রিমঝিম – ৬

২৭ শ্রাবণ।

কয়েকদিন ডায়েরি লেখা হয়নি।

শুনেছি যারা ডায়েরি লিখতে আরম্ভ করে, প্রথম প্রথম তারা খুব আগ্রহের সঙ্গে লেখে; তারপর ক্রমে তাদের মন এলিয়ে পড়ে। আমারও হয়তো তাই হয়েছে। কদিন থেকে বৃষ্টি বন্ধ আছে, বেশ গুমোট চলেছে। বর্ষাঋতু প্রায় শেষ হয়ে এল। এ সময় শরীর ভাল থাকে না। তার ওপর আমার একটা নতুন কাজ জুটেছে; বেলা দুপুর থেকে রাত্রি আটটা পর্যন্ত একটি রোগিণীর সেবা করতে হয়। যখন কাজ সেরে ফিরে আসি তখন আর ডায়েরি লেখার মত মনের অবস্থা থাকে না।

রোগিণীর বয়স হয়েছে, বড় মানুষের গিন্নী। রোগও এমন কিছু মারাত্মক নয়; কিন্তু মহিলাটি বাড়িসুদ্ধ লোককে তটস্থ করে রেখেছেন। বিছানায় শুয়ে শুয়ে হুকুম চালাচ্ছেন; ছেলেরা ছুটোছুটি করছে, পুত্রবধুরা ভয়ে কাঁটা হয়ে আছে। কতা মাঝে মাঝে দরজায় উঁকি দিয়ে যাচ্ছেন, কিন্তু তাঁর ঘরে ঢোকবার হুকুম নেই। পাছে আমার ওপর তাঁর চোখ পড়ে।

এমনই বিরক্তিকর পরিবেশের মধ্যে আমাদের কাজ করতে হয়। কিন্তু যাক গে, ভাল লাগে না। এসব ছোট কথা লিখতে।

কাল কাজ থেকে যখন বাড়ি ফিরলুম তখন রাত্রি সাড়ে আটটা। পোশাক ছেড়ে স্নান করলুম, তারপর হাল্কা একটা শাড়ি পরে শুক্লার সঙ্গে চা খেতে বসলুম। শুক্লার আজ কাজ নেই, সে বাড়িতেই ছিল; রান্নাবান্না সব করে রেখেছে।

চা খাওয়া শেষ হয়েছে, আমরা বসে গল্প করছি, এমন সময় নীচে দরজার সামনে একটা মোটর এসে থামার শব্দ হল। শব্দটা যেন চেনা-চেনা। উঠে গিয়ে বারান্দা থেকে নীচে তাকালুম। বুকটা ধক করে উঠল। শঙ্খনাথবাবুর প্রকাণ্ড গাড়িখানা এসে দাঁড়িয়েছে এবং তিনি গাড়ি থেকে নামছেন।

ছুটে গিয়ে শুক্লাকে বললুম, শঙ্খনাথবাবু আসছেন। তারপর দরজা খুলে দিতে গেলুম।

ক্লান্তভাবে সিঁড়ি বেয়ে উঠে শঙ্খনাথবাবু দরজার সামনে দাঁড়ালেন। আমার পানে নিষ্পলক চেয়ে রইলেন।

আমি অস্বস্তি দমন করে বললাম, আসুন। পিউ ভাল আছে? তিনি আমার কথা শুনতে পেলেন কিনা সন্দেহ। হঠাৎ বললেন, বাঃ! তোমাকে এ-বেশে কখনও দেখিনি। যেন লক্ষ্মী ঠাকরুন।

জড়সড় হয়ে পড়লুম, কী বলব ভেবে পেলুম না। তিনি আমার আরও কাছে সরে এসে করুণস্বরে বললেন, প্রিয়দম্বা, আজ রাত্তিরে আমাকে দুটি খেতে দিতে পারবে? এই জন্যেই তোমার কাছে এসেছি।

আমি হতভম্ব হয়ে গেলুম। শঙ্খনাথবাবু খেতে এসেছেন আমার কাছে। তারপর সামলে নিয়ে বললুম, আসুন আসুন, দাঁড়িয়ে রইলেন কেন? ঘরে বসবেন চলুন।

তাঁকে ঘরে এনে বসালুম। দেখলুম ইতিমধ্যে শুক্লা চায়ের বাসন সরিয়ে ফেলেছে এবং নিজেও অন্তর্ধান করেছে।

শঙ্খনাথবাবু ঘরের এদিক-ওদিক তাকিয়ে একটি তৃপ্তির নিশ্বাস ফেলে বললেন, খাসা বাসাটি। তা আমাকে খেতে দেবে তো?

আমি ব্যাকুল হয়ে বললুম, শঙ্খনাথবাবু, আমি বুঝতে পারছি না, আপনি ঠাট্টা করছেন, না সত্যি সত্যি বলছেন।

তিনি আশ্চর্য হয়ে বললেন, কী মুশকিল। ঠাট্টা করব কেন! আমিই সত্যিই খেতে এসেছি।

কিন্তু কেন? কেন? আমি কিছু বুঝতে পারছি না। বাড়িতে খাবেন না কেন?

তাঁর মুখ অন্ধকার হয়ে উঠল, বললেন, আমার বাড়িতে আজ মোচ্ছ। তাই আগেভাগেই চলে এলাম।

মোচ্ছব! সে আবার কী?

মোচ্ছ বুঝলে না? নাচগানের মোচ্ছ। ছাতের ওপর আসর বসবে, রেডিওতে নাচের বাজনা বাজবে, সারি সারি টেবিল সাজিয়ে বুফে ডিনার তৈরি থাকবে। বোষ্টম-বোষ্টমীরা নাচবে আর খাবে।

ও! আজ বুঝি আপনার বাড়িতে পার্টি?

হুঁ। গোটা পঞ্চাশ ন্যাড়া-নেড়ীর নেমন্তন্ন হয়েছে। নটা থেকে পার্টি আরম্ভ হবে…তার আগেই আমি কেটে পড়েছি।

ওঁর কথা শুনলে হাসিও পায় দুঃখও হয়। হাসি চেপে বললুম, আপনি না হয় পালিয়ে এলেন, কিন্তু পিউ কোথায় রইল?

কলাবতীর কাছে। সে আর কোথায় যাবে, তার তো পালাবার উপায় নেই।

একবার ইচ্ছে হল জিগ্যেস করি, তাকে নিয়ে এলেন না কেন? কিন্তু তা না বলে প্রশ্ন করলুম, পিউ আমার জন্যে কান্নাকাটি করে না?

তিনি বললেন, কান্নাকাটি আর করে না, তবে মাঝে মাঝে দম্মা দম্মা বলে ডাকে। সে যাক, এখন খেতে দেবে কি না বল। যদি না দাও হোটেলে চেষ্টা দেখি।

বললুম, হোটেলে চেষ্টা দেখতে হবে না, এখানেই খাবেন কিন্তু শাক ভাত। তার বেশী বোধহয় কিছু দিতে পারব না।

খুশি হয়ে বললেন, শাক ভাতই যথেষ্ট।

তাহলে আপনি বসুন, আমি এখনই আসছি–বলে আমি রান্নাঘরে গেলুম।

শুক্লা রান্নাঘরে ছিল, আমার পানে চোখ বড় করে তাকাল। আমি ফিসফিস করে তাকে সব বললুম। শুনে সে মাথায় হাত দিয়ে বসল।

বড়মানুষ অতিথি, কী খেতে দেব রে?

কী কী আছে?

আজ কি কিছু বেঁধেছি। পুঁইশাক আর কুচো চিংড়ি দিয়ে বাটি-চচ্চড়ি, কাঁকড়ার ঝাল আর ভাত।

তা আর উপায় কী, ওই দিয়েই চালাতে হবে। ভাতে বোধহয় কুলবে না

আমি দুমুঠো চাল চাপিয়ে দিচ্ছি, আধ ঘণ্টার মধ্যে হয়ে যাবে। তুই যা।

না, তুই আয় আমার সঙ্গে, শঙ্খনাথবাবুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই। তুই ওঁর কাছে বসে গল্প। করিস, আমি রাঁধব। তুই একা সারাক্ষণ বেঁধে মরবি কেন?

বেশ, তোর যখন তাই ইচ্ছে—

দুজনে বসবার ঘরে গিয়ে দেখি শঙ্খনাথবাবু চোখ বুজে হাত জোড় করে বসে আছেন; তাঁর ঠোট দুটি নড়ছে, যেন বিড়বিড় করে কিছু বলছেন। আমাদের পায়ের শব্দে তিনি চোখ খুললেন। আমি আশ্চর্য হয়ে বললুম, ও কী হচ্ছে।

তিনি বললেন, মা কালীর কাছে মানত করছিলাম—হে মা, আজ রাত্তির বারোটার আগে যেন বিষ্টি হয়, ওদের মোচ্ছ যেন ভেসে যায়।

আমরা দুজনেই খিলখিলিয়ে হেসে উঠলুম, কী মানুষ আপনি! পরের অনিষ্ট-চিন্তা করছেন?

তিনি চোখ পাকিয়ে বললেন, অনিষ্ট-চিন্তা করব না। যারা আমার জীবনটা ছারখার করে দিয়েছে তাদের অনিষ্টা-চিন্তা করব না?

আমার হাসি থেমে গেল। বললুম, ও কথা যাক। এই আমার বন্ধু শুক্লা। আমার দুজনে একসঙ্গে থাকি, একই কাজ করি।

তিনি বললেন, বেশ বেশ, বয়সও প্রায় একই। তা আজ আমি তোমাদের দুজনেরই অতিথি।

বললুম, হাঁ। একটু দেরি হবে কিন্তু। ততক্ষণ আপনি শুক্লার সঙ্গে গল্প করুন। ইতিমধ্যে যদি চা খেতে চান–

দরকার নেই।

আমি রান্নাঘরে ফিরে গিয়ে রান্না চড়ালুম। ভাঁড়ারে চাট্টিখানি ভাল চাল ছিল, বাঁকতুলসী চাল, তাই চার মুঠি চড়িয়ে দিলুম। শঙ্খনাথবাবুর খোরাক কী রকম তা তো জানি না, তবে চেহারা দেখে খোশ-খোরাকি মনে হয় না। একটু বেশী করে ভাত রাঁধাই ভাল, শেষে লজ্জায় পড়ে যাব।

আমাদের দুটো প্রেশার-স্টোভ আছে; একটাতে ভাত চড়িয়ে দিলুম, অন্যটাতে আলু-বেগুনবাড়ি দিয়ে ঝোল চড়ালুম। তবু তিনটে ব্যঞ্জন হবে। তার কম কি ভদ্রলোকের পাতে দেওয়া যায়?

সাড়ে নটার সময় শঙ্খনাথবাবুকে খেতে দিলুম।

ইতিমধ্যে শুক্লার সঙ্গে তাঁর ভাব হয়ে গেছে। শুক্লাকেও তিনি গোড়া থেকে তুমি বলেই সম্বোধন করছিলেন এবং জোর গলায় তাকে লেকচার দিচ্ছিলেন। লেকচারের মর্ম—তোমাদের মত মেয়েরা বিয়ে করে না বলেই তো দেশটা অধঃপাতে যাচ্ছে। শুক্লা গালে হাত দিয়ে বসে শুনছিল। কী বলবে সে? বলবার তো কিছু নেই।

আমি টেবিলের ওপর সাদা চাদর পেতে অব্যঞ্জন তার ওপর রাখতেই তিনি চেয়ার টেনে খেতে বসে গেলেন। আমাদের একবার জিগ্যেস করলেন না, আমরা তাঁর সঙ্গে খাব কি না! কথাটা বোধহয় তাঁর মনেই আসেনি। শুক্লা আড়চোখে আমার পানে চেয়ে একটু হাসল।

খুব তৃপ্তি করে খেলেন শঙ্খনাথবাবু। প্রত্যেকটি ব্যঞ্জন চেখে চেখে, প্রত্যেকটি গ্রাসের স্বাদ নিয়ে। বাটি-চচ্চড়ি দুবার চেয়ে খেলেন। তারপর খাওয়া শেষ করে মাঝারি গোছের একটি ঢেকুর

তুলে মুখ ধুয়ে এসে বসলেন। পরম তৃপ্তিতে নিশ্বাস ফেলে বললেন, আঃ!

শুক্লা বিনয় করে বলল, কিছুই তো খেলেন না।

তিনি পেটে হাত বুলিয়ে বললেন, পেটে জায়গা থাকলে আরও খেতাম। কে বেঁধেছে? এমন রান্না তিন বছর খাইনি।

শুক্লা বলল, আমরা দুজনেই বেঁধেছি। তিনি বললেন, তোমরা আমার লোভ বাড়িয়ে দিলে। আবার একদিন এসে যদি খেতে চাই, খেতে দেবে তো?

শুক্লা বলল, নিশ্চয় দেব। কিন্তু দয়া করে অন্তত দুঘন্টা আগে খবর দেবেন।

তিনি মাথা নেড়ে বললেন, সেটি হবে না। যখন আসব হঠাৎ আসব। তোমরা নিজেদের জন্যে যা বেঁধেছ তাই খাব।

বললুম, তাহলে বাটি-চচ্চড়ি আর কাঁকড়ার ঝাল ছাড়া আর-কিছু জুটবে না।

যা জুটবে তাই খাব। প্রিয়দম্বা, তোমরা এখনও বাটি-চচ্চড়ি আর কাঁকড়ার ঝালের মর্ম বোঝনি। যদি তিন বছর বাবুর্চির হাতের কালিয়া কাবাব খেতে তাহলে বুঝতে।কজির ঘড়ির দিকে। তাকিয়ে বললেন, হুঁ, এগারোটা বাজে। তোমাদের খেতে দেরি হয়ে গেল। আজ উঠি।

তিনি বারান্দায় এলেন, আমরাও সঙ্গে সঙ্গে এলুম। আকাশে অল্প মেঘ আছে, তার ফাঁকে ফাঁকে তারা মিটমিট করছে। আমি বললুম, আপনার প্রার্থনা মাকালী শুনতে পাননি মনে হচ্ছে।

তিনি একবার আকাশের দিকে তাকালেন, তারপর বিমর্ষভাবে ই বলে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেলেন।

বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখলুম গাড়ি চলে গেল। তখন আমরা এসে খেতে বসলুম।

শুক্লা বলল, যা-ই বলিস লোকটি ভাল। সত্যি ভাল।

আমি কি বলেছি মন্দ!

শুধু বাইরের পালিশ থাকলেই হয় না। মন্মথ করের তো খুব পালিশ আছে, তাই বলে সে কি ভাল লোক?

কে বলেছে মন্মথ কর ভাল লোক? তবে ভদ্রসমাজে বাস করতে হলে একটু পালিশ দরকার বইকি।

খাওয়া শেষ করে আমরা রাত বারোটা পর্যন্ত গল্প করলুম। তর্কে শুক্লা প্রমাণ করে দিলে শঙ্খনাথবাবু খাঁটি সোনা, তাঁর পালিশের দরকার নেই; আর মন্মথ করের যতই পালিশ থাকুক সে একটা নেকড়ে বাঘ এবং অজগর সাপ; হাড়ে হাড়ে বজ্জাতি। গল্প করতে করতে এক বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লুম।

সকালবেলা উঠে দেখি আকাশ বেশ পরিষ্কার; রাত্তিরে বৃষ্টি হয়নি। শঙ্খনাথবাবুর মনস্কামনা সিদ্ধ হল না। আমার মনটাও একটু খারাপ হয়ে গেল। বৃষ্টি হলে বেশ মজা হত।

বেলা আন্দাজ দশটার সময় শঙ্খনাথবাবুর মোটর এসে বাড়ির সামনে দাঁড়াল, মোটর থেকে নামল শিউসেবক। তার হাতে একটা বাদামী কাগজ-মোড়া চৌকো গোছের বাক্স। আমি সিঁড়ির দরজা খুলে দিলে সে সেলাম করে বাক্সটা আমার হাতে দিল, সসম্ভ্রম হেসে বলল, বাবুজি পাঠিয়েছেন।

আমি আর শুক্লা বাক্সটি টেবিলের ওপর রেখে কাগজের মোড়ক খুললুম। দেখি একটি ঝঝকে সুন্দর ইলেকট্রিক স্টোভ।

শুক্লা হাততালি দিয়ে কলকণ্ঠে হেসে উঠল, দেখেছিস ভদ্রলোক কাকে বলে?

শিউসেবককে দুটাকা বকশিশ দিলুম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *