০৯. গল্পে জল্পে ডারউইনিজম

গল্পে জল্পে ডারউইনিজম

সৌরভ। সোহরাওয়ার্দী হলে নতুন উঠেছে। সারা দিন আমার পেছনে ছায়ার মতো লেগে থাকে। তার একটি ব্যাপার আমার খুব চোখে পড়ে। সে যখন আমাকে ভাইয়া বলে ডাকে, তখন তার দুই গালে খুব সুন্দর টোল পড়ে। তার গালে টোল-পড়া দেখে আমার হুমায়ুন আজাদের বিখ্যাত কবিতার দুটো লাইন মনে পড়ে যায়। কবি লিখেছিলেন—

আমি সম্ভবত খুব ছোট্ট কিছুর জন্যে মারা যাব
শিশুর গালের একটি টোলের জন্যে।

সৌরভ অবশ্য শিশু নয়, সদ্য যৌবনে পা দেওয়া তাগড়া যুবক। তবুও তার গালে টোল পড়া দেখে তাকে শিশুদের মতোই দেখায়।

তিন দিন ধরে সে আমার কাছে বায়না ধরেছে। তার খুব ইচ্ছা সে সাজিদকে দেখবে। আমার কাছে সাজিদের এত এত গল্প শুনে সে নাকি সাজিদের বিশাল বড় ফ্যান হয়ে গেছে। সেদিন ভোরবেলায় দেখি আমার রুমের সামনে এসে দাঁড়িয়ে আছে। বলা-কওয়া ছাড়া তার এমন আগমনে বিস্মিত হয়ে বললাম, এত সকাল সকাল আমার কাছে?

সে বলল, তোমার কাছে আসিনি তো। সাজিদ ভাইয়ার কাছে এসেছি।

আমি বেশ অবাক হওয়ার মতো করে বললাম, সাজিদের কাছে যে এসেছিস, সাজিদ জানে?

সে মুখ কালো করে বলল, তা কী করে জানবে? সাজিদ ভাইয়াকে তো আমি চিনি না। ভাইয়াও আমাকে চেনে না।

আমি কঠিন চেহারায় বললাম, তাহলে বললি যে, সাজিদের কাছে এসেছিস?

সে বলল, ওমা! তুমিই তো বলেছিলে তোমরা একই রুমে থাকো। ভাবলাম হঠাৎ করেই চলে আসি। তোমাকে আর সাজিদ ভাইয়াকে, দুজনকেই চমকে দিই।

সৌরভের চমকে দেওয়ার কথা শুনে আমার নিজেরই চমকে যাওয়া উচিত। সাজিদকে ভালো করে চিনলে সে সাজিদকে চমকে দেওয়ার কথা মুখেই আনত না। যে-ছেলের পাশে বোমা ফাটলেও টনক নড়ে না, সৌরভকে দেখে সে যে চমকে যাবে, এই দৃশ্য ভাবতেই আমার হেসে কুটিকুটি হতে মন চাচ্ছে। সৌরভকে বললাম, তোর টাইমিংটা ভুল ছিল রে। এক সপ্তাহ হলো সাজিদ নেই। বাড়িতে গেছে।

সৌরভ হতাশ কণ্ঠে বলল, ওহ।

সমস্যা নেই। আমি তো আছি। বল তোর কী কী জানা লাগবে? সাজিদের চেয়ে আমি ভালো উত্তর দিয়ে থাকি আজকাল।

সৌরভ হেসে উঠে বলল, ফাজলামো কোরো না তো। সাজিদ ভাইয়াকে সেই কবে থেকেই দেখতে চাচ্ছি।

আচ্ছা, ফাজলামো বাদ। ভেতরে এসে বস। একটি সারপ্রাইজ আছে তোর জন্যে।

সারপ্রাইজের কথা শুনে সৌরভের চোখমুখ ঝলমল করে উঠল। সে বলল, সাজিদ ভাইয়া ভেতরেই আছে, তাই না?

না তো।

তার চেহারার ঝলমলে ভাবটি মুহূর্তেই উধাও হয়ে গেল। বলল, তাহলে সারপ্রাইজটি কী?

উঠতি ছেলেপিলেদের এই এক সমস্যা। ধৈর্য থাকে না মোটেও। খানিকটা কর্কশ গলায় বললাম, তোকে যখন বলেছি সারপ্রাইজ আছে, তখন তো কিছু একটি আছেই, তাই না? এত প্রশ্ন করিস কেন?

সৌরভ বেশ লজ্জিত চেহারায় বলল, সরি ভাইয়া।

ভাইয়া বলতে গিয়ে বেচারার গালে টোল-পড়া দেখে আমি হেসে দিলাম। বললাম, হয়েছে। এবার ভেতরে আয়।

সৌরভ ভেতরে এসে বসল। ছেলেটি বেশ ভদ্র। কম কথা বলে। কিছু বললে মনোযাগ দিয়ে শোনে। দ্বিমতের জায়গাগুলো খুব ধীরে-সুস্থে তুলে ধরে।

আমি তাকে বললাম, চা খাবি, সৌরভ?

সে মাথা নেড়ে বলল খাবে না। নিজের জন্যে এক কাপ চা করে নিয়ে আমি চেয়ারে এসে বসলাম। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে, সাজিদের বুক শেলফটি দেখিয়ে বললাম, এটি হচ্ছে আমাদের বিখ্যাত মি. আইনস্টাইনের বুক শেলফ।

সৌরভ আমার দিকে বেশ অদ্ভুতভাবে তাকাল।বলল, আইনস্টাইনের বুক শেলফ মানে?

কোনা-চোখে সৌরভের দিকে তাকালাম। তার চোখেমুখে বিস্ময়ের রেশ ফুটে উঠেছে। বুঝতে পারলাম সাজিদের আইনস্টাইন হয়ে ওঠার গল্পটি তার কাছে করা হয়নি। এ জন্যেই বেচারা চমকে গেছে। বললাম, সে এক লঙ্কা-কাহিনি। অন্যদিন করা যাবে।

হালকা নীরবতার পরে সৌরভ বলল, কী সারপ্রাইজ সেটি তো বললে না?

আরে তাইতো!ওকে তো একটি সারপ্রাইজ দেববলেছিলাম; কিন্তুকী যেদিই! এদিক-সেদিক তাকাতেই আমার চোখ গিয়ে আটকালো সাজিদের ড্রয়ারের দিকে। ইউরেকা! এই ড্রয়ারেই তো তার বিখ্যাত ডায়েরিটি থাকে। মান্ধাতা আমলের সেই ডায়েরি…।

উঠে গিয়ে তার ড্রয়ার খুলে ডায়েরিটি বের করলাম। সৌরভের হাতে দিয়ে বললাম, এইটাই হলো সারপ্রাইজ!

সে চোখ বড় বড় করে ডায়েরিটির দিকে তাকিয়ে বলল, এটি তো একটি ডায়েরি মনে হচ্ছে।

হ্যাঁ। ডায়েরিই তো।

এটি দিয়ে আমি কী করব?

পড়বি।

তোমার ডায়েরি পড়ে আমি কী করব?

ধুর! এটি আমার ডায়েরি না। এটি সাজিদের ডায়েরি। খুব বিখ্যাত ডায়েরি আমার মতে।

ডায়েরিটি সাজিদের এই কথা শুনে ওর মুখ ঝলমল করে উঠল। পরক্ষণেই বলল, কিন্তু সাজিদ ভাইয়ার ডায়েরি এভাবে পড়া কি ঠিক? তিনি যদি কিছু মনে করেন?

সৌরভের ব্যবহারের মতো তার কমনসেন্সটাও ভারি চমৎকার। অন্যের সামান্য ডায়েরি পড়ার ব্যাপারেও সে কতকিছু চিন্তা করে। আজকালকার ছেলে-মেয়েদের মধ্যে এরকম কমন-সেন্সের বড়ই অভাব। আমি বললাম, শোন, এই ডায়েরিটি তার বিভিন্ন ভাবনা, ভ্রমণ-কাহিনি, অভিজ্ঞতার লেখাজোখাতে ঠাসা। সাজিদের এই ডায়েরি পড়ার অনুমতি আমার আছে। আমি তোকে অনুমতি দিলাম। তুই নিশ্চিন্তে পড়তে পারিস। মন চাইলে পড়। আমি হালকা পড়াশোনা করে নিই।

সৌরভ ডায়েরির পাতা উল্টে পড়তে লাগল। খেয়াল করলাম, সে ডায়েরির একেবারে শেষদিক থেকে শুরু করেছে। ডায়েরির পাতায় বড় বড় করে একটি শিরোনাম লেখা, গল্পে জল্পে ডারউইনিজম। সৌরভ খুব মনোযোগ দিয়ে পড়তে শুরু করল…

ডারউইন হলেন বিবর্তনবাদের জনক। পৃথিবীতে সকল উদ্ভিদ এবং প্রাণী এসেছে একটি এককোষী ব্যাকটেরিয়া থেকে, এই তত্ত্বকে জনপ্রিয় করার নেপথ্যনায়ক হলেন এই ডারউইন। তার ব্যাপারে বিভিন্ন মহল থেকে নানান রকম গল্প, ঘটনা জানা যায়; কিন্তু আজকে আমি ডারউইন তথা তার তত্ত্বের যে-দিকটি লিখতে যাচ্ছি, সেটি একটি বিধ্বংসী দিক। এই দিকটার কথা খুব কম বিবর্তনবাদী জানে অথবা জানলেও স্বীকার করে না।

প্রকৃতিতে প্রাণীদের টিকে থাকার ব্যাপারে যে-তত্ত্ব ডারউইন প্রস্তাব করেছিল, সেটি ছিল ন্যাচারাল সিলেকশান। অর্থাৎ প্রকৃতিই বেছে নেবে দিনশেষে প্রকৃতিতে কে টিকবে আর কে বিলুপ্ত হবে। ডারউইন তার বিখ্যাত বই, যেটিকে বিবর্তনবাদের বাইবেল বলা হয়, সেটির নামও রাখেন এটিকে মূল বিষয় ধরে। বইটির নাম Origin of species: By means of natural selection. বইটির নাম থেকেই বইটির বিষয়বস্তু সহজে অনুমেয়। কীভাবে প্রকৃতির বাছাইয়ের মাধ্যমে প্রাণীর উদ্ভব হয়। বলা বাহুল্য, এই ন্যাচারাল সিলেকশান-কে অনেকে সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট হিশেবেও উল্লেখ করে থাকে। সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট মানে হলো যোগ্যতমের টিকে থাকার লড়াই। সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্টের মূল কথা হলো, প্রকৃতিতে একটি অবিরাম সংগ্রাম চলছে। এই সংগ্রাম হলো টিকে থাকার সংগ্রাম। দিনশেষে প্রকৃতিতে তারাই টিকে থাকবে, যারা যোগ্য। অযোগ্য এবং দুর্বলেরা বিলুপ্ত হবে।

আপাতদৃষ্টিতে এই কথাগুলোকে বৈজ্ঞানিক কথাবার্তা মনে হলেও এই কথাগুলো দ্বারা উৎসাহিত হয়ে মানব-ইতিহাসে ঘটে গেছে এমন কিছু ঘটনা, যার দায় ডারউইনিজম কোনোভাবেই এড়াতে পারে না।

সৌরভ খুব অবাক হলো। বায়োলজির একজন ছাত্র হিশেবে তাকে ডারউইনিজম পড়তে হয়। পড়তে হয় ন্যাচারাল সিলেকশানের কথা, এককোষী ব্যাকটেরিয়া থেকে উদ্ভিদ এবং প্রাণীজগতের আবির্ভাবের ব্যাপারেও তাকে পড়াশোনা করতে হয়। সে জানে এই থিওরিটি বিজ্ঞানের ইতিহাসের সবচেয়ে বিতর্কিত একটি থিওরি। এই থিওরির বিরুদ্ধে বিজ্ঞানীমহল থেকে নানান ধরনের ক্রিটিসিজম আসলেও সে সম্পর্কে খুব-একটা কনসার্ন নন অ্যাকাডেমিক সাইন্সের হর্তাকর্তারা। কোনো এক অদৃশ্য কারণে তারা মাইকেল বেহে, মাইকেল ডেন্টন, জোনাথন ওয়েলস, ডগুলাস এক্স, স্টিফেন মায়ারসহ আরও অনেক বিজ্ঞানীর বিবর্তনের বিরুদ্ধে অ্যাকাডেমিক কাজকে পাত্তা দেন না। সৌরভ কারও কারও কাছে শুনেছে, পশ্চিমা বস্তুবাদী মহল নাকি পুরোটাই টিকে আছে এই বিবর্তনবাদের ওপর ভর করে। বিবর্তনবাদ ভেঙে পড়লে তাদের সব পরিকল্পনা মুহূর্তেই ভেস্তে যাবে আর পৃথিবী ধর্মহীন করার যে-চক্রান্ত, সেটি নস্যাৎ হয়ে পড়বে। এ জন্যেই বর্তমান বিজ্ঞান অ্যাকাডেমিয়ার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেওয়া বস্তুবাদীরা বিজ্ঞানের অন্দরমহলে কখনোই স্রষ্টাকে ঢুকতে দেবে না। ধর্মহীন পৃথিবী গড়তে একমাত্র বিবর্তনবাদই হলো তাদের তুরুপের তাস; কিন্তু এই ডায়েরিতে এমন কী লেখা আছে, যা সম্পর্কে সৌরভ জানে না? বেড়ে গেল তার কৌতূহলের মাত্রা। সে পরের পৃষ্ঠা উল্টাল। আবারও গভীর মনোযোগের সাথে পড়তে লাগল সে।

হিটলারের ঘটনা আমরা সকলেই জানি। প্রায় ষাট লক্ষ ইহুদী খুন করার মাধ্যমে সে পৃথিবী থেকে ইহুদী-জাতিকে বিলুপ্ত করে দিতে চেয়েছিল। নিঃসন্দেহে, এটি ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে বর্বোরোচিত ঘটনাগুলোর অন্যতম। ইহুদী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও হিটলার হয়ে ওঠে একজন বিধ্বংসী নাস্তিক। তার দৃষ্টিতে ইহুদীরা ছিল নিচু জাত, ম্লেচ্ছ। যারা ম্লেচ্ছ, তাদের বেঁচে থাকার কোনো অধিকার থাকতে পারে না এটাই ছিল হিটলারের চিন্তাধারা। এই চিন্তাধারার বীজ কোথায় প্রোথিত আমরা কি তা জানি? এই চিন্তাধারার বীজ প্রোথিত ছিল ডারউইনের সেই Natural selection থিওরিতে। হিটলার তার Mein Kampf তথা My Struggle নামের আত্মজীবনীতে GIC3301, If nature doesnt wish that weaker individuals should mate with the stronger, she wishes even less that a superior race should intermingle with an inferior one; because in such cases all her efforts, throughout hundreds of thousands of years, to establish an evolutionary higher stage of being, may thus be rendered futile.

But, such a preservation goes hand-in-hand with the inexorable law that it is the strongest and the best who must triumph and that they have right to endure. he who would live, must fight. he who doesnt wish to fight in this world, where permanent struggle is the law of life, hasnt the right to exist.[১]

হিটলারের আত্মজীবনীর এই কথাগুলো খুব মনোযোগের সাথে যদি আমরা খেয়াল করি, তাহলে দেখব যে—এখানে ঠিক সেই কথাগুলোই প্রতিধ্বনিত হচ্ছে, যা আমাদের চার্লস ডারউইনের ন্যাচারাল সিলেকশান শেখায়। হিটলার বলেছে If nature doesnt wish, এখানে Nature বলতে হিটলার কী বুঝিয়েছে? চার্লস ডারউইনের সেই ন্যাচারাল সিলেকশান নয়তো? হিটলার খুব স্পষ্ট করেই দুটি ধারার কথা বলেছেন। একটি হলো Superior race, অন্যটি হলো Inferior race. অর্থাৎ সবল আর দুর্বলের মধ্যে একটি সংঘাত, একটি লড়াই যে প্রকৃতিতে বলবৎ, সেটি হিটলার খুব স্পষ্ট করেই লিখেছেন। ঠিক একই কথাগুলো আমরা ন্যাচারাল সিলেকশান তথা প্রকৃতির বাছাইকরণ পদ্ধতির মধ্যেও দেখতে পাই।

হিটলার আরও লিখেছেন, It is the strongest and the best who must triumph and that they have right to endure. হিটলার বলতে চেয়েছেন সবলরাই প্রকৃতিতে টিকে থাকবে এবং এটাই হওয়া উচিত। অন্যদিকে, দুর্বলদের ক্ষেত্রে কী হবে সে ব্যাপারে বলতে গিয়ে হিটলার লিখেছেন He who doesnt wish to fight in this world, where permanent struggle is the law of life, hasnt the right to exist.

খুবই স্পষ্ট কথা। হিটলার বলেছে, সংগ্রামই যেখানে law of life, সেখানে যারা এই সংগ্রামে অংশগ্রহণ করবে না, তাদের প্রকৃতিতে টিকে থাকার কোনো অধিকার নেই।

হিটলারের উদ্ধৃত কথাগুলো ডারউইনের ন্যাচারাল সিলেকশানের সাথে খুব সামঞ্জস্যপূর্ণ। এমনকি, হিটলার Evolutionary higher stage এর কথাও উল্লেখ করেছেন।

হিটলার ভাবত ইহুদীরা যেহেতু ম্লেচ্ছ এবং প্রকৃতিতে সংগ্রাম করে টিকে থাকার যোগ্য নয়, তাই সে প্রায় ষাট লক্ষ ইহুদীকে হত্যা করে বসে।

সৌরভ খুব অবাক হলো। সে এতদিন ভাবত হিটলার একজন গোঁড়া খ্রিষ্টান হয়ে পড়েছিল, যার কারণে সে ইহুদীদের প্রতি চরম বিদ্বেষী হয়ে ওঠে; কিন্তু ঘটনার পরম্পরা যে এত গভীরে সে আসলে কখনো ভাবতেও পারেনি। সৌরভ ভাবল, আচ্ছা, হিটলার কি সত্যিই ডারউইনিয়ান এভুলুশান পড়েই এতদূর এগিয়েছে? সে ডায়েরিটার পরের পৃষ্ঠা উল্টাল। পরের পাতাগুলোও বেশ ভর্তি। সে খুব মনোযোগ দিয়ে আবার পড়া শুরু করে দেয় :

এখানে কেবল হিটলারের ঘটনা দিয়ে ইতি টেনে দিলে ব্যাপারটির প্রতি অন্যায় করা হবে। শুধু হিটলারকেই নয়, ডারউইন প্রভাব ফেলেছিলেন আরও অনেক বিখ্যাত ব্যক্তির ওপরেও। এই তালিকায় আছে কার্ল মার্ক্স, লেলিন এবং স্ট্যালিন।

কার্ল মার্ক্সকে সমাজতন্ত্রের জনক হিশেবে গণ্য করা হয়। সমাজতন্ত্র হিশেবে আমাদের যা বলা হয় বা যা শেখানো হয় তা হলো, সমাজতন্ত্র সমাজের শ্রেণি-বৈষম্য নিয়ে কাজ করে। আদতে, এখানেও একটি শুভঙ্করের ফাঁকি রয়েছে। সমাজতন্ত্রের আগাগোড়াজুড়ে রয়েছে ডারউইনিজম। আর ডারউইনিজম সম্পর্কিত নাস্তিকতার সাথে। সুতরাং, সমাজতন্ত্রকে বলতে গেলে নাস্তিকতার প্রতিরূপ হিশেবে কল্পনা করা যায়।

যাই হোক, কার্ল মার্ক্সের সাথে ডারউইনিজমের সম্পর্ক নিয়ে আলোচনায় আসা যাক। মূলত, কমিউনিজম তথা সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা হলেন দুজন। কার্ল মার্ক্স এবং ফ্রেডরিক এঙ্গেলস। কমিউনিজমের ওপরে কার্ল মার্ক্সের লিখিত বিখ্যাত একটি বই আছে। এটিকে সমাজতন্ত্রের বাইবেল বলা যেতে পারে। বইটির নাম Das Capital. খুবই মজার ব্যাপার হচ্ছে, কার্ল মার্ক্স নিজে এই বইটি উৎসর্গ করেছিলেন বিবর্তনবাদের জনক চার্লস ডারউইনকে। ডারউইনকে দুজনে এত বেশিই পরিমাণে পছন্দ করতেন যে, ডারউইনের প্রথম বই Origin of species বের হলে ফ্রেডরিক এঙ্গেলস এক চিঠিতে কার্ল মার্ক্সকে লেখেন, Darwin, whom I am just now reading, is splendid.[২]

এঙ্গেলসের চিঠির প্রত্যুত্তরে মার্ক্স লিখেছেন, This is the book which contains the basis of natural history of our view.[৩]

মার্ক্স বলেছেন যে, তারা ন্যাচারাল হিস্ট্রি সম্পর্কে যে-ধারণা পোষণ করে থাকে, সেটার পূর্ণ প্রতিফলন আছে ডারউইনের বইতে। সুতরাং, ডারউইনিজম আর মার্ক্সিজম তথা সমাজতন্ত্র যে—মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ সে কথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

কাহিনির এখানেই অবশ্য শেষ নয়। লেসাবেল নামের এক বন্ধুকে কার্ল মার্ক্স চিঠিতে Foto 362a, Darwins book is very important and serves me as a basis in natural science for the class strugle in history.[৪]

শ্রেণি-সংগ্রামের যে-ভিত্তি এবং প্রকৃতির সবখানে যে সেটি বলবৎ, ডারউইনের রচনাবলি পড়ার পরে সেটি কার্ল মার্ক্স আরও ভালোভাবে উপলব্ধি করেন। এই কথার সত্যতা পাওয়া যায় কার্ল মার্ক্সের বধু এঙ্গেলস লিখিত একটি বইয়ে। এঙ্গেলস ডারউইন এবং কার্ল মার্ক্সকে একই সমান্তরালে এনে লেখেন, Just as Darwin discovered the law of Evolution in organic nature, so Marx discovered the law of nature in human history. [৫]

অর্থাৎ ডারউইন উদ্ভিদ এবং প্রাণীর অর্গানিক ফিল্ডের যে ল আবিষ্কার করেছেন, মার্ক্স সে রকম ল আবিষ্কার করেছেন মানবজাতির ইতিহাসের। আরও সহজভাবে, ডারউইন যে-শ্রেণি-সংগ্রামের ভেতর দিয়ে উদ্ভিদ এবং প্রাণিজগতের আবির্ভাবের কথা বলেছেন, ঠিক সেই একই শ্রেণি-সংগ্রামের ভেতর দিয়ে মানবজাতির ইতিহাসের বিবর্তনের কথা বলেছেন মার্ক্স।

ডারউইনিজম এবং কমিউনিজমের মধ্যকার সুগভীর সম্পর্ক বোঝাতে কার্ল মার্ক্সের একটি জীবনীতে লেখা হয়েছে, Darwinism presented a whole string of truth supporting Marxism and proving and developing the truth of it. The spread of Darwinist evolutionary ideas created a fertile ground for Marxist ideas as a whole to be taken on board by the working class… Marx, Engels, and Lenin attached great value to the ideas of Darwin and pointed to their scientific importance and in this way the spread of these ideas was accelerated.[৬]

অর্থাৎ মার্ক্সিজম তথা কমিউনিজম যে একটি অন্যটির পরিপূরক, সে-কথা এই বক্তব্যগুলোতে একদম সুস্পষ্ট। আরও বলা হয়েছে, ডারউইনের আইডিয়া থেকে মার্ক্স, এঙ্গেলস এবং লেনিনরা উপকৃত হয়েছে এবং সেগুলো কাজে লাগিয়েছে।

সৌরভ যেন খুব চিন্তায় পড়ে গেল। এই তো কয়েকদিন আগে সৌরভদের ডিপার্টমেন্টের এক বড়ভাই তার কাছে কমিউনিজমের দাওয়াত নিয়ে এসেছিল। রক্ষণশীল ধর্মীয় পরিবার থেকে উঠে আসা ধার্মিক যুবক সৌরভ তখন মাত্র ক্যাম্পাসে পা দিয়েছে। তার কাছে বিভাস মণ্ডল নামের একজন কমিউনিস্ট ছাত্র আন্দোলনের নেতা কমিউনিজমের ব্যাপারে একথা-সেকথা বলতে এলে সৌরভ প্রথমেই জিজ্ঞেস করেছিল, আচ্ছা, কমিউনিজম কি নাস্তিকতা-ঘেঁষা কোনো কিছু?

সেদিন বিভাস মণ্ডল বেশ সুন্দরভাবেই সৌরভের এই প্রশ্নকে এড়িয়ে গিয়েছিল। আজ সৌরভ বুঝতে পারছে আসলে কমিউনিজম আর এথেইজম তথা ডারউইনিজমের মধ্যে কী সম্পর্ক। সে আবার পড়া শুরু করে দেয় সাজিদের ডায়েরি :

কার্ল মার্ক্সের ফিলোসফিকে যে-ব্যক্তি বাস্তব রূপ দান করে, তার নাম লেনিন। ইতিহাসের ছাত্র মাত্রই নামটির সাথে পরিচিত। Communist Bolsheviks Movement নামের একটি ইতিহাস বিখ্যাত আন্দোলনের মাধ্যমে লেনিন রাশিয়ার ক্ষমতা দখল করে। বলাই বাহুল্য, এই আন্দোলন রাশিয়ার ইতিহাসে অন্যতম একটি রক্তক্ষয়ী আন্দোলন ছিল। এই আন্দোলনে মারা গিয়েছিল হাজার হাজার মানুষ এবং বাস্তুহারা হয়েছিল অনেক মানুষ। মার্ক্সের অন্যতম শিষ্য, কমিউনিজমের ঝাণ্ডাবাহী এই লেনিনও ছিল ডারউইনের গুণমুগ্ধ ভক্ত। ডারউইন সম্পর্কে সে লিখেছে, Darwin put an end to the belief that the animal and vegetable species bear no relation to one another, except by chance, and that they were created by God, and hence immutable.[৭]

মানে, ধর্মবাদী ধার্মিকরা উদ্ভিদ এবং প্রাণীর ব্যাপারে যে প্রথাগত বিশ্বাস রাখে, সেই বিশ্বাসের ইতি ঘটিয়েছেন ডারউইন। লেনিনের পরে রাশিয়ার ক্ষমতা দখল করে আরেক নাস্তিক, বস্তুবাদী কমিউনিস্ট স্ট্যালিন। ইতিহাস থেকে জানা যায়, স্ট্যালিন হত্যা করেছিল প্রায় এক মিলিয়ন মানুষকে এবং ঘরবাড়ি ছাড়া করেছিল বিশ মিলিয়নেরও বেশি মানুষকে। এই স্টালিনও ছিল ডারউইনের একজন তুখোড় ভক্ত। ডারউইন সম্পর্কে স্ট্যালিন লিখেছে, There are three things that we do to disabuse the minds of our seminary students. We had to teach them the age of the earth, the geologic origin, and Darwins teachings.

ছোটবেলা থেকেই স্ট্যালিন ডারউইনের ফ্যান হয়ে পড়ে। স্ট্যালিনের এক বাল্যবন্ধু স্ট্যালিনের জীবনী লিখেছিল। সেখানে তিনি জানিয়েছেন যে, স্ট্যালিন মূলত ডারউইনের বইপত্র পড়েই নাস্তিক হয়ে পড়ে এবং তার সেই বন্ধুকে ডারউইনের বইপত্র পড়ার জন্যে চাপ প্রয়োগ করত। তিনি লেখেন, At a very early age, while still a pupil in the ecclesiastical school, Comrade Stalin developed a critical mind and revolutionary sentiments. He began to read Darwin and became an atheist. [৮]

হিটলার, মার্ক্স, এঙ্গেলস, লেলিন এবং স্ট্যালিন। পৃথিবীর ইতিহাসে কেউ ঘটিয়েছে হত্যাকাণ্ড, কেউ বপন করেছে নাস্তিকতার বীজ। এদের সবার মূল গিয়ে পৌঁছেছে। একটি জায়গায়—ডারউইন এবং ডারউইনিজম; কিন্তু কোনো এক অদ্ভুত কারণে আমাদের ইতিহাস কিংবা বিজ্ঞানের কোনো পাঠ্যতালিকায় আমরা এই ইতিহাসগুলো খুঁজে পাই না। সবখানে একটা আবছা অন্ধকার!

সাজিদের ডায়েরিতে এই পর্যন্তই লেখা। সৌরভ ডায়েরিটি বন্ধ করল। এরপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি না বলেছিলে সাজিদ ভাইয়ার কোনো এক স্যার তাকে কী একটি নামে ডাকে?

আমি বললাম, হু। মফিজুর রহমান স্যার। সাজিদকে মি. আইন্সটাইন বলে ডাকে, ব্যঙ্গ করে।

তিনি কিন্তু খুব একটা খারাপ বলেন না।

সৌরভের কথা শুনে আমার চোখ কপালে উঠে গেল। বললাম, মানে?

সৌরভ মুচকি হেসে বলল, সাজিদ ভাইয়া হলো আমাদের আইনস্টাইন। হা-হা-হা-হা…।

আমি সৌরভের চেহারার দিকে তাকালাম ভালো করে। ছেলেটি তখনো হাসছে। তার গালে সুন্দর একটি টোল পড়েছে। ভারি সুন্দর!

————-
১ Mein Kamp, Hitler, Page : 239-240

২ Evolution, Marxian Biology & the social scene, Page : 85-87

৩ Evolution, Marxian Biology & the social scene, Page : 85-87

৪ Evolution, Marxian Biology & the social scene, Page : 85-87

৫ Evolution, Marxian Biology & the social scene, Page : 85-87

৬ The Biography Of Karl Marx, Oncu Yayinevi, Page : 368

৭ Landmarks in the life of Stalin, E. Yaroslavsky, Page : 08

৮ Landmarks in the life of Stalin, E. Yaroslavsky, Page : 08

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *