৩৫. খাতাখানা এনে ড্রয়ারে পুরে রাখল বকুল

মাধুরী-বৌয়ের কাছ থেকে খাতাখানা এনে ড্রয়ারে পুরে রাখল বকুল। বকুলের ড্রয়ারে কখনো চাবির পাট নেই, তার জন্যে কোনোদিন কোনো অভাবও অনুভব করেনি।

আজই হঠাৎ মনে হলো, যেন ওটাকে চাবির মধ্যে বন্ধ করে রাখতে পারলেই ভাল হয়। না, কেউ বকুলের ড্রয়ারে হাত দেবে এ ভাবনা আর নেই, অনেক দিন হয়ে গেল, সেই সামাল-সামালের স্বাদ ভুলে গেছে বকুল।

লিখতে লিখতে আধখানা ফেলে রেখে গেলেও টেনে-উটকে পড়ে নিতো শম্পা। এখন বকুলের টেলিফোনে কদাচ কারো হাত পড়ে, বকুলের টেবিলে ড্রয়ারে হাত পড়ে না। এ বাড়িতে আরো ছেলেমেয়ে আছে, কিন্তু তারা বকুলের অচেনা। তারা এদিক মাড়ায় না।

তবু বকুলের মনে হল চাবি বন্ধ করে রেখে দিলে বুঝি স্বস্তি হত। যদিও খুলে দেখেনি এক পাতাও। থাক, কোনো এক সময়ের জন্যে থাক। আজ তো এক্ষুনি আবার বেরিয়ে যেতে হবে।

দেশবন্ধু হলে বাংলা সাহিত্য সম্মেলনের আজ বিশেষ বার্ষিক অধিবেশন।

সাহিত্যে অধোগতি হচ্ছে কিনা এবং যদি হয়ে থাকে তো প্রতিকার কী? এই নিয়ে তোড়জোড় আলোচনা চালানো হবে।

এ আলোচনায় অংশগ্রহণ করা অনামিকা দেবীর অবশ্যকর্তব্য। ঘন্টা-তিনেক ধরে অনামিকা দেবী এবং আরো অনেক দেব-দেবী বাংলা সাহিত্যের ভবিষ্যৎ পন্থা নিরূপণ করে শেষ রায় দিয়ে যখন বেরোচ্ছেন, তখন একটি মেয়ে অনামিকার কাছে এসে নমস্কার করে দাঁড়াল।

অনামিকা চমকে উঠলেন, বৌমা? শোভনের বৌ, তুমি এসেছিলে এখানে?

হ্যাঁ।

কখন এসেছ? কোন্‌খানে বসেছিলে? দেখতে পাইনি তো?

আপনারা দেখতে পাবেন, এমন জায়গায় বসতে পাবো? শোভনের বৌ রেখা একটু হাসল, আমাদের কি সেই টিকিট?

কী মুশকিল! এর আবার টিকিট কি? সঙ্গে কেউ আছে নাকি?

তা তো আছেই। কারো শরণাপন্ন না হলে তো প্রবেশপত্র মিলতো না। আমার এক কবি মাসতুতো দাদার শরণাপন্ন হয়ে এসেছি।

বেশ করেছো। তুমি সাহিত্য-টাহিত্য বেশ ভালবাস, তাই না?

রেখা মৃদু হেসে বলে, সাহিত্যকে ভালবাসি কিনা জানি না, তবে একজন সাহিত্যিককে অন্ততঃ ভাল লাগে, তাই দেখতে এলাম তাকে।

অনামিকা হাসলেন।

কিন্তু–অনামিকা মনে মনে ভাবলেন, এটা কী হল? রেখা কি নরম হয়ে গেছে? রেখা কি বকুলকে মাধ্যম করে ওদের চিড়-খাওয়া জীবনটাকে মেরামত করে ফেলতে চায়?

অনামিকা ঠিক বুঝতে পারলেন না। অনামিকা সাবধানে বললেন, খুব রোগা হয়ে গেছো!

রেখা বলল, কই?

নিজে নিজে কি বোঝা যায়? ছেলেমেয়ে ভাল আছে?

বলেই মনে হলো জিজ্ঞেস না করলেই ভাল ছিল। কোথায় ছেলে, কোথায় মেয়ে, কে জানে!

কিন্তু রেখা বৌমা সে কথা বলল না।

সে শুধু মলিন একটু হেসে বলে, ভালই আছে বোধ হয়। খোকাকে তো শুনেছি আসানসোলে মিশন স্কুলের বোর্ডিঙে ভর্তি করে দিয়েছে।

অনামিকা একটু থেমে বলেন, শুনেছো?

রেখার মুখে এখনো হাসি। বলে, তাই তো। মায়ের কাছে চন্দননগরে ছিল, তারপর মার চিঠিতে জেনেছি।

চারিদিকে লোক।

তবু এও এক ধরনের নির্জনতা।

অনেক লোকের ভিড়ের মধ্যে নিভৃতে কথা বলা যায়।

অনামিকা শান্ত মৃদু গলায় বলেন, মার চিঠিতে জানতে হলো খবরটা?

রেখা অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো।

অনামিকা বকুল হয়ে গেলেন না, অনামিকা দেবীই থেকে মৃদু মার্জিত গলায় বললেন, সব কিছু শেষ হয়ে যাওয়াটা কি এত সহজ রেখা?

রেখা চোখ তুলে তাকিয়ে বলে, শক্তই বা হলো কই?

অনামিকা তাকিয়ে দেখেন।

রেখার এমন প্রসাধনবর্জিত মুখ কবে দেখেছেন অনামিকা? রেখার পরনে একখানা সাদা টাঙাইল শাড়ি, রেখার মুখে উগ্র পেন্টের আতিশয্য নেই।

মনটা মমতায় ভরে গেল।

আস্তে বললেন, রেখা, খুব জটিল অঙ্ক কষতে তো সময় লাগে!

রেখাও মৃদু ভাবে বলে, তা তো লাগেই। হয়তো সারাজীবন ধরেই কষতে হবে।

অনামিকা বলেন, তোমাদের যুগকে আমরা খুব বিচক্ষণ আর বুদ্ধিমান ভাবতাম বৌমা।

রেখা চুপ করে রইলো।

অনামিকা আবার বললেন, আর কিছুতেই কিছু হয় না বোধ হয়?

রেখা বলে, সে হওয়ার কিছু মূল্য আছে মাসিমা?

তা বটে। খুকু স্কুলে ভর্তি হয়েছে?

কবে!

অনামিকা আবহাওয়া হালকা করতে বলেন, তোমার মা বাবা ভাল আছেন?

ওই পরিস্থিতিতে যতটুকু ভাল থাকা সম্ভব। একটা শোধ হয়ে যাওয়া ঋণের বোঝা আবার যদি নতুন করে ঘাড়ে চাপে, ভাল থাকা কি সম্ভব?

অনামিকা আর কি বলবেন?

এই নিষ্প্রভ মৃতকল্প পরিস্থিতিতে কোন্ কথা বলবেন?

রেখা আবার বলে, শম্পাকে মাঝে মাঝে দেখি—

শম্পা–

হ্যাঁ। একসময় শুনেছিলাম ওকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তাই ভাবলাম আপনি তো এখানে আসছেন আজ, খবরটা দিই।

অনামিকা একটু হেসে বলেন, ঠিক তোমার মত করেই ওকেও একদিন আবিষ্কার করেছিলাম।

ওঃ, পেয়েছেন খবর? 

হুঁ, কিন্তু তুমি ওকে মাঝে মাঝে কোথায় দেখো?

আমি যে অফিসে কাজ করি, সেই অফিসের বিল্ডিংয়েই বোধ হয় কোনো এক জায়গায় শম্পাও কাজ করে!

অনামিকা শম্পার খবর জানেন। অনামিকা রেখার খবরটাই নতুন করে জানলেন। বললেন, তুমি কাজ করছো?

না করলে চলবে কেন মাসিমা? বাবা রিটায়ার করেছেন, তার ওপর আবার এই ভার–

অধিক সমস্যা সমাধানেই কি এ ভারের লাঘব হয় বৌমা!

জানি হয় না। তবু কঠোর বাস্তব বলেও তো একটা কথা আছে মাসিমা? সেখানে সব দরকার।

অনামিকা এখন একটু কঠিন গলায় বললেন, সেই লক্ষ্মীছাড়া হতভাগা ছেলেটা কি তার স্ত্রী-কন্যার খরচটাও দেয় না? সেটা দিতে তো বাধ্য সে!

রেখা হেসে ফেলে।

বলে, না মাসিমা, আপনাদের ছেলে লক্ষ্মীছাড়া হতভাগা নয় যে, যা করতে বাধ্য তা করবে না। বরং অনেক সাধ্যসাধনাই করেছে ওটা দেবার জন্যে।

অনামিকা শান্ত হয়ে যান।

বলেন, ওঃ! কিন্তু তোমাকে তো খুকুকে মানুষ করে তুলতে হবে?

রেখা অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বলে, মানুষ হবেই। গরীবের মেয়ের মত মানুষ হবে।

অনামিকা একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বলেন, তোমাদের চিত্তের দারিদ্র্য ওদের জীবনে এই দারিদ্র্য ডেকে আনল!

রেখা বললে, আমাদের ভাগ্য! অথবা ওদেরই ভাগ্য!

রেখা, আমরা সেই যুগকে দেখেছি, যে যুগে মেয়েরা পড়ে মার খেতো। আমরা তোমাদের যুগকেও দেখছি। তফাতটা খুব বুঝতে পারছি না। যুগের হাওয়া যুগের বিদ্যে বুদ্ধি বিচক্ষণতা, কোনো কিছুই তো লাগছে না।

রেখা দৃঢ় গলায় বলে, লাগাতে আরো হয়তো দু-চারটে যুগ কেটে যাবে মাসিমা!

অনামিকা আরো মৃদু গলায় বলেন, হয়তো তোমাদের কথাই ঠিক। হয়ত সেই যুগ আসছে–যখন কেউ কারুর কাছে হৃদয়ের প্রত্যাশা করবে না–

হৃদয়! রেখা হেসে ওঠে।

বলে, ওরে বাবা, ওসব দুর্লভ দামী জিনিস কি আর ব্যবহারে লাগানো যাবে মাসিমা? সোনার ভরি তিনশো টাকায় ওঠা পর্যন্ত বাজার কেমিক্যালের গহনায় ভরে গেছে দেখছেন তো? এখন আর ওতে কেউ লজ্জা অনুভব করে না। সোনা মুক্তো হীরে না জুটলে কাঁচ পুঁতি সিসেতেই কাজ চালাবে এটাই ব্যবস্থা। অলঙ্কারটা তো রইলো?

কিন্তু সে অলঙ্কারের মূল্যটা কোথায়?

কোথাও না! রেখা শান্ত গলায় বলে, মূল্যবোধটাই যে বদল হয়ে যাচ্ছে।

সাহিত্য-সভাতেও কিছুটা আকর্ষণীয় আয়োজন রাখতে হয়। নিছক সাহিত্যে লোক জমে। এতক্ষণ তাই স্টেজে এক নামকরা মূকাভিনেতার মূক অভিনয় চলছিল। বোধ করি কোনো কৌতুককর ঘটনার অভিব্যক্তি। শেষ হতেই হাসির স্রোত আর হাততালির স্রোত বয়ে গেল।

এরপর ইলেকট্রিক গীটার বাজবে।

অনামিকা বললেন, ওই যমযন্ত্রণাটা আর সহ্য হবে না, এবার উঠি।

আমিও উঠি। রেখা বলে, যাচ্ছি মাসিমা, শম্পার খবর তাহলে জেনেই ছিলেন! ঈশ্বর করুন ওর বিশ্বাসটা বজায় থাক্।

রেখা চলে যায়।

অনামিকা প্রায় অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন। এত তাড়াতাড়ি এত পরিবর্তন হতে পারে মানুষের? এর আগে যে রেখাকে দেখেছেন বিয়েবাড়িতে বা কোনো উৎসব-সভায়, সেই রেখা কি এই মেয়ে? ওর মুখের সেই তেল-পিছলে-পড়া অহমিকার কোটিংটা ধুয়ে মুছে গেল কী করে? অথচ ঠিক নম্র নতমুখী নয়।

আর এক ধরনের অহমিকার প্রলেপ পড়েছে ওর মুখে। বিষণ্ণতার সঙ্গে অনমনীয়তার।

হয়তো এরাই ঠিক। তবু মনের মধ্যেটা যেন হাহাকার করে ওঠে। মাধুরী-বৌয়েরাই কি তাহলে ভুল?

তা হয়তো ভুলই।

নইলে এই খাতাখানা সে প্রাণ ধরে ছিঁড়ে ফেলতে পারেনি, পুড়িয়ে ফেলতে পারেনি, শেষ পর্যন্ত তার হাতেই তুলে দিয়েছে, পাতায় পাতায় যার নাম লেখা।

কিন্তু বরের হাতের লেখায়, পাতায় পাতায় পাড়ার একটা মেয়ের নাম লেখা খাতাখানা তো চিরদিন সহ্য করেও এসেছে মাধুরী! চিরদিন তো মাধুরী সব-ফুরিয়ে-যাওয়া বুড়ী হয়ে যায়নি?

কিন্তু বকুল তো এ খাতাখানা কিছুতেই ধৈর্য ধরে আগাগোড়া পড়ে উঠতে পারছে না। বকুল কেবলই পাতা ওলটাচ্ছে। বকুলের মনই বসছে না।

বকুলের মাঝে মাঝে কাঁচা ভাষায় উচ্ছ্বসিত ভাবপ্রবণতা দেখে হাসিও পেয়ে যাচ্ছে।

বকুল-বকুল! তুমি আমার জীবনের স্থির লক্ষ্য। তুমি আমার ধ্রুবতারা!…আমার সব কিছুর মধ্যে তুমি।…বকুল…যখন একা থাকি..চুপিচুপি তোমার নাম উচ্চারণ করি…।

বকুল পৃষ্ঠার কোণে লেখা সাল তারিখটা দেখল।

বকুল একটু হেসে খাতাখানা বন্ধ করল।

বকুল ভাবল, রেখা-বৌমা ঠিকই বলেছে–যে বস্তু এক সময় পরম মূল্যবান থাকে, আর এক সময় তা নিতান্তই মূল্যহীন হয়ে যায়, প্রতিক্ষণেই মূল্যবোধের পরিবর্তন ঘটছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *