০১. তাসের ঘর

তাসের ঘর

সেই তখন থেকেই লক্ষ্য করছিলাম একপাটি চকচকে তাস নিয়ে কিরীটী তার বসবার ঘরে, শিথিল অলস ভঙ্গিতে সোফাটার উপরে বসে, সামনের নিচু গোল টেবিলটার ওপরে নানা কায়দায় একটার পর একটা তাস বসিয়ে, তাসের একটা ঘর তৈরি করবার চেষ্টা করছে। কিন্তু প্রতিবারই কিছুটা গড়ে উঠবার পর ভেঙেচুরে তাসগুলো টেবিলের উপরে ছড়িয়ে পড়ছে। এবং আমি নিঃশব্দে বারংবার সেই প্রচেষ্টার একই পুনরাবৃত্তি দেখছিলাম তারই উল্টোদিকে অন্য একটা সোফার ওপরে বসে।

প্রতিবারের ভেঙেপড়া তাসের ঘরের পুনর্গঠনের মধ্যে নিজে ব্যস্ত থাকলেও কিরীটীর সমস্ত মনটাই যে কোন একটি বিশেষ চিন্তার ঘূর্ণাবর্তের মধ্যেই পাক খেয়ে ফিরছিল সেটা আমি জানতাম বলেই তার দিকে নিঃশব্দে তাকিয়ে বসেছিলাম কোনোরূপ সাড়াশব্দ না করে।

নিস্তব্ধ ঘরটার মধ্যে দেওয়াল-ঘড়ির মেটাল পেণ্ডুলামটা কেবল একঘেয়ে বিরামহীন একটা টকটক শব্দ তুলছিল।

ফাল্গুনের ঝিমিয়ে-আসা শেষ বেলা।

কলকাতা শহরে এবারে শীতটা যেমন একটু বেশ দেরিতেই এসেছিল তেমনি এখনো যাই যাই করেও যেন যাচ্ছে না।

একটা মৃদু মোলায়েম শীত-শীত ভাব যেন শেষ-হয়ে-যাওয়া গানের মিষ্টি সুরের রেশের মতই দেহ ও মনকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে অবিশ্যি তিন-চার দফা চা পান উভয়েরই হয়ে গিয়েছে। এবং কিরীটীর শেষবারের চায়ের কাপটার অর্ধনিঃশেষিত চাটুকু তারই সামনে টেবিলের উপরে তখনো ঠাণ্ডা হচ্ছে।

প্রায় ঘণ্টাদেড়েক হবে এসেছি কিন্তু কিরীটী আমার পদশব্দে চোখ না তুলেই সেই যে, আয় সুব্রত বস, বলে তাসের ঘর তৈরিতে মেতে আছে তো আছেই। আর আমিও সেই থেকে আসা অবধি বোবা হয়ে বসে আছি তো আছিই।

ঘড়ির পেণ্ডুলামটা তেমনিই টকটক শব্দ করে চলেছে। নিচের রাস্তা দিয়ে একটা গাড়ি চলে গেল হর্ণ বাজিয়ে ইঞ্জিনের শব্দ তুলে।

শেষ পর্যন্ত বসে বসে একসময় কখন যেন কিরীটীর তাসের ঘর তৈরি দেখতে দেখতে তন্ময় হয়ে গিয়েছি নিজেই তা জানি না।

দেখছিলাম তাসের পর তাস সাজিয়ে ঘরটা এবারে কিরীটী অনেকটা গড়ে তুলেছে। হঠাৎ সব আবার ভেঙে টেবিলের উপরে ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে কিরীটীর কণ্ঠ থেকে বের হয়ে এল, যাঃ! আবার ভেঙে গেল!

সম্পূর্ণভাবে সোফার গায়ে নিজেকে এলিয়ে দিয়ে কিরীটী বললে, জানি তাসের ঘর এমনি করেই ভেঙে যায়। বৃথা চেষ্টা।

আমিও প্রশ্ন করলাম, কি হল?

পাচ্ছি না। দাঁড়াবার মত কিছুতেই যেন একটা শক্ত ভিত পাচ্ছি না।

কেন?

কেন আর কি! টুকরো টুকরো সূত্রগুলো এমন এলোমেলো যে, একটার সঙ্গে অন্যটা কিছুতেই জোড় দিতে পাচ্ছি না।

তাসগুলো টেবিলের উপরে তেমনিই ছড়িয়ে রয়েছে।

দিনান্তের শেষ আলোটুকুও মিলিয়ে গিয়ে ঘরের মধ্যে ইতিমধ্যে কখন জানি ধূসর আবছা অন্ধকার একটু একটু করে চাপ বেঁধে উঠেছে।

বাঁ-দিকে উপবিষ্ট সোফার হাতলের উপর থেকে রক্ষিত চামড়ার সিগারকেস ও দেশলাইটা হাত বাড়িয়ে তুলে নিয়ে, তা থেকে একটা সিগার বের করে দাঁত দিয়ে চেপে ধরে সিগারে অগ্নিসংযোগ করে নিল কিরীটী। ওষ্ঠধৃত জ্বলন্ত সিগারটায় কয়েকটা মৃদু সুখটান দিয়ে ধূমোদগীরণ করেকিরীটী আবার কথা বললে, ভুজঙ্গ ডাক্তারকে কেমন লাগল আজ সুব্রত?

ভুজঙ্গ ডাক্তার। ডাঃ ভুজঙ্গ চৌধুরী, এ. আর. সি. এস. (লণ্ডন)।

মনে পড়ল মাত্র আজই সকালে তাঁর সঙ্গে আলাপ হয়েছে।

কিরীটীর প্রশ্নের সঙ্গে সঙ্গে আজকের সকালের সমস্ত দৃশ্যটাই যেন মুহূর্তে মনের মধ্যে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

ডাঃ ভুজঙ্গ চৌধুরী।

নামে ব্যবহারে চেহারায় কারও মধ্যে এতটা সামঞ্জস্য, আবার সেই অনুপাতে অসামঞ্জস্যও থাকতে পারে ইতিপূর্বে যেন আমার সত্যিই ধারণারও অতীত ছিল।

ভুজঙ্গ ডাক্তারের চেম্বার থেকে তার সঙ্গে আলাপ করে ফিরবার পথে ঐ কথাটাই বার বার আমার যে মনে হয়েছিল সেও মনে পড়ে ঐ সঙ্গেই।

সামঞ্জস্যটা ওর চেহারা ও নামের মধ্যে। মনে হয়েছিল শিশুকালে যিনিই ওই ভুজঙ্গ নামকরণ করে থাকুন না কেন, দূরদর্শী ছিলেন তিনি নিঃসন্দেহে। কারণ আর যাই করুক

কেন কানা ছেলের নাম পদ্মপলাশলোচন রাখেননি এটা ঠিকই। কিন্তু ব্যাপারটা প্রথম দৃষ্টিতেই নজরে পড়বে না। এবং কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলে তবে নজরে আসবে এবং বলাই বাহুল্য চোখ ফিরিয়ে নিতে হবেই। না নিয়ে উপায় নেই। সমস্ত মনটা ঘিন ঘিন করে উঠবে এবং সেই সঙ্গে মনে হবে লোকটার ঐ ভুজঙ্গ নাম ছাড়া দ্বিতীয় কোন আর নাম বুঝি হতেই পারত না।

গায়ের রঙ লোকটির সত্যিকারের কাঞ্চনবর্ণ বলতে শুদ্ধ ভাষায় যা বোঝায় ঠিক তেমনি। চোখ যেন একেবারে ঠিকরে যায়। কিন্তু মানুষের গায়ের রঙটাই তো তার রূপের সবটুকু নয়। মুখখানা চৌকো। অনেকটা ভারী চোয়ালওয়ালা দ্রাবিড়িয়ান টাইপের মূখ। টানা দীর্ঘায়ত রোমশ যুগল। তার মধ্যে দু-একটা জ্বকেশ এত দীর্ঘ যে বিস্ময়ের চিহ্নের মত যেন উঁচিয়ে আছে। তারই নীচে ক্ষুদ্র গোলাকার পিঙ্গল দুটি চক্ষুতারকা। শাণিত ছোরার ফলার মতোই সে-দুটি চোখের দৃষ্টিতে যেন অদ্ভুত একটা বুদ্ধির প্রাথর্য। শুধু কি খই, আরও কি যেন আছে সেই দুটি পিঙ্গল চক্ষুতারকার দৃষ্টির মধ্যে। এবং যেটা সে-দৃষ্টির দিকে তাকালেই তবে অনুভূত হয়, অদ্ভুত এক আকর্ষণ।

চোখের নিচেই নাকটা টিয়াপাখির ঠোঁটের মতো যেন একটু বেঁকে রয়েছে সামনের দিকে।

গালের দু-পাশে হনু দুটি একটু বেশিমাত্রায় সজাগ, অনেকটা ব-দ্বীপের মত। অতিরিক্ত মাত্রায় ধূমপানের ফলে পুরু ওষ্ঠ দুটিতে একটা পোড়া তামাটে রঙ ধরেছে, আর তারই মধ্যে

মধ্যে কলঙ্কের মত ছোট ছোট খেতচিহ্ন। চিবুকটা একটু ভোঁতা এবং ঠিক মধ্যিখানে পড়েছে একটা খাঁজ।

আরও একটা বিশেষত্ব আছে মুখটার মধ্যে। প্রশস্ত কপালের ডানদিকে একেবারে প্রান্ত ছুঁয়ে আধ ইঞ্চি পরিমাণ লম্বা একটা রক্তজড়ুল চিহ্ন। সেই জড়ুলের উপরেও দুটি দীর্ঘ কেশ।

মাথায় অত্যন্ত ঘন কর্কশ কুঞ্চিত কেশ অনেকটা নিগ্রোদের মত, ব্যাকব্রাস করা।

লম্বা হাড়গিলে প্যাটার্ণের ডিগডিগে চেহারা। সরু লম্বা গলা। কণ্ঠা ও চিবুকের মধ্যবর্তী গলনলীর উপরে অ্যাডমস্আপেলটা যেন একটু বেশী প্রকট। ইংরাজীতে যাকে বলে প্রমিনেন্ট।

নিখুঁতভাবে দাড়িগোঁফ কামানো। মধ্যে মধ্যে লোকটির সূচাগ্র জিহ্বার অগ্রভাগটা বের করা আর টেনে নেওয়া যেন একটা বদভ্যাস। সব কিছু জড়িয়ে মনে হয় যেন একটা বিষধর সরীসৃপ ফণা বিস্তার করে হেলে আছে। এই বুঝি ছোবল দেবে। ভুজঙ্গ নামটা সার্থক সেদিক দিয়ে। এবং চেহারায় সরীসৃপ-সাদৃশ্যটা যেন আরও বেশি প্রকট হয়ে ওঠে ভুজঙ্গ ডাক্তারের চাপা নিঃশব্দ হাসির মধ্যে। ডাক্তারের সদাসর্বদা জিহ্বার অগ্রভাগটা বের করা আর টেনে নেওয়ার মত আর একটি অভ্যাস যা প্রথম দৃষ্টিতেই আমার নজরে পড়েছিল, সেটা হচ্ছে তাঁর হাসি। বলতে গেলে কথায় কথায় যেন তিনি হাসেন এবং হাসির সঙ্গে সঙ্গেই ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

হাসির সঙ্গে সঙ্গে নিচের শ্বেতিচিহুিত পুরু তাম্রাভ ওষ্ঠটা নিচের দিকে নেমে আসে উল্টে আর উপরের ওষ্ঠটি সামান্য একটু উপরের দিকে কুঁচকে ওঠে। আর বিভক্ত সেই ওযুগলের ফাঁকে সজারুর মত ছোট ছোট তীক্ষ্ণ দুসারি অদ্ভুত রকমের সাদা সাদা দাঁত একঝাঁক তীরের ফলার মত যেন মুহূর্তের জন্য সেই হাসির সঙ্গে সঙ্গে ঝিকিয়ে ওঠে। এবং অতিরিক্ত ধূমপানের ফলে নিকোটিননিষিক্ত মাড়িটা যেন ঠেলে ঠেলে বের হয়ে আসতে চায়। ঐ সঙ্গে আর একটা কথাও মনে হয়েছিল, যে লোক অতবেশী ধূমপান করে তার মাড়ির সঙ্গে দাঁতেও নিকোটিনের কালচে দাগ থাকা উচিত ছিল, কিন্তু দাঁতগুলো যেন মুক্তার মতই ঝকঝক করছিল।

যাহোক, বলছিলাম ভুজঙ্গ ডাক্তারের হাসির কথা। ভুজঙ্গ ডাক্তার হাসলে এবং সেই সময় তার দিকে চেয়ে থাকলে, সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টি সে মুখের উপর থেকে ফিরিয়ে অন্যদিকে নিতে হবেই। ঘিনঘিন করে উঠবে সমস্ত মনটা। হঠাৎ গায়ে একটা টিকটিকি পড়লে যেমন অজান্তেই সর্বাঙ্গ সিসিরিয়ে ঘিনঘিন করে ওঠে, ঠিক তেমনি। কিন্তু আশ্চর্য! পরক্ষণেই ডাক্তারের কণ্ঠস্বর কানে গেলেই পুনরায় তার দিকে চোখ ফিরিয়ে না তাকিয়ে উপায় নেই। পুরুষোচিত গম্ভীর কণ্ঠস্বর, কিন্তু যেমন সুরেলা তেমনি মিষ্টি। মনে হবে কথা তো নয় যেন গান গাইছে লোকটা। আর কথা বলার ভঙ্গিটিও এমন চমৎকার! শুধু কি কথাই? ব্যবহারটুকুও যেমনি মিষ্টি মোলায়েম তেমনি দরদেরও যেন অন্ত নেই।

শিক্ষায় দীক্ষায় রুচিতে ব্যবহারে কথায়বাতায় সৌজন্যতায় এমন কি আগাগোড়া পরিচ্ছন্ন রুচিসম্মত বেশভূষায় পর্যন্ত যেন একটা অদ্ভুত ঝকঝকে শালীনতা ও আভিজাত্য সুস্পষ্ট। তাই বলছিলাম নাম ও চেহারার সামঞ্জস্যের মধ্যে অদ্ভুত অসামঞ্জস্য।

সামান্য আলাপেই যেন লোকটির একেবারে নিঃস্ব পর একান্ত অপরিচিতকেও মুহূর্তে আকর্ষণ করে আপনার করে নেবার আশ্চর্য রকমের একটা ক্ষমতা আছে।

চোখের উপরে যেন এখনও ভাসছে লোকটার চেহারাটা।

পরিধানে দামী পাতলা ট্রপিক্যাল অ্যাস কলারের ক্রীজ করা সুট। গলায় সাদা কলারের সঙ্গে কালোর উপরে লাল স্পটেড বো, পায়ে দামী গ্লেসকীডের চকচকে ক্রেপসোলের জুতো।

ডাঃ ভুজঙ্গ চৌধুরী, এ. বি. এফ. আর. সি. এস. (লণ্ডন)। কলকাতা শহরে বছর দশেক হবে প্র্যাকটিস করছেন। সরকারী হা তালের সঙ্গে জড়িত। ইতিমধ্যেই শহরের অগ্রগণ্য চিকিৎসকদের তালিকার মধ্যে অন্য কজন বলে চিহ্নিত হয়ে গিয়েছেন।

প্রতিপত্তি ও পসারে বেশ কায়েমী ভাবেহ ২..ছেন সুপ্রতিষ্ঠিত। লোকেরা বলে ভুজঙ্গ ডাক্তার মরা মানুষকেও নাকি বাঁচিয়ে তুলতে পারে এমনই পারঙ্গম চিকিৎসাশাস্ত্রে।

সাজারী প্র্যাকটিস করেন ভুজঙ্গ ডাক্তার। সর্বরোগের চিকিৎসক নন। সাজারীর যে-কোন কঠিন রোগীর ঘরে ভুজঙ্গ ডাক্তার পা দিলেই নাকি লোকেরা বলাবলি করে, তার অর্ধেক রোগ সেরে যায়। এমনি অচল বিশ্বাস ও আস্থা সকলের ভুজঙ্গ ডাক্তারের উপরে বর্তমান।

পার্কসাকাস অঞ্চলে তিনতলা একটা বিরাট ফ্ল্যাটবাড়ির দোতলার চারঘরওলা একটা সম্পূর্ণ ফ্ল্যাট নিয়ে ভুজঙ্গ ডাক্তারের কনসালটিং চেম্বার ও নার্সিংহোম। একজন জুনিয়ার ডাক্তার অ্যাসিস্টেন্ট ও চারজন শিক্ষিতা ট্রেণ্ড নার্স। দুজন ইউরোপীয়ান, একজন অ্যাংলো-চায়নীজ, একজন বাঙালী। চেম্বারের সঙ্গে সংলগ্ন চার-বেডের নার্সিংহোমটির সঙ্গেই লাগোয়া একটি অপারেশন থিয়েটারও আছে।

চেম্বারের কনসালটিং আওয়ার প্রতিদিন সকাল সাড়ে সাতটা থেকে সাড়ে আটটা। আবার সন্ধ্যায় পাঁচটা থেকে সাড়ে আটটা।

প্রচুর পসার।

চেম্বারের ঐ নির্দিষ্ট টাইমটা ছাড়াও ভুজঙ্গ ডাক্তারকে হাসপাতাল ও প্রাইভেট কল অ্যাটে করবার জন্য ব্যস্ত থাকতে হয়। কিন্তু একটা ব্যাপার ভুজঙ্গ ডাক্তার সম্পর্কে সকলেই জ্ঞাত যে রাত নটার পর বাড়িতে একবার ঢুকলে, তখন হাজার টাকা অফার করলেও তাঁকে দিয়ে কোন রোগী দেখানো তো যাবেই না, এমন কি তিনটা থেকে পরদিন ভোর ছটার আগে পর্যন্ত তিনি নিজে কোন ফোন-কলও অ্যাটেণ্ড করবেন না। ঐ সময়ের মধ্যে যদি কোন অ্যাপয়েন্টমেন্ট থাকে বা করতে হয় তো বাড়ির অন্য লোক মারফৎ করতে হবে।

আশ্চর্য! গত পাঁচ বৎসর ধরেই শোনা যায়, প্রতিদিন রাত্রি নটা থেকে ভোর ছটা পর্যন্ত, ঐ আট ঘণ্টা সময় তিনি নাকি সমস্ত দায়িত্ব ও কাজকর্ম থেকে নিজেকে একেবারে সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন করে নিজের শয়নঘর ও তৎসংলগ্ন লাইব্রেরী ও ল্যাবরেটরী ঘরের মধ্যে নিজেকে আড়াল করে রাখেন।

বলতে গেলে বাইরের জগতে তো নয়ই, এমন কি তাঁর গৃহেও ঐ আট ঘণ্টা সময় তো তিনি সকলের কাছ থেকেই দূরে বিচ্ছিন্ন ও একক হয়ে থাকেন।

শোনা যায় ভুজঙ্গ ডাক্তারের বয়স নাকি প্রায় বিয়াল্লিশের কাছাকাছি। অকৃতদার। এবং নারী জাতি সম্পর্কেও আজ পর্যন্ত তাঁর কোনরূপ দুর্বলতার কথা কেউ কখনও শোনেনি।

সংসারে আপনার জন বলতে বিকলাঙ্গ, অর্থাৎ ডান পা-টি খোঁড়া, বেকার একটি সহদর ভাই আছে। বয়সে ভাইটি ডাক্তারের থেকে আট বৎসরের ছোট। নাম ত্রিভঙ্গ। তাই ত্রিভঙ্গ চৌধুরীও মৃখ নয়। বি. এ. পাস। ত্রিভঙ্গ বিবাহিত। ভুজঙ্গ ডাক্তারই ত্রিভঙ্গের বিবাহ দিয়েছেন। অপূর্ব সুন্দরী বি. এ. পাস একটি গরীব মেয়ের সঙ্গে। সেও বছর ছয়েক হবে। নাম মৃদুলা। আর আছে বছর সাড়ে চারের মৃদুলা ও ত্রিভঙ্গর একমাত্র পুত্রসন্তান অগ্নিবান।

ভাইপোটি শোনা যায় ভুজঙ্গ ডাক্তারের অত্যন্ত প্রিয়। বাড়িতে আর লোকজনের মধ্যে ভুজঙ্গের অনেক দিনের খাসভৃত্য, রামচন্দ্র বা রাম। সে একমাত্র ভুজঙ্গেরই কাজকর্ম করে। দ্বিতীয় ভৃত্য হচ্ছে ভূষণ। একটি ঝি রাতদিনের, সুরবালা, রাঁধুনী বামুন কৈলাস, সোফার হরিচরণ ও নেপালী দারোয়ান রাণা।

ভুজঙ্গ ডাক্তারের ইদানীং পসার খুব বৃদ্ধি হলেও ফিজ পূর্বের মতই রেখেছেন, বাড়ান নি। চেম্বারে ষোল ও বাড়িতে বত্রিশ। শোনা যায় ফিজ সম্পর্কে ভুজঙ্গ ডাক্তারের নাকি অপূর্ব একটা নীতি ছিল সেই প্র্যাকটিসের শুরু থেকেই।

ফরেন ডিগ্রী নিয়ে দুশ বৎসর পূর্বে যেদিন তিনি পার্কসাকাস ট্রাম-ডিপোর কাছাকাছি বড় রাস্তা থেকে একটু ভিতরেই পঞ্চাশ টাকা মাসিক ভাড়ায় ছোট একখানা ত্রিকোণাকার ঘর নিয়ে প্র্যাকটিস শুরু করেন, সেই দিন থেকেই তাঁর ফিজ তিনি চেম্বারে মোল ও গৃহে বত্রিশ ধার্য করেন।

এবং সে-সময় নতুন সদ্য-বিলাতফেরত ডাক্তারদের যা অবস্থা হয়ে থাকে, দিনের পর দিন রোগীর প্রত্যাশায় বারনারীর মতোই আপনাকে সাজিয়ে-গুছিয়ে, রাস্তার চলমান পদধ্বনির দিকে কান পেতে, নিজের প্রকোষ্ঠেরই কড়িকাঠ গণনা করতে হত, সে-সময়ও কচিং কখনও কোন রোগী তাঁর চেম্বারে এলে সর্বাগ্রে তাকে বলতেন, জানেন তো আমার ফিজ! এখানে ষোল, বাড়িতে হলে বত্রিশ। ফ্রি কনসালটেশন আমি করি না।

ফলে যা হবার তাই হত।

ভাগ্যে সপ্তাহে একটি রোগী জুটত কিনা সন্দেহ।

বন্ধুবান্ধবেরা যদি কখনও বলত, গোড়াতে ফিজটা কমাও ভুজঙ্গ। পরে যখন পসার বাড়বে ফিজ ক্রমে বাড়িয়ে যাবে।

ভুজঙ্গ নাকি হেসে জবাব দিতেন, উহুঁ। Start ও finish আমার একই থাকবে, শুরুতে যা ধরেছি শেষেও তাই রাখব।

উপোস করে মরবে যে!

মরবে না ভুজঙ্গ চৌধুরী। প্রতিভার যাচাই অত সহজেই হয় না হে। কয়লাখনির মধ্যে যে হীরা থাকে তাকে খুঁজে বের করতে হলেও সময় ও ধৈর্যের পরীক্ষা তাদেরও দিতে হবে বৈকি। আর আমাকেও সেটা সহ্য করতে হবে।

এত বিশ্বাস!

ঐ বিশ্বাসের উপরেই তো দাঁড়িয়ে আছি হে।

ভুজঙ্গ ডাক্তারের প্রতিভা যে সত্যিই ছিল এবং সে যে মিথ্যা দম্ভ প্রকাশ করেনি, ক্রমে সকলেই সেটা বুঝতে পেরেছিল। লোকে একদিন তাকে চিনতে পারলে। সেই সঙ্গে ভুজঙ্গ ডাক্তারের চেম্বারও বদল হল। বিরাট জাঁকজমকপূর্ণ হল।

এবারে ঐ অঞ্চলেরই একেবারে ট্রাম-রাস্তার উপরে বিরাট একটা ফ্ল্যাট বাড়ির দোতলায় সম্পূর্ণ একটা ফ্ল্যাট নিয়ে জাঁকজমকের সঙ্গে ভুজঙ্গ নতুন চেম্বার ও নার্সিংহোম করলেন।

তারপর দেখতে দেখতে গত পাঁচ বৎসরে যেন হু-হু করে ভুজঙ্গ ডাক্তারের পসার ও খ্যাতি শহর ও শহরের আশেপাশে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল। ফিজ কিন্তু তাঁর মোল-বত্রিশের উপরে গেল না। কথা তিনি ঠিকই রেখেছিলেন। এক কথায় সকলকেই তিনি তাজ্জব বানিয়ে দিয়েছিলেন সন্দেহ নেই।

প্রতিভা থাকে অবিশ্যি অনেকেরই কিন্তু সেই প্রতিভার বিকাশের ও স্বীকৃতিলাভের সৌভাগ্য কজনের হয় সত্যিকারের! সেই দিক দিয়ে ভুজঙ্গ ডাক্তার নিঃসন্দেহে ভাগ্যবান।

চেম্বারে প্রত্যহ রোগীর ভিড় এত থাকে যে, সব রোগীকে তিনি প্রত্যহ পূর্ব অ্যাপয়েন্টমেন্ট দেওয়া সত্ত্বেও দেখে উঠতে পারেন না। ক্ষুন্ন মনে অনেককেই পরের দিনের আশায় ফিরে যেতে হয়। কারণ যাকে তিনি পরীক্ষা করেন সময় নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপেই পরীক্ষা করে থাকেন।

এনগেজমেন্টের খাতায় পাঁচ থেকে সাতদিন পর্যন্ত রোগী সব বুক হয়ে থাকে চেম্বারে।

এত পসার ও খ্যাতি লোকটার তবু নাকি ব্যবহারে তাঁর এতটুকু চাল বা অহঙ্কার নেই। পূর্বে যারা তাঁকে চিনত, তারা বলে, ভুজঙ্গ ডাক্তার আগের মতোই ঠিক আছে। কোন বদল হয়নি।

তাঁর সম্পর্কে গুজবের অন্ত নেই। বিশেষ করে তাঁর ব্যাঙ্ক-ব্যালেন্স সম্পর্কে। এখনও কিন্তু তিনি নিজের বাড়িও একটা করেননি।