১৩. লেট দেয়ার বি লাইট

লেট দেয়ার বি লাইট

শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বাইরের করিডোরে বসে আছি আমরা। আমি আর সাজিদ। পৌষের হাড় কাঁপানো শীত। অল্প দূরের বস্তুগুলোও ভারী কুয়াশায় আচ্ছন্ন। শীতের তীব্রতায় ঘরে টেকা যেখানে দায়, সেখানে এরকম ভোলা পরিবেশে যে আমরা অপেক্ষার প্রহর গুনতে পারছি, সেটাই ঢের আশ্চর্যের।

আমরা অপেক্ষা করছি ডেভিডের জন্যে। ডেভিডের কথা নিশ্চয়ই মনে আছে? ওই যে, সাজিদের সেই আমেরিকান বন্ধু, যার সাথে যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টায় সাজিদের পরিচয় হয়েছিল। সে এখন অনর্গল বাংলা বলা শিখে গেছে। সাজিদ বলেছিল বাংলায় লেখা ওর মেইলগুলো পড়লে নাকি বোঝার উপায়ই নেই যে, এই ছেলে জন্মসূত্রে আমেরিকান। এমনকি বাংলা যতিচিহ্নের সঠিক ব্যবহারও নাকি খুব ভালোমতোই রপ্ত করেছে সে।

আজ ডেভিড দ্বিতীয়বারের মতো বাংলাদেশে আসছে। আমি আর সাজিদ ছাড়াও ডেভিডের আরও কিছু বাঙালি বধু জুটেছে। তাদের সবাই খ্রিষ্টান। তার খ্রিষ্টান বন্ধুদের আমন্ত্রণে সে এবারের ক্রিসমাস ডে পালন করতেই মূলত বাংলাদেশে আসছে; কিন্তু ডেভিড নাকি বারবার করে সাজিদকে বলে রেখেছে আমরা যেন এয়ারপোর্টে তার জন্যে অপেক্ষা করি।

ঘড়ির কাঁটায় যখন সকাল সাতটা বাজে, ঠিক তখন ডেভিডের ফ্লাইট ল্যান্ড করে। ফ্লাইট ল্যান্ড করার বিশ মিনিট পরে কাঁধে একটি ইয়া মোটা ব্যাগ ঝুলিয়ে ডেভিড বাইরে বেরিয়ে এলো। বাইরে এসেই এদিক-ওদিক তাকিয়ে আমাদের খুঁজতে লাগল সে। আমরা ভিড়ের মধ্যে ছিলাম বলে সে আমাদের দেখতে পায়নি। চশমার গ্লাস নাড়তে নাড়তে তার চোখ দুটো আমাদের তখনো খুঁজে ফিরছিল। পেছন দিক থেকে এসে আমি চিৎকার করে বললাম, হাই ডেভিড। হেয়ার উই আর মাই ফ্রেন্ড।

পেছনে ফিরে আমাকে দেখে সেও চিৎকার করে বলল, ওয়াও! আররিফ, নাইস টু মিট ইউ এগেইন। এটি বলেই সে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। আমার পেছনেই ছিল সাজিদ। সে বলল, ডেভিড, তোমার তো বাংলায় কথা বলার কথা। ইংরেজি কপচানোর তো কথা ছিল না।

সাজিদকে দেখে ডেভিড আরেকবার চিৎকার করে বলে উঠল, হেইই, সাজিদ। কেমন আছ তুমি? বলতে বলতেই সে সাজিদকে জড়িয়ে ধরল। আমেরিকানদের মধ্যে কোলাকুলির এই সংস্কৃতি আছে কি না জানি না। তবে সাজিদকে যেভাবে সে জড়িয়ে ধরল তা দেখে বোঝার উপায়ই নেই যে, সে কোনো বিদেশি। মনে হচ্ছে কোনো বাংলাদেশি বন্ধু অনেক বছর পরে দেশে ফিরে এসেছে। ডেভিডের চোখেমুখেও সে রকম উচ্ছাস।

সাজিদ বলল, আমি ভালো আছি। তুমি কেমন আছো বলো তো?

ফাইন, ডেভিড বলল। ও সরি সরি। আই অ্যাপোলোজাইজ। আমার তো বাংলায় কথা বলার কথা, রাইট?

আমি আর সাজিদ দুজনেই হেসে ফেললাম। আমি বললাম, তোমার অ্যাপোলোজিতেও কিন্তু বেশ ভালো রকমের ইংরেজি রয়ে গেছে। হা-হা-হা।

মাথা চুলকাতে চুলকাতে এবার ডেভিডও আমাদের সাথে হেসে ফেলল।

আমাদের গাড়ি চলতে শুরু করেছে। ডেভিড মাঝখানে, আমি আর সাজিদ তার দুই পাশে বসা। ডেভিড যত ভালোই বাংলা শিখুক, বাংলা বলার মধ্যে এখনো বেশ অস্পষ্টতা রয়ে গেছে তার। তার ত উচ্চারণ এখনো ট এর মতো শোনায়। সে বলল, শোনো সাজিদ, আগামীকাল তোমরা দুজনেই কিন্তু আমার সাথে যাচ্ছ।

কোথায়? জানতে চাইল সাজিদ।

অ্যালেনদের বাসায়।

অ্যালেন কে?, আমার প্রশ্ন।

ডেভিড বলল, অ্যালেন ক্রিস্টোফার। আমার বাঙালি বন্ধু।

ওখানে কী?, সাজিদ জানতে চাইল।

আগামীকাল ক্রিসমাস ডে না? অ্যালেনদের বাসায় আমরা আগামীকাল একসাথে সেলিব্রেইট করব, ওকে?

আমি বললাম, আই সী; কিন্তু ডেভিড, একটি সমস্যা আছে।

ডেভিড বলল, সমস্যা? কী সমস্যা?

যেহেতু আমরা মুসলিম, তাই আমরা অন্য…।

আমাকে কথা শেষ করতে দিল না সাজিদ। আমাকে থামিয়ে দিয়েই সে বলে উঠল, ডেভিড, তোমার কি ক্ষুধা লেগেছে?

ডেভিড আমার দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে সাজিদের দিকে তাকাল। বলল, ইয়াপ।

সাজিদ বলল, এক কাজ করি। চলো আমরা ভাপা পিঠা খাই।

সাজিদের কথা শুনে আমার বেশ রাগ হলো। আমাকে কথাটুকু শেষ করতে দিলে কী এমন হতো? আমি ডেভিডকে সুন্দরভাবেই বুঝিয়ে বলতাম যে, কেন একজন মুসলমানের উচিত নয় অন্য ধর্মাবলম্বীদের অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়া; কিন্তু সাজিদের জন্যে আমি এগোতেই পারলাম না। সাজিদের প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেল ডেভিড। সে বলল, আমি বাংলাদেশি পিঠা খুব পছন্দ করি।

আমি বললাম, তুমি আবার বাংলাদেশি পিঠা খেলে কবে?

আমাদের ইউনিভার্সিটিতে কিছু বাঙালি ছেলেমেয়ে আছে। তাদের সাথে আমার খুব ভাব হয়েছে। ওরাই খাওয়ায় মাঝে মাঝে।

আমি আবার বললাম, বাহ, তুমি তো দেখছি আমাদের চেয়েও বেশি বাঙালি বনে গেছ ভাই। গ্রেট জব!

ঢাকার বিভিন্ন রাস্তার ধারে শীতকালীন পিঠা পাওয়া যায়। ভাপা পিঠা, চিতই পিঠা ইত্যাদি। মাটির ঢেলার একটি চুলা বানিয়ে মহিলারা এসব পিঠা বানায় আর পথচারীরা কিনে খায়। এরকম একটি পিঠার দোকান দেখে আমাদের গাড়িটি থামল। আমরা সবাই পিঠা খাওয়ার উদ্দেশ্যে নেমে আসলাম বাইরে।

চালের গুড়া আর খেজুর গুড়ের ভাপা পিঠা খেতে খেতে ডেভিড শীতের আমেরিকা কীরকম হয় সেই গল্প সেরে নিল। পিঠা খাওয়ার পর্ব শেষ করে আমরা আবার গাড়িতে চড়ে বসলাম। চলতে শুরু করল আমাদের গাড়ি।

এবার প্রশ্ন করল ডেভিড। বলল, আরিফ, তুমি কী যেন বলছিলে তখন?

সাজিদ বলল, আমি বলছি ডেভিড। আরিফ মে বি জানতে চাচ্ছিল যে, অ্যালেনদের বাসাটি ঢাকার কোনো জায়গায়। দূরে হলে কিন্তু ঢাকায় ট্রাভেল করা খুব ঝামেলার ব্যাপার। ঢাকার যে-কটি জিনিস বিখ্যাত, তার মধ্যে অন্যতম ঢাকার জ্যাম। তুমি নিশ্চয়ই এ ব্যাপারে জানো?

ডেভিড বলল, ও মাই গড! এই ট্রাফিক জ্যামের কথা আমি কোনোদিন ভুলতে পারব না। গতবার ঢাকা এসে আমি বুঝেছিলাম ট্রাফিক জ্যাম কাকে বলে।

আমি আর সাজিদ আবারও হেসে উঠলাম। সাজিদ বলল, হ্যাঁ। এটাই তো সমস্যা। তা, অ্যালেনদের বাসাটি কোথায় যেন?

সে বলল, আই ডোন্ট নো একচুয়ালি। তার সাথে কনট্যাক্ট করে জানতে হবে।

ঠিক আছে, বলল সাজিদ। কিন্তু ডেভিড, আমার একটি প্রশ্ন আছে।

ডেভিড বলল, শিওর।

ক্রিসমাস ডে কেন পালন করা হয় সে ব্যাপারে আমরা তোমার কাছ থেকে জানতে চাই।

ডেভিড অবাক হয়ে বলল, আই সী। তোমরা জানো না ক্রিসমাস ডে কেন পালন করা হয়?

আমরা দুজনেই চুপ করে রইলাম। ডেভিড আবার বলল, ক্রিসমাস ডে হলো জিসাস ক্রাইস্টের জন্মদিন। এই দিনে, অর্থাৎ পচিশে ডিসেম্বর মাতা মেরী জিসাস ক্রাইস্টকে জন্ম দেন। আমাদের পরম পবিত্র ঈশ্বরের এই দিনে পৃথিবীতে আগমনের স্মৃতি হিশেবে আমরা পঁচিশে ডিসেম্বরকে ক্রিসমাস ডে হিশেবে পালন করি।

সাজিদ বলল, আই সী…।

সাজিদকে আই সী বলতে দেখে ডেভিড বলল, সাজিদ, আমার কথা শুনে তুমি বেশ অবাক হলে বলে মনে হলো।

সাজিদ বলল, অবাক হওয়ার মতোই তো ব্যাপার।

সাজিদের কথা শুনে আমি নিজেই অবাক হয়ে গেলাম। যিশু খ্রিষ্টের জন্মদিনেই তো বড়দিন তথা ক্রিসমাস ডে পালন করা হয়। এ কথা তো একটি বাচ্চা ছেলেও জানে। এটি শুনে তো সাজিদের অবাক হবার কথা নয়।

আমার মতো ডেভিডও অবাক হলো। সে তার কপালের ভাঁজ মোটা করে বলল, অবাক হওয়ার মতো ব্যাপার মানে? বুঝতে পারলাম না কিছুই।

সাজিদ থামল একটু। বলল, আচ্ছা ডেভিড, তোমার জন্মদিন কবে?

ডেভিড বুঝতে পারল না জিসাস ক্রাইস্টের জন্মদিনের সাথে তার জন্মদিনের কী। সম্পর্ক। তারপরও সে বলল, জুলাইয়ের সতেরো তারিখ।

সাজিদ বলল, বাহ। তোমার জন্মদিনের সাথে একজন বিখ্যাত ব্যক্তির জন্মদিনের মিল রয়েছে।

ডেভিড বলল, কার?

স্যার জর্জ ল্যামিত্রে। আধুনিক বিগ ব্যাং থিওরির জনক বলা হয় যাকে। তিনিও জন্মেছিলেন আঠারোশো চুরানব্বই সালের সতেরোই জুলাইতে।

আমি বুঝতে পারছি না সাজিদ এসব কী আলাপ করছে ডেভিডের সাথে। বুঝতে না পারলেও কিছু করার নেই। চুপ করে শুনে যেতে হবে।

সাজিদ আবার বলল, আচ্ছা ডেভিড, তোমার জন্মদিন হলো জুলাইয়ের সতেরো তারিখে; কিন্তু আমি যদি তোমার জন্মদিন পালন করি জানুয়ারির পাঁচ তারিখে, তোমার তখন কেমন লাগবে?

ডেভিড বলল, স্ট্রেইঞ্জ! জানুয়ারির পাঁচ তারিখে কেন আমার জন্মদিন পালন করতে যাবে?

যদি পালন করা হয়, তোমার কেমন লাগবে সেটাই বলল।

ডেভিড চোখমুখ শক্ত করে বলল, এটি অবশ্যই ঠিক কাজ হবে না। আমি যেদিন জন্মেছি, সেদিনই আমার জন্মদিন পালন হওয়া উচিত। অন্য কোনো দিনে নয়।

দ্যাটস রাইট, বলল সাজিদ। একদম ঠিক বলেছ; কিন্তু আমি যদি বলি তোমরা ঠিক এমন একটি দিনে যিশু খ্রিষ্টের জন্মদিন পালন করো যেদিন আসলে তার জন্মদিনই নয়?

এবার হাঁ হয়ে গেল ডেভিডের মুখ। চমকে গেলাম আমিও। কী বলল এটি সাজিদ? ডেভিড কিছুক্ষণ ওভাবেই তাকিয়ে ছিল সাজিদের দিকে। এরপর প্রশ্ন করল, কী বললে তুমি?

সাজিদ বলল, আমি বললাম যে, খ্রিষ্টানরা যে-দিনটি যিশুর জন্মদিন হিশেবে পালন করে, সে-দিন আসলে যিশুর জন্মদিন নয়। তারা ভুল একটি দিনকে উদ্যাপন করে যাচ্ছে শতাব্দীর পর শতাব্দী।

বুঝতে পারলাম না। সাজিদ কি ড্যান ব্রাউন সাজতে চাচ্ছে নাকি? খ্রিষ্টানরা নাকি যুগের পর যুগ ধরে ভুল দিনে যিশুর জন্মদিন পালন করে আসছে। হাউ স্ট্রেইঞ্জ! ডেভিড মুখ খুলল। বলল, সরি, কুডনট আন্ডারস্ট্যান্ড। ক্যান ইউ ক্ল্যারিফাই ইট পোপারলি?

এই প্রথম ডেভিডের মুখে ন্যাটিভ আমেরিকান টোন শুনলাম। সাজিদ নড়েচড়ে বসল। বলল, আচ্ছা, আমি তোমাকে বুঝিয়ে বলছি। তুমি কি কখনো তোমাদের পবিত্র বাইবেল আগাগোড়া পড়ে দেখেছ?

ডেভিড না সূচক মাথা নাড়ল। পড়েনি। সাজিদ বলল, কোনো সমস্যা নেই; কিন্তু ডেভিড, আমি যদি তোমাকে বলি যিশু খ্রিষ্ট কোন দিনে জন্মগ্রহণ করেছে সে সম্পর্কে বাইবেলে একটি শব্দও নেই, তুমি কি বিশ্বাস করবে?

ডেভিড কোনো কিছুই বলল না। একটি প্রচ্ছন্ন নীরবতা নেমে এলো আমাদের মাঝে। সাজিদ আবার বলতে শুরু করল, ডেভিড, খুব আশ্চর্যের ব্যাপার হলেও সত্য এই যে, পুরো বাইবেলে যিশুর জন্মদিনের ব্যাপারে এক্সাক্ট একটি শব্দও তুমি খুঁজে পাবে না; বরং যিশুর জন্মদিন নিয়ে বাইবেল যা ইঙ্গিত করে, তা শুনলে তুমি নিজেই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাবে।

যেমন?, জানতে চাইল ডেভিড।

আচ্ছা, বল তো যিশু কোথায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন?

ডেভিড দ্রুত উত্তর দিল। বলল, বেথেলহামে।

রাইট। এই বেথেলহাম কোন দেশে অবস্থিত জানো?

হ্যাঁ। ফিলিস্তিন।

এক্সাক্টলি। তুমি কি জানো ফিলিস্তিনে ডিসেম্বরে কোন ঋতু থাকে? আই মিন, এখন ফিলিস্তিনে কোন ঋতু চলছে?

ফিলিস্তিন সম্পর্কে খুব বেশি জানাশোনা নেই ডেভিডের। এ জন্য সে বলতে পারল না ডিসেম্বরে ফিলিস্তিনে কোন ঋতু চলে। তাকে হেল্প করল সাজিদ। বলল, আমি বলছি। ডিসেম্বরে ফিলিস্তিনে এখানকার মতোই শীতকাল। তবে ফিলিস্তিনের শীতটা আরও প্রকট। ইউরোপের মতো শীতকালে ওখানেও তুষারবৃষ্টি হয়। গরমকালে প্রচণ্ড গরম আর শীতকালে প্রচণ্ড ঠান্ডা, শীতল হয়ে পড়ে ওই অঞ্চল।

ডেভিড বলল, আই সী।

সাজিদ আবার বলতে শুরু করল, এবার তোমাকে বাইবেল থেকেই যিশুর জন্মদিনের কথা শোনাই। তুমি কি কখনো বাইবেলের লুক পড়েছ?

হ্যাঁ।

গুড। লুকের শুরুতেই কিন্তু যিশু খ্রিষ্টের জন্মের কাহিনি বর্ণনা করা আছে। সেখানে কী বলা আছে জানো?

ডেভিড তাকিয়ে আছে সাজিদের দিকে। সাজিদ বলল, লুকের কাহিনিতে বর্ণনা করা আছে যে, যিশু খ্রিষ্টের জন্ম হয় বেথেলহামে। রাজ্যে যখন আদমশুমারির ডাক পড়ে, তখন সুদূর গালীল প্রদেশের নাসরত থেকে যিশুর বাগদত্তা পিতা জোসেফ, যিশুর মাতা মেরীকে নিয়ে বেথেলহামে আসেন। মেরী তখন অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। বেথেলহামে আসার পরেই যিশু ভূমিষ্ঠ হয়। ডেভিড বলল, এই শ্লোক আমি পড়েছি; কিন্তু এটি দিয়ে তুমি কী বোঝাতে চাইছ, সাজিদ?

সাজিদ বলল, তুমি এখনো বুঝতে পারোনি?

না।

আচ্ছা। আমি আরও সহজ করে বলছি। খেয়াল করো, প্রথমত, মাতা মেরী অন্তঃসত্ত্বা। দ্বিতীয়ত, গালীল প্রদেশ থেকে বেথেলহামে আসতে হলে তাদের পাড়ি দিতে হবে বহুদূরের পথ। রাইট?

হ্যাঁ।

তৃতীয়ত, মাসটি যদি সত্যিই ডিসেম্বর হয়ে থাকে, তাহলে তো তুষারপাতে ঢাকা রাস্তা ভেঙে এতদূরের পথ পাড়ি দিয়ে মাতা মেরীকে নিয়ে বেথেলহামে আসা কোনোভাবেই জোসেফের পক্ষে সম্ভব না। তোমার কি মনে হয় বরফে আচ্ছাদিত অঞ্চলে, মাইলের পর মাইল পাড়ি দিয়ে একজন অন্তঃসত্ত্বা নারীকে নিয়ে কোনো পুরুষ বেথেলহামে আসতে পারে?

কিছুই বলল না ডেভিড। সাজিদ আবার বলতে লাগল, শুধু তা-ই নয়। কোনো রাজা কখনোই এরকম প্রচণ্ড শীতের সময়ে তার রাজ্যের আদমশুমারি ডাকবেন না। কারণ, এরকম পরিস্থিতিতে রাজ্যের সকল প্রান্ত থেকে লোকজনের পক্ষে এসে হাজিরা দিয়ে যাওয়া জাস্ট ইমপসিবল।

ডেভিড বলল, তো, তুমি কি বলতে চাচ্ছ যে, যিশু বেথেলহামে জন্মগ্রহণ করেনি?

তুমি কি বলতে চাচ্ছ যে, বাইবেলের কাহিনিগুলো বানোয়াট? না। আমি তা বলিনি ডেভিড। আমি শুধু বলতে চেয়েছি যে, এই ঘটনাগুলো ডিসেম্বরে, অর্থাৎ বরফজমা শীতের মৌসুমে সম্ভব না।

মানে?

মানে হলো, এই ঘটনাগুলো থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, এগুলো অবশ্যই শীত মৌসুমের ঘটনা নয়। কীভাবে মাতা মেরী যিশুকে গর্ভে নিয়ে পাড়ি দেবেন বরফঢাকা পথ? কীভাবে একজন রাজা এমন সময়ে আদমশুমারি ডাকতে পারেন যখন রাজ্যজুড়ে নেমে আসে বরফ ঢাকা শীতের মৌসুম?

তাহলে?

হতে পারে, এই ঘটনাগুলো ডিসেম্বর ব্যতীত অন্য মাসের। অন্য মৌসুমের।

কোন মাস বা কোন মৌসুম?

সে ব্যাপারে বাইবেল অবশ্য নির্দিষ্ট করে কিছুই বলে না।

আমাদের গাড়ি শাহবাগে এসে থামল। সাজিদ গাড়ি ভাড়া পরিশোধ করতে করতে বলল, একটু আগেই নেমে গেলাম আমরা। কথা বলতে বলতে যাওয়া যাবে, কী বলো ডেভিড?

ফাইন, ডেভিড বলল। আমরা কি টিসিতে যাব না?

আমি ফিক করে হেসে ফেললাম। বললাম, ওটি টিএসসি হবে, মাই ফ্রেন্ড।

ও হ্যাঁ। টিএসসি।

আমরা ওদিকেই যাচ্ছি, বলল সাজিদ।

শাহবাগের প্রশস্ত রাস্তা ধরে হাঁটছি আমরা। প্রশ্ন করল ডেভিড। বলল, তো, তুমি বলতে চাচ্ছ যে, যিশু ডিসেম্বরে, অর্থাৎ পঁচিশে ডিসেম্বরে জন্মগ্রহণ করেনি, তাই তো?

আমি বলছি না আসলে। বাইবেলের বর্ণনা সে রকমই ইঙ্গিত করছে, বলল সাজিদ।

আই সী। কেবল এটুকু ইঙ্গিত দিয়ে কি প্রমাণিত হয় যে, যিশু ডিসেম্বরের পঁচিশ তারিখে জন্মাননি? আই থিংক, তোমার কথা যদি সত্য হয়, তাহলে বাইবেলে এরকম আরও কিছু তথ্য থাকার কথা।

আছে, সাজিদ বলল। কের দ্বিতীয় অধ্যায়েই আরও কিছু তথ্য আছে যা নির্দেশ করে যে, যিশু আসলে ডিসেম্বরে নয়, এমন কোনো একটি সময়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন যখন শীত ঋতু ছিল না।

যেমন?

যেমন লুকের আট নম্বর শ্লোকে বলা হচ্ছে, যে-রাতে যিশু জন্মগ্রহণ করছিলেন, ওই সময়টায়, অর্থাৎ রাতের বেলায় মেষপালকরা মাঠে তাদের মেষ পাহারা দিচ্ছিল। এই শ্লোক থেকে কয়েকটি ব্যাপার আমাদের বোঝার আছে। আগেই বলেছি ডিসেম্বরে বেথেলহামে প্রচণ্ডরকম শীত পড়ে। তুষারপাতও হয়। এমন একটি সময়ে, রাতের বেলা মেষপালকরা কোন দুঃখে মাঠে মেষ চরাবে? এটি একেবারেই অসম্ভব এবং অযৌক্তিক। প্রথমত, প্রচণ্ড শীতের রাতে মেষপালক এবং মেষ দুটোরই বাইরে থাকা অযৌক্তিক। দ্বিতীয়ত, সে-রকম শীতের রাতে আকাশ কুয়াশায় ঢাকা থাকে। চারদিকে থাকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। এরকম অন্ধকার পরিবেশে মেষপালকরা মাঠে মেষ ছেড়ে দিয়ে পাহারা দিচ্ছে, ব্যাপারটি খুব অযৌক্তিক নয় কি ডেভিড?

তো, তুমি বলতে চাচ্ছ এই ঘটনা মিথ্যা?

তুমি সম্ভবত আমাকে আবার ভুল বুঝছ, ডেভিড। আমি বলছি না যে, এই ঘটনা মিথ্যা; বরং আমি বলতে চাচ্ছি যে, বাইবেলের এই ঘটনা ডিসেম্বর মাসের কনকনে

শীতের রাতে ঘটা একেবারেই অসম্ভব।

তাহলে?

এই ঘটনা ডিসেম্বর মাসের শীত ঋতুর নয়। এই ঘটনা নিশ্চিতরূপে গ্ৰীয় ঋতুর। কারণ, গ্রীষ্মকালে আকাশে চাঁদের জোছনা থাকে। আবহাওয়া গরম এবং শুষ্ক থাকে। এমন সময়েই সাধারণত মেষপালকরা রাতে তাদের মেষ চরাবে। বাইবেলের ইঙ্গিত এবং যুক্তি তা-ই বলে।

ডেভিড কিছুই বলল না। সাজিদ আবার বলতে শুরু করল, খেয়াল করো, যিশুর বাগদত্তা পিতা জোসেফ এবং যিশুকে গর্ভে নিয়ে মাতা মেরীর পক্ষে কি কখনোই গালীল প্রদেশের নাসরত অঞ্চল থেকে বরফে আচ্ছাদিত পথ, কুয়াশার আস্তরণ মাড়িয়ে বেথেলহামে আসা সম্ভব ছিল? ছিল না। যুক্তিতে বিশ্বাসী এমন যে-কেউ বলবে যে, এটি কোনোভাবেই সম্ভব না। তাছাড়া, একজন রাজাও এমন সময়ে রাজ্যে আদমশুমারি ডাকবেন না, যখন ওই রাজ্যে কনকনে শীতকাল। চারদিকে তুষারপাত। তিনি ভালো করেই জানেন—এরকম পরিস্থিতিতে দূর-দূরান্তের প্রজাদের পক্ষে বেথেলহামে আসা সম্ভব না। তাই তিনি ডিসেম্বরে আদমশুমারি ডাকবেন, এটি অসম্ভব। তাহলে কোন সময়ের ঘটনা হতে পারে এটা? হতে পারে . এমন সময়ের যখন আবহাওয়া শুষ্ক ছিল। রাস্তাঘাট ভালো ছিল। তাহলে মেরী এবং জোশেফের পক্ষে গালীল প্রদেশ থেকে বেথেলহামে আসা সহজ। আর, রাজাও এমন সময়ে আদমশুমারি ডেকেছিলেন যখন আবহাওয়া শুষ্ক ছিল। কারণ, আদমশুমারিগুলো সাধারণত ফসল কাটার পর পর ডাকা হতো। কিন্তু ডিসেম্বর কোনোভাবেই ফসল কাটার মৌসুম নয়। তাহলে কোন সময়ের ঘটনা হতে পারে এটি? হতে পারে গ্রীষ্ম ঋতুর ঘটনা।

তাহলে?, প্রশ্ন ডেভিডের।

তাহলে দুইয়ে দুইয়ে চার হয়। মানে, জোসেফ এবং মেরী এমন সময়ে বেথেলহামে এসেছিলেন যখন আবহাওয়া শুষ্ক ছিল এবং রাস্তাঘাট ভালো ছিল। রাজাও এমন একটি সময়ে আদমশুমারি ডেকেছিলেন যখন আবহাওয়া শুষ্ক ছিল। আবার অন্যদিকে, মেষপালকরাও এমন একটি সময়ে, রাতের বেলা মেষ চরাচ্ছিল যখন আকাশে জোছনা ছিল। আবহাওয়া শুষ্ক ছিল। কনকনে শীত ছিল না। মোদ্দাকথা, বাইবেলের বর্ণনা থেকে এই ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, যিশু আসলে শীতের সময়ে, অর্থাৎ ডিসেম্বরে জন্মগ্রহণ করেননি।

আমি এতক্ষণ চুপ করেই ছিলাম; কিন্তু আর চুপ থাকতে পারলাম না। বললাম, সাজিদ, তোর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ থেকে এই কথাই প্রমাণিত হয় যে, যিশু পঁচিশে ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেননি; কিন্তু আমার প্রশ্ন, কুরআনে কি যিশু, আই মিন ঈসা আলাইহিস সালামের জন্মের ব্যাপারে কোনো ইঙ্গিত আছে?

আমার প্রশ্নের সাথে ডেভিডও মাথা নেড়ে সহমত জানাল। সম্ভবত সেও এই প্রশ্নটাই মনে মনে প্রস্তুত করছিল। সাজিদ বলল, বাইবেলের মতো কুরআনও ঈসা আলাইহিস সালামের জন্মের ব্যাপারে নির্দিষ্ট কোনো দিন-তারিখের ব্যাপারে বলে না। তবে কুরআনে কিছুটা ইঙ্গিত পাওয়া যায় ঈসা আলাইহিস সালামের জন্মের সময়ের পরিবেশ সম্পর্কে।

যেমন?, আমি জানতে চাইলাম।

যেমন ধর, পবিত্র কুরআনের সম্পূর্ণ একটি সূরার নামই হলো মারইয়াম। ঈসা আলাইহিস সালামের মাতার নামে এই সূরার নামকরণ। এই সূরার মধ্যে ঈসা আলাইহিস সালাম জন্মের সময়কার কয়েকটি চিত্রের বর্ণনা আছে। মারইয়াম আলাইহাস সালাম যখন আল্লাহর ইচ্ছায় গর্ভবতী হলেন, তখন তিনি খুব ভীত হয়ে পড়লেন। তিনি ভয় পাচ্ছিলেন তার কওম তার বিরুদ্ধে-না আবার ব্যভিচারের অপবাদ আনে! মারইয়াম আলাইহিস সালাম ছিলেন পূত-পবিত্র নারী। তাকে কোনোদিন কোনো পুরুষ স্পর্শও করেনি। কওমের নিন্দার ভয়ে তিনি লোকালয় থেকে দূরে কোথাও চলে গেলেন। যখন তার প্রসববেদনা শুরু হয়, তখন তিনি একটি খেজুর গাছের নিচে অবস্থান করছিলেন। প্রচণ্ড ব্যথা আর কওমের নিন্দার ভয়ে তিনি একেবারেই ভেঙে পড়লেন। প্রচণ্ড দুঃখবোধ থেকে তিনি ওই মুহূর্তে মুখে বিড়বিড় করে যে-কথাগুলো বলেছিলেন, সেগুলো হুবহু কুরআনে স্থান পায়। সূরা মারইয়ামের তেইশ নম্বর আয়াতে বলা হচ্ছে, হায়! এর আগেই (অর্থাৎ ঈসা আলাইহিস সালাম ভূমিষ্ঠের আগেই) যদি আমি মরে যেতাম এবং মুছে যেতাম মানুষের স্মৃতি থেকে।

এমন সময় তাকে শান্তনা দিয়ে আল্লাহর পক্ষ থেকে বলা হলো, তুমি চিন্তা কোরো না। তোমার রব তোমার পায়ের নিচে একটি ঝরনা সৃষ্টি করেছেন। আর তুমি খেজুর গাছের ডাল ধরে নাড়া দাও। তাহলে সেখান থেকে তোমার জন্য পাকা খেজুর পড়বে। এই কথাগুলো আছে সূরা মারইয়ামের চব্বিশ এবং পঁচিশ নম্বর আয়াতে।

আমি বুঝতে পারলাম না, এখান থেকে সাজিদ কী প্রমাণ করতে চাচ্ছে। সম্ভবত ডেভিডও বুঝতে পারেনি। আমি বললাম, এই আয়াতগুলো থেকে কী প্রমাণিত হয়?

সাজিদ বলল, পঁচিশ নম্বর আয়াতটি খেয়াল কর। ওই আয়াতে মারইয়াম আলাইহিস সালামকে কী করতে বলা হচ্ছে? বলা হচ্ছে তিনি যেন খেজুর গাছের ডাল ধরে নাড়া দেন। তাহলে খেজুর গাছ থেকে পাকা খেজুর পড়বে এবং তা মারইয়াম আলাইহাস সালাম খেতে পারবেন।

তো?

এখনো বুঝতে পারিসনি?, সাজিদ আমার কাছে জানতে চাইল।

আমি মুখ কালো করে বললাম, না।

হঠাৎ ইয়েস…ইয়েস… শব্দে চেঁচিয়ে উঠল ডেভিড। এই আমেরিকানকে এভাবে চিৎকার দিয়ে উঠতে দেখে আমি যারপরনাই অবাক হলাম বটে। ডেভিড বলল, আমি মনে হয় বুঝতে পেরেছি তুমি কী বোঝাতে চাচ্ছ।

কী?, প্রশ্ন সাজিদের।

মারইয়ামকে বলা হলো খেজুর গাছের ডাল ধরে নাড়াতে। তাহলে খেজুর গাছ থেকে পাকা খেজুর পড়বে। তার মানে হলো, ডিসেম্বর বা শীতকালে তো খেজুর পাকার কথা নয়। খেজুর পাকে গ্রীষ্মকালে। যেহেতু ওই সময়ে গাছে পাকা খেজুর থাকার কথা বলা হচ্ছে, তাহলে সময়টি নিশ্চিত ডিসেম্বর নয়। কারণ, ডিসেম্বরে কোনোভাবেই খেজুর গাছে পাকা খেজুর থাকবে না।

সাজিদ মুচকি হাসল। বলল, ইউ আর রাইট মাই ফ্রেন্ড। ঠিক এই ব্যাপারটিই আমি বলতে চাচ্ছিলাম। কুরআনের এই ইঙ্গিত থেকেও বোঝা যায় যে, ঈসা আলাইহিস সালাম ডিসেম্বরের শীতে নয়; বরং গ্রীষ্মের কোনো একটি সময়ে জন্মেছেন। বাইবেল থেকেও এরকম ইঙ্গিতই পাওয়া যায়। তাহলে ডেভিড, যে-দিনটায় আসলে যিশু জন্মই নেননি, সে দিনটি তার জন্মদিন হিশেবে পালন করা কি আদৌ ঠিক? তুমি বলো?

ডেভিডের উৎফুল্ল চেহারা মুহূর্তেই আবার অন্ধকারে ছেয়ে গেল। সে বুঝতে পারছে না—কীভাবে তারা যুগের পর যুগ ধরে ভুল একটি দিনে যিশুর জন্মদিন পালন করে যাচ্ছে। ডেভিড মুখ কালো করে বলল, সাজিদ, পঁচিশে ডিসেম্বরে যদি যিশু জন্মগ্রহণ না-ই করে, তাহলে খ্রিষ্টানরা কেন এই দিনে যিশুর জন্মদিন পালন করে?

সরি টু সে মাই ফ্রেন্ড। কোনো খ্রিষ্টানের কাছেই এই প্রশ্নের যথাযথ কোনো উত্তর নেই।

এই দিনটি কীভাবে তাহলে যিশুর জন্মদিন হিশেবে স্বীকৃতি পেল?

সে ইতিহাস অবশ্য অনেক লম্বা। সেই গল্পটি চা খেতে খেতে করা যাক, চলো…।

আমরা হাঁটতে হাঁটতে টিএসসিতে চলে এলাম। মতি ভাইয়ের দোকানের টুলে এসে বসলাম আমরা তিন জন। আমাদের সাথে সাদা চামড়ার এই আগন্তুককে দেখে খানিকটা অবাক হলেন টিএসসির এই সুদর্শন চা-ওয়ালা। একটু পরপর তিনি ডেভিডের দিকে তাকাচ্ছেন। আমাদের দেখে ইতোমধ্যেই কেটলিতে পানি বসিয়ে দিয়েছেন তিনি। মতি ভাইকে নিয়ে আমাদের ক্যাম্পাসে বেশ ভালো রকমের গল্প রটানো আছে। কথিত আছে, তিনি নাকি গ্রামে থাকাবস্থায় কোনো এক পরীর সাথে প্রেম করতেন। দীর্ঘ দুই বছরের প্রেমের ইতি ঘটে, যখন মতি ভাই চায়ের দোকান নিয়ে বসে। মতি ভাই চা বিক্রি করছেন, এটি জানতে পেরেই নাকি পরী মতি ভাইয়ের সাথে ব্রেকআপ করে। একটি পরীর বয়ফ্রেন্ড সামান্য চা-বিক্রেতা, এটি সম্ভবত জিন-সমাজে বেশ অপমানজনক ব্যাপার। এ জন্যেই পরীটি মতি ভাইকে ছেড়ে অন্যত্র চলে যায়।

আমি মতি ভাইকে বললাম, তা মতি ভাই, তোমার পরী কি পরে আর আসছিল?

মতি ভাই বেশ নরম সুরে বললেন, না। আর আইব কিয়েল্লাই। হেতির আর আমারে দিয়া কাম কী কও?

কোনো চিঠিপত্রও কখনো পাঠায়নি?

এবারও মতি ভাই না-সূচক উত্তর দিলেন। এরপর বললেন, তোমাদের কি আদা চা-ই দিমু?

আমি বললাম, তা-ই দাও। ডেভিডের দিকে ফিরে বললাম, ডেভিড, তুমিও কি আদা চা-ই খাবে?

ডেভিড আমেরিকান ইংরেজিতে বলল, হোয়্যাট ডাজ ইট মিন বাই আদা চা?

ডেভিডের ইংরেজি শুনে মতি ভাই আমাকে বলল, কেডা এই লোক?

আমাদের বন্ধু।

কই থাহে?

আমেরিকা। বাংলাদেশে বেড়াতে এসেছে।

মতি ভাই ও বলে আবার চা বানানোয় মন দিল। সাজিদ ডেভিডকে আদা চায়ের ব্যাপারে বুঝিয়ে বলার পরে ডেভিডও আদা চা খাওয়ার ব্যাপারে রাজি হয়ে গেল। ডেভিড বলল, সাজিদ, এবার বুঝিয়ে বলো কেন খ্রিষ্টানরা ভুল দিনে ক্রিসমাস। ডে পালন করে।

সাজিদ গলা খাঁকারি দিল হালকা করে। বলল, সারপ্রাইজিং টুথ কী জানো ডেভিড? এই ক্রিসমাস ডের সাথে ক্রিশ্চিয়ানিটির আসলে কোনো সম্পর্কই নেই।

সাজিদের এই কথা শুনে ডেভিড আর আমি দুজনেই চমকে উঠলাম। বলে কী ও! ক্রিসমাস ডের সাথে নাকি খ্রিষ্টানদের কোনো সম্পর্ক নেই! চোখেমুখে বিস্ময় নিয়ে আমি জিজ্ঞেস করলাম, কী বলছিস এসব তুই? ক্রিসমাস ডের সাথে ক্রিশ্চিয়ানিটির সম্পর্ক নেই মানে? তাহলে ক্রিশ্চিয়ানিটির মধ্যে ক্রিসমাস ডে এলো কোথেকে?

সাজিদ মুচকি হেসে বলল, সেটাই হচ্ছে প্রশ্ন। ক্রিশ্চিয়ানিটির মধ্যে এই উৎসব ঢুকল কী করে! আরও অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে, ক্রিশ্চিয়ানিটির মধ্যে এই ক্রিসমাস ডে তথা পঁচিশে ডিসেম্বরে উৎসব পালনের রীতিটি এসেছে প্যাগানদের কাছ থেকে।

এবার আমি আর ডেভিড দুজনেই হাঁ করে রইলাম। কারও মুখে কোনো কথা নেই যেন। সাজিদ আবার বলতে শুরু করল, এই ইতিহাস অনেক পুরোনো। যিশুর জন্মের আগে ইউরোপে রাজত্ব কত প্যাগানরা। এই প্যাগানরা তখন স্যাটারন্যালিয়া নামক একটি উৎসব পালন করত। দেবতা স্যাটার্ন এর পূজোই এই উৎসবের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। দেবতা স্যাটার্ন ছিল ফসলের দেবতা। ফসল কাটার মৌসুম শেষে যখন সবার ঘরে ঘরে খাবার এবং ফসল মজুদ হয়ে যেত, তখনই এই উৎসব পালন করা হতো বলে জানা যায়। ডিসেম্বরের সতেরো তারিখে এই স্যাটারন্যালিয়া উৎসব পালন করা হতো।

মতি ভাই আমাদের দিকে চা এগিয়ে দিল। আমরা সন্তর্পণে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে সাজিদের কথার দিকে মনোযোগ দিলাম।

প্যাগানদের মধ্যে আরেকটি প্রধান উৎসবের প্রচলন ছিল। সেটি হলো দেবতা মিথ্রাসের জন্মদিন। এটিকে মিথ্রাইজম বলা হয়। মিগ্রাস ছিল আলোর প্রতীক। যিশুর জন্মের দুই হাজার বছর আগ থেকে এই দেবতা মিথ্রাসের পুজোর প্রচলন ছিল প্যাগানদের মধ্যে। জানা যায়, এই মিথ্রাস দেবতার জন্মদিন ছিল পঁচিশে ডিসেম্বর। তাই, প্যাগানরা ডিসেম্বরের পঁচিশ তারিখ এই মিথ্রাসের জন্মদিন পালন করত। প্যাগানরা এই উৎসবকে বলত Dies Natalis Solis Invicti. এর মানে হলো The Birthday of Unconquerable Sun.

যাইহোক, তখন ইউরোপে আস্তে আস্তে ক্রিশ্চিয়ানিটি প্রবেশ করছিল মাত্র। কিছু কিছু প্যাগান প্যাগানিজম ছেড়ে খ্রিষ্টধর্মে চলে আসা শুরু করে। তখন কনস্ট্যানটাইন নামের একজন রোমান, যিনি প্যাগানধর্মের একজন একনিষ্ঠ ভক্ত, তিনি খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করেন। খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করার পরে তিনি প্যাগানদের মধ্যে খ্রিষ্টান চার্চের ব্যাপক প্রচারণা শুরু করে দেন; কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, প্যাগানিজম ছেড়ে তিনি খ্রিষ্টধর্মে আসলেও প্যাগানদের রীতি-নীতিকে মন থেকে ছুড়ে ফেলতে পারেননি। তখন থেকে তিনি চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকেন ক্রিশ্চিয়ানিটি এবং প্যাগানিজমের মধ্যে একটি মেলবন্ধন তৈরি করতে। পরে তিনিই দেবতা স্যাটার্ন এবং দেবতা মিথ্রাসের জন্মদিনকে যিশুর জন্মদিন বলে প্রচার করতে লাগলেন, যাতে একই দিনে প্যাগানরা এবং খ্রিষ্টানরা উৎসব পালন করতে পারে।

আমাদের বিস্ময়ের রেশ এখনো কাটেনি। বললাম, তো, কনস্ট্যানটাইন নামের ভদ্রলোক যে, প্যাগান উৎসবকে যিশুর জন্মদিন বলে চালিয়ে দিল, খ্রিষ্টান পাদ্রীরা আপত্তি করল না কেন?

সাজিদ বলল, গুড পয়েন্ট। কনস্ট্যানটাইন যখন প্যাগান এই উৎসবগুলো যিশুর জন্মদিন বলে চালিয়ে দিল, তখন খ্রিষ্টান পাদ্রীরা কয়েকটি কারণে আপত্তি করেনি। প্রথমত, তাদের নিজেদের কাছেও যিশুর সঠিক জন্মদিনের কোনো প্রমাণ নেই। কারণ, বাইবেলে এটি সম্পর্কে নির্দিষ্ট করে কিছুই বলা নেই। দ্বিতীয়ত, এই পাত্রীরা চাচ্ছিলেন যে, ওই সময়ে ক্রিশ্চিয়ানিটি যেন সর্বত্র ছড়িয়ে যায়। এমতাবস্থায়, যদি প্যাগানদের বোঝানো যায় যে, দেখো, আমরাও কিন্তু তোমাদের মতো পঁচিশে ডিসেম্বরে আমাদের ঈশ্বরের জন্মদিন পালন করি। তোমাদের ঈশ্বর আর আমাদের ঈশ্বর, সে তো একই। আসো, তোমরাও খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করো।

ডেভিড এতক্ষণ পর কথা বলে উঠল। সে বলল, সাজিদ, তুমি বলতে চাচ্ছ যে, প্যাগানদের খ্রিষ্টধর্মে ভিড়ানোর জন্যে চার্চের পাদ্রীরা প্যাগান দেবতার জন্মদিনকে যিশুর জন্মদিন হিশেবে মেনে নিয়েছে?

একদম তা-ই, বলল সাজিদ।

কিন্তু ক্রিসমাস ডেতে প্র্যাকটিস হওয়া রিয়ালগুলো তাহলে কীভাবে এলো?

কোন রিয়ালগুলো?, জানতে চাইল সাজিদ।

এই ধরো, ক্রিসমাস ট্রি এর কথা। ক্রিসমাসের দিন একটি সবুজ গাছকে ঘিরে যে-সাজ-সজ্জা এবং আনন্দ-ফুর্তি হয়, সেটা।

সত্যি বলতে, এই রিচুয়ালগুলোও প্যাগানদের থেকে ধার করা। প্যাগানরা মনে করত সবুজ বৃক্ষ হলে প্রাণ তথা জীবনের প্রতীক। তাই তারা তাদের পুজো-উৎসবে তাদের ঘর এবং ঘরের আশপাশ এরকম সবুজ বৃক্ষ দিয়ে সাজিয়ে রাখত এবং পুজো করত। এমনকি সান্তা ক্লজ, যেটি ক্রিসমাস ডের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ, সেটাও ধার করা জার্মান মিথোলজি থেকে। সান্তা ক্লজ যে ক্রিসমাসের আগের রাতে এসে বাচ্চাদের উপহার দিয়ে যায়, সেটি মিথোলজির দেবতা Odin এর কাহিনি থেকে আসা।

আমি বললাম, তা না-হয় বুঝলাম বাপু; কিন্তু যিশুর সময়কাল থেকেই যদি এই উৎসব পালন হয়ে থাকে তো এত যুক্তি-প্রমাণের তো কোনো দরকার নেই, তাই না?

রাইট, বলল ডেভিড। তার চোখেমুখে উজ্জ্বল আভা। যেন সে শক্ত কোনো ভিত্তি পেয়ে গেল পায়ের তলায়।

সাজিদ বলল, সরি টু সে, পৃথিবীর ইতিহাসে চতুর্থ শতাব্দীর আগে ক্রিসমাস ডে উদ্যাপনের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। এই কথাটি ক্রিশ্চিয়ান চার্চের অক্সফোর্ড ডিকশনারি এভাবে লিখেছে, Though speculation as to the time of the year of Christs birth dates from the early 3rd century…. the celebration of the anniversary does not appear to have been general till the later 4th century. ক্যাথলিক এনসাইক্লোপিডিয়া লিখেছে এরকম, Christmas was not among the earliest festivals of the Church খেয়াল করো, যিশুর জন্মের আরও তিনশো বছর পরে এসে হঠাৎ করে ক্রিসমাস ডে পালন করা শুরু হলো। এর আগে এরকম কোনো উৎসবের নাম-গন্ধও খ্রিষ্টানদের ইতিহাসে ছিল না। অদ্ভুত না ব্যাপারটি?

আমি আর ডেভিড দুজনেই চুপ করে রইলাম। আমাদের মনোযোগ বিচ্ছিন্ন হলো মতি ভাইয়ের কথায়। মতি ভাই বলল, কী ব্যাপার! আম্নেরা দেহি চা-টারে বরফ বানাইয়া ছাইড়লেন।

আমরা খেয়াল করলাম যে, আসলেই আমাদের তিনজনের চা-ই ঠান্ডা বরফ হয়ে আছে। ক্রিসমাসের প্রকৃত রহস্য শুনতে শুনতে ভুলেই গিয়েছি যে, হাতে চায়ের কাপ ধরে বসে আছি।

আমাদের ওই চা আর খাওয়া হলো না। চায়ের বিল পরিশোধ করে দিয়ে হাঁটা ধরলাম বাসার উদ্দেশ্যে। ডেভিডের মুখ একেবারে শুকনো হয়ে আছে। বেচারা কত শখ করে বাংলাদেশে ক্রিসমাস ডে পালন করতে এসেছিল। সাজিদ সবটায় জল ঢেলে দিল। আমি বললাম, তা ডেভিড, অ্যালেনদের বাসার ঠিকানা তো নিলে না এখনো। আগামীকাল তো তোমার সেখানে যাওয়ার কথা।

সে মুখ নিচু করে বলল, না আরিফ। আমি ক্রিসমাস ডেতে অ্যাটেন্ড করব না।

বেচারার শুকনো মুখ দেখে আমার খুব মায়া হলো। আমি সাজিদকে টেনে একপাশে নিয়ে গিয়ে বললাম, অ্যাই, আজকেই তোর এই ইতিহাস টানতে হলো কেন? বেচারা কত শখ করে সেই সুদূর আমেরিকা থেকে বাংলাদেশে ক্রিসমাস পালনের জন্যে এসেছে। তুই তো ওর সব আশায় জল ঢেলে দিলি।

সাজিদ আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল। বলল, বাইবেলে খুব সুন্দর একটি শ্লোক আছে। জানিস কী সেটা?

আমি বললাম, কী?

সাজিদ বলল, Let There Be Light, অর্থাৎ আলোকিত হতে দাও। বাইবেল বলছে, যেখানে অন্ধকার, অজ্ঞতা রয়েছে, সেখানে আলো দাও। আমিও তা-ই করলাম। অন্ধকারে আলো দিলাম।

ঠিক কী কারণে জানি না। শ্লোকটি আমারও বেশ পছন্দ হয়ে গেল। লেট দেয়ার বি লাইট…

ক্রিসমাস ডে সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে

১) McGowan, A. How December 25th Became Christmas, Bible History Daily

২) Stephen Nissenbaum, The Battle for Christmas : A Cultural History of Americas Most Cherished Holiday, New York: Vintage Books, 1997, p. 4.

৩) The two babylons by Alexander Hislops

৪) Golden Bough- Sir James Frazer

৫) Encyclopedia-Man, Myth & Magic by Richard Cavendis

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *