২৯. জ্বর জ্বর

জ্বর জ্বর!

পক্ষকাল কাটল।

উত্তরোত্তর বাড়ছে বৈ কমছে না। ক্রমশ বিকার ধরল। হাত মুঠো করে আস্ফালন করছে রোগী, বিছানায় তেড়ে তেড়ে উঠছে। দুটো লোক দুদিকে ঠায় বসে আছে রোগীকে বিছানায় চেপে ধরে রাখতে।

আর একজন তো অবিরত পানাপুকুরের ঠাণ্ডা জল এনে কলসী কলসী ঢালছে রোগীর মাথায়। কবিরাজ এসে ওষুধ দিচ্ছেন বটে, কিন্তু যেভাবে মুখ প্যাচা করে আস্তে আস্তে ঘাড় নাড়ছেন, তাতে ওষুধ সম্পর্কে ভরসা বোধ করছে না কেউ।

এদিকে বাড়িতে রথ-দোলের ভিড়।

পাড়ার লোকের যেন খেয়ে ঘুমিয়ে স্বস্তি নেই। তারা প্রতি মুহূর্তে চরম মুহূর্তের অপেক্ষায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে। নাটকের শেষ দৃশ্যটা পাছে ফসকায়! অবিশ্যি অহিতৈষী কেউ নয়। সকলেই নিরীহ নবকুমারকে ভালোবাসেন। তেমন তেমন কেউ ওর নামে পুজো মানত করেছে, “গা শেতল” হবার আবদার নিয়ে গঙ্গাজলের ঘড়ার মধ্যে পাঁচ কড়া কড়ি ফেলে রেখেছে, আর ওলাইচণ্ডীতলা থেকে নিত্য মায়ের চরণামৃত এনে যোগান দিচ্ছে।

বাঁড়ুয্যে-গিন্নীর ওই সবেধন নীলমণিটুকুর প্রাণের জন্য উদ্বেগ, উৎকণ্ঠার আর অন্ত নেই লোকের। তবু আশা যখন ছাড়তেই হচ্ছে, বিশেষ নাট্যমুহূর্তটিকে ছাড়বে কেন?

অতএব নিজের নিজের সংসারের রান্না-খাওয়া সংক্ষিপ্ত করে এ বাড়ির হাজরেটা বজায় রাখছে সবাই। তা ছাড়া প্রায় প্রত্যেকেই তো এক-একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসক! সে চিকিৎসা বিদ্যা কাজে লাগাবার যখন সুযোগ পাওয়া গেছে, কাজে লাগাবে না?

প্রকৃতপক্ষে এখন কবিরাজী চিকিৎসা বাতিল হয়ে গেছে, পাড়ার গিন্নীদের চিকিৎসাই চলছে। গতকাল নুটু স্যাকরার মার ব্যবস্থাপনায় পেটে পচা পুকুরের শ্যাওলা প্রলেপ দেওয়া হচ্ছিল। কারণ নুটুর এক ভাসুরপোর নাকি ঠিক এই অবস্থায় ওই দাওয়াই অব্যর্থ হয়েছিল।

হবেই বা কেন? কথায় বলে, মুড়ি আ ভুঁড়ি। দুটোর মধ্যে দূরত্ব বেশ খানিকটা থাকলেও সম্বন্ধ যে অবিচ্ছেদ্য। একজনকে ঠাণ্ডা করতে পারলেই আর এক জন ঠাণ্ডা হতে বাধ্য। তাই পেটে শ্যাওলার প্রলেপ চাপিয়ে চাপিয়ে তাকে ঠাণ্ডা করে আনবার চেষ্টা চলছিল–মাথায় চড়ে ওঠা রক্তকে চড় চড় করে নামিয়ে আনতে।

কিন্তু নুটুর মার কপাল! অত বড় অব্যর্থ প্রয়োগটাও বিফল হল। রোগী বিছানায় মাথা ঘষটাতে শুরু করল।

আজ তাই হরি ঘোষালের গিন্নীর দাওয়াই চলেছে। গায়ের তাপ ধান দিলে খৈ ফুটছে, তাই ঘোষাল-গিন্নী বিধান দিচ্ছেন সপসপ করে ভেজানো ন্যাকড়ায় রোগীকে আষ্টেপিষ্টে মুড়ে তার উপর জোর জোর করে পাখার বাতাস লাগাতে। সেই বাতাসে ন্যাকড়া শুকিয়ে উঠলেই আবার তাতে জলের আছড়া।

রোগী জ্ঞানশূন্য, অতএব সেবিকারা বাকবিন্যাসে ভয়শূন্য। ঠিক এই অবস্থায় আর এই এই লক্ষণে কার জানাশোনা কটি রোগীর স্বর্গপ্রাপ্তি ঘটেছে তারই হিসেবনিকাশের সঙ্গে সঙ্গে পাখা চলছিল উদ্দাম বেগে। নীলাম্বর বড়য্যে অনেকক্ষণ বসে থাকতে থাকতে হঠাৎ বুক কেমন করছে বলে পাশের ঘরে গিয়ে শুয়েছেন, সদু তার চোখে মুখে জল দিচ্ছে, এমন সময় এলোকেশীর গলায় মরাকান্না উঠল।

যারা খোদ রোগীর ঘরে বসে তারা বুঝলেন, মাগী আর পারছে না, চেপে থেকে থেকে বুক ফেটে যাচ্ছে!

যারা এ বাড়ির বাইরে আছেন, তাঁরা উঠি তো পড়ি, পড়ি তো মরি করে ছুটে এলেন। নীলাম্বর যাঃ সব্বনাশ হয়ে গেল বলে চৌকি থেকে মড়মড়িয়ে নামতে গিয়ে হুড়মুড়িয়ে পড়ে গলেন, আর সদু তাকে তোলার পরিবর্তে চলে গেল ও-ঘরে, তবে একটু দাঁড়িয়েই চলে এসে সান্তনা দিতে বসল মামাকে।

এলোকেশীর কাছে যাওয়া কর্তব্য ছিল, কিন্তু কোন্ কর্তব্যটা করবে? সে তো আর চতুর্ভূজ্যা নয়?

এলোকেশী ঢেঁকিঘরে বসে কাঁদছেন।

সমাগতা মহিলারা সেইখানেই জমায়েত হলেন এবং এই হঠাৎ-কান্নার কারণ অবগত হয়ে গালে হাত দিয়ে বসে পড়লেন।

কয়েকজন এ কথাও বললেন, পায়ের ধুলো দাও নবুর মা, তোমার একটু পায়ের ধুলো দাও, মাথায় ঠেকাই, যদি তাতে তোমার মতন সহ্যশক্তি জন্মায়। ওই দজ্জাল বৌ নিয়ে এই অবধি ঘর করছ তুমি!

জনৈকা আক্ষেপ করে বলেন, আমি ভাবছিলাম আজ ভরসন্ধ্যেয় তোমার বৌকে নিয়ে চণ্ডীতলায় গিয়ে মায়ের পায়ে তার শাঁখা-সিঁদুর জমা দিয়ে এয়োৎ বাঁধা রাখার মানুতি করে আসব। তোমার তো মাথার ঠিক নেই, পাঁচজনে না দেখলে চলবে কেন? কিন্তু যে বৌ তোমার–বলতে তো ভরসা হচ্ছে না!

অপরা ফিসফিস করে, বলো না দিদি, বলো না। আমি বলি নি ভেবেছ? হাত বাঁধার কথা বলেছিলাম। কিন্তু সদুর কাছে নাকি বলেছে নবুর বৌ, আমি ডান হাতের বদলে বাঁ হাতে ভাত খেলে আমার স্বামীর পরমায়ু ফিরবে এ কথা আমি বিশ্বাস করি না। উচিতমত ওষুধ না পড়লে কি অসুখ সারে?

আঁ! এই কথা বলেছে?

তাই তো বলল সদু। বলল, ওই নিয়ে আর বৌকে পেড়াপেড়ি করতে যেয়ো না খুড়ি, মানুষের মান-মর্যাদা তো রাখতে জানে না। হয়তো তোমার মুখের ওপরই না বলে বসবে।

সাধে কি আর বলছি, নবুর মার পাদোদক খেতে হয়!

কথাটা এলোকেশীর কানে যায়। তিনি বুকটা আর একবার চাপড়ে, আর একবার সেই চিরপরিচিত সুরের কান্নাটি কেঁদে ওঠেন।

ওরে নবু রে–ওরে আমার সোনার গোপাল রে, তুই থাকতেই তোর বৌ আমাকে কী পায়ে দলছে দ্যাখ রে!

যারা রোগীর সেবা করছিলেন, তারা সেবা ফেলে ছুটে আসেন।

হলটা কি?

এই দুঃসময়ে ‘পাহাড়ে’ বৌ কি না কি করে বসল!

তা সে যা করে বসেছে তা চরম!

শাশুড়ীর মুখের ওপর বলেছে, মানুষটাকে দশজনে মিলে কুপিয়ে কুপিয়ে না কেটে একেবারে মা চণ্ডীর কাছে বলি দিয়ে দিলেই হত! মানুষটাও উদ্ধার পেত, দশজনেরও খাটুনি কমত!

স্বামীর কথা নিয়ে যে বৌ এমনি করে গলা তুলে শাশুড়ীর সঙ্গে কথা বলতে পারে, সে বৌ তা হলে না পারে কি!

ঝেটিয়ে বিদেয় করে দাও, ঝেটিয়ে বিদেয় করে দাও– চাটুয্যে-গিন্নী দৃপ্তকণ্ঠে বলেন, ওই ডাকাতের আওতাতে-আওতাতেই ছেলে তোমার তুষ হয়ে গেছে নবুর মা! নইলে অমন ডবকা ছেলে, হঠাৎ এমন পিচাশ পাওয়া রোগেই বা ধরবে কেন?

তবু আমার নবু ওই বৌ-অন্ত-প্রাণ চাটুয্যে দিদি! বৌয়ের ভয়ে কাঁটা!

দুটো অবস্থার মধ্যে সামঞ্জস্য না থাকলেও কথাটা বলেন এলোকেশী।

তা ভগবান তেজ ভাঙছেন! অবিশ্যি তোমার মাথায়ও মুগুর মারছেন! কিন্তু ওই তো বিধাতার বিধান। একের পাপে আরের দণ্ড। তবু এও বলব, ওর দুঃখে শেয়াল-কুকুর কাঁদবে! পথের শত্রুর আহা করে যাবে!

এঁরা অধিকাংশই এলোকেশীর খাতক। গোপনে সুদী কারবার করে থাকেন এলোকেশী। ওঁদের অনেকেরই সোনাটা রূপোটা এলোকেশী সিন্দুকে পচছে।

অবশ্য পাড়ায় স্পষ্টবক্তা ন্যায়দর্শী একেবারে নেই তা নয়। কিন্তু তেমনদের সঙ্গে এলোকেশী ভাব চটিয়ে রেখেছেন। তবু নবকুমারের মরণ বাঁচন অসুখ শুনে দেখতে আসছেন তারা, ন্যায্য কথা দু-একটাও বলেও যাচ্ছেন।

যেমন ভজুর পিসি বলে গেছলেন, হাগা, বৌয়ের বাপের বাড়ি খবর দিয়েছ?

এলোকেশী বাঁকা মুখে জবাব দিয়েছিলেন, কেন, সেখানে খবর দিয়ে আবার কি হবে?

ওমা, তাদের হল গে জামাই! মুখের ওপর বলছি না, তবে ভগবানের মারের ওপর তো কথা নেই! একটা এদিক-ওদিক কিছু হয়ে গেলে জবাবটা কি দেবে?

জবাব!

এলোকেশী মনোকষ্ট ভুলে উদ্দীপ্ত হয়ে উঠেছিলেন, কেন, আমি কি তাদের উঠোনে বাস করি? আমি কি তাদের জমিদারির প্রজা? আমি কি তাদের খাতক? আমি কি কাঠগড়ায় আসামী যে জবাবদিহি দিতে হবে? কি বলব, এখন আমার দুঃসময় চলছে তাই-নইলে তোমায় উচিত কথা শুনিয়ে দিতাম কায়েত-ঠাকুরঝি!

সনতের জেঠী একদিন বলেছিলেন, নবুর শ্বশুর তা শুনেছি নামকরা কবরেজ, জামাইয়ের অসুখের খবর দিচ্ছ না কেন?

এলোকেশী গম্ভীর কণ্ঠে জবাব দিয়েছিলেন, আমার তো দশটা পাইক-পেয়াদা নেই দিদি যে হুট বলতে খবর দেব। বলে ছেলের ব্যামোতেই চোখে সরষে ফুল দেখছি। বেশ তো, তোমরা পাঁচজন আছ, খবর দাও না। বলে পাঠাও, এস তুমি। তোমার জামাইয়ের উচিত চিকিচ্ছে করে যাও।

.

এরপর আর কে কথা কইবে?

কিন্তু এলোকেশী কি সত্যিই এত মন্দ যে নিজের ছেলের কল্যাণ-অকল্যাণ দেখেন না?

না, তা নয়।

আসলে এলোকেশী এ বিশ্বাস রাখেন না বৌয়ের বাপ ধন্বন্তরী! তা ছাড়া এটাও মনের মধ্যে কাজ করছে,যদি সত্যিই তা হয়, বৌয়ের বাপের গুণপনাতেই যদি তাঁর ছেলে সেরে ওঠে, সে অপমানের জ্বালা এলোকেশী জুড়োবেন কিসে?

আর বৌও কি তা হলে আরও সাপের পাঁচ-পা দেখবে না? ছেলের প্রাণের জন্য শত-সহস্রবার তেত্রিশ কোটি দেবতার চরণে মাথা খুড়ছেন এলোকেশী, কিন্তু বৌয়ের তেজ-দর্পটা কিছু খর্ব হোক, এটাও প্রার্থনা। দুটোর সামঞ্জস্য বিধান হয় না, কারণ মরা স্বামী বেঁচে উঠলে তো দবুদবার আর শেষ থাকে না মেয়েমানুষের। তেমন হলে বড় কেউ মায়ের পুণ্যবলের কথা তোলে না, তোলে পরিবারের এয়োতের জোরের কথা!

আবার সেই বেঁচে ওঠাটাই যদি বৌয়ের নিজের বাপের গৌরবে হয়? উঃ রক্ষে করো! নবু তার নিজের বাপের পুণ্যে তরবে। নিত্য একশ আট তুলসী দেওয়া কী ব্যর্থ হবে!

হায়, এলোকেশীর ছেলের একশ বছর পরমায়ু হয়ে যদি বৌয়ের হাড়ির হাল হওয়া সম্ভব হত! তা হবার উপায় নেই। এলোকেশীর প্রাণের পুতুলই যে বৌয়ের অহঙ্কারের মাটি।

.

কিন্তু সত্য এ নাটকের কোন্ অঙ্কে?

সে কি এবারও স্বামীসেবার পুণ্য অর্জন করে না?

নাঃ, সে পুণ্য অর্জনের সৌভাগ্য তার হয় না। কারণ গুরুজনদের সামনে গিয়ে তো আর সে বরের গায়ে-পায়ে হাত বুলোতে বসবে না। ঘরে ঢুকবেই বা কোন লজ্জায়!

রাত্রে? সে তো শ্বশুর-শাশুড়ী দুজনে ছেলেকে বুক দিয়ে আগলে পড়ে থাকেন। আর সদু তাঁদের খিদমদগিরি করে। সেখানে সত্য কে?

তা ছাড়া তার কোলে বাচ্চা ছেলে। ছ মাসও হয় নি। আর তার গলাতেই সংসার।

স্বামীসেবার একটি অংশ তার ভাগে আছে। সেটা হচ্ছে ঔষধের অনুপান প্রস্তুত। বহুবিধ জিনিস নিয়ে ছাঁচা, বাটা, গুড়ানো, সেদ্ধ করা ইত্যাদিতে অনেকটা সময় ব্যয় হয় তার।

কবরেজ আবার ওষধে ফল হচ্ছে না দেখে অবিরতই অনুপানের ত্রুটি আবিষ্কার করছেন! তেজী সত্য এসময় শুকনো চোখে ঠায় খাড়া থাকে। শুধু রান্নাঘরের কোণে যখন একা মুখ নিচু করে কাজ করে, আর রাত্রে যখন ছেলে দুটো ঘুমিয়ে পড়ে, তখন বাধমুক্ত করে অশ্রুর সাগরকে।

নবকুমার যদি সত্যিই না বাঁচে!

তোলপাড় হয়ে ওঠে আকাশ পাতাল পৃথিবী। যে মানুষটা সত্যর মনের জগতে একটা অবোধ অজ্ঞান নাবালকের দলে গণ্য ছিল, সে যে তার এত বড় আশ্রয় এ কথা এখন টের পেল সত্য! যখন সে মানুষটা যেতে বসেছে।

সত্য কেন তাকে কেবল বকেই এসেছে! কেন শুধুই ভালোবাসে নি? কেন কেবল হেসে কথা বলে নি?

ঠাকুর, ওকে এবারের মত বাঁচিয়ে দাও, সত্য ওকে শুধু ভালবাসবে। ও বোকামি করুক, ভীরুতা করুক, ছেলেমানুষি করুক, কোন দোষ ধরবে না সত্য।

কিন্তু ও কি বাচবে!

মাকে অবহেলা করেছিল সত্য, মা বাঁচেন নি। আর স্বামীকে অবহেলা করে পার পাবে!

তখন না হয় বুদ্ধি ছিল না, মা কী বস্তু বোধ জন্মায় নি। কিন্তু এখন? এখন কী জবাব আছে?

সারারাত জেগে ঠায় বসে থাকে সত্য কান খাড়া করে। হঠাৎ বুঝি কোন সময় সেই ভয়ঙ্কর শব্দটা ওঠে। মাঝে মাঝে পা টিপে টিপে গিয়ে এ-জানলা ও-জানলা করে মরে। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসে। রাত্তিরে রুগীর ঘরের জানলা কে খুলে রাখবে? একে তো “সান্নিপাতিক জ্বরবিকার”, হাওয়া লাগলেই বিপদ। তা ছাড়া রাত্তিরে জানলা খোলা দেখলে অপদেবতায় উঁকি মারবে না? হাওয়া বাতাস লাগবে না? আর ভাবতে বুক কাঁপলেও না ভেবে উপায় নেই, পথ খোলা দেখলে যমদূত ঢুকে পড়বে না? এলোকেশী কি সেই আসার পথ খোলা রাখবেন?

অতএব সত্য কানকে তীক্ষ্ণ থেকে তীক্ষ্ণতর করে তোলে।

কিন্তু এতেই কি সত্যর সকল কর্তব্য শেষ হয়ে গেল? আর কোন করণীয় নেই তার স্বামীর সম্পর্কে! ওঁরা মা-বাপ, তা ঠিক। কিন্তু এঁরা যদি অবোধ হন? তবে সত্যই বা কি কম অবোধ! এক মাস হতে চলল জ্বর চলছে নবকুমারের, দিন দিন বাড়ছে বৈ কমছে না, অথচ উচিতমত একটা ওষুধ পড়ল না তার পেটে!

আর সত্য নিশ্চেষ্ট হয়ে বসে আছে।

সত্যর ভগবান কি এর পরও ক্ষমা করবেন সত্যকে?

এলোকেশীর সেই কান্নার পর এলোকেশীকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন মহিলারা, কখনো কোন দোষ করোনি, ঘাট করে নি, কারুর অহিত করো নি, পুত্রশোকের জ্বালা তোমায় কেন দেবে ভগবান?

আবার সু-পরামর্শ দিচ্ছিলেন পরক্ষণে, বলতে নেই, ছেলের যদি কিছু হয় নবুর মা তো তুমি একদোর দিয়ে ছেলেকে বিসর্জন দেবে, আর দোর দিয়ে ওই হারামজাদীকে গলাধাক্কা দিয়ে বার করে দেবে। যে বৌ শাশুড়িকে অত কথা বলে–

ও বাতাসীর মা, শুধু কি ওই কথা বলেছে! বলি তবে শোন! রাতে বাইরে যাব বলে হঠাৎ দোর খুলে দেখি ঝপ করে কে দুয়োরের কাছ থেকে সরে গেল! ভয়ে হাঁকপাক করে চেঁচিয়ে উঠেছি। কে কে বলে চেঁচিয়ে উঠে দেখি, না আমার অবতার! রাগের চোটে মুখ দিয়ে কু-কথা বেরিয়ে গেল, বললাম, দোরের গোড়ায় কি করছিলি রে হারামজাদী? তুক না তাক? বলল কি জান!–ছেলে মিত্যুশয্যেয়, তবু তোমার জিভের ধার কমে না? কেমন মা তুমি?

শ্রোত্রী মহিলা সঙ্গে সঙ্গে সবলে নিজের গালে ঠাঁই ঠাই করে দুটো চড় কষিয়ে বলে ওঠেন, ওমা আমি কোথায় যাব! ও নবুর মা, সে বৌয়ের মুখ তুমি নাথি দিয়ে ভেঙে দিলে না?

এই শাস্তিমূলক ব্যবস্থার জবাবে উদারচরিতানাম নবুর মা কী বলতেন কে জানে, সহসা অন্য এক ঝড় এসে লাগল। দেখা গেল গোয়ালের পাশের দরজা ঠেলে ঢুকে নাপিত-বৌ চুপি চুপি রান্নাঘরের দিকে এগোচ্ছে। অর্থাৎ সত্যর সন্ধানে যাচ্ছে।

বৌয়ের সঙ্গে নাপিত-বৌয়ে কিসের শলা! মুহ্যমান এলোকেশী গলা তুলে হাঁক দিলেন, কোথায় যাওয়া হচ্ছে?

চতুর নাপিত-বৌ বুঝল ধরা পড়েছে। অতএব মিছে কথা বলে চাপা না দিয়ে এদিকে এসে চুপি চুপি বলে, বৌমা যে আমায় তেনার বাপের কাছে পাঠিয়েছিল গো, তার বার্তাটা দিতে।

কথা শেষ করতে পারে না সে। এলোকেশী রুদ্ধশ্বাসে বলেন, কার কাছে পাঠিয়েছে?

ওনার বাপের কাছে গো। ভারী মস্ত কবরেজ তো! পত্তর লিখে আমার হাত দে পাঠিয়েছিল জামাইরে বিত্তান্ত জানিয়ে। এসে চিকিচ্ছে করতে।

তুই সে-ই কথা আমায় না জানিয়ে, স্বাধীনে চলে গিয়েছিলে?

নাপিত-বৌ নরম হবার মেয়ে নয়। যেই দেখল ধমকের পথ ধরেছে গিন্নী, সেও সতেজে বলে, স্বাধীন পরাধীন বুঝি নে! বৌ-টা সোয়ামীর ভাবনায় ধড়ফড়াচ্ছে, দেখে মায়া হল–

মায়া! মায়া হল? তুই আর ভূতের কাছে মামদোবাজী করতে আসিস নে নাপতে-বৌ! বিনি মজুরিতে তুই পরের জন্যে একটা হাই তুলিস না, আর তুই যাবি মায়ায় পড়ে

বিনি মজুরিতে, তা তো বলি নি নাপিত-বৌ বেজার মুখে বলে, তা করলে আমার চলবেই বা কেন? নেয্য মজুরি দিয়েছে, গিয়েছি।

দিয়েছে! বৌ তোকে নেয্য মজুরি দিয়েছে? এলোকেশী ক্ষেপে ওঠেন, সে কোথায় পাবে শুনি? তা হলে সে আমার বাক্স থেকে চুরি করতে শিক্ষে করছে! আর তুই তার মন্ত্রী হয়ে

সহসা পিছনে বজ্রপাত হয়।

এতগুলো গিন্নী সম্বন্ধে অবহিত মাত্র না হয়ে সত্য বলে ওঠে, নিচু ঘরের মতন কথা বোলো না। নাপিত-খুড়ীকে আমি রাহাখরচ বলে আমার মলজোড়াটা দিয়েছি।

মলজোড়াটা! পাথর হয়ে যান মহিলারা।

শাশুড়ীকে না বলে-কয়ে গায়ের গহনা দানছত্র! মুহুর্মুহু মূৰ্ছা গেলেও বোধ করি এই প্রবল আঘাতের বেগ রোধ হবে না।

এত বড় দুঃসাহস কেউ কল্পনাও করতে পারেন না।

এলোকেশী বুকে হাত চাপড়ে বলে ওঠেন, দ্যাখ, তোমরা দ্যাখ! দেখে বল আমায় ধরে ঝ্যাঁটা মারবে কিনা, বৌকে আমি নিন্দে করি বলে! ওরে বাবা রে, আমি কি করব রে

সত্য সেদিকে দৃকপাত না করে নাপিত-বৌয়ের দিকে তাকিয়ে শান্তভাবে বলে, বাবা কি চণ্ডীমণ্ডপে ছিলেন?

ওমা শোন কথা! নাপিত-বৌ গালে হাত দিয়ে বলে, তিনি আবার কই? তেনার হাতে নাকি কোন মরণ-বাচন রুগী, তাকে ফেলে আসতে পারল না। ওষুধ পাঠিয়ে দেছে। এসেছে তোমার বড় ভাই–তার হাতেই ওষুধ আর তোমার নামে পত্তর আছে। ওমা ও কি ও কি, বৌ যে পড়ে গেল গো! ওমা ই কী কাণ্ড!

প্রবল একটা কোলাহল উঠল বাঁধ হারিয়ে ফেলা সেই ছড়িয়ে পড়া নদীটুকু ঘিরে।

ভিরমি লেগেছে… ভিরমি! ভিরমি না ভিটকিলোমি… মস্ত বড় একটা অপকম্ম করে ফেলে এখন ধরা পড়ে।

নদীকে ঘিরে ঢেউ ওঠে অসংখ্য।

.

দীক্ষাগুরু নিপাতে তিন দিন অশৌচ শাস্ত্রীয় বিধি।

বিদ্যারত্ন রামকালীর তথাকথিত মন্ত্ৰদীক্ষার গুরু ছিলেন না, আর রামকালীও ওই ধরনের শাস্ত্রীয় বিধি যে ঠিক অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন তা নয়। তবু বিদ্যারত্নের মৃত্যুর পরের দিন রামকালী সমস্ত কাজকর্ম পূজাপাঠ পরিত্যাগ করে স্তব্ধ হয়ে বসে ছিলেন বারমহলে।

তিন দিন ঔষধরূপী নারায়ণে হস্তক্ষেপ করবেন না, শাস্ত্রপাঠ ইত্যাদি করবেন না, অনুগ্রহণ করবেন না।

বিগত কয়েকদিন রোগীর বাড়িতে দিনে রাত্রে যমের সঙ্গে যুদ্ধ করে পরাজিত হয়ে ফিরে এসেছেন। মুখে সেই পরাজয়ের কালি-মাখা ছাপ। চিন্তা করছেন এই অবস্থায় জামাত-গৃহে যাওয়ার কোন অর্থ হয় না। কারণ চিকিৎসা করা থেকে যখন বিরত থাকতে হবে। ঔষধ যখন স্পর্শও করবেন না। মনে করছেন আগামী পরশু স্নানশুদ্ধির পর

চিন্তায় বাধা পড়ল।

দেখলেন তাঁর পালকি ফিরছে। অর্থাৎ হয় রাসু নয় রাসুর খবর। রাসুকে বলে দিয়েছিলেন, সত্য উদ্বিগ্ন হয়ে খবরটা দিয়েছে বটে তবে যথার্থই রোগ কঠিন কিনা সেটা রাসু অনুধাবন করে শীঘ্রমধ্যে হয় নিজে ফিরে আসবে, নয় পালকি পাঠিয়ে দিয়ে ঘটনার গুরুত্ব জানিয়ে দেবে।

ঈষৎ কম্পিত বক্ষে অপেক্ষা করেন রামকালী, পালকি শূন্য না পূর্ণ দেখা পর্যন্ত।

না, শূন্য নয়।

রাসু নামছে। যাক ঈশ্বর রক্ষা করেছেন। রাসু এসে নতমুখে প্রণাম করতে উদ্যত হতেই রামকালী পিছিয়ে গিয়ে বলেন, থাক থাক, এ সময় প্রণাম নিষেধ। কি রকম দেখলে?

রাসু আস্তে আস্তে মাথা নেড়ে বলে, ভাল নয়।

ভাল নয়!

সহসা রামকালীর মনশ্চক্ষে একটা মূর্তি ভেসে ওঠে। নিরাভরণ শুভ্র মূর্তি। শিউরে ওঠেন রামকালী, নিস্তেজ স্বরে বলেন, ঔষধটায় ফল হল না?

ঔষধ প্রয়োগ করা হয়নি– রাসু জলদগম্ভীর স্বরে বলে, সত্য ফেরত দিয়েছে।

ফেরত দিয়েছে?

সত্য রামকালীর ঔষধ ফেরত দিয়েছে! রাসু ওই দিশেহারা মুখের দিকে না তাকিয়েই হাতের পেটিকাটি আস্তে নামিয়ে রেখে বলে, হ্যাঁ। আপনার পত্র নেয় নি, পড়ে নি।

রামকালী ব্যাকুলভাবে বলেন, তোমার সঙ্গে দেখা করতে দেয় নি?

না, না, তা দিয়েছে। সত্যও অসুস্থ ছিল। আমি গিয়েছি মাত্র, ঠিক সেই সময় হঠাৎ অচৈতন্য হয়ে পড়েছিল নাকি। পরে সুস্থ হয়ে আমার সঙ্গে দেখা করে বলল, বাবার যখন আসা সম্ভব হল না, চিঠি থাক বড়দা, ও আর পড়ে কি করব! আর ওষুধও তুমি ফিরিয়ে নিয়ে যাও। আমার অদৃষ্টে যা আছে তাই হবে। যদি সতীমায়ের কন্যে হই, সেই পুণ্যেই আমার শাখা লোহা বজ্জর হয়ে থাকবে।

জীবনে বোধ করি এই প্রথম রামকালী হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন, কথা খুঁজে পান না। এরপর কি আর স্নান-শুদ্ধ হয়ে যাত্রা করবেন রামকালী, সত্যর কথা অবোধের কথা ভেবে?

তা সেই অবোধ সত্য তো তাহলে একথাও বলে বসতে পারে, আবার তুমি এলে কেন বাবা, তোমার ওষুধ যখন খাওয়াচ্ছি না!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *