০৪. সারাদিন গুমোটের পর

সারাদিন গুমোটের পর হঠাৎ একচিলতে ঠাণ্ডা হাওয়া উঠল। গা জুড়িয়ে এল, কিন্তু প্ৰাণে জাগছে আতঙ্ক। সময়টা খারাপ, চৈত্রের শেষ। ঈষাণকোণে মেঘ জমেছে, তার কালো ছায়া আধখানা আকাশকে যেন ঘোমটা পরিয়ে দিল। যেন একটা দুরন্ত দৈত্য হঠাৎ পৃথিবীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বার আগের মুহূর্তে পায়তাড়া কষছে।

মাঠের ঘাটে পথে পুকুরের যে যেখানে বাইরে ছিল, তারা ঘন ঘন আকাশের দিকে তাকাতে তাকাতে হাতের কাজ চটপট সারাতে শুরু করল।

আর বাতাসে বাতাসে তরঙ্গ তুলে গ্রামের এ-প্ৰান্ত থেকে ও-প্রান্ত অবধি ছড়িয়ে পড়ল একটানা একটা সানুনাসিক স্বরের ধুয়ো। সে স্বর ধাপে ধাপে চড়ছে, মাঝে মাঝে খাদে নামছে। তার ভাষাটা এই বুধী আঁ-য়! সুন্দরী আঁ-য়! মুংলী আঁ-য়! লক্ষ্মী আঁয়!

ঝড়ের আশঙ্কায় গৃহপালিত অবোলা জীবগুলিকে গোচারণ ভূমি থেকে গোহালে ফেরার আহবান জানানো হচ্ছে।

সত্যবতী জানে না। ঝড়ের আগের মুহূর্তে কিংবা সন্ধ্যার আগে গরুগুলোকে যখন ডাক দেওয়া হয়, তখন নাকি সুরে ডাকা হয় কেন ও জানে এই নিয়ম। অবিশ্যি যারা ডাকে, তারা নিজেরাই বা আট বছরের সত্যবতীর চাইতে ৰোশী কি জানে? তারাও জ্ঞানাবধি দেখে আসছে। গরুকে সাবসন্ধ্যায় ঘরে ফিরিয়ে আনবার সময় আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে যে আহবানটা জানানো হয়, সেটার সুর সানুনাসিক। কে জানে কোন কালে কোন বেরপ্রাপ্ত গরু মানুষের ভাষা শিখে ফেলে, মানুষের কাছে তার পছন্দ-অপছন্দর নমুনাটা জানিয়েছে কিনা। বলেছে কিনা। এই সানুনাসিক স্বরটাই আমার রত চিকর।

আপাতত দেখা যাচ্ছে এই অবোলা জীবগুলি এ-প্ৰান্ত ও-প্রান্ত ধুয়োতে সচকিত হয়ে দ্রুতগতিতে গোহালিমুখী হচ্ছে। তারাও গলা তুলে আকাশটাকে দেখে নিচ্ছে একবার একবার।

সত্যবতী একটা সংবাদ বহন করে দ্রুতগতিতে বাঁড়ুয্যে-পাড়া থেকে বাড়ির দিকে আসছিল, তবু আশেপাশে ধুয়ো শুনে অভ্যাসবশে গলার সুর চড়িয়ে হাঁক পাড়ল, শ্যামলী আঁ-য়! ধবলী আঁ-য়!

আমবাগানের ওদিক দিয়ে রামকালী ফিরছিলেন রায়পাড়া থেকে পায়ে হেঁটে।

পালকিটি ধার দিয়ে আসতে হয়েছে রায়পাড়ায়।

গ্রাম-বৃদ্ধ রায়মহাশয়ের অবস্থা খারাপ, খবর পেতে নাড়ী দেখতে গিয়েছিলেন রামকালী। নাড়ীর অবস্থা দেখে গঙ্গাযাত্রার ব্যবস্থা দিলেন, আর ব্যবস্থা দিয়েই পড়লেন বিপাকে।

রায়মশায়ের ছেলেরা দুজনেই গত হয়েছে, আছে তিন নাতি কিন্তু তাদের এমন সঙ্গতি নেই যে পালকিভাড়া দিয়ে আর চারটে বেহারাকে মজুরি জলপানি দিয়ে ঠাকুরদার গঙ্গাযাত্রা করাবে। অথচ আমন নিষ্ঠাবান সদাচারী প্রাচীন মানুষটা ঘরে পড়ে মরবে? এটাই বা চোখে দেখে সহ্য করা যায় কি করে? আর গেলে ত্ৰিবেণীর গঙ্গাই উত্তম। গঙ্গাযাত্রার ঘোষণা শুনেই রায়মশাইয়ের নাতিরা যেই মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল, সঙ্গে সঙ্গেই বলতে হল রামকালীকে, পালকির জন্যে চিন্তা করো না, আমার পালকিতেই যাবেন রায় কাকা।

নাতিরা অস্ফুটে একবার বলল, আপনাকে রোগী দেখতে দূরে দূরে যেতে হয়, পালকিটা দিলে–

রামকালী গম্ভীর হাস্যে বললেন, তবে নয়। ঠাকুরদাকে কাঁধে করেই নিয়ে যাও! তিন নাতি রয়েচ উপর্যুক্ত!

বয়োজ্যেষ্ঠর পরিহাসবাক্যে হেসে ফেলবে এমন বেয়াদপির কথা অবশ্য ভাবাই যায় না, কাজেকাজেই তিনজনে ঘাড় চুলকোতে লাগল। আর ওরই মধ্যে যে বড়, সে সাহসে ভর করে বলল, ভাবছিলাম গো-গাড়ি করে—

ভাবাটা খুব উচিত হয় নি বাপু! রামকালী বলেন, গো-বাড়ি চড়িয়ে নিয়ে গেলে ওই বিরোনব্বই বছরের জীর্ণ খাঁচাখানা কি আর প্রাণপাখি সমেত গঙ্গা পর্যন্ত পৌঁছবে? পাখি খাঁচাছাড়া হয়ে উড়ে যাবে। আমিও ওঁর সন্তানতুল্য বাপু, তোমাদের সঙ্কোচ করবার কিছু নেই। তাছাড়া চটপট ব্যবস্থার দরকার, কখন কি হয় বলা যায় না।

রায়মশাইয়ের ঘোলাটে চোখ দুটো থেকে দুফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। তিনি শিরাবহুল ডানহাতখানা আশীর্বাদের ভঙ্গীতে তুলে বললেন, জয়স্তু।

বাইরে এসে রামকালী পালকিবোহারা কটাকে নির্দেশ দিলেন, পালকিটা আর মিথ্যে বয়ে নিয়ে যাবি কেন, ওটা এখানেই থাক, তোরা বাড়ি গিয়ে খেয়ে-দোয়ে নে গে। শেষ রাতে উঠে চলে আসবি। আর দেখ, বাড়ি থেকে কালকের সারাদিনের মতন জলপান নিয়ে আসবি, বুঝলি? আর শোন, তোরা এখন এখানে কিছু কাজকর্মের প্রয়োজন আছে কিনা দেখ। আমি বাড়ি ফিরছি।

জোর পায়েই ফিরছিলেন রামকালী, কারণ বেরিয়েই দেখেছিলেন ঈষাণ কোণে মেঘ। পালকি চড়ে রুগী দেখতে যান বলে যে রামকালী হাঁটতে অনভ্যস্ত তা নয়। প্রতিদিন ব্ৰাহ্মমুহূর্তে উঠে, প্রাতঃকৃত্য সেরে ক্রোশ-দুই হেঁটে আসা তাঁর নিত্যকর্মের প্রথম কর্ম। তবে হ্যাঁ, রোগীর বাড়ি যাওয়ার কথা আলাদা, সেখানে মান-মর্যাদার প্রশ্ন।

পথ সংক্ষেপের জন্য বাগানের পথ ধরেছিলেন, কিন্তু আমবাগানের কাছবরাবর আসতেই ঝরাপাতা আর ধুলোর ঝড় উঠল। রামকালী তাড়াতাড়ি বাগানের মাঝামাঝি থেকে বেরিয়ে কিনারায় এলেন, আর আসতে না আসতেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন। গলা কার?

সত্যর না?

হ্যাঁ, সত্যরই তো মনে হচ্ছে।

যদিও ঝড়ের সোঁ সোঁ শব্দের বিপরীতে শব্দটা হওয়ায় বুঝতে সামান্য সময় লেগেছিল, কিন্তু সে সামান্যই। তা ছাড়া গরু দুটোর নামও পরিচিত। শ্যামলী ধবলী রামকালীর বাড়িরই গরু। গরু অবিশ্যি চাটুয্যেদের একগোহাল আছে, কিন্তু এই গরু দুটি বিশেষ সুলক্ষণযুক্ত বলে রামকালীর বড়ই প্রিয়। সময় পেলেই রামকালী নিজে হাতে ওদের মুখে ঘাস ধরে দেন, গায়ে হাত বুলেন। বাড়ির কুমারী মেয়েরা শ্যামলী ধবলীকে নিয়েই গোকাল ব্ৰত করে, মোক্ষদা তাদের কাছ থেকে সংগৃহীত গোময় দ্বারাই সম্যক বিশুদ্ধতা রক্ষা করে চলেন।

কান খাঁড়া করে ধ্বনির মূল উৎসের দিকটা অনুমান করে নিলেন রামকালী, তারপর দ্রুতপায়ে এগিয়ে গিয়ে ধরে ফেললেন কন্যাকে। সত্যবতী তখন ধুলোর আচোট থেকে চোখ রক্ষা করতে আঁচলের কোণটা দুহাতে মুখের সামনে তুলে ধরে ছুটছিল।

যাচ্ছিস কোথায়?

জলদগম্ভীর স্বরে হাঁক দিলেন রামকালী।

সত্যবতী চমকে মুখের ঢাকা খুলে থ!

যদিও সকলেই সত্যবতীকে বাপ-সোহাগী আখ্যা দেয় এবং সত্যিই সত্যবতী রামকালীর বিশেষ আদরিণী,–তা ছাড়া পয়মন্ত মেয়ে বলে রামকালী মনে মনে বেশ একটু সমীহও করেন। তাকে, তাই বলে সামনাসামনি যে কোন আদর-আদিখ্যেতার পাট আছে তা নয়। কাজেই বাবার গলা শুনেই সত্যবতীর হয়ে গেছে!

রামকালী আর একবার প্রশ্ন করেন, এমন সময়ে একা গিয়েছিলি কোথায়?

সত্যবতী ক্ষীণ কণ্ঠে বলে, সেজপিসীর বাড়ি।

সত্যবতী যাকে সেজপিসী আখ্যা দিল তিনি হচ্ছেন রামকালীর খুড়তুতো বোন, এ গ্রামেই শ্বশুরবাড়ি। এ গ্রামেই বাস।

রামকালী ভুরু কুঁচকে বলেন, অত দূরে আবার একা একা যাবার দরকার কি? সঙ্গে কেউ নেই কেন?

এইজন্যেই সত্যবতীর বাপসোহাগী আখ্যা।

চড় নয়, চাপড় নয়, নিদেন একটা কানমলাও নয়। শুধু একটু কৈফিয়ত তলব।

সত্যবতী এবার সাহস পেয়ে বলে, না একা কেন, পুণ্যপিসি আর নেড়ু ছিল। তারপর আমি তোমাকে ডাকতে ছুটতে ছুটতে আসছি।

আমাকে ডাকতে ছুটতে ছুটতে আসছিস? রামকালী ভুরু কুঁচকে বলেন, কেন? আমায় কি দরকার?

সত্যবতী এবার পূর্ণ সাহসে ভর করে সোৎসাহে বলে, জটাদার বৌ যে মর-মার। নাড়ী ছেড়ে গেছে। তাই সেজপিসী কেঁদে বললে, যা সত্য, একবার মেজদাকে ডেকে নিয়ে আয়, যেখানে পাস। তা আমি রায়পাড়া গিয়ে শুনলাম তুমি এই মাত্তর চলে এসেছ!

আবার রায়পাড়াও গিছিলি! নাঃ, বিপদ করলে দেখছি। জটার বৌয়ের আবার হঠাৎ কি হল যে নাড়ী ছেড়ে যাচ্ছে?

যাচ্ছে কি বাবা, সত্য আরও উৎসাহ সহকারে বলে, গেছে। সেজপিসী চোঁচাচ্ছে, বুক চাপড়াচ্ছে আর বালিশ বিছানা সরিয়ে নিচ্ছে।

আঃ কি যে বলে! চল দেখি গে। রামকালী বলেন, ঝড় উঠে পড়ল, এখুনি বিষ্টি আসবে, কি মুশকিল! হয়েছিল কি?

কিছু নয়। সেজপিসী বললে, রান্নাবান্না সেরে যেই খেতে বসেছে জটাদার বৌ, আর আমনি ওটাদা পান চেয়েছে! জটাদার বৌ বলেছে, পান ফুরিয়ে গেছে, ব্যস বাবু মহারাজের রাগ হয়ে গেছে। দিয়েছেন ঠাঁই ঠাঁই করে পিঠের ওপর লাথি। আর অমনি জটা-বৌঠান কাসিতে মুখ থুবড়ে। হঠাৎ খুক খুক করে হেসে ওঠে সত্যবতী।

হাসছিস যে!

ধমকে উঠলেন রামকালী। বিরক্ত হলেন। কী অসভ্য হচ্ছে মেয়েটা! হাসির কি সময় অসময় নেই? বললেন, মানুষ মরছে দেখে হাসতে হয়? এই শিক্ষাদীক্ষা হচ্ছে?

সত্যবতী নিতান্তই হেসে ফেলেছিল, এখন বাপের ধমকে সামলে নিয়ে মুখটা স্নান করবার চেষ্টা করে বলে, সেজপিসী বলছিল যেই না ধাক্কা খাওয়া আমনি কুমড়ো গড়াগড়ি হয়ে দাওয়া থেকে উঠোনে পড়ে গেল! কষ্টে হাসি চেপে ফের বলে সত্যবতী, জটাদার বৌ অনেক ভাত খায় না বাবা! তাই অত মোটা!

আঃ! বলে বিরক্তি প্ৰকাশ করে তাড়াতাড়ি এগোতে থাকেন। রামকালী।

সত্যবতীও হাঁটায় কিছ কম দাঁড় নয়। বাপের সঙ্গে সমানই এগোতে থাকে।

রামকালী জটার বৌয়ের জন্য সহানুভূতিতে যতটা না হোক, জটার ব্যবহারে মনে মনে অত্যন্ত বিরক্তি বোধ করেন। হতভাগা বামুনের ঘরের গরু, পেটে ক অক্ষরের আঁচড় নেই, গাজা-গুলি সবেতেই ওস্তাদ। আবার বংশছাড়া বিদ্যে হয়েছে, বৌ-ঠেঙানো! জটা, ফাটর বাপ তো আমন ছিল না! বরং রামকালীর গুণবতী বোনই লোকটাকে সারাজীবন জুলিয়ে পুড়িয়ে খেয়েছেন!

কে জানে কী কী ভাবে বেটক্করে লেগেছে, সত্যিই যদি মরে-টারে যায়, দস্তুরমত ফ্যাসাদে পড়তে হবে।

সত্যবতীর কথা ভুলে গিয়ে আরও জোরে পা চালান রামকালী। সত্যবতী এবার দৌড়তে শুরু করে। হেরে যাবে না। সে।

চোখ কপালে উঠে স্থির হয়ে গেছে, মুখে ফেনা ভেঙ্গে সে ফেনা শুকিয়ে উঠেছে। হাত পা ঠাণ্ডা পাথর।

সন্দেহ আর নেই, সমস্ত লক্ষণই স্পষ্ট। তুলসীতলায় শুইয়ে দেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যেই। অবশ্য কষ্ট করে আর ঘর থেকে বয়ে আনতে হয় নি, লাথি খেয়ে গড়িয়ে তো উঠোনেই পড়েছিল তুলসীতলার কাছবরাবর। দণ্ডখানেকের মধ্যেই বেতারবার্তায় সারা পাড়ায় সংবাদ রটে গেছে এবং পাড়া ঝেটিয়ে মহিলাবৃন্দ এসে জড়ো হয়েছেন, আসন্ন ঝড়ের আশঙ্কা তুচ্ছ করে।

ব্যাপারটা তো কম রংদার নয়, দৈনন্দিন বৈচিত্ৰ্যশূন্য জীবননাট্যের মধ্যে এমন একটা জোরালো দৃশ্য দর্শনের সৌভাগ্য জীবনে কবার আসে?

প্ৰথমে সমস্ত জনতার মধ্যে উঠল একটা চাপা উত্তেজনার আলোড়ন, জটা নাকি বৌটাকে একেবারে শেষ করে ফেলেছে! তারপর হায় হায়। জটা সম্পর্কে মন্তব্যগুলিও এখন আর জটার মার কান বাঁচিয়ে হচ্ছে না। কারণ স্পষ্ট কথা বলে নেবার মত এ-হেন সুযোগই বা কার জীবনে কবার আসে?

সত্যি শেষ হয়ে গেছে? ছিছিছি, কী খুনে দস্যি ছেলে গো! ধন্যি সন্তান পেটে ধরেছিল ম্যাগী! আচ্ছা জটাটাই বা এত গোয়ার হল কোথা থেকে? ওদের বাপ তো ভালমানুষ ছিল! হল কোত্থেকে? তুমি আর জ্বলিও না ঠাকুরঝি, বলি গৰ্ভধারিণীটি কেমন? এ হচ্ছে খোলের গুণ!. আহা হাবাগোবা নিপাট ভাল মানুষ বেঁটা, মা-বাপের বাছা, বেঘোরে প্রাণটা গেল! এমনি নানাবিধ আলোচনা চলতে থাকে। একটা মেয়েমানুষের জন্যে, এর চাইতে আর কত বেশী দরদ আশা করা যায়?

প্রতিবেশিনীদের আক্ষেপোক্তিগুলো নীরবে হজম করতে বাধ্য হচ্ছিলেন জটার মা, কারণ আজ তিনি বড় বেকায়দায় পড়ে গেছেন। তাই সমস্ত মন্তব্য চাপা পড়ে যায় এমন সুরে মড়াকান্নাটা জুড়ে দেন তিনি, বুক চাপড়ে চাপড়ে মৰ্মভেদী হৃদয়বিদারক ভাষায় ইনিয়ে বিনিয়ে।

বাড়ির কাছাকাছি আসতে না আসতেই শুনতেই পেলেন রামকালী খুড়তুতো ছোটবোনের সেই পাজারভাঙা শোকগাথা, ওরে আমার ঘরের লক্ষ্মী ঘর ছেড়ে আজ কোথায় গেল রে! ওরে সোনার পিতিমেকে বিসর্জন দিয়ে আমি কোন প্ৰাণে ফের সংসার করব রে! ওরে জটা, তোর যে নগরে না। উঠতেই বাজারে আগুন লাগল রে!

সত্যবতী বলে উঠল, যাঃ, সৰ্বনাশ হয়ে গেল!

দ্রুত পদক্ষেপটা হঠাৎ স্তিমিত হল, ভুরুটা একবার কুঁচকোলেন রামকালী। যাক তা হলে হয়েই গেছে! তবে আর তিনি গিয়ে কি করবেন? এখন জটা হতভাগার কপালে কত দুৰ্গতি আছে, কে জানে!

হঠাৎ ভয়ানক রকমের একটা চিৎকার উঠল, বোধ করি ফিনিশিং টাচ্‌। ওরে বাবা রে, আমার কী সর্বনাশ হল রে! কী রাঙের রাঙা বৌ এনেছিলাম রে!

রামকালী পায়ে পায়ে এগোতে এগোতে সহসা দরজার কাছাকাছি এসেই ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, যাক, সত্যিই শেষ হয়ে গেছে তা হলে! সত্য তুই বাড়ি যা।

সত্যবতী কাঠ!

বাড়ি! একলা?

কেন একলা কেন, নেড়ু আর পুণ্য এসেছিল বললি না?

সত্যবতী ভয়ে ভয়ে বলে, এসেছিল তো, আর কি এখন যাবে তারা?

যাবে না? যাবে না। মানে? ওদের ঘাড় যাবে! দেখ কোথায় আছে। আমাকে তো আবার এদের এদিক দেখতে হবে।

কৈফিয়ত দিয়ে কথা রামকালী কদাচ কাউকে বলেন না, কিন্তু সত্যর কাছে সামান্য একটু সহজ রামকালী।

সত্যবতী গুটি গুটি এগিয়ে একবার পিসীর উঠোনের ভিতর গিয়ে দাঁড়ায়, এদিক ওদিক তাকিয়ে নেড় পুণ্য কারও দেখা না পেয়ে ফিরে এসে ম্লান মুখে বললে, ওদের কাউকে দেখতে পাচ্ছি না!

কেন, গেল কোথায় সব?

কি জানি! সত্য আস্তে আস্তে সাহসে ভর করে প্রাণের কথাটা বলে ফেলে, বাবা, তুমি তো মারা বাঁচাতে পার!

মরা বাঁচাতে? দূর পাগলী!

সত্য মিয়মাণ ভাবে বলে, তবে যে লোকে বলে!

লোকে বলে? কি বলে? অন্যমনস্ক ভাবে মেয়ের কথার জবাব দিয়ে রামকালী এদিক ওদিক তাকাতে থাকেন, যদি একটা বেটা ছেলের মুখ চোখে পড়ে। এসে যখন পড়েছেন তিনি, দায়িত্ব এড়িয়ে চলে যেতে তো পারেন না। জটাদের তেমন বাঁশঝাড় না থাক, রামকালীর বাগান থেকেই বাঁশ কেটে আনতে হুকুম দেবেন। কিন্তু কই? কে কোথায়? বাড়ির ভিতর থেকে সুর উঠছে নানা রকম, বাইরেটা শূন্য স্তব্ধ!

ভালর মধ্যে আকাশটায় হঠাৎ মেঘ উড়ে গিয়ে দিব্যি পরিষ্কার হয়ে উঠেছে, আর বোঝা যাচ্ছে সন্ধ্যার এখনো দেরি আছে।

হঠাৎ সত্যবতী একটা অসমসাহসিক কাণ্ড করে বসে, বাপের একখানা হাত দু হাতে চেপে ধরে রুদ্ধকণ্ঠে বলে ওঠে, বলে যে কবরেজ মশাই মরা বাঁচাতে পারেন! দাও না বাবা একটুখানি ওষুধ জটাদার বৌকে!

রামকালী এই অবোধ বিশ্বাসের সামনে থতমত খেয়ে সহসা কেমন অসহায় অনুভব করেন। তাই ধমকে ওঠার পরিবর্তে মাথা নেড়ে বলেন, ভুল বলে মা! কিছুই পারি নে! মিথ্যে অহঙ্কারে কতকগুলো শেকড়-বাকড় নিয়ে নাড়ি আর লোক ঠকাই!

সত্যবতী এ কথার সুর ধরতে পারল না, পারার কথাও নয়, বুঝল এ হচ্ছে বাবার রাগের কথা। কিন্তু আপাতত সে মরীয়া। যা থাকে কপালে, বাবার হাতে যদি ঠেঙানি খাওয়া থাকে তাই খাবে সত্য, কিন্তু সত্যবতীর চেষ্টায় জটাদার বেঁটা যদি বাঁচে! তাই চোখ-কান বুজে সে বাবার গায়ের চাদরের খুঁটটা টেনে বলে ফেলে, তোমার পায়ে পড়ি বাবা, জন্মের শোধ একটু ওষুধ দাও না। আহা, বিনি চিকিচ্ছেয় মারা যাবে জটাদার বৌ!

মরার পর যে আর চিকিচ্ছে চলে না, এ কথা আর মেয়ের কাছে ব্যাখ্যা করতে পারলেন না রামকালী। শুধু একটা নিঃশ্বাস ফেলে ফের ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, চল দেখি।

জমজমাট নাটকের মধ্যখানে যেন হঠাৎ আসরের চাঁদোয়া ছিঁড়ে পড়ল। কবরেজ মশাইয়ের গলা-খাঁকারি না?

হ্যাঁ, তাই বটে। বিশালকার সুকান্তি পুরুষ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। সঙ্গে সঙ্গে সত্যর শানানো গলা বেজে উঠেছে, বাবা বলছেন, ভিড় ছাড়তে হবে!

পাড়ার মহিলারা মাথায় কাপড় টেনে চুপ করে গেলেন। শুধু জটা-জননী ড়ুকরে উঠলেন, ও মেজদা গো, আমার জটা আজ লক্ষ্মীছাড়া হল গো!

থাম। যেন একটা বাঘ হুঙ্কার দিল, তোর জটা আবার লক্ষ্মীছাড়া না ছিল কবে? একেবারে শেষ করে ফেলেছে তো?

ভির সরে গেছে, কবরেজ মশাই ভাগ্নে-বৌয়ের কাছে গিয়েও যতটা সম্ভব ছোঁয়া বাঁচিয়ে হেঁট হয়ে দু আঙুলে নাড়িটা টিপে ধরেন, আর মুহূর্তকাল পরেই চমকে ওঠেন।

যাক, সব রং-তামাশা ফক্কিকার!

শুধু নাটকের একটা দৃশ্যই জখম নয়, আগাগোড়া নাটকটাই খতম! বেহব্বারম্ভে লঘূক্রিয়ার এহেন উদাহরণ আর কখনও কেউ দেখেছে না। শুনেছে? জটার বৌয়ের এই আচরণটা যেন ধাষ্টামোর চরম, ক্ষমার অযোগ্য! ছি:। ছি, মেয়েমানুষের প্রাণ বলে কি এমনই কাঠ-পরমায়ূ হতে হয় গো? তবে এ মেয়েমানুষের কপালে যে অশেষ দুঃখ তোলা আছে, তাতে আর কারও মতভেদ থাকে না। মরে গিয়ে তুলসীতলায় শুয়ে আবার চারদণ্ড পরে ঘরে উঠে শোয়, ঢাক ঢকা করে একবাটি গরম দুধ গেলে, এমন মেয়েমানুষের খবর এর আগে এরা অন্তত কেউ পান নি!

ছি ছি, কী ঘেন্না! পুরুষের প্রাণ হলে আর এই স্বর্ণসিঁদুরটুকু জিভে ঠেকিয়েই চোখ খুলতে হত না!  কিন্তু যাই বল, জটার বৌ। খুব খেল দেখালো বটে! … এইবার শাশুড়ী মাগীর হাতে যা খোয়ার হবে টের পাচ্ছি, মাগীর যা অপমান্যি হয়েছে আজ! … কিন্তু যাই বলো, তুলসীতলা থেকে অমন হুট্‌ করে ঘরে তোলাটা ঠিক হয় নি, একটা অঙ্গ-প্ৰচিত্তির-টাচিত্তির করা কোর্তব্য ছিল।

কে জানে বাবা, সত্যি বেঁচে ছিল না কোন অবদেবতায় ভর করল! আমার তো কেমন সন্দ হচ্ছে! থাম সেজবৌ, সাঁজসন্ধ্যোয় একা ঘাটে-পথে যাই, ভাবলে গা ছম্‌ ছম্‌ করবে। কিন্তু ছাউনিটা একটু কেমন কেমনই লাগিল! না না, ওসব কিছু না, কবরেজ মশাই তো বললেনই, আচমকা ধাক্কা খেয়ে ভির্মি গেছল!

নে বাবা চল চল, ছিষ্টি সংসারের কাজ পড়ে, নাহক পাঁচ দণ্ড সময় বৃথা নষ্ট হল। জটার মান আদিখ্যেতাটা দেখলি? যেন বৌ মরে বুক একেবারে ফেটে যাচ্ছিল! … দেখেছি। দেখতে আর বাকী কিছুই নেই। বুক যদি ফেটেছে, বৌ জীইয়ে ওঠায়! বড় আশায় ছাই পড়ল। ভাবছিল তো বেট তার ভাগ্যিমান হল। আবার এখুনি তার বে দিয়ে, দানসামগ্ৰী গয়নাপত্তর ঘরে তুলবে!

বাক্যের স্রোত আর থামে না।

ঘাটে পথে, আপনি বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে বাক্যের বৃন্দাবন বসে যায়। এত বড় একটা ঘটনাকে এ॥৩ সহজে জুড়িয়ে ফেলতে ইচ্ছে কারুরই ইচ্ছে না; জটার মাকে পেড়ে ফেলবার এত বড় সুবর্ণ সুযোগটাও মাঠে মারা গেল। জটার বৌয়ের উপর কিছুতেই আর প্রসন্ন হতে পারছেন না কেউ, ধৌটা যেন সবাইকে বড় রকমের একটা ঠকিয়েছে। জ্ঞাতি খুড়শাশুড়ী খবর পেয়েই আঁচলের তলায় লুকিয়ে আলতাপাতা আর সিঁদুরগোলা এনেছিলেন, যাতে প্রথম সিঁদুর দেওয়ার বাহাদুরিটা তারই হয়। সেগুলো এখন ঘাটে ভাসিয়ে এলেন। যতই হোক, মড়ার জন্যে আনা তো! তা রাগটা তারই বেশী হচ্ছে জটার বউয়ের ওপর!

না, নাম কেউ জানে না, জানিবার চেষ্টাও করে না—জটার বৌ এই তার একমাত্র পরিচয়, এরপর শেষ পরিচয় হবে অমুকের মা। তবে আর নামে দরকার কী? নামে দরকার নেই, কিন্তু তার কথায় সকলেরই দরকার আছে। সেই দরকারী কথাগুলোর মধ্যে হঠাৎ জ্ঞাতি খুড়শাশুড়ী বলে উঠলেন, আমাদের বাপের বাড়ির দেশ হলেও বৌকে আর ঘরে উঠতে হত না, ওই গোয়ালে কি টেকশেলে জীবন কাটাতে হত!

দুএকজন মুখ-চাওয়াচাওয়ি করলেন, জীবন নিয়ে বিচারটা কেন?

খুড়শাশুড়ী ফের রায় দেন, একে তো তুলসীতলায় বার করা, তাপর আবার কত বড় অনাচার ভাবো, মামাশ্বশুরের ছোঁয়াচ খাওয়া! কবরেজ মশাই যখন নির্ভরসায় নাড়ী টিপে ধরলেন, তখনই তো আমি হ্যাঁ। অবিশ্যি উনি ভেবেছিলেন মরেই গেছে। আর মারে গেলে সৎকারের আগে দেহশুদ্ধি তো একটা করতেই হত। কিন্তু এ যে একেবারে জলজ্যান্ত জীইয়ে উঠল! প্ৰচিত্তির না করলে কি করে চলবে?

বহু গবেষণান্তে স্থির হল, মামাশ্বশুর-স্পর্শের পাতকস্বরূপ একটা প্ৰায়শ্চিত্ত জটার বৌকে করতেই হবে, তা ছাড়া মরে বাঁচার পাতকে আর একটা। নইলে জটার মাকে পতিত থাকতে হবে।

বেচারা অপরাধিনী তো অচৈতন্য। জটার মাও জটাকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন, কাজেই একতরফা ডিক্রী হয়ে যায়।

কিন্তু সত্যবতী এসবের কিছুই জানে না। ও এক অদ্ভুত গৌরবের আনন্দে ছলছল করতে করতে বাবার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ি ফেরে।

উঃ, রাগ করে বাবা কি উল্টো কথা বলছিলেন! বলছিলেন। কিনা চিকিচ্ছে-টিকিচ্ছে কিছু জানি না। —সাধে কি আর সত্য অত দুঃসাহস করে বাবাকে হাতে ধরে বলেছিল একটু ওষুধ দিতে, তাই না বেচারী বেঁটা বাঁচল! আহা সত্য যখন শ্বশুরবাড়ি যাবে, তখন যদি সত্যর বর (মুখে অলক্ষ্যে একটু হাসি ফুটে ওঠে) আমনি মেরে সত্যকে মেরে ফেলে বেশ হয়। বাবা খবর পেয়ে গিয়ে একটিমাত্রা স্বর্ণসিঁদুর মধু দিয়ে মেড়ে খাইয়ে দেবেন, আর একটু পরেই সত্য চোখ খুলে সবাইকে দেখে তাড়াতাড়ি মাথায় ঘোমটা টেনে ফেলবে।

উঃ, কী মজাই হবে তা হলো!

দেশসুদ্ধ লোকের তাক লেগে যাবে সত্যর বাবা রামকালী কবরেজের গুণের মহিমায়। বাপ রে বাপ, সোজা বাবা তার! গায়ের আর কোন মেয়েটার এমন বাপ আছে?

হাসির কথা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ সশব্দে হেসে ফেলা সত্যর বরাবরের রোগ।

রামকালী চমকে প্রশ্ন করলেন, কী হল? হাসলি যে?

সত্য কষ্টে সামলে নিয়ে ঢোক গিলে বলল, এমনি।

তোর ওই এমনি হাসিটা একটু কমা দিকি, প্ৰায় সহাস্যেই বলেন রামকালী, নইলে এর পর শ্বশুরবাড়ি গিয়ে ওই জটার বৌয়ের দশা হবে তোর!

মনটা বড় প্রসন্ন রয়েছে, এই সামনে রাত, না-হক্‌ কতগুলো ঝঞ্ঝাট-ঝামেলায় পড়তে হত, জটার বৌ তার হাত থেকে বাঁচিয়েছে। বাপের মনের প্রসন্নতার কারণটা অনুমান করতে না পারলেও প্ৰসন্নতাটুকু অনুধাবন করতে পারে সত্যবতী এবং তারই সাহসে প্রায় উচ্ছ্বসিত ভাবে বলে, ওই জন্যেই হাসলাম! আমি মরে গেলে তুমি বেশ গিয়ে বাঁচিয়ে দেবে!

হুঁ, বটে! বলেন স্বল্পভাষী রামকালী।

রামকালী নিঃশব্দে হন।হন করে খানিকটা অগ্রসর হয়ে যান এবং সত্যবতী বাপের সঙ্গে তাল রাখতে প্ৰায় ছুটতে থাকে।

হঠাৎ একসময় থেমে রামকালী বলেন, মরে গেলে স্বয়ং ভগবান এসেও কিছু করতে পারেন না, বুঝলি? জটার বৌ মরে নি।

মরে নি! সত্য একটু আনমনা হয়ে যায়, মরাটা তা হলে আর কোন রকম? হঠাৎ চিন্তার গতি বদলায়, সত্য সোৎসুকে বলে, কিন্তু বাবা, তুমি গিয়ে নাড়ি দেখে স্বর্ণসিঁদুর না কি না খাওয়ালে ওই রকম মর্যা-মরা হয়েই তো থাকত জটাদার বৌ! আর সবাই মিলে বাশ বেঁধে নিয়ে গিয়ে পাকুড়তলার শশানে পুড়িয়ে দিয়ে আসত!

রামকালী একটু চমকালেন।

আশ্চর্য! এতটুকু মেয়ে, এত তলিয়ে ভাবে কি করে? আহা মেয়েমানুষ তাই সবই বৃথা। এ মগজটা যদি নেড়ুটার হত! তা হল না–আট বছরের হাতী এখনও অ আ ইতে দাগা বুলোচ্ছে। নেড়ু রামকালীর দাদা কুঞ্জর শেষ কুড়োত্তি। তেরোটা ছেলেমেয়ে মানুষ করার পর চৌদ্দটার বেলায় রাশ একেবারে শিথিল হয়ে গেছে কুঞ্জ আর তার পরিবারের। ছেলেটা বামুনের গরু হবে। আর কি!

কিন্তু মেয়ে-সন্তানের বোধ করি এত বেশী তলিয়ে ভাবতে শেখাও ভাল নয়, তাই রামকালী ঈষৎ ধমকের সুরে বলেন, থাম থাম, মেলা বকিস নি, পা চালিয়ে চল! গহীন অন্ধকার হয়ে গেছে দেখছিস!

অন্ধকার? হুঁ! সত্যবতী স-তাচ্ছিল্যে বলে, অন্ধকারকে আমি ভয় করি নাকি? এর চাইতে আরও অনেক অনেক অন্ধকারে বাগানে গিয়ে পেচার চোখ গুনি না!

অন্ধকারে কী করিস? চমকে ওঠেন। রামকালী।

সত্য থমমত খেয়ে বলে, ইয়ে আমি একলা নয়, নেড়ু আর পুণ্যপিসীও থাকে। পেঁচার চোখ শুনি।

হঠাৎ রামকালী হা-হা করে হেসে ওঠেন।

অনেকক্ষণ ধরে দরাজ গলায়। এই মেয়েকে আবার ধমকবেন কি, শাসন করবেন কি!

নির্জন পথে অন্ধকারের গায়ে সেই গম্ভীর গলায় দরাজ হাসি যেন স্তরে স্তরে ধ্বনিত হতে থাকে।

বাঁড়ুয্যেদের চণ্ডীপণ্ডপ থেকে উৎকীর্ণ হয়ে ওঠেন দু-একটি গ্রাম্য প্রৌঢ়।

গুনি।

একলা কি আর! নিশ্চয় ধিঙ্গী মেয়েটা সঙ্গে আছে। নইলে আর–

ওই এক মেয়ে তৈরি করছেন রামকালী। ও মেয়ে নিয়ে কপালে দুঃখু আছে।

আর দুঃখু! টাকার ছালা ঘরে, ওর আবার দুঃখু! শুনছি। নাকি বর্ধমানের রাজার কাছ থেকে লোক এসেছিল কাল, রাজার সভা-কবরেজ হবার জন্যে সাধতো!

তই নাকি? কই শুনি নি তো? তা হলে গায়ের মায়া কাটাল এবার চাটুয্যে!

না না, শুনছি। যাবে না।

বটে! তবু ভাল। তোমায় বললে কে?

কুঞ্জর বড় ছেলেটা বলছিল।

হুঁ ভালই, এ বয়সে আবার বিদেশে গিয়ে রাজদরবারে চাকরি! তবে রামকালীর মতিগতি বড় বড় অত বড় বিসি মেয়েকে এতটা বাড় বাড়তে দেওয়া উচিত হয় না, পাড়ার ছেলেগুলো ওর খেলুড়ি!

হ্যাঁ, গাছে চড়তে, সাতার কাটতে, মাছ ধরতে বেটা ছেলের দশগুণ ওপরে যায়।

এটা একটা গৌরবের কথা নয় খুড়ো। যতই হোক মেয়েছেলে, তায় আবার একটা মান্যিমান ঘরের বৌ হয়েছে। তারা টের পেলে ও বেঁকে ঘরে নিতে বেঁকে বসবে না!

একটা কলঙ্ক রটিয়ে দিতেই বা কতক্ষণ?

বদ্যি চাটুয্যের ও তার ধিঙ্গি মেয়ের আলোচনায় চণ্ডীমণ্ডপ ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। যাকে সামনে সমীহ করতে বাধ্য হতে হয়, তাকে আড়ালে নিন্দে করতে না পেলে বাঁচবে কেমন করে মানুষ!

এইসব সমালোচনার প্রধানা পাত্রী তখন বাবার পিছন পিছন ছুটছে আর মনে মনে আকুল প্রার্থনা করছে, হেই ভগবান, আমার পা-টা বাবার মতন লম্বা করে দাও নাগো, তা হলে বাবার মতন হাঁটি, হেরে যাই না!

হেরে যেতে একান্ত আপত্তি সত্যবতীর।

কোন ক্ষেত্রে কোথাও হার মানবে না। এই পণ।

এই পুণ্যি, ছড়া বাঁধতে পারিস?

চিলেকোঠার ছাদের ওপর সত্যবতীর খেলাঘর। প্রধান খেলুড়ি রামকালীর জ্ঞাতি খুড়োর মেয়ে পুণ্যবতী। সত্য তাকে পাঁচজনের সামনে সভ্যতা করে পুণ্যিপিসী বললেও, নিজের এলাকায় পুণ্যিই বলে।

বাবুই পাখীর বাসা আনতে পারিস? অথবা কাচপোকা ধরতে পারিস? কিংবা সঁতরে তিনবার বড় দীঘি পারাপার হতে পারিস? এ ধরনের পরীক্ষামূলক প্রশ্ন প্রায়ই করে সত্য, কিন্তু ছড়া বাধতে পারিস কিনা, এহেন প্রশ্ন একেবারে আনকোরা নতুন!

পুণ্য বিমূঢ়ভাবে বলে, ছড়া! কিসের ছড়া?

জটাদার নামে ছড়া, বুঝলি? ছড়া বেঁধে গা-সুদ্ধ সব ছেলেমেয়েকে শিখিয়ে দেবী, জটাদাকে দেখলেই তারা হাততালি দিয়ে ছড়া কাটবে।

হি হি হি!

জটাধরের দুর্দশার চিত্র কল্পনা করে দুজন দুলে দুলে হাসতে থাকে।

অতঃপর পুণ্যবতী একটা পাল্টা প্রশ্ন করে, খুব তো বললি, বলি মেয়েমানুষকে আবার ছড়া বাধতে আছে নাকি?

বাঁধতে নেই? সহসা অগ্নিমূর্তি ধরে সত্য, কে বলেছে তোকে নেই? মেয়েমানুষ! মেয়েমানুষ! মেয়েমানুষ যেন মায়ের পেটে জনায় না, বানের জলে ভেসে আসে! অত যদি মেয়েমানুষ-মেয়েমানুষ করবি তো আমার সঙ্গে খেলতে আসিস নে।

পুণ্যি মুচকি হেসে বলে, আহা, মশাই রে! আর তোর বর যখন বলবে?

কি বলবো?

ওই মেয়েমানুষ!

ইস, বলবে বৈকি! দেখিয়ে দেব না! আমি ওই জটাধার বৌয়ের মত হব ভেবেছিস? কক্ষনো না। দেখ না, ছড়া বেঁধে জটাদাকে কী উৎপাত করি!

পুণ্যি ঈষৎ সমীহভাবে বলে, কিন্তু কি করে বাঁধবি?

কি করে আবার কথক ঠাকুর। যেমন আখর দেন তেমনি করে। একটুখানি তো বেঁধেছি, শুনিবি?

বেঁধেছিস! অ্যাঁ! বল না ভাই, বল না।

সত্য আত্মস্থভাবে চেখে চেখে তেঁতুল খাওয়ার ভঙ্গীতে বলে—

জটাদাদা, পা গোদা
যেন ভোঁদা হাতী,
বৌ-ঠেঙানো দাদার পিঠে
ব্যাঙে মারুক লাথি।

ওরে সত্য? পুণ্যি সহসা ড়ুকরে ওঠে সত্যকে জড়িয়ে ধরে, তুই কী রে! এরপর তো তুই পয়ার বাধতে শিখবি রে?

সেটাও যেন সত্যর কাছে কিছু নয় এমন ভাবে বলে, সে যখন শিখব, তখন শিখব, এখন এটা যে-যেখানে আছে সবাইকে শিখোতে হবে, বুঝলি? আর জটাদাকে দেখলেই—হি হি হি হি!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *