রিমঝিম – ৫

২১ শ্রাবণ।

শুক্লা ফিরল সন্ধ্যে পেরিয়ে। একটা বড় নার্সিংহোমে নার্সের ঘাটতি হয়েছে, শুষ্কা সেখানে যাচ্ছে। দিনের বেলা কাজ।

শুক্লা ইউনিফর্ম ছেড়ে হাতমুখ ধুয়ে এল, দুজনে খেতে বসলুম। খাওয়া শেষ হলে দুজনে বিছানায় গিয়ে শুলুম, মুখোমুখি শুয়ে গল্প করতে লাগলুম। সেই আগের কালের মত, যখন হস্টেলে থাকতুম। এখনও সুবিধে পেলেই আমরা ওইভাবে গল্প করি।

শুক্লাকে সলিলার কথা বললুম, শুনে সে হাসতে লাগল। আমি ব্যাগ থেকে রুমাল বার করে তাকে গন্ধ শোঁকালুম, সে চোখ বুজে চুপটি করে পড়ে রইল; তারপর গুনগুনিয়ে গাইল—গগন মগন হল গন্ধে, সমীরণ মুর্ছে আনন্দে–

আমি বললুম, এমন গন্ধ শুকতে শুকতে মরেও সুখ, কী বলিস? শুক্লা বলল, হ্যাঁ। কিন্তু আমাদের কাপলে নেই। মরণকালে আমাদের এ গন্ধ কে শোঁকাবে বল?

মরণকালের এখনও বোধহয় দেরি আছে। থুথুড়ি বুড়ি হয়ে যাব, তবে মরব। তখন বুড়ি নার্সকে আড়াই শো টাকা দামের গন্ধ কে শোঁকাবে!…

এক সময় জিগ্যেস করলুম, হাঁরে, সেই টেলিফোন আর এসেছিল?

না, আর আসেনি। কিন্তু যদি মন্মথ কর হয়, আর জেনেশুনে বজ্জাতি করবার জন্যে ফোন করে থাকে—

তাহলে?

তাহলে সহজে ছাড়বে না। নাছোড়বান্দা লোক। দেখছিস না, তোর আশা এখনও ছাড়েনি।

জামাইবাবুকে তোর সন্দেহের কথা বলেছিলি?

তারপর থেকে দেখাই পাইনি, বলব কাকে? টেলিফোনও করেননি।

আজ হয়তো আসবেন।

রাত্রে আমরা যে-সময়ে খাই সে-সময় খেলুম না। শুক্লা ছটফট করে বেড়াচ্ছে, হয়তো জামাইবাবু আসবেন। রান্না তিনজনের মতই করে রাখা হয়েছে।

প্রায় পৌনে দশটার সময় টেলিফোন বেজে উঠল। আমি ছুটে গিয়ে টেলিফোন ধরলুম। নিশ্চয় জামাইবাবু।

মোটা গলায় আওয়াজ এল,-হ্যালো—প্রিয়দম্বা?

এক মুহূর্তের জন্যে থতিয়ে গেলুম, তারপর বললুম, শঙ্খনাথবাবু! এত রাত্রে কী খবর?

তিনি বললেন, খবর আর কী, পিউ কিছুতেই ঘুমুচ্ছে না, কেবল দম্মা দম্মা বলে কাঁদছে।

দম্মা দম্মা বলে কাঁদছে! তার মানে?

বুঝতে পারলে না?তোমাকে ডাকছে। তোমার পুরো নামটা বলতে পারে না, তাই দম্মা বলে।

ভারি রাগ হল, বললুম, এ আপনার কাজ, আপনি ওকে শিখিয়েছেন দম্মা বলতে।

আরে না না, আমি শেখাব কেন? ও যা শোনে তাই শেখে। আমাকে প্রিয়দম্বা বলতে শুনেছে, তাই–

যাকগে। ওকে খানিকটা ওভালটিন খাইয়ে দিন। তাহলেই ঘুমিয়ে পড়বে।

খাওয়াবার চেষ্টা হয়েছিল, কিন্তু খাচ্ছে না। কেবল কাঁদছে। তুমি না এলে ও ঘুমুবে না।

কী উত্তর দেব, চুপ করে রইলুম। শঙ্খনাথবাবু বললেন, তুমি একটিবার আসবে? গাড়ি পাঠাব?

গলার স্বর যতদূর সম্ভব নীরস করে বললুম, পাঠান। কিন্তু পিউ ঘুমুলেই আমি চলে আসব।

আচ্ছা আচ্ছা।

টেলিফোন রেখে তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিতে গেলুম নিজের ঘরে। কিছুক্ষণ পরে শুক্লা এসে ঢুকল–কী রে, এখন বেরুবি নাকি?

তাকে বললুম পিউয়ের কথা। শুনে সে বলল, আহা, বেচারী মায়ের আদর তো কখনও পায়নি, তাই তোকেই আঁকড়ে ধরেছে। আজ কি সারারাত থাকবি?

বললুম, না, ওকে ঘুম পাড়িয়ে ফিরে আসব।

পনেরো মিনিটের মধ্যে গাড়ি এল।

গিয়ে দেখলুম পিউ ঘুমিয়ে পড়েছে। শঙ্খনাথবাবু ঘরে আছেন, কলাবতী পিউয়ের খাটের পাশে মেঝেয় বসে আছে।

শঙ্খনাথবাবু আমার কানের কাছে মুখ এনে বললেন, এইমাত্র কেঁদে কেঁদে ঘুমিয়ে পড়ল।

পিউয়ের পাশে গিয়ে বসলুম। চোখের কোলে জল শুকিয়ে আছে, ঠোঁট দুটি ঘুমের মধ্যেও ফুলে ফুলে উঠছে। ইচ্ছে হল দু হাতে ওকে বুকে চেপে ধরে ঘুম ভাঙিয়ে দিই। কিন্তু না, কাঁচা ঘুম ভাঙিয়ে দিলে হয়তো আর ঘুমুবে না। যখন ঘুমিয়ে পড়েছে তখন ঘুমুক।

আস্তে আস্তে তার গায়ে হাত রাখলুম। একটি ছোট্ট নিশ্বাস পড়ল; যেন আরও নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমুতে লাগল। ঘুমের মধ্যে কি বুঝতে পেরেছে যে আমি এসেছি?

আধ ঘণ্টা তার গায়ে হাত দিয়ে বসে রইলুম। কলাবতী উঠে গিয়ে দোরের পাশে বসল। শঙ্খনাথবাবু ঘরের এমুড়ো-ওমুড়ো পায়চারি করতে লাগলেন। সলিলা বোধহয় আজ নাচতে বেরিয়েছে, তাকে দেখলুম না।

সাড়ে দশটার পর উঠলুম। শঙ্খনাথবাবু পায়চারি থামিয়ে তীব্র চোখে আমার পানে তাকালেন। আমি তাঁর কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম, বললুম, আমি এবার যাই।

যাচ্ছ?

হ্যাঁ। আমার থাকার দরকার নেই।

তিনি আরও কিছুক্ষণ তীব্র চোখে চেয়ে রইলেন, তারপর পকেট থেকে টাকা বার করে আমার সামনে ধরলেন।

রাগে গা জ্বলে গেল। আমি যেন টাকার জন্যে এসেছি। বড়মানুষ কিনা, টাকা ছাড়া আর কিছু বোঝেন না। খুব ধীরভাবে বললুম, টাকার দরকার নেই।

নেবে না?

না।

শঙ্খনাথবাবু নোটগুলো মুঠিতে পাকিয়ে পকেটে পুরলেন। মনে হল তিনি ভীষণ অপমানিত হয়েছেন এবং দাঁত কিড়মিড় করছেন। আমি আর দাঁড়ালুম না, ঘর থেকে বেরিয়ে দ্রুত নীচে নেমে গেলুম। যা রাগী লোক, এখনই হয়তো চেঁচামেচি শুরু করে দেবেন। এমন মানুষ দেখিনি; নিজের মনের মত সব হওয়া চাই, তা না হলেই চিৎকার লাফালাফি। আমার ইচ্ছে আমি টাকা নেব না। উনি মেজাজ দেখাবার কে?

বাসায় ফিরলুম প্রায় এগারোটা।

জামাইবাবু এসেছেন। এখনও খেতে বসেননি, আমার জন্যে অপেক্ষা করছেন। হাসিমুখে হাত বাড়িয়ে বললেন, এস সখি! তোমার নাকি একটি মেয়ে জুটেছে?

তাঁর পাশে গিয়ে বসলুম। শুক্লা বলল, আর বসিনি প্রিয়া, কাপড় বদলে আয়। আমি ভাত বাড়তে চললুম।

আমার মনটাও কেমনধারা হয়ে গিয়েছিল, জামাইবাবুর সঙ্গে বসে একটু হাসি-গল্প করব তা আর ইচ্ছে হল না। নিজের ঘরে গিয়ে কাপড়চোপড় বদলে মুখে চোখে জল দিয়ে এসে খেতে বসলুম।

বসবার ঘরে টেবিলের ওপর চাদর পেতে আমাদের খাওয়া-দাওয়া। যা যা রান্না হয়েছে টেবিলের ওপর এনে রাখা হয়, তারপর যার যেমন দরকার নিজের হাতে তুলে নিয়ে খাই।

খেতে খেতে কথা হল। জামাইবাবু বেশীর ভাগ কথা বললেন। শুক্লা তাঁকে মন্মথ করের কথা বলেছে, কিন্তু তিনি বিশ্বাস করতে পারছেন না। জামাইবাবু তাকে চেনেন; ভারি ভাল ছেলে, ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট। কয়েক বছরের মধ্যে প্র্যাকটিস বেশ জমিয়ে নিয়েছে। সে মিছিমিছি পরের গুপ্তকথা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করবে কেন?

একটা ভাল খবর এই যে, জামাইবাবুর সহধর্মিণীর কানে কথাটা এখনও ওঠেনি। তাই তিনি একটু আশ্বস্ত হয়েছেন। বললেন, তুমি বোধহয় ভুল করেছ শুক্লা। টেলিফোনে গলার আওয়াজ সব সময় ধরা যায় না। একজনের গলা আর-একজনের গলা বলে মনে হয়।

শুক্লা বলল, কিন্তু একজন কেউ জানতে পেরেছে।

জামাইবাবু বললেন, হয়তো পেরেছে। কিন্তু তার মনে কোনও কু-অভিপ্রায় নেই। থাকলে এতদিন শহরময় টি-টি পড়ে যেত, আমার বাড়ি ঢোকবার উপায় থাকত না।

শুক্লা চুপ করে রইল; কিছুক্ষণ পরে প্রশ্ন করল, মন্মথ করের বিয়ে হয়েছে কি না জান?

জামাইবাবু আশ্চর্য হয়ে চোখ তুললেন,—বিয়ে। যতদূর জানি, সে বিয়ে করেনি। কেন বল দেখি?

শুক্লা তখন চায়ের নেমন্তন্নর কথা বলল। সব শুনে জামাইবাবু বেশ কিছুক্ষণ ভুরু কুঁচকে রইলেন। তারপর বললেন, তাই নাকি। ওর এসব গুণ আছে তা জানতাম না। কিন্তু মতলবটা

কী? চাপ দিয়ে প্রিয়ংবদার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা করতে চায়?

আমি হাল্কা সুরে বললুম, কিন্তু তাতে ক্ষতিই বা কী? ওর সঙ্গে চা খেলে আমার তো আর জাত যাবে না।

জামাইবাবু গম্ভীর করে বললেন, না সখি, ও যদি এই ক্লাসের লোক হয় তাহলে তুমি কক্ষনো ওর চায়ের নেমন্তন্ন নেবে না। কোন কেসে ডাকলেও যাবে না। ও যা পারে করুক। ইতিমধ্যে খোঁজ নিচ্ছি ও কেমন লোক। যদি সত্যিই পাজি লোক হয়, তিনি কপাল কুঁচকে চুপ করলেন, কথাটা শেষ করলেন না।

খাওয়া শেষ হলে জামাইবাবুকে পান এনে দিলুম। তিনি হেসে বললেন, কই, তোমার মেয়ের কথা বললে না?

বললুম, শুক্লার কাছে শুনবেন। আমার ঘুম পাচ্ছে, শুতে চললুম।

ওরা বসে রইল, আমি শোবার ঘরে এসে দোর বন্ধ করলুম। যেদিনই জামাইবাবু আসেন, আমি খাওয়ার পর একটা ছুতো করে নিজের ঘরে চলে আসি। ওদের তো একটু নিরিবিলি দরকার।

আজ কিন্তু সত্যিই আমার শরীরটা ক্লান্ত বোধ হচ্ছে। আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়লুম। ক্লান্তি সত্ত্বেও ঘুম এল না। শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগলুম পিউয়ের কথা। আজ সে আমার জন্যে কেঁদে কেঁদে ঘুমিয়ে পড়েছে; কাল হয়তো আর কাঁদবে না, এমনিই ঘুমিয়ে পড়বে। তারপর ক্রমে আমাকে ভুলে যাবে। ছেলেমানুষ তো, ওদের স্মৃতিশক্তিই বা কতটুকু! পরে যদি কোনওদিন আমাকে দেখতে পায়, চিনতেই পারবে না।

মাত্র তিন দিন তো পিউ আমাকে দেখেছে, এরই মধ্যে এত ন্যাওটা হল কী করে? মায়ের আদর পায়নি তাই? কী জানি! আমারই বা ওর ওপর এত মন পড়ল কেন? সুন্দর মেয়ে, তাই? কী জানি…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *