১৩. কফিটা শেষ হয়

কফিটা শেষ হয় এক সময়। আমার স্বীকারোক্তি কে এড়িয়ে গিয়ে অশ্রুকণা বলে, সেলিনা কে তুমি ভালবাস না? উত্তরে বলি সত্যি কথা কি জান কণা, সেলিনা আমার জীবনে যেমন এক ঝলক মুক্ত হাওয়া, তেমনি কেবলমাত্র সেই আমার জীবনে নিয়ে আসতে পারে প্রচণ্ড ঝড়, যাতে শিকড় সুদ্ধ উপড়ে যেতে পারে আমার, কেন তোমার এরকম মনে হয়। তাতো বলতে পারবো না। শুধু অনুভবে বুঝতে পারি ছায়ার মত তার উপস্থিতি। তাই কখনো কখনো এত দুর্বল হয়ে যাই যে আমার নিজের কাছে নিজেকে অপরাধী বলে মনে হয়।

ও আমার একটা হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বলে প্রান্তিক, অপরাধ তুমি করতে পার না। শুনেছি তপতীদি তোমাকে একদিন ভীষণ ভালবাসতো। রেহানার কথা থাক, হয়তো তার স্তরে নিজেদেব পৌঁছে দেওয়ার ক্ষমতা আমাদের নেই। কিন্তু সেলিনা, সে যে তোমাকে কি পরিমান ভালবাসে তার কল্পনাও তুমি করতে পাববে না। আমাদের বাধন কাটাতে পারলেও তার বাধন তুমি কোনদিন কাটাতে পারবে না। সে হয় তো কোন দিন তোমাকে ভালবাসার কথা বলেনি, হয়তো বলবেও না, কিন্তু অন্যকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে নিক্তিতে ওজন করে নিয়েছে তার ভালবাসার ভার কতো। আজ তোমাকে বলতে কোন দ্বিধা বা লজ্জা নেই, ও আমাদের সকলের ছোট অথচ সবাই আমরা হেরে গেছি ওর কাছে। তোমাকে আমার অনুরোধ, যদি এক মুহূর্তের জন্যও আমাকে ভালবেসে থাক তাহলে সেই ভালবাসার অধিকারে দাবী করছি, যদি সত্যিই রেহানা ছাড়া তোমার জীবন দুঃসহ হয়ে ওঠে, সেলিনাকে গ্রহণ করো, তোমার তপ্তমক হৃদয় একমাত্র ওইভরে দিতে পারে মরুদ্যানে।

আমি অবাক হয়ে বললাম, কশা আজ তোমাকে বলতেই হবে, জীবনে যদি এমন কিছু ঘটে পারবে মেনে নিতে? অশ্রুকণা বলল, আমি রেহানার মতো বড় নই, তাই তোমার মঙ্গল কামনায় সে যেমন হারিয়ে যেতে পারে, আমি তা পারি না। আমি একেবারে সাধারণ মেয়ের মতন একান্ত করে পেতে চাই আমার ইপ্সিতকে। তোমার কথার প্রতিধ্বনি করে বলা যেতে পারে ভাগ আমি চাই না। আমি মরে যাব, সেও ভালো তবু মেনে নিতে পারবো না আর কারো দাবীর অধিকার। তাই অভিমান বা রাগ আমার যাই থাকুক, সে শুধু আমারই থাকুক। আর সেজন্যই কষ্ট হলেও একদিন যেমন রেহানার কাছে হেরে গিয়েও জয়ী হতে চেয়েছিলাম, আজো তেমনি সেলিনার হাতে তোমাকে তুলে দিয়েও জয়ী হতে চাই। অশ্রুকণার আভিজাত্য ব্যর্থতার মধ্যে খুঁজে পাক তার চরম সার্থকতা। শরবে না মন থেকে, তোমার কণার প্রেমিকা সত্তা মুছে দিয়ে শুধু তোমার বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করতে।

কি যে মনে করে ও তাকিয়ে ছিল আমার দিকে, ভাষায় তা ব্যাখ্যা করা যাবে না। মনে হতে লাগলো অশ্রুকণা আমাকে এই চরম পরীক্ষায় ফেলে প্রমাণ করতে চায়, তাকে হারানোর সাধ্য কারো নেই। আমি বললাম, জীবনের স্মৃতি কি মুছে দেওয়া এত সহজ? কি করে ভুলে যাব, প্রথম যে দিন গঙ্গার ঘাটে বিশাল বট গাছের নীচে আমার জন্য বয়ে আনা টিফিন তুমি ফেলে দিয়েছিলে গঙ্গায়। আমার জীবনে রেহানা সেদিন তেমন করে আসেনি। ভুলতে পারব কি ব্যাণ্ডেলে যাবে বলে বাড়ী থেকে বেরিয়েও আমাকে কিছু না বলে তোমার বাড়ীতে ফিরে যাওয়া। কেমন করে ভুলবো রেহানার জন্য নিজে সরে দাঁড়ানো, যে চরম অভিমানে তুমি আমাকে পেতে চেয়েছে, তার কোন মৰ্যাদাই দিতে পারলাম না একথা ভুলবো কি করে? কি করে ভুলবো, আমাকে সকলের থেকে উঁচুতে জায়গা দিতে গিয়ে চিরদিনের জন্য তোমার বাবা-মাকে ছেড়ে আসা। পিরবো কি ভুলে যেতে আমাকে না জানিয়ে তুমি যেতে পারোনা এই তীব্র অভিমানকে। যে জোর সেলিনার আছে বলে তুমি বলছ, সেই জোর তোমার থাকবে না? ম্লান হাসল অশ্রুকণা, যে হাসিতে দুঃখ আনন্দ ব্যথা বেদনা সব কিছু একাকার হয়ে যেন চরম প্রশান্তি নেমে এল। বলল, আমার জোর নেই কে বলেছে? জোরের কথা যদি বল, একদিন নিজেই জানতে পারবে আমার থেকে কারো বেশী জোর নেই, না রেহানারও নেই। যত ভালবাসাই তোমার পরে তার থাকনা কেন, একদিন তোমার মনে হবে জীবনের আনন্দ যজ্ঞে সে তোমাকে ঠকিয়েছে।

আমি প্রতিবাদ করে বললাম, কণা এ তুমি কি বলছ? ও কোন প্রতিবাদ না করে বলল, আমার কথার ভুল ব্যাখ্যা করো না। আমি ওই ভাবে বলিনি। তোমার জীবনে রেহানার অভাব আমি বুঝি। কিন্তু এও বুঝি সে তোমাকে পূর্ণতা দেয়নি, দিয়েছে চরম শূন্যতা আর হাহাকার। হয়তো রেহানা এমন এক জীবন বেছে নিয়েছে, যত মহানই সে জীবন হোক, সে জীবন তোমার জন্য নয় প্রান্তিক। যদি তার সন্ধান পাও কোন দিন সে মহাজীবনের করুণা তোমার ওপর বর্ষিত হতে পারে, কিন্তু তোমার সুখ দুঃখের সাথী হয়ে তোমার আপন ঘরে সে আর ফিরে আসবে না কোন দিন। তুমিও পারবে না নিজেকে তার সামিল করতে, যদি পার, তাহলে মনে করব, আমার ভালবাসা মিথ্যাই শুধু নয়, জীবন সম্পর্কে আমার গোটা ধারণাটাই ভুল।

হয়তো অশ্রুকণা যা বলেছে সে তার বিশ্বাসের কথা। হয়তো রেহানা সম্পর্কে তার মূল্যায়ন মনগড়া। কি করে ভুলে যাবো রেহানার ভালবাসা, তার সেই কথা, প্রান্তিক আমিতো তোমারই। আমি যখন বলেছিলাম, কিন্তু কেউ যদি তোমাকে ছিনিয়ে নেয় আমার কাছ থেকে? বলেছিল রেহানার দেহটাইতো সব নয়, তার মন? সে তো তোমারই প্রান্তিক। আমি জানি, কেউ আমাকে তোমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে পারবে না। আর সেটা ভালো করে জান বলেই এই অকারণ ভয় দেখাচ্ছো আমাকে। সেই রেহানা, আমাকে ছেড়ে অন্য জীবন বেছে নেবে? না অশ্রুকণার একথা মেনে নিতে মন সায় দিচ্ছেনা। ও বলল, কিছু ভাবছো? বললাম, না, শুধু মনে হচ্ছে কি বিচিত্র এই জীবন। সম্রাট সেকেন্দার শার সেই অমর উক্তি কি বিচিত্র এই ভারতভূমি। ও সেদিকে না গিয়ে বলল, তোমাকে কি আমি আঘাত করেছি? আবেগ রুদ্ধ কণ্ঠে বললাম, ভালবাসা যেখানে কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায় আঘাত সেখানে বাজে না। পূর্ণ ঘটে কি শব্দ হয়? তারপর এক সময় বললাম, রাত হয়েছে আমাকে যেতে হবে। জানতে চাইলাম মা কি উঠেছেন? তুমি বোস, আমি দেখছি।

কখন যেন ঘুমিয়ে গেছেন মিনতি সেন। আমি চলে যাব জেনেও ডাকতে মায়া হল ওর। এতক্ষণ শুধু গল্পই করেছে অশ্রুকণা। একবারও জিজ্ঞাসা করেনি, আমি কখন খেয়েছি। এখান থেকে বাড়ী ফিরতে তো অনেক রাত হবে, এতক্ষণ না খেয়ে থাকবে? এক অব্যক্ত ব্যথায় ভিতরটা ডুকরে কেঁদে ওঠে, অশ্রুকণার। ফিরে এসে বলল, পিসি ঘুমাচ্ছেন, আজকের রাতটা তুমি থাকতে পার না।

বললাম ভীষণ লোভ হচ্ছে, আজকের রাতটা তোমার কাছে থাকতে। তারপর ওর একটা হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বললাম, আমার এই ক্ষণিকের দুর্বলতাটুকু ক্ষমা করতে পারবে তো। ও বুঝি ভিতরে ভিতরে এতক্ষণ কাঁদছিল এবার টপটপ করে চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। আমি বললাম ছি কশা! তোমার চোখে জল? আমি মুছে দিতে চাইলে ও বাধা দিয়ে বলল, সামান্য অবাধ্য জলকেও তুমি সহ্য করতে পারছে না। থানা ওটা আপনা আপনি শুকিয়ে যাবে। আমি বললাম তাই থাক। হয়তো তোমার চোখের জল এক সময় শুকিয়ে যাবে, কিন্তু আমার কাছে এ মুহূর্তটুকু যে অমরত্ব পেল তার মূল্যতে কম নয়। মাকে বলল আমি আসছি।

উঠে যখন পড়ছি, ও বলল, ভীষণ লোভটাকে কি অবলীলায় তুমি দমন করতে পারলে, কিন্তু সারারাত আমার কাটবে কি করে সে কথাতো বলে গেলে না? আমি বললাম, শ্রীরাধিকার সেই অভিশাপ তোমার মনে আছে? তাকিয়ে আছে দেখে বললাম আমার পরান যেমতি করিছে তেমতি হউক সে। প্রচণ্ড আঘাতে যেন বুক ভেঙে যাচ্ছে অশ্রুকশার, উঃ বলে চিৎকার করে উঠে অশ্রুকশা। বলল কি নিষ্ঠুর তুমি। আমি বললাম তোমার থেকেও।

মন, না চাইলেও যেতে হবে আমাকে। অশ্রুকণাও জানে ছেড়ে দিতে ইচ্ছে না করলেও ছেড়ে তাকে দিতেই হবে। কত ব্যর্থ প্রেমের ইতিহাস, এই ভাবে পৃথিবীর ইতিহাসে অলিখিত হয়ে বেঁচে আছে কে তার হিসাব রাখে? ভেজানো দরজা খুলে পা রাখলাম বাইরে। ও আবার পিছু ডেকে বলল, প্রান্তিক, শুধু এই একটা রাতের জন্য আমার স্বপ্ন কল্পনাকে তুমি বাস্তবায়িত করতে পার না? আমি ছল ছল চোখে তাকালাম ওর দিকে। বলল, কি যে হচ্ছে আমার বুকের মধ্যে দেখবে একবার? আচমকা তুলে নিল আমার হাত। আমি থর থর করে কেপে উঠলাম। ও আমার হাতটা তার নিজের বুকে রাখতে গিয়েও ছেড়ে দিয়ে বলল, তুমি চলে যাও প্রান্তিক তুমি চলে যাও এরপর হয়তো আমি তোমার কাছে ভীষণ ছোট হয়ে যাব।

আমি তার আবেগকে বুঝতে পারছি। সংক্রামক রোগের মতো তা যে আমাকেও সংক্রামিত করে চলেছে, ওর দুটো হাত নিজের দুহাতের মধ্যে তুলে নিয়ে, দু হাতের করতলে আমার কম্পিত ওষ্টধর নামিয়ে এনে গভীর ভালবাসার চিহ্ন একে দিলাম।

বেরিয়ে যখন আসছি, ও এল পিছু পিছু বলল সেলিনা যদি যেতে চায়, ওকে কিন্তু নিয়ে এসো। আমি অবাক হয়ে বললাম সেলিনা কেন? ও মৃদু হেসে বলল এমুহূর্তে তোমাকে বড্ড দুর্বল লাগছে প্রান্তিক। একা পথ ভুল করতে পার। সেলিনা তোমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে আসবে। অভিমানে বললাম, আমায় তুমি ঠাট্টা করছ? অশ্রুকণা বলল, ছিঃ প্রান্তিক, ওকে না নিয়ে এলে যে সারা জীবন তোমাকে ভুলের খেসারত দিয়ে যেতে হবে। আমার মাথার দিব্যি ওকে তুমি জোর করেই নিয়ে এসো। তারপর বলল আমার লোভর মাত্রাতে জানি, ও যদি আসে, বেশ কয়েকটা দিনের জন্য আমি তোমাকে কাছে পাবো, একি আমার কম লোভ। আচ্ছা বলে আর ফিরে না তাকিয়ে বেরিয়ে এলাম।

অতরাতে ফেরার জন্য নীলাঞ্জনা পিসি বললেন, কেন যে এত রাত কর প্রান্তিক। তোমাকে আগেও বহু বার বলেছি, মিনতির ওখানে যেদিন যাবে, সেদিন রাত হলে একটা ফোন করে দেবে। আসতে হবে না। তোমার তো দেখছি আমাকে গুরুত্ব না দিলেও চলে। আমি এগিয়ে এসে পিসির মুখ চেপে ধরে বললাম, আর কখনো একথা বলবেনা। আমাকে কেন বোঝনা পিসি। তোমাকে বাদ দিলে কি আমার গুরুত্ব? পিসি তবু রেগে গিয়ে বললেন, অনেক গুলো ভালো ভালো বুলি শিখে নিয়েছে তাই দিয়ে চুম্বকের মতো টানো সকলকে। চারিদিকের যা অবস্থা, প্রতিদিন রাজনৈতিক খুন, ছিনতাই রাহাজানি খুন হয়েই চলেছে, ভয় হয় না? অথচ একটা সংবাদ দেওয়ারও প্রয়োজন বলে মনে করো না।

বুঝতে পারছি, যে কোন কারণে পিসি রেগে আছেন। সেলিনা এগিয়ে এসে বলল, কেন রাগ করছ মা। তোমার এখানে কি ভাবে সংবাদ দেবে। আমাদেরই বরং উচিৎ ছিল, মিনতি পিসির বাড়ী ফোন করে জানা প্রান্তিক ভাই কখন আসছে। তাইতো প্রান্তিক ভাই? পিসীর কথা যদিও বা সহ্য করা গেল, কিন্তু সেলিনার কথায় যেন সমস্ত শরীরে আগুনেব। ফোস্কা পড়ল। বহু কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে পিসিকে বললাম, উপায় ছিল না পিসি, হঠাৎ মিনতি সেন অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। আর কালই অশ্রুকণার নতুন জায়গায়। যোগদানের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে করতে একটু রাতই হয়ে গেল। মিনতি সেন কিছুতেই ঘুম থেকে উঠছেন না আর তাকে না বলেও আসতে পারছি না। এই উভয় সংকটে পড়ে শেষ পর্যন্ত অবশ্য না বলেই এসেছি, তুমি চিন্তা করবে। পিসি বললেন তাহলে আমার কথা ভেবেছিলে, এটাই যথেষ্ট প্রান্তিক, তবুও তোমাকে আমার অনুরোধ, মিনতির ওখানে গেলে তোমার আসতে অসুবিধে হতে পারে, তাই একটু জানিয়ে দিয়ে থেকে যাবে। ভবিষ্যতে কোন দিন এতরাত করে বাড়ী ফিরবে না।

পিসি আর কোন কথা না বলে রান্না ঘরে চলে গেলেন। সেলিনা বলল চল প্রান্তিক ভাই খাবে। সকালে পিসি আগে খেয়ে বেরিয়ে যান, সেলিনা যেদিন বেরোয় আমার আগেই বেরিয়ে পড়ে, দুপুরের খাওয়া আমাকে একাই সারতে হয়, কিন্তু রাতে আমরা এক সঙ্গেই খাই। একটা পারিবারিক স্পর্শ লেগে থাকে তাতে।

খেতে খেতে সেলিনা জানতে চাইল, তা হলে তোমাদের ট্রেন কখন প্রান্তিক ভাই। আমি অবাক হয়ে বললাম আমাদের ট্রেন মানে? বাঃ অদিকে তুমি এগিয়ে দিতে যাবে না? না, এখনো সেই অভিমান? তারপর বলল দেখ প্রান্তিক ভাই এত অভিমান কিন্তু ভাল নয়। হঠাৎ বললাম, না আমি যাব না। সেলিনা হেসে ফেলল। পিসি বলল, তুই হাসলি যে, . বাঃ হাসব না। প্রান্তিক ভাইকে যেতেই হবে, ও ভালো করেই জানে ওর না গিয়ে কোন উপায় নেই, তবু বলছে যাব না। হাসব না। পিসি বললেন, তুই সব জেনে বসে আছিস। জানিই তো। প্রান্তিক ভাই যদি শেষ পর্যন্ত রাজী না হতেন, তাহলে কিছুতেই এত রাতে বাড়ী না ফিরে অনেক আগেই ফিরতেন। আমি অবাক হয়ে ভাবি এ মেয়ে কি সবজান্তা। কিন্তু ওর কোন কথার প্রতিবাদ করারও সাহস হল না আমার। নীলাঞ্জনা পিসি বললেন, ও না গেলে তো সেই মিনতিকেই যেতে হতো ও যদি যেতে রাজী হয়ে থাকে তাহলে তো বলব ও ঠিকই করেছে, বাবা-মাকে ছেড়ে ও এসেছে, এখন প্রান্তিক যদি সব ব্যাপারেই ওকে এড়িয়ে চলে তাহলে মেয়েটিই বা দাঁড়ায় কোথায় বল? আর ও যখন রাজী হয়েছে তখন উল্টো পাল্টা কথা বলে তুই আবার ওকে বাধা দিচ্ছিস কেন সেলিনা? যেন আকাশ থেকে পড়েছে, এই ভাবে সেলিনা বলল, আমি বাধা দিচ্ছি? আমি তো আরো প্রান্তিক ভাইকে যেতে বলছি। আমার কথার তুমি এই মানে বুঝলে। থাক আমাকে অত মানে শেখাস না। দেখতে পাচ্ছি, আজকাল প্রান্তিক যাইই করে তুই তার বাঁকা অর্থ করিস। অভিমানে উঠে পড়ে সেলিনা। বেশ আমি কোন কথাই বলব না। এখনতো দেখছি আমার কথারই তুমি বাঁকা অর্থ কর। তারপর এতদিন অদিব সঙ্গে যা ব্যবহার করেছে প্রান্তিক ভাই তুমিতো তার জন্য কিছুই বললে না, আর অশ্ৰুদি যেই মাত্র কান্নাকাটি করে কোন ভাবে প্রান্তিক ভাইকে রাজী করিয়েছে, সেই মাত্র প্রান্তিক ভাই ভাল হয়ে গেল। আর আমি হয়ে গেলাম খারাপ? ঠিক আছে, আমি আর কোন কথাই বলব না, আর থাকবও না তোমাদের কোন কথার মধ্যে।

আমি বললাম সেলিনা বোস, পিসিকে তুমি ভুল বুঝছ কেন? পিসিতে তোমাকে এমন কিছু বলেননি, ও আমার কথায় কোন গুরুত্ব না দিয়ে বলল তোমরা কথা বল, আমার খাওয়া হয়ে গেছে আমি চললাম। সত্যি সত্যি ও চলে গেল।

আগে পিসির ঘরে আলদা বিছানায় ও রাত কাটাতো। ওর পড়াশোনার অসুবিধা হয় বলে পাশের যে ঘরটা এতদিন অব্যবহারে পড়েছিল সেটাই সাজিয়ে গুছিয়ে তাকে দেওয়া হয়েছে। ঘরটা আমার ও পিসির ঘরের মাঝখানে। ও সেই ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। নীলাঞ্জনা ভীষণ অবাক হয়ে গেলেন। উঠে গিয়ে ওকে ডাকলেন কয়েক বার। কিন্তু সেলিনা বলল, আমার ঘুম পাচ্ছে, আমাকে আর বিরক্ত করোনা মা। নীলাঞ্জনা আর অপেক্ষা না করে ফিরে এলেন। বুঝতে পারছি খুবই আঘাত পেয়েছেন নীলাঞ্জনা পিসি। মাতৃত্বের সবটুকু অধিকার তাকে দিয়েও কেন যে এই অভিমান কে জানে? আমি বললাম, ওতো চিরদিনই এই রকম, ও বলছিল বোলুকনা, আমিতো ওর কথায় কিছু মনে করিনা পিসি।

নীলাঞ্জনা বললেন তা ঠিক। তারপর কী ভেবে বললেন, এক কাজ করে প্রান্তিক তুমি ওকেও নিয়ে যাও। এখানে থাকলে কে জানে ওর এই অভিমান কদিনে ভাঙবে? আমারও খুব খারাপ লাগবে। বরং তোমার সাথে গেলে হয়তো আস্তে আস্তে এ অভিমান এক সময় জল হয়ে যাবে। যদি যেতে না চায়? জোর করে নিয়ে যাওনা। আমার বিশ্বাস তুমি জোর করলে ও অমত করবেনা। আচ্ছা কাল সকালেই দেখব। কাল সময় হবে না। আজই রাজী করাও। কি করে করাবো, ও যদি দরজা না খোলে। খুলবে। বললাম যদি খোলেও আমার প্রস্তাবে কি রি-অ্যাক্ট করবে কে জানে?

আমি খেয়ে উঠে পিসির সঙ্গে কিছু প্রয়োজনীয় কথা সেরে, নিজের ঘরে যাওয়ার সময়, ওর দরজায় ঠক্ঠক্ শব্দ করে ডাকলাম ওকে। কিন্তু ও কোন সাড়া দিল না। আমি ওযাতে শুনতে পায় তেমনি ভাবে বললাম, আমি জেগে থাকব। তোমার সঙ্গে আমার ভীষণ জরুরী কথা আছে, একবার এসো লক্ষ্মীটি। তারও কোন প্রতি উত্তর ও দিল না। পিসি বললেন, তুমি নিজের ঘরে যাও প্রান্তিক। ওকেতো বললেই, ওর সঙ্গে তোমার কথা আছে, যদি ওর প্রয়োজন থাকে ও যাবে তোমার কাছে, না হলে আর কি করা যাবে। নীলাঞ্জনা পিসিও খানিকটা বিরক্ত হয়ে নিজের ঘরে গিয়ে দরজায় খিল তুলে দিলেন।

রাত ক্রমান্বয়ে গম্ভীর হয়ে এসেছে ও আসতে পারে, এই আশায় আলো জ্বালিয়ে শুয়ে আছি। মুহূর্তের পর মুহূর্ত অতিবাহিত হয়ে যায়। গভীর ঘুম নেমে আসে চোখে, ও তবু আসে না। তারপর বাত কত হবে জানিনা ঝড়ের মতো ঘরে এসে ঢোকে সেলিনা। ওই রাতেও সেজেছে পরিপাটি করে। চোখে দিয়েছে সুর্মা, সুন্দর এলো খোঁপায় বেঁধেছে চুল, গলায় একটা সকচেন চিকচিক্ করছে ঘাড়ের কাছে, কপালে সবুজ টিপ দুই ভুর মাঝখানে। ধূসর রঙের শাড়ী পরেছে রাতের অন্ধকারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে। চোখে অদম্য কৌতূহলের দুষ্টুমি। অপূর্ব লাগছে ওকে। মুখ দিয়ে বেরিয়ে যেতে চেয়েছিল বা খুব সুন্দর লাগছে তো তোমাকে, কিন্তু সে যে তার এক রাতে কি সুর বেঁধেছে কে জানে? তাই কিছুই না বলে বললাম তুমি? কেমন লাগছে বললে নাতো। আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল–

হারিয়ে যাওয়া মুখর রাতে
তোমায় আমি চেয়েছিলাম,
আসলে নাতো সেদিন প্রিয়া
তবু তোমায় পেয়েছিলাম,
ধূসর বাতের অন্ধকারে,
স্বপ্ন ভেলায় সওয়ার হয়ে
তোমায় যখন ছুঁয়েছিলাম,
আকাশ ভরা তারার রাতে,
হঠাৎ কখন মিলিয়ে গেলে
আবার যদি আসলে ফিরে
চোখের তারায় আগুন জ্বেলে,
কোন সে ফাগুন জ্বালাতে চাও?
একটু খানি তাকিয়ে দেখ,
তপ্ত হৃদয় মরুর রাতে
আঁচল হাওয়ার দুষ্টুমিতে
অভিমানের কি দাম পাও।

জড়তাহীন লাইনগুলো কেমন করে যে হৃদয় আবেগকে ঝরিয়ে দিতে পেরেছিল বুঝতে পারিনি, বুঝতে পারলাম ও যখন বলল

অভিমানের হৃদয় মাঝে
দেখতে তুমি পাও কি আমায়?
কেমন করে আসি আমি
সেতো তোমার জমার খাতায়
না মেলা এক অংক, তুমি
মেলাতে চাও বারংবার,
ভাবতে তুমি পেরেছে কি
এই এসেছি আবার যখন
হারানো মন খুঁজে পেতে
সুর বেধেছি এক তারাতে
চিনতে তুমি পারবে কিগো
সেই সুরেরই ঐক্যতান।

দুহাতে ওকে কাছে টেনে নিয়ে বললাম, না সেলিনা পারবো না, পারতে আমি চাইও না, কেন পারবো? কিসের জন্য পিরবো? যে সুরের ঐক্যতান নিয়ে আজ তুমি এসে দাঁড়িয়েছে আমার দুয়ারে, নিঃশব্দ রাতের ক্ষণিক উষ্ণতায় লুণ্ঠন করে তাকে খান খান করে দিতে চাই না। তারপর বললাম জানতে চাইছিলেনা, কেমন লাগছে আমাকে? বললে নাতো! আনত চোখ দুটি নামিয়ে তাকিয়ে আছে মাটির দিকে। আবেগে থর থর করছে তার সমস্ত দেহ বরী। এত দুর্বলতো কোন দিন মনে হয়নি সেলিনাকে। মায়া হল, মনে হল যে সুরের ঐক্যতান নিয়ে ও এসে দাঁড়িয়েছে আমার দ্বারে, আমার গোপনতার অন্ধকারে তাকে একাকার করে দিই। কিন্তু পারলাম না, এবারও হেরে গেলাম ওর কাছে। ও বলল, আর এগিয়োনা প্রান্তিক ভাই, মধ্য রাতের এ স্মৃতি নিয়ে কেমন করে এগিয়ে দেবে তুমি কাল অদিকে। তার চেয়ে তুমি ফিরে এসো, আমি তোমার অপেক্ষায় থাকবো।

ও আমার কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল। বললাম সেলিনা। বল কাল তুমি যাবে আমার সাথে? কোথায়? অশ্রুকণাকে এগিয়ে দিতে তুমিও চল আমার সাথে। এতক্ষণ বুঝি এই কথাই ভাবছিলে? এটা আমার উত্তর নয়। ও বলল, আমাকে সঙ্গে নিলে সব ছন্দ হারিয়ে যাবে তোমার। কেন? আমিতো শান্ত সরোবর নই, আমি উত্তাল সমুদ্র, ঢেউয়ের তালে তালে তুমি যদি নিজেকে ভাসিয়ে রাখতে ব্যর্থ হও, সেতো আমারই ব্যর্থতা। তার চেয়ে তুমি একাই যাও। আমি চোখ তুলে তাকালাম ওর দিকে, ও বলল, তাছাড়া অদির তোমাকে একা পাওয়া ভীষণ প্রয়োজন। আমি মৃদু হেসে বললাম হয়তো প্রয়োজন তার থাকতে পারে, কিন্তু প্রয়োজনে সঙ্গ দিতে গিয়ে যদি পথ হারিয়ে ফেলি? চোখে সেই অব্যর্থ দুষ্টুমি মাখা হাসি। ভয় নেই, আমার অশরীরী কায়া তোমায় পথ দেখিয়ে নিয়ে আসবে। তবু তুমি যাবে না? কেন পাগলামী করছ। এবার ঘুমাওতো বলে ও চলে গেল। কিন্তু কি যে দিয়ে গেল, কেমন করে মেলাই তার হিসাব?

জানি অংকের হিসাবের সঙ্গে জীবনের হিসাব মেলে না। মিনতি সেন সরাসরি অকশাকে নিয়ে হাওড়াতে চলে যাবেন। আমি যাব এখান থেকে ৮ টায় ট্রেন। সুতরাং আমাকে ৭টা থেকে ৭.১৫ মি. মধ্যে বেরোতেই হবে। সকালে উঠে প্রস্তুতও হয়েছি। সেলিনাও যথা সম্ভব সাহায্য করেছে। নীলাঞ্জনা বললেন, সেলিনা, মা তুইও যা, কয়েকদিন থেকে আয় অশ্রুদের সাথে, ওর ও ভাল লাগবে, তোরও ভাল লাগবে। সেলিনা বলল কেন যে বিরক্ত কর মা, বারবার এক কথা বলে, একদম আমার ভালো লাগে না, বলে নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। যাওয়ার সময় হয়ে গেছে আর দেরি করলে ট্রেন মিস্ করতে পারি। ওর দরজার কাছে গিয়ে বললাম, সেলিনা আসছি, তারপরে কণ্ঠে আবেগ ঝরিয়ে বললাম ঠিক আছে তোমাকে যেতে হবে না, তাই বলে যাওয়ার সময়ও তুমি দরজা বন্ধ করে থাকবে? কণ্ঠে বুঝি আবেগের সঙ্গে মিশেছিল বিষণ্ণতার ছোঁয়া। কোন উত্তর নেই ভেতর থেকে। পিসিকে প্রণাম করে আমি ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে পড়ছি, হঠাৎ দরজা খুলে বেরিয়ে এল সেলিনা, ঠিক যে পোষাকে ও কাল রাতে এসেছিল আমার কাছে। শুধু খোঁপাটা এলো নয়, চুল সুন্দর বেনী করে বাঁধা। কাঁধে শান্তিপুরী ঝোলা ব্যাগ। বেরিয়ে এসে বলল চল প্রান্তিক ভাই। আমি অবাক হয়ে বললাম কোথায়? ওর কণ্ঠে সেই চাপল্য, বলল। নিজের স্বার্থটাতো ভাবতে হবে, তোমাদের অবাধ্য হয়ে নিজের স্বার্থ বাঁচাব কি করে? দেখতে পাচ্ছি নীলাঞ্জনার চোখ দুটি আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। বললেন, সেই যখন যাবিই ঠিক করলি, কিছু না খেয়ে বেরোবি। দাঁড়া একটা মিষ্টি আর এক গ্লাস জল খেয়ে যা। বাধ্য মেয়ের মত তাই খেয়ে নিয়ে, আমাকে বলল, গাড়ীতে উঠে কিন্তু খাওয়াবে প্রান্তিক ভাই। পেটে অত খিদে নিয়ে আমি কিন্তু এতটা পথ যেতে পারবো না। বললাম আচ্ছা। রাস্তায় নেমেও আবার দ্রুত ফিরে এল ও ঘরে। আশঙ্কায় বুক কেঁপে উঠলো। কি জানি, আবার মত পরিবর্তন করবে কি না। কিন্তু না, ও এসে নীলাঞ্জনাকে প্রণাম করে বলল, চিন্তা করো না মা, আমি যত জেদীই হইনা কেন তোমাদের অবাধ্য হব না, বলে নীলাঞ্জনাকে কিছু বলার অবকাশ না দিয়েই আবার দ্রুত ফিরে এল। একটা চলন্ত ট্যাক্সিকে হাত দিয়ে থামিয়ে উঠে পড়লাম। বসলাম পাশাপাশি, ট্যাক্সি চলতে আরম্ভ করলে বললাম, কাল থেকে বলছি চল আমার সাথে, পিসি বলেছে, তবু এত উৎকণ্ঠায় রাখলে কেন? ও শুধু হাসল। হাসলে যে। না এমনি। শুধু এমনি, না অন্য কিছু ভা ছিলে? ও আস্তে আস্তে আমার একটা হাত ওর হাতের মধ্যে নিয়ে বলল, কি জানি কেন ভীষণ ভয় করছে, কেন যে বুকটা এমন করে খাঁ খাঁ করছে, কিছুতেই বুঝতে পারছি না। তারপর বলল এই সব অশুভ চিন্তাকে সরিয়ে রাখতে প্রাণপনে যুদ্ধ করবার চেষ্টা করেছি কিন্তু পারলাম না তোমাকে একা ছেড়ে দিতে, যদি অন্যায় করে থাকি, ক্ষমা করে দিও। তারপর বলল, আমার মনের মধ্যে যে কী হচ্ছে সে কেবল আমি জানি তোমাকে তা বোঝাতে পারবো না।

একোন সেলিনা! যতই দেখছি ততই যেন অবাক হয়ে যাচ্ছি। এই রোদ তো এই বৃষ্টি, এই মরুভূমি তো পরক্ষনেই সাগরের উচ্ছল তরঙ্গ। কিছুতেই ওর মনের কিনারা খুঁজে পাচ্ছিনা। বললাম, তাহলে শুধু জিততেই পার না মাঝে মাঝে হারতেও জান, তাইনা? ও আমার হাতটা ছেড়ে দিয়ে বলল, হার জিতের মানে জান? বোঝ কাকে বলে হারা আর কাকে বলে জেতা? সেই পুরোনো সেলিনার মেজাজ যেন। বললাম, না জানিনা। কিন্তু ওখানেই না থেমে বললাম, বক্সিং-ই তোমার আসল জায়গা, যেখানে হার জিতই শেষ কথা। তাই বলে ভালবাসার অভাব হয় না কোন দিন। ও বলল থাম? অনেক বড় বড় কথা বলছ প্রান্তিক ভাই। কতটুকু জান তুমি এই বক্সিং জগতের? জান ব্যর্থ যে হয় তার জন্য কাঁদে কত লোক? শুধু কথার মায়াজালে নিজের সত্যকে আড়াল করতে চাইছে। চাইছে না আমি তোমার সাথে যাই এইতো। তারপর বলল, নামিয়ে দাও আমাকে। যাবনা আমি তোমাদের সাথে? বললেই তো পারতে একথা, না ক্ষণিকের দুর্বলতায় ভুলে গিয়েছিলে সবকিছু। তোমার জীবন তোমারই, সেখানে রেহানা আসবে না অশ্রুকণা আসবে, সে অংকের হিসাব মেলাবে তুমি, কেন অকারণ আমায় জ্বালাতন কর। তারপর আমাকে কোন সময় না দিয়ে নিজেই আদেশ করল ড্রাইভার, গাড়ী রোখ।

এই প্রথম রেগে গেলাম আমি। ড্রাইভারকে বললাম, কারো কোন কথা শুনতে হবে না। ট্রেনটা মিস্ না করতে হয় তার জন্য একটু তাড়াতাড়ি চালাও ভাই। তারপর সেলিনাকে বললাম, দেখ সেলিনা, সকলের সহ্যের একটা সীমা আছে আর আছে হেয়ালিরও, নিজেকে তুমি যতবড়ই মনে করো না কেন, তোমার মূল্য কতটুকু তা তুমি ভাল ভাবেই জান। কোন কিছুকে সোজাসুজি পেতে শেখো। ভালবাসলেও সোজাসুজি ভালবাস। ঘৃণা করলেও তা সোজাসুজি করো। আর একটা কথা জেনে রাখ জীবনটা তোমার হতে পারে, কিন্তু যতক্ষণ তুমি আমাদের অস্বীকার করে বেরিয়ে না যাচ্ছে ততক্ষণ তোমার খেয়ালটাই একমাত্র সত্য হতে পারে না। বলেছিলে অপমান করতে করতে আমায় নাকি অপমানের নেশায় পেয়েছে। তুমি কি করছ? কে দিয়েছে প্রত্যেককে এত অপমান করার অধিকার? আমার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসতে চাইলো। থেমে গেলাম। কিন্তু প্রচণ্ড রেগে যে গেছি তা বুঝতে পারার জন্য তৃপ্তিও পাই। কিন্তু আমার রাগ জ্বালাকে কোন গুরুত্বই না দিয়ে খিলখিল করে হেসে উঠলো সেলিনা। উত্তেজিত হয়ে বললাম, হাসলে যে। এবার শান্ত সরোবরের মতন স্থির যেন ও। বলল, তোমার ভিতরের এই পৌরুষটাকেই দেখতে চেয়েছিলাম প্রান্তিক ভাই, তোমাকে দুর্বল ভাবতে এত কষ্ট হচ্ছিল যে, শুধু ভাবছিলাম, যারা তোমার উপর নিজেদের ভাগ্যকে সঁপে দিতে চায়, তাদের বুক আগলে বাঁচাবার কোন ক্ষমতা তোমার আছে কি না।

একই নারীর কি বিচিত্র রূপ। ঠিকই বলেছিল কাল রাতে ও, আমিতো কেবল শান্ত সরোরব নই আমি উত্তাল সমুদ্র। নিজের সম্পর্কে তার এই মূল্যায়ন আমার মনে হয় ১০০ ভাগ খাঁটি। জিজ্ঞাসা করার সময় হলো না, তোমার কথা অনুসারে যারা আমার উপরে নির্ভর করতে চায় তাদের আগলে রাখার ক্ষমতা আমার আছে কি না, তারা কারা। তার আগেই গাড়ীটা ঢুকে গেল স্টেশনের ভিতরে।

প্লাটফর্মে গাড়ী দেয়নি তখন, হয়তো এখনি দেবে। দেখতে পেলাম একটি কফি স্টলে দাঁড়িয়ে আছেন মিনতি সেন ও অশ্রুকণা। তারা এদিকে ওদিক তাকাচ্ছেন, আমরা এসেছি কি না তাই হয়তো খুঁজে দেখছেন, সেলিনা এগিয়ে এসে অশ্রুকণার হাত ধরে বলল, অশ্ৰুদি লোভ সামলাতে পারলাম না, তাই চলে এলাম তোমাকে তোমার নতুন জায়গায় শুধু পৌঁছিয়ে দিতে নয়, কটাদিন থাকার বায়নাও নিয়ে এসেছি তাড়িয়ে দেবে নাতো।

এতো সেই পরিচিত সেলিনা। তোমাকে তাড়িয়ে দেব বলেই কি প্রান্তিককে অত করে বলেছিলাম আসতে না চাইলেও জোর করে নিয়ে আসবে। সেলিনা তাকালে আমার দিকে, অসম্ভব দুষ্টুমি ভরা দুটি চোখ। বলল, কই প্রান্তিক ভাই একবারও তো বললে না সে কথা। শুধু তুমি কিছু মনে কর কি না, তাইতো এত না আসার বায়না ধরেছিলাম। কিন্তু তোমার ছাড় পত্র নিয়েও এই গোপনতার মানে কি?

কি উত্তর দেব এর, তবু কিছু না বললে অশ্রুকণা ভুল বুঝতে পারে, তাই বললাম, তুমিই বলতো সেলিনা, সে সুযোগ কি তুমি দিয়েছো? কাল থেকে আজ পর্যন্ত যা তুমি করেছে তাতে বলার সুযোগটা পেলাম কখন? হয় তো সত্যি। সেলিনা যে তা বোঝে না তাও নয়, তবু সে সেলিনা, যে কখনো হারতে জানে না। বলল পিসি তোমার ছেলেকে আমার পিছনে লাগতে না করে দাও, নিজে হাজারটা দোষ করবে আর অপরকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে এটা ঠিক নয়, এটা অন্যায়। মিনতি সেন ওকে কাছে টেনে নিয়ে বললেন হারে সেলিনা, ওখানে গিয়েও কি এমনি করে ঝগড়া করবি নাকি তোরা। এই দেখ পিসি, নিজের ছেলের অন্যায়টাকে কি কৌশলেই না তুমি আড়াল করতে চাইছে। হেসে ফেলেন মিনতি সেন, বললেন, এতো সব মায়েরই ধর্ম। তোর মা তোকে আড়াল করে না? করেন তো, আবার বকেনও। অবাক হয়ে মিনতি সেন বললেন, নীলাঞ্জনা তোকে বকেছে কোনদিন? হা বকেছো তো। এমন ভাবে বকেছে যে কাল রাতে খাওয়ার টেবিল থেকে উঠে গিয়ে সারারাত না খেয়ে রয়েছি। এখন মনে হচ্ছে দূর আমি কি বোকা। রাগারাগি করে না খেয়ে থাকার কোন মানে হয় নাকি। এখন খিদের কষ্টটাতো আর মাকে পেতে হচ্ছে না। আমাকেই ভুগতে হচ্ছে। তা পিসি যা হোক কিছু খাওয়াও তো আগে, তারপর কথা হবে।

আচ্ছা খাওয়াচ্ছি, বল কি খাবি? কি করে জানব তোমাদের কাছে কি আছে? আর এই সময় হুট হুট করে ট্রেনটা প্লাটফরমে ঢুকে গেল। মাইকে, ঘোষনা করা হচ্ছে ১৫ নং প্লাটফর্মের গাড়ী নির্দিষ্ট সময়েই ছাড়বে। হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি আর মাত্র ৫ মিনিট সময় বাকী আছে। অশ্রুকণা বলল ট্রেনে গিয়েই খাওয়া যাবে সেলিনা, আমারও খিদে পেয়েছে। তোমার মত কাল রাতে আমারও খাওয়া হয়নি। সেলিনা অবাক হয়ে বলল, কেন, তোমার খাওয়া হয়নি কেন? ঐ তোমারই মত। কি রকম? প্রান্তিক অতরাতে না খেয়ে চলে এল, পিসিকেও তাই আর বললাম না, ডাকলামও না, এই সবের জন্য আর কি? ওঃ এখানেও তাহলে সেই প্রান্তিক ভাই। তা হলে বুঝতে পারছ পিসি মা হয়ে ছেলেকে কেমন করে আড়াল করছো? তারপর বলল, তোমার ছেলে যদি না খেয়ে আসে, তোমার সঙ্গে দেখা না করে আসে তার জন্য তোমার নিজের ছেলেকেই বকা উচিত অশ্ৰুদিকে বকা কেন? ওকি করবে? ও কি বলেছে, তুমি খেয়োনা, মায়ের সাথে তোমার কথা বলার দরকার নেই। ওর কথা শুনে মিটি মিটি হাসছেন মিনতি সেন, সেলিনাকে বললেন, তোর অভিযোগ যথেষ্ট গুরুতর, আর ওখানে যে কয়দিন থাকবি, সব অন্যায় গুলো খাতায় লিখে রাখবি, তার পর ফিরে এসে আমাকে জানাবি, দেখবি কিরকম শাস্তি দিই। তুই কি ভেবেছিস মা হয়ে ওকে ক্ষমা করব? মোটেই নয়। মনে থাকবে তো। মনে থাকবেনা মানে, সাক্ষী নেই? সেলিনা বলল যার বিরুদ্ধে অভিযোগ তাকেই সাক্ষী মানতে হবে নাকি? তাহলে কাকে মানবি? অশ্রুতো থাকবেনা। ও বলল তোমাকেই মানবব। মিনতি সেন একটি ছোট্ট শিশুর মতো সেলিনাকে বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে বললেন আচ্ছা তাই মানিস। তারপর দ্রুত গাড়ী থেকে নামতেই গাড়ী ছেড়ে দিল।

মেদিনীপুরের এক আধা মফসল শহরের প্রান্ত ঘেঁষা আদিবাসী, তপশিলী ও অনুন্নত শ্রেণীর মানুষের ছেলেমেয়েদের জন্য স্কুল। স্কুলটা খানিকটা মিশনারী ধাঁচের হলেও মিশনারী নয়। ব্যয়ভার বহন করে প্রতীম বাবুদের কোম্পানী। ম্যানেজমেন্ট ওখানে যে সমস্ত শিক্ষয়িত্রীরা থাকতে চান তাদের জন্য যেমন হোষ্টেল এর এ্যারেঞ্জমেন্ট করেছেন, তেমনি যারা থাকতে চান না, তাবা যাতে সময় মত স্কুলে আসতে পারেন তার জন্য গ্রাম্য যান বাহনের বন্দোবস্ত রেখেছেন, এমন কি স্কুলের সকল শিক্ষাথী, তাদের জন্য আলাদা কোয়ার্টারের ব্যবস্থা রেখেছেন, সে সমস্ত কোয়ার্টারের বিদ্যুৎ থেকে জ্বালানী পৰ্যন্ত সবকিছুই বিনামূল্যে সরবরাহ করা হয়। সপ্তাহে ৪ দিন হয় পঠন পাঠন, আর ২ দিন হাতে কলমে কাজ শেখানো হয়। অঞ্চলটা কৃষি প্রধান, তাই এখানকার ছেলেমেয়েরা যাতে কৃষি কাজটা বিজ্ঞান ভিত্তিক করতে পারে তার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। শহর এখান থেকে অনেক দুরে। তাই এখানকার ছেলেমেয়েদের জন্য মাসে একদিন শিক্ষা মূলক যাত্রা থিয়েটার ইত্যাদির ব্যবস্থা রেখেছেন। ম্যানেজমেন্ট বিশ্বাস করে, এই সমস্ত খেটে খাওয়া মানুষদের মধ্যে শিক্ষার আলো পৌঁছে দিতে হলে তাদের ভাষায় তাদের মতো করেই বোঝাতে হবে। আমরা যখন এখানে এসে পৌঁছালাম, তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। কিন্তু ম্যানেজমেন্ট আগের থেকেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন যাতে কোন অসুবিধা না হয়। মেদিনীপুর শহর থেকে সারাদিনে একটি মাত্র বাস যাতায়াত করে। আর সেই বাস স্টপেজ থেকেও এখানকার দূরত্ব কমবেশী ২০ কি.মি., হয় সাইকেলে, না হয় ভ্যান রিক্সা অথবা হাঁটা ছাড়া যাওয়ার কোন বিকল্প উপায় নেই। মটর গাড়ী যাওয়ার কোন রাস্তা নেই, তবে সাইকেল বা ভ্যান রিক্সা যাওয়ার রাস্তা সরু হলেও পরিচ্ছন্ন।

আমাদের যিনি নিতে এসেছিলেন, তিনি সত্যভূষণ দোসাদ। ভদ্র শিক্ষিত এবং মার্জিত এক যুবক। আমরা নামতে তিনি নমস্কার করে আমাদের সামনে এসে দাঁড়ালেন। নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন, আমি আপনাদের নিতে এসেছি।

রাস্তা দিয়ে চলছি। চারপাশের হত দরিদ্র মানুষগুলিকে দেখে কান্না আসার মত অবস্থা। এত দীর্ঘ পথে কোথাও একটা ভালবাড়ী চোখে পড়লনা। জামা গায়ে আছে এমন মানুষজনের সংখ্যাও খুব কম। সত্যভূষণ বাবু আমাদের উদ্দেশ্য করে বললেন,এখানকার মানুষজন খুবই গরীব, কিন্তু তাই বলে আপনারা শহরের মানুষেরা এই সব গরীব মানুষদের যে চোখে দেখেন এরা কিন্তু তা নয়, এদের আত্মমর্যদা সীমাহীন। এরা চুরি করে না, না খেয়ে থাকলেও ভিক্ষা করে না। বরং শহর থেকে যারা এখানে আসেন, তাদের যাতে কোন কষ্ট না হয় সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখেন, অথছ মজার ব্যাপার কি জানেন, শহরের মানুষ এদের কখনো মানুষ বলেই ভাবে না। হোট বড় সকলকেই তুচ্ছার্থে তুই তোকারি করেন। সামান্য ভদ্রতা করে তুমি পর্যন্তও বলেন না। অথচ এরা কিন্তু কোন কিছুই তেমন একটা গায়ে মাখে না। তার বিশ্বাস, ঈশ্বরই এই ব্যবধান যখন রচনা করেছেন তখন আর তাদের প্রতিবাদ কবে কি লাভ? সেলিনা ও অশ্রুকণা কোন কথারই কোন উত্তর না করে চুপ করে শুনে যায় মিঃ দোসাদের বক্তব্য। আমি বললাম, সত্যভূষণ বাবু, আপনিতো এদেরই একজন। উনি বললেন হ্যাঁ। আপনি নন? আমি চমকে উঠলাম, সত্যভুষণ বাবু যে এমন চোখা প্রতি উত্তরে আমার হৃদয়কে নাড়া দিয়ে যেতে পারেন তা ভাবনার অতীত ছিল।বললাম, নিশ্চয়ই। আমি অবশ্যই এদেরও একজন, যেহেতু এরা মনুষ্য সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন নন। কিন্তু আপনাকেই আমার জিজ্ঞাস্য আমার মনে হয় আপনি যথেষ্ট শিক্ষিত। উনি কথার মাঝখানে আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, শিক্ষিত বলতে আপনি কি বোঝাতে চাইছেন জানিনা।যদি একাডেমিক কোয়ালিফিকেসানকে আপনি শিক্ষিতের মানদণ্ড হিসাবে বিচার করেন তাহলে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমি গত বছর ইংরেজীতে প্রথম শ্রেণীর এম.এ করেছি। অবশ্য এটাকে আমি কোন পবিচয় বলে মনে করিনা। কারণ একটু অনুকূল পরিবেশ আর আর্থিক স্বচ্ছলতা থাকলে যেকোন মানুষই আমার মত বেশ কয়েকটি বিষয় নিয়ে এমএ করতে পারেন। কারো নামের পাশে এক গাদা ডিগ্রী দিয়ে আমি তার মূল্যায়ন করিনা। সামান্য থেমে বললেন আমি মানুষকে বিচার করি তার হৃদয়ের সংবদেনশীলতা দিয়ে। মানুষকে আপন করে নেওয়াব ক্ষমতা কতটুকু আছে তাই দিয়ে তাকে আমি পরিমাপ করি। তারপর সুন্দর হেসে বললেন, থাক না ও সব কথা। আপনারা আজ প্রথম এসেছেন আর আসার সময় এই অখ্যাত অজ্ঞাত কুলশীল মানুষগুলোকে দেখতে দেখতে এসেছেন। ভয় পেয়ে যেতে পারেন, সেই আশঙ্কাতেই এত কথা বলা। কিন্তু ওরা যে ভয়েব বস্তু নয়, এটাই শুধু জানিয়ে দিতে চেয়েছি। আমার বাচালতাকে ক্ষমা করবেন।

সন্ধ্যার পরে আমরা যখন এখানে এসে পৌঁছালাম মন প্রশান্তিতে ভরে গেল। বিরাট স্কুল কমপাউন্ড। পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। অজস্র জানা অজানা গাছ-গাছালি আর কোয়ার্টারের সামনে সুন্দর ফুলের বাগান। প্রত্যেকটা কোয়ার্টার একতলা, মেঝে পাকা, কিন্তু ছাদ টালির। এক একটা কোয়ার্টার থেকে আরেকটা কোয়ার্টারের দূরত্ব বেশ খানিকটা এবং কাটাতারের বাউন্ডারি দিয়ে তা আলাদা করা। সেলিনা বলল, প্রান্তিক ভাই কি অপূর্ব জায়গাটা তাই না? তারপর অশ্রুকণাকে বলল, অশ্ৰুদি তোমার ভাগ্যটা সত্যিই হিংসা করার মত। সত্যভূষণ বাবু বললেন, আপনাকে ঠিক চিনতে পারলাম না, তবে একথা আপনি ঠিকই বলেছেন জায়গাটা অপূর্ব। মানুষগুলো আরো অপূর্ব, শুধু যদি তাদের অনাড়ম্বর সাধারণ জীবন যাত্রাকে মেনে নিতে পারেন। আরেকটা কথা ভয় পাবেন না। এমনিতে এখানে কোন ভয় নেই, তবু ম্যানেজমেন্ট এই গোটা বাউন্ডারির বাইরে পাহারা দেওয়ার জন্য রক্ষী মোতায়েন রেখেছেন। নামেই তারা রক্ষী, আসলে তারা এই অঞ্চলের খেটে খাওয়া মানুষের দল। তাদের কাছে এই স্কুলটা দেব মন্দিরের মতন পবিত্র, তাই তারা নিজেদের গরজেই সারারাত ধরে পাহারা দেন কেউ যাতে এই মন্দিরের পবিত্রতা নষ্ট করতে না পারেন। ম্যানেজমেন্ট তাদের জন্য যা ব্যয় করেন, তা তারা কেউই হাতে নেননা, এই স্কুলকেই দান করে দেন। অশ্রুকণা এই প্রথম বলল, আশ্চর্য তো। হ্যাঁ সত্যিই আশ্চর্য! তারপর বললেন, থাকতে থাকতে যদি এদের ভালো লেগে যায় তাহলে দেখবেন আরো অনেক ব্যাপারে আশ্চর্য হয়ে যাবেন। আমি বললাম, তা হলে কি আপনি বলতে চাইছেন এখানে চোব, গুডা, বদমায়েস এ সব নেই? নেই কেন হবে? আছে। তবে আপনাদের শহরের মতো তারা মাথা উঁচু করে চলে না। তারা এই সমাজ জীবনের বাইরেই থাকে। গ্রাম্য নেতৃত্ব তাদের সাধ্যমত বাইরে রাখার চেষ্টা করেন। তবে যে আপনি বললেন, এখানে কোন চোর-গুভা নেই। আমি সেই ভাবে বলিনি, আসলে আপনারা শহরের ভদ্রলোকেরা যেমন ভাবেন, গ্রামের গরীব মানুষ মানেই হয় গুন্ডা না হয় চোর আমি তার প্রতিবাদ করেছি মাত্র। আপনার এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্ক। উত্তরে মিঃ দোসাদ বললেন সেই অর্থে আমি প্রতিষ্ঠানের কেউ নই। প্রতীমবাবু একদিন আমাকে ডেকে বললেন, তোমার ভবিষ্যৎ নষ্ট হয়ে যাক আমি চাইনা, তবু যদি গ্রামকে ভালবেসে গ্রামেই থাকবে বলে মনস্থ কর তাহলে, এই প্রতিষ্ঠানের ভালো-মন্দের দায়িত্ব গ্রহণ কর না। তা ছাড়া আমি এই স্কুলেরই ছাত্র। তাইতো তার অনুরোধকে ফেলতে পারলাম না, এই আর কি। সরকারি ভাবে আমি কেউ নই, শুধু ভালবাসার টানে থেকে গেছি। অবাক হয়ে শুনছে অশ্রুকণা ওর কথা। বুঝতে পারছি ওকে আমাদের সবার ভাল লেগে গেছে। উনি বললেন, আজ আর হবে না অশ্রুদেবী, তবে কাল থেকে এখানকার একটি মেয়ে আপনার সংসারের যাবতীয় কাজ করে দেবে। ওকে বেতন দেওয়ার দায়িত্ব অবশ্য ম্যানেজমেন্টের। তাকে ভাল লাগলে আপনাকে শুধু সুপারিশ করতে হবে। অবশেষে বললেন আসি তাহলে নমস্কার। রান্না ঘরে সবই আছে এখানে রান্না কয়লায় করতে হবে। বাসন পত্র রান্নার সবই আছে। এবেলার মত তরিতরকারী, ডিম, ডাল রাখা আছে। ম্যানেজমেন্টের বাজার সরকাব কাল সকালে আসবেন, এখানকার স্টোর থেকে তিনিই সব পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করবেন। মাসের শেষে আপনার বেতন থেকে কেটে নেওয়া হবে। এটাই এখানকার নিয়ম। অবশ্য আপনি ইচ্ছে করলে বাজারটা নিজেও করতে পারেন। পারবেন কিনা বলতে পারবো না কারণ, কাছাকাছি কোন বাজার নেই। আসি তাহলে। উনি বেরোতে গিয়েও আবার ফিরে এসে বললেন। এই দেখুন সবই বললাম, কিন্তু চাবি দিতে ভুলে যাচ্ছিলাম। এই ধরুন চাবি। চা-কফি-বিস্কুট, গুড়ো দুধ সবই আছে ষ্টোর রুমে। স্টোর রুম খুললেই দেখতে পাবেন।

না এরপর তিনি আর দেরি করেননি। সেলিনা বলল, অশ্ৰুদি চাবিটা দাও তো দেখি তোমার নতুন ঘরে কি আছে? আগে চা বা কফিতে খাওয়া যাক। অশ্রুকণা বলল তোমরা বোস সেলিনা আমিই দেখছি। সেলিনা বলল এখন থেকে এত নিজের নিজের ভাবলে চলবে কেন অদি। আমরা চলে গেলেই না হয় ভেবো। আমি বললাম, কণা ওকে চাবিটা দিয়ে দাও, সত্যিই তো আমাদের চা বা কফি খাওয়াবার অধিকারতো ওর আছে। সেলিনা তার তীর্যক দৃষ্টি হেনে বলল, তাহলে মানছ আমার কথা, ও চাবি নিয়ে চলে গেল হাসতে হাসতে।

অশ্রুকণা চুপ হয়ে বসে আছে। এই প্রাকৃতিক পরিবেশ ওর ভাল না খারাপ কেমন লাগছে এই দ্বিধায় পড়েছে বোধ হয়। বললাম, কিছু ভাবছো কণা। না এমন কিছু নয়। ও উঠে গেল। আমায় বলে গেল, সারদিনের পোষাকটা বদলে আসছি। তুমিও বাথরুমে গিয়ে হাতে মুখে জল দিয়ে পোষাকটা বদলে নাও। ভাবছি স্নান করব। ও আঁতকে উঠে বলল, না প্রান্তিক, নতুন জায়গা জ্বরটর আসতে পারে। এলোই বা, কয়টা দিনতো তোমার শুশ্রূষা পাব। ও থমকে দাঁড়িয়ে বলল, লোভ যে হয় না প্রান্তিক তা নয়, তবে সে অধিকারটুকু পাব কি না কে জানে। ও চলে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই কফি, বিস্কুট, ডিম সিদ্ধ নিয়ে এল সেলিনা, আমাকে একা বসে থাকতে দেখে বলল, অশ্ৰুদি কোথায়? সারা দিনের পোষাকটা ছাড়তে গেছে। এখনি আসবে। তুমি ছাড়বেনা? তারপর বলল, তুমি একটু বোস আমি আসছি। ও ভিতরে গিয়ে দেখল, অশ্রুকণা কিছুই ছাড়েনি, একা একা কাঁদছে। সেলিনা বলল, অশ্ৰুদি তুমি কাদছো, সেলিনাকে জড়িয়ে ধরে বলল, আমার একদম ভাল লাগছেনা। সেলিনা এ চাকরি আমি কবব না। তোমাদের সাথেই ফিরে যাবো। সেকি কথা অদি। এত সুন্দর জায়গা, কেন করবে না? কেন তুমি এরকম ভাবছো! জানি না, কেন আমার মোটেই ভাল লাগছেনা। আচ্ছা ঠিক আছে। কালতো রবিবার। কাল না হয় সারদিন ভেবো। এখন চল, আমি কফি করে ও ঘরে রেখে এসেছি, প্রান্তিক ভাই বসে আছে, আগে ওটা খেয়ে নাও, তারপর না হয় শাড়ী বদলিও। সেই গাড়ীতে কখন কি খেয়েছে। তারপর অশ্রুকণাকে এক প্রকার জোর করে নিয়ে এলো সেলিনা।

চুপচাপ কফিটা খেয়ে উঠে পড়লো ও। সেলিনা বাধা দিল না। ও চলে গেলে, সেলিনা বলল, জান প্রান্তিক ভাই অশ্ৰুদি শাড়ী বদলাবার নাম করে ঘরে গিয়ে শুধু কাদছিল। কঁদছিল? কেন? তাব নাকি এ জায়গা একদম ভালো লাগছেনা, তাই অশ্ৰুদি এখানে জয়েনও করবেনা, আমাদের সঙ্গেই ফিরে যাবে। তুমি কি কিছু বলেছো? আমি উন্মা প্রকাশ করে বললাম, হঠাৎ আমাকে আক্রমণ করছ কেন? আমি ওকে কি বলবো? তারপর বললাম এত সুন্দর জায়গা যদি ওর পছন্দ না হয়, তাহলে কিছু করার নেই। এই মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশ ও কোথায় পাবে? ওরতো বরং প্রতীমবাবুর কাছে কৃতজ্ঞ থাকা উচিত এত সুন্দর একটা চাকরি ওকে পাইয়ে দিয়েছেন বলে? বাঃ তোমার বক্তৃতা শেষ? মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশ হলেই বুঝি একা একা থাকা যায়? একা একা থাকবে কেন? সত্যভূষণ বাবুতো। বলেছেন, কাল থেকে একটি কাজের মেয়ে আসবে। তাছাড়া এখানে ওর মতো আরো অনেক শিক্ষয়ত্ৰী আছেন, তারা কেমন কবে থাকছেন? তুমিতো জানো তারা কেমন করে থাকছেন। হয়তো তাদের মনেও এই রকম দুঃখ আছে। আমি বুঝতে পারছি না সেলিনা, কেন অশ্রুকশার এই ভাবনাকে তুমি সমর্থন করছে। তোমার জন্য। আমার জন্য? হা তোমার জন্য। মানে? যা হোক এমন কিছু তুমি বলেছে, যেটা অশ্ৰুদিকে আঘাত দিয়েছে। তুমি হয়তো আমায় বলতে চাইছেনা। তারপর বলল, তোমাদের সঙ্গে আমার আসাই উচিত হয়নি। কিন্তু কি করব এসে যখন পড়েছি।

আমি তারপর বিস্মিত হয়ে বললাম, তোমার সঙ্গে ঝগড়া করতে আমার একদম ভাল লাগছেনা সেলিনা। তাহলে কাগজ কলম দাও, লিখে রাখি কেন তোমার সঙ্গে ঝগড়া করতে হচ্ছে? মিনতি পিসিকে রিপোর্টটা করতে হবে তো। কবে তুমি সিরিয়াস হবে সেলিনা? কত সহজ ভাবে বলল, যেদিন তোমার মন, অন্যের জন্য সংবদেনশীল হয়ে উঠবে। কি বলতে চাইছে তুমি? কিছুনা। অদিকে কি বলেছে, তা তুমিই জান, আমি বাথরুমে যাচ্ছি, ততক্ষণ তুমি ওকে তোমার মত করে বোঝাও, একটু জিততে চেষ্টা কর প্রান্তিক ভাই? সব জায়গায় এত হেরে যাও কেন বলতো। মনে রেখ দুর্বল পুরুষকে করুনা করা যায় শ্রদ্ধা। করা যায় না।

ও কফির সরঞ্জামের সব কিছু নিয়ে চলে গেল। অশ্রুকণার দুঃখ হয়তো বুঝতে পারছি। মনের মধ্যে যে গোপন স্বপ্নগুলো থাকে, বাস্তব, পারিপার্শিকতা, আর যৌক্তিকতা যাকে প্রতিমুহূর্তে প্রতিহত করে চলে, এমনি এক উন্মুক্ত মনোরম পরিবেশে, তা হয়তো প্রকাশ হতে চায়। অশ্রুকণার মনের মধ্যেকার সেই স্বপ্নগুলো হয়তো বেরিয়ে আসার জন্য গুমরে মরছে, কিন্তু সে জানে, তার কোন উপায় নেই। তাই হয়তো চাপা অভিমান চোখের জল হয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে, কিন্তু আমি কি করবো। তবুআস্তে আস্তে গেলাম অশ্রুকণার কাছে। চেয়ারে বসে মাথাটা উপুড় করে টেবিলে রেখে চুপ করে আছে। পিঠ থেকে আঁচলটা সরে গিয়ে উন্মুক্ত পিঠের অনেকটা অংশ দেখা যাচ্ছে। আমি ওর পিঠে হাত দিতেই ও টেবিল থেকে মাথাটা তুলেই মুহূর্তে আমাকে দেখে তার বুকের মধ্যে জড়িয়ে নিয়ে বলল, না প্রান্তিক আমি পারব না কিছুতেই পারবো না তোমাকে ছেড়ে থাকতে। আমি আস্তে আস্তে ওকে আমার কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে চেয়ারটায় বসিয়ে দিয়ে বললাম, কণা, এভাবে কেন নিজের দুর্বলতায় আরেকজনকে আচ্ছন্ন করছ? কেন বুঝতে পারছনা এখানে সেলিনা আছে। ও যে কিছু বোঝেনা তাতো নয়। ওর দৃষ্টি তীক্ষ্ণ, ওর অনুভূতি প্রখর, ওর উপলব্ধি সীমাহীন, কেন তার কাছে এভাবে ছোট হয়ে যেতে চাইছে। তা ছাড়া তাকে নিয়ে আসার জন্য তো জোর তুমিই করেছিলে। তাহলে এমন করছ কেন? আর আমার কথা কেন একদম ভাবছনা। তোমার এই দুর্বলতা আমাকে কত দুর্বল করে দিতে পারে বুঝতে চাইছেনা কেন? এরপর মুখ দেখাবো কি করে?

অশ্রুকণা বলল, তোমাকে যে বুঝতে পারছি না তা নয় প্রান্তিক। আসলে আমি নিজেকে বোঝাতে পারছি না। যে চরম অভিমানে একদিন বাড়ী ত্যাগ করেছিলাম, আজ কেবলি মনে হচ্ছে সে আমার ভুল। ওকে বাধা দিয়ে বললাম, সত্যিইতো। না সত্যি নয় কি সত্যি নয়। এই যে তুমি বললে বাড়ী থেকে চলে আসা আমার ভুল, না ওটা অমার ভুল নয়। তাহলে কি তোমার ভুল। জানিনা, তুমি যাও প্রান্তিক। আমাকে আর দুর্বল করে দিওনা। সেলিনা কোথায়? বাথরুমে গেছে। ও তাই তুমি এসেছে আমার কাছে? ওর সামনে দিয়ে আমার কাছে আসার সাহস তোমার হয়নি তাইতো। আমি থাকতে না পেরে বললাম, এও তোমার ভুল কণা। আমি তো জানিই না তোমার ভিতরে বয়ে চলেছে এক প্রচণ্ড ঝড়। বললে আমি শাড়ীটা বদলে আসি। হ্যাঁ বলেছিলাম আর সত্যিই শাড়ীটা বদলে তোমার কাছে আসতামও। তাহলে না এসে একা একা কাদছিলে কেন? কেন তুমি হঠাই কোন সুযোগ না দিয়ে আমার মনে ঝড় তুলে দিলে? বলল অশ্রুকণা। আমি ঝড় তুলোম? কি ভাবে? ও বলল কেন তুমি এক সাধারণ সৌজন্যতাকে অসাধারণ ব্যঞ্জনাময় করে তুললে? যেমন? কেন তুমি বললে এলোইবা জ্বর কয়েকটা দিন তোমার শুশ্রূষা পাবতো! অথচ তুমি ভাল ভাবেই জান তোমাকে শুশ্রূষা করার জন্য, তোমার পাশে সব সময় থাকার জন্য, সেলিনা আছে, অথচ এই ঝড়টুকু তোমার না তুললে কি চলতো না?

আমি স্তম্ভিত। এই সামান্য ঠাট্টাটুকু কারো জীবনে যে এমন কঠিন ঝড় তুলে দিতে পারে তা আমার ভাবনারও অতীত। বললাম, সত্যি যদি জ্বর হয়, জ্বর কেন, যেকোন রকম শুশ্রূষার প্রয়োজন হয় জীবনে, থাকুক সেলিনা আমার পাশে পাশে, তোমার শুশ্রূষা যদি সত্যি আমার প্রয়োজন হয় পারবে দিতে? ও বলল, তুমি কি নিতে পারবে? বললাম দেখ কশা, সেলিনাকে আমি ঠিক অতটা বুঝিনা যতটা তোমরা বোঝ। একটা জিনিষ শুধু বুঝতে পারি কোন ভাবেই সেলিনা আমার অমঙ্গল চায় না। তার জন্য জীবনের সর্বস্ব দিয়ে সে রূখে দাঁড়াতে জানে। আবার যদি সে বোঝে, তার থেকেও কোন কোন মুহূর্তে তোমাকেই আমার প্রয়োজন, হাসি মুখে সরে দাঁড়াবে, কোন রকম রাগ বা অভিমান না রেখেও, আমাকে তোমার হাতে সেই মুহূর্তের জন্য তুলে দিতে তার কোন ঈর্ষা থাকবে না, তাই বলে সে চিরদিনের জন্য তার দাবী ছেড়ে দিয়ে সরে দাঁড়াবে এতটা দুর্বল তাকে তুমি মনে করো না। আবার ও যাদের ভালোবাসে, এই ধর তুমি, তপতী, রেহানা, নীলাঞ্জনা পিসি, মিনতি সেন এই নামগুলো বললাম এই জন্য যে, কারণ, মেয়েদের ঈর্ষা মেয়েদের নিয়ে আবর্তিত হয়, তাদের যদি কারও সত্যি আমাকে প্রয়োজন হয়, তাহলে সেই প্রয়োজনের জন্য আমাকে হাসিমুখে ছেড়ে দেবে। এই ধরনা, আজকের কথাই, আমিতো জামিয়া কিছুই, কিন্তু তোমার মনে যে ঝড় উঠেছে, তার জন্য ও আমাকেই দায়ী করল আর অবশ্যিই যেন তোমার কাছে আসি, তার দিব্যি দিয়ে বাথরুমে চলে গেল। সুতরাং সেলিনার অবর্তমানে তোমার কাছে এসেছি এটা ঠিক নয়।

অশ্রুকশা বলল, আর আঘাত দিওনা প্রান্তিক। এবার চুপ কর, তুমি যা বলছ তা যে বুঝিনা তাতো নয়, মন বুঝতে না চাইলে কি করব। আমাকে তুমি ক্ষমা করো। আমি বললাম আমার সঙ্গে তোমার ক্ষমার সম্পর্ক নয় কণা। তোমার সব আচরণকে যদি মেনে নিতে না পারব, কিসের আমার ভালবাসার বড়াই। এবার ওঠ লক্ষ্মীটি, মনে হয় সেলিনার বেরোবার সময় হয়েছে। তোমার আচরণে ও হয়তো ভাবতে পারে সে বুঝি এসে অন্যায় করেছে। ও। ছলছল চোখে তাকালে আমার দিকে। বলল, আমাকে একটা কথা দেবে, আর হয়তো সময়। হবে না। বল। ও বলল তোমাকে যদি ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করে তুমি আসবে আমার কাছে? আমি কণ্ঠে আবেগ ঝরিয়ে বললাম আসব। ও বলল, যদি সেলিনা বাধা দেয় তা হলেও, আমি বললাম জানিনা আমার কোন কাজে সেলিনার বাধা দেওয়ার কোন অধিকার আছে কি না, যদি থাকেও, তবু তোমাকে কথা দিচ্ছি কণা, তোমার একান্ত প্রয়োজনে সে আমাকে তোমার দেখার ইচ্ছে হোক বা অন্য যাই হোক, জানতে পারলে আমাকে পাবে তোমার পাশে। কিন্তু ওকে বাধা দিয়ে বললাম আর কিন্তু নয় কশা, ঐ বুঝি বেরোল সেলিনা, এবার তুমি যাও। আচ্ছা তাই হবে। তুমি যাবে না বাথরুমে যাব আগে তোমার হোক।

আমি ফিরে এলাম, যে ঘরে প্রথম এসে বসেছিলাম সে ঘরে। আসতেই দেখি ভিজে কাপড়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসছে সেলিনা। আমি ওর দিকে তাকাতেই একটু হেসে ও অন্য ঘরে ঢুকে গেল।

ভাবছি এই মান অভিমান আর দুর্বলতা নিয়ে কদিন কাটানো যাবে এখানে। সেলিনার চাওয়াটা এতটা স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে তাতে কি ভাবে এর সমাধান হবে কে জানে। আর অশ্রুকণা, ওর চাওয়াটা বুঝি, স্পষ্টতা বুঝিনা। আজ যদি সত্যি সত্যি ও ওর দাবী নিয়ে এসে দাঁড়ায় আমার সামনে বুঝতে পারছি না কি ভাবে তার ইতি টানতে পারব।

কতক্ষণ এরকম ভাবছিলাম মনে নেই। একটা আটপৌরে শাড়ী পরে এসে দাঁড়ালো সেলিনা আমার সামনে। বলল তোমাকে আমার ভীষণ ভাল লাগছে প্রান্তিক ভাই। আমি হেসে বললাম, হঠাৎ? বাঃ জীবনের সব ঘটনাই তো হঠাৎ হঠাৎ হয়, এই যেমন অশ্ৰুদি হঠাৎ বলল, তার ভাল লাগছেনা সে এ চাকরি করবেই না, চলে যাবে আমাদের সঙ্গে। এও তো তার হঠাৎ ভাবনা তাইনা? হয়তো হবে। তাহলে কি তুমি বলতে চাইছো হঠাৎই আমাকে তোমার ভাল লেগে গেল? বলতে পার এই মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশ, বাইরের আকাশে ওই ভরা জোছনা, চারিদিকে এত গাছ গাছালি তার মাঝে ওই সুন্দর ফুলের বাগান, ভাল না লেগে পারে খাওয়া দাওয়ার পবে চলনা আসার সময় দেখে এসেছি বাগানের এক প্রান্তে যে বসার বেদী ওখানে গিয়ে বসব কিছুক্ষণ শুধু তুমি আর আমি। চোখে ওর অদম্য কৌতূহল। আমি বললাম রাজী আছি, কিন্তু শেষ পর্যন্ত পিছিয়ে যাবে নাতো।

এতটা সাহস বুঝি ও আশা করেনি, বলল, তুমি হারতে চাওনা তাই তো? না তা নয়। তবে? তোমাকে আমি জিততে দেবো না, প্রতিটি মুহূর্তে তুমিই কেবল জিতে যাবে, তা হবে না। মনে থাকবে তো। আজ পর্যন্ত এমন কিছু ঘটেছে কি যা আমি মনে রাখিনি। বুঝতে পারছি সেলিনা প্রচন্ড অবাক হয়ে যাচ্ছে। বলল, ঠিক আছে সময় মত তার পরীক্ষা দেওয়া যাবে। আপাতত বলত: কি রান্না হবে। ও ইতিহাস তো আমার জানার কথা নয়। কি আছে তাইতো জানিনা। আলু, ডিম, আর ডাল। বললাম এক কাজ কর, এক সঙ্গে সবই সিদ্ধ দিয়ে দাও, তাতে সময় বাঁচবে, তাছাড়া বেশ খিদেও পেয়েছে। ও বলল তোমার পেয়েছে খিদে? অসম্ভব। মানে? মানে থাক, আমি তা হলে সব সিদ্ধ বসিয়েই দিচ্ছি। তুমি অশ্ৰুদি বেরুলেই বাথরুমে যাবে? আচ্ছা। তাই বলে আবার চান করে বসোনা কিন্তু। কেন? ক্স ছাড়া সারাদিনের যা ক্লান্তি চান না করলে ক্লান্তি যাবে কেন? সেলিনা প্রতিবাদ করে বলল না, অসময়ে চান করলে অসুখ বিসুখ করতে পারে। করলই বা তুমিতো আছো? আমি? না বাপু আমি পারবো না এখানে তোমার শুশ্রূষা করতে? তুমি না পারলে অশ্রুকণাই করবে। তার মানে অশ্ৰুদিকে তুমি ভোগাতে চাও এইতো না। তবে আমি তোমাকে ভোগাতে চাই। ও রাগ করে বলল, তোমার যা ইচ্ছে তাই কর। কিন্তু জেনে রেখো, আমি তোমার কোন শুশ্রূষাই করতে পারবো না। ও বলতে গেলে রাগ করেই চলে গেল। বুঝতে পারছি ও ও যেন কি বলতে চায়। শুধু ওর আচরণ বোঝা কষ্টকর এই যা তফাৎ।

খাওয়া দাওয়ার পরে দুই ঘরে দুটো বিছানা করা হলো। ঠিক হয়েছে অশ্রুকণা ও সেলিনা থাকবে এক ঘরে আর আমি অন্য ঘরে একেবারে স্বাভাবিক। একটা ঘর থেকে আরেকটা ঘরে যাওয়ার জন্য যে দরজা আছে তাতে খিল, বিণী বা উসা নেই। অতএব তা ভেজানো থাকলেও খোলাই থাকবে।

সব কিছু গোছাতে গোছাতে অনেক রাত হয়ে গেল। সেলিনা বলল প্রান্তিক ভাই, তোমার শরীর খুব ক্লান্ত এবার তুমি ঘুমিয়ে পড়। আমি বললাম তোমরা ঘুমাবেনা? না, আমরা একটু বাইরে গিয়ে বসব। আমাকে নেবেনা? অকণা বল, সেলিনা, প্রান্তিক যখন যেতে রাজী আছে, তুমি ওকেই নিয়ে যাও, আমার সত্যিই ভীষণ ঘুম পাচ্ছে। সেলিনা বলল ঘুম পাচ্ছে না প্রান্তিক ভাই না গেলে তুমি যাবে না কোনটা সত্য? কি যে ঠাট্টা কর সেলিনা। তোমরা যাও না, বিশ্বাস কর আমার শরীর আর বইছে না। জীবনে এত ধকল তো কোন দিন আসেনি। তাহলে আমিও যাবো না। আমি বললাম সেই ভালো। বরং সকলেই একসঙ্গে ঘুমিয়ে পড়া যাক৷ কাল না হয় যাওয়া যাবে। সেলিনা আর কথা বাড়ালো না। আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়লো।

সকাল হয়েছে কখন বুঝতে পারিনি। সমস্ত শরীরে অসম্ভব ব্যথা, হাত পা নাড়াতে পারছি না। ওদের বারণ শুনে স্নান করিনি। কিন্তু তাতে ওদের আশঙ্কা কাটানো যায়নি। অশ্রুকণা কফি করে সেলিনাকে বলল, দেখতো সেলিনা প্রান্তিকের ঘুম ভেঙেছে কি না। এটা ওকে দিয়ে এসো। এর মধ্যে সকালে বাজার সরকাব এসে কি কি বাজার পাঠাতে হবে তার লিস্ট নিয়ে গেছেন। সেলিনা কফি নিয়ে আসে। আমি বুঝতে পারছি ও এসেছে। কিন্তু চোখ মেলে তাকাতে পারছি না। ও ডাকছে প্রান্তিক ভাই, কি ঘুম ঘুমাতে পার। ওঠ, কফিটা খেয়ে নাও। আমি তবু তাকে কোন সাড়া দিচ্ছি না দেখে ও কফিটা রেখে আমাকে ঠেলা দিতেই চমকে উঠে বলল, একি প্রান্তিক ভাই গা যে পুড়ে যাচ্ছে। ডাকতে পারনি? তবু আমি কোন কথা বলতে পারছি না, ও জানতে চাইল জ্বর কখন এসেছে? বললাম জানিনা ঠিক। মাঝরাতে রাতে যখন শীত শীত করছিল তখন তোমাদের ডেকেছিলাম, বোধহয় তোমরা শুনতে পাওনি। ও বলল, আমি অদিকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। অশ্রুকণা এলো। গায়ে হাত দিয়ে শিউরে উঠে বলল, এতো দেখছি ১০৩/১০৪ ডিগ্রি জ্বর হবে। তোমাকে বার বার করে বললাম স্নান করো না। এখন কি হবে বলতো। সেলিনা বলল, প্রান্তিক ভাই এখানে বেশকিছুদিন থাকতে চায় তাই ইচ্ছে করেই জ্বরটা বাধিয়েছে। সত্যভূষণ বাবু এলে কোন ডাক্তার পাওয়া যায় কিনা দেখা যাবে। আপাতত তুমি ওর কাছে বস অশ্রুদি। আমি রান্না ঘরে আছি। ও আর দাঁড়ালো না।

অশ্রু বলল, জ্বরটা কখন থেকে এসেছে প্রান্তিক, আমি বললাম ঠিক জানিনা, তবে মনে হয় গাড়ীতে যখন উঠেছি তখন জ্বর জ্বর লাগছিল। ভেবেছিলাম ও কিছু নয়। গুরুত্ব দিইনি। তারপর যখন বাথরুমে গিয়ে হাতে মুখে জল দিলাম, শীতে ভাল করে চোখেমুখেও জল দিতে পারলাম না। তখন বললে না কেন? ভাবলাম কমে যাবে তাই আরকি। আর তাছাড়া ভিতরে ভিতরে একটা লোভতো ছিলই তবে সত্যিই বুঝতে পারিনি, এমন তীব্র ভাবে আক্রান্ত হতে পারি। যদি কোন একস্ট্রা চাদর টাদর থাকে দেখনা ভীষণ শীত করছে। অশ্রুকণা ঘরে গিয়ে অতিরিক্ত একটা চাদর এনে আমার গায়ে চাপা দিয়ে দিল। আর একেবারে বিনা কারণে ওর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল।

কিন্তু ওর দিকে তাকাবার মত অবস্থা তখন আমার নেই। কফিটা কোন ভাবে খেয়ে  আবার চোখ বন্ধ করলাম। এর মাঝে এলেন সত্যভূষণ বাবু। সেলিনা তাকে দরজা খুলে দিলে উনি বললেন, আপনাদের কোন অসুবিধা হয়নি তো। না। অদেবী কোথায়, একবার প্রধান শিক্ষয়িত্রীর কাছে যেতে হবে। আজ তো রবিবার। তাতে কি? তিনি একবার ডেকে পাঠিয়েছেন। আমি বসছি, আপনি যদি তাকে একবার পাঠিয়ে দেন। আচ্ছা বসুন, আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি।

অশ্রুকণা এলে সত্যভূষণ বাবু বললেন, আপনি যদি একবার তাড়াতাড়ি প্রস্তুত হয়ে নেন, তা হলে ভাল হয় অশ্রুদেবী। একবার প্রধান শিক্ষিকার কাছে যেতে হবে। অশ্রুকণা বলল, আজ না গেলে নয়? কেন বলুন তো। কোন অসুবিধা আছে কি? অসুবিধা একটু আছে বৈকি। আমাকে বলা যায় না? আপনাকে তো বলতেই হবে। আপনি যদি এ সময় না আসতেন। তাহলে হয়তো আমাকেই আপনাকে খুঁজতে বেরোতে হতো। সত্যভূষণ বাবু শুধু একটু হাসলেন, তারপর বললেন বলে ফেলুন। অশ্রুকণা বলল, কাল প্রান্তিকের জ্বর এসেছে, জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। মনে হয় ১০৩/১০৪ ডিগ্রি জ্বর হবে। ডাক্তারের প্রয়োজন। জানিনা এখানে কোন ডাক্তার আছে কি না। না এখানে ধারে কাছে কোন ডাক্তার নেই অশ্রুদেবী। আমি ডাক্তার নই, তবুও এখানকার গরীব মানুষের চিকিৎসা আমাকেই করতে হয় বেআইনী জেনেও। আমাদের প্রতিষ্ঠানে অবশ্য একজন ডাক্তার আছেন, তবে তিনি আজ নেই, বিশেষ কাজে বাইরে গেছেন। যদি বিশ্বাস রাখেন আমি একবার দেখতে পারি। অকণা বললেন আসুন।

সত্যভূষণ বাবু আমাকে দেখলেন। টেথিসকোপ ছাড়াই শুধু হাতে তিনি বুক পিঠ পরীক্ষা করলেন। চোখ এবং জিহ্বা দেখলেন। তারপর বললেন, না ভয় নেই অশ্রুদেবী। আমি কয়েকটা ট্যাবলেট পাঠিয়ে দিচ্ছি। প্রথমেই একটা খাইয়ে দেবেন, ঘন্টা চারেক পরে আরেকটা খাওয়াবেন। তারপরও যদি না কমে, তাহলে আরো চারঘন্টা পরে আরেকটা খাওয়াবেন। তবে তৃতীয়টা খাওয়াবার প্রয়োজন হবে না বলেই মনে হয়। অশ্রুকণা উদ্বিগ্নতার সঙ্গে বললেন আপনাকে কষ্ট দিচ্ছি। আরে না না, কষ্ট কেন দেবেন। আপনি বরং এক কাজ করুন অঞদেবী, আপনি চলুন আমার সঙ্গে বড় দিদির সঙ্গে দেখা হবে, আর ওষুধটাও নিয়ে আসতে পারবেন। আর সেই সঙ্গে আমি কোথায় থাকি সেটাও দেখা হয়ে যাবে। অশ্রুকণা বললেন ঠিক আছে আপনি বসুন আমি আসছি।

সত্যভূষণ বাবু আমার কাছে না বসে, বসার ঘরে গিয়ে বসলেন, সেলিনা কফি ও বিস্কুট নিয়ে এলে সত্যভূষণ বাবু বললেন, আমিতো চা বা কফি কিছুই খাইনে। শুধু শুধু কষ্ট করতে গেলেন। সেলিনা বলল, কষ্টটা বড় কথা নয় সত্যবাবু, অপমানটাই বড়। মানে? আপনি কি বলতে চাইছেন আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। না বোঝার কথাতে নয় আপনার। অবাক হয়ে তাকালেন সত্যভূষণ বাবু সেলিনার দিকে, তারপর বললেন, হয়তো আপনি বলতে চাইছেন সকালে এসে কিছু না খাওয়াটা অপমানেরই নামান্তর, তা যদি বলেন, আমি বিস্কুট গুলো খেয়ে নিচ্ছি, কিন্তু বিশ্বাস করুন চা বা কফি সত্যিই আমি খাইনা। কারণ? কারণ এমনিতে কিছুই নেই। আসলে আমিতো এদের মাঝে বড় হয়েছি, এখানকার কেউই চা বা কফি খায় না। আর এখানে ওসব পাওয়াও যায় না, তাই অভ্যেসটা গড়ে ওঠেনি। সেলিনা বলল যে অভ্যেস গড়ে ওঠেনি, তার আবার স্থায়িত্ব কি? হ্যাঁ তা বলতে পারেন। তাহলে কফিটা খেয়ে নিন। বাঃ আপনিতো অপূর্ব ম্যানেজ করতে পারেন। প্রয়োজন হলে কি নামে ডাকব আপনাকে। হয়তো আমাকে আপনার প্রয়োজন হবে না। তবে একান্তই যদি দরকার হয়, তা হলে আমার নাম সেলিনা। সেলিনা রহমান। দাঁড়ান দাঁড়ান আপনার নাম যেন কোথায় দেখেছি। হেসে ফেলল সেলিনা। বলল, কোথাও দেখেননি, হঠাৎ আপনার মনে হয়েছে তাই আপনি বললেন। কিন্তু আপনি বোধ হয় জানেন না মিস রহমান আমার স্মৃতি শক্তি খুব একটা খারাপ নয়। আমি কি তা ভাবতে পারি কখনো। শুধু মাত্র গতকাল রাতে আমার পরিচয় পেয়েও আজ তা যখন ভুলে গেছেন তখন তার প্রশংসাতো করতেই হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *