২৮. সংসারসুদ্ধ সকলেই আশা করেছিল

সংসারসুদ্ধ সকলেই আশা করেছিল প্রস্তাবটা সারদার দিক থেকেই উঠবে। কারণ সত্যিই কি আর এতটা বেয়েক্কেলে আর চক্ষুলজ্জাহীন হবে সে? কিন্তু আক্কেল সম্পর্কে নিতান্ত উদাসীন হয়েই অনেকগুলো দিন কাটিয়ে দিল সারদা। চক্ষুলজ্জার প্রকাশ দেখা গেল না।

তাহলে?

চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখানো ছাড়া তো উপায় নেই। কিন্তু সেই আঙুলটা বাড়ায় কে? যে মুখরা সারদা, সুযোগ পেলে গুরুজনকেও রেয়াত করে কথা কয় না। ঘোমটার মধ্যে থেকেই এমন কুটুস কামড়টি দেয়, তাতে কামড়াহতের সর্বাঙ্গে জ্বালা ধরে যায়।

কাজেই আড়ালে-আবডালে সমালোচনা উদ্দাম হয়ে ওঠে। বস্তুত এখনকার অবস্থা এই, সারদা যখনই যে কাজে এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় গিয়ে পড়ে, দেখে দু তিনটি মুখ একত্র হয়ে গুঞ্জরণ করছে, সারদা গিয়ে পড়তেই ঝপ করে গুঞ্জরণটা থেমে যায় এবং মুখগুলি বিভক্ত হয়ে গিয়ে সহসা যা থোক একটা কাজরে কথা নিয়ে সোরগোল শুরু করে দেয়।

সারদা কি বোঝে না কি কথা হচ্ছিল ওদের? বোঝে বৈকি। বুকে মাথা থেকে পা অবধি রি রি করে জ্বলে ওঠে তার, তবু বুঝতে না পারার ভানটাই চালিয়ে যায় সে। চালায় এই জন্যে, জানে। বুঝতে পেরেছি বলার সঙ্গে সঙ্গেই সমস্ত ব্যাপারটা নিরাবরণ হয়ে যাবে, যেটুকু চক্ষুলজ্জার আড়ালে আবডালে রেখে ঢেকে বলছে ওরা, সেটুকু ঘুচে গিয়ে প্রকাশ্য আক্রমণের পথে নেমে আসবে। কাজেই ওই মুখোমুখিটা যতক্ষণ এড়ানো যায়! ১৭০

তা ছাড়া এমনিতেই সারদা বিশেষ আত্মস্থ, গায়ে পড়ে কিছু বলতে যাওয়া বা জবাব দিতে যাওয়া ওর স্বভাবই নয়।…

কিন্তু ওঁরাই এবার গায়ে পড়ে বলতে আসার সংকল্প গ্রহণ করেছেন। সারদার নিজের শাশুড়ী আর পিসশাশুড়ী শশীতারা। এই পিসশাশুড়ীটিকে জীবনে এই প্রথম দেখল সারদা। কারণ প্রায় বছর তিরিশ পর তিনি পিত্রালয়ে এসেছেন। এতদিন বিরতির কারণ অবশ্য বৈবাহিক কলহ। তা দুই বৈবাহিকের একজন তো বহুদিন গত হয়েছেন, কুণ্ড রামকালী আর শশীতারার বাবা জয়কালী। অপরটি অর্থাৎ শশীতারার শ্বশুর নাকি এতদিন বেঁচে থেকে পুত্রবধূর পিত্রালয়ের পথের কাঁটাটি দৃঢ়মূল রেখেছিলেন।

সম্প্রতি তার শ্রাদ্ধ চুকেছে, শশীতারা এত বছর পরে পিত্রালয়ে এসেছেন। এখন কিছুদিন থাকবেন।

এসে দিন দুই লেগেছে তার সংসারের হালচাল বুঝতে, তারপর কার্যক্ষেত্রে নেমেছেন। সংসারে নিজের ভাই কুঞ্জর প্রতিপত্তিহীন অবস্থা ও সতাতো ভাই রামকালীর বোলবোলাও দাপটটা তার বুকে শেল বিধেছে, এবং রাসুর প্রথম পক্ষ’র নিলজ্জতায় গালে হাতে দিতে বাধ্য হয়েছেন তিনি।

অবাক হয়ে বলেছেন, হ্যাঁগা, ও বুড়োমাগী গায়ের জোরে বর আগলে বসে থাকবে, আর সোমত্ত যুবতী বৌটা শাশুড়ীর ঘরে শুয়ে ঘরের আড়া গুনবে? এ তোমরা চলতে দিচ্ছ? বলি ছেলেটার কথাও তো ভাবতে হবে? তার টাটকাটি রইল ধামাচাপা দেওয়া, আর শুকনো বাসিটায় মন সন্তোষ করে থাকার জুলুম? এতখানি বয়সে এমন কথা শুনি নি দেখি নি!

সারদার শাশুড়ি সুদীর্ঘকালের অদেখা ননদিনীটিকে পরম আত্মীয়ের অধিকার দিয়ে বিগলিত স্বরে বলেন, দেখ ঠাকুরঝি দেখ। যত থাকবে ততই বুঝবে। একে তো তোমার দাদার ওই মিনমিনে স্বভাবের জন্যে আমি চিরদিন বড় হয়েও ছোট, হাঁড়ি-হেঁসেল ছাড়া আর কিছু দেখলাম না। তার ওপর বৌটি হয়েছেন জাহাবাজ। এমনিতে দেখবে ওকে কারুর সাতে-পাঁচে নেই, কিন্তু অহঙ্কারে মটমট। কারুর মতে চলাতেও যাও দিকি? চলবে না। আর এমন রাশভারী প্রিকিতি, ডেকে একটা কথা বলতে সাহস হয় না।

তোমাদের হয় না, আমার হবে। শশীতারা দৃঢ় রায় দেন, এ নিঘিনেপনার বিহিত আমি করে ছাড়ব।

বিহিত করতে ভাজকে নিয়ে এজলাসে এসে আসামীকে তলব করলেন শশীতারা।

সারদা এল, ঘার হেট করে বসে ঘোমটার মধ্যে থেকেই মৃদু অথচ স্পষ্ট স্বরে বলল, কি বলছ?

শশীতারা নড়েচড়ে বসে হাতপাখা নাড়তে নাড়তে বললেন, বলছি একটা নেয্য কথা। মনে কিছু করো না। আক্কেল যাদের শরীরে নেই, তাদের আক্কেল করাতে হলে চোখে আঙ্গুল দেওয়া ভিন্ন তো গতিও নেই। তাই দেব। তাতে চোখে যদি তোমার জ্বালা ধরে, আমায় কিন্তু দুষো না বাছা!

সারদার কণ্ঠ থেকে একটু হাসির আওয়াজ পাওয়া গেল, তোমাদের দুষব? এত আসপদ্দা আমার পিসীমা?

আসপদ্দা! শশীতারা পাখার বেগটা বাড়িয়ে দিয়ে বলেন, না, আসপদ্দা তোমার দেখি না বটে, কিন্তু আক্কেলটুকুও তো তিলমাত্তর দেখি না বাছা! নতুন বৌমার দিকটা তো একেবারে ভাবছ না!

পরক্ষণে শশীতারা আর তার ভাজকে অবাক করে দিয়ে সারদার মৃদুকণ্ঠের স্পষ্ট স্বর ধ্বনিত হয়, আমি না ভাবলাম, তোমরা এতজনে তো ভাবছ!

এতজনে ভাবছি? আমরা এতজনে ভাবছি! তুমি যে অবাক করলে বড় বৌমা! আমরা ভেবে তার কী উবগারটা করতে পারব শুনি? তুমি এদিকে আত্মঘাতী হবার ভয় দেখিয়ে সোয়ামীকে শাসিয়ে রেখেছ, ভয়ে কাঁটা হয়ে আছে সে, আমরা কি করব? এই তো সিদিনকে রাত্তিরে ছোঁড়াটাকে হাত ধরে হিঁচড়ে এনে বললাম, রাসু, তুই ইদিকে আয়। ঘরের তো অভাব নেই বাড়িতে। এ ঘরে নবাবী পালঙ্ক না থাক, সোয়ামী পেলে নতুন বৌয়ের এখন আমতক্তাই রাজতক্তা। তা আনতে কি পারলাম? ভয়ে সিটিয়ে হাত ছাড়িয়ে পালিয়ে গেল। বলে কি, তাহলে তোমাদের বড়বৌ আপ্তঘাতী হবে! ….হ্যাঁ গা, বাপ তো তোমার শুনলাম ভালমানুষ, তোমার এ কী ছোটলোকমি।

শশীতারার কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘরের মধ্যে যেন একটা তীব্র বিদ্যুৎ ঝলসে ওঠে। বিদুৎটা আর কিছু নয়, সারদার চোখের আগুন। হঠাৎ মুখ তুলতে গিয়ে মাথার ঘোমটাটা খসে গিয়েছিল সারদার। ঘোমটাটা আবার একটু তুলে মুখ প্রায় অনাবৃত রেখেই সারদা বলে, দশচক্রে ভগবান ভূত হয় পিসীমা, তায় মানুষ তো কোন্ ছার! পাকেচক্রে ভদ্রলোকের মেয়ে ছোটলোক হয়ে উঠবে এতে আর আশ্চয্যি কি!

একে মুখ খোলা, তাতে এই বাকি!

সারদার শাশুড়ী বোধ করি নিজের মর্যাদা সম্পর্কে এবার সচেতন না হয়ে পারেন না। তাই নথপরা মুখ ঘুরিয়ে বলে ওঠেন, মুখের ঘোমটা খুলে শাশুড়ীর সঙ্গে ঝগড়া করছ তুমি বড় বৌমা! বুকের পাটা তোমার এত কিসের? জান, জন্মের শোধ বাপের বাড়ি বিদেয় করে দিতে পারি তোমায়?

এজলাসটা বোধ করি সারদার ধারণার জগতে ছিল, আর সওয়ালের জন্যে প্রস্তুতও ছিল সে। তাই তীক্ষ্ণ একটু হাসির সঙ্গে বললে, জন্মের শোধ যদি যেতেই হয় তো বাপের বাড়ি যাব কেন? যমের বাড়ি তো কেউ কেড়ে নেয় নি!

শশীতারা এবার চাকা নথ ঘুরিয়ে ঝঙ্কার দিয়ে ওঠেন, যমের বাড়ির ভয় দেখিয়ে আমাদের জব্দ করতে পারবে না বড় বৌমা, আমরা নাসু নই। বলি ওই যে একটা ঘরের মেয়ে এসেছে, যার বাপ ঘরবসতের দ্রবিতে বাড়ি ভরিয়ে দিয়েছে, তার দাবি-দাওয়াটা মানবে না তুমি? আর ওই রূপের কান্তি টাটকা পদ্মফুল, সোয়ামীকে তুমি এর ভোগ থেকে বঞ্চিত করছ, এতে যে তোমার নরকেও ঠাই হবে না!

হঠাৎ হেসে উঠে সারদা দিব্যি স্পষ্ট গলায় বলে, ভালই তো পিসীমা! নরকে ঠাই না হলে সগৃগে যাব! দুটো বৈ তো আর দশটা জায়গা নেই!

দুটো গিন্নীকে হতবাক করে দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে সারদা, তালের বড়া খেতে চেয়েছে ছোট ঠাকুরপো, তালগুলো মেড়ে রাখিগে।

অর্থাৎ তোমাদের কাঠগড়া থেকে ফসকে পালাচ্ছি এবার।

শশীতারা বোঝেন, যেমন ভেবেছিলেন, ঠিক তেমনটি। ধিক্কার দিয়ে বিচলিত করে কার্যসিদ্ধ করা যাবে না। অন্য চাল চালেন তিনি। বলেন, সভ্যতা-ভব্যতার পাঠশালায় দেখছি একেবারেই পড় নি তুমি বড় বৌমা। গুরুজনের সামনে থেকে অনুমতি না নিয়ে উঠতে আমি আমার শ্বশুরবাড়ির দিকের কোন ঝি-বৌকে কখনও দেখি নি। আমরা নিজেরাও–গুরুজন ডেকে একটা কথা শুধোলে ঘাড় নেড়ে, হ্যাঁ হু করে উত্তর দিয়েছি, উঠে যেতে না বললে ঘাড় গুঁজে বসে থেকেছি।

সারদাকে এতেও অপ্রতিভ করা যায় না, সে তেমনি মদু হাসির সঙ্গে বলে, বসবার অবকাশ থাকলে তো বসে থাকাও একটা সুখ পিসীমা!

হুঁ! কথার পিঠে কথা দেওয়াই তোমার লোগ দেখছি। হাবাগঙ্গা শাউড়ী পেয়েছ, তাই এমন দুরবস্থা হয়েছে। যাক বলি শোন, আপস-মীমাংসার কথাই কইছি। ঘরণী গিন্নী বেটার মা তুমি, অনেকদিন তো সোয়ামীকে ভোগ করলে! ওকে একেবারে ভাসিয়ে দিলে চলবে কেন? ওরও আগুন সাক্ষী বিয়ে। আমি বলি কি, একটা পালা ঠিক করো।

মনে মনে হাসেন শশীতারা, একবার যদি রাসুকে নতুনের নেশা ধরিয়ে দেওয়া যায়, তারপর দেখা যাবে তোমার কত আদর থাকে! দেখা যাবে কোথায় থাকে তোমার ঐ তেজ! ওই বৌয়ের আস্বাদ পেলে, তুমি গলায় দড়ি দিলে কি জলে ডুবলেও কিছু এসে যাবে না রাসুর!

‘পালা’র বুদ্ধিটা মাথায় আসার জন্যেই নিজেকে নিজে তারিফ করেন শশীতারা।

কিন্তু সারদা সে তারিফ বেশীক্ষণ বজায় থাকতে দেয় না। তীক্ষ্ণকণ্ঠে বলেন, তোমাদের অনুমতি না নিয়েই যাচ্ছি, পিসীমা। এসব নীচু কথা শুনতে মাথা কাটা যাচ্ছে।

আঁ আঁ? কী বললি? আমরা নীচু কথা কইছি? ছোটলোকের বেটি, হাঘরের মেয়ে। বলতে জিভ আড়িয়ে গেল না! শশীতারা ধেই ধেই করে নেচে ওঠেন, খুব উঁচু কথাটা তুমি কইছ বটে! একলা খাব, একলা পরব, একলা ভোগ করব, এই তো মহত্ত্বের কথা! পালা কথাটা নিচু কথা হল! বলি তাতে তো দুই দিকই রক্ষে হয়!

সারদার বোধ করি কী একটা কঠিন কথা মুখে আসে, কিন্তু সেটা কষ্টে দমন করে বলে, দুদিক রক্ষের দরকার নেই, একদিকই রক্ষে করো তোমরা।

এরপর আর দাঁড়ানো চলে না।

মান-সম্মান বজায় রাখা শক্ত হবে। সারদার নিজের চোখই তাকে অপদস্থ করে ছাড়বে।

.

দু-টো গিন্নীকে পাথর করে দিয়ে চলে যায় সারদা।

এই চরম অপবাদের মুহূর্তে ভুবনেশ্বরীকে মনে পড়ে তার। সারদার ভাগ্যটাই মন্দ, নইলে অমন একটা স্নেহের আশ্রয় হারায় সে? ভুবনেশ্বরীর কি এখন মরবার বয়স?

হ্যাঁ সারদা নির্লজ্জ, সারদা বেহায়া, সারদা স্বার্থপর। কিন্তু পরার্থপরতায় উদার হবার ভাগ্য সে পেল কবে? ভাগ্য যে তাকে বঞ্চনাই করেছে। আর সে বঞ্চনা এসেছে তার গুরুজনদের হাত থেকেই।

গুরুজনদের প্রতি শ্রদ্ধা সম্মান তার আসরে কোথা থেকে? বিষপাত্রের বিনিময়ে কে অমৃতপাত্রের উপহার নিতে হাত বাড়ায়?

শশীতারা গাল হাত দিয়ে অভয়াকে উদ্দেশ করে বলেন, মান্যে বড় গুরুজন তুমি বৌ, তোমার পায়ের ধুলো নেবারই কথা। তবু বলি, তোমার পায়ের ধুলোয় গড়াগড়ি দিতে ইচ্ছে করছে। এই কালকেউটে নিয়ে ঘর করছ তুমি?

কুঞ্জ-গৃহিণী কপালে হাত ঠেকিয়ে বলেন, অদেষ্ট ঠাকুরঝি!

আসল কথা অদেষ্ট’টা তাঁর নিজের কাছে ধরা পড়েছে এই সম্প্রতি। ননদিনীর দিব্যদৃষ্টির প্রভাবে। এবং এযাবৎ বোকামি করে এসেছেন, সুদে-আসলে সেটা উসুল করে নিতে ইচ্ছে হচ্ছে তাঁর।

ওই কালনাগিনীর দিক থেকে রাসুর মন একেবারে ঘুরিয়ে দিতে পারি, এমন ‘ওষুধ’ আমার জানা আছে বৌ শশীতারা চাপা হিংস্র স্বরে বলেন, অব্যর্থ তুক। রাসু তোমার ছটফটিয়ে নতুন বৌর পায়ে পড়বে, বড়বৌকে জন্মের বিষ দেখবে!

ভাজ অবাক হয়ে বলেন, সত্যি ঠাকুরঝি, তেমন ওষুধ তোমার জানা আছে?

শশীতারার মুখে একটি বিচিত্র হাসি ফুটে উঠে, জানা না থাকলে আর তোমার ননদাইকে অমন কেন গোলাম করে রেখেছি? বয়সকালে কি কম দুর্দান্ত ছিল নাকি? সম্পর্ক অসম্পর্ক মানত না, রূপসী মেয়েমানুষ দেখলেই উন্মাদ হয়ে উঠত। এক বাণীবুড়ী শেখাল আমায় সেই তুক, তার পর থেকে এমন নেলাখেপা হয়ে গেল যে, আমি বৈ আর কিছু জানে না। আমি উঠতে বললে ওঠে, বসতে বললে বসে, খেতে বললে খায়, ঘুমুতে বললে ঘুমোয়। আমার মুখের দিকে ফ্যালফেলিয়ে তাকিয়ে থাকে। আমি বলি থাক, ওই আমার ভাল, নাই বা রোজগার করল, নাই বা হট্টগোল করে বেড়াল, ভাতের তো অভাব নেই ঘরে। আমার আঁচলটিতে তো বাবা রইল জন্মের শোধ!

রাসুর মা ইতস্তত করে বলেন, কোন শেকড়বাকড় নাকি? রাসুর কোন ক্ষতি হবে না তো?

শোন কথা! সে কাজ আমি করব? এ আর কিছুটি নয়, শুধু একজনের থেকে মন ঘুরে আর একজনের ওপর পড়া। তাহলে বলি শোন, তোমার কপালক্রমে এই পরশুই আমাসে আসছে– একেবারে দুপুররাতে নতুন বৌমা যদি এলোচুলে বিবস্ত্র হয়ে একটা কলাগাছের গোড়ায় এক ঠোকায় একটি ছুঁচ বিধে দিয়ে আসতে পারে, তাহলে

কথা শেষ হয় না শশীতারার, সারদার ছেলে দৌড়ে এসে বলে, তোমরা শীগগির চলে এস, মেজঠাকুদ্দা অজ্ঞান হয়ে গেছে।

মেজঠাকুদ্দা! মানে রামকালী! যিনি জ্ঞানের পারাবার! রামকালী অজ্ঞান হয়ে গেছেন, এ কী অদ্ভুত ভাষা?

সকলেই দৌড়ায়। তবে কি রামকালীও ভুবনেশ্বরীর মত বিনা নোটিশে

ব্যাপারটা এত জানাজানি হল, ভিতরবাড়িতে পড়ে গিয়ে। বারবাড়িতে পড়লে অন্তত মেয়েমহলের দল এভাবে ধারেকাছে গিয়ে হা-হুতাশ করতে পারত না।

যাদের স্পর্শের অধিকার আছে তারা মুখে মাথায় জল ঢেলে গঙ্গা বইয়ে দিল, বাড়িতে যত হাতপাখা এনে জড় করল। এ শুধু দুর্ভাবনাই নয়, এক প্রকার রোমাঞ্চও। যে মানুষটার মুখের দিকে কেউ কোনদিন স্পষ্ট করে তাকিয়ে দেখবার সাহস পায় নি, সে মানুষটা অসহায়ভাবে চোখ মুদে পড়ে আছে, তাকিয়ে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে কেমন তার নাকমুখ, করুণা করা যাচ্ছে তাকে জল দিয়ে বাতাস দিয়ে, এটা প্রায় সুখের পর্যায়েই পড়ে।

সারদাও একখানা হাতপাখা নিয়ে এসেছিল, আর দূর থেকে বাতাস করছিল এবং ভাবছি, আশ্চর্য এতদিন ঘর করছি মানুষটা কেমন দেখতে তা তো কোনদিন দেখি নি! একেই কি বলে “তপ্ত কাঞ্চন-বৰ্ণাভাং_”

ভয়ঙ্কর একটা আবেগের আলোড়নে চোখে ছলাৎ করে জল এসে যায় সারদার, এ হেন স্বামীকে ফেলে চলে যেতে হয়েছে মেজখুড়িকে? আর তাই বুঝি স্বর্গেও তিষ্ঠোতে পারছেন না, আকর্ষণ করে টেনে নিয়ে যেতে চাইছেন নিজের কাছে? মনের মত স্বামী এমনি জিনিস! তার পর চোখ মুছে ভাবল, মেজখুড়ো আমাদের মায়া কাটিয়ে চললেন!

কিন্তু আপাতত দেখা গেল সারদার আশঙ্কা অমূলক। চিরশান্ত চিরসুকুমার ক্ষীণশক্তি ভুবনেশ্বরীর আকর্ষণ মাধ্যাকর্ষণের চেয়ে জোরালো হল না।

রামকালী চোখ মেললেন।

চারদিকে এতগুলো মুখ দেখে ভুরুটা ঈষৎ কুঁচকে গেল, আবার চোখ বুঝলেন। আর অনেকক্ষণ পরে বললেন, আমাকে বাইরে চণ্ডীমণ্ডপে বিছানা করে দাও।

.

হ্যাঁ, বাইরেই শুলেন রামকালী। মেয়েদের এই হা-হুতাশ তাঁর অসহ্য, নিজের কাছে নিজে ভয়ানক লজ্জিত হচ্ছেন। রামকালীর পক্ষে এ হেন দুর্বলতা ক্ষমার অযোগ্য। রামকালী জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেছেন। পাঁচজনে মুখে-মাথায় জল দিল, হা-হুতাশ করল, এর চাইতে ঘৃণ্য ব্যাপার আর কি আছে!

এ রকমটা হল কেন?

অনেকদিন থেকেই যেন ভিতরে ভিতরে একটা ক্ষয় চলছে, যেন একটা ভাঙনের পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছেন। শরীর খারাপ হয়ে গেছে। সেই থেকেই গেছে।

রামকালীর মধ্যেও একটা আবেগের আলোড়ন উঠল। সেই ছোটখাটো মানুষটা, যাকে রামকালী কোনদিনই পুরো একটা মানুষ বলে গণ্য করেন নি, সে যে দৃঢ়কঠিন রামকালীর ভিতরের এতটা শক্তি হরণ করে ফেলবে এ রামকালীর ধারণার মধ্যেই ছিল না।

ভুবনেশ্বরী সম্পর্কে যে তাঁর একটা বাৎসল্যমিশ্রিত প্রীতি ছিল, জীবনের কোন আদর্শে, কোন চিন্তায়, কোন সুখদুঃখে তাকে ডাক দেন নি। আজ মনে হচ্ছে সম্পূর্ণ বিচার করেন নি রামকালী স্ত্রীর উপর। চিরদিন যাকে ছোট ভেবে এসেছেন, সে হয়তো এমন ছোট ছিল না, যাকে সামান্য ভেবেছেন, সে হয়তো সামান্য নয়। রামকালী যদি তাকে স্নেহের সঙ্গে কিছু শ্রদ্ধাও দিয়ে হৃদয়ের সহধর্মিণী করে তুলতে পারতেন, হয়তো সারাটা জীবন এতখানি নিঃসঙ্গ হয়ে থাকতেন না।

মৃত্যুর মহিমায় ভুবনেশ্বরী যেন বড় হয়ে উঠেছে।

বিছানায় শুয়ে শুয়েই সংকল্প করলেন রামকালী, শীঘ্রই তীর্থযাত্রা করবেন। বায়ু-পরিবর্তনের প্রয়োজন হয়েছে।

বায়ু পরিবর্তন ভিন্ন ভাঙন ধরা স্বাস্থের ক্ষয়পূরণ সম্ভব নয়।

তীর্থযাত্রার সংকল্প ঘোষণা করলেন রামকালী।

.

দু-তিনটে দিন রামকালী সম্পর্কে উদ্বেগ নিয়েই দিন গেছে সকলের, রাসু বারবাড়িতে চণ্ডীমণ্ডপেই রাত কাটিয়েছে, কাকার নিষেধ সত্ত্বেও, চুপি চুপি–তার অলক্ষ্যে।

আজ আবার স্বাভাবিকত্ব এল সংসারে। যদিও রামকালীর তীর্থযাত্রার সংকল্পে ভয় ভাবনা আতঙ্ক দেখা দিল, তবু সেটা তো আজই নয়। তীর্থযাত্রার অনেক তোড়জোর।

রাসুকে আজ শশীতারা আবার ডেকে পাঠালেন। বললেন, দেখ, পুরুষের চামড়া যদি গায়ে থাকে তো বৌয়ের নাকে-কান্নায় ভিজিস নে। আপ্তঘাতী অমনি হলেই হল! আজ তুই ইদিককার ঘরে শুবি।

তিন-তিনটে রাত বাইরের ঘরে কাটিয়ে রাসুরও মন চঞ্চল, এ প্রস্তাবে আরও চঞ্চল হয়ে ওঠে। অথচ তার সায় দেবার উপায় নেই। এ যেন পেটে খিদে, সামনে সুখাদ্য অথচ মুখ বাধা!

তাছাড়া রাসু সারদা নয় যে এসব কথার পিঠে কথা কইবে। লজ্জায় ঘাড় হেঁট করে থাকে সে। শশীতারা বোঝেন মৌনং সম্মতি লক্ষণম্। হৃষ্টচিত্তে বলেন, তোকে কিছু ভাবতে হবে না, তুই শুধু খাওয়ার পর আমার ঘরে এসে বসবি। পিসি-ভাইপোয় গল্প করবার ছুতোয় রাতটা একটু ঘোর করে দেব, তার পর–আহা নতুন বৌটার মনের দিকে একটু তাকাবি না তুই? ভাববি না তার কথা?

রাসুর চোখে জল এসে পড়ে, সে তাড়াতাড়ি সরে যায়। নতুন বৌয়ের কথা ভাবছে না সে? অহরহই তো ভাবছে!

কিন্তু যাকে নিয়ে এত দুর্ভাবনা শশীতারার, সে কোথায়? পাটমহলের লক্ষ্মীকান্ত বাড়ূয্যের নাতনী পটলী?

সে যেন একটা অদ্ভুত ভয়ে কাঠ হয়ে আছে। এতদিনে অবশ্য সে চিনে ফেলেছে কে তার সতীন। সতীনকে যে এতটাই ভীতিকর মনে হয় তা বুঝি ধারণা ছিল না তার। সারদার মুখের দিকে কোনদিন ভাল করে তাকাতে পারে না সে, কথা বলা তো দূরের কথা।

অথচ সারদা হরদমই তার সঙ্গে কথা বলে। সংসারের সবাইকে খেতে দেওয়ার ভার যে সারদারই হাতে-অগত্যাই পটলীকে তার হাতে পড়তে হয়েছে। তার শাশুড়ী দু-চারদিন নিজের এক্তারে রাখবার চেষ্টা করে অক্ষমতাবশতই হাল ছেড়ে দিয়েছেন।

সারদা ফি-হাত ডাকে, নতুনবৌ, খাবে এসো।…নতুনবৌ, এখন মুড়ি খাবে? নতুনবৌ, তুমি মাছের পেটি ভালবাস না দাগা? নতুনবৌ, তুমি হ্যাঁচা আমের আচার খাও না? নতুনবৌ, আচারের তেল দিয়ে কৎবেল মেখে খেয়েছ কোনদিন? খাবে তো বল মাখি?

নতুনবৌ যে কার নতুন বৌ সে কথা যেন জানে না সারদা। কুটুম্বের মেয়ে এসেছে, তাকে আদরযত্ন করছে ভারপ্রাপ্ত কর্মচারী।

আজও ফুলুরি আর তিলপিটুলি বেগুনভাজা করে এক বাটি হাতে নিয়ে ডাকতে এসেছিল সারদা নতুনবৌকে, খাবে গরম গরম?

পটলী মাথা নেড়ে বলল, না।

সারদা একটু আশ্চর্য হল। কারণ নতুনবৌ কোনদিন কিছুতেই না করে না। করে না বলে মনে মনে বরং একটু কৌতুকই অনুভব করে সারদা। ভাবে, ভাল করে খাইয়ে-দাইয়ে ঠাণ্ডা করে রাখা যাবে ওকে।

পটলী যে ভয়েই না করতে পারে না, সেটা বোঝে না সারদা। হয়তো বোঝার কথাও নয়। আজ না শুনে বলে, কেন গো, খাবে না কেন, খিদে নেই?

পটলী মাথা আরও নিচু করে মাথাটা আর একবার নাড়ে।

সারদা একটু চুপ করে থেকে মুচকি হেসে বলে, কেন বল তো নতুনবৌ? তোমার তো কখনও অগ্নিমান্দ্য দেখি নে!

এরপর নতুনবৌয়ের দিক থেকে কোনও সাড়া আসে না, শুধু তার ঘাড়টা আরও নুয়ে পড়ে। সারদা চলে যেতে উদ্যত হয়ে বলে, তবে নয় দুটো তিলের নাড়ু পাঠিয়ে দিই গে, খেয়ে জল খাও।

এবার হঠাৎ নতুনবৌ বলে ওঠে, তুমি আমায় এত যত্ন করো কেন?

সারদা বোধ করি এ প্রশ্নের জন্য আদৌ প্রস্তুত ছিল না, তাই হঠাৎ একটু থতমত খেয়ে যায়, তবে সে মুহূর্তের জন্য। পরক্ষণেই তীক্ষ্ণ একটু হেসে বলে, করব না কেন, যত্ন করবারই তো সম্পর্ক গো!

এতক্ষণ ঘাড় নিচু ছিল, এবার বোধ করি অজ্ঞাতসারেই মুখটা তুলে ফেলে পটলী, আর দীর্ঘ পল্লবচ্ছন্ন দুটি চোখের কোল বেয়ে দুফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে তার। সে চোখের দৃষ্টিতে ফুটে ওঠে একটা অসহায় ভর্ৎসনা। সে দৃষ্টি সারদার উপর নিবদ্ধ রেখেই বলে, তামাশা করছ?

মুখরা সারদা সহসা যেন মূক হয়ে যায়। ওই দুফোঁটা চোখের জলের দিকে তাকাতে পারে না, আর ভগবান জানেন কোন এক অদ্ভূত হৃদয়-রহস্যে সারদার নিজের চোখ দুটোও জলে ভরে ওঠে।

তবু নিজেকে সামলে নিয়ে সে বলে, করলামই বা একটু তামাশা! করতে নেই?

পুটলীর বোধ করি এক্ষণে খেয়াল হয় যে, তা চোখ দুটো শুধু দু’ফোঁটা জল ফেলেই ক্ষান্ত হয়নি। তাই সে দুটোকে নামিয়ে ফেলে এবার। আর কষ্টে গলার স্বর পরিষ্কার করে বলে, আমি তো তোমার শত্তুর, আমাকে বিদেয় করে দাও না? তুমি বাঁচ, আমিও বাঁচি।

সারদা ঈষৎ বিষণ্ণ কৌতুকে বলে, আমি না হয় বাঁচব, তোর বাঁচবার হেতু?

তোমার বুকের পাথর হয়ে আর সংসারসুদ্ধ সকলের দয়ার পাত্র হয়ে থাকতে হয় না, সেই বাচান?

সারদা আর একবার মূক হয়। দেখে নতুনবৌয়ের হেঁটমুণ্ডের অন্তরাল থেকে জল ঝরে ঝরে তার কোলের উপর জড়ো হয়ে থাকা ফর্সা ফর্সা ফুলো ফুলো দুখানি করপল্লবের ওপর পড়েই চলেছে।

স্তব্ধ হয়ে অনেকক্ষণ সেই দিকে তাকিয়ে থাকে সারদা, তার পর সহসাই আত্মস্থ হয়ে শান্ত দৃঢ়কণ্ঠে বলে, চোখ মোছ, নতুনবৌ, আর কাঁদতে হবে না।

তোমার পায়ে ধরি দিদি, আমায় পাঠমহলে পাঠিয়ে দাও।

শোন কথা, আমি কি পাঠিয়ে দেবার কর্তা? সারদা হেসে ওঠে, বলে আমার ওপরই হুকুমজারি হয়েছে–জন্মের শোধ বিদেয়! সে যাক, বলি এত রূপযৌবন নিয়ে কেঁদে মরবি আর হেরে পালাবি কি লো? লড়াই করে সতীনের কাছ থেকে বর কেড়ে নিবে নে?

লড়াই-টড়াই আমি কিছু চাই না দিদি।

লড়াই চাস না! কি মুশকিল, তবে তো খয়রাত করতে হয়! সারদা তেমনি বিষণ্ণ কৌতুকে বলে, তুই দেখছি আমার সব মজা মাটি করে দিলি। লড়াই করতে বসলে জোরের পরীক্ষে হয়, দান-খয়রাত করতে গেলে যে বেবাক সবটাই তুলে দেওয়া ছাড়া গতি থাকে না।

ব্যাকুল আবেগে উচ্চারণ করে নতুনবৌ।

আমার কিছু চাই না দিদি।

সারদা হাসে, কিছু চাস না? বরও চাস না?

না।

সারদা বলে, কিন্তু জগতের কি নিয়ম জানিস, না চাইলে সব জিনিস মেলে চাইতে বসলেই হাতছাড়া! ইস, কথা কইতে কইতে এমন খাসা তিলপিটুলি বেগুনভাজাগুলো নেতিয়ে গেল। খা, খেয়ে ফেল, মন ভাল হবে।

.

মেজঠাকুদ্দা!

রামকালী একখানা সরু খাতার উপর ঝুঁকে পড়ে আসন্ন তীর্থযাত্রার হিসেবের খসড়া করছিলেন, হঠাৎ রাসুর ছোট ছেলের এই ডাকে চমকে স্নেহকোমল স্বরে বললেন, কি দাদা?

মা বলছে, মা তোমার কাছে ভিক্ষে চাইবে।

এ আবার কী অভূতপূর্ব কথা!

রামকালী বিমূঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখেন।

দরজার ওপাশে রাসুর বৌয়ের উপস্থিতি টের পান। প্রায় বিচলিত স্বরে বলেন, কি বলছ দাদা, বুঝতে পারলাম না তো!

এবার মাধ্যমের গুরুত্ব হারায়। মাধ্যমকে মাধ্যম মাত্র করে সারদা মৃদু কণ্ঠে বলে, খোকন বল, মা বলছে কখনো কিছু চায় নি মা, বাড়ির বড়বৌ, একটা ভিক্ষে চাইছে।

রামকালী ধারণা করেন, এ আর কিছু নয়, রাসুর দ্বিতীয় পক্ষ ঘটিত নাটক। নির্ঘাত সপত্নী অসহিষ্ণু এই মেয়েটি সতীনকে তার পিত্রালয়ে পাঠানোর প্রস্তাব করতে এসেছে। বিরূপ চিত্তে গম্ভীর হাস্যে বলেন, ভিক্ষেটা কি, সেটা না জানলে তো সাদা কাগজে দস্তখত করা যায় না বড় বৌমা! দেবার ক্ষমতা যদি আমার না থাকে!

খোকা বল, আপনি ইচ্ছে করলেই হয়।

রামকালী যদিও রাসুর বৌয়ের এই অসমসাহসিকতায় স্তম্ভিত হন, তবু ঈষৎ চমৎকৃতও হন। হঠাৎ একটা অতি অসমসাহসী মেয়ের কথা মনে পড়ে গিয়ে মনটা শিথিল হয়ে যায়! বলেন, মাকে বল দাদাভাই, ইচ্ছে করবার মত হলে অবশ্যই করব।

খোকা বল, আপনি তীর্থে যাচ্ছেন আমার মাকে সঙ্গে নিন।

এ আবার কি কথা!

এ যে রামকালীর ধারণার অগোচর, স্বপ্নের অগোচর। এই কথা বলতে এসেছে রাসুর বৌ! মেয়েটা পাগল নাকি! তবে নাকি নিতান্তই হাস্যকর অলীক কথা, তাই ঈষৎ কৌতুকের সুরে বলেন, তোমার মাকে নিয়ে যাই এত সাধ্যি কি আমার আছে দাদাভাই? তুমি বড় হও, মাকে নিয়ে যাবে।

মেজঠাকুদ্দা, মা বলছে তামাশা করে উড়িয়ে দিলে হবে না, মা সত্যি ভিক্ষে চাইতে এসেছে।

রামকালী আর মাধ্যমকে গ্রাহ্য করেন না, বলেন, বড় বৌমা, তোমার প্রার্থনাটা যে বড় অসম্ভব। আমি পুরুষমানুষ, কোথায় উঠব, কোথায় থাকব, কিভাবে ঘুরব

মেজঠাকুদ্দা, মা বলছে, মা কষ্ট করতে হারবে না। তোমার রান্না করা, বাসন মাজা–এর জন্যেও তো একটা লোক চাই। মা সব করে দেবে।

দাদাভাই, তোমার মা ছেলেমানুষ, সবটা বুঝতে পারছেন না। সম্ভব হলে আমাকে দুবার বলতে হত না। তোমার মাকে বল, বাড়ির বড়বৌ বলে আমার কাছে একটা আবদার করলেন, রাখতে পারছি না, এটা আমারও কষ্ট। আমি তার বদলে তার নামে খাসে কুড়ি বিঘে ধানজমি লেখাপড়া করে দেব। তার আদায় থেকে উনি যা খুশি করতে পারবেন। আর তুমি যখন বড় হবে—

.

খোকা বল বাবা, বিষয়-সম্পত্তিতে মার কোন দরকার নেই।

খাসে কুড়ি বিঘে ধানজমি!

এতেও একটু প্রলোভিত হল না মেয়েটা? আশ্চর্য তো! সত্যি বলতে কি, এ সংকল্প রামকালীর সহসা আজকের নয়। কিছুদিন থেকেই ভাবছিলেন তিনি, এই ধরনের একটা কিছু করবেন। ওই মেয়েটাকে তিনি যতই সাধারণ হিংসুটে মেয়েছেলে ভেবে আসুন, ওর সম্পর্কে কোথায় যেন একটু অপরাধবোধ তাকে হৃদয়ের গভীর স্তরে পীড়িত করত। তাই ভাবতেন ক্ষতি পূরণার্থে

কিন্তু মেয়েটা বলে কি? বিষয়-সম্পত্তিতে তার দরকার নেই?

একটু চুপ করে থেকে বলেন, তবে আর কি করব বল দাদাভাই! যাতে লোকে নিন্দে করতে পারে, এমন কাজ কি করে করা যায়!

মেজঠাকুরদ্দা, তুমি তো লোকনিন্দেকে ডরাও না?

লোকনিদেকে ডরাই না!

রামকালী যেন হঠাৎ অদ্ভুত অজানা একটা রহস্যের রাজ্যের সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন। এরা সব রামকালীকে ভাবে কি? রামকালী সম্পর্কে রামকালীর অপরিচিত যে একটা জগৎ আছে, তাদের ধারণাটা কি? একটা কৌতুকের বিস্ময়ে স্বল্পবাক রামকালী আজ একটু বেশী কথাই বলে ফেলেন।

লোকনিন্দকে ডরাই না একথা কে বলে দাদু? ডরাই বৈকি। সত্যি নিন্দের কাজ করলে– রামকালীও কথা সমাপ্ত করতে করতে ভাবেন–শেষ করতে গিয়ে থামেন। এই অবসরে এতক্ষণের নম্র আর মৃদু চাপা কণ্ঠস্বরটা প্রায় স্পষ্ট হয়ে ওঠে, খোকা বল, আপনার যদি একটা দুঃখিনী মেয়ে থাকত, তাকে তীর্থে নিয়ে গেলে লোকে নিন্দে করত?

রামকালী স্তব্ধ হয়ে যান!

অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলেন, আচ্ছা দাদু, তোমরা ভেতরে যাও। আমাকে একটু ভাবতে দাও।

হ্যাঁ, ভাববেন রামকালী। অনেক কিছু ভাববেন। এইটুকু মেয়েটা কুড়ি বিঘে ধান জমির মোহ ত্যাগ করে তীর্থে যেতে চায় কোন্ মানসিক অবস্থায় তা ভাববেন, আর ভাববেন মোক্ষদাকে সঙ্গে নিয়ে রাসুর বৌয়ের প্রার্থনাটা পূরণ করা যায় কিনা! মোক্ষদার হাত ভেঙেছে, পা-টা-তে মজবুত আছে। তার জীবনেও তো কখনো কিছু হয়নি। এ কর্তব্যটা করা উচিত ছিল রামকালীর।

রান্না-ভাঁড়ার ঘরের জীবগুলো সম্পর্কে এত বেশি করে কখনও ভাবেন নি রামকালী।

একটা মেয়ে তাকে মাঝে মাঝেই ভাবাত। অনেক দিন সে রামকালীর কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে। আশ্চর্য হয়ে ভাবছেন রামকালী, কতদিন তার কথা ভাবি নি!

সে পাছে ভাবে বলে রামকালীর অসুখের খবর দেওয়া হয় নি। কিন্তু তীর্থযাত্রার খবর! সেটাও কি না দিলে চলবে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *