১৪. কাবার ঐতিহাসিক সত্যতা

কাবার ঐতিহাসিক সত্যতা

ডেভিডের খুব মন খারাপ। গতকাল সাজিদের কথাগুলো শোনার পর থেকেই সে কেমন যেন নির্জীব হয়ে আছে। সকাল থেকে বাংলায় সে একটি কথাও বলেনি। টুকটাক যা বলেছে তার সবটাই টান টান ইংরেজিতে।

পঁচিশে ডিসেম্বর হিশেবে আজ সরকারি ছুটির দিন। আমার একবার মনে হয়েছিল ডেভিড রাতের মধ্যেই সিদ্ধান্ত পাল্টাবে এবং সকালেই তার বন্ধু অ্যালেনদের সাথে ক্রিসমাস পার্টিতে জয়েন করবে; কিন্তু সকাল থেকেই তার মধ্যে তেমন কোনো লক্ষণ দেখতে পাচ্ছি না। সাদা চামড়ার এই ছেলেটিকে এরকম বিষণ্ণ চেহারায় দেখতে আমার একদমই ভালো লাগছে না। সাজিদ মনোযোগ দিয়ে কী যেন লিখছে। মন খারাপ নিয়ে ডেভিড ম্যাগাজিন পড়ছে, আর আমি হাত-পা গুটিয়ে বেডের ওপর বসে আছি। পুরো ঘরটি জুড়েই প্রচ্ছন্ন নীরবতা।

নীরবতা ভেঙে আমি বললাম, ডেভিড, তুমি কি অ্যালেনদের বাসায় সত্যিই যাচ্ছ না?

আমার কথা শুনে সে ম্যাগাজিন থেকে চোখ তুলে আমার দিকে তাকাল। যেন আমার এই প্রশ্নটি তার কাছে খুব অপ্রত্যাশিত। চশমার ফ্রেম ঠিক করতে করতে সে বলল, নো।

আমার কথা শুনে সাজিদ লেখা থামিয়ে দিল। সম্ভবত আমাদের আলোচনায় সেও অংশগ্রহণ করবে। আমি বললাম, তুমি যে যাচ্ছ না, সেটি অ্যালেনকে জানিয়েছ?

ডেভিড আবারও বলল, নো।

অ্যালেন চিন্তা করবে না তোমার জন্যে?

হোয়াই?, ডেভিভ প্রশ্ন করল।

আমি অবাক হয়ে বললাম, বলো কী! তুমি কিন্তু অ্যালেনের ইনভাইটেশান পেয়েই বাংলাদেশে এসেছ। বাংলাদেশে পা রাখার পরে অ্যালেনের সাথে তোমার কি একবারও যোগাযোগ হয়েছে?

ডেভিড পুনরায় বলল, নো।

এবার কথা বলে উঠল সাজিদ। সে বলল, ডেভিড, এটি কিন্তু ঠিক হয়নি মোটেও। অ্যালেন তো তোমার জন্যে অপেক্ষা করে আছে। কোনো খোঁজ না পেয়ে সে ভাবতে পারে, হয়তো তোমার কোনো বিপদ হয়েছে।

সাজিদের কথা শুনে ডেভিড ও মাই গড বলে চিৎকার করে উঠল। এরপর বলল, ইউ আর রাইট, সাজিদ। বলতে বলতেই সে তার ব্যাগ খুলে একটি ডায়েরি বের করল এবং দ্রুতই ডায়েরি থেকে অ্যালেনের নাম্বার খুজে বের করল। সেখান থেকে ফোন নম্বর নিয়ে অ্যালেনকে ফোন করল। সবকিছু সে খুব দ্রুততার সাথেই করল। বিদেশিরা যে কাজকর্মে খুব চটপটে হয়ে থাকে সেটি ডেভিডকে দেখে হাতেনাতে প্রমাণ পাওয়া গেল।

নাহ, ডেভিডের কল যায়নি। আমি বললাম, তোমার ফোনে তো নেটওয়ার্কই নেই, মাই ফ্রেন্ড। কল কীভাবে যাবে?

ডেভিড ফোনের দিকে তাকিয়ে বলল, আই সী…।

আমি আমার ফোনটি তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, তুমি চাইলে আমার মোবাইল থেকে কল করতে পারো।

সে থ্যাংক ইউ বলে আমার হাত থেকে মোবাইলটা নিয়ে অ্যালেনকে ফোন করল। অ্যালেনের সাথে কথা বলা শেষ করে ডেভিড বলল, আই হ্যাভ টু গো দেয়ার।

আমি বললাম, কোথায়?

অ্যালেনদের বাসায়।

ক্রিসমাস ডে সেলিব্রেইট করার জন্যে?

নো নো।

তাহলে?

ডেভিড এবার খুব স্পষ্ট বাংলায় বলল, ক্রিসমাস ডের দিন যদি জিসাস ক্রাইস্ট জন্মগ্রহণ না-ই করে, সেটি তো অ্যালেনেরও জানা উচিত, তাই না? অ্যালেন তো আমার বন্ধু। আমি আমার বন্ধুকে এই সত্যটি জানাব না?

আমি বললাম, কিন্তু ডেভিড, তুমি যদি এটি করতে চাও তো…।

আমাকে আবার থামিয়ে দিল সাজিদ। সে বলল, অবশ্যই অ্যালেনেরও জানা উচিত এইটা। এরপর সে ডেভিডের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি অবশ্যই যাবে, মাই ফ্রেন্ড।

এবার হাসল ডেভিড। সাজিদের উৎসাহ পেয়ে তাকে যারপরনাই খুশি বলে মনে হলো; কিন্তু ডেভিড যদি অ্যালেনদের কাছে গিয়ে আজকের দিনে এসব কথাবার্তা বলে, তা যে কতটা হিতে বিপরীত হতে পারে তা কি সাজিদ বুঝতে পারছে না?

ডেভিডের অনুরোধে আমাদের দুজনকেই তার সাথে যেতে হচ্ছে। অ্যালেনদের বাসা শ্যামলীতে। অ্যালেনের সাথে ফোনে কথা বলার সময় ডেভিড একেবারে স্পষ্ট করেই জানিয়ে দিয়েছে যে, সে ক্রিসমাস ডেতে অ্যাটেন্ড করছে না। তার কথা শুনে অ্যালেন ভারি অবাক হলো। ডেভিড ক্রিসমাস পার্টিতে কেন অ্যাটেন্ড করবে না সে ব্যাপারে বারবার জানতে চাচ্ছিল অ্যালেন। ডেভিড শুধু একটি বাক্যই বলেছে তাকে, আগে দেখা হোক তারপর বলব।

আমাদের দেখা হলো শ্যামলী স্কয়ারে। বিশাল এই স্কয়ারের পাঁচ তলার একটি রেস্টুরেন্টে আমরা চারজন এসে বসলাম। মজার ব্যাপার হচ্ছে, অ্যালেনের কাছে অনেক আগেই নাকি ডেভিড আমাদের গল্প করে রেখেছে। সাজিদের পরিচয় পাওয়ার পরে অ্যালেন বলল, ওহ! সো ইউ আর মি. আইনস্টাইন।

অ্যালেনের মুখে এই নাম শুনে আমি বেশ অবাক হলাম। সে বলল, আপনাদের গল্প ডেভিড আমার কাছে সবসময়ই করত। ইচ্ছে ছিল ঢাবি ক্যাম্পাসে গিয়ে একদিন আপনাদের সাথে দেখা করে আসব; কিন্তু হয়ে উঠল না আর। আজকে তো দেখা হয়েই গেল, বলতে বলতে হেসে ফেলল অ্যালেন।

খেতে খেতে ডেভিড বলতে লাগল, তোমাদের বাংলা ভাষা যে কী দুর্বোধ্য! এই ভাষা রপ্ত করতে আমার মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হয়েছে। একবার কী হয়েছে। শোনো। একদম প্রথম দিকের কথা। তখন আমি নতুন নতুন বাংলা শিখছি মাত্র। এক বাঙালি লোকের সাথে পরিচয় হলো ক্যান্টিনে। তার কাছে ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করলাম চেয়ারকে বাংলা ভাষায় কী বলে? সে বলল, চেয়ার। আমি বললাম, আরে না না। চেয়ার তো ইংরেজি। এটিকে বাংলা ভাষায় কী বলে থাকে? সে আবার বলল চেয়ার বলে। আমার মাথা গেল গরম হয়ে। বললাম, আরে চেয়ার তো ইংরেজি শব্দ। এটার বাংলা আছে না? আমি সেই বাংলাটি জানতে চাইছি।

আমি চটে গেছি দেখে লোকটি তার ব্রেড হাতে নিয়ে আমার টেবিল থেকেই উঠে চলে গেল। এর অনেক পরে আমি জানতে পারলাম—চেয়ারের বাংলা করলে হয় কেদারা। বাঙালিরা এই কঠিন শব্দে না বলে চেয়ারকে সোজাসুজি চেয়ার-ই বলে। এটি জানার পরে সেদিনের ওই লোকটার জন্যে আমার খানিকটা মায়া হলো। বেচারা সেদিন সঠিক উত্তর দিয়েও কি ঝাড়িটাই-না খেলো আমার। হা-হা-হা।

ডেভিডের কথা শুনে আমরাও হেসে উঠলাম। খেতে খেতে আমাদের আরও বেশ কিছু বিষয়ে গল্প হলো। অ্যালেনের আগ্রহের বিষয় রাজনীতি। সে ট্রাম্প-হিলারির নির্বাচন নিয়ে বেশ বড় রকমের লেকচার ফেঁদে বসল। অ্যালেন আমাকে আর সাজিদকে আপনি করে বলছে দেখে ডেভিড বলে উঠল, হেই, তুমি ওদের আপনি বলে সম্বোধন করছ কেন? বাংলা ভাষার আরেকটি সমস্যা হলো এই জিনিস। সম্বোধনের কতগুলো স্তর। তুই-তুমি-আপনি। আমাদের ইংরেজিতে বাবা এত ঝামেলা নেই। ছোট-বড় সবাইকে আমরা You দিয়েই সেরে ফেলি।

অ্যালেন বলল, তা তুমি ঠিক বলেছ অবশ্য। বাংলা ভাষা হলো সর্বনামের আখড়া। হাহাহা।

অ্যালেন বলল, তা ডেভিড, তুমি ক্রিসমাস পার্টিতে জয়েন করবে না কেন? কী সমস্যা?

বিরাট সমস্যা, বলল ডেভিড। তুমি জানলে খুব অবাক হবে যে, আমাদের জিসাস ক্রাইস্ট কিন্তু ডিসেম্বরের পঁচিশ তারিখে জন্মগ্রহণ করেননি। আমরা একটি ভুল-দিনে জিসাস ক্রাইস্টের জন্মদিন পালন করি। আই সোয়ার।

ডেভিডের কথার আগামাথা কোনো কিছু অ্যালেন বুঝতে পারল না। সে কপাল কুঁচকে বলল, কী বললে তুমি? ডেভিড খুব সিরিয়াস চেহারায় বলল, আমাদের জিসাস ক্রাইস্ট পঁচিশে ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেননি। আমরা, মানে খ্রিষ্টানরা একেবারে একটি ভুল-দিনে জিসাস ক্রাইস্টের জন্মদিন পালন করি।

আর ইউ কিডিং?, অ্যালেনের চেহারা থেকে রুক্ষ ভাবটি যায়নি। কুচকানো কপাল আর গুটানো চোখে যেন তার রাজ্যের বিস্ময়।

নো, মাই ফ্রেন্ড। ট্রাস্ট মি। আই অ্যাম নট লায়িং টু ইউ। আই সোয়ার।

আমার সবচেয়ে মজা লাগছে ডেভিডের হাবভাব দেখে। সে এমনভাবে অ্যালেনকে বোঝাচ্ছে যেন অ্যালেন ক্রিসমাস ডে পালন না করলে তারই লাভ। সিরিয়াসনেসের সবটুকু তার চেহারায় বিরাজ করছে।

অ্যালেন বলল, তুমি এই কথা কোথায় শুনলে?

আমাকে সাজিদ বলেছে। সে কিন্তু মিথ্যে বলেনি অ্যালেন। সে একেবারে এভিডেন্স সহকারে আমাকে প্রমাণ করে দেখিয়েছে যে—জিসাস ক্রাইস্ট পঁচিশে ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেননি। আমরা ভুলদিনে ক্রিসমাস ডে পালন করি।

তাই?

হ্যাঁ।

এবার অ্যালেন সাজিদের দিকে মুখ ফেরাল। তার চেহারায় একটু আগের উজ্জ্বলতাটুকু নেই। সেখানে স্থান করে নিয়েছে একগাদা অবিশ্বাস আর আস্থাহীনতা। সে হয়তো এতক্ষণে ধরে নিয়েছে যে, আমরাই ডেভিডের মাথা গুলিয়ে খেয়েছি। অ্যালেন সাজিদকে উদ্দেশ্য করে বলল, তুমিই বলেছ ডেভিডকে এই কথা?

আমি খেয়াল করলাম অ্যালেন এবার আপনি সম্বোধন ছেড়ে তুমিতে চলে এসেছে। সচেতনভাবে এসেছে না অবচেতনভাবে এসেছে তা বোঝা যাচ্ছে না।

সাজিদ বলল, হ্যাঁ।

তোমার কাছে কী ধরনের এভিডেন্স আছে?

সাজিদ ধীরে ধীরে অ্যালেনকে সব কাহিনি খুলে বলল, যা সে গতকাল ডেভিডকে বুঝিয়েছিল। তবে একটি ব্যাপার বুঝেছি, অ্যালেন বাইবেল সম্পর্কে বেশ ভালো জ্ঞান রাখে। কয়েকটি জায়গায় সাজিদকে প্রশ্ন করে আটকাতেও চেয়েছে; কিন্তু সাজিদ দুর্দান্তভাবে সেগুলো রিফিউট করেছে। একটি পর্যায়ে গিয়ে অ্যালেন তো স্বীকার করেই বসল যে, জিসাস ক্রাইস্টের জন্ম কোনদিন সেটি বাইবেল নিশ্চিত করে না এবং সে এও বলল যে—আর্লি খ্রিষ্টানদের থেকে এই দিনটি জিসাস ক্রাইস্টের জন্মদিন হিশেবে উদ্যাপনের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না।

তার কথা শুনে ডেভিড বলল, তাহলে, আমরা এই দিন পালন করি কেন অ্যালেন?

অ্যালেন বলল, ধর্মের কিছু কিছু বিচ্যুয়াল এভাবেই তৈরি হয়ে যায়। হতে পারে এই দিনেই জিসাস ক্রাইস্টের জন্মদিন উদ্যাপন উপলক্ষ্যে এমন কোনো ব্যাখ্যা আছে, যা আমরা কেউই জানি না। যারা জানে তারা হয়তো গত হয়েছে। তবে আমাদের উচিত প্রশ্ন না করে সেগুলো পালন করে যাওয়া।

তার কথা শুনে অবাক হলো ডেভিড। অবাক হলাম আমিও। সে ক্রিসমাস ডের জন্য এমন এক ব্যাখ্যার কথা বলছে যা বাইবেলে নেই, আর্লি ক্রিশ্চিয়ানরা পালন করেনি। সে এটিকে একটি রিচ্যুয়াল বানিয়ে সার্টিফায়েড করে দিতে চাইছে। অদ্ভুত! অ্যালেন আবার বলল, এরকম রিচ্যুয়ালগুলো যে কেবল ক্রিশ্চিয়ানিটির মধ্যেই আছে তা নয়। মোটামুটি সব ধর্মেই এসব পাওয়া যায়। এমনকি, ইসলামধর্মেও।

আমি আর সাজিদ সাথে আছি বলেই হয়তো অ্যালেন ইসলামধর্মের নামটি বেশ জোর দিয়েই বলল। ইসলামধর্মেও এরকম রিচ্যুয়াল আছে শুনে আরেকবার অবাক হলো ডেভিড। সে বেশ বিস্ময়ের সাথেই আমার আর সাজিদের চেহারার দিকে তাকাল। এই কথা শুনে আমাদের রিঅ্যাকশান কী হতে পারে সম্ভবত সেটি দেখাই তার উদ্দেশ্য।

আমি অ্যালেনকে উদ্দেশ্য করে বললাম, ইসলামধর্মেও এরকম রিচ্যুয়াল আছে বলতে?

অ্যালেন আমার দিকে তাকাল। বলল, শিওর।

যেমন?

এই যেমন ধরো তোমাদের কাবা ঘর। তোমাদের কুরআন বলে এটি নাকি আব্রাহাম আই মিন নবী ইবরাহীম তার পুত্র ইসমাঈলকে নিয়ে নির্মাণ করেছিলেন। দেখো, এটি যদি সত্যি হয়ে থাকে, তাহলে জিসাস ক্রাইস্টের জন্মের আগেও পৃথিবীতে কাবা ঘরের অস্তিত্ব থাকবে, রাইট? এমনকি, জিসাস ক্রাইস্টের জন্মের সময়েও এটার অস্তিত্ব থাকা স্বাভাবিক ছিল; কিন্তু নবী মুহাম্মদের জন্মের আগে তুমি এমন কোনো নন-মুসলিম সোর্স পাবে না যেখান থেকে প্রমাণ করা যায় যে, কাবা ঘরের অস্তিত্ব সেই আদিকাল থেকেই আছে। তাহলে কাবা ঘর আসলেই সেই আদিকাল থেকে ছিল কি ছিল না, সেটি নিয়ে একটি সংশয় কিন্তু আছে। তবুও মুসলিমরা সেটার দিকে মুখ করে ইবাদত করে। কাবায় হজ করে ইত্যাদি। এই যে, এভাবেই তো রিচ্যুয়াল তৈরি হয়।

সাজিদ বলল, তো, তুমি বলতে চাচ্ছ যে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্মের আগে, নন-মসুসলিম কোনো সোর্স থেকে কাবার অস্তিত্ব প্রমাণ করা যায় না?

অ্যালেন বলল, হ্যাঁ। দ্যাটস ইট।

কফি চলে এলো। কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে ডেভিড বলল, হাউ স্ট্রেইঞ্জ!

সাজিদ বলল, অ্যালেন, আমার মনে হয় তুমি কোথাও একটি ভুল করছ।

না, বলল অ্যালেন। আমি এ ব্যাপারে একেবারে সুনিশ্চিত।

তুমি কার কাছে শুনেছ এ ব্যাপারে?

অ্যালেন একটু ইতস্তত বোধ করল। এরপর বলল, আমাদের এক ফাদারের কাছে।

আমার আর বুঝতে বাকি রইল না এই ফাদার আসলে কে। নিশ্চিত ক্রিশ্চিয়ান মিশনারি।

সাজিদ বলল, ইটস ওকে। বাট, হতে পারে তোমার ফাদারের জানার মধ্যে কোথাও একটি গ্যাপ আছে।

অ্যালেন বলল, আই ডোন্ট নো। বাট, তুমি কী বলতে চাচ্ছ, কাবার অস্তিত্ব সম্পর্কে ঐতিহাসিক কোনো সত্যতা আছে? নন-ইসলামিক সোর্স থেকে?

অবশ্যই, বলল সাজিদ। খুব সুন্দরভাবেই আছে।

সাজিদের কথা শুনে ডেভিডের চোখে-মুখে আবারও বিস্ময়ের রেশ দেখা গেল। এবারের বাংলাদেশ সফরে সে এত বেশিই বিস্মিত হচ্ছে যা সে তার পুরো জীবনেও হয়নি। সে বলল, ওয়াও! সাজিদ, ক্যান ইউ এক্সপ্লেইন ইট, প্লিজ?

সাজিদ কফিতে চুমুক দিতে দিতে বলল, শিওর।

এরপর সে অ্যালেনের দিকে ফিরল। বলল, অ্যালেন, তোমার কথাবার্তা শুনে আমার মনে হয়েছে, বাইবেল, ইতিহাস এবং রাজনীতি নিয়ে তোমার বেশ জানাশোনা আছে। তুমি কি ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ Edward Gibbson-এর নাম শুনেছ কখনো?

অ্যালেন একটু মনে করার চেষ্টা করল। এরপর বলল, ঠিক মনে করতে পারছি না। হয়তো আমি তাকে চিনি না।

ফাইন, বলল সাজিদ। আমি বলছি। Edward Gibbson হচ্ছেন পৃথিবীর হাতেগোনা সেরা কয়েকজন ইতিহাসবিদদের একজন। তার একটি বই এতই বিখ্যাত যে, ওই বইটির নামেই তাকে চেনা হয়ে থাকে। ডেভিড বলে উঠল, গ্রেট! কী নাম বইটির?

The History of the Decline and the Fall of the Roman Empire.

ডেভিড আবার বলল, নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে বইটি আগাগোড়া ইতিহাসের বই। হা-হা-হা।

সাজিদ আবার বলতে শুরু করল, এই বইতে তিনি বিভিন্ন ধর্ম, সেগুলোর উৎপত্তি থেকে শুরু করে সেগুলোর বিস্তৃতি ইত্যাদি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা করেছেন।

পৃথিবীতে ক্রিশ্চিয়ানিটির আগমনেরও আগে কাবার অস্তিত্ব নিয়ে তিনি কথা বলেছেন। মূলত তিনি এই রেফারেন্স টেনেছেন যিশু খ্রিষ্টেরও এক শতাব্দী আগের একজন ইতিহাসবিদ থেকে। তার নাম ছিল Diodorus Siculus. গ্রিক এই ইতিহাসবিদ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের আবিস্কৃত অঞ্চল নিয়ে একটি বই লিখেছিলেন। বইটির নাম হলো Bibliotheca Historica. এডওয়ার্ড গিবসন তার সেই বই থেকেই কোট করেছিলেন।

কী আছে গিবসনের বইতে?

গিবসন লিখেছে, blind mythology of barbarians – of the local deities, of the stars, the air, and the earth, of their sex or titles, their attributes or subordination. Each tribe, each family, each independent warrier, created and changed the rites and the object of this fantastic worship; but the nation, in every age, has bowed to the religion as well as to the language of Mecca. The genuine antiquity of Caaba ascends beyond the Christian era : in describing the coast of the Red sea the Greek historian Diodorus has remarked, between the Thamudites and the Sabeans, a famous temple, whose superior sanctity was revered by all the Arabians; the linen of silken veil, which is annually renewed by the Turkish emperor, was first offered by the Homerites, who reigned seven hundred years before the time of Mohammad [১]

অর্থাৎ ক্রিশ্চিয়ানিটির আগেই যে কাবার অস্তিত্ব পাওয়া যায়, সেটি গিবসন অকপটে স্বীকার করেছে। এই দাবি গিবসনের নিজের নয়। তিনি কোট করেছেন গ্রিক হিস্টোরিয়ান ডিয়োভোরাসকে, যিনি আবার যিশু খ্রিষ্টের জন্মের আগেই। মারা গেছেন। ডিয়োডোরাস তার বইতে গ্রিক ভাষায় যা লিখেছেন সেটার ইংরেজি ট্রান্সলেশান করলে যা দাঁড়ায় তা হলো, And a temple has been set-up there, which is very holy and exceedingly revered by all Arabians.

খেয়াল করো, গ্রিক হিস্টোরিয়ান বলছে যে, তখন সেখানে এমন একটি টেম্পল তথা প্রার্থনাস্থল তৈরি করা হয়েছিল, যা ছিল অতি পবিত্র এবং সেটি ছিল সকল আরবের কাছে পরম শ্রদ্ধার।

তো, এই যে টেম্পল তথা প্রার্থনাস্থল যা ছিল সকল আরবদের কাছে অতিশয় পবিত্রতা আর শ্রদ্ধার প্রতীক, এটি কি কাবাকেই নির্দেশ করে না, যা ইবরাহীম আলাইহিস সালাম তার পুত্র ইসমাইল আলাইহিস সালামকে নিয়ে নির্মাণ করেছিলেন?

অ্যালেন বলল, তা যে কাবা হবে, তা কীভাবে নিশ্চিত? অন্য কোনো ধর্মের কোনো গির্জা বা প্রার্থনাস্থলও তো হতে পারে, তাই না?

গুড কোয়েশ্চান, বলল সাজিদ। কিন্তু, এখানে যে-সময়টার কথা বলা হচ্ছে তা যিশুর জন্মেরও অনেক আগের ঘটনা। ইতিহাস এবং বাইবেল থেকেও আমরা জানতে পারি—ইবরাহীম আলাইহিস সালাম তার স্ত্রী হাজেরা এবং শিশুপুত্র ইসমাঈলকে আরব দেশে রেখে যান। সে সময় আরব তথা মক্কায় তেমন কোনো লোকালয় ছিল না। এমনকি, ইবরাহীম আলাইহিস সালামের স্ত্রী হাজেরা আলাইহাস সালাম শিশু ইসমাঈলের তৃষ্ণা নিবারণের জন্য এ-পাহাড় থেকে ও-পাহাড়ে দৌড়াদৌড়ির ঘটনাগুলোও তো সুপ্রসিদ্ধ, তাই না?

হুম।

এরকম একটি সময়ে ওই এলাকায় কি অনেকগুলো ধর্ম থাকা সম্ভব? নাকি, কেবল ইবরাহীম আলাইহিস সালাম যে-ধর্ম প্রচার করেছেন সেটি থাকা সম্ভব?

ইবরাহীমের ধর্ম থাকাই অধিক যুক্তিযুক্ত, তবে…, অ্যালেন একটি আপত্তি তুলতে যাচ্ছিল।

তাকে থামিয়ে দিয়ে সাজিদ বলল, বেশ। ধরে নিলাম যে ওই সময়ে অনেকগুলো ধর্ম ছিল। তাহলে, গ্রিক হিস্টোরিয়ান ডিয়োডোরাস যে-টেম্পল তথা প্রার্থনাস্থলের কথা বলেছেন, তা একই সাথে ওই সময়ের সকল আরবদের কাছে পবিত্র এবং শ্রদ্ধার জায়গা হয় কীভাবে? যদি একেকজনের ধর্ম আলাদা আলাদা হয়, তাহলে তো ওই প্রার্থনাস্থল একই সাথে সবার কাছে সম্মানের এবং শ্রদ্ধার স্থান হিশেবে পরিচিতি পেতে পারে না। যদি তা-ই হয়, ডিয়োডোরাস কীভাবে লিখলেন যে, And a temple has been set-up there, which is very holy and exceedingly revered by all Arabians?

অ্যালেন চুপ মেরে গেল। সাজিদ আবার বলতে লাগল, ডিয়োডোরাসের এই বক্তব্য থেকে এটাই পরিষ্কার যে, ওই সময়ে কেবল একটিই ধর্ম প্রচলিত ছিল এবং আরব দেশে অন্য কোনো ধর্মের এমন কোনো প্রার্থনাস্থলের নিদর্শন পাওয়া যায়, যা একই সাথে খুবই প্রসিদ্ধ এবং শ্রদ্ধার বস্তু ছিল, কেবল কাবা ছাড়া। সেই ঐতিহাসিককাল থেকে আজ পর্যন্ত কাবা পুরো বিশ্বের সকল মুসলমানের কাছেই সমানভাবে সম্মানের, শ্রদ্ধার এবং ভালোবাসার জায়গা।

ডেভিড বলল, ইটস অ্যা গুড পয়েন্ট, মাই ফ্রেন্ড।

তাহলে ডিয়োডোরাসের এই বক্তব্য থেকে আমরা জানতে পারলাম—যিশুর জন্মেরও অনেক আগেই কাবার অস্তিত্ব ছিল। এবার আসা যাক পরের পয়েন্টে। অ্যালেন, তুমি কি টলেমিকে চেনো?

কথা বলে উঠল ডেভিড। বলল, বিজ্ঞানী টলেমির কথা বলছ তো?

হুম।

-সাইন্সের ছাত্র হয়ে টলেমিকে চিনবে না এরকম আবার হতে পারে নাকি? হা-হা-হা।

বেশ, বলল সাজিদ। টলেমি ছিলেন চতুর্দশ শতাব্দীর একজন বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী। তিনি নিজের কাজের জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন সুপ্রাচীন অঞ্চলের একটি ম্যাপ তৈরি করেছিলেন। যিশুর জন্মেরও অনেক আগে পৃথিবীর কোথায় কোথায় প্রসিদ্ধ অঞ্চল বা লোকালয় আছে সেসব জড়ো করাই ছিল মূলত তার উদ্দেশ্য।

এই কাজটি করতে গিয়ে তিনি তৎকালীন মক্কা-কে Macoraba বলে উল্লেখ করেছিলেন এবং এই Macoraba-কে তিনি ধর্মীয় উপসনালয় এবং আরবের প্রাণকেন্দ্র হিশেবে উল্লেখ করেছিলেন। এই ব্যাপারটি অস্ট্রিয়ান ইতিহাসবিদ Gustave E. Von Grunebaum AIC PCSO F31620, Mecca is mentioned by Ptolemy, and the name he gives it allows us to identify it as a south Arabian foundation created around a sanctuary. [২]

এতটুকু বলে সাজিদ থামল। ডেভিড আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আরিফ, তোমার কি ব্যাপারটি ইন্টারেস্টিং লাগছে?

আমি বললাম, হ্যাঁ। আমি তো খুব এনজয় করছি ডেভিড। তুমি?

আমিও খুব এনজয় করছি।

খ্রিষ্টপূর্ব সময়ে কাবার অস্তিত্ব যে ছিল এবং সেটি যে উপাসনালয় হিশেবে আরব পেনিনসুলাতে খুবই পরিচিত ছিল সেটাও আমরা টলেমির এসব রেফারেন্স থেকে বুঝতে পারি। তাহলে, এই কথা অস্বীকারের আর কোনো উপায় থাকে না যে, কাবার অস্তিত্ব কেবল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সময় থেকেই নয়; বরং আমরা দেখলাম যে—কাবার ইতিহাস যিশু খ্রিষ্টের ইতিহাসের চাইতেও পুরোনো। যিশুর জন্মেরও বহু আগেও কাবার অস্তিত্ব পৃথিবীতে বিদ্যমান ছিল।

ডেভিড বলল, কোয়াইট কনভিন্সিং, মাই ফ্রেন্ড।

চুপ করে আছে অ্যালেন। সাজিদ আবার বলা শুরু করল, আচ্ছা অ্যালেন, বাইবেল কি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আগের না পরের?

ডেফিনেটলি আগের, বলল অ্যালেন। আচ্ছা। তাহলে নন-ইসলামিক সোর্স হিশেবে আমরা বাইবেলের রেফারেন্সও দেখতে পারি এক্ষেত্রে, কী বলে?

ডেভিড চোখেমুখে বিস্ময় নিয়ে বলল, কী বলো! বাইবেলে এসব আছে নাকি?

ডেভিডের প্রশ্নের সরাসরি উত্তর না দিয়ে সাজিদ বলতে লাগল, বাইবেলের Psalms এর চুরাশি নম্বর শ্লোকে বেশ ইন্টারেস্টিং কথা আছে। ওই শ্লোকটিতে মূলত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম যখন স্ত্রী হাজেরা এবং পুত্র ইসমাঈলকে নিয়ে হিজরত করছিল, সেই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে। শ্লোকটিতে বলা হচ্ছে :

[১] How lovely is your dwelling place, O LORD Almighty!

[২] My soul yearns, even faints, for the courts of the LORD; my heart and my flesh cry out for the living God.

[৩] Even the sparrow has found a home, and the swallow a nest for herself, where she may have her young– a place near your altar, O LORD Almighty, my King and my God.

[৪] Blessed are those who dwell in your house; they are ever praising you.

[৫] Blessed are those whose strength is in you, who have set their hearts on pilgrimage.

[৬] As they pass through the Valley of Baca, they make it a place of springs; the autumn rains also cover it with pools.

এই শ্লোকটিতে সবচেয়ে আশ্চর্যজনক হচ্ছে শেষের লাইনটি। সেখানে তাদের, অর্থাৎ ইবরাহীম আলাইহিস সালাম এবং তার পরিবারের হিজরতের বর্ণনা দিতে গিয়ে বাইবেল বলছে, As they pass through the valley of Baca. তুমি কি বলতে পারো অ্যালেন, এই Valley Of Baca বলতে বাইবেল কোন জায়গাটি বুঝিয়েছে?

অ্যালেন বলল, তুমি কি এটিকে মক্কা বলতে চাইছ?

হ্যাঁ, বলল সাজিদ। কারণ, কুরআনের একটি আয়াতে মা কে সরাসরি বাক্কা নামে ডাকা হয়েছে।

ডেভিড অবাক হয়ে বলল, রিয়েলি?

হ্যাঁ। সূরা ইমরানের ছিয়ানব্বই নম্বর আয়াতে বলা হচ্ছে, নিশ্চয় ইবাদতের জন্য সর্বপ্রথম যে-ঘর নির্মিত হয়েছিল তা ছিল বাক্কায়। এ থেকে আমরা জানতে পারি যে মক্কার আদি একটি নাম হলো বাক্কা এবং বাইবেলও কিন্তু এই নাম, অর্থাৎ মক্কার আদি নামই উল্লেখ করেছে। As they pass through the Baca, অর্থাৎ তারা যখন বাকা বা বাক্কার উপত্যকায় পৌঁছুল। মানে হলো, তারা যখন মক্কার উপত্যকায় পৌঁছুল।

অ্যালেন বলল, ইউ নো অ্যা ভেরি লিটল অ্যাবাউট বাইবেল, সাজিদ। তুমি বাইবেলের Valley Of Baca এর অর্থ করেছ মক্কার উপত্যকা। কিন্তু, বাইবেল-বিশারদরাও কি ঠিক এই অর্থ করেছে? সাজিদ হাসল। মুখে হাসি রেখেই বলল, ফাইন। এটি আমি তোমার কাছ থেকেই শুনতে চাই, অ্যালেন।

কোনটা?, অ্যালেনের প্রশ্ন।

বাইবেল-বিশারদরা Valley Of Baca এর কী অর্থ করেছে, সেটা।

অ্যালেন একটু কেশে নিল। এরপর বলল, তুমি যদি Jewish Encyclopedia দেখো তাহলে দেখবে যে, সেখানে Baca এর অর্থ করা আছে এরকম : Valley Of Weeping। তা ছাড়া, অনেকে এই শব্দের আরও অর্থ করেছেন, যেমন : valley Of Stream, Valley Of Deep Sorrow ইত্যাদি। সুতরাং, Baca শব্দ থাকলেই যে তা তোমাদের কুরআনের বাক্কা বা মক্কা হয়ে যাবে, তা কিন্তু নয়।

অ্যালেনের চেহারায় বিজয়ীর একটি ভাব তৈরি হলো। সে সম্ভবত ধরেই নিয়েছে যে—সাজিদকে এবার সে আচ্ছামতো কাবু করে ফেলেছে। এই যুক্তি খণ্ডন করার ক্ষমতা আর সাজিদের নেই।

সাজিদ বলল, তুমি একদম ঠিক বলেছ অ্যালেন। বাইবেল-বিশারদরা এই শব্দটির অর্থ ঠিক এভাবেই করেছে যেমনটি তুমি বলেছ। শুধু Jewish Encyclopedia নয়, Anchor Bible Dictionary-তেও Baca শব্দটির অর্থ তা-ই করা হয়েছে, যা তুমি একটু আগে বলেছ।

অ্যালেনের চেহারার উজ্জ্বলতা আরও বেড়ে গেল। আমি বুঝতে পারলাম না, সাজিদ কি নিজ থেকে হেরে যেতে চাচ্ছে নাকি অ্যালেনের কাছে? অ্যালেনের যুক্তি টিকে গেলে তো এতক্ষণ ধরে একটি একটি করে সাজিয়ে আসা সাজিদের সকল যুক্তি পুরোপুরিই ভেঙে পড়বে।

আবারও কথা বলে উঠল সাজিদ। সে বলল, তবে অ্যালেন, আমি শব্দটির অর্থগুলোর একটু বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিচ্ছি।

আমরা সবাই খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছি। সাজিদ বলতে লাগল, Baca শব্দের অর্থ হিশেবে তুমি প্রথমে কোন অর্থটি বলেছিলে?

অ্যালেন বলল, Valley Of Weeping.

ফাইন। Valley Of Weeping. মানে কান্নার উপত্যকা। আমি কি তোমাকে একটি করুণ ইতিহাস মনে করিয়ে দিতে পারি?

অ্যালেনের হয়ে উত্তর দিল ডেভিড। বলল, হোয়াই নট।

দেখো অ্যালেন, ইবরাহীম আলাইহিস সালাম যেমন ইসলামধর্মের একজন সম্মানিত নবী, তেমনই তিনি খ্রিশ্চিয়ানদের কাছেও সম্মানিত একজন প্রফেট, রাইট?

অ্যালেন মাথা নাড়ল। সাজিদ বলতে লাগল, নবী ইবরাহীম যখন স্ত্রী হাজেরা

এবং শিশুপুত্র ইসমাঈলকে একটি পাহাড়ি উপত্যকায় রেখে যান, তখন কিন্তু ওই উপত্যকায় কোনো জনবসতি ছিল না, কোনো খাবার ছিল না। এমনকি, তৃষ্ণা নিবারণের পানিটুকু পর্যন্ত কোথাও ছিল না। এরকম একটি অবস্থায় একেবারে অসহায় হয়ে পড়লেন হাজেরা আলাইহাস সালাম। তিনি শুধু কাঁদতেন। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য আল্লাহর কাছে কেঁদে কেঁদে ফরিয়াদ করতেন আর চাইতেন যেন জীবনধারণের জন্য একটি ব্যবস্থা হয়। হাজেরা আলাইহাস সালামের সেই অনবরত কান্নার জন্যেই যদি এই উপত্যকার নাম হয়ে থাকে Valley Of Weeping, তা কি খুব বেশি অবাক হবার মতো ব্যাপার?

ডেভিড বলল, নাইস! এরকম তো হতেই পারে। মানুষের নামে, আশপাশের পরিবেশের নামে তো দুনিয়াজুড়েই কত জায়গার নাম হয়েছে। Hill Of Tears নামে একটি জায়গাও আছে কোথায় যেন। এগুলো খুবই সম্ভব।

সাজিদ আবার বলতে শুরু করল, Baca এর আরও কয়েকটি অর্থ Jewish Encyclopedia করেছে। যেমন : Valley Of Deep Sorrow. চিন্তা করো, ইবরাহীম আলাইহিস সালাম যখন হাজেরা আলাইহাস সালাম এবং ইসমাঈলকে রেখে চলে যান, ওই সময়টুকু কি হাজেরা আলাইহাস সালামের জন্য খুব সুখকর ছিল? অবশ্যই না। তার জন্যে সময়গুলো ছিল চরম পরীক্ষার; ধৈর্যের। না আছে। থাকার ব্যবস্থা, না আছে খাবার আর না আছে পানি। সাথে একটি বাচ্চা শিশু। নিজে -হয় ক্ষুধা সহ্য করে থাকল; কিন্তু বাচ্চাটা? তার কী অবস্থা হবে? তখন কি হাজেরা আলাইহাস সালামের মন একরকম বিষণ্ণতায় ছেয়ে যায়নি? একটি গভীর দুঃখবোধ কি তার মনের গভীরে ছেপে বসেনি? সেগুলো বিবেচনায় যদি Baca এর অর্থ করা হয় Valley Of Deep Sorrow, তা কি খুব অযৌক্তিক শোনায়?

চুপ করে আছে অ্যালেন। চুপ করে আছি আমি আর ডেভিডও। ডেভিড মুখে হাত দিয়ে সাজিদের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

সাজিদ বলতে লাগল, Baca শব্দের অর্থ হিশেবে Jewish Encyclopedia আরও একটি অর্থ করেছে। সেটি হলো valley Of Stream, যার অর্থ করলে দাঁড়ায় প্রবাহের উপত্যকা। মানে, পানির ঝরনার উপত্যকা। অ্যালেন, তোমাকে আমি আবারও একটি ঘটনা মনে করিয়ে দিই। যখন হাজেরা আলাইহাস সালাম সেই দুর্গম অঞ্চলে, জনমানবহীন পরিবেশে পুত্র ইসমাঈলকে নিয়ে একাকিনী দিন কাটাচ্ছিলেন, তখন তৃষ্ণায় ইসমাঈলের প্রাণ ওষ্ঠাগত। তার তৃষ্ণার্ত চেহারা দেখে হাজেরা আলাইহাস সালাম কোনোভাবেই সহ্য করতে পারছিলেন না আর। তিনি এ-পাহাড় থেকে ও-পাহাড় দৌড়াচ্ছিলেন একটু পানির খোঁজে। তখন আল্লাহর পক্ষ থেকে হাজেরা আলাইহাস সালামকে জানানো হলো যে, পুত্র ইসমাঈলের কাছে ফিরে যেতে; কারণ, তার পদচিহ্ন লেগে সেখানে ইতোমধ্যেই পানির একটি ফোয়ারার সৃষ্টি হয়েছে। সেই পানির ফোয়ারার নাম হলো যমযম। যমযম কূপ সৃষ্টির এই ইতিহাস তো সর্বজনবিদিত, তাই না? এখন এই ঘটনাকে সামনে রেখে বাইবেলের Baca শব্দের অর্থ যদি Valley Of Stream বা প্রবাহের উপত্যকা করা হয়, এটাও কি অযৌক্তিক হয়ে যায়?

ডেভিড বলল, গ্রেট, মাই ফ্রেন্ড। তোমার এক্সপ্লেনেশান আমার খুবই ভালো লেগেছে। এরপর সে অ্যালেনের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কি কিছু বলবে অ্যালেন?

অ্যালেন না-সূচক মাথা নাড়ল। সম্ভবত সে বুঝতে পেরেছে যে, তার দাবিটি ভুল ছিল। কাবার অস্তিত্ব মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সময়কাল থেকে নয়; বরং যিশু খ্রিষ্টেরও বহু বহু আগ থেকেই এটির অস্তিত্ব পৃথিবীতে ছিল।

অ্যালেন আমাদের কাউকে বিল পরিশোধ করতে দিল না। শ্যামলী স্কয়ার থেকে বের হয়ে আমরা অ্যালেনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিলাম। একটি ট্যাক্সি ভাড়া করে আমরা তিনজনই উঠে পড়লাম তাতে। ট্যাক্সি ছেড়ে দেওয়ার পরে ডেভিড মাথা বের করে চিৎকার করে বলতে লাগল, অ্যালেন, ক্রিসমাস পার্টিতে যেয়ে না কিন্তু, মাই ফ্রেন্ড।

ডেভিডের কথা শুনে অ্যালেন মুচকি হাসল। হাসলাম আমরাও। ডেভিডের মতো সহজ-সরল মানুষ পৃথিবীতে খুঁজে পাওয়াই দুষ্কর।

দ্রুতই অ্যালেন আমাদের দৃষ্টি সীমানার বাইরে চলে গেল। মিলিয়ে গেল ঢাকা শহরের যানবাহনের মধ্যে। আমরা ছুটে চললাম আমাদের গন্তব্যের দিকে। বিকেল হতে চলেছে। মসজিদে আসরের আযান পড়তে শুরু করেছে ততক্ষণে।

————-
১ The history of decline & the fall of the Roman Empire, Volume- 5, Page : 223-224

২ Gustave E. Von Grunebaum, Classical Islam: A History 600-1258, Page : 19

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *