লাভার্স বিচ

লাভার্স বিচ – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ

দুদিন ধরে ওদের এই অদ্ভুত লুকোচুরি খেলা দেখছি। ছেলেটি এসে সমুদ্রতীরে উঁচু বালি-মাটিতে ভাঙাচোরা পাথরের বাড়িগুলোর ভেতর দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর মেয়ে টিকে আসতে দেখলেই লুকিয়ে পড়ে। মেয়েটি এসে তাকে খোঁজে। যেই টের পায় তার অস্তিত্ব, অমনি শুরু হয় ওই লুকোচুরি। কখনও বা উল্টোটা। আগে মেয়েটি এসে অপেক্ষা করে। তারপর ছেলেটিকে আসতে দেখলে অমনি লুকিয়ে পড়ে। একই লুকোচুরি খেলা শুরু হয়। শেষে দেখি, ঢালু পাড়ের বালিয়াড়ি ভেঙে দুজনে হাত ধরাধরি, গড়াতে-গড়াতে বিচে নামে এবং ছেলেটি, কখনও মেয়েটি আগে দৌড়ুতে থাকে। দুর্বিনীত সামুদ্রিক বাতাসে দুজনের চুল ওড়ে। শাড়ির আঁচল খসে পড়ে। পরস্পরকে তাড়া করার ভঙ্গিতে প্রলম্বিত সংকীর্ণ বিচ ধরে কতদূর-বহুদূর ছটে চলে। তারপর শালীনতাবশে আমি বাইনোকুলার নামিয়ে ফেলি চোখ থেকে। আমি এক বৃদ্ধ মানুষ। চিরকুমার। আমার জীবনে কখনও এমনতরো ঘটনা ঘটেনি, যদিও আমার একদা ওই বয়স ছিল। চপলতা ছিল। আবেগ ছিল। উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়তে পারতুম। অথচ কখনও সে বয়সে কোনো তরুণীর সঙ্গে এমন খেলা খেলার সুযোগ পাইনি। তাই ওদের ওই খেলাটাকে ঈর্ষাজনক এবং অদ্ভুত লাগে। কী সুখ এমন খেলায় আমি জানি না, বুঝতে পারি না।

চন্দনপুর-অন-সি ওড়িশার সমুদ্রতীরে একটি ছোট্ট জনপদ। বেমরশুমে, এই সেপ্টেম্বরে তার বিচ একেবারে জনহীন খাঁ খাঁ। সেই ভোরে–অতি প্রত্যূষে দীর্ঘ বিচের উত্তরপ্রান্তে যেখানে জেলেবস্তি, তেলুগুভাষায় যাদের বলে নুলিয়া, কঁক বেঁধে ছোট-ছোট নৌকো নিয়ে সমুদ্রের সঙ্গে লড়াইয়ে নামে। এ সমুদ্র বড় উদ্ধত। অহঙ্কারী। তবু এক ঝক কালো কালো শীর্ণকায় মানুষের এ লড়াই বেঁচেবর্তে থাকার লড়াই। এই লড়াই দিয়েই আবহমানকালব্যাপী মানুষ প্রকৃতিকে পরাজিত করেছে। এ সমুদ্রও প্রকৃতি। তার বুকে ছোট-বড় নানা গড়নের কালো পাথর মাথা উঁচিয়ে আছে। প্রচণ্ড ঢেউ আর ওইসব কালো পাথরের অস্ত্র দিয়ে সমুদ্র মানুষকে রুখতে চায়। পারে না। দুপুর নাগাদ যখন ক্লান্ত নুলিয়ারা ফিরে আসে, তখন তাদের নৌকো-ভরা ঝকঝকে রুপোলি সমুদ্র শস্য। তারপর আবার বিচ জনহীন খাঁ খাঁ-নিরুপদ্রব। পাড়ে বালিয়াড়ির মাথায় শক্ত মাটিতে দাঁড়ানো প্রচীনযুগের পর্তুগীজ আর মুঘল বণিকদের পাথরের বাড়িগুলো নিজস্ব নির্জনতা ফিরে পায়। কী গম্ভীর প্রগাঢ় সেই নির্জনতা–যেন মহাকালের হাঁ-করা মুখ। সমুদ্রের গর্জন, জলপাখিদের চিৎকার, প্রেমিক-প্রেমিকার কণ্ঠস্বর আর হাসি, সবকিছুই সেই হাঁ-করা মুখের ভেতর লুপ্ত হয়ে যায়। কোনো শব্দ আর তখন শব্দ নয়। দিনের আলোও দিনের আলো নয়, কিংবা অন্ধকার বা জ্যোৎস্নাও অন্ধকার বা জ্যোৎস্না নয়। সবই ওতপ্রোত একাকার, গম্ভীর এক সময়সত্তা।

ঠিক বোঝাতে পারছি না, চন্দনপুর-অন-সি বেলাভূমিতে আসলে যেন বিরাটেরই স্বাদ অনুভব করতে পারছিলুম। তাই নিজেকে একা আর তুচ্ছ লাগছিল। মনে হয়েছিল ছেলেটি ও মেয়েটির সঙ্গে আলাপ করি। কিন্তু ওদের কাছাকাছি পৌঁছুতে পারছিলুম না। যখনই পা বাড়িয়েছি, ওরা দ্রুত সরে গেছে দূরে।

তৃতীয় দিনের বিকেলে বিচে একটা প্রকাণ্ড পাথরের ওপর বসে আছি, হঠাৎ ঘসঘস শব্দে চমকে উঠলাম। দেখলাম, ছেলেটি ধ্বংসস্তূপের নিচেকার বালিয়াড়ি দিয়ে একরাশ বালি ধসিয়ে অন্যদিনের মতোই নেমে এল। এসে আমার থেকে আন্দাজ পনের মিটার দূরে দাঁড়াল। তার পরনে অন্য দিনের মতোই হাল্কা ছাইরঙা গেঞ্জি আর জি, পায়ে নীলচে কেডস। তার রুক্ষ বড়-বড় চুলের কাঁপ সামুদ্রিক বাতাসে ছত্রখান হচ্ছিল। কয়েক মিনিট সে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। একটা বড় ঢেউ এসে ভেঙে পড়ল এবং সাদা একরাশ ফেনিল জলের হাল্কা একটা স্তর তাকে পেরিয়ে গেল। তবু সে দাঁড়িয়ে রইল।

একটু কাশলুম। তখন সে আমার দিকে একবার মুখটা ঘোরাল। গলা ঝেড়ে নিয়ে তাকে লক্ষ্য করে বললুম, আকাশ আজ দারুণ পরিষ্কার। কালকের মতো বৃষ্টি নামার লক্ষণ নেই। অথচ সমুদ্রকে কেমন যেন পাগলাটে দেখাচ্ছে। তাই না?

ছেলেটির বয়স চব্বিশ-পঁচিশের মধ্যে। দেহের-গড়নে স্পোর্টস-ম্যানের আদল আছে। ওর বাহুর পেশী শক্ত হয়ে ফুলে উঠেছে এবং মুখেও একটা শক্ত ভাব, চোয়াল আঁটো। চোখে কী একটা হিংস্রতানাকি অভিমান, কিংবা ক্ষোভ, সঠিক বুঝতে পারছিলুম না। একটু অবাক লাগছিল ওর চাউনি দেখে। আমার কথা শুনছিল কি না, জানি না। তবু আলাপ করার প্রগলভতায় এবং চিরাচরিত স্বভাবে বলতে থাকলুম, আসলে পাহাড় বলুন, জঙ্গল বলুন, কী মরুভূমি বলুন– প্রকৃতির সবচেয়ে রহস্যময় জিনিস হলো সমুদ্র। ওই গুমগুম চাপা গম্ভীর শব্দটা শুনুন! পর্দার আড়ালে কী তুমুল একটা কাণ্ড ঘটছে মনে হয়। যেন হয়, এবার প্রকাশ্যেই দেখতে পাব সাংঘাতিক কিছু জাস্ট লাইক অ্যান নিউক্লিয়ার এক্সপ্লোসান!

এইসব কথা বলতে বলতে পাথরটা থেকে নেমে আমি ওর কাছাকাছি গেলুম ও সমুদ্রের দিকে মুখ রেখে আস্তে বলল, আর য়ু আর লেকচারার অফ ফিলসফি?

হেসে ফেললুম। ও নো, নো। জাস্ট অ্যান অবজার্ভেশান।

 দেন হু আর য়ু?

নিতান্ত একজন ট্যুরিস্ট।

দীর্ঘ একমিনিট চুপচাপ থাকার পর বলল, আপনার কাছে বাইনোকুলার কেন? আপনি কি বার্ডওয়াচার?

ইংরেজিতেই দুজনের কথা চলছিল। কিন্তু আমার সন্দেহ হচ্ছিল যুবকটি বাঙালি। আজকাল আর আগের মতো বিশেষ করে ছেলেমেয়েদের দেখে বাঙালি-অবাঙালি কিছু বোঝা যায় না। তাহলেও এ চোখ কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের। আমি আরও এক পা এগিয়ে তার কাঁধে হাত রাখলুম। সে দ্রুত, যেন, অপ্রত্যাশিত গায়ে-পড়া অন্তরঙ্গতায় খাপ্পা হয়েই ঘুরে দাঁড়াল আমার মুখোমুখি। আমিও দ্রুত বলে উঠলুম, হোয়াট হ্যাঁপড়, ইয়ং ম্যান? কী ঘটেছে?

আস্তে কাঁধ থেকে আমার হাতটা সরিয়ে দিয়ে বলল, নাথিং! কেন এ প্রশ্ন করছেন?

এবার সেও আমারই মতো দ্বিতীয় বাক্যটি বাংলায় উচ্চারণ করল। একটু হেসে বললুম, আপনার চেহারায় কথাটি লেখা আছে। নানা। সংকোচের কোনো কারণ নেই। এই দূরদর্শন যন্ত্রটি দিয়ে প্রকৃতি এবং মানুষ উভয়ই আমি পর্যবেক্ষণ করি। এ আমার একটা হবি। আপনার বন্ধুটি কি আপনার সঙ্গে ঝগড়া করে চলে গেছে?

যুবকটির মধ্যে মুহূর্তের জন্য হিংসা ঝিলিক দিল–তার ব্যক্তিগত ব্যাপারে এক ধূর্ত বৃদ্ধ নাক গলাচ্ছে বলেই। কিন্তু পরমুহূর্তে সে সংযত হলো। লক্ষ্য। করলুম, সে কাকতাড়ুয়ার মতো বিশীর্ণ আর শুকনো হয়ে যাচ্ছে প্রতি সেকেন্ডে। যেন এখনই ভেঙে পড়বে ভিজে বালির ওপর। সে মুখটা নামাল। তার নাসার ফুলে উঠল। চোয়াল আরও ঠেলে উঠল।

ফের বললুম, মানুষের গতিবিধিও আমার পর্যবেক্ষণের বিষয়। তাছাড়া

আমাকে থামিয়ে দিয়ে হিসহিস করে বলে উঠল, তাহলে আপনি সবই দেখেছেন! য়ু আ পার্ভাটেড ওল্ড ম্যান! আই হেট যু! তারপর সে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল।

বললুম, শুনুন! আমি কর্নেল নীলাদ্রি সরকার!

আই কেয়ার আ ফিগ ফর আ গড়ড্যাম কর্নেল অর আ ব্লাডি হেল! এই গজরানি দিয়ে সে দ্রুত হাঁটতে থাকল সিধে বিচ বরাবর দক্ষিণে। ওদিকে সাদা ও লাল লাইটহাউসটি শূন্যনীল শেষবেলার আকাশ ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ধু ধু করছে ধূসর জনহীন উঁচু টিলার মতো বালিয়াড়ি। নিচের বিচে একটা নেড়ি কুকুর আর একটি ন্যাংটো নুলিয়া বালক আপনমনে খেলা করছে।

যুবকটি তাদের পাশ দিয়ে এগিয়ে বালিয়াড়িতে উঠে গেল এবং ওপাশে অদৃশ্য হলো। তখন আমি আস্তে আস্তে পেছনকার বিধ্বস্ত পাথুরে বাড়িগুলোর ভেতর উঠে গেলুম। গাঢ় ছায়া সেখানে। কী এক অবচেতন কৌতূহলে–কিংবা ইনটুইশান বশে কী যেন খুঁজতে থাকলুম। একটু পরে মনে হলো, কী খুঁজছি এখানে? কী? কেনই বা অনুসন্ধানবৃত্তি পেয়ে বসল ভূতের মতো?

ঘরগুলোর দেয়াল ভাঙাচোরা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কোথাও খানিকটা ছাদের টুকরো ঝুলে আছে। সে-সবের ভেতর দিয়ে শেষদিকে উত্তরপ্রান্তে ঘুপটি একটুকরো ঘর আবিষ্কার করলুম। তার এদিকের দেয়ালে একটা প্রকাণ্ড ফোকর। ফোকরে উঁকি দেওয়ার আগে জ্যাকেটের পকেট থেকে টর্চ বের করে নিলুম। ছোট্ট ঘরটা নিশ্চয় গুদাম ছিল। ওপাশে ভাঙা দরজা। ভেতরটা এখনই গাঢ় আঁধারে ভরে গেছে। টর্চের আলোয় মেঝেটুকু স্পষ্ট হয়ে উঠল।

এইসব বিধ্বস্ত পাথরের বাড়িগুলোর ভেতর শুধু বালি আর বালি ভর্তি। এই টিকে থাকা খুদে ঘরটির মেঝেতেও চাপ-চাপ বালি। সেই বালিতে কয়েকটা জুতোর সোলের স্পষ্ট ছাপ এবং ব্যাপারটা অদ্ভুত একারণেই যে ছাপগুলো শেষ হয়েছে এই ফোকরের নিচেই।

হুঁ, কেউ দাঁড়িয়ে ফোকর দিয়ে কিছু লক্ষ্য করেছিল অথবা লক্ষ্য করত। কিন্তু কে সে? কী লক্ষ্য করত সে?

.

চন্দনপুর-অন-সিতে আমি যে ছোট্ট বাংলোবাড়িতে উঠেছি, সেটি আমার এক বন্ধু অরবিন্দ পাণিগ্রাহীর। তিনি ব্যবসায়ী মানুষ। থাকেন মেহেরগঞ্জে এখান থেকে পঁয়ত্রিশ কিলোমিটার দূরের শহরে। এই বাংলোবাড়ির নাম ‘উদয়াচল। কেয়ারটেকার আছে। তার নাম গউড়-অ। ওড়িয়া ভাষার অ-কারান্ত উচ্চারণ বাংলায় লেখা কঠিন। তাই তাকে বরং গউর বলা যাক, গৌরের বাংলা। অপভ্রংশ। তাছাড়া এই গউর বা গউড়-অ-চমৎকার বাংলা বলে। শুধু তাই নয়, সে হিন্দি এবং তেলুগুও বলতে পারে। এই চতুৰ্ভাষাবিদ লোকটির বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। অতিশয় বুদ্ধিমান এবং মালিকের অতিথির চমৎকার সার্ভিস দিতে পটু। সে-রাতে খেতে বসে তাকে জিগ্যেস করলুম, সমুদ্র তার কেমন লাগে?

আমার প্রশ্নটা নিশ্চয় তার অদ্ভুত লাগল। তাই যেন বলল, কেমন লাগবে স্যার? সমুদ্রের ধারে যার জন্ম আর এতকাল থাকা, তার কাছে সমুদ্র তো সমুদ্রই। আপনি যদি নতুন কিছু দ্যাখেন, তাহলে বুঝবেন সেটা ভাল না খারাপ।

একটু হেসে প্রশ্নটা শুধরে দিলুম। …না–মানে, তুমি সকাল-বিকেল বা কোনো সময় ফুরসত পেলে সমুদ্রের ধারে বেড়াতে যাও কি না?

গউর হাসতে লাগল। …তা যাই স্যার। তবে সমুদ্রের আর নতুন কী দেখব? যাই নুলিয়াদের কাছে মাছ-টাছ আনতে। কখনও কারুর সঙ্গে দেখা হলে বিচে একটু বসে গপ্পসপ্প করি–এই আর কী?

আচ্ছা গউর, গত কয়েকদিনে তুমি কি কোনও যুবক-যুবতী–মানে ছেলে মেয়েকে দেখেছ বিচে?

গউর আরও হাসতে লাগল। …স্যার, চন্দনপুর বিচের একটা পুরনো নাম আছে। আজকাল নামটা সবাই ভুলে গেছে। ব্রিটিশ আমলে–তখন আমি এইটুকু ছেলে, তবু মনে আছে, লোকে বলত লাবার্স বিচ! বড় বদনাম ছিল, স্যার!

লাবার্স বিচ, নাকি লাভার্স বিচ?

ওই হলো আর কী। গউর ঈষৎ লজ্জায় আড়ষ্টভাবে বলল। ক’বছর আগে অব্দি অফ-সিজন বলতে কিছু ছিল না। সব সময় জোড়া-জোড়া–মানে স্যার, বুঝলেন তো? লাজলজ্জার বালাই নেই–সেকালের সায়েবমেমদের মতো ‘নেকিড’ হয়ে বিচে, নয়তো বালিয়াড়িতে…।

সংকোচে সে থেমে গেলে বললুম, বুঝেছি।

গউর বলল, তো শেষে পুলিশ খুব পেছনে লাগল। মাঝে-মাঝে খুনখারাবিও হতো। মানে কে কার বউ ভাগিয়ে নিজের বউ সাজিয়ে এনেছে, আর তা ‘হাজব্যান্ডো’ তক্কেতক্কে চলে এসেছে। শেষে–গউর ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে ফের বলল, কাগজে লেখালেখির চোটে পুলিশ ক্যাম্প বসালে বিচের মাথায়। তারপর এই অবস্থা। ওই এক শীতকালটা যা ভিড়ভাট্টা, তারপর বাকি সময় খাঁ খা পড়ে থাকে। যদি বা কেউ এস পড়ে, মন টেকে না। একটা দিন থেকে চলে যায়।

কেন? গউর এ প্রশ্নে একটু অবাক হল। বলল, মানুষ আসলে ভিড়ভাট্টাই বেশি ভালবাসে, স্যার। এখানে আছেটা কী? না বাজার, না কিছু। একটা মোটে হোটেল বা কারুর এইরকম লজ বা বাংলো। আর হোটেল মানে কী, নিশ্চয় দেখেছেন স্যার?

দেখেছি। মাটির ঘর।

মাটির ঘর। গউর রিপিট করল। শীতের সময়টা বাদ দিলে খাঁ খাঁ। না খদ্দের, না কিছু।

খাওয়া শেষ করে জল খাচ্ছিলুম। তখন গউর এঁটো থালাবাটি গোছাচ্ছিল টেবিল থেকে। জল খেয়ে বললুম, হা-তাছাড়া লাইটহাউসের পেছনে ডিফেন্স ডিপার্টের বিভিন্ন দফতর আছে। আর্মি ট্রেনিং সেন্টার আছে। তাই এখানে আসতে স্পেশাল পারমিট লাগে। সেই ঝামেলায় এই অবস্থা হয়েছে।

আজ্ঞে, আজ্ঞে। গউর সায় দিয়ে বেরিয়ে গেল কিচেনের দিকে।

আরাম করে বারান্দার ইজিচেয়ারে বসে চুরুট টানছি, সবে জ্যোৎস্না ফুটেছে, মনে পড়ল, ওই যা! গউর তো আমার মূল প্রশ্নের জবাব দেয়নি। তাকে ডাকলুম। বললুম, হু–তোমার কাছে যা জানতে চাইছিলুম তখন। গত দু-তিন দিনে বিচে কোনও ছেলেমেয়েকে

এ পর্যন্ত শুনেই গউর খ্যা খ্যা করে হাসল। …বুঝেছি। আপনি মেহেরগঞ্জের মহাপাত্ৰমশায়ের ছেলের কথা বলেছেন তো? ওনাকে দেখেছি বৈকি। সঙ্গে বউমা ছিল, তাও দেখেছি। তবে স্যার, দীপবাবু ছেলেটা গোঁয়ারের হদ্দ। জিগ্যেস করতে গেলুম, বিয়েতে অধম নেমন্তন্ন কেন পায়নি, তো এমন চোখ করে তাকাল!

আস্তে বললুম, কেমন করে বুঝলে মেয়েটি ওর বউ?

গউর মাথা চুলকে বলল, তাছাড়া আর কে হবে? সিঁথেয় সিঁদুর ছিল মনে পড়ছে।

ওরা কি বাঙালি?

তা বলতে পারেন। মেদিনীপুরের কাথির লোক মহাপাত্ৰমশাই। কাথিতে আমার বোনের বিয়ে হয়েছে স্যার। তাছাড়া পাণিগ্রাহীমশাই ওনার বন্ধু বটেন। সেই লাইনে চেনাজানা আমার সঙ্গে।

ওরা কোথায় উঠেছে জানো কি?

গউর ঝটপট বলল, কেন? ওই তো রাস্তার ওধারে ন্যাড়া পাথরের টিলার নিচে মহাপাত্রমশাইয়ের বাংলোবাড়ি।

ঘড়ি দেখলুম। রাত সাড়ে আটটা বাজে মোটে। সামুদ্রিক আবহাওয়ায় কী যে রাক্ষুসে খিদে পায় মানুষের। খুব সকাল-সকাল খাওয়া হচ্ছে। উঠে দাঁড়িয়ে বললুম, গউর! আমি একটু ঘুরে আসি। তুমি শুয়ে পড়তে পারো।

গউর বলল, নানা, আপনি ঘুরে আসুন বিচে। আমার ঘুমুতে রাত একটা দুটো…

.

বিচের দূরত্ব এই বাংলোবাড়ি থেকে বড়জোর সিকি কিলোমিটার। কৃষ্ণপক্ষের ঈষৎ ক্ষয়টে হলুদ জ্যোৎস্নায় সমুদ্রতীর অবশ্যই আমার পক্ষে এখন লোভনীয়। কিন্তু সেই ইনটুইশন–চিরদিন যে অতীরিন্দ্রিয়জাত বোধ আমাকে কাটার মতো খোঁচা মারে, এদিনই শেষ বেলায় বিচের মাথায় ভাঙা পাথুরে ঘরের ভেতর যা আমাকে উঁকি মারতে বাধ্য করেছিল, তাই আমাকে ঠেলে নিয়ে চলল রাস্তার ওধারে ন্যাড়া পাথরের টিলার নিচে একটি বাড়ির দিকে।

একটা বিশাল ও কাছিমের খোলের গড়ন ঘাসে ঢাকা জমির ওপারে বাড়িটার একটা জানালায় আলো দেখা যাচ্ছিল। ঘাসের জমিটা চিরে আবছা জ্যোৎস্নায় একফালি পায়েচলা পথ চোখে পড়ল। সেই পথে অনেকটা এগিয়ে গেছি, মনে হলো কেউ যেন আমাকে অনুসরণ করছে। দ্রুত ঘুরে কাউকে দেখতে পেলুম না। হয়তো মনের ভুল। জমিটার শেষ প্রান্তে ঘন আগাছার জঙ্গল। তারপর একটা সরু এবং খোয়াঢাকা রাস্তা। রাস্তা পেরিয়ে বাড়িটার গেটে পৌঁছুলে আবার মনে হলো, পেছনে কেউ আসছে। আবার দ্রুত ঘুরে দাঁড়ালুম এবং এবার টর্চ জ্বাললুম। কেউ নেই।

কিন্তু তারপরই বাড়িটার আলোজ্বলা জানালা থেকে কেউ বলে উঠল, হুজ দেয়া?

হু, সেই ছেলেটি–দীপ। যে কণ্ঠস্বর কর্নেল নীলাদ্রি সরকার জীবনে একবার শোনে, আর তা ভোলে না। একটু কেশে সাড়া দিয়ে বললুম, হ্যাল্লো দীপ!

হু আর য়ু?

 দ্যাট ওল্ড ফেলা, হুম ইউ মেট অন দা সি-বিচ!

কিছুক্ষণ পরেও! এখানে আপনি কী করছেন?

আপনার–তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি, দীপ!

আমি গায়ে-পড়া আলাপ ডিজলাইক করি মিস্টার! হোয়াট দা হেল য়ু থিং য়ু আর গোয়িং টু ডু উইথ মি?

আমি মনে মনে হাসছিলুম। কথির কোনও এক ব্যবসায়ী, যিনি মেহেরগঞ্জে ব্যবসা করতে এসে বসবাস করছেন, তাঁর ছেলে দীপের এই অ্যাংলিয়ানা! অবশ্য ছেলেটি নিশ্চয় কলকাতায় থেকে ইংলিশ মিডিয়ামে লেখাপড়া শিখেছে। এবং ইদানিংকার রীতি অনুসারে ট্যাসে পরিণত হয়েছে, এতে অস্বাভাবিকতার কিছু নেই।

কিন্তু তারপর দেখলুম, সে বেরিয়ে এসে গেটের তালা খুলে দিল। তার হাতের টর্চ আমাকে কয়েক সেকেন্ড ঝলসে দিয়ে নিভে গেল।

তারপর শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে আস্তে বলল, ওকে। আসুন!

ছোট্ট লনের ডাইনে গ্যারেজ একটা ঝকমকে গাড়ি দেখতে পেলুম সরাসরি তার ওপর জ্যোৎস্না পড়েছে বলেই। বারান্দায় উঠে সে ফের চাপা গলায় বলল, প্লিজ কাম ইন!

ড্রইং রুমটি ছোট এবং সাজানো। ওর পরনে শর্টস আর হাতকাটা গেঞ্জি। -গলায় সরু রুপোলি চেন। আমি বসলে বলল, এনি ড্রিংক?

ধন্যবাদ। সদ্য ডিনার সেরে আসছি। …নিভন্ত চুরুটটি জ্বালিয়ে নিলে সে অ্যাসট্রেটি এগিয়ে দিল। তারপর আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। বললুম, হোয়াট হ্যাঁপ দীপ?

প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বলল, আমার নাম কে বলল আপনাকে?

 গউর। তুমি–তুমি বলার জন্য কিছু মনে কোরো না ডার্লিং, এ আমার অভ্যাস–ততা তুমি আজ বিকেল থেকে একা কেন?

একটু চুপ করে থাকার পর নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে বলল, হু আর য়ু? আপনি কে?

আমার নাম তোমাকে বিকেলে বলেছিলুম। বলে বুঝতে পেরেছিলুম এই নামটির সঙ্গে তোমার পরিচয় নেই। আমি কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। আমি একজন ন্যাচারালিস্ট–নেচার পর্যপেক্ষণ আমার হবি। নেচারকে পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে তার অন্তর্ভুক্ত আরও অনেক কিছু আমার চোখে পড়ে যায়।

মুখ নামাল এবং দু হাত দুই গালে রেখে নগ্ন হাঁটুতে দুটি কনুই রেখে আস্তে বলল, য়ু হ্যাভ আ বাইনোকুলার!

ইয়া। একটু হেসে বললুম।

আপনাকে আমরাও–আমি ওয়াচ করেছিলুম। প্রথমে ভেবেছিলুম, আপনি একজন ফরেন ট্যুরিস্ট। ইউ লুক জাস্ট অ্যান য়ুরোপিয়ান। সুভদ্রা বলল, বাজি রাখছি, হি ইজ আ খ্রীস্টিয়ান ফাদার!

সুভদ্রা কোথায়?

দুটো হাত গাল থেকে সরে পুরো মুখে ঢেকে গেল। ভাঙা গলায় বলে উঠল, জানি না। সানলি শি ইজ ভ্যানিল্ড–আ ট্র্যাজিক ম্যাজিক ইনডিড! তাকে দুপুর থেকে খুঁজে পাচ্ছি না। সারা চন্দনপুর তন্নতন্ন খুঁজেওবাট শি ওয়জ নট আ গার্ল অফ দ্যাট টাইপ! ও ছিল—

দ্রুত কথা কেড়ে বললুম, সুভদ্রা কি তোমার স্ত্রী?

মুখ থেকে হাত-দুটো সরে গেল। দেখলুম, চোখ দুটো লাল এবং ভিজে। নাসারন্ধ্র

স্ফুরিত। সেই তখনকার মতো চোয়াল শক্ত। দাঁতে দাঁতে। একটু পরে বলল, শি ওয়জ। মাই ফিয়াসে! শীগগির আমাদের বিয়ে হতো।

হু–সুভদ্রার বাড়ি কোথায়?

কলকাতা–ফিয়ার্স লেনে। বাবার বিজনেসের সূত্রে ওদের ফ্যামিলির সঙ্গে আমার পরিচয়। কিন্তু বাবার এ বিয়েতে মত ছিল না। তাই বাবা জানেন না, সুভদ্রাকে নিয়ে এখানে এসেছি। ওর কথামতো স্টেশনে গাড়ি নিয়ে গিয়েছিলুম লাস্ট ফ্রাইডে। আজ সানডে। স্টেশন থেকে ওকে নিয়ে সোজা এখানে চলে এসেছিলুম।

তোমার বাবা জানেন তুমি চন্দনপুরে আসছ?

 বাবা জানেন, আমি একা আসছি।

পারমিট লাগে চন্দনপুরে ঢুকতে। তুমি স্বামী-স্ত্রী হিসেবে পারমিট নিয়েছিলে?

দ্যাটস ওকে।

শেষবার সুভদ্রাকে–মানে কখন সে বাংলো থেকে…।

প্রশ্নটা বুঝে দ্রুত বলল, দুপুরে দুজনে রান্না করে খেলুম। একটা ক্যাসেট চালিয়ে মিউজিক শুনতে শুনতে আমার ঘুম এসেছিল। সুভদ্রা পাশে শুয়ে একটা ম্যাগাজিন পড়ছিল। আমার ঘুম ভাঙল তিনটেয়। তারপর ওকে দেখতে পেলুম না। ভাবলুম বিচে গেছে। সেখানে গেলুম। ভাবলুম রোজকার মতো লুকোচুরি খেলছে। কিন্তু

আমার দুহাতে মুখ ঢাকল। ডাকলুম, দীপ!

বলুন!

 ডু য়ু থিংক দেয়ার ইজ এনি ফাউল, প্লে সামহোয়্যার?

ইয়া। আই স্মেল সামথিং। বলে উঠে দাঁড়াল হঠাৎ। …আপনাকে দেখাচ্ছি। জাস্ট এ মিনিট!

সে পাশের ঘরে চলে গেল। ঠিক তখনই আবার আমার মনে হলো, কেউ কোত্থেকে আমার দিকে নজর রেখেছে। চিরদিন এ ধরনের রহস্যময় ঘটনার মাঝখানে গিয়ে পড়লে এই অনুভূতিতে আক্রান্ত হই। দ্রুত উঠে গিয়ে বারান্দায় উঁকি মেরে টর্চ, জ্বেলে এদিক-ওদিক দেখে নিলুম। পেছনের ন্যাড়া টিলাটা এখন জ্যোৎস্নায় কালো। টর্চের আলো তার কিনারা ছুঁল। কিন্তু কেউ কোথাও নেই। বসার ঘরে ঢুকে দেখি, দীপ ফেরেনি। পাশের ঘরে খসখস শব্দ হচ্ছে। কিছু খুঁজছে যেন ব্যস্তভাবে। খুঁজে পাচ্ছে না হয়তো। সে চাপা অশ্লীল ইংরেজি খিস্তি করছে কানে এল।

তখন সোজা ওঘরে ঢুকে গেলুম পর্দা তুলে। আমাকে দেখে সে স্থির হয়ে দাঁড়াল। ভাঙা গলায় বলে উঠল, খুঁজে পাচ্ছি না। অথচ ওটা আমার জিনসের পেছন পকেটে গোঁজা ছিল। মনে পড়ছে না–তারপর কোথাও রেখেছিলুম কি না। আসলে বিকেল থেকে আমার মাথার ঠিক নেই–দা ব্লাডি হেল অফ আ মেস!

জিনিসটা কী, দীপ!

একটুকরো কাগজ। ওটা ওই কোণের টুলে যে স্কাল্পচারটা দেখছেন, ওখানে খোলা অবস্থায় রাখা দেখেছিলুম। যেন আমার চোখে পড়ার জন্য কেউ রেখেছে। পড়ে দেখে সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারলুম, সুভদ্রা মূর্তিটার তলায় কোণাটা চাপা দিয়ে রেখেছে, যাতে আমার চোখে পড়ে।

কী লেখা ছিল কাগজে?

সে প্রশ্নের জবাব না দিয়ে দীপ বলল, কাগজটা তখনই পেছন পকেটে গুঁজে আবার বিচে চলে গিয়েছিলুম। কিন্তু গিয়ে মনে হলো, দেরি হয়ে গেছে বড্ড। এখন আর কিছু করার নেই।

তারপর তুমি প্যান্ট বদলেছ। শর্ট পরেছ।

 ইয়া।

 বাথরুমে ঢুকেছিলে কি?

 দীপ তাকাল বড় চোখ করে। বলল, মাই গুডনেস! ইউ আর রাইট, কর্নেল!

 তখন ড্রয়িং রুমের দরজা খোলা ছিল কি?

 ছিল, ছিল! নড়ে উঠল দীপ। আসলে আমার মাথার ঠিক ছিল না। আপনি আসার জাস্ট কয়েক মিনিট আগে খেয়াল হলে গেটে তালা দিয়েছি। ড্রয়িং রুমের দরজাও বন্ধ করেছি।

আর কোনও দরজা খোলা ছিল না–মানে বাইরের কেউ ঢুকতে পারে এ ঘরে, এমন কোনও দরজা? 

নাঃ।

নাও টেল মি প্লিজ, কী লেখা ছিল কাগজে?

একজ্যাক্ট ল্যাঙ্গোয়েজ ভুলে গেছি। জাস্ট মনে পড়ছে, লেখা ছিল : ‘জরুরি একটা কাজে বেরুচ্ছি–বিচে যেও। ওখানে থাকব।‘ ..বলে দীপ নাকের ডগা আঙুলে ঘষে বলল ফের, না–বিচে গিয়ে আমার খোঁজ কোরো’–অথবা ওইরকম কিছু।

মনে করে দ্যাখো, আর কিছু লেখা ছিল কী না!

দীপ ব্যাকুলভাবে স্মরণ করার চেষ্টা করছিল। একটু পরে বলল, আর তো কিছু মনে–ও, হ্যাঁ! মনে পড়েছে! লাস্ট কথাটা ছিল : ‘ভুল বুঝো না। একটা বোঝাপড়া করা উচিত। কিছু বুঝতে পারিনি।

এ ঘরটা বেডরুম। আলো তত উজ্জ্বল নয়। টর্চ জ্বেলে বললুম, কোন প্যান্টটাতে চিঠিটা ছিল?

দীপ খাটের বাজুর মাথায় আটকে ঝোলানো প্যান্টটা দেখাল। সেটার সব পকেট খুঁজে দেখার পর, আবার মেঝে পরীক্ষা করতে থাকলুম টর্চের আলোয়। এবার চোখে পড়ল লাল সিমেন্টের মেঝেয় কিছু বালির ছাপজুতোর ছাপেরই চিহ্ন। অবশ্য ওগুলো দীপের জুতোরও হতে পারে।

বললুম, তোমার বাংলোয় টেলিফোন আছে?

আছে। দীপ আস্তে বলল। … কিন্তু আপনি কি পুলিশকে জানাতে চাইছেন? তাতে আমার আপত্তি আছে। স্ক্যান্ডালাস হয়ে পড়বে পুরো ব্যাপারটা।

ওর চোখে চোখ রেখে বললুম, দীপ! তুমি ফাউল প্লের কথা বলছিলে। হোয়াট ডিড য়ু মিন? সুভদ্রা পালিয়ে গেছে?

দীপ জোরে মাথা নেড়ে অস্থির ভঙ্গিতে বলল, ও নো নো! আই ডিডনট মিম দ্যাট কর্নেল! আমার মনে হচ্ছে, ও কারুর ট্র্যাপে পড়েছে–ওর লাইফের সব কথা তো আমি জানি না। জাস্ট মাস কয়েকের পরিচয় ওর সঙ্গে।

তাহলে কী ঘটতে পারে? ট্র্যাপ বলতে তুমি কী বোঝাতে চাইছ?

দীপ আবার দুহাতে মুখ ঢেকে নিচু খাটের বিছানায় বসে পড়ল। ভাঙা গলায় বলে উঠল, আমি জানি না। কিছু জানি না।

তার কাধ আঁকড়ে বললুম, দীপ, দীপ! মাথা ঠাণ্ডা রাখো। শক্ত হও। এমন ভেঙে পড়লে কিছু করা যাবে না। বি স্টেডি, ডার্লিং!

দীপ শান্ত হবার চেষ্টা করে বলল, বাট হোয়াট ক্যান আই ডু?

আমার মূল প্রশ্নের জবাব দাও। কেন তুমি ভাবছ, সুভদ্রা তোমাকে ছেড়ে পালিয়ে যায়নি? তুমি বলছ চিঠিতে লেখা ছিল : ভুল বুঝো না। এতেই তো বোঝা যায়, সে কারুর সঙ্গে কিছু নিয়ে রফা করতে গিয়েছিল–ধরো, তার আগের কোনও প্রেমিকের সঙ্গে

দীপ প্রায় চেঁচিয়ে উঠল, অসম্ভব। আমি বিশ্বাস করি না। তাহলে সে আমাকে বলত।

কোনও মেয়ের পক্ষে সেটা সম্ভব নয়, দীপ।

দীপ আমার চোখে চোখ রেখে ঈষৎ শান্ত হয়ে বলল, ওকে! কিন্তু সুভদ্রার সঙ্গে আপনার পরিচয় নেই, তাই একথা ভাবতে পারছেন। যদি তার আগের প্রেমিক কেউ থাকে, সে ওকে ফলো করে এখানে আসে–আমার চোখে পড়ত। কারণ আমি একমাত্র একটা লোককে ভয় পাই, তিনি আমার বাবা। বাবা। নিজে বা কাউকে পাঠিয়ে চন্দনপুর-অন-সিতে আমি কী করছি, সে খবর নিতে পারেন–সেটা তার মতো লোকের পক্ষে অসম্ভব নয়। তাই আমি চারদিকে চোখ রেখেছিলুম। এক আপনি বাদে এখানে আর কোনও আউটসাইডারকে দেখিনি। তাছাড়া সবসময় সুভদ্রা আমার সঙ্গে থেকেছে। তারও কোনও সন্দেহজনক লোককে চোখে পড়েনি। পড়লে সে আমাকে বলত।

কিন্তু আজ তুমি দুপুরে যখন ঘুমিয়ে ছিলে, তখন যদি কেউ এসে ওকে। ডেকে নিয়ে গিয়ে থাকে?

বাবার লোক, কিংবা বাবা নিজে?

দীপের কণ্ঠস্বরে চমক লক্ষ্য করে বললুম, না। ধরো-সুভদ্রার আগের কোনো প্রেমিক?

দীপ হঠাৎ যেন পাগল হয়ে গেল। গর্জন করে দরজার দিকে আঙুল বাড়িয়ে বলে উঠল, গেট আউট ইউ ওল্ড ফুল! গেট আউট ইউ ব্লাডি হ্যাঁগার্ড! আই সে আউট! লিভ মি অ্যালোন।…

বেগতিক বুঝে দ্রুত বেরিয়ে এলুম। একালের ছেলেমেয়েদের রীতিনীতি সত্যি অদ্ভুত! গেট দিয়ে বেরিয়ে সংকীর্ণ এবড়ো খেবড়ো রাস্তায় ডাইনে পুবের দিকে পা বাড়ালুম। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার, সব সময় মনে হচ্ছিল কেউ আড়ালে থেকে আমাকে অনুসরণ করছে। কিছুতেই এই অস্বস্তিকর অনুভূতি এড়াতে পারলুম না। প্রতি মুহূর্তে পিছন বা পাশ থেকে আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে শেষ পর্যন্ত জ্যাকেটের ভেতর-পকেট থেকে ২২ ক্যালিবারের খুদে নতুন কেনা পিস্তলটি বের করতে হলো। এতে আঠারোটি গুলি ভরা আছে। সুতরাং অজানা আততায়ীর সঙ্গে লড়াই করার পক্ষে এটি যথেষ্ট।

আজ রাতে সমুদ্রকে জ্যোৎস্নায় একটা বিশাল বিস্ফোরণের মতো দেখাচ্ছিল। প্রচণ্ড হাওয়া দিচ্ছিল। জনহীন বিচে একটা সাদা কুকুরকে বালি শুঁকে বেড়াতে দেখছিলুম। গউর বলেছিল, বিচের বালি খুঁকে ওরা টের পায়, কোথায় পাঁকাল জাতীয় সাপ-মাছ ঢুকে আছে। বালি নখের আঁচড়ে সরিয়ে কিলবিলে সামুদ্রিক প্রাণীটিকে ওরা তারিয়ে তারিয়ে খায়। তাছাড়া কঁকড়াও কুকুরদের প্রিয় খাদ্য– যদিও বিদ্যুতের মতো গতিশীল এইসব কঁকড়া পাকড়াও করা ওদের কাছে আকাশকুসুম সাধ!

বেশ বলতে পারে বটে রসিক গউর। কিন্তু এ মুহূর্তে গউর বা তার রসিকতা অথবা ওই একলা অনুসন্ধানী ক্ষুধার্ত সাদা কুকুরটির চেয়ে আমার মনে অন্য একটি ভাবনা পাথরের মতো আটকে গেছে। আর প্রতিমুহূর্তে অতর্কিতে আক্রান্ত হওয়ার অস্বস্তি!

পাথরের ভাঙাচোরা বাড়িগুলোর ধ্বংসস্তূপের ভেতর ঢুকতে গিয়ে মনে হলো, ঠিক করছি না। মানুষখেকো বাঘের মতো অদৃশ্য আততায়ী আমাকে আত্মরক্ষার সুযোগ দেবে না এমন একটা পরিবেশে। ধ্বংসপুরীটি আন্দাজ তিনশো মিটারের বেশি লম্বা। বিচে খোলামেলায় নেমে উত্তর প্রান্তের বালিয়াড়ি দিয়ে আবার ওপরে উঠলুম। ঘুরে দক্ষিণমুখী হতেই সেই ছোট্ট টিকে থাকা কুঠুরিটি সামনে পড়ল, যার ওপাশের দেয়ালের ফোকর দিয়ে মেঝের বালিতে জুতোর ছাপ দেখেছি।

পিস্তল ও টর্চ বাগিয়ে ধরে মরিয়া হয়ে কয়েকটি পা বাড়িয়েছি সেদিকে, অমনি আমার পাশে ধপাস করে একটুকরো পাথর বা কিছু পড়ল। থমকে যেতেই আবার একটা ঢিল বা পাথর পড়ল। টর্চ জ্বেলে কিছু দেখতে পেলুম না সামনে। অথচ ক্ষেপণাস্ত্রগুলো সামনের ধ্বংসপুরীর দিক থেকেই আসছিল।

টর্চের আলোয় পিস্তলটি বাড়িয়ে চেঁচিয়ে বললুম, গুলি ছুঁড়ব বলে দিচ্ছি! সাবধান!

কিন্তু অদৃশ্য আততায়ী গ্রাহ্য করল না। হয়তো, সে নিরাপদে দেয়াল বা পাথরের স্তূপের আড়ালে আছে বলেই। আবার পাথরের টুকরো এসে পড়তে শুরু করল। আলোয় দেখতে পাচ্ছিলুম, সেগুলো খুবই ছোট্ট। খাপ্পা হয়ে। আন্দাজ করে ট্রিগারে চাপ দিলুম। গুলি বেরিয়ে গেল। প্রচণ্ড সামুদ্রিক হাওয়ায় পিস্তলের গুলির শব্দটা অতিরিক্ত কোনও সাড়া জাগাল না। আর আরও অদ্ভুত ব্যাপার, পাথর ছোঁড়া কিন্তু থেমে গেল না।

জনহীন জ্যোৎস্নারাতে পর্তুগিজ আর মুঘলদের ধ্বংসপুরীতে এতক্ষণে অন্য এক অস্বস্তির তীব্র শিহরন ঘটে গেল মনে। এ কি কোনও অশরীরী আত্মার ক্রিয়াকলাপ? এই কর্নেল নীলাদ্রি সরকার এ জীবনে অসংখ্য অদ্ভুত…অদ্ভুত ভৌতিক রহস্যের মোকাবিলা করেছে। কিন্তু এমন ভৌতিক ঘটনার মুখোমুখি কখনও হয়নি। আবার ঢিল পড়তে শুরু করলে কী এক দুজ্ঞেয় আতঙ্ক আমার রক্ত হিম করে ফেলল। আমি হনহন করে ফিরে চললাম পাণিগ্রাহীর বাংলো উদয়াচলের দিকে।

গউর ঘুমোচ্ছিল। দরজা খুলে দিয়েই টলতে টলতে যেভাবে নিজের ঘরের দিকে চলে গেল এবং একটি কথাও বলল না, তখন বুঝলাম লোকটা গাঁজাখোর।

পোশাক বদলে ফোনের কাছে গেলুম। কিন্তু ফোন তুলেই দেখলুম, ডেড! অথচ আজ দুপুরেও ফোন ঠিক ছিল। মেহেরপ্পঞ্জে পাণিগ্রাহীর সঙ্গে বাক্যালাপ করেছি ফোনে। অবাক হয়ে একটু বসে থাকার পর চুরুট ধরালুম এবং তারপরই একটা কথা মাথার ভেতর নড়ে উঠল।

এতগুলো ঢিল ছুঁড়ছিল কেউ, কিন্তু একটাও আমার গায়ে লাগেনি। ভূতের ঢিল নাকি মানুষের গায়ে লাগে না। কিন্তু ওই অশরীরী–যে আমাকে অতক্ষণ ধরে আড়াল থেকে অনুসরণ করছিল, তার ঢিলগুলো টর্চের আলোয় স্পষ্ট দেখেছি, সবই আমার আশেপাশে পড়ছিল!

তার মানে, সে আমাকে লক্ষ্য করে ঢিল ছুঁড়ছিল ঠিকই কিন্তু আমার শরীর তার লক্ষ্যস্থল ছিল না। কেন?

সে যেই হোক, আমাকে আঘাত করা তার উদ্দেশ্য ছিল না। যেন উদ্দেশ্য ছিল, আমাকে ওই কুঠুরিতে ঢোকা থেকে নিবৃত্ত করা? কেন?

মাই গুডনেস! আমি নড়ে বসলুম। সাদা দাড়ি আঁকড়ে ধরলুম উত্তেজনায়।…

.

পরদিন ভোর ছটায় গউর বেড-টি দিয়েছিল যথারীতি। আমিও চিরাচরিত নিজস্ব অভ্যাসে প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়েছিলুম। সমুদ্রতীরে ধ্বংসপুরীর সামনে পৌঁছে রাতের কথা ভেবে যুগপৎ হাসি ও দুঃখে বিচলিত বোধ করছিলুম। দিনের প্রথম ধূসর আলো, সমুদ্রে পূর্ব দিগন্তে আজ ঘন মেঘ এবং বাতাসও জোরালো, আমাকে অকুতোভয়ে সেই ছোট্ট কুঠুরিতে পৌঁছে দিতে সাহায্য করল। ভেতরে ঢুকেই থমকে দাঁড়ালুম।

কোণের দিকে একখানে বালির মেঝে কেউ যত্ন করে সমান করে রেখেছে। একই জুতোর সোলের অনেকগুলো ছাপ। কাল দিনশেষে দেখা ছাপের ওপর এই ছাপগুলো দেবে বসেছে। কেউ ভারী কিছু তুলেছে যেন! তারপরই ফোকরটার দিকে চোখ পড়ল। ফোকরের কিনারা এবড়ো-খেবড়ো এবং ধারালো। সেখানে কয়েকটা লম্বা কালো চুল আটকে আছে।

দেখা মাত্র ফোকর গলিয়ে ওপাশে গেলুম। বালির ওপর বড়-ছোট পাথরের ধসে পড়া চাঁই পড়ে আছে। সেই বালিতেও দেবে যাওয়া জুতোর ছাপ। বাঁদিকে। ঘুরে গেছে ছাপগুলো। একটা ফুট তিনেক খাড়া দেয়ালের ভাঙা অংশের নিচে সটান ঢালু বালিয়াড়ি বিচের কিনারায় শেষ হয়েছে। সেই ঢালু বালিয়াড়িতে একটা জায়গা ধস ছেড়েছে এবং এখন জোয়ারের সময় সমুদ্রের ফেনিল জলের হাল্কা স্তরগুলো বিচের কিনারা অব্দি ধুয়ে দিয়ে যাচ্ছে। ধস ছাড়া জায়গাটা দেখে বুঝলুম, এখান দিয়েই ভারী জিনিসটা বয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বিচে। বিচের সব চিহ্ন জোয়ার এসে ধুয়ে ফেলেছে। কিন্তু সবই স্পষ্ট হয়ে গেল আমার কাছে।

হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গেলুম প্রথমে দীপের বাংলোয়। কিন্তু ডাকাডাকি করেও তার সাড়া পেলুম না। তখন থানায় যাওয়ার জন্য পা বাড়ালুম।

কিন্তু কয়েক পা এগিয়ে কী একটা বোধ মাথার ভেতর ঝিলিক দিল। ডাইনের ঘাস-জমিতে পায়ে চলা রাস্তাটা দিয়ে ফিরে গেলুম উদয়াচলে– আমার ডেরায়। গিয়ে দেখি, গেটে তালাবন্ধ করে গউর রোজকার মতো সাইকেলে চেপে বাজারে গেছে। সাড়ে ছটা বাজে। ডুপ্লিকেট চাবি আছে আমার কাছে। গেট খুলে বারান্দায় পৌঁছুতে দু সেকেন্ডও লাগল না। প্রথমে ঘরে ঢুকেই ফোনের লাইন চেক করলুম। ফোন তেমনি ডেড। তখন তারটি টেনে বের করলুম ওয়াড্রোবের পেছন থেকে। তারপর আবিষ্কার করলুম-হা, আমি তো এটা জানতুমই, তারটা কাটা রয়েছে।

কিটব্যাগে কখন কী কাজে লাগে ভেবে সব সময় টুকিটাকি ক্রুড্রাইভার, খুদে ছুরি এসব মজুত রাখি। ঝটপট তার জোড়া দিতেই লাইন চালু হলো। প্রথমেই রিং করলুম আর্মিক্যাম্পের কমান্ডান্ট মিঃ চোপরাকে। চোপরা আমার এক সামরিক অফিসার বন্ধুর ছেলে। তাকে যখন জিগ্যেস করলুম, চন্দনপুর বিচে পৌঁছুনোর জন্য এনট্রি-গেট ছাড়া আর কোনও পথ আছে কি না– বিশেষ করে গাড়ি নিয়ে, সে খুব অবাক হয়ে হাসতে লাগল। বলল, না। সি-বিচের দক্ষিণে, লাইটহাউসের পর ব্যাকওয়াটারভীষণ কাদা আছে। আর উত্তরে বিচের শেষদিকে চোরাবালি আছে। প্রটেক্টেড এরিয়া। এছাড়া উত্তরে আর্মির গুলিগোলা প্র্যাকটিসের জায়গা। কাজেই প্রটেক্টেড এরিয়া। দক্ষিণে আর্মিক্যাম্প। পশ্চিমে ওই গেট আর দুধারে খাড়া পাহাড়ের দেয়াল। অতএব গাড়ি নিয়ে ঢোকার প্রশ্নই ওঠে না। পায়ে হেঁটে? অসম্ভব। মিলিটারির চোখ এড়িয়ে কোনো ট্রেসপাসারের ঢোকার সাধ্য নেই। কিন্তু এসব প্রশ্ন কেন?

পরে জানাব, বলে ফোন রাখলুম। এবার ডায়াল করলুম এনট্রি গেটের অফিসারকে। গত এক সপ্তাহের মধ্যে গতকাল পর্যন্ত কেউ চন্দনপুরে ঢুকেছে। কি না? অফিসারটি চোপরার সুবাদে আমাকে খাতির করেন। জানালেন, তিনজন ঢুকেছেন এই সময়ের মধ্যে। এক : আমি। দুই: মেহেরগঞ্জের বিখ্যাত ব্যবসায়ী মৃত্যুঞ্জয় মহাপাত্রের পুত্র দীপঙ্কর এবং পুত্রবধূ সুভদ্রা।

 পুত্রবধূ! আমার মুখ দিয়ে কথাটা বেরিয়ে গেলে অফিসার ভদ্রলোক হাসতে লাগলেন। বললেন, ওকে কর্নেল! মে বি হিজ ফিয়াসে অর আ লাভ-গার্ল! আপনি নিশ্চয় শুনেছেন চন্দনপুর বিচকে লাভার্স বিচ বলা হয়?

ফোন রেখে চুরুট ধরালুম। ছটা পঁয়তাল্লিশ বাজে। একটু ইতস্তত করে থানায় রিং করলুম। ডিউটি অফিসারকে নিজের পরিচয় দিয়ে বললুম, প্লিজ ও সি মিঃ মোহন পট্টনায়ককে বলুন, আমি একটা খুব জরুরি কথা বলব।

এক মিনিট পরে পটনায়কের সাড়া পেলুম। …হ্যালো ওল্ড ম্যান। ইউ আর হেয়ার অ্যাট লাস্ট! ও মাই গড! শুনেছি, প্রবাদ আছে : কর্নেল যেখানে, ডেডবডি সেখানে। উঃ! আপনাকে নিয়ে পারা যায় না মশাই! কবে এসেছেন? একবার রিং করবেন তো! সেই কবে ভুবনেশ্বরে ডঃ সীতাকান্তের বাড়িতে দেখা–এক বছর আগে! তো

দ্রুত বললুম, শিগগির দলবল নিয়ে সি-বিচে চলে যান। আমি সেখানেই ওয়েট করব।

ফোন রেখে উঠে দাঁড়ালুম। এবার একটা কাজ বাকি। জরুরি কাজ। গউর ফেরার আগেই সেটা সেরে ফেলতে হবে। জানি না সফল হব, না ব্যর্থ। কিন্তু এই কাজটাই এখন আসল কাজ।…

.

কে যেন বলেছিলেন, সমুদ্র অন্যের কিছু নেয় না নিলে তা ফিরিয়ে দেয়। ফিরিয়ে দিয়েছে সুভদ্রাকে।

একদল নুলিয়া ভিড় করে দাঁড়িয়েছিল বিচের একখানেকাল বিকেলে বিচের যে পাথরটায় বসেছিলুম, সেখানে। আমিও পৌঁছেছি বালিয়াড়ির মাথায়, পটনায়কের জিপও এসে পড়েছে একই সময়ে। সঙ্গে দুজন কনস্টেবল আর একজন এস আই। পটনায়ক জিপ থেকে নেমেই সহাস্যে বললেন, হোয়্যার ইজ ইওর ডেডবডি, কর্নেল?

আঙুল দিয়ে নিচের বিচের নুলিয়াদের ভিড়টা দেখিয়ে দিলুম। পুলিশবাহিনী বালিয়াড়ি ভেঙে ধস ছাড়ার মতো নেমে গেল। আমি গেলুম–অন্তত এক– মিনিট পরে।

গলায় শাড়ির ফাস শক্ত করে আটকানো ধূসর এক মৃতদেহ–প্রায় উলঙ্গ যুবতীর নিস্পন্দ শরীর। নোনাজলে সাদাটে দেখাচ্ছে। জিভ দাঁতের ফাঁকে। ব্লাউস ফদাফাই–একাংশ টিকে আছে। ব্রা নেই।

পটনায়ক ঠোঁট কামড়ে ধরে দেখছিলেন। এসে আমার একটা হাত নিয়ে একটু তফাতে গিয়ে চাপা স্বরে বললেন, বলুন কর্নেল!

সংক্ষেপে দ্রুত সব বললুম। শোনার পরই পটনায়ক চাপা গর্জন করলেন, দা ব্লাডি বাস্টার্ড! তারপর আমার দিকে ঘুরে একটু হাসবার চেষ্টা করে বললেন, লাভার্স বিচের ট্রাডিশন, কর্নেল! এই বিচে কী আছে জানি না, এই এক বছর ধরে দেখছি–এ নিয়ে তিনটে মেয়ের ডেডবডি পাওয়া গেল। আগের দুটোকেও মারতে নিয়ে এসেছিল তাদের প্রেমিক। আগের বহু কেস-হিসট্রিতেও একই ব্যাপার দেখেছি। এবার আমার আমলে দিস ইজ দা থার্ড কেস। আই ড্যাম কেয়ার অফ দা ওয়েলদি বিজনেসম্যান মহাপাত্র! শুনেছি, তার পলিটিক্যাল গার্জেন ইজ দা মোস্ট পাওয়ারফুল ম্যান ইন ওড়িশা! সো হোয়াট? আইন তার নিজের পথে চলবে।

মিঃ পটনায়ক! ডাকলুম ব্যস্তভাবে।

 পটনায়ক ঘুরে বললেন, বলুন কর্নেল!

 দীপঙ্কর তার ফিয়াসেকে খুন করেনি।

হোয়াট? পটনায়ক উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। ফের বললেন, হোয়াই নট? পয়েন্টটা কি আপনার?

শান্তভাবে বললুম, সুভদ্রাকে একটা লোক মিথ্যা কথা বলে ডেকে এনে ওই কুঠুরির ভেতর রেপ করেছিল কাল বেলা আড়াইটের মধ্যে। হা-ওটাই সম্ভাব্য সময়। শি ওয়াজ বুটালি রেল্ড অ্যান্ড কিল্ড বাই হিম। কারণ রেপ করার পর এ ছাড়া তার বাঁচার উপায় ছিল না।

পটনায়ক আস্তে বললেন, কে সে?

পকেট থেকে দলা-পাকানো একটুকরো ভাঁজ করা কাগজ–যা আমি ভজ করেছি, ওঁর হাতে গুঁজে দিলুম। বললুম, সুভদ্রা–যা বুঝতে পেরেছি, খুব সরল আর বোকা মেয়ে ছিল। তাকে বহুবার–গত দু-দিন ধরে বাইনোকুলারে ওয়াচ করেছি। হা–সে হাসিখুশি সরল মেয়েই ছিল। পাছে ওভাবে গতকাল বেলা দুটোর পর দীপঙ্কর তাকে একা বেরুতে দেখলে কী ভাববে, তাই সরল মনেই এই চিঠিটা লিখে রেখে এসেছিল। দীপঙ্কর ঘুমুলে তার একা আসা হতো না। আর একটা কথা, লোকটা জানলার ফাঁক দিয়ে অথবা কোনোভাবে সুভদ্রাকে চিঠিটা লিখতে দেখেছিল বলেই আমার ধারণা। তাই সে গতরাতে সাতটা নাগাদ এক সুযোগে ওটা চুরি করে নিয়ে আসে। দীপঙ্কর তখন বাথরুমে ছিল। দরজা ও গেট ছিল ভোলা। ওর মাথার ঠিক ছিল না তখন।

পটনায়ক বললেন, কিন্তু কিন্তু চিঠিটা দীপঙ্কর কোথায় রেখেছে সে জানল কীভাবে?

বললুম, খুব সহজে। দীপঙ্কর চিঠিটা পেয়েই বিচে খুঁজতে আসে সুভদ্রাকে। আততায়ী তার দিকে লক্ষ্য রেখেছিল। চিঠিটা স্বাভাবিকভাবেই দীপঙ্করের হাতে এই বিচে দাঁড়িয়ে আবার তাকে পড়তে দেখেছিল আততায়ী। তার ভয়ও ছিল, দীপঙ্কর ডেডবডিটা খুঁজে পায় যদি! অবশ্য তখন ডেডবডিটা ওই কুঠুরির ভেতর বালিতে পোঁতা ছিল। কাল রাতে একই কারণে সে ঢিল ছুঁড়ে আমাকে ওদিকে পা বাড়াতে দেয়নি।

পটনায়ক শ্বাস ছেড়ে বললেন, ওক্কে! কিন্তু আপনি এটা পেলেন কোথায়?

 পাণিগ্রাহীর উদয়াচল বাংলোর কিচেনের পেছনে ছাইগাদায়।

হোয়াট? পটনায়ক আবার প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন। হোয়াট ডু য়ু মিন বাই দ্যাট কর্নেল? হু ইজ দা ব্লাডি কিলার? কে সে?

আমার সঙ্গে চলুন। আপনি একাই যথেষ্ট। ওঁদের বলে আসুন, বডি মর্গে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে।

এই কথা বলে ধীরে সুস্থে আমি বালিয়াড়ির দিকে পা বাড়ালুম।…

.

গউর আমার ব্রেকফাস্ট রেডি করছিল। একবার তাকিয়েই কিচেনে গিয়ে ঢুকল। পটনায়ক এক মুহূর্ত দেরি করলেন না। সোজা কিচেনে ঢুকেই তার জামার কলার আঁকড়ে ধরলেন।

অমনি চমকে উঠে কয়েক সেকেন্ডের জন্য গোবেচারা ধরনের ওই মধ্যবয়সী লোকটির মধ্যে হিংস্র চিতাবাঘের রূপ দেখলুম। তারপর আবার তার রূপান্তর ঘটল। আগের মতো গোবেচারা সরল মুখ। পটনায়ক তাকে টানতে টানতে আমার সামনে দিয়ে নিয়ে গেলেন। একটিবারও সে মুখ খুলল না।

আর তার তৈরি ব্রেকফাস্ট খাওয়া অসম্ভব আমার পক্ষে। নিজে ব্রেকফাস্ট তৈরি করতে ইচ্ছে করছিল না। পটনায়কের জিপের শব্দ মিলিয়ে গেলে তালা এঁটে বেরিয়ে পড়লুম।

দীপঙ্করের বাংলোয় গিয়ে দেখি গেটে তালা। তখন বিচের দিকে এগিয়ে গেলুম। হা–যা আশা করেছিলুম, ঠিক তাই।

তখনও নুলিয়া ছেলেমেয়ে বুড়োবুড়ির একটা দল আর দুজন কনস্টেবল সুভদ্রার মৃতদেহ ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। এস আই ভদ্রলোক নিশ্চয় অ্যামবুলেন্সে খবর দিতে গেছেন।

দীপঙ্কর একটু দূরে একটা পাথরে বসে আছে। একটুকরো প্রাচীন ভাস্কর্য যেন। সমুদ্রের জল এসে আছড়ে পড়ছে পাথরটার ওপর। ভিজিয়ে দিচ্ছে তাকে। কাছে গিয়ে ডাকলাম, দীপ! ডার্লিং!

দীপঙ্কর তাকাল না।

 দীপ, সুভদ্রার খুনী ধরা পড়েছে।

দীপঙ্কর নড়ে উঠল। তারপর একলাফে পাথর থেকে নেমে দৌড়ে এসে মুখোমুখি দাঁড়াল। আঁটো চোয়াল। লাল চোখ। উষ্কোখুস্কো চুল মুখের ওপরটা বারবার ঢাকা পড়ছে। হিসহিস করে বলল, কে? সে কে?

আস্তে বললুম, আচ্ছা দীপ, গউর নামে পাণিগ্রাহীর বাংলোর কেয়ারটেকারকে তো তুমি চেনো?

দীপঙ্কর সঙ্গে সঙ্গে চমকে উঠল। বলল, নাও আই আন্ডারস্ট্যান্ড!

কী দীপ?

গউর আমাদের ফলো করে বেড়াত।

 সে তোমার বাংলোয় গেছে কখনও?

হ্যাঁ। দীপঙ্কর ভাঙা গলায় বলল। কাজকর্ম করে দিত একটু-আধটু। গতকালও সকালে সে জানতে গিয়েছিল কিছু দরকার আছে নাকি। কিন্তু

তাকে থামিয়ে দিয়ে টানতে টানতে নিয়ে চললুম তার বাংলোয়। সেখানে পৌঁছেই ফোন করলুম থানায়। পটনায়ক সাড়া দিয়ে খ্যাখ্যা করে হেসে বললেন, এক গুঁতোতেই কবুল করেছে কর্নেল! শয়তানটা বলছে, সে চুপিচুপি সুভদ্রাকে বলেছিল, মহাপাত্রমশাই সুভদ্রার সঙ্গে গোপনে দেখা করতে এসেছেন। ছেলের বিরুদ্ধে তার কিছু বলার আছে, সেটা সুভদ্রাকে গোপনে জানতে চান। তাই শুনেই সুভদ্রা ওর কথামতো ওই ছোট্ট কুঠুরিতে গিয়ে মহাপাত্ৰমশাইকে খোঁজে এবং

দীপঙ্করের গলায় বলে উঠলুম, ওকে! আই আন্ডারস্ট্যান্ড! বাট–অফ কোর্স ইটস নট দা ট্রাডিশনাল অ্যাফেয়ার অফ দা লাভার্স বিচ। এ একটা নতুন ঘটনা-তাই না মিঃ পটনায়ক?

পটনায়কের খ্যাখ্যা হাসি ভেসে এল দূর থেকে। হা কর্নেল, ট্রাডিশান ভেঙে দিয়েছে হারামজাদা গউড়—অ।…