১৯. লক্ষ্মীকান্ত বাড়ুয্যে মারা গেলেন

লক্ষ্মীকান্ত বাড়ুয্যে মারা গেলেন।

পুণ্যবান মানুষ, নিয়মের শরীর, ভুগলেন না ভোগালেন না, চলে গেলেন সজ্ঞানে। সকালেও যথারীতি স্নান করেছেন, ফুল তুলেছেন, পূজো করেছেন। পূজো করে উঠে বড় ছেলেকে ডেকে বললেন, তোমরা আজ একটু সকাল সকাল আহারাদি সেরে নাও, আমার শরীরটা ভাল বুঝছি না, মনে হচ্ছে ডাক এসেছে।

বড় ছেলে হতচকিত হয়ে তাকিয়ে থাকে, বোধ করি ধারণাও করতে পারে না, লক্ষ্মীকান্তর শরীর খারাপের সঙ্গে তাদের আহারাদি সেরে নেওয়ার সম্পর্ক কোথায়? আর ‘ডাক’ কথাটারই বা অর্থ কি?

লক্ষ্মীকান্ত ছেলের ওই বিহ্বলতায় হাসলেন। হেসে বললেন, আহারাদি সেরে দুই ভাই আমার কাছে এসে বসবে, কিছু উপদেশ দিয়ে যাব। অবশ্য উপদেশ দেবার অধিকার আর কিছুই নয়, কতটুকুই বা জানি, জগৎকে কতটুকুই বা দেখেছি, তবু বয়সের অভিজ্ঞতা। বধূমাতাদের জানিয়ে দাও গে, রান্না কতকগুলি পদ বাড়িয়ে যেন বিলম্ব না করেন।

বাপ কেবল তাদের খাওয়ার কথাই বলছেন। কিন্তু তাঁর নিজের?

বড় ছেলে রুদ্ধ কণ্ঠে বলে, আপনার অন্নপাক কখন হবে?

এই দেখ বোকা ছেলে, বিচলিত হচ্ছ কেন? আমার আজ পূর্ণিমা, অন্ন নেই। ফলাহার একটু করে নেব, নারায়ণের প্রসাদ। প্রসাদে চিত্তশুদ্ধি, দেহশুদ্ধি।

ছেলে গিয়ে ছোট ভাইয়ের কাছে ভেঙে পড়ল। তার পর অন্তঃপুরিকারা টের পেলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই সমস্ত সংসারে শোকের ছায়া নেমে এল। কেউ অবিশ্বাস করল না, কেউ হাস্যকর বলে উড়িয়ে দিল না, অমোঘ নিশ্চিত বলে ধ্বসে পড়ল।

বাড়ূয্যের সংসার থেকে এ সংবাদ সঙ্গে সঙ্গেই বাইরেও ছড়িয়ে পড়ল, কারণ আগুন কখনো এক জায়গায় আবদ্ধ থাকে না।

মুহূর্তে চারিদিকে প্রচার হয়ে গেল, বাড়ুয্যে যে চললেন!

যেন বাঁড়ুয্যে কোন বিদেশভ্রমণে যাচ্ছেন, নৌকো ভাড়া হয়ে গেছে, সঙ্গীরা প্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কোথাও।

.

উঠোনে তুলসীমঞ্চের নীচে লক্ষ্মীকান্তের শেষ শয্যা বিছানো হয়েছে, বালিশে মাথা রেখে দুই হাত বুকে জড়ো করে টানটান হয়ে শুয়ে আছেন তিনি সোজা।

কপালে চন্দনলেখায় হরিনাম, দুই চোখের উপর-পাতায় আর দুই কানে চন্দন মাখানো তুলসীপাতা। বুকের উপর ছোট্ট একটি হাতে-লেখা পুঁথি। লক্ষ্মীকান্তর নিজেরই হাতের লেখা, গীতার কয়েকটি শ্লোক। নিত্য পাঠ করতেন, সেটি সঙ্গে দেওয়া হচ্ছে।

যাত্রাকালে কেউ স্পর্শ করবে না, যাত্রীর নিষেধ। বিছানাটি ছেড়ে আশেপাশে মাথা হেঁট করে বসে আছে ছেলেরা, পাড়ার কর্তাব্যক্তিরা। অন্তঃপুরিকারা আলম্ব ঘোমটায় আবৃত হয়ে বসে নীরবে অশ্রু বিসর্জন করছেন।

মৃত্যুর দণ্ডকাল অতীত না হওয়া পর্যন্ত ডাক ছেড়ে কাঁদা চলবে না, সেটাও নিষেধ। ক্রন্দনধ্বনি আত্মার ঊর্ধ্বগতির পথে বিঘ্ন ঘটায়।

বাঁড়ুয্যে-গিন্নীও সেই নিষেধাজ্ঞা শিরোধার্য করে নিঃশব্দে ডুকরোচ্ছেন।

ঘোষাল এসে দাঁড়ালেন।

কাঁপা গলায় বলে উঠলেন, জনকরাজার মত চললে বাঁড়ুয্যে?

লক্ষ্মীকান্ত মৃদু হেসে মৃদুস্বরে বললেন, বিদেশ থেকে স্বদেশে। বিমাতার কাছ থেকে মাতার কাছে।

তারপর ছেলেদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “তারক ব্রহ্ম।”

অর্থাৎ বৃথা কথায় কালক্ষেপ নয়।

নমো নারায়ণায় নমো নারায়ণায়, হরের্নামৈব কেবলম্।

আস্তে আস্তে চোখের পাতা দুটি বুজলেন লক্ষ্মীকান্ত। তুলসীপাতা দুটি ঢেকে দিল দুটি চোখের

নিঃশ্বাসের উত্থান-পতনের সঙ্গে সঙ্গে নামজপ হতে থাকল ভিতরে, যতক্ষণ চলল শ্বাসের ওঠাপড়া।

একসময় থামল।

যাক, বয়স হয়েছিল লক্ষ্মীকান্তর, ভুগলেন না ভোগালেন না, চলে গেলেন, এতে দুঃখের কিছু নেই। অন্তত দুঃখ করা উচিত নয়। মানুষ তো মরবার জন্যেই এসেছে পৃথিবীতে, সেই তার সর্বশেষ, আর সর্বশ্রেষ্ঠ কর্মটি যদি নিপুণভাবে নিখুঁতভাবে করে যেতে পারে, তার চাইতে আনন্দের আর কি আছে?

না, লক্ষ্মীকান্তর মৃত্যুতে দুঃখের কিছু নেই।

তবু নিকট-আত্মীয়রা দুঃখ পায়।

মায়াবদ্ধ জীব দুঃখ না পেয়ে যাবে কোথায়?

কিন্তু নিকট-আত্মীয় না হয়েও একজন এ মৃত্যুতে দুঃখের সাগরে ভাসে, সে হচ্ছে সারদা।

শ্রাদ্ধ উপলক্ষে নতুন কুটুম্বকে নিমন্ত্রণ জানিয়েছে বাঁড়ুয্যের ছেলেরা আর নিয়মভঙ্গ অবধি থাকার আবেদন জানিয়ে রাসুকে নিতে লোক পাঠিয়েছে।

তুলনা হিসেবে বলতে গেলে সারদার মাথায় একখানা ইট বসিয়েছে।

নিয়ে যাবে পরদিন। কথা চলছে সারাদিন।

এ বাড়ি থেকে রামকালী খবর শোনামাত্র একবার দেখা করে এসেছেন, এবং যথারীতি হবিষ্যান্নের যোগাড় পাঠিয়েছেন লৌকিকতা হিসাবে। প্রচুরই পাঠিয়েছেন।

এখন আবার রাসুর সঙ্গে লোক যাবে, শ্রাদ্ধের ‘সভাপ্রণামী’ আর সমগ্র সংসারের ঘাটে ওঠার কাপড়চোপড় নিয়ে। নিয়মভঙ্গের দিন দুপুরে জাল ফেলানো হবে, মাছ যাবে, রাসুর শাশুড়ীদের জন্য সিঁদুর আলতা পান সুপারি যাবে।

এই সব আলোচনাই চলছে সারাদিন।

সারদার মনে হচ্ছে, সবই যেন বড্ড বেশী বাড়াবাড়ি হচ্ছে।

এই যে তার বাবার খুড়ী মারা গেলেন সেবার, কই এত সব তো হয় নি!

যাক, সে কথা যাক।

পয়সা আছে বিলোবে।

কিন্তু সারদার খাস তালুকটুকু না এই উপলক্ষে বিকিয়ে যায়!

রাতে ছাড়া কথা কওয়ার উপায় নেই, স্পন্দিতচিত্তে সংসারের কাজ সারে সারদা, আর প্রহর গোনে।

তবু কুটুমদের একটু আক্কেল আছে, দিনে দিনেই নিয়ে চলে যায় নি, একটা রাত হাতে রেখেছে।

এ বাড়ির খাওয়া-দাওয়া মিটতে রাতদুপুর হয়ে যায়।

তবু একসময় আসে সেই আকাক্ষিত সময়।

দরজায় হুড়কো লাগিয়ে দেওয়া যায় এবার, সমস্ত সংসার থেকে পৃথক হয়ে এসে বসা যায় দুটো মানুষ।

চট করে কথা বলা সারদার স্বভাব নয়

প্রথমটা যথারীতি প্রদীপ উসকোয়, এলাপের শিখার ওপর বাটি ধরে ছেলের দুধ গরম করে, ছেলে হলে দুধ খাওয়ায়, তার পর তাকে শুইয়ে চাপড়ে তার ঘুম সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে এদিকে এসে পা ঝুলিয়ে বসে।

শব্দ করে নিঃশ্বাস ফেলে।

তারপর?

রাসু অবশ্য এ প্রশ্নের জন্য প্রস্তুতই ছিল, তাই নির্লিপ্ত স্বরে বলে, যাওয়া ছাড়া যে উপায় দেখছি না।

উপায় খুঁজে বেড়াচ্ছিলে বুঝি? ব্যঙ্গ-তীক্ষ্ণ সুর।

খুঁজে আর কি বেড়াব? জানি তো ছাড়ান-ছিড়েন নেই!

চেষ্টা থাকলে ছাড়ান। আরও তীক্ষ্ণ হুল ফোঁটায় সারদা।

কি করে শুনি? ঈষৎ উষ্মা প্রকাশ করে রাসু।

শরীর খারাপের ছুতো দেখাতে পারলে কেউ টেনে নিয়ে যেতে পারে না।

রাসু বিরক্তভাবে বলে, সে ছুতোটা দেখাব কি করে শুনি, এই আঁকাড়া দেহখানা নিয়ে?

সারদা এ বিরক্তিতে ভয় পায় না, দমে না। অম্লান বদনে বলে, চেষ্টা থাকলে কি না হয়। বলকা দুধ তোমার ধাতে অসৈরণ, লুকিয়ে সের দু-তিন কাঁচা দুধ চুমুক দিয়ে খেয়ে ফেললেই এখুনি এককুড়ি বার মাঠে ছুটতে হত। অসুখ বলে টের পেত সবাই। গুরুজনের সঙ্গে মিছে কথাও বলা হত না।

তা এটা আর মিছে ছাড়া কি? মিছে কথা না হয়ে, হয় মিথ্যে আচরণ!

নীতিবাগীশ রাসু জোর দিয়ে বলে।

থামো থামো, সারদা তীব্র প্রতিবাদ করে ওঠে, এটুক তো আর কখনো করো না গোসাইঠাকুর! ফটা বটঠাকুরদের বাড়ি থেকে পাশা খেলে দেরি করে ফিরে সদর দিয়ে না ঢুকে খিড়কি দিয়ে ঢোকা হয় কেন শুনি? মেজকাকা মশাই যে সমস্কৃত পড়ার টোল ঠিক করে দিয়েছেন, সেখানে তো মাসের মধ্যে দশ দিন কামাই দাও, সে কথা জানাও ওনাকে? নিত্যিনিয়মে বেরিয়ে এখান-ওখান করে বেড়াও না? আমাকে আর তুমি ধম্ম দেখাতে এস না!

আমি কাউকে কিছু দেখাতে চাই না, বীরপুরুষ রাসু বলে, গুরুজন যা নির্দেশ দেবে মানব, ব্যস।

তা তো মানবেই। সেখানে যে মধু আছে। নতুন বাগানের নতুন ফুল। পাটমহলের পাটরাণী।

বাজে কথা বলো না।

বাজে কথা বটে!

সারদা আর একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলে, আমার গা ছুঁয়ে প্রিতিজ্ঞে করেছিলে, সে কথা মনে পড়ছে?

পড়বে না কেন? তা আমি তো আর জামাইষষ্ঠীর নেমন্তন্ন খেতে যাচ্ছি না। যাচ্ছি একটা মান্যমান লোকের শ্রাদ্ধয়।

তার সঙ্গে আমারও শ্রাদ্ধ-পিণ্ডির ব্যবস্থা হচ্ছে, অন্তরেই জানছি। এবার নিঘঘাত তারা মেয়ে পাঠাবার কথা কইবে।

রাসু তেড়ে ওঠার ভান করে বলে, তোমার যেমন কথা! নিজে থেকে কেউ মেয়ে পাঠাবার কথা বলে?

বলে বৈকি। ক্ষেত্তর বিশেষে বলে। সতীনের ওপরে পড়া মেয়ের কথায় বলে।

বলি তার ঘরবসতের বয়েসটা হবে, তবে তো? তুমি যেন রাতদিন দড়ি দেখে ‘সাপ’ বলে আঁতকাচ্ছ।

বয়েস! সারদা তীব্র ঝঙ্কারে বলে ওঠে, মেয়েমানুষের বয়েস হতে আবার কদিন লাগে? দশ পেরোলেই বয়স। আর মেজকাকা মশাইয়ের কড়াকড়ির জারিজুরি তো ভেঙে গেল। নিজের মেয়েকেই যখন বয়েস না হতেই পাঠালেন!

গুরুজনের কাজের ব্যাখ্যান করো না। কারণ ছিল তাই এ কাজ করেছেন

সারদা দুর্বার, সারদা অদম্য।

সেও সমানে সমানে জবাব দেয়, তা তোমার দ্বিতীয় পক্ষকে শ্বশুরঘর করতে নিয়ে আসারও একটা কারণ আবিষ্কার হবে। তবে এই জেনে রাখো, নতুন বৌ যদি আসে, সেও এক দোর দিয়ে ঢুকবে, আমিও আর এক দোর দিয়ে দড়ি-কলসী নিয়ে বেরিয়ে যাব।

অস্ত্রটা মোক্ষম।

রাসু এবার কাবু হয়।

আপসের সুরে বলে, আচ্ছা অত পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে দুঃখু ডেকে আনবার কি দরকার তোমার বলো তো? যাচ্ছি দাদাশ্বশুরের শ্রাদ্ধয়, খাব মাখব চলে আসব, ব্যস! আমি কি কাউকে আনতে যাচ্ছি?

তা সে। মনে রাখলেই হল।

সারদা সহসা রাসুর একটা হাত টেনে নিয়ে ঘুমন্ত ছেলের মাথায় ঠেকিয়ে দিয়ে বলে, তবে সত্যি করে যাও সেকথা!

আ ছি ছি! কি মতিবুদ্ধি তোমার! ছেলের মাথায় হাত দিয়ে

সারদা অকুতোভয়ে বলে, তাতে ভয়টা কি? আমায় বলো না খোকার মাথায় হাত দিয়ে দিব্যি করতে– জীবনে কক্ষনো পরপুরুষের দিকে চোখ তুলে চাইব না, একশ বার সে দিব্যি করব।

চমৎকার বুদ্ধি! সেটা আর এটা এক হল?

কেন হবে না? আমি ছাড়া জগতের আর সকল মেয়েমানুষকে পরস্ত্রী ভাবলে কোন কষ্ট নেই!

বাঃ, যাকে অগ্নিনারায়ণ সাক্ষী করে গ্রহণ করলাম-

ও! সারদা ঝট করে উঠে দাঁড়ায়। দরজার খিলটা খুলে ফেলে, কপাট ধরে দাঁড়িয়ে চাপা অথচ ভয়ঙ্কর একটা শব্দে বলে ওঠে, ও বটে! এতক্ষণে প্রকাশ পেল মনের কথা! তা এতক্ষণ না ভুগিয়ে সেটা বললেই হত! আচ্ছা–

রাসুও অবশ্য এবার ভয় পেয়েছে, সেও নেমে এসে বলে, আহা, তো কপাট খুলছ কেন? যাচ্ছ কোথায়?

যাচ্ছি সেইখানে, যেখানে খলকাপট্য নেই, আগুনের জ্বালা নেই। বলে ঝট করে বেরিয়ে পড়ে অন্ধকারে মিশিয়ে যায় সারদা।

নাঃ, আর কিছু করবার নেই!

নিরূপায় ক্ষোভে কিছুক্ষণ উঠেনের সেই গভীর রাত্রির নিকষ অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থেকে নিঃশব্দে কপাটটা ভেজিয়ে দিয়ে খাটের ওপর বসে পড়ে রাসু।

ঘাম গড়াচ্ছে সর্বাঙ্গ দিয়ে।

গরমে নয়, আতঙ্কে।

কিন্তু করবার কি আছে এখন? ঘর থেকে বেরিয়ে তো আর বৌ খুঁজে বেড়াতে পারবে না রাসু, মা-খুড়ীর ঘুম ভাঙিয়ে দুসংবাদটা জানাতেও পারবে না!

নিজের হাতে যদি করণীয় কিছু থাকে তো সে হচ্ছে নিজের হাতটা মুঠো পাকিয়ে নিজের মাথায় কিল মারা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *