২৬. নবকুমার চলে গিয়ে পর্যন্ত

নবকুমার চলে গিয়ে পর্যন্ত এই কটা দিন আরো টো-টো করে বেড়াচ্ছিল সত্য, বাঁধা গরু ছাড়া পাওয়ার ধরনে, নবকুমারের উপস্থিতিতে সামান্য যেটুকু সাবধান হতে হচ্ছিল তাও ঘুচেছিল, হঠাৎ শ্যেনদৃষ্টি মোক্ষদার মোক্ষম আবিষ্কারের ফলে স্বাধীনতা সাংঘাতিক রকম খর্ব হয়ে গেল তার।

বিদ্রোহ করা চলছে না, উঠতে বসতে উপদেশের ঠেলা। দরজায় বসিস নি, দুজনের মাঝখান দিয়ে যাস নি, সাঁঝ-সন্ধ্যে হয়ে গেলে উঠোনে নামিস নি, শনি-মঙ্গলবারে পথে বেরোস নি পুকুরে একা যাস নি, নিষেধের বৃন্দাবন একেবারে। তাছাড়া আছে “বিধি”।

পায়ের আঙুলে রুপোর আঙটি পরে থাকো, চলের আগায় আর শাড়ীর আচলে সর্বদা গিঠ বেঁধে রাখো, শত্রুপক্ষ জাতীয় কোনো মহিলাকে দেখলেই সরে বসো এবং নজর-খরা কোন মহিলার নজরে পড়ে গেছ সন্দেহ হলেই দেহের কোনোখানে লোহা পুড়িয়ে ছ্যাকা দাও, রাত্রে খোপা খড়কে রাখো, এইসব অনুশাসনের শাসনে চলতে হচ্ছে সত্যকে।

সত্যকে যেন বেঁধে মারছে এরা।

তবু সত্য যখন-তখনই ভয়ানক অঘটন ঘটিয়ে বসছে।

যেমন অন্যমনস্কতায় পান-ধোওয়া জল মাড়িয়ে গেল, মাছ-ধোওয়া জল ডিঙিয়ে গেল, হেঁচতলায় নিজের শাড়িখানা মেলে দিয়ে বসল, এই সব সর্বনেশে কাণ্ড!

ভুবনেশ্বরী কেবল বলে, অ সত্য, কখন কি করে বসবি, আয় না আমার কাছে, একটু বোস না!

এক-আধবার বসে সত্য।

হয়তো ভিতরের কোন ক্লান্তিতেই। কিন্তু বেশীক্ষণ মায়ের কাছে কাছে থাকতে তার লজ্জা করে। তাছাড়া চিরচঞ্চল চিত্ত তার দীর্ঘকাল শ্বশুরঘর করেছে অচঞ্চল ভুমিকা নিয়ে, আর সে সহজ ক্লান্তির কাছে হার মানতে রাজী হয় না, হয় না মমতার কাছে বশ্যতা স্বীকার করতে।

অতএব একদিন রামকালীর কাছে নালিশ পৌঁছায়। বলা হল, তুমি শাসন করো।

কিন্তু রামকালী কি করলেন শাসন?

নাকি চিকিৎসক-জনোচিত নিষেধের বাণী বর্ষণ করলেন?

না, সে সব কিছুই করলেন না রামকালী। কেন কে জানে ভিতরে ভিতরে একটা পীড়া বোধ করছেন তিনি। কেমন যেন একটা বিমুখতা। যেন শেষ সম্বলটুকুও হারিয়েছেন, তাই মনের মধ্যে নির্লিপ্ত শূন্যতা।

রামকালী শুধু একদিন মেয়েকে ডেকে বললেন, গুরুজনরা যা বলছেন, মন দিয়ে শুনবে। ওঁরা বোঝেন, ওঁদের কথা মেনে না চললে ক্ষতি হতে পারে।

অভিমানে সত্য তিন দিন শুয়ে রইল।

ভুবনেশ্বরী অনুযোগ করলে বলল, এই তো চাও তোমরা। বেশ তো, যা চাও তাই হচ্ছে।

সত্যিই হঠাৎ চুপচাপ হয়ে গেল সত্য।

.

কিন্তু ক্ষতিকে কি রোধ করা গেল?

না, রামকালী এখন গ্রহের কোপে পড়েছেন।

রামকালী মহাগুরু নিপাতের বিপাক মুক্ত হতে পারছেন না।

তাই রামকালীর প্রথম দৌহিত্র সন্তান পৃথিবীর আলোয় উদ্ভাসিত না হতেই অন্ধকারের রাজ্যে হারিয়ে গেল।

তা ছাড়া আর কি কারণ?

সত্য তো সব কিছু বিধিনিষেধ মেনে চলছিল ইদানীং।

মোক্ষদা অবশ্য বললেন, এ সেই গোড়ার কালে ধিঙ্গীপনা করার ফল। কিন্তু চিকিৎসক রামকালী তা বলেন না। রামকালীর হঠাৎ মনে হয়, এ বোধ করি তার নিজেরই অবহেলার ফল। পিতা হিসাবে না হোক, চিকিৎসক হিসেবে তার আর একটু কর্তব্য ছিল।

তবু এটাও তো সত্যি, এ পরিবারভুক্ত আত্মীয় আশ্রিত মিলিয়ে যে গোষ্ঠীটি সে গোষ্ঠীতে বছরে গড়ে অন্তত পাঁচ-সাতটা শিশুর জন্ম হচ্ছে নিতান্ত সহজে, প্রায় কর্তা-পুরুষের অজ্ঞাতসারেই।

না, অত্যুক্তি নয়। ওই ছেলেমেয়েগুলো একটু বড় হয়ে যখন অন্যের ট্যাঁকে চড়ে বহির্জগতে বেরোয়, তখন ওঁরা কৌতূহলী হয়ে প্রশ্ন করেন, কার এটা?

অতএব অপরাধটা কোথায় রামকালীর?

এই কটা দিন আগে তেল-সন্দেশ সহকারে খবর পাঠানো হয়েছিল সত্যর শ্বশুরবাড়িতে এবং এলোকেশী হেন মানুষও খবরদাত্রীকে একখানি নতুন কাপড়দানে পুরস্কৃত করেছিলেন, বৌকে বাপের ঘরে রাখার অনুমতিও দিয়েছিলেন দীর্ঘকালের জন্যে। আবার এখন এই বার্তা পাঠাতে হবে।

ঘটা করে সাধ দিচ্ছিলেন বৌয়ের বড়লোক বাপ, তা নয়, মূলে হাবাৎ! হয়েছিল অবিশ্যি মেয়েসন্তান, তবু প্রথম সন্তান তো! সত্য তো ভাঙ্গা হয়ে গেল। আরতো সত্য অখণ্ড পোয়াতি রইল না। কোনো শুভকর্মে নিয়ম লক্ষণের কাজে আগ বাড়িয়ে আসতে তো পারবে না সত্য।

কড়া হুকুম দিলেন এলোকেশী, শরীর-স্বাস্থ্য একটু ভাল হলেই যেন মেয়েকে পালকি চড়িয়ে পাঠিয়ে দেন বেহাই। আহ্লাদে মেয়ে বাপের বাড়ি গিয়ে আহ্লাদেপনা করেই যে এইটি ঘটিয়েছেন, তাতে আর সন্দেহ কি!

ঐ বচন হজম করতে হল রামকালীকে।

এ নির্দেশ মানতেই হল।

আবার রাসুকে যেতে হল সত্যর শ্বশুরবাড়ি, কেঁদে কেঁদে চোখ-ফোলানো ম্রিয়মাণ সত্যকে নিয়ে।

কিন্তু রামকালীর গ্রহের কোপ কি কাটল?

মহাগুরু নিপাতের বছর পূর্ণ হয়েও তো আরো একটা বছর কেটে গেল, তবু রামকালীর সংসারে অঘটন ঘটতেই লাগল কেন? কোনোখানো কিছু নেই, নেড়ু নামক নিরীহ ছেলেটা হঠাৎ একদিন হারিয়ে গেল, যেমন করে একদিন রামকালী হারিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু নেড়ু তো খড়মপেটা খায় নি।

অনেক খোঁজাখুঁজি করলেন রামকালী, কুঞ্জ অনেক কাঁদলেন মেয়েমানুষের মত, নেড়ুর বার্তা পাওয়া গেল না। এর ক’মাস পরেই কাশীশ্বরী মারা গেলেন, আরো ক’মাস পরে শিবজায়ার বড় মেয়ে বিধবা হয়ে বাপের বাড়িতে এসে আশ্রয় নিল একপাল ছেলেমেয়ে নিয়ে।

এ সমস্তই যে রামকালীর গ্রহবৈগুণ্য, একথা কেহ না বলবে?

এর সব ‘হ্যাঁপা’ই তো রামকালীকে নিতে হচ্ছে।

আর মজা এই, শত অসুবিধের মধ্যেও রামকালী কাউকে বলেন না, সুবিধে হবে না। শত ঝঞ্ঝাটেও বলে ফেলেন না, আর পারা যাচ্ছে না!

বিধবা হয়ে বাপের বাড়ি আসা খুড়তুতো বোনের বিয়ের যুগ্যি মেয়ে দুটোর জন্যেও তোড়জোর করে পাত্র খুঁজতে ঘটক ঠিক করে স্যাকরা ডেকে পাঠালেন। পাত্র খোঁজা হোক, গহনাপত্রও প্রস্তুত হোক। বোনের ছেলে চারটের কথাও ভুলে থাকলেন না, যথাযথ হিসেবে তাদের কাউকে টোলে, কাউকে পাঠশালা ভর্তি করে দিলেন।

কর্তব্যের ত্রুটি করছেন না রামকালী, করছেন না কোনো অনাচার, তথাপি বারেবারেই ভাগ্যের মার পড়ছে তার উপর।

কিন্তু ওস্তাদের মার নাকি শেষরাত্রে, আর ভাগ্য নামক ব্যক্তিটির মত এমন ওস্তাদ আর কে আছে?

তাই–

রাত্রিশেষের ছায়াছন্ন আলো-আঁধারি মুহূর্তে সে তার প্রধান মারের খেলা দেখিয়ে গেল।

ঘণ্টা কয়েকের ভেদবমিতে ভুবনেশ্বরী মারা গেল!

রামকালী কবারেজের ডেকে কথা কওয়া ওষুধের সমস্ত মাহাত্ম্য কি ব্যর্থ হল? হয়তো ব্যর্থই হল, নিয়তিকে কে পারে ঠেকাতে? কে পারে অপ্রতিরোধ্যকে রোধ করতে? তবু চেষ্টা করবার সম.টাও যে পেলেন না রামকালী। হয়তো সময়টা পেলে আক্ষেপটা কম হত। কিন্তু লাজুক ভুবনেশ্বরী, নির্বোধ ভুবনেশ্বরী সে চেষ্টাটুকুর অবকাশ দেয় নি। সে মাঝরাত্রে বিছানা থেকে উঠে সেই যে ঘাটের ধারে গিয়ে পড়েছিল, আর উঠে আসে নি, কাউকে জানায় নি। হয়তো বা পারেও নি।

বাণী-বুড়ী শেষরাত্রে ঘাটে গিয়ে আবিষ্কার করল এই ভয়ঙ্কর ঘটনার দৃশ্য।

ও মা আঁ আঁ- করে চেঁচাতে চেঁচাতে এসে সে আছড়ে পড়ল। তার আর্তনাদ থেকে ব্যাপারটা বুঝতেও কিছুক্ষণ গেল লোকের।

কিন্তু দু-পাঁচ মিনিট আগে বুঝেই বা কী এমন লাভ হত? তখন তো একেবারে শেষ সময়। চোখ মুখ বসে গেছে, নাড়ী ছেড়ে গেছে।

রামকালী নাড়ীটায় একবার হাত দিয়েই আস্তে সেই প্রায় স্পনহীন হাতখানা নামিয়ে রাখলেন ঝুঁকে বসে রুদ্ধ-কম্পিত স্বরে বললেন, মেজবৌ, এ কী করলে?

রাসু হাতে-ধরা প্রদীপটা রোগিণীর মুখের আরো কাছে এগিয়ে অল, ভূবনেশ্বরী কষ্টে চোখের পাতা টেনে চোখ দুটো খুলল একবার। কি একটা বলতে গেল, ঠোঁট নাড়তে পারল না। চোখের কোণ থেকে দু ফোঁটা জল রগ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল। ১৬০

এ রোগে রোগীর শেষ অবধি জ্ঞান থাকে, চৈতন্য বিলুপ্তি ঘটে না। কিছু একটু বলবার জন্যে ভয়ঙ্কর একটা আকুলতা যে সেই মৃত্যুপথযাত্রিনীর ভিতরটাকে তোলপাড় করছে তা সেই বাতাসে– কাঁপা ক্ষীণ প্রদীপশিখার আলোতে ধরা পড়ল।

রামকালী তেমনি রুদ্ধগম্ভীর আবেগকম্পিত গলায় বললেন, মেজবৌ, এমন কঠিন শাস্তি কেন?

মুহর্তের জন্য রোগিণীর ভিতরকার সেই আকুলতার জয় হল। ঠোঁটটা, নড়ে উঠল। উচ্চারিত হল, ছি!

সত্যকে না দেখেই চললে?

হঠাৎ সেই কাঠ হয়ে আসা দেহটা বিদ্যুতাহতের মত নড়ে উঠল, একঝলক জল সেই কোটরগত চোখের চারধার থেকে উথলে উঠে গড়িয়ে পড়ল।

রাসুর হাতে প্রদীপটা নিভে গেল বাতাসের ঝটকায়।

গত রাত্রে সহজ সুস্থ ভুবনেশ্বরী সংসারের বহুবিধ কাজ সেরে, আগামী সকালের রসদ বাবদ তিন-তিনটে মোচা কুটে রেখে, এক জামবাটি ডাল ভিজিয়ে ঘুমোতে গিয়েছিল, আজ আর সে সেই সকালের মুখ দেখতে পেল না। ভোরের প্রথম আলো একজোড়া ঘুমন্ত চোখের ওপর এসে স্থির হয়ে পড়ে রইল ব্যর্থতার গ্লানি বহন করে।

রাসু মেয়েমানুষের মত হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল। কেঁদে উঠল যে যেখানে ছিল সকলেই। মোক্ষদার তীব্র তীক্ষ্ণ চিৎকার প্রথম ভোরে স্নিগ্ধ পবিত্রতাকে যেন দীর্ণ-বিদীর্ণ করে ধিক্কার দিয়ে উঠল।

কুঞ্জ ভাসুরমানুষ, বেশী কাছে আসবেন না, দূরে বসে বুচাপড়ে বলে উঠলেন, জীবনভোর এত লোককে বাঁচালে রামকালী, সোনার প্রতিমা ঘরের লক্ষ্মীকে বাঁচাতে পারলে না? হেরে গেলে?

রামকালী শুধু একবার সেই হাহাকারের দিকে ফিরে তাকালেন, বললেন না, যুদ্ধের অবকাশ পেলাম কই?

অজাতশত্রু ভুবনেশ্বরীর মরণকালে তার পরমদেবতার সঙ্গে যেন ভয়ঙ্কর একটা শক্রতা সেধে গেল।

সেজকর্তা ভাঙা-ভাঙা গলায় মন্ত্রোচ্চারণের ভঙ্গীতে বললেন, নারায়ণ নারায়ণ! অন্তিমে নারায়ণ! রামকালী, আত্মা এখানেই অবস্থান করছেন, নারায়ণের নাম কর।

আপনারা করুন। বলে রামকালী উঠে দাঁড়ালেন।

.

এমন অকস্মাৎ মৃত্যুতে ঘরের পাশের লোকের সঙ্গেই দেখা হয় না, তা গ্রামান্তরের! মায়ের এ হেন মৃত্যু সত্যবতীর দেখবার কথা নয়, কিন্তু মাতৃশ্রাদ্ধও দেখা হল না তার।

হ্যাঁ, শ্রাদ্ধ ভুবনেশ্বরীর ভাল করেই হল।

বাড়িতে পাঁচটা বুড়ী আছে বলে যে আর কেউ তার প্রাপ্য পাওনা পাবে না, এমন নীতিতে বিশ্বাসী নন রামকালী। আয়োজন দেখে ক্ষুব্ধ মোক্ষদা রামকালীকে বললেন, আমাদের কথা না হয় ছেড়েই দিলে, কিন্তু তোমার খুড়ো এখনো বেঁচে, তার চোখের সামনে একটা কচি বৌয়ের ছেরাদ্ধয় এত ঘটা করা কি বেশ বিবেচনার কাজ হচ্ছে রামকালী?

রামকালী পিসীর মুখের দিকে না তাকিয়েই উত্তর দিলেন, তোমাদের কথা ছেড়ে দেবার কিছু নেই, কারুর কথাই আমি ছেড়ে দিচ্ছি না, যেটা বিধি সেটাই করছি।

মোক্ষদা একটা ঈর্ষাকাতর নিঃশ্বাস ত্যাগ করে বলেন, পাঁচটা বুড়ীর চোখের ওপর ওই কচি বৌটার সমারোহ করে ছেরাদ্ধ করাই তাহলে বিধি?।

রামকালী তেমনি মুখ ফিরিয়েই বললেন, আত্মার বয়স নেই।

কিন্তু চোখে যে সহ্য করতে পারা যায় না রামকালী! বললেন মোক্ষদা।

রামকালী মৃদুস্বরে বললেন, জগতে অনেক জিনিসই সহ্য করে নিতে হয়। এ নিয়ে বৃথা আলোচনায় ফল কি?

মোক্ষদা চুপ করে গেলেন। কথাটা সত্যি বৈকি কনিষ্ঠজনের মৃত্যুটাই যদি সহ্য করে নেওয়া যায়, তার সেই প্রিয় পরিচিত মূর্তিটা আগুনে পুড়িয়ে শেষ করে চিতায় জল ঢেলে এসেই আবার যাওয়া যায়, ঘুমানো যায়, তবে আর কোন্ মুখে বলা চলে- তার পারলৌকিক কাজটা চোখ মেলে দেখে সহ্য করার ক্ষমতা আমার নেই!

কিন্তু মায়ের শ্রাদ্ধ চোখে দেখবার ক্ষমতা ছেলেমানুষ সত্যবতীর হবে না বলেই কি নিয়ে আসা হল না তাকে?

না, তা নয়, নিজেরই তার আসা সম্ভব হল না। সে যখন মায়ের মৃত্যুসংবাদ পেল, তখন দুদিনের ছেলে নিয়ে আঁতুরঘরে। ভুবনেশ্বরী যেদিন ভোরে মারা গেছেন ঠিক সেইদিনই সকালবেলা সত্যর দ্বিতীয় সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়েছে। পুত্র-সন্তান

দু পরিবার থেকে দুজন লোক কুটুমবাড়ি এসেছে খবর জানাজানি করতে। একজন জনের, আর একজন মৃত্যুর খবর বহন করে।

.

কিন্তু সত্য কেন প্রসবের প্রাক্কালে বাপের বাড়ি আসে নি? বিশেষ করে বাপ যার এত বড় চিকিৎসক?

আসে নি তার কারণ আছে। যদিও ধরতে গেলে কারণটা নিতান্তই মেয়েলী, কিন্তু এসব ক্ষেত্রে মেয়েলী প্রথা আর মেয়েলী কুসংস্কারেই জয়ী হয়, সত্যর বেলাতেও তার অন্যথা হয়নি। সত্যর প্রথমবারের ঘটনাটাই এমন অনিয়মের কারণ। বাপের বাড়িতে যখন অমন একটা অপয়া ব্যাপার ঘটে গেছে, তখন পালা বদল হোক।

তাই এবারে দুপক্ষ থেকেই একমত হয়ে স্থির করা হয়েছিল, সত্যর এবারের সন্তান মাতুলালয়ে ভূমিষ্ঠ না হয়ে পিত্রালয়ে ভূমিষ্ঠ হবে।

সত্য তাই ওখানেই আছে।

ভালই আছে। বেটাছেলেটি কোলে এসেছে। এলোকেশী বড় মুখ করে লোক পাঠিয়েছিলেন বড়লোক কুটুমবাড়ি। তাকে বলে দিয়েছিলেন, শুভ সংবাদের বকশিশ হিসেবে পেতলের গামলাটা দিলে নিবি না, বলবি ঘড়া কই?

কিন্তু ঘরা গামলা কিছুই পাওয়া হল না তার। এসে শুনল এই বিপদ।

ওদিকে সত্যবতীও পুলকে আনন্দে আশায় গর্বে প্রত্যাশিত হয়ে বসেছিল কখন সংবাদদাতা ধড়া নিয়ে ফিরবে। কিন্তু তার ফেরা পর্যন্ত আর অপেক্ষা করে বসে থাকতে হল না! লোক এল ওদিক থেকে।

এলোকেশী আঁতুড়ের দরজায় এসে মুখটা কঠিনে কোমলে করে বললেন, আঁতুড়ঘরে কাঁদতে নেই, কাঁদলে ছেলের অকল্যাণের ভয়, নাড়ীর দোষ হবার ভয়, সাবধান করে দিয়ে খবরটা বলি বৌমা, ভেদবমি হয়ে তোমার মা-টি মরেছেন। লুকোছাপা করে চেপে রাখবার তো খবর নয়, চতুর্থী করা না হোক, দুদিন মাছভাতটা তো বন্ধ দিতে হবে। তাই জানিয়েই দিলাম দেখি, ভটচার্যকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পাঠাই, এক্ষেত্তেরে কী বিধিব্যবস্থা!

একটা সদ্যপ্রসূতি তরুণী মেয়ের নিঃশঙ্ক বুকে বেপরোয়া একখানা ধারালো ছুরি বসিয়ে দিয়ে নিতান্ত সহজভাবে সেখান থেকে সরে গেলেন এলোকেশী। ছুরিটার ক্ষমতার বহরও তাকিয়ে দেখে গেলেন না।

কিন্তু পাড়ায় বেরিয়ে এলোকেশী তার প্রায় সখীমহলে এই সরেস খবরটি পরিবেশন করে বলে বেড়ালেন, দেখলি তো? মিথ্যে বলি কাঠপ্রাণ? মা মরার খবর শুনে পাট প্যাট করে তাকিয়ে বসে রইল, ডুকরে কেঁদে উঠল না!

সত্যিই ডুকরে কেঁদে সত্যবতী ওঠে নি।

স্তম্ভিত বিস্ময়ে শুকনো চোখ মেলে বসেই ছিল অনেকক্ষণ। তার পর কখন একসময় নবজাত শিশুটা তার দেহের ওজনের চেয়ে অনেক গুণ বেশী ওজনের চিৎকার করে উঠেছে, ধীরে ধীরে তাকে কোলে তুলে নিয়ে এদিকে পিঠ ফিরিয়ে চুপ করে বসে থেকেছে দেওয়ালের দিকে মুখ করে।

ওদিকে যদি একটুকরো জানলা থাকত, সত্যর প্রাণটা বুঝি তাহলে সেই খোলা পথটুকু দিয়েই দষ্টির খেয়া-নৌকা চড়ে অসীম আকাশে সাঁতরে সাঁতরে আছড়ে গিয়ে পড়ত সেই তার শৈশবনীড়ে।

যেখানে মেজবৌ পরিচয়ে চিহ্নিত একটি নিটোল মুখ, ফর্সা রং, ছোটখাটো মানুষ ভীরু কণ্ঠিত পদক্ষেপে সারাদিন শুধু সকলের মনোরঞ্জন করে বেড়াচ্ছে। আর তারই আশেপাশে এখানে সেখানে, তাকে প্রায় বিস্মৃত হয়ে দৃপ্ত পদপাতে ঘুরে বেড়াচ্ছে একটি গাছকোমর-বেঁধে কাপড় পরা স্বাস্থ্যবতী তালিকা। কিন্তু এই আঁতুরঘরের এধারে ওধারে কোন ধারেই জানালা নেই। তিনদিকেই বেরলেপা নিরেট মাটির দেওয়াল। দৃষ্টি সেখানে অচল হয়ে থেমে থাকে।

কেন সর্বদা এমন ভয়ে ভয়ে থাকে, এই নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করত সত্যবতী। বলত, ভয় ভয় ভয়! এই ভয়ের জ্বালাতেই সগগ পাবে না তুমি মা, দেখে নিও।

সত্যবতীর মা কি স্বর্ণ পায় নি।

সত্যবতীর প্রাণটা তবে কেন ‘স্বর্গ’ নামক সেই এক অদৃশ্যলোকের অসীম শূন্যতায় হাহাকার করে বেড়াচ্ছে?

মা নেই, মাকে আর দেখতে পাবো না, এ কথা মনে রাখতে পারছে না সত্য, শুধু মনে হচ্ছে সেই চিরমমতাময়ী মানুষটা যেন ভয়ঙ্কর এক নিষ্ঠুর খেলায় মেতে একছুটে কোন দূর-দূরান্তর লোকে পোঁছে গিয়ে সত্যকে দুয়ো দিয়ে ব্যঙ্গহাসি হাসছে।

বলছে, কি গো, রাতদিন তো নিজের খেলা নিয়েই উন্মত্ত হয়ে বেড়াতে, মা বলে যে একটা মানুষ ছিল সংসারে, তার দিকে তাকিয়ে দেখেছিলেন কোন দিন? মনে রেখেছিলে তুমি তার একমাত্র সন্তান, তুমি ছাড়া আপনার বলতে আর কেউ নেই তার?

মা মারা গেছেন এ দুঃখের চেয়ে দুরন্ত হয়ে উঠছে সত্যর ছেলেবেলাকার সত্যর সেই মার প্রতি ঔদাসীন্যের দুঃখ। মাকে কেন ভাল করে দেখে নি সত্য, দু’দন্ড কেন স্থির হয়ে বসে নি মার কোলের কাছে? কেন রাতে আর পাঁচটা মেয়ের সঙ্গে ঠাকুমার ঘরে শোয়ার বদলে মায়ের গলাটি জড়িয়ে ঘুমোয় নি? প্রায় তো সেই কুণ্ঠিত মানুষটি ভীরু ভীরু মুখটি হাসিতে উজ্জ্বল করে চুপি চুপি অনুনয় করত, এ ঘরে আমার বিছানায় শুবি আয় না! রূপকথার গল্প বলব!

যার কাছে এই অনুনয়, সে কোনদিনই তার মান রাখত না। নিতান্ত তাচ্ছিল্যে বণত, হুঁ, কতই গল্প জান তুমি! ওঘরে বলে আমার বন্ধুরা সবাই-ওদের ছেড়ে তোমার কাছে শুতে আসব আমি? বলিহারী কথা বটে!…

কী পাষাণ ওই মেয়েটা গো! কী পাষাণ!

গোবরলেপা ওই নিরেট দেওয়ালটায় মাথা কুটে কুটে মাথার মধ্যেকার ভয়ঙ্কর যন্ত্রটাকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলতে ইচ্ছে করে সত্যর।

ভগবান, একবারের জন্যে সেই দিনটা এনে দিতে পারো না? সত্য তাহলে সেদিন সেই নিষ্ঠুর মেয়েটার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করে?

সেই ছোটখাটো দেহটাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে বুকে মুখ গুঁজে বলে, মা মাগো, নিষ্ঠুর ছিল না সে মেয়েটা, শুধু অবোধ ছিল!

ইদানীং-এর মাকে, শ্বশুরবাড়ি থেকে ঘুরে গিয়ে দেখা মাকে, কিছুতেই যেন মনে পড়াতে পারে না সত্য, ঘুরেফিরে শুধু মার সেই নিতান্ত বধু-মূর্তিটিই রামকালী কবরেজের মস্ত বড় বাড়িটার সর্বত্র সঞ্চরণ করে ফেরে।

সত্য যদি এখুনি মরে যায়, ‘স্বর্গ’ নামক সেই জায়গাটায় কি দেখা হবে মার সঙ্গে? তা হলে সত্য তার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে ডুকরে কেঁদে উঠবে, মা মাগো, এত পাষাণ তুমি কী করে হলে মা!

আত্মবিস্মৃত সত্য কি মনে করে বসেছিল, সত্যিই সেখানে পৌঁছে গেছে? ঝাঁপিয়ে পড়েছে মার বুকে? আর তার ডুকরে ওঠাটা এত তীক্ষ্ণ হয়ে গেছে যে মর্ত্যলোকের এইখানে এসে ধাক্কা দিয়েছে?

নইলে এলোকেশী ছুটে আসবেন কেন? কেন কঠিন গলায় ধমকে উঠবেন, বৌমা, একটাকে বিসর্জন দিয়ে আশ মেটে নি, এটাকেও দিতে চাও? ওই আঁতুড়-ষষ্ঠীর ছেলে কোলে নিয়ে মড়াকান্না? বুকের পাটাকেও ধন্যি! বলি মা বাপ কি কারো চিরদিনের? তবু তো বিধাতাপুরুষের সুবিচার হয়েছে, বাপ না গিয়ে মা গিয়েছে। শাঁখা-সিঁদুর নিয়ে এয়োসতী ভাগ্যবতী ড্যাংডেঙিয়ে চলে গেল, দেখে আহ্লাদ কর, তা নয় মা-মা করে চিৎকার তুলছ! বলি আর বেশীদিন বাচলে কপালে দুর্ভোগ ছাড়া কি ছাই সুখভোগ আসত? হাত শুধু করে থান পরে বোগনো বেড়ির ঘরে ভর্তি হতে হত না? চোখের জল যদি ছেলের গায়ে পড়ে বৌমা, তোমায় আমি বাপান্ত করে ছাড়ব তা বলে দিচ্ছি, মা-মা করে ন্যাকামি করা বার করে দেব।

চোখের জল ছেলের গায়ে!

সত্য আঁচলটা তুলে ঘষে ঘষে চোখটা শুকনো করে ফেলে সভয়ে তাকিয়ে দেখে, ছেলের গায়ে কোথাও জলের ফোঁটা লেগে আছে কিনা।

এই তো এই যে! এই যে জলের ফোঁটা! শিউরে ওঠে সত্য।

হে মা ষষ্ঠী, রক্ষা করো মা। এমন বুদ্ধিহীনের মত কাজ আর কখনো করবে না সত্য।

কল্পিত সেই জলের ফোঁটা আঁচলের কোণ দিয়ে মুছে নিয়ে ছেলেকে নিবিড় করে ধরে সত্য। মৃত্যুর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে জীবনের মুখোমুখি বসে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *