তাই তো বলি! তাতেই তেজে মটমট! দেশ কোথা?

কোথা কি বিত্তান্ত কে শুধোবে মা? পঞ্চুর মা মনে মনে সত্যর প্রতি স্নেহশীল এবং সমীহপরায়ণ হলেও, নিতান্তই দত্তগিন্নীর সুয়ো হতে মনিবের প্রতি অগ্রাহ্য দেখিয়ে বলে, গপপো করবার সময় আছে তেনার? ঘরের কাজ মিটল তো বই কেতাব মুখে দিয়ে বসল

বই কেতাব!

ঘরের মধ্যে একটা ব্যঙ্গহাসির ঢেউ খেলে যায়, তাই নাকি? ওরে পঞ্চার মা, তুই যে দেখচি খুব ভাল বাড়িতে চাকরি ধরেছিস! দেখিস বাপু, গিন্নীর হাওয়া লেগে তুই সুদ্ধ পণ্ডিতনী হয়ে যাস নি!

পঞ্চুর মা হেসে বলে, তা পারলে গিন্নী আমাকেও বই ধরায়। বাবা, ছেলে দুটোকে পড়া পড়া করে যা দিক করে। তবু ওই ছেলে দুটোই যা গপপোগাছা করে আমার সঙ্গে। ওদের মুখেই শুনেছি, বারুইপুর না কোথায় যেন দেশ, ঠাকুমা আছে ঠাকুন্দা আছে পিসি আছে আর মামার বাড়ি সেই তিরবেণীর কাছে নিত্যেনন্দপুর না কি যেন। দাদামশায় কবরেজ খুব বড়মানুষ

সহসা ঘরের মধ্যে একটা মানুষের মুখ কেমন উদ্ভ্রান্তের মত হয়ে যায়, দেয়ালের কোলে একখানা পেতলের চৌকিতে পাতিয়ে পাতিয়ে পান সাজছিল সে, কাজ করা হাতটা তার থেমে যায়। হাঁ করে তাকিয়ে থাকে পঞ্চুর মার মুখের দিকে, কানে যায় না দত্তগিন্নীর মন্তব্য।

বড়মানুষের ঝি বলেই এত দেমাক সাত নম্বর বাড়ির গিন্নীর–সেই মন্তব্যই করেন দত্তগিন্নী।

পঞ্চুর মাও মন্তব্য দিয়ে পরিসমাপ্তি করে, সেই তো!

শুনলাম নাকি ছাঁদার হাঁড়ি ছোঁয় নি– ভাগ্নে-বৌ নিভন্ত আগুনে কাঠ ফেলে, ঢপ শোনে নি!

সেই কথাই তো বলে মরছি বৌদিদি– পঞ্চুর মা আক্ষেপ করে, এত এত নোকের সময় হল, আর তোর সময় হল না? পাড়ার সকল ছেলে ঘরে বসে রইল, তোর ছেলেদেরই ইস্কুলের মান্যি এত হল! ছেলে দুটোর জন্যে মরছি করকরিয়ে।

তা যাস, হাঁড়িখানা নয় তুই-ই নিয়ে যাস। দিস গিয়ে ছোঁড়াদের।

বলেন অপর এক মহিলা।

কিন্তু পানসাজুনি বিধবাটির কানে বুঝি এসবের বিন্দুবিসর্গও যায় না। সে তেমনি হাঁ করে তাকিয়ে থাকে পঞ্চুর মার মুখপানে, আর কি বলে সে সেই আশায়।

পঞ্চুর মা কিন্তু আর কথা বাড়ায় না। সত্যর বিরুদ্ধে কথা বলতে তার বিবেক তেমন সায় দিচ্ছে, তবে নেহাৎ নাকি এ ঘরে এখন পালের হাওয়া উল্টো দিকে তাই। বড়মানুষের কথার ধামা তো ধরতেই হবে। তা ছাড়া সত্যর ওপর তার আজ সত্যিই বড় রাগ হয়েছে।

সে কোথায় ভেবে রেখেছিল সত্যকে নিয়ে এসে বড়লোকের বাড়ির জাঁকজমক দেখাবে, আর তার বোনঝি শৈলর যে এ বাড়িতে কতখানি মানমর্যাদা তা বুঝিয়ে ছাড়বে। একটা মান্যিমানের মাসী পিসি হওয়াও তো কম গৌরবের নয়।

মান্যিমান বৈকি!

দত্তগিন্নীর মেজছেলের সঙ্গে শৈলর দহরম-মহরম তো আর রাখা-ঢাকা নেই। মেজবাবুর উপর শৈলর আধিপত্য একেবারে প্রকাশ্য ব্যাপার। মেজবৌটাকে ঢিট রাখতে দত্তগিন্নী এ আগুনে রীতিমতই ইন্ধন দিয়ে চলেন। শৈলর জন্যে গন্ধতেল গন্ধসাবান সরবরাহ হয় দত্তগিন্নীর নিজের ভাড়ার থেকে। শৈলর জন্যে পানে খাবার সব চেয়ে দামী কিমা আসে গিন্নির খরচে। শৈলর ফিতেপেড়ে শান্তিপুরী হাফশাড়ীর যোগানদার অবশ্য মেজবাবু স্বয়ং, তবে একটু ময়লা কি ছেঁড়া চোখে পড়লেই দত্তগিন্নী গ্যাদারী বেজারমুখী মেজবৌটাকে শুনিয়ে শুনিয়ে শৈলকে বলেন, হালা, কাপড় এত ময়লা কেন? নেই বুঝি? বলতে পারিস না তোর মেজদাদাবাবুকে?

এতজন থাকতে মেজদাদাবাবুকেই কেন, সে প্রশ্নটা অবশ্য উহ্য থাকে।

তা এসব রঙ্গরসের গপপো অবশ্য পঞ্চুর মার মনিবনীর সঙ্গে করার জো নেই, কিন্তু শৈলর দখলত্বিটা দেখানো যেত–তা হল না কিছুই।

মরুক গে।

যার যেমন বুদ্ধি।

বুদ্ধির দোষেই ঠকে মানুষ। বৌদিদি যে এত বুদ্ধিমতী, তা কই জিততে পারল কই, হেরেই তো মলো। নিজে ভাল করে খেলি না, স্বামীপুত্তরকে খেতে দিলি না, গান শুনলি না, সব দিকেই ঠকলি। ধুত্তোর!

মনঃক্ষুণ্ণ পঞ্চুর মা পানসাজুনির দিকে এগিয়ে এসে বলে, দাও বামুনদি, দুটো বেশ মচমচে করে পান দাও দিকি খাই

দুটো পান তাড়াতাড়ি সেজে কম্পিত হাতে সে দুটো পঞ্চুর মার হাতে তুলে দিয়ে পানসাজুনি বামুনদি চাপা নীচু গলায় বলে, কই তোর মনিবনীকে তো আমায় দেখালি না?

ওমা শোন কথা! ক’দণ্ড থাকল তিনি? এল আর চলে গেল বৈ তো না।

তোদের কথাবার্তা শুনে একটু কৌতূহল হচ্ছে। বলি এত তেজদম্ভ শুনছি–দেখাবি না একবার?

আর দেখানো! বৌদি কি আর এমুখো হবে? আর এ বাড়িতে আসবে? তবে যদি তুমি

বামুনদি আরও মৃদু গলায় বলে, তবে তাই চল না, দেখে আসি।

ওমা! হঠাৎ আমার মনিবের ওপর এমন নেকনজর কেন গো বামুনদি?

আস্তে। এক্ষুনি গিন্নীর কানে উঠবে আর না করে বসবে!

বেশ, সন্ধ্যের পর নিয়ে যাব।

.

যাবার মুখটায় কিন্তু বামুনদিদি কেমন যেন বিচলিত হয়, আগ্রহটা যেন ঝিমিয়ে আসে তার। বলে, থাক গে পঞ্চুর মা–কাজ নেই।

ওমা কেন? ত্যাখন অত মন করলে!

হ্যাঁ, ঝোঁকের মাথায় তখন বলেছিলাম বটে, তা বলি কি, গেলে আবার এ গিন্নীর যদি গোসা হয়?

শোন কথা! কে টের পাচ্ছে? তোমার আমার মতন চুনোপুঁটির খবর রাখতে ওনাদের দায় পড়েছে। কাজের বাড়িতে নানা গোলমাল, দশটা নতুন রাঁধুনী চাকরানী খাটছে, ফাঁকি দেবার এই তো সুযোগ।

না ভাবছি গিয়েই বা কি হবে! শুনেছি নাকি দেমাকী, রাঁধুনী পানসাজুনির সঙ্গে যদি কথা না কয়!

ওমা না না, তা তুমি ভেবো না বামুনদি– পঞ্চুর মা অভয় দেয়, তাকে যদি কেউ ঘাঁটাতে না যায় সেও কিছু বলবে না। বাড়িতে অতিথি এলে বরং আদর-আভ্যানই করবে, রাধুনী চাকরানী বিচার করবে না। এই তো সেদিন তাতিনী মাগী গেছল, তাকে কত যত্ন করে বসাল, তেষ্টার জল দিল পান দিল। কাপড় অবিশ্যি নিল না, বলল দরকার নেই, তবে দূর-ছাই তো করল না।

অনেক অগ্রপশ্চাতের পর শেষ অবধি অগ্রেরই জয় হয়।

পেঁজা তুরতুরে সিল্কের চাঁদরখানা গায়ে জড়িয়ে সন্ধ্যের দিকে খিড়কির দরজা খুলে পঞ্চুর মার সঙ্গে রাস্তায় নামল পানসাজুনি বামুনমেয়ে।

বামুনের মেয়ে একদা কাজের দরকার নিয়ে এসেছিল দত্তবাড়িতে। নেহাৎ ঝি-চাকরানীর কাজ তো দেওয়া যায় না তাকে, তাই এই কাজের ভার। অবশ্য পান সাজা কথাটা শুনতে যত হালকা, এ বাড়িতে সে ব্যাপারটা তত হালকা নয়। দৈনিক অন্তত হাজার তিনেক পান তাকে সাজতে হয়। তদুপযুক্ত সুপুরিও কেটে নিতে হয়। তাছাড়া সব পান ঠিক এক ধরনের সাজলে চলে না, তার আবার শ্রেণীবিভাগ আছে। কারুর কারুর মিঠাপানের খিলি বরাদ্দ, কারুর কারুর জায়ফল দারচিনি জৈত্রি কাবাবচিনি এলাচ কর্পূর সম্বলিত রাজকীয় পান, কারো বা দোক্তা খাওয়া মুখের রুচি অনুযায়ী শুধু খয়ের দুপুরি। আবার সুপুরিও মিহি মোটা নানা প্রস্থ। এই সব পানের নৈবেদ্য সজিয়ে যার যার ঘরের বাটায় রেখে আসতে হয় গোলাপজলে ভিজানো ন্যাকড়া চাপা দিয়ে।

এছাড়া সরকার গোমস্তা লোজন, অতিথি ফকির, আসুন্তি যাউন্তি, আশ্রিত অভ্যাগতদের জন্যে মোটা বাংলা পানের ব্যবস্থা আছে। সমস্ত ওই বামুনমেয়ের ঘাড়ে। শুধু পান নিয়েই সারাটা দিন তার প্রাণ যায়-যায়। তার ওপর আবার বাড়িতে যজ্ঞি হলে তো কথাই নেই। সেও তো আছে যখন তখন। বিয়ে, সাধ, মুখেভাত এসব বাদেও বাড়ির হরেক রকম মেয়েমানুষের হরেক রকম বত্ত সারাও তো সারা বছর। লোকজন খাওয়া লেগেই আছে। দত্তগিন্নীর ছোটজা অনন্ত-চতুর্দশীর বত্ত সারল, তিন-চারশ লোক খেল। পতিপুত্রহারা বিধবা, তবু কমতি কিছু হল না। বড়গিন্নী উদারমনা, বললেন, তা হোক। ওই কেউ না থাক, আমি যখন আছি আমিই ওর সব করাব। ইহকালটা তো বৃথাই গেল, পরকালটা বজায় থাক্।

ছোটগিন্নী অবশ্য বেইমান।

আড়ালে আবডালে বলে বেড়ায়, আমার বুঝি ভাগ নেই দত্তদের বিষয়-সম্পত্তিতে? বানের জলে ভেসে এসেছি বুঝি আমি? কাঠ হাত করে ঢুকি নি আমি এদের উঠোনে। গাঁটছড়া বেঁধে সঙ্গে করে নিয়ে আসে নি এদেরই একজন? তাকে উষ্ণুনিও দেয় কেউ কেউ।

কিন্তু সে নেহাতই আড়ালে। বড়গিন্নীর সামনে সবাই ঠাণ্ডা।

কিন্তু সে যাক।

পথ চলতে চলতে বামুনমেয়ের সঙ্গে নিম্নোক্ত কথাবার্তা হয় পঞ্চুর মার, যতই হোক তুমি হলে স্বজাতি, তোমায় সমেহা দেখাবে।

স্বজাতি অবশ্য সত্যবতীর। কারণ সেও বামুন।

বামুনমেয়ে কিন্তু এ আশ্বাসে উল্লসিত হয় না। উদাসভাবে বলে, সোনারবেনের অন্ন খাওয়া বামুন আবার বামুন! তুইও যেমন পঞ্চার মা। তোরা ‘বামুনদি বামুনদি’ করিস তাই, নিজেকে বামুনের মেয়ে বলে পরিচয় দিতে আমার ইচ্ছে করে না। নেহাৎ নাকি কাজ করতে এসে শুদ্র বললে পাছে পা টিপতে, ছাড়া কাপড় কাঁচতে, এটো বাসন মাজতে বলে, তাই ওই পরিচয় দেওয়া।

তা কেন বামুনদি, তোমার আচার-আচরণ তো সদ্ বাম্মনের মতনই। নইলে রাঁধুনী কুটনোকুটনী ভাড়ারদিনি আরও যে-সব বামনী ধনী আছেন, তাদের আচার-কেতা তো আর পঞ্চুর মার অবিদিত নেই! ঘেঁচার মা তো সেদিন লুকিয়ে গরম মাছভাজা খেতে গিয়ে জিভে কাটা ফুটিয়ে হাতেনাতে ধরা পড়ল, তাই কি মাগীর হায়া আছে? আসল কথা কি জান বামুনদি, স্বভাব-চরিত্তিটি যতক্ষণ ভাল আছে, ত্যাতোক্ষণ কক্ষনো সে আচারবিচার ছাড়বে না। আচার-অনাচার ত্যাগ করলেই বুঝবে মতিগতি বিগড়েছে। ধম্মকম্ম আচার-আচরণ হচ্ছে নদীর বাঁধ, যদি একবার ভাঙ্গে–

বাসনমাজা ঝি পঞ্চুর মার এই জীবনদর্শনের ব্যাখ্যার শেষাংশটা আপাতত মুলতুবী থাকে। সত্যবতীর দরজায় এসে পড়েছে দুজনেই। পঞ্চুর মা শানানো গলায় ডাক পাড়ে, কই গো বৌদিদি কোথায়? একবার বেরিয়ে এসো গো। নতুন মানুষ এয়েছে তোমায় দশ্যন করতে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *