৭. হিরোইন

হিরোইন
সপ্তম পরিচ্ছেদ

এক

অনেকগুলি নবীনা অভিনেত্রী সোমনাথকে ঘিরিয়া ধরিয়াছিল। নব বসন্তে যেমন প্রজাপতির ঝাঁক আসিয়া প্রস্ফুটিত গোলাপকে কেন্দ্র করিয়া নৃত্যোৎসব শুরু করিয়া দেয়, গন্ধে বিহ্বল হইয়া কেবল উড়িয়া উড়িয়া ফুলকে প্রদক্ষিণ করে, তেমনি এই তরুণীগুলি সোমনাথকে কেন্দ্র করিয়া বসন্তোৎসবের সমারোহ আরম্ভ করিয়া দিয়াছিল।

অন্যায় করে নাই; কারণ আজ বসন্তোৎসব—হোলি। এই মেয়েগুলির দেহে যেমন যৌবনের মদী, মনেও তেমনি অফুরন্ত রঙ্গরস। সকলে সুন্দরী নয়, কিন্তু সকলেরই অন্তরে রসোল্লাসের মাদকতা তাহাদের কমনীয় করিয়া তুলিয়াছে। আজ তাহারা একজোট হইয়া, রঙ ও আবীরের হাতিয়ারে সজ্জিত হইয়া সোমনাথের অফিস আক্রমণ করিয়াছিল এবং সোমনাথকে একাকী পাইয়া তাহাকে সম্পূর্ণ পরাভূত করিয়া দিয়াছিল। হাসির লহর, পিচকারির তরল বর্ণ-স্ফুরণ আবীর গুলালের চুণোচ্ছ্বাস চারিদিকের বায়ুমণ্ডলে রঙীন তরঙ্গ তুলিয়াছিল।

সোমনাথ এখন সিনেমা রাজ্যের একচ্ছত্র সম্রাট; সকলেই তাহাকে চেনে, সকলেই তাহাকে সম্ভ্রম করে। এই মেয়েগুলির সহিত কর্মসুত্রে সোমনাথের পরিচয় আছে; প্রত্যেকটি মনে মনে তাহারা প্রতি প্রীতিমতী। তাই আজ হোলির সুত্র ধরিয়া তাহারা তাহার সর্বাঙ্গে প্রীতির ঝারি উজাড় করিয়া দিয়া চলিয়া গেল।

অন্যের প্রীতি নিজের মনেও প্রীতির সঞ্চার করে। মেয়েরা চলিয়া গেলে সোমনাথ ভিজা কাপড়-চোপড় পরিয়াই বসিয়া রহিল এবং স্মিতমুখে তাহাদের কথা ভাবিতে লাগিল। ইহার কেহ শ্যামলী কেহ গৌরী; কেহ প্রগভা, কেহ বা ঈষৎ গর্বিত। সোমনাথ শুধু ইহাদের চেনেই না, ইহাদের জীবনের গুঢ় কথাগুলিও তাহার জানা আছে। সিনেমা সমাজে কাহারও কোনও কথা গোপন থাকে না, সকলেই কাচের ঘরে বাস করে। ইহাদের জীবনে নিন্দার কথা অনেক আছে; কেহই নিষ্কলঙ্ক নয়, কেহই সতীসাধ্বী নয়। তবু—

ইহাদের নারীত্ব অবহেলার বস্তু নয়; সোমনাথ ইহাদের ঘৃণা করিতে পারে না! সত্য, ইহারা নারীত্বের ব্যবসা করে কিন্তু পণ্য মাত্রেই কি হেয়। ফুলও তো বাজারে বিক্রয় হয়; ফুল কি হেয়?

সোমনাথের মনের চিত্রপটে মেয়েগুলি একটি একটি করিয়া আসিয়া দাঁড়াইতে লাগিল। তাহাদের হাসি, চাহনি, দেহভঙ্গিমাতাহাদের চমক-ঠমক—

সোমনাথ মনের মধ্যে মগ্ন হইয়া গেল।

কি দোস্ত, একেবারে তন্ময় হয়ে গেছ যে!

সোমনাথ চমকিয়া উঠিল। পাণ্ডুরঙ বাহির হইতে আসে নাই, অফিসেই ছিল। তরুণীপুঞ্জের আকস্মিক আক্রমণে সে আত্মরক্ষার্থে পাশের ঘরে লুকাইয়াছিল। তরুণীরাও সোমনাথকে পাইয়া আর কাহারও খোঁজ লয় নাই। এখন বিপদ কাটিয়াছে দেখিয়া পাণ্ডুরঙ গুটি গুটি পাশের ঘর হইতে বাহির হইয়া আসিয়াছে।

সোমনাথের সম্মুখে বসিয়া পাণ্ডুর দুষ্টামিভরা হাসিল;—যাঁরা এসেছিলেন তাঁরা ধ্যানের পাত্রী বটে। তা—কোটির ধ্যান হচ্ছিল?

সোমনাথ অপ্রস্তুতভাবে বলিল—-আরে না না—

পীরের কাছে মামদোবাজি চলে না, সে চেষ্টা কোরো না। আর এতে লজ্জারই বা আছে কি? এতদিনে যদি তোমার প্রাণে রঙ ধরে থাকে–

কী পাগলের মত বকছ।

ভাই সোমনাথ, তোমাকে আমার জীবনের ফিলজফি বলি শোনোনা। তোমাদের ঐ সঙ্কীর্ণ অনুদার যৌন-নীতি আমি মানি না। এ বিষয়ে স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ আমার আদর্শ; অর্জুন আমার আদর্শ। আরও অনেক বড় বড় আদর্শ আছে। আমি আমার স্ত্রীকে ভালবাসি; সে আমার গৃহদেবতা; কিন্তু তাই বলে আমি অন্য মেয়ের পানে চোখ তুলে চাইব না, এত অধম আমি নই। তুমি এতদিন নিজের পথে চলেছ, আমি কোনও দিন তোমাকে বিপথে নিয়ে যাবার চেষ্টা করিনি; কিন্তু আজ যদি তোমার ভিন্ন পথে চলবার ইচ্ছে হয়ে থাকে, আমি বাধাও দেব না। এসব তুচ্ছ জিনিস, এদের বড় করে দেখতে নেই। আসল কথা হচ্ছে, দিল খাঁটি হওয়া চাই, ইমান দুরস্ত থাকা চাই। তবেই মানুষের মনুষ্যত্ব। তোমার যদি কারুর ওপর মন পড়ে থাকে তাতে লজ্জার কিছু নেই। ওটা বয়সের ধর্ম, প্রকৃতির লীলা—

চুপ কর পাণ্ডুরঙ, ওসব কথা আমার ভাল লাগে না।

তুমি মনকে চোখ ঠারছ সোমনাথ। একদিন ঘাড় মুচড়ে পড়বেই, তার চেয়ে চোখ খুলে পড়া ভাল। ঐ যে মেয়েগুলো আজ এসেছিল ওদের প্রত্যেকের মনের কথা আমি জানি। তোমার জন্যে ওরা পাগল। ওরা যখন পরের বাহুতে বাঁধা থাকে তখনও তোমার কথা ভাবে, ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে ওরা তোমার স্বপ্ন দেখে–

ছি পাণ্ডুরঙ-সোমনাথ উঠিয়া দাঁড়াইল—তুমি আমাকে লোভ দেখাবার চেষ্টা করছ।

পাণ্ডুরঙ নিশ্বাস ফেলিল।

লোভ দেখাইনি ভাই, অদৃষ্টের কথা ভাবছি। কেউ চেয়ে পায় না, আবার কেউ পেয়েও চায় না—এই দুনিয়া; কিন্তু যৌবনকে বঞ্চনা করলে আখেরে ভাল হয় না সোমনাথ; অন্তরের ভুখা এবান একদিন প্রতিশোধ নেবে–

সোমনাথ আর দাঁড়াইল না, বাড়ি চলিয়া গেল। যাইবার সময় পাণ্ডুরঙকে গম্ভীর কণ্ঠে ভর্ৎসনা হয় পেল—তুমি একটা নরকের কীট।

কিন্তু মুখে যত ভর্ৎসনাই করুক মনের কাছে তো লুকোচুরি চলে না। সোমনাথ মনে মনে এই মেয়েগুলির রূপযৌবনের চিন্তা করিতেছিল ইহা সে নিজে কি করিয়া অস্বীকার করিবে? নিজের কাছে ধরা পড়িয়া গিয়া তাহার অন্তরাত্মা যেন আর্তস্বরে চিৎকার করিয়া উঠিল। ছি ছি ছি। সে এ কি করিতেছে। তাহার মন তাহার একান্ত অজ্ঞাতসারে এ কোন্ আঁস্তাকুড়ে আসিয়া পৌঁছিয়াছে।

তাহার মন তো এমন ছিল না। তিন বছর আগে যখন সে এই সিনেমা ক্ষেত্রে প্রবেশ করে তখন তাহার মন দৃঢ় ছিল, নির্মল ছিল; পরস্ত্রীর প্রতি লব্ধতা তাহার ছিল না। মন লইয়া সে গর্ব করিতে পারিত; কিন্তু আজ কি হইয়াছে! কোন শিথিলতার ছিদ্রপথে এই দৌর্বল্য তাহার অন্তরে প্রবশে করিয়াছে? সব চেয়ে আশ্চর্য, তাহার মনে যে এমন ঘুণ ধরিয়াছে তাহা সে নিজেই এতদিন জানিতে পারে নাই।

লম্পট! কথাটা মনে আসিতেই তাহার শরীর সঙ্কুচিত হইয়া উঠিল। লোকে তাহাকে আড়ালে লম্পট বলিবে, প্রকাশ্যে চোখ টিপিয়া হাসিবে। ভদ্রলোকেরা তাহাকে দেখিয়া স্ত্রী কন্যা সামলাইবে। আর রত্না—সে কি ভাবিবে? ছি ছি ছি!

বাড়ি ফিরিয়া সোমনাথ ভিজা কাপড়-চোপড় ছাড়িয়া স্নান করিতে গেল। অশান্ত বিবেক-পীড়িত মন, অথচ বাড়িতে কথা কহিবার একটি লোক নাই; দিদি জামাইবাবু এখনও পুণায় আছেন।

স্নান করিতে করিতে তাহার ইন্দুবাবুর কথা মনে পড়িল। ইন্দবাবু একদিন তাহাকে ললিত ও লতার কাহিনী শুনাইয়াছিলেন। ললিতও ভাল ছেলে ছিল–

বৈকালবেলা সোমনাথ আবার মোটর লইয়া বাহির হইল; ইন্দুবাবুর বাসায় গিয়া উপস্থিত হইল।

ইন্দুবাবু তক্তাপোশের উপর পদ্মাসনে বসিয়া একটি লম্বা-চওড়া পুস্তক পাঠ করিতেছিলেন, সোমনাথকে দেখিয়া বই সরাইয়া রাখিলেন।

সোমনাথ জিজ্ঞাসা করিল—কি বই পড়ছেন?

ইন্দুবাবু একটু অপ্রতিভভাবে হাসিয়া বলিলেন—গীতা। একটা নতুন এডিশন বেরিয়েছে বেশ ভাল। তাই নেড়ে-চেড়ে দেখছিলাম। বইখানা আবার টানিয়া লইয়া পাতা উল্টাইতে উল্টাইতে বলিতে লাগিলেন—বঙ্কিম চার অধ্যায়ের বেশী টীকা লিখে যেতে পারেননি, বাঙ্গালাভাষার দুর্ভাগ্য। যদি শেষ করতে পারতেন, অমর গ্রন্থ হত।

গীতা সম্বন্ধে সোমনাথের কোনও জ্ঞানই ছিল না। গীতা ভগবদ বাক্য, যাহা সাধারণের বুদ্ধির অগম্য; আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে যেসব ছাত্র দর্শন পড়ে তাহারা পাশ্চাত্য দর্শন মুখস্থ করে কিন্তু ষড়দর্শনের খোঁজ রাখে না। সোমনাথেরও মনের ও-দিকটা অন্ধকারই ছিল। ইন্দুবাবু কথাপ্রসঙ্গে। আধ্যাত্মিক তত্ত্বের যে আলোচনা করিতে লাগিলেন সে তাহা বিশেষ কিছু বুঝিল না, কেবল নীরবে শুনিয়া গেল।

ইন্দুবাবু এক সময় বলিলেন—আমাদের দর্শনশাস্ত্র পড়বার সময় একটা বড় অসুবিধা হয়—পরিভাষা নিয়ে। কখন কোন পারিভাষিক শব্দ কী অর্থে ব্যবহার হয়েছে তা বোঝ শক্ত। টীকাকারেরাও সবাই নিজের কোলে ঝোল টেনেছেন, নানা মুনির নানা মত। এই দ্যাখো না, গীতায় এক জায়গায় বলা হয়েছে-বিষয় বস্তুর ধ্যান করতে করতে পুরুষের সে বিষয়ে আসক্তি জন্মায়; আসক্তি থেকে কাম জন্মায়; কাম থেকে ক্রোধ; ক্রোধ থেকে সম্মোহ, সম্মোহ থেকে স্মৃতিভ্রম; স্মৃতিভ্রম থেকে বুদ্ধিনাশ এবং বুদ্ধিনাশের ফলে মানুষ বিনাশ পায়। এই শ্লোকগুলিতে সব কথারই মানে বোঝা যায়, কেবল স্মৃতিবিভ্রম ছাড়া। এই স্মৃতিবিভ্রম বলতে ঠিক কি বোঝায় তুমি বলতে পার?

সোমনাথ বলিল—স্মৃতিবিভ্রম কথার সাধারণ মানে তো–

ইন্দুবাবু বলিলেন—সাধারণ মানে এখানে চলবে না, এটা পারিভাষিক শব্দ। আমার কি মনে হয় জানো? ইংরেজিতে যাকে sense of values বলে সেই মূল্যবোধ হারানোর নামই স্মৃতিবিভ্রম। মানুষ যখন এই জ্ঞান হারিয়ে ফ্যালে তখন তাকে রক্ষা করা শিবের অসাধ্য। তোমার কি মনে হয়?

সোমনাথ উঠিয়া পড়িল—আমি এসব কিছু বুঝি না। আচ্ছা, আর একদিন আসব। আপনি শাস্ত্রচর্চা করুন। বলিয়া সে বিদায় লইল।

আজ সোমনাথ ইন্দুবাবুর কাছে বিশেষ কোনও উদ্দেশ্য লইয়া আসে নাই; তাহার অস্থির মন তাহাকে টানিয়া আনিয়াছিল। সে ভাবিয়াছিল ইন্দুবাবুর সঙ্গে সাধারণভাবে কথাবার্তা বলিলেই তাহার মনটা সুস্থ হইবে; কিন্তু ইন্দুবাবুকে গীতায় মশগুল দেখিয়া সে নিরাশ হইল। তাহার মনের যে অবস্থা তাহাতে এই জাতীয় সুক্ষ্ম আলোচনা তাহার অপ্রাসঙ্গিক মনে হইল। সোমনাথের মনে কোনও অজ্ঞান ধর্মবোধ ছিল না, এ বয়সে তাহা থাকে না। যাহা ছিল তাহা রক্তগত শুচিতার সংস্কার। এই সংস্কারই তাহাকে অনেক বিপদে আপদে এতদিন রক্ষা করিয়া আসিয়াছে; কিন্তু বিরুদ্ধ। পরিবেশের মধ্যে দীর্ঘকাল থাকিলে জন্মগত সংস্কারও পঙ্গু হইয়া পড়ে মূল্যবোধ বিকৃত হয়। সোমনাথ যদি মন দিয়া গীতাবাক্য শুনিত তাহা হইলে হয়তো তাহার বর্তমান সঙ্কটও অনেকটা সরল হইয়া যাইত; কিন্তু সে যন্ত্রারূঢ়ের ন্যায় নিয়তির দ্বারা চালিত হইতেছিল। তাহার ভাগ্যদেবী তাহাকে লইয়া আবার নুতন খেলা খেলিবার উপক্রম করিতেছিল।

মোটরে লক্ষ্যহীনভাবে এদিক ওদিক ঘুরিয়া সে আবার স্টুডিওতে আসিয়া উপস্থিত হইল। স্টুডিওতে আজ ছুটি; কাজকর্ম কিছু নাই। তবু এই স্টুডিও তাহার মনের চারিপাশে এমন শিকড় বিস্তার করিয়া জড়াইয়া ধরিয়াছে যে কাজে অকাজে এ স্থানটি ছাড়িয়া থাকা তাহার পক্ষে অসম্ভব। হানাবাড়ির মত ইহার একটি অনিঝর্য মোহ আছে।

কিন্তু স্টুডিওতে পৌঁছিয়াই একটা সংবাদ বোমা বিস্ফোরণের মত তাহাকে প্রায় মুছহত করিয়া দিল। শম্ভুলিঙ্গ মহাশয় হঠাৎ কাঁদিতে কাঁদিতে আসিয়া বলিলেন—সোমনাথবাবু, আমার কি হবে? রুস্তমজি মারা গেছেন।

কী?

হ্যাঁ—এই ঘণ্টাখানেক হল। আজ হোলি; বন্ধু-বান্ধব নিয়ে খুব মদ খেয়েছিলেন, হঠাৎ হার্ট ফেল করে গেছে।

সোমনাথ মাথায় হাত দিয়া বসিয়া পড়িল।

.

রুস্তমজির মৃত্যু যেন চোখে আঙুল দিয়া সোমনাথকে পথ দেখাইয়া দিল।

তারপর এক হপ্তা কাটিয়াছে। রুস্তমজি উইল করিয়া যাইতে পারেন নাই, কিন্তু অনেক সম্পত্তি রাখিয়া গিয়াছেন। তাই ইতিমধ্যে সম্পত্তির উত্তরাধিকার লইয়াতাঁহার জ্ঞাতি গোষ্ঠীর মধ্যে মামলা শুরু হইয়া গিয়াছে। স্টুডিও আদালতের হেফাজতে রাখিবার কথা হইতেছে।

সোমনাথ অন্য অনেক চিত্র-প্রণেতার নিকট হইতে সাদর আমন্ত্রণ পাইতেছে; সকলেই তাহার হাতে চিত্র রচনার ভার তুলিয়া দিয়া নিশ্চিন্ত হইতে প্রস্তুত; সোমনাথ এই সাত দিনে নিজের ভবিষ্যৎ জীবনের ছক কাটিয়া যাত্রাপথ স্থির করিয়া ফেলিয়াছে; কোনও প্রলোভনই আর তাহাকে পথভ্রষ্ট করিতে পারিবে না।

এই কয় বৎসরে সে যাহা উপার্জন করিয়াছে তাহার মধ্যে প্রায় সাড়ে চার লক্ষ টাকা তাহার সঞ্চয় হইয়াছে। একটা মানুষের স্বচ্ছন্দ জীবনযাত্রার পক্ষে ইহাই কি যথেষ্ট নয়? উপরন্তু তাহার কর্মজীবন এখন তো শেষ হইয়া যাইতেছে না।

জামাইবাবুকে একটি দীর্ঘ পত্র লিখিয়া সে ডাকে দিল। তারপর বন্ধু ও সহকর্মীদের কাছে বিদায় ইল। পাণ্ডুরঙকে আলিঙ্গন করিয়া বলিল-কলকাতায় চললাম। আমার মোটরটা তুমি ব্যবহার কোরো।

পাণ্ডুরঙ ভারি গলায় বলিল—তুমি যেখানেই যাও, আমার ভালবাসা তোমার সঙ্গে থাকবে।

.

দুই

কলিকাতায় পৌঁছিয়া সোমনাথ হ্যারিসন রোডের একটি ভাল হোটেলে উঠিল। তাহার চেহারা দেখিয়া হোটেলের ম্যানেজার তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে চাহিলেন, কিন্তু সোমনাথ আত্মপরিচয় দিয়া একটা হৈ-হৈ বাধাইয়া তুলিতে রাজি নয়। বিখ্যাত অভিনেতা সোমনাথ চৌধুরী কলিকাতায় আসিয়াছে একথা রাষ্ট্র হইয়া পড়িলে, তাহার আর প্রাণে শাস্তি থাকিবে না, সময়ে অসময়ে, তোক দেখা করিতে আসিবে; কাগজে লেখালেখি হইবে। সে হোটেলের খাতায় ছদ্মনাম লিখাইল।

তারপর তাহার কাজ আরম্ভ হইল। বসিয়া থাকার কাজ নয়; অনেক ছুটাছুটির কাজ। উকিলের সহিত পরামর্শ, সরকারী দপ্তরে ঘাঁটাঘাটি, বড় বড় বিলাতী সওদাগরী অফিসে যাতায়াত, কলকব্জা খরিদ। তিন চার বার তাহাকে কলিকাতার বাহিরেও যাইতে হইল।

এইভাবে মাস দেড়েক কাটিল। তারপর একদিন হোটেলের সম্মুখেই একটি পুরাতন বন্ধুর সহিত তাহার দেখা হইয়া গেল।

সোমনাথ! তুমি হেথায়?

ইনি সেই শিক্ষক বন্ধু, যিনি সোমনাথের প্রথম ছবি বাহির হইবার পর প্রশস্তি জানাইয়া চিঠি লিখিয়াছিলেন এবং প্রসঙ্গান্তরে মিষ্টান্ন দাবি করিয়াছিলেন। ইনি জামাইবাবুর দুর সম্পর্কের আত্মীয়, তাহা পূর্বে বলা হইয়াছে।

সোমনাথ বন্ধুকে হোটেলে নিজের ঘরে আনিয়া বসাইল। অনেক দিন পরে সাক্ষাৎ; দুই বন্ধুতে অনেক মনের প্রাণের কথা হইল; কিন্তু সোমনাথ নিজের বর্তমান বৈষয়িক ভাবান্তরের কথা কিছু ভাঙিল না।

বন্ধু এক সময় জিজ্ঞাসা করিলেন–হঠাৎ এ সময় এলে যে! রত্নাকে দেখতে?

রত্নাকে দেখতে! কেন, কি হয়েছে?

সে কি, তুমি কিছু জানো না? আমি ভেবেছিলাম—

না, আমি কিছু জানি না।

বন্ধু বিস্মিত হইলেন—রত্না প্রায় এক বছর হল ভুগছে।

কি হয়েছে?

সত্যি কিছু জানো না? আমি ভেবেছিলাম রত্না আর তোমার মধ্যে একটা বোঝাপড়া–

না, তুমি ভুল বুঝেছ। রত্নার সঙ্গে আমার কোনও বোঝাপড়া নেই। সে মাঝে বার দুই বোম্বাই গিয়েছিল, দেখা হয়েছিল এই পর্যন্ত।–কিন্তু তার অসুখটা কী?

বন্ধু সাবধানে বলিলেন-তা ভাই আমি ঠিক জানি না। তবে শরীর সুস্থ নয়। তুমি তো জানো আমি ওদের দুঃস্থ আত্মীয়, বেশী মেলামেশা নেই। শুনেছি রত্নাকে মধুপুর না গিরিডিতে নিয়ে গিয়ে রাখবার কথা হয়েছিল; কিন্তু রত্না রাজি হয়নি। তোমার বোধহয় দেখা করা উচিত।

বন্ধু চলিয়া যাইবার পর সোমনাথ অনেকক্ষণ চুপ করিয়া বসিয়া রহিল।

সেই যে বছর দেড়েক আগে একটি ঝড়ের রাত্রে রত্না তাহার বাসায় রাত কাটাইয়াছিল, তারপর হইতে রত্নার কোনও খবরই সে রাখে না। তাহার এখনও বিবাহ হয় নাই; বিবাহ হইলে সোমনাথ নিশ্চয় খবর পাইত। হয়তো অসুখের জন্যই বিবাহ হয় নাই; নচেৎ বিবাহ না হইবার অন্য কোনও কারণ নাই। অসুখটা কী? বন্ধু যেন গুরুতর অসুখের ইসারা দিয়া গেলেন। তাহাকে দেখিতে যাওয়া কি সোমনাথের উচিত হইবে? রত্না সোমনাথের উপর বিরক্ত; হয়তো দেখা করিতে গেলে আরও উত্ত্যক্ত হইবে—

তবু সন্ধ্যার প্রাক্কালে সোমনাথ রত্নদের বাড়িতে গিয়া উপস্থিত হইল।

জামাইবাবুর দাদা কলিকাতার একজন প্রসিদ্ধ ডাক্তার। বালিগঞ্জে তাঁহার সুদৃশ্য দ্বিতল উদ্যানমধ্যবর্তী বাড়িটি তাঁহার শ্রীসমৃদ্ধির সাক্ষী।

গৃহস্বামী বাড়ি ছিলেন না; দিদির জা মনোরমা দেবী সমাদর করিয়া তাহাকে বসাইলেন। তিনি স্থূলকায় ও বহুভাষিণী; নচেৎ তোক ভাল।

এস ভাই। অনেক দিন তোমায় দেখিনি; অবিশ্যি ছবিতে অনেকবার দেখেছি। কী সুন্দর ছবিই করেছ! কে ভেবেছিল তোমার পেটে এত আছে! তাকবে এলে?

সোমনাথ ভাসা-ভাসা উত্তর দিল। দুচার কথার পর সে জিজ্ঞাসা করিল-রত্না কেমন আছে?

মনোরমা দেবী বলিলেন—রত্নার শরীর ভাল যাচ্ছে না ভাই। সেই যে ওবছর বর্ষার সময় বোম্বাই গিছল, সেখান থেকে ফিরে ওর শরীর খারাপ যাচ্ছে। তোমাদের বোম্বাই ভাল জায়গা নয়, যাই বল। কী লোগ যে নিয়ে এল, দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছে মেয়েটা। অথচ বাড়িতেই ডাক্তার; ওষুধ-বিষুধ সবই খাওয়ানো হচ্ছে; কিন্তু কিছুতেই ওর শরীর সারছে না।

সোমনাথ জিজ্ঞাসা করিল—রোগটা কি? মনোরমা গলা খাটো করিয়া বলিলেন-উনি তো প্রথমে সন্দেহ করেছিলেন বুঝি টিবি; কিন্তু এক্সরে করে কিছু পাওয়া যায়নি। ভগবানের দয়া। তবু খুব সাবধানে রেখেছি, বাড়ি থেকে বেরুনো বারণ—বেশী চলাফেরা বারণ—

এখন সে বাড়িতে আছে তো?

ওমা, বাড়িতে আছে বৈকি! ওপরে আছে—ওর দাদা বেশী ওপর নীচে করা মানা করে দিয়েছেন। তা ও কি শোনে? মাঝে মাঝে নেমে আসে। তুমি এসেছ সাড়া পেলে হয়তো এখনি নেমে আসবে। তা তুমি ওপরেই যাও না ভাই। তুমি তো বাড়ির ছেলে। এখন না হয় মস্ত লোক হয়েছ, কাক-কোকিলে নাম জানে। যাও, ওপরে যাও, আমি তোমার চা জলখাবার পাঠিয়ে দিচ্ছি।

দ্বিতলে গিয়া সোমনাথ একটি বদ্ধ দরজায় টোকা দিল। ভিতর হইতে রত্নার গলা আসিল-কে? ভেতরে এস।

সোমনাথ দ্বার ঠেলিয়া ঘরে প্রবেশ করিল। মেয়েলি ছাঁদে সাজানো পরিপাটি কক্ষ। এটি রত্নার নিজস্ব ঘর।

পশ্চিম দিকের জানালার সম্মুখে বসিয়া সন্ধ্যার পড়ন্ত আলোয় রত্না একখানা বই পড়িতেছিল। সোমনাথকে দেখিয়া সে সম্মোহিতের ন্যায় চাহিয়া রহিল। তাহার শীর্ণ মুখ হইতে রক্ত নামিয়া গিয়া মুখখানা যেন আরও পাংশু দেখাইল।

সোমনাথ তাহার কাছে গিয়া দাঁড়াইল, একটু হাসিবার চেষ্টা করিয়া বলিল—আমাকে কি চিনতে পারছ না?

না, পারছি না। এস—বোসো। কথাগুলি ব্যঙ্গোক্তি হইলেও রত্নার স্বর এত ক্ষীণ ও দুর্বল শুনাইল যে সোমনাথের বুকে তাহা সূক্ষ্ম শলাকার মতো বিধিল।

দুজনে একটি সোফায় বসিল। রত্না আরও কিছুক্ষণ সোমনাথের পানে চাহিয়া থাকিয়া বলিল—কি ভাগ্যি যে এলে! একেবারে ভুলে যাওনি তাহলে?

সোমনাথ একথার উত্তর অনেক ভাবে দিতে পারিত, কিন্তু আবেগভরে বলিয়া উঠিল—তুমি যে বড্ড রোগা হয়ে গেছ রত্না!

রত্না হাসিল। তাহার শীর্ণ মুখে হাসি ভাল মানাইল না। কপাল হইতে একগুচ্ছ রুক্ষ চুল সরাইয়া সে বলিল—ও কিছু নয়। তুমি কেমন আছ বল। হঠাৎ এ সময়ে কলকাতায় এলে যে! কাজকর্ম কি বন্ধ?

সোমনাথ কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল—সিনেমার কাজ ছেড়ে দিয়ে চলে এসেছি।

রত্না উচ্চকিতভাবে চাহিল।

সিনেমা ছেড়ে দিয়ে চলে এসেছ? ও-আবার কলকাতায় বাংলা ছবি করবে!

সোমনাথ মাথা নাড়িল।

না। সিনেমা করাই ছেড়ে দিয়েছি।

রত্না নিশ্বাস রোধ করিয়া চাহিয়া রহিল।

এই সময় একটি দাসী সোমনাথের জন্য চা ও জলখাবার লইয়া আসিল। ঘরে সন্ধ্যার ছায়া নামিয়াছিল, রত্না উঠিয়া সুইচ টিপিয়া আলো জ্বালিল। বলিল—ঝি, আমার জন্যেও এক পেয়ালা চা নিয়ে এস।

ঝি বলিল—তোমার যে এখন ডাক্তারী দুধ খাবার সময় দিদিমণি।

রত্না বিরক্ত হইয়া বলিল—না, চা নিয়ে এস।

ঝি চলিয়া গেল।

রত্না আবার গিয়া বসিল। সোমনাথ লক্ষ্য করিল রত্নর গালে ঈষৎ রক্ত সঞ্চার হইয়াছে, চক্ষু দুটিও যেন চাপা উত্তেজনায় উজ্জ্বল দেখাইতেছে। সে জলখাবারের রেকাবি টানিয়া আহারে মন দিল।

রত্না বলিল—এর মানে? সিনেমায় তো বেশ টাকা পাচ্ছিলে।

সোমনাথ বলিল—ছেড়ে দেবার ওটাও একটা কারণ। এই তিন বছরে যা পেয়েছি তাতে বাকি জীবনটা চলে যাবে।

কিছুক্ষণ চুপচাপ। তারপর রত্না বলিল—সিনেমায় এত শিগগির তোমার অরুচি ধরে যাবে তা ভাবিনি। ও পথে যে যায় তাকে বড় একটা ফিরতে দেখা যায় না। তোমার এই বৈরাগ্যের অন্য কোনও কারণ আছে নাকি?

সোমনাথ শান্তভাবে বলিল—আছে। রুস্তমজি মারা গেলেন সেটাও একটা কারণ। তা ছাড়া–

তা ছাড়া?

ঝি আসিয়া রত্নাকে চা দিয়া গেল। সোমনাথ নিজের চায়ের বাটি তুলিয়া লইয়া একটু হাসিল।

আর একদিনের চা খাওয়ার কথা মনে পড়ে? বাইরে ঝড়ের মাতন, সমুদ্রের আফসানি, তার মধ্যে টর্চের আলো জ্বেলে চা তৈরি করে খাওয়া?

রত্নার মুখখানা ক্ষণকালের জন্য কেমন যেন একরকম হইয়া গেল; তারপর সামলাইয়া লইল। বলিল—আসল কথাটা এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করছ যে! বল না—তা ছাড়া কী?

সোমনাথ ঈষৎ ক্ষুব্ধ স্বরে বলিল-কি হবে বলে? তুমি বিশ্বাস করবে না।

তবু বলই না শুনি।

নিঃশেষিত চায়ের পেয়ালা ধীরে ধীরে নামাইয়া রাখিয়া সোমনাথ বলিল—ইদানীং ভয় হয়েছিল বুঝি তোমার কথাই ফলে যায়–

আমার কথা?

হ্যাঁ। তুমি দিদিকে একবার লিখেছিলে, আমি যখন সিনেমায় ঢুকেছি তখন আমার পতন অনিবার্য। ইদানীং আমারও সেই ভয় হয়েছিল। তাই—পালিয়ে এলাম।

রত্নার পানে সসঙ্কোচে চোখ তুলিয়া সোমনাথ দেখিল, রত্নার করতলে চায়ের পেয়ালা থরথর করিয়া কাঁপিতেছে, এখনি পড়িয়া যাইবে। সে তাড়াতাড়ি পেয়ালা লইয়া সরাইয়া রাখিল। রত্নার মুখ আবার পাঙাস বর্ণ ধারণ করিয়াছে—ঠোঁট দুটি অসম্ভব কুপিতেছে।

কি হল রত্না?

রত্না প্রবল চেষ্টায় নিজেকে সম্বরণ করিল।

কিছু না। আমার শরীরটা একটু–। মাঝে মাঝে অমন হয়। তুমি আজ এস গিয়ে।

সোমনাথ এভাবে উঠিয়া দাঁড়াইল। মানসিক উত্তেজনা দুর্বল শরীরের পক্ষে ভাল নয়। সে বলিল—আচ্ছা, আমি যাচ্ছি। বড়দিদিকে পাঠিয়ে দেব?

না না, তার দরকার নেই। আমি আপনিই ঠিক হয়ে যাব।

আচ্ছা।

সোমনাথ দ্বার পর্যন্ত গিয়াছে, পিছন হইতে রত্না ডাকিল–শোনো।

সোমনাথ ফিরিয়া দাঁড়াইল।

আবার আসবে তো?

আসব; কিন্তু–

কবে আসবে?

সোমনাথ একটু চিন্তা করিয়া বলিল—কাল আমাকে বাইরে যেতে হবে। হপ্তাখানেক পরে ফিরব। তারপর আসব।

সন্তর্পণে দরজা ভেজাইয়া দিয়া সে চলিয়া গেল।

.

তিন

কলিকাতায় আসিয়া সোমনাথ একটি মোটর-লঞ্চ কিনিয়াছিল। পরদিন সকালবেলা সে কয়েকজন লোক সঙ্গে লইয়া লঞ্চে উঠিল; ভাগীরথীর আঁকাবাঁকা পথে নৌকা দক্ষিণ দিকে চলিয়া গেল।

এক হপ্তার মধ্যে ফিরিবার কথা, কিন্তু ফিরিতে সোমনাথের এগারো দিন লাগিল। যাহোক, কাজকর্ম সব সুচারুরূপে সম্পন্ন হইয়াছে।

কলিকাতায় ফিরিয়াই রত্নাদের বাড়ি গেল। আজ রত্নার দাদা বাড়িতে ছিলেন। বয়স্থ গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ, জামাইবাবুর মত রঙ্গ রসিকতা বেশী করেন না; কিন্তু ভিতরে রস আছে; বর্ণচোরা আম।

দেবেশবাবু বলিলেন—সেদিন এসেছিলে, দেখা হয়নি। এস তোমার সঙ্গে গল্প করি। বলিয়া নিজের বসিবার ঘরে লইয়া গেলেন।

দুজনে উপবিষ্ট হইলে দেবেশবাবু বলিলেন—শুনলাম তুমি সিনেমা ছেড়ে দিয়েছ?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

টাকা তো বেশ পাচ্ছিলে; নামও যথেষ্ট হয়েছে। তবে ছেড়ে দিলে যে। আর কি ভাল লাগল না?

আজ্ঞে না। সময় থাকতে ছাড়াই ভাল।

দেবেশবাবু একটু হাসিলেন—বেশ বেশ। কোনও জিনিসেই মোহ থাকা ভাল নয়।

সোমনাথ নীরব রহিল। দেবেশবাবু তখন বলিলেন—রত্না অনেক দিন ধরে ভুগছে। ও আমাদের বড় আদরের বোন; ভারি ভয় হয়েছিল। রোগটা কিছুতেই ধরতে পারছিলাম না। এখন মনে হয় ধরেছি।

সোমনাথ সপ্রশ্ন নেত্রে চাহিল। দেবেশবাবু উঠিয়া পায়চারি করিতে লাগিলেন, তারপর বলিলেন—দেহের রোগ নয় মনের রোগ। সেদিন তুমি তাকে দেখে গিয়েছিলে তো, আজ আবার দেখলেই বুঝতে পারবে। আমার আগেই বোঝা উচিত ছিল, বোম্বাই থেকে ফিরে আসবার পরই তার রোগের সূত্রপাত হয়। মনের মধ্যে অনেকগুলো জট পাকিয়েছিল। যাহোক, এখন বোধহয় সেগুলো পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে।

সোমনাথ নিরুত্তর রহিল। দেবেশবাবু আবার আসিয়া বসিলেন; বলিলেন—সোমনাথ, তুমি যদি রত্নাকে বিয়ে করতে চাও, আমাদের কোনও আপত্তিই হবে না; বরং আমরা খুব খুশি হব।

সোমনাথ কিছুক্ষণ হেঁট মুখে বসিয়া রহিল, তারপর আস্তে আস্তে বলিল-আপনি বোধহয় জানেন না, আগে একবার এ প্রস্তাব হয়েছিল; কিন্তু রত্না–

দেবেশবাবু বলিলেন—রত্না বড় অভিমানী মেয়ে। সে সময় হয়তো ওর মনে ক্ষোভের কোনও কারণ ছিল। যাহোক, সে সব কেটে গেছে। একটু চুপ করিয়া থাকিয়া বলিলেন-ওর স্বভাব, যে জিনিস ও মনে মনে চায় প্রাণ গেলেও তা মুখ ফুটে চাইবে না। আমি জানতে পেরেছি, তোমাকেই ও বিয়ে করতে চায়। এখন তোমার হাত।

সোমনাথ আরক্ত মুখে উঠিয়া দাঁড়াইল।

দেবেশবাবু বলিলেন-হ্যাঁ, যাও। রত্না ওপরেই আছে। মনে রেখো, রোগীকে অনেক সময় জোর করে ওষুধ খাওয়াতে হয়। বলিয়া একটু হাসিলেন।

সোমনাথ উপরে গেল। রত্নাকে দেখিয়া সে চমৎকৃত হইয়া গেল। এই কয় দিনে তাহার কী অপূর্ব পরিবর্তন হইয়াছে! শীতের শেষে পাতা ঝরিয়া লতা শুষ্ক শীর্ণ আকার ধারণ করে, আবার নব-কিশলয়ে তাহর সর্বাঙ্গ ভরিয়া যায়। রত্নার মুখের সেই দৃঢ় অথচ সুকুমার ডৌল ফিরিয়া আসিয়াছে; গাল দুটিতে নব পল্লবের কোমল অরুণিমা।

রত্না নত হইয়া সোমনাথের পদধুলি লইল; একটু ঘাড় বাঁকাইয়া বলিল—সেদিন তোমাকে পেন্নাম করতে ভুলে গিয়েছিলাম।

সোমনাথের হৃদযন্ত্র দুন্দুভির মত শব্দ করিতেছে; প্রথম যেদিন সে ক্যামেরা ও মাইকের সম্মুখে দাঁড়াইয়াছিল সেদিনও এত ভয় হয় নাই; কিন্তু সে সংযতভাবে একটি গদিমোড়া চেয়ারে গিয়া বসিল; গম্ভীর মুখে বলিল-ভুল সকলেই করে; কিন্তু সময়ে শুধরে নেওয়া চাই।

রত্না তাহার প্রতি একটি চকিত দৃষ্টিপাত করিল; পরে সোফার এক কোণে বসিয়া বলিল—এই বুঝি তোমার এক হপ্তা পরে আসা? কোথায় যাওয়া হয়েছিল?

সোমনাথ বলিল—সোঁদরবনে।

রত্না চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া চাহিল।

সে কি! শিকারে গিয়েছিলে?

উহুঁ।

তবে?

সোমনাথের স্নায়ুমণ্ডলী এতক্ষণে কিছু ধাতস্থ হইয়াছে, হৃদ্যন্ত্রও বেশী গণ্ডগোল করিতেছে না। সে উঠিয়া গিয়া সোফায় রত্নার পাশে বসিল।

রত্না, তোমাকে একটা খবর দিই। আমি সুন্দরবনে পাঁচশো বিঘে জমি কিনেছি। খুব ভাল ধান জমি। আর কী সুন্দর জায়গা! চারদিকে নদী আর জঙ্গল। কলকাতা থেকে জলপথে চার ঘণ্টার রাস্তা। এবার সেইখানে বসে চাষবাস করব।

রত্না যেন বুদ্ধিভ্রষ্টের মত চাহিয়া রহিল; শেষে ক্ষীণকণ্ঠে কহিল—চাষবাস করবে? কিন্তু–চাষবাসের তুমি কী জানো?

কিছু জানি না। যখন সিনেমা করতে গিয়েছিলাম তখন সিনেমার কিছুই জানতাম না। শিখেছি। এও শিখব। আমি ট্র্যাক্টর কিনেছি, বৈজ্ঞানিক প্রথায় চাষবাস করব। একটা মোটর-লঞ্চ কিনেছি, যখন ইচ্ছে হবে কলকাতায় চলে আসব।

কিন্তু চাষবাস কেন? অন্য কোনও কাজ কি করতে পারতে না?

আমি সৃষ্টি-ধর্মী কাজ করতে চাই। যাঁরা প্রতিভাশালী তাঁরা অনেক বড় বড় সৃষ্টি করেন, তাঁদের সৃষ্টি দেশের সম্পদ। আমার প্রতিভা নেই, কিন্তু শস্য উৎপাদন তো করতে পারব। আমার পাঁচশো বিঘে জমিতে বছরে অন্তত পাঁচ হাজার মন ধান হবে। সব ধান আমি একলা খেতে পারব না, বেশীর ভাগই দেশের লোকের পেটে যাবে। দেশের অন্ন-সম্পদ বাড়বে। সেটাই কি কম কথা?

রত্না অনেকক্ষণ নতমুখে চুপ করিয়া রহিল। সোমনাথ দেখিল তাহার মুখে শ্বেতাভা ও রক্তাভা পর্যায়ক্রমে যাতায়াত করিতেছে। সে উদ্বিগ্ন হইয়া বলিল-আমি যা করতে যাচ্ছি তা কি তোমার ভাল লাগছে না?

রত্না একটি নিশ্বাস ফেলিয়া ম্লান হাসিল; বলিল—খুব ভাল লাগছে–

উৎসাহিত হইয়া সোমনাথ বলিল—আমি সেখানে একটি ছোট্ট বাড়ি করাচ্ছি রত্না। মাত্র দুটি ঘর; তাদের ঘিরে বারান্দা। আর বাড়ি ঘিরে বাগান। কেমন, সুন্দর হবে না?

তা হবে; কিন্তু—

কিন্তু কি?

রত্না নিজের চুড়ি ঘুরাইতে ঘুরাইতে বলিল—তুমি সারা জীবন শহরে কাটিয়েছ, গত তিন বছর হাজার লোকের মধ্যে কাজ করেছ। দেশজোড়া তোমার সুখ্যাতি। এখন সব ছেড়ে দিয়ে ঐ বনে কি তোমার মন লাগবে?

সোমনাথ রত্নার একটি হাত নিজের হাতে তুলিয়া লইয়া গাঢ়স্বরে বলিল—লাগবে যদি একটি মেয়ে আমার সঙ্গে থাকে।

রত্না সোমনাথের মুঠি হইতে নিজের হাত টানিয়া লইবার চেষ্টা করিল, কিন্তু সোমনাথ হাত ছাড়িল না। তখন রত্না ঝরঝর করিয়া কাঁদিয়া ফেলিল। সোমনাথ বলিল-কান্নাকাটি কিছু শুনব না। আমাকে বিয়ে করতে হবে; ঐ জঙ্গলে গিয়ে থাকতে হবে। যদি রাজি না হও জোর করে ধরে নিয়ে যাব। তোমার দাদা কিছুই বলবেন না।

রত্না বাঁ হাতে চোখ মুছিবার চেষ্টা করিয়া ভাঙা গলায় বলিল—তুমি জানো না, আমার টিবি হয়েছে। দাদা মুখে বলেন না, কিন্তু আমি জানি।

সোমনাথ তাহাকে আরও কাছে টানিয়া আনিয়া দৃঢ়স্বরে বলিল—তুমি কিছু জানো না। তোমার যা হয়েছে তা দাদা আমাকে বলেছেন। দেহের রোগ নয়, মনের রোগ। মনে মনে প্রেম, আর মুখে ঝগড়া করলে ঐ রোগ হয়। বুঝলে?—যাহোক, ঠিক সময়ে ওষুধ পড়েছে, এবার আর রোগ থাকবে না। ওষুধ যে ধরেছে তার লক্ষণও এরি মধ্যে দেখা যাচ্ছে বলিয়া তাহার গালে আঙুলের মৃদু টোকা দিল।

মেয়েরা সময় বিশেষে কাঁদিয়া বড় আনন্দ পায়। রত্না প্রাণ ভরিয়া কাঁদিতে লাগিল।

কিছুক্ষণ পরে সোমনাথ যেন কতকটা আত্মগতভাবেই বলিল—কাল সকালেই দিদিকে তার করতে হবে। দিদি আর জামাইবাবু যতক্ষণ না আসছেন ততক্ষণ কিছুই হবে না।

.

চার

ফুলশয্যার রাত্রে ঘর অন্ধকার করিয়া দুজনে শুইয়াছিল। মধ্যরাত্রির পর বাড়ি নিস্তব্ধ হইয়াছে; ফুলের গন্ধে রুদ্ধশ্বাস বাতাস নিঃশব্দ সঞ্চারে জানালা দিয়া যাতায়াত করিতেছে। আকাশের খণ্ডচন্দ্র অনেকক্ষণ অস্ত গিয়াছে।

অন্ধকারে রত্নার একটা হাত সোমনাথের বুকে আসিয়া পড়িল। রত্না মৃদুস্বরে বলিল—তুমি আমাকে বড্ড জ্বালিয়েছ।

সোমনাথ তাহার হাত মুঠিতে লইয়া বলিল—আমি জ্বালিয়েছি; তা তো বটেই। —আচ্ছা রত্না, কবে তোমার এই দুর্বুদ্ধি হল, মানে, কবে তুমি আমাকে ভালবাসলে ঠিক করে বল তো।

দশ বছর বয়সে।

উঃ কী পাকা মেয়ে!

মেজদার বিয়ের ফুলশয্যার দিন তোমাকে দেখি, তুমি বৌদির সঙ্গে এসেছিলে। সেই দিনই মনে মনে ঠিক করে ফেললাম, তোমাকে ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করব না।

প্রথম দর্শনেই এত! তারপর।

তারপর আট বছর অপেক্ষা করলাম। ঠিক করেছিলাম আই.এ. পর্যন্ত পড়ব তারপর বিয়ে। যখন বিয়ের সময় হল তখন দেখি তুমি সিনেমায় ঢুকে পড়েছ।

তাতেই বুঝি মেজাজ বিগড়ে গেল?

বোম্বাই এলাম নিজের চোখে দেখতে। যা দেখলাম তাতে মন আরও বিষিয়ে গেল। তারপর এই তিন বছর যে আমার কি করে কেটেছে তা আমিই জানি।

সোমনাথ বলিল—আমার ওপরে যদি তোমার মন বিষিয়েই গিয়েছিল তবে লুকিয়ে আমার ছবি দেখতে কেন?

তোমাকে না দেখে থাকতে পারতাম না। ছবিতে তোমাকে দেখতাম আর ভাবতাম তুমি কি ভাল আছ? নষ্ট হয়ে যাওনি?—সেবার সেই ঝড়ের রাত্রে গিয়ে পৌঁছুলাম; সে রাতটা ভুলব না—

সোমনাথ বলিল—আমিও না।

রত্না বলিতে লাগিল—সে রাত্রে যদি তুমি আমাকে চাইতে আমি বোধহয় না বলতে পারতাম না; কিন্তু তুমি ও দিয়ে গেলে না। আমি কি করব? আমি কি বলব, ওগো তুমি আমায় বিয়ে কর?

তাহলে সেরাত্রে আর তোমার সন্দেহ ছিল না?

সন্দেহ যায়নি; কিন্তু বুঝতে পেরেছিলাম ভাল হও মন্দ হও তুমি ছাড়া আমার গতি নেই।

সোমনাথ তাহাকে কাছে টানিয়া আনিল।

এখন সন্দেহ গেছে তো?

রত্না তাহার বুকে মুখ রাখিয়া চুপ করিয়া রহিল। অনেকক্ষণ পরে একটা নিশ্বাস ফেলিয়া সোমনাথ বলিল—রত্না, আমি শেষ পর্যন্ত নষ্ট হয়ে যেতাম, যদি তুমি আমার মনের মধ্যে না থাকতে। তুমিই আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছ।

তারপর দীর্ঘকাল আর কোনও কথা হইল না। স্বামীর বলিষ্ঠ বাহুবন্ধনের মধ্যে চোখ বুজিয়া রত্না ভাবিতে লাগিল, পূর্ব জন্মে কোন্ পুণ্য করিলে মানুষ এত সুখ অনুভব করে?

.

একটি মোটর-লঞ্চ নদীর রবিকরোজ্জ্বল বুক চিরিয়া দক্ষিণ মুখে চলিয়াছে! নক্ষত্র বেগে ছুটিতেছে; যেন উড়িয়া চলিয়াছে।

দুই তীরের নগর পিছনে পড়িয়া রহিল; গ্রামগুলি কিছু দূর আসিয়া থামিয়া গেল। কেবল রহিল উপরে নির্মেঘ নীল আকাশ আর নীচে সুজলা শ্যামলা বঙ্গভূমি।

নদী ক্রমে সপ্তমুখী হইল; আঁকিয়া বাঁকিয়া শাখা বিস্তার করিয়া গোলকধাঁধার সৃষ্টি করিল। ক্ষিপ্রবেগা তরণী তাহারই পাকে পাকে পথ চিনিয়া চলিয়াছে; যেন বনকপোত নিজ নীড়ের সন্ধানে উড়িয়া যাইতেছে। অতি নির্জনে লোকচক্ষুর অন্তরালে ক্ষুদ্র একটি নীড়, সেই নীড়ে সে ফিরিবে—তাহাতে কেবল দুইটি পাখির স্থান–

চারিদিকে আলো ও ছায়ার লুকোচুরি। কোথাও আলো বেশী, ছায়া কম; কোথাও আলো কম ছায়া বেশী। আলোতে ছায়াতে মিলিয়া বিচিত্র চঞ্চল ছবি আঁকিয়া চলিয়াছে।

অনন্তকাল ধরিয়া আঁকিতেছে, অনন্তকাল ধরিয়া আঁকিবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *