২৪. নীলাম্বর বাঁড়ুয্যে নিত্যনিয়মে

নীলাম্বর বাঁড়ুয্যে নিত্যনিয়মে সন্ধ্যা-গায়ত্রী আহ্নিকপূজো ইত্যাদি সেরে গৃহদেবতা নারায়ণশিলার প্রসাদী বাতাস দুখানি মুখে দিয়ে জল খেয়ে হাঁক দিলেন, সদু, আজ আর আমার জলখাবার গোছাস নে, শরীরটা তেমন ভাল নেই।

        সদু দুটি চালভাজায় তেল-নুন মাখছিল মামার জন্যে। ঘরে ক্ষীরের তক্তি আছে, আছে নারকেলকোরা, ওতেই হবে। আজকাল আর রাত্রে বেশী কিছু খান না নীলাম্বর।

মামার কথায় বেরিয়ে এসে বলে সদু, কেন, শরীরে আবার তোমার কি হল মামা।

কি জানি কেমন খিদে নেই।

বলে যথারীতি বেনিয়ানটি গায়ে এটে আলোয়ান কাঁধে ফেলে নিত্যনিয়মিত রাত চরতে বেরিয়ে যান নীলাম্বর।

সত্যবতী ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বলে, শরীর খারাপ যদি, ঠাকুর আবার এই শীতের রাত্তিরে বেরোলেন কেন ঠাকুরঝি?

সদু হাসি চেপে বলে, কেন বেরোলেন, তুই নিজে জিজ্ঞেস করলেই পারতিস বৌ!

শোন কথা, আমি কথা কই?

ও, তা বটে! বলে সদু মুখ টিপে হাসে।

সত্য হঠাৎ সদুর হাত চেপে ধরে সন্দিগ্ধ স্বরে বলে, আচ্ছা ঠাকুরঝি, ঠাকুর বেড়াতে বেরোলেই তুমি অমন হাসো কেন বল তো? কোথায় যান?

সদু অমায়িক মুখে বলে, ওমা, হাসি আবার কখন! যান বোধ হয় দাবা-পাশার আড্ডায়!

তা শরীর খারাপ হলেও যেতে হবে? ঝড়বৃষ্টি বজ্রাঘাত কোনমতেই কামাই চলবে না? বারণ করতে পার না তোমরা?

বারণ? ও বাবা! ও আকর্ষণ যমের আকর্ষণের বাড়া! বলে আর একবার হাসি চাপে সদু।

আমি ঠাকুরের সঙ্গে কথা কইলে ঠাকুরের ওই মারাত্মক নেশা ছাড়িয়ে দিতাম।

তা সেই চেষ্টাই নয় করিস। নিজে বলতে না পারিস বরকে দিয়ে বলাস। সে উপযুক্ত ছেলে বাপের এই বদ নেশা যদি ছাড়াতে পারে!

সদু এবার হাসি চাপে না, হাসে।

কথাটা যে সত্যর মনে লাগল তা নয়, বরং সদুর কথার মধ্যে সে একটা প্রচ্ছন্ন কৌতুকের আভাস পেল। তার শ্বশুরের এই আড্ডায় আকর্ষণটা যে ঠিক দাবাপাশার আড্ডা নয়, এই সন্দেহই বদ্ধমূল হল।

রাত্রে তাই ঘরে ঢুকেই প্রথম ওই কথাটাই পাড়ে সত্য, আচ্ছা, রোজ রাত্তিরে ঠাকুর কোথায় যান বল তো?

হ্যাঁ, কিছুদিন হল রাত্রির অধিকার পেয়েছে সত্য। সদুরই প্রচেষ্টায় আর সদুর প্রচেষ্টাটা নবকুমারের প্রতি করুণাতেই। নইলে বৌ তো কিছুতেই হেলে দোলে না।

নববধূর স্বপ্নে বিভোর নবকুমার অবশ্যই এ হেন প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিল না। তাই থতমত খেয়ে বলে, কোথায় আবার! তুমি জান না?

জানলে তোমায় শুধোতাম না। নবকুমার গম্ভীর হয়ে গিয়ে বলে, বাপ গুরুজন, তার কথা নিয়ে আলোচনা না করাই ভাল।

সত্য ভুরু কুঁচকে বলে, গুরুজনের নিন্দে করাই না হয় ভাল নয়, গুরুজনের কথা মাত্তরই কওয়া দোষ?

নবকুমার গম্ভীরতর হয়ে বলে, তা এ তো নিন্দেরই কথা। বামুনের ছেলে হয়ে বান্দী-পাড়ায় যাওয়া, তাদের হাতের পান-জল খাওয়া, এসব কি আর খুব গুণের কথা!

বান্দীপাড়ায় যাওয়া!

তাদের হাতে পান-জল খাওয়া!

সত্যকে যেন তার স্বামী হঠাৎ ধরে ধোবার পাটে আছাড় মারল।

সত্যও তাই থতমত খায়।

বলে, ও কথার মানে?

সত্যর বয়সের দিকে তাকায় না নবকুমার, বৌ সকল জ্ঞানের আধার হবে, এইটাই ধারণা তার। তাই উদাস গলায় বলে, মানে যদি না বোঝ তো নাচার! বাপের সম্পর্কে স্পষ্ট করে আর কী বলব? কথায় বলে– পিতা স্বর্গ পিতা ধর্ম। নইলে পথেঘাটে যখন উল্লাসী বান্দিনীকে দেখি, তখন কি আর রাগে ব্রহ্মাণ্ড জ্বলে যায় না? কিন্তু কী করব, মনকে প্রবোধ দিতেই হয়, ভাবতে হয় যতই হোক মাতৃতুল্য।

পূজনীয় পিতৃদেব সম্পর্কে কিছু বলব না বলেও সবটুকুই বলে ফেলে নবকুমার নিশ্চিন্ত হয়ে স্ত্রীকে সমাদর করে কাছে টানতে যায়।

কিন্তু এ কী!

নিত্যকার প্রফুল্ল প্রতিমা সহসা প্রস্তর-প্রতিমায় পরিণত হল কেন? সত্যিই সত্যর সর্বশরীর যেন পাথরের মতই কঠিন হয়ে উঠেছে।

আর সেই শরীরের মধ্যেকার মনটা?

সেই মনটাও কি কাঠ হয়ে উঠল? অজানিত একটা ভয়ে?

হ্যাঁ, ভয়েই।

অনেক অনেক দিন আগে বালিকা সত্যর নিঃশঙ্ক চিত্ত যেমন ভয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিল কাটোয়ার বৌ শঙ্করীর এক অজানা অন্ধকার লোকের বার্তা শুনে, তেমনি ভয়ে। কিন্তু সেদিন ছিল শুধুই অন্ধকার, শুধুই ভয়। কিন্তু আজ সেই অন্ধকারের মাঝখানে জ্বলে উঠেছে একটা তীব্র বিদ্যুৎশিখার চোখ-ধাঁধানো আলো।

আজকের সত্য সেদিনের অবোধ বালিকা নয়, সংসার-তত্ত্বের অনেক কিছুই তার জানা হয়ে গেছে। তাই ভয়ের গাঢ় অন্ধকারের মাঝখানে দপদপ করে জ্বলে উঠেছে ঘৃণার বিদ্যুৎশিখা।

বার দুই চেষ্টার পর নবকুমার হতাশ হয়ে বলে, হলটা কি তোমার? সারা দিনের পর দুটো সুখ-দুঃখের কথা কইব, একটু হাসি-আনন্দ দেখব এই আশায় হাঁ করে থাকি—

সত্য রুদ্ধস্বরে বলে, হাসি-আনন্দ তো কুমোরবাড়ির হাঁড়ি-কলসী নয় যে ফরমাস দিলেই পাওয়া যায়, হাসি-আনন্দের মতন মন না থাকলে?

নির্বোধ নবকুমার পরিহাসের ব্যর্থ চেষ্টায় বলে, তা এতে তোমার এত মন খারাপের কী আছে? আমি তো আর কোনও বান্দিনীর সঙ্গে ভালবাসা

থামো থামো তীব্র ধিক্কারের স্বর ছড়িয়ে পড়ে বদ্ধ ঘরের দেওয়ালে দেওয়ালে।

শীতের রাতের সুবিধে, একটু গলা খুলে কথা কওয়া চলে। আর সত্যি কথা বলতে, সত্য এমন কিছু লজ্জাবতী বৌও নয়। গলার শব্দ তার যখন-তখন শুনতে পাওয়া যায়।

ধিক্কার দিয়ে সত্য গায়ের কথাটা টেনে গলা পর্যন্ত ঢেকে ওদিকে মুখ করে শুয়ে বলে, ওই ঘেন্নার কথা নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করতে লজ্জা হয় না তোমাদের? আমি কিন্তু এই পষ্ট বলে দিচ্ছি, এরপর থেকে যদি ঠাকুরকে আমি ছেদ্দাভক্তি না করতে পারি দুষো না আমায়।

এর পর নবকুমার কথা কইবার চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে মনে মনে নিজেকে গালাগাল দিতে থাকে। ছি ছি, কী একটা গাধা সে! বললেই হত, বাবা কোথায় যায় আমি জানি না! বৌকে তো সে চেনে। ভাল মেজাজে আছে তো গঙ্গাজল, মেজাজ বিগড়ে গেল তো আগুনের খাপরা।

বাবা, কী যে একবগ্গা মেয়ে! কবে একদিন সেই নবকুমারের কী-একটা মিথ্যে কথা ধরে ফেলে একেবারে পাঁচ দিন কথা বন্ধ! অবশেষে নবকুমার নিতাইয়ের কাছ থেকে পরামর্শ নিয়ে একটা শাস্তরের শ্লোক আউড়ে বোঝায়, পরিবারের সঙ্গে মিথ্যে কথায় পাপ নেই, তবে বৌয়ের মুখের কুলুপ খোলে। অবিশ্যি শাস্ত্রবাক্য মেনে নিয়ে নয়, মুখ খোলে প্রতিবাদের মুখরতায়।

সেদিন তেজের সঙ্গে বলেছিল সত্য, থাক থাক, আর শাস্তর আওড়াতে হবে না। যে শাস্তর বলে মিথ্যে কথায় পাপ নেই, সেই শাস্তরে আমার অরুচি। পরিবার বুঝি একটা মানুষ নয়, ভগবান বাস করে না তার মধ্যে? এর পর আর তোমার কোন কথা মন-প্রাণ দিয়ে বিশ্বেস করব আমি?

সে যাই হোক, তবু ঝগড়ার সূত্রেও কথার দরজা খুলেছিল। এবার আবার কি না-জানি হয়!

আর সত্য?

সে ভাবছিল, ছি ছি, এই চরিত্র তার শ্বশুরের! যাকে ‘ঠাকুর’ বলে সম্বোধন করতে হয় তাকে। চরিত্রের অন্য বহুবিধ ক্রটি সে দেখেছে শ্বশুরের, নীচতা ক্ষুদ্রতা স্বার্থপরতায় গিন্নী এলোকেশীর থেকে কিছু কম যান না তিনি, এযাবৎ সে-সবই মনে মনে মেনে নিয়েছে সত্য আর ভেবেছে ত্রিসংসারে আমার বাবার মতন আর কজন হবে?

কিন্তু এ কী!

এ যে ঘৃণায় লজ্জায় সমস্ত রক্তকণা ছি-ছি করে উঠছে। এই বয়সে এই প্রবৃত্তি! আর সব চেয়ে আশ্চর্য কথা, এরা সে কথা সবাই জানে! অথচ সত্য নির্বোধ, সত্য ন্যাকা, তাই এতদিন দেখেও শ্বশুরের এই রাত-চরার অর্থ কোনদিন আবিষ্কার করার চেষ্টা করে নি। সত্যরা ঘুমিয়ে পড়ার অনেক পরে যে তিনি বাড়ি ফেরেন এ কথা তো বরাবরই দেখেছে। তার মানে বোঝে নি। না না, এ শ্বশুরকে সে ভক্তি-ছেদা করতে পারবে না, তাতে সত্যকে যে যাই বলুক।

হঠাৎ সত্যর সর্বশরীর আলোড়ন করে প্রবল একটা কান্নার উচ্ছাস আসে আর এই দীর্ঘকাল পরে বাপের ওপর তীব্র অভিমানে হৃদয় বিদীর্ণ হতে থাকে তার।

এ সংসারে এসে অনেক নীচতা অনেক ক্ষুদ্রতা অনেক হৃদয়হীনতা দেখেছে সত্য, সবই এদের অশিক্ষা-কুশিক্ষার ফল বলে সহ্য করে নিয়েছে, কিন্তু আজকে এই একটা বুড়ো লোকের চরিত্রহীনতার নোংরামি তাকে যেন আছড়ে মারছে।

তাই যে সত্য উৎপীড়নেও কখনো কাঁদে না, সে আজ কেঁদে বালিশ ভিজিয়ে বলতে থাকে, বাবা বাবাগো, দশটা নয় পাঁচটা নয়, একটা মাত্তর মেয়ে আমি তোমার, দেখেশুনে এমন ঘরেও দিয়েছিলে! এত তুমি বিচক্ষণ, আর এই তোমার বিচার!

অনেকক্ষণ কেঁদে কেঁদে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ে সত্য।

.

কিন্তু রাতে কম ঘুমিয়েছে বলে সকালবেলা পর্যন্ত ঘুমোবে, এত সুখ তো আর বৌ-মানুষের ভাগ্যে ঘটে না। যথারীতি ভোরে উঠে স্নানশুদ্ধ হয়ে নারায়ণের ঘরের গোছ করতে ঢুকল সত্য ভারাক্রান্ত মনে, আর অভ্যাসমতন চন্দন-পাটাখানা টেনে নিয়ে চন্দন ঘষতে গিয়েই কথাটা একটা বিদ্যুৎ-শিহরণ এনে দিল ওর মধ্যে।

সত্যর এই যত্ন করে চন্দন ঘষা, ফুল-তুলসী বাছা, ধূপ-ধুনোয় ঘর ভর্তি করে তোলার মূল্য কি?

এসব উপকরণ নিয়ে পূজো করবেন তো এখন নীলাম্বর বাঁড়ুয্যে! তার আবার কাশির ধাত বলে প্রাতঃস্নান করবেন না, মুখ হাত ধুয়ে তসর ধুতিখানা জড়িয়ে এসে পূজোর আসনে বসেন।

কিন্তু স্নান করলেই বা কি?

দেহ মন আত্মা সবই যার অশুচি, স্নানে আর কী শুদ্ধ হবে সে? হাত গুটিয়ে চুপ করে বসে থাকে সত্য হাঁটুতে মুখ রেখে। ফুল তোলা হয় না, তুলসী চয়ন হয়।

অনেকক্ষণ পরে সৌদামিনী কি কাজে এসে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে বলে, কি হল বৌ, অমন করে বসে যে?

সত্য অবশ্য নির্বাক।

সদু ব্যগ্রভাবে দরজার চৌকাঠ অবধি এগিয়ে এসে বলে, শরীর খারাপ করছে?

সত্য মাথা নাড়ে।

তবে? বাপের বাড়ির জন্যে মন উতলা হচ্ছে বুঝি? সত্যি, কতকাল হয়ে গেল

সত্য হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বলে ওঠে, বাপেরবাড়ির জন্যে মন উতলা হতে কখনও দেখেছ ঠাকুরঝি, তাই বলছ? সদু তার বড় ননদ, তবু একটু প্রশ্রয় তার কাছে আছে।

সদু হেসে ফেলে বলে, তা দেখি নি বটে, তা হলে বরের সঙ্গে কেদল?

বকো না ঠাকুরঝি, অত তুচ্ছ ব্যাপারে তোমাদের বৌ হারে না। আমার মন ভাল নেই, আজ থেকে পূজোর ঘরের কাজ আর আমি করব না।

সদু হঠাৎ এই অভাবিত ঘোষণায় স্তম্ভিত হয়ে বলে, সে কি কথা বৌ!

ওই কথা ঠাকুরঝি। গুরুজনের কথায় বলতে কিছু চাই নে, কিন্তু ঠাকুর এসে পূজোর আসনে বসবেন মনে করে পূজোর গোছ করবার প্রবৃত্তি আমার হরে যাচ্ছে।

সদু ভয়ের চোটে নিজের মুখোনাতেই একবার হাত চাপা দিয়ে আস্তে-আস্তে বলে, ও কি সব্বনেশে কথা বৌ, মামীর কানে গেলে আস্ত থাকবি?

সত্য মুখটা ফিরিয়ে শুকনো গলায় বলে, এ সংসারে আর আস্ত থাকবার বাসনা আমার নেই ঠাকুরঝি!

সদু প্রমাদ গনে।

এ আবার কী কথা রে বাবা! এর মূল কারণ যে সত্যর কালকের সেই শ্বশুর-সম্পর্কিত প্রশ্ন তাতে আর সন্দেহ নেই, বোধ করি প্রশ্নের উত্তর তার জানা হয়ে গেছে। কিন্তু তার সঙ্গে এই রণমূর্তির সঠিক সম্বন্ধ অনুমান করতে পারে না সদু।

পারবার কথাও নয়।

সদুর অনেক বয়স হয়েছে, এসব ব্যাপার তার কাছে কিছুই নয়। আশেপাশে অহরহ দেখতে দেখতে হাড়মাস কালি। কাজেই নিজের স্বামী-পুত্র ব্যতীত আর কারও চরিত্রহীনতায় যে এত বিচলিত হওয়া সম্ভব ও সদুর বোধের বাইরে।

কিন্তু অন্য বিষয়ে সদু বুদ্ধিমতী, তাই এ কথা নিয়ে বেশী বাজাবাজি না করে বলে, আচ্ছা বেশ, আমি চট করে চানটা সেরে এসে দিচ্ছি গুছিয়ে, তুমি চলে এস।

রাগ করো না ঠাকুরঝি, আমার মন কিছুতেই নিচ্ছে না তাই। তোমার কি কি কাজ আছে দেখিয়ে দাও, আমি করছি। বলে সত্যিই পূজোর ঘর থেকে বেরিয়ে আসে সত্য।

কিন্তু পূজোর ঘরের তুলসী-চন্দনের দায় না হয় সদু সামলালে, বধূজনোচিত আরও যে একটা কাজ রয়েছে সকালবেলাকার।

সে দায় কে সামলাবে?

সকালবেলা জল মুখে দেবার আগে শ্বশুর-শাশুড়ীর পদবন্দনা সত্যর নিত্য কর্মপদ্ধতির একটি অঙ্গ। এলোকেশীই শিখিয়েছেন সদু মারফৎ।

সত্যও অবশ্য সে শিক্ষা মেনেই চলেছে এযাবৎ।

কিন্তু আজ সত্যর ভয়ানক এক দুঃসাহসিক সংকল্প। আস্ত তাকে না থাকতে হয় তাও ভাল, তবু ওই অপবিত্র মানুষটার পায়ের ধুলো মাথায় নেবে না সে।

গুরুজন?

তা আর কি করা যাবে? গুরুজন যদি ইতরজনের মত আচরণ করে!

.

এলোকেশীও নিত্য সকালবেলা স্নান সেরে এসেই পূজোর ঘরে ঢোকেন। সাংসারিক কাজের তো কোন দায় নেই। সদু আছে, বৌ আছে। আর এলোকেশীর আছে দেব-দ্বিজে পরমা ভক্তি। নীলাম্বরও সারা সকাল ওইখানেই থাকেন, চণ্ডীর পুঁথি পড়েন, মহিম্নস্তব আওড়ান।

কর্তাগিন্নীর যাবতীয় বিশ্রম্ভালাপ এইখানেই। কারণ সে আলাপের যেটা প্রধান সময় সে সময়টা এলোকেশীর হাতের বাইরে। মশারী-বক্তৃতার উপায় কোথা?

তা এইখানেই রোজ একত্রে দুজনকে প্রণাম করে যায় সত্য।

কিন্তু আজ আর সত্যর দেখা নেই।

এলোকেশী কিছুক্ষণ পরে সদুকে ডেকে বিরক্তি ব্যঞ্জক স্বরে বলে, আজ আর নবাব-নন্দিনীর দেখা নেই যে! গেলেন কোথা?

ব্যাপার বুঝতে সদুর দেরি হয় না। এবং বৌয়ের এই বেখাপ্পা গোয়ে একটু বিরক্তই হয় সে, তবু সামলে নিয়ে বলে, যাবে আর কোথায়? এই তো ওই দিকে

বলে কল্পিত ওদিকের দিকে তাকায় সদু।

এলোকেশী বলেন, ছেদ্দায়-অছেদ্দায় দৈনিক একবার শ্বশুর-শাশুড়ীর পায়ে মাথাটা নোয়ানো, আজ থেকে বুঝি সে বরাদ্দ বন্ধ?

নীলাম্বর মহিম্নস্তবের মাঝখানে উৎকর্ণ হয়ে ওঠেন। ততক্ষণে সদু হাওয়া। ওখানে গিয়ে এস্তেব্যস্তে বলে, কী রে বৌ, এখনো পেন্নামটা ঠুকে আসিস নি বুঝি?

সত্য হাতের কাজ সেরে উদাস মুখে বসেছিল। ঘাড় না ফিরিয়েই বলে, না।

শাশুড়ীর টনক নড়েছে। যা যা, চট করে সেরে আয়।

যেন ভুলে গেছে সত্য, তাই মনে পড়িয়ে দেওয়া।

সত্য গম্ভীরভাবে বলে, দুজনে একত্রে বসে, একজনকে প্রেণাম করলাম, একজনকে করলাম না, ভাল দেখায় না। ঠাকরুন এদিকে আসুন, তখন হবে।

সদু এবার বিরক্তি গোপন করে না। বলে, তোর আবার বড় বেশী বাড়াবাড়ি বৌ! স্বভাব দোষ আর কটা বেটাছেলের নেই? তালুই মশাইয়ের মতন দেবচরিত্র কি আর সবাই? তা বলে স্বভাব-দোষের অপরাধে শ্বশুরের পাওনা পেন্নামটা রদ হয়ে যাবে?

বাবার কথা তুলে কাজ নেই ঠাকুরঝি, তবে আমার যাতে মন নেয় না, সে কাজ আমি করতে পারি না। এক হিসাবে উনি পতিত। শালগেরামের পূজো ওঁর দ্বারা হওয়াই উচিত না।বলে সত্য জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে থাকে। বোধ করি মানসিক উত্তেজনাতেই।

সদুর কিছুক্ষণ আর বাকশক্তি থাকে না।

খানিক ‘খ’ বনে দাঁড়িয়ে থেকে আস্তে আস্তে বলে, তোর মত লেখাপড়া শিখি নি বৌ, এ কথা বোঝবার ক্ষমতা নেই। আমি সার বুঝি, যে যা করে করুক, আমার কর্তব্য আমি করে যাব।

মনে অভক্তি দেখানোটাই কি কর্তব্য ঠাকুরঝি?

সদু চট করে এ কথার জবাব দিতে পারে না, কি যেন একটা বলতে যায়, কিন্তু ইত্যবসরে পিছনে এসে দাঁড়িয়েছেন বাঘিনী। মনের মধ্যে তার সন্দেহের ধোয়া। যেন বুঝেছেন একটা কিছু হয়েছে।

বাঘিনীর মতই হাঁক করে রঙ্গস্থলে পড়েন তিনি, কোতব্য অকোতব্যের কথা কি হচ্ছে রে সদু?

সদু চুপ।

সত্যও চুপ।

এলোকেশীই ফের প্রশ্ন করেন, মুখে কথা নেই কেন? কী শলাপরামর্শ হচ্ছিল দুজনে শুনি? তুই সদু আমার খাবি পরবি আর আমারই বৌ ভাঙাবি? কবে বিদেয় হবি তুই আমার সংসার থেকে?

কথাটা নুতন নয়, এটাই এলোকেশীর কথার মাত্রা। প্রতিবাদ সদু কোনদিনই করে না, কিন্তু আজ হঠাৎ বিচলিত স্বরে বলে ওঠে, শলা-পরামর্শ আমি তোমার বৌকে কোনদিন দিই নি মামী, সৎ পরামর্শই দিই। সত্যিমিথ্যে বৌই বলুক।

বৌয়ের অবশ্য শাশুড়ীর সামনে কথা বলবার কথা নয়। কিন্তু সত্য যখন-তখনই নিয়ম লঙ্ন করে বসে, তাই আজও ফস্ করে বলে, সে কথা হাজারবার সত্যি। ঠাকুরঝি আমাকে সৎ পরামর্শই দিতে এসেছেন। কিন্তু সে পরামর্শ আমার মনে নেয্য বলে না ধরলে তুমি ইদিকে এসেছ ভালই হয়েছে- বলে সত্য মুহূর্তে হাত বাড়িয়ে শাশুড়ীর পায়ের ধুলো মাথায় নিয়ে বলে, যতই যা হোক তুমি সতীলক্ষ্মী।

সতীলক্ষ্মী অবশ্য প্রথমটা বেশ কিছু হকচকিয়ে যান, তারপর বলেন, এ সবের মানে কি সদি?

মানে বুঝতে আমিও অপারগ মামী, সদু বেজার মুখে বলে চলে যায়, বৌ পারে তো নিজে বুঝিয়ে বলুক!

সত্যিই আজ তার ভারী রাগ হয়েছে। এ আবার কী রে বাবা! তিলকে তাল করা! ডেকে অশান্তি টেনে আনা! বিশ্বভুবনে যে কথা কেউ কখনো শোনে নি, বলে নি, ভাবে নি– সেই কথা ওই মেয়ের মাথায় আসেই বা কী করে? আর বুকের পাটা? এযাবৎ সত্যর অনেক বুকের পাটা দেখেছে সদু, দেখে মূর্ছিত হব-হব হয়েছে, কিন্তু আজকের সঙ্গে যেন কোন দিনের তুলনাই হয় না!

তা সত্যিই তুলনা হয় না।

কারণ সদু চলে যেতে যেতে শুনতে পায় সত্য বলছে, বলতে মাথা কাটা গেলেও না বলে পারছি নে, ঠাকুরের পায়ের ধুলো মাথায় ঠেকাবার প্রিবৃত্তি আর আমার নেই। যতদিন না জানতাম, ততদিন–

কথার শেষাংশ শোনবার ক্ষমতা আর হয় না সদু। ঝপ করে বিনা প্রয়োজনে একটা ঘড়া নিয়ে ঘাটে চলে যায়।

.

অনেকক্ষণ পরে ঘড়া কাঁথে নিয়ে আস্তে আস্তে থাকায় দাঁড়ায়। কোথাও কেউ নেই, সব যেন নিথর তবে কি একটা হত্যাকাণ্ড ঘটে গেছে? এটা শ্মশানের নিস্তব্ধতা?

দাওয়ায় উঠে কিন্তু অবাক হয়ে গেল সদু। দেখে মাঝের ঘরের দরজার কাছে গোটা দুই তিন গামছাবাঁধা পুটুলি, আর মামা-মামী দুজনে মিলে এক খানা ছেঁড়া কাপড়ে বড় একটা ধামা বাঁধছেন। ধামা অবশ্য বোঝাই, কি আছে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। এটা অপ্রত্যাশিত। সদুর বুকের রক্ত হিম করে।

এই সময়টুকুর মধ্যে হঠাৎ গোছগাছ হয়ে গেল? আর কেনই বা হল?

এঁরা কি তাহলে বৌয়ের সঙ্গে পেরে না উঠে দেশত্যাগী হচ্ছেন?

কথাটা তাই। এ আর এক অভিনব রূপ এলোকেশীর।

সদুর সঙ্গে চোখাচোখি হতেই এলোকেশী বলেন, ননদ-ভাজে পুণ্যির সংসার কর সদু, পাপী তাপীরা বিদেয় হয়ে যাচ্ছে!

সদু ঘড়া নামিয়ে বসে পড়ে বলে, মামী তুমি কি ক্ষেপেছ?

তা ক্ষেপলে জগৎ দুষতে পারবে না সদু। দশে-ধর্মে সবাইকে শুধিয়ে এস, এতেও যদি মানুষ না ক্ষ্যাপে তো কিসে ক্ষ্যাপে!

ও তো একটা পাগল! ওর কথা আবার ধর্তব্য! গলা নামিয়ে বলে সদু।

পাগল! আঝাড়া কেউটে! তুই আর বৌয়ের হয়ে ওকালতি করতে আসিস না সদি। এত বড় একটা মান্যিমান মানুষ, পুতবৌয়ের ধিক্কারে জীবন বিসর্জন দিতে যাচ্ছিল। অনেক বুঝিয়ে নিবৃত্তি করে যাচ্ছি এখন গুরুপাটে। তার পর যা আছে অদৃষ্টে।

জোরে জোরে গাঠরি বাঁধতে থাকেন এলোকেশী।

সদুর ইচ্ছে করছিল যে ছুটে গিয়ে বৌকে বলে, ভাল চাস তো পায়ে ধরে মাপ চাই গে যা! কিন্তু জানে সে কথা বলা বৃথা। স্বয়ং বৈকুণ্ঠের নারায়ণ এলেও সত্যকে স্বমতে আনতে পারবেন না। অনেক গুণ আছে বৌয়ের, কিন্তু ওই এক মহৎ দোষ। জেদ। মেয়েমানুষের এত জেদ? আজকের ব্যাপারটাকে সদু যেন কোন দিক থেকেই সমর্থন করতে পারছে না।

তাই চেষ্টা সে এদিক থেকেই করে।

তা বাড়ি ছেড়ে তোমরা যাবে কেন শুনি? বাড়ি কি তোমার ছেলে-বৌয়ের?

না হোক, যেখানে ওর মুখ দেখতে হবে সেখানে থাকব না, ব্যস! এতক্ষণে মুখ খোলেন নীলাম্বর, এ কথাটি বলেন তিনিই।

তা বাড়ি থেকে তো অমনিমুখে যাওয়া চলবে না, ভাত-ডাল চড়িয়েছি আমি। মুখে দিতে হবে। এ যেন আপাতত সমুদ্রে বালির বাঁধ।

চড়িয়েছিল সত্যিই, কিন্তু রান্নাঘরের অবস্থা সম্পর্কে এখন আর কোন জ্ঞান নেই সদুর। কাঠ পুড়ে উনুন নিভে ঠাণ্ডা হয়ে বসে আছে নিশ্চিত।

সহসা নীলাম্বর একটা প্রবল হুঙ্কার দিয়ে মাটিতে পা ঠোকেন, ভাত-ডাল! এ ভিটেয় আমি আর জলগ্রহণ করব ভেবেছিস তুই?

সদুর বুকটা ধড়ফড় করে ওঠে। মামীর সঙ্গে সে অনেক কথা চালাতে পারে, কিন্তু মামা? উল্লাসীর হাতে পান-জল খাওয়া ইত্যাদি করে বহু ইতিহাস তো তার জানা। তবু তো কই ভয়ে মরে নি। আর ওই বৌ কোথায় পেল সেই ভয়-জয়ের মন্ত্র, যে মন্ত্রের জোরে স্বচ্ছন্দে বলা যায় উনি তো পতিত, শালগ্রামের পূজো করা ওঁর উচিত নয়?

বেশী গভীরে ভাবার ক্ষমতা থাকে না সদুর, শুধু ভাবতে থাকে, নবাটা আবার আজকেই হাটে দেরি করছে। আর এই ভয়ানক দুর্দিনে কি হাটবারও হতে হয়?

সদু কি করবে?

গিয়ে বৌয়ের পায়ে ধরবে? না কি রান্নাঘরে শেকল তুলে দিয়ে কোথাও আঁচল বিছিয়ে শুয়ে থাকবে? তারই বা এত ভয়-পাবার কী আছে– তার দোষে তো আর নবকুমারের মা-বাপ দেশত্যাগী হচ্ছে না?

সাহস দেখে কি সাহস জন্মায়?

দুঃসাহস দেখে দুঃসাহস?

তাই সে হঠাৎ অন্য মূর্তি ধরে, ঠিক আছে, চুলোয় জল ঢেলে দিই গে। বলে চলে যায়।

আশ্চর্য আশ্চর্য!

গিয়ে দেখে সত্য কিনা রান্নাঘরের দাওয়ায় বসে শাক বাছছে। মুখ দেখে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।

সদুর আর সহ্য হয় না। সে বলে ওঠে, ও পিণ্ডির কাজ করে আর কী হবে? গিলবে কে? বাড়ির কর্তা-গিন্নী তো সংসার ত্যাগ করছে!

সদুকে অবাক করে দিয়ে সত্য বলে, সংসার ত্যাগ করা অত সোজা নয় ঠাকুরঝি! সংসার ত্যাগ করতে বসে কেউ সমস্ত সংসারটাকে পুঁটুলি বেঁধে নিয়ে যেতে চায় না! মিছে ভাবছ, কেউ কোথাও যাবে না। উনুনে আমি কাঠ ঠেলে দিয়েছি, তুমি দেখ এইবার।

তা সত্যর কথাই ঠিক।

শেষ পর্যন্ত কত্তা- গিন্নী দেশত্যাগের বর্জন করে থেকেই গেলেন। শুধু ভাত খাবার সময় একটু বেশী সাধ্যসাধনা করতে হল সদুকে!

থেকে গেলেন অবশ্য নবকুমারের নির্বেদে। নবকুমার দুজনের পায়ে মাথা খুঁড়ে “রক্তগঙ্গা” হতে চাইল, আর মায়ের পা ছুঁয়ে শপথ করল বৌকে শাসন করে দেবে।

ছেলের এতটা কাতরতা সহ্য করতে না পেরেই বোধ করি ওঁরা এ যাত্রায় যাত্রা স্থগিত রাখলেন।

আর এই এতদিনের মধ্যে কখনো যা করে নি নবু, আজ তাই করে বসল। দিনের বেলায় কথা কয়ে বসল বৌয়ের সঙ্গে।

কিন্তু বৌকে কি বাগ মানাতে পেরেছিল নবু? বকে, খোশামোদ করে, পায়ে পড়তে গিয়ে? না, এ কথা কোনদিন সত্যর মুখ দিয়ে বার করতে পারে নি নবকুমার, আমার অন্যায় হয়েছে। শুধু শেষ পর্যন্ত যখন নব আত্মঘাতী হবার ভয় দেখিয়েছিল তখন সত্য বলে উঠেছিল, ঘেন্না ধরে যাচ্ছে সবেতেই। পুরুষ না হয়ে মেয়েমানুষ হয়ে জন্মাও নি কেন তুমি, এই বিধেতার রহস্য। বেশ, ছেদ্দা শূন্য পেন্নামে যদি তোমাদের এত দরকার থাকে তো করব কাল থেকে সেই ন্যাকরা।

রাত্রে অবশ্য নবকুমারের ভিন্ন রূপ।

সুন্দরী তরুণী স্ত্রীর সঙ্গে বাক্যালাপ বন্ধের দুঃসহ কষ্ট বহন করবার মত শক্তি তার নেই, তাই যেচে বলে, মা-বাপকে শুনিয়ে শুনিয়ে একটু শাসন করতে হল, নইলে বলবে, ছেলে বৌকে মাথায় তুলে রেখেছে।

আজ আমার কথা কইতে মন নেই, ক্ষমা দাও।

বলে পাশ ফিরে শুয়েছিল সত্য।

আর বেশ কিছুক্ষণ পরে হঠাৎ ধড়মড়িয়ে উঠে বলেছিল, আমি কলকাতায় যাব।

নবকুমার চমকে বলে, কলকাতায়! কলকাতায় যাবে তুমি? এতক্ষণে বুঝতে পারছি, মাথাটাই বিগড়েছে তোমার!

কেন, মাথা না বিগড়োলে কলকাতায় যায় না কেউ? তোমার মাস্টারের মাথা খারাপ?

মাস্টার? মাস্টারের সঙ্গে তোমার তুলনা? তিনি বেটাছেলে, একা যাচ্ছেন একা আসছেন, গিয়ে বন্ধুর বাসায় উঠছেন, তুমি কোন্‌টা করবে?

সত্য তীব্রস্বরে বলে বেটাছেলে আমি নয়, তুমি তো? তুমি যেতে পারবে না? তোমার সঙ্গেই যাব। বাসা করে থাকবো।

নবকুমার স্তম্ভিত হয়ে বলে, তোমার সঙ্গে সঙ্গে আমি তো উন্মাদ হই নি! মা-বাপ দেশ-ভিটে ছেড়ে যাব কিনা কলকাতায় বাসা করতে? কেন শুনি?

কেন তা শুনবে? দেখতে যাবে তোমাদের এই বারুইপুরের বাইরেও আর জগৎ আছে!

দেখে আমার দরকার?

সত্য চরম ধিক্কারের স্বরে বলে, দরকার? কী দরকার, তাও তোমাদের এই বারুইপুরের গর্তয় পড়ে থেকে বোঝার ক্ষমতা হবে না!

নবকুমার এ কথার অর্থ ধরতে পারে না, একটা জোরালো যুক্তিই জোর দিয়ে বলে, মেয়েমানুষ কলকাতায় যাবে! জাতধর্ম কিছু আর থাকবে তা হলে?

সত্য গম্ভীর স্বরে বলে, ঠাকুরের যদি এখনো জাত থেকে থাকে, শালগেরাম নাড়ার অধিকার থেকে থাকে তো আমারও কলকাতায় গিয়ে জাতের হানি হবে না।

আবার সেই এক কথা, পুরুষের আড়াই পা বাড়ালেই শুদ্ধ, মেয়েমানুষের তাই হবে? চামড়া দেওয়া কলের জল খেতে হবে, তা জান?

খেতে হলে খাব। সেখানের আরও দশজন ব্রাহ্মণ-সজ্জনের যা গতি হচ্ছে, তাই হবে। কেন, হালদার-বাড়ির মেজ ছেলে যায় নি কলকাতায়?

বৌ নিয়ে যায় নি!

তা মরা বৌকে কি আর শুশান থেকে তুলে নিয়ে যাবে?

হালদারের ছেলে গেছে চাকরি করতে সত্য দৃঢ়ভাবে বলে, তুমিও ভাই যাবে।

আমি? উপহাসের হাসি হেসে ওঠে নবকুমার, আমি যাব কেন বল?

কেন নয়? তুমি যত ইংরেজি শিখেছ, এ তল্লাটে আর কেউ শেখেনি।

অন্য দিন হলে নবু অবশ্যই স্ত্রীর এই স্বীকৃতিতে বিগলিত হত। কিন্তু আজ নেই সে সুর। তাই বলে, শুধু বিদ্যে থাকলেই তো হবে না।

সত্য জাড়া ভুরু কুঁচকে বলে, তা আর কি থাকা দরকার?

বিপদের মুখে ফস্ করে সত্যি কথাই বলে বসে নবু, দরকার সাহসের।

সত্য এক মিনিট চুপ করে থেকে ঝুপ করে শুয়ে পড়ে বলে, আচ্ছা সেটা তোমার আছে।

কিন্তু এত বড় আশ্বাসেও কি বিশেষ কাজ হল? হল না। নবকুমার ক্রুদ্ধ চিৎকার করলো, পরের চাকরি করতে যাবই বা কেন? ঘরে আমার ভাতের অভাব? দেখেশুনে চালাতে পারলে পায়ের ওপর পা দিয়ে বসে কাটিয়ে দিতে পারি তা জানো? কি জন্য করবো দাসত্ব?

সত্য গম্ভীরভাবে উত্তর দিলে, বসে খাবো এ বাসনা ঘোচাবার শিক্ষা পেতেই যাওয়া দরকার।

চলল অনেক কথা-কাটাকাটি। আর বহুক্ষণ কাটাকাটি করে নবকুমার এই কথাই ব্যক্ত করল, আমার দ্বারা হবে না, এই স্পষ্ট বলে দিচ্ছি।

মৃত্যও দৃপ্তস্বরে বলে উঠল, আমিও স্পষ্ট বলে রাখছি, কলকাতায় আমি যাব যাব যাব যে মানুষ কলকাতায় গেলে আকাশের বজ্জর এসে মাথায় পড়ে কিনা তা দেখব।

কিন্তু সে দৃশ্য কবে দেখতে পেয়েছিল সত্য? তখুনি কি?

না, দেখতে তার আরো অনেকদিন লেগেছিল।

ভিজে ন্যাকড়াকে তাতিয়ে শুকিয়ে সে ন্যাকড়ায় সলতে পাকিয়ে তাতে প্রদীপ জ্বালাতে হলে সময় একটু লাগবে বৈকি। ততদিনে সত্য দুটি ছেলের মা হয়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *