২১. ত্রিবেণীর ঘাটে এসেছিলেন রামকালী

ত্রিবেণীর ঘাটে এসেছিলেন রামকালী। রোগী দেখতে নয়, যোগে গঙ্গাস্নান করতে। একাই আস্ত একটা পারানী নৌকা ভাড়া করেছিলেন স্নানের জন্যে। পাঁচজনের সঙ্গে ঠেলাঠেলি করে নৌকা বোঝাই হয়ে। যেতে রামকালী ভালবাসেন না। দরকার হলে একাই ভাড়া করেন।

আগে অবশ্য এমন নৌকাভ্রমণ সহজ হত না। কারণ রামকালী যোগের স্নান করতে ত্রিবেণী যাচ্ছেন, কি কাটোয়া যাচ্ছেন, কি নবদ্বীপ যাচ্ছেন টের পেলে সত্যবতী একেবারে নাছোড়বান্দা হয়ে পেয়ে বসত। পায়ে পায়ে ঘুরে কাকুতি-মিনতি-করা মেয়েকে রামকালী এড়াতে পারতেন না, সঙ্গে নিতেন। অগত্যাই নেড়ু আর পুণ্যি। ওদের ফেলে রেখে শুধু নিজের মেয়েকে নিয়ে কোথাও যাবেন, এমন দৃষ্টিকটু কাজ রামকালীর পক্ষে সম্ভব নয়।

ওরা যেত।

রামকালী জলে সাবধান করতেন। আর স্নানের শেষে ঠাকুর-দেবতা দেখিয়ে নিয়ে ফিরতেন। ঘাট আর পথ, নৌকা আর মন্দির-প্রাঙ্গণ মুখর হয়ে উঠত ছোট্ট একটা বাক্যবাগীশ মেয়ের বাক্যস্রোতে।

আজকে শুধু জলের উপর দাঁড়টানার ছপাৎ ছপাৎ শব্দ। উন্মুক্ত গঙ্গাবক্ষের দিকে তাকিয়ে ছোট একটা নিঃশ্বাস ফেললেন রামকালী।

আকাশের পাখিটা খাঁচায় বন্দী হয়ে কেমন আছে কে জানে!

পুণ্যিটার বিয়ের ঠিক হয়ে আছে।

গত ক-মাস অকাল ছিল বলে বিয়ে হয়নি। কিন্তু পুণ্যি অন্য ধরনের মেয়ে। নেহাৎ সত্যর “প্রজা” হিসেবে দস্যিচাল্লি করে বেড়িয়েছে, নচেৎ একান্তই ঘরসংসারী মেয়ে সে। খাঁচার পাখি হয়েই জন্মেছে পুণ্যি আর পুণ্যির মত মেয়েরা।

কিন্তু সত্যর মত দ্বিতীয় আর একটা মেয়ে আর দেখলেন কই রামকালী? যে মেয়ে প্রতি পদে প্রশ্ন তুলে জানতে চায় “কী” আর “কেন”!

খোলা গঙ্গার দিকে তাকিয়ে আর একবার মনে হল রামকালীর, কতদিন যোগে স্নান করি নি। মনে হচ্ছে যেন দীর্ঘকাল। আর একটা নিঃশ্বাস পড়ল।

মাঝিটা একবার কথা কয়ে উঠল, খুকী শ্বশুরঘরে কত্তাবাবু?

রামকালী বললেন, হুঁ।

আর বার দুই ছপাৎ ছপাৎ করে ফের মাঝিটা বলে উঠল, থাকবে এখন?

সংক্ষেপে “দেখি” বলে আলোচনায় ইতির সুর টানলেন রামকালী। পুণ্যির বিয়ে আসছে, এই যা একটু আশার আলো দেখা যাচ্ছে, নইলে থাকবে ছাড়া আর কি। চিরকালই থাকবে সেখানে। আর সেইটাই তো কাম্য। মোক্ষদার মত অনবদ্য রূপ আর অশেষ তীক্ষ্ণতা নিয়ে আজীবন বাপের ঘরে বসে জ্বলতে থাকবে, এমন ভাগ্য কেউ মেয়ের প্রার্থনা করে না। ঘরে থাকা মেয়ে মানেই দুর্ভাগা মেয়ে। অথচ মাঝে মাঝে পালেপার্বণে কি ভাত-পৈতে-বিয়েয় কুটুম্বের মত যে আসা, সে আসায় মায়ের প্রাণ ভরতে পারে, বাপের ভরে না। অতএব তাতে ইতি হয়ে গেছে।

কিন্তু শুধু মেয়ে-সন্তান কেন, পুত্র-সন্তান হলেই বা কতটুকু তফাৎ? ছেলে ঘরে থাকে, ছেলের ওপর জোর খাটে, এই পর্যন্ত। ছেলে বড় হয়ে গেলে আর কি তাকে নিয়ে মন ভরে? তাই হয়তো মানুষ জীবনের মধ্যে বারে বারে নতুন শিশুকে ডেকে আনে জীবনকে সরস রাখতে, ভরাট রাখতে। আবার তার পরেও আশ্রয় খোঁজে টাকার সুদের মধ্যে।

.

নিত্যানন্দপুর ঘাট থেকে ত্রিবেণী ঘাট সামান্য পথ।

মাঝি নৌকা বাধল।

আর ঘাটে নেমেই প্রথম যার সঙ্গে চোখাচোখি হল রামকালীর, সে হচ্ছে “রানার” গোকুল দাস। দূর থেকে রামকালীকে নামতে দেখে ছুটে ছুটে আসছে সে।

কাদার উপরই আভূমি এক প্রণাম করে কৃতার্থম্মন্য গোকুল সবিনয় হাস্যে বলে, আজ আমার কী ভাগ্যি কত্তাবাবু, কী ভাগ্যি!

রামকালী মৃদু হেসে বলেন, সক্কাল বেলা হঠাৎ ভাগ্যের এত জয়-জয়কার যে গোকুল!

গোকুল বলে, তা জোকার দেব না আজ্ঞে? এই আপনার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল, নইলে তো যেতে হত সেই নিত্যেনন্দপুরে। এই নিন, পত্তর আছে আপনার।

পত্র!

কলকাতা থেকে আসছে! অভাবনীয়!

বিস্মিত হলেন রামকালী, কিন্তু বিস্ময় প্রকাশ করলেন না। খামে আঁটা চিঠিটা নিজের পরিত্যক্ত গাত্রবস্ত্রের উপর রেখে দিয়ে বললেন, আচ্ছা ঠিক আছে। ভাল তো সব?

আপনাদের আশীৰ্বাদে আজ্ঞে। বলে ঈষৎ উসখুস করে গোকুল বলে ফেলে, কলকাতার চিঠি আজ্ঞে?

তাই তো দেখছি, বলে রামকালী গামছা কাঁধে ফেলে জলে নামেন। প্রথম সূর্যের কাঁচা রোদ ঝলসে ওঠে কাঁচা সোনার রঙের দীর্ঘ দেহখানির উপর। গোকুল হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। থাকতে থাকতে মনে মনে ভাবে–ইস, যেন আকাশের দেবতা! কী দিব্য অঙ্গ!

পত্রের কথা মন থেকে সরিয়ে ফেলে, যথাকৃত্য সব সেরে উত্তরীয়ের কোণে পত্ৰখানা বেঁধে মন্দির-দর্শনে অগ্রসর হলেন রামকালী। অগত্যাই গোকুল আর একটা সাষ্টাঙ্গ প্রণাম সেরে বিদায় নিল। কলকেতা থেকে কার পত্র এল সে কৌতূহল আর মিটল না তার।

.

নৌকোয় বসে চিঠি খুললেন রামকালী। আর পড়ে স্তব্ধ হয়ে গেলেন।

এই সকলের আলো তার সমস্ত উজ্জ্বলতা হারিয়ে যেন আসন্ন সন্ধ্যার মত মলিন হয়ে গেল। সদ্য গঙ্গাস্নানে নির্মল রামকালী যেন একটা অপবিত্র দ্রব্যের সংস্পর্শে এসে নিজেকে অশুচি বোধ করলেন।

চিঠি কোন পরিচিতের নয়। অজ্ঞাত ব্যক্তির। তাছাড়া নিচে কোন নাম-দস্তখতও নেই।

বেনামী এই চিঠিতে শুধু সম্বোধনের বাগাড়ম্বর অনেক। কিন্তু সেটাই তো কথা নয়। চিঠির বক্তব্য এ কী ভয়ঙ্কর।

বার বার পড়ার পর আরও একবার চিঠিখানা সামনে মেলে ধরলেন রামকালী।

হস্তাক্ষর সুঁছাদের, লাইনগুলি পরিপাটি, বানান বিশুদ্ধ। কোন “লিখিত পড়িত” লোকের দ্বারা লেখা, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই; উপরে শ্রীশ্রীবাগদেবী শরণং দিয়ে শুরু

মহামহিমার্ণব শ্রীল শ্রীযুক্ত রামকালী চট্টোপাধ্যায় বরাবরেষু– যথাযোগ্য-সম্মান-পুরঃসর নিবেদনমেতৎ, অত্রপত্রে এই জ্ঞাত করাই যে, মহাশয়ের কন্যার অতীব বিপদ! তিনি তাহার শ্বশ্রূগৃহে যারপরনাই লাঞ্ছিতা উৎপীড়িতা ও অপমানিতা রূপে কালযাপন করিতেছেন। বলিতে মন শিহরিত ও কলেবর কম্পান্বিত হইলেও জ্ঞাতার্থে লিখিতেছি, আপনার কন্যা তাঁর পূজনীয়া শ্বশ্রূমাতা কর্তৃক প্রহারিতাও হইতেছেন। সেই অবলা বালিকাকে রক্ষা করে নিষ্ঠুর পাষাণপুরীতে এমন কেহই নাই। আপনার জামাতা ধর্মপত্নীর এবম্বিধ নির্যাতনে অবিরত অশ্রু বিসর্জন সার করিয়াছে। গুরুজনদিগের উপর তাহার আর কি বলিবার সাধ্য আছে? এবম্প্রকার অবস্থায় মহাশয় যদি সত্বর কন্যাকে নিজগৃহে লইয়া যান তবেই মঙ্গল নচেৎ কি যে হইতে পারে চিন্তা করিতে মস্তক ঘূর্ণিত হইতেছে। মনুষ্যজনোচিত কর্তব্য বোধে ইহা আপনার গোচরে আনিলাম। নিজ গুণে ধৃষ্টতা মার্জনা করিয়া কৃতার্থ করিবেন। অলমতিবিস্তরেণ। ইতি–

না, নাম-স্বাক্ষর নেই।

পত্র-লেখকের বাচালতা বা বাগাড়ম্বরে কৌতুক বোধ করবেন, এমন মানসিক অবস্থা থাকে না রামকালীর। চিঠিটা আস্তে আস্তে মুড়ে মেরজাইয়ের পকেটে রেখে দিয়ে এই রৌদ্রকরোজ্জ্বল পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে থাকেন তিনি।

এত আলো পৃথিবীতে, তবু পৃথিবীর মানুষগুলো এত অন্ধকারে কেন?

কিন্তু কে এই পত্র-লেখক?

সত্য শ্বশুরবাড়ির কোন শত্রু? এভাবে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে পত্র লিখে তাঁদের অনিষ্টসাধন করতে চায়? কিন্তু তাহলে চিঠিতে কলকাতার ছাপ কেন? কলকাতা থেকে এ চিঠি আসে কি করে?

ভেবে ভেবে অবশ্য একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন রামকালী। পত্র-লেখকের অবশ্যই কলকাতায় যাতায়াত আছে, এবং নিজেকে গোপন রাখতে কলকাতায় অবস্থানকালে পত্র প্রেরণ করেছে।

তবু একটা সমস্যা থেকেই যায়। পত্রের মধ্যস্থিত ওই বীভৎস সংবাদটা সত্যি, না শত্রুপক্ষের মিথ্যা রটনা?

রামকালী কি একেবারে নিজে গিয়েই তদন্ত করবেন, না লোক পাঠাবেন? বাইরের লোক গিয়ে কি ভিতরকার প্রকৃত তথ্য আবিষ্কার করতে পারবে? এক যদি কোন স্ত্রীলোককে পাঠানো যায়!

যারা বারো মাস রামকালীর সংসারে খেটে খায়, চিড়ে-কোটানি মুড়ি-ভাজুনি ইত্যাদি, তাদেরই কারো একজনকে একটা সঙ্গী ও রাহাখরচ দিলে খবর এনে দিতে পারে। পল্লীগ্রামে সচরাচর এরাই কাজ করে। কিন্তু রামকালীর ওদের কথা ভেবে চিত্ত বিমুখ হল। কোন খবর ওরা জানা মানেই সাতখানা গ্রামের লোকের জানা। ঈশ্বর জানেন কী খবর আনবে, আর সেই নিয়ে সারা গ্রামে আলোচনা চলবে।

মনে হল সত্য যদি নিজে চিঠি লিখত!

চিঠি লেখবার মত বিদ্যে সত্য অর্জন করেছে। কিন্তু করে আর লাভ কি? পিত্রালয়ে নিজের খবর জানিয়ে চিঠি দেবে এমন সাধ্য বা সাহস তো হবে না। তবে আর মেয়েদের লেখাপড়া শিখে লাভ কি?

বুকের মধ্যেটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠল স্থিতপ্রজ্ঞ রামকালী কবরেজের। চোখের সামনে ভেসে উঠল সত্যর সেই দৃপ্ত মুখচ্ছবি। সেই সত্য পড়ে মার খাচ্ছে! এ যে বিশ্বাস করা একেবারে অসম্ভব!

না না, এ মিথ্যা চিঠি।

শত্রুপক্ষের কাজ।

নইলে কেনই বা? ভাবলেন রামকালী, সত্যর ওপর নির্যাতন চালাবে কেনই বা? অকারণ এত হিংস্র কখনো হতে পারে মানুষ? তাছাড়া শুধু তো শাশুড়ী নয়, তার শ্বশুর রয়েছেন। হাজার হোক একটা ভদ্ৰব্যক্তি, তাঁর জ্ঞাতসারে এ রকমটা হওয়া কখনই সম্ভব নয়। আর বাড়ির লোকেরও অজ্ঞাতসারে যদি কোন পীড়ন চলে, পাড়ার লোকে টের পাবে কি করে?

আবার ভাবলেন রামকালী, সত্যবতী তাদের একমাত্র পুত্রবধূ। বিনা প্রতিবাদে রামকালী তাকে শ্বশুরঘর করতে পাঠিয়ে দিয়েছেন, তার সঙ্গে ঘরবসত হিসাবে প্রচুর সামগ্রী পাঠিয়েছেন, যাতে অন্তত শাশুড়ীর মন ভোলে। তবু তারা সত্যকে নির্যাতন করবে?

তাই কখনও সম্ভব?

বললে দোষ, ভাবতে বাধা নেই, মেয়ের বিয়ের সময় ঘটক আনীত নানা পাত্রের মধ্যে এই পাত্রটিকেই পছন্দ করেছিলেন রামকালী, কেবলমাত্র তাদের পরিবারের লোকসংখ্যা কম বলে। সেই শৈশব থেকেই লক্ষ্য করেছেন, তাঁর মেয়ে জেদী তেজী অনমনীয়। বৃহৎ গোষ্ঠীর অনেকের মন যুগিয়ে চলা হয়তো তার পক্ষে সহজ হবে না, সে বোধ রামকালীর ছিল, তাই ভেবেছিলেন এখানেই ভালো। বাপের একমাত্র ছেলে? দোষ কী? সত্যও তো তার বাপের একমাত্র মেয়ে!

ঘরজামাইয়ের সাধ একেবারেই ছিল না রামকালীর। শুধু এইটুকু মনে মনে ভেবেছিলেন, ছেলেটা যেন নেহাত রাঙামূলো না হয়। লেখাপড়ার একটু ধার যেন ধারে। তা সে সাধটুকু মিটেছিল রামকালীর, মিটছিলও। জামাই তখনই ছাত্রবৃত্তি পাস, টোলে সংস্কৃত শিখছে।

তারপর লোক-পরম্পরায় শুনেছিলেন, জামাই নাকি ইংরেজি ভাষা শিখতে উদ্যোগী হয়েছে। শুনে সন্তুষ্ট হয়েছিলেন রামকালী। নিজে সামনে উপস্থিত না হলেও জামাইয়ের খবর তিনি লোক মারফৎ নিতেন, এবং এটুকু জেনে নিশ্চিন্ত ছিলেন, ছেলেটা কুসঙ্গে মেশে না, বদ খেয়ালের দিকে যায় না।

সবই তো একরকম ছিল, হঠাৎ এ কী বিনামেঘে বজ্রপাত। অ

বশেষে আবার ভাবলেন, এ শত্রুপক্ষের কাজ।

কিন্তু মনের মধ্যে যে আলোড়ন উঠেছিল, সেটাকে একেবারে চেপে ফেলে নিশ্চিন্ত হয়ে থাকতে পারলেন না রামকালী, স্থির করলেন তিনি একবার নিজেই যাবেন বেহাইবাড়ি।

মান খাটো হবে?

তা যেদিন জামাইয়ের হাঁটু ধরে কন্যা-সম্প্রদান করেছেন, সেইদিনই তো মান গেছে। সেকালের মত তো রামকালী মেয়েকে স্বয়ম্বরা করতে পারেন নি।

তাছাড়া একেবারে অকারণ জামাইবাড়ি যাওয়ার অগৌরবটা পোহাতে হবে না। পুণ্যির বিয়েকে উপলক্ষ করে মেয়ে নিয়ে আসতে চাইবেন। সেই সঙ্গে জামাই-বেহাইকেও নিমন্ত্রণ করে আসা হবে। রামকালী নিজে গিয়ে নিমন্ত্রণ করছেন, এর চেয়ে সৌজন্য আর কি হতে পারে?

ত্রিবেণী থেকে ফিরে রামকালী দীনতারিণীর কাছে সংকল্প ঘোষণা করলেন, মনে করছি একবার বারুইপুর যাব।

বারুইপুর! সত্যর শ্বশুরবাড়ি? দীনতারিণী চমকে উঠে বললেন, কেন, হঠাৎ? সত্যর কোন রোগ-ব্যামো হয় নি তো?

কী আশ্চর্য! রোগ-ব্যামো হবে কেন? রামকালী শান্তভাবে বললেন, ভাবছি পুণ্যিটার বিয়ে হয়ে যাবে, তারপর দুজনে কবে দেখাসাক্ষাৎ হয় না হয়, গলাগলি বন্ধু দুটোতে। বিয়ের আগে কিছুদিন একসঙ্গে থাক।

দীনতারিণী ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন। এত সহজ ভাষা, এত সহজ কথা! রামকালীর মুখে!

ছেলেকে তো তিনি “পাথরের ঠাকুর” আখ্যা দেন।

.

সহজ কথা। তবু রামকালীর মুখ থেকে উচ্চারিত হয় বলে কেউ সহজভাবে নিতে পারে না।

মোক্ষদা খরখরিয়ে বলেন, এ আর অমনি নয়, লিখিপড়ি-উলি বিদ্যেবতী মেয়ে, নিঘঘাত লুকিয়ে বাপকে চিঠি লিখেছে, বাবা আমায় নিয়ে যাও, আর ঘোমটা দিয়ে থাকতে পারছি নে!

শিবজায়া আনতমুখী ভুবনেশ্বরীর দিকে কটাক্ষপাত করে কাতর-কাতর মুখে বলেন, আমার কিন্তু তা মন নিচ্ছে না ছোটঠাকুরঝি। মনে হচ্ছে কোন কু-খবর আছে, রামকালী চাপছেন।

বলা বাহুল্য এর পর আর ভুবনেশ্বরীর ডুকরে কেঁদে ওঠা ছাড়া গতি থাকে না।

ভুবনেশ্বরীর একমাত্র অন্তরের সুহৃদ অসমবয়সী এবং অসমসম্পর্ক হলেও ভাসুরপো- বৌ সারদা। কিন্তু এমনি কপালের দুর্দৈব ভুবনেশ্বরীর যে, সারদা আজ চার মাস কাল বাপের বাড়ি।

দ্বিতীয় সন্তানের আবির্ভাব ঘোষণাতেই তার এই পিতৃগৃহে স্থিতি।

না, সেই এক অন্ধকার রাত্রে রাসুর সঙ্গে কলহ করে ডোবার জলে ডুবে মরেনি সারদা। শুধু অন্য ঘরে ননদের কাছে গিয়ে শুয়েছিল। সে শুধু একটাই রাত। রাতের পর রাত পারবে কেন?

শ্বশুরবাড়ি বৌয়ের রাতটুকুই তো মরুভূমিতে সরোবর। মৃত্যুপুরীর মধ্যে জীবন। যত বড় দুর্জয় মানই হোক, সে মান খাটো না করে উপায় থাকে না তাদের।

সকলেরই তাই। রাত্রে ভুবনেশ্বরীরও কান্নার বেগ অসম্বরণীয় হয়ে ওঠে। রামকালী অপর চৌকি থেকেও সেটা টের পান। কিছুক্ষণ ঘুমের ভান করে চুপচাপ থাকলেও শেষ পর্যন্ত আর চুপ করে থাকা সম্ভব হয় না। মৃদুস্বরে বলেন, অকারণ কাঁদছ কেন?

বলা বাহুল্য, এ প্রশ্নে যা হয় তাই হল।

কান্নার আবেগ আরও প্রবল হল।

রামকালী বলেন, ছেলেমানুষি করো না। এস কাছে এস, কান্নার কারণটা শুনি।

ভুবনেশ্বরী চোখ মুছতে মুছতে উঠেই এল। এসে স্বামীর বিছানার এক প্রান্তে বসে চোখে আঁচল ঘষতে লাগল।

রামকালী ক্ষুব্ধস্বরে বললেন, তুমিও যদি এই সব গিন্নীদের মত হও, তাহলে তো নাচার। অপরাধের মধ্যে বলেছি পুণ্যির বিয়ে উপলক্ষে সত্যকে কিছুদিন আগেই আনব। নিজে গেলে আর ওরা অমত করতে পারবে না। কিন্তু এই সহজ কথাটা না বুঝে সবাই মিলে এমন কাণ্ড করছ যে, মনে হচ্ছে বুঝি কি একটা অমঙ্গলই ঘটে গেছে। আশ্চর্য!

তা কিছু নয়। ভূবনেশ্বরী কষ্টে বলে, মেয়েটার জন্যে প্রাণটা উতলা হচ্ছে তাই–

হচ্ছে ঠিকই। হওয়া স্বাভাবিক। রামকালী স্নেহ-গম্ভীর স্বরে বলেন, তোমার একমাত্র সন্তান। কিন্তু কান্নাকাটি করলেই তো আর কিছু সুরাহা হয় না। মায়ের প্রাণ উতলা হয়, বাপের প্রাণেই কি একেবারে কিছু হয় না? আর একটু ক্ষুব্ধ হাসি হাসলেন রামকালী।

ভুবনেশ্বরীর পক্ষে এ কথার জবাব দেওয়া সম্ভব নয়।

অপ্রতিভ হয়ে বসে থাকে বেচারা।

একটু পরে রামকালী বলেন, যাও, ভগবানের নাম স্মরণ করে শুয়ে পড় গে। দেখি যদি নিয়ে আসতে পারি।

ভুবনেশ্বরী সহসা আবার কেঁদে ভেঙে পড়ে বলে, আমার মন বলছে ওরা পাঠাবে না।

রামকালী আর কিছু বলেন না, দুর্গা দুর্গা বলে পাশ ফিরে শুয়ে পড়েন। ভুবনেশ্বরী অনেকক্ষণ কেঁদে অবশেষে এসে শোয়।

পরদিন মেয়ের বাড়ি যাত্রার আয়োজন করেন রামকালী।

.

ইংরিজি পড়া আপাতত বন্ধ আছে, কারণ ভবতোষ মাস্টার গ্রামে নেই। ছাত্রদের জন্য সেকেণ্ড বুক সংগ্রহ করতে কলকাতায় গেছে। নবকুমারের তাই এখন অবসর। কিন্তু হায়, অবসরকে কুসুমমণ্ডিত করে তুলবে, এ ভাগ্য নবকুমারের কই? বাড়িতে যে দু-দণ্ড বিশ্রামসুখ উপভোগ করবে, খাবে মাখবে থাকবে, তারও জো নেই। সেখানে জাগন্ত অবস্থায় যতক্ষণ থাকে ততক্ষণই হৎকম্প হতে থাকে তার।

কিন্তু ঘুমন্তই বা থাকে কতক্ষণ?

রাত্রে এখন আর সেই মহিষ-বিনিন্দিত ঘুম নেই নবকুমারের। বিছানায় শুয়ে ঘুম আসে না, ওঠে, বসে, পায়চারি করে, জল খায়, আবার শোয়, এইভাবে অনেকটা সময় কাটে। দিনের বেলা কর্মহীনের কর্ম, নিষ্কর্মার গতি পুকুরে ছিপ ফেলা।

বন্ধু নিতাই আর সে দুজনে সারা দুপুর সেই কাজটা করে। আজও করছিল। ফাত্মা থেকে চোখ তুলতে হঠাৎ চোখে পড়ল নিতাইয়েরই।

বলল, অমন বাহারে পালকি চড়ে কে আসছে বল্ দিকি?

নবকুমার তাকিয়ে বলল, তাই তো! দিব্যি পালকিখানা! তবে আসছে না বোধ হয়, গাঁ পার হচ্ছে।

বলল কিন্তু দুজনের একজনও চোখ ফেরাতে পারল না।

আর কম্পিত চিত্তে ভীত পুলকে দেখল পালকি তাদের দিকেই আসছে।

নবকুমার বলল, ছিপ ফেলে রেখে চো চো দৌড় দিই আয়।

নিতাই সবিস্ময়ে বলে, কেন, পালাব কেন?

আমার মন বলছে এ পালকি নিত্যেনন্দপুরের।

আঁ! চিনিস বুঝি?

চিনব কেন, অনুমান। মেয়ে নিতে পাঠিয়েছে নিয্যস। নিতাই, আমি পালাই।

নিতাই ওর কোঁচার খুঁট চেপে ধরে বলে, পালাবি মানে? হেস্তনেস্ত দেখবি না?

আর একটু তর্কাতর্কি হয় দুই বন্ধুতে এবং সত্যি বলতে, নবকুমার যতই পালাবার চিন্তা করুক, নড়তেও পারে না। টিকটিকির শিকারী দৃষ্টির সম্মোহনী শক্তিকে আকর্ষিত কীটের মত নির্জীব হয়ে বসে থাকে।

পালকি এই দিকেই আসে, আরোহীর নির্দেশে বেহারারা এখানেই নামায়, এবং আরোহী না নেমেই হাতছানি দিয়ে ডাকেন ওদের। ঘাটের ধার থেকে দুজনেই উঠে আসে কেঁচার খুঁটটা টেনে গায়ে দিতে দিতে।

তোমরা এ গ্রামের?

ভরাট গম্ভীর এই কণ্ঠস্বরে বুক কেঁপে ওঠে দুজনেরই। এবং যদিও নবকুমার শ্বশুরকে চেনে না, বিয়ের সময় তাকিয়ে দেখেও নি, দু-দুবার ষষ্টিবাটায় নেমন্তন্ন করেছিল, অসুখের ছুতো করে যায় নি। ভয়েই যায় নি। তবু তার মন বলতে থাকে, এ সেই! এ সেই!

হ্যাঁ, রামকালীই। তিনি ওদের ঘাড়নাড়া উত্তরের পর আবার বলেন, এ গ্রামের ছেলে, না ভাগিনেয়?

নিতাই এগিয়ে এসে বলে, আজ্ঞে আমি ভাগিনেয়, শ্ৰীযুক্ত কৃষ্ণধন দত্ত আমার মাতুল। আমার নাম নিতাইচন্দ্র ঘোষ। আর এই বাঁড়ুয্যে বাড়ির ছেলে নবকুমার বাঁড়ুয্যে। আমার বন্ধু।

নবকুমার বাঁড়ুয্যে!

রামকালীর দুই চোখে একটা বিদ্যুতের আভা খেলে যায়, নিশ্চিন্ত হন অনুমান ঠিক। আর একবার ভাল করে আপাদমস্তক দেখে নেন ছেলেটার। দেখে নেন ওর মেয়েলী মেয়েলী দুধেআলতা গোলা রং, আলতা-গোলা ঠোঁট, আর রোদে ঝলসানো টুকটুকে লালরঙা মুখ। তার পর নেমে আসেন পালকি থেকে।

গম্ভীরতর স্বরে বলেন, আমি রামকালী চাটুয্যে!

বসে পড়বার একটা সুযোগ পেয়েই বোধ হয় বেঁচে যায় ছেলে দুটো, তাড়াতাড়ি বসে পড়েই রামকালীর চরণ-বন্দনা করে।

থাক থাক বলে উভয়ের মাথাতেই একটু হাতের স্পর্শ দিয়ে রামকালী একবার নিতাইয়ের দিকে দৃষ্টিক্ষেপ করে নবকুমারকে উদ্দেশ করে বলেন, এ যখন তোমার বন্ধু, তখন এর সামনে কথা বলতে বাধা নেই, জিজ্ঞেস করছি, এইভাবে মাছ ধরেই দিন কাটাও নাকি?

নবকুমারের থুতনি বুকে ঠেকে। কিন্তু কায়স্থ বংশধর নিতাই, ওর থেকে অনেক চটপটে চৌকস। আর নিভীকও বটে।

সে তাড়াতাড়ি বলে, না আজ্ঞে, অন্যদিন দুপুরবেলা আমরা মাস্টারের বাড়ি পড়তে যাই। আজ তিনি–

কি পড়তে যাও?

নবকুমার পিছন থেকে প্রবল চিমটি কেটে বন্ধুকে নিষেধ করে যাতে ইংরিজি পড়াটার কথা না বলে ফেলে। বলা যায় না, ম্লেচ্ছ ভাষা অধ্যয়নের সংবাদে ক্ষেপে ওঠেন কিনা এই ভয়ঙ্কর লোকটা!

ভয়ঙ্কর?

অন্তত নবকুমারের তাই লাগছে।

কিন্তু নিতাই নিষেধের মান্য রাখে না। বরং একটু বিনয়-আচ্ছাদিত গর্বিত ভঙ্গীতেই বলে, আজ্ঞে ইংরিজি।

ইংরিজি! তা বেশ। কতদূর পড়েছ?

ফার্স্ট বুক সেকেণ্ড বুক সারা হয়ে গেছে আজ্ঞে। এখন

ভাল, শুনে সুখী হলাম। তা আজ পড়তে যাও নি যে?

প্রশ্নটা নবকুমারকে, তবু উত্তরটা দেয় নিতাই-ই, মাস্টার মশাই বই আনতে কলকাতায় গেছেন।

কলকাতায়! ওঃ! হুঁ। যাক বাবাজী, তোমার সঙ্গে একটা কথা আছে। জানতে চাইছি, গ্রামে তোমাদের কোন শত্রু আছে?

শত্রু!

নবকুমার বিহ্বলভবে তাকিয়ে থাকে।

কোনও শত্রু! এলোকেশীর মতে তো গ্রামসুদ্ধ সকলেই তাদের শত্রু।

হ্যাঁ, শত্রু। মানে যে তোমাদের অনিষ্টকামী। মিথ্যা অপবাদ রটিয়ে তোমাদের ক্ষতি করতে চায়। এমন কোনও লোক আছে মনে হয়?

নবকুমার আস্তে আস্তে নেতিবাচক মাথা নাড়ে, কিন্তু ততক্ষণে নিতাই অন্য উত্তর দিয়ে বসেছে, আজ্ঞে গায়ে তো সবাই সবাইয়ের শত্রু। ওই ওপরেই দেখন-হাসি। আর নবুর মার মেজাজের জন্যে তো

থাক ও কথা–, মৃদু ধমক দিয়ে ওঠেন রামকালী, মেঘমন্দ্র স্বরে বলেন, গ্রামের সকলের হাতের লেখা চেন? বলতে পার এ লেখা কার?

মেরজাইয়ের পকেট থেকে চিঠিখানা বার করে সামান্য একটু মেলে ধরেন রামকালী।

কিন্তু মেলে ধরবার দরকারই বা কি, ওরা তো জানে এ লেখা কার! ভবতোষ মাস্টারের। আর লেখার প্রেরণা নিতাই নিজে। মাস্টারের কাছে হতভাগ্য নবকুমারের ধর্মপত্নীর যন্ত্রণাময় জীবনের কাহিনী দিব্য বিশদ করেই বলেছিল সে, এবং সহসা ভবতোষ মাস্টার ঘোষণা করেছিল, আচ্ছা, আমি এর প্রতিকার সাধনে যত্নবান হব। সাহেবদের দেশে কদাপি কেউ স্ত্রীজাতির প্রতি নির্যাতন সহ্য করে না।

কি, চিনতে পারলে বলে মনে হয়?

দুজনেই প্রবল বেগে মাথা নাড়ে। বলা বাহুল্য নেতিবাচক। হ্যাঁ বলে কে সিংহের মুখবিবরে মাথা গলাতে যাবে?

ঠিক আছে। আমি তোমাদের ওখানেই যাচ্ছি। তোমার বাবা বাড়ি আছেন অবশ্যই!

আছে। অস্ফুট এই শব্দটি এতক্ষণে রামকালীকে নিশ্চিন্ত করে, তাঁর জামাতা বাবাজী বোবা নয়।

পালকি-বেহারাদের ডেকে জনান্তিকে কি যেন নির্দেশ দিয়ে রামকালী বলেন, চল, এটুকু তোমাদের সঙ্গে হেঁটেই যাই।

আমি আজ্ঞে একটু দৌড়ে গিয়ে খবরটা দিয়ে আসি, বলেই বন্ধু নিতাই বিশ্বাসঘাতকের মত নবকুমারকে অথই জলে ফেলে রেখে দৌড় মারে।

রামকালী কয়েক পা অগ্রসর হয়ে সহসা স্বভাব-বহির্ভূত স্বরে একটা প্রশ্ন করে বসেন, আমার মেয়ে কি তোমাদের গৃহে কোন উৎপাত ঘটাচ্ছে?

আঁ–আজ্ঞে, সে–এ কী!

তোতলা হয়ে ওঠে নবকুমার।

না, তাই প্রশ্ন করছি। সে বালিকা মাত্র, অবুঝ হওয়া অসম্ভব নয়।

আঁ–অজ্ঞে! না-না।

কালঘাম ছুটে যায় নবকুমারের। সে গায়ের একমাত্র আচ্ছাদন কোঁচার খুঁটটুকু টেনে কপালের ঘাম মুছতে থাকে।

রামকালী মৃদু হাস্যে বলেন, অধীর হবার কিছু নেই, আমি কৌতূহলপরবশ হয়ে প্রশ্ন করেছিলাম মাত্র। যাক, আমি যার জন্য এসেছি তোমাকে জানাই, কারণ তুমি আমার জামাতা। বাড়িতে একটি শুভ কাজ আসন্ন, সে কারণ আমার নাকে আমি নিয়ে যেতে মনস্থ করেছি। বিবাহের সময় অবশ্য যথারীতি নিমন্ত্রণ আসবে, তুমি এবং তোমার পিতা যাবে। তোমাকে কয়েকদিন থাকবার জন্য মেয়েরা অনুরোধ করতে পারেন, সে সম্পর্কে আমি তোমার পিতা-মাতাকে জানিয়ে যাব। থাকবার জন্যে প্রস্তুত থেকো।

এ সবের আর কি উত্তর দেবে নবকুমার?

ভয়ে আর আনন্দে, আশায় আর উৎকণ্ঠায় তার তো মুহুর্মুহু স্বেদ-কম্পপুলক দেখা দিচ্ছে।

বাড়ির দরজার কাছাকাছি আসতেই নবকুমার সহসা কাতরকণ্ঠে বলে ওঠে, আমি যাই।

কি আশ্চর্য, যাবে কেন?

হ্যাঁ, আমি যাই। নিতাই আছে– বলে এদিক ওদিক তাকিয়ে শ্বশুরের পায়ের কাছে মাটিতে একটা খাবল দিয়ে ছুট মারে নবকুমার।

রামকালী সেদিকে চেয়ে একটা নিঃশ্বাস ফেলেন।

লেখাপড়া শিখছে?

কিন্তু মানুষ হচ্ছে কি?

ঠিক এই সময় নিতাই নবকুমারদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে, আর নীলাম্বর বাঁড়ুয্যে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে একটি সুনিপুণ হাস্য সহযোগে বলেন, বেহাই মশাই যে? কী মনে করে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *