১৪. সত্যভূষণ বাবু

সত্যভূষণ বাবু ভীষন লজ্জায় পড়ে গেলেন। এর কি উত্তর দেবেন তিনি। অশ্রুকণা এসে বললেন চলুন সত্যবাবু। তারপর জানতে চাইল, কত দেরি হবে ওখানে? বেশী নয়, হয়তো ঘন্টা দেড়েক হতে পাবে। অশ্রুকণা বললনে, সেলিনা আমি ফিরেই রান্নাটা করব। ততক্ষণ প্রান্তিকের কাছে গিয়ে বোস। ওর কিছু দরকার হয় কিনা। ওরা বেরিয়ে গেলেন। আমি বুঝতে পারছি সেলিনা আমার ঘরেই আসছে। ভেজানো দরজা খুলতেই আমি বললাম এসো। ও একটা চেয়ারে বসল আমি বললাম ওখানে কেন আমার কাছে এসো। ও কাছে এল। বললাম সকালে ও ভাবে চলে গেলে কেন? তুমিতো আমাকে চাওনি? কে বলেছে? যদি চাইতে তাহলে আমাকে যেতে দিলে কেন? আর তা ছাড়া কাল বার বার বললাম স্নান করো না। তবু তাই করলে এবং জ্বর বাধালে আর এখন আমাকেই শাস্তি দিতে চাইছো? আমি কি ইচ্ছে করে জ্বর বাধিয়েছি? তাছাড়া কি? এ তোমার ভুল সেলিনা। স্নানতো দুরের কথা, হাতে মুখে পর্যন্ত ভালো করে জল দেওয়া হয়নি। আসলে বলতে গেলে জ্বর নিয়েই তোমাদের সঙ্গে এসেছি। ও স্তম্ভিত হয়ে বলল জ্বর নিয়ে? বলনি তো। বলার সময় কোথায় পেলাম। সেলিনা আর কথা না বাড়িয়ে বলল, বাথরুমে যাবে? যাওয়াতো দরকার, কিন্তু উঠতে যে পারছি না। উঠতে পারছে না অদিকে বলেছিলে? না, তাহলে আমাকে ধর। তোমাকে বাথরুমে নিয়ে যাচ্ছি। ও নীচু হলে দুহাতে ওর গলাটা জড়িয়ে ধরে উঠে পড়লাম। আর আমার গায়ের উত্তাপ ওর শরীরের যেখানে যেখানে স্পর্শ করলো, সেখানে সেখানে। যেন, ফোস্কা পড়তে লাগল। ওর মুখ দিয়ে উচ্চারিত হল উঃ তুমি কি নিষ্ঠুর।

সমানে মাথায় জল পট্টি দিয়ে চলেছে সেলিনা। ওর মত প্রাণ চঞ্চল সদা কৌতুকময়ী মেয়েরও যে কি হল কে জানে। গুম মেরে বসে আছে, কি যে করবে বুঝতে পারছেনা। কলকাতা হলে হয়তো এতক্ষণ ২/৩ জন ডাক্তারকে কল দিয়ে বসতো। কিন্তু এখানে তো! কাউকে ও চেনে না। খুব মায়া হতে লাগলো ওর জন্য। বললাম, সেলিনা কি এত ভাবছ? কিছু না আতিক ভাই। কিছু যদি নয় তা হলে এত চুপ চাপ আছো কেন? হাজার কথার ফুলঝুরি ছোটে যে মুখে তা এতো নিশ্ৰুপ কেন? ও আস্তে আস্তে বলল, নিজেকে ক্ষমা করতে পারছি না প্রান্তিক ভাই। কেন? কেবলি মনে হচ্ছে আমি যদি ওই ভাবে অসুখ জ্বর এই সব না বলতাম তাহলে হয়তো তোমার কিছুই হতো না। আমি হেসে ফেলে বললাম, তুমিতো এ যুগের শিক্ষিত মানুষ, সব কিছুকে বিচার করতে হয় যুক্তি দিয়ে। এই সব কুসংস্কারগুলো তোমার মাথায় আবার কবে থেকে শিকড় গেড়ে বসল। ও কোন উত্তর না দিয়ে চুপ করে আছে দেখে তাড়া লাগিয়ে বললাম, কি হলো বললে না কবে থেকে? ও একটা ছোট্ট সুই তুলে বলল, বিশ্বাস করবে তো। হঠাৎ বিশ্বাস অবিশ্বাসের প্রশ্ন আসছে কেন? তারপর কি মনে হতে বললাম, সেলিনা, তোমাকে বিশ্বাস না করা যে আমার পাপ। ও বলল, যেদিন থেকে নিজেকে আর তোমার থেকে আলাদা করে ভাবতে পারিনি সেদিন। থেকে। আমি আশ্চর্য হয়ে বললাম সেলিনা! ও বলল, আর কথা নয়, ওই বুঝি অশ্রুদি এল। আমি তবুও তাকে বললাম সেই দিনটা কবে বলনা সেলিনা। ও তবু উঠে যেতে চায় দেখে ওর আঁচলটা ধরতেই, ওটা কাঁধ থেকে সরে যেতেই আমি লজ্জায় ওকে ছেড়ে দিলাম। সেলিনাও বুঝি প্রচণ্ড লজ্জায় আর আমার দিকে না তাকিয়ে অশ্রুকণাদের দরজা খুলে দিতে এগিয়ে গেল।

অশ্রুকণা আর তার সঙ্গে একটা মেয়ে। জানতে চাইল প্রান্তিকের জ্বর কি একই রকম আছে? মনে হয় একটু কমেছে। অশ্রুকণা তারপর সঙ্গের মেয়েটাকে দেখিয়ে বলল, এর নাম সীতা, সত্যভুষণবাবু পাঠিয়েছেন। আচ্ছা, তুমি এই ওষুধটা আগে নাও। ওকে এখনি একটা খাইয়ে দাও। সেলিনা বলল, সে না হয় হবে অদি। এত ব্যস্ত হওয়ার তো কিছু নেই। কিছু নেই মানে? এখানে কিছু হলে কে দেখবে? কেন তুমি? আমি? তুমি ছাড়া আবার কে দেখবে? বাঃ বেশ মজার কথাতো আমি ছাড়া আবার কে দেখবে? তুমি দেখতে পারবেনা? পারবে। তবে তুমি যখন ক্লান্ত হয়ে পড়বে তখন। অবশ্য ততক্ষণে প্রান্তিক ভাই সুস্থই হয়ে যাবে।

সন্ধ্যার দিকে মনে হচ্ছে জ্বরটা আর নেই। কাল সারাটা দিন যে ভারি ভারি ভাবটা ছিল তাও আর নেই। বেশ হাল্কা লাগছে। অশ্রুশা বলল, এ বেলা ফুলের বাগানের মাঝখানে যে বেদীটা আছে ওখানে গিয়ে চা খাওয়া যাবে। সেলিনা বলল সেই ভাল, বিকেলের হিম লেগে জ্বরটা আবার এলে মন্দ হয় না! অবাক হয়ে অশ্রুকণা বলল সেলিনা তুমি যে মাঝে মাঝে কি ভাষায় কথা বল বুঝতে পারি না। তুমিও বুঝতে পারনা? অবাক করলে অশ্রুদি। আমার কথা একা প্রান্তিক ভাইই বোঝেনা এতদিন তো তাই জানতাম এখন দেখছি তুমিও বোঝ না? ঠিক আছে বোঝার দরকার নেই, চল চা ওখানেই খাওয়া যাবে।

আমি বললাম দরকার নেই কশা। আজ আর বাইরে গিয়ে বসব না, বরং আর যদি জ্বরটা না আসে তা হলে কাল গিয়ে বসা যাবে। সেলিনা বলল, দেখলে তো অদি, আমি যেটা বলব তাতেই প্রান্তিক ভাই বাদ সাধবে। যাতে আমি রেগে যাই তাই করবে। আবার ওনার মায়ের কাছে আমাকে লিখিত রিপোর্ট করতে হবে, ওর বিরুদ্ধে আমার কি কি অভিযোগ? একটা হাই ছেড়ে বলল, তাইতো তোমায় বলেছিলাম, আমিতো রেহানা নই, আমি সেলিনা। হতভাগী রেহানার বোন, আর তার অবর্তমানে আমি তো বোঝ। আমি অবাক হয়ে মনে মনে বললাম, সেলিনা তোমার এই দুর্বোধ্য ভাষা আমি সত্যি বুঝিনা, তবু যত পার কলকাতায় গিয়ে তোমার ভাষায় কথা বল, এবার অভত শান্ত হও। চেষ্টা করেও মুখে কিন্তু কোন কথাই বলতে পারলাম না।

অকশা বলল সেলিনা, প্রান্তিক না বুঝলেও তোমাকে আমি বুঝতে পারি। তোমার যন্ত্রণা তোমার আত্মপীড়ন, তোমার স্বপ্ন, তোমার অন্তরের কথা, প্রান্তিকের পুরুষ চোখ এড়িয়ে গেলেও, আমিতো তোমার মতো মেয়ে তাহলে এ আঘাত দিয়ে তুমি কি আনন্দ পাও। সেলিনা অভিমানের সঙ্গে বলে, আমি তোমাকে আঘাত দিয়েছি অশ্ৰুদি তুমি একথা বলতে পারছ? অশ্রুকণা বলল না সেলিনা, তুমি জেনে শুনে আমাকে আঘাত দিচ্ছ না। আসলে তোমার কথার ভুল মানে হয়ে অন্তরকে আঘাত করছে। তারপর পড়ে থাকা চায়ের সরঞ্জাম নিয়ে অশ্রুকণা চলে গেল।

সেলিনাকে অনেক রকম কথা বলতে ইচ্ছে করে, কিন্তু পারিনা। সেলিনাই বলে, তোমারও কি তাই মত, যে আমার কথায় তোমরা আঘাত পাও। আমি বললাম, সেলিনা ওভাবে সরাসরি উত্তর দেওয়া যায় না। বেশ তাহলে, তুমি কদিন থেকে যাও অশ্ৰুদির কাছে। আমি কালই চলে যাবো। তুমি চলে যাবে মানে? মানে কিছু নয়। আমি থাকলে, আমাকে কথা বলতেই হবে, আর প্রতিটি কথারই তোমরা ভুল মনে করবে। আমি সেদিকে না গিয়ে বললাম, কিন্তু আমাকে এখানে রেখে যেতে পারবে? কেন পারবো না? তুমি আমার কে যে তোমার জন্যে আমাকে এই বনজঙ্গলে পড়ে থাকতে হবে? কেউ নই না? না কেউ নও। তারপর বলল, আমি কিন্তু কাল চলে যাবই প্রান্তিক ভাই, বাধা দেওয়ার চেষ্টা কবো না।

বেশ, আজতো আর যাচ্ছ না, কাল যখন যাবে তখন ভাবা যাবে। আজ বরং চল। ওই বাগান দিয়ে একটু ঘুরে আসি। তুমি যাও। আচ্ছা সেলিনা, অশ্রুকণা তোমায় এত ভালবাসে, আর তুমি কেন প্রতিমুহূর্তে ওকে আঘাত দাও। নির্বিকার সেলিনা বলে, আমিতো অদিকে আঘাত দেওয়ার জন্য কোন কথা বলিনা, উনি নিজের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে নিয়ে আঘাত পেলে আমি কি করব? তাহলে তুমি কাকে আঘাত দিতে চাও? তোমাকে। আমাকে? কেন আমার প্রতি তোমার এত রাগ কেন? সে আমি জানি না প্রান্তিক ভাই, প্রায়ই ভাবি, না এ আমার ঠিক হচ্ছে না, তবু তোমাকে আঘাত দেওয়ার জন্য পাগল হয়ে উঠি। আমার কেবলি মনে হয় আঘাতের মধ্যে দিয়েই আমি তোমার কাছে পৌঁছে যেতে পারি। আমি ভীষণ অবাক হয়ে তাকাই ওর দিকে। বলি, অন্তরের মধ্যে যদি সত্যের সন্ধান না পাও আঘাত দিয়ে কি পাবে? না পাব না, জানি, তবু মনে হয় এতেই বুঝি আমি আমাকে মেলে ধরতে পারি। আমি বললাম, তোমাকে একটা কথা বলব সেলিনা? বল। আমাকে কি তুমি বুঝতে পায় না? তোমাকে তো বলেছি আমার থেকে তোমাকে কেউ বেশী বোঝে না। তাই যদি হয়, তাহলে এই পাগলামি গুলো ছাড় সেলিনা। তোমার অদিকে তার নিজের পথ খুঁজে নিতে সাহায্য কর। তারপর বললাম তুমি যেমন আমাকে বোঝ, মনে হয় অশ্রুকণাকেও বোঝ তার থেকে বেশী। যে কটা দিন এখানে থাক, কোন আঘাত নয়, লেন সংঘাত বা অভিমান নয়, একান্ত বন্ধুর মতো তার হৃদয়টাকে বুঝবার চেষ্টা করা। যে ভালবাসা তোমাকে সে দিতে চেয়েছে, তা গ্রহণ কর সেলিনা। এ আমার একান্ত অনুরোধ।

এমন করে বুঝি সেলিনাকে কোনদিন কিছু বলিনি। হয়তো এমনি কোন কথা সে শুনতে চেয়েছিল আমার মুখ দিয়ে। ও মুখ নীচু করেছিল। আমি বললাম, কি হল? তুমি তাকাবে না আমার দিকে? ও মুখ তুলে তাকালো। কিন্তু একি এমন নিঃশব্দ অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে কেন ওর চোখ দিয়ে? আমি বললাম সেলিনা! ও বলল না এভাবে নয় প্রান্তিক ভাই, আঘাতের বিনিময়ে আরো বড় আঘাত দিয়ে ভেঙে দিতে পার না আমার দম্ভকে? আমার ঔদ্ধত্যকে এমন ভাবে সহ্য কর কেন? সে কি শুধু আমি রেহানার বোন বলে? ও উঠে যেতে চাইলে, আমি উঠে গিয়ে ওর পথ রোধ করে দাঁড়ালাম। একটু আগে দেখেছি সীতাকে নিয়ে অশ্রু বাগানের দিকে চলে গেছে। ও বলল পথ ছাড়, বললাম না ছাড়বনা। ও বলল, ছিঃ অশ্ৰুদি কি ভাববে? অশ্রণা নেই, ও অনেকক্ষণ হলো বাগানে গেছে। তবু তুমি সরে দাঁড়াও প্রান্তিক ভাই। তা হয় না সেলিনা, কোন ভাবেই আমি তোমাকে দুরে সরে যেতে দিতে পারি না। কি করবে আমাকে নিয়ে, পারবে আমাকে জায়গা দিতে রেহানাকে সরিয়ে? পারবে অশ্ৰুদির ভালবাসা ভুলে, শুধু আমাকেই ভালবাসতে, পারবে তপশীদির দীর্ঘ ছায়া চিরদিনের জন্য তোমার জীবন থেকে সরিয়ে দিতে? আমি ওকে ছেড়ে দিয়ে বললাম পারবো। হ্যাঁ পারবো সেলিনা, যদি মুহূর্তের জন্যও তুমি রেহানার নাম উচ্চারণ না কর, যদি রেহানাকে তোমার জীবন থেকে চির নির্বাসিত কর, যদি কখনো অশ্রুকণার ছায়ায় নিজে দাঁড়াতে না চাও, যদি তপতীকে মুছে দিতে পার তোমার ভালবাসা থেকে। সেলিনা এগিয়ে এলো আমার কাছে, এই প্রথম ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার বুকে, না এ শাস্তি তুমি আমাকে দিও না, তার চেয়ে তুমি আমায় যা বলবে, সেই ভাবে চলব। তোমাতে নিবেদিত প্রাণ আমার চলার পথের পাথেয় হোক প্রান্তিক ভাই। আর কোন দিন তোমার অবাধ্য হবো না। তোমাকে কথা দিচ্ছি, আমার কোন আচরণে আজ থেকে আমি আর অদিকে আঘাত দেবনা।

ভীষণ ইচ্ছে করছিল, সেলিনাকে সজোরে বুকের পরে টেনে নিয়ে আদরে আদরে তার উপপসি তৃষ্ণাকেভরে দিই। হায় ভীরু মন, যা তুমি চাও তা তোমার পাওয়ার যোগ্যতা কত বিচার করেও দেখনা। ও আমার পাশ কাটিয়ে চলে গেল। আমি নেমে এলাম বাগানে। জোছনা ভরা রাতের আকাশ। বাগানে ফুটেছে অজস্র ফুল। কি যে মনোরম পরিবেশ। স্বপ্নের ডানায় ভর দিয়ে চলে যেতে ইচ্ছে হয় দূর তেপান্তরে। ভাবতে অবাক লাগছে, সেলিনা কি ভাবে আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। মুহূর্তের দুর্বলতায় কখনো কখনো যে মনে হয়নি, ওকে আমার ভীষণ প্রয়োজন, তবে তা আজকের মত নয়। সেলিনা হীন এমন শূণ্যতার অনুভূতি আগে তো কখনো হয় নি। তবে কি তার সম্পূর্ণ আত্ম নিবেদনই আমি চেয়েছিলাম।

জানিনা, কি চেয়েছিলাম, অশ্রুকণা আমাকে একা দেখে আমার দিকে এগিয়ে এল। সেলিনা এলোনা? না, ওকে বলে এখানে আমি আসিনি। ও কৌতুক দৃষ্টি হেনে বলল আবারতো একটা ঝামেলা করবে? কিআর অবক। ও বলল, বাইরে বেশ ম, তোমার বেরোনো ঠিক হয় নি। তাহলে তুমি বেরুলে কেন? তোমার ঠান্ডা লাগবেনা? আমি শাড়ীর আঁচলে ঠান্ডাটাকে খানিকটা চাপা দিতে পারব, কিন্তু তুমি? আমি না হয় সেই আঁচলে নিজেকে লুকোবার চেষ্টা করব। ও বলল আঘাত পাব জেনেও এই কৌতুক তুমি ছাড়তে চাওনা, কেন বলত? ভালে লাগে তাই। যাকগে সে সব কথা। বড় দিদির সঙ্গে দেখা হল? হ্যাঁ। ভদ্রমহিলা খুব ভাল জান? কি বললেন? আমার জয়েনিং রিপোট নিলেন, আর এখানকার সব কিছু সম্পর্কে একটা স্বচ্ছ ধারণা দিলেন। সত্যভূষণবাবু ছিলেন? হ্যাঁ ছিলেন, উনি কি বললেন? না উনি কিছু বলেননি। বড় দিদির ওখানে কাজ শেষ হয়ে গেলে, উনি বললেন চলুন আমি যেখানে থাকি। আমি ওর দিকে তাকাতে উনি বললেন ওষুধটাতো নিয়ে যেতে হবে অশ্রুদেবী। আমি বললাম ও হ্যাঁ, চলুন।

এই প্রতিষ্ঠানের যে বিরাট পাঁচিল, তার গা ঘেঁষে আরেকটা ছোট পাঁচিল দিয়ে ঘেরা একটা স্বয়ংসম্পূর্ণ আলাদা কোয়ার্টার। উনি আমাকে নিয়ে বারান্দা পেরিয়ে একটা ঘরে নিয়ে বসালেন। বেশ বড় হল ঘরের মত। সারা ঘর ভৰ্ত্তি অনেক বই। একটা বেশ বড় টেবিল, আর বসার চেয়ার আর সামনে মাত্র ২টো চেয়ার। আমি ওকে জিজ্ঞাস করলাম এটা আপনার অফিস? উত্তরে বললেন না ঠিক অফিস নয়, আবার অফিসও বলতে পারেন। হেঁয়ালিটা বুঝলাম না। হ্যাঁ অশ্রুদেবী হেঁয়ালিই, তবে ধীরে ধীরে হয়তো বুঝবেন। এখানে যখন এসেছেন সবই জানতে পারবেন। এখানে আপনি একা থাকেন? ঠিক একা নই, আরো দু জন থাকেন, একজন আমার দেখাশুনা করেন, আরেকজন এই প্রতিষ্ঠানের একজন কর্মচারী। আপনার স্ত্রী? না নেই। মানে? নেই মানে নেই, মানে এখনো সেই ভাবে ভাবিনি। তারপর নিজেই হেসে বললেন, একদিনেই সবকিছু জানতে চাইলে চলবে কেন অশ্রুদেবী। তারপর আমার হাতে একটা প্যাকেট দিয়ে বললেন প্রান্তিকবাবুর ওষুধ। আমি ওটা হাত পেতে নিলে উনি বললেন, না অশ্রুদেবী চা বা কফি কিছু খাওয়াতে পারবো না। কারণ ঐ অ্যারেঞ্জমেন্ট এখানে নেই। ধন্যবাদ জানিয়ে বেরিয়ে এলাম।

আমি বললাম, অদ্ভুত মানুষ এই সত্যভুষণবাবু তাই না। হ্যাঁ তার সৌজন্য বোধের তুলনা হয় না। তবে যে কজনের সঙ্গে কথা হল, অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে তার কথা বললেন, তাতে আমার মনে হয়, এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তার যে কোন অফিসিয়াল যোগাযোগ নেই, এটা বোধ হয় ঠিক নয়। আমারও তাই মনে হয় কণা। ও বলল এবার চল, দেখ সেলিনার আবার অভিমান কোথায় গিয়ে পৌঁছায়। আমি বললাম, ওর কথা থাক, তোমার কি কোন অস্বস্তি হচ্ছে আমার সঙ্গে বাগানে থাকতে? খানিকটা তো হচ্ছেই প্রান্তিক। দেখ সেলিনা আঘাত পেতে পারে এমন কিছু আমি করতে চাইনা, আর আমি আঘাত পেতে পারি এমন কিছু বুঝি করতে তোমার আপত্তি নেই? এই ভাবে বলছ কেন প্রান্তিক। তোমাকেও আঘাত দিতে চাইনা, পারলে আঘাতে শুধু প্রলেপ নয় জীবনটাও তোমার কানায় কানায় ভরে দিতে চাই। কিন্তু তা আজ আর সম্ভব নয়। কেন? সব কথার উত্তর দিতে পারব না প্রান্তিক। তা ঠিক, কাল কিন্তু বলেছিলে, আমাকে ছেড়ে তুমি থাকতে পারবে না।

কথা বলতে বলতে গোটা বাগানটা ঘুরে এসে আমরা বসার বেদীটার সামনে যখন এসেছি অশ্রুকণা বলল বসবে কিছুক্ষণ? হ্যাঁ বসা যাক, বলে বসে পড়লাম আমরা। ও বলল, বলেছিলাম, এখনো বলছি, সারাজীবন ওই একই কথা বলব, তোমাকে ছাড়া আমি থাকতে পারবো না। তাহলে? তাহলে কি! তাহলে সেলিনা কি ভাববে এ নিয়ে ভাবছ কেন? ভাবছি এই জন্য যে ওকে ছেড়েও আমি থাকতে পারবো না! কশা? ও বলল, বল। এ ভাবে এত কষ্ট পাচ্ছ কেন? আমার তো কোন কষ্ট নেই। কোন কষ্ট নেই? না প্রান্তিক, কোন কষ্ট নেই। এতদিন আমার জন্য তোমার কোন অনুভূতি আছে কি না, তার জন্য কষ্ট হতো। প্রায়ই মনে হতো সত্যি কি আমার জন্য তুমি একটুও ভাব না। তাই কষ্ট হতো। এখন মনে হয়, আমার সে ধারণা ভুল। এখন, আমার যেটুকু প্রাপ্য, আমি জানি তোমার কাছ থেকে আমি তা পাবই, সুতবাং কষ্ট কেন হবে? কাল কিন্তু বলেছিলে আমার সঙ্গে তুমি চলেই যাবে। আমি যদি এখন বলি, আমি তোমাকে না নিয়ে যাব না কণা! কি করবে? চলে যাবো তোমার সাথে। তোমাব এই চাকরি, জীবনের এই নিবাপত্তা সবকিছুকে বিসর্জন দিয়ে। দেখ প্রান্তিক, কোন মেয়ে কিসে নিরাপত্তা পাবে তুমি কি তা জান? ঠিক বুঝতে পারলামনা। ও বলল, তুমিতো রেহানাকে সমস্ত নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়েছিলে, দাওনি? ঠিক জানিনা, নিরাপত্তা জিনিষটা কি তাও বুঝিনা, তবে ওকে আমি ভালবেসে ছিলাম। যদি সেই ভালবাসার মর্যাদা রাখতে একদিন ওকে নিয়ে পথে দাঁড়াতে হতে কি করতে তুমি! হয়তো রেহানা আমাকে বিশ্বাস করে পথেই নামতো! কেন? ভালবাসার আকর্ষণে। না প্রান্তিক সেটাই সব নয়, শুধু ভালবাসার টানে, মেয়েরা কোন প্রেমিকের হাত ধরে পথে নামে না, যদিনা সে বিশ্বাস করে, সেই পুরুষটি তাকে পূর্ণ নিরাপত্তা দেবে। আমিও বিশ্বাস করি তুমি আমাকে ভালবাসতে না পারলেও নিরাপত্তা দিতে কুণ্ঠিত হবে না। আমি অবাক হয়ে বললাম, শুধু নিরাপত্তাই সব। হ্যাঁ সব প্রান্তিক। ইনটারভিউ শেষে প্রতীমবাবু বলেছিলেন, অশ্রু, তোমাকে তুমিই বলছি, একবার যাবে আমার বাসায়? আমি অবাক হয়ে বললাম এ ভাবে বলছেন কেন? আমিতো আপনার আশ্রয় প্রার্থী। উনি বললেন, ভুল তোমার মা, তুমি আমার আশ্রয় প্রার্থী নও। তোমার যোগ্যতা তোমাকে আশ্রয় দেবে। আমি সে জন্য তোমাকে যেতে বলছি না, তবে? তোমার কাছে কয়েকটা ব্যাপার জেনে নিতে চাই। আমি বলেছিলাম, ঠিক আছে যাবো, প্রান্তিক আসুক। উনি বললেন, ও এখন আসবেনা। তা হলে কখন আসবে? আসবে, আর তোমাকে নিয়ে যাবে। আমি বললাম, চলুন। গেলাম ওনার বাড়ীতে। ফ্রীজ খুলে উনি আমাকে মিষ্টি খেতে দিলেন। তারপর বললেন, আমি তোমার পিতৃস্থানীয় অশ্রু। তাই যা জিজ্ঞাসা করব তার ঠিক ঠিক উত্তর দিও। আমি মাটির দিকে চোখ রেখে বললাম বলুন। উনি বললেন, মা–বাবাকে এতবড় আঘাত কেন দিয়ে জানি না অশ্রু, মনকে প্রস্তুত করতে পারলে ওদের মেনে নিও। ওরা তোমার মঙ্গলই চেয়েছিলেন। আমার ভিতর থেকে একটা প্রতিবাদ উঠে আসতে চাইছিল। উনি বললেন, আমি জানি তুমি কি বলতে চাইছে। প্রান্তিককে তুমি গভীর ভালবাস এইতো। তাই তার অপমান তুমি সইতে পারনি। কিন্তু ওকে আমি যতটুকু বুঝেছি, তাতে তোমার মন যেভাবে ওকে চেয়েছে সেই ভাবে হয়তো ও তোমাকে চাইতে পারেছে না, তার মানে কিন্তু এই নয় যে ও তোমাকে ভালবাসেনা। ওর জীবনে কিছু জটিলতা আছে বলে মনে হয়। ও একটি মেয়েকে ভীষণ ভালবাসতো তাই না? তার নাম বোধ হয় রেহানা। ওর বোধ হয় বিশ্বাস সেলিনার জন্য সে চলে গেছে। আসলে কিন্তু তা আমার মনে হয় না মা। যে মহান ভালবাসা ত্যাগের মধ্যে দিয়ে তার স্থায়ী আসন গড়ে নিতে চায় রেহানার ভালবাসা সেই গোত্রীয়। তাই আমার বিশ্বাস, রেহানা হয়তো চিরদিনই ওর আড়ালে থেকে যাবে। ওর কাছেই শুনেছি সেলিনা রেহানার বোন। কয়েকটি টুকরো ঘটনার মধ্যে ও সেলিনার কথা যা বলেছে তাতে সেলিনা ওর জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়ার নয়। পারবেনা মা, সেলিনাকে তার হাতে সপে দিয়ে রেহানার মত মহৎ প্রেমের দৃষ্টান্ত রাখতে। উজ্জ্বল দুটি চোখ মেলে উনি তাকিয়ে ছিলেন, আর আমিও অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম প্রতীমবাবুর দিকে। জিজ্ঞাস করেছিলাম, প্রান্তিক আপনাকে কি বলেছে জানিনা, কিন্তু এটা সত্যি যে দিন বাবা-মায়ের প্রতি অভিমান করে চলে এসেছিলাম, সেদিন কিন্তু প্রান্তিকের জীবনে আসতেই হবে এমন কোন স্বপ্ন ছিল না, তবে স্বপ্নগুলো কুঁড়ির মতো ফুটেছিল, রেহানার চলে যাওয়ার পরে। যদিও আমি বিশ্বাস করতাম, রেহানার থেকে সেলিনা আরো বেশী ভালবাসে প্রান্তিককে। রেহানার ভালবাসা ছিল চাপা। কাউকে বুঝতে দিতোনা। কিন্তু সেলিনা ছিল তরঙ্গ বিক্ষুদ্ধ সমুদ্র যেন। সেখানে হারিয়ে যাওয়া ছাড়া প্রান্তিকের যে আর কোন উপায় নেই, তা জানতাম। প্রতীমবাবু বাধা দিয়ে বলেছিলেন, অশ্রু, একটু বোধ হয় ভুল বললে, সেলিনা অবশ্যই তরঙ্গ বিক্ষুদ্ধ সমুদ্র কিন্তু সমুদ্রতো শান্ত হতে জানে অন্য দিকে হাজার চেষ্টাতেও শান্ত সরোবর কখনো তরঙ্গ বিক্ষুদ্ধ হতে পারে না। প্রান্তিকের একটা মন সব সময় স্পর্শ করে আছে সেলিনাকে, কারণ সেলিনাই এসেছে তার কাছে একেবারে বাস্তব হয়ে। রাগে-বিদ্বেষে, মানে-অভিমানে, দুঃখ ও ভালবাসায় একেবারে পূর্ণ হয়ে। যা রেহানার ছিল না। রেহানার ভালবাসা যেন পূজার অঞ্জলি। দেবতা নিলে নিজেকে ধন্য মনে করবে, কিন্তু না নিলেও তার কোন অভিযোগ নেই, সেখানে সেলিনা তার দাবী নিয়ে প্রান্তিকের সামনে দাঁড়িয়ে কৈফিয়ৎ চাইতে জানে। তার পূজার ফুল অবহেলা করে কেউ পার পেয়ে যাবে তা সে মেনে নেবে না কোন ভাবেই। এমন এক সাহসী প্রতিবাদ তার মধ্যে আছে বলেই সেলিনা তোমাদের সকলের থেকে আলাদা।

প্রান্তিক ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছিল নিজের অজান্তে সেলিনার সহজ সারল্য আর স্পষ্টতায়। হয়তো প্রান্তিক মানতে চাইবেনা, তবু এটা সত্য অশ্রু একটা সময় সকলের অগোচরে রেহানার জায়গায় সেলিনা ওর মনের মধ্যে স্থায়ী আসন করে নিয়েছে।

এরপর প্রতীমবাবু বললেন, আমার আর কিছু বলার নেই অশ্রু, তোমার যদি কিছু বলার থাকে তুমি বলতে পারো।

এবার অশ্রুকণা আমার একটা হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বলল, বিশ্বাস কর প্রান্তিক আমার ভিতর থেকে কান্ন উঠে আসছিল যেন। মনে হচ্ছিল এত অবিশ্বাস। যে কথা তুমি প্রতীমবাবুকে বলতে পারলে, তা তুমি আমাকে বলতে পারলে না? এইটুকু করুণা আমার উপর করা যেত না? তারপর মনে হল, বলবে কেন? সে অধিকার তো আমার নেই। আমিতো রেহানার মতো নিবেদিত প্রাণ নই। নই সেলিনার মত তরঙ্গ বিক্ষুদ্ধ সমুদ্র যে প্রয়োজনে শান্ত হতে জানে। আমি তো শান্ত সোর। ঢেউটুকুও যেন ওঠেনা। প্রত্নীমবাবুকে বললাম, না আমার কিছু বলার নেই। উনি বললেন এ তোমার অভিমানের কথা মা। আমি জানি, তোমারও আছে অনেক কথা বলার। তবুও আমার অনুরোধ পড়ি টানাটানি করে একটা অমূল্য জীবন নষ্ট করে দিও না। একটু ক্ষোভের সঙ্গে বললাম, এনিকের জীবনটাই আপনার কাছে বড়, তার মান-অভিমান, দুঃখ-ভালবাসা এ সবের জন্য আপনার ভাবনা হয়, আর আমি মেয়ে বলেই কি আমার দুঃখ কষ্ট, ব্যথা-বেদনাকে ভাবতে নেই।

উনি হাসলেন। কি মধুর সেই হাসি, তোমাকে বোঝাতে পারবো না। সমস্ত প্রাণ যেন জুড়িয়ে গেল। বললেন কে বলেছে তোমার কথা আমি ভাবিনি মা। আমিতো প্রান্তিককে ত্যাগ করতে বলি নি, ভালবেসে দূরে সরে যেতেও বলিনি। তোমার ভিতরের আলোকে তোমার বাইরেটাকেও আলোকিত করতে বলেছি মাত্র, যে ত্যাগ তুমি রেহানার জন্য করেছিলে সেই ত্যাগটুকু তুমি শুধু সেলিনার জন্য কর।

বলেছিলাম যদি না পারি। এও তোমার অভিমান। তোমাকে যতটুকু বুঝেছি তাতে পারার কিছু নেই মা। জীবনে জ্বালাটাই কি সব? তার স্থির শান্ত ও মাধুর্যময় রূপটাকে তোমার দেখতে ইচ্ছে করে না? করে কিন্তু এটাও করে আমি যে জ্বালায় জ্বলছি সেই একই জ্বালায় যেন অন্যেও জ্বলে প্রতীমবাবু বললেন, এইখানে তুমি প্রায় সেলিনার সমকক্ষ হয়ে গেছে। তুমি নিজে জ্বলতে জ্বলতে হয়তো চাইতে পারো সেও যেন তোমারি মত জ্বলে। কিন্তু সেলিনা শুধু কামনায় নিজেকে আবদ্ধ করে রাখবেনা সে যে কোন ভাবে তার বুকেও আগুন জ্বেলে দেবে। তার মানবী রূপটাই তার কাছে আসল সত্য।

আমি বলেছিলাম, তাহলে আমাকে কি করতে হবে, উনি বললেন, কোন দিক নির্দেশের জন্য তোমাকে এত কথা বলিনি। আর আমার এসব কথা শুনে মনে হতে পারে প্রান্তিক বুঝি আমাকে এসব বলেছে। কিন্তু না, মা, ও আমাকে কিছুই বলেনি।

সামান্য টুকরো টুকরো কথার মধ্য দিয়েই যা আমার মনে হয়েছে তাই শুধু বললাম। তোমার পথ, তোমার সিদ্ধান্ত সে সবই তোমার। আমার কিছু বলার নেই।

না উনি আর কিছু বলেননি, আজ বুঝতে পারছি প্রতীমবাবু ভালবাসার কোন জায়গায় পৌঁছে গিয়ে একথা বলতে পেরেছেন। তারপর নিজেই বলল যিনি ত্যাগ স্বীকার করতে পারেন, তিনিই তো ত্যাগের মহত্ত্ব বোঝেন তাই না প্রান্তিক? তোমার কাছেই শুনেছি, সেই • কতবছর আগে পূর্ব পরিচিতি ছাড়া একটি বিয়ের সম্ভাবনা বিয়োগান্ত একটি ঘটনায় নষ্ট হয়ে যায়। প্রতীমবাবু তার জন্য নিজেকে দায়ী করে এই জীবন বয়ে নিয়ে চলেছেন। যে মেয়েটি তার মত মানুষকে এই অবস্থায় এনে দাঁড় করিয়েছেন, তার হৃদয়টা কি নিষ্ঠুর তাই না প্রান্তিক? আমি কল্পনাও করতে পারিনি অশ্রুকণা বুঝতেও পারেনি যে সে মেয়েটি কে? আমি বললাম সত্যিই নিষ্ঠুর। নির্মম আর পাষাণ। কিন্তু তুমি যদি জানতে কলা, যে সেই হৃদয়হীন মেয়েটি হাজার প্রলোভনেও নতুন করে ঘর বাধতেই শুধু পারলো না তাই নয়, ভালোবাসার স্বপ্নটুকুও দেখতে পারলো না। অথচ আশ্চর্যের বিষয় কি জান? প্রতীমবাবু বা তোমার ভাষায় সেই হৃদয় হীনা নারী উভয়ে উভয়ের অজান্তে বয়ে চলেছে এক দুর্বিষহ জীবন হাসি মুখে, কারো প্রতি কোন অভিমান না রেখে।

অবাক হয়ে অশ্রুকণা বলল তুমি জানলে কি করে? কাকতালীয় ভাবে। তারপরু বললাম তুমিতো প্রতীমবাবুকে দেখেছো, একবার দেখতে ইচ্ছে করে না সেই নারীকে, যিনি তার জেদে অবিচল থেকে প্রতীমবাবুকে এই কঠিন জীবনের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন?

অশ্রুকণা বলে, হ্যাঁ ভীষণ ইচ্ছে করে। জানতে ইচ্ছে করে তার কাছ থেকে, কেন আপনাবা জীবনকে এই ভাবে টেনে নিয়ে চলেছেন? এতে আপনারা কি লাভ করেছেন? আমি বললাম তারা হয়তো জীবনে পাননি কিছুই, কিন্তু তোমার আমার মত জীবনগুলোকে ভালবাসায় ভরে দিয়েছেন। জান কণা সেই হৃদয়হীনা মেয়েটি কে? প্রচণ্ড ঔৎসুক্য নিযে ও আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল কে? আমি বললাম মিনতি সেন! শোনামাত্র নির্বাক নিস্পন্দ ভাবহীন বেদনাময় অভিব্যক্তি যেন আচ্ছন্ন করে ফেলল অশ্রুকণাকে। বললো মিনতি পিসি? হ্যাঁ আমার মা। প্রায় ২৫ বছর পরে আমি প্রতীমবাবুকে মিনতি সেনের কথা বললাম, সরাসরি যখন জানালাম, আমার মাই আপনাকে এই জীবনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন, ইচ্ছে করে না আমার মায়ের শূন্যতাকে পূর্ণতায় ভরে দিতে? উনি প্রথম ভেবেছিলেন, মিনতি সেন হয়তো নতুন সংসাব পেতেছেন, আর আমিই তার উত্তরাধিকারী, তখন হয়তো চাপা

অভিমান থাকলেও থাকতে পারে কিন্তু যখন জানতে পারলেন, রেহানার কথা, আমার কথা, আমাদের কথা, তিনি শুধু অবাক হলেন না, জীবনের সর্বোত্তম শ্রদ্ধা তিনি জানালেন মিনতি সেনকে। বললেন আমাকে, তোমার মায়ের মাতৃত্বের অহংকারকে আমি শ্রদ্ধা করি প্রান্তিক। এখনি কিছুই বলার দরকাব নেই, কিন্তু প্রয়োজন যদি দাবী করে জানিয়ে আমার সর্বোত্তম শ্রদ্ধা তাকে। বলেছিলেন তোমাদের প্রয়োজনে তোমাদের হিতাকাঙ্খী বন্ধু হিসাবে আমাকে পাশে পাবে। এর থেকে বেশী দাবী করে কোন মহত্ত্বকে ছোট করে দিওনা প্রান্তিক! জানি না কেন, নিজের অজান্তে মাথা নত হয়ে এসেছিল তার পায়ের উপর।

তুমি যখন রাগ করে চলে গেলে কণা, মিনতি সেনই আমাকে বললেন ওরা কাগজে কি একটা বিজ্ঞাপন দিয়েছে খোঁজ নিয়ে দেখনা, যদি মেয়েটার কিছু হয়। ও যে এত অভিমানী আর জেদী ভাবতেও পারিনি, হয়তো ঠিক মতো ওকে ভালবাসতে পারিনি, যদি পারতাম, যদি তোদের মত ও-ও আমাকে আপন ভাবতে পারতো যত অভিমানই হোক চলে যেতে পারতোনা। তুই যা না বাবা একবার।

তোমার জন্যই গিয়েছিলাম কণা। উনি শুধু জিজ্ঞাস করেছিলেন, আমার কাছে তুমি নিজেই এসেছো? না …। আমি তাকে বাধা দিয়ে বললাম এসেছি আমি নিজের ইচ্ছেয়, তবে মা জানেন, তিনি আমাকে নিষেধ করেন নি। পরের ইতিহাস তোমার জানা কণা। তুমি ভাবতেও পারবেনা কি অপরিসীম শ্রদ্ধা আমার মায়ের প্রতি তার। ত্যাগে যে প্রেম কোন স্তরে পৌঁছিয়ে যেতে পারে তার জ্বলন্ত প্রমাণ প্রতীমবাবু ও আমার মা। অথচ দেখ, আমার মায়ের সঙ্গে প্রতীম বাবুর কোন পূর্ব পরিচয় ছিল না, দেখাশুনা করেই এই বিয়ে ঘটতে যাচ্ছিল। কিন্তু ঘটল না এই বিয়েকেই কেন্দ্র করে একটা চরম এক্সিডেন্ট ঘটে যাওয়ায়। আর এসব মিটে গেলে প্রতীমবাবু আমার মাকে একটা ছোট্ট চিঠি দিয়েছিলেন, তাতে বলেছিলেন সবকিছুকে ভুলে গিয়ে যদি মনে করা যায় আমারা এক সাথে পথ চলতে পারি, আমি অপেক্ষা করব। অপেক্ষাই করেছেন প্রতীমবাবু আমার মায়ের কোন উত্তর না পেয়েও। আর আমার মা? তিনিও অপেক্ষা করেছেন উত্তর না দিয়ে। দীর্ঘ ২৫ বছর পরে যখন তুমি সজলবাবুকে বিয়ে করতে অস্বীকার করলে, আমাদের যাওয়ার কথাকে বাতিল করার জন্য আমি যাই প্রতীমবাবুর কাছে এবং তাকে আমাদের বাড়ীতে মানে নীলাঞ্জনা পিসির বাড়ীতে আসতে বলি, পিসি মাকেও বলেন তবে কোন কিছু না জানিয়ে। ২৫ বছর পরে দেখা হলেও চিনতে তারা পেরেছিলেন একে অপরকে। কিন্তু আত্ম মর্যাদার গভীর অহংকারে নিজেদের সরিয়ে নিতে কুণ্ঠিত হননি কেউ। আমি পচিয় করিয়ে দিয়ে বলেছিলাম, আমার মা। তীক্ষ্ণ চোখে দেখেছিলাম এক গভীর বেদনা তাকে যেন পাণ্ডুর করে তুলেছে। মিনতি সেন আর কাছে এলেন না। যখন চলে গেলেন তখন দেখা করেও গেলেন না। প্রতীমবাবুকে মিনতি সেনেব বাবার একটা চিঠি যা তিনি আমাকে লিখেছিলেন তার হাতে তুলে দিয়ে ছিলাম তাতেই জেনেছিলেন তিনি, মিনতি সেনের সত্যিকারের পরিচয়। মুগ্ধ শ্রোতার মতন অশ্রুকণা শুনছিল আমার কথা। প্রতীমবাবু আর মিনতি সেন, তাকে যেন নিয়ে চলেছে এক নতুন জগতে। যেখানে জাগতিক দেনা পাওনা দিয়ে জীবনের বিচার হয় না।

কারো মুখে কোন কথা নেই। নৈসর্গিক নিঃশব্দতাকেও যেন হার মানিয়েছে আমাদের নিঃশব্দতা। বললাম এবার তবে ওঠা যাক। অশ্রুকণা বলল, হ্যাঁ উঠতেতো হবেই, কিন্তু বিশ্বাস কব, প্রতীমবাবু ও মিনতি পিসি তারা যে কেমন ভাবে তাদের অজান্তে আমার জীবনে আলোড়ন তুলেছেন তা তোমাকে বুঝাতে পারবো না প্রান্তিক।

প্রতীমবাবুকে বলেছিলাম, আমি নিজে কিছুই চাইবোনা ওর কাছে। কিন্তু ও যদি আসে, আমি ফিরিয়ে দিতে পারবো না। বলেছিলেন, তাতে আরো আঘাত পাবে মা, কি দরকার জীবনকে আরো জটিলতার মধ্যে নিয়ে গিয়ে। তার চেয়ে যা সহজ স্বাভাবিক এবং সুন্দর তার মধ্যে নিজের মুক্তি খুঁজে নিও। দেখবে তাতে কোন হারানোর বেদনা থাকবেনা। জীবনে যদি জয়ী হতে চাও মা, পথকে অনাবশ্যক দূর্গম না করে সুগম করে নাও।

হঠাৎ দেখি সীতা এগিয়ে আসছে। সামনে এসে বলল, দিদিমণি জিজ্ঞাসা করছেন, আপনাদের কত দেরি হবে। এখানে কি চা বা কফি পাঠিয়ে দেবে, না একেবারে রাতে খাবার খেয়ে নেবেন।

অশ্রুকণা হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল বাবাঃ ১০টা বেজে গেছে। বলল, না তুমি যাও সীতা, আমি আসছি। ও আমাকে বলল এতটা সময় এখানে কাটালাম, কি জানি সেলিনা আবার কি ভাবছে, না জানি অভিমানে কথাই বলবে কি না। আমি একটু হেসে বললাম ভয় নেই কণা প্রতীমবাবুতো বলেছেনই সেলিনা উত্তাল সমুদ্র হলেও, সমুদ্র শান্ত হতে জানে। তুমি কি বিশ্বাস কর ওকে বাদ দিয়ে এই আকাশ ভরা জোছনা ধারায় যে মুহূর্তটুকু কাটিয়ে গেলাম তাতে ও কিছু ভাববে না? কেন ভয় পাচ্ছ কণা। ভাবারতো কিছু নেই। কি জানি আছে কি না। তবু ভয় হয়। আমি বরং ওকে তোমার কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছি। যদি না আসে? সীতাকে পাঠিয়ে ডাকিয়ে নেবো। প্রয়োজন হবে না কশা। বল আমি ডাকছি! আচ্ছা।

একটু পরে এল সেলিনা। বলল, এতক্ষণ এখানে আছে, এরপরও আবার আমাকে ডেকে পাঠিয়েছে কেন? বললাম বোস না সেলিনা। রাত কত হয়েছে জান? না হিসেব করিনি। তারপর বললাম কি হল কসবে না?হা বসব, তুমি একটু অপেক্ষা কর আমি এক্ষুনি আসছি। ও ভিতরে গিয়ে অশ্রাকে বলল, অদি, প্রান্তিক ভাই আসতে চাইছেনা এখন, তুমি যাবে? চল না কফি খেতে খেতে আরো কিছুক্ষণ কাটানো যাক। না সেলিনা, তুমি যাও। আমিতো অনেকক্ষণ ছিলাম। সেইজন্য বুঝি, আমি যাইনি বলে তুমিও যাবে না। দূর পাগলি মেয়ে, আমি কি তাই বলেছি? তুমি যাওনা, হয়তো তোমাকে কিছু বলতে পারে। বেশ আমি ওর জন্যও কফিটা নিয়ে যাচ্ছি। তুমি যাও, আমি সীতাকে দিয়ে পাঠিয়ে দিচ্ছি। দরকার নেই অশ্রুদি, হয় আমাকে দাও, না হলে দিতে হবে না। হঠাৎ অশ্রুকণা বলল, একিরে মেয়ে, চুলগুলো এমন উস্কো খুশকো, শাড়ীটা যারপর নাই কোচকানো, এই ভাবে যাবে নাকি তুমি। একটু বুঝি লজ্জা পায় সেলিনা, বলে, চুলটা বাধার সময় হয়নি, আর তাছাড়া শাড়ী, বাড়ীর মধ্যে বাগান, কে দেখবে শাড়ীটা কেমন? অশ্রুকণা বলল, যার চোখ আছে সেই দেখবে। ঐ শাড়ীটা ছেড়ে ফেল সেলিনা, আর চিরুনীটাও নিয়ে যাও, প্রান্তিকের সঙ্গে কথা বলতে বলতে চুলটা বেধে ফেল। সেলিনা বলল আমার চুল বাধা নিয়ে এত ভাবছে কেন? এমনতো নয যে, এমন ভাবে প্রান্তিক ভাই আমাকে কখনো দেখেনি। হয়তো দেখেছে, কিন্তু দেখেছে বলেই এই ভাবেই তোমাকে রোজ দেখতে হবে তারতো কোন মানে নেই। তাহলে তুমিই চল, চুলটা তুমিই বেঁধে দেবে ওখানে বসে। অশ্রু বলল, সেই এক জেদ, আচ্ছা তুমি সব কিছু নিয়ে যাও। সত্যি যদি চুল বাঁধার কোন অসুবিধা হয় ফিরে এলে বেঁধে দেবো। আর দেরি করো না, অনেকক্ষণ প্রান্তিক একা একা বসে আছে।

সেলিনা আমার পাশে বসে পড়ে বলল, এই নাও চিরুনি আর ফিতে। আমি অবাক হয়ে বললাম, এসব দিয়ে আমি কি করব! কি করবে তা আমি কি করে বলব? আমাকে নাকি এভাবে তোমার দেখতে ভাল লাগবে না, এ ভাবে নাকি তোমার কাছে আসাই উচিত নয় আমার, তহলে যে ভাবে সাজলে তোমার কাছে দৃষ্টি সুন্দর হয়, সেই ভাবেই সাজিয়ে নাও না বাপু।

ভিতরের অভিমানটা টের পাচ্ছি, বুঝতে পাচ্ছি যতক্ষণ অশ্রুকণা ছিল ও আসেনি ঠিকই, কিন্তু ভিতরের উত্তাপকে মিইয়ে যেতেও দেয়নি। বললাম, যে সাজে তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করে সেই সাজে সাজাতে পারলে সাজাবত! পারবে সাজাতে? আমার কোন আপত্তি নেই।

কি অস্বাভাবিক পরিবর্তন! বললাম সেলিনা, তুমি কি আমার উপর প্রতিশোধ নিচ্ছ? না। তবে? আমাকে তোমার হাতে তুলে দিয়েছি প্রান্তিক ভাই। আমাকে তোমার যে ভাবে ভাল লাগে, সে ভাবে দেখতে ইচ্ছে করে না? করে সেলিনা, এই মায়াবী রাতে তোমার ডানায় ভয় দিয়ে ঐ চাঁদের দেশে পৌঁছিয়ে যেতে ইচ্ছে করে, যাবে তুমি? যাব! সবটুকু আবেগ ঢেলে দিয়ে বলল সেলিনা। বার বার মনে পড়ছে একটু আগে অশ্রুকণার বলা প্রতীমবাবুর কথা, সেলিনা উত্তাল সমুদ্র হলেও সমুদ্র শান্ত হতে জানে। বললাম, আমার দিকে পিছন ফিরে বস। ও কোন প্রতিবাদ না করে তাই করল। আমি চিরুনিটা তুলে নিয়ে যতটুকু সম্ভব সুন্দর করে ওর চুল আঁচড়িয়ে দিলাম। তারপর এক বেনীতে বেঁধে দিলাম ওর ঘন কালো চুলের গোছা, যেমন করে একদিন নির্জন নার্সিং হোমের কেবিনে রেহানাকে বেধে দিতাম। তারপর গাছ থেকে সেই জোছনা আলোকে তুলে নিলাম প্রমান সাইজের চন্দ্রমল্লিকা পরম মমতায় খুঁজে দিলাম তা ওর বেনীর উৎসে। এবার বললাম আমার দিকে ফিরে বোস। ও দ্বিধাহীন ভাবে তাই করল। অপলক তাকিয়ে রইলাম ওর দিকে। বলল অমন করে কি দেখছ? তোমাকে? আগে কি দেখনি কোনদিন? না সেলিনা, তোমাকে এমন ভাবে কোনদিন দেখিনি? তুমি কি দেখেছো এমন করে কোনদিন আমাকে? ও উঠে দাঁড়ালো, বললাম উঠলে যে। না এমনি, তুমি বোস আমি আসছি! কোথায় যাবে? কোথাও না, তুমি কিন্তু উঠবে না প্রান্তিক ভাই। ও উঠে গিয়ে গাছ থেকে সুন্দর দুটো গোলাপ তুলে নিয়ে এল, আর তা তুলতে গিয়ে গোলাপ কাটার আঘাতে ওর হাত ক্ষতবিক্ষত হয়ে রক্ত ঝরতে লাগল, সেদিকে ওর কোন খেয়াল নেই। ও গোলাপ দুটো নিয়ে এসে দাঁড়ালো আমার কাছে। তারপর আমার পায়ের কাছে রেখে প্রণাম করল। আমি বললাম সেলিনা একি করলে? ও উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমার হিংসা আর অভিমানকে উজাড় করে তোমাকে দিলাম। আমি ওকে বুকের পরে টেনে নিয়ে বললাম সেলিনা! আমার জন্য কিছু রাখলাম না প্রান্তিক ভাই, এবার আমি কেবল তোমারই। আমার মান-অভিমান হিংসা-দ্বেষ-ঈর্ষা-ভালবাসা সবকিছু তোমার পায়ে অঞ্জলি দিয়ে নিজেকে নিঃস্ব করে তোমার হলাম, পারবে কি আমায় ফিরিয়ে দিতে? বললাম, তোমাকে ফিরিয়ে দিতে পারি সে সাধ্য আমার নেই। তারপর ওকে ছেড়ে দিয়ে বললাম, দেখি তোমার হাত! কেন? দেখিনা! ও হাতখানা বাড়িয়ে দিল। তখনো সেখান দিয়ে রক্ত ঝরছে। বুঝি প্রথম খেয়াল হল সেলিনার, বলল, হাতটা কেঁটে গেল কখন কে জানে? আমি ওর হাতটা নিজের হাতের মধ্যে তুলে নিয়ে, আঙুলে তুলে নিলাম ঝরে যাওয়া রক্ত। তারপর তাই দিয়ে টিপ পরিয়ে দিলাম ওর দুই ভুর মাঝখানে, বললাম, এটার বুঝি অভাব ছিল। কি যে আনন্দে তাকালো ও, বলল অশ্ৰুদিকে একটা প্রণাম করব, উনি নেবেন তে আমার প্রণাম? আত্মসমর্পণে আকাঙ্খ কোথায় পৌঁছিয়ে যায় তাই শুধু ভাবছিলাম।

কেটে গেছে কয়েকটা দিন। অশ্রুকণার প্রথম যতটা খারাপ মনে হয়েছিল, এখন আর তা হয় না। মোটামুটি মানিয়ে নিয়েছে। সত্যভূষণ বাবু রোজ আসেন না। তবে ডেকে পাঠালে আসেন, তার সৌজন্য তাকে কোন ভাবে বাহুল্যে ভরে দিতে তিনি যেন জানেন না।

এবার যখন সত্যভূষণ বাবু এলেন, আমি বললাম, কালতো চলে যাবো সত্যবাবু। আপনার সৌজন্যের কথা আপনার সমব্যথী দরদী মনের কথা, আমাদের মনে থাকবে। উনি হেসে ফেলে বললেন, ও সবতো আমি নই, আমাকে কি মনে থাকবে প্রান্তিকবাবু। বললাম, কোন রকম বাঁকা অর্থে এসব বলিনি সত্যবাবু। সত্যি আপনাকে ভীষণ ভাল লেগেছে আমাদের। তাহলে বন্ধুত্বের অধিকার দিচ্ছেন তো। সে অধিকার তো যেদিন এসেছি–সেদিনই দিয়েছি। তাহলে ওই কথাই রইল, আমি না আসলে বেরুবেন না। আমিও যাবো আপনাদের সঙ্গে। আমাদের সঙ্গে, কোথায়? কাল অশ্রুদেবীই জানান যে আপনারা আগামীকাল যাবেন। মেদিনীপুরে কি একটা বিশেষ কাজ আছে, যদি আমি আপনাদের সাহায্য করি, অবাক হলাম একটু। মেদিনীপুরে কি কাজ, অশ্রুকণা কি বোঝাতে চাইছে, কোনটাই তো জানিনে। সেটা না হয় অশ্রুকণার কাছে জেনে নেওয়া যাবে, তাই বললাম, তাহলে তো খুব ভাল হয়। আসলে মেদিনীপুর শহরের তো বিশেষ কিছু জানিনা, আপনি থাকলে তো বিশেষ উপকারই হয়। উনি বললেন এ ভাবে বলছেন কেন? এটা আমার জেলা। মেদিনীপুর আমার শহর।

রাতের দিকে একা পেয়ে অশ্রুকণাকে বললাম, হঠাৎ সত্যবাবুকে আমাদের বিশেষ কি কাজের কথা বলেছ কণা? ও বলল, তা হলে থাক, আমি বলে দেব, না, ওরা এবার সময় পাবে না। আমি বুঝতে পারছি না কি ও বলতে চাইছে, তবু বললাম, কণা সব সময় যে সব কথা বুঝতে পারবো এমন তো নয়। যদি তুমি কি চাইছো জানতে পারি। ও বলল, হয়তো অভিমানেই, সেলিনা মনে হয় আজ তোমার সব শূণ্যতা পূর্ণ করে দিয়েছে প্রান্তিক, তাই হয়তো আর কারো জন্য তোমার হৃদয়ে এক বিন্দু জায়গাও নেই, আর সে জন্যই রেহানা আজ তোমার কাছে অতীত ইতিহাস। কিন্তু তুমি বিশ্বাস কর, সত্যিকারের ভালবাসা ওর কাছ থেকে শিখেছিলাম একদিন। খাতা কলমে শেখায়নি। নীরবে, একাকী তার আচরণের ভিতর দিয়ে হৃদয়ে গেঁথে দিয়েছিল। মনে হয়েছিল হয়তো তাকে একবার খুঁজতে চাইবে। এই মেদিনীপুর সেন্ট্রাল জেলে ডালিমের মৃত্যু হয়েছিল। আমার বার বার মনে হয়েছে, অলিমের সঙ্গে এই জেলে রেহানার দেখা হতে পারে। তাই ভেবেছিলাম, হয়তো এখানকার সাক্ষাৎ প্রার্থীর রেজিষ্টার দেখলে রেহানার কোন হদিশ পেলেও পেতে পার। হয়তো এসব আমার ভুল প্রান্তিক। যদি জীবন থেকে ওকে মুছে দিতে চাও দরকার নেই। আর যদি মনে কর, বাস্তব যাই হোক না কেন, ওকে একবার খোঁজা তোমার দায়িত্ব। তাই মনে হয়েছিল, সত্যভূষণবাবু তোমাদের কিছু সাহায্য করলেও করতে পারেন।

না এখানে এসেও ভাবিনি, সেন্ট্রাল জেলে গিয়ে এই ভাবে তার একটা খোঁজ নেওয়া যেতে পারে, যদিও স্থির বিশ্বাস, ডালিমের সঙ্গে রেহানার দেখা হয়েছিল, দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম কণা, জীবন থেকে রেহানাকে মুছে দিতে পারবো, এ তুমি ভাবলে কি করে? সেলিনা : তার দাবী নিয়ে এসেছে বলে রেহানাতো মুছে যাওয়ার নয়। বলেছে সে তোমাকে ভালবাসা শিখিয়েছে, হয়তো সে তোমার হৃদয়ের উপলব্ধি। কিন্তু আমার জীবন দর্শনতো তারই দান। সব কিছুকে, কি ভাবে, জীবনের সঙ্গে সহনশীল করতে, কি ভাবে জীবনকে মৰ্য্যাদাময় করতে হয়, এসব আমাকে সে তার নীরবতা, উপলব্ধি আর অনুভব দিয়ে শিখিয়েছে। না কণা, জীবনে সেলিনা যেভাবেই আসুক না কেন, তোমাকে ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করবো না, বরং তুমিও চলনা সত্যবাবুর সাহায্যে আমি, তুমি ও সেলিনা যদি তার কোন খোঁজ পাই।

অশ্রুকণা বলল, এত আবেগ তাড়িত হয়োনা প্রান্তিক। তোমরাই যাও। প্রাথমিক খোঁজ যদি পাও, আমাকে জানিও। আমিতো এখানেই থাকবো, তার সর্বশেষ সংবাদ পাওয়ার জন্য আমি যথাসাধ্য করব। ওকে আর বেশী কথা বাড়াতে না দিয়ে প্রসঙ্গটায় ইতি টেনে দিলাম।

আজ চলে যাব। মনটা সকাল থেকে ভীষণ ভারাক্রান্ত অশ্রুকণাকে নতুন করে কোন সান্ত্বনা দেওয়ার নেই আমার। নিজের সান্ত্বনা সে নিজেই খুঁজে পেয়েছে। এখানকার পরিবেশ, এখানকার মানুষ, তার সহকর্মীরা সর্বোপরি সত্যভূষণবাবু সবকিছু মিলে হয়তো অশ্রুকণাকে নতুন ঠিকানার সন্ধান দিতে পারবে, এই আশা নিয়েই যাচ্ছি। সেলিনাও একয়দিনে জীবনের আমূল পরিবর্তন করে ফেলেছে। ও বোধ হয় সার সত্য বুঝেছে যে হিংসা বা ঈর্ষা দিয়ে কোন হৃদয় জয় করা যায় না, তার জন্য যে স্বার্থ হীন ভালবাসা দরকার, সে তা অর্জন করেছে বলে মনে হয়।

মনের মতো করে সাজিয়ে দিয়েছে সেলিনাকে অশ্রুকণা। ওর সব থেকে দামী শাড়ী আর গয়না দিয়ে সাজিয়েছে ওকে। সেলিনা বলল, এ তুমি কি করলে অশ্ৰুদি তোমার সব থেকে দামী শাড়ী আর গয়না আমাকে দিয়ে দিলে? অশ্রুকণা বলল, এসব তো ভাল লাগার জন্য। তোমাকে পরিয়ে আমার ভাল লাগলো। তাই তোমাকে সাজিয়ে দিলাম। শুধু ভাল লাগার জন্য অদি। তা ছাড়া আর কি? তারপর বলল সেদিন রাতে যখন তুমি প্রান্তিকের সাজানো সাজে আমায় প্রণাম করলে, অবাক হয়েছিলাম সেলিনা, কি আছে ওর মধ্যে যা তোমাকে এমনি করে পরিবর্ক্স করে দিল। ভুল অশ্ৰুদি আমার মধ্যে যা কিছু পবিবর্তন সে তোমারই দান। গর্ব হয়েছিল কি না জানিনা সেলিনা, কিন্তু আনন্দে দু চোখে যেন বান ডেকে এসেছিল। ভেবেছিলাম, সময় যদি আসে আমিও একদিন সাজাবো তোমায়। তাই সাজিয়েছি বোন, অন্তরের কৃতজ্ঞতায় যদি গ্রহণ কর, অভিমানে যদি ছুঁড়ে ফেলে না দাও সেই হবে আমার পুরস্কার। সেলিনার গলা যেন আবেগে থর থর করে কাঁপছে, বলল, অশ্ৰুদি, তোমাদের ভালবাসার সত্যি কি আমি যোগ্য! অশ্রুকণা বলল সেতো জানিনা ভাই। যোগ্যতার পরিমাপ কি করে করতে হয় তাও জানিনা। একদিন মনে করতাম মিনতি পিসির বেছে নেওয়া জীবন যেন কোন ধনীর দুলালির হঠাৎ খেয়াল। কিন্তু যেদিন সত্যিটাকে জানলাম, মনে হলো মানুষকে আমরা কত ভুলই না ভাবি, মিনতি সেনের সর্বস্ব ত্যাগ, আমাকে যেন এক নতুন সত্যের সন্ধান দিল। না, সেলিনা প্রান্তিককে তোমার হাতে তুলে দিতে, আমার কোন পিছুটান নেই। সত্যি কথা বলতে কি, মনে যে কোন লোভ ছিল না তা নয়, কিন্তু এখানে এসে জানলাম লোভই জীবনের সর্বস্ব নয়, তাকে, ত্যাগের মধ্যে লুকিয়ে আছে জীবনের সার্থকতা। হয়তো অনেক সময় ভুল বুঝেছ আমাকে, আমার আচরণও যে তাতে ইন্ধন যোগায় নি, তা কিন্তু নয়। ওর চোখ দুটি ছল ছল করে উঠলো।

আমি শুনতে পাচ্ছি, সেলিনা বলছে, এই খানে তুমি জয়ী অদি, ত্যাগের মধ্যে তুমি পেয়েছে সত্যের সন্ধান, আর আমি, ত্যাগ চাইনি, জীবনের সর্বস্ব দিয়ে পেতে চেয়েছি, পেয়েছি কি না জানি না, তবু প্রতিমুহূর্তে ভয়, এই বুঝি হারিয়ে যাবে। কেন এত ভয়? ওকি তোমাকে গ্রহণ করেনি? যে উপলব্ধিতে তোমার জয় হয়েছে সেই উপলব্ধিটুকু যে আমার নেই। প্রতি মুহূর্ত মনে হয় আমি রেহানার ছায়ামাত্র। রেহানার সাথে ওর যেভাবেই দেখা হোক, যদি তা হয় কোনদিন, ওর জীবন থেকে মুছে যাবে সেলিনা। ত্যাগের মধ্যে দিয়ে তো আমি সত্যের সন্ধান করিনি। যদি সেই শুভ মুহূর্ত আসে ওর জীবনে, আমি কি করব বলতে পার অদি?

একটু দ্রুত পায়ে সত্যভূষণ বাবু এলেন। এসেই কৈফিয়ৎ দেওয়ার ভঙ্গীতে বললেন, একটু দেরি হয়ে গেল। আসলে একটা টেলিগ্রাম এসেছে কলকাতা থেকে। অশ্রুকণা বলল কোন দুঃসংবাদ। প্রাণ খোলা হাসিতে নিজেকে প্রকাশ করে সত্যভূষণ বাবু বললেন আমাদের একটা বদ্ধমূল বিশ্বাস, টেলিগ্রাম মানেই দুঃসংবাদ। না অশ্রুদেবী এটা দুঃসংবাদ নয়। পাঠিয়েছেন এই সমস্ত প্রতিষ্ঠানের যিনি প্রাণ পুরুষ সেই প্রতীম চোধুরী প্রান্তিক বাবুর জন্য। আমি অবাক হয়ে বললাম, আমাকে? হ্যাঁ প্রান্তিকবাবু আপনাকে। টেলিগ্রামটা উনি আমার হাতে তুলে দিলেন। যদিও টেলিগ্রাম, তবু আসলে একটা চিঠি। প্রতীম বাবু লিখেছেন, প্রান্তিক, আমি মেদিনীপুর হোটেলের ৪ নং ঘরে উঠছি। ৫ ও ৬ নং ঘর তোমার ও সেলিনার জন্য বুক করা আছে। অশ্রু যদি আসতে পারে, ওকেও নিয়ে এসো। তোমরা দেরি করছ দেখেই টেলিগ্রামটা করতে হল। ৫ তারিখ রাত ৮ টার মধ্যে অবশ্য পৌঁছে যেও। এতদিনে সত্যভূষণের সঙ্গে নিশ্চয়ই তোমাদের আলাপ হয়েছে, ওই তোমাদের পৌঁছিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করবে, ইতি–প্রতীম চৌধুরী।

অশ্রুকণা ও সেলিনা আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি টেলিগ্রামটা তাদের হাতে দিয়ে বললাম, সত্যবাবু ৫ তারিখ তো আজ তাইনা? আপনি জানেন কি উনি কেন আসছেন? তা তো বলতে পারবো না প্রান্তিক বাবু।

অশ্রুকণা টেলিগ্রামটা পড়ে সেলিনার হাতে দিয়ে বলল, তোমরা যাও প্রান্তিক। আমি এখন আর যাব না। জানতে চাইলাম, কেন টেলিগ্রাম করেছেন পড়ে কিছু মনে হল? না বুঝতে পারছি না, হয়তো এমনও হতে পারে ব্যক্তিগত কোন কাজেই হয়তো আসছেন।

সেলিনা বলল আমার মনে হয় অশ্রুদি, কোন বিশেষ সংবাদ আছে, এবং তা মেদিনীপুরেই। তারপর আমাকে বলল প্রান্তিক ভাই, রেহানার কোন ব্যাপার ওকে বলেছ। কি? না আমি কিছু বলিনি, তবে ব্যাপারটি উনি জানেন। তুমি বলনি অথচ জানেন? আমি বললেও কেউ না কেউ হয়তো বলেছে। তাই বল।

সত্যভূষণবাবু বললেন, তাহলে আর দেরি করা ঠিক হবে না, যতটা তাড়াতাড়ি যাওয়া যায় ততই ভাল। বললাম বেশ চলুন তা হলে। সেলিনা বলল, অশ্ৰুদি তোমার কি যেতে খুব অসুবিধা হবে? বলল অসুবিধাটা তোমাকে বোঝাবার নয়। তোমাদের সঙ্গে গিয়ে একা একা ফেরার যে দূর্বিসহ যন্ত্রণা, তার ভেতর পড়তে চাইনা, এরপর যখন আসবে, তোমাদের সূঙ্গে যাব। এবার আর অনুরোধ করোনা। সত্যভূষণবাবু বললেন, আমি বাইরে আছি, দেখি ওরা এল কিনা। উনি বেরিয়ে গেলেন। সেলিনাও পাশের ঘরে চলে গেল ব্যাগ আনার জন্য। অশ্রুকণা বলল, কিছু বলবেনা? বললাম তোমার মন শান্ত হোক কণা, ঈশ্বর যেন তোমাকে সেই শক্তি দেয়। যাওয়ার আগে আমার কাছে তোমার কিছুই চাওয়ার নেই বলল অশ্রুকণা। কে বলল নেই? তাহলে বল। কি তোমাকে দেব। যাতে আমার সব শূণ্যতা আর অভাব পূর্ণতায় ভরে যায় তাই আমাকে দাও কশা। আমি দিলে তুমি পারবে নিতে? পরীক্ষা করেই দেখনা? বাঁধা দেবে নাতো? না বেশ, তাহলে নিয়ে যাও বলে আচমকা ও হাঁটু ভেঙে যে ভাবে মাথা নোয়ালো, তাতে আমার বিস্ময়ের অবধি রইলনা। তবু তাকে বাধা না দিয়ে বললাম, তোমাকে কিছু দিতে না পারলেও আমি কিন্তু তোমার দান হৃদয় দিয়ে গ্রহণ করে নিয়ে যাচ্ছি। দুঃখ পেও না কশা। অপেক্ষা করো। সত্যি? হ্যাঁ সত্যি। আমি আসব, আবার আসব তোমার কাছে কশা। এমন করে তোমার দানকে স্বার্থপরের মত কেবল বাক্সবন্দী করে রাখতে পারবো না। যদি না পার তাহলে জাগতিক এমন কিছু দিয়ে যাও, যা আমার একাকী নিঃসঙ্গতায় সব সময় আমার পাশে থাকবে। বেশ, বলে, আমার পার্স থেকে একটা পাসপোর্ট সাইজের ফটো তার হাতে তুলে দিয়ে বললাম, জানিনা অহংকারটা বেশী হয়ে গেল কিনা।

উজ্জ্বল চোখদুটি চিক চিক করে উঠল। দু হাত পেতে নিল আমার ছোট্ট উপহার, তারপর বলল সেলিনাকে দেখ প্রান্তিক। ওর অভিমানে যেন কোন ভাবে ঘা না লাগে এই অনুরোধ।

সাতটার একটু পরে আমি ও সেলিনা মেদিনীপুর হোটেলের ৪ নং ঘরে নক করলাম। বেরিয়ে এলেন প্রতীমবাবু। আমরা ওনাকে প্রণাম করলাম। প্রতীমবাবু বললেন, জায়গাটা কেমন লাগলো সেলিনা? ভীষণ ভালো। তাহলে কদিন থেকে এলে না কেন? কি ভাবে থাকবো? কেন অশ্রুর কাছে। অশ্ৰুদিরতা থাকার অধিকার আছে, কিন্তু আমাদের তো তা নেই। অনধিকারে আর কদিন থাকবো বলুন। তাহলে তুমি অধিকার চাও? হাসতে হাসতে প্রতীমবাবু বললেন। চাইলেই বা আমাকে দেবে কে? গলাটা বোধ হয় একটু ভারি হয়ে এসেছিল। আমি অবাক হয়ে তাকালাম ওর দিকে। তবে কি অশ্রুকণার কাছ থেকে বিদায়ের সেই ছোট্ট দৃশ্যটুকু তার দৃষ্টি এড়িয়ে যায় নি? এরই মাঝে প্রতীমবাবু বেল দিয়ে বেয়ারাকে ডেকে পাঠালেন, এলে স্নাকস্ ও কফির অর্ডার দিলেন যেমন, তেমনি তিন জনের ডিনারেরও। আমার হাতে ঘরের চাবি দিয়ে বললেন ওর ঘরটা দেখিয়ে দাও প্রান্তিক। আচ্ছা বলে সেলিনাকে বললাম চল। ওর ঘরে ঢুকে ও বলল, রাতে আমাকে এখানে একা থাকতে হবে? অদ্ভুত প্রশ্ন। বললাম, অসুবিধে হবে? অসুবিধা হলে কি করবে তুমি? থাকবো তোমার কাছে। বাজে কথা বলল না প্রান্তিক ভাই? কোনদিনই তুমি আমার কাছে থাকতে পারবেনা। একি বলছ সেলিনা। আজ রাতে যদি সত্যিই তোমার কাছে থাকি, কাল মুখ দেখাতে পারবে? আগে থাকার যোগ্যতা তো অর্জন করো, তারপর ভাবা যাবে, কি হবে আর কি হবে না। বললাম ঠিক আছে প্রতীমবাবু কফির অর্ডার দিয়েছেন। বেয়ারাকে দেখলাম, কফি নিয়ে ঢুকলো, তুমি তাড়াতাড়ি এসো। যাচ্ছি। আমি কিন্তু একা একা এ ঘরে থাকতে পারবো না বলে দিচ্ছি।

একটু পরে শাড়ীটা বদলে চোখে মুখে জল দিয়ে এলো সেলিনা। প্রতীম বাবু বললেন, একা একা থাকতে ভয় লাগবে তো। নানা আমার কোন অসুবিধা হবে না বলে সেলিনা তাকালো আমার দিকে। লজ্জার কিছু নেই। ওই ঘর দুটোয় ভিতরে দরজা আছে, ভয় করলে দরজা না হয় খোলা রেখ। কিন্তু আমি তোমাদের আসতে বলেছিলাম, কারণ, এখানকার সেন্ট্রাল জেলেতো ডালিম মারা গিয়েছিল তাই না? আমরা উভয়ে তাকালাম ওনার দিকে। আমি খোঁজ নিয়ে দেখেছি ডালিমের মৃত্যুর দিন কয়েক আগে রুকসানা নামে একটি মেয়ে ওর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। আমার মনে হয় মেয়েটি রেহানা হতে পারে। আসলে ব্যারিষ্টার ভট্টাচার্য সাহেব, আমাকে বলেছিলেন, আপনিতো ওখানে যাচ্ছেন, খোঁজ নিয়ে দেখবেনতো রেহানা নামে কোন মেয়ে ডালিমের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন কি না। আমি বললাম, হঠাৎ ডালিমের মৃত্যুর এতদিন পরে আপনার এ খোঁজ নেওয়ার দরকার হলো কেন? উনি আমাদের কোম্পানীর সলিসিটর, তাকে অনুরোধ করেছেন তোমার মা। আমরা যুগপত বিস্মিত হলাম। অবশ্য মেয়েটির একটি ঠিকানাও দেওয়া আছে প্রযত্নে মোসলেমউদ্দীন আমি তার বাড়ীতেও খোঁজ নিয়েছি, মোসলেমউদ্দীন ডালিমের এক দূর সম্পর্কের চাচা। কিন্তু ওখানে ককসানা নামে কেউ থাকে না। ওই নামে উনি কাউকে চেনেনও না। মনে হয় মেয়েটি তার আসল নাম সাক্ষাৎ প্রার্থীর খাতায় লেখেনি। আমার সন্দেহটা অমূলকও হতে পারে। তবু প্রান্তিক আমি চাইছি তোমরা দুজনেই মোসলেমউদ্দীনের বাড়ীতে একবাব খোঁজ নাও। প্রায় প্রতি সপ্তাহেই তিনি ডালিমের কাছে আসতেন। এতক্ষণে সেলিনা বলল আমার মন বলছে রুকসানাই রেহানা। আমারও তাই মনে হয়। বললেন প্রতীম চৌধুরী। তারপর নিজেই বললেন, এবার তোমরা যাও। সকালে আমি একটা গাড়ী ঠিক করে রেখেছি। ড্রাইভার আমার নিজের লোক। তাকে বিশ্বাস করে তোমরা যে কোন জায়গায় যেতে পারো। তোমাদের আরো যদি কোথাও যাওয়ার প্রয়োজন হয় ও তোমদের নিয়ে যাবে। এবার এস তোমরা আমার কিছু অফিসিয়াল কাজ আছে।

আমরা চলে এলাম। ঘরে এসে জামা প্যান্ট ছেড়ে বাথরুমে গিয়ে ভাল ভাবে স্নান করলাম। তারপর পাজামা পাঞ্জাবি পরে নিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। আর সারদিনের ক্লান্তি শেষে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে চোখে ঘুম নেমে এল।

খানিক পরে এল সেলিনা, বসল আমার মাথার কাছে। তারপর আমার সঙ্গে কোন কথা না বলে নীরবে আমার মাথার চুলের মধ্যে তার আঙুল চালিয়ে বিলুনী কাটতে লাগল। এক সময় বলল, শরীর খুব খারাপ লাগছে প্রান্তিক ভাই? আমি চোখ মেলে দেখি ও আমার শিয়রের কাছে বসে আছে। বললাম, কতক্ষণ এসেছো? অনেকক্ষণ। ডাকলেনা কেন? তোমার ঘুমন্ত মুখটা দেখতে ভীষণ লোভ হচ্ছিল তাই। আমি আর কোন কথা না বলৈ উঠে বসলাম। বললাম এবার তুমি শুয়ে পড়ো, আমি তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। না। কেন না? ও দিকে না গিয়ে বলল, তোমার কি মনে হয় না রুকসানাই রেহানা। ঠিক বুঝতে পারছি না, হতেও পারে আবার নাও হতে পারে। মানে? আমার কি মনে হচ্ছে জান? কি? তুমি আসনিতো সেলিনা? ও অবাক হয়ে গেল, বলল তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? না মাথা আমার খারাপ হয়নি, আগে হয়তো এত বুঝতে পারতাম না। কিন্তু এখন বুঝি। রেহানা এটা পারবেনা। রেহানা পারবে না, আর আমি পারবো, একথা ভাবলে কেন? রেহানা আমাকে ছেড়ে যেতে পারলেও তুমি পারবেনা এই বিশ্বাস আছে বলে বিশ্বাস তোমার যেমনই থাকুক প্রান্তিক ভাই রেহানার কাছ থেকে তোমাকে আমি কোনদিনই কেড়ে নিতে পারবো না। আর তা ছাড়া তুমি যা ভাবছ, সে তোমার কল্পনা, বাস্তব নয়। একটা কথা জেনে রাখ, তোমার জন্য আমি যুদ্ধ করতে পারি, নিজের জীবনও হয়তো দিতে পারি, কিন্তু তোমার জন্য করুণা ভিক্ষা করতে পারি না কারো কাছে, তাতে আমার আত্ম মর্যাদায় আঘাত লাগে। তাহলে কাল আমরা যাচ্ছি ঠিকতো। অবশ্য যাবো। যাবে? কেন, তুমি আমাকে অবিশ্বাস করছ? একটা হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বললাম, অবিশ্বাস নয় সেলিনা, অশ্রুকণার ওখানে ওই কয়টা দিন আমার জীবনে যে কি পরিবর্তন এনে দিয়েছে তোমাকে বোঝাতে পারবো না। যেমন? আগে বুঝতে পারতাম না আমি কি চাই? এখন কি বোঝ? ভীষণ ভাবে বুঝি? কি চাও তুমি? তোমাকে ছাড়া আমার এক মুহূর্তও চলবে না এ সত্য আমি, ওখানেই আবিস্কার করেছি। না, প্রান্তিক ভাই, কোন সত্যই তুমি আবিস্কার করতে পারনি। অবশ্য তার জন্য তোমাকে দোষ দেওয়া যায় না। আমিও যদি তোমার মতো জটিলতার মুখোমুখি হতাম, আমার অবস্থাও তোমার মত হতো। তুমি আমায় বিশ্বাস করতে পারছে না? কি যে বল প্রান্তিক ভাই! আজ যদি তুমি বল সেলিনা, তোমার সঙ্গে যা করেছি সব অভিনয়! আমার বিশ্বাস করতে কোন কষ্ট হবে না। কেন জান? আমি বললাম কেন? আমার নিজেরও মাঝে মাঝে মনে হয় এই যে মান অভিমান ঈর্ষা ও হিংসা, তোমাকে পাওয়ার জন্য যে আকুলতা সেও কি অভিনয় নয়? যদি অভিনয় না হয় তা হলে কেন বলতে পারিনা প্রান্তিক ভাই, যে দিন প্রথম তোমায় দেখেছিলাম সেদিনই তোমায় ভালবেসেছিলাম। সেলিনা? না প্রান্তিক ভাই ওই ভাবে আমাকে দুর্বল করে দিও না। কারণ আমি জানি, রেহানা সামনে এসে দাঁড়ালে তুমি হারিয়ে যাবে। কেমন করে সেই বাস্তবকে মেনে নেবো? তুমি হয়তো কোন দিন, বলনি, কিন্তু বুঝতে পারি, তোমরা সবাই আমার সম্পর্কে একটা কথা ভাবো, তা হলো আমার বাঁধন থেকে তুমি মুক্তি পাবে না। কি ভাবো না? আমি অবাক হয়ে যাই ওর কথায়? নিজেকে সংযত করে বলি, কে কি ভাবে জানি না সেলিনা, আমি শুধু জানি তোমার বাঁধনেই চাই আমার পূর্ণ মুক্তি। তারপর ওকে বুকের ওপরে টেনে নিয়ে অপলক ওর চোখে চোখ রেখে বলি, আমায় কি তুমি বুঝতে পারনা সেলিনা? পারি। অ হলে এত দ্বিধা কেন? নিজের মুখটা আস্তে নামিয়ে আমার তৃষ্ণাতুর ঠোঁট দুটি রাখতে চাই নিরাপদ আশ্রয়ে। ও আঙুল দিয়ে বাধা সৃষ্টি করে বলে, আজ না। তোমার ভিতরের এ দুর্বলতা আমায় যে কি কষ্ট দিচ্ছে, সে তোমাকে বোঝাতে পারবো না, তবু আজ নয়। আমি ওকে ছেড়ে দিই। বাইরের দরজায় কে যেন নক করে। ও আমার বিছানা থেকে উঠে গিয়ে নিজের বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। মাঝের দরজাটা খোলাই থাকে। দরজাটা খুলেই দেখি প্রতীমবাবু, বললাম আপনি! হ্যাঁ আমি, ভাবলাম ঘুমিয়ে পড়লে কি না। ডিলার দিয়েছে বেশ কিছুক্ষন। সেলিনাকে নিয়ে চলে এসো, দেরি করো না।

প্রতীমবাবুর কথা মতো গাড়ী আসে। ড্রাইভারের নাম আকবর আলী। আমি ও সেলিনা গাড়ীতে গিয়ে বসি। ওকে বলি, আকবর ভাই, তুমি মোসলেমউদ্দীন সাহেবের বাড়ী চেনো? চিনি। কত পথ হবে? তা প্রায় দু আড়াই ঘন্টা লাগবে। তাহলে চল।

চারিদিকে সুবজ শুধু ধান আর ধান। আমি আর সেলিনা। যেন স্বপ্নের ডানায় ভর দিয়ে চলেছি। বার বার মন দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। অথচ কি আশ্চর্য, আমরা চলেছি, রেহানাকে খুঁজতে, সেই রেহানা, যাকে বাদ দিয়ে আমি কোন দিনই ভাবতে পারিনি কিছু। সেলিনার কথা যদি সত্যি হয়, যদি রেহানাকে খুঁজে পাই, ওর সামনে আমি কি ভাবে দাঁড়াবো, কি বলবো ওকে আমি!

সেলিনা বলল কি ভাবছো? ভাবছি আমার অতীত ও বর্তমান। না তুমি তা ভাবছে। তাহলে কি ভাবছি? ভাবছে, রেহানা যদি সামনে এসে দাঁড়ায় কি ভাবে বিদায় দেবে আমাকে, বল সত্যি কি না। ভয় নেই প্রান্তিক ভাই, রেহানাকে খুঁজে পেলে আমি কোন দিন কোন দাবী নিয়ে তোমার কাছে আসবে না। প্রতীমবাবুকে বলব, অদির মতো আমাকেও একটু আশ্রয় দিন। তাতে তুমি মুক্তি পাবে? মুক্তি তো আমি চাই না। তবে? তোমার বুকে আগুন জ্বালাতে চাই প্রান্তিক ভাই আর সেই আগুনের লেলিহান শিখায় পুড়ে ছাড়খাড় হয়ে যেতে চাই। তুমি ভাবছো কি করে রেহানাকে খুঁজে পেলে আমার বুকে তুমি আগুন জ্বালাতে পারবে? তুমিতো জ্বলছে, নতুন করে জ্বালাবার দরকার হবে না। আচ্ছা সেলিনা রেহানাকে তুমি হিংসা কর? রেহানাকে নয়, আমি হিংসা করি তোমাকে! সত্যি আমি বুঝতে পারি না, তোমাদের কাউকে। বুঝতে পারনা কেন? না বোঝার মতো তো আমার কোন আচরণ নয়, রেহানা বা অশ্ৰুদির মতো, দুঃখকে গোপন করতে পারি না আমি। রেহানা তার মনের মণি কোঠায় কি ভাবে তোমাকে জায়গা দিয়েছে বলতে পারব না, কিন্তু আমি কেমন ভাবে তোমাকে পেতে চাই তাতো অস্পষ্ট নয়। আমি রক্ত মাংসের মানুষ, আমার ব্যাথা আছে বেদনা আছে–আর তাকে প্রশমিত করার জন্য আমি কোন অবয়বহীন আদর্শের পিছনে ছুটি না। তাইতো তোমার কাছে আসি আমি বারবার বিচিত্র রূপে। কিন্তু তুমি? যখনি মনে হয়, আর কোন ভয় নেই, আমার বাধন কাটাবারও কোন উপায় নেই, তখনি আবার ভয় হয়, এই বুঝি তুমি হারিয়ে গেলে। এই বুঝি তুমি অশ্ৰুদির হয়ে গেলে, অথবা রেহানার। কেন এমন হয় বলত। বললাম তুমি কি বৈষ্ণব কবির সেই লাইনটা জান? কোনটা। যেখানে কবি বলেছেন দুহ ক্রোরে দুহ কাঁদে বিচ্ছেদ ভাবিয়া অথচ তাদের প্রেম ভাষায় অবর্ণনীয়। তারা নিজেরাও জানে, তাদের মধ্যে বিচ্ছেদ কেউ ঘটাতে পারবে না, তবু ভয় নাই যায়। সেলিনা বলল–

আমারও মনে হয়
পাহাড়ের উচ্চতা স্পর্শ করতে পারে না যে কুটিল হাত
আমার প্রেম পৌঁছিয়ে যায়
পতনের অপেক্ষা না রেখে,
আমি বললাম, তাই যদি বিশ্বাস কর, কেন আঘাত দাও।
আঘাত যদিবা দিই,
বাজে কি সে আঘাত অন্তরে তোমার?
প্রতিধ্বনিত বীণা তন্ত্রীতে
যেসুর ব্যাকুল হয়ে বাজতে চায়
কোন সে অযুহাতে
ফিরিয়ে দাও তাকে।
কেন মায়াবী রাতের
নিঃশব্দ অন্ধকার, তোমার বলিস্ট পেষনে
আলোকিত হয় না?
কেন নির্বাক মুখে
যে ভাষা মুখর হতে চায় বার বার
 কোন সে কুয়াশায় ঢেকে রেখে
তার থেকে মুক্তি পেতে চাও তুমি?
যে কথা উচ্চারিত বহুবার
যে সুরের স্পর্শে প্রলম্বিত ইথার বাতাস
হৃদয় যেখানে কান্নায় উন্মুখ
ভীরু হৃদয় দুয়ারে আঘাত হেনে–
অন্ধ চোখের বোবাগলিতে
কান পেতে শুনেছ
কি উত্তাল সাগর তাব যে গর্জনে ঢেকে দেয়–
মুখর ঊর্মি, সে তরঙ্গ মালায়
ভুল করে কোন দিন যদি আস তুমি
ভীতি হীন মুহূর্তগুলো
যে স্বাক্ষর রেখে যায় আদিম স্পষ্টতায়
অরণ্যের নির্জনতা
সেও কি ভয়ংকর তার থেকে?
কে তোমাকে বেসেছিল ভাল,
জানেনা সেলিনা,
সে কেবলি জানে
প্রথম স্পষ্টতায় যে স্বাক্ষর রেখেছিল একদিন
তোমার হৃদয়ে আজো ভাস্বর – তা,
শুধু তুমি অন্ধ বলে
বার বার হাতড়িয়েছ পথ
খুঁজে পেতে চেয়েছে সে ভুলের ঠিকানা।
জান তুমি ভাল করে
সব কিছু জমা আছে
হৃদয়ের মাঝে,
তবু কেন খোঁজ বার বার।
হে অন্ধ পথিক,
যে পথ চেননা তুমি
জাননা পথের শেষ
তবুও পৌঁছাতে চাও
পথ প্রান্তে যে আছে অপেক্ষা করে।
হায় ভালবাসা, ভীরুমন–
সেলিনারে বুঝলেনা কোনদিন।
শুধু কথার যাদুতে
চেয়েছে যা পেতে
নিজের অন্তর চিরে, দেখেছো কি?
কি চেয়েছো তুমি?
তবু যদি মনে হয়,
আমি ছাড়া সবই অন্ধকার
সকলি শূণ্য, শূণ্য চারিদিক
রিক্ত হস্ত ক্লান্ত বেদনায়
এতদিন যা চেয়েছ সবই ভুল
সত্য শুধু সেলিনার প্রেম।
ধর বন্ধু হাত, তুলে নেও হৃদয়ে তোমার
নামুক তৃষ্ণাতুর ওষ্টদুটি
প্রতিদান হীন।
এইতো এসেছি আমি,
চেয়েছি তোমার কাছে জীবনের দাম,
যে আজ হারিয়ে গেছে
হারতেই জন্ম যার
কেমনে করবে জয়ী, তারে তুমি,
হে অন্ধ পথিক।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *