১২. সত্যর মনের কাছে এত বড় ভয়ের পরিচয়

ভয়! ভয়!

সত্যর মনের কাছে এত বড় ভয়ের পরিচয় বোধ করি এই প্রথম।

   কাটোয়ার বৌয়ের খুব যে একটা খোয়ার হবে এটা আশঙ্কা করছিল সত্য, কিন্তু এ কি! তিরস্কারের এ কোন ভাষা? জীবনে অনেক কথা শুনেছে সত্য, অনেক কথা শিখেছে, কিন্তু এসব শব্দ তো কখনো শোনে নি।

অসতী মানে কি? উপপতি কাকে বলে? কুল খাওয়া বলতেই বা কি বোঝায়?

যে কুলের আচার তৈরি হয়, আর তেলে-নুনে জরিয়ে অপূর্ব আস্বাদন পাওয়া যায়, এটা যে ঠিক সে জাতীয় নয়, এইটুকুই শুধু বুঝতে পারে সত্য। কিন্তু তার পরই কেমন দিশেহারা হয়ে যায়। দূর থেকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে শঙ্করী আর কাশীশ্বরীর দলের দিকে।

না, আর কেউ কিছু বলছে না, সবাই নিথর, এমন কি মোক্ষদা পর্যন্ত কেমন যেন স্তব্ধ, একা কাশীশ্বরীই পালা চালিয়ে যাচ্ছেন, চাপা তীক্ষ্ণ গলায়।

শঙ্করীকে ধরে চিবিয়ে খেলেও বুঝি রাগ মিটবে না, এমনি সব মুখভঙ্গী।

মোক্ষদা এক ধরনের, কাশীশ্বরী আর এক ধরনের। মোক্ষদার অটুট গতর, অসীম ক্ষমতা, অনর্গল বাকপটুত্ব। কিন্তু কাশীশ্বরীর তা নয়। কাশীশ্বরী শোকেতাপে কিছুটা অথর্ব, তাছাড়া চিরদিনই তিনি টেপামুখী। শুধু তেমন মোক্ষম অবস্থায় পড়লেই মুখ দিয়ে কথা বেরোয় তাঁর চাপা তীক্ষ্ণ।

কিন্তু আজকের মত এমন সব কথা কবে বেরিয়েছে কাশীশ্বরীর মুখ দিয়ে? এমন ঘৃণা-জর্জরিত মুখই বা কবে দেখা গেছে তাঁর?

কে গিয়েছিল কাটোয়ায়?

কে কি শুনেছে এসেছে সেখান থেকে? বার বার শঙ্করীর বাপেরবাড়ির কথাই বা উঠছে কেন? তারা নাকি কেউ ভোজবাড়িতে আসবে না, সম্পর্ক রাখতে চায় না শঙ্করীর সঙ্গে। নেহাৎ নাকি তারা শঙ্করীর মা-বাপ নয়, খুড়োখুড়ী, তাই অমন মেয়েকে টুকরো টুকরো করে কেটে কাটোয়ার গঙ্গায় ভাসিয়ে দেয় নি।

আরও কত কথা, তার সঙ্গে কত মুখভঙ্গী! 

শঙ্করীকে গলায় দড়ি দিয়ে মরবার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে, দেওয়া হচ্ছে ঘাটে ডুবে মরবার নির্দেশ! পাপিষ্ঠা শঙ্করীর পাপস্পর্শেই যে কাশীশ্বরীর একমাত্তর নাতিটা বিয়ের বছর না ঘুরতেই মরেছে, সেকথাও প্রমাণিত হয়ে যাচ্ছে আজকের বিচারের রায়ে।

অনেক শুনতে শুনতে শেষ পর্যন্ত এইটুকু বুঝতে পারে সত্য, নাপিত-বৌ আর রাখু কাটোয়া গিয়েছিল যজ্ঞির জন্যে নেমন্তন্ন করতে। আর শঙ্করীর খুড়ী নাপিত-বৌয়ের কাছে শঙ্করীর নামে যাচ্ছেতাই করেছে।

সেখান থেকে খুব যে একটা গর্হিত কাজ করে চলে এসেছে শঙ্করী, সে বিষয়ে আর সন্দেহমাত্র নেই। লক্ষ্মীর ঘরে সন্ধ্যা দিতে দেরি হওয়া অথবা সাঁঝ-সন্ধ্যে পর্যন্ত ঘাটে বসে থাকার চাইতে যে অনেকে বেশী গর্হিত তা বুঝতে পারা যাচ্ছে।

কিন্তু শঙ্করীর অপরাধের সঙ্গে তার খুড়ীর বোনগোর যোগ কোথায়? সে কেন শঙ্করীর জন্যে বাড়ি ছেড়ে নিরুদ্দিশ হয়ে চলে গেছে?

এইখানেই সব গোলমাল লাগছে সত্যর।

সব যেন হেঁয়ালি।

এই অন্য জগতের অর্থবহ, জীবনে না-জানা শব্দগুলো সত্যর বুকটাকে কেমন হিম-হিম করে দিচ্ছে। ভয় করছে। যে অনুভূতি জীবনে জানে না সত্য, আজ সেই অনুভূতি তার সমস্ত সাহসকে যেন বোবা করে দিয়েছে।

গিন্নীরা কাউকে শাসন করছেন, অথচ সত্য তার মধ্যে ফোড়ন কাটছে না, এমন ঘটনা বোধ করি সত্যর জ্ঞানে এই প্রথম। অপরাধীর পক্ষ নেওয়াই সত্যর স্বভাব। তা সে অপরাধী যে শ্রেণীর হোক।

একবার বাসন-মাজুনী বাণী-বৌ সন্ধ্যে করে ঘাটে বাসন মাজতে গিয়ে পাজার বাসন থেকে একটা বাটি হারিয়ে ফেলেছিল। খুব সম্ভব বাটিটা জলেই ডুবে গিয়েছিল, কিন্তু বাণী-বৌকে ‘চোর’ অপবাদ দিয়ে ন ভূতো ন ভবিষ্যতি করেছিলেন শিবজায়া আর দীনতারিণী। এবং মোক্ষদা হুকুম দিয়েছিলেন, না যদি নিয়েছিস তো সমস্ত রাত ওই পুকুর হাতড়ে বাটি খুঁজে বার কর।

বান্দী-বৌ যত হাউমাউ কাঁদে, গৃহিণীকুল ততই চেপে ধরেন তাকে। চুরির উদ্দেশ্যেই যে সে বেলা গড়িয়ে বাসন মাজতে আসে এ মন্তব্যও করতে ছাড়েন না তারা। সেযাত্রা সত্যই তো রক্ষে করেছিল বান্দী-বৌকে।

বলেছিল, চল বান্দীবৌ, আমিও খুঁজিগে তোর সঙ্গে। আমি খুব সাঁতার জানি, সাঁতরে এপার ওপার করে বাটি হাতড়াব।

তুই খুঁজবি মানে?

ধমকে উঠেছিল সবাই। এবং সকলকে চমকে দিয়ে সত্য উদাসভাবে বলেছিল, তা খুঁজতে হবে বৈকি। তোমাদের পাপের প্রাচিত্তির আমাকেই করতে হবে, ভগবান যখন আমাকে তোমাদের ঘরের মেয়ে করে পাঠিয়েছে। বাড়িতে যাদের পাঁচসিন্দুক বাসন, তারা যদি তুচ্ছ একটা ডাল খাবার বাটির জন্যে একটা মানুষের প্রাণবধ করতে চায়, তবে একজনকে তো তার প্রিতিকার করতে হবে।

থ হয়ে গিয়েছিল সবাই, আর বোধ করি তুচ্ছ একটা বাটির জন্য নিজেদের তুচ্ছতার বহরটা সেই প্রথম নজরে পড়েছিল তাদের।

তবে আর কি, পাঁচসিন্দুক বাসন আছে তো হরির নুট দিগে যা বাসনের। অনেক পয়সা আছে তোর বাপের। বলে কেমন যেন শিথিলভাবে রণে ভঙ্গ দিয়েছিলেন তাঁরা।

বাদী-বৌ গলায় কাপড় দিয়ে সত্যকে প্রণাম করেছিল সেদিন।

তা এমন অনেককেই অনেক সময় বিপদ থেকে ত্রাণ করেছে সত্য। কিন্তু আজ আর সত্য গলা দিয়ে শব্দ বেরোচ্ছে না।

একটা অন্ধকার অরণ্যের গা-ছমছমে রহস্য মূক করে দিয়েছে সত্যকে।

কখন যে তিরস্কার-পর্ব শেষ হল, কখন যে গিন্নীরা আপন আপন কর্মে প্রস্থান করলেন, কাটোয়ার বৌ তারপর গেল কোথায়, এসবের কোন খবরই আর রাখতে পারে নি সত্য। কখন একসময় যেন আস্তে আস্তে চলে গিয়ে সারদার ঘরের মেজেয় পরনের চাঁদের আলো-রাঙা আটহাতি শাড়িখানির আঁচলটুকু বিছিয়ে শুয়ে পড়েছিল। যেখানে সারদাও শুয়ে আছে সেই একই পদ্ধতিতে, কোলের ছেলেটুকুকে কোলের কাছে নিয়ে।

সারদা বলেছিল, শুলে যে সত্য ঠাকুরঝি!

শুলাম বলে উত্তর এড়িয়েছিল সত্য।

সারদা আর একবার নিঃশ্বাস ফেলে বলেছিল– কাটোয়ার বৌ অত গাল খাচ্ছিল কেন ঠাকুরঝি?

সত্য বলেছিল, জানি না।

সত্যর পক্ষে এমন সংক্ষিপ্ত স্বল্প ভাষণ প্রায় অভূতপূর্ব, কিন্তু সারদারও নাকি মনে সুখের লেশ নেই– তাই আর বেশী কথা বাড়ায় নি। একসময় ছেলের সঙ্গে ঘুমিয়েও পড়েছিল।

কিন্তু সত্যর চোখে ঘুম আসতে চায় না।

ভয়ের সেই অনুভূতিটা ছাড়তে চায় না তাকে।

থেকে থেকে বুকটা কেমন ঠাণ্ডা আর ফাঁকা-ফাঁকা লাগে। অজানা ওই শব্দগুলো না হয় চুলোয় যাক, কিন্তু আর একটা নতুন ভয় যে মনের মধ্যে বাসা বাধল এসে।

সত্যিই যদি কাটোয়ার বৌ…

গলায় দড়ি দেওয়ার পদ্ধতিটা কি, আর তার পরিণামই বা কি ঠিক জানে না সত্য, কিন্তু অপরটার আশঙ্কায় বার বার গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল তার। যদি তাই হয়?

যদি কাল যজ্ঞি’র প্রয়োজনে পুকুরে জাল ফেলতে গিয়ে জেলেরা মাছের সঙ্গে আরও একটা জিনিস ছেঁকে তোলে।

ভারী রুই পড়েছে ভেবে আহ্লাদে হেঁই হেঁই করে জাল টেনে তুলে যদি দেখে মাছ নয়!

বুকের মধ্যে ঢেঁকির পাড় পড়ার মত শব্দ হতে থাকে সত্যর।

কজনকে পাহারা দেবে সে?

সারদার ব্যাপারেই তো ভয়ে আর বাপের হুকুমে তটস্থ হয়ে আছে, তার ওপর আবার কাটোয়ার বৌ চাপল মনের মধ্যে। কাকে রেখে কাকে দেখবে সত্য?

গালাগালির সময় মুখটা কি রকম দেখাচ্ছিল কাটোয়ার বৌয়ের?

সত্য কি তাকায় নি?

বোধ হয় তাকিয়েছিল, কিন্তু দালানের এক কোণায় মিটমিট করে একটা প্রদীপ জ্বলছিল, তার থেকে দাওয়ায় আর কত আলো এসে পড়বে?

তাও আবার চাঁদের এখন আঁধার কাল চলছে। শুক্কল চললে তবু উঠোনে বাগানে হেঁটে চলে সুখ, মনিয্যিকে দেখাও যায়। আঁধারে তো সন্ধ্যে হলেই হয়ে গেল।

মানুষের সঙ্গে কথা কওয়া ওই মুখ-চোখ না দেখেই।

না, শঙ্করীর মুখ দেখতে পায় নি সত্য। তাই বুঝতে পারছে না, ওই অদ্ভুত অদ্ভুত শব্দগুলোর মানে শঙ্করী ধরতে পেরেছে কিনা।

আচ্ছা সারদাকে একবার চুপি চুপি জিজ্ঞেস করবে সত্য? যতই হোক সারদা সত্যর দুগুণ বয়সী, ছেলের মা, কতদিন আগে বিয়ে হয়েছে সারদার, হয়তো বিদঘুঁটে কথাগুলোর মানে জানা থাকলেও থাকতে পারে।

কিন্তু বার বার বলি বলি করেও বলতে পারল না শেষ অবধি। মুখের দরজায় কে যেন তালাচাবি দিয়েছে।

মানে বুঝতে না পারলেও কথাগুলো যে খারাপ কথা, সেটা বুঝতে পেরেছে সত্য।

.

কাটোয়ার বৌয়ের সঙ্গে খুব যে একটা যোগাযোগ ছিল সত্যর তা নয়। একে তো মাত্র বছরখানেক হল এসেছে সে, সবে আগন্তুক হয়ে, তাছাড়া সে তো নিরামিষ দিকের। একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া নেই। তবে নাকি নেহাৎ দেখা-সাক্ষাৎ-সূত্রে কথাবার্তা। তাও বিশেষ মিশুকে নয় শঙ্করী। সর্বদাই যেন আনমনা, কাজেই

সত্য আজও যখন সন্ধ্যা গড়িয়ে যাওয়ার অপরাধে চুপি চুপি অবহিত করতে এসেছিল শঙ্করীকে, তখন নেহাৎ একটা জীবের প্রতি যতটুকু মমতা থাকা উচিত তার বেশী ছিল না। কিন্তু এখন যেন মায়ায় মন ভরে যাচ্ছে সত্যর। মনে হচ্ছে কত না-জানি কাঁদছে বেচারা! জগতে এমন কেউ নেই ওর যে সে কান্নায় একটু সান্ত্বনা দেয়!

বিধবা হওয়ার কি কষ্ট!

সত্যরও তো বিয়ে হয়েছে। একটা বরের সঙ্গেই নাকি হয়েছে। সেই বরটা যদি হঠাৎ মরে যায়, সত্যও তাহলে তো বিধবা হবে?

তা যদি হয়, সত্যকেও সবাই অমনি করে খোয়ার করবে?

কিন্তু তাই বা কি করে বলা যায়?

পিসঠাকুমাও তো বিধবা।

বিবা আরও কতজনেই, তাদের ভয়েই তো সবাই তটস্থ হয়ে থাকে।

ওদের দেখে মনে হয়, ওরাই যেন পৃথিবীর দণ্ডমুণ্ডের কর্তা।

তবে? ওরা বড় বলে? কিন্তু তাই কি? এরা বড় হলে ওরকম হতে পারে?

না, এ সব ঠিক বুঝতে পারে না সত্য।

শুধু যে বয়েস দিয়েই সব বিচার হয় তা তো নয়। এই যে তার বাবাকে দেশসুদ্ধ লোক ভয় তে, জেঠামশাইকে কি কেউ করে? উল্টে জেঠামশাই পর্যন্ত তো বাবার ভয়ে কাঁটা। শুধু কি ওঠামশাই? সেজঠাকুদ্দা? ন’ঠাকুদ্দা? কে নয়? ওরা তো আর মেয়েমানুষ নয়?

বয়েসটা কিছু নয়। ছোট বড় বলেও কিছু নয়।

তাহলে ভয়ের বাসাটা কোথায়?

ভাবতে ভাবতে থই পায় না সত্য। তবু ভাবে। কে যে ওকে ভয়ের বাসা খোঁজার চাকরি দিয়েছে কে জানে!

অনেক রাত্রে ভুবনেশ্বরী আসে ডাকতে।

এই সত্য, না খেয়ে ঘুমিয়েছিস যে, ওঠ! সত্য পাশ ফিরে ঘুমের ভান করে জানায়, তার খিদের অভাব।

ভুবনেশ্বরী বকে ওঠে, খিদে নেই কেন? ও যা, রাত-উপুসী থাকতে নেই। কথায় বলে রাত উপুসে হাতী কাবু। বড় বৌমা, তুমিও ওঠো দিকি বাছা। সারাদিন উপুসে আছ, আর অমন করে পড়ে থেকো না। স্বামী-পুতুরের অকল্যেণ হয় ওতে।

ভুবনেশ্বরীর গলা পেয়েই ধড়মড়িয়ে উঠে বসেছিল সারদা। পৃথিবী থেকে বিদায় নেবার তীব্র ইচ্ছেয় ধরাশয্যা নিয়ে পড়ে থাকলেও খুড়শাশুড়ীকে দেখে সমীহ করবে না, এমন কথা ভাবা যায় না। তাই ধড়মড়িয়ে উঠেছিল। স্বামী-পুত্তুরের অকল্যেণ শুনে এবার মনে মনে ধড়ফড়িয়ে উঠল।

ভুবনেশ্বরী ফের বলে, আমি তোমার ছেলে দেখছি, যাও ওঠো। সত্যকে ডেকে নিয়ে খেতে যাওগে। তোমার শাশুড়ী হেঁসেল আগলে বসে আছে। এবেলায় জাল ফেলিয়ে মস্ত একটা মাছ ধরানো হয়েছিল, এসো-জন বসো-জন যদি আসে বলে। খামি খামি দাগার মাছ আর আমের বাখরা দিয়ে এমনি খাসা টক বেঁধেছে দিদি, দেখগে যাও খেয়ে।

ভুবনেশ্বরী অনেকগুলো কথা বলে গেলেও সত্যর কানে তার শেষ অবধি পৌঁছয় নি। পুকুরে এলি ফেলে বড় মাছ ধরা হয়েছে, শুনেই তার মনশ্চক্ষে ভেসে উঠেছে জালবদ্ধ আর একটা জীব। যাকে টেনে তুলে ধড়াস করে পুকুরপাড়ে ফেলা হয়েছে আর যে মুখ চন্দ্র-সূয্যিতে দেখতে পাবার কথা নয়, সেই মুখ সহস্র লোক দেখছে।

কিন্তু সেই মুখের উপর যে চোখ দুটো বসানো আছে, সে কি আর দেখছে? জীবনে কি আর দেখবে কোন কিছু?

উঠে বসে তাড়াতাড়ি বলে, মা, কাটোয়ার বৌ কোথায়?

কোথায় আবার, ঝঙ্কার দিয়ে ওঠে ভুবনেশ্বরী, কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়েছে গিয়ে। তাকে তোর দরকার কি? খেতে যাচ্ছিস খেতে যা।

খাব না, খিদে নেই। ফের শুয়ে পড়ে সত্য।

কিন্তু ওদিকে দাগা দাগা রুই মাছ আর আমের বাখড়ার টক অন্যত্র কাজ করেছে। একে ষোল এই বয়সের দুরন্ত স্বাস্থ্য, তার উপর সারাদিন ছেলেটা বুকের দুধ টেনে খাচ্ছে।

সতীনকাটার যন্ত্রণাটাও যেন কাবু হয়ে এসেছে।

তবু একান্ত বাসনা সত্ত্বেও বাধা আসে মনে।

সারাদিন অভুক্ত পড়ে থেকেও সেই অভুক্ত চেহারাটায় স্বামীর সঙ্গে একবার দেখা হল না, কে জানে রাতে হতে পারে কিনা? আজ তো নতুন বৌয়েরই কালরাত্রি, কাজেই আজ পুরনো বৌ সামান্য পেলেও পেতে পারে। দিব্যি করে মাছের ঝাল দিয়ে একপাথর ভাত সেঁটে এসে অভিমান জানাবে কোন মুখে? সারদা তাই চি চি করে বলে, সবে পেটের ব্যথাটা একটু নরম পড়েছে।

তা হোক। ও খেলেই নরমে যাবে, নরম গলায় বলে ভুবনেশ্বরী, তুমি ডেকেডুকে নিয়ে গেলে তবে যদি সত্য দুটো খায়!

নিজের শাশুড়ীর সঙ্গে কথা বলে না। ঘোমটা দিতে হয় একগলা। কথা যা তা এই শাশুড়ীর সঙ্গেই। তা খুড়শাশুড়ীর কণ্ঠের নরম সুরটুকুই চোখে জল এনে দিল সারদার। অগত্যাই আর রাসুর সামনে অভুক্ত মুখ দেখাবার ইচ্ছেটাকে টেনে রেখে দেওয়া গেল না, সারদা সত্যকে নাড়া দিয়ে বললো, চল ঠাকুরঝি, যা পারবে খেয়ে নেবে।

সত্য উঠে বসল।

হাই তুলে বিরক্ত হয়ে উঠে বলল, বাবা, দু’দণ্ড যদি একটু নিরিবিলিতে পড়ে থাকার জো আছে! নাও চল।

.

সারদা চলে যেতেই ভুবনেশ্বরী একটা অসমসাহসিক কাজ করে বসল।

ঘুমন্ত ছেলেটাকে কাঁথা মুড়ে কোলে চেপে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে চুপি চুপি রাখুর মাকে গিয়ে বলল, রাখুর মা, বড় ছেলেকে একবার ডেকে দে তো। বলবি জরুরী দরকার।

বড় ছেলে অর্থে রাসু।

রাখুর মা এদিক ওদিক তাকিয়ে ফিসফিস করে বলে, দেখে এলাম চণ্ডীমণ্ডপে শুয়েছে।

তা হোক, তুই আমার নাম করে ডেকে নিয়ে আয়।

.

        ঘরের কাছাকাছি গিয়ে মায়ের ডাকে থমকে দাঁড়িয়ে পড়তে হল সত্যবতীকে, আর সারদার বুকটা কী এক আশঙ্কায় চমকে উঠে শীতকালের পানাপুকুরের জলের মত ঠাণ্ডা নিথর হয়ে গেল।

অভ্যস্ত উচ্চারণে মেয়ের নাম ধরে ডাক দেয় নি ভুবনেশ্বরী, ব্যস্ত অথচ চাপা গলায় বলে উঠেছে, এই, তুই এদিকে আয়। তুই অর্থেই সত্য।

আর বিশেষ করে সত্যকেই হঠাৎ চাপা গলায় ডাক দিয়ে সরিয়ে নেবার অর্থ কি? অর্থ আছে, এরকম ডাকের একটাই অর্থ হয়, আর যে অর্থ সত্যর কাছে ধরা না পড়লেও সারদার কাছে যেন ধরা পড়েছে। তাই না বুকটা হঠাৎ এমন হিম-হিম নিথর হয়ে গেল। তাই না আশঙ্কায় চমকে উঠল সে বুক।

সারদা জানে, সারদার মনে আছে।

ছেলেবেলায় সারদা যখন নিঃশঙ্কচিত্তে তার সদ্য-বিবাহিতা কাকীমার কাছে শোবার বায়না নিয়ে তোড়জোড় করত, তখন ঠিক এমনি চাপা গলায় তার মাও ডাক দিতেন, ইদিকে আয় বলছি। তবুও বায়না করত সারদা। এখন মনে পড়লে কী হাসিই পায়!

সত্যবতী থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, বড় বৌ কি একলা শোবে নাকি? তোমাদের আক্কেলটা তো ভাল!

ভুবনেশ্বরী হাসি চেপে ভর্ৎসনার সুরে বলে, থাম্‌, তোকে আর সক্কলের আক্কেল খুঁড়ে খুঁড়ে বেড়াতে হবে না। একলা কেন, অত বড় বেটা ঘরে রয়েছে বড় বৌমার, সে কি কম নাকি?

জানি না বাবা, তোমাদের একো সময় একো মতি! এইটুকুনখানি কচি ছেলে, যার গলা টিপলে দুধ বেরোয়, যে আগলাবে মাকে!

তুই আসবি?

যাচ্ছি বাবা যাচ্ছি। তর সয় না একটু, সবাই যেন ঘোড়ায় জিন দিয়ে আছে। নাও চল। একটা মনোকষ্টওলা মানুষ এই আঁধারপুরীতে একলা পড়ে থাকবে, এই যখন তোমাদের বিচের তো তাই হোক! কোন্ মুখেই যে তোমরা ধম্মকথা কও, তাও জানিনে বাবা!

আটহাত শাড়িখানার হাততিনেক অংশমাত্র কাজে লাগিয়ে, আর বাকী হাতপাঁচেক বিড়ে পাকিয়ে কুক্ষিগত করে নিয়ে মায়ের পিছু পিছু চলল সত্যবতী অনিচ্ছামন্থর গতিতে। সত্যিই তার আজ সারদার কাছে শুতে ইচ্ছে ছিল। প্রধানত সারদার প্রতি সহানুভূতি, দ্বিতীয়ত মনে আশা করছিল, যদি শুয়ে শুয়ে গল্প করতে করতে ভয়ঙ্কর শব্দগুলোর অর্থ উদ্ধার করে নিতে পারে!

শব্দগুলো যে ভাল নয়, বড়দের কাছে প্রশ্ন করলে যে সত্যি উত্তর পাওয়া যাবে না, ঠেলামারা একটা ভুলভাল উত্তরের সঙ্গে হয়তো বা খানিকটা ধমকই জুটবে– এ বিষয়ে যেন নিশ্চিত হয়ে রয়েছে সত্যবতী।

অথচ ভয়ঙ্কর অদম্য একটা কৌতূহল ভিতর থেকে চাড়া দিচ্ছে। শব্দগুলোর অর্থ সংগ্রহ করতে পারলেই যেন অনেক রহস্যের ঘরের চাবি খোলা যায়। অন্তত শঙ্করী কেন চব্বিশ ঘণ্টা ‘মরব’ ‘মরব’ করে, আর বাড়ির সকলে কেন তার প্রতি এককড়া সদ্ব্যবহার করে না, এটুকু যেন ওর থেকেই ধরা যাবে।

কিন্তু সকল গুড়ে বালি দিল মা।

তা নতুন কিছুও নয় অবিশ্যি! জন্মাবধি তো দেখে আসছে সত্যবতী, বড়দের কাজই হচ্ছে ছোটদের সকল ইচ্ছের গুড়ে বালি দেওয়া।

দীনতারিণীর ঘরে বাড়ির সব কটা সোমত্ত মেয়ের শোবার ব্যবস্থা। ঘরটা প্রকাণ্ড বড় বলেও বটে তাছাড়া বড় বড় মেয়েরা এখান ওখান ছড়িয়ে থাকে এটা বিধি নয়। এই বয়স্থা মেয়েদের মধ্যে ন বছরের সত্যবতী সব চেয়ে বড়, আর তার বিয়েও হয়ে গেছে, তাই সে হচ্ছে দলনেত্রী। পুণ্যি রাজু নেড়ী টেপি পুঁটি রাখালী সক্কলেই তাকে ওপরওলার সম্মানটা দেয়।

আজ ওরা সত্যর জন্যে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে ঘুমিয়ে পড়েছিল, সত্য এসে দেখল ঘুমন্ত পুরী। যে যেমন ইচ্ছে হাত-পা ছড়িয়ে শুয়েছে, জায়গা বিশেষ নেই, ওর মধ্যেই ওদের হাত-পা ঠেলেঠুলে জায়গা করে নিতে হবে।

সত্য বিরক্তভাবে আর একবার বলে উঠল, একদিন অন্যত্তর শুলে যে কী মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেত মা মঙ্গলচণ্ডীই জানে!… নে, সর দিকি, এই পুঁটি, ঠ্যাঙটা একটু গুটো।

বলা বাহুল্য পুঁটির সুপ্তির গভীরতায় এ স্বর পৌঁছল না। অগত্যাই সত্যবতী বাক্যবলের সাহায্য ছেড়ে বাহুবলের শরণ নিল। পুঁটির পা আর রাখালীর হাত সরিয়ে নিজের মতন একটু জায়গা করে শুয়ে পড়ল বিছানায়। দীনতারিণী এখনো আসেন নি, তাঁর শুতে আসতে দেরি হয়। বিধবাদের দিকের রাতের জলপান চালভাজা তিলের নাড়ুকে বড়ো দাঁতে জব্দ করতে সময় লাগে।

ঠাকুমার বিছানাটা ঠিক আছে কিনা একবার দেখে নিল সত্যবতী। আছে বটে একফালি ঠাই। অবিশ্যি বিছানা আর কি, ঘরজোড়া একখানা শতরঞ্জির উপর বড় বড় মোটা মোটা খানকয়েক কাঁথা পাতা, আর তারই মাথার দিকে দেয়ালজোড়া টানা লম্বা মাথার বালিশ।

একসঙ্গে যাতে সারি সারি অনেকগুলো মাথা ধরানো যায় তার জন্যেই এই অভিনব মাথার বালিশের আয়োজন। এক-একটা বালিশ বোধ হয় লম্বায় চার হাত আর ওজনে আধ মণ, যারা গোয় তারা নিজেরা তাকে এক ইঞ্চিও নড়াতে পারে না। নিজের বালিশকে নিজের ঘাড়ের তলায় ইচ্ছেমত ভঙ্গীতে রাখতে পারার সুখ ওরা জানে না।

বালিশগুলো যে শুধু মাপেই বড় বলে ভারী তাও তো নয়, তুলোগুলোও যে পুরনো। জিনিস যত সস্তাই হোক আর যত বেশীই প্রাচুর্য থাক–অপচয় করার কথা কউ কল্পনাও করতে পারে না। তাই কর্তাদের বড় বড় তাকিয়াগুলো ছিঁড়ে গেলে যখন তাদের জন্যে নতুন ‘খেরো’ দিয়ে নতুন তুলোর তাকিয়া বানানো হয়, তখন পুরনো তুলো আর ছেঁড়া খেরোগুলো কাজে লাগানো হয় বাড়ির নাবালকদের জন্যে।

সব বাড়িতেই একই অবস্থা। ছেলেপুলে কাচ্চা-বাচ্চা ছাড়া সংসারের যত ওঁচা মালের গতি হবে কাদের উপর দিয়ে? তবু তো কবরেজ-বাড়ির অবস্থা উত্তম। বাৎসরিক বৃত্তি দিয়ে সাজো-ধোবা ঠিক করা আছে, নিয়মিত সব ফর্সা করে দিয়ে যায় সে। মানে আর কি, কেচে শুকিয়ে পাট করে দিয়ে যায় কি আর? কাঁচার পুকুরে কেচে ভিজে কাপড়-চোপড়ের উঁই খিড়কির পুকুরের পৈঠেয় নামিয়ে রেখে যায়। তার পর তো আছেন মোক্ষদা। ভাল পুকুরের জল দিয়ে শুদ্ধ করে সেই ভিজের বস্তা রোদে মেলে দেওয়ার দায়িত্ব তার। তার পর আছে বৌ-ঝিরা। শিবজায়ার ছেলের বৌরা, কুঞ্জর বৌ, বনেশ্বরী–পরবর্তী ডিউটি এসে পড়ে এদের ওপর।

নিত্যি বিছানা কাথার ওয়াড় খোলা আর ওয়াড় পরানো কম ঝামেলার ব্যাপার নয়, কিন্তু–রামকালীর যে ধোবার উপর এবং সংসার–পরিচালিকাদের উপর কড়া হুকুম দেওয়া আছে, অনত্ত মাসে দুক্ষেপ সব সাফ করতে।

আজই বোধ হয় সব সদ্য কাচা। কলা-বাসনার ক্ষার আর সাজিমাটির গন্ধ ছাড়ছে। সত্যবতী নাকে কাপড় দিয়ে শুয়েছে, এই গন্ধটা তার ভারী বিশ্রী লাগে। ও শুয়ে শুয়ে ভাবে, এই বিচ্ছিরি গন্ধটা বাদ দিয়ে কাপড় কাচা যায় না? ওটা ভাবতে ভাবতে আরও অন্য ভাবনায় চলে গেল সত্যবতী।…

বড়বৌ তো একা শুলো, মাঝরাতে উঠে যদি জলে ডুবতে যায়? বৌটা তো যাবেই, বাবাকে কি জবাব দেবে সত্য? তারপর গিয়ে রাত পোহালেই বাড়ি কুটুমে ছেয়ে যাবে, তার মাঝখানে সেই বড়বৌয়ের ডুবে মরার র‍্যালা। আচ্ছা বিপদ হল বটে!

নাঃ, নিশ্চিন্দি থাকা চলে না, বেশী রাতে বাড়ি নিঃসাড় নিশ্চুপ হয়ে গেলে উঠে গিয়ে দেখে আসতে হবে বড়বৌকে। সব চেয়ে ভাল হয় ওর ঘরটায় বাইরে থেকে শেকল তুলে দিলে, নইলে কবার আর দেখতে যাওয়া যাবে? কোন ফাঁকে যদি উঠে গিয়ে সর্বনাশ ঘটিয়ে বসে থাকে বড়বৌ?

দরজার মাথায় শেকল, সত্যবতীর হাত পৌঁছয় না, কিসের ওপর উঠে শেকলে হাত পাওয়া যায় তাই ভাবতে থাকে সে।

ঢিপঢিপ-করা বুকটা নিয়ে সারদা ঘরে ঢোকে। সারদার আহারকালীন অবকাশে ছেলে কেঁদে ভুবনেশ্বরীকে জ্বালাতন করেছিল কিনা জিজ্ঞেস করতেও পারে না। ভুবনেশ্বরীই নিজ থেকে বলে, নিঃসাড়ে গিয়ে শুয়ে পড় তো বড় বৌমা, ছেলে সবে ঘুমিয়েছে, জেগে না যায়। শেওরে কাজললতা দিয়ে শুইয়ে রেখে এসেছি।

রাসুকে ডাকিয়ে এনে ঘরে পুরে দেওয়া পর্যন্ত স্বস্তি ছিল না ভুবনেশ্বরীর। কি জানি যদি অন্ধকারে ঠাহর করতে না পেরে কে কে করে চেঁচিয়ে ওঠে সারদা!

এদিকে আবার রাসুকে বলতে পারে না যে ঘরের পিদিম নিভিও না, কারণ ছেলেকে শোবার ঘরে পুরে দিয়ে আর তার সঙ্গে কথা কইতে মায়েরই লজ্জা লাগে। এ তো ভাসুরপো। আর সারদাকেই বা স্পষ্টাস্পষ্টি বলা যায় কি করে, ওগো তোমার জন্যে ঘরের মধ্যে মানিক আনিয়ে রেখেছি! বলা যায় না বলেই কচি ছেলের ছুতো।

তা ছাড়া আর একটু কারণও কি ছিল না? একটু কৌতুকের সাধ? হলেও শ্বাশুড়ী সম্পর্ক, তবু তো মেয়েমানুষ। আর বাবা রামকালীর ঘরণী হলেও ভুবনেশ্বরী যেন এখনও ভিতরে ভিতরে কোথায় একটু কাঁচা একটু সবুজ রয়ে গেছে।

মানিকের উপমাটা ভুবনেশ্বরীরই মনে এসেছে। নিত্যকার মানুষটাই যে আজ সারদার কাছে পরম মূল্যবান হয়ে উঠেছে, একথা বোঝবার ক্ষমতা ভুবনেশ্বরীর আছে। দেখা যাক বড়বৌমা কতটুকু করায়ত্ত রাখতে পারে স্বামীকে! অবিশ্যি ভরসা কিছু নেই, বেটাছেলের মন, নতুন বৌ ডাগরটি হয়ে উঠতে উঠতে সারদাও কোন্ না ততদিন তিন ছেলের মা হয়ে বসবে! তখন কি আর রাসু নতুন ফুলের মধু ফেলে–

ভাবতে গিয়ে চমকে গেল ভুবনেশ্বরী। মনে মনে নাক-কান মললো। রাসু না তার পুত্রস্থানীয়! তার সম্পর্কে এসব কথা কি বলে ভাবছে সে! সম্পর্কের মান-মর্যাদা আর থাকছে কি করে তা হলে।

ওদের সম্পর্কে সব ভাবনা জোর করে মুছে নিয়ে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল ভুবনেশ্বরী। এবার তাদের দলের খাবার পালা। তবে আজ আর খাবার পরে ঘুম নয়, রাত জেগে কালকের যজ্ঞির কুটনোবাটনা করতে হবে। বড়লোকের বাড়ির বৌ বলে তো আর আয়েস করবার হুকুম নেই। বৌ হচ্ছে বৌ। বরং রাসুর মা দুদণ্ড পা ছড়িয়ে বসলে, কি কাজে গাফিলি করলে কেউ কিছু বলবে না, কিন্তু বৌদের সেরকম আচরণ অমার্জনীয়!

তা খাটুনিতেও দুঃখ ছিল না, যদি শুধু নিজেরা জা-ননদের দল থাকতে পায় সে দলে। হাতের সঙ্গে গল্পগাছাও চলে তা হলে। কিন্তু তা তো হবার জো নেই, একজন গিন্নী পাহারাদার থাকেনই।

বৌরা ঘরভাঙানি মন্ত্রণা করছে কিনা সেটা তো দেখতে হবে তাঁদের। এই গুরু কর্তব্যের দায়ে বেচারা শিবজায়াকে যে মরতে মরতে রাত জেগে ছেলেবৌয়ের ঘরের পেছনের ঘুলঘুলির নিচে কান পেতে বসে থাকতে হয়।

     .

        সারদার ঘরে অবশ্য ঘুলঘুলি নেই। ভাল জানালা আছে। বাড়ির মধ্যে সেরা ঘরটাই সারদার। বর্ধমান থেকে মিস্ত্রী আনিয়ে রামকালী যখন অনেক খরচা করে দক্ষিণের উঠোনে এই ঘরদালান বানিয়েছিলেন, তখন সকলেই ভেবেছিল এটা রামকালীর নিজের জন্যই। মিস্ত্রীর কাজ শেষ হয়ে গেলে দীনতারিণীও তাই বলেছিলেন, একটা শুভ দিন দ্যাখ তা হলে রামকালী নতুন ঘরে ওঠবার।

রামকালী হেসে উঠে বলেছিলেন, তোমার যে দেখছি গাছে না উঠতেই এক কাঁদি গো মা। ঘরে যে উঠবে, সে আসুক আগে?

দীনতারিণী অবাক হয়ে বলেছিলেন, কে আসবে? কার কথা বলছিস?

ঘরের লক্ষ্মীর কথাই বলছি মা, রামকালী বোধ করি মায়ের হৃদগত ধারণা অনুমান করেছিলেন, তাই একবার মায়ের ধারণা-বৃক্ষের মূলে কুঠারাঘাত করে পরম শান্তভাবে কথা শেষ করেছিলেন, কেন, তুমি কি শোন নি রাসুর বিয়ের কথা চলছে?

রাসুর! রাসুর বৌ এসে ওই ঘরের দখলীদার হবে!

দীনতারিণীর সতীনপোর ছেলের বৌ! দীনতারিণী আর আত্মসংবরণ করতে পারেন নি, বিরক্তভাবে বলে উঠেছিলেন, অজ্ঞানের মতো কথা বলো না রামকালী। ওই সেরা ঘরখানা তুমি রাসুকে দেবে!

রামকালী আর হাসেন নি, গম্ভীরকণ্ঠে বলেছিলেন, দেওয়া-দিইর কথা কিছু নেই মা, যার যা ন্যায্য প্রাপ্য সে তা পাবে।

দীনতারিণী তথাপি ছেলের ক্রোধশঙ্কা তুচ্ছ করেও উষ্মা প্রকাশ না করে পারেন নি, বলে উঠেছিলেন, তুমি মাথার ঘাম পায়ে ফেলে উপায় করছ, ‘হীরে হেন জিরে’ এনে নবাবীপছন্দের ঘর গড়লে, সে দ্রব্যি কুঞ্জর বেটা-বৌয়ের প্রাপ্য হল কোন্ সুবাদে রামকালী!

না, রামকালী প্রত্যক্ষে তিরস্কার করেন নি মাকে, বরং আরও শান্তকণ্ঠে বলেছিলেন, যে সুবাদে মানুষ বনের জন্তু-জানোয়ারদের মতন উদোম হয়ে না বেরিয়ে কোমরে কাপড় দিচ্ছে মা। যাকগে ও কথা থাক, ‘জ্যেষ্ঠের শ্রেষ্ঠ ভাগ’ এ বিধিটা তো তোমার অজানা নয় মা। রাসু এ বাড়ির জ্যেষ্ঠ ছেলে।

দীনতারিণীর চোখে জল এসে গিয়েছিল দুঃখে আর অপমান-বোধে, তাই শেষ-বেশ তর্কে বলে বসেছিলেন, মেজ বৌমার প্রাণটার দিকেও তো তাকাতে হয়। যতই হোক সে এখনও কাঁচা মেয়ে, এই ঘর আরম্ভ হয়ে ইস্তক তার একটা আশা ছিল তো।

রামকালী এবার আর একটু হেসেছিলেন, তোমার মেজ বৌমার যদি এমন ইলুতে আশা হয়েই থাকে তো সে আশায় ছাই পড়াই উচিত মা।

ছাই পড়াই উচিত?

আঁচল দিয়ে চোখ মুছেছিলেন দীনতারিণী। মেজ বৌমার আশাভঙ্গের কল্পনায় যত না হোক, নিজের আশাভঙ্গে। কুঞ্জ যে জন্মভোর গায়ে হাওয়া দিয়ে বেড়িয়ে সংসারের সব কিছুর সেরা ভাগটা ভাগ করে, এটা কি চিরকাল সহ্য হয়? দীনতারিণীর আশা ছিল, এই ঘরখানার ব্যাপারে অন্তত কুঞ্জ আর কুঞ্জের বৌয়ের মুখটা ছোট হবে। সেই আশায় ছাই পড়ল। তাই কেঁদে ফেলে বললেন, ছাই পড়াই উচিত?

উচিত বৈকি। ভবিষ্যতে তা হলে আর কখনও এমন বেয়াড়া আশা জন্মাতে পাবে না।

এর পর দীনতারিণী নীরবে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেছিলেন চন্দননগর থেকে ছুতোর এসে ঢুকল সেই ঘরে। হ্যাঁ, জোড়াপালঙ্ক বানাতে হলে ঘরের মধ্যে বসেই বানাতে হয়, বাইরে থেকে গড়ে এনে লাগিয়ে দেওয়া রীতি তখনও হয় নি।

বহুবিধ কারুকার্য করা পালঙ্ক।

ওর জন্যে চন্দননগরের ছুতোরদের ভাত যোগাতে হয়েছিল মাস দেড়েক ধরে। খেয়ে, মজুরি নিয়ে আর নতুন কাপড়ের জোড়া বখশিশ আদায় করে ছুতোররা চলে গেল, তার পরই বিয়ে হল রাসুর। নতুন পালঙ্কে ফুলশয্যে হল।

সেই পালঙ্ক ছেড়ে সারাদিন আজ মাটিতে পড়েছিল সারদা। এখনও খুড়শাশুড়ীর নির্দেশমত নিঃসাড়ে ঘরে ঢুকে হুড়কোটা লাগিয়েই ছেলের তল্লাসমাত্র না করে ঝুপ করে শুয়ে পড়ল মাটিতেই।

ঘরে ঢুকে না তাকিয়েও টের পেয়েছিল সারদা, তার আশার আশঙ্কাটা মিথ্যে নয়। আঘ্রাণে, অনুমানে, হৃৎস্পন্দনে বুঝিয়ে দিয়েছিল সারদাকে ঘরে তোমার সাতরাজার ধন মানিক।

এ যেন আবার নতুন বিয়ের নতুন বর। দ্বিরাগমনে এসে প্রথম রাত্তিরে যখন পাঁচটা সমবয়সী মিলে সারদাকে ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে বাইরে থেকে দরজায় শিকল লাগিয়ে পালিয়েছিল, তখন এমনি বুক ধড়াস করেছিল সারদার। তবু তো তখন মাত্র বারো বছর বয়েস। আর এখন ষোলো। ষোড়শীর হৃদয় তো আলোড়নে আরোই উত্তাল হবে।

.

ঘরে যে অপরাধী আসামী অবস্থান করছিল তার অবস্থাও অবশ্য সারদার চাইতে কিছু উন্নত নয়। তার বুকের মধ্যে হাতুড়ি পিটছে। জীবনে আর কখনও সারদার মুখোমুখি দাঁড়াতে পারে, এ আশা বুঝি ছিল না রাসুর। সারাদিন শুধু ভেবেছে জীবনের সমস্ত আনন্দ-আহ্লাদের সমাধি হয়ে গেল তার।

মেজখুড়ী কেন অন্দরে ডেকে পাঠিয়েছিল, তাও ঠিক বুঝতে পারে নি। ভেবেছিল আবার কোন বিষম শাসনের পাকচক্রে পড়তে হবে এসে, কিন্তু এসে যা শুনল অভিনব।

সারদা নাকি রান্নাঘরে কাজে ব্যস্ত, আর ভুবনেশ্বরীরও কাজের তাড়া, ভাঁড়ারের দিকে না গেলেই নয়, তাই ঘুমন্ত খোকাকে একটু আগলাতে হবে রাসুকে।

কিছু নয়, শুধু ঘরে একটু থাকা।

বোকা রাসু তখনও কিছু সন্দেহ করে নি। শুধু একটু তাজ্জব বনে গিয়েছিল প্রস্তাবে। দেশসুদ্ধ লোক থাকতে কিনা ছেলে আগলাবার জন্যে রাসুকে ডাকিয়ে আনা হল বার-বাড়ি থেকে! আশ্চর্য নয় তা কি যে রাথুর মা ডাকতে গিয়েছিল, সে-ই তো পারত কাজটা। করেও তো বরাবর তাই। তবু কিছু বলতেও পারে নি। না প্রতিবাদ, না প্রশ্ন। নতুন বৌয়ের ব্যাপারে যতটা লজ্জা, ঠিক ততটাই লজ্জা এই নতুন ছেলের বিষয়েও।

সুড়সুড় করে তাই ঘরে ঢুকেছিল রাসু। আর ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই বুকের মধ্যে সন্দেহের হাতুড়ি পড়েছিল।

মেজখুড়ীর এই ডাকিয়ে আনাটা ছল নয় তো! মেজখুড়ীকে তো এমনিতেই খুব ভালবাসে রাসু, এবার যেন ইচ্ছে হল পুজো করে তাকে। ফস্ করে প্রদীপটা নিভিয়ে দিয়ে কাঠ হয়ে ভাবতে লাগল।

সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে খেয়াল করল ঘরে খিল পড়েছে, আর পরমূহুর্ত থেকেই অনুভব করল, বাতাসহীন ঘরের চাপা গুমোটটা যেন একটা কান্নার ধাক্কায় কেঁপে উঠছে।

টপ টপ্ করে দু’ফোঁটা জল পড়ল রাসুর চোখ থেকে। পুরুষ মানুষ! তা হোক, মানুষ তো বটে।

ধড়মড় করে উঠে বসল সারদা। একটা বলিষ্ঠ আবেষ্টন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করতে করতে রুদ্ধকণ্ঠে বলল, আর কেন, আর কেন?

আর কিছু বলতে পারল না। চোখ দুটো বিশ্বাসঘাতকতা করে বসেছে। সারাদিন ধরে প্রতিজ্ঞা করেছিল, যদি কখনও সেই নিষ্ঠুরটার সঙ্গে দেখা হয়, কাঁদবে না, মুখ মলিন করবে না। পরস্য পরের মত উদাসীন থাকবে। কিন্তু পরিস্থিতিটা সমস্তই গোলমাল করে দিল।

তাই কি দু-চার ফোঁটা?

একেবারে ধারার শ্রাবণ!

একে কি করে রোধ করবে সারদা? কোন্ বাঁধ দিয়ে ঠেকাবে?

বড়বৌ!

এতটুকু শব্দের মধ্যে কত মিনতি কত আবেদন!

কিন্তু এই করুণ মিনতিভরা ডাকেই বা সাড়া দিচ্ছে কে?

বড়বৌ, আমার কি দোষ? আমার ওপর বিরূপ হচ্ছ কেন? বুঝতে পারছ না আমার প্রাণটাও গুড়ো হয়ে যাচ্ছে!

ধারা শ্রাবণে বন্যা এল।

থাক থাক, আর মন-মজানে মিছে কথায় কাজ নেই। পুরুষের প্রাণে আবার দরদ!

বড়বৌ, এই আমার মাথা খাও, বিশ্বাস কর তোমার মতনই জ্বলে পুড়ে খাক হচ্ছি আমি। তুমি যে আমাকে বিশ্বাসঘাতক ভাবছ, এ কষ্ট আমি রাখব কোথায়?

রাখবার দরকার কি? সারদা কান্না সামলে কঠোর হবার চেষ্টা করে, কাল তোমার নতুন ফুলশয্যে, নতুন সুখ, আজ আবার এত দুঃখ কষ্টর পালা গাইবার কি আছে?

বড়বৌ, বল কি করলে তুমি আমায় বিশ্বাস করবে?

বলিষ্ঠ আবেষ্টনের চাপটা যেন পিষে ফেলতে চাইছে সারদাকে, কি করে আর কঠিন থাকবে সারদা? তবু শেষ চেষ্টা করে, আমার বিশ্বাস অবিশ্বাসে কি এসে যাচ্ছে তোমার? ছেলের মা বুড়ীকে ছেড়ে এখন কচি তালশাঁস—

বড়বৌ, তুমি এমন ব্যাভার করলে আমার আত্মঘাতী হওয়া ছাড়া আর উপায় থাকবে না তা বলে দিচ্ছি– রাসুও কঠিন হতে জানে, তাই বাধন আলগা দিয়ে বলে, এই চললাম মেজকাকার ওষুধের ঘরে। তাজা গোখরো সাপের বিষ সঞ্চয় আছে। কোথায় আছে তাও আমার জানা। এর পর কিন্তু বিধবা হলে দোষ দিও না আমায়!

বিধবা!

বুকটা থর থর করে ওঠে সারদার। বরং একশটা সতীন নিয়ে ঘর করবে সারদা, বিধবা হওয়ার মত অভিশাপ আর কি আছে? কিন্তু ঠিক এই মুহূর্তে বলাই বা যায় কি?

তা হলে চললাম। এই জনের শেষ দেখা। বলে রাসু দরজার কাছে এগোয়, আশা এই যে এবার সারদা মাথা খাওয়ার অনুরোধ জানাবে, কিন্তু সারদা যেন অনড়।

ভেবেছিলাম ওকে চিরদিনের মত ত্যাগ দিয়েই রাখব, তুমি আমার যে প্রাণেশ্বরী সেই প্রাণেশ্বরীই থাকবে- স্বগত উচ্চারণে আক্ষেপ প্রকাশ করে দরজার হুড়কোয় হাত লাগায় রাসু, কিন্তু তুমি পতিহন্ত্রী হয়ে নিজের পায়ে কুড়ল মারলে বড়বৌ!

হুড়কোটা খুলে পাশে রাখল রাসু।

এবার সারদা কথা বলল, কিন্তু এ কী কথা! এই কি প্রেমে পাগলিনী অবলা বালার ভাষা?

রুদ্ধকণ্ঠে সারদা বলে উঠেছে, ঘরের পরিবারের সঙ্গে যাত্রা-গানের মতন কান্নার সুরে কথা কইছ কেন? হুড়কো খুলে বেরিয়ে গেলেই বুঝি খুব পৌরুষ হবে? তোমার গোখরো বিষ আছে, আর আমার দড়ি-কলসী নেই?

তোমার প্রাণটা পাথরে গড়া বড়বৌ! মেজকাকা যখন আমার গলায় গামছা মোড়া দিয়ে টানতে টানতে নিয়ে গেল, তখন তার সামনে গিয়ে বলতে পারলে না, আমারও দড়ি-কলসী আছে! ঠিক আছে, সবাইকে এবার দেখিয়ে দিচ্ছি–ভালমানুষ রাসু কি করতে পারে!

এই প্রকাণ্ড বীররসের ভূমিকাটি অভিনয় করে কপাটটা ধরে হ্যাঁচকা টান মারল রাসু, কিন্তু–টানার সঙ্গে সঙ্গেই পরিস্থিতিটা বুঝতে দেরি হল না, দরজার বাইরে শেকল এ কাজ কে করল?

মেজখুড়ী?

কিন্তু তাঁর পক্ষে কি এ ধরনের চপল রসিকতা সম্ভব? অথচ তা ছাড়া আর কে? রাসু যে বাড়ির মধ্যে এসেছে, তাই তো কেউ দেখে নি। মেজখুড়ী তো আজকের নাট্যকার।

বাইরে থেকে বন্ধ!

একটা বিপন্ন স্বর আস্তে ঘরে ছড়িয়ে পড়ল।

বন্ধ!

সারদারও এতক্ষণকার নীরবতা ভঙ্গ হল বিস্ময়ে ভয়ে।

তাই তো দেখছি রাসুর কণ্ঠে ব্যাকুলতা, এখন উপায়? যদি সকাল পর্যন্ত বন্ধ থাকে? বড়বৌ, কি হবে?

সহসা অদ্ভুত একটা কাণ্ড ঘটে।

একেবারে অভাবিত অপ্রত্যাশিত। হয়তো বা সারদা নিজেও এক মুহূর্ত আগে এটা কল্পনা করতে পারত না। ভাবতে পারত না তার কান্নায় বুজে আসা কণ্ঠ সহসা অমন কৌতুকের লীলায় হেসে উঠবে। সে হাসির শব্দ চাপা বটে তবু রহস্যে উচ্ছ্বসিত।

তা এই ধরনেরই স্বভাব বটে সারদার, নিতান্ত দুঃখের সময়ও হাসির কথা হলে হেসে ফেলা। কিন্তু আজকের কথা যে আলাদা। আজ সারদার মরণ-বাচনের সমস্যা। আজ কান্নায় গলা বুজে রয়েছিল সারদার। তবু রাসুর এই বিপন্ন বিপর্যস্ত কণ্ঠ থেকে তাকে কী যে কৌতুকের যোগান দিল, উচ্ছ্বসিত রহস্যে হেসে উঠল সে। হেসে উঠে বলল, কী আর হবে! দায়ে পড়ে মশাইকে এখন পরনারীর সঙ্গে রাত কাটাতে হবে!

রাসু চমকে গেছে, থমকে পড়েছে। তবে কি এতক্ষণ ছলনা করছিল সারদা? সতীন হওয়ায় তেমন কিছু লাগে নি তার? এ হাসি এ কথা তো রীতিমত প্রশ্রয়ের।

অতএব দরজা নিয়ে মাথা পরে ঘামালেও চলবে, এখন এদিকের ঘাঁটি সামলে নেওয়া যাক।

খোলা হুড়কো আবার দরজায় উঠল।

অনাদৃত পালঙ্কের বিছানা আবার স্পর্শের উষ্ণতা পেল।

না, একেবারে সহজে ধরা দেবে না সারদা। সে সত্যবদ্ধ করিয়ে নেবে স্বামীকে।

থাক, আমাকে স্পশ্য করতে হবে না, আগে মা সিংহবাহিনীর নামে দিব্যি কর, আমি বেঁচে থাকতে ছুটকিকে ছোঁবে না?

রাসুর বুকটা কেঁপে ওঠে।

শপথটা যে মারাত্মক। ভয়ে ভয়ে বলে, সিংহবাহিনীর নামে দিব্যি করা কি ভাল বড়বৌ?

মনে পাপ থাকলে ভাল নয়। একমন একপ্রাণ থাকলে ভয়ের কি আছে?

তবু, ঠাকুর-দেবতা বলে কথা!

বেশ তো, আমি তোমায় সাধি নি। নাই বা আর স্পশ্য করলে আমায়!

হায় মা সিংহবাহিনী, এমন ঘোরতর বিপদে তোমার গ্রামের আর কেউ কখনও পড়েছে?

একদিকে একখানি অপরাধবোধের ভারে পীড়িত আর নতুন আশায় উদ্বেল ব্যাকুল হৃদয়, আর অপরদিকে এক অনমনীয়া পাষাণী।

তবে কি হাসিটাই ছল?

তাই সম্ভব, নইলে দিব্যি গুছিয়ে ছেলের কাছ ঘেঁষে শোবার আয়োজন করছে কেন সারদা?

বড়বৌ!

আঃ, কেন জ্বালাতন করছ? সারদার বুকে পরম ভরসা দরজার বাইরে শেকল লাগানো, রাগ করে ছিটকে বেরিয়ে যাবার উপায় নেই রাসুর।

আঃ, কে সেই দেবী, যে রাসুকে এমন বন্দী করে ধরে দিয়েছে সারদার কাছে? স্বয়ং মা সিংহবাহিনী নয় তো?

তা হলে তোমার দয়া হবে না?

সোয়ামী, গুরুজন, তুমি আবার দয়ার কথা তুলছ কেন গো? পরিবারই হল গিয়ে কেনা দাসী।

আচ্ছা বেশ, করছি দিব্যি। হল তো?

কই করলে?

মনে মনে করেছি।

মনে মনে? হু! মনের কথা বনে যায়। মুখে বল।

বেশ বেশ, এই বলছি, তুমি ছাড়া আর কাউকে ছোঁব না, সিংহবাহিনী সাক্ষী।

আমি ছাড়া নয়, আমি বেঁচে থাকতে

এটুকু অনুগ্রহ করে সারদা।

ওই হল। কে আগে যায় কে পরে যায়, বলা যায় কি?

আমার কুষ্ঠিতে আছে সধবা মরব। সারদা আত্মপ্রসাদের হাসি হাসে, কিন্তু মনে থাকে যেন মা সিংহবাহিনী সাক্ষী!

থাকবে থাকবে।

কিন্তু সত্যিই কি মনে ছিল?

রাসু কি শেষ অবধি মা সিংহবাহিনীর মর্যাদা রাখতে পেরেছিল?

পুরুষমানুষ কি তাই পারে?

রাসুর মত মেরুদণ্ডহীন পুরুষ?

তবু এমনি মিথ্যে শপথের চোরাবালির উপরই তো ঘর বাঁধতে হয় মেয়েমানুষকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *