রিমঝিম – ১০

৮ আশ্বিন।

তিন হপ্তা হল লোকটা চলে গেছে, আর কোনও খবর নেই।

পিউ আমার কাছে আছে। পিউকে না পেলে বোধ হয় মরে যেতুম। ও আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে।

কাজকর্ম মাথায় উঠেছে। কাজের ডাক যখন আসে তখন বলি, আমার সময় নেই, অন্য কাজ আছে। পিউ এখন আমার একমাত্র কাজ। ওর পিতৃদেব এক হাজার টাকা দিয়ে গিয়েছিলেন পিউয়ের খরচ চালাবার জন্যে। সে টাকা আমি পিউয়ের নামে ব্যাঙ্কে জমা করে দিয়েছি। পিউয়ের খরচ চালাবার ক্ষমতা আমার আছে।

কী মেয়ে পিউ! একবার কাঁদল না, একবার বলল না, বাড়ি যাব। যেন এই বাসাটাই তার চিরদিনের ঘরবাড়ি। আমি তার চিরকালের আপনজন। জানি না, হয়তো আগের জন্মে ওকে পেটে ধরেছিলুম।

দম্মা দম্মা দম্মা–সারাক্ষণ খালি দম্মা। পুতুল নিয়ে খেলা করছে, হঠাৎ ছুটে এসে কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ল-দম্মা! কোলের মধ্যে কিছুক্ষণ মুখ গুঁজে থেকে, ছোট্ট একটি নিশ্বাস ফেলে আবার গিয়ে খেলা করতে লাগল। আমি রাগ দেখিয়ে বলি, তুই আমাকে দম্মা বলবি কেন?

ঘাড় হেলিয়ে মিটিমিটি হেসে তাকায়, বলে, উঁ!

প্রিয়ংবদা বলতে পারিস না?

আস্তে আস্তে উচ্চারণ করে,–পি-ও-দম্মা?

তবে রে। চড় তুলে ছুটে যাই, সে খিলখিল করে হেসে আমার গলা জড়িয়ে ধরে। দুষ্টু কি কম?

চুপিচুপি জিগ্যেস করি, হ্যাঁরে, তোর মা কোথায়?

মা নেই-নেই। বলে আবার খেলা শুরু করে। মা সম্বন্ধে কোনও আগ্রহ নেই; মাকে ও চেনে না।

ওকে মায়ের কথা একেবারে ভুলিয়ে দিতে হবে। বড় হয়ে যেন জানতে না পারে, ওর মা কুলত্যাগিনী। কিন্তু কী করে ভোলানো যায়? একমাত্র উপায়, ও যদি আর কাউকে মা বলে চিনতে শেখে। একদিন শুক্লা আর জামাইবাবুর সামনে কথা উঠেছিল, জামাইবাবু গম্ভীর মুখে বলেছিলেন, সখি, তুমি এক কাজ কর। ওকে শেখাও তোমাকে মা বলতে, তাহলে সব গোল মিটে যাবে। ওঁর কথা শুনে চুপিচুপি উঠে পালিয়ে এসেছিলুম। উনি সব জানেন, শুক্লা যদি নাও বলে থাকে, উনি বুঝতে পেরেছেন। কিন্তু ও আমি পারব না, মনে যাই থাকুক।

রাত্রে পিউকে আমি নিজের কাছে নিয়ে শুই। শোবার ঘরে একটা নাইটল্যাম্প লাগিয়েছি, সারারাত সেটা জ্বলে। রাত্তিরে দু-তিনবার পিউয়ের ঘুম ভাঙে, ঘর অন্ধকার দেখলে ভয় পায়। ওকে রাত্তিরে কোলের কাছে নিয়ে যখন শুই, কত কথা মনে আসে। একদিন ভেবেছিলুম, পরের সোনা কানে দেব না, কিন্তু এখন? সেই সোনা শিকল হয়ে আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে ধরেছে, কিন্তু কই, ছাড়াবার চেষ্টা তো করছি না!…চেষ্টা করব কোত্থেকে? একটা দুর্দান্ত বর্বর যে আমার মাথা খেয়ে দিয়ে চলে গেছে। আমার লজ্জা নেই, ঘেন্না নেই, আত্মসম্মান নেই, কিছুই নেই—

ওর কথা আমি ভাবি না, ভাবতে চাই না; জোর করে ওর চিন্তা মন থেকে দূরে সরিয়ে রাখি। কিন্তু গভীর রাত্রে যখন ঘুম ভেঙে যায় তখন ঝাঁকে ঝাঁকে দুশ্চিন্তা এসে মনকে জুড়ে বসে। কোথায় চলে গেল মানুষটা! সারা ভারতবর্ষ একটা অপদার্থ স্ত্রীলোকের পিছনে পিস্তল নিয়ে ছুটে বেড়াচ্ছে। ধরতে পারবে কি? যদি ধরতে পারে খুন না করে ছাড়বে না। তারপর? খুন করে পুলিসের হাত এড়ানো কি সহজ? ধরা পড়ে যাবে; হয়তো খুন করে নিজেই গিয়ে পুলিসের হাতে ধরা দেবে। তারপর—আদালতে খুনের বিচার! আমার সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। পিউকে বুকে আঁকড়ে চোখ বুজে পড়ে থাকি।

আগে আমার খবরের কাগজ পড়া অভ্যেস ছিল না, আজকাল রোজ পড়ি। ভয় করে, বুক দুরদুর করে, তবু না পড়ে আমি পারি না। হয়তো কাগজ খুলে দেখব, অমুক তার পলাতকা স্ত্রীকে খুন করেছে। ভগবানের দয়ায় এখনও সেরকম খবর চোখে পড়েনি। যদি খুঁজে না পায়, যদি হতাশ হয়ে ফিরে আসে, বেশ হয়। পিউকে এত ভালবাসে তার কাছে ফিরে আসতে কি মন চায় না?

পিউ কিন্তু এখন আমার হয়ে গেছে। এখন যদি ওর বাপ এসে মেয়ে ফেরত চায়, বলব, দেব না। মেয়ে, যাও তুমি বাউণ্ডুলের মত বউ খুঁজে বেড়াওগে। পিউকে আমি ছাড়ব না। পিউও আমাকে। ছেড়ে কক্ষনো বাপের কাছে যেতে চাইবে না।

কিন্তু–তা কি পারব? ও এসে যদি হাত পেতে দাঁড়ায়, আমি না বলতে পারব কি? হা ভগবান, এ তুমি আমার কী করলে? ও একটা নেকড়ে বাঘ, একটা অজগর সাপ। ও যদি হাত পেতে দাঁড়ায় আমি বলব—তোমাকে না বলবার ক্ষমতা আমার নেই। তুমি আমাকে গিলে খেয়ে শেষ করে ফেল, আমি নিশ্চিন্দিহই।…

কলাবতী রোজ সকাল-সন্ধ্যে আসে। শিউসেবক তাকে সঙ্গে করে নিয়ে আসে, আবার পিউয়ের খাওয়া হলে সঙ্গে নিয়ে চলে যায়। সন্ধ্যেবেলা কলাবতী বেশীক্ষণ থাকে না, পিউ ঘুমিয়ে পড়লেই চলে যায়। কিন্তু ভোরবেলা যখন আসে, পিউকে খাইয়ে দুদণ্ড পা ছড়িয়ে বসে গল্প করে। আমি তাকে চা জলখাবার দিই, সে তাই খেতে খেতে বাঁকা বাঁকা হিন্দীতে কথা বলে।

ওদের দেশ ছিল ভারতের উত্তর-পশ্চিমে। ভারত যখন ভাগ হল তখন ওরা পড়ে গেল পাকিস্তানে। সেই মারামারি কাটাকাটি নিষ্ঠুর পাশবিকতার মধ্যে থেকে কোনও রকমে প্রাণ বাঁচিয়ে ওরা নিঃস্ব অবস্থায় ভারতবর্ষে পালিয়ে এসেছিল। কিন্তু এখানে এসেও ওদের দুর্দশা ঘুচল না। খাদ্য নেই, মাথা গোঁজবার জায়গা নেই; মীরাটের রাস্তায় রাস্তায় ওরা কেঁদে বেড়াচ্ছিল। সেই সময় শঙ্খনাথবাবু কী কাজে মীরাটে ছিলেন, ওরা তাঁর নজরে পড়ে যায়। তিনি ওদের কলকাতায় নিয়ে আসেন। সেই থেকে ওরা ওঁর কাছে আছে। উনি মানুষ নন, সাক্ষাৎ মদেব।

মহাদেবের মহাদেবীর প্রতি কিন্তু কলাবতীর মোটেই ভক্তি নেই। ওদের চোখের সমানেই সলিলা বিয়ে হয়ে এসেছে। প্রথমে সলিলার রূপ দেখে ওরা মুগ্ধ হয়েছিল, তারপর যতই সলিলার গুণ প্রকাশ হতে লাগল, ততই ওদের ভক্তি চটে যেতে লাগল। পিউ জন্মাবার পর ওদের মন সলিলার ওপর একেবারে বিষিয়ে উঠল; পিউকে সলিলা দেখে না, নিজের নাচ গান আমোদ নিয়ে মত্ত থাকে। কলাবতী আমাকে বলল, মাজী, বহুর রূপ আছে বটে, কিন্তু সে ভাল মেয়ে নয়; আমার বাবুজীর উপযুক্ত বহু নয়। ছোট ঘরের মেয়ে। ভাল ঘরের মেয়ে কি তয়ফাওয়ালীর মত নেচে বেড়ায়? ছি ছি ছি। ও চলে গেছে ভালই হয়েছে। ওরকম মেয়ে কখনও ঘরে থাকে না। এখন ভগবানের কাছে জানাচ্ছি, আমার বাবুজী যেন ঘরে ফিরে আসেন, একটি ভদ্রলোকের মেয়ে বিয়ে করে শান্তিতে থাকেন।

কলাবতী রোজ সকালে পিউয়ের ঘুম ভাঙবার আগেই এসে হাজির হয়। একদিন বেচারী আসতে পারেনি। সে কী কাণ্ড! সকালবেলা চোখ চেয়েই পিউ বলল, কলা খাব। কিন্তু কোথায় কলা! তাকে ভোলাবার চেষ্টা করলুম,-আজ কলা নেই-নেই। আজ তুমি বোতলে করে দুধু খাবে। কেমন? লক্ষ্মী মেয়ে, সোনা মেয়ে–

কে কার কথা শোনে? পিউ বিছানায় শুয়ে শুয়েই কান্না শুরু করল,—কলা খাব। সে সহজে কাঁদে না, কিন্তু ঠিক সময়ে কলা না পেলে রক্ষে নেই।

তার কান্না শুনে শুক্লা দোরের কাছে এসে দাঁড়াল,—পিউ-মেয়ে কাঁদে কেন?

কলাবতী আসেনি, তাই কাঁদছে। আমি পিউয়ের পাশে শুয়ে তাকে আদর করে বললুম, ছি কাঁদতে নেই। তুমি এখন বড় হয়েছ, কাঁদলে লোকে নিন্দে করবে। বলবে—পিউ দুই মেয়ে, পিউ কথা শোনে না। আমি এক্ষুনি তোমার জন্যে দুধ আনছি—

পিউ কান্না থামিয়ে বিছানায় উঠে বসল, একদৃষ্টে আমার পানে চেয়ে রইল; যেন নতুন কিছু আবিষ্কার করেছে। তারপর দম্মা খাব বলে আমার গায়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল। আমার বুকের মধ্যে মুণ্ডু গুঁজে দিলে। রাসী।

কী করি আমি তখন দিশেহারা হয়ে শুক্লার পানে তাকালুম। মুখপুড়ী আমার দশা দেখে মুখে আঁচল খুঁজে হাসছে।

পিউ কিন্তু ভারী ঠকে গিয়েছিল সেদিন।

শুক্লা পিউকে ভালবাসে। সেই প্রথম দিন ওকে কোলে নিয়ে আদর করেছিল, তারপর থেকে কিন্তু বেশী কাছে আসে না। যখন বাইরে যায় ওর জন্য কত রকম খেলনা কিনে নিয়ে আসে; কিন্তু নিজে দূরে দূরে থাকে। আমি তা লক্ষ্য করেছিলুম; একদিন জিগ্যেস করলুম, তখন সে ম্লানমুখে বলল, না ভাই, আমি ওকে ছোঁব না। জানিস তো আমাদের পেটে কী প্রচণ্ড ক্ষিদে। পিউকে ছুঁলে ওর যদি অনিষ্ট হয়। যদি নজর লাগে।

সত্যি ওদের জীবন কেমন যেন দড়কচাপড়া হয়ে আছে। সন্তানের জন্যে দুজনেই পাগল, কিন্তু উপায় নেই। জামাইবাবুর স্ত্রী হাসপাতালে আছেন; জলের মত টাকা খরচ হচ্ছে। কিন্তু তিনি মরবেনও না, সেরেও উঠবেন না। কতদিন এইভাবে চলবে কেউ বলতে পারে না। আমার এক-এক সময় অসহ্য মনে হয়, ইচ্ছে হয় হাসপাতালে গিয়ে মহিলাটির গলা টিপে দিই। কিন্তু জামাইবাবুর ধৈর্য আছে বলতে হবে। হাসিমুখে কর্তব্য করে যাচ্ছেন। ওঁর প্রাণের ব্যথা শুক্লা জানে আর আমি জানি।

শুক্লা মাঝে মাঝে জামাইবাবুর বাড়িতে যায়, ঘরকন্না তদারক করে আসে। আমার সেই প্রথম। দিনের পর আর যাওয়া হয়নি। শুনেছি, বাড়ির এখন ছিরি ফিরেছে। কিন্তু ছিরি ফিরলে কী হবে, সবই ঝি-চাকরের হাতে। জামাইবাবু একলা মানুষ, বেশীর ভাগ সময় বাইরে ঘুরে বেড়াতে হয়। শুক্লা তো সেখানে গিয়ে থাকতে পারে না। জামাইবাবু কাশী থেকে মাকে আনবার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু তিনি গুরুর কাছে মন্ত্র নিয়েছেন, কাশী ছাড়তে চান না। বুড়ি ঝিটাও কয়েক বছর আগে মরে গেছে।

এদিকে পুজো এসে পড়ল। এখনও পুজোর বাজার হয়নি। একদিন কালবতীকে পিউয়ের কাছে বসিয়ে আমি আর শুক্লা যাব বাজার করতে। শুক্লা কেবল একটা শাড়ি কিনবে; আমিও নিজের জন্যে বিশেষ কিছু কিনব না, কিন্তু পিউয়ের জন্যে জুতো জামা সব কিনব। ভাবছি ওর শীতের পোশাকও এই সময় কিছু কিনে রাখব; এক সেট ভাল অ্যাঙ্গোরা উলের পোশাক। কলাবতীর জন্যেও একখানা শাড়ি কিনতে হবে। ওর বাবুজী বাড়ি নেই, পুজোর সময় ও যদি নতুন শাড়ি না পায়, ওর মনে দুঃখ হবে।

বাবুজী যে কবে ফিরবেন তা বাবুজীই জানেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *