০৫. মিনতি সেনের বাড়ী

মিনতি সেন সাধারণত ৫/৩০টার আগে বাড়ীতে ফেরেন না। হাসপাতাল থেকে মিনতি সেনের বাড়ীতে যেতে গেলে এক ঘন্টার উপর সময় লাগে। তাই তপতীকে বলে এসেছি আজ আমার আসা হবে না, তুমি ওকে সময় দিও। কিন্তু কে জানতত, শিয়ালদা স্টেশনে হঠাৎ করে এমনি ভাবে দেখা হয়ে যাবে পরিমলবাবুর সঙ্গে। রেল ক্যান্টিন থেকে রেকচ্ছেন পরিমল বাবু, সঙ্গে এক সুন্দরী মহিলা। তা হলে পিসির অনুমান ঠিক। কিন্তু এ মহিলার যে সিঁথিতে সিঁদুর। তা হলে কে এই মহিলা? মিনতি সেন যে নন, তাতে দেখতেই পারছি। তবে কি কাকলী মিত্র? কিন্তু যতদূর জানি কাকলী মিত্র অবিবাহিতা। অবশ্য পরিমলবাবু যদি গোপনে তাকে বিয়ে করে থাকেন তা হলে অন্য কথা। কিন্তু তাইবা কি করে সম্ভ। পিসির অনুমতি ছাড়া বিয়ে হবে কি করে? আমি একটু আড়ালে গিয়ে দাঁড়ালম। শুনতে পেলাম ভদ্রমহিলা বলছেন, রোজ রোজ ব্যারাকপুর থেকে আমি আসতে পারবনা। তাহলে কি করবে? কি আর করব। তোমার পরেতো আমারও অধিকার আছে? আমিতো অস্বীকার করছিনা। তা হলে তোমার যেতে আপত্তি কোথায়? তুমি বুঝতে পারছ না, যুঁথি। আমি সবই বুঝতে পারছি। তারপর বললেন তোমারই অনুরোধে আমি চুপ করে ছিলাম এতদিন। আর সম্ভব না। তাহলে কি করতে চাও? আমি আর আসতে পারবনা। বেশ তাই হবে, কাল আমিই যাব।

আনন্দে চিক্ চিক্ করে উঠলো ভদ্রমহিলার চোখ। পরিমলবাবু বললেন, সেই প্রথম দিনের মতো ফিরিয়ে দেবে নাতো। তোমার মনে আছে সেদিনের কথা। মনে থাকবেনা কেন? আজো সেদিনের কথা মনে পড়লে অপমানের জ্বালায় আমি কেঁপে উঠি। তাই বুঝি। হ্যাঁ যুঁথি তাই। তবুও তো ভুলতে পারলেনা। না পারলামনা। তারপর বললেন, হয়তো পারতাম তবে পারলে না কেন? ওরা ক্যান্টিনের বাইরে একটা ফাঁকা জায়গা বেঁছে নিয়ে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন। আমার যে কি হল আমি কিছুতেই পা নাড়াতে পারছি না। পরিমলবাবু বললেন পারলাম না তোমার জন্য? আমার জন্য? হ্যাঁ তোমারই জন্য। আরো বললেন, কারণ আমি কথা দিয়েছিলাম, আমার সন্তানের মা তুমি ছাড়া আর কেউ হবে না। বিজয়িনীর হাসি দেখা গেল যুঁথির মুখে। বললেন, কিন্তু আমি যে শুনেছি সন্তান দেওয়ার মতো ক্ষমতাই তোমার নেই। তাই বুঝি। বেশ কালতে যাচ্ছি। পরীক্ষা দেবে? হ্যাঁ পরীক্ষাই দেব, কিন্তু পাশ করলে কি দেবে বল? তার আগেতে প্রবেশাধিকার চাই। সেটা পাও আগে। তার মানে এখনো তোমার সেই হেঁয়ালি। আমার জন্য কি তোমার কোন মায়া হয় না? যুঁথি বললেন কালতে যাচ্ছ? কাল বলব। কাল কেন আজ বলা যায় না। হয়তো যায়, কিন্তু এখনো আমার নিজেকে জানা হয়নি। যাকগে চলি। চল তোমাকে গাড়ীতে তুলে দিয়ে আসি। কোন দরকার নেই। তুমি চলে যাও। আমি একাই যেতে পারব। বেশ জোর করবনা।

পরিমলবাবু সিঁড়ি ভেঙে নেমে গেলেন। আর যুঁথি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আস্তে আস্তে নেমে এলেন। টিকিট কাউন্টারে এসে টিকিট কাটলেন। হ্যাঁ ব্যারাকপুর এর টিকিট। আমি নিজে তার পিছনে দাঁড়িয়ে ব্যারাকপুরের টিকিট কাটলাম।

চায়ের তৃষ্ণা পেয়েছে খুব কিন্তু চায়ের ফেরিওয়ালা, অন্যদিকে থাকায় আমি জোবে ডাকলাম, এই চা। কিন্তু ও বোধ হয় শুনতে পায়নি। ও অন্য কম্পার্টমেন্টে চলে গেল। আমি আপন মনে বললাম, ভীষণ চা তেষ্টা পেয়েছিল কিন্তু চাওয়ালা শুমতেই পেলনা। হাসলেন যুঁথি। হাসলে ভীষণ সুন্দর লাগে ভদ্রমহিলাকে। ভদ্রমহিলার চেহারার মধ্যে এমন একটা আলাদা জৌলুস আছে যা যেকোন পুরুষকে তার দিকে তাকাতে বাধ্য কববে। উনি নিজের ফ্লাস্ক থেকে চা ঢেলে আমার দিকে বাড়িয়ে দিলে আমি বললাম, না থাক আপনি খান। অবারও হাসলেন যুঁথি। লজ্জা করছে? ছেলেদের লজ্জা আমার কাছে কেমন বোকা বোকা মনে হয়। আমি বললাম আমারও তাই মনে হয়। কি? ঐ যে আপনি বললেন না লাজুক ছেলেদের আপনার কেমন বোকা বোকা মনে হয়।

ট্রেনের যাত্রীরা নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত, সুতরাং আমাদের দিকে তাকাবার তাদের সময় কোথায়? তবু যে ২/১ জন আড়চোখে তাকাচ্ছেনা তা হলপ করে বলা যায় না। যুঁথি বললেন, তাই বুঝি। বুঝতে পারছি যতটা বোকা তিনি আমাকে মনে করেছিলেন আমি যে তা নই এটা বুঝতে পেবেই একটা সমীহের দৃষ্টিতে তাকালেন আমার দিকে। বললেন আপনি তো ভারি সুন্দর কথা বলতে পারেন। আপনি কি ব্যারাকপুরেই থাকেন? এত জায়গা থাকতে হঠাৎ আপনার ব্যারাকপুরের কথা মনে হলো কেন? আস্তে আস্তে বললেন, আপনাকে আমি টিকিট কাউন্টার থেকে লক্ষ কবছি। আপনি ব্যারাকপুরের টিকিট কেটেছেন তাও দেখেছি। আমি হেসে ফেললাম। হাসলেন যে। না এতলোক থাকতে আপনি আমার গতিবিধি লক্ষ কবেছেন কীনা তাই। তারপর বললাম না আমি ব্যারাকপুর থাকি না। তবে আমার এক বন্ধুর ওখানে অপেক্ষা করার কথা, কি জানি অপেক্ষা করে আছেন না চলে গেছেন। চলে গেলে তো খুব দুঃখের কথা। কেন দুঃখ হবে কেন? বা দুঃখ হবে না, আপনি এত কষ্ট করে গিয়ে দেখলেন যে যার থাকার কথা তিনি নেই। এতো দুঃখেরই কথা। আমি খুব গম্ভীর ভাবে বললাম। আমি কোন কিছুকে মূল্যহীন মনে করিনা কারণ উনি না থাকলেও আমার সঙ্গে তো একজন নতুন বন্ধু রয়েছেন। কে? কেন আপনি? অবাক হয় যুঁথি? এ ছেলেটি বলে কি? মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে গেলে যে অধিকাংশ ছেলের লেজেগোবরে অবস্থা হয়, এ ছেলেটির মধ্যেতে তার বিন্দুমাত্র লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। কত সহজ এবং স্বাচ্ছন্দ্য। কোন আড়ষ্টতা নেই, নেই কোন অস্পষ্টতাও। নিজের মতামত দৃঢ়ভাবে জানাতে পারে। এমন ছেলেদেরইতো মেয়েদের সাধারণত ভাললাগার কথা। যুঁথির তাই ভাল না লেগে উপায় নেই। এমন একজন সহজ সাবলীল এবং সোজাসুজি কথা বলতে পারে এমন যুবকের সঙ্গে কথা বলতে পারা যে অনেক মেয়ের কাছে ঈর্ষণীয় তাকে অস্বীকার করবে কি করে যুঁথি। বললেন, আমাকে আপনি বন্ধু বলে মনে করেন? অবশই যতক্ষণ ট্রেনে চলছি ততক্ষণ তাতে আপত্তি কি? সময়টাতে অন্তত ভালো কাটবে। যুঁথির যেন আর কোন কথা জোগায় না।

কিছুক্ষণ চুপচাপ। কোন তরফের থেকেই কোন কথা নেই। সামনে একজন রহস্যময়ী সুন্দরী মহিলা বসে আছেন। হোকনা তিনি আমার থেকে বেশী বয়সী তাতে কি? সৌন্দর্যের পরিমাপ কি বয়স দিয়ে মাপা যায়? সিঁথিতে সিঁদুর, হাতে শাখা না থাকলে অনেক পুরুষের বুকে যে আগুন জ্বালাবার সৌন্দর্য আকর্ষণ তার আছে তাকে অস্বীকার করা যায় না। আর তা ছাড়া ট্রেনে চলতে চলতে হয় উদাস দৃষ্টিতে বাইরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে হয় না হয় চোখ দুটিকে নিবদ্ধ রাখতে হয় ঠিক আমার সামনে যিনি বসে আছেন তার দিকে। দুটোই সমস্যার। অনেক সময় কথা না বলেও এত কথা বলা যায় যে নিজেকে ক্লান্ত মনে হয়। ঠিক কিনা বলুন? শেষের কথাটায় একটু জোর বেশী দিলাম যাতে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায়। কিন্তু আমার কথা শুনে হেসে ফেললেন উনি, বললেন না আপনার সঙ্গে সত্যি পেরে ওঠা যাবে না, বললাম আপনি যে বেশীক্ষণ পারবেন না তা আমি জানি। যাক গে সে সব কথা। এবার বলুনতো আপনি কি করেন? যুঁথি সহজ ভাবে বললেন, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে এত খোঁজ নিচ্ছেন কেন বলুনতো? আপনার সঙ্গে হয়তো ভবিষ্যতে আমার আর কোন দিন আর দেখা নাও হতে পারে। হতেও তো পারে। আবার সেই কথার মারপ্যাঁচ। হয়তো যুঁথি মনে মনে ভেবে চলেছেন, ছেলেটার বয়স বেশী নয়, কিন্তু যেকোন বয়সের মেয়েদের সঙ্গে যে তার সাবলীল মেলা মেশার অধিকার আছে তাকে অস্বীকার করা যায় না। হয়তো মনে মনে ভেবে নিয়েছেন যুঁথি যে যতক্ষণ একসঙ্গে পথ চলা হচ্ছে, ততক্ষণ চুকরে না থাকাই ভাল। বললেন আপনার এই আত্মবিশ্বাস কোথা থেকে পেলেন বলুনতো? ঠিক বুঝলামনা আপনার কথা, উনি বললেন এই যে আমার কথার প্রতি উত্তরে অমন করে বললেন, আপনি যে বেশীক্ষণ পারবেন না তা আমি জানি। এই আত্মবিশ্বাস। আমি হো হো করে হেসে উঠলাম। পাশের যাত্রীরাও চমকে উঠে তাকালেন আমার দিকে ঠিক যুঁথির মতো।

ততক্ষণে ট্রেনটি ব্যারাকপুর স্টেশনে ঢুকে পড়েছে। সবাই নামার জন্য ব্যস্ত। আমি বললাম, কি হলো নামবেন না। হ্যাঁ নামব। এ ট্রেনের শেষতো এখানেই, অত তাড়াহুড়োর কি আছে? সত্যিইতো তাড়াহুড়োর কিছু নেই। এই জন্যই আমার আপনাকে ভীষন ভালো লেগেছে। মানে? এতক্ষনে বুঝেছি, আপনি ধৈর্য্য ধরতে জানেন। জানেন এটা মেয়েদের একটা বিশেষ গুন। আপনি বুঝি মেয়েদের খুব ভালো ভাবে চেনেন। এই দেখুন আপনি কেমন অবাস্তব কথা বল্লেন। মেয়েদের চেনে না এমন কেউ আছে নাকি? মা, বোন, বৌদি, পিসি, মাসি এমন কি স্ত্রী পর্যন্ত সবাইতো মেয়ে। আপনি কি বলতে চান এদের আমি চিনিনা? তারপর বললাম, না এবার নামতে হবে, ট্রেনে আর কেউ নেই দেখছি।

আমরা প্লাটফরম থেকে বেরিয়ে এলাম। যুঁথি বললেন, কই আপনার বন্ধু নেই? না দেখছিনা। তা হলে কি করবেন? হঠাৎ প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে বললাম, চলুননা ওইতো চায়ের দোকান, ওই দোকানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাড়ে চা খাওয়া যাক। আপনার বোধহয় মাঝে মাঝেই চা তেষ্টা পায়। মাঝে মাঝে নয়, তবে সঙ্গে কেউ থাকলে চা খাওয়ার একটা বিশেষ জেদ চেপে যায়। শুধু চা আর কিছু খেতে ইচ্ছে করেনা? না করেনা, কারণ পকেট ওর বেশী পারমিট করে না। আবারও হেসে উঠলেন যুঁথি, তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, এই ট্রেন প্রায় ৪০ মিনিট পরে ছাড়বে, আমার বাড়ী কাছেই, যদি আপত্তি না হয় তা হলে চলুন না, বাড়ীতে চা করে খাওয়া যাবে। আবারও সেই মুখচোরা হাসি। বুঝতে পারছি আমার কথাবার্তা তার কাছে যেন হঠাৎ পাওয়া মজার সামগ্রী। খুব গম্ভীর কিন্তু হতাশ কণ্ঠে বললাম। যেতে তো ইচ্ছে করে কিন্তু বাড়ীতে কেউ যদি কিছু ভাবেন। ভাবলোই বা। মানে? মানে আবার কি, যদি কেউ কিছু ভাবতে চান, ভাববেন, তাতে আপনার কি। আমিতো আপনার বন্ধু কি তাই না? কিন্তু ওরা যদি বিশ্বাস করতে না চান। ওদের বিশ্বাসে কি যায় আসে, আমিতো বিশ্বাস করছি। আমি অবাক হয়ে বললাম সত্যি? কেন আমাকে আপনার বিশ্বাস হচ্ছে না। না ঠিক তা নয় আসলে। কি আসলে? আসলে আপনি সত্যিই বলছেন তো যে, আমি আপনার বন্ধু। কেন আমার বন্ধু হতে আপত্তি আছে আপনার না ঠিক তা নয়। তারপর বললাম আপনি আমাকে কতটুকু চেনেন? যতটুকু চিনি তাতেই চলবে। চলুন এবার।

সত্যি কাছেই বাড়ী। একতলা, ছিমছাম, সত্যিই সুন্দর বাড়ীটা। ছোট বাড়ী, উনি নিজের চাবি দিয়ে তালা খুলে ভিতরে এলেন। ছোট্ট বসার ঘর। এক দেওয়ালে দেওয়াল ঘড়ি, আর এক দেওয়ালে একটা বড় ফটো সুন্দর করে বাঁধানো। এগিয়ে ভাল করে দেখি পরিমলবাবুর ছবি। আমি বললাম, আপনি এখানে একাই থাকেন? হ্যাঁ। দেওয়ালের ছবিটির দিকে তাকিয়ে বললাম ওটা কার ছবি? আমার বন্ধুর। আপনার বন্ধু? হ্যাঁ। আমাকে তো আপনি বন্ধু বললেন তাইনা? হ্যাঁ। তাহলে এবার আমার একটি ছবি বাঁধিয়ে আপনাকে দিয়ে যাব। কেন? বা এক বন্ধুর ছবি রাখবেন, আরেক বন্ধুর রাখবেন না।

আবার সেই মন পাগল করা হাসি। বললেন, আচ্ছা দেবেন, রাখব? সতি? হ্যাঁ সত্যি? যাঃ তাই হয় নাকি? কি হয়না। উনি আপনার সত্যি কারের বন্ধু হতে পারেন। কিন্তু আমিতো চলতি পথের সাথী হারা বন্ধু মাত্র। যুঁথি বললেন, কেউ সাথী হারা নয়। চলতি পথে কোন সাথী হারিয়ে গেলে নুতন সাথী জুটে যায়। যেমন আপনি। ওর কথা শেষ হতেই হো হো করে হেসে উঠলাম, আর আমার সঙ্গে হেসে উঠলেন যুঁথিও।

মিনিট পাঁচেক পরে কফি, কিছু মিষ্টি এবং নিমকি নিয়ে এলেন যুঁথি। আমি অবাক হয়ে বললাম কফি? হ্যাঁ, আপনি পছন্দ করেন না। ভীষণ ভীষণ পছন্দ করি, কি করে যে আমার মনের কথাটি বুঝতে পারলেন। আবার সেই কৌতুক হাসির রেখা ওষ্টা ধরে বিলিয়ে দিতে দিতে বললেন, মেয়েদের একটা সিক্সথ সেন্স আছে জানেন? হা জানি। তা হলে? আমিতো সেই জন্যই ভাবি যারা মেয়ে চায়না বলে …। থাক, বলে থেমে গেলাম।

কফির কাপটা তুলে নিলাম। বললাম, কই আপনি নিলেন না? এই নিই। কফি খাওয়া শেষ হলো। বললাম তা হলে উঠি। আচ্ছা। কিন্তু একটা কথা জানা হল না? কি? আবার কি আমাদের দেখা হতে পারে। আপনিতো বাড়ী চিনে গেলেন, আসবেন সময় করে। আপনি বুঝি একা থাকেন? আপাতত। আচ্ছা আপনাকে চিনবো কি করে? আই মীন কি পরিচয়ে। আমার নাম যুঁথি। এই নামেই এ পাড়ার সকলেই চেনেন আমাকে। আবাল বৃদ্ধ বনিতা যাকেই বলবেন, তারাই চিনিয়ে দেবেন আমার বাড়ী। তা তো না হয় হলো, কিন্তু তারা যদি জানতে চান, আপনি আমার কে হন? তা হলে? আপনার যেমন ইচ্ছে আমার পরিচয় দেবেন। যদি বলি আমার বন্ধু। তাই দেবেন। আচ্ছা যাওয়ার আগে একটি কথা জিজ্ঞাস কবি, ঐ ছবির মানুষটি আপনার স্বামী তাই না? চুপ করে থাকেন যুঁথি। আমি বললাম, আমি জানতাম, তাই বলেছিলাম, ওই ছবির পাশে কিছুতেই আপনি আমার ছবি টাঙাতে পারবেন না। তা উনি কি এখানে থাকনে না? না। কেন? আমাকে না জানিয়ে উনি আবার একজনকে বিয়ে করেছেন তাই। আমি অবাক হয়ে বললাম, সেকি সাংঘাতিক কথা, আপনার মতো একজন সুন্দরী স্ত্রী থাকতেও আবার বিয়ে করেছেন? আপনিতো ওর বিরুদ্ধে কোর্টে যেতে পারতেন। আজ থাক বলে কি যেন একটা সম্বোধন করতে চাইছিলেন আমাকে। বললাম, আমার নাম প্রান্তিক, আপনি প্রান্তিক নামেই ডাকবেন আমাকে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললাম, ইস? অনেক দেরি হয়ে গেল। আবেক দিন আসব হাতে সময় নিয়ে। সেদিন শুনবো আপনার কথা। তারপর বললাম না ভদ্রলোক যথেষ্ট অন্যায় করেছেন। দেখতে পাচ্ছি যুঁথির মনটা মেন যেন শুকিয়ে যাচ্ছে। আমি কিন্তু বলেই চলেছি আপনাকে এব; স্থির সিদ্ধান্তে আসতে হবে। যুঁথি উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন, কিসের স্থির সিদ্ধান্ত। আমি বললাম, বাঃ আপনিতো কোন অশিক্ষিত গ্রাম্য বধু নন, যে স্বামীর অন্যায় অবিচার মুখ বুজে মেনে নেবেন, কোন উপায় নেই বলে। আপনি শিক্ষিত নারী। প্রচলিত আইন যে জানেন না তাও নয়। তাই আপনার নিজের সম্পর্কে সিদ্ধান্ততো আপনাকেই নিতে হবে, অন্যায়কে মেনে নেবেন না প্রতিবাদ করবেন। তারপর হেসে বললাম, যাই হোক, এটা আমার ব্যক্তিগত অনুযোগ মাত্র। আজ তাহলে চলি আবার দেখা হবে। শুভরাত্রি। যুঁথিও বললেন শুভরাত্রি। কিন্তু তাকে খুব বিষণ্ণ দেখায়।

বাসায় যখন ফিরলাম, তখন রাত ১১টা বেজে গেছে। ভয়ে ভয়ে বাড়ী ঢুলাম। কোথায় ভাবলাম পিসিকে আজ নতুন কথা শুনিয়ে অবাক করে দেবো, তা নয়। এযে দেখছি আষাঢ়ের মেঘ। আমি বেল দিতেই তিনি গেট খুলে দিলেন ঠিকই, কিন্তু কোন কথা না বলে ভিতরে ঢুকে গেলেন। আমি পিছনে পিছনে এসে দাঁড়ালাম পিসির পাশে। পিসি বললেন, কোথায় গিয়েছিলে? সে অনেক কথা তোমাকে পরে বলব। আর বলার দরকার হবে না। আমার সব জানা শেষ হয়ে গেছে। আমি কিছুই বুঝতে না পেরে বললাম, তোমার কি হয়েছে পিসি। তুমি এমন করে কথা বলছ কেন? পিসি আমার কথার কোন উত্তর না দিয়ে ড্রয়ার থেকে একটা সাদা খাম, যার উপরে সুন্দর পুরুষালী হাতে নীলাঞ্জনা নাম লেখা। আমার হাতে দিয়ে বললেন আমার ছাড়পত্র। তুমি পড়, তারপর বল আমার কী করণীয়। পিসি খামটা দিয়ে নিজের ঘর থেকে চলে গেলেন যে ঘরে আমি থাকি। আর তারপরে সে ঘরের বিছানায় নিজের দেহটা এলিয়ে দিলেন হয়তো কোন এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে। আমি খামটা খুলে পড়তে লাগলাম।

নীলাঞ্জনা,

তোমাকে আগের মতো হে আমার সন্ধ্যাকাশের তারা এই নামে ডাকতে পারলাম। জীবনের অনেক গুলো বছর তোমার সঙ্গে কাটিয়ে গেলাম নিখুঁত অভিনয়ের মধ্যে দিয়ে। অভিনয়ও তো কখনো কখনো ভালবাসায় পর্যবেশিত হয়। একদিন তাই তোমাকে সত্যিই ভালোবেসেও ছিলাম। পেয়েও ছিলাম তোমার কাছ থেকে ভালোবাসার প্রতিদান। কিন্তু যে বন্ধন এতদিন আমাদের এক সূত্রে গেঁথে দিয়েছিল আজ আর তা নেই। কেন নেই তারজন্য কাউকে অভিযোগ জানাব না। অপরাধের বোঝা সব নিজের ঘাড়ে নিয়ে তোমার জীবন থেকে সরে যাচ্ছি। ইচ্ছে করলে আমার বিরুদ্ধে তুমি কোর্টে যেতে পার। আমি আত্মপক্ষ সমর্থন করব না। যে মিথ্যে অভিনয় এতদিন তোমার সাথে নিখুঁত ভাবে করেছি, আমি মনে প্রানে বিশ্বাস করি তার শাস্তি হওয়া উচিৎ। তোমাকে ভুল বোঝাবার জন্য আমি দুঃখিত। হয়তো আর কোনদিনই তোমার সাথে দেখা হবে না আমার। যদি কোন নতুন জীবন বেছে নাও, আমি ঈশ্বরের কাছে তোমার ও তোমাদের মঙ্গল কামনা করবো পরিমল।

একবার নয়, বার বার পড়লাম পরিমলবাবুর চিঠি। তার মানে কাল তিনি যাবেন যুঁথির কাছে। যদি এই জীবনটুকু না জানতাম, ভালো হতো। নীলাঞ্জনা পিসির যেমন অনেক কথা বলার আছে, তেমনি যুথির যে অনেক কথা বল।অহ ৩ ব ক করে। এতদিনে, এত অবিচারের পরেও যুঁথি কি ভুলতে পেরেছেন পরিমলবাবুকে? না। পারেননি, তাহলে নীলাঞ্জনা পিসি বা ভুলবেন কি কবে? যৌবনের উষালগ্ন থেকে যাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছেন, স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করেছেন। আজ যদি হঠাৎ তা বালির বাধের মত ভেঙে নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যায় তাতেই কি মুছে যায় তার স্মৃতি রেখা। কি বলব পিসিকে সব মেনে নাও। একথাটা বলা যত সহজ, মেনে নেওয়াটা কি ততই সোজা? ভেবে দেখলাম সত্যিকারের অপরাধ যদি কেউ করে থাকেন তিনি পরিমলবাবু। আবার একথাও সত্য ভালবাসাতে কোন আইন মানেনা যে নিক্তিতে ওজন করে ভালবাসতে হবে। তবুও আমার মনে হয় পরিমলবাবু যদি বলতেন আমি তোমাকে সত্যি ভালবাসি নীলাঞ্জনা, কিন্তু সব ভালবাসাই যেমন মিলনে শেষ হয় না, তোমার আমার ভালোবাসাও মিলনে শেষ হবে না কারণ আমি বিবাহিত আর এদেশের আইন দ্বিতীয় বিয়েকে সমর্থন করবেনা। তাই আমাদের ভালবাসা শুধু ভালবাসাতেই তার পূর্ণতা পাক নীলাঞ্জনা। তাহলে পিসি হয়তো তার নিজের সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন।

আমি এখন বিশ্বাস করি যে পিসির এই দূরে সরে যাওয়াটা সত্যি না হলেও পরিমলবাবুকে একদিন পিসিকে ছাড়তেই হতো। কিন্তু কেন পরিমলবাবু এটা করলেন যুঁথি যথেষ্ট সুন্দরী বলে। আমারতো মনে হয় পিসির চেয়েও সুন্দরী। তাহলে? কেন যুঁথিকে দূরে সরিয়ে রেখে সেদিন পরিমলবাবুকে নীলাঞ্জনার কাছে আসতে হল? কেন মিথ্যা অভিনয়ে নীলাঞ্জনার বুকের মধ্যে পরিমলবাবু তার স্থায়ী আসন অধিকার করে নিলেন? যদি না জানতাম, মিথ্যে সন্দেহ করতাম হয়তো পিসিকে। বলতাম, এ দাম্পত্যকলহ একদিন মিটে যাবে পিসি এটাই নিয়ম, কিন্তু আমি যে জানি সব। আমার জানা কথাটি কি ভাবে যে বলব পিসিকে বুঝতে পারিনা। তবু আস্তে আস্তে ধীর পায়ে আসি একসময় আমার ঘরে যেখানে পিসি আছেন। বসি তার মাথার কাছে। আলতোভাবে আমার ডান হাতটা রাখি পিসির মাথায়। আর তাতেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে আমাকে তার বুকের পরে টেনে নিয়ে বলেন, আমি কি করব প্রান্তিক, আমাকে বলে দাও কি আমার করণীয়। পিসির কান্নার অশ্রুবিন্দু ছোঁয়াচের মতন আমাকেও সংক্রামিত করতে থাকে। আমিও ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম। তারপর বললাম, আমি জানি না পিসি, আমি কিছু জানি না, এখন কি তোমার করণীয়। তারপর একসময় নিজের চোখের জল মুছে নিয়ে, পিসির আঁচলে পিসির চোখের জল মুছে দিয়ে বললাম, জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে মেনে নিতে হবে পিসি। জানি আমি যা বলছি, এই মুহূর্তে তোমার ৩. পক্ষে তা মেনে নিতে কষ্ট হবে, কিন্তু এ ছাড়া পথ কি? পিসি কোন কথা না বলে, উঠে বসলেন, তারপর বললেন, জানতাম একদিন এমন কিছু ঘটবে, কিন্তু এত তাড়াতাড়ি যে ঘটবে তা ভাবিনি। আমি বললাম, তুমি যদি জানতে, তা হলে শুধু সময়ের হেরফেরের জন্য অভিযোগ করে কি লাভ? আমি শুধু বলব, পরিমলবাবু যতই নিখুঁত অভিনয় করুন না কেন তুমিতো করনি। তোমার ভালবাসা, তোমার একনিষ্ঠতা তাকে তোমার কাছে আবার ফিরিয়ে নিয়ে আসবে কীনা জানিনা। কিন্তু কেউ ছোট হয়ে গেল বলে তুমি নে ছোট হবে। পিসি বলেন, তোমার কথা ভাববে প্রান্তিক। একদিন মনে করতাম এত কাজ না করে ও একটা স্থির সিদ্ধান্তে আসুক, তাতে ও-ও বাঁচবে আমিও বাঁচব। কিন্তু শেষের সে দিন যখন সত্যিই এল তখন আমার বুকের মধ্যে এত ধড়ফড় করছে কেন? বলে তিনি আমার একটা হাত টেনে নিয়ে রাখলেন তার বুকের ওপর।

অসম্ভব ওঠানামা করছে তার হৃদপিন্ড। নাড়ীর গতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলেছে তার বুকের ওঠা নামা। তামি হাতটা সরিয়ে নিলাম। বললাম পিসি থেকে গিয়ে ভালো করে স্নান করো, আমি গীজারে জল গরম করে দিচ্ছি। যাব তার আগে আমাকে বলতো, তুমিও কি আমার সঙ্গে নিখুঁত অভিনয় করছো? একদিন তুমিও কি এমনি করে ছেড়ে যাবে আমাকে। আবার ডুকরে কেঁদে উঠলেন পিসি। আমি পিসিকে আমার বুকের পরে টেনে নিয়ে বললাম না পিসি কোনদিন তোমাকে ছেড়ে যাব না। আগেও বলেছি, আজ আবারও বলছি, তুমি তাড়িয়ে না দিলে আমি কোথাও যাব না। সত্যি? বলে তিনি আমার ওষ্ঠাধরে এক জ্বালাহীন চুম্বন এঁকে দিলেন। আর আমি? প্রতিদান দিলাম তার কপালে প্রতি চুম্বন এঁকে।

গতদিন কলেজ খুলেছে। ২/৩ দিন যেতে পারিনি, না রেহানার কাছে, না সেলিনার কাছে। তাই প্রথম কলেজ খোলার দিনটা কামাই করতে হল। সকালে চলে গেলাম হাসপাতালে। ডিউটিতে আছে তপতী। আমাকে দেখেই প্রচন্ড রেগে গিয়ে বলল, তুমি কি প্রান্তিক? আজ তিন দিন তুমি আসনা। রেহানাও আসে না। প্রথম ২ দিন যদিও বা কিছু খাইয়েছি, কাল যে সারাদিন কিছুই খায়নি। সারাদিন সে এক কথা বলেছে না দিদি, হয় প্রান্তিক ভাইয়ের কিছু হয়েছে, না হয় রেহানার অবস্থা আরো খারাপ হয়েছে। আমি কিছুই খাবনা। ডাঃ সরকার অনেক করে বোঝালেন কিন্তু তার সেই এক কথা, তোমাদের সংবাদ না পাওয়া পর্যন্ত সে কিছুই খাবে না। তারপর তপতী জানতে চাইল কি হয়েছিল তোমার? শরীর খারাপ, না রেহানার বাড়াবাড়ি কিছু হয়েছে? ওর মা-ই বা কেমন আছেন? কি করে বলি আমার নিজের অবস্থার কথা। রেহানার সংবাদ তো জানিনে ২/৩ দিন। ওতো অন্তত আসতে পারতো। তিন দিন আগে ওর সঙ্গে যখন দেখা হয়েছিল, তখনতো ওর শরীর অনেক ভাললছিল। যাকগে, ওসব কথা ভেবে লাভ নেই। আমি তপতীকে বললাম, পিসির শরীরটা কয়েকদিন ধরে ভালো যাচ্ছেনা। আমার তাই, রেহানাদের ওখানে বা এখানে কোথাও আসা হয়ে ওঠেনি। সেলিনা যে এতটা পাগলামি করবে তা ভাবতে পারিনি। যাকগে আমি এখন কি করব বলতো তপতী। ও অবাক হয়ে বলল আমি বলে দেব তোমাকে যে তুমি কি করবে? বললাম, দেখ আমার মনের অবস্থা মোটেই ভাল নয়, এটা ঠাট্টা করার সময় নয়। তুমি সেবিকা সেবাই তোমার ধর্ম রোগীর ভাল মন্দ তুমি যেমন বুঝবে আমি কি তা বুঝব। তাছাড়া আমিতো বুঝতেই পারছি না সেলিনা আমাকে দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে যাবে না শান্ত হবে। তপতী কি যেন ভাবলো খানিকক্ষণ। তারপর বলল। তুমি দেখা করে যাও প্রান্তিক। না হলে এ বেলাও খাবেনা। বেশ তাই হবে।

আমি যখন সেলিনার কাছে এলাম দেখলাম দেওয়ালের দিকে মুখ করে শুয়ে আছে ও। আমার উপস্থিতি টের পায়নি মনে হয় আমিও ডাকিনি তাকে ইচ্ছে করে। একটু পরে এল তপতী। আমি ওকে ঈশারায় না ডাকবার জন্য বললাম। ও একটু হেসে বেরিয়ে গেল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম, দেখা করার সময় প্রায় আধ ঘন্টা অতিবাহিত হয়ে গেছে, আর দেরি করলে হয়তো কথাই বলা যাবে না। ওর মাথায় আলতো হাত রাখতে আমার দিকে ফিরেই কেঁদে ফেলল। আমি তো ভীষণ অপ্রস্তুত। বললাম, ছিঃ সেলিনা কাঁদেনা। তুমি কাল সারাদিন খাওনি কেন? ও বলল, আমি কিছু খাবনা, আর আপনার সঙ্গে কথাও বলবনা। কেন এত রাগ করছ কেন? এ কয়দিন আসেননি কেন? আপনি আমাকে একটুও ভালবাসেন না, আমি আর এখানে থাকবোনা, আমি আজই বাড়ী চলে যাবো। আমি বললাম পাগলামি করেনা সেলিনা। আমি আজই ডাক্তারবাবুর সঙ্গে কথা বলে যাবো। তারপর ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললাম তুমি যে খেলে না কিছু, কাল সারদিন পোকও বদলালে না এতে তপতীদির দুঃখ হয় না? না হয় না। আমার জন্য কারও কোন দুঃখ হয় না। আমি বললাম, তুমিতো এমন ছিলে না। এমন হয়ে যাচ্ছ কেন? তপতীদি যা যা বলেন অবশ্যই করবে। তিনি তোমাকে ভালবাসেন। আমি বিকালে আবার আসবো। রেহানাকেও সঙ্গে নিয়ে আসবো। জানতে চাইল ও কেমন আছে? আগের থেকে ভালো। তারপর উঠে আসার আগে ওর একটা হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বললাম, তপতীদির কথা শুনবে না? ও মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো, হ্যাঁ শুনবো। আঃ কি শান্তি।

আমি বেরিয়ে এলাম। আর ও, আমি যতক্ষণ না অদৃশ্য হয়ে যাই এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আমার দিকে, কি যে চায় ও, কে জানে? মনটা ডুকরে কেঁদে উঠলো। নিজের চোখের জলকে চাপতে গিয়ে আর এক বার তাকিয়ে দেখি, এক দৃষ্টিতে ও আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। বললাম, আমি বিকালে আবার আসব। তপতী পাশেই ছিল বলল, অভিমান ভেঙেছে? বাবা। পারও বটে তুমি। কথাটা কেমন যেন বেসুরো লাগে আমার কানে। বললাম, তোমাকে সত্যি অসুবিধায় ফেলেছি তপতী। কিন্তু এ দায়িত্ব তো তুমি নিজেই গ্রহণ করেছিলে। আমি কি তা অস্বীকার করছি? না বরং তুমি তোমার দায়িত্ব ষোল আনার জায়গায় ১৮ আনা পালন করেছে আর তাতেই ওর ধারণা হয়েছে, আমাদের উপর অভিমান করার ওর সত্যি সত্যি অধিকার আছে। তারপর বললাম আর কয়েকটা দিন একটু দেখ তপতী। তপতী বলল, আমার কথায় রাগ করলে প্রান্তিক? কেন রাগ করবো কেন? তোমার উপর কি রাগ করা সাজে? কিন্তু যাকগে সেকথা, তুমি জানকি, ওকে আর কয়দিন হাসপাতালে থাকতে হবে? কাল ওর ব্যান্ডেজ খোলা হবে। সব ঠিক থাকলে কালই ছেড়ে দেওয়া হবে। সত্যি বলছ? নীরব আনন্দে দুচোখ আমার যেন উছলে উঠছে। তারপর বললাম, একেতো ডানপিটে মেয়ে, তারপর মা ও দিদিকে ছাড়া। এই হাসপাতালের বন্ধ ঘরে ওর নিঃশ্বাস যেন বন্ধ হয়ে আসছে। তা ছাড়া এখানে ও আর একদম থাকতে চাইছেনা। ঠিক আছে তুমি আর চিন্তা করোনা, ওকে যাতে ছেড়ে দেয় তার জন্য ডাক্তারবাবুকে যা বলার আমি বলবো। তারপর সম্পূর্ণ প্রসঙ্গান্তরে গিয়ে বললো এরপরতো তুমি আর আসবে না তাইনা প্রান্তিক। তপতীর একথার মানে হয়তো খানিকটা অনুমান করতে পারছি। বললাম, আসব না একথা তুমি ভাবলে কি করে? কেন আসবে? কার জন্য আসবে? গলাটা কেমন যেন ভারি মনে হয় তপতীর। বললাম কে যে কার জন্য কোথায় যায় আর কার জন্য কত কি ভাবে কেউ বলতে পারে? আমিতো তোমার জন্যও আসতে পারি তপতী? আমার জন্য ঠাট্টা করছ?

আমি ওকে বললাম, ঠাট্টা কিনা জানিনা, তবে এখানে যদি আসি তবে তোমার জন্যই আসবো। তপতী। আর কোন কথা না বলে ওর কাছ থেকে কোন প্রতি উত্তর না শুনেই, আস্তে আস্তে বেরিয়ে এলাম। না, রেহানা ততটা সুস্থ হয় নি। আমাকেই তাই আসতে হল সেলিনাকে নেওয়ার জন্য। হাসপাতালের সমস্ত কিছু মিটিয়ে দিয়ে আমি যখন ওকে নিয়ে আসব, সেই সময়ের মধ্যে একবারও আসেনি তপতী। আমি আয়াকে দিয়ে ওকে সংবাদ পাঠালাম। তবুও এলোনা। সেলিনা বলল, প্রান্তিক ভাই তপতীদি আসবেনা। আমি কি কোন অন্যায় করেছি ওর কাছে? নানা তুমি কেন অন্যায় করবে। তুমি একটু বোস, আমি আসছি।

ডিউটি ঘরে গিয়ে দেখি, তপতী তার দু হাতের মধ্যে মাথা গুঁজে বসে আছে। আমি ডাকলাম, তপতী। ও তাকালো আমার দিকে। কেঁদে কেঁদে চোখ দুটো লাল। আমি কিছুই বলতে পারলাম না। ও শুধু বলল, আমি যাব না প্রান্তিক। আমি কিছুতেই সেলিনার কাছে যাবো না। কেন? কেন জানতে চাইছো? আজ কতদিন হয়ে গেল। এই মান অভিমানের অতীত হয়ে গেছি আমি। নিজেকে শুধু যন্ত্রের মত মনে হয়েছে এই দীর্ঘ বছরগুলো। আর আজ এতগুলো বছর পরে মেয়েটা আমার সবকিছু কেড়ে নিয়েছে প্রান্তিক। সবকিছু। বললাম, এ তোমার ভুল তপতী। বল জীবন তোমার কানায় কানায় ভরে দিয়েছে। তোমার স্বজাতি নয়, তোমার ধর্মেরও নয়, অথচ কি তীব্র অভিমানে ওর সামনে যেতে পারছনা, এর কি কোন মূল্য নেই তপতী? আমি তো দেখেছি অনেক দিন, কি ছটফটে আর অফুরন্ত জীবনশক্তির একটা মেয়ে, এই আঘাতে মিইয়ে গেছে। ওকে তুমি ভুল বুঝো না তপতী। তপতী বলল আমি ওকে ভুল বুঝেছি, এই কি তোমার মনে হলো? তারপর বলল তুমি জানো প্রান্তিক আমার বুকের মধ্যে যে কি হচ্ছে? এখানে তো সম্ভব নয়, অন্য কোথাও হলে তোমাকে বলতাম, আমার বুকে হাত দিয়ে বলতে প্রান্তিক সেলিনা কি আমার কেউ নয়? ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল তপতী। অদ্ভুত এই মানব চরিত্র, কার জন্য যে কোথায় কে অপেক্ষা করে আছে কেউ জানে না। কিন্তু না, পারলামনা, ওর চোখের জল মুছিয়ে দিতে। শুধু বললাম, চোখের জল মুছে ফেল তপতী। আঘাত তোমার যতই তীব্র হোক তুমি বড়। সেলিনা চাইছে তুমি একবার অন্তত এস ওর কাছে। নিজের আঁচলে চোখের জল মুছে নিয়ে ও বলল, তুমি এগোও প্রান্তিক, আমি আসছি।

আসামাত্র সেলিনা ওকে জড়িয়ে ধরে বলল, আমার কথা তোমার মনে থাকবে তপতীদি? ওরে পাগলি মেয়ে তোকে কি আমি ভুলতে পারব। তুই যে আমাকে কি দিয়ে ভরিয়ে দিয়েছিস তুই নিজেও তা জানিসনে। তোকে শুধু একটা অনুরোধ জীবনে অনেক ঝড় ঝপটা আসবে, কেটেও যাবে, কিন্তু প্রান্তিককে কখনো কোন দিন ভুল বুঝিসনি ভাই। ঈশ্বর ওর মত মানুষকে মাঝে মাঝে পৃথিবীতে পাঠিয়ে প্রমান করতে চান যে পৃথিবী এখনো, বাসের অযোগ্য হয়নি। সেলিনা তাকালো আমার দিকে, তারপর কি মনে হতেই, হঠাৎ পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলো তপতীকে। আর তপতী ওকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে নিয়ে ওর কপালে পরপর কয়েকটা চুমু খেল। সেলিনা বলল, তা হলে তুমি কবে যাচ্ছ আমাদের ওখানে। যাবরে পাগলি যাব! বোধ হয় কান্না চাপতে পালিয়ে গেল তপতী। ট্যাক্সিটা ছাড়বার সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতেও পারলনা।

সারাটা পথ উদাস দৃষ্টিতে, গাড়ীর জানালা খুলে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকলো সেলিনা। একটি কথাও বললোনা আমার সাথে। আমি বললাম, মন খুব খাবাপ লাগছে তাই না? অথচ দেখ সেলিনা, হাসপাতাল থেকে চলে আসার জন্য কি আকুলতা তোমার। আর এখন সেই হাসপাতাল, ওখানকার প্রতিটি মুহূর্ত বার বার তোমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সেখানে। এই হয় সেলিনা। এই ভালবাসা, এই মমতা, এই মুগ্ধ স্মৃতি এটুকু বয়ে নিয়ে চলি বলেই আমবা মানুষ। কিন্তু আমার কথার কোন উত্তর দিল না সেলিনা। একবারও বাইরের দৃষ্টিকে ভিতরে এনে আমার দিকে তাকালোনা।

তারপর বেহানাদের ওখানে যখন পৌঁছালাম তখন রাত প্রায় ৯টা হয়ে গেছে। রেহানা তার দুর্বল শরীর নিয়ে এগিয়ে এলো। কানের পাশের কপালের ঘাটা প্রায় শুকিয়ে এসেছে, তবে দাগ যে কোনদিন মুছে যাবে না এটা নিশ্চিত। ট্যাক্সি থেকে নামতেই সেলিনাকে জড়িয়ে ধরল রেহানা। কিন্তু তার সাথেও কোন রকম কথা না বলে ভিতরে চলে গেলো সেলিনা। আফরোজ বেগমের অবস্থা এখন অনেক ভালো। সংসারের কাজও একটু একটু করে করা আরম্ভ করেছেন। সেলিনাকে কাছে টেনে নিয়ে কপালে একটা চুম্বন এঁকে দিয়ে ওকে ভিতরের ঘরে নিয়ে গেলেন। আমি বসার ঘরে বসলাম। রেহানা বলল, চা খাবে? না। সেলিনার কি হয়েছে বলত। কোন খারাপ সংবাদ কিছু আছে? আমি আঁতকে উঠে বললাম, কি খারাপ সংবাদ থাকবে বলতো। না হলে এতদিন পরে দেখা হলো, অথচ কোন কথাই বলল না আমার সাথে। সেতো আমার সাথেও বলেনি সারাটা পথ। গাড়ীর কাঁচ খুলে বাইরের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে কাটিয়ে দিল। রেহানা বলল কেন ও এসব করছে? আমাদের কি এসব ভাল লাগবে? আমি বললাম রেহানা, হাসপাতালে মানুষ অনেক আশা নিয়ে যায়, ফিরে আসে স্বপ্ন ভঙ্গের বেদনা নিয়ে। ও কিন্তু ফিরে এসেছে অনেক স্মৃতি নিয়ে। হাসপাতালের মায়ায় পড়ে গিয়েছে, কাটিয়ে উঠতে তো সময় লাগবে। তারপর জানতে চাই তুমি এখন কেমন আছো? ভালো। ছোট উত্তর। আমি বললাম যখনি জানতে চাই তখনি বল ভাল। কিন্তু তোমার চেহারা যে দিন দিন কত খারাপ হয়ে যাচ্ছে দেখ কি? ও তোমার মনের ভুল, না হলে আমি সত্যিই ভালো আছি। ভালো আছো না ছাই। আসলে তুমি আমার কাছে নিজেকে লুকাচ্ছো। আমাকে কি তুমি একটুও বিশ্বাস করতে পারনা। থাক ও সব কথা, ওই দেখ, তুমি চা খাবে না বলেছো, অথচ মা তোমার জন্য চা নিয়ে এসেছেন, চাটা খাও। আমি আসছি। আফরোজ বেগম বললেন, তোমার ঋণ কি ভাবে শোধ করব জানিনা। আমি বললাম, ছিঃ মাসীমা। ছেলের কাছে কি মায়ের কোন ঋণ থাকে নাকি? এ কথা শোনাও যে পাপ। আফরোজ বেগম আর কোন কথাই বলতে পারলেন না। রেহানা আসতে, উনি আবারও ফিরে গেলেন নিজের কাজে।

রেহানা, একটা মোটা খাম আমার হাতে দিয়ে বললো, এটা নাও। কি এটা। আগে ধর তারপর বলছি। আমি নিলাম ওর হাত থেকে। তারপর খুলতে যেতেই রেহানা বাধা দিয়ে বলল এখন নয়, পরে এক সময় খুলো। কেন? কি আছে এতে। আমার কৃতজ্ঞতা। তুচ্ছ করোনা প্রান্তিক। ও আর সামনে দাঁড়ালো না। আমি ডাকলাম, রেহানা শোন ও আবার এসে দাঁড়ালো আমার কাছে। বললাম বস। ও বসল। আমি বললাম, ওতে কি আছে আমি হয়তো অনুমান করতে পারছি। কিন্তু রেহানা, আমিও তো মানুষ। পশু বা দেবতা নই। ভুল যদি করে থাকি, তার শাস্তি এ ভাবেই দিতে হবে। তোমরা কি ভাবো বলতো আমাকে।

রেহানা আমার কথার কোন উত্তর না দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। আমি বললাম তোমার কিছুই বলার নেই? ও বলল, আছে। তবে বল। ওতেই যা বলার বলেছি। আমি বড্ড ক্লান্ত। ও প্রায় পড়ে যাচ্ছিল। আমি কোন ভাবে ওকে ধরে ফেললাম। কতক্ষণ ওকে ওই ভাবে ধরে ছিলাম মনে নেই। সম্বিৎ ফিরে পেলাম, ও যখন বলল, ছাড়, মা আসছেন। আফরোজ বেগম গরম গরম লুচি, বেগুন ভাজা আর মিষ্টি নিয়ে এলেন। বললেন, রাত অনেকটা হয়েছে, খেয়ে নাও বাবা। আপনি আবার এসব করতে গেলেন কেন? কই আর করলাম। আমাদেরও তো খেতে হবে। আমি দ্বিরুক্তি না করে খেয়ে নিলাম। আফরোজ বেগম বললেন, খাওয়া শেষ হলে একবার সেলিনার সঙ্গে দেখা করে যেও। ও কারো সঙ্গে কোন কথা বলছেনা। বলছে খাবেনা। আমি বললাম কেন? কি জানি বাবা, ওকেতো কোনদিনও বুঝিনি। আজই বা বুঝবো কি করে। আফরোজ বেগম চলে গেলে রেহানা তাকালে আমার দিকে। ওর চোখে কি যেন মায়া আছে। বেশীক্ষণ তাকাতে পারিনা, আপনিই চোখ নামিয়ে নিতে হয়। বললাম, কি হয়েছে বলত, কি করে বলি প্রান্তিক। সত্যিই মাঝে মাঝে নিজের উপর ঘৃণা হয়, ধিক্কার হয়। বললাম তুমিও চল, ও আবার তাকালো আমার দিকে তার সেই মায়াবী চোখ তুলে। বলল না তুমি যাও প্রান্তিক। আমি আর দাঁড়াতে পারছি না।

সেলিনা চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। ডাকলাম, সেলিনা। কোন উত্তর নেই। আবারও ডাকলাম, তেমনি নিরুত্তর। এবার ওর কপালে হাত ছোঁয়াতে চোখ মেলে তাকালো। বলল, আপনি এখনো যাননি প্রান্তিক ভাই? আমি ওর কথার কোন উত্তর না দিয়ে বললাম তোমার কি হয়েছে বলত। হাসপাতালে কি কিছু হয়েছে? কেন বলুনতো। না মাসীমা বললেন তুমি কারো সঙ্গে কথা বলছনা। এমন কি খাওনি পর্যন্ত। আমার খেতে ইচ্ছে করছেনা। তা কি হয়। সেই কখন খেয়েছে। খাবেনা কেন? খেয়ে নাও। বোঝনা কেন, তুমি না খেলে এরা খায় কি করে? আজ দুদিন ধরে তুমি রেহানার কথা একবারও জিজ্ঞাসা করনি। এখানে এসেও তুমি ওকে এড়িয়ে গেলে, কেন? ও সে সবের দিকে না গিয়ে বলল, কাল থেকে তো আর আপনি আসবেন না, তাই না? কে বলেছে? আমি জানি, আর আপনি আসবেন না। তারপর নিজেই বলল, আসতে হবে না। কেন আসবেন? আমরা আপনাকে দুঃখ ছাড়া কি দিয়েছি? আমি অবাক হয়ে বললাম, এসব তোমাব মাথায় কে ঢুকিয়েছে? তারপর তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য বললাম, যতদিন না তুমি সুস্থ হয়ে আবার বক্সিংএর রিংএ ফিরে না যাচ্ছ ততদিন রোজই আসব। ম্লান হেসে সেলিনা বলল, কেন মিথ্যে সান্ত্বনা দেন প্রান্তিক ভাই। আমিতো আর বক্সিংএর রিংএ ফিরতে পারবনা সেতো আপনি ভাল ভাবেই জানেন। তারপর যেন আপন মনে বলল, দরকার নেই রোজ আসার কিন্তু মাঝে মাঝে আসবেন বলন। বলে একটা হাত আমার ওর নিজের হাতের মধ্যে তুলে নিয়ে বলল, কেন যে প্রান্তিক ভাই বেঁচে ফিরলাম। এতদিনে আপনার পরিচিত সেলিনার যে মৃত্যু হয়েছে। দুটিচোখ দিয়ে ওর জল গড়িয়ে পড়ল। একবার ভাবলাম মুছে দিই। পরে মনে হল, না, ওর কান্নার প্রয়োজন। ভীষণ প্রয়োজন। বললাম ছাড় আমাকে যেতে হবে। রাত হয়েছে অনেক। ও আমাকে ছেড়ে দিল। তারপর বললাম, শোন যদি আগের মত হওয়ার চেষ্টা না করো তাহলে আর কোনদিন আসবোনা। আরেকটা কথা, নিয়মিত খেয়ে নেবে। মাকে কষ্ট দেবেনা। আপনি কষ্ট পাবেন না? জানিনা বলে ওর কাছ থেকে বেরিয়ে দেখি রেহানা দাঁড়িয়ে আছে। আমি আর ওর সঙ্গে কোন রকম কথা না বলে বেরিয়ে এলাম।

বহুদিন পরে অশ্রুকণার সঙ্গে দেখা হল কলেজ ক্যান্টিনে, অথচ কি অদ্ভুত আমাকে দেখেও না দেখার ভান করে চলে যেতে উদ্যত হতেই আমি বললাম, কি ব্যাপার চিনতে পারছনা? কেমন যেন হঠাৎ দেখা হয়েছে, তারই আনন্দের রেশ টেনে বলল, আরে প্রান্তিক। তুমি কি গ্রামের বাড়ীতে গিয়েছিলেন নাকি? বহুদিন কোন খোঁজ টোজ নেই। খোঁজ কি রাখার চেষ্টা করেছে? কেন বলত। না তা হলে জানতে পারতে আমি কোথায় আছি। ও তাই বল। তবে এর মাঝে তোমার পিসির সঙ্গে দেখা হয়েছিল জান? আমার পিসি? কই বলেননি তো। তোমার সঙ্গে দেখা হলেতো বলবে। আমি আসলে তোমার মিনতি পিসির কথা বলছি। মনে মনে বললাম মিনতি সেন। তারপর ওর দিকে তাকিয়ে বললাম, তোমার কি এখন ক্লাস আছে? না। তাহলে এস না চা খাওয়া যাক। আচ্ছা চল। চা ও টোস্টের অর্ডার দিলাম। তারপর ওকে বললাম, হ্যাঁ অনেকদিন যাওয়া হয় না মিনতি পিসির ওখানে। কেন যাওনি কেন? তোমার কথা অনেক করে বলেছিলেন। তোমার দাদুর অবস্থাও খুব ভাল না। প্রায়ই তোমার নাম করে বলে, প্রান্তিক এসেছে? পিসি যখন বলেন, যে না আসেনি, তখন আবার চুপ করে যান, তুমি একবার যেও প্রান্তিক। তোমার পিসি ও দাদু তোমার কথা খুব ভাবেন। আমি বললাম, হ্যাঁ এবার একদিন যাব। মনে মনে ভাবছিলাম তার আগে একদিন প্রতীম বাবুর সঙ্গে দেখা করতে হবে। ও বলল, কিছু বলছ? না, কিন্তু কণা, তুমি আমাকে জানাওনি কেন? আমিতো জানাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তোমার পিসি এমন করে না করলেন যে, আমি তোমার সঙ্গে দেখা পর্যন্ত করিনি এতদিন, যদি দেখা হলেই বলে ফেলি। তাহলে আজ কেন বললে? কি করে জানব এত দিনেও তোমার যাওয়া হয়নি। চা খেয়ে উঠে পড়লাম। ও বলল, চললে? হ্যাঁ, আমার ক্লাস আছে। ও আমি উঠতেই বলল, রেহানাকে দেখছিনা, ওকি কলেজে আসেনি? আমার সঙ্গে দেখা হয়নি। বলে আর কোন কথার অপেক্ষা করে বেরিয়ে এলাম।

দুর্গাপুরে একটি ফার্মে ম্যানেজারের পোস্টে চাকরি করতেন প্রতীমবাবু। কিন্তু ট্রান্সফার হয়ে এসেছেন লিলুয়াতে। ওখানে গিয়েই জানতে পারলাম। পরের দিন আবার তাই লিলুয়া। বেশ বড় ফার্ম। এখানকার সিনিয়র ম্যানেজার প্রতীম চৌধুরি। বড় বড় অক্ষরে নামের ফলক। আমি একজন স্বাক্ষাৎ প্রার্থী। স্লিপ দিয়ে অপেক্ষা করছি। প্রায় ১৫ মিনিট পরে, অনুমতি এল। আমি ঘরে ঢুকতেই উনি একবার চোখ তুলে তাকালেন আমার দিকে। সুন্দর সৌম্য চেহারা। প্রায় ৬ ফুট লম্বা গৌরবর্ণ ছিপছিপে মানুষটি। কানের কাছে জুলপির ২/১টা চুলে পাক ধরেছে। কিন্তু তা সযত্নে রক্ষা করা হয়েছে। গোফ কামানো। দামী ফ্রেমের চশমার মধ্যে দিয়ে চোখের ঈশারায় বসতে বললেন।

বেল দিতেই এক ভদ্রমহিলা ঢুকলেন। বললেন দু কাপ কফি। আমি অবাক হয়ে ভাবছি উনিকি তবে সব সাক্ষাৎ প্রার্থীকে কফি খাওয়ান? কি জানি? পরিমলবাবুও কলকাতার একটা মার্চেন্ট ফার্মে কাজ করেন। কোন দিনতো যাইনি, তাই জানিনে নিয়ম কানুন। কফি আসতেই, উনি এক পেয়ালা তুলে নিয়ে বললেন, কফিটা নিন, তারপর বলুন আমি আপনার জন্য কি করতে পারি? আমার জন্য? আমার ঘরেতো আর কেউ নেই। হাসলেন উনি, তারপর বললেন, ও আপনি ভাবছেন আপনার জন্য কফি কেন? না, আপনার জন্য আলাদা করে কফির অর্ডার দেওয়া হয়নি। আসলে আপনি আপনার সাক্ষাৎ প্রার্থনায় লিখেছেন, প্রয়োজন ব্যক্তিগত। তাই আপনাকে ইচ্ছে করে দেরি করে ডাকা হয়েছে। আমার সাক্ষাতের নির্দিষ্ট সময় শেষ। অবশ্য এর মাঝে কয়েকবার আপনার নামটায় চোখ বুলিয়ে নিয়েছি, আগে কখনো আপনার নাম শুনেছি কিনা! নিশ্চয়ই শোনেননি। আপনি কি মনে করেন শোনা উচিৎ? হাসতে হাসতে বললাম, কি যে বলেন। না না আমি সে সব কথা বলিনি। কথার পরে কথা বলতে হয় তাই বলা। উনি বললেন, তাহলে বলুন আপনার ব্যক্তিগত প্রয়োজনের কথা। আমি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম, আমার নাম প্রান্তিক। হ্যাঁ, মিপে তাই লিখেছেন। কি করেন আপনি? আমি ওনাকে বাধা দিয়ে বললাম, আপনি একজন কর্মব্যস্ত মানুষ। হয়তো অনেক অমূল্য সময় আমি নষ্ট করে দিচ্ছি। তবু এসে যখন পড়েছি, তখন কি আরেকটু সময় আমায় দিতে পারবেন? যদি বলেন, সম্ভব নয় তাহলে কবে সম্ভব হবে জানালে আমি সেদিন আসতে পারি। কতক্ষণ লাগবে? যদি আপনি কিছুই না বলতে চান তাহলে ১০ মিনিট আর যদি শুনে কিছু বলতে চান তাহলে অন্তত আধঘন্টা। বা আপনিতো বেশ মজার মানুষ। কি করেন? কিছুই করিনা। তবু। আমি এবার ফাঁইনাল ইয়ারের ছাত্র। ও তাহলে তো তুমি বলা যেতে পারে। নিশ্চিন্তে। আর তা হলে আমার পক্ষেও ভাল হয়। কেন ভাল হয় কেন? আসলে আপনি বললে অনেকটা দূরের বলে মনে হয়। তুমি বললে অনেকটা কাছের মনে হয় তাই আরকি। বেশ বল তাহলে।

আমি একটা গলা খাঁকানি দিয়ে বললাম, আপনার বাড়ীতে কে কে আছেন? কেউ। কিন্তু কেন? তাহলে বাড়ীতে গিয়ে বললে ভাল হয়। খুব কি গোপন কথা। মোটেই, কিন্তু অফিসে কথা বলতে বলতে দেখা গেল, আপনার কাজের ফাঁইল এসে গেছে, আমাকে থেমে যেতে হবে। তারপর আবার যখন আরম্ভ করব তখন হয়তো দেখব, যা বলছিলাম তা ভুলে গেছি, উনি একটু হাসলেন শুধু। তারপর বললেন, তুমি নিশ্চিন্তে বলতে পার। আপাতত এখানে কোন ফাঁইল আসবেনা। আমি কি বলব ভাবছি। উনি বললেন কই কিছু বললে না। বললাম, আপনার এখানে কেউ নেই, তার মানে বাড়ীর সব কি দেশের বাড়ীতে? তুমি চেন আমার দেশের বাড়ী? না চিনি না, তবে জানি। তারপর জানতে চাই আচ্ছা আপনার মা বাবা বেঁছে আছেন এখনো? না ওরা কেউ আর নেই এখন। আপনিতো বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান তাইনা? হ্যাঁ, কিন্তু এত কথা তুমি জানলে কি করে? সে তো পরের কথা, আপনি একা থাকেন মানে …। উনি বললেন তুমি জানতে চাইছো আমি বিয়ে করেছি কিনা তাইতো। হ্যাঁ। না করিনি। এরপরে তুমি জানতে চাইবে কেন করিনি। ঠিক তাই। কেন তোমার এসব কথা জেনে কি হবে। আমি বললাম আসলে আমি একটা বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের উপর সমীক্ষা চালাচ্ছি। যারা বিভিন্ন প্রাইভেট কনসার্নে এক্সিকিউটিভ আছেন, তাদের ব্যক্তিগত জীবন কাজকে কি ভাবে প্রভাবিত করে। উনি বললেন ভেরি ইনটারেস্টিং। এমন কোন সমীক্ষা হয়েছে বলেতো জানা নেই। তা কতদিন তুমি এটা করছ। তা বেশ কিছু দিন হল। কতজনের কাজের ধারা, তাদের ব্যক্তিগত জীবনের প্রভাব ইত্যাদি সমীক্ষা শেষ করেছে। তা কয়েকজনের হয়েছে। আসলে আমার কাছে আপনার যে ঠিকানা ছিল, তা দুর্গপুরের। আমি সেখানেই গিয়েছিলাম। কিন্তু শুনলাম আপনি আর ওখানে নেই। হ্যাঁ, সেতো অনেক দিন আগের কথা, পরে আমি জার্মানি যাই, এবং সেখান থেকে ফিরে বছর তিনেক হলো আমি এখানে জয়েন করেছি। বললাম খুব ভালকথা, আপনি কি মনে করেন একাকী জীবনে কাজ করা সহজ না সংঘবদ্ধ পারিবারিক জীবন থেকে তা সহজ। দেখ। তোমার এই ব্যাপারটা নিয়ে আমি কখনো ভাবিনি। তাহলে আপনি ভাবুন, আমি বরং পরে একদিন আসব। কোন প্রয়োজন নেই, আমার যা মনে হয় তাই তোমাকে বলতে পারি। তাইতো বলবেন, আমিতো আপনি যা মনে করেন তাই জানতে চাই। কি মনে হয় আপনার?

দেখ আমি একাকী থাকি। তাই সময়ও আমার অফুরন্ত ইচ্ছে করলে অনেক কাজ করতে পারি। তবে করেন না কেন? মাঝে মাঝে একঘেয়েমি মনে হয় তাই। এই একঘেয়েমি থেকে মুক্তি পেতে আপনি কি চান? কি আর চাইব। আমি বললাম পরিবার, সঙ্গ এসবতো জীবনে প্রয়োজন। উনি বললেন মাঝে মাঝে হতাশ মনে হয় নিজেকে। কেন কাজ করব? কার জন্য করবো? তাহলে অবকাশ সময় কাটান কি করে? কাটাবার তো বিভিন্ন উপায় আছে তবে আমার ভালো লাগেনা। কেন? একটা বিস্মৃত অধ্যায় মাঝে মাঝে আমাকে তাড়া করে ফেরে। আমি একটু চুপ করে থেকে বললাম, একটা কথা জিজ্ঞাসা করব? বল। আপনি কি কাউকে ভালবাসতেন? কেন বলতো? ঐ যে আপনি বললেন না একটা বিস্মৃত অধ্যায় তাই আর কি। কি হবে সে সব কথা শুনে। না আমি জোর করবনা। তবে যে সমীক্ষা আমি চালাচ্ছি, তাতে ঐ বিস্মৃত অধ্যায় সম্পর্কে জানতে পারলে আমার ভাল হতো। আমার কাজের সুবিধা হতো। নাম ধাম গোপন করে ঘটনা বলতে কি আপনার আপত্তি আছে। না তা নেই তবে সে সব অতীত অতীতই থাকুক না। ঠিকই বলেছেন, অতীতের তো অতীতেই থাকা উচিৎ বর্তমানে তাকে টেনে এনে যন্ত্রণা বাড়ানো কেন? কিন্তু অতীতকে ভুলে থাকাকি অতই সহজ? না, স্যার তা মোটেই সহজ নয়। এই যেমন ধরুন, প্রানপনে আপনি আপনার অতীতকে ভুলতে চাইছেন, কিন্তু পারছেন কি? যদি পারতেন তাহলে তো আপনাকে এই নিঃসঙ্গ জীবন কাটাতে হতো না। তারপর বললাম আপনার কাছে তা অতীত নয় বলেই তো এখনো অপেক্ষায় আছেন আপনি তাইনা? চমকে উঠলেন প্রতীম চৌধুরী। তিনি কি সামান্য সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখছেন আমাকে?

একটা দীর্ঘশ্বাস টেনে নিলেন প্রতীম চৌধুরী। তাকালেন আমার দিকে। তারপর বলেলেন ভাবছি কি হবে তোমাকে সে সব কথা বলে? না আমাকে বলে হয়তো আপনার প্রতীক্ষার অবসান হবে না, তবু আমার এই ছোট্ট জীবন দিয়ে বুঝেছি নিজের দুঃখের বোঝ কাউকে না কাউকে ভাগ করে দিতে হয় এবং তা বললে মনটা হয়তো একটু হাল্কা হতে পারে। উনি বললেন বেশ আমি বলছি, কিন্তু তোমাকে কথা দিতে হবে প্রান্তিক, একথা আর কেউ জানবেনা। তোমার গবেষণা পত্রেও এ ঘটনার কোন ছায়াপাত ঘটাবে না তুমি। কথা দিলাম। উনি ধীরে ধীরে বললেন, না জীবনে কোন মেয়েকে কোনদিন ভালবাসিনি। আসলে ক্যারিয়ার এবং পড়াশোনার বাইরে যে একটা জগৎ আছে তাই আমার জানা ছিল না। তারপর একদিন একটি মেয়ের সঙ্গে আমার বিয়ের কথা হয়। পছন্দও হয়। মনে মনে স্বপ্নও দেখি ওকে নিয়ে। একটু থামলেন প্রতীম চৌধুরী। বললেন কফি খাবে? যদি আপনি খান তাহলে আপত্তি নেই। বেয়ারা এলে উনি কফির অর্ডার দিলেন এবং বললেন, আধ ঘন্টা পরে দুই প্লেট লাঞ্চ। উনি তারপর বলে চললেন, পাকা দেখার দিন, কি হয়েছিল জানিনা, সব কিছু ঠিক ঠাক হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও এ বিয়ে হল না। মেয়েটির মা আত্মহত্যা করলেন। ওর বাবাকে পুলিশ এ্যারেষ্ট করলেন। জেল হল তার পরে একদিন জেল থেকে ফিরেও এলেন, চরম ট্রাজেডির মুখোমুখি দাঁড়িয়েও আমরা কিন্তু রাজী হয়েছিলাম। কিন্তু মেয়েটি রাজী হলেন না। স্বপ্ন ভেঙে গেল প্রান্তিক। তবু আজো আমি সেই স্বপ্নই দেখি। বললাম মেয়েটির সঙ্গে আপনার আর দেখা হয়নি কোন দিন? না। কেন দেখা করেননি কেন? ভয়ে। কিসের ভয়? যদি মুখের পরে দরজা বন্ধ করে দেয়। আমি বললাম চিঠি লিখেও তো জানতে চাইতে পারতেন তার মনের কথা! তুমি ঠিকই বলেছো। আমি আমার মনের কথা তাকে জানিয়েছিলাম। কিন্তু ভালোবাসার চিঠিতে কোন দিন লিখিনি হয়তো তা লেখার জন্য আলাদা মুন্সিয়ানার দরকার। যা হৃদয়কে ছুঁয়ে যেতে পারে। আমার চিঠিটা ছিল খুবই সোজাসুজি। জানিয়েছিলাম, আমি অপেক্ষা করতে রাজী। মৃদু হেসে বললাম, তিনি কি উত্তরে কিছু বলে ছিলেন? না প্রান্তিক। তাই এখন যদি জানতে চাও তার ঠিকানা আমি জানি কীনা। কিন্তু জানলেও সে ঠিকানা তো আমি তোমায় দিতে পারব না প্রান্তিক।

অনেকক্ষণ চুপচাপ। এর মাঝে কফি এল। নীরবে দুজনেই কফি খেলাম। তারপর আমি বললাম। আজো কি আপনি তার অপেক্ষায় আছেন। ঠিক জানিনা। তবে নতুন কাউকে জীবনের সঙ্গে মেনে নিতে পারিনি। সেতো দেখতে পারছ। আমি বললাম, আপনার এই নীরব পূজার মানে কি? এতো অর্থহীন। আর সত্যি সত্যিই যদি মন থেকে তাকে চান, খুঁজে বের করুন তাকে। দাঁড়ান তার মুখোমুখি, বলুন আপনার কথা নিজের অধিকারকে দাবী করুন তার কাছে। ভয় হয় প্রান্তিক ভীষণ ভয় হয়, যদি আবার ফিরিয়ে দেয়। দিলেনই বা। পৃথিবীর সব দাবী কি কারো মেটে? তাই বলে দাবী করার অধিকার যার আছে, সে কি দাবী করতে ভুলে যাবে? কি করে বুঝবো আমার দাবীর অধিকার আছে? এক নিঃসঙ্গ বিষণ্ণতা ধরা পড়ে তার কণ্ঠে।

আমি আস্তে আস্তে বললাম, তা অবশ্য ঠিক, কিন্তু তবু আপনাকে অনুরোধ করব, আপনি তার কাছে যান, বুঝুন তাকে। হয়তো এমনও হতে পারে, আপনারই অপেক্ষায় আজো বসে আছেন তিনি পথ চেয়ে। এরপর জোর দিয়ে বললাম কেন দুটো জীবন এমন ভাবে ব্যর্থ হয়ে যাবে? কোথায় খুঁজবো তাকে? কেন যেখানে তারা থাকতেন, সে ঠিকানাতো আপনার জানা। সেখানে কি তারা নেই? জানি না প্রান্তিক কিছুই জানিনা আমি, আমার ভয় হয় কি জান? কি? তুমি ওয়ার্ডসওয়ার্থের সেই বিখ্যাত কবিতা পড়েছো? কোন কবিতা। ঐ যে ইয়াররা আনভিসিঢেউ এবং ইয়াররা ভিসিঢেউ। এখনো সে বেঁচে আছে আমার স্বপ্নে। কিন্তু গিয়ে যদি সে স্বপ্ন মায়ামরীচিৎকার মতো মিলিয়ে যায়। বললাম হয়তো বাস্তবের মুখো মুখি দাঁড়িয়ে একথা মনে হতে পারে আপনার। তাতে কি? স্বপ্ন আর বাস্তব যে এক নয় এটাও তো আপনার জানা দরকার। তারপর বললাম বলবেন কি তার ঠিকানা যদি কোন উপকারে আসে। না থাক প্রান্তিক। আমার সত্য আমার কাছেই থাক। তাকে গবেষণাগারে ফেলে লাভ নেই। তবে যদি কোন দিন চলতি পথে তার সাথে দেখা হয় নিশ্চয়ই জিজ্ঞাসা করবো, আমার সেদিনের চিঠির উত্তর তিনি দিলেন না কেন? আর যদি এমন হয় আপনার চিঠির উত্তর তিনি দেননি ঠিকই, কিন্তু তিনিও তার জীবন বয়ে নিয়ে চলেছেন একাকিনী নিঃসঙ্গ তপস্বিনীর মতো আপনারই প্রতীক্ষায়। দিন গুনে গুনে, কি করবেন আপনি? আবেগে। আপ্লুত কণ্ঠ। বললেন জানিনা কি করব। সত্যি আমি জানিনা আমার কী করা উচিৎ।

আমার জানার যা তা জানা হয়ে গেছে। এবার আমাকে উঠতে হবে। অথচ উনি লাঞ্চের অর্ডার দিয়েছেন, তাই বসতে হয়। বললাম, জীবনে যদি এমন শুভ মুহূর্ত কোন দিন আসে। আমাকে জানাবেন তো? উনি বললেন তোমার ঠিকানাটা দাও। আমি ঠিকানাটা লিখে তার দিকে এগিয়ে দিলাম। লাঞ্চ এলো। খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম।

রেহানার চিঠিটা পড়েছি বেশ কয়েকবার। কি যে ও বলতে চায়, বার বার পড়েও উদ্ধার করতে পারিনি। কেন যে এত চাপা আর এত অস্পষ্টতা নিয়ে ও এগিয়ে চলেছে কে জানে। একবার বলেছে তোমাকে ছাড়া আর কাকে বলব? আবার বলছে আমায় ক্ষমা করো তোমাকে এসব কথা বলছি বলে। চিঠিটা আরেকবার পড়ি আমি। লিখেছে রেহানা।

প্রান্তিক।

আমি জীবনে কাউকে কোনদিন কোন চিঠি লিখিনি। লেখার প্রয়োজনও হয়নি। আজ তোমাকে লিখছি, মুখে সব কথা বলতে পারবনা বলে। তোমার ঈশ্বর আর আমার আল্লাহ কেউ বোধ হয় চায়নি, আমরা এক সাথে পথ চলি। মানুষ যে কেন, এমন করে প্রতিরোধ খাড়া করে বুঝতে পারিনা। তোমাকে বোধ হয় ডালিমের কথা বলিনি কোনদিন। ওকে একদিন ভাল লেগেছিল। আস্তে আস্তে বোধ হয় ভালও বেসে ছিলাম, কিন্তু কি যে হলো জানিনা, ও সেলিনাকে যে ভাষায় চিঠি লিখলো ঘৃণায় তা উচ্চারণও করা যায় না। ভুলে গিয়েছিলাম সব। ডালিম নামের কোন ছেলে যে এই পৃথিবীতে বাস করে তাও মনে হয়নি পরে কোনদিন।

এর মাঝে পরিচয় হলো তোমার সাথে। আস্তে আস্তে কেমন যেন দুর্বল হয়ে যেতে লাগলাম, সেলিনা আমার থেকে ২ বছরের ছোট। কিন্তু ও আমার সব থেকে কাছের বন্ধু। আমার দুর্বলতাকে আরো দুর্বল করে দিয়ে আমাকে পৌঁছিয়ে দিতে চাইল তোমার কাছে। জানিনে কতটুকু পৌঁছাতে পেরেছিলাম। কিন্তু চেষ্টার ত্রুটি করিনি প্রান্তিক। তোমার আর ডালিমের মধ্যে আছে এক দুস্তর ব্যবধান। তুমি তোমাকে বুঝতে দাওনা, আর ডালিম, সে তার অধিকার জোর করে ছিনিয়ে নিতে চায়, আর তার জন্য কোন নিষ্ঠুরতাই যেন তার কাছ কোন বাধা নয়।

নিজেকে প্রস্তুত করেছিলাম যাব তোমার সাথে, জানি অনেক বাধা আছে, তবু আমি চেয়েছিলাম তোমার সঙ্গে একাকী কাটিয়ে দেব কয়েকটি দিন। আগের দিন রাতেই বলছিল সেলিনা যে সে যাবে না। ওকে অনেক করে বলেছিলাম, কিন্তু ওর ওই এক কথা, না রেহানা তোরা যা। আমি এ কয়দিন খিদিরপুর মাসির ওখানে গিয়ে থাকবো। মাও যাবেন আমার সাথে ঠিক হয়েছিল। কিন্তু পরদিন সব গোলমাল হয়ে গেল।

ডালিম এলো আরো কয়েকটি ছেলেকে নিয়ে। ওতো আসেনা বহুদিন। সেলিনা প্রথমে ওদের ঢুকতে দিতে চায়নি, কিন্তু মা বললেন আসতে দে ওদের। শোন ওরা কি বলতে চায়। সেলিনা ওদের বসবার ঘরে বসতে বললে মা বললেন না ওদের ভিতরের ঘরে নিয়ে আয়। ওরা ভিতরের ঘরে গেলে আমিও গেলাম ও ঘরে। আমার চোখের পরে চোখ রেখেডালিম বলল, তোমরা নাকি একটা কাফের ছেলের সাথে তাদের গ্রামে যেতে চাইছে। সেলিনা বললো, এ ভাবে কথা বলছেন কেন? কাফের বলে আমাদের কাছে কিছু নেই। হ্যাঁ, ওর সাথেই ওদের গ্রামের বাড়ীতে যাব আমরা। না যেতে পারবেনা এটা আমার আদেশ। আদেশ? আপনার বোধ হয় সেদিনের কথা মনে নেই সেলিনা বলল। ডালিম তার উত্তরে বলে আছে। আর আছে বলেই আমরা সেই ভাবে প্রস্তুত হয়ে এসেছি। কি বলতে চান আপনি? ডালিম বলল, আমি মৌলবীকে বলে এসেছি, আজই রেহানার সাথে আমার বিয়ে হবে?

বিশ্বাস কর প্রান্তিক, আমি মাটির সাথে মিশে যেতে লাগলাম। বলে কি এবা? এটা কি মধ্যযুগ নাকি? আধুনিকতার শিক্ষা কি এরা পায়নি? বললাম, এ তুমি কি বলছ ডালিম। তুমিতো শিক্ষিত ছেলে। প্রেসিডেন্সিতে পড়াশোনা করেছো। জোর করে কাউকে বিয়ে করা যায় নাকি? ওদের মধ্যে একজন ছিলেন নুরুজ্জমান, সেও ভালো ছেলে, বলল এক হিন্দু কাফের তোমাকে শয্যাসঙ্গিনী করবে সেটা বুঝি ভাল হবে? আজকেই তোমাদের দুই বোনের সঙ্গে আমাদের বিয়ে হবে। সেলিনা বলল, আবদার নাকি?

এই সময় বেল দিলে তুমি। কয়েকবারই দিলে। সেলিনার ঐ অবস্থায় তোমাকে ফিরিয়ে দেওয়া ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না। আমি জানালা দিয়ে বিমর্ষ ভাবে তোমার ফিরে যাওয়া দেখলাম। কিন্তু তোমাকে ডাকতে পারলাম না। পারলাম না আমাদের চরম লজ্জার মধ্যে তোমাকে নিয়ে আসতে।

এতক্ষণে মা বলল, তোমরা কি বলতে চাইছো ডালিম। তোমাদের কারো সঙ্গে আমি আমার কোন মেয়েরই বিয়ে দেবোনা। তোমরা বেরিয়ে যাও। সেলিনা বলল ডালিম ভাই, ভাল ভাবেই বলছি আপনারা বেরিয়ে যান, তা না হলে কিন্তু অপমানিত হতে হবে। ডালিম উদ্যত হয়ে বলল অপমানিত হতে হবে? একজন কাফেরের রক্ত কি আমার রক্তের থেকে দামী। তাহলে আজই সেই রক্তের দাম আমাকে মিটাতেই হবে? বলতে বলতে এগিয়ে গিয়ে সেলিনাকে টেনে নিল ওর বুকের মধ্যে তারপর বীভৎস ভাবে জোর করে তার কোমাৰ্য্য লুষ্ঠিত করতে চাইলে দরজার ডাঁসা দিয়ে ডালিমের মাথায় আঘাত হানেন মা। আমি ভয়ে লুটিয়ে পড়ি মেঝেতে। তবু ওর মধ্যে থেকে দেখি, ডালিম পড়ে গিয়েও মায়ের হাত থেকে কেড়ে নেয় সেই ডাশা, এবং তাই দিয়ে আঘাত হানে মায়ের ডান হাতে, মা পড়ে যান। কিন্তু তাতেও লম্পটটা ছাড়ে না, ঐ উঁশা দিয়ে মায়ের পায়ে আঘাত করলে, সেলিনা কোন ভাবে নিজেকে ছাড়িয়ে রান্না ঘরে গিয়ে বড় আঁস বটিটা নিয়ে এসে আক্রমণ করে ওদের। নুরুজ্জমান সহ তিনজন পালিয়ে যায়। কিন্তু ডালিম শেষ বারের মত চেষ্টা করে আমাকে তুলে নিয়ে যেতে। কোন ভাবে সেলিনার বটির একটা কোপ বাঁচিয়ে, নিজের পকেট থেকে পিস্তল বের করে গুলি করে সে সেলিনার মাথা লক্ষ করে। গুলিটা কানের পাশ দিয়ে মাথার একটা অংশ ক্ষত করে বেরিয়ে যায়। সেই অবস্থাতেই আমি শরীরের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে ওর কাছ থেকে নিজেকে ছিনিয়ে নিয়ে সেন্নিকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরি। ডালিম ততক্ষণে আবার গুলি করে, কিন্তু তা সেলিনার পায়ে লাগে, এবার আমি ভয়ংকর মুর্তিতে সেই আঁস বটি নিয়ে এগিয়ে যাই ডালিমের দিকে। সম্ভবত ওর পিস্তলে আর গুলি ছিল নাওকোন ভাবে পালিয়ে যায়। আমি তখন ভয়ংকরী।

আমার শাড়ী কোথায় জানিনা, ব্লাউজ ছিন্ন বিচ্ছিন্ন। ডালিমের নিষ্ঠুরতায় ঠোঁট দিয়ে রক্ত ঝরছে, মা জ্ঞানহীন। আর সেলিনা নারীর শেষ কৌমাৰ্যটুকু যদিও রক্ষা করেছে, কিন্তু হায়েনার দাঁতের আঘাতে সমস্ত দেহ ক্ষতবিক্ষত। সে কি দুর্বিসহ অবস্থা। তোমাকে বলে বোঝাবার নয়।

কি করব আমি, শরীরে এক বিন্দু শক্তি নেই। অথচ ডাক্তার ডাকতে হবে। মনে মনে চাইছিলাম আর প্রার্থনা করছিলাম হে করুণাময় আল্লাহ প্রান্তিককে এই সময় একবার আমার কাছে পাঠিয়ে দাও। আমার এই আকুল আহ্বান বধির আল্লাহর কানে পৌঁছালনা। কোন ভাবে শাড়িটা খুঁজে পেয়ে তা দেহের সঙ্গে পেঁচিয়ে নিয়ে আমাদের মোড়ে যে ডাঃ সরকার আছেন, তার কাছে গিয়ে কেঁদে পড়লাম। তিনি বললেন কি হয়েছে মা। সব সংক্ষেপে খুলে বললাম তাকে। তিনি এলেন দেখলেন, তারপর সেলিনাকে হাসপাতলে পাঠাবার ব্যবস্থা করে মাকে বাড়ীতেই যা করার করলেন। পুলিশে সংবাদ দিলেন ঐ ৪ জনকেই এ্যরেষ্ট করা হল। তারপর কি হয়েছে জানিনা।

আজ ভয় হয় প্রান্তিক, কি হবে সেলিনার ও মায়ের। আমার কথা ভাবিনা। নিজের মৃত্যুর পরওয়ানা নিজেই লিখে দিয়ে যাব একদিন। কিন্তু ওরা? ওদের কি হবে?

জানি, একদিন আমার কাছে জানতে চাইবে সব। পারবনা মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এসব কথা বলতে। তাই তো আগে থেকে লিখে জানিয়ে দিলাম সব। আমার আর কিছুই বলার নেই প্রান্তিক। তোমার জীবনে আমার দুঃখের বোঝা নামিয়ে দিতে চাইনে। যদি কোন মুহূর্তে কোন দুর্বলতা তোমাকে স্পর্শ করে থাকে তার জন্য আমায় ক্ষমা করো। ভেবেছিলাম কোন কথাই বলব না তোমাকে কিন্তু কেন যে জানালাম তার উত্তর জানিনা। তুমিও জানতে চেয়োনা–রেহানা।

সেলিনাদের গোটা পরিবারের ঘটনায় এমন যে কিছু একটা থাকতে পারে অনুমান করেছিলাম। কিন্তু ডালিম যে সেই ঘৃণ্য ঘটনার নেতৃত্ব দিয়েছে ভাবতে পারিনি। সেলিনার কাছে ডালিমের কথা শুনেছি, মানে সেলিনা যতটুকু বলেছে, তাতে ডালিমের ঐ ব্যাপারটি যৌবনের এক হঠাৎ খেয়াল বলে মনে হয়েছিল। তাকে অত হিংস্র বলে কখনো মনে হয়নি। প্রেসিডেন্সির শিক্ষিত ছেলে কেন এত হিংস্র হবে। আর মধ্যযুগীয় বর্বরতা? এতো অসহনীয়। কিন্তু তাই বলে ঘটনার গুরুত্বকে অস্বীকার করা যায় না। একদিনতো ফিরে আসবে ডালিমরা, সেদিন যে আবার প্রতিশোধের নেশায় মেতে উঠবে না কে বলতে পারে। কিন্তু আমিই বা কি করতে পারি। কতটুকু ক্ষমতা আমার। আমি আমার জীবন দিয়ে এদের পাশে দাঁড়াতে পারি, আমার ক্ষুদ্র সামর্থ দিয়ে এদের সাহয্য করতে পারি, তার বেশি ক্ষমতা কোথায়? আর ডালিমদের মোটেই ছোট করে দেখা উচিৎ নয়। ওরা ভয়ংকর বিষধর সাপ। ছোবল মারার প্রতিক্ষায় থাকবেই। কি করব। কি করা উচিৎ কোনটাই বুঝতে পারছি না। রেহানাদের সংবাদও জানিনা ২/৩ দিন। কোন দিনই আমি আইন-আদালতের পাতা দেখিনা। কিন্তু আজ নিজের অজান্তেই চলে আসি এই পাতায়। হঠাৎ দেখি আগামী সোমবার একটি বিশেষ কেসের শুনানী হবে। আসামি ডালিম নুরুজ্জমান সহ চারজনকে সেদিন কোর্ট প্রাঙ্গণে আনবার জন্য পুলিশকে মহামান্য বিচারক আদেশ জারী করেছেন, চোখটা আটকে গেল ওখানে। কয়েকবারই পড়লাম লাইনগুলো। না কোথাও রেহানা, সেলিনা বা আফরোজ বেগমের কথা নেই।

চিন্তায় আছি ভীষণ। রেহানাদের যা অপমান ওদের হাতে হতে হয়েছে, ওতেই যেন শেষ হয় সব আর যেন কোন অপমান আদালত প্রাঙ্গণে না হয়। কারণ যদি ওদের সাক্ষী হিসেবে এই আদালতে আনতে হয়, তা হলে উকিলের উল্টো পাল্টা প্রশ্নে বেআব্রু হওয়া ছাড়া কোন উপায় থাকবে না।

কলেজ থেকে সোজা বাড়ী না ফিরে শিয়ালদা স্টেশান এবং সেখান থেকে ট্রেনে ঢাকুরিয়া, কে আমাকে নিয়ে এল আমি জানিনে। আমার এখানে আসার কোন পূর্বপরিকল্পনা ছিল না অথচ এলাম। কতদিন পরে। ঘড়িতে দেখলাম প্রায় ৪/৩০, তার মানে মিনতি সেনের ফিরে আসার সময় হয়েছে, আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলাম বাড়ীর দিকে।

বেল দিতেই এক ভদ্রমহিলা দরজা খুলে দিলেন। কাকে চাই? আমি বললাম, পিসি, মানে মিনতি সেন আছেন? আপনি ভিতরে আসুন। ভিতরে গিয়ে দেখি, মিনতি সেনের বাবার অবস্থা বেশ খারাপ। মিনতি সেন তাই কয়েকদিন অফিস থেকে ছুটি নিয়েছেন। আমাকে দেখে বললেন, প্রান্তিক তুমি এসেছো? তোমার কথাই ভাবছিলাম। কয়েকদিন ধরে বাবা শুধু তোমার নাম করছে। তুমি একটু বোস বাবার পাশে। আমি বসলাম তারপর আস্তে ডাকলাম দাদু। বৃদ্ধ চোখ মেলে তাকালেন। দৃষ্টি ঘোলাটে। তবু আমাকে চিনতে পারলেন, আমার একটা হাত তার দুর্বল হাতের মধ্যে তুলে নিয়ে বললেন, এতদিন আসনি কেন দাদু। আমি আর কি বলব, উনি আমার হাতটা নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে আবার চোখ বন্ধ করলেন। মিনতি সেন মিনিট দশেকের মধ্যে ফিরে এলেন। বললেন, কলেজ থেকে আসছ? হ্যাঁ। তারপর যে ভদ্রমহিলা আমাকে দরজা খুলে দিয়েছিলেন তাকে বললেন, জবার মা, তুমি প্রান্তিক কে কিছু খেতে দাও। আমি বললাম দরকার নেই পিসি। উনি বললেন, দরকার তোমার নেই, কিন্তু আমার আছে। তুমি তাড়াতাড়ি খেয়ে এসো তোমাকে একটা কাজ করতে হবে। আমি আর অন্যথা না করে তাড়াতাড়ি খেয়ে এলাম। উনি বললেন স্টেশান পেরিয়ে গেলে দেখবে ডাঃ অমল মজুমদারের চেম্বার। তোমাকে একবার তাকে নিয়ে আসতে হবে। যাবে আর আসবে। একদম দেরি করবে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *