কাগজে রক্তের দাগ

কাগজে রক্তের দাগ

মেয়েটি বারে গান গাইত। হাতের মুঠোয় স্পিকার। হাল্কা-পলকা মেয়েটি ফুলের ওজন। গলায় স্টার গায়িকার প্রতিধ্বনি। বারটিও ছিল ছোট্ট। ছিমছাম, রঙচঙে, গোছানো। মিঠে, নরম আলোয় সিগারেটের ধোঁয়া কুয়াশার মতো দুলত। এখানে যারা আসত, তারা কেউ জাত-মাতাল নয়। নেহাত পাতি, ছিঁচকে। কোনও মাঝারি কারবারি কি তার তরুণ প্রজন্ম। দৈবাৎ কোনও একলা। হয়ে-পড়া বুড়ো। একঝাক ছাত্র কি কোন পাড়ার মস্তান। কদাচিৎ একরোখা প্রেমিকের টানে কোনও এরিয়া প্রেমিকা, এক চুমুকের পরই যাকে সামলানো কঠিন হতে প্রেমিকের। একলা বুড়ো মাতাল কোনার দিকে বসে আপন মনে। শব্দহীন হাসত।

ছোট্ট ডায়াসে বাজত স্প্যানিশ গিটার, অ্যাকর্ডিয়ান, জিপসিদের ঝুমঝুমি। মেয়েটি একটু নাচের ভঙ্গি করত। জমাটির সময় শোনা যেত মাতালদের তীক্ষ্ণ শিস, হুই, হই। তবে সামলানোর জন্য একটি লোক ছিল। তাগড়াই চেহারা। মস্ত গোঁফ। নতুন মাতাল বেগড়বাঁই করলে সে ইঁদুরছানার মতো তুলে ফুটপাতে ফেলে দিত।

রাত দশটায় মেয়েটিকে নিতে আসত তার বাবা। সত্যিই কি বাবা? বার মালিকের সন্দেহ ছিল। কিন্তু কে কার বাবা, এ নিয়ে তার মাথা ঘামানোর মানে হয় না। কম টাকায় তিন ঘণ্টার গান, এই তো যথেষ্ট। সে জানত, তাকে মানুষদের গার্জেনগিরি ফলাতে দেওয়া হয়নি। সে কোনও মরালিটির জিম্মাদার নয়। রাষ্ট্র তাকে নাগরিকদের মাতাল করার অধিকার দিয়েছে। মদ খাওয়া ইমমরাল হলে যত বেশি ইমমরালিটি ছড়ায়, তত তার লাভ। তবে মদ খাওয়া। সে ইমমরাল মনে করে না। যত দিন যাচ্ছে, সমস্যা বাড়ছে। মানুষজন যদি কিছুক্ষণ সমস্যা ভুলে থাকতে চায়, মন্দ কী? মদের সঙ্গে অপরাধের কোনও সম্পর্ক নেই, এই তার শক্ত লজিক। ওই গাইয়ে মেয়েটি যদি খারাপ হয়ে যায়, তার সঙ্গেও এই বারের সম্পর্ক সে স্বীকার করে না। কারণ বারে গান করে না, এমন মেয়েরাও তো খারাপ হয়ে যায়।

মেয়েটি বুঝতে পারছিল, বারের মালিক তাকে কম টাকা দেয়। সে নিজের দামও বুঝতে পারছিল। তাই অনেক সেধে ইদানীং যাতায়াতের ট্যাক্সিভাড়াও আদায় করত। দৈত্যের মতো দেখতে সেই প্রহরী যাওয়ার সময় ট্যাক্সি ধরে দিত। হাত নেড়ে বলত, যাই।

মেয়েটি থাকত এঁদো শহরতলিতে। টালির বাড়িগুলো ছিল অসম্বদ্ধ, ঘন। তার ভেতর জরাজীর্ণ একতলা কিছু দালান। একটু দূরে ভাঙা গির্জা আর কবরখানা। তারপর রেলইয়ার্ড। মেয়েটি থাকত একটা দালানে। কার্নিশে অশ্বথচারা, দেয়ালের বাইরে ফাটল, নগ্ন ইট। মেয়েটি ভেতরটা সাজিয়ে গুছিয়ে সুন্দর করতে পেরেছিল।

আর বার-মালিক ঠিকই ধরেছিল, প্রৌঢ় ঢ্যাঙা লোকটি তার বাবা নয়। সে তার বাবার এক বন্ধু। ইলেকট্রিক মিস্ত্রি। পাশের ঘরের ভাড়াটে। মেয়েটির পরিবারে ছিল শুধু তার মা। মায়ের অনুরোধেই মিস্ত্রি লোকটি এসকর্ট হতে এবং পাঁচটা করে টাকা পেত। মন্দ কী!

এমন এক মেয়ে, তার প্রেমিক থাকবে না, তা হয় না। বস্তি এলাকার সব উঠতি তরুণ তার কাছে প্রেম দাবি করত। তারা জানতে পেরেছিল, মেয়েটি বারে গান গাইতে যায়। প্রেম না পেয়ে তারা কেউ কেউ টাকা ধার চাইত অর্থাৎ দাবি করত। মেয়েটি স্বপ্ন দেখত, সে একদিন উঠে যাবে ভদ্র এলাকার কোনও ফ্ল্যাটে। আয়নায় নিজেকে সে দেখত উজ্জ্বল সুন্দর। মুগ্ধ হয়ে ভাবত, তাকে এখানে মানায় না। কেন সে এখানে পড়ে আছে? আর কতকাল তাকে এই আবর্জনার গাদায় পচে মরতে হবে? বার-মালিক জানে না, সে যে-সব গান গায়, তা আসলে তার নিজস্ব প্রার্থনা! যে পরিচ্ছন্ন, শোভন, পেলব স্তরে সে পৌঁছতে চায়, ওইসব গান দিয়ে সেই স্তরকে সে ছুঁত। আর গান জিনিসটাও তো জীবনের ওইরকম একটা দিকে টুকরো-টাকরা অংশ।

আবার জীবনেরই আরও একটা দিক আছে। সেই দিকেরও টুকরো-টাকরা অংশ আছে, যা ক্র, ভয়াল। ভুল পা ফেলে দৈবাৎ সেখানে পৌঁছুলেই সর্বনাশ। জীবনটা মৃত্যু হয়ে যায়।

মেয়েটি সেই ভুল করে বসল। তার মৃত্যু হলো। ক্রুর ভয়াল মৃত্যু। প্রচুর রক্তে সবুজ ঘাস লাল হয়ে গেল!……..

.

০১.

 কর্নেল নীলাদ্রি সরকার কাগজটির ওপর আতস কাঁচ রেখে হরফগুলো দেখতে দেখতে বললেন, প্রত্যেকটি শব্দ যত্ন করে লেখা। বাছাই করা শব্দ। বাক্যগুলোর মধ্যে ছন্দ আছে। একসময় হয়তো কবিতা লেখার অভ্যাসও ছিল। ডার্লিং! এই লেখাটির লেখক খাঁটি দার্শনিক।

ডিটেকটিভ ডিপার্টের ডেপুটি কমিশনার অরিজিৎ লাহিড়ী হাসলেন। আপনার দর্শন-টর্শনে আগ্রহ আছে জানি। বাট দিজ ইজ আ মার্ডার!…..

কোনও-কোনও মার্ডারে দার্শনিকতা থাকে, অরিজিৎ! কর্নেল টেবিলে কাগজটির ওপর আতস কাঁচ চাপা দিয়ে বললেন। মুখে গাম্ভীর্য। যাই হোক, এই কাগজটা কোথায় পেলে?

গৌরীর ব্লাউসের ভেতর রাখা পার্সে! তাই বৃষ্টিতে ভেজেনি।

গৌরী?

মেয়েটির নাম। নিক নেম টিনি। বস্তি এরিয়ায় টিনি নামেই ওকে সবাই জানত।

কর্নেল সাদা দাড়িতে হাত বুলিয়ে বললেন, বডি কী অবস্থায় ছিল?

উপুড় হয়ে। একটা হাত কবরের ওপর। কবরটা ব্রিটিশ আমলের। ক্রসটা ভাঙা। ক্রসে এবং কবরে রক্তের আভাস আছে। বৃষ্টি হলেও বোঝা যায়।

ঘাস ছিল বডির নিচে?

ইয়া। অরিজিৎ পাইপ বের করলেন। মর্গের রিপোর্ট অনুসারে মৃত্যু হয়েছে রাত এগারোটা থেকে বারোটার মধ্যে। ডান কাঁধের হাড় কেটে গলা অব্দি একটা আঘাতের চিহ্ন। আরেকটা গলার পেছনে। তবে মাথাটা বডির সঙ্গে……

হাত তুলে কর্নেল দ্রুত বললেন, এনাফ ডার্লি! সত্যিই ‘ক্রুর ভয়াল’ মৃত্যু।

অরিজিৎ পাইপে তামাক ঢুকিয়ে জোরে হাসলেন। অবজেক্টিভ ডেসক্রিপশন, কর্নেল। বুঝতে পারছি, শূন্যোদ্যানের মালী ভদ্রলোক এবার তাঁর ফুলগুলোর মতোই কোমল হয়ে উঠেছেন!

তোমার এই চমৎকার কবিত্ব সত্ত্বেও তুমি পুলিশে চাকরি করো! কর্নেল চুরুট ধরালেন লাইটার জ্বেলে। অরিজিতের, পাইপেও তামাক ধরিয়ে দিলেন। অবজেক্টিভ ডেসক্রিপশন বললে! অর্থাৎ যা যেমনটি, তা তেমনটি করে বর্ণনা, ওকে। তা হলে ভোজালির আঘাত?

ইয়া! না হলে হাড় কাটত না। ভোরের দিকে ঝিরঝিরে বৃষ্টিটাই অনেক ক্লু নষ্ট করে দিয়েছে।

কর্নেল ধোঁয়ার রিং পাকানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে বললেন, যে লোকটি ওকে বার থেকে আনতে যেত……

গত রাতে সে যায়নি। টিনির মা বলেছেন, যুধিষ্ঠিরের সারাদিন জ্বর। টিনি তার মাকে বলে গিয়েছিল, কারও যাওয়ার দরকার নেই। সে ঠিকই চলে আসতে পারবে। কিন্তু এল না। সকাল সাড়ে সাতটায় কবরখানার কেয়ারটেকার মিঃ গোমেশ টিনির বডি দেখতে পান। তিনি থানায় খবর দেন।

যুধিষ্ঠিরের সত্যিই জ্বর হয়েছিল কি না! টিনির মা কী বলেছেন, সেটা কথা নয়।

ঠিক। তাকে অ্যারেস্ট করা হয়েছে। একদিনের জ্বর বলে নাকি ডাক্তারের কাছে যায়নি। অরিজিৎ একটু হাসলেন। আজ অবশ্য তার জ্বরটর নেই।

জেরার মুখে কিছু জানতে পেরেছ?

তেমন কিছু না। শুধু বলেছে, পাড়ার মস্তানদের কাজ। এদিকে সোক মস্তানগুলো পাড়া ছেড়ে বেপাত্তা। খোঁজা হচ্ছে। পেয়ে যাব’খন। কিন্তু….

কর্নেল তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, বারের মালিক কী বলছেন?

টিনি গত রাতে যায়নি বারে। তিন ঘণ্টায় ওর মজুরি ছিল মাত্র তিরিশ টাকা আর ট্যাক্সিভাড়া কুড়ি টাকা।

বাড়ি থেকে কখন বেরিয়েছিল?

পাঁচটায়। রোজই ওই সময় বেরুত সেজেগুজে। অরিজিৎ একটু গম্ভীর হলেন। সাধারণ মার্ডার কেস বলা যেত। কিন্তু ওই কাগজটা সব জট পাকিয়ে তুলেছে।

কর্নেল হাসলেন। কাগজটা যেন টিনির জীবনী! যেন জ্যোতিষীর কোষ্ঠীবিচার! বলে একটু নড়ে বসলেন। কাগজটাতে আঙুলের ছাপ থাকা উচিত। তোমরা….

বাধা দিলেন অরিজিৎ! উই আর নট সো ফুল, কর্নেল! ফরেনসিক ল্যাবে ছাপ তুলে রাখা হয়েছে। আমরা ওতে হাত দিইনি দেখামাত্র।

কর্নেল অট্টহাসি হাসলেন। ভৃত্য ষষ্ঠীচরণ পর্দার ফাঁকে উঁকি দিল। বাবামশাইয়ের এমন হাসি শুনলেই সে টের পায়, একটা সাংঘাতিক কিছু ঘটেছে বা ঘটতে চলেছে। পুলিশি আঁতে ঘা লেগেছে, ডার্লিং! বলে ষষ্ঠীর দিকে চোখ কটমটিয়ে তাকালেন। ষষ্ঠীচরণ অদৃশ্য হলো। কর্নেল হাঁকলেন, কফি!

অরিজিৎ কপট স্মার্টনেস দেখিয়ে বললেন, লাগবে না। আপনার কাছে যাচ্ছি শুনেই ডিপার্টমেন্টের পাকা পাকা মুখে বাঁকা হাসি ফুটেছে।

কাগজটাতে আসা করি টিনির আঙুলের ছাপ পাওয়া যায়নি?

ডি সি ডি ডি লাহিড়ীসায়েবের চোখে একটু বিস্ময় ঝিলিক দিল। যায়নি। ওটা প্ল্যান্টেড। পার্সের ভেতর কেউ ঢুকিয়ে দিয়ে গেছে।

যে ঢুকিয়েছে, আশা করি, তাকেই খুনী ভাবছ না?

 ভাবছি। সেটাই তো স্বাভাবিক।

কাগজে রক্তের দাগ….মাই গুডনেস! কর্নেল হঠাৎ টেবিলে ঝুঁকে গেলেন। আতস কাঁচের সাহায্যে আবার কাগজটা পরীক্ষা করতে করতে বললেন, কাগজটা নিউজপ্রিন্ট। গোটানো অবস্থায় নিউজপ্রিন্ট কিনতে পাওয়া যায়। আজকাল বিয়েবাড়িতে টেবিলে লম্বা করে নিউজপ্রিন্ট বিছিয়ে দেওয়া হয় দেখেছি। তার ওপর সুখাদ্যের প্লেট। যাই হোক, নিউজপ্রিন্টে ডটপেনে লেখা। ওপরের দিকটা চমৎকার ভাজ করে ছেঁড়া হয়েছে। কিন্তু নিচের দিকটা টেনে ছেঁড়া। বেঁকে গেছে। রক্তের দাগ ছিল কি?

অরিজিৎ সহাস্যে বললেন, বৃদ্ধ ঘুঘু মহাশয়! আপনার খুরে খুরে দণ্ডবৎ। ইউ আর ড্যাম রাইট। ছেঁড়াটা অবশ্য ফরেনসিক ল্যাবের ডঃ মহাপাত্রের উত্তেজিত হাতের কীর্তি! আপনি তো জানেন আপনার বন্ধুকে। রক্ত দেখলেই কেমন একসাইটেড হয়ে ওঠেন। একেবারে বাঘের মতো!

ষষ্ঠীচরণ চুপচাপ কফির ট্রে রেখে গেল। কর্নেল তাকে বললেন, ছাদে কিছু ঘটেছে। দেখে আয়!

ষষ্ঠী দাঁত বের করে বলল, কাকের ঝগড়া বাবামশাই! কখন থেকে শুনছি।

কর্নেল তেড়ে উঠলেন। শুনছিস আর চুপ করে আছিস হতভাগা?

ষষ্ঠী সিঁড়ির ওপর উধাও হয়ে গেল। অরিজিৎ বললেন, আপনার সেই অ্যারিজোনার ক্যাকটাসটির কী অবস্থা? ফুল ধরাতে পেরেছেন তো?

না ডার্লিং! কলকাতা বড় সাংঘাতিক হয়ে উঠেছে দিনে-দিনে। বাতাসে বিষ…..

এবং ঘাসেও রক্ত!

এবং কাগজেও!

অরিজিৎ কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন, হু, কাগজেও এবং সেটাই প্রবলেম। এই লেখা যে লিখেছে, আমার ধারণ সে সাহিত্যিক-টাহিত্যিক না হয়ে যায় না!

টাহিত্যিকটি কী ডার্লিং?

 জাস্ট কথার কথা।

ও নো নো! কর্নেল তার টেকো মাথাটি জোরে নেড়ে বললেন, কথার কথা নয়। মনে হচ্ছে, এই কেসটিকে জটিল করে ফেলেছে ওই টাহিত্যিক জিনিসটাই। এনিওয়ে! এটার একটা জেরক্স কপি আমার চাই। আর……., বারটির নামধাম?

মুনলাইট।

চিনি। মালিক ভদ্রলোককেও চিনি।

বলেন কী!

কর্নেল হাসলেন! তোমার কথার সুরে মনে হচ্ছে আমি এই বুড়ো বয়সে আবার ড্রিংক ধরেছি। অরিজিৎ, তুমি গোয়েন্দা অফিসার। তোমার মাথায় আসা উচিত ছিল মুনলাইটের কাছেই দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার অফিস। এবং…..

অরিজিৎ দ্রুত বললেন, আই নো, আই নো। দা রিপোর্টার জয়ন্ত চৌধুরি! আপনার প্রতেজে!

জয়ন্ত পাঞ্জাবে আছে। ও এখানে থাকলে ভাল হতো।

অরিজিৎ লাহিড়ী ঘড়ি দেখে দ্রুত কফি শেষ করলেন। চলি! সি পি-র ঘরে কনফারেন্স। চারটে বেজে গেল।

.

কবরখানার জরাজীর্ণ ফটকের সামনে লাল রঙের ল্যান্ডরোভার গাড়িটি দেখে আংলো-ইন্ডিয়ান খ্রিস্টান কেয়ারটেকার গোমেশ একটু ভড়কে গিয়েছিলেন। সকাল থেকে পুলিশের জেরায় জেরবার তিনি। গাড়ি থেকে কর্নেল নামলে তিনি স্মার্ট হয়ে সেলাম ঠুকলেন। ফরেনার ভেবেই।

কর্নেল এগিয়ে গিয়ে হাত বাড়িয়ে ইংরেজিতে বললেন, হ্যাল্লো মিঃ গোমেশ!

অন্তরঙ্গ করমর্দনে খুশি কেয়ারটেকার বললেন, মহাশয় কি বিদেশী?

কখনই না মিঃ গোমেশ! খাঁটি স্বদেশী।

আপনাকে বিদেশী দেখায়। গোমেশ একটু অবাক হয়ে বললেন, আপনি। আমার নাম জানেন! দুঃখিত মহাশয়। আমার এটা আগেই ভাবা উচিত ছিল, গোমেশ জেভিয়ার এই কবরখানার ভূত বলে পরিচিত। হাঃ হাঃ হাঃ! তবে কি জানেন, আর আমার মাথার ঠিক নেই। এই কবরখানা ক্রমশ শয়তানের আড্ডা হয়ে গেছে। বছরে গড়ে তিনটে করে খুনখারাপি। মহাশয়, এই কবরখানা ছিল নন্দনকানন। আপনি লক্ষ্য করুন! কত গাছ! কত ফুল! অথচ হয়ে গেছে একটা জঙ্গল! সব দামী মার্বেল পাথরের ফলক উপড়ে নিয়ে গেছে। সমস্ত দামী কাঠের ক্রস পর্যন্ত! পুলিশ কিছু করে না।

কর্নেল ভেতরে ঢুকে বললেন, আপনি কি এখানেই থাকেন?

হ্যাঁ, স্যার। গির্জার পাশে এই ঘরটাতে। ভাবতে পারেন? একা একজন লোক এই কবরখনায় বাস করে। আমার স্ত্রীর কবর ওইটে। আমার দুই ছেলে তিন মেয়ে অস্ট্রেলিয়া চলে গেল। আমি যেতে পারলাম না। গোমেশ করুণ মুখে একটু হাসলেন। ওরা আমাকে ডাকে। কিন্তু তার চেয়ে বেশি ডাকে মৃতেরা! ব্যাপারটা কল্পনা করুন মহাশয়! মৃতেরা আমাকে ডাকে। আমি…..

কর্নেল তার কাঁধে হাত রেখে বললেন, ভাই গোমেশ! বলছিলে, আজ মাথার ঠিক নেই। কিছু কি ঘটেছে? তারপর একটি দামী চুরুটও উপহার দিলেন।

ভাই সম্বোধনে এবং চুরুটটি পেয়ে বিগলিত কেয়ারটেকার বললেন, খুন মহাশয়! সাংঘাতিক খুন!

নিজে চুরুট ধরিয়ে এবং গোমেশেরটি ধরিয়ে দিয়ে কর্নেল বললেন, বলেন কী! কোথায়? কে খুন হলো?

উত্তেজিত কেয়ারটেকার তার হাত ধরে টানলেন। আসুন, আসুন! দেখাচ্ছি। হতভাগিনী মেয়েটা! আমি জানতাম, ওকে এই কবরখানার মৃতেরা ডেকেছে। রোজ বিকেলে কবরে ফুল দেবার ছলে ওখানে এসে বসে থাকত। আমার চোখ, মহাশয়! বুঝতে পেরেছিলাম, ও কখনই খ্রিস্টান নয়।

এবড়ে-খেবড়ো সংকীর্ণ পথ। দুধারে গাছ, ঝোপঝাড় আর কবর। শুধু কবর। পাখি ডাকছে। ফুলের ঝোপে বসে আছে প্রজাপতি। বিকেলের রোদ ফিকে হয়ে এসেছে। অক্টোবরের দিনশেষে আকাশে ঘন মেঘ। হয়তো একটু পরেই বৃষ্টি এসে যাবে। কর্নেল প্রজাপতিটার দিকে তাকিয়ে আনমনে বললেন, রোজ বিকেলে এখানে আসত মেয়েটি–মানে, যে খুন হয়েছে?

আবার কে? গোমেশ উৎসাহে হাঁটতে হাঁটতে বললেন। ওদিকটায় ব্রিটিশ আমলের অনেক বিখ্যাত মানুষের কবর আছে। মেয়েটা যে কবরে বসত, সেটা কার জানেন? ক্রিস্টিনা ম্যাকবেরির। লর্ড কার্জনের আত্মীয়া। তখনকার এক মেয়েকবি। ব্রিটেনের পত্রিকায় তার কবিতা ছাপা হতো। কল্পনা করুন, মহাশয়!

মেয়েটি কি একা বসে থাকত?

গোমেশ চাপাস্বরে বললেন, আপনাকে বলা চলে। আপনি ভদ্রলোক। পুলিশকে বলিনি। আপনি তো জানেন মহাশয়, পুলিশকে কিছু বলা মানেই ফঁদে পা দেওয়া। আপনাকেই ওরা খুনী সাজাবে। কেন? তার উত্তরে বলব, যেভাবে হোক, পুলিশ কাউকে খুনী সাব্যস্ত করতে পারলেই ওপরওলার কাছে প্রশংসিত হবে।

কর্নেলও চাপা স্বরে বললেন, ঠিক ঠিক। পুলিশকে বলেননি, ভাল করেছেন।

কেয়ারটেকার ফিস ফিস করে বলেন, ওই ভাঙা পাঁচিল গলিয়ে ওর প্রেমিক আসত।

ওদিকটায় তো রেলইয়ার্ড?।

হ্যাঁ, কেয়ারটেকার হঠাৎ থেমে বললেন, এই কবর। মার্বেল ফলকটা নেই। ওই দেখুন, ঘাসের ভেতর রক্তের ছাপ। গত রাতে মেঘ সরে জ্যোৎস্না উঠল। আপনাকে আগেই বলেছি, মৃতেরা আমাকে ডাকে। আমি ঘুমোতে পারি না। অস্থির হয়ে কবরখানার ভেতর ঘুরে বেড়াই। মৃত আত্মাদের সঙ্গে কথা বলি। বিশ্বাস করুন!

কর্নেল বুঝতে পারছিলেন, লোকটি ছিটগ্রস্ত। সেটা স্বাভাবিক। বহু বছর ধরে কবরখানায় থাকলে এ বয়সে মাথার ঠিক না থাকারই কথা। কর্নেল সায় দিলেন। না, না। বিশ্বাস করছি। আমি জানি মৃতেরা জীবিতদের সঙ্গে কথা বলতে চায়। দরকার শুধু দীর্ঘকাল ঘনিষ্ঠতার।

সুন্দর বলেছেন মহাশয়! আপনি জ্ঞানী।

কাল রাতে জ্যোৎস্নায় এখানে দুজনকে দেখেছিলেন?

 হ্যাঁ!

আপনি কী করলেন?

কী করব? কেয়ারটেকার ম্লান হাসলেন। আমার হাতে অবশ্য টর্চ ছিল। কিন্তু আমার পক্ষে কি প্রভু যীশুর অনভিপ্রেত পাপ কাজ দেখা উচিত হতো? তা ছাড়া এ অবস্থায় পুরুষটির মস্তান হওয়াই স্বাভাবিক। সাধারণ যুবকদের এ সাহস হবে না। কাজেই আমাকে সে ভোজালির কোপ মারতই, যেভাবে মেয়েটিকে মেরেছিল।

তারপর আপনি কী করলেন?

আমি দূরে সরে এলাম।

তখন সময় কত?

প্রায় রাত বারোটা। ঘড়ি দেখিনি।

কোনও আর্তনাদ শুনেছিলেন?

নাঃ! আমি ওই জীর্ণ গির্জার সামনে প্রার্থনা করছিলাম। প্রভু! পাপীদের হাত থেকে এই পবিত্র স্থানকে রক্ষা করুন!

আলো কমে এসেছে আরও। পুবের আকাশে মেঘ আরও গাঢ় হয়েছে। কর্নেল কবরটির দিকে ঝুঁকে পড়লেন।

ছিটগ্রস্ত কেয়ারটেকার এতক্ষণে একটু চমকে উঠে বললেন, কী দেখছেন আপনি?

মানুষের রক্ত, গোমেশভাই!

 আপনি কি খ্রিস্টান?

কেন?

আমি তাই ভেবেছিলাম। আপনাকে…..ঈশ্বর! ঈশ্বর! আপনি পুলিশের গোয়ন্দা নন তো?।

না ভাই গোমশ!

বৃদ্ধ কেয়ারটেকার সন্দিগ্ধ দৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন। চুরুট থেকে একদলা ছাই ঝরে পড়ল।

কর্নেল কবরটার চারপাশে ঘুরে ভাঙা দেয়ালটার দিকে এগিয়ে গেলেন। গোমেশ এবার তার পেছনে গিয়ে প্রায় আর্তনাদের ভঙ্গিতে বললেন, ঈশ্বরের দোহাই! আপনি কে?

আমার নাম কর্নেল নীলাদ্রি সরকার।

 আপনি কী দেখে বেড়াচ্ছেন?

রেলইয়ার্ডটা দেখতে ইচ্ছে করছে। আপনার ভাবনার কারণ নেই। ভাঙা অংশটা কোমরসমান উঁচু। সেখানে দাঁড়িয়ে কর্নেল জ্যাকেটের পকেট থেকে। বাইনোকুলার বের করলেন। রেলইয়ার্ড দেখতে থাকলেন।

গোমেশ আরও অবাক হয়ে কাছে গিয়ে বললেন, বাইনোকুলারে কী দেখছেন মহাশয়?

পাখি। পাখি দেখা আমার নেশা, গোমেশভাই!

অনিচ্ছাসত্ত্বেও কেয়ারটেকার খিকখিক করে হেসে উঠলেন। ওদিকে পাখি নেই! শকুন আছে। মহাশয়, পাখি দেখতে হলে এদিকে ঘুরুন। দেখুন, দেখুন! গাছে-গাছে কত পাখি! চিড়িয়াখানা মহাশয়!

গোমেশভাই! এক মিনিট! সিগন্যাল-পোস্টের মাথায় একটা অদ্ভুত জাতের শকুন দেখতে পাচ্ছি। আপনি দয়া করে আমার গাড়িটার কাছে যান। আপনাকে পুরস্কৃত করা হবে। আজকাল বড় গাড়িচোরের উপদ্রব!

পুরস্কারের লোভেই কেয়ারটেকার হন্তদন্ত হয়ে গেটের দিকে এগিয়ে গেলেন।

কর্নেল ভাঙা পাঁচিল ডিঙিয়ে ওধারে নামলেন। ঝোপঝাড়, খানাখন্দ, ঘন ঘাস। তারপর রেলইয়ার্ডের কাঁটাতারের ছেঁড়াখোঁড়া বেড়া। এখানে ওখানে ওয়াগন দাঁড়িয়ে আছে। কাছে একটা ওয়াগন লাইনছাড়া হয়ে মাটিতে আটকে গেছে। প্রকৃতি তাকে যথেচ্ছ শাস্তি দিচ্ছে। তবে ওয়াগানব্রেকারদের উপযুক্ত ঘাঁটি বলা চলে।

 একটু দূরে একটি শান্টিং ইঞ্জিন হুইল দিতে দিতে চলাফেরা করছে। তার ওদিকে দুজন সশস্ত্র সেন্ট্রি সিগারেট ফুকুতে ফুঁকতে সারিবদ্ধ ওয়াগনের আড়ালে অদৃশ্য হলো। তখন কর্নেল বেড়া গলিয়ে রেলইয়ার্ডে ঢুকলেন। কর্নেল বাইনোকুলারে একটা লাইনের ওপর একপাটি জুতো দেখতে পেয়েছিলেন। সাধারণ স্যান্ডেল মাত্র।

 রেলইয়ার্ডে এমন অনেক কিছুই পড়ে থাকে। তবু দেখা দরকার। কাছে গিয়ে দেখলেন, ফিতে ভেঁড়া পুরনো স্যান্ডেল। স্যান্ডেলটা বাঁ হাতে আলতোভাবে কুড়িয়ে নিলেন।

আর তখনই দড়দড় করে তার আশেপাশে পাথরকুচি এসে পড়তে থাকল। একটা পাথরকুচি তার জুতোয় এসে পড়ল। মুহূর্তে গতি আঁচ করে টের পেলেন কেউ ওই ভাঙা ওয়াগনটার দিক থেকে এই কাজটি করছে। তার চেয়ে বড় কথা, কর্নেলের কাজটিও তার মনঃপুত নয়। দ্রুত পকেট থেকে রিভলবার বের করে তেড়ে গেলেন ওয়াগানটার দিকে। এই সময় ঝিরঝিরে বৃষ্টি এ গেল।

ছেঁড়া চটিটা জ্যাকেটের পাশ-পকেটে ঢুকিয়ে ছোট্ট টর্চ বের করে ভাঙা ওয়াগনের ভেতরটা দেখলেন কর্ণেল।

চাপচাপ পাথরকুচি, মাটির চাবড়া, গুল্ম। কোনার দিকটা পরিষ্কার। সেখানে প্রকাণ্ড ফোকর। ফোকরে উঁকি দিতেই ধূসর বৃষ্টির ভেতর খানিকটা দূরে এইমাত্র কেউ সারবদ্ধ ওয়াগনের আড়ালে চলে গেল। পরনে প্যান্ট-শার্ট। রোগা চেহারা। কয়েক সেকেন্ডের দেখা একটা মানুষ এবং দিনশেষের বৃষ্টির ধূসরতায় দেখা একটা আবছা মূর্তি মাত্র।

সে এই স্যান্ডেলটাই নিতে এসেছিল, এতে কোনও ভুল নেই। এও ঠিক, সে ভেবেছিল, ভূতের ঢিল পড়া দেখে এই দাড়িওলা বুড়ো সায়েব লোকটি ভয় পেয়ে পালাবে!

ঝকঝকে জায়গাটিতে সিগারেটের টুকরো পড়ে আছে। একটা ছেঁড়া তাসের জোকারও। কারা এখানে তাস খেলত। সিগারেট ফুঁকত। সম্ভবত তারা ওয়াগনব্রেকার অথবা নেহাত নেশাখোর ভবঘুরের দল।

বৃষ্টির মধ্যে কর্নেল সাবধানে পায়ের কাছে টর্চের আলো ফেলতে ফেলতে কবরখানায় ফিরে এলেন। সেন্ট্রিদের চোখে পড়লেই গুলি ছুড়ত। খুব ঝুঁকি নিয়েছিলেন কর্নেল।

গেটের ছাউনির তলায় হাসিমুখে দাঁড়িয়ে ছিলেন কেয়ারটেকার। বাও করে বললেন, ওই আপনার গাড়ি, মহাশয়! দেখুন, যেমন ছিল তেমনই আছে। আসলে এই শয়তানের আখড়ার দিকে সচরাচর কেউ আসে না। আমার জ্ঞান মতে, যারা গাড়িচোর, তারা ছিঁচকে মস্তান নয়। যাই হোক, আশা করি সেই অদ্ভুত শকুনটি কাছে থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে?

না গোমেশভাই! বৃষ্টি সব গণ্ডগোল করে দিল।

গোমেশ তার আপাদমস্তক লক্ষ্য করে বললেন, ভিজে গেছে দেখছি। যদি এ গরিবের ডেরায় ঢোকেন, কড়া চা খাওয়াতে পারি। আসুন, আসুন! আমার ঘরের জানালা থেকে আপনার গাড়ির ওপর নজর রাখা চলে।

গির্জার কাছ ঘেঁষে একতলা জীর্ণ কয়েকটি ঘর। দুটি ঘর যেকোনও সময় ভেঙে পড়তে পারে। বাকি ঘরটি মোটমুটি মেরামত করা হয়েছে। বারান্দার একপাশে কিচেন। ছোট্ট একটা ডাইনিং টেবিল। সবই ব্রিটিশ যুগের। ঘরের ভেতর চল্লিশ ওয়াটের বাল। লোহার খাটে সাদাসিধে একটা বিছানা পাতা। নড়বড়ে তিনটে চেয়ার। দেয়ালের আয়নাটা ডিমালো এবং সুদৃশ্য! গোমেশ কিচেনে কেরোসিন কুকার জ্বেলে কেটলি চাপিয়ে এসে দেখলেন, কর্নেল আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। গোমেশ উৎফুল্ল মুখে বললেন, খাঁটি বেলজিয়ামী আয়না মহাশয়! আজকাল দুষ্প্রাপ্য। দুঃখের কথা কী বলব টাকার অভাবে এমন কত দামী জিনিস বেচে দিতে হয়েছে। মাত্র দুশো টাকা মাইনে আর কফিনে নতুন লাশ এলে কিছু বখশিস। এ বাজারে একজন মানুষের পক্ষে কোনও রকমে বেঁচে থাকা। তবে এই কবরখানায় খুব কম লাশ আসে। শহরতলি এলাকা। কাছাকাছি খ্রিস্টানবসতি নেই।

কর্নেল একটা চেয়ারে বসে বললেন, কবরখানায় ওয়াগনব্রেকারদের খুব দৌরাত্ম্য মনে হয়?

সাংঘাতিক। তারা এই গেট দিয়ে মাল পাচার করে। গেটের সামনে ট্রাক অপেক্ষা করে। ভয়ে পুলিশকে জানাতে পারি না, মহাশয়!

কর্নেল একটু হেসে বললেন, আপনি কিছু বখশিস দাবি করতেই পারেন।

গোমেশ জোরে মাথা নেড়ে বললেন, কখনই না। সেটা পাপ। আমাকে একবার দশটা টাকা দিতে এসেছিল। নিইনি। বলেছিলাম, তোমাদের কাজ তোমরা করো। আমি তো বাধা দিচ্ছি না। মুখ বুজে আছি। থাকব।

কেয়ারটেকার টেবিলের বাইবেল স্পর্শ করলেন। তারপর কিচেনে গেলেন।

টেবিলের তলায় কর্নেলের জুতোয় কিছু ঠেকল। কাত হয়ে দেখলেন একটা ওয়েস্ট পেপার বাস্কেট। ছোট টর্চটা জ্বেলে দেখলেন ছেঁড়া কাগজে ঠাসা। কর্নেল উঠে গেলেন জানালার কাছে। তারপর চেঁচিয়ে উঠলেন, এই! এই! কী হচ্ছে?

 গোমেশ সাড়া দিলেন বাইরে থেকে। কী হয়েছে? কী হয়েছে?,

ভাই গোমেশ! দেখুন তো গাড়ির কাছে কে কী করছে!

গোমেশ দ্রুত ঘরে ঢুকে দেয়ালের হুক থেকে ছাতি আর টেবিলের ড্রয়ার থেকে টর্চ বের করে হন্তদন্ত হয়ে বেরুলেন। আবছা অন্ধকারে বৃষ্টি পড়ছে। ঝিরঝির করে। গেটের মাথায় আলো নেই কেন? কর্নেল ওয়েস্ট-পেপার বাস্কেটটা টেনে নিলেন। ছেঁড়া ঠোঙা, খ্রিস্টান সোসাইটির ইস্তাহার, এইসব কাগজ।

একটা কুচিতে বাংলা হরফ চোখে পড়েছিল কর্নেলের। ডটপেনে লেখা। সেজন্যই গোমেশকে বাইরে পাঠানো।

ঝটপট অনেকগুলো কুচি কাগজ কুড়িয়ে পকেটে ঢোকালেন। তারপর জিনিসটা টেবিলের তলায় চালান করে বারান্দায় গেলেন। গেটের বাক্টা জ্বলে। উঠল।

গোমেশ ফিরলেন। মুখে হাসি। পালিয়েছে। গেটের আলোটা জ্বালতে ভুল হয়েছিল, তাই এত সাহস।

একটু পরে চা খেয়ে ব্রাদার গোমেশ’কে কুড়িটা টাকা বখশিস দিয়ে কর্নেল বেরুলেন। গোমেশ ছাতা ধরে তাকে গাড়িতে পৌঁছে দিলেন। বললেন, ইউ আর ভেরি গুড জেন্টলম্যান, স্যার! ইউ আর আ বার্ড-ওয়াচার। ওয়েল, কাম স্যার ইন দা মর্নিং, অর হোয়েন ইউ লাইক! মেনি মেনি বার্ডস ইন দা সিমেট্রি! গুড বাই স্যার! মে আওয়ার লর্ড দা সেভিয়ার ব্লেস ইউ! বাই বাই!

কবরখানার কেয়ারটেকার হাত নাড়তে থাকলেন।…..

.

রাত দশটায় ষষ্ঠীচরণ হাই তুলতে তুলতে পর্দার ফাঁকে মুখ বের করল। বাবামশাই টেবিলে একপাটি ভেঁড়া জুতো নিয়ে কী যেন করছেন। ছ্যা ছ্যা ছ্যা! নাক কুঁচকে গেল ষষ্ঠীর। সব থাকতে ছেঁড়া জুতো ঘাঁটা। সে খুক করে কাশল।

কর্নেল মুখ না তুলেই বললেন, তোকে না বলেছি খাবার ঢাকা দিয়ে শুয়ে পড়গে?

ষষ্ঠী বেজার মুখে বলল, ভাল করে হাত দুটো যেন ধুয়ে লেবেন।

কর্নেল স্যান্ডেল তুলে কপট প্রহারের ভঙ্গি করলে যষ্ঠীচরণ অদৃশ্য হলো।

কর্নেলের সামনে কাগজের কুচিগুলো মোটামুটি সাজানো। কতক্ষণ ধরে তাস মেলানোর মতো পরিশ্রম চলেছে। বুঝতে পারছেন না সাজানো ঠিক হয়েছে কি না। গোমেশ যেন খুব খাপ্পা হয়েই কাগজটা ছিঁড়েছিলেন। দলা-পাকানো কাগজের কুচি। ওর চিহ্নটুকু কোথাও স্পষ্ট, কোথাও অস্পষ্ট। একটিও পুরো শব্দ নেই। এটাই সমস্যা।

কিন্তু দুটো জিনিস বিস্ময়কর। এ কাগজটাও নিউজপ্রিন্ট এবং সেই একই হস্তাক্ষর। অন্তত কর্নেলের যতটা স্মরণ হচ্ছে। জেরক্স কপিটা পেলে মেলানো যাবে।

আরও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, গোমেশ এটা পেলেন কোথায়? ছিঁড়ে ওয়েস্ট-পেপার বাস্কেটে ফেললেন কেন? এখনও বেশ কিছু কুচি গোমেশের ওয়েস্ট-পেপার বাস্কেটে পড়ে আছে। পুলিশকে বললে এখনই ওটা নিয়ে আসবে। ওটা আনা দরকার। কাগজের এই কুচিগুলো মিলিয়ে মোটামুটি একটা ছোট্ট চিঠি দাঁড়িয়েছে। এটাই ভাবিয়ে তুলেছে কর্নেলকে। টিনিকে লেখা চিঠিই বটে! সেটার মোটামুটি এবং আনুমানিক চেহারা এইরকম :

টিনি, আজ তুমি ক্রিস্টিনার কবরের ওখানে যাবে। ওখানে তোমার জন্য ফুলগুলি ফুটে আছে। সুন্দর বিষাক্ত লাল ফুল। আজ রাতে বৃষ্টি না হলে জ্যোৎস্নায় তোমাকে পরী দেখাবে। তুমি আকাশকন্যা। মৃতদের মধ্যে জীবন জাগাবে। তুমি ক্রিস্টিনা হয়ে উঠবে! কবির আত্মা। কিন্তু সাবধান। বেশিক্ষণ নয়। গোমেশ তোমাকে সব কথা বলবে।…..

ক্ষীণ হাসি ফুটে উঠল কর্নেলের ঠোঁটের কোনায়। টাকে হাত বোলালেন। যা লিখেছেন, তার দিকে তাকিয়ে রইলেন। বলতে গেলে শব্দ ও বাক্যের অনেকটাই তাঁরই আরোপিত। কিন্তু ন্যায়শাস্ত্রে আনুমানও যুক্তিসিদ্ধ।

হ্যাঁ, চিঠিটা এরকমই ছিল। কাব্যিক, আবেগময়।

 হাত বাড়িয়ে ফোন তুলে ডায়াল করতে থাকলেন কর্নেল। অরিজিৎ লাহিড়ীর ফ্ল্যাটের ফোন, সাড়া এল, লাহিড়ী!

ডার্লিং! তাশা করি গোদারের চিত্রনাট্য পড়ছ?

হেরে গেলেন, অন্তর্যামী!

ভূতের গল্প নয় তো?

 হু। প্রায় কাছাকাছি। বইটার নাম কবরখানার সাহিত্য।

 রোজার গারোদি!

ধন্যবাদ! আপনি সর্বঘটের কাঠালী কলা। তবে কমিউনিস্ট গারোদি–সাত্র, পাউন্ড কাউকে রেয়াৎ করেননি। কবরে পাঠিয়ে ছেড়েছেন!

ডার্লিং! গারোদিকেই পরে কমিউনিস্টরা কবরে পাঠিয়েছিল।

 আপনাকেও আজ কবরে দেখা গেছে!

খুশি হলাম শুনে। তবে ডার্লিং, ওই কবরখানায় এখনই কাউকে পাঠানো দরকার।

মাই গুডনেস! কী ব্যাপার? আবার কি……..।

না। কেয়ারটেকার মিঃ গোমেশের ঘরে টেবিলের তলায় একটা ওয়েস্ট পেপার বাস্কেট আছে। সেটা খুবই জরুরি। আর……মিঃ গোমেশকে আটক করে জেরা করো–তিনি কিছু জানেন। একটু পরে অরিজিতের সাড়া এল, আর ইউ দেয়ার, ওল্ড বস?

ইয়া! মেক হেস্ট ডার্লিং! দিস্ ইজ ভেরি ইমপর্ট্যান্ট।

ফোন ছেড়ে দিলেন কর্নেল। কাগজের কুচিগুলো একটা খামে ঢুকিয়ে নিজের লেখাটা ভাঁজ করে ড্রয়ারে রাখলেন। বৃষ্টি আবার শুরু হয়েছে। বাইরে আবহাওয়া স্নিগ্ধ ছিল। কিন্তু এতক্ষণে গরম টের পেলেন। কাগজের কুচি উড়ে যাওয়ার আশঙ্কায় জানালা বন্ধ করেছিলেন। ফ্যানও বন্ধ ছিল। জানালা খুলে ফ্যান চালিয়ে দিলেন। তারপর টেবিল থেকে স্যান্ডেলটা তুলে নিয়ে ইজিচেয়ারে বসলেন।

বাঁ পায়ের স্যান্ডেল। দুপাশেরই ফিতে উপড়ে গেছে। রবারসোল চিড় খেয়েছে। ছুটে পালিয়ে যাওয়ার স্পষ্ট চিহ্ন। কিন্তু ছুটে পালাতে হলো কেন? ওই জনহীন জায়গায় ধীরে-সুস্থে যেতে পারত কাজ শেষ করে–অবশ্য যদি সে খুনী হয়!

রেলইয়ার্ডের সেন্ট্রি তাড়া করেছিল কি?

ওরা তাড়া করে না। চার্জ করে। না থামলে গুলি ছোঁড়ে। খোঁজ নেওয়া দরকার গত রাতে তেমন কিছু ঘটেছিল কি না।

কিন্তু এমন পুরনো স্যান্ডেল, আর সেলাইয়ের চিহ্ন…কোনও বেকার যুবক?

স্যান্ডেলের চেহারায় রুচির পরিচয় না থাক, সামান্য বিলাসিতা…..নাঃ! বিলাসিতা নয়। সে গতানুগতিকতার পক্ষপাতী নয়। সবাই যে স্টাইল পছন্দ করে, সে তা করে না।

কর্নেল হাত বাড়িয়ে টর্চটা নিলেন। আবার খুঁটিয়ে পরীক্ষা করতে থাকলেন। বুড়ো আঙুলের জোড়ের জায়গাটা ফাঁক করেই চমকে উঠলেন। জোড়ের জমাট অংশে কী ছোপ। বৃষ্টিতেও ধুয়ে যায়নি। দ্রুত একটা আলপিন এনে জোড়ের ভেতর চালিয়ে একটা কাগজে আলপিনেরডগা ঘষে দিলেন। কালচে রক্তের রেখা!

স্যান্ডেলে রক্ত মেখে গিয়েছিল। ধুয়ে গেছে বৃষ্টিতে। আজ সুযোগমতো এটা খুঁজতে এসেছিল। কর্নেল গিয়ে পড়ায় ব্যর্থ হয়েছে।

কাগজে স্যান্ডেলটা মুড়ে ড্রয়ারে ঢুকিয়ে বাথরুমে গেলেন কর্নেল। সাবান দিয়ে রগড়ে দুটো হাত ধুয়ে ফেললেন। ডাইনিং রুমে ঢুকে দেখেন, ষষ্ঠীচরণ বসে ঢুলছে। তার চুল টেনে দিয়ে থাপ্পড় তুলতেই ষষ্ঠী ফিক করে হেসে বলল, বেড়াল, বাবামশাই! বেড়াল?

তারপর নিজের ঘরে চলে গেল। কর্নেল হাসতে হাসতে তার উদ্দেশে বললেন, বেড়াল তোর মাথার ভেতর, ষষ্ঠী! খেয়াল করে শোন, মাও মাও করে ডাকছে।

ষষ্ঠী তার ঘর থেকে বলল, আর ডাকছে না বাবামশাই!

পাইলে গেছে?

ষষ্ঠীকে নকল করায় ষষ্ঠীর অভিমান হওয়া স্বাভাবিক। আর তার সাড়া পাওয়া গেল না।

খাওয়ার পর কর্নেল ড্রইংরুমে এসে ইজিচেয়ারে বসে সবে চুরুট জ্বেলেছেন, ফোন বাজল। সাড়া দিলেন।

হাই ওল্ড বস! চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে।

 বাস্কেটটা নেই?

 আছে। তবে খালি। কিচেনে ছাইয়ের গাদা। মিঃ গোমেশ উধাও।

সে কী! কর্নেল সোজা হয়ে বসলেন। অরিজিৎ! ওঁর কোনও বিপদ হয়নি তো?

তেমন কোনও লক্ষণ খুঁজে পাওয়া যায়নি। ঘরের দরজায় তালা আটা ছিল। ভাঙতে হয়েছে।

ঘরে তালা আটা! জিনিসপত্র? দেয়ালে একটা ওভাল মিরর ছিল……

নেই। ইন্সপেক্টর আর মিটারকে তো চেনেন! খুবই দক্ষ অফিসার আমার ডিপার্টে। কেয়ারটেকার সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ রিকশো চেপে কোথায় গেছেন, সো মাচ ইনফরমেশন হি গট।

তুমি সকালে একবার এস, ডার্লিং! একপাটি জুতো…

জুতো মারবেন? আমার অপরাধ?

 তুমি যে খাঁটি বারেন্দ্র বামুন, বোঝা গেল। একটুতেই উত্তেজনা!

 জুতোটুতো শুনলে ভূতেও উত্তেজিত হয় কর্নেল!

আরও উত্তেজিত হও, ডার্লিং! কাগজে রক্তের দাগ ছিল। এবার জুতোয় রক্তের দাগ।

ব্যস! এনাফ! আজ ঘুমের ট্যাবলেট খেতে হবে। গুড নাইট!…..

০২.

সকাল নটায় ছেঁড়া একপাটি স্যান্ডেল নিয়ে অরিজিৎ লাহিড়ী চলে গেলে কর্নেল বেরুলেন। পায়ে হেঁটেই গেলেন। ক্রিশ্চিয়ান আন্ডারটেকার সোসাইটির অফিস মিনিট পাঁচেক হাঁটলেই বাঁ দিকে পড়ে। গেটের কাছে পৌঁছুলে উঁচু বারান্দায় ডেভিড প্যাটার্সনকে দেখতে পেলেন। বারান্দায় টেবিলের সামনে বসে সিগারেট ফুঁকছেন।

কলকাতায় কয়েকটা আন্ডারটেকার সোসাইটি আছে। এঁরা হিন্দু সকার সমিতির মতোই মৃত খ্রিস্টানদের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার ব্যবস্থা করেন। কফিন তৈরি, কফিনবাহী গাড়ি, পাদ্রি ইত্যাদি সবই এঁরা ব্যবস্থা করে দেন। 

কর্নেলকে দেখেই ডেভিড তড়াক করে উঠে দাঁড়ালেন। মর্নিং! মর্নিং কর্নেল! বলে হাত বাড়িয়ে দিলেন করমর্দনের জন্য। ঈশ্বর না করেন, লিন্ডার ঠাকমার কিছু সুসমাচার নেই তো?

আন্ডারটেকারকর্মী হাসতে লাগলেন। লিন্ডারা থাকে কর্নেলের তিনতলা বাড়ির দোতলায়। ওর ঠাকমা অনেকদিন ধরে শয্যাশায়িনী।. বুড়ো বয়সে হাজারটা অসুখ।

কর্নেল মুচকি হেসে বললেন, না মিঃ প্যাটার্সন। আপনাকে সেই সুসমাচার এ মুহূর্তে দিতে পারছি না।

ডেভিড একটু নিরাশই হলেন যেন। এক সপ্তাহ যাবৎ কোনও বডি পাচ্ছেন না। এমনিতেই এ শহরে খ্রিস্টান সংখ্যা কমে গেছে দিনে দিনে। তাঁর সোসাইটির রোজগারপাতিও কমে গেছে। বড় আশা করে আছেন, লিন্ডার ধনী ঠাকুমার বডি পড়লে দামী কাঠের কফিন অর্ডার আসবে। ফিউনারাল হকে জম্পেশ রকমের। ভাব গোপন করে বললেন, প্রভুর ইচ্ছা! আসুন, বসুন। গল্প করা যাক। চমৎকার আবহাওয়া আজ।

কর্নেল বসে বললেন, একটা কথা জানতে এলাম মিঃ প্যাটার্সন!

 বলুন, বলুন! আপনার সেবার জন্য আমি সর্বদা তৈরি।

 রেলইয়ার্ডের পাশের ওই সিমেট্রি কোন চার্চের প্রপার্টি?

ডেভিড বাঁকা মুখে বললেন, ওটা একরকম পোডড়া কবরখানাই বলতে পারেন কর্নেল! কে যাবে অতদূরে? তার ওপর চোর-ডাকাত-ওয়াগনব্রেকারদের আচ্ছা। আমি প্রভুর নামে দিব্যি কেটে বলতে পারি, কোনও ধনী খ্রিস্টান গত চল্লিশ বছরে ওখানে বডি নিয়ে যাননি। কেন জানেন? মার্বেল ফলক, দামী কাঠের ক্রস, সব রাতারাতি ডাকুরা উপড়ে নিয়ে পালাবে। শয়তানের কবলে পড়েছে কবরখানাটা। তা ছাড়া ওটা প্রোটেস্টান্ট চার্চের সম্পত্তি। ক্যাথলিক চার্চ হলে বরং রক্ষণাবেক্ষণ হতো।

সেই প্রোটেস্ট্যান্ট চার্চের ঠিকানাটা জানেন? 

ডেভিড একটু অবাক হয়ে বললেন, কিছু কি ঘটেছে?

কর্নেল বুঝলেন, ডেভিড খবরের কাগজে ছোট করে বেরুনো খুনের খবরটা পড়েননি। চেপে গিয়ে বললেন, নাঃ মিঃ প্যাটার্সন! আপনি তো জানেন আমি বার্ড-ওয়াচার, গতকাল ওখানে পাখি দেখতে গিয়ে কবরখানার দুর্দশা লক্ষ করলুম। অনেক বিখ্যাত ইংরেজদের কবর আছে ওখানে। আপনি যা বলছিলেন, সব দামী ফলক আর ক্রস লোপাট হয়ে গেছে। তাই ভাবলুম…।

হাত তুলে তাকে থামিয়ে রুষ্ট ভঙ্গিতে ডেভিড বললেন, কিছু করা যাবে না। কেন জানেন? কেয়ারটেকার গোমেশ বুড়োই হলো যত নষ্টের গোড়া। আমার দৃঢ় ধারণা, সে-ই ফলক আর ক্রসচোরদের সাহায্য করে। বখরা পায়। গোমেশ মূর্তিমান শয়তান।

গোমেশকে আপনি চেনেন?

চিনি না মানে? ডেভিড ফুঁসে উঠলেন। জীবনে অসংখ্য কাজ সে করেছে, যা কোনও কবরখানার কেয়ারটেকার কখনই করবে না।

যেমন?

গোমেশ রেস খেলত।

 বলেন কী!

ডেভিড আরও উত্তেজিত হয়ে বললেন, রেসে ফতুর হয়ে যাচ্ছিল দেখে ওর বউ আত্মহত্যা করেছিল। ওর ছেলেমেয়েরা রাগ করে অস্ট্রেলিয়া চলে গেল। আমার কাছে গোমেশ একবার পঞ্চাশ টাকা ধার করে নিয়ে গেল। আর শোধ দেবার নাম নেই। শেষে ওর খুড়তুতো বোনকে গিয়ে ধরলুম! ভদ্রমহিলা পরিবারের সম্মান বাঁচাতে টাকাটা শোধ করলেন। কর্নেল! যদি ওর সব কথা ওদের চার্চকে জানাতুম, ওর চাকরিই থাকত না। প্রভু যিশুর দিব্যি, টাকাটা না পেলে আর মুখ বুজে থাকতুমই না।

কর্নেল চুরুটের কৌটো বের করে ডেভিডকে একটি চুরুট দিলেন। ডেভিড সিগারেট তক্ষুণি ঘষটে নিভিয়ে অমায়িক হেসে চুরুটটির তারিফ করলেন। এতক্ষণে কর্নেলের আপ্যায়নের জন্য হাঁক দিলেন, বারবারা! হোয়ার আর ইউ, হনি? কাম অ্যান্ড সি, হু ইজ হেয়া!

ডেভিডের ধুমসি বউ বারবারা ঘর থেকে উঁকি মেরে প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন, ও! মাই, মাই! তারপর ধুপধাপ শব্দে এসে সামনে দাঁড়ালেন। ইউ নটি বয়! কত্তোদিন পাত্তা নেই। আজ আপনার শাস্তি।

এক পেয়ালা কফি, ডার্লিং! কর্নেল অট্টহাস্য করলেন।

বারবারা ধুমসি মেমসাহেব হলেও খুব চটপটে, হাসিখুশি, চঞ্চল মহিলা। স্বামীর উল্টো। তখনই অতিথি সত্ত্বারে ছুটলেন। ডেভিড বাঁকা মুখেই ছিলেন। এই সময় চাপা গলায় বলে উঠলেন, আস্ক হার অ্যাবাউট গোমেশ। শি অলসো নোজ এভরিথিং। তাছাড়া গোমেশের খুড়তুতো বোন আবার বারবারার বন্ধু। তা নইলে কি টাকাটা ফেরত পেতুম?

সেই বোনের ঠিকানা জানেন?

ডেভিড নাকের ডগা কুঁচকে চুরুটের ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, চন্দননগরে থাকে। আমি ঠিকানা জানি না। বারবারা জানে।

একটু পরে বারবারা ট্রে সাজিয়ে নিয়ে এলেন। কর্নেল ব্রেকফাস্ট সেরে বেরিয়েছেন। কিন্তু বারবারা তাঁকে ডবল ব্রেকফাস্ট না খাইয়ে ছাড়বেন না। কর্নেল কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন, বারবারা, ডিয়ারি! তোমার হাতের কফির কোনও তুলনা হয় না!

বারবারা ভ্রূভঙ্গি করে বালিকার চাপল্যে বললেন, আই গেস, সামথিং থ্রিলিং হ্যাজ হ্যাঁপড় সামহোয়্যার। ওকে নটি বয়। আস্ক মি হান্ড্রেডস অফ কোয়েশ্চন্। আইম রেডি টু আনসার।

ডেভিড চমকে উঠলেন এতক্ষণে। মাই গড! আমার এটা ভাবা উচিত ছিল।

কর্নেল মিটিমিটি হেসে বললেন, তেমন কিছু নয়। ঠিক আপনার মতোই ব্যাপার। গোমেশ আমার কাছে একশো টাকা ধার করেছেন। প্রায়ই ওই কবরখানায় পাখি দেখতে যেতুম। তো কাল বিকেলে গিয়ে দেখি, ওঁর ঘরের দরজায় তালা আটকানো।

ডেভিড দ্রুত বললেন, বারবারা। ইউ ডু সামথিং এগেন! দা ব্লাডি বাস্টার্ড সোয়াইন!

বারবারা স্বামীকে ধমক দিয়ে বললেন, চুপ! দিনটাকে নষ্ট কোরো না। কর্নেল! সমস্যা হলো, বেচারি ইভলিন আর তার কাজিন ব্রাদারের টাকা শোধ করতে পারবে কি না, আমার সন্দেহ আছে। ইভলিন মিশনারি কলেজের অধ্যাপিকা। দয়া করে ওকে এক্সটেনশন দিয়েছেন কলেজ কর্তৃপক্ষ। ওঁর-ও তে ভবিষ্যৎ আছে। তবে আমি চিঠি লিখে আপনাকে পরিচয় দিতে পারি।

উনি কি চন্দননগরে থাকেন? কর্নেল জিজ্ঞেস করলেন।

ইভলিন থাকে একটু দূরে। ব্রিটিশ চন্দননগরের কাছে নিরিবিলি এলাকায় গঙ্গার ধারে ওর পৈতৃক বাড়ি। পুরানো বাড়ি ওর বোন এমা বিয়ে করেছে এক হিন্দু ভদ্রলোক সাম মিঃ ঘোষকে। এমা তার স্বামীকে নিয়ে দিদির বাড়িতেই থাকে। বারবারা একটু ভেবে নিয়ে ফের বললেন, ঠিকানা লিখে দিচ্ছি, তবে ইভলিনকে দয়া করে পীড়াপীড়ি করবেন না, হেভস্ সেক!

না, না। গোমেশ কোথায় গেলেন, সেটা খোঁজার জন্য ওঁর সাহায্য চাইব।

ডেভিড বললেন, বদমাশটা ঠিক ওখানে গিয়ে জুটেছে দেখবেন। আর যাবে কোন চুলোয়? অস্ট্রেলিয়া যে যায়নি, তা আমি দিব্যি কেটে বলতে পারি। যাবার টাকা ও পাবে কোথায়?

বারবারা স্বামীর কথায় সায় দিলেন। হ্যাঁ, ইভলিনের ঘাড়ে গিয়ে চাপতেও পারে। ইভলিনটা যে বড্ড বেশি দয়ালু মেয়ে।…

.

কর্নেল চন্দননগরে ট্রেন থেকে যখন নামলেন, তখন প্রায় বারোটা বাজে। ইভলিনকে এখন কলেজে পাওয়া যাবে। তাই রিকশো করে মিশনারি কলেজে গেছেন।

গিয়েই নিরাশ হলেন। ইভলিন তিন দিন আগে ছুটিতে গেছেন। সম্ভবত মুসৌরিতে বেড়াতে গেছেন।

কিন্তু তাঁর বোন এমা ঘোষ আছেন। অন্তত থাকার সম্ভাবনা আছে। কারণ, দিদির সঙ্গে তিনিও মুসৌরি চলে যেতে পারেন। তবু শেষ চেষ্টা। গোমেশের খোঁজ যদি মেলে!

গোমেশ এই হত্যারহস্যের একটা প্রধান সূত্র।

রিকশোওলা গাঁইগুঁই করছিল। ওই এলাকায় রাস্তাঘাট নাকি ভাল নয়। বখশিসের লোভে সে শেষে রাজি হলো। গঙ্গার ধারে রাস্তা ধরে শহর এলাকা ছাড়িয়ে তারপর আমবাগান, বাঁশবন, জঙ্গল পোডড়া বাড়ির ভেতর দিয়ে কাঁচা পথ। বৃষ্টিবাদলায় কাদা আর খানাখন্দে ভরা। রিকশাওলা তেতো মুখে মাঝে মাঝে নেমে সাইকেল রিকশো টেনে নিয়ে যাচ্ছিল।

কর্নেল তৈরি হয়েই বেরিয়েছেন। কিটব্যাগে লাঞ্চের প্যাকেট, হ্যাঁভারস্যাকে জল আছে। ফ্লাস্কভর্তি কফিও মজুত। বাইনোকুলার ক্যামেরা যথারীতি ঝুলছে গলা থেকে। হাতে প্রজাপতি ধরা নেটস্টিক। রথদেখা কলাবেচা দুই-ই হবে। বরাবরকার অভ্যাস।

বাঁ দিকে দূরে সুদৃশ্য হাউসিং কলোনি। একখানে রিকশাওলা গোঁ ধরে দাঁড়াল। আর যেতে পারব না স্যার! ওই দেখুন কত্তো জল। আপনি দয়া করে চলে যান।

সত্যি আর রিকশো যাবে না। অগত্য নেমে পড়লেন। বখশিস অবশ্য কথামতো দিলেন। রিকশোওলা একটু বিশ্রাম নিতে বসল একটা গাছের তলায়।

কর্নেলের পায়ে গামবুট। জলকাদা ভেঙে হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিলেন, ইভলিন কলেজে যান কোন রাস্তায়? নিশ্চয় ভুল রাস্তায় এসে পড়েছেন। সম্ভবত ওই হাউসিং কলোনির ভেতর দিয়ে ভাল রাস্তা আছে।

হ্যাঁ, ভুলটা নিজেরই। দূরত্বটা বেশি হতো ওদিকে গেলে। কিন্তু নিজেই গঙ্গার শোভা এবং পাখি-প্রজাপতির ধান্দায় এদিকে নিয়ে এসেছিলেন রিকশোওলাকে।

তবে লাভ হলো। পাখির রাজত্ব এদিকটায়। কত রকমের প্রজাপতিও। সাধারণ প্রজাতির প্রজাপতি বলে নেটে ধরার চেষ্টা করলেন না। জঙ্গুলে এলাকা। মুসলিম গোরস্তান। ভাঙা মসজিদ। কোথাও ধ্বংসাবশেষ।

একটা বাজে। গঙ্গার ধারে বসে লাঞ্চ সেরে নিলেন কর্নেল।

চুরুট ধরিয়ে আবার হাঁটতে থাকলেন। এবার গাছপালার ফাঁকে জরাজীর্ণ কিছু বাড়ি চোখে পড়ল। বনেদী বড়লোকের বাড়ি ছিল একদা। কিন্তু মানুষজন। চোখে পড়ল না। এগুলো বাগানবাড়ি বলেই মনে হচ্ছিল। খানিকটা এগিয়ে বাঁ দিকে সুরকি-বিছানো ক্ষয়টে এক ফালি সংকীর্ণ রাস্তার ধারে একটা গেট। গেটের মাথায় বোগনভেলিয়ার ঝাপি। নিচু পাঁচিলঘেরা একটা পুরনো দোতলা বাড়ি। গেটের ফলকটা টুটাফাটা। লেখা আছে : ইভনিং ভিলা। এই সেই বাড়ি!

গেট বন্ধ। গরাদ দেওয়া গেট। ভেতরে ফুলবাগিচা অযত্নে জঙ্গল হয়ে আছে। বাড়ির সিঁড়ির মাথায় খোলা পার্লারে একটা হাফপ্যান্ট গেঞ্জিপরা লোক বসে পালক দিয়ে কান চুলকোচ্ছে। আরামে চোখ বন্ধ। কর্নেল খুক করে কাশতেই সে তাকাল। তারপর হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে এসে সেলাম দিল।

কর্নেল, মিসেস ইভলিনের ভাই গোমেশকে একটু ডেকে দাও না ভাই!

লোকটি হকচকিয়ে গেল। তারপর জোরে হাত নেড়ে বলল, গোমসায়েব নেই স্যার! তাকে এখানে পাবেন কে বলল? সে তো কলকাতায় থাকে।

কর্নেল ইচ্ছে করেই প্রশ্নটা করেছিলেন। কিন্তু লোকটির প্রতিক্রিয়া অদ্ভুত। এর দুটো অর্থই হয়। গোমেশ এখানে আছেন এবং নিষেধ করা আছে, কিংবা এ বাড়িতে তিনি অবাঞ্ছিত লোক।

কর্নেল অমায়িক হেসে বললেন, মিসেস ইভলিনের বাড়িতে ওঁর সঙ্গে আমার দেখা করার কথা ছিল।

লোকটি গেটের গরাদে বুক ঠেকিয়ে চাপা গলায় বলল, স্যার কি মাল কিনবেন? তা হলে এখানে নয়। মেমসায়েবের বকুনিতে গোমসায়েব আর এখানে মাল এনে রাখতে সাহস পায় না। অন্য জায়গায় নিয়ে গিয়ে রাখে। দামী পাথর স্যার! আদ্ধেক দামে পাবেন। কিছু বখশিস ছাড়ুন। পাথর কেনার ব্যবস্থা করে দেব।

একটা চক্রের স্পষ্ট আভাস পাওয়া যাচ্ছে। কর্নেল বললেন, পাথর? পাথর নয়। গোমেশ আমার কাছে টাকা ধার করেছেন। দিদির কাছে টাকা নিয়ে…

লোকটা হাসতে লাগল। সে-গুড়ে বালি। বড় মেমসায়েব গোমসায়েবকে টাকা দেবেন? তার এ বাড়ির ত্রিসীমানায় আসা বারণ।

বড় মেমসায়েব তো এখন মুসৌরিতে। তাই…

গোমসায়েব আপনাকে খামোকা কষ্ট দিয়েছে স্যার! লোকটা আরও হাসতে লাগল।

কর্নেল দাড়ি চুলকে বললেন, ছোট মেমসায়েব তো আছেন। তাকে একটু ডেকে দাও তা হলে।

ছোট মেমসায়েব আর সায়েব কলকাতা গেছেন।

 কখন ফিরকেন?

কিছু বলে যাননি। বিকেলে ফিরতে পারেন; রাত্তিরেও ফিরতে পারেন। লোকটা হাই তুলে বলল। তবে ছোট মেমসায়েব আরও তেজী। গোমসায়েবের নাম শুনলেই খেপে যান।

কর্নেল একটু চুপ করে থেকে বললেন, এদিকে রাস্তাটা খারাপ। ভাল রাস্তা কোনদিকে?

লোকটা বাঁ দিকে আঙুল তুলে বলল, ওই দিকে। স্টেশনে যাবেন তো? দূর হবে। তবে রিকশো পেয়ে যাবেন কলোনির মোড়ে।

সে চলে গেল। পার্লারে গিয়ে বসে আবার পালক দিয়ে কান চুলকোতে থাকল। কর্নেল বাঁ দিকে এগিয়ে একটা মোটামুটি ভাল রাস্তা দেখতে পেলেন। তারপর ঘুরে লক্ষ্য করলেন, লোকটা এবার চোখ বুজে নেই। তাকে দেখছে। দাঁত দেখা যাচ্ছে। তাকে বোকা ভেবে হাসছে নাকি।

একটু গাছের আড়ালে গিয়ে কর্নেল ডাইনে ঘুরলেন। তারপর গঙ্গার ধারে একটা বটগাছের তলায় গেলেন। চোখে বাইনোকুলার রেখে বাড়িটা দেখতে থাকলেন।

লোকটা ঘরে ঢুকে গেল সদ্য। মিনিট দুতিন লক্ষ্য রাখলেন কর্নেল। কিন্তু তাকে বেরুতে দেখলেন না। দোতলা বাড়িটার দরজা-জানালা সব বন্ধ।

এবার গাছতলায় বসে গঙ্গার শোভা দেখতে থাকলেন। এক ঝাঁক হাঁস। গঙ্গার ওপর দিয়ে উড়ে চলেছে বাঁকা রেখার মতো। ভরা গঙ্গায় পালতোলা নৌকো। খেয়া নৌকো। একটা লঞ্চ। চিরাচরিত দৃশ্য।

হ্যাঁ, গোমেশ নিজেও লুকিয়ে কবরের ফলক বেচতেন। ওই লোকটার সঙ্গে তাঁর যোগাযোগও ছিল। পেছনে একটা চক্রও আছে। কিন্তু তার সঙ্গে টিনি হত্যারহস্যের সম্পর্ক কী?

ছেঁড়া চিঠিটা এবং গোমেশের হঠাৎ অন্তর্ধান…

খুব জট পাকিয়ে গেল ব্যাপারটা। টিনি সম্পর্কে যে ওই নিউজপ্রিন্টে অনবদ্য আখ্যায়িকা লিখেছে, সে-ই টিনিকে লেখা একটা চিঠি গোমশকে দিয়েছিল, টিনিকে দেবার জন্য। গোমেশ তোমাকে সব কথা বলবে লিখেছিল। কী কথা?

গোমেশকে সবার আগে খুঁজে বের করা দরকার। সে আর কোথায় যেতে পারে, সে-খোঁজ এমা সম্ভবত দিতে পারবেন। অতএব এমার সঙ্গে দেখা না করে কলকাতা ফেরা উচিত নয়।

তিনটে পনের বাজে, একটা রিকশো দেখতে পেলেন কর্নেল। রিকশায় এক মেমসায়েব এবং এক দিশী সায়েব। রিকশোটা ইভনিং ভিলার দিকে ঘুরলে কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন।

রিকশো থেকে দুটিতে নেমেছে, কর্নেল হন্তদন্ত হয়ে গিয়ে বললেন, গুড় আফটারনুন!

দুজনেই তাকালেন। পুরুষটির চেহারায় রুক্ষ ভাব। চোখের তলায় কালচে ছোপ। চল্লিশের মধ্যে বয়স।

কর্নেল বললেন, আশা করি মিসেস এমা এবং মিঃ ঘোষকেই আমি দেখছি!

ঘোষসায়েব কী বলতে ঠোঁট ফাঁক করেছিলেন, তার আগে এমা বললেন, আপনাকে তো চিনতে পারলুম না!

আমার নাম কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। ইলিয়ট রোডের আন্ডারটেকার মিঃ ডেভিড প্যাটার্সনের স্ত্রী মিসেস বারবারা আমার পরিচিত। তিনি আপনার দিদিকে একটা চিঠি লিখে দিয়েছেন। বলে কর্নেল চিঠিটা দিলেন এমাকে।

এমা চিঠিটা পড়ে বললেন, কিন্তু দিদি তো নেই।

দিদি নেই, কিন্তু তার বোন আছেন! কর্নেল একটু হেসে বললেন। আশা করি, তার সহযোগিতা পাব।

এমা একটু পরে বললেন, ওকে। ভেতরে আসুন।

সেই লোকটা দৌড়ে এসে গেট খুলেছিল। দম্পতি আগে ঢুকলেন। পেছনে কর্নেল। তার চোখে চোখ পড়তেই লোকটা কর্নেলকে চোখ টিপল। এর একটাই অর্থ হয়। পাথর সম্পর্কে কোনও কথা যেন কর্নেল না তোলেন। লোকটা হাত দুটো জোড়ও করল।

হুঁ, লোকটাকে যতই গুণ্ডা দেখাক, নেহাত ভিতু ছিঁচকে। হয়তো বাঘের পেছনকার ফেউয়ের মতো কিছু বখরাকড়ি পায়-টায়। কর্নেল মুচকি হেসে চোখের ইশারায় তাকে আশ্বস্ত করলেন।

মেমসায়েব বারান্দায় ওঠার সময় বললেন, কাল্লু! দরওয়াজা-জানলা বন্ধ কাহে? তুমকো বোলা, কভি বনধ নেহি রাখনা। হওয়া পাস নেহি করে গা। খুল দো জলদি!

কাল্লু কঁচমাচু মুখে বলল, আভি খুল দেতা মেমসাব! একেলা থা। হম্‌। চোট্টাউট্টাকা ডর লাগতা থা। ইস্ লিয়ে…

শাট আপ! এমা ধমক দিলেন। কভি এইসা না কিও।

কাল্লু দৌড়ে ঢুকে প্রথমে বসার ঘরের জানালা খুলে দিল। তারপর ভেতরে ঢুকে গেল। এমা কর্নেলকে বসতে বললেন। ততক্ষণে পাশের ঘরে জানালা খোলার শব্দ এবং তার একটু পরে ওপরেও। একটু হেসে বললেন, পুরনো বাড়ি। এই আবহাওয়ায় স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে ওঠে। অথচ কাল্লু বড় ভিতু। আমরা না থাকলেই জানালাগুলো বন্ধ করে ফেলবে। যাই হোক, গোমেশদাকে টাকা ধার দেওয়া নিয়ে এর আগে অনেক ঝামেলা দিদিকে পোয়াতে হয়েছে। বারবারাদির কথা আলাদা। কিন্তু অন্য যারা টাকা ধার দিয়েছে, সবাই কিন্তু পাথর কেনার জন্যই দিয়েছে। না, না–আমি বলছি না, আপনিও একই উদ্দেশ্যে দিয়েছেন। আপনাকে সেরকম লোক মনে হচ্ছে না।

কর্নেল দ্রুত বললেন, আপনি ঠিকই ধরেছেন, ম্যাডাম! আমি একজন নেচারিস্ট প্রকৃতিপ্রেমিক। ওই কবরখানায় প্রচুর গাছ আর পাখি। এই দেখছেন বাইনোকুলার। পাখি দেখতে গিয়ে মিঃ গোমেশের সঙ্গে পরিচয়। তো, উনি কি এখানে এসেছেন?

…এলে কাল্লু আমাকে এখনই জানাত। কাজেই আসেনি। তা ছাড়া এ বাড়িতে ওকে দিদি ঢুকতে বারণ করেছেন। আমি তো দিদির চেয়ে আরও কড়া। ওকে বাড়ির ত্রিসীমানায় দেখলে ভাগিয়ে দিই। কারণ, কবে না আমাদের চোরাপাথরের কারবারে ফাঁসিয়ে দেয়! এমা শক্তমুখে কথাগুলি বললেন।

কর্নেল বললেন, গোমেশের কবরখানার ঘরের দরজা বন্ধ। খবর নিয়েছি, উনি কোথায় চলে গেছেন। দয়া করে যদি জানান, আর কোথায় ওঁর যাওয়ার চান্স আছে?

এমা মাথা নেড়ে একটা ভঙ্গি করে বললেন, যাবে কোন চুলোয়! অবশ্য ওর সঙ্গে চোরচোট্টাদের ভাব আছে। কলকাতায় কোথাও থাকতে পারে। আপনি বরং পুলিশে খবর দিন। ওর এবার শাস্তি হওয়া দরকার!

কর্নেল একটু চুপ করে থেকে বললেন, আপনাদের বাড়িটা একবারে প্রকৃতির রাজ্য। বড় সুন্দর পরিবেশ।

এমা শ্বাস ছেড়ে বললেন, আর পরিবেশ! সব জঙ্গল হয়ে গেল। কী ছিল এই বাড়ি ব্রিটিশ স্বর্ণযুগে! এখন নরকের মাঝখানে আছি। চারদিকে চোর ডাকাত। আইন-শৃঙ্খলা নেই। ভাবছি, শিগগির বাড়ি বেচে দিয়ে আমরা বাইরে চলে যাব।

বলে কর্নেলকে এতক্ষণে ভাল করে লক্ষ্য করে হাসলেন। ইউ লুক আ ফরেনার! জাস্ট লাইক আ ক্যাথলিক ফাদার! হাউ ফানি! ইউ আর আ কর্নেল! ডিড ইউ সার্ভ আন্ডার দা গোল্ডেন ব্রিটিশ এম্পায়ার?

কর্নেল হাসলেন মাত্র। প্রসঙ্গ এড়িয়ে বললেন, তা হলে গোমেশকে কোথায় পাব, আপনি বলতে পারছেন না?

এমা মাথা নাড়লেন। হি ইজ ইন দা হেল! প্লিজ ডোন্ট টক অ্যাবাউট হিম।

তাহলে উঠি ম্যাডাম!

জাস্ট আ মিনিট কর্নেল সরকার। আই অ্যাম সরি! বলে এমা উঠে দাঁড়ালেন। এ বাড়ির একটা বনেদি কালচার আছে। অন্তত এক কাপ চা খেয়ে যান। অথবা একটা কোল্ড ড্রিংক!

ধন্যবাদ, অসংখ্য ধন্যবাদ! কর্নেল উঠে বললেন, চলি!

এই সময় ঘোষসায়েব জীর্ণ পর্দার ফাঁকে উঁকি মেরে বললেন, এমা, হনি! দ্যাটস্ এনাফ। লেট হিম গো!

ড্যানি! ডোন্ট টক ননসেন্স! হি ইজ আ জেন্টলম্যান আ রিটায়ার্ড মিলিটারি অফিসার।

সো হোয়াট?

ড্যানি ঘোষ যে ঘরে ঢুকেই মদ গিলেছেন, বোঝা যাচ্ছিল। জড়ানো গলায় কথা বলেছিলেন। পর্দা ঠেলে ঢুকে কর্নেলের দিকে চোখ কটমটিয়ে বাংলায় বললেন, দেখুন মশাই! শিকারী বেড়ালের গোঁফ দেখলেই চেনা যায়। আমি মাল চিনি। আপনি নির্ঘাত পুলিশের লোক! তবে এখানে সুবিধে হবে না। কেটে পড়ুন!

এমা তাকে ধাক্কা দিতে দিতে ভেতরে নিয়ে গেলেন। কর্নেল বারান্দায় পৌঁছেছেন, তখন তিনি ফিরে এলেন! প্লিজ, প্লিজ কর্নেল সরকার! ড্যানি একটুতেই মাতাল হয়। আপনি দয়া করে কিছু মনে করবেন না। আই অ্যাম সো সরি ফর মাই হাজব্যান্ড!

কর্নেল অমায়িক হেসে ভব্য-জনোচিত বাও করে চলে এলেন।

 হঠাৎ ড্যানি ঘোষের ওসব কথা বলার কারণ কী? কর্নেল গঙ্গার ধারে সেই যে বটতলায় গিয়ে দাঁড়ালেন। নিঝুম নিরিবিলি প্রকৃতিতে পাখিদের দিনশেষের হল্লা অর্কেস্ট্রার মতো। আলোর রঙ বদলে গোলাপি হয়েছে। বাইনোকুলারে চোখ রেখে বাড়িটা খুঁটিয়ে দেখতে থাকলেন।

নিচের একটা ঘরের জানালার পর্দা সরিয়ে দিয়ে ড্যানি ঘোষের মুখ উঁকি দিল। রুষ্ট দৃষ্টিতে তিনি সম্ভবত কর্নেলকে খুঁজছেন। প্রত্যেকটি রেখা স্পষ্ট দেখা। যাচ্ছে বাইনোকুলারে।

তারপর এমার মুখ দেখা দেল। তাকে কিছু বোঝাতে চাইছেন। ড্যানি ঘোষ ফুঁসছেন রাগে।

কিন্তু তারপর বাইনোকুলার ঘোরাতেই দক্ষিণ-পূর্বে পাঁচিলের কোনায় ঝোপের কাছে কাল্লুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেন। কাকে ওদিকে হাতের ইশারা করছে।

কর্নেল আগের রাস্তা ধরে এগিয়ে গেলেন। কিন্তু সেদিকে আর কাউকে দেখতে পেলেন না। কাল্লু তেমনি দাঁড়িয়ে আছে। তারপর সে বাঁদিকে ঘুরে কর্নেলকে দেখতে পেল। অমনি পাঁচিলের একটা ভাঙা অংশ ডিঙিয়ে বাইরে এল। কর্নেল থমকে দাঁড়ালেন।

জনহীন, ঝোপঝাড় গাছপালা আর ধ্বংসস্তূপের ভেতর দিয়ে জল-কাদা খানাখন্দে ভরা একটা রাস্তা কর্নেল হন্তদন্ত হয়ে চলতে শুরু করলেন। কালুকে আর দেখা যাচ্ছিল না। কাল্লু কি তাকে কোনও কথা বলতেই অমন করে এগিয়ে আসছিল তার দিকে?

একটা প্রকাণ্ড গাছের তলায় থকথকে কাদা। কাদা এড়িয়ে গাছের গুঁড়ির গা ঘেঁষে কর্নেল ওধারে যেতেই কাল্লুকে দেখতে পেলেন, একেবারে মুখোমুখি। তার হাতে একটা চকচকে ছুরি। মুহূর্তে কাল্লু ছুরির ডগা কর্নেলের গলায় ঠেকিয়ে হিসহিস শব্দে বলল, শালা বুড়ো খোঁচড়! বল, কেন এসেছিলি? আ বে শালা! তোর বাপরা ঘোষসায়েবের পোষা বেড়াল জানিস? দেব শালাকে। গঙ্গায় মড়া ভাসিয়ে। বল্!

কর্নেল একটু হকচকিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর সেই ইনটুইশন কোথায় গেল? এ যে একেবারে অতর্কিত এবং অপ্রত্যাশিত। কাল্লুকে কী ভেবেছিলেন?

হুঁ, জীবনে এরকম দুএকটি ব্যর্থতার দৃষ্টান্ত নেই, এমন নয়। ভাগ্যিস ফলাটা সঙ্গে সঙ্গে গলায় ঢুকিয়ে দেয়নি। গঙ্গায় টেনে নিয়ে ফেলে দিলে ভেসে যেতেন মড়া হয়ে। খুনটা কোথায় হয়েছে পুলিশ টেরই পেত না। ডেভিডের কাছে যাওয়ার কথা কাউকে বলে আসেননি। অরিজিৎ লাহিড়ীর পক্ষে খেই পাওয়া অসম্ভব হতো।

বিচলিত ভাবটা তখনই কাটিয়ে উঠলেন কর্নেল। বললেন (ভয় পাওয়া ভঙ্গিতে), ভাই কাল্লু! আমাকে প্রাণে মেরো না। সব খুলে বলছি। বরং একশোটা টাকাও…

কাল্লু ঝটপট বলল ছুরির ডগায় একটু চাপ দিয়ে, তবে আগে ঝাড় বে! মানিব্যাগ বের কর! জলদি!

কর্নেল জ্যাকেটের ভেতর পকেটে মানিব্যাগ বের করার ছলে হাত ঢোকালেন এবং বেরিয়ে এল তার রিভলবার। মুহূর্তে তার নল কাল্লুর গলায় ঠেকিয়ে সহাস্যে বললেন, মরলে দুজনেই মরি তবে!

কাল্লু ভ্যাবাচাকা খেয়েছিল। সেই সুযোগে কর্নেল হাঁটু তুলে তার পেটে গুতো মারলেন। কাল্লু অঁ শব্দে পড়ে গেল। কর্নেল একটা গামবুট তার ছুরিধরা হাতে চাপিয়ে অপরটা তার বুকে রাখলেন। কাল্লু হাঁসফাঁস করে বলল, অ্যাই বাপ! মরে যাব! আর কক্ষণও এমন করব না…মাইরি স্যার! ওই শালা ঘোষসায়েবের কথায়…মা কালীর দিব্যি..শালা ঘোষসায়েব…বাবা রে!

কর্নেল ছুরিটা কুড়িয়ে নিয়ে ভাঁজ করে পকেটে ঢোকালেন। তারপর তার গেঞ্জির কলার ধরে ওঠালেন। তাকে টেনে গাছের গুঁড়ির আড়ালে এনে গুঁড়িতে ঠেসে ধরে বললেন, পাথর কোথায় পাওয়া যায়?

ঘোষসায়েব জানে স্যার! মাইরি মা কালীর দিব্যি!

রিভলবারের নল গলায় আরও চেপে কর্নেল বললেন, তখন বললি তুই ঠিকানা জানিস! বল্। নইলে তোকে মড়া করে গঙ্গায় ভাসাব!

করুণ হাসল কাল্লু। মাইরি পাথর কিনবেন স্যার? তা হলে শালা ঘোষসাহেব বলল যে আপনি পুলিশের টিকটিকি!

বল! চার গুনতে গুনতে না বললেই মড়া। এক..দুই…তিন…

 কলকাতায় স্যার, কলকাতায়।

ঠিকানা বল্!

ঘোষসায়েবের মামার কাছে স্যার! ফিরি ইস্কুল স্টিট স্যার! রায় কোম্পানিতে স্যার! কাল্লু ভাঙা গলায় বলল। তবে এই শালা ঘোষসায়েবের চিঠি ছাড়া দেবে না।

 গোমেশ কোথায়?

কথাটা বলেই কর্নেল কাল্লুর নাভির ওপরটা খামচে ধরলেন। যন্ত্রণায় গোঙিয়ে উঠে কাল্লু বলে ফেলল, এসেছিল। ছোট মেমসায়েবের ভয়ে লুকিয়ে ছিল কোনার ঘরে। আপনি আসার পরই পালিয়ে গেল। স্যার, এবার গোমসায়েব খুব দামী পাথর বেচেছে কোম্পানিকে। ফিরি ইস্কুল স্টিটে গেলেই পেয়ে যাবেন।

কর্নেল তাকে ছেড়ে দিতেই সে দিশেহারা হয়ে গা ঢাকা দিল। দেখার মতো দৃশ্য।

কিন্তু হাসতে গিয়ে হাসতে পারলেন না কর্নেল। আবছায়া ঘনিয়ে এসেছে। বড় বিপজ্জনক জায়গায় এসে পড়েছেন। হনহন করে হাঁটতে থাকলেন।

বসতি এলাকায় পৌঁছে একটা সাইকেল রিকশো পেয়ে গেলেন। বললেন, স্টেশন!

স্টেশনে পৌঁছুতে প্রায় আধঘণ্টা লাগল। টিকিট কেটে প্ল্যাটফর্মে গিয়ে দেখলেন, হাওড়াগামী ট্রেন সবে হুইসল দিচ্ছে। সামনের কামরায় উঠে পড়লেন। বড্ড ভিড়। এবার চুরুট টানতে পারলে মাথার ঘিলু চাঙ্গা হত। কিন্তু এই ভিড়ে সেটা সম্ভব নয়।

ট্রেন হাওড়া স্টেশনে পৌঁছুনোর পর কর্নেল নেমে চুরুট ধরালেন। ধোঁয়া ছেড়ে সেই ধোঁয়ার ভেতর আচমকা আবিষ্কার করলেন, ভিড়ে গোমেশ চলেছেন।

ভিড় ঠেলে এগিয়ে ডাকলেন, হ্যাল্লো ব্রাদার গোমেশ!

গোমেশ ঘুরে তাকে দেখামাত্র প্রায় দৌড়ে ভিড় ঠেলে নিপাত্তা হলে গেলেন। এতক্ষণে কর্নেল হাসতে পারলেন।….

.

ষষ্ঠীচরণ কফি রেখে খুঁটিয়ে কর্নেলকে দেখছিল। কর্নেল বললেন, কী রে?

 ষষ্ঠী একটু হেসে বলল, বাবামশাইকে কেমন যেন দেখাচ্ছে।

কেমন?

কেমন যেন..ঝড়জল খাওয়া কেমন শুটকো…ষষ্ঠী জুতসই উপমা খুঁজে পাচ্ছিল না।

কর্নেল চোখ কটমট করে তাকিয়ে বললেন, খুব হয়েছে। অরিজিৎ কটায় আসবে বলেছে বললি যেন?

ষষ্ঠী যেতে যেতে বলে গেল, ঠিক ধরেছি। কিছু গণ্ডগোল হয়েছে। বললুম নালবাজারের নাহিড়ীসায়েব ফোং করবে বলেছেন, আর বলেন, কী, কটায় আসবে?

হু। কটায় ফোন করবে?

রাত্তির নটা বাজুক! ঘড়ির কাটা জায়গামতো যাক্। বলে ষষ্ঠী পর্দা ঠেলে ভেতরে ঢুকে গেল।

সত্যিই বড় ধকল গেছে দিনটায়। তার ওপর নিজের সেই ষষ্ঠেন্দ্রিয়জাত বোধের ব্যর্থতা! ভাবতে বুক ধড়াস করে ওঠে, কাল্লু যদি সত্যি তাকে মড়া করে গঙ্গায় ফেলে দিত? রহস্যটার অন্য একটা দিক এটা, নাকি ওটা আলাদা একটা ব্যাপারটিনির হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যোগসূত্রহীন?

যোগসূত্র শুধু গোমেশের ওয়েস্টপেপার বাস্কেটে ছেঁড়া চিঠিটা। তার মানে, রহস্য যদি দুটি পৃথক ঘটনাকেন্দ্রিক হয়, তাহলেও গোমেশ একটা যোগসূত্র হয়েই থাকছেন। গোমেশের অদ্ভুত আচরণের কারণ কী? এইসব কথা ভাবতে ভাবতে রাত নটা দুমিনিটে ফোন এল অরিজিৎ লাহিড়ীর। হাই ওল্ড বস! সারাদিন কোথাও কি পাখি-প্রজাপতি-অর্কিডের খোঁজে নিপাত্তা হয়েছিলেন? নাকি।…

ডার্লিং। নাকি অংশটাই ঠিক। এনিওয়ে, কোনও খবর আছে বুঝতে পারছি। বলো!

চার্লস গ্রিয়ার্সনের নাম চেনা মনে হচ্ছে?

 ইয়া। যদি তিনি হন এইটিন্থ সেঞ্চুরির ব্রিটিশ অ্যাডভেঞ্চারার!

কারেক্ট। ইস্টার্ন প্রোটেস্ট্যান্ট সিমেট্রিতে তাঁর কবর আছে।

তার কবরের ফলক চুরি গেছে কি?

ইউ আর ড্যাম রাইট, বস! তবে সাধারণ মার্বেল নয়। উনি নিজের কবরের ফলকের জন্য দুর্মূল্য পাথর এনেছিলেন পার্সিয়া থেকে। কালো একরকম দুর্লভ পাথর। সরি! দেখতে পাথর, কিন্তু আসলে রত্ন। ছ ইঞ্চি বাই ন ইঞ্চি মাপ। দাম আজকাল কম করেও লাখ টাকা।

কী করে চুরি যাওয়ার খবর পেলে?

দুপুরে আবার গোমেশের ঘর এবং গির্জায় পুলিশ গিয়েছিল তদন্তে। সঙ্গে চার্চের যাজক এবং কমিটির মেম্বাররা ছিলেন। যে কবরে টিনি খুন হয়েছে, তার কয়েক হাত তফাতে চার্লস গ্রিয়ার্সনের কবর। যাজক ফাদার হুবার্টই আবিষ্কার করলেন, ফলকটা নেই। পরে এক্সপার্ট টিম গিয়ে তদন্ত করলেন। ফলকটা ওপড়ানো হয়েছে, এটাই আশ্চর্য, টিনির মৃত্যুর পরের রাতে। ডঃ মহাপাত্রকে আপনি তো জানেন ইওর বুজ ফ্রেন্ড! উপড়ে ফেলা ঘাসগুলোর অবস্থা পরীক্ষা করে ওঁর এই সিদ্ধান্ত। টিনি খুন হওয়ার চব্বিশ ঘণ্টা পরে ঘটনাটি ঘটেছে।

অরিজিৎ! কুইক! এখনই ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে রয় অ্যান্ড কোম্পানির নিলামঘর, অফিস, গোডাউন সার্চ করো!

হো-য়া-ট?

 রয় অ্যান্ড কোম্পানি। ইউ নো দেম।

 মাই গুডনেস! কিন্তু…

 কোনও কিন্তু নয়। মেক্ হেস্ট!

 একটু পরে অরিজিতের গলা শোনা গেল ফের, ওল্ড বস! আর য়ু দেয়ার?

 বলো!

 তা হলে আপনি কোনও সূত্রের সন্ধানে আজ সারাটা দিন…

নো মোর টক। ডু দ্যাট অ্যাট ওয়ান্স। অবশ্য জানি না, ওরা কতটা বোকা বা বুদ্ধিমান। তবু দেখা যাক।

ওকে। গুড নাইট!

ফোন বন্ধ হলো। কর্নেল ফোন রেখে রিসিভারে হাত চেপে রাখলেন কিছুক্ষণ। তারপর ফের ফোন তুলে ডায়াল করলেন দৈনিক সত্যসেবুক পত্রিকায়। সাড়া এলে বললেন, প্লিজ পুট মি টু দা চিফ অব দা নিউজ ব্যুরো প্লিজ!

মহিলা অপারেটর বললেন, প্লিজ, হোল্ড অন!

একটু পরে চিফ অফ দা নিউজ ব্যুরো তারক গাঙ্গুলির সাড়া এল, হ্যা! গাঙ্গুলি।

আমি কর্নেল নীলাদ্রি সরকার, মিঃ গাঙ্গুলি!

হ্যাল্লো সান্তা ক্লজ! ক্রিসমাসের তো ঢের দেরি! হাঃ হাঃ হাঃ।

জয়ন্তকে কি পাঞ্জাবের সন্ত্রাসবাদীদের সঙ্গে লড়তে পাঠিয়েছেন?

আপনার শাগরেদ রোজ একখানা করে সাসপেন্স থিলার টেলেক্সে পাঠাচ্ছে।

আচ্ছা মিঃ গাঙ্গুলি, আপনাদের সাংবাদিকরা তো নিউজপ্রিন্টে ডটপেনে লেখেন?

আরে, আরে! কী সর্বনাশ! হঠাৎ এসব…

 প্যাডের সাইজটা কাইন্ডলি বলবেন?

কী কাণ্ড!..এক মিনিট।…হু, বারো বাই আট জেনারেলি, কখনও চৌদ্দ বাই দশ।

থ্যাংকস! কর্নেল লাইন অফ করে ফোন নামিয়ে রাখলেন। তারক গাঙ্গুলি আকাশ-পাতাল হাতড়াচ্ছেন। তাকে ফোন করবেন ভেবেই কর্নেল টেবিলে ফোনটা কাত করে রাখলেন। কাগজের লোকেরাও আজকাল রহস্যের গন্ধ পেলেই হইহই বাধিয়ে ছাড়ে। খবরের কাগজে অন্ততদন্ত অধুনা হিড়িক ফেলে দিয়েছে। পাবলিক খুব খাচ্ছে।…

.

০৩.

 কর্নেলের শূন্যোদ্যান থেকে বাইনোকুলারে লেডি ব্র্যাবোর্ন কলেজের ওদিকে উঁচু-উঁচু দেবদারুগুলি চমৎকার দেখা যায়। দেবদারুশীর্ষে শকুনের বাসা! রোজ সকালে বাসাগুলি দেখা অভ্যাসে দাঁড়িয়েছে কর্নেলের। ষষ্ঠীকেও ব্যাপারটা দেখিয়েছেন। ষষ্ঠী বলে, ভাবগতিক ভাল ঠেকছে না বাবামশাই! বড় কুলক্ষণ। কর্নেল দাড়ি নেড়ে সায় দেন। কলকাতা ভবিষ্যতে কি ভাগাড়ে পরিণত হবে, এ তারই পূর্বাভাস? শকুনের আশ্চর্য এক ইন্দ্রিয় আছে। কোথায় মড়া প্রাণী পড়েছে, ঠিকই টের পায়। কলকাতাকে প্রধানমন্ত্রী মুমূর্ফ নগরী বলেছিলেন। বুদ্ধিজীবীরা তাই শুনে খাপ্পা হয়েছিলেন। কিন্তু সত্যিই কি কলকাতা ধুকছে না? সেদিন কাগজে কে শাসিয়ে লিখেছে, দেখে নিও, কলকাতা একদিন মোহেনজোদাড়ো হয়ে যাবে! শকুনগুলির গাছে গাছে বাসা বেঁধে বংশবৃদ্ধি সেই শাসানিরই প্রতীক কি? এদিকে একদল হুজুগে লোক কলকাতার তিনশো বছর পূর্তি উপলক্ষে উৎসবের জন্য উঠে পড়ে লেগেছে! বুড়ো থুথুড়ে এক শহর চুলে কলপ দিয়ে যুবক সেজে আছে, মুখে পেন্ট। হার্ট কমজোর, সেদিকে কারও লক্ষ্য নেই! বোকা। বোকা!…

বোকা! কী আশ্চর্য! আপনি যা বললেন, তাই করলুম। আর উল্টে বলছেন বোকা?

কর্নেল দ্রুত ঘুরলেন। অরিজিৎ লাহিড়ীকে দেখে একটু হেসে বললেন, ও! তুমি? মর্নিং ডার্লিং!

কিন্তু বোকা বলাটা কি ঠিক হলো বস?

 কর্নেল অট্টহাসি হাসতে গিয়ে সংযত হলেন। না, না। তোমায় বোকা বলিনি!

অরিজিৎ বললেন, দিব্যি বোকা বলছেন শুনতে পেলুম! এনিওয়ে, ষষ্ঠী বলে যে তার বাবামশাই আজকাল কেমন যেন হয়ে যাচ্ছেন। আপনমনে বিড়বিড় করে কথা বলেন! কর্নেল, দিনকতক বাইরে কোথাও ঘুরে আসুন বরং!

কর্নেল চেপে রাখা অট্টহাসিটি ছেড়ে দিলেন। তারপর বললেন, সত্যি, আজকাল আমার কী যেন একটা গণ্ডগোল ঘটেছে। ডার্লিং! বরাবর নিজের ইনটুইশনের গর্ব করতুম। বর্মার জঙ্গলে গেরিলাযুদ্ধের তালিম নেওয়ার পর যষ্ঠেন্দ্রিয়জাত বোধ জেগে উঠেছিল। এতদিনে তা কি নিঃসাড় হয়ে আসছে? এই যে তুমি কখন এসে দাঁড়িয়ে আছ, টের পেয়েছিলুম, ঠিকই–তবে ভেবেছিলুম তুমি নও, ষষ্ঠী! আমার আশঙ্কা অরিজিৎ, এর পর পেছনে কোন আততায়ী এসে দাঁড়ালেও..

ডি সি ডি ডি তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, প্লিজ কর্নেল! এই সাতসকালে দৌড়ে এসেছি। পরে আপনার বিষাদকাহিনী তারিয়ে-তারিয়ে শুনব খন। হাতে সময় কম।

হু, রাতে রয় অ্যান্ড কোম্পানিতে হানা দিয়ে কিছুই মেলেনি তো?

 অরিজিৎ হাসলেন। হ্যাঁ। তবে সে কথা ফোনেই জানাতে পারতুম।

কর্নেল পাশের একটা অর্কিডের দিকে তাকিয়ে বললেন, আশা করি, তার, চেয়ে খারাপ কোনও খবর এনেছ?

ইয়া!

কর্নেল দ্রুত ঘুরে বললেন, কারও মৃত্যুসংবাদ কি?

অরিজিৎ গম্ভীর হয়ে বললেন ফের, ইয়া!

মাই গুডনেস! মিঃ গোমেশ জেভিয়ার…

হি হ্যাজ কমিটেড সুইসাইড। আত্মহত্যা করেছেন ভদ্রলোক। অন্তত আপাতদৃষ্টে তাই মনে হয়।

কর্নেল শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন কয়েক মুহূর্ত। তারপর একটু কেশে। বললেন, কোথায়?

সিমেট্রির ওধারে রেলইয়ার্ডে ভোর ছটায় রেলপুলিশ বডি পেয়েছে। রেললাইনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন ইঞ্জিনের সামনে!

ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন? ড্রাইভার দেখেছেন?

অরিজিৎ সিগারেট ধরিয়ে বললেন, তদন্ত সবে শুরু। তবে ওটা রেলপুলিশের ভার্সান। মর্গের রিপোর্ট না পেলে কোনও সিদ্ধান্ত করা অবশ্য উচিত নয়। কোনও সুইসাইডাল নোটও ঘরে গোমেশ রেখে যাননি।

 কর্নেল দুঃখিতভাবে তাঁর ছাদের বাগিচার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললেন, চলল! নিচে গিয়ে বসি। কফি ডার্লিং! কড়া কফি দরকার এ মুহূর্তে।

নিচের ড্রইংরুমে বসার সঙ্গে সঙ্গে ষষ্ঠীচরণ কফি রেখে গেল। নালবাজারের নাহিড়ীসায়েব বরাবর তার কাছে রহস্যময় ব্যক্তি, তার বাবামশাইয়ের চেয়েও। সে পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে ছিল। কর্নেল বললেন, পা দেখা যাচ্ছে হতভাগা! আড়ি পাততেও শিখলিনে এখনও? বোকা! বোকা!

ষষ্ঠীর পা দুটো দরজার পর্দার তলা থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল।

অরিজিতের তাড়া ছিল। সংক্ষেপে জানালেন, রয় অ্যান্ড কোম্পানির অফিস; গোডাউন, এমন কি মালিকের বাড়ি পর্যন্ত তন্ন-তন্ন খুঁজেও গ্রিয়ার্সনের কবরের দামী পাথরের ফলক মেলেনি। সমস্যা হলো, রয়সায়েব প্রভাবশালী লোক। রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে, দোস্তি আছে। অরিজিৎ একটু উদ্বিগ্ন।  

অরিজিৎ কফিতে শেষ চুমুক দিয়ে বললেন, আপনার কথায় তখন মনে হলো, গোমেশের মরার পথ তাকিয়ে ছিলেন। কারণটা বলতে আপত্তি আছে?

কর্নেল টাকে হাত বুলিয়ে বললেন, আজ ঘুম থেকে ওঠার পরই কেন যেন মনে হয়েছিল, গোমেশ বিপন্ন।

ওটা কোনও ব্যাখ্যা হলো না!

 ডার্লিং! আমাদের সব অনুভূতির কার্যকারণ ব্যাখ্যা করা যায় না।

 প্লিজ! মনস্তত্ত্ব নয়। তাড়া আছে। বেরুব। একটু কংক্রিট ব্যাখ্যা পেলে ভাল হয়।

নিজেই এখনও অন্ধকারে ঘুরছি অরিজিৎ! যা কিছু ঘটতে দেখছি, মেলাতে পারছি না একটার সঙ্গে আরেকটাকে।

অন্তত একটা ঝাড়ুন। নইলে মনে কাঁটা খচখচ করবে।

রয়সায়েবের এক ভাগ্নে ঘোষসায়েবকে নজরে রাখো। সে থাকে চন্দননগরের আউটকার্স্টে ইভনিং ভিলায়। ড্যানি ঘোষ। কিন্তু সাবধান! সে যেন টের না পায় তাকে নজরে রাখা হয়েছে।

অরিজিৎ নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে বললেন, হাই ওল্ড ডাভ! তাহলে গতকাল কি…ওকে! নো মোর টক। বাই।

বলে ক্রাইম ব্রাঞ্চের ডি সি ডি ডি ধাঁই করেই বেরিয়ে গেলেন।

কর্ণেল হাঁকলেন, যষ্ঠী! দরজা বন্ধ করে দে! আমি ওপরে যাচ্ছি।

শূন্যোদ্যানের সকালবেলার পরিচর্যা বাকি আছে। ক্যাকটাস-অর্কিডের ক্ষতে লোশন লাগাতে হবে। কর্নেল হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে সেই দূরের দেবদারুশীর্ষে শকুনের বাসাগুলির দিকে বাইনোকুলারের নল রাখলেন। ওই শকুনগুলো…কোনও মানে হয়? শহরটা কি ভাগাড় ভেবেছে ওরা? পুরসভা করছেটা কী? অত সুন্দর দেবদারুর মাথায় শকুন!

অ্যারিজোনার কচ্ছপ-ক্যাকটাসটার কাছে এসে হাঁটু মুড়ে বসলেন কর্নেল। মাথার ভেতর শূন্য লাগছে। গোমেশ জেভিয়ার মারা পড়লেন? আত্মহত্যা…, কাল রাতে হাওড়া স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে কর্নেলকে ডাকতে দেখেই উধাও হয়ে গেলেন। চন্দননগরে ইভনিং ভিলায় লুকিয়ে ছিলেন। কাল্লু তাকে লুকিয়ে রেখেছিল। সম্ভবত গোমশ আড়াল থেকে কর্নেলকে দেখে থাকবেন। তাই বিপদ আঁচ করেই কি আত্মহত্যা করে ফেললেন?

নাকি কেউ বা কারা তাঁর মুখ বন্ধ করতেই মেরে ফেলল?

গোমেশ একটু বোকা আর ভিতু লোক ছিলেন তো বটেই।..

.

দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার চিফ অব দা নিউজব্যুরো তারক গাঙ্গুলি টেবিলে ঝুঁকে খুব মনোযোগে দা গার্ডিয়ান পত্রিকা পড়ছিলেন। সামনে থেকে কেউ চাপা স্বরে বললেন, ব্রিটেন বরাবর বরের ঘরের মাসি, কনের ঘরের পিসি।

তারক গাঙ্গুলি মুখ না তুলেই বললেন, ধূর্ত! চিরকূর্ত! পাঞ্জাবের টেররিস্টদের দমন করবে বলছে, আবার তলায়-তলায় সাহায্যও করছে। বাজি রেখে বলতে পারি।

আসলে প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিস্টানদের দেশ। সব তাতে রক্ষণশীল। আইরিশ টেররিস্টদের ওপর রাগটা…….

রাইট, রাইট! আমরা মরছি ঘা খেয়ে তো তোরা ইন্ডিয়ানরাও ঘা খেয়ে মর! হ্যাঃ হাঃ হ্যাঃ!

অবশ্য থ্যাচার খুব জাঁদরেল মহিলা।

মহিলা বলেই তো বন্দী বিনিময় চুক্তি নিয়ে টালবাহানা করছে। আমাদের সম্পর্কে গাদাগাদা বিধিব্যবস্থা বরাদ্দ করে যাননি! রামায়ণ মহাভারত আঠারো পুরাণ সবখানে মহিলা নিয়ে গণ্ডগোল। ট্রয়ের যুদ্ধ!

এবং ইস্টার্ন সাবআর্বান সিমেট্রিতে খুন।

অ্যাঁ? বলে এতক্ষণে তারক গাঙ্গুলি কাগজ নামিয়ে মুখ তুললেন। তারপর প্রায় লাফিয়ে উঠে হাত বাড়ালেন করমর্দনে। হ্যাল্লো! হ্যাল্লো! হ্যাল্লো ওল্ড বস! কী আশ্চর্য কী অদ্ভুত!

কর্নেল তাকে চুরুট অফার করে বললেন, আমার চেয়ে আশ্চর্য-অদ্ভুত মানুষ পৃথিবীতে বিস্তর আছেন মিঃ গাঙ্গুলি!

তারক গাঙ্গুলি হেসে কুটি কুটি হয়ে বললেন, আছে, আছে! আমি কারণ এতক্ষণ দিব্যি কথা চালিয়ে যাচ্ছি, অথচ মুখ তুলে দেখছি না হুম আই অ্যাম টকিং টু! সাংবাদিক মহালের প্রবাদ, তেত্রিশটে বেড়াল মরে একটা সাংবাদিক জন্মায়। আমি হোপলেস! সেজন্যই কোম্পানি আমাকে এখানে নিষ্কর্মা করে বসিয়ে রেখেছে। নামেই চিফ অব দা নিউজব্যুরো। কাজের মধ্যে শুধু কাগজ পড়া। বরং ওই সুব্রতর মতো পদ্য লিখতে পারলেও……ওই দেখুন! ও কি খবর লিখছে ভাবছেন? পদ্য লিখছে?

তারক গাঙ্গুলি আঙুল তুলে অদূরে এক যুবককে দেখালেন। মুখে দাড়ি। পরনে সাদাসিধে প্যান্ট-শার্ট। কিন্তু শিল্পীসুলভ চেহারা। ঈষৎ লাজুক হাবভাব। কর্নেলের দিকে সে তাকিয়ে ছিল। তারক গাঙ্গুলিকে বলল, কিছু বলছেন তারকদা?

বলছি। তুমি নিশ্চয় পদ্য লিখছ? তারক গাঙ্গুলি সহাস্যে বললেন। এঁকে চেনো কি? নতুন এসেছ। চিনবে না। জয়ন্তের ফ্রেন্ড-ফিলসফার-গাইড কর্নেল নীলাদ্রি সরকার।

সুব্রত মুখ নামিয়ে কাজে মন দিল! তারক গাঙ্গুলি বললেন, তুমি ওয়ার্থলেস! যোগ্য সাংবাদিক হতে হলে প্রথম গুণ অবজার্ভেশন–পর্যবেক্ষণ! কাম হিয়্যার মাই বয়! কাম, কাম! আলাপ করিয়ে দিই। আ ম্যান অব হাই কানেকশনস। আখেরে লাভ হবে।

 সুব্রত মুখ তুলে একটু হাসল। কিন্তু উঠল না। তারক গাঙ্গুলি চটে গিয়ে চাপা স্বরে বললেন, আমাকে আর কেউ গ্রাহ্য করে না কর্নেল! এক্সটেনসনে আছি তো! যত্তোসব আজকালকার কিম্ভুত ছেলেছোকরা ঢোকাচ্ছে কোম্পানি! খবরে সাহিত্য ফলায়। খবর হবে অবজেক্টিভ। তা নয়, খালি মেয়েলি ভাষায় কাব্যি।

কর্নেল উঠে গেলেন সুব্রতর কাছে। সুব্রত তাকাল। কর্নেলের মনে হলো, চাউনিটা মাছের। আজকাল ছেলেছোকরাদের হাবভাব এরকমই। আর সব রিপোর্টাররা হইহই করে উঠল। হ্যাল্লো ওল্ড বস! একটা স্কুপ ঝাড়ুন প্লিজ! আজ একেবারে খবরে ভাটা।

কর্নেল সবাইকে হাত তুলে সম্বাধনের ভঙ্গি করে সুব্রতর সামনে বসলেন। চেয়ারটা খালি ছিল। সুব্রত আস্তে বলল, বলুন কর্নেল সরকার!

কর্নেল একটু হাসলেন। সত্যসেবক পত্রিকায় নতুন জয়েন করেছেন বুঝি?

হ্যাঁ। আপনার কিছু খবরটবর ছাপার থাকলে প্লিজ চিফ রিপোর্টারকে দিন। আমার কিছু সরাসরি করার ক্ষমতা নেই।

খবর আছে। তবে সেটা আপনার জন্য।

 সুব্রত চমকে উঠল। আমার জন্য? কী খবর?

আমি একটা ম্যাগাজিন বের করছি। শুনলুম, আপনি কবিতা লেখেন…

সুব্রত একটু বিরক্ত হয়ে বলল, গাঙ্গুলিদা আমাকে নিয়ে ঠাট্টা করেন। আমি কবিতা লিখি না।

গল্প লেখেন?

চেষ্টা করি।

বেশ একটা গল্পই দিন না প্লিজ! যৎকিঞ্চিৎ সম্মান দক্ষিণা আমি দেব, যদি কিছু মনে না করেন। শুধু একটা অনুরোধ….

বলুন!

প্রেমের গল্প হলে ভাল হয়। একটু ট্রাজিক ধরনের…..বোঝেন তো, বাঙালি পাঠক বড্ড রোমান্টিক। একটু সঁতসেঁতে প্রেম ট্রেম চায় আর কী! কর্নেল হাসতে লাগলেন। আর একটা ব্যাপার থাকলে ভাল হয়। সেক্স নয়, অন্তত, খানিকটা ভায়োলেন্স, রহস্য-টহস্য…..ধরুন, পরিবেশকে রোমাঞ্চকর করার জন্য কবরখানায় নায়ক-নায়িকা….

সুব্রত চুপচাপ শুনছিল। এবার শ্বাস-প্রশ্বাসের মধ্যে রুষ্টস্বরে বলল, ফরমায়েসি গল্প আমি লিখি না।

না, না! জাস্ট পত্রিকার ক্যারেক্টার অনুসারে বলছি।

ওইসব ট্র্যাশ পত্রিকায় আমি লিখি না! আমি লিখি নিজের অভিজ্ঞতা থেকে। সুব্রত চাপা স্বরে বলল, আমি যা লিখব, তা ছাপতে পারেন আসবেন, নয় তো আসবেন না!

কর্নেল বললেন, ঠিক আছে, তবে তাই। বাই দা বাই, স্পেশাল রিপোর্টার জয়ন্ত চৌধুরির সঙ্গে আপনার আলাপ হয়েছে?

 না। আমি যেচে কারুর সঙ্গে আলাপ করি না। তা ছাড়া আমি জয়েন করেছি সদ্য দিন দশেক আগে। উনি এখন পাঞ্জাবে আছেন লং অ্যাসাইমেন্টে।

কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। বাও করে পা বাড়িয়েছেন, সুব্রত ডাকল, শুনুন!

 কর্নেল ঘুরে বললেন, বলুন!

সুব্রতকে এবার একটু নরম দেখাচ্ছিল বলল, একটা কথা। কিছু অ্যাডভান্স করলে ভাল হতো। আমার টাকার দরকার।

কর্নেল দ্রুত পকেট থেকে পার্স বের করে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট গুঁজে দিলেন ওর হাতে। সুব্রতও দ্রুত তা পকেটস্থ করল। তারপর কর্নেল লম্বা নিউজ রুমের শেষ প্রান্তে এসেছেন, পেছনে হল্লা শুনে ঘুরলেন। রিপোর্টাররা সুব্রতকে ঘিরে ধরেছে। কিছু বোঝা যাচ্ছে না।

শুধু একটা জিনিস চোখে পড়ার মতো। সুব্রত তার দিকে তাকিয়ে আছে। মুখটা এবার অসম্ভব সাদা–পাণ্ডুর। কর্নেল হনহন করে বেরিয়ে গিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নামতে থাকলেন। লিফটের দিকে গেলেন না।

একেবারে অপ্রত্যাশিত আবিষ্কার নয়। দৈবাৎ প্রাপ্তি নয়। নিউজপ্রিন্ট, সাহিত্য ও সাংবাদিকতার যোগসূত্র, মুনলাইট বারের কাছে দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার অফিস, এই কয়েকটি পয়েন্ট ধরে তাহলে ঠিক লক্ষ্যে পৌঁছেছিলেন। কর্নেল একটু গম্ভীর হয়ে হাঁটছিলেন। সন্ধ্যা ছটা বাজে। রাস্তা জ্যাম। খানাখন্দের ওপর আলো পড়ে মনে হচ্ছে, কলকাতা সত্যি মুমূর্ষ এবং ক্ষতবিক্ষত। অথচ এত জেল্লা চারদিকে ওপরে ওপরে।

হুঁ, সুব্রতর পায়ে নতুন চপ্পল, তাও তার দৃষ্টি এড়ায়নি। কিন্তু সুব্রত…

হঠাৎ ঝিরঝিরিয়ে বৃষ্টি এসে গেল। কর্নেল মুনলাইট বারে ঢুকলেন। বারের মালিকই ম্যানেজার। নাম যশোবন্ত সিনহা। কর্নেলকে দেখেই হাত তুললেন। গুড ইভনিং স্যার! আফটার হাউ লং ডেজ……আইয়ে, আইয়ে!

কর্নেল কাউন্টারের সামনে গেলেন। বৃষ্টির জন্যই বোধ করি ছোট্ট বারে ভিড় বেড়ে গেল দেখতে দেখতে। পাশের ছোট্ট ডায়াসে এক পপ সিঙ্গার প্রাচ্য-প্রতীচ্য খিচুড়ি পরিবেশন করছে। জগঝম্পে কানে তালা ধরে যায়। সিনহা কর্নেলকে কাউন্টারের ভেতরে একটা চেয়ারে বসতে দিলেন। ইংরেজিতে বললেন, আপনি তো বিয়ার ছাড়া কিছু ছোঁবেন না। এক মিনিট। সিঙ্গাপুর থেকে একডজন বিয়ারক্যান পাওয়া গেছে। আপনাকে দিয়েই উদ্বোধন হোক।

 বিয়্যারক্যানে চুমুক দিয়ে কর্নেল বললেন, মেয়েদের দিয়ে গান করালে যথার্থ বারের আবহাওয়া গড়ে ওঠে মিঃ সিনহা! পুরুষেরা বড্ড রাফ!

সিনহা হাসতে হাসতে বললেন, ঠিক! কিন্তু আমার বরাত মন্দ। একটা সুন্দর মেয়ে যোগাড় করলুম। তো তার চরিত্র ভাল নয়। খুন হয়ে গেল। কাগজে পড়েননি? পুলিশের হাঙ্গামা সামলাতে জেরবার।

বলেন কী!।

সিনহা আগাগোড়া তার যেটুকু জানা, সব বর্ণনা করে চোখ নাচিয়ে বললেন, পাড়ার মস্তানদের নিয়ে খেলত। তাদেরই কেউ খতম করেছে। বোকা মেয়ে! আপনি স্যার এই কেসটা……

আচ্ছা মিঃ সিনহা! এই বারে তো দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার সাংবাদিকরা অনেকে আসেন?

হা, হা! ওঁদের অনেকে আমার নিয়মিত খদ্দের। সিনহা চাপা স্বরে বললেন, টিনির মার্ডার কেস হাতে নিয়েছেন বুঝি?

কর্নেল জোরে মাথা নেড়ে বললেন, আমি ওসব লাইন কবে ছেড়েছি, মিঃ সিনহা! এখন স্রেফ নেচারিস্ট। এই যে দেখছেন, সব সময় বাইনোকুলার ক্যামেরা নিয়ে ঘুরছি। পাখি টাখি দেখি। ছবি তুলি।

জানি, জানি। সিনহা সকৌতুকে বললেন। আপনার বাইনোকুলারে কত কিছু দেখেন। তো আমি বলি কী, এই কেসটাও দেখুন। মেয়েটার জন্য আমার কষ্ট হয়, কর্নেল!

কর্নেল মাথা নেড়ে বললেন, বয়স হয়েছে। আর ছোটাছুটি করতে পারি না?

বলে কর্নেল বারের ভিতরটা দেখতে থাকলেন। বাইরে বৃষ্টির জন্য তাগড়াই চেহারার প্রহরী দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল। এই সময় দরজা খুলে কাউকে সসম্মানে অভ্যর্থনা করল। কর্নেল ঠাণ্ডা চোখে তাকিয়ে মুখ নামালেন। চন্দননগরের সেই ড্যানি ঘোষ ঢুকছে। সঙ্গে দুজন লোক।

প্রহরী দুই মাতালকে ঠেলে বের করে দিল বৃষ্টির মধ্যে। তারা নাচতে শুরু করেছিল। আসলে ড্যানি ঘোষকে আসন করে দিল সে। বাকি দুই মাতাল ভয়ে ভয়ে কেটে পড়ল আসন ছেড়ে। ড্যানি ঘোষের চোখে চোখ পড়ল কর্নেলের। সে ক্রুর চোখে তাকিয়ে আছে।

কর্নেল বললেন, আপনার প্রহরীটি বেশ। বারেরও একটা নীতি-বোধ নিয়মকানুন থাকা উচিত। সে তা বজায় রাখে।

সিনহা বললেন, যোসেফ? ওঃ খুব হুঁশিয়ার এসব ব্যাপারে।

 ওর নাম যোসেফ নাকি?

হ্যাঁ। একসময় ফ্রি স্কুল স্ট্রিট এলাকার সব মস্তান ওর পায়ের তলায় থাকত। ওকে পুলিশ সোর্স থেকে বলে কয়ে নিয়ে এসেছিলুম। ও ছিল পুলিশের ইনফরমার। কাজেই ওর-ও নিজের নিরাপত্তার প্রশ্ন ছিল।

যোশেফকে ড্যানি কিছু ইশারা করছে কর্নেলকে দেখিয়ে। যোসেফ হেসে কী বোঝাচ্ছে। কর্নেল আস্তে বললেন, ওই ভদ্রলোককে চেনেন? যোসেফ যার সঙ্গে কথা বলছে।

কে চেনে না ড্যানি ঘোষকে? ওর মামা নিলামের কারবারী। রয় অ্যান্ড কোং আছে ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে। সব এক ঘাটের মড়া। ড্যানি অবশ্য চন্দননগরে মেমসায়েব বউয়ের কাছে থাকে।

এবার ঢুকল সুব্রত। ঢুকেই টেবিল খালি পেল না। এদিক-ওদিক তাকিয়ে হঠাৎ কর্নেলের চোখে পড়তেই বেরিয়ে গেল।

কর্নেল বললেন, ওই যুবকটিকে চেনেন?

খুব চিনি। সুব্রত চৌধুরি। আমিই সত্যসেবকের মালিককে ধরে ওকে চাকরি পাইয়ে দিয়েছি।

বাঃ! ভাল কাজ করেছেন!

সিনহা মিটিমিটি হাসলেন। ছেলেটা ভালই। প্রথম প্রথম বন্ধুদের সঙ্গে আসত। তাদের পয়সায় খেত। আলাপ হয়ে গেল। একদিন দেখি টিনিকে সঙ্গে নিয়ে হাজির। বলে, মেয়েটি ভাল গায়। নাচতেও পারে। যদি ওকে চান্স দিই…..

বুঝতে পেরেছি। বলে কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। চলি মিঃ সিনহা। আবার দেখা হবে।

কর্নেল দরজার বাইরে গিয়ে দেখলেন, বৃষ্টিটা কমেছে।….

.

ইস্টার্ন সাব-আরবান সিমেট্রির পুবে রেল ইয়ার্ড, দক্ষিণে একটা বস্তি। এলাকা। বস্তিটা ক্রমশ তার সত্তা হারাচ্ছে, এটা শুভ লক্ষণ নাকি অশুভ, কর্নেল ভাবছিলেন। ইতস্তত তিন থেকে পাঁচ তলা বাড়ি উঠেছে বস্তি খুঁড়ে। কবি কিপলিঙের পভার্টি অ্যান্ড প্রাইড/সাইড বাই সাইড এখানে মর্মান্তিক সত্য। নতুন উঁচু বাড়িগুলোতে নিশ্চয় বস্তির লোকেরা থাকে না। তার মানে, তাদের রাতারাতি আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়নি। তাদের উচ্ছেদ করেই বস্তি মালিকেরা ফ্ল্যাটবাড়ি বানিয়েছেন। তারা হয়তো ফুটপাতে কি অন্যত্র আবার আশ্রয় নিয়েছে। ঝোঁপড়ি বেঁধেছে। দশ-বিশ বছর পরে কোন বড়কর্তার খেয়াল হবে, তখন পুলিশ গিয়ে ঝোঁপড়ি ভাঙবে। তারা আবার ছড়িয়ে পড়বে মহানগরের অন্যত্র। সভ্যতার দেহে মারীবীজাণুর মতো জন্ম নেবে ঝাঁকে ঝাঁকে রাস্তার ছেলেমেয়েরা। মহানগরের রক্ত দূষিত করবে। সভ্যতাকে পচিয়ে দেবে তীক্ষ্ণ আণবিক দাঁতের কামড়ে।

দিক। কর্নেল রিকশো থেকে নেমে মনে মনে বললেন, একচোখা সভ্যতার পতন ঘটুক। কার্ল মার্ক্সের বর্ণিত সত্যিকার সর্বহারারা মারীজীবাণু হয়ে উঠুক। তবেই নতুন সভ্যতার জন্ম হবে। আসলে এখনও মানুষ বর্বরতার যুগ অতিক্রম করতে পারেনি।

সাব! ভাড়া…

 কর্নেল বললেন, সরি! এই নাও ভাই!

রিকশোওয়ালা ভাড়া নিয়ে ঘণ্টি বাজাতে বাজাতে চলে গেল। বস্তির ভেতরটা কেমন থমথম করছে। বাতিগুলি নিষ্প্রভ। ইতস্তত কিছু জটলা। শ্রমজীবীরা আড্ডা দিচ্ছে। তাস খেলছে। একটা পানের দোকানে জিজ্ঞেস করলে টিনির মা সুরঞ্জনা দেবীর বাড়ি দেখিয়ে দিল।

একটুকরো পোড়ো জমি এবং খোলা ড্রেন পেরিয়ে একতলা জরাজীর্ণ বাড়ি। ভেতরে আলো দেখা যাচ্ছিল খোলা জানালা দিয়ে। কর্নেল দেখলেন, কলিং বেল আছে। টিনির আশা-আকাঙ্ক্ষার একটা সামান্য চিহ্ন। টিপলে পিয়ানোর শব্দ হলো। বুকের ভেতর ঝংকৃত হলো ধ্বনি। যেন টিনির আত্মা সাড়া দিল।

কে রে? মহিলাকণ্ঠে ভেতর থেকে সাড়া এল।

 কর্নেল বললেন, আমি একটু দেখা করতে চাই আপনার সঙ্গে।

কে আপনি? বলে এক প্রৌঢ়া দরজা খুললেন। ফ্যাকাসে গায়ের রঙ, বোগা, বিধ্বস্ত চেহারা। কর্নেলকে দেখে এক পা পিছিয়ে বললেন, আপনি কোত্থেকে আসছেন স্যার?

 কর্নেল হাসলেন। আমাকে স্যার বলবেন না। আমার নাম কর্নেল নীলাদ্রি সরকার।

সুরঞ্জনা দেবী একটু ইতস্তত করে বললেন, কী ব্যাপার…..পুলিশকে তো……

আমার নামটা আপনার জানা মনে হচ্ছে সুরঞ্জনা দেবী? কর্নেল শুকনো হাসলেন।

 সুরঞ্জনাকে নার্ভাস দেখাচ্ছিল। সে কথার জবাব না দিয়ে বললেন, কর্নেলসায়েব। আমি মেয়ে। বয়স হয়েছে। তাতে বুকে এই পাথরচাপা শোক। পুলিশকে যা বলার সব বলেছি। আর নতুন কথা তো নেই।

 কর্নেল একটু গম্ভীর হয়ে বললেন, আমার সঙ্গে কথা বলতে কেউ নিষেধ করেছে, বুঝতে পারছি।

সুরঞ্জনা কাঁপা কাঁপা গলায় ফিসফিস করে বললেন, আপনি চলে যান কর্নেলসায়েব! আপনার সঙ্গে কথা বললে আমার আরও বিপদ হবে। এর বেশি কিছু বলতে পারব না! পুলিশ কত দিন আমার বাড়ি পাহারা দেবে?

যে শাসিয়ে গেছে, সেই বলেছে বুঝি?

 দরজা মুখের ওপর বন্ধ হয়ে গেল। কর্নেল মুহূর্তে শক্ত হয়ে গেলেন। জ্যাকেটের পকেটে হাত ভরে দ্রুত রিভলবারটি বের করে প্যান্টের পকেটে ঢোকালেন এবং সেই পকেটে হাত ঢুকিয়ে এদিক-ওদিক তীক্ষ্ণদৃষ্টে তাকালেন।

একটা ঝুঁকি নিয়ে ফেলেছেন। ঝোঁকের মাথায় রাত আটটায় এখানে আসা ঠিক হয়নি। আলো-আঁধারি পরিবেশ। আততায়ীর পক্ষে দারুণ সুযোগ।

দ্রুত পোড়ো জমিটা পেরিয়ে সংকীর্ণ রাস্তায় পৌঁছুলেন। আলোকিত অংশে এসে সাহস ফিরে পেলেন।

 ইনটুইশন? হয়েতো তাই। কেন হঠাৎ তখন মনে হলো তিনি বিপন্ন? বড় রাস্তায় পৌঁছে হনহন করে হাঁটতে থাকলেন। কোনও ট্যাক্সি নেই। ডাইনে দূরে সেই কবরখানার গেটের সামনে আলো জ্বলছে। এক দঙ্গল পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে দেখতে পেলেন কর্নেল।

 একটু অন্যমনস্ক হলেন। কেউ আজই শাসিয়ে গেছে টিনির মাকে। কে সে? সুব্রত? কোনও কথা জিজ্ঞেস করার সুযোগই পেলেন না। হ্যাঁ, সুব্রতর কথাই জানতে গিয়েছিলেন। কিন্তু সুব্রত…।

পেছনে গরগর শব্দ। ঘুরেই দেখলেন, হেড লাইটহীন একটা গাড়ি তার মাত্র কয়েক গজ দূরে। এক লাফে উঁচু ফুটপাতে উঠলেন। জনহীন খাঁ খাঁ রাস্তা। প্রাইভেট গাড়িটা প্রচণ্ড জোরে এগিয়ে গিয়ে ব্রেক কষল। সঙ্গে সঙ্গে কর্নেল পকেট থেকে রিভলবার বের করে তৈরি হলেন। গাড়ির দরজা খুলে দুটি লোক বেরুল। চোখে কালো চশমা।

বাঁ দিকে একটা হাউসিং কলোনি। কর্নেল বাঁ দিকে ফুটপাতে। হঠাৎ মনে হলো, অকারণ একটা খুনোখুনি ঘটিয়ে লাভ নেই। হাউসিং কলোনির গেট দিয়ে ঢুকে পড়লেন। ছোট পার্কে কয়েকটি যুবক উজ্জ্বল আলো জ্বেলে ভলিবল খেলছে। কর্নেল খেলা দেখার ছলে একটু দাঁড়িয়ে লক্ষ্য রাখলেন। লোক দুটো তাকে ফলো করে আসেনি। কিন্তু ও পথে যাওয়া আর নিরাপদ নয়।

হাউসিং কলোনির উল্টোদিকে একটা বস্তি। এই বস্তিটা সচ্ছল অবাঙালি মুসলিমদের। বস্তিতে রিকশো পাওয়া গেল। বললেন, পার্ক সার্কাস! জলদি…..

.

সিঁড়িতে দেখা হয়ে গেল অরিজিৎ লাহিড়ীর সঙ্গে। সবে নেমে আসছিলেন। কর্নেলকে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে ভুরু কুঁচকে বললেন, আধ ঘণ্টা অপেক্ষা করে চলে যাচ্ছিলুম। বাট হাউ ফানি! আপনাকে ঝোড়ো কাক দেখাচ্ছে কেন?

কর্নেল হাসবার চেষ্টা করলেন। চলো, বলছি! আমায় সত্যিই বাহাত্তুরে। ধরেছে ডার্লিং!

ষষ্ঠী দরজা খুলে দিলে বললেন, কফি! কড়া কফি! তারপর ধপাস করে। বসে রুমালে মুখ মুছলেন।

অরিজিৎ বসে বললেন, ঝডটা কিসের?

এক মিনিট। ড্যাম টায়ার্ড। আগে কফি, পরে কথা। বলে হঠাৎ অট্টহাসি হাসলেন, বোকা। আমি এক নম্বর বার্ধক্য এবার সত্যিই……ওঃ! ভাবা যায় না!

ষষ্ঠী এই হাসি শুনলেই পর্দার ফাঁকে উঁকি মারে। চোখে চোখ পড়লে কর্নেল চোখ কটমট করে বললেন, কফি!

ষষ্ঠী অদৃশ্য হলো।

অরিজিৎ কপট গাম্ভীর্যে বললেন, কফির আগেই এই পৈশাচিক হাসি। বড় গোলমেলে ব্যাপার।

কর্নেল দাড়ি খামচে ধরে বললেন, ওই কবরখানার পিশাচের সংস্পর্শে গিয়ে পড়েছিলুম, ডার্লিং! যাই হোক, আমারটা কফি খেয়ে হবে। তোমারটা শোনা যাক।

গোমেশ জেভিয়ার…..

স্যুইসাইড করেননি।

অরিজিৎ কপট রোষে বললেন, তা হলে আমার হয়ে আপনিই বলুন, আমি শুনি।

সরি ডার্লিং! আর স্পিকটি নট। মুখ বন্ধ করলুম।।

গোমেশকে মাথার পেছনে শক্ত কিছু দিয়ে আঘাত করা হয়। তারপর বডি তুলে নিয়ে রেলইয়ার্ডে ফেলে রাখা হয় লাইনের ওপর। বৃষ্টি হচ্ছিল। ড্রাইভার কিছু দেখতে পাননি। তবে এসব ক্ষেত্রে যা হয়! তার অনুমান-জাস্ট উইশফুল থিংকিং বলা যায় যে, গোমেশ ইঞ্জিনের সামনে ঝাঁপ দিয়েছিলেন। অর্থাৎ পরে তার এমনটি মনে হয়েছিল মাত্র।

কর্নেল কী প্রশ্ন করতে ঠোঁট ফাঁক করেছিলেন। কিন্তু প্রশ্নটা করলেন না।

অরিজিৎ বললেন, বৃষ্টি এবারও রক্ত ধুয়ে ফেলেছে। কবরখানা তন্নতন্ন খুঁজে রক্তের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। ওঁর ঘর, গির্জার ভেতরটা–কোথাও না।

ষষ্ঠী কফি আনল। চুপচাপ কফি খেতে থাকলেন, কর্নেল। অরিজিৎ দুবার খেয়েছেন। অতএব আর খাবেন না।

কফি শেষ করে কর্নেল চুরুট জ্বেলে ধোঁয়ার মধ্যে বললেন, আঃ!

এবার তাহলে আপনার কথা।

কর্নেল দৈনিক সত্যসেবক-সুব্রত উপাখ্যান এবং মুনলাইট অংশ বাদ দিয়ে শুধু টিনিদের বস্তিতে যাওয়ার ঘটনাটির সরস বৃত্তান্ত দিলেন। সঙ্গে প্রচুর অট্টহাসি।

অরিজিৎ মন দিয়ে শুনছিলেন। সবটা শোনার পর খুব গম্ভীর হয়ে বললেন, আপনি ঝুঁকি নিয়েছিলেন ঠিকই। তবে আমরা আর সহ্য করব না। ড্যানি ঘোষকে, তার মামা রায়সায়েবকে আর ওই ধূর্ত যুধিষ্ঠিরকে দুরমুশ করব। নো, নো! আর আপনার কথা শুনবই না।

দুরমুশ করে লাভটা কী হবে, অরিজিৎ? কোর্টে প্রমাণ করতে পারবে ওরা টিনি এবং গোমেশের হত্যাকারী অথবা হত্যার জন্য দায়ী? কী প্রমাণ তোমার হাতে আছে?

ডি সি ডি ডি ক্রুদ্ধস্বরে বললেন, আপনার ওপর হামলা করার স্পর্ধা গুঁড়িয়ে দেব।

ডার্লিং! নিজেকে রক্ষার ক্ষমতা আমার আছে। একটু ধৈর্য ধরো। কর্নেল নিভন্ত চুরুট ফের ধরিয়ে বললেন, যুধিষ্ঠিরের ওপর অকারণ চাপ দিলে কিছু হবে না।

সে গভীর জলের মাছ!

তেমন কোনও কথা কি বের করতে পেরেছ তার কাছ থেকে?

আজ এক দফা জেরার মুখে সে বলে ফেলেছে, গোমেশ টিনি হত্যার একদিন আগে টিনিদের বাড়ি গিয়েছিলেন।

ইজ ইট? কর্নেল সোজা হয়ে বসলেন।

যুধিষ্ঠির বলেছে, সে গোমেশ কে জানে না। তখনও জানত না। তবে একজন অ্যাংলোসায়েবকে সে যেতে দেখেছিল। টিনিকে তার সঙ্গে বেরিয়ে যেতেও দেখেছিল। অরিজিৎ শ্বাস ফেলে বললেন, অ্যাংলোসায়েবের চেহারার যে বর্ণনা দিয়েছে সে, তা গোমেশের সঙ্গে মিলে যায়।

কর্নেল একটু চুপ করে থাকার পর বললেন, অরিজিৎ! যথেষ্ট দেরি হয়ে গেলেও এবার বলব, টিনিদের বাড়ি তন্নতন্ন করে সার্চ করা দরকার বিশেষ। করে টিনির যা কিছু আছে, সেইগুলো। আসলে….

কর্নেলকে থামতে দেখে ডি সি ডি ডি ভুরু কুঁচকে বললেন, শ্যুট!

কর্নেল জোরে শ্বাস ছেড়ে বললেন, জীবনে এই প্রথম একটি কেসে আমি উল্টোমুখে হেঁটে যাচ্ছিলুম। ডার্লিং! তোমাকে তো বরাবর বলে এসেছি, খুনীকে ধরতে হলে তার ছায়ার পেছনে দৌড়ো না, যে খুন হয়েছে তাকেই খুঁজে দেখ। খুনীকে তার মধ্যেই পেয়ে যাবে। সব হত্যাকারী লুকিয়ে থাকে তার ভিকটিমের মধ্যে। এবার আমি……বয়স অরিজিৎ, বয়স! আমাকে বাহাতুরে ধরেছে!

অরিজিৎ একটু হাসলেন। টিনিদের বাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজতে হবে? ওকে। কী সূত্র আশা করছেন আপনি?

কিছু না। তবে যেখানে দেখিবে ছাই/উড়াইয়া দেখ তাই/পাইলে পাইতে পার অমূল্য রতন! বলে কর্নেল আবার এক অট্টহাসি ছাড়লেন।

ওঃ! আপনি বড্ড বেশি পৈশাচিক হাসি হাসছেন আজ! অরিজিৎ মন্তব্য করলেন।

কর্নেল হাসি থামিয়ে চোখ বুজে অভ্যাসমতো দুলতে শুরু করেছেন।

অরিজিৎ উঠে বললেন, চলি। আমিও বড্ড টায়ার্ড!

ডার্লিং, সুব্রত…..

অরিজিৎ চমকে উঠলেন। সুব্রত? হু জি দ্যাট ফেলো?

 সুব্রত চৌধুরি। দৈনিক সত্যসেবকের সাংবাদিক এবং গল্প লিখিয়ে।

 বিরক্ত ডি সি ডি ডি বললেন, হেঁয়ালির স্বভাব আপনার গেল না!

অরিজিৎ! সুব্রত হয়তো বিপন্ন। তার পুলিশ প্রোটেকশন দরকার। কর্নেল চোখ খুলে সোজা হয়ে বসলেন। সেজন্যই এখনই তাকে গ্রেফতার করে হাজতে রাখার ব্যবস্থা করো। সেটাই হবে তার প্রকৃত প্রোটেকশন। না, তার ওপর জুলুম কোরো না। তাকে হাজতে সাচ্ছন্দ্যে রাখবে। গল্প লেখার সুযোগ দেবে। খাওয়া-দাওয়া যেন কয়েদিদের মতো না হয়। সুব্রত এই কেসে খুব গুরুত্বপূর্ণ ঘুটি। এক মিনিট, সে এখন কাগজের অফিসে আছে কি না জেনে নিই।

বলে কর্নেল ফোন তুলে ডায়াল করলেন। তারক গাঙ্গুলিকে চাইলেন।

তারক গাঙ্গুলি নটায় চলে গেছেন। চিফ রিপোর্টার অমল গুপ্ত লাইনের ও প্রান্তে। কর্নেল বললেন, সুব্রত চৌধুরি। আপনাদের নতুন রিপোর্টার……। নেই?….। অসুস্থতা….ওকে! ওর বাড়ির ঠিকানাটা…হ্যাঁ, ধরে আছি।

ডান হাতে টেবিল থেকে প্যাড-কলম টেনে বললেন, ১২/২ গোবিন্দ মিস্ত্রি লেন, কলকাতা ১৭…..। ওকে! পার্ক সার্কাস…..ও! বেকবাগান এরিয়া? থ্যাংকস্ ডার্লিং! না, না! আমি সত্যিই একটা পত্রিকা করছি। অপরাধ তদন্ত বিষয়ক পত্রিকা। তার ভেতর দুটো গল্প, খান চারেক পদ্য না ঢোকালে পাবলিক খাবে না! হাঃ হাঃ হাঃ!।

ফোন রেখে কর্নেল অরিজিতের দিকে তাকালেন। কুইক! ঠিকানা লিখে নাও। সুব্রত বিপন্ন। আর একটা কথা, সুব্রতের হাতের লেখার নমুনা আমি দেখেছি। তবু টিনির পার্সের ভেতর পাওয়া লেখাটির সঙ্গে ভালভাবে মিলিয়ে দেখা দরকার। আর তার আঙুলের ছাপের সঙ্গে ওই লেখাটির কাগজে পাওয়া ছাপ…..

এনাফ! বলে ডি সি ডি ডি কর্নেলের টেলিফোনের দিকে হাত বাড়ালেন।…

.

০৪.

মার্চে রূপগঞ্জ থেকে আনা রেনবব্যা অর্কিডের দিকে তাকিয়ে ছিলেন কর্নেল। এপ্রিলে চমঙ্কার রামধনুরঙা ফুল ফুটিয়েছিল। এখন বেমরশুমে ঝিমোচ্ছ। তবে বর্ষার পর এখন জাঁকালো চেহারা। যেন ধাড়ি মুরগি ডিমে তা দিচ্ছে। ডিম ফুটে বাচ্চা বেরুতে সেই বসন্তকাল।

কিন্তু প্রকৃতির কেন এত সব আয়োজন? একদিকে সৌন্দর্য, অন্যদিকে নিষ্ঠুর হত্যা। সুন্দর অসুন্দরকে নিয়ে ডানহাত বামহাতে লোফালুফি। অদ্ভুত বৈপরীত্যের ছন্দের বাঁধা এই বিশ্বের সব কিছু। ডান হাতে দান, বাম হাতে কেড়ে নেওয়া– রবীন্দ্রনাথ চরম প্রশ্নটি ভুলে গেছেন, কিন্তু কেন?

সব চেয়ে অদ্ভুত লাগে, প্রকৃতি নির্বিকার। তার কাছে রক্ত এবং অশ্রুর কোনও পৃথক মূল্য নেই। প্রাচীন ভারতীয় হিন্দু দার্শনিকরা যথার্থ সত্যটিকে জেনেছিলেন। যিনি অন্নপূর্ণা, জীব পালন করেন স্নেহে, তিনিই কালী, ধ্বংস করে ফেলেন সব কিছু, সঙ্গে হিংস্র সহচরীরা। পায়ের তলায় জড়বৎ শিব। আবার সেই দার্শনিকরাই অন্যদিক থেকে সত্যকে জেনে ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর– স্রষ্টা পালক সংহারকর্তা এই তিন প্রতীক এঁকে রেখে গেছেন।

নিরীশ্বরবাদী মার্ক্স এঙ্গেলসও প্রকৃতিতে একই দ্বন্দ্ব দেখেছিলেন। থিসিস, অ্যান্টিথিসিস, সিন্থেসিস-তত্ত্বকে বাজিয়ে দেখলে একই ব্যাপার! জড়ে যেমন দ্বন্দ্বের ধারা, চৈতন্যেও তাই। দ্বন্দ্ব আছে। দ্বন্দ্বহীন অবস্থা অকল্পনীয়। প্রকৃতি দ্বন্দ্বাকীর্ণ।

বাবামশাই!

কর্নেল ক্রুদ্ধ হয়ে ঘুরেই হেসে ফেললেন। মূর্তিমান রসভঙ্গ ষষ্ঠীচরণ!

আজ্ঞে, আর কেউ হলে ডিসটাব করি? নালবাজারের নাহিড়িসায়েবের ফোং!

অগত্যা নিচে ড্রয়িং রুমে যেতে হলো কর্নেলকে। মোটে সাতটা বাজে। আকাশ আজও নির্মেঘ। দেবদারুশীর্ষে শকুনগুলি দেখার ইচ্ছে ছিল। হঠাৎ তত্ত্বচিন্তার উপদ্রব।

বলো, ডার্লিং! সুব্রত…

রাতারাতি উধাও। বাড়িতে বলে গেছে, পত্রিকার অ্যাসাইনমেন্টে বাইরে যাচ্ছে-দার্জিলিঙ গোখা মুভমেন্ট কভারজে। কিন্তু….

পত্রিকার কর্তৃপক্ষ বলেছেন, তাকে কোথাও পাঠানো হয়নি!

কী আশ্চর্য! জানেনই যদি, তাহলে কেন…..।

ওকে ডার্লিং! মুখ বন্ধ করলুম। গো অন, প্লিজ!

গা ঢাকা দিয়েছে। আপনি কাল গিয়ে ওর সঙ্গে কথা বলেই এই কাণ্ডটি বাধিয়েছেন!,

অরিজিৎ, আমার ভয় হচ্ছে…..

না। কোথাও কোন বডি পড়ার খবর নেই। পুলিশ নেটওয়ার্ক অ্যাক্টিভ। সব রাজ্যের পুলিশ কর্তৃপক্ষকে অ্যালার্ট করা হয়েছে। জাল ঘেঁকে মাছটি ভোলা হবে। ভাববেন না। কিন্তু আমি শুধু ভাবছি, ছেলেটা যদি চক্রান্তের সঙ্গে জড়িত না থাকবে এবং নির্দোষ হবে, তা হলে সে গা ঢাকা দিল কেন? কেন সে সব কথা বলল না আমাদের, যখন তারই প্রেমিকা খুন হয়েছে? সুব্রত সব জানে। জেনেও এমন আচরণ কেন? নিশ্চয় সে……

আতঙ্ক, ডার্লিং! কবিসাহিত্যিকদের মন কোমল। স্পর্শকাতর। তাই তারা কলমে যতই খুনখারাবি করুক, বাস্তবে খুনখারাবি দেখলে দিশেহারা হয়ে পড়ে!

বোগাস! সুব্রত টিনির রক্তাক্ত বডি ঘেঁটেছিল। ভুলে যাচ্ছেন, তার ছেঁড়া জুতোয় রক্তের ছাপ। কাগজে রক্তের ছাপ।

মরিয়া হয়ে পড়েছিল সে। আমার ধারণা টিনির পার্সে পাওয়া এই লেখাটির মধ্যে আসলে কোনো সূত্র লুকোনো আছে। সুব্রত চেয়েছিল খুনী ধরা পড়ুক। কিন্তু খুনীকে তার প্রচণ্ড ভয়। এর দুটো কারণ থাকা সম্ভব। খুনী খুব শক্তিমান প্রভাবশালী লোক এবং সুব্রত তাকে চেনে।

লেখার জেরক্স কপি তো দিয়েছি। আপনি কিছু সূত্র পেলেন না এখনও?

না!

অথচ আপনার বিশ্বাস ওতেই খুনীকে চেনার সূত্র আছে!

 ইউ আর ড্যাম রাইট! ওকে, ছাড়ি। পরে যোগাযোগ করব।

কর্নেল ফোন রেখে কিছুক্ষণ চোখ বুজে টাকে হাত বুলিয়ে হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন। বইয়ের র‍্যাক থেকে দা গ্রেট ব্রিটিশ অ্যাডভেঞ্চারার্স বইটি বের করলেন। প্রকাণ্ড বই।

কর্নেল চার্লস গ্রিয়ার্সনের সংক্ষিপ্ত একটি জীবনী এবং কর্মকাণ্ড আছে ওতে। তিনি প্রখ্যাত ব্রিটিশ অভিযাত্রী রিচার্ড বার্টনের সঙ্গে করাচি সেনানিবাসে ছিলেন। পরে বার্টন মুসলিম ছদ্মবেশে মক্কায় যান। বই লেখেন দা পিলগ্রিমেজ টু মেক্কা। পরে আরব্য উপন্যাস অনুবাদ করেন। আরও পরে যান আফ্রিকায় নীলনদের উৎস সন্ধানে। আর গ্রিয়ার্সন সিপাহি বিদ্রোহের সময় পালিয়ে যান পারস্যে। সেজন্য তার শাস্তি হয়েছিল ছমাস জেল। পারস্য থেকে তাঁকে ধরে আনা হয়েছিল। জেলে আত্মজীবনী লেখেন। সেটির খোঁজ মেলেনি। তবে একটি নোটবই পাওয়া গিয়েছিল। তাতে এই কয়েকটি লাইন উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে আছে এবং তার ওপরে আছে মধ্যযুগের পহলভি ফার্সিতে লেখা কিছু কথা। এই বইয়ে পুরো পাতাটির ব্লক করে ছাপানো হয়েছে। ইংরেজি অনুবাদের বাংলা করলে দাঁড়ায় :

আমি, দিব্যজ্ঞানী, আর্দশের! অহুর মাজদা আমাকে রক্ষা করতে এসেছিলেন।

পারস্যে পহলভি আমল খ্রীঃ পূর্ব ২৫০ থেকে খ্রীস্টাব্দ ১৯১ পর্যন্ত। তখনকার অগ্নিপূজক জোরাস্তার ধর্মাবলম্বী সম্রাট আর্দশের। তার লেখা আবিষ্কার করেছিলেন প্রিয়ার্সন?

 নিশ্চয় তাই। যে কালো দামী পাথরের ফল গ্রিয়ার্সনের কবরের মাথায় ছিল, সেটি কি সেই ফলক? তার উল্টো পিঠেই কি পহলভি লেখাটি ছিল?

তা হলে তো…

কর্নেল নড়ে উঠলেন। কেউ কি জানতে পেরেছিল এই গোপন সত্যটি? পাথরের নিজস্ব দামের চেয়ে সেটির ঐতিহাসিক দাম বহু লক্ষ টাকা বেশি। লক্ষ টাকা কেন, আজকাল কোনও ধনকুবের বিদেশী সেটি কোটি ডলার দামেও সংগ্রহ করতে চাইবেন। সম্রাট আর্দশেরের ফলকের দাম কম নয়।

কর্নেল বইটি র‍্যাকে রেখে হাঁকলেন, ষষ্ঠী! আজ আটটায় ব্রেকফাস্ট খাব। বেরুব।….

.

ইস্টার্ন সাব-আর্বান সিমেট্রির পুলিশরক্ষীরা কর্নেলের কার্ড দেখেই সেলাম ঠুকে বসল। এস. আই. সঙ্গে আসতে চাইলেন বিনীতভাবে, যদি কোনও সাহায্য দরকার হয় কর্নেল সায়েবের! কর্নেল সহাস্যে বললেন, না, না। আমি জাস্ট পাখি দেখতে আর দুষ্টু প্রজাপতি ধরতে বেরিয়েছি। আপনাকে কষ্ট করতে হবে না।

পুলিশমহলে কিংবদন্তির নায়ক বৃদ্ধ ঘুঘুর সঙ্গলাভে বঞ্চিত পুলিশ অফিসার একটু মনঃক্ষুণ্ণ হলেন বৈকি!

কর্নেল বাইনোকুলারে পাখি দেখতে দেখতে পুবের পাঁচিলের কাছে ক্রিস্টিনার কবরে এলেন। এখানেই টিনি খুন হয়েছিল। তার ডাইনে হাত সাত-আট দূরে গ্রিয়ার্সনের কবর। শূন্য ফলকের চৌকো স্থানটি চোখে খচখচ করে বিঁধছে। ক্রসটিও উপড়ে নিয়ে গেছে কারা। তবে অনেক আগে। তার চিহ্ন স্পষ্ট।

শূন্য ফলকের নিচের ঘাসের দিকে ঝুঁকে বসলেন কর্নেল। আতস কাঁচ বের করে অনেকক্ষণ ধরে খুঁটিয়ে ঘাসের পাতা বেরুনো ভঁটার খাঁজ, তলার মাটি পরীক্ষা করতে থাকলেন। বৃষ্টিতে কোনও অস্বাভাবিক চিহ্ন থাকলে ধুয়ে যাওয়ার কথা। তবে লাইম কংক্রিটের গুড়ো প্রচুর। গুড়োগুলো ডাইনে এগিয়ে গেছে। হাত দশেক তফাতে আবার একই গুঁড়ো ঘাসের তলায়।

যে উপড়েছিল, সে গুঁড়ো ঝেড়ে সাফ করতে করতে নিয়ে যাচ্ছিল ফলকটা।

গতিপথ লক্ষ্য করে বুঝলেন ভাঙা গির্জাঘর। কিন্তু এর পর গুঁড়োর ছড়াছড়ি সর্বত্র। আর পার্থক্য করা অসম্ভব। গির্জা ঘরের পেছনে একটা দরজা আছে। কপাট উপড়ে নিয়ে গেছে কারা। সংকীর্ণ করিডর দিয়ে পুবের জানালার কাছে গেলেন কর্নেল। সেকেলে লম্বা খড়খড়ি দেওয়া জানালা। ভাঙাচোরা অবস্থা। হাত গলিয়ে মরচেধরা ছিটকিনি খুলে আস্তে টানলেন। একটা পাট খুলে গেল অদ্ভুত শব্দে। অশরীরী আত্মার ক্ষুব্ধ কণ্ঠস্বর মনে হলো। প্রার্থনা গৃহের প্রায়শ্চিত্ত প্রার্থনায় রত কোনও আত্মা কি বিরক্ত হলো? কিন্তু তিনটে গরাদ নেই!

কর্নেল নিঃশব্দে উঠে ভেতরে ঢুকলেন। টর্চের আলো জ্বালার দরকার নেই। খোলা জানালা দিয়ে ছোট্ট গির্জার ভেতর সবটাই দেখা যাচ্ছে। একটা চেয়ারও অবশিষ্ট নেই। একপাশে আবর্জনার গাদার মতো চেয়ারগুলোর টুকরো। কতকাল এই গির্জায় কেউ প্রার্থনা করতে ঢোকেনি। মেঝেয় ধুলো। দেয়ালে ঝুলকালি। ফাটা ছাদ দিয়ে আলো ঢুকছে। লম্বা রোদের ফালি তলোয়ারের মতো বিধছে গির্জার বুকে।

কর্নেল হাঁটু মুড়ে বসে মেঝেয় টর্চের আলো ফেললেন। জুতোর ছাপ ইতস্তত পরিষ্কার। পুলিশের জুতোর চাপও থাকা স্বাভাবিক। পুলিশ গির্জার ভেতরও সূত্র খুঁজেছে। কিন্তু একটা ছাপ অন্যরকম। জুতোটার হিল পুলিশের নয়।

তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চিহ্ন সুরকিগুঁড়ো–এই গির্জার সুরকিগুঁড়োর সঙ্গে মেলে না। যাজকের বেদির বাঁ দিকে একটা তাক। তাতে কয়েকখণ্ড জীর্ণ বাইবেল বই। লাতিন, ইংরেজি, হিব্রুও।

একটা বই সরাতেই পেছনে সুরকিগুঁড়োর একটা রেখা আবিষ্কৃত হলো।

 হু, ফলকটা প্রথমে এখানে এনে রাখা হয়েছিল। তারপর?

জানলায় হঠাৎ সেই পুলিশ সাব-ইন্সপেক্টরের মাথা দেখা গেল। মুখে হাসি। বললেন, যামু স্যার? তখন কইলাম আমারে সঙ্গে লন। হ্যাঃ হাঃ হাঃ। স্যার, কিছু কু পাইলেন নাকি?

কর্নেল দাড়ি নেড়ে বললেন, নাঃ। ক্লু নয়, বাইবেলগুলো দেখছিলাম।

জানলা দেখি ভাঙা! খাইছে!

 হ্যাঁ মরচেয় খেয়েছে আর কী!

স্যার! বেরিয়ে আসেন! কিছু বলা যায় না। ছাদের অবস্থা দ্যাখছেন না?

 কর্নেল ছাদের দিকে তাকিয়ে আঁতকে ওঠার ভঙ্গি করে হন্তদন্ত হয়ে জানালা দিয়ে বেরুলেন। অফিসার অবাক হয়ে তারিফ করলেন, এই বয়সেও এমন জিমন্যাস্টিক করা যায়, তার কল্পনায় আসে না। তবে কর্নেল সায়েবের সব কথাই তার জানা। শুধু চোখের দেখাটা দেখতে বাকি ছিল। তিনি এও স্বীকার করলেন, এই পড়ো পড়ো গির্জার ভেতর প্রাণ গেলেও তিনি ঢুকতে রাজি হতেন না।

কর্নেল শুধরে দিলেন, প্রাণ নয়, চাকরি বলুন।

 অফিসার বেজায় হেসে বললেন, হ, ঠিক কইছেন স্যার, চাকুরী।

 কর্নেল তাকে একটি চুরুট দিলে তিনি খুব খুশি হলেন। চুরুটটি জ্বেলে দিয়ে এবং নিজেরটি ধরিয়ে কর্নেল হনহন করে পুবে রেলইয়ার্ডের দিকে চলতে থাকলেন।

ভাঙা দেয়াল ডিঙিয়ে জংলা জমি পেরিয়ে রেলইয়ার্ডের সেই পরিত্যক্ত ওয়াগনটির ভেতরে ঢুকলেন কর্নেল। একবার ঘুরে কবরখানার ভাঙা দেয়ালের ওখানে সেই পুলিশ অফিসারের মাথাটি দেখতে পেলেন। দুটি গুলি গুলি চোখও।

ওয়াগনের ভেতর সাফ করা অংশে বৃষ্টি চুঁইয়ে পড়ে কাদাটে ভাব। ঘাস ও ঝোপের ভেতরটা প্রজাপতি ধরা জালের স্টিক দিয়ে সরিয়েই চমকে উঠলেন। একফালি রোদ্দুর পড়েছে এখানে। সেখানে কালচে রক্তের কয়েকটা ছোপ।

 জেভিয়ারের বডি এখানে এনে খুনী বা খুনীরা অপেক্ষা করছিল সম্ভবত। তারপর বডিটা নিয়ে গিয়ে রেললাইনে ফেলে দেয়।

কর্নেল বেরিয়ে এলেন ওয়াগন থেকে। বেরিয়েই পড়লেন দুজন সেন্ট্রির মুখে। তারা বন্দুক তাক করে দৌড়ে এল। কর্নেল হাসতে হাসতে আঙুল তুলে কবরখানার ভাঙা দেয়ালের ওখানে পুলিশ অফিসারকে দেখালেন। তিনি দেয়াল গলিয়ে দৌড়ে এলেন চেঁচাতে চেঁচাতে ক্যা করতা হ্যায়? ক্যা করতা হ্যায়?

সেন্ট্রিদের একজন বলল, ত আপ সি আই ডি কা আদমি হ্যায়? যাইয়ে সাব। ইহাঁপর হমলোলগানে ভি ডিউটি করতা হ্যায়।

কর্নেল এগিয়ে গিয়ে পুলিশ অফিসারকে বললেন, চলুন। ওদেরও তো  ডিউটি করতে হবে।

অফিসার চাপাস্বরে বললেন, কিছু ক্লু পাইলেন স্যার?

নাঃ। একটা প্রজাপতি ঢুকেছিল। ধরতে পারলুম না। দুষ্টু প্রজাপতি!

ওই নামে একটা ফিল্ম দেখেছিলাম, স্যার! হ্যাঃ হাঃ হ্যাঃ!

 বাড়ি ফিরে গিয়েই ডি সি ডি ডি অরিজিৎ লাহিড়ীকে ফোন করলেন কর্নেল। ওই উদ্ভট ব্যাপারটার অর্থ হয় না, ডার্লিং! কর্নেলের প্রথম বাক্যটি এই।

অরিজিৎ, কণ্ঠস্বরে হকচকিয়ে ওটার ভাব ছিল, উদ্ভট! কী উদ্ভট?

 কবরখানায় পুলিশ মোতায়েন।

অরিজিৎ হাসছিলেন। বাপস! এমন উদ্ভট কথা নিজেই বলে আমাকে ঘাবড়ে দিচ্ছেন। এনিওয়ে, কবরখানায় পুলিশ মোতায়েন কেন আপনার চক্ষুশূল হলো? বাকি পাথর টাথরগুলো৷…

অরিজিৎ! পুলিশ হঠাও!

 কী আশ্চর্য! পুলিশ আমরা নিজেদের ইচ্ছেয় রাখিনি। কবরখানার মালিক প্রোটেস্ট্যান্ট চার্চ সোসাইটির কর্তৃপক্ষের অনুরোধ। তা ছাড়া, চার্লস গ্রিয়ার্সনের কবরের ফলক কবরখানাতে কোথাও লুকিয়ে রাখাও সম্ভব, আমার ডিপার্টের এক্সপার্ট ওপিনিয়ন। ডোন্ট ফরগেট কর্নেল, রয় কোম্পানিতে হানা দিয়েও তা খুঁজে পাইনি আমরা। কাজেই….

পুলিশ হঠাও, ডার্লিং!

কী মুশকিল!

 হ্যাঁ, মুশকিল। খুনী অর্থাৎ ফলকচোরের পক্ষে মুশকিল।

অরিজিৎ বিরক্ত হয়ে বললেন, আপনার হঠাৎ তাদের ওপর দয়া উথলে ওঠার কারণ?

কর্নেল একটু হাসলেন। বেচারা এত কাণ্ড করেছে, তাকে একটু দয়া করা অন্যায় নয়।

ওঃ! শুধু হেঁয়ালি! ডি সি ডি ডি অনিচ্ছাসত্ত্বেও হাসলেন। ব্যাপারটা বলুন তো?

পুলিশ হঠাও!

বেশ। হঠালুম! তারপর?

আশেপাশে সাদা পোশাকের গোয়েন্দা পুলিশ রাখো। দ্যাট উইল বি এনাফ। বরং আমাদের হালদারমশাইকে কাজে লাগাও।

হালদারমশাই? মাই গুডনেস! সেই কে কে হালদার?

 ইয়া। হালদার প্রাইভেট ডিটেকটিভ এজেন্সির হালদারমশাই। ডোন্ট ফরগেট, উনি তোমাদের পুলিশ ডিপার্টের রিটায়ার্ড অফিসার।

আপনার মাথা খারাপ হয়ে গেল? হালদারমশাইকে এতদিন এত কাণ্ডের পরও চিনতে পারেননি? ভদ্রলোক সর্বক্ষেত্রে হিতে বিপরীত বাধিয়ে ছাড়েন। এমন একটা কেসে…..

না, ডার্লিং! ছদ্মবেশ ধরতে ওঁর জুড়ি নেই। তোমার গোয়েন্দারা ছদ্মবেশ ধরতে রাজি হবেন না। ধরো, যদি বলি, পাগলা সেজে কবরখানার অনাচে কানাচে ঘুরুন? ময়লা ন্যাকড়াকানিপরা পাগল, বিড়বিড় করে বকতে হবে ইত্যাদি।

হাঃ হাঃ হাঃ। কোনও মানে হয়? এ কি রহস্য উপন্যাস, না বাস্তব ঘটনা? ওসব রহস্য উপন্যাসে মানায়, বস্!

ঠিক আছে। আমি হালদারমশাইয়ের দায়িত্ব নিচ্ছি। তুমি পুলিশ হঠাও। চার্চ সোসাইটিকে বলে, তোমাদের পক্ষে আর একখানে দিনের পর দিন পুলিশ মোতায়েন সম্ভব নয়। এমনিতেই পুলিশ ফোর্সের অবস্থা টাইট। যাই হোক, প্লিজ ডু দ্যাট ডার্লিং!

একটু পরে অরিজিৎ লাহিড়ীর নৈরাশ্যমিশ্রিত কণ্ঠস্বর ভেসে এল ফোনে, ওকে। ঠিক আছে।….

কর্নেল আবার বেরুলেন।

.

গণেশ অ্যাভিনিউতে রাস্তা থেকে একটা তেতলা বাড়ির চিলেকোঠার ছাদে সাইনবোর্ডটি দেখা যায় : হালদার প্রাইভেট ডিটেকটিভ এজেন্সি। কৃতান্তকুমার হালদার পুলিশের সার্কেল অফিসার ছিলেন গ্রামাঞ্চলে। রিটায়ার করে এই লাইন ধরেছেন। ঢ্যাঙা মানুষ। প্রচণ্ড নস্যির নেশা। কর্নেলকে খুব খাতির করেন। ইতিপূর্বে কর্নেলের সঙ্গে বেশ কিছু কেসে সহযোগিতা করেছেন, যেচে পড়েও করেছেন। বিভ্রাটও বাধিয়েছেন। তবে লোকটি ঝুঁকি নিতে পারেন। ছদ্মবেশ ধরতে যেমন উৎসাহী, তেমনি দক্ষ।

ইদানীং কেস পাচ্ছেন না বলে মনমরা হয়েই ছিলেন। ছাদে অ্যাসবেস্টস চাপানো ছোট্ট ঘরে চেয়ারে হেলান দিয়ে টেবিলে ঠ্যাং তুলে বলে ছিলেন। নাকে নস্যির ছোপ। কর্নেলের সাড়া পেয়েই চোখ খুললেন এবং প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন, স্বপ্ন! স্বপ্ন!

স্বপ্ন নয় হালদারমশাই! রহস্য! টাটকা রহস্য! কবরখানায় দুদুটো খুন। দামী কবরের ফলক চুরি।

হালদারমশাই রহস্যের গন্ধ পেলেই শক্ত হয়ে যান। চোখ দুটো গোল করে বললেন, হঃ!

হঃ কী? কাগজে পড়েননি?

পড়ছি! পড়ছি! হালদারমশাই লাফিয়ে উঠলেন। তারপর ঝটপট নস্যি নিয়ে ফাঁচ শব্দে স্বকীয়তাসম্পন্ন হাসিটি হাসলেন। কর্নেলস্যার! কী আশ্চর্য! আমি কি সত্যি স্বপ্ন দেখছি, না কর্নেলস্যারকে দেখছি গরিবালয়ে! কাইলি টেক ইওর সিট কর্নেলস্যার!

কর্নেল বুঝলেন, এতক্ষণে ধাতস্থ হয়েছেন প্রাইভেট গোয়েন্দা কে কে হালদার। ড্রয়ার থেকে খাম বের করে ফেললেন। খামে লেখা সিমেটি মিস্ট্রি। ভেতরে খবরের কাগজের কাটিং। কর্নেল এ-ও বুঝলেন, এই কেসটিতে তার নাক গলানোর খুব ইচ্ছে সত্ত্বেও কোনও পক্ষ থেকে তাকে ডাকা হয়নি। তবু প্রতীক্ষায় ছিলেন।

কর্নেল তাকে কাগজের খবরের বাড়তি কিছু বললেন না। বললে পরে অত্যুৎসাহী গোয়েন্দা ভদ্রলোক স্বভাবমতো কী বিভ্রাট বাধিয়ে বসবেন, বলা যায় না। তারপর বললেন, হালদারমশাই! আপনাকে পাগল সেজে ওই কবরখানার আনাচে-কানাচে থাকতে হবে। অন্তত দুটো দিন। আমার ধারণা, গ্রিয়ার্সনের কবরের ফলক এখন কবরখানায় কোথাও লুকানো আছে। কারণ গোমেশ জেভিয়ারের মৃত্যুর পরই পুলিশ পাহারা বসেছে। আজ থেকে পুলিশ সরে যাচ্ছে। এখন আপনিই প্রহরী। বুঝলেন কি কিছু?

 হ। বুঝছি! বলে উত্তেজিত হালদারমশাই আরেক টিপ নস্যি নিলেন। উত্তেজনার ব্যাপার ঘটলেই তিনি পূর্ববঙ্গীয় মাতৃভাষায় কথা বলেন। বরাবর এই অভ্যাস।

কী বুঝলেন?

আমারে পাগল সাজতে হইব।

নজর রাখতে হবে…..

 হাত তুলে হালদারমশাই বললেন, এনাফ, কর্নেলস্যার, এনাফ!

সশস্ত্র থাকতে হবে। আপনার রিভলবার…

এনাফ, কর্নেলস্যার, এনাফ!

 হালদার ডিটেকটিভ এজেন্সি থেকে বেরিয়ে কর্নেল তার লাল রঙের ল্যান্ডরোভার গাড়িটির গতি সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউমুখী করলেন। জ্যাম ছিল পাতালরেলের কারণে। ম্যাডান স্ট্রিট হয়ে ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে পৌঁছুতে সাড়ে বারোটা বেজে গেল।

রয় অ্যান্ড কোম্পানির দোকান তার চেনা। বিশাল হলঘরের ভেতর সেকেলে আসবাবপত্রের স্তূপ। একদা এগুলি সায়েবসুবো রাজা-মহারাজা রইস। লোকেদের গৃহশোভা ছিল, বোঝা যায়। চোখ জ্বলে যায় সৌন্দর্যের দীপ্তিতে, যদিও কালের ধূসর পাঞ্জার ছাপ পড়েছে গায়ে। কর্নেল ঘুরে ঘুরে জিনিসগুলি দেখছিলেন, ক্রেতার ভঙ্গি। কোন জিনিস কবে নিলাম হবে, তা স্লিপে লিখে আটকানো আছে।

শেষপ্রান্তে কোনার দিকে গিয়ে থমকে দাঁড়ালেন কর্নেল। একটি ডিমালো আয়না। বেলজিয়াম কাঁচে তৈরি। অবিকল গোমেশের ঘরে দেখা সেই আয়নাটার মতো।

একই গড়নের আয়না অনেক থাকতে পারে। নিঃসংশয় হওয়ার জন্য ঝুঁকে গেলেন একটু। কোম্পানির লোক ইতস্তত দাঁড়িয়ে আছে। একজন এগিয়ে এসে বলল, উসকি নিলাম পরশু রোজ হোগি, সাব! খাস বিলয়তকি চিজ।

জেরা দেখনা চাহিয়ে ভাই!

দেখিয়ে। লোকটি দাঁত বের করল।

 পেছনে কিছু লেখা ছিল সুন্দর হস্তাক্ষরে। ঘষে তুলে ফেলা হয়েছে। দুটি ডবলিউ হরফের অস্পষ্ট চাপ। উইথ বেস্ট উইশেস? এর পর অস্পষ্ট একটা হরফের মাথা। জি। গোমেশে জি আছে। গোমেশ শব্দটি বিকৃত উচ্চারণ। শব্দটি পর্তুগিজ গোজ। সংক্ষিপ্ত উচ্চারণে গোম। কাল্লু গোমসায়েব গোমসায়েব বলেছিল। সে মেমসায়েবদের মুখে সঠিক উচ্চারণ শুনে থাকবে। হিব্রু জামে থেকে গ্রিক লাতিনে জেমস। পর্তুগিজ ভাষায় তাই বিকৃত গোমজ।

হুঁ, সেই আয়নাটাই বটে। গোমেশ জেভিয়ারকে কেউ উপহার দিয়েছিল, সম্ভবত তার বিয়েতে। সেটা এত দিনে তিনি বেচে দিয়েছিলেন কেন? অস্ট্রেলিয়ায় ছেলেমেয়েদের কাছে চলে যেতে চেয়েছিলেন? কিন্তু এই আয়না বেচে কি তত টাকা পাওয়া যায়?

তা হলে কি গোমেশই গ্রিয়ার্সনের কবরের ফলকটা…..

কর্নেল কয়েক মুহূর্তের জন্য শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর ঘুরে আস্তে পা বাড়ালেন। রয়সায়েবের সঙ্গে আলাপ করার ইচ্ছায় এখানে আসা। তার অফিস দোতলায়। হলঘরের ভেতর থেকে কাঠের সিঁড়ি ঘুরে ঘুরে দোতলায় উঠেছে। আসবাবপত্রের ভেতর দিয়ে এগিয়ে সিঁড়ির কাছে যেতেই মুখোমুখি দেখা হয়ে গেল মুনলাইট বারের সিনহার সঙ্গে। সিনহা বলে উঠলেন, হ্যাল্লো! হ্যাল্লো! হ্যাল্লো!

একটা ফার্নিচার কেনার তালে আছি, মিঃ সিনহা!

আমিও। হাসিখুশি সিনহা বললেন। ভাবছি বারটা টোট্যালি রিমডেলিং করব। একটু পুরনো বনেদি চেহারা দেব। ভিক্টোরিয়ান শেপ। তাই রয়সায়েবের কাছে এসেছিলুম যদি তেমন কিছু পাই।।

পেতে পারেন।

 আশা দিলেন রয়সায়েব। ওক্কে চলি। বাই!

 সিনহা হন্তদন্ত হয়ে চলে গেলেন। কর্নেল কার্পেট বিছানো সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠলেন। রিসেপশনিস্ট মহিলা মিষ্টি গলায় বললেন, ক্যান আই হেল্প যু, স্যার?

কর্নেল বাংলায় বললেন, রয়সায়েবের সঙ্গে দেখা করতে চাই।

 হ্যাভ য়ু এনি অ্যাপয়েন্টমেন্ট, স্যার? হি ইজ নাউ ভেরি বিজি।

কর্নেল একটু হাসলেন। কিন্তু আমার যে দেখা করা জরুরি। বলে তিনি এম রয় ফলক আঁটা ঘরটির দিকে পা বাড়ালেন। রিসেপশনিস্ট মহিলা বিব্রতমুখে দাঁড়িয়ে রইলেন।

 কিন্তু দরজা ঠেলতেই দেখলেন টেবিলের ওধারে রয়সায়েব এবং এধারে তার ভাগ্নে ড্যানি ঘোষ বসে আছেন। ড্যানি ঘোষ ঘুরে কর্নেলকে দেখে উঠে দাঁড়ালেন। ঘুষি পাকিয়ে বললেন, ইউ ওল্ড হ্যাঁগার্ড! গেট আউট! আউট!

রয়সায়েব বললেন, ঔ ড্যানি! ডোন্ট শাউট লাইক দ্যাট!

 ডোন্টু নো হিম? হি ইজ আ ডিটেকটিভ!

সো হোয়াট? ড্যানি, ইউ গো টু ইওর চেম্বার প্লিজ!

ড্যানি ঘোষ চোখের আগুনে ঝলসে দিতে দিতে বেরিয়ে গেলেন। কর্নেল বসে বললেন, আমি ডিটেকটিভ নই, মিঃ রয়। নিছক প্রকৃতিবিদ। পাখি প্রজাপতি দেখা আমার হবি। তাই আপনার ভাগ্নের চন্দননগরের ডেরার কাছে গিয়েছিলুম। কিন্তু কেন জানি না, উনি আমাকে ডিটেকটিভ ভাবলেন! ভাববার কোনও বিশেষ কারণ আছে কি?

রয়সায়েব পাইপ ধরিয়ে বললেন, আমি ব্যস্ত। বলুন।

ইস্টার্ন সাপ-আর্বান সিমেট্রির কেয়ারটেকার গোমেশ জেভিয়রের আয়নাটা আপনারা কিনেছেন দেখলুম। গোমেশ আমাকে ওটা বেচতে চেয়েছিলেন। তো….

তা হলে ড্যানি ইজ রাউট। আপনি ডিটেকটিভ।

আমি গোয়েন্দাগিরি করতে আসিনি মিঃ রয়। ওই আয়নাটা আমি কিনতে চাই।

নিলামের দিন কিনবেন।

প্লিজ মিঃ রয়। নিলামে দরাদরি আমার পোয় না বড্ড। বাজে লোকেদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হয়। কর্নেল নীলাদ্রি সরকার…..

রয়সায়েব হাসলেন। আই নো, আই নো! দা নেম ইজ ওয়েলনোন। এবার সব স্পষ্ট হলো। প্রাইভেট ডিটেকটিভ কর্নেলসায়েবের কথা, কে না জানে? ওয়েল, আসল কথাটা বলুন। আমার বাড়ি, অফিস, গোডাউন সার্চের পর পুলিশ আপনাকে পাঠিয়েছে, আমি জানি। বলুন!

গোমেশায়েবের আয়নাটা। আমি কিনতে চাই।

আই অ্যাম আ ম্যান অব প্রিন্সি! ট্রাই ইওর লাক অ্যাট দা অকশন।

কর্নেল উঠলেন। রয়সায়েব গম্ভীর। কাগজপত্রে মন দিলেন। কর্নেল বাইরে বেরিয়ে দেখলেন, রিসেপশনিস্ট মহিলা করুণমুখে বসে আছেন। ড্যানি ঘোষ বকে দিয়েছে কি?

হলঘরে নেমে আবার আয়নাটির উদ্দেশে চললেন কর্নেল। আয়নাটি নেই। ওপর থেকে ফোনে নিচে রয়সায়েব জানিয়ে দিয়েছেন, ওটা সরিয়ে ফেলল। কর্নেল হাসতে হাসতে বেরিয়ে এলেন। রয়সায়েব ভেবেছেন কি আয়নার মধ্যে গ্রিয়ার্সনের ফলকের কোনও সূত্র লিখে রেখে গেছেন গোমেশ এবং তিনি তা ধরে ফেলবেন? অদ্ভুত মানসিকতা! তবে গোমেশ ধুর্ত লোক ছিলেন নিঃসন্দেহে। তাঁকে হত্যা করার মোটিভ আবছা টের পাওয়া যাচ্ছে।….

.

দুপুরে খাওয়ার পর সুব্রতর লেখা সেই টিনি বৃত্তান্তের জেরক্স কপিটি নিয়ে বসে ছিলেন কর্নেল। বারবার পড়ছিলেন।

ভুল পা ফেলে দৈবাৎ সেখানে পৌঁছুলেই সর্বনাশ!…মেয়েটি সেই ভুল করে বসল।

সুব্রতর এই সব কথায় কি কোনও সূত্র লুকিয়ে আছে? কী ভুল করেছিল টিনি? তার একটা স্বপ্ন ছিল। আধুনিক জীবনযাত্রার স্বপ্ন। বস্তি এলাকা ছেড়ে কোনও ফ্ল্যাটবাড়িতে উঠে যাওয়ার স্বপ্ন। সেই স্বপ্নের জন্যই কি টিনি এমন কিছু করে ফেলেছিল, যাতে মৃত্যুর সামনে গিয়ে পড়ল সে?

ঘটনার দিন সুব্রত গোমেশকে একটা চিঠি দেয়। চিঠিতে সুব্রত টিনিকে ক্রিস্টিনার কবরে তার জন্য অপেক্ষা করতে বলেছিল। তারপর সে খুন হয়ে যায়। সুব্রত পরে এসে তার ব্লাউসের ভেতর পার্সে এই লেখাটা খুঁজে রেখে যায়।

কিন্তু খুনের পর এমন হস্তাক্ষরে এমন গুছিয়ে কিছু লেখা যায় না। এটা টিনির মৃত্যুর আগেই লেখা। এখানেই সব জট পাকিয়ে যাচ্ছে। সুব্রত জানত টিনি খুন হবেই।

কী ভাবে জানতে পেরেছিল? পেরেছিল যদি, কেন বাধা দেয়নি তাকে কবরখানায় আসতে? টিনি কি তার নিষেধ শোনেনি? নাঃ, সুব্রতর চিঠিটা এই পয়েন্টটা নস্যাৎ করে দিচ্ছে। সুব্রত তাকে কবরখানায় ডেকেছিল অন্যান্য দিনের মতো।

অথচ গোমেশ চিঠিটা ছিঁড়ে ফেলেছিলেন। ছেঁড়া চিঠির টুকরো কর্নেল হাতিয়ে আনার পর তিনি উধাও হয়ে গেলেন চন্দননগরে। তারপর তাকে খুন করা হলো কবরখানার কোথাও।

গোমেশ টিনির বাড়ি গিয়েছিলেন, এও একটা পয়েন্ট।

কর্নেল চোখ বুজে দাড়ি মুঠোয় চেপে দুলতে থাকলেন। দাঁতে চুরুট কামড়ানো।

বাবামশাই!

চোখ খুলে ষষ্ঠীকে দেখতে পেলেন। তার মুখে কাচুমাচু হাসি বা চুলকোচ্ছে। কর্নেল বললেন, কী রে? কিছু বলবি?।

ষষ্ঠী বলল, আজকাল আমার কেন যেন বড় ভুলভাল হয়ে যাচ্ছে, বাবামশাই! মনে থাকছে না কিছু। নালবাজারের নাহিড়ীসায়েব…..

এসেছিল অরিজিৎ?

 আজ্ঞে না। নোক পাইঠেছিলেন। এই খামখানা দিয়ে গেছে। আমি…

ভুইলে গেছিস, হতভাগা! কর্নেল হাসলেন। কৈ, দে!

ষষ্ঠী খামখানি দুহাতে দিয়ে দ্রুত কেটে পড়ল। খামের মুখ ছিঁড়ে কর্নেল দুটো ভাজ করা কাগজ বের করলেন। একটা অরিজিতের চিঠি। লেখা আছে : সুব্রতর অফিসের টেবিলে ড্রয়ারে পাওয়া গেছে। সন্দেহজনক মনে হলো। বৃদ্ধ ঘুঘুমহাশয়ের প্রতি উপহার। ইতি–অল।

দ্বিতীয় কাগজটি নিউজপ্রিন্ট। ডটপেনে লেখা সুব্রতর একটি কবিতা। কবিতাও লিখত তা হলে! কিন্তু এ কী অদ্ভুত কবিতা!

॥ পতন ॥

 চুপিসাড়ে এসেছে সে আলতো পা
বেড়াল ভূত কি পরী জানতো না
অবশেষে আততায়ী হাতে ছুরি
কণ্ঠার হাড় কাটে ভাঙা চুড়ি
 রেলগাড়ি ঝমাঝম বাঃ রে বাঃ
কড়কড়ে নোটগুলি মূল্য তা
নিয়ে ঘোরে দিব্যি তো ফালতো না।
হায় রে সাক্ষী শুধু ক্রিস্টিনা
সে ছাড়া কেউ না আর কেউ তো না।

বারকতক পড়ার পর কবিতা থেকে একটি ছবি ফুটে উঠল। চুপিসাড়ে আসা একজন আততায়ী, একটা হত্যা, হাতের চুড়ি ভেঙে পড়া, রেলগাড়ির শব্দ, কিছু টাকা….! রেলগাড়ির শব্দ হয়েছিল হত্যার সময়, তাই টিনির আর্তনাদ শোনা যায়নি কি? সাক্ষী শুধু ক্রিস্টিনা…..। কিন্তু ক্রিস্টিনা তো মৃত। তার কবরের ওপর একটি হত্যা ঘটল। তবু সাক্ষী কেন সে? মৃতেরা চিরমূক। তা হলে সাক্ষী শব্দটা কেন? নিছক আলঙ্কারিক প্রয়োগ?

কর্নেল কাগজ খামে ঢুকিয়ে টেবিলের ড্রয়ারে রাখলেন। তারপর পোশাক বদলে বেরুলেন। গলায় ঝুলন্ত বাইনোকুলার, ক্যামেরা, হাতে প্রজাপতিধরা নেটের স্টিকছড়ির মতো। তার চেনা মূর্তিটি।

গাড়ি নিয়েই বেরুলেন।

ইস্টার্ন সাব-আর্বান সিমেট্রির গেটের সামনে এক নোংরা পোশাকপরা কালিঝুলি-মাখা পাগল দাঁড়িয়ে কাকে শাসাচ্ছে। বিড়বিড় করছে। কর্নেলের গাড়ি দেখেই সে ঘুরে ফ্যাঁচ করে হাসল।

হালদারমশাই।

কর্নেল আস্তে বললেন, খুব মানিয়েছে।

গোয়েন্দা হালদারমশাই ফের অনবদ্য ফাঁচ করে বললেন, সন্দেহজনক তেমন কিছু দেখলুম না কর্নেলস্যার। তবে নতুন কেয়ারটেকার অ্যাপয়েন্ট করেছে। হালায় ঢুকতে দিচ্ছে না।

গাড়িটার দিকে লক্ষ্য রাখুন আপাতত।

বলে কর্নেল গেটে গেলেন। চার্চ সোসাইটি নতুন কেয়ারটেকার পাঠিয়েছেন। তাকে দেখেই কর্নেল চেঁচিয়ে উঠলেন, হাই ডেভিড! আ সারপ্রাইজ ইনডিড! আ কেয়ারটেকার ফ্রম অ্যান আন্ডারটেকার!

ডেভিড প্যাটার্সন খুব হেসে বললেন, আ টেকার ওনলি টেকস সামথিং গুড অর ব্যাড। বাট আ টেকার লাইক মি ওনলি টেক দা ডেডস!

ভালো। তবে এটা পদোন্নতি, না পদাবনতি সেটাই প্রশ্ন।

ডেভিড বললেন, আমার ক্ষেত্রে পদাবনতি। তবে পুষিয়ে গেছে। আমার স্ত্রী বারবারার পদোন্নতি হয়েছে। এখন সে আন্ডারটেকার।

আশা করি, বারবারা বেচারিকে ছেড়ে এই ভুতুড়ে কবরখানায় রাত কাটাবেন না?

ডেভিড হতাশার ভঙ্গিতে বললেন, সোসাইটি পীড়াপীড়ি করছে, নিয়ম হচ্ছে নিয়ম। তবে আমি এই শয়তানের দরবার পাহারা দেব রাতবিরেতে? কখনও না। রাত নটাতেই কেটে পড়ব। আসব ফের সকাল সাতটায়।

কথা বলতে বলতে দুজনে কবরখানার ভেতর হাঁটছিলেন। কর্নেল বাইনোকুলারে পাখি দেখছিলেন। হঠাৎ পথ ছেড়ে কবরের জঙ্গুলে জায়গায় ঢুকে গেলেন। ডেভিড হুঁশিয়ারি দিলেন, সাবধান কর্নেল! সাপ থাকতে পারে। কর্নেল গ্রাহ্য করলেন না।

উত্তর দিকে ঘুরে ঝোপঝাড় ঠেলে পুবে ক্রিস্টিনার কবরের কাছে গেলেন। দাঁড়িয়ে চারপাশে বাইনোকুলোরে খুঁটিয়ে দৃষ্টিপাত করলেন। দূরে ডেভিড দাঁড়িয়ে আছেন। মুখে বিরক্তির ছাপ। ভুরু কুঁচকে গেছে। গেটের ফঁক গলিয়ে পাগল উঁকি দিচ্ছিল। কর্নেলস্যারের গোয়েন্দাগিরি লক্ষ্য করার জন্য পাগলের বড় কৌতূহল বরাবর। কিন্তু ডেভিড তেড়ে গেলেন তার দিকে।

ক্রিস্টিনার কবরের ওপর ঝুঁকে পড়লেন। সুব্রতর কবিতাটি সত্যিই কোনও সংকেতবহ কি না দেখা দরকার। আগের বার আতস কাঁচ দিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছেন। এবার আরও পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসন্ধান শুরু করলেন।

একটু পরে কবরের ফাটলে ভাঙাচুড়ির কয়েকটি টুকরো আবিষ্কার করলেন। কর্নেল। 

কবরের দক্ষিণের অংশে নিচে ঘাসের ভেতরও দুটো টুকরো। মড মেয়ে হয়ে উঠেছিল টিনি। তারা আজকাল রঙবেরঙের চুড়ি পরে হাতে। প্লাস্টিকের চুড়িই।

চুড়ির টুকরো এগিয়ে গেছে গ্রিয়ার্সনের কবরের দিকে। গ্রিয়ার্সনের কবরের কাছেও তিনটি টুকরো। কেন?

ক্রিস্টিনা এবং গ্রিয়ার্সনের কবরের মধ্যে একটা ঝোপের আড়াল। টিনি গ্রিয়ার্সনের কবরের কাছে গিয়েছিল এবং সেখানেই কেউ তার হাত ধরে টেনে এনেছিল। এত জোরে চেপে ধরেছিল যে মুটমুট করে চুড়ি ভেঙে গিয়েছিল?

সেটাই কি টিনির ভুল পথে পা বাড়ানো।

ক্রিস্টিনার কবরের কাছে ফিরলেন কর্নেল। কবরটা আবার খুঁটিয়ে দেখতে থাকলেন। উত্তর-পূর্ব কোণে ফাটলটা প্রায় সিকি ইঞ্চি। নিচের মাটিও ফেটে গেছে। ঘাস সরাতেই একটা টাটকা খোঁড়া গর্ত আবিষ্কৃত হলো।

গর্তের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল একটা ছুঁচো। ছুঁচোর গর্ত। প্রজাপতি ধরা স্টিক দিয়ে গর্তের ভেতর খোঁচা দিলে আরও ছুঁচো বেরুল। কিচকিচ শব্দে গাল দিতে দিতে পালাল। কিন্তু ছুঁচোর গর্ত খুঁড়ল কে? কী ছিল ওর ভেতর? কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। কিছু লুকোনো ছিল। কেউ তুলে নিয়ে গেছে……

.

০৫.

কর্নেল শূন্যোদ্যানে দাঁড়িয়ে লেডি ব্র্যাবোর্ন কলেজের ওদিকে দেবদারু গাছের শীর্ষে শকুনের বাসা দেখছিলেন। বিরক্তিকর দৃশ্য। অথচ ক্ষত খোঁচানোর মধ্যে মানুষের যেমন কী একটা প্রবণতা আছে, এক্ষেত্রেও তা-ই। বিষদৃষ্টে একটি শকুনকে দেখতে দেখতে পেছনে শুনলেন, মর্নিং ওল্ড বস!

কর্নেল না ঘুরেই বললেন, মর্নিং ডার্লিং!

টিনির হত্যাকারীকে দেখতে পাচ্ছেন বাইনোকুলারে? অরিজিৎ কৌতুকে বললেন, অসম্ভব নয়। বাইনোকুলার যে কত জরুরি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রককে বোঝাতে পারা গেল না ওঁদের মতে, ফাইন্যান্স দফতর আটকে দেবে। তা ছাড়া পুলিশ বাইনোকুলার নিয়ে দেখবেটা কী? পুলিশ কি মিলিটারি?

অরিজিৎ! কলকাতার মাথায় বিপদ সংকেত!

কী রকম?

শকুন, ডার্লিং, শকুন! কর্নেল ঘুরলেন। কলকাতা ভাগাড় হবে, এ তার লক্ষণ।

ওঃ! আপনার সেই শকুনতত্ত্ব? ষষ্ঠী বহুবার বলেছে! অরিজিৎ কাগজে মোড়া একটা জিনিস দিয়ে বললেন, রাতে আপনার ফোন পেয়ে তখনই ফোরেন্সিক এক্সপার্ট আপনার বন্ধু ডঃ মহাপাত্রের ল্যাবে গেলুম। ওঁর পরীক্ষা শেষ।

টিনির পার্স?

 ইয়া।

ডঃ মহাপাত্র কী বললেন?

আশ্চর্য ব্যাপার, টিনির পার্স! টিনির ব্লাউসের ভেতর ছিল। অথচ টিনির আঙুলের ছাপ নেই। অন্য কারও আঙুলের ছাপ।

সুব্রতর আঙুলের ছাপ তো নিয়েছ!

টিনির পার্সে সুব্রতর আঙুলের ছাপ পাওয়া নতুন কথা নয়। সে তার লেখাটি টিনির পার্সে ভরেছিল। কিন্তু টিনির পার্সে টিনির আঙুলের ছাপ না থাকাটা আশ্চর্য! এটা নতুন সূত্র। কর্নেল সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেলেন।

অরিজিৎ তাকে অনুসরণ করে বললেন, গোমেশের আঙুলের ছাপও নয়। মিলিয়ে দেখা হয়েছে। গোমেশের আঙুলের ছাপ আমরা নিয়েছিলুম।

ড্রইংরুমে নেমে কর্নেল গার্ডেনিং পোশাক খুলে বাথরুমে হাত ধুয়ে এলেন। অরিজিৎ সোফায় বসে কাগজ পড়ছিলেন। মোড়ক থেকে পার্সটা খুলে কর্নেল বললেন, হুঁ, আশ্চর্য!

উ?

 ডার্লিং, এই পার্স টিনির না হওয়াই সম্ভব।

কিন্তু ওর ভেতরকার জিনিসগুলো দেখুন। সেফটিপিন, নেলপালিশ, লিপস্টিক, চুলের ক্লিপ….

কর্নেল পার্স থেকে জিনিসগুলো বের করে অট্টহাসি হাসলেন।

আমি তোমাকে বলেছিলুম অরিজিৎ। এটা নিছক পার্স। মানিব্যাগ মাত্র! কোনও অতিচালাক একে নারীচরিত্র দেবার জন্য……হাঃ হাঃ হাঃ! বলে হঠাৎ গম্ভীর হলেন। সেফটিপিন, ক্লিপ যদি বা পার্সে থাকে, লিপস্টিক নেলপালিশ কেন? তা ছাড়া এগুলো সবই নতুন। সবই প্ল্যান্টেড, ডার্লিং?

তা হলে সুব্রতরই কাজ।

সম্ভবত তাই। সে জানত টিনি খুন হবে। লেখাটি ঠাণ্ডা মাথায় লিখেছিল। পার্সটিও নতুন, জিনিসগুলো নতুন। তার মানে, টিনির হত্যাকাণ্ডের পরই সে টিনির ব্লাউসের ভেতর এটা গুঁজে দিয়ে পালিয়ে যায়। রেললাইনে চপ্পল ছিঁড়ে যায়। এনিওয়ে, এ সুব্রতরই কাজ।

তা হলে সে-ই খুনী।

জানি না ডার্লিং! বড় জটিল এই কেস। কর্নেল হাত বাড়ালেন এবং কফির পেয়ালা হাতে পৌঁছে গেল। যষ্ঠী নালবাজারের নাহিড়ীসায়েবকে অর্ঘ্যদানের মতো কফির পেয়ালা দিয়ে ভয়ে-ভক্তিতে চলে গেল।

একটু পরে কর্নেল বললেন, এবার গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, টিনির পার্স কোথায় গেল? তার বাড়িতে কোনও পার্স পাওনি। কাজেই টিনি খুন হওয়ার আগেই তার পার্স চুরি যায় বা কেড়ে নেওয়া হয়।

কেন?

কড়কড়ে নোট ছিল হয়তো! পদ্যটা তুমিও পড়েছ।

অরিজিৎ সোজা হয়ে বসে বললেন, সুব্রত! সুব্রত! তাকে খুঁজে বের করবই। সে-ই খুনী। তার অভাব ছিল। প্রেম-ট্রেম বোগাস! কর্নেল, নিরীহ বোকাসোকা চেহারার মধ্যেও খুনী লুকিয়ে থাকে। কবিদেরও খুনী হওয়া সম্ভব। কবি রাবোকে খুন করতে কবি ভেরলেন গুলি ছুঁড়েছিলেন। নিজেকে খুন করেন হেমিংওয়ে। তারপর……

কবি-সাহিত্যিকরাও মানুষ। তাদের কেউ অপরাধী হতেও পারেন। মহাকবি বাল্মীকি প্রথম জীবনে দস্যু ছিলেন। সোক্রাতেস বলেছিলেন, আমি সাংঘাতিক ক্রিমিন্যাল হতে পারতুম। কিন্তু ইচ্ছাশক্তির জোরে নিজেকে দার্শনিক করে ফেললুম। তো কথা হচ্ছে, সুব্রত কেন পার্সটা ঢোকাল টিনির ব্লাউসে?

আমাদের ভুল পথে চালাতে।

কর্নেল চোখ বুজে বললেন, দ্যাট মে বি আ পয়েন্ট। কিন্তু…..মাই গুডনেস! হঠাৎ নড়ে উঠলেন কর্নেল। অরিজিৎ! গির্জার পেছনের দেবদারু গাছের মাথাতেও শকুনের বাসা আবিষ্কার করেছি আজ!

আবার শকুনতত্ত্ব! চলি।

আন্ডারটেকার ডেভিড প্যাটার্সনকে ওই কবরখানার কেয়ারটেকার করা হয়েছে। কর্নেল হাসলেন। অদ্ভুত ব্যাপার, উনি আনন্দের সঙ্গে চাকরিটা নিয়েছেন।

শুনেছি। কিন্তু অদ্ভুত বলছেন কেন?

 ডেভিড বলতেন শয়তানের ডেরা। সেই ডেরাতেই এবার উনি প্রহরী!

উপরি রোজগার। ওঁর বউ নাকি আন্ডারটেকার সোসাইটির হেড হয়েছেন!

অরিজিৎ লাহিড়ী উঠলেন। যাবার সময় বলে গেলেন, কোট একজিবিট আপনার জিম্মায় রইল–ওই পার্সটা পরে ফেরত চাইব।

অরিজিৎ বেরুনোর একটু পরে হালদারমশাইয়ের আবির্ভাব ঘটল। বসেই বললেন, বাস্! ভূত, ভূত, ভূত! কী সর্বনেশে জায়গা কর্নেলস্যার! ষষ্ঠীকে বলুন, বেশি দুধ দিয়ে কড়া কফি। মাথা ভোঁ ভোঁ করছে।

ষষ্ঠী হালদারমশাইকে দেখলেই অস্থির হয়। সে কফি আনতে দৌডুল। কর্নেল বললেন, রাত্রে ছিলেন নাকি কবরখানায়?

সারা রাত! হালদারমশাই করুণমুখে বললেন। হালার মশায়…..সরি কর্নেলস্যার, মসকুইটো! একেকখানা রকেট। এফোঁড় ওফোঁড় করে বেরিয়ে যায়। এই দেখুন, শরীরের অবস্থা!

আপনার কষ্টের জন্য দুঃখিত, হালদারমশাই!

 কিছু কষ্ট না। পুলিশের চাকরিতে কত মশা দেখেছি। এ কী মশা? বলে তিনি নস্যি নিলেন। ফাঁচ করে হেসে ফের বললেন, সায়েব তো সন্ধ্যাবেলা কেটে পড়ল। তখন ঢুকলুম। গির্জার পাশের ঘরের বারান্দায় পাগল শুয়ে আছে নাকি। অনেক রাতে গির্জার ভেতর রহস্যজনক শব্দ। টর্চের আলো। গুঁড়ি মেরে ঝোপের আড়ালে বসলুম। তিনজন লোক স্যার, আঙুল দেখালেন হালদারমশাই। একজন তাগড়াই, একজন বেঁটে, একজন মাঝারি। অন্ধকারে কিছু বোঝা গেল না। তার ওপর হঠাৎ টিপটিপ করে বৃষ্টি। ওদের একজন গেটের কাছে, একজন গির্জার জানালার ধারে, আরেকজন জানালা গলিয়ে গির্জার ভেতরে। কতক্ষণ পরে বেরিয়ে বলল, নাথিং। নেহি মিলা!

হু, তারপর?

তারপর চলে গেল। বলে ষষ্ঠীর হাত থেকে কফি গ্রহণ করলেন হালদারমশাই। কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন, ভোররাত্তিরে বাড়ি ফিরলুম। স্নান করে হেভি ব্রেকফাস্ট খেয়ে বেরিয়েছি। এবার বলুন, আর দরকার আছে নাকি কবরখানায় নজর রাখার?

না। এই যথেষ্ট। কর্নেল নিভন্ত চুরুট ধরালেন।

 হালদারমশাই বললেন, কিন্তু ওরা কী খুঁজছিল?

 একটা দামী ফলক। পাথরটাও দামী।

 হ। বুঝছি।

 বুঝে থাকলে আর একটা দায়িত্ব দেব হালদারমশাই!

স্বচ্ছন্দে। হালদারমশাই ফুঁ দিয়ে কফি খাচ্ছিলেন। চুমুক দিয়ে বললেন, প্রাণ দিয়া দিমু কর্নেলস্যার কইলে। সেই সঙ্গে ফ্যাচ করে হাসি।

কর্নেল একটা কাগজ নিয়ে নকশা এঁকে বললেন, চন্দননগরের বাইরে এই এলাকা। ইভনিং লজ নামে এই পুরানো বাড়ি। এই হলো গঙ্গার ধারে বটতলা। এখানে বসে বাড়িটার দিকে নজর রাখতে হবে। কে কেমন চেহারার লোক যাতায়াত করছে, তার ডিটেল জানতে চাই। শুধু সাবধান, ওই বাড়িতে কাল্লু নামে একটা লোক আছে। সে খুনে প্রকৃতির। পরনে হাফপ্যান্ট আর গেঞ্জি। পালক দিয়ে কান চুলকোনো অভ্যাস। আবার বলছি, সে সাংঘাতিক লোক।

তাচ্ছিল্য করে হালদারমশাই বললেন, পুলিশলাইফে কত সাংঘাতিক লোকেরে দেখছি, কর্নেলস্যার! ভাববেন না।

ছদ্মবেশের দরকার হবে এবারও।

ঠিক করেই ফেলেছি। সাধু সেজে গঙ্গার ধারে বটতলায় ধুনি জ্বেলে বসব। ব্যস!

দারুণ!

হালদারমশাই সোৎসাহে চলে গেলেন।…

.

সুব্রত টিনিকে কবরখানায় রাতে যেতে বলেছিল। গোমেশের হাত দিয়ে চিঠি পাঠিয়েছিল।

নাকি গোমেশের কাছে চিঠিটা রেখে এসেছিল?

খুব চিন্তাযোগ্য পয়েন্ট এটা। গোমেশ টিনিদের বাড়ি গিয়েছিল। চিঠিটা দিতেই কি গিয়েছিল?

তা হলে গোমেশ চিঠি ছিঁড়ে ওয়েস্টপেপার বাস্কেটে ফেলবে কেন?

গোমেশ চিঠি দিতে টিনির কাছে নাকি অন্য কারণে গিয়েছিল? সুব্রত এবং টিনি প্রায়ই কবরখানায় যেত প্রেম করতে, এটা বোঝা যায়।

নাকি ছেঁড়া চিঠি জোড়তাপ্পি দিতে ভুল হয়েছে কর্নেলের? রাতে যেতে বলেছিল, না নিষেধ করেছিল? গোমেশের ওয়েস্টপেপার বাস্কেটের বাকি টুকরোগুলি পেলে ব্যাপারটা পরিষ্কার হতো। গোমেশ সেগুলি পুড়িয়ে ফেলে।…..

কর্নেল গাড়ির ব্রেক কষলেন বক্তির ভেতর। দুটো বাজে। উজ্জ্বল রোদ। গাড়ির কাছে উৎসুক একদল ছেলেমেয়ে ভিড় করল। কর্নেল তাদের মধ্যে লজেন্স চকলেট হরির লুঠ দিয়ে বলেন, তোমরা এই গাড়ি পাহারা দেবে। কেমন? ফিরে এসে আবার লজেন্স-চকোলেট!

ছেলেমেয়েরা খুব খুশিতে হাসতে লাগল। বয়স্ক লোকেরাও আমোদ পাচ্ছিল। সে রাতে এসে টিনিদের বাড়ি চিনে গেছেন কর্নেল। পোড়ো জমি, খোলা ড্রেন, আর এই পানের দোকান।

বেলা দুটোয় কারও সাহস হবে না তার ওপর হামলা করতে। তবু সাবধানে চারদিক দেখে নিলেন কর্নেল। বয়স্কদের উদ্দেশে বললেন, হম্ সি এম ডি এ সে আতা হ্যায় ভাই! ইয়ে মহল্লাকা ডেভালাপমেন্ট কাম হোনে লগে।

এতে কাজ হলো। যুবকেরাও এসে ভিড় করল। নানা অভিযোগ তাদের। কর্নেল সব নোট করার ভঙ্গি করলেন নোটবইতে। তারপর পা বাড়ালেন পোড়ো জমিটার দিকে। দলটি তাকে অনুসরণ করছিল। বললেন, ঠিক হ্যায়। হম্‌ উও ড্রেন দেখনে যাতা ভাই! আপলোগোনে গাড়িকি পাশ ওয়েট কিজিয়ে!

তবু জনাকয়েক উৎসাহী যুবক তার সঙ্গ ছাড়ল না। তাদের মধ্যে বাঙালি অর্ধশিক্ষিত যুবকরাও আছে। তারা বিপ্লবী কথাবার্তা বলতে থাকল। কর্নেল একতলা বাড়িটার দিকে আঙুল তুলে বললেন, ও বাড়িটা কার?

একজন বলল, একটা খারাপ মেয়েছেলের স্যার! মার্ডার হয়ে গেছে।

কে থাকে বাড়িতে?

ওর মা থাকত, স্যার। আর থাকত যুদ্ধে নামে একটা লোক। সে হাজতে।

অপর একজন বলল, যুধোটাকে জামিনে ছেড়ে দিয়েছে। ভোরবেলা দেখলুম, রিকশো করে আসছে। পুলিশ হাড় ভেঙে দিয়েছে। খোঁড়াচ্ছে।

সবাই হাসতে লাগল। কর্নেল বুঝলেন, বস্তিবাসীদেরও কড়া নীতিবোধ আছে এবং টিনি ছিল চক্ষুশূল। কর্নেল বললেন, ড্রেনটা বাড়িটার ধারে। একটা প্রবলেম। যাই হোক, দেখি বাড়ির লোকেরা কী বলে।

একজন বলল, টিনির মা তো দুপুরে পাড়া ছেড়ে কোথায় চলে গেল স্যার! কোন মুখে আর এখানে থাকবে? যুবধা আছে।

টিনির মা চলে গেছেন? কর্নেল একটু চিন্তিত হলেন। বললেন,  তা হলে আপনাদের ওই যুধোর সঙ্গে কথা বলতে হয়।

আপনি যান স্যার! ও বাড়িতে আমরা কেউ যাই না। আর যুধোর কথা বলছেন? ও শালা এক ঢ্যামনা স্যার। টিনিকে তো খারাপ রাস্তা সে-ই দেখিয়েছিল।

আরেকজন বলল, হমলোগ জানতা স্যার। যুবধা বহত খারাপ আদমি। টিনিকো রোজ এক বারমে লেকে যাতা শালালোগ। টিনি নাচতি উঁহাপর! খারাব ছোঁকরি থি।

কর্নেল ড্রেন পরীক্ষার ছলে চোখে বাইনোকুলার রেখে এগিয়ে পিছিয়ে একটা ভঙ্গি করলেন। ক্যামেরায় শাটার টিপেও ছবি তোলার ভান করলেন। সবাই ভোলা ড্রেনের যাচ্ছেতাই নিন্দা শুরু করল। তাদের এবার বড় আশা, ড্রেনটার সংস্কার হবে।

এবার কর্নেল টিনিদের বাড়ির দরজায় কড়া নাড়লেন। পাশের ঘর খুলে একটা ভীত মুখ উঁকি দিল। লোগা, তোবড়ানো গাল, ঢ্যাঙা একটা লোক। ভিড়টা দূরে দাঁড়িয়ে আছে। মুখে ঘৃণার ছাপ।

কর্নেল বললেন, আপনি এ বাড়িতে থাকেন?

যুধিষ্ঠির তাঁর অমায়িক কণ্ঠস্বরে একটু আশ্বস্ত হলো। বলল, আপনি কে, স্যার?

আমি সি এম ডি এ থেকে আসছি। এই ড্রেনটা….

যুধিষ্ঠির বেরিয়ে নমস্কার করে বলল, ড্রেনটা খুব, নোংরা স্যার! ওটা ঢাকা দিলে ভাল হয়।

তাকে পুলিশ পীড়ন করেছে বোঝা যাচ্ছিল। কর্নেলের আফসোস হচ্ছিল, অরিজিৎকে একটু বলে দিলে ভাল হতো। যুধিষ্ঠিরের মুখ দেখে মনে হয়, সে তত কিছু খারাপ লোক নয়। কর্নেল বললেন, আপনি কি অসুস্থ?

যুধিষ্ঠির করুণ হাসল। না, স্যার। গরিবের কপাল। অসুস্থ করে নি। ভগবান আছেন, এর বিচার করবেন। খামোকা পুলিশ আমাকে ধরে নিয়ে গেল। তারপর…..

পুলিশ? সে কী! কেন?

কর্নেলের কণ্ঠস্বরে সহানুভূতি টের পেয়ে যুধিষ্ঠির চোখ মুছে বলল, দয়া করে যদি ভেতরে আসেন স্যার, সব বলছি। আপনি আমাকে কাইন্ডলি একটু হেল্প করুন স্যার। আমি গরিব লোক টুকিটাকি কাজকর্ম করি। মেদিনীপুরে আমার ফ্যামিলি। তাদের আনলে বুড়ো বাবা-মাকে কে দেখবে? অতগুলো লোকের তো জায়গা হবে না এই ছোট্ট ঘরে। আসুন স্যার দয়া করে।

ঘরটা ছোট্ট। নেহাতই ঘর। পলেস্তারাখসা দেয়াল। কালিঝুলিতে ভর্তি। একটা খাটিয়ায় বিছানা। ঘরেই কুকার জ্বেলে রাঁধা হয়। সামান্য তৈজস। দেয়ালে কয়েকটা দেবদেবীর ক্যালেন্ডার। একটা তাকে সবই বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের দোকানের মিস্ত্রির নানারকম হাতিয়ার। একটা চটের থলেয় ভর্তি।

কর্নেলকে সে খাটিয়ার পাশে একটা ফোল্ডিং চেয়ার পেতে দিল বসতে। কর্নেল বললেন, পুলিশে ধরল কেন আপনাকে?।

যুধিষ্ঠির যা বলল, তার সারমর্ম হলো……

 টিনির বাবা মধুবাবু ছিলেন ছোট ব্যবসায়ী। তাঁর সঙ্গে পরিচয় ছিল। যুধিষ্ঠিরের। হঠাৎ স্ট্রোকে মধুবাবু মারা যান। ব্যবসা কে দেখবে? দোকানে উঠে যায়। যুধিষ্ঠির এসে টিনিদের মাথার ওপর দাঁড়ায়। এই যে বাড়িটা টিকে আছে তা যুধিষ্ঠিরের জোরে। টিনির মা ন্যালাভোলা মেয়ে। কত মারোয়াড়ি এসে, টাকার লোভ দেখাত। টিনির মা বাড়ি বেচে দিতে এক পা ছিলেন। এ পাড়ায় থাকার ইচ্ছে ছিল না তার। না থাকারই কথা। যুধিষ্ঠিরও কি থাকতে চায়? যত মস্তান-চোর-ডাকাতের মহল্লা। তো, বাড়ি বেচলে সেই টাকায় ভাল এরিয়ায় মাটিটুকু মাত্র কেনা যাবে। বাড়ি আর উঠবে না। যুধিষ্ঠির বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বাড়িবেচা ঠেকিয়েছিল।

এবার টিনির কথা।

 টিনি স্কুল ফাইনালে পরপর দুবার ফেল করল। তবে গানের গলাটা ছিল ভাল। এ পাড়ার ক্লাবে ফাংশন হলে নাচ-গাইত। সেউ সূত্রে পাশের পাড়ার একটা ছেলের সঙ্গে ভাব হলো। ছেলেটাকে যুধিষ্ঠিরের ভাল মনে হতো। এখন বুঝতে পেরেছে, ভাল ছেলে ছিল না। সেই টিনিকে বারে গাইতে নিয়ে যায়। যুধিষ্ঠিরকে টিনির মা অনুরোধ করেন, রোজ যেন কাজের জায়গায় পৌঁছে দিয়ে আসে এবং নিয়ে আসে। যুধিষ্ঠির সামান্য টাকা পেত এজন্য। তারপর যুধিষ্ঠিরের খটকা লাগে। মাঝে মাঝে টিনির কাছে এক সায়েব লোক আসে কেন?

কর্নেল জানতে চাইলে যুধিষ্ঠির বলল, শক্ত চেহারার গুফো লোক। টিনিকে জিগ্যেস করলে বলত, অন্য একটা বারের মালিক। সেখান গাইলে বেশি টাকা পাবে। তা টিনি যাচ্ছে না কেন? টিনি বলেছিল, তা হলে হারামজাদা যোশেফ তাকে খুন করবে।

কে যোশেফ?

যে বারে টিনি গাইতে যায়, তার মালিকের লোক। দত্যিদানোনার মতো চেহারা। অ্যাংলো সায়েব। এদিকে দিশি সেই সায়েব লোক সম্পর্কে টিনির কাছে যুধিষ্ঠির বেশি কথা জানতে চাইলে টিনি খেপে যেত। বলত, তোমার ও নিয়ে মাথা ঘামানোর কী দরকার? তবে টিনির মুখে তার নাম শুনেছিল একদিন যুধিষ্ঠির। ড্যা……ড্যা…..ড্যাং সায়েব না কী নাম।

ড্যানি?

আজ্ঞে স্যার! ড্যানি।

বেশ। তারপর?

সেই ছেলেটা স্যার রোজ রাত্তিরে টিনিকে নিয়ে আসার সময় একটা কবরখানার গেটে অপেক্ষা করত। টিনি বলত, তুমি একটু অপেক্ষা করো। আসছি। বলে দুজনে কবরখানায় ঢুকত। যুধিষ্ঠিরের নাকের ডগা কুঁচকে গেল ঘেন্নায়।

ছেলেটার নাম কী?

 সুব্রত, স্যার। লম্পট! লম্পটের ধাড়ি হারামজাদা!

কবরখানায় তো কেয়ারটেকার আছে। সে নিষেধ করত না?

গোমেশসায়েব? সে-ও তো টিনির কাছে আসত মাঝে মাঝে। যুধিষ্ঠির মাথা নেড়ে বলল ফের, কী একটা গণ্ডগোলে জড়িয়ে গিয়েছিল মেয়েটা। কিছু বুঝতে পারছি না স্যার। খামোকা পুলিশ আমাকে…..

এসব কথা কি পুলিশকে বলেছেন?

সব বলেছি। বলব না কেন? যা জানি, সব বলে দিয়েছি।

কর্নেল গুম হয়ে গেলেন। অরিজিৎ তাঁকে এসব তথ্য গোপন করল কেন? তার সঙ্গে বুদ্ধির পাঞ্জা কষতে চায়? একটু ক্ষুব্ধ হলেন কর্নেল। এমনটি আরও একটা কেসে করেছিল। শেষে বলেছিল, দুষ্টুমি। বৃদ্ধ ঘুঘুমশাইয়ের সঙ্গে মগজের লড়াই করতে একটু সাধ জাগে। কর্নেল হেসে ফেললেন।

হাসলেন কেন স্যার?

 পুলিশের কাণ্ড ভেবে।

পুলিশ স্যার মাথামোটা। খালি ডাণ্ডা চেনে। খামোকা আমাকে….. যুধিষ্ঠির আবার চোখ মুছল।

টিনি খুন হয়েছে শুনলুম?

হয়েছে। হতোই। যুধিষ্ঠির ক্ষুব্ধভাবে বলল। আসল কথাটা বলে দিই স্যার! পুলিশকে বলিনি! বললে আরও ঠ্যাঙানি দিত আমাকে। ভাবত আমিও এর সঙ্গে আছি। বলে ফিসফিস করল, গোমেশসায়েব, ড্যানিসায়েব, সুব্রত আর টিনি কবরখানায় পাথর চুরির কারবার করত স্যার। ড্যানিসায়েবের বারটার নেই। আমি স্বচক্ষে দেখেছি, ড্যানিসায়েব কবরখানায় গোমেশসায়েবের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিল এক রাত্রে। সুব্রত গেটের কাছে দাঁড়িয়ে ছিল। টিনি তার সঙ্গে কবরখানায় ঢুকল। আমি কী আর করি, গেলুম গোমেশ সায়েবের সঙ্গে গল্প করতে। গিয়ে দেখি ঘরের ভেতর ড্যানি আর গোমেশ। চুপিচুপি শুনলুম, পাথরের দরাদরি হচ্ছে। দামী পাথর স্যার!

যুধিষ্ঠির কথাটি বলেই ফেস করে শ্বাস ছাড়ল। ফের বলল, পুলিশ ধরুক না ড্যানিসায়েবকে। সাধ্যি আছে? বড়লোকের সব দোষ টাকার জোরে মাপ। খামোকা গরিবের ওপর অত্যাচার ভগবান এ কি সইবেন?

বলে সে করজোড়ে ঠাকুরের উদ্দেশে নমো করল।

 টিনির মা চলে গেলেন কেন?

যুধিষ্ঠির বলল, ড্যানিসায়েব এসে নিয়ে গেছে। ভাল ফ্ল্যাট দিয়েছে। টিনির মা বলল, যুধোদা, তুমি বাড়িতে থেকে পাহারা দেবে। বাড়ি বেচে দেব। তোমাকে টাকা দেব, ভেবো না। স্যার, আর একটা গাড়ি নিয়ে এসেছিল ড্যানিসায়েব। টেম্পোগাড়ি স্যার! জিনিসপত্র নিয়ে গেল টিনির মা।

কর্নেল উঠে পড়লেন। যুধিষ্ঠিরের মুখ দেখে একবার মনে হলো, সত্যি কথা বলছে আমার মনে হলো, মিথ্যা বলছে। লোকটি নিরীহ এবং সরল, নাকি গভীর জলের মাছ? দামী পাথর নিয়ে দরাদরি করছিলেন গোমেশ! গোমেশকে তা হলে ড্যানি মারবে কেন?

সেদিন রাতে কর্নেল আবার চার্লস গ্রিয়ার্সনের অ্যাডভেঞ্চার কাহিনী খুঁটিয়ে পড়ছেন, রাত দশটা পনের বাজে। টেলিফোন বাজল। অভ্যাসমতো ফোন তুলে সাড়া দিলেন।

মহিলাকণ্ঠে কথা ভেসে এল, টু নাইন সিক্স থ্রি নাইন ফাইভ?

ইয়া, ম্যাডাম।

প্লিজ হোল্ড অন! আ ট্রাঙ্ক কল ফ্রম ডালটনগঞ্জ।

কর্নেল জোরে সাড়া দিলেন। জয়ন্ত নাকি? হ্যালো ডার্লিং! হঠাৎ অমৃতসর ছেড়ে….

আমি সুব্রত চৌধুরি।

হোয়াট?

সুব্রত, কর্নেল! ডালটনগঞ্জ থেকে বলছি। একটা কথা…..।

 সুব্রত, তুমি পালিয়ে বেড়াচ্ছ কেন?

আমার কিছু কথা আছে। ফোনে বলা যাবে না। আপনি বেতলা ফরেস্টের ওখানে কোয়েল নদীর ধারে আসুন। একা আসবেন। জঙ্গল জায়গা। পুলিশ আনলে আমি গা ঢাকা দেব। মদনরাজার কেল্লার পুবে জঙ্গলের ঢালে। একা। পরশু বিকেল পাঁচটা থেকে ছটা অব্দি অপেক্ষা করব।

এত ভয় কেন, সুব্রত?

কারণ আছে। আসুন। বলব। আপনাকে জানি বলেই…

 হ্যালো! হ্যালো! হ্যালো!

লাইন কেটে গেছে। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেও আর রিং হলো না। কর্নেল উত্তজনায় দাড়িতে আঙুলে চিরুনি টানতে শুরু করলেন। আশ্চর্য ছেলে তো সুব্রত! অত দূরে এঁকে ডাকল কেন?

কিন্তু ডেকেছে যখন, তখন যেতেই হবে। কর্নেল আপন মনে একটু হাসলেন। যাবার আগে অবশ্য একটু মার্কেটিং করতে হবে। কিছু কেনাকাটা করে কিছু উপহার নিয়ে যাবেন। রাঁচি হয়ে যাওয়াই ভাল। রাঁচিতে তার বন্ধু আছেন মেজর তারাপদ ভৌমিক। তার জিপ পাওয়া যাবে। হাওড়া-হাতিয়া এক্সপ্রেস রাত সাড়ে আটটায়। রাঁচি পৌঁছুবে সকাল নটা নাগাদ। মেজর ভৌমিক না থাকলে ওখানে বেতলা যাওয়ার গাড়ি ভাড়া পাওয়া যায়।

বেতলা রিজার্ভ ফরেস্টের স্মৃতিতে আচ্ছন্ন হলেন কর্নেল। ক্রমশ উত্তেজনা থিতিয়ে স্মৃতির মাধুর্য ফিরে এল। ডিসেম্বরের কুয়াশা-ঢাকা ভোরে মেজর ভৌমিকের সঙ্গে ভ্রমণ। জলাশয়ে বাষ্পের মতো কুয়াশার উত্থান, বড় মায়াময়। ওখানে একটা সিঙ্কোনা-ফার্ম আছে। বাঁ দিকের জঙ্গলে একটা হায়েনা দেখেছিলেন। হায়েনার চোখের বিস্ময় মনে পড়ে যায়। সে-ও কি কর্নেলকে দেখে ক্রিসমাসের সান্তা ক্লস ভেবেছিল? মদনরাজার কেল্লার ভেতর মসজিদ। সেখানে দাঁড়িয়ে হাতিদের ডাল ভাঙার শব্দ শুনতে পেয়েছিলেন।

এই অক্টোবরে জঙ্গল ঘন সবুজ হয়ে উঠেছে।….

সকালে শূন্যোদ্যান থেকে নেমে আসার পর ডেভিড প্যাটার্সনের আবির্ভাব ঘটল। খুব উত্তেজিত চেহারা। হাঁফাচ্ছেন। কর্নেল বললেন, কী হয়েছে মিঃ ডেভিড? এনিথিং রং?

সার্টেনলি রং, কর্নেল!

হোয়াটস দ্যাট?

 ডেভিড কফির পেয়ালায় চুমুক দিয়ে বললেন, ওই কবরখানায় দিনদুপুরেই শয়তানের চেলার উপদ্রব। গির্জার ভেতর অদ্ভুত সব শব্দ। পল্টারজিস্ট! পল্টারজিস্ট!

জার্মান শব্দ পল্টারজিস্টের অর্থ, শব্দকারী ভূত-যে সবকিছু ফেলে দেয়। ভাঙচুর করে। কর্নেল মিটিমিটি হেসে বললেন, কখন?

এইমাত্র। আমি ট্যাক্সি দাঁড় করিয়ে রেখেছি। বারবারাকে যেন বলবেন না। শুনলে আমাকে ব্যঙ্গবিদ্রুপে অস্থির করবে। কর্নেল!

ওকে। কিন্তু মিঃ ডেভিড, আপনি উঁকি মেরে দেখলেন না কেন?

 দেখেছি। কিছু নেই।

 ভেতরে ঢুকেছিলেন গির্জার?

 ঢুকতে যাচ্ছি, কী একটা পড়ল গালে। অদৃশ্য হাতের থাপ্পড়।

চামচিকে বা পাখি নয় তো?

 গালটা দেখুন! ডেভিড বা গাল এগিয়ে দিলেন। এখনও জ্বালা করছে।

কর্নেল পরীক্ষা করে দেখে কিছু পেলেন না। তবে গালটা লাল হয়ে আছে বটে। বললেন, সাহস, মিঃ ডেভিড, সাহস! সাহস এবং বাইবেলের আবৃত্তি। আপনি এখনই ফিরে যান। বাইবেল হাতে জানালা গলিয়ে ভেতরে ঢুকুন।

আপনি আমার সঙ্গে চলুন, প্লিজ! আমি একজন আন্ডারটেকার ছিলাম। কত মৃতদেহ গাড়িতে বয়ে নিয়ে গেছি। সকারের ব্যবস্থা করেছি। কখনও কোন আত্মা আমাকে জ্বালাতন করেনি। এ হচ্ছে শয়তানের চেলাদের কাজ। আপনি। চলুন।

আমি গিয়ে কী করব?

আমি কেয়ারটেকার। গির্জার ভেতর চার্চ সোসাইটির কিছু জিনিসপত্র আছে। সেগুলোর জন্য আমি দায়ী। ভেতরে ঢুকে দেখা দরকার কী অবস্থা হয়েছে। প্লিজ!

অগত্যা কর্নেল উঠলেন।

 ট্যাক্সি কবরখানায় দাঁড় করিয়ে রেখে কর্নেল বললেন, আমিই ভাড়া দেব, মিঃ ডেভিড। সামান্য ব্যাপার। এই ট্যাক্সিতেই ফিরতে চাই।

.

গির্জার পুবের সেই জানলাটা ভেতর থেকে যথারীতি আটকানো। খড়খড়ি ফঁক করে ছিটকিনি তুলে দিলেন কর্নেল। ডেভিড অবাক হয়ে বললেন, স্ট্রেইঞ্জ! আমি জানালা খোলা দেখেছিলাম।

ভেতরে গেলেন কর্নেল। ডেভিডও সাহস করে ঢুকলেন।

কর্নেলের প্রথমেই চোখ গেল বেদির পাশের সেই তাকে। বাইবেলগুলি নিচে পড়ে আছ। পুরনো বই। পাতা ছিঁড়ে মলাট ভেঙে পড়ে আছে। ডেভিড মাই গড বলে আর্তনাদ করে পবিত্র গ্রন্থগুলি গোছাতে ব্যস্ত হলেন।

সেই সময় কর্নেল দেখলেন ইংরেজি বাইবেলের কিং জেমস ভার্সনের ১৯১০ সালের সংস্করণটি দুভাগ হয়ে পড়ে আছে। তলায় একটুকরো কাগজ উঁকি দিচ্ছে। কাগজটা পকেটে ঢুকিয়ে বাইবেলটি তুলে রাখলেন।

ডেভিড বললেন, কী? কী?

স্যাটানিক ভার্সেস অথবা সদুপদেশ! কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন। কিংবা ধাঁধা।

দেখি, দেখি?

 বাইরে গিয়ে দেখাচ্ছি। কেতাবগুলো ঠিকমতো সাজিয়ে রাখুন।

গির্জাঘরের ভেতর ধুলোয় একই লোকের জুতোর অনেকগুলো ছাপ। আগের ছাপে ধুলো পড়ে মিলিয়ে গেছে। তার ওপর নতুন ছাপ।

বাইরে গিয়ে দেবদারুতলায় দাঁড়িয়ে কর্নেল কাগজটা বের করলেন। ডেভিড সাগ্রহে তার কাঁধের পাশ দিয়ে উঁকি দিলেন।

Vulgarity is a very common thing today.
 Ultimatium to then who commit nuisances!
 Learn what is good and what is bad.
 Turn your face towards the Heaven.
Understand what I say to thee.
 Remember what I said to thee.
 Even the foolish person will know the Truth.
 Satan is always following you, oh man!
Never submit your self to him.
Eden Garden from where you had fallen;
Say, I must go back to that place!
Turn your face towards the Heaven.

 ডেভিড একটু হেসে বললেন, কোনও ভক্ত খ্রীস্টানের উপদেশ। স্যাটানিক ভার্সের্স নয়।

ঠিক তাই। বলে কর্নেল কাগজটা পকেটে ঢোকালেন। তারপর বাইনোকুলারে পুবের দিকটা লক্ষ্য করতে থাকলেন।

এইমাত্র কে ভাঙা পাঁচিল গলিয়ে রেলইয়ার্ডের দিকে নামল। শুধু মাথার পেছনটা এক পলকের জন্য দেখা গেল।

কর্নেল হন্তদন্ত হয়ে সেখানে পৌঁছুলেন। সঙ্গে ডেভিড। তিনি ভীষণ উত্তেজিত। বারবার জিজ্ঞেস করছেন, হোয়াটস দ্যাট? হোয়াটস দ্যাট? কর্নেল জবাব দিচ্ছেন না।

আজ রেলইয়ার্ডে অসংখ্য মালগাড়ি। তেমন কাউকে দেখা গেল না।

বাড়ি ফিরে কর্নেল কাগজটা নিয়ে বসলেন। হুঁ, ডেভিড ঠিকই বলেছেন, কোনো ভক্ত খ্রীস্টানের সদুপদেশ। কোনও পাদ্রিসায়েবেরই হয়তো।

কিন্তু কাগজটা পুরনো হলেও লেখাটা খুব পুরনো মনে হচ্ছে না। হস্তাক্ষর আঁকাবাঁকা দ্রুত লেখা। ডটপেনে লেখা। বাংলা করলে মোটামুটি এই মানে দাঁড়ায় :

অশ্লীলতা আজকাল খুব সাধারণ ব্যাপার।
 যারা অপকর্ম করে, তাদের প্রতি চূড়ান্ত হুঁশিয়ারি,
 মুখ ফেরাও স্বর্গলোকের দিকে।
 বুঝে নাও কী তোমায় বলছি।
স্মরণ করো কী তোমায় বলেছি।
এমন কি, বোকারাও সত্যকে জানতে পারবে।
হে মানুষ, শয়তান সবসময় তোমার পিছনে।
 তার কাছে কদাপি বশ মেনো না।
নন্দনকানন থেকে তুমি পড়েছিলে।
বল, আমি আবার ফিরে যাবোই সেখানে।
মুখ ফেরাও স্বর্গলোকের দিকে।

 হুঁ, ধর্মভীরু কোনও মানুষের উপদেশ। গোমেশের কি? তা হলে বলতে হবে, এটা তার নিজের প্রতি হুঁশিয়ারি। খ্রীস্টানদের মধ্যে পাপ বিষয়ে স্বীকারোক্তি। বা কনফেসন-প্রথা চালু। এটা কনফেসন হওয়াই সম্ভব।

কর্নেল কাগজটা ড্রয়ারে রেখে রেলের টাইম-টেবিলের পাতা ওল্টাতে থাকলেন। আজ রাতেই রাঁচি রওনা হওয়া দরকার। নির্জন অরণ্যে কোয়েল নদীর তীরে কী কথা বলবে ফেরারি আসামী সুব্রত চৌধুরি, জানার জন্য মন চঞ্চল হয়ে উঠেছে।

আবার ভাবলেন, কোনও ফঁদ নয় তো? শরীর একটু শিউরে উঠল। উত্তেজনাটা থিতু হয়ে এলে ঠিক করলেন, আগে ট্রাংক কলে রাঁচিতে মেজর ভৌমিকের সঙ্গে সব কথা খোলাখুলি আলোচনা করে নেওয়া দরকার।……

.

০৬.

 গঙ্গার পাড়ে বটতলায় এক সাধুবাবা ধুনি জ্বেলে বসে আছেন, এটা নতুন কোনও দৃশ্য নয়। হাজার-হাজার বছর ধরে পবিত্র নদী গঙ্গার সঙ্গে সাধুসন্ন্যাসীদের অস্তিত্ব ঐতিহ্যানুগত। তাকে পুরনো বাঙালি শাস্ত্রকারের উক্তি, গঙ্গার পশ্চিম কূল/বারাণসী সমতুল।

সাধুবাবার পাশে একটা ত্রিশূল পোঁতা এবং ডগায় একফালি লাল কাপড় এলোমেলো উড়ছে। বাবার পরনে বাঘছাল। আসন হরিণের চামড়ার। চেহারাটি দেখলে গা ছমছম করে ভয়ে ও ভক্তিতে। তবে এদিকটায় বসতি কম। শুধু জঙ্গল, ধ্বংসস্তূপ। ঐতিহাসিক কিংবদন্তি, এখানেই ছিল মোগল ফৌজদার গুরগন খায়ের সামরিক ঘাঁটি। পরে একটা গঞ্জ হয়ে ওঠে। ফরাসিরা মোগল বাদশাহের কাছে জায়গির পেয়েছিল। আঠারোশতকে ফরাসি সায়েব কুঠিয়ালদের ডেরা ছিল এখানটাতেই। ইংরেজরা ছিল ফরাসিদের শত্রু। মুর্শিদাবাদের নবাব ফরাসিদের সহায়। ইংরেজরা এঁটে উঠতে পারত না। পরে নাকি গঙ্গার ভাঙনে ফরাসিদের গঞ্জ খানিকটা ভাটিতে সরে যায়।

সাধুবাবা ইতিহাস পড়েই এসেছেন। চোখ বুজে আসন করে বসেছেন। মাঝে মাঝে হুঙ্কার ছাড়ছেন, ব্যোম কালী! বাবা শৈবও বটেন, শাক্তও বটেন। যিনি শিব, তিনিই কালী। কয়েকজন স্নানার্থী-স্নানার্থিনীর চোখে পড়েছিল ব্যাপারটা। তারা হাউসিং কলোনির বাসিন্দা এবং বয়স্ক মানুষ। করজোড়ে এবং সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে গেলেন। সাধুবাবা উদাত্ত স্বরে আওড়াচ্ছিলেন :

কস্তুরিকাঁচনলেপনায়ৈঃ শ্মশান
ভস্মাঙ্গ বিলেপনায় চ।
সকুণ্ডলায়ৈঃ মণিকুণ্ডলনায় নমঃ
শিবায়ৈ চ নমঃ শিবায় ॥

সবাই চলে গেলেন। কিন্তু ইভনিং ভিলার কান্দু বসে রইল। সাধুবাবা চোখ কটমটিয়ে বললেন, কৌন বে শালে?

কাল্লু গাঁজা প্রসাদ পাওয়ার লোভে এসেছিল। কিন্তু সাধুবাবা কিছুতেই প্রথা অনুসারে ছিলিম বের করছেন না। কাল্লু করজোড়ে বলল, বাবা, আমি কাল্প।

তু ম্লেচ্ছ খ্রীস্টানবাড়িকি নোকর আছিস? ভাগ, ভাগ।

 না বাবা! ও বাড়িতে থাকি এইমাত্র। আমি হিন্দুর ছেলে বাবা! কাল্লু ভক্তিতে-করুণ হয়ে বলল। পোড়া পেটের দায়ে নোকরি করি। গঙ্গাজলে না। চান করে কি এসেছি আপনার চরণদর্শনে? মাইরি! আপনার দিব্যি।

সাধুবাবা একটু নরম হয়ে বললেন, কিন্তু হুঙ্কারটা জমল না।

তেরা নাম কী আছে বেটা?

আজ্ঞে, হারাধন পাত্র। ডাকনাম কাল্লু। সবাই আমাকে কাল্লু বলে।

সাধুবাবা ব্যোম কালী হুঙ্কার ছেড়ে বললেন, বেটা কাল্লু! হা দেখতা, তেরা বহুত দুর্ভাগ্য হ্যায়! উও কোঠি খ্রীস্টান ম্লেচ্ছ লোকের কোঠি আছে। হম্ .. ইয়ে ভি দেখতা পাতা কি উও কোঠিমে বহত পাপ হ্যায়।

কাল্লু একটু ভড়কে গিয়ে বলল, কী পাপ দেখতা হ্যায়, বাবা?

সাধুবাবা জটা দুলিয়ে হাসলেন। তুভি পাপী হ্যায়। আবে, ম্যায় ত্রিকালজ্ঞ হু।

কাল্লু আরও ভড়কাল। বাবা, মাইরি বলছি, আমি হুকুমের নোকর। ড্যাং সায়েব যা বলে, তা না মানলে নোকরি তো যাবেই, জেলও খাটতে হবে।

কৌন উও ড্যাংসায়েব?

হিন্দু ছিল, বাবা! মেমসায়েব বে করে খেরেস্তান হয়েছে। তাই ওঁর মামা রায়সাহেব খুব চটে আছে। কিন্তু চটলে কী হবে? সেয়ানে-সেয়ানে কোলাকুলি। কাল্লু ফিসফিস করে বলল, চোরাই মাল বেচে, বাবা!

সাধুবাবা আবার হুঙ্কার ছাড়লেন, ব্যোম কালী!

কাল্লু একটু উসখুস করে বলল, একটু প্রসাদ পাই বাবা। আজ্ঞা হোক!

আবে যা যা! ভাগ! ম্যয় রাতমে কারণবারি পিউঙ্গা! ইয়ে মড়াকা খুলিমে। রাতমে আ যা! বলে সাধুবাবা মড়ার খুলিটি দেখালেন!

কাল্লু একগাল হেসে বলল, হুকুম হলে আমি এনে দেব বাবা। খাঁটি বিলিতি কারণবারি। ইচের বোতল ড্যাংসায়েবের ঘরে আছে।

আবে শালে! ম্যয় ম্লেচ্ছ কারণবারি নেহি পিউঙ্গি! সাধুবাবা বাঁকা মুখে বললেন।

কাল্লু দাঁত বের করে বলল, বাবা, শিবের জটা চলে না?

ক্যা?

কাল্লু হাতের তালুতে গাঁজা ডলার ভঙ্গি করে হাসতে লাগল।

যত সাধুবাবা দেখেছি, সব্বাই শিবের জটা আনেন। খাঁটি পাহাড়ি মুল্লুকের মাল। আপনি আনেননি বাবা?

সাধুবাবা অট্টহাসি হাসলেন। জরুর আনা! লেকিন তুঝকো নেহি দেউঙ্গি!

কেন বাবা?

তু পাপী আছে। উও পাপপুরী আছে। ম্যয় ত্রিকালজ্ঞ হু! উও কোঠিমে বহত চোট্টালোক আনাযানা করত।

কাল্লু চাপা গলায় ব্যস্তভাবে বলল, এখন আর আসে না। কদিন আগে দুদুটো মাডার হলো। পুলিশ…..

মার্ডার!

আপনি ত্রিকালজ্ঞ পুরুষ। আপনি সবই জানেন। তবে পুলিশ ধানি দিয়েছে সায়েবকে। এদিকে মেমসায়েবও ধাতাচ্ছেন। ওঁর দিদি এলে বিহিত করবেন বলে শাসাচ্ছেন। খুব ঝগড়া, বাবা, খু-উ-ব! কাল্লু খ্যাখ্যা করে হাসতে লাগল।

সাধুবাবা ভুরু কুঁচকে বলেন, কোন মার্ডার কিয়া?

তা জানি না। তবে ড্যাংসায়েব পেছনে আছে।

কিসকো মার্ডার কিয়া? কাহাপর?

কলকাতায়। দুদুটো…. কাল্লু থেমে গেল। ইভনিং ভিলার জানালায় ড্যানি ঘোষের মুখ। সে উঠে দাঁড়িয়ে বলল ফের, রাত্তিরে এসে কারণবারি প্রসাদ পাই যেন বাবা! আমি খানিক শিবের জটাও আনব। পাহাড়ি মুল্লুকের চেয়ে সরেস জিনিস। দুটোকে মেশালে জম্পেশ হবে, বাবা!

সাধুবাবা হুঙ্কার ছাড়লেন, ব্যোম কালী। ব্যোম! ব্যোম ভোলা! ব্যোম!

কাল্লু চলে গেল। তখন সাধুবাবা এদিক-ওদিক তাকিয়ে ডটপেন আর নোটবই বের করলেন আসনের তলা থেকে। খচখচ করে লিখলেন, টু মার্ডারস ইন ক্যালকাট্টা! ড্যানি ঘোষ।…..

চিৎপুরের যাত্রার সাজের দোকানে নকল বাগছাল, হরিণের চামড়ার আসন, মড়ার খুলি এবং ত্রিশূল, কিনেছিলেন গোয়েন্দা কে কে হালদার। সারাটা দিন বৃথা গেল। তেমন সন্দেহজনক কাউকে দেখতে পেলেন না ড্যানি ঘোষের বাড়ি ঢুকতে। এই কাল্লু সম্পর্কে সাবধান করেছিলেন কর্নেল। কিন্তু নেহাত গোবেচারা মনে হচ্ছে।

তবে সমস্যা হলো, রাতে ব্যাটাচ্ছেলে গাঁজার প্রসাদ চাইলেই বিপদ। একপাত্তর স্কচ হুইস্কিতে আপত্তিতে নেই হালদারমশাইয়ের। কিন্তু গাঁজা বড্ড বাজে জিনিস।

দুপুরে এক ভক্ত একগাদা আপেল আর এক ঘটি দুধ দিয়ে গেছেন। খিদেয় পেট চনচন করছে। রাত্তিরটা কাটিয়ে চলে যাবেন। তেমন সন্দেহজনক কিছু দেখছেন না।

সন্ধ্যার মুখে একদঙ্গল ভক্ত এসে প্রণাম করে গেল কলোনি থেকে। আড়চোখে দেখলেন, সব মিলিয়ে যা প্রণামী পড়েছে, তাতে চিৎপুরের যাত্রার সাজের দোকানে কেনা জিনিসগুলোর দাম প্রায় উসুল হয়ে যাবে। এটাই আনন্দের কথা।

ভিড় হটিয়ে হুঙ্কার দিলেন, ম্যয় ধেয়ান করুঙ্গা। আভি মুঝকো একেলা রহনে দে। যাঃ! যা সব! ভাগ, ভাগ!

ভক্তরা কেটে পড়ল। অদূরে একটা শ্মশান। সেখানে হরিধ্বনি শোনা যাচ্ছিল। কেমন গা ছমছম করে।

একটু পরে ইভনিং ভিলার সামনে মোটরগাড়ির আলোর ছটা। সাধুবাবা ঝটপট নোটবই পেন বের করলেন। বাড়িটার গেটের মাথায় আলো আছে। এক দিশি সাহেব নামলেন। চেহারার বর্ণনা নোট করে নিলেন।

ধুনির আগুন উসকে দিলেন। শুকনো কাঠকুটোর অভাব নেই এখানে। কিছুক্ষণ পরে কাল্লু এল। মুখে একগাল হাসি। সাষ্টাঙ্গে নমো করে বসল। হাফপ্যান্টের পকেট থেকে গাঁজার পুরিয়া বের করল এবং কাঁধের ঝোলা থেকে সত্যিই একটা স্কচের বোতল।

বলল, আগে প্রসাদ করুন বাবা!

সাধুবাবা বোতল খুলে মড়ার খুলিতে একটু র স্কচ ঢেলে চোখ বুজে গিললেন। গলা জ্বলে গেল। এমন গণ্ডগোলে কখনও পড়েননি। কিন্তু ওইটুকুতেই মাথা টলছে। খালি পেটে স্কচ! গলা ঝেড়ে হুঙ্কার দলেন, ব্যোম কালী! কিন্তু হুঙ্কারটা জমল না।

কাল্লু গাঁজার পুরিয়া এগিয়ে দিয়ে বলল, ছুঁয়ে দেন বাবা! আমি মাল তৈরি করি। আপনি ছিলিম বের করুন।

কী বিপদ! ছিলিমের কথা মনে ছিল না সাধুবাবার। দরকার হবে মনে হয়নি আসলে। তাছাড়া গাঁজা খাওয়া…..সর্বনাশ! হুঙ্কার ছেড়ে বললেন, ছিলম গঙ্গামাইজি লে লিয়ি! তু খা। হম্‌ নেহি পিউঙ্গা! মাইজিকি মানা হ্যায়।

কাল্লু গাঁজা ডলতে উলতে বলল, তবে আপনি কারণবারি খান, বাবা। খান, খান। তবেই তো ধ্যানে মন বসবে।

পাছে কাল্লু সন্দেহ করে, আরেক চুমুক র স্কচ টানতে হলো। মাথার ভেতরটা কেমন করছে। তবে স্ফূর্তি হচ্ছে খুব। ঘনঘন হুঙ্কার ছাড়লেন সাধুবাবা, ব্যোম! ব্যোম কালী! ব্যোম! ব্যোম ভোলা!

স্কচের নেশা বেশ টান ধরায়। ঝোঁকের মাথায় আরও এক চুমুক এবং হুঙ্কার। তারপর চোখ নাচিয়ে বললেন, ঔর এক পাপী আয়া তোরা কোঠিমে। কৌন হ্যায় বে?

ড্যাংসায়েবের মামা রায়সায়েব। মামাভাগ্নে মাল টানছে আর তক্ক হচ্ছে।

কি নিয়ে?

কাল্লু ছিলিম এগিয়ে ধরল দুহাতে। চিমটে নেই? বলে সে নিজেই একটুকরো অঙ্গার ধুনি থেকে তুলে ছিলিমে রাখল এবং বলল, প্রসাদ, বাবা! প্রসাদ!

নেশার ঝোঁকে সাধুবাবা ছিলিম নিয়ে এক টান দিলেন। তারপর কী হতে থাকল, বুঝতে পারছিলেন না। মনে হলো, শূন্যে ভেসে চলেছেন। কখনও মনে হলো, পাতালে তলিয়ে যাচ্ছেন। আবার মনে হলো, উড়ে বেড়াচ্ছেন আকাশে….

.

 চোখ খুলে কিছুক্ষণ বুঝতে পারলেন না হালদারমশাই, কোথায় আছেন। ঘুলঘুলি দিয়ে আলো আসছে। কিছুক্ষণ পরে দৃষ্টি স্বচ্ছ হলো। কিন্তু শরীরে ব্যথা। একটা ঘুপচি ঘরের মেঝেয় শুয়ে আছেন। হাত এবং পা দুটো শক্ত করে বাঁধা। তারপর সব মনে পড়ল।

কিন্তু পরনে খালি জাঙ্গিয়া! ঝুলিতে পোশাক ছিল। অতিকষ্টে ডাকলেন, কাল্লু! বেটা কালুয়া!

দরজা খুলে গেল। কালুয়া ঢুকল। ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দিল সে। আতঙ্কে।– হালদারমশাই দেখলেন, তার হাতে একটা চাকু। বললেন, কী বে শালা টিকিটিকি? জ্ঞানবুদ্ধি হলো? নাকি এক খোঁচা দেব?

হুঁ, ধূর্ত কাল্লুর কাছে ধরা পড়ে গেছেন। নেশা করিয়ে তাকে অচেতন অবস্থায় এখানে এনে ফেলে রেখেছে। হালদারমশাই কাতরস্বরে বলল, ইয়ে ক্যা হ্যায় বেটা?

চুপ শালা! এখনও ন্যাকামি? বলে কাল্লু তার পাশে বসে গলায় ছুরির ডগা ঠেকাল। ড্যাংসায়েবের চোখরে ফাঁকি দেবে? আমি না হয় বোকা। ড্যাংসায়েব ঠিকই ধরেছে। দেব শ্বাসনালী ছেঁদা করে?

হালদারমশাই আঁ আঁ করে উঠলেন আতঙ্কে।

এই সময় দরজা খুলে ড্যানি ঘোষ ঢুকল। দরজা বন্ধ করে বলল, জ্ঞান ফিরেছে শালার?

কাল্লু বলল, হ্যা! ষোল ঘণ্টা কেটে গেল। তিন বালতি জল ঢেলেছি গায়ে।

খুনখারাবি করিসনে। ওকে তুলে বসা। জেরা করে দেখি।

কাল্লু হাত-পায়ের বাঁধন খুলে গোয়েন্দাকে দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসাল। গোয়েন্দা বললেন, বিশ্বাস করুন, আমি পুলিশের লোক নই।

নোস। তুই প্রাইভেট ডিটেকটিভ কে কে হালদার। ঝুলিতে তোর আইডেন্টিটি কার্ড আর রিভলবার পেয়েছি। ড্যানি ঘোষ বলল, শুওরের বাচ্চা! কাল তোকে আমি হায়ার করতে গণেশ অ্যাভেনিউতে তোর অফিসে গিয়েছিলাম। ভেবেছিলুম, মোটা ফি দিয়ে তোকে কাজে লাগাব। বল, কে তোকে অ্যাপয়েন্ট করেছে? ডেভিড হারামি? না অন্য কেউ?

হালদারমশাই বললেন, ডেভিড কে আমি চিনি না, মিঃ ঘোষ!

 চুপ। সত্যিকথা ব?

কর্নেলসায়েব। বিশ্বাস করুন, কর্নেল নীলাদ্রি সরকার…

হু! তা-ই বটে। বুড়ো ঘুঘুকে ফাঁদে ফেলেছি এবার। শিগগির ওর ডেডবডি দেখবি।

হালদারমশাই হাসবার চেষ্টা করে বললেন, মুশকিল করে দিল বুড়া। আমার আপত্তি নাই ঘোসায়েব। তবে কথা দিচ্ছি, বিনা ফি-তে আপনার কাম করুম। কন, কী করতে হইব?

চার্লস গ্রিয়ার্সনের কবরের ফলক কোথায় আছে জানিস?

ড্যানি ঘোষ প্রশ্নটা করেই কাল্লুকে ইশারা করল। কাক্কু আবার গোয়েন্দার গলায় ছুরি ঠেকাল। গোয়েন্দা ছটফট করে বললেন, মা কালীর দিব্যি! কী কন, কিছু বুঝি না। বুড়া আমারে কিছু কইয়া দেয় নাই। শুধু কইছিল, বাড়ির দিকে নজর রাখবা। ঘোষসায়েব, প্লিজ! বিশ্বাস করেন।

ফের চালাকি? বল্, ফলক কোথায়?

মাইরি আপনার দিব্যি, আমারে বুড়া কিছু কয় নাই।

কাল্লু!

ইশারা পেয়ে কাল্লু ছুরির ডগায় একটু চাপ দিল। হালদারমশাই আর্তনাদ করলেন, গেছিরে বাবা! গেছি! গেছি!

অমনি ভেজানো দরজা খুলে গেল এবং এমার আবির্ভাব ঘটল। সে ক্রুদ্ধ স্বরে বলল, ড্যানি! হোয়াটারায়ু ডুইং? দিস ইজ মাই লাস্ট ওয়ার্নিং, ইফ ইউ ডোন্ট স্টপ দিজ শর্টস অফ ন্যাস্টি থিংস, আই মাস্ট…..

এমা!

 শাট আপ! আই অ্যাম গোয়িং টু কল দা পোলিস!

 এমা! ডোন্ট ইন্টারফেয়ার!

আই মাস্ট! আই মাস্ট নট টলারেট….ইট ইজ বিয়ন্ড মাইই টলারেশন! লেট মাই সিস্টার কাম ব্যাক।

ড্যানি ঘোষ নরম হয়ে বলল, প্লিজ এমা!

 নো। লেট হিম গো ফ্রি!

বাট হি উইল গো টু দা পোলিস। অ্যান্ড গেস, হোয়াট উইল হ্যাপন।

হালদারমশাই বললেন, আমারে হায়ার করুন! আমারে হায়ার করুন। আমি ফলক উদ্ধার করিয়া দিমু! আই অ্যাম আ প্রাইভেট ডিটেকটিভ ম্যাডাম! বলে তিনি মেমসায়েবকে সেলামও ঠুকলেন।

এমা দাঁতমুখ খিঁচিয়ে বলল, শাট আপ! ইউ আর আ ফুল! গিভ আপ দা প্রফেশন! গো অ্যান্ড ওয়াশ দা ফিট অব ইওর ওয়াইফ।

রাগ হজম করলেন গোয়েন্দা। বউয়ের পা ধুইয়ে দিতে বলছে ট্যাস ফিরিঙ্গি মেয়ে। ফিরে গিয়ে দেখাচ্ছি মজা! কে কার পা ধুইয়ে দেয়।

তবে মুক্তি পাওয়া গেল। মেমসায়েব টেনে তুলে বের করে দিল ঘর থেকে। বেরিয়ে গোয়েন্দা করজোড়ে বললেন, ঘোষসায়েব, দয়া করে আমার ঝুলিটা…।

মেমসায়েব হাসি চেপে জাঙ্গিয়া-পরা গোয়েন্দাকে কটাক্ষ করে পাশের ঘরে চুকল। ড্যানি ঘোষ বলল, ভাগ! ভাগ!

আমার রিভলবারটা…..

 কাল্লু! এই বেড়ালটাকে জলে চুবিয়ে দে!

কাল্লু ছুরি হাতে এগিয়ে এসে হালদারমশাইয়ের ঘেটি ধরল। গায়ে একফোঁটা জোর নেই। নয় তো এই হাফপ্যান্ট গেঞ্জি-পরা নেংটি ইঁদুরকে কুপোকাত করে ছাড়তেন। কী আর করা যাবে!

কিন্তু সত্যি কি জলে চুবোতে নিয়ে যাচ্ছে কাল্লু? থামলেই পিঠে ছুরির খোঁচা। কেটে-ছড়ে গেল হয়তো। চিনচিন করছে।

সর্বনাশ! জাঙ্গিয়া-পরা হালদার মশাইকে ঠেলে গঙ্গায় ফেলে দিল কাল্লু। দু হাত তুলে তিনি চিকুর ছাড়লেন, বাঁচাও! বাঁচাও!

অক্টোবরের ভরা গঙ্গা। নদীনালার দেশের মানুষ কে কে হালদার। সাঁতার জানেন। পুলিশে চাকরি করলেও সবই শিখতে হয়। কিন্তু গায়ে যে জোর নেই। মরিয়া হয়ে আবার চেঁচালেন, বাঁচাও! বাঁচাও!….

লালবাজার পুলিশ হেড কোয়াটার্সে ক্রাইম ব্রাঞ্চের ডি সি ডি ডি অরিজিৎ লাহিড়ী কার্ডটা দেখে বললেন, ডাকো! সাদা পোশাকের পুলিশ সেলাম ঠুকে বেরিয়ে গেল।

একটু পরে আগন্তুক ঢুকে সেলাম ঠুকলেন সামরিক কায়দায়। বোঝা গেল, মিলিটারি কায়দা-রপ্ত।

অরিজিৎ লাহিড়ী বললেন, হ্যাল্লো মিঃ প্যাটার্সন! বসুন। আশা করি, কোনও দুঃসংবাদ নিয়ে আসেননি কবরখানা থেকে?

ডেভিড প্যাটার্সন বসে বললেন, কর্নেল নেই। তাই আপনার দ্বারস্থ হলুম স্যার!

বলুন।

কবরখানায় দিনদুপুরে রহস্যময় কাণ্ড ঘটছে। আমার এবার মনে হচ্ছে, পুলিশ পাহারার ব্যবস্থা না থাকলেন আবার কী ঘটে যাবে। হয়তো আমিই…ঔ জেসাস! বলে বুকে ক্রস আঁকলেন ডেভিড।

কী ঘটছে?

ডেভিড গতকাল গির্জার ভেতর যা-যা ঘটেছিল, কর্নেলকে নিয়ে গিয়ে যা যা দেখিয়েছেন, সব ঘটনা ইনিয়েবিনিয়ে বর্ণনার পর আজকের ঘটনা শোনালেন। আজও একই ঘটনা। আজ বাড়তি সংযোজন হলো ঢিল। পাথরকুচি ছুড়ছিল ভূতেরা। ঘর থেকে বেরুতেই পারেননি ডেভিড। যখনই বেরুতে পা বাড়িয়েছেন, তখনই ঝাঁকে ঝাঁকে ঢিল। গিয়ে স্বচক্ষে দেখতে পারেন পুলিশের গোয়েন্দারা। এবার গির্জার সদর দরজার তালাও ভেঙেছে। ভেতরকার আসবাবপত্র ওলট পালট করেছে। জঙ্গুলে কবরখানা, তার ওপর সেকেল কবর সব। একেকটি খুদে স্থাপত্য। আড়ালে লোকজন চলাফেরা করলে বা ঘাপটি পাতলে দেখতে পাওয়া যায় না।

অরিজিৎ বললেন, ঠিক আছে। আবার পুলিশ মোতোয়েন করছি। আপনার সঙ্গেই পাঠাচ্ছি। আপনি বাইরে অপেক্ষা করুন।

ডেভিড বেরিয়ে গেলে অরিজিৎ কর্নেলের বাড়ি রিং করলেন। বৃদ্ধ প্রকৃতিবিদের কাল রাত্রি থেকে পাত্তা নেই। কিছু বলেও যাননি। বাইরে গেছে নাকি।

ষষ্ঠীচরণ ফোন ধরেই বলে দিল, বাবামশাই নেই! একশোবার লোকে জ্বালাতন করছে কাল রাত্তির থেকে। বলছি, নেই, নেই, নেই, নেই!

অরিজিৎ মুচকি হেসে বললেন, আমি নালবাজারের নাহিড়ীবাবু, ষষ্ঠী।

অমনি ষষ্ঠির স্বর বদলে গেল। আজ্ঞে স্যার, আপনি? নমস্কার স্যার! তা আগে বললে….স্যার, দোষ নেবেন না। কে একজন খালি জ্বালাতন করছে….তাই স্যার……

তোমার বাবামশাই কিছু বলে যাননি?

আজ্ঞে, না। আপনাকে বলে গেছেন ভাবছি। বলেননি?

 না তো!

স্যার, স্যার! হঠাৎ ষষ্ঠী উত্তেজিত হয়ে উঠল।

কী হলো, যষ্ঠী?

 বাবামশাই সত্যি রাঁচি যাননি তো?

 রাঁচি? রাঁচি কেন?

বাবামশাই ঠাট্টা করে বলেছিলেন, ষষ্ঠী, তুই বলিস আমি নাকি পাগল হয়ে যাচ্ছি। বিড়বিড় করে বকি। ঠিক বলেছিস! বলে বাবামশাই বললেন, এবার আমি রাঁচিই চলে যাব। সেখানে পাগলাগারদ আছে জানিস তো? আজ্ঞে স্যার, ভেবে দেখুন কথাটা।

ষষ্ঠী, তুমি বুদ্ধিমান। কবে এ কথা বলছিলেন কর্নেল?

আজ্ঞে, পরশু স্যার! গতকালকেও সন্ধ্যায় বেরুনোর সময় জিজ্ঞেস করলুম, কখন ফিরবেন। অমনি রাগ করে বললেন, পাগলাগারদে যাচ্ছি।– ঠিক আছে। হাসতে হাসতে ফোন রাখলেন অরিজিৎ লাহিড়ী। তারপর গম্ভীর হলেন। কর্নেল হঠাৎ নিপাত্তা হলেন কোথায়? ফের চন্দননগরের ওদিকে গিয়ে ড্যানি ঘোষের পাল্লায় পড়েননি তো? একটু উদ্বিগ্ন হলেন অরিজিৎ। ড্যানি ঘোষের রেকর্ড খারাপ। পুলিশ ওকে বহুদিন থেকে ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করছে। ধূর্ত লোক।

ডেভিডসায়েবের সঙ্গে সাদা পোশাকের একদল পুলিশ পাঠানোর ব্যবস্থা করে চন্দননগর থানায় ফোন করলেন অরিজিৎ। ও সি ভবেশ রুদ্র ফোন ধরলেন। ফোনেই সেলামবাজি করে বললেন, বলুন স্যার!

ভবেশবাবু, আপনি কি কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের নাম শুনেছেন?

 নামটা শুনেছি মনে হচ্ছে। তবে…

দ্যাখেননি?

 না স্যার! কেন….

সাদা দাড়ি, মাথায় টাক, প্রকাণ্ড মানুষ। গলায় বাইনোকুলার, ক্যামেরা ঝোলে। পাখি দেখা, প্রজাপতি ধরা, অর্কিড পাড়া বাতিক আছে। খ্রীসমাসের সান্তা ক্লজ! মাতায় কখনও টুপিও থাকে। ফর্সা রং। সায়েব বলে মনে হয়। খাঁটি বাঙালি। ভবেশবাবু, চন্দননগরের ব্রিটিশ এরিয়ায় বিস্তর গাছপালা আছে। ড্যানি ঘোষের বাড়ির কাছে……

স্যার! কর্নেলসায়েব ইদানীং দাড়ি কামাননি তো?

অসম্ভব।

স্যার, একটা লম্বা বডি গঙ্গা থেকে উদ্ধার করেছে লোকেরা। তবে ফর্সা নয়।

ডেডবডি?

 প্রায় সেই অবস্থা। হাসপাতালে আছেন। জাঙ্গিয়া-পরা বডি। মাঝে মাঝে জ্ঞান ফিরে বলছেন, রিভলবার। বড় মিসটিরিয়াস!

লম্বা নাক, শ্যামবর্ণ, ঢ্যাঙা?

হ্যাঁ, স্যার! সেই রকমই।

 গোঁফ নেই?।

 না তো।

 রিভলবার বলছেন?

হ্যাঁ। যখনই জ্ঞান ফিরছে, তখনই রিভলবার বলে ফের অজ্ঞান। এখানকার কেউ আইডেন্টিফাই করতে পারছে না।

ভবেশবাবু, নাকের পাশে জডুল আছে কি?

 আছে! আছে!

অরিজিৎ হাসতে লাগলেন।

 কী হলো স্যার?

ভবেশবাবু, তা হলে উনি প্রাইভেট ডিটেকটিভ কে কে হালদার। রিটায়ার্ড পুলিশ ইন্সপেক্টর। গণেশ অ্যাভেনিউতে হালদার ডিটেকটিভ এজেন্সি আছে ওঁর। কিন্তু আমি ভেবে পাচ্ছি না, উনি গঙ্গায় জাঙ্গিয়া পরে ঝাঁপ দিলেন কেন? এনিওয়ে, ওঁর সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করুন। তারপর জবানবন্দি নিয়ে অ্যাকশন নিন। সামথিং মিসটিরিয়াস হ্যাজ হ্যাঁপনড়। থরোলি ইনভেস্টিগেট। আমি টুচড়োয় পুলিশ সুপারকে অনুরোধ করছি।

ওকে স্যার!…

ফোন রেখে অরিজিৎ আবার হাসতে গিয়ে গম্ভীর হলেন। প্রাইভেট ডিটেকটিভ মাত্রেই ছিটগ্রস্ত, অথবা ছিটগ্রস্তরাই প্রাইভেট ডিটেকটিভ হন। দুই মেরুর দুই নিদর্শন, কর্নেল এবং হালদারমশাই। একজন হয়তো রাঁচি চলে গেলেন হঠাৎ, অন্যজন দিলেন জাঙ্গিয়া পরে গঙ্গায় ঝাঁপ! কী অদ্ভুত!….

.

চন্দননগর হাসপাতালে হালদারমশাই চোখ খুলে পিটপিট করে তাকালেন। সাদা সিলিং ফ্যান ঘুরছে। আলো জ্বলছে। তিনি কোথায়? কিছু মনে পড়ছে না।

হঠাৎ টের পেলেন নাকে কী ঢুকে আছে। বেজায় চটে গেলেন। তাঁর নাকে কী ঢুকিয়েছে কেউ। সুড়সুড় করছে। আধ মিনিট পরে কাল্লুর কথা মনে পড়ল। সেই ব্যাটাচ্ছেলের কাজ না হয়ে যায় না। খাপ্পা হয়ে নাক থেকে জিনিসটা হ্যাঁচকা টানে খুলে ফেললেন। উঠে বসলেন। নার্স হাঁ হাঁ করে দৌড়ে এলেন।

হালদারমশাই রাগী চোখে চারদিকটা দেখে নিয়ে বললেন, আমি এখানে ক্যান? আমার তো অন্যত্র থাকনের কথা। ব্যোম কালী! ব্যোম শিব!

নার্স ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে সিস্টারকে ডাকতে গেলেন। হালদারমশাই দেখলেন, তার পরনে পাজামা, গায়ে পাঞ্জাবি। ছ্যা ছ্যা! ফুঁসে উঠলেন, কোন হালায় এগুলান পরাইল?

তারপর বালিশের পাশেই নিজের সেই ঝুলিটি আবিষ্কার করলেন। ঝটপট হাত ঢুকিয়ে দেখলেন, রিভলবারটি রয়েছে। বের করে বললেন, গুলি করুম! সব হালারে গুলি করুম!

রোগীরা উঠে বসেছিল বেডে। পাশের বেডে স্যালাইন দেওয়া রোগীটিও ভয়ে চোখের কোনা দিয়ে তাকাল। সিস্টার, নার্সের বাহিনী, জমাদার-জমাদারনি ছুটে আসছিলেন। থমকে দাঁড়ালেন জলে-ডোবা রোগীর হাতে রিভলবার দেখে। এক তরুণ ডাক্তার তক্ষুণি ব্যস্তভাবে পুলিশে ফোন করতে ব্যস্ত হলেন। মুখে তার প্রচণ্ড আতঙ্ক।

হঠাৎ হালদারমশাই ফাঁচ করে হাসলেন। পাওয়া গেছে। পাওয়া গেছে। বলে ঝুলিতে হাত ভরে নস্যির ডিবেটি খুঁজে বের করলেন। রিভলবার ঝুলিতে ঢুকিয়ে দুটিপ নস্যি নিয়ে বিকট হাঁচার সঙ্গে সঙ্গে তার মগজ পরিষ্কার হয়ে গেল।

সিস্টার এবং হাসপাতালবাহিনী সাহস করে কাছে এলেন। সিস্টার বললেন, প্লিজ! আপনি শুয়ে থাকুন। আপনার এখনও অক্সিজেন দরকার!

হালদারমশাই পুনঃ ফাঁচ করলেন। ব্রেন ইজ ক্লিয়ার নাও! আই অ্যাম কে কে হালদার, দা ফেমাস প্রাইভেট ডিটেকটিভ! আই মাস্ট গো নাও টু দা পোলিস! বলে উঠে দাঁড়ালেন।

জমাদাররা ধরে শুইয়ে দিতে এলেন শাসিয়ে বললেন ফেল, ডোন্ট টাচ! রিভলবার বের করুম।

তারা ভয়ে সরে গেল। সিস্টার নার্সকে বললেন, এই ব্যাগটা এল কোত্থেকে? কখন কে আনল জানো ঊষা?

নার্স করুণস্বরে বললেন, একটা লোক কিছুক্ষণ আগে এসে রেখে গেল। বলল, আমি ওঁর আত্মীয়।

তুমি দেখলে না ওতে কী আছে?

নার্স আরও করুণস্বরে বললেন, ভাবলুম খাবার-টাবার আছে। হাসপাতালে বাইরের খাবার তো রোগীদের জন্য অ্যালাউড।

হালদারমশাই বললেন, বাথরুম কোথায়? এই বেটপ পাঞ্জাবি-পাজামার নিকুচি করেছে। আমার ড্রেস পরব। ছ্যা ছ্যা ছা।

বলে নিজেই বাথরুম আবিষ্কার করে সটান গিয়ে ঢুকলেন। একটু পরে প্যান্ট-শার্ট পরে বেরিয়ে এসে পাঞ্জাবি-পাজামা ছুঁড়ে ফেললেন। বললেন, যাই গিয়া! ডাক্তারবাবুরা, সিস্টার বোন, নার্স বোনটি, সক্কলেরে আমার বিদায় নমস্কার। আমি কৃতজ্ঞ। তবে কেউ বাধা দেবার চেষ্টা করলে….. বলে রিভলবার বের করলেন। আবার আতঙ্কের হিড়িক পড়ে গেল। পুলিশ আসতে বড্ড দেরি করছে। ডাক্তার এখনও ফোনের কাছে।

রিভলবার তাক করে পিছু হটে বেরিয়ে গেলেন হালদারমশাই। সবে সন্ধ্যা নেমেছে। বাইরে গিয়ে একটা রিকশা ডেকে বললেন, স্টেশন!…

.

রাত সাড়ে নটায় দরজা খুলে ষষ্ঠীচরণ হালদারমশাইকে দেখে হাসি চাপল। ওঁকে দেখলেই তার হাসি পায়। সে বলল, বাবামশাই তো গতকাল থেকে বাইরে।

হালদারমশাই সোজা ড্রইংরুমে ঢুকে সোফায় বসে বললেন, কফি ভাইটি! কড়া কফি আর প্রচুর দুধ। আগে চাঙ্গা হই, তারপর মা গঙ্গার কথা। বাপস্! ভাগ্যিস বাবা ভোলার নাম জপছিলুম, তাই মা গঙ্গা ভয় পেয়ে…..ফোঁচ। অর্থাৎ হাসি।

ষষ্ঠী, যেতে যেতে ঘুরে বলল, হালদারমশাই, আপনার গোঁফ?

কাটছিলাম! হালদারমশাই গোঁফের জায়গায় হাত বুলিয়ে বললেন, একবার-না, একবার নয়, দুবার সাধু সেজে অভিজ্ঞতা হয়েছে। গোঁফে গোঁফ আটকে যায়। যাক সে কথা। আগে কফি, পরে কথা।

কিছুক্ষণের মধ্যেই ষষ্ঠীচরণ হালদারমশাইয়ের জন্য বিশেষ কফি আনল। উনি চুমুক দিয়ে বললেন, ফার্স্ট ক্লাস! এবার বলো ভাইটি, কর্নেলস্যারের খবর কী?

ষষ্ঠী বলল, বাবুমশাই কি কখনও বলে যান? তবে এবার যেন মনে হলো রাঁচি যাচ্ছেন। আচ্ছা হালদারমশাই, রাঁচিতে পাগলাগারদ আছে না?

আছে। তবে কর্নেলস্যার পাগলাগারদে যদি যান, তা হলে জানবে কোনও  পেয়েছেন। কবরখানায় যে মাইয়াডা খুন হইছে, সেই খুনী পাগলাগারদে পাগল সেজে আছে। সিওর!

হালদারমশাই! আজ ডেভিডসায়েব এসেছিলেন কবরখানায় থাকেন বললেন, ডেভিডসায়েব। সেখানে আবার কী ভুতুড়ে ব্যাপার হয়েছে। তো…

হালদারমশাই বললেন, এক্ষুণি যাচ্ছি। ভূতৈর বাপের শ্রাদ্ধ করিয়া দিমু, দেখবা।

ষষ্ঠী মনে করিয়ে দিল, আপনার গোঁফ?।

কইলাম না গোঁফে গোঁফ আটকাইয়া যায়! গোঁফ গেছে, গোঁফ গজাবে। ভেবো না।

বলে কফি শেষ করে বেরিয়ে পড়লেন হালদারমশাই। এবার লক্ষ্য ইস্টার্ন সাব-আর্বান সিমেট্রি, যেখানে পাগল সেজে ঘুরেছেন। সব চেনা হয়ে গেছে একদিনেই।

পৌঁছুতে ঘণ্টাখানেক লেগে গেল। কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ উঠেছে। কিন্তু মেঘও– আছে। রেলইয়ার্ড ঘুরে সেই ভাঙা পাঁচিল গলিয়ে কবরখানায় ঢুকলেন।

চুপিচুপি কবর ও ঝোঁপজঙ্গলের আড়ালে এগিয়ে গির্জার কাছে গেলেন। কারা ওপাশে চাপাস্বরে কথা বলছে। গেটের কাছে দুজন বন্দুকধারী পুলিশ রয়েছে। তাদের এদিকে দৃষ্টি নেই। খৈনি ডলছে।

কিন্তু কথা বলছে কারা? রহস্যময় ব্যাপার। রিভলবার বের করে পা টিপে টিপে গুঁড়ি মেরে এগিয়ে গেলেন। কেয়ারটেকারের ঘরের বারান্দায় আলো জ্বলছে। লোক নেই।

লোক নেই, অথচ কথা শোনা যাচ্ছে। আরও রহস্যময় ব্যাপার।

দেবদারু গাছের পেছনে যেতেই তাঁর ওপর টর্চের আলো পড়ল। আচম্বিতে। তারপরই পেছন থেকে কেউ তাকে ধরে ফেলল। মুচড়ে রিভলবার কেড়ে নিল। হালদারমশাই চেঁচালেন, পুলিশ! পুলিশ!

ততক্ষণে তাঁকে ঠেলতে ঠেলতে কেয়ারটেকারের ঘরের সামনে নিয়ে গেছে হামলাকারীরা। হালদারমশাই অবাক। পুলিশরক্ষীরা ঘুরেও তাকাল না! হাল ছেড়ে দিলেন হালদারমশাই।

কেয়ারটেকার ডেভিড বেরিয়ে বললেন, সোয়াইন! ব্লাডি! রাস্কেল!

হালদারমশাই চটে গিয়ে বললেন, ইউ সোয়াইন! ইউ ব্লাডি! ইউ রাস্কেল!

সাদা পোশাকের পুলিশ তার ঘাড়ে থাবা হাঁকড়ে বলল, চো-ও-প বে শালে! চোট্টা!

হালদারমশাই বললেন, শাট আপ! তুম জানতা হম্‌ কৌন হ্যায়? প্রাইভেট ডিটেকটিভ কে কে হালদার!

আবে কৌন হালদার? তেরা বাপকো আভি ডিটেকটিভ দেখা দুঙ্গা! বৈঠ!

হালদারমশাই অবাক হয়ে বললেন, ভুল হয়ে গেছে। ভুল হয়ে গেছে! সেমসাইড!

সাদা পোশাকের দ্বিতীয় পুলিশ তার চুল খামচে ধরে বলল, চো-ও-প! বৈঠ শালে লোক।…

.

০৭.

 রাঁচির গর্ণেশলাল লেনে মেজর তারাপদ ভৌমিকের বাড়ি। দোতলার বারান্দার পাশেই একটি পাইনগাছ। সকালের ট্রেনে স্টেশনে পৌঁছুনোর পর মেজর ভৌমিক তার গাড়িতে কর্নেলকে নিয়ে এসেছেন। ব্রেকফাস্ট খাওয়ার পর কফি। কফির পর চুরুট। দুই বন্ধুর অনেক দিন পরে দেখা। প্রথমে খোশগল্প, তারপর পাইনগাছটির কথা উঠেছিল। কর্নেল বলেছিলেন, আশ্চর্য আপনার দক্ষতা মেজর ভৌমিক! পাইনগাছ! ভাবা যায় না। বিশেষ করে এত বড় ধাইনগাছ!

 মেজর সগর্বে বলেছিলেন, শিলংও উঁচু জায়গায়, রাঁচিও তাই। আমি জেদ ধরেছিলুম, এখানকার মাটিতেও এই সিকুইয়া পাইন কেন হবে না? হলো।

এসব আলোচনার পর বেতলা জঙ্গলের প্রসঙ্গ উঠল। কোয়েল নদী,, মদনরাজার কেল্লা নিয়ে অনেক আলোচনা হলো। তারপর কর্নেল বললেন, ট্রাঙ্ক করে সুব্রত কথা বলল। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সুব্রতই কথা বলল কি না আমি নিশ্চিত নই। একবার শোনা গলা। সেই গলার স্বর মনে থাকলেও ট্রাঙ্ক কলে সুদূর ডালটনগঞ্জ থেকে সেই গলা সনাক্ত করা কঠিন। কাজেই….. বলে তিনি অট্টহাসি হাসলেন।

মেজর উৎসুক হয়ে বললেন, কাজেই?

আমার লগেজে একটা আশ্চর্য জিনিস এনেছি। দেখাচ্ছি। কুমোরটুলির প্রখ্যাত এক মৃৎশিল্পীর তৈরি। আপনি অবাক হয়ে যাবেন দেখলে।

বলে তিনি লগেজ আনলেন ঘর থেকে। খুলতেই বেরিয়ে পড়ল ভাজকরা কিছু খোলজাতীয় জিনিস। একটা মুণ্ড। কর্নেল সবগুলো জোড়া দিয়ে বললেন, কাকে দেখছেন?

অবাক মেজর বললেন, মাই গুডনেস! ইট ইজ ইউ!

হ্যাঁ, আমি। সরি, মাই ডামি। কেমন চমৎকার নকল কর্নেল নীলাদ্রি সরকার, বলুন?

অসাধারণ। কিন্তু…..

কিন্তু কী?

ভেঙে যাবে না হ্যান্ডল করতে?

ভাঙেনি। ভাঙবে না। কারণ প্লাস্টার অফ প্যারিস আর শোলার তৈরি। এবার দেখুন শোলার তৈরি বাইনোকুলার দুহাতে চোখে ঠেকিয়ে দিচ্ছি। পেছনে সুতো দেখছেন। ষাট গজ গম্বা নাইনলের সুতো। পুতুলনাচ তো দেখেছেন। এই সুতো ধরে দূর থেকে টানলে ডামি মূর্তির দুহাতে ধরা শোলার বাইনোকুলার চোখে উঠে আটকে যাবে। সুতো ঢিলে করলে গলা থেকে খুলে পড়বে।

আপনার বুদ্ধির প্রশংসা নতুন করে করার নয়। তবু বলব, আপনি টেক্কা দিয়েছেন। মেজর হাসতে হাসতে বললেন, কিন্তু যদি ওটা সত্যি শত্রুপক্ষের ফাঁদ হয়, তারা আপনার সঙ্গে কথা বলবে আগে। ডামি কথা না বললে সন্দেহ হবে।

কর্নেল মিটিমিটি হেসে বললেন, ডামিও কথা বলবে! দেখবেন?

আপনার রহস্য বোঝা কঠিন।

রহস্য নয় মেজর ভৌমিক! খুব সোজা পরিকল্পনা। ওখানে পাথর আর ঘন জঙ্গল আছে দেখেছি। অসুবিধে হবে না।

এগারোটার মধ্যে দুই বন্ধুতে খেয়েদেয়ে রওনা হলেন। প্রায় দেড়শো মাইল রাস্তা। অপূর্ব দৃশ্য মাঝে মাঝে। জঙ্গল, পাহাড়, ছোট্ট বাজার। পালামৌ জেলায় পালামৌ রেঞ্জের পাহাড় পেরুনোর সময় দার্জিলিং এলাকার কথা মনে পড়ে যায়। নীচে বিস্তীর্ণ জঙ্গল। পাহাড়ের গা বেয়ে ঘুরে ঘুরে রাস্তা চলেছে চড়াই থেকে উত্রাই।

ডাল্টনগঞ্জগামী রাস্তার মোড়ে বাঁ দিকে ঘুরল গাড়ি। বেতলা আর মাত্র কয়েক মাইল। কোয়েল ব্রিজ পেরিয়ে গিয়ে বেতলা এলাকা। দুধারে টিলা পাহাড়, ঘন জঙ্গল।

বেতলায় একটা বেসরকারি লজে ঘর পাওয়া গেল। প্রায় সাড়ে তিনটে বাজে। ফরেস্ট বাংলোর কাছে পিচ রাস্তার ধারে একটা দোকানে অখাদ্য কফি খেয়ে কর্নেল এবং মেজর রুমে ফিরলেন। তারপর মদনরাজার কেল্লার দিকে। রওনা হলেন গাড়ি নিয়ে।

ঘন জঙ্গলের ভেতর কেল্লার সামনের চত্বর ফঁকা। বাঁ দিকে ধ্বংসাবশেষের আড়ালে গাড়ি লক করে রেখে দুজনে বোঁচকাটি নিয়ে জঙ্গলে ঢুকলেন।

কোয়েল নদীর তীরে জঙ্গলে পাথরের প্রকাণ্ড চাই ইতস্তত। তার আড়ালে বসে কর্নেল ঝটঝট ডামিটি জোড়া দিলেন। গুঁড়ি মেরে দুজনে ডামিটিকে ঠেলতে ঠেলতে (যেন হেঁটে চলেছেন কর্নেল) নিয়ে গেলেন নদীর ধারে বালির চড়া থেকে উঁচিয়ে ওঠা একটা পাথরের কাছে। সেই পাথরে ডামিটি বসানো হলো। তখন সাড়ে চারটে বাজে। বাতাস বইছিল। তাই ডামিটির দুধারে পাথর সেঁটে দিলেন কর্নেল। গুঁড়ি মেরে পিছিয়ে এসে ঝোপে বসলেন।

নদীর ওধার থেকে বা দুপাশ থেকে দেখলে, এমন কি পেছন থেকে দেখলেও, কর্নেল বসে আছেন। মাঝে মাঝে সুতো টানলে ডামি কর্নেল চোখে বাইনোকুলার তুলে রাখছে দুহাতে। ঢিলে করলে হাত এবং বাইনোকুলার নামাচ্ছে। হালকা ওজনের পলকা ফোঁপরা মূর্তি।

পাঁচটা বেজে গেল দেখতে দেখতে। শরৎকালের বনভূমিতে এখনই অন্ধকার ছমছম করছে। কোয়েল নদী এখন ভরা। বুকে বড় বড় পাথর। চারদিকে পাখপাখালি তুমুল চ্যাঁচামেচি করছে। মাঝে মাঝে হনুমান-বাঁদর হুপহাপ, কিচমিচ করে ডাকছে। তারপর নদীর ওপার থেকে সম্বর হরিণের ডাক ভেসে এল, ঢাঁক! ঢাঁক!

ডামি কর্নেলের চোখে বাইনোকুলার উঠল। মিনিট তিনেক পরে বাঁ দিকে জঙ্গল ভেঙে দুটি লোক বেরুল। তাদের একজনের হাতে বন্দুক। সে একটা পাথরের আড়ালে দাঁড়িয়ে রইল। অন্যজন যুবক। চোখে সানগ্লাস। ডামির কাছে গিয়ে বলল, এসে গেছে তা হলে?

মেজর অবাক হয়ে শুনলেন, ডামি বাইনোকুলার নামিয়ে মুখ ঘুরিয়ে বলল, এস ডার্লিং, বলল তোমার কী কথা?

মেজর কর্নেলের দিকে তাকালেন। কর্নেল ঠোঁটে আঙুল রেখে চুপ করতে ইশারা করলেন।

আপনার গলার স্বর অমন কেন, কর্নেল?

 তোমার গলার স্বর অমন কেন, সুব্রত?

সানগ্লাস-পরা যুবকটি পেছনে ঘুরে বন্দুকবাজকে ইশারা করল। সে বন্দুক তুলল। তারপর গুলির শব্দ। কর্নেলের ডামি ডিগবাজি খেয়ে জলে পড়ে গেল। তীব্র স্রোতে ভেসে চলল ওলট-পালট হতে হতে। যুবক হাসল। চলো কুন্দন সিং! কাম ফতে! আভি ডালটনগঞ্জ যানা পড়ে। উহা বাস পাকাড় কর কলকাতা যায়েগা। সাবকা পাশ বাকি রুপৈয়া আদা করনে হোগা!

চলিয়ে।

মেজর ফিসফিস করে বললেন, ওদের ধরে ফেলা উচিত। শিগগির।

কর্নেল চাপাস্বরে বললেন, রিস্ক নেওয়ার দরকার নেই। ওরা সশস্ত্র। যেতে দিন। ভাড়াটে গুণ্ডা।

কিন্তু ডামি কথা বলল, এই রহস্যটা বোঝা যাচ্ছে না।

 কর্নেল মুচকি হাসলেন। সেফ ভেন্ট্রিলোকুইজম! স্বরজাদু। আমি এ বিদ্যাটা জানি। আপনি নিশ্চয় ম্যাজিকে কথা বলা পুতুল দেখেছেন?

মেজর শ্বাস ছেড়ে বললেন, তা-ই! আমি ভেবেছিলুম কোনও যন্ত্রট নাকি!

দুজনে সাবধানে মদনরাজার কেল্লায় ফিরলেন। তখন অন্ধকার ঘন হয়েছে জঙ্গলে। গাড়িটা আড়ালে রাখা ছিল। স্টার্ট দিয়ে মেজর বললেন, কী সর্বনেশে লোক। এ তল্লাটে বিস্তর ভাড়াটে খুনী পাওয়া যায় জানতুম। এই প্রথম স্বচক্ষে দেখলুম। কিন্তু ওরা গেল কোন পথে?

বেতলা গ্রামের দিকেই গেল মনে হচ্ছে। ফরেস্ট বাংলোর দক্ষিণে বেতলা গ্রাম।

হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন।

আমাদের এখনই রাঁচি ফিরতে হবে কিন্তু। আপনার কষ্ট হবে। আমি ড্রাইভ করব বরং।

মেজর হাসলেন। দুজনেই বুড়োমানুষ। তবে আমি ডাক্তার, ডোন্ট ফরগেট দ্যাট।

ষষ্ঠীচরণ দরজা খুলে সন্দিগ্ধ দৃষ্টে বাবামশাইকে দেখে তারপর ফিক করে হাসল। কর্নেল রাঁচি থেকে বাসে এসেছেন। চেহারায় ক্লান্তির ছাপ থাকা স্বাভাবিক। রুষ্ট হয়ে বললেন, হাসির কী আছে! কফি।

ষষ্ঠী তবু ফিকফিক করে হাসতে লাগল।

হাসি কেন রে হতভাগা? কর্নেল আয়নার সামনে গিয়ে নিজেকে দেখার চেষ্টা করে দাড়ি ঝেড়ে বললেন, আবার হাসি? তবে রে?

ষষ্ঠী কয়েক হাত পিছিয়ে গিয়ে বলল, বাবামশাই কি সত্যি রাঁচি গিছলেন?

 হুম্। আগে কফি।

আপনাকে ছেইড়ে দিলে?

 ছেইড়ে দিলে মানে?

আজ্ঞে, ওই যে গো, কিসের যেন গারদ আছে রাঁচিতে।

কর্নেল অট্টহাসি হেসে বললেন, ব্র্যাভো ডার্লিং! এতদিনে গাঁইয়া ভাব গিয়ে স্মার্ট হয়েছ। হুঁ, রসবোধও জন্মেছে। ভাল, ভাল। তবে আগে কফি।

ষষ্ঠীর কফি করতে সময় লাগে না। কর্নেল পোশাক বদলে বাথরুম সেরে ফিটফাট হয়ে আরামকেদারায় বসলেন। কফিও পেলেন। চুমুক দিয়ে বললেন, কিছু খবর আছে এ দুদিনের? বল, শুনি।

এবার ষষ্ঠী বেজার মুখে বলল, খালি ফোং ফোং আর ফোং! আবার কে? ওই…..

নালবাজারের নাহিড়ীসায়েব?

আজ্ঞে। তিনি তো বটেই। কাল আবার ডেভিডসায়েব এসে হাজির। ভূতে জ্বালাচ্ছে। আর….. ষষ্ঠী মাথা চুলকে স্মরণ করে বলল, হালদারমশাই! তাঁর দেখি গোঁফ নেই। খেকুঠে মড়ার মতো চেহারা। জল থেকে মড়া উঠে এসেছে যেন। তা, পরে…..হ্যাঁ, ফোং! কী যেন নাম যেন…পেটে আসছে, মুখে আসছে না……

সুব্রত চৌধুরি?

ষষ্ঠী জোরে মাথা নেড়ে বলল, না, না। মেয়েছেলে! নরম গলা।

সুরঞ্জনা দেবী, যাঁর মেয়ে খুন হয়েছে?

ধুস!! কা……কা…না, না! ক…ক…..কথা….কথা……তাপরে কী যেন, ক…কলি? নামটা কেমন যেন গোলমেলে। বিচ্ছিরি!

কথাকলি?

ষষ্ঠী দাঁত বের করল। আজ্ঞে, তা-ই। কথাকলি চ..চ……..চক্কবত্তিই হবে।

 কী বলেছিলি?

আপনার খোঁজ করছিল। আমি বললুম, নেই।

উঁহু, রাঁচি গেছি বলেছিলি!

ষষ্ঠী ফের দাঁত বের করল। তা হতে পারে। কী করব? খালি ফোং আর ফোং। তাই বলেও থাকতে পারি।

কথাকলি চক্কবত্তি কী বলল?

বললে সব্বোনাশ! মারা পড়বেন যে! শুনে আমি বললুম, বাবামশাইকে মারে এ সাধ্যি ভগবানেরও নেই।

তাই বললি?

বললুম। বলব বৈকি।

 হারে বুদ্ধ, মানুষ বুঝি মরে না?

 মরে। তবে আপনাকে মারে কে? বলে ষষ্ঠী পা বাড়াল।

 কর্নেল ডাকলেন, শোন হতভাগা!

 রান্না করিগে। মুখ দেখে মনে হচ্ছে, পেটে কিছু পড়েনি।

সবে সন্ধ্যা সাতটা বাজে। ডিনার খাব দশটায়। তুই শোন্!

 বলুন। বলে ষষ্ঠী সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল।

 কথাকলি চক্কবত্তি আর কী বলল?

ভেংচি কাটছেন। বলব না। আমি কি শুদু কথা বলতে পারিনে? চকরোবর্তী! হলো তো?

হলো। বল!

বললে, এক্ষুণি পুলিশে খবর দাও। কর্নেলসায়েবের বিপদ হতে পারে। আমি যত বলি, আমার বাবামশাই নোহার মানুষ তত বলে, বিপদ হবে। পুলিশে খবর দাও। তো কী করি, নালবাজারে…..

ফোন বাজল। কর্নেল ফোন তুলে সাড়া দিলেন। …..অরিজিৎ! হ্যাল্লো ডার্লিং! কী খবর?

অরিজিৎ বললেন, বেঁচেবর্তে ফিরেছেন? আজ দুপুরেই রাঁচিতে রেডিও মেসেজ পাঠিয়েছি। বাপস্! কী যে করে বেড়ান!

ষষ্ঠীর মুখে শুনেই…

নাঃ! সাম গার্ল! নাম বলেনি। ইয়াং বলেই মনে হচ্ছিল গলা শুনে। বলল, কর্নেলসায়েব রাঁচিতে ফাঁদে পা দিতে গেছেন, তাকে বাঁচান। লাইন কেটে গেল। এক্সচেঞ্জে এনকোয়ারি করে জেনেছি জি পি ওর পাবলিক বুথ থেকে ফোন করেছিল। এনিওয়ে, ব্যাপারটা কী?

এসে শুনো। চলে এস।

বাই দা বাই, আপনার হালদারমশাইকে নিয়ে পারা গেল না। এইমাত্র খবর পেলুম, ওঁকে আমাদের লোক কিঞ্চিৎ ধোলাই করেছে। ওদের দোষ নেই। কবরখানায় সন্ধ্যাবেলা গেছেন আড়ি পাততে। যাই হোক, ওঁকে লালবাজারে আনতে বলেছি। ওঁকে সঙ্গে নিয়েই যাব। ওয়েট!…..

কর্নেল ফোন রেখে ফোঁস করে শ্বাস ছাড়লেন। কথাকলি চক্রবর্তী কে? একটা নতুন সুতোর খেই এই রহস্যজটে। কে সে? কর্নেলের হিতাকাঙিক্ষণী মনে হচ্ছে। সে কী করে জানল কর্নেল রাঁচি যাচ্ছেন বা গেছেন এবং সেখানে ফঁদ পাতা হয়েছে, তাকে হত্যা করতেই? সে অরিজিৎ লাহিড়ীকেও ফোন করেছে। কিন্তু নাম বলেনি নিজের। ..

কর্নেল চার্লস গ্রিয়ার্সনের বইটি নিয়ে এলেন র‍্যাক থেকে। তারপর ফলকের বিবরণ পড়ে ড্রয়ার থেকে সেই ইংরেজি উপদেশাবলী বের করলেন, যেটি গির্জার বাইবেলের ভেতর গোঁজা ছিল। আতস কাঁচ দিয়ে খুঁটিয়ে পড়তে থাকলেন।

আধঘণ্টা ধরে খুঁটিয়ে দেখা এবং পড়ার পর টেবিল ল্যাম্পের বালবের আরও কাছে নিয়ে গেলেন। ক্রমে এই কথাগুলি উপদেশবাক্যের মাথায় স্পষ্ট ফুটে উঠল।

FOR COLONEL N. SARKAR.

কর্নেলের ঠোঁটের কোণায় সূক্ষ্ম হাসির রেখা ফুটে উঠল। ভ্যানিশিং ইংকে লেখা ছিল তার নাম। উত্তাপ দিলেই ভ্যানিশিং ইংকে লেখা ফুটে ওঠে।

কার লেখা এটা?

গোমেশ জেভিয়ারের কি?

কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের উদ্দেশে এই উপদেশ লেখার কারণ কী? আবার উপদেশগুলি পড়তে শুরু করলেন। তার মধ্যে হাঁকলেন, ষষ্ঠী! কফি।

তারপর ড্রয়ার থেকে চুরুটের বাকসো বের করে চুরুটটি কাগজটির ওপর লম্বালম্বি রাখলেন। চুরুট কফি খেয়েই ধরাবেন। ফ্যানের হাওয়ায় কাগজটা উড়ে যাচ্ছে। চুরুটটা কাগজের কাঁপনে একটুখানি গড়িয়ে ঠাইনড়া হলো।

একটা পেপার-ওয়েট বের করে চাপাতে গিয়েই কর্নেল চমকে উঠলেন, মাই গুডনেস!

ষষ্ঠী কফি আনছিল। বলল, রাঁচির গারদ থেকে ছেড়ে দিয়ে ডাক্তারবাবুরা কাজটা ভাল করেননি। আবার সেই…

কর্নেল উঠে গিয়ে ষষ্ঠীকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ওরে হতভাগা! আমার বড় আনন্দ হচ্ছে। দে দে কফি খাই। ওঃ! ষষ্ঠী! আমার নাচতে ইচ্ছে করছে রে!

সব্বোনাশ! সব্বোনাশ। ষষ্ঠী বেজায় ভড়কে গেল। ছাড়ুন, ছাড়ুন! গরম কফি?

কর্নেল এসে ধপাস করে বসলেন। কফিতে চুমুক দিয়ে চুরুট ধরালেন। তা হলে গোমেশ-ই চিঠিটা লিখে রেখে গেছেন! হতভাগ্য কেয়ারটেকার! লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু। তবু একটা পুণ্যকর্ম করে গেছেন এই উপদেশটি লিখে…

.

আধঘণ্টা পরে অরিজিৎ লাহিড়ী এলেন। সঙ্গে কাচুমাচু মুখে গোয়েন্দা হালদারমশাই।

তিনি ধপাস করে বসে বললেন, সেমসাইড!

অরিজিৎ মুচকি হেসে বললেন, আইডেন্টিটি কার্ড সঙ্গে সঙ্গে দেখালে সেমসাইড হতো না! এনিওয়ে, কর্নেল! আপনার এই চর ভদ্রলোককে একটা সামলান। যদি কোনও অ্যাসাইনমেন্ট দেন, তা হলে অন্তত আমাকে একটু জানিয়ে রাখবেন।

কর্নেল অট্টহাসি হেসে বললেন, হালদারমশাই মাঝে মাঝে বিপদে পড়লেও কিছু মূল্যবান সূত্র যোগান দেন। আশা করি, কাল্প…

হালদারমশাই বললেন, কাল্লুরে ধরেছে! ডি সি সায়েবরে, জিগ্যান!

অরিজিৎ মুচকি হেসে বললেন, কাল্লু হালদারমশাইকে গঙ্গায় খুব নাকানি চোবানি খাইয়েছে। ভাগ্যিস, তখন কলোনির ঘাটে লোকেরা স্নান করছিল। তুলে হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়।

কর্নেল আবার অট্টহাসি হাসলেন।

অরিজিৎ বললেন, আমার আশঙ্কা হচ্ছে, রাঁচি থেকে ফিরে আপনি পাগল হয়ে গেছেন। লোকে যায় পাগলামি সারাতে। আপনি সম্ভবত কাকে মেন্টাল অ্যাসাইলামের সব পাগলের পাগলামি সংগ্রহ করে ফিরেছেন!

আজ এ মুহূর্তে আমার মনমেজাজ খুশি ডার্লিং! এত খুশি যে আমার কাছে ঘৃণ্য পাখি কাক এবং শকুনদের ক্ষমা করে দিয়েছি। যাই হোক, বলুন হালদারমশাই! আপনার এপিসোড শোনা যাক।

হালদারমশাই ফ্যাঁচ করে হেসে নস্যি নিলেন। তারপর বললেন, ড্যাং সায়েবডারে পাওয়া যায় নাই। আপনে আগে কইয়া দ্যান স্যার! আমার পরে কমুঅনে!

অরিজিৎ হাসি চেপে বললেন, না, না। আপনারটা আগে বলুন। আপটু দ ইস্টার্ন সাব-আর্বন খ্রীস্টান সিমেট্রি এপিসোড। গো অন!

হালদারমশাই শুরু করলেন। তার মধ্যে কফি ও স্ন্যাক্স এসে গেল। লম্বা চওড়া কাহিনীটি শেষ করে হালদারমশাই বললেন, মজাটা দেখুন কর্নেলস্যার! ড্যাংসায়েব আমাকে হায়ার করতে আসত। কেন, সেটাই বোঝা যাচ্ছে না।

কর্নেল বললেন, যাচ্ছে। পারস্যের পহলভিসম্রাট আশিরের ফলক উদ্ধার করতেই।

অরিজিৎ অবাক হয়ে বললেন, তার মানে?

ডার্লিং! চার্লস গ্রিয়ার্সন নিজের কবরে যে ফলক লাগিয়েছিলেন, সেটাই সেই পহলভি ফলক। উল্টোপিঠে কী লেখা ছিল, এই দেখ। বলে কর্নেল গ্রিয়ার্সনের বইটা এগিয়ে দিলেন অরিজিৎ লাহিড়ীকে।

অরিজিৎ আগ্রহে বইটার পাতায় চোখ রাখলেন।

হালদারমশাই তাকে পাশে উঁকি মেরে পড়ার চেষ্টা করছিলেন। কর্নেল বললেন, হালদারমশাই! অনেক ধকল গেছে। এবার বাড়ি ফিরে বিশ্রাম নেওয়া দরকার। টানা ঘুম!

হাই তুলে হালদারমশাই বললেন, হঃ! যাই গিয়া। তবে ঘুম হইব না।

চেষ্টা করবেন। ভেড়ার পাল গোনার চেষ্টা করবেন। মনে আছে তো সেবারকার রূপগঞ্জের কাহিনী? পালের গাড়লটাকে ধরার চেষ্টা করবেন। ঘুম এসে যাবে।

ফ্যাঁচ শব্দে হেসে হালদারমশাই ডি সি ডি ডি-কে প্রথাসিদ্ধ স্যালুট ঠুকে বেরিয়ে গেলেন।

অরিজিৎ পড়া শেষ করে বললেন, বুঝলুম। কিন্তু ফলকটা নিয়েই কি এই খুনোখুনী?

তাই মনে হচ্ছে, ডার্লিং! কর্নেল সায় দিয়ে বললেন। তবে টিনিও এই চক্রে জড়িত ছিল। মাই গুডনেস!

কী হলো হঠাৎ?

কথাকলি চক্রবর্তী সুব্রত চৌধুরির নতুন প্রেমিকা নয় তো?

কথাকলি চক্রবর্তী? হু ইজ শি?

 তোমাকে ফোন করেছিল। আমাকেও করেছিল। তখন আমি রাঁচিতে।

অরিজিৎ একটু চুপ করে থেকে সিগারেট ধরিয়ে বললেন, সুব্রত সম্ভবত কলকাতাতেই আছে তাহলে। হুঁ, আপনার কাহিনী শুনি।

কর্নেল, তার বেতলা-অরণ্য-অভিযান বর্ণনা করতে থাকলেন।…

.

ডিনার খেয়ে চুরুট ধরিয়ে শূন্যোদ্যানে উঠে কিছুক্ষণ অভ্যাসমতো পায়চারির পর কর্নেল শুতে এলেন। সবে শুয়েছেন, বেডরুমের পাশের ফোনটা বাজল। বিরক্তিকর! হালদারমশাই আবার কোনও বিপদ বাধালেন নাকি? তাঁরই উত্তেজিত কণ্ঠস্বর!

কর্নেল বললেন, আপনাকে ঘুমোতে বলেছিলুম, হালদারমশাই!

কী যে কন কর্নেলস্যার? রহইস্য ভ্যাদ না হওয়া পর্যন্ত ঘুম আসব? শোনেন!

আপনি কোত্থেকে ফোন করছেন?

বউবাজার ফাঁড়ি থেকে। একটুর জন্য ড্যাংসায়েব ফস্কে গেল কর্নেলস্যার! হালদারমশাইয়ের শ্বাস-প্রশ্বাসজড়িত কণ্ঠস্বর ভেসে এল। আপনার বাড়ি থেকে বেরিয়ে ভাবলুম, বড় ধকল গেছে। একটু ড্রিংক করা উচিত। না কর্নেলস্যার, আমি ড্রিংক করি না। জাস্ট এক পেগ ব্রান্ডি খাই রোজ শোওয়ার আগে। ডাক্তারের পরামর্শ। তো মুনলাইট বারে গিয়ে ঢুকলুম। ঢুকেই দেখি, ড্যাংসায়েব আর একটা আজেবাজে চেহারার লোক বসে আছে।

আজেবাজে চেহারার লোক মানে?

 থার্ড ক্লক্স, কর্নেলস্যার। বারে মানায় না। শুঁড়িখানায় মানায়।

বেশ। তারপর?

তক্ষুণি বেরিয়ে গেলুম। সোজা বউবাজার ফাঁড়িতে। পুলিশ সঙ্গে সঙ্গে চলে এল। এসে দেখি পাখি উড়েছে।

আপনার থার্ড ক্লাস লোকটা?

সে-ও নেই। দুজনেই কেটে পড়েছে। আমাকে দেখতে পেয়েছিল, কর্নেলস্যার! বুঝলেন তো?

বুঝলুম। রাখছি। আপনি…..ধন্যবাদ হালদারমশাই! আপনি এবার বাড়ি যান। ব্র্যান্ডির চেয়ে হালকা ভোজের ঘুমের পিল খেয়ে নেবেন বরং। ট্রাংকুলাইজার পাওয়া যায় যে-কোনও দোকানে। পাঁচ মিলিগ্রামের পিলই যথেষ্ট। পুনশ্চ ধন্যবাদ! অসংখ্য ধন্যবাদ! ফোন রেখে দিলেন কর্নেল।

ড্যানি ঘোষের সঙ্গে থার্ড ক্লাস লোকটা কে হতে পারে? ওর বডিগার্ড? কর্নেল টেবিলবাতির সুইচ অফ করে দিলেন।……

সকালে গার্ডেনিংয়ের জোব্বা পরে কর্নেল তার শূন্যোদ্যানে কিম্ভুত কিমাকার অথচ পুষ্পবতী গাছগুলির সেবা করছিলেন। মাঝে মাঝে উঠে দূরের দেবদারুশীর্ষে বাইনোকুলারে শকুনের বাসা দেখছিলেন। কখনও শরতের নীল আকাশে কোনও পাখি। আজ অবিশ্বাস্যভাবে কোথায় ঘুঘু পাখি ডাকছে। সত্যিকার ঘুঘু তো?

বাবামশাই, ফোং! বাবামশাই, সেই ফোং!

ঘুরে দেখলেন ষষ্ঠী ছটফট করছে। কর্নেল বললেন, কার ফোন বলবি তো হতভাগা? সেই ফোং আবার কী?

ষষ্ঠী গম্ভীর হয়ে গেল। কথাকলি চকরবর্তী। দেখুন গে না! আমার কী আপনারই ক্যাস।

কর্নেল হাসলেন। কেস রে কেস! এত শিখিয়েও কথাটা রপ্ত হলো না! বল, কে-স।

ওই হলো। হালদারমশাই বলেন না? শুনে-শুনে মুখস্থ।

কর্নেল তেড়ে গেলেন। বল্ কে-স!

খেস!

 থাপ্পড় খাবি। খেস নয়, কেস।

ষষ্ঠী কেস, কেস করতে করতে হাসতে হাসতে নেমে গেল।

কর্নেল খুরপি রেখে হাত ঝাড়তে ঝাড়তে সিঁড়ির দিকে এগোলেন। ড্রংইরুমে গিয়ে ফোন তুলে আস্তে বললেন, কর্নেল নীলাদ্রি সরকার বলছি।

আপনার কোনও বিপদ হয়নি তো?

কণ্ঠস্বরে উদ্বেগ। আসল-নকল একটি বাক্য শুনে বোঝা অসম্ভব। তবে সুরেলা কণ্ঠস্বর। কর্নেল বললেন, কার সঙ্গে কথা বলছি, আগে জানতে চাই।

আমার নাম কথাকলি চক্রবর্তী।

হু সুব্রত….।

আপনার কোনও বিপদ হয়নি তো?

 হতে পারত। হয়নি? তো বলো–বলুন!

আপনি-টাপনি নয়। আমি আপনার মেয়ের মতো। টিনি আমার বন্ধু ছিল।

 তুমিও কি বারের গাইয়ে?

 ভ্যাট! কেন এ কথা বলছেন?

 তোমার কণ্ঠস্বরটি গায়িকার।

ধন্যবাদ। শুনুন, আমি আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাই। কিন্তু আমার ভয় করছে, অকারণ পুলিশ যদি আমাকে….

না। পুলিশ আমার বাড়ি পাহারা দেয় না। তুমি চলে এস।

প্লিজ কর্নেল! আমি সামান্য নেয়ে। আমার আয়ের ওপর একটা বড় ফ্যামিলি বেঁচে আছে। আমার বাবা পক্ষাঘাতগ্রস্ত। ভাইবোনেদের লেখাপড়া, সংসার……

এনাফ! নির্ভয়ে চলে এস, ডার্লিং! এই বৃদ্ধের অবস্থা বটবৃক্ষের মতো। সবাইকে আশ্রয় দিয়ে খুশি হয়। চলে এস।

কর্নেল ফোন রেখে গার্ডেনিং জোব্বা খুলতে গেলেন। বাথরুম সেরে ড্রইং রুমে এলেন। চুরুট ধরালেন। একবার ভাবলেন, আবার কোনও ফাঁদ নয় তো? আবার মনে হলো, কণ্ঠস্বরে অভিনয়ের ছাপ নেই। থাকলে আঁচ করার ক্ষমতা আছে তার। অবশ্য তিনি চিরকুমার। সাংবাদিক জয়ন্ত চৌধুরীর মতো মেয়েসঙ্গ করার অভিজ্ঞতা তার নেই। ভারতীয় প্রাচীন শাস্ত্রে বলেছে, মেয়েদের বুঝতে দেবতাদেরও হিম্মত নেই, মানুষ কোন ছার!

মাত্র পনের মিনিট পরে ডোরবেল বাজল। ষষ্ঠীকে বললেন কর্নেল, তোর সেই চকরবর্তী এলে নিয়ে আসবি এ ঘরে। অন্য কেউ হলে বুঝেছিস তো! ওয়েটিংরুমে বসিয়ে নামধাম সব জিজ্ঞেস করবি।

ষষ্ঠী বোঝে। ঝটপট সে যাকে নিয়ে এল, তার বয়স কুড়ি-একুশের মধ্যে। পরনে প্যান্ট-কোর্তা। স্মার্ট মড চেহারা। ছোট করে ছাঁটা চুল। নমস্কার করে বসল।

কর্নেল অমায়িক হেসে বললেন, তুমি টিনির বন্ধু! ওয়েল, তোমারও ডাকনাম থাকা উচিত।

কলি।

সুইট নেম, ইনডিড! কর্নেল নিভন্ত চুরুট ধরিয়ে বললেন, তুমি আমার জন্য উদ্বিগ্ন ছিলে। সেজন্য ধন্যবাদ। তবে বুঝতে পারছি, তুমি টিনির খুনীদের চক্রটি সম্পর্কে খবর রাখো। প্লিজ, এই পয়েন্টটা আগে ক্লিয়ার করে দাও।

কথাকলি মুখে বিষণ্ণতা ফুটিয়ে বলল, টিনি আমাকে মুখ ফসকে বলেছিল, সে শিগগির ভাল পাড়ায় উঠে যাবে। কারণ সে অনেক টাকা পাচ্ছে শিগগির। ওকে ইনসিস্ট করেছিলুম। তখন শুধু বলল, কাকেও যেন না বলি, একটা দামী পাথরের খোঁজ পেয়েছে একটা সিমেট্রিতে। সে…..

এক মিনিট। সুব্রতর সঙ্গে তোমার পরিচয় আছে?

 কথাকলি একটু হাসল। সুব্রত টিনি আমার কমন ফ্রেন্ড।

সে কোথায় জানো?

কথাকলি একটু চুপ করে থেকে একটু দ্বিধার সঙ্গে বলল, ও নির্দোষ। ও টিনিকে বাঁচাতে চেয়েছিল। টিনিকে খুনের চক্রান্ত সে মুনলাইট বারে শুনেছিল।

কেন টিনিকে খুন করা হবে সে জানতে পেরেছিল?

টিনি কোনও খ্রস্টিয়ান সিমেট্রির দামী পাথর নাকি অন্য কাউকে বেচতে চেয়েছে। এটা ড্যানি ঘোষ বরদাস্ত করবে না। সুব্রত আমাকে পরে সব বলেছে।

ড্যানি ঘোষকে তা হলে তুমি চেনো?

কথাকলি একটু হাসল। সুব্রতর সঙ্গে মুনলাইট বারে দিন তিনেক বিয়ার খেতে গিয়েছিলুম। সে ড্যানিকে চিনত। বলেছিল ওই লোকটা সাংঘাতিক খুনী। টিনি ওর পাল্লায় পড়েছে।

ওয়েল, রাঁচিতে আমাকে ফাঁদে ফেলা হবে, কেমন করে জানলে তুমি?

কর্নেল! সাংবাদিক জয়ন্ত চৌধুরী আমার দূরসম্পর্কের দাদা। আমিও দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার স্টাফ। তবে অফসেট প্রিন্টিংয়ে কাজ করি। কম্পিউটার ট্রেনিং নিয়েছি। সেই সূত্রে আপনাকে বিশেষভাবে জানি। সুব্রতও জানে। সুব্রত ড্যানিকে পাল্টা ফাঁদে ফেলার জন্য, মানে টিনি খুন হওয়ার পরে ওর সঙ্গে গোপনে দেখা করেছিল রয় কোম্পানিতে। সুব্রত ড্যানিকে বলেছিল, টিনি যে পাথরটা বেচতে চেয়েও বেচেনি, সেটা কোথায় আছে সে জানে।

ভেরি ইন্টারেস্টিং। তারপর?

সুব্রত বলেছিল, সিমেট্রির কেয়ারটেকার গোমেশের কাছে পাথরটা আছে। গির্জাঘরে লুকিয়ে রেখেছে। এটা সুব্রতর বোকামি। খামোকা বেচারা গোমেশ খুন হয়ে গেল। সুব্রতর রাগে মাথা খারাপ হয়ে গেছে। কিন্তু পুলিশ তাকেও খুঁজছে। ও একটা বোকার বোকা। মিথ্যা বলে একটা লোকের প্রাণ চলে গেল!

হয়তো মিথ্যা বলেনি! কর্নেল মিটিমিটি হেসে বললেন, সুব্রত কোথায়!

কলকাতায় আছে। কথাকলির মুখে দুষ্টু হাসি ফুটে উঠল।

তো শুনুন, ড্যানির সঙ্গে সুব্রত খুব জমিয়ে নিয়েছিল। ড্যানি ওকে পোপোজ করে ডাল্টনগঞ্জে গিয়ে আপনাকে ফোন করতে। সুব্রত ড্যানির প্ল্যান শুনে ঘাবড়ে যায়। সে আর ড্যানির ছায়া মাড়ায়নি।

হু। ড্যানি ডালটনগঞ্জের কোনও বাঙালি ছেলেকে সুব্রত সাজিয়ে আমাকে ট্রাংককল করেছিল। এনিওয়ে, সুব্রতকে নিয়ে এস। একটা জট এখনও খুলছে না। সেটা সে খুলতে পারে। তাকে আমার জরুরি দরকার।

 কথাকলি আগ্রহ দেখিয়ে বলল, কী জট বলুন না কর্নেল?

টিনি যে রাতে খুন হয়, সেই রাতে যা সব ঘটেছিল, সুব্রত জানে। আর জানতেন গোমেশ। গোমেশ ইজ ডেড। আমার ভয় হচ্ছে, সুব্রত……

সুব্রতকে বেরুতে দিলে তো? কথাকলি হেসে ফেলল।

কর্নেল তার বিশাল অট্টহাসি হেসে বললেন, খাঁচায় পুরেছ? ভেরি ওয়েল, ডার্লিং! কামনা করি, এ খাঁচা স্থায়ী হোক।

কথাকলি ঈষৎ রাঙা হয়ে বলল, উই আর জাস্ট ফ্রেন্ডস!

ওকে। ওকে নির্ভয়ে নিয়ে এস।

সুব্রত ভীষণ অনুতপ্ত, কর্নেল! গোমেশ বেচারাকে ওর ভুলের জন্য মরতে হলো। টিনি অবশ্য জেদী গোঁয়ার মেয়ে ছিল। নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু সুব্রত সৎ ছেলে, আমি বলছি!

হুঁ, ওকে আজই নিয়ে এস। বিকেলের মধ্যে আনলে ভাল হয়। তা হলে আমার ফঁদ পাতার সুবিধে হবে।

কথাকলি চমকে উঠে বলল, কিসের ফাঁদ কর্নেল?

 খুনীদের চক্রটি আমরা জানি। তুমি এবং সুব্রতও জানো। কিন্তু কে টিনিকে খুন করল এবং গোমেশ জেভিয়ারকেও খুন করল, তাকে আমি চিনতে পেরেছি। তোমরা পারোনি। অথচ তোমরা–হয়তো তুমি নও, সুব্রত তাকে ভালই চেনে। কিন্তু শুধু জানে না, সে সাংঘাতিক খুনী। টিনি বোকামি করে তার সাহায্য নিতে গিয়েই…নাঃ। তুমি সুব্রতকে আজই নিয়ে এস। ফাঁদ পাতব।

ষষ্ঠী জানে, মেয়েরা কফি পছন্দ করে না। চা-ও খুব কম মেয়ে খায়। তাই সে স্ন্যাক্স, সন্দেশ এবং চা এনেছিল। কর্নেল, সস্নেহে বললেন, সুখবর এনেছ। মিষ্টিমুখ কারো ডার্লিং!

কথাকলি হাসল। জয়ন্তদার কাছে শুনেছি, পুরুষ-মেয়ে সবাইকে আপনি ডার্লিং বলে সম্ভাষণ করেন। ইট ইজ আ বিট……

হু, ইট ইজ আ বিট স্ট্রেইঞ্জ! কর্নেল আবার বিশাল হাসি হাসলেন। কলি! ইংরেজি ভাষার মজাটাই এই। বাংলায় এই ডার্লিং শব্দের বিকল্প নেই। বলল, আছে?

কথাকলি সন্দেশ খেতে খেতে বলল, বোধ হয় নেই।

বাছা শব্দটা চলত। কিন্তু ওটা একেবারে বালক-বালিকাদের ওপর চলে। এদিকে দেখ, ইংরেজিতে হনি শব্দটাও উভলিঙ্গ। ডার্লিং! ইংরেজরা মহা ধূর্ত জাতি!

আবার এক অট্টহাসি।

কথাকলি অবাক চোখে দেখছিল। এতদিন পরে রহস্যভেদী ধুরন্ধর বৃদ্ধ ঘুঘুর সঙ্গে ঘটনাচক্রে তার অপ্রত্যাশিতভাবে পরিচয় হয়ে গেল।

.

০৮.

 লাঞ্চের পর কর্নেল সুব্রত এবং কথাকলির প্রতীক্ষায় ছিলেন। আড়াইটে বাজার পর ডোরবেল বাজল। কর্নেল নিজেই গিয়ে লুকিং গ্লাসে যাদের দেখলেন, একটু অবাক হলেন। যুধিষ্ঠির এবং টিনির মা।

দরজা খুললে যুধিষ্ঠির হকচকিয়ে গেল। বলল, আজ্ঞে আপনি স্যার…

কর্নেল সহাস্যে বললেন, সি এম ডি এ অফিসার নই। ভেতরে এস। আসুন সুরঞ্জনা দেবী!

দুজনে কুণ্ঠিতভাবে ড্রইংরুমে বসল। সুরঞ্জনা চোখ মুছে বললেন, আগে ক্ষমা চাইছি দাদা! আমার মাথার ঠিক ছিল না। ওই নচ্ছার খুনেগুলোর কথায় আমার বুদ্ধি সুদ্ধি গুলিয়ে গিয়েছিল।

কর্নেল বললেন, কী ব্যাপার বলুন! আমার ঠিকানাই বা কোথায় পেলেন, তা-ও বলুন!

যুধিষ্ঠির বলল, সুব্রতবাবু আজ গিয়েছিল। আপনার ঠিকানা দিয়ে বলল, ওঁর কাছে যান। দিদি আমাকে বললেন, যুবধা আমাকে নিয়ে চল। কিন্তু আমি স্যার, ভাবতেই পারিনি….

তার কথার ওপর সুরঞ্জনা বললেন, তুমি থামো তো যুধো! আমাকে বলতে দাও। ড্যানিসায়েব আর ওই গোমেশ পোড়ারমুখোই আমার মেয়েকে খুন করেছে। দাদা, আমি ঘুণাক্ষরে বুঝতে পারিনি। টিনির সঙ্গে ওদের চেনা ছিল। টিনিই বলেছিল, বিপদে-আপদে ড্যানিসায়েবকে বললে মাথার কাছে দাঁড়াবে। গোমেশ পাপের সাজা পেয়েছে। এবার ড্যানিসায়েবের পালা। আমাকে বারণ করেছিল অচেনা লোক কিছু জিজ্ঞেস করল যেন মুখ না খুলি। তারপর আমাকে সে-ই ক্যামাক স্ট্রিটে এক ফ্ল্যাটবাড়িতে নিয়ে গিয়ে তুলল। বলল, পুলিশ জ্বালাতন করবে। এখানেই আপনি যতদিন খুশি থাকুন। কাল সন্ধ্যাবেলা বদমাশ হারামজাদা গুণ্ডা দিয়ে আমাকে ফ্ল্যাট থেকে বের করে দিল। জিনিসপত্র ফুটপাতে ফেলে দিল। তখন কী আর করব? কাঁদতে কাঁদতে নিজের বাড়িতে গেলুম।

যুধিষ্ঠির বলল, আমি বারণ করেছিলুম স্যার, দিদি শোনেনি।

কর্নেল বললেন, সুব্রত কখন আপনাদের কাছে গিয়েছিল আজ?

সুরঞ্জনা বললেন, ঘণ্টাখানেক আগে। সঙ্গে ছিল কলি নামে একটা মেয়ে। টিনির বন্ধু। আপনার ঠিকানা দিয়ে বলল, এখনই কর্নেলসায়েবের সঙ্গে দেখা করে সব বলুন।

 কর্নেল হাসলেন। আস্তে বললেন, ড্যানিসায়েব বুঝতে পেরেছে, আপনাকে ক্যামাক স্ট্রিটে রেখে লাভ নেই। কারণ আপনার ঘরে পাথরের দামী ফলকটা নেই।

যুধিষ্ঠির চমকে উঠল। পাথরের দামী ফলক? সে কী জিনিস স্যার?

 কবরখানার ফলক। কর্নেল মিটিমিটি হেসে টিনির মাকে বললেন, আপনাকে আপনার বাড়ি থেকে সরানোর কারণ, সে আপনার বাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজতে চেয়েছিল। যুধিষ্ঠির হাজতে ছিল। কাজেই ইচ্ছেমতো খোঁজার সুযোগ পেয়েছে।

যুধিষ্ঠির আবার চমকে উঠে বলল, কাল রাত্তিরে স্যার, দিদির ঘরে চোর ঢুকেছিল। আমি চুপচাপ ছিলুম। নেবেটা কী? ঘরে তো লবডঙ্কাটি! সে হেসে ফেলল। চোর চলে গেলে খুব হাসলাম, স্যার!

কর্নেল চুরুট ধরিয়ে একরাশ ধোঁয়ার মধ্যে সুরঞ্জনাকে বললেন, ড্যানিসায়েব আপনার মেয়েকে খুন করেছে?

সুরঞ্জনা কী বলতে ঠোঁট ফাঁক করেছিলেন, যুধিষ্ঠির বলল, গোমেশ স্যার, গোমেশ! তবে ড্যানিসায়েব হয়তো পেছনে ছিল। খুন করেছে গোমেশ। আমার সামান্য বুদ্ধিতে তাই মনে হচ্ছে। গোমেশ প্রায়ই যেত টিনির কাছে। ফুসুরফুসুর করত।

কর্নেল বললেন, হু, কিন্তু গোমেশকে কে খুন করল, যুধিষ্ঠির?

যুধিষ্ঠির এবং সুরঞ্জনা এক গলায় বললেন, ড্যানিসায়েব।

কর্নেল সুরঞ্জনা দেবীর দিকে তাকিয়ে বললেন, কেন?

যুধিষ্ঠির কী বলতে যাচ্ছিল। তাকে থামিয়ে সুরঞ্জনা বললেন, আমি ভাবতুম, আমার মেয়েকে গোমেশ খুন করেছে, তারই শোধ নিয়েছে। কিন্তু আপনি কবরের দামী পাথরের ফলকের কথা বলেন। তাই এখন মনে হচ্ছে, আমার আমার বোকা মেয়ে ফাঁদে পা দিয়েছিল।

উত্তেজিত যুধিষ্ঠির বলল, রোজ খ্রীস্টান কবরখানায় যেত টিনি! সুব্রতও যেত। আজ সুব্রত বিপদে পড়ে ভাল মানুষ সেজেছে বটে, কিন্তু স্যার, সে-ও দলে ছিল মনে হয়। ঠেলায় না পড়লে তো বেড়াল গাছে চড়ে না!

কর্নেল হা হা করে হাসলেন। ঠিক, ঠিক বলেছ যুধিষ্ঠির! সুব্রত…..তবে আমার সন্দেহ……না, খুলেই বলি, সুব্রত জানে, দামী পাথরের ফলক কোথায় আছে। আমিও হয়তো আঁচ করেছি, কোথায় সে ওটা রেখেছে। টিনি ওকে রাখতে দিয়েছিল হয়তো।

যুধিষ্ঠির অবাক হলো। দামী পাথরের ফলক? কী রকম দাম হতে পারে স্যার?

তা বিদেশে বেচলে কোটি টাকা!

যুধিষ্ঠির কপালে চোখ তুলে বলল, ওরে বাবা! একশো হাজারে এক লাখ। একশো লাখে এক কোটি! মাথা খারাপ হয়ে যায় শুনলে। গোমেশ আর ড্যানিসায়েবের মাথা খারাপ হবারই কথা।

এবং সুব্রতরও।

আজ্ঞে। যুধিষ্ঠির সায় দিল। সুব্রত ডুবে ডুবে জল খায়। নইলে টিনির সঙ্গে রোজ সে কবরখানায় যেত কেন?

সুব্রত জানে, টিনি পাথরের ফলক কবরখানায় লুকিয়ে রেখেছে।

সুরঞ্জনা শ্বাস ছেড়ে বললেন, কাকে আর বিশ্বাস করব? অথচ সুব্রত আপনার কাছে আসতে বলল। ওর পেটে-পেটে বদমাইশি!

যুধিষ্ঠির বলল, আহা, আগে যদি জানতুম, ওই ফেরারি আসামীকে আজই ধরিয়ে দিতুম পুলিশের হাতে।

সুরঞ্জনা কাতর স্বরে বললেন, আমি বড় অভাগিনী, দাদা! আমার বড় ভয় করছে। আপনি এর একটা বিহিত করুন। আমার মেয়েকে আর ফিরে পাব না। কিন্তু পালের গোদারা শাস্তি পাক।

কর্নেল আস্তে বললেন, পাবে। সুব্রতকে আগে ধরা দরকার।

 যুধিষ্ঠির বলল, বমালসুদ্ধ স্যার! হাতে-নাতে ধরা উচিত।

নিশ্চয়। কর্নেল ঘড়ি দেখে বললেন, ঠিক আছে। আমি একটু বেরুব। লালবাজারে পুলিশকে সব বলা দরকার। আগে ড্যানিসায়েবকে অ্যারেস্ট করতে হবে। সুরঞ্জনা দেবী! আপনি নিশ্চিন্তে বাড়িতে গিয়ে থাকুন। আপনার আর ভয়ের কারণ নেই। চোরাই মাল তো আপনার বাড়িতে নেই! কাজেই আর আপনার বিপদের আশঙ্কা নেই। চোরাই মাল কবরখানাতেই লুকোনো আছে। সম্ভবত সুব্রত আজ রাতেই তা হাতাতে যাবে। তখন তাকে ধরে ফেলব।

সুরঞ্জনা এবং যুধিষ্ঠির চলে যাওয়া মাত্র কর্নেল ফোন তুললেন। ডি সি ডি ডি অরিজিৎ লাহিড়ীকে চাইলেন। একটু পরে তার কণ্ঠস্বর ভেসে এল, হাই ওল্ড বস! এনি নিউ ডেভালাপমেন্ট?

ইয়া। ডার্লিং! এখনই পুলিশ ফোর্স পাঠিয়ে কবরখানা পুলিশে-পুলিশে ছয়লাপ করে দাও। কুইক! এরিয়ার বাইরেও পুলশ মোতায়েন রাখতে হবে।

ব্যাপারটা কী?

তুমিও বেরিয়ে পড়ো। চলে এস আমার ডেরায়। এখনই দুজনে বেরুব।

ওকে। কিন্তু যাব কোথায়? কবরে নাকি?

 ইয়া।

 সর্বনাশ! এ বয়সে কবরে নিয়ে যাবেন আমাকে?

কুইক, অরিজিৎ, কুইক! আগে পুলিশ ফোর্স, ডোন্ট ফরগেট। এখনই পুলিশ না গেলে কেলেংকারি হবে। তুমি সোজা আমার কাছে এস। প্রতিটি মুহূর্ত মূল্যবান।

ফোন রেখে কর্নেল দ্রুত পোশাক বদলাতে ঘরে গেলেন। তারপর ষষ্ঠীকে বললেন, যদি কেউ আসে, বলবি একটু অপেক্ষা করতে। আমি বেরুব। ফিরব আধঘণ্টার মধ্যে। যে-ই আসুক, অপেক্ষা করতে বলবি।

কর্নেল ড্রংইরুমে পায়চারি শুরু করলেন। উত্তেজিত, অস্থির। মঞ্চের উইংসের আড়ালে অভিনেতা যেমন অপেক্ষা করে, নাটকীয় ক্লাইমেক্সের দৃশ্যে ঢোকার মুহূর্তটির জন্য, তেমনি তীব্র প্রতীক্ষার ছাপ কর্নেলের মধ্যে। মিনিটগুলো অসম্ভব দীর্ঘ। সেকেন্ডগুলো যেন খুঁড়িয়ে এগোচ্ছে। মহাকাশযানের চরম উৎক্ষেপণ মুহূর্তের কাউন্টডাউন শুরু, এক……দুই….তিন……।

ডোরবেল বাজল। কর্নেল গিয়ে দরজা খুললেন। নাঃ, অরিজিৎ নন। কথাকলি এবং সুব্রত। কর্নেল ভেতরে নিয়ে এসে বসালেন। বললেন, অপেক্ষা করো। এখন কোনও কথা নেই। আধঘণ্টার জন্য বেরুচ্ছি। ফিরে কথা হবে। না, না, উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ নেই। জরুরি একটা কাজ পড়েছে। এখনই ফিরে আসছি, ডার্লিং! ষষ্ঠী! এঁদের কফি-টফি খাইয়ে দে! ইচ্ছে করলে ইউরোপিয়ান বা ভারতীয় ক্লাসিক্যাল কিংবা পপ মিউজিক শোনো! ওই রেকর্ডপ্লেয়ার! বলে। দুজনকেই ভীষণ অবাক করে বেরিয়ে গেলেন। সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত নেমে নিচের লনে গেটের কাছে দাঁড়িয়ে রইলেন।

.

অরিজিৎ এলেন দশ মিনিট পরে। মাই গড! আপনাকে সাংঘাতিক দেখাচ্ছে! জাস্ট লাইক আ টাইগার অ্যাট দা মোমেন্ট অফ আ স্প্রিং ডাউন! যেন ঝম্পপ্রদান করে ঘাড় মটকাবেন।

কর্নেল তার গাড়িতে উঠে পড়লেন। বললেন, কুইক! টু দা গ্রেভইয়ার্ড!

যেতে যেতে অরিজিৎ বললেন, একটু আভাস না পেলে অ্যাকসিডেন্ট করে ফেলব। মন চঞ্চল।

ঐতিহাসিক ফলক উদ্ধার করা হবে।

অ্যাঁ!

অ্যা নয়, হ্যাঁ। কর্নেল একটু হাসলেন। একটু অসুবিধা আছে। তবে তোমার পুলিশ বাহিনীর লোকেরা ট্রেইন্ড। কেউ না কেউ কাজটা পারবে।

কী কাজ?

আসল কাজ।

কী বিপদ!

হ্যাঁ, একটু বিপদ আছে। ঠ্যাং ভাঙার।

 কী মুশকিল!

আমি ডার্লিং, এই দাড়িধারী লোকটি পীর মুশকিল আসান! যাঁহা মুশকিল তাহা আসান।

অরিজিৎ চুপ করে গেলেন।….

 প্রাচীন ইস্টার্ন সাব-আর্বান খ্রীস্টিয়ান সিমেট্রিতে পুলিশে-পুলিশে ছয়লাপ। আশেপাশের বস্তি থেকে লোকেরা ভিড় করেছিল। পুলিশ ভিড় দূরে হঠিয়ে দিয়েছে। সবাই ভাবছিল, একটা খুনখারাপি হয়েছে।

রেলইয়ার্ডের দিকেও একদল পুলিশ। রেলপুলিশরাও এসে গেছে। তারাও জানে না কী ঘটছে। ডিউটি ইজ ডিউটি। তারা একদঙ্গল ভাঙা ওয়াগনের ভেতরে, আরও একদঙ্গল রেলইয়ার্ডে মালগাড়ির আড়ালে ওত পেতে আছে।

ডেভিড কেয়ারটেকারের ঘরের বারান্দায় পাথরের মূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। কর্নেলকে দেখে জীবন্ত হলেন। ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে বললেন, হোয়াট হ্যাড! ও মাই গড! আই ক্যান্ট আন্ডারস্ট্যান্ড হোয়াট ইজ দিস!

চলে আসুন মিঃ প্যাটার্সন! একটি ঐতিহাসিক কীর্তির ঐতিহাসিক পুনরুদ্ধার দর্শন করবেন! বলে কর্নেল গির্জার পেছন দিকে দক্ষিণে গেলেন। অরিজিৎকে বললেন, তোমার লোকেদের মধ্যে গাছে চড়তে পারে, এমন কাউকে খুঁজে বের করো। কুইক!

অরিজিৎকে অবাক করে তিনি একটা দেবদারু গাছের সামনে দাঁড়িয়ে বাইনোকুলারে শকুনের বাসা দেখতে থাকলেন। অরিজিৎ পুলিশ অফিসারদের কাছে দৌড়ে গেলেন।

ডেভিড কর্নেলকে বললেন, প্লিজ কর্নেল! এটা কী হচ্ছে?

কর্নেল দেবদারু গাছটির গায়ে খোদাই করা ক্রুশ চিহ্নটি দেখিয়ে বললেন, আশা করি, এটি আপনার কীর্তি নয়?

ডেভিড বললেন, না। এ নিশ্চয় পাগলা গোমেশের কীর্তি!

অরিজিৎ কয়েকজন পুলিশ অফিসার এবং একজন বেঁটে গাড়োয়ালি সেপাইকে সঙ্গে নিয়ে এলেন। তারপর কর্নেলকে বললেন, কুনাল সিং গাড়োয়ালের লোক। বলছে, বাঙাল মুলুকের গাছ তার কাছে গাছই নয়। দেবদারু গাড়োয়ালেও আছে। তবে এ দেবদারু তার কাছে বেঁটে। ওর নিজের চেয়েও নাকি বেঁটে!

কুনাল সিং হাসল। বাংলা বোঝে। হাসিতে ওর চোখ ঢেকে গেল।

কর্নেল বললেন, কুনাল সিং! উও দেখ, গিধনিকি ডেরা। উহা এক পাথর হ্যায়। হোঁশিয়ারিসে লে আনা ভাই! গির যানে সে সব বরবাদ হো যায়েগা!

কুনাল সিং ক্রুশআঁকা গাছটাতে উঠে পড়ল। সে অবলীলাক্রমে ডগায় চলে গেল। একটা শকুন উড়ে পালাল ডানা ঝটপটিয়ে। কর্নেল চেঁচিয়ে বললেন, পাথর হ্যায়?

কুনাল সিং ওপর থেকে বলল, হ্যায় সাব! ছোটা কালা পাথর!

 হোঁশিয়ারিসে লেকে আও! তুরন্ত!

অরিজিৎ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলেন। কর্নেলের চোখে বাইনোকুলার। অরিজিৎ কাছে গিয়ে আস্তে বললেন, ইন দা ভালচারস্ নেস্ট! কী আশ্চর্য!

কর্নেল বাইনোকুলার নামিয়ে মিটিমিটি হেসে বললেন, হ্যাঁ, দা ভালচার নেস্ট!

কিন্তু আপনি কি ওটা বাইনোকুলারে আবিষ্কার করেছিলেন?

না ডার্লিং! এ কথা ঠিক যে আমি দেবদারু গাছের ডগায় শকুনের বাসা দেখতুম। রাগ হতো। কিন্তু শকুনের বাসায় লুকিয়ে রাখা ফলকের কথা জানতে পারি এই উপদেশাবলী থেকে। এই দেখ! বলে কর্নেল জ্যাকেটের পকেট থেকে একটা কাগজ দিলেন।

অরিজিৎ পড়ে বললেন, এ থেকে কী ক্লু পেলেন? এ তো উপদেশ!

কর্নেল বললেন, প্রতিটি লাইনের আদ্যক্ষর লক্ষ্য করো।

Vulgarity is a Common thing today.
 Ultimatum to them who commit nuisance.
 Learn what is good and what is bad.
 Turn your face towards the Heaven.
Understand what I say to thee.
Remember what I said to thee.
 Even the foolish person will know the Truth.
 Satan is always following you, oh man!
 Never submit yourself to him.
 Eden Garden from wherever had fallen;
Say, I must go back to that place!
Turn your face towards the Heaven.

অরিজিৎ পড়ে দেখলে কর্নেল বললেন, আদ্যক্ষর থেকে স্পষ্ট পড়া যাচ্ছে, VULTURES NEST দৈবাৎ আমার একটা চুরুট কাগজটার ওপর রেখেছিলুম। সেটা লম্বালম্বি আদ্যক্ষরের ডান পাশে গাড়িয়ে যেতেই চমকে উঠে দেখি, লম্বালম্বি ভালচার্স নেস্ট-শকুনের বাসা কথাটি পড়া যাচ্ছে। আমার শকুনের বাসা দর্শনের তাৎপর্য বেরিয়ে পড়ল, ডার্লিং! তা ছাড়া ভ্যানিশিং ইংকে-এর মাথায় লেখা আছে To Colonel-কর্নেলের প্রতি! অমনি বুঝলুম, বুদ্ধিমান, গোমেশ বিপদের আশঙ্কা করে আমার জন্য এটা বাইবেলের ভেতর লুকিয়ে রেখেছিলেন। ওঁর যদি কোনও বিপদ হয়, আমি এটা থেকেই ফলকটা উদ্ধার করতে পারব।

কুনাল সিং নামল। হাতে ফলক। কর্নেল সেটা নিয়ে বললেন, পহলভি সম্রাট আশিরের ফলক! মূল্যবান ঐতিহাসিক নিদর্শন! অরিজিৎ! এবার ডিসবার্স করে দাও তোমার বাহিনী। সবাই চলে যাক। আমাদের কাজ শেষ। ডেভিড, আশা করি সন্ধ্যার আগেই এই শয়তানের ডেরা ছেড়ে চলে যাবেন?

ডেভিড বললেন, ও! সিওর! বাট নাও আই আন্ডারস্ট্যান্ড, হোয়াট দা থিং দোজ থিভস্ হ্যাভ বিন সার্চিং!

অরিজিৎ অফিসারদের অর্ডার দিলেন, ডিসবার্স!

কিছুক্ষণ পরে অরিজিতের গাড়ি কর্নেলকে তার বাড়িতে নামিয়ে দিল। কর্নেল অরিজিতের পাশে এসে বললেন, তা হলে ফঁদ পাতার আয়োজন করিগে। তোমাকে যা সব বলেছি, অক্ষরে-অক্ষরে পালন করা চাই। না হলে আবার একটা খুনখারাপি হয়ে যাওয়ার চান্স আছে। ডোন্ট ফরগেট দ্যাট, ডার্লিং!

অরিজিৎ বললেন, ভাববেন না। আজ রাতে কবরের কফিন থেকে প্রেতাত্মাদের মতো আমার লোকজন বেরিয়ে পড়বে। আ রেজারেকশন! দেখবেনখন উইশ ইউ গুড লাক। বাই!

কর্নেল হাত নেড়ে বললেন, অ রিভোয়া! আবার দেখা হবে।

.

ড্রইংরুমে পপ মিউজিক বাজছে। সুব্রত চুপচাপ বসে আছে। কিন্তু কথাকলিকে দেখে কর্নেলের মনে হলো, নাচছিল। ষষ্ঠীও মুচকি হেসে চাপাস্বরে বলে গেল, ঘরের মধ্যে সিনেমা, বাবামশাই! কথাকলি রেকর্ডপ্লেয়ার বন্ধ করল।

কর্নেলকে দেখে সুব্রত কাঁচুমাচু হাসল। আমি অনেক অন্যায় করেছি, কর্নেল! আমাকে রক্ষা করুন।

কথাকলি বলল, নিশ্চয় করেছ। প্রথমেই সব বলা উচিত ছিল তোমার। তুমি বোকার বোকা!

আহা, বকে না! কর্নেল সস্নেহে বললেন, আসলে সুব্রত ভয় পেয়ে গিয়েছিল। কারণ সে একটা হত্যাকাণ্ডের সাক্ষী। তাকে পুলিশ জড়াবে ভেবে তার ভয় পাওয়া স্বাভাবিক।

সুব্রত কথাকলির উদ্দেশে বলল, কিন্তু আমি যথেষ্ট ক্ল দিয়েছিলুম। টিনির বুকের মধ্যে পার্স এঁজে…..

শাট আপ। অসভ্য।

কর্নেল হাসলেন। হ্যাঁ, তুমি নিজের পার্সের ভেতর একটা লেখা ভরে মৃতা টিনির ব্লাউসের ভেতর গুঁজে দিয়েছিলে। তুমি বড্ড বেশি রোমান্টিক, সুব্রত! টিনির চমৎকার আর্টিস্টিক্ জীবনচরিত লিখেছিলে। প্রচুর ব্লু ছিল ওতে। তোমাকে সেজন্য ধন্যবাদ। কিন্তু টিনির পার্স কী হলো?

সুব্রত মুখ নামিয়ে বলল, ওর পার্সে দুশো টাকা ছিল। আমার টাকার খুব দরকার। লোভ সামলাতে পারিনি। কিন্তু ভয় পেয়ে প্রথমে…..

প্রথমে পাশেই একটা ফাটলে ছুঁচোর গর্তে লুকিয়ে রেখেছিলে।

সুব্রত চমকে উঠল। আপনি জানেন!

 পরে আমি গর্তটার খোঁজ পাই। যাই হোক, ওটা পরে নিয়ে গিয়েছিলে?

হ্যাঁ। শেষ অব্দি মনে হয়েছিল খামোকা দুশো টাকা নষ্ট হবে কিংবা পুলিশ খুঁজে পাবে। তার চেয়ে আমিই নিই।

তুমি টিনিকে গোমেশের মারফত চিঠি পাঠিয়েছিলে। টিনিকে রাতে কবরখানায় ডেকেছিলে কেন?

টিনি বলেছিল, ড্যানি ঘোষ কবরের পাথরের ফলক কেনে। অ্যান্টিক ভ্যালু আছে ওগুলোর। আমি যদি ওকে সাহায্য করি, একটা দামী পাথরের ফলক সে বেচবে। আমাকে ভাগ দেবে টাকার। আমি ওকে নিষেধ করেছিলুম প্রথমে। পরে আমারও লোভ হলো। ঠিক করলুম, সে-রাতে ফলকটা উপড়ে তুলতে ওকে সাহায্য করব। তাই গোমেশকে চিঠি দিয়ে এলুম, টিনিকে যেন পৌঁছে দেয়। গোমেশের মারফত আমরা পরস্পরকে চিঠি লিখতুম। গোমেশকে বখশিস দিত টিনি। আমরা কবরখানায় গিয়ে আড্ডা দিতুম।

কথাকলি ফুঁসে উঠল, প্রেম করতে!

সুব্রত একটু হাসল। না কলি! ঠিক প্রেম নয়, আই জাস্ট… লাইকৃড় হার। আই ট্রায়েড টু আন্ডারস্ট্যান্ড হার। ওর মধ্যে গানের প্রতিভা ছিল।

কর্নেল বললেন, হু। আগে বলো, গোমেশ চিঠিটা ছিড়লেন কেন? আমার পরামর্শে। চিঠিটা গেমেশ দিতে গিয়েছিল টিনিকে। ওকে বাড়িতে না পেয়ে ফিরে আসে। তারপর রাত দশটা নাগাদ কথামতো আমি রেলইয়ার্ড ঘুরে কবরখানায় ঢুকলুম। জ্যোৎস্না ছিল। ক্রিস্টিনার কবরের কাছে টিনি আর একটা লোককে দেখলুন, চাপা স্বরে কথা বলছে। আমার ভীষণ রাগ আর দুঃখ হলো। ভারি ট্রেচারাস মেয়ে তো! তক্ষুণি চুপিচুপি ঝোপঝাড়ের আড়াল দিয়ে চলে গেলুম গোমেশের কাছে। আমার কথা শুনে গোমেশ টর্চ নিয়ে বেরুলেন। আমি ওঁর সঙ্গে। টর্চের আলো দেখেই হয়তো ওরা পালিয়েছে ভাবলুম। তারপর ক্রিস্টিনার কবরের কাছে এসে দেখি, ওঃ! বীভৎস দৃশ্য! টিনি খুন হয়ে পড়ে আছে। অমনি গোমেশকে বললুম, আমরা এতে জড়িয়ে পড়ব। চিঠিটা যেন ছিঁড়ে ফেলে। পুলিশে খবর দিতে বললুম। গোমেশ বললেন, এত রাতে খবর দিতে গেলে পুলিশের সন্দেহ হবে, ঘর থেকে এত রাতে অতদূরে ক্রিস্টিনার কবরে কেন গেল সে? তার চেয়ে সকালে খবর দেওয়াই ভাল। পুলিশের জেরার চোটে কী বলতে কী বলে ফেলবে।

 টিনির পার্সে টাকা আছে কেমন করে জানলে?

আমারও লোভের কথা অস্বীকার করছি না, কর্নেল। আমি এখনও পার্মানেন্ট স্টাফ হইনি। ভাউচারে টাকা পাই। ট্রেনি জার্নালিস্ট মাত্র। ড্যানি ঘোষকে আমিও কবরের ফলক বেচতে চেয়েছিলাম। তখন ড্যানি বলেছিল, আজই সে টিনিকে দুশো টাকার কড়কড়ে নোট দিয়েছে। অ্যাডভান্স। আমি বরং টিনিকে হেল্প করলে টাকার ভাগ পাব।

তাই তুমি চিঠি লিখে টিনিকে বলেছিলেন রাত দশটায় কবরখানায় যেতে?

হ্যাঁ।

বেশ। তারপর তুমি মৃতা টিনির পার্স বের করে নিজের পার্স ঢোকালে? কিন্তু নেলপালিশ, লিপিস্টিক…..

কর্নেল, ওটা টিনির পিকিউলার অভ্যাস! সে হ্যান্ডব্যাগ ব্যবহার করত না। একবার ছিনতাই হয়েছিল ওদেরই বস্তিতে।

কর্নেল হাসলেন। তা হলে আমি ভুল বুঝেছিলুম। এনিওয়ে, এবার বলল। টিনির ডেডবডি দেখার পর কী করলে তোমরা?

বললুম তো! গোমেশকে চুপচাপ গিয়ে শুয়ে পড়তে আর চিঠিটা ছিঁড়ে ফেলতে বললুম।

গোমেশ পাশের কোনও কবরের ওপর আলো ফেলে কিছু দেখেছিলেন?

আলো ফেলেছিল চারপাশে। কী দেখেছিল, জানি না। বলেনি কিছু।

টিনি তোমাকে বলেনি কোন কবরে ফলক চুরি করবে?

 না। শুধু বলেছিল, একটা দামী পাথরের ফলক আছে, সে দেখেছে।

এবং তুমি ওকে প্রথমে নিষেধ করায় সে অন্য কারও সাহায্য নিয়েছিল। তাই তো?

ঠিক তা-ই।

ঘটনাস্থলে গিয়ে কোনও কারণে তার সঙ্গে টিনির বচসা হয়। ধস্তাধস্তিও হয়। কর্নেল চুরুট ধরিয়ে বললেন, ধস্তাধস্তির প্রমাণ চুড়ি ভাঙা! তুমি পদ্যে লিখেছিলে! তোমার টেবিলের ড্রয়ারে সেই পদ্য পাওয়া গেছে।

সুব্রত বিষণ্ণভাবে বলল, পার্স বদলাতে গিয়ে জ্যোৎস্নায় ভাঙা চুড়ি দেখতে পেয়েছিলুম, ঝিকমিক করছিল কবরে আর ঘাসে।

হুম্। তুমি ভাঙা ওয়াগনের আড়াল থেকে আমাকে ঢিল ছুঁড়েছিল!

সুব্রত করুণ হাসল। আমার চটি ছিঁড়ে গিয়েছিল। পরে পুলিশের ডগস্কোয়াডের কথা মনে পড়েছিল। আমি টিনিকে ছুঁয়েছি। কুকুর আমার চটি শুঁকে যদি…

কর্নেল অট্টহাসি হাসলেন, আমার পদ্ধতি ভিন্ন। আমি কুকুর পছন্দ করি না। ওয়েল, যা হবার হয়েছে। এবার আমাকে খুনীকে ধরতে সাহায্য করো। আমি আজ রাতে ফাঁদ পততে চাই। একটু রিস্ক আছে। তবে তোমার কোনও ভয় নেই। শোনো, লেট মি এক্সপ্লেন…

কথাকলি বলে উঠল, কিন্তু গোমেশবুড়োকে টিনির খুনী কেন খুন করল?

কর্নেল একটু গম্ভীর হয়ে বললেন, অনুমানও যুক্তিশাস্ত্রে সিদ্ধ। জাস্ট অঙ্ক, ডার্লিং! টিনি খুন হওয়ার পর টর্চের আলোয় গোমেশ সেই নির্দিষ্ট ফলকটিতে খোঁজার চিহ্ন দেখে থাকবেন, যা সুব্রতর চোখে পড়েনি। ফলে গোমেশ ফলকটি কোনও এক সময়ে চুপিচুপি খুঁড়ে হাতিয়েছিলেন। বেচার জন্য চন্দননগর গিয়েছিলেন। টিনির খুনী কবরখানায় গিয়ে ব্যাপারটা টের পায়। গোমেশকে সে রাত্রে গিয়ে ডাকে এবং খুন করে। ফলকের দামও দিতে চেয়েছিল হয়তো। গোমেশ সরাসরি নাকি ড্যানির সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এতে সে চটে যায়। ভয়ে গোমেশ ফলকটা লুকিয়ে ফেলেন। খুনীকে ধরতে পারলে জেরা করে জানা যাবে। যাই হোক, গোমেশকে খুন করে তারপর সে তন্নতন্ন করে খুঁজেছে। ফলকটি পায়নি। বুদ্ধিমান গোমেশ সেটি অদ্ভুত জায়গায় লুকিয়ে রেখেছিলেন। প্রাণের আশঙ্কা ছিল বলে সাংকেতিক ভাষায়…..না। সব পরে শুনবে। আমার প্ল্যান নিয়ে বসা যাক। ষষ্ঠী! কফি! কফি না খেলে আমার মগজ চাঙ্গা হয় না। ষষ্ঠী। দেরি কেন?……

.

কাঁটায় কাঁটায় রাত দশটা বাজল। আকাশ এ রাতে পরিষ্কার। ভ্যাপসা গরম। গাছপালার পাতা চুপ করে আছে। কবরখানায় পোকামাকড় ডাকছে। একটা রাতপাখি ডাকল কোথাও। তারপর ক্রাও ক্রাও একটা প্যাচা গির্জা থেকে উড়ে গেল রেলইয়ার্ডের দিকে। সেখানে হুইল্ শোনা গেল। তারপর মালগাড়ির শব্দ কতক্ষণ ধরে। টেনে-হিঁচড়ে বিরক্তিকর ভারী জিনিস টেনে নিয়ে যেতে ইঞ্জিনটা ফোঁস ফোঁস করে হাঁফাচ্ছে!

কৃষ্ণপক্ষের টুকরো চাঁদটা উঠেছে সবে। হালকা নরম সোনালি জ্যোৎস্না ছড়াচ্ছে। ছায়াকালো একটা মূর্তি রেলইয়ার্ডের দিকের ভাঙা পাঁচিল পেরিয়ে সাবধানে কবরখানায় ঢুকল।

ছায়ামূর্তিটি গির্জার দিকে এগিয়ে এল। গাছের ছায়ায় কখনও সে মুছে যাচ্ছিল, আবার ফাঁকায় তাকে দেখা যাচ্ছিল।

মূর্তিটি সোজা গির্জার পুব দিকে এসে একটু কাশল।

গির্জার জানালার কাছে অন্য কেউ কেশে সাড়া দিল। তখন ছায়ামূর্তিটি হনহন করে এগিয়ে এল। চাপাস্বরে বলল, এনেছ?

এনেছি।

 দাও।

 টাকা?

সায়েব ওয়াগনের ওখানে আছে। বললে, সঙ্গে করে নিয়ে এস। টাকা মিটিয়ে দেব।

চলো।

উঁহু, আমার হাতে মাল দাও আগে। মাল দেখি। আমি ওটা চিনি।

চলো না। ওয়াগনের ওখানে গিয়েই দেখবে আসল না নকল!

নাঃ। আগে দাও, দেখি। আমার কাছে টর্চ আছে।

টর্চ জ্বলল। হু, ঠিক আছে। দাও। টর্চ নিভে গেল। দেরি কোরো না। দাও, দাও।

না। হাতে-হাতে টাকা চাই! নৈলে টিনির মতো আমাকেও…

 শালা মরেছ তা হলে!

এবার ছায়ামূর্তি হাত তুলেছে। অমনি দ্বিতীয় ছায়ামূর্তি টর্চ জ্বালল। আততায়ীর হাতে ভোজালি!

দ্বিতীয় ছায়ামূর্তি একলাফে সরে গিয়ে চিৎকার করল, কর্নেল! কর্নেল!

অমনি চারদিক থেকে টর্চের আলো জ্বলে উঠল। বাজখাই গলায় কে চেঁচিয়ে উঠল, হাত উঠাও! চারদিক থেকে বুটের শব্দ। দুদ্দাড় ধুপধুপ এবং তীব্র আলো আর আলো।

আততায়ী যেদিকে পালাতে যায়, আলো! হাত উঠাও শুওরকা বাচ্চা! সে দুহাত তুলে দাঁড়াল। ভোজালিটা পড়ে গেল হাত থেকে।

কর্নেল সাড়া দিলেন, সুব্রত! আর ইউ অলরাইট?

সুব্রত হাসল। অলরাইট, কর্নেল!

অরিজিৎ লাহিড়ী এগিয়ে এসে হতভম্ব হয়ে বললেন, কী আশ্চর্য! এ তো সেই যুধিষ্ঠির!

কর্নেল বললেন, হ্যাঁ, যুধিষ্ঠির। টিনি ওর সাহায্য চেয়েই বিপদটি বাধিয়েছিল। দুধ দিয়ে কালসাপ পোষা একেই বলে। গোমেশ ওকে টেক্কা দিয়ে সরাসরি ড্যানিকে ফলক বেচার চেষ্টা করেছিলেন। এতে যুধিষ্ঠিরের রাগ হওয়া স্বাভাবিক।

যুধিষ্ঠিরকে হাতকড়া পরিয়ে টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে, আচমকা হালদারমশাইয়ের গলা শোনা গেল, এই তো হেই থার্ড ক্লাস লোকটা! হেই বারের লোকটা! ড্যাং হালার লগে অরে দেখছিলাম!

কর্নেল অবাক হয়ে বললেন, আরে হালদারমশাই যে! আপনি কোথায়?

হালদারমশাই গির্জার ভাঙা জানালা গলিয়ে বাইরে ঝাঁপ দিলেন। আমি গির্জার ভেতর সার্চ করছিলাম। প্রথমে ফিসফিস, তারপর আলো আর চেঁচামেচি শুনে ভয়ে….বাপস্!

কর্নেল হালদারমশাইয়ের করমর্দন করে বললেন, আপনি বরাবর ঝামেলা বাধান বটে, তবে এবারকার কেসে আপনিই লাস্ট ক্ল দিয়েছেন। থার্ড ক্লাস লোকটা! হুঁ, আমার পুরো থিওরি আপনার ক্লু পেয়ে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। কনগ্রাচুলেশন!

একজন অফিসার হাঁফাতে হাঁপাতে এলেন। অরিজিৎকে স্যালুট ঠুকে বললেন, ড্যানি ঘোষ ইজ অ্যারেস্টেড স্যার! হি ওয়জ ওয়েটিং ইন আ কার নিয়ার দা স্লাম এরিয়া!

অরিজিৎ বললেন, গুড নিউজ! থ্যাংক য়ু মিঃ ঘটক। নাও ডিসবার্স দা ফোর্স! অল দা অফিসারস ব্যাক টু লালবাজার! সি পি ইজ অ্যাংকশাসলি ওয়েটিং! হুঁ, আগে রেডিও মেসেজ জানিয়ে দিন, দা ব্লু মুন অপারেশন ইজ সাকসেসফুল!

হালদারমশাই স্যালুট ঠুকে বললেন, ব্লু মুন ক্যান স্যার? দা মুন ইজ গোল্ডেন!

অরিজিৎ চোখ কটমটিয়ে বললেন, সাইলেন্স ইজ গোল্ডেন!

হালদারমশাই ভড়কে গিয়ে কর্নেলের সঙ্গ ধরলেন। চাপাস্বরে বললেন, ডি সি ডি ডি সায়েব আমারে লাইক করেন না ক্যান, বুঝি না। ব্লু মুন ক্যান কর্নেস্যার?

কর্নেল হাসলেন। সরকারি আমলাতন্ত্রে ভাষা বোঝার সাধ্য আমারও নেই হালদারমশাই! ওসব নাকি কোড ল্যাংগোয়েজ ওঁদের শাস্ত্রে। ছেড়ে দিন। চলুন। আমার ঘরে গিয়ে ঘন দুধের কফি খাবেন। এস সুব্রত।

.

কর্নেলের ড্রইংরুমে পপ মিউজিক বাজছিল। থামল। ষষ্ঠী চুপিচুপি কর্নেলকে বলে গেল, এও এক মেম। সে কী নাচ, বাবামশাই! আবার, আমাকেও ডেকে বলে, এস ষষ্ঠীদা, নাচি! খি খি খি……

কর্নেল বললেন, কলি। তোমার জাস্ট আ ফ্রেন্ড-কে আস্ত ফিরিয়ে দিলুম। দেখ, অক্ষত আছে নাকি।

কথাকলি সলজ্জ হাসল। বলল, ধরা পড়েছে?

সুব্রত বলল, হ্যাঁ, তবে এক সেকেন্ড দেরি হলে ভোজালি ঝাড়ত। ওঃ! এখনও বুক ঢিপঢিপ করছে। আলো না জ্বালা অব্দি আমি চিনতেই পারিনি লোকটা যুধিষ্ঠির। কর্নেলের কথামতো আমি ড্যানসায়েবের নামে চিঠি লিখে রেখে এসেছিলুম রয়সায়েবের কাছে। কিন্তু আশ্চর্য! যুধিষ্ঠির…..

কর্নেল বললেন, কোনও লোকের চেহারায় কিছু থাকে, দেখেই মনে খটকা বাধে। তবে আমার মূল পয়েন্ট ছিল, খুনী এমন কেউ, যে টিনির সুপরিচিত। টিনি খুব কাছের লোকের সাহায্য চাইবে পাথরটা হাতাতে। পাথরটা খুঁড়ে কবর থেকে ছাড়ানো ওর কর্ম নয়। এমন লোক দরকার, যে নিপুণভাবে আস্ত ফলক ওপড়াতে পারবে। অর্থাৎ সে হাতুড়ি চালাতে জানে। সেকেন্ড পয়েন্ট, টাকার বখরা কম দিতে হলেও টিনির ঘনিষ্ঠ লোক দরকার। এই ক্ষেত্রে টিনির অতি ঘনিষ্ঠ ছিল দুজন। সুব্রত আর যুধিষ্ঠির। সুব্রতকে খুনী সাব্যস্ত করা যায় না। তা হলে সে টিনির জীবনচরিত লিখে ক্ল দিত না। বাকি রইল যুধিষ্ঠির। যুধিষ্ঠির রোজ তাকে বারে পৌঁছে দিত এবং বাড়ি ফেরত আনত। স্বভাবত সুব্রত টিনিকে নিষেধ করায় সে যুধিষ্ঠিরকে বেছে নিতে বাধ্য। তার বাবার বন্ধু যুধিষ্ঠির। তাদের বাড়িতেই থাকে। কিন্তু টাকার লোভে বড় লোভ। মানুষ ক্রমশ টাকার জন্য মরিয়া হয়ে উঠছে। টাকা টাকা টাকা! গোমেশও ফলকটা বেচে টাকা পাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর দুর্ভাগ্য! যাই হোক, এবার কফি! ষষ্ঠী!

হালদারমশাই আড়চোখে সুব্রত এবং কথাকলিকে দেখতে দেখতে ফাঁচ করে হাসলেন। কর্নেলস্যার! আমি ঘটকালি করুম! মাইয়াডা আর পোলাডারে যা মানায়!

কথাকলি ফুঁসে উঠল, ডোন্ট টক লাইক দ্যাট! উই আর জাস্ট ফ্রেন্ডস।

 হালদারমশাই দ্রুত নস্যি নিয়ে বললেন, হঃ! কর্নেল বিশাল অট্টহাসি হাসলেন। তারপর আবার হাঁকলেন, ষষ্ঠী! কফি!…