০১. ভালোবাসার থেকে বড় আর কিছু নেই

আমার কাছে মানুষের ভালোবাসার থেকে বড় আর কিছু নেই। জীবনে এর থেকে বড় কোন সম্পদ আছে কিনা আমার জানা নেই। আমি মনে করি না শুধু, বিশ্বাস করি মানব সভ্যতাই গড়ে উঠেছে মানুষের ভালবাসার মধ্য দিয়ে, তার মধ্যে আবার নর-নারীর ভালবাসার থেকে মহৎ আর কিছু নেই।

ধূসর বিকালের গোধূলি লাল আভায় বিস্তারিত সবুজ মাঠের উপরে তার আলোকছুটা এক মায়াবী কল্পনায় আমাকে নিয়ে যায় সেই অতীত বেলা ভূমে যেখানে আমার সঙ্গে নিত্য পথ চলতো আমার ভালবাসা, আমার স্বপ্ন, আমার কল্পনা, আমার ঘৃণা, আমার দ্বন্দ্ব, আমার দুর্বলতা, আমার ভীরুতা, আমার প্রাপ্তি আর অপ্রাপ্তি।

হিসাবের খাতা উল্টিয়ে দেখি কোন হিসাবই মেলেনি। হিসাব মেলেনি তাদেরও যারা স্বপ্ন ও বাস্তবকে নিয়ে হিসাব মিলাতে চেয়েছিল। কেন তাদের হিসাব মেলেনি? জীবনের চোবাবালিতে কেন তাদের পথ হারাতে হল? সে দুর্গম রহস্যের সমাধান হয়তো কোনদিনই হবে না। আর এটাই তো জীবন। তাই বলে হিসাব যে একেবারেই মেলেনি কথাটা কি এত জোর দিয়ে বলা যাবে? তারা তো বেঁচে আছে–কখনো সমুদ্রে, কখনো পাহাড়ে, আবার কখনো বা এই সমতলের ধানের শিষে ভোরের শিশিরের সুরভিতে।

ভোরের শিউলিতে খুঁজে ফিরি তার পরশ, শিশিরে পেতে চাই তার স্পর্শ, ভোরের বাতাস কখনোবা নিয়ে এসেছে তার ঘ্রাণ, সন্ধ্যার কুহেলিতে দেখেছি তার অবয়ব, অথচ তাকে পাইনি, যে আমার অধরা আর অনাঘ্রাতা, আমার স্বপ্নকে ভেঙে করেছে চুরমার। কেন এমন হল, কেন জোর করে ছিনিয়ে নিতে পারলাম না তাকে?

কে আমি কোন অধিকারে তার নাগাল পেতে চাই? জীবনে যে জল রঙের ছবিই আঁকতে পারল না তার সাধ হয় কি করে অমুর্তকে মুর্ত করার। ধরতে পারে কেবল মাত্র সেই যার সে অধিকার আছে। আমার তো সে অধিকার নেই। তবু না মেলা অংককে বার বার মিলাবার ব্যর্থ প্রয়াসে ভাবি জীবনের সব কিছুই কি মিথ্যে? হিসাব যে মিলাতে চেয়েছিলাম, তার কি কোন মূল্য নেই? নিজের জীবনের হিসাব মিলানোটাই কি সব? যাদের অংক মিলে গেছে তাদের জন্য কি থাকবেনা আমার কোন অভিনন্দন?

আবার ভাবি, যে স্মৃতির মেখলা পরে এই ধূসর বিকাল আমার চোখে মায়াঞ্জন হয়ে এঁকে চলেছে, পথ চলা শেষে তাদের অস্বীকার করব কি করে! আমার পৃথিবীর শব্দ ভান্ডার হলেই বা স্বল্প, অন্য পৃথিবী থেকে ধার করে নেব না হয় কিছু নতুন শব্দ। সেই শব্দেই লিখে যাব পৃথিবীর আর এক ইতিহাস।

স্বপ্নকে যদি কোন মায়াবী আলোয় বাস্তবের কাছাকাছি নিয়ে আসা যায়, হয়তো যন্ত্রণা বাড়তে পারে, আঘাতে বিবর্ণ হতে পারে মানবিক অনুভূতিগুলো। তাতে কি? যে খুঁজে পেতে চায় অপ্রাপণীয়াকে তাকে তো যে কোন ভাবে জয় করতেই হবে বাধাগুলো।

আমি পারিনি বলে আর কেউ যে পারবেনা, তাতো নয়। প্রান্তিক রায় জীবনের প্রতিক্ষেত্রে হেরে গেছে বলে রেহানাকেও হারতে হবে, সে দিব্যি তো কেউ দেয়নি।

রেহানা দূরের তারা হয়ে বাঁচতে চায়, সাধ্য কি তাকে মর্তের মাটিতে ফিরিয়ে আনার। অথচ একদিন, এই রেহানাই শুধু নয় তার সঙ্গে অশ্রুকণা, তপতী ও আরো কেউ কেউ হারতে চেয়েছিল। কিন্তু কি হল জীবন ইতিহাসের দৃশ্যগুলিতে? জনমানসে আলোড়ন তুলে তারা শুধু আমার দুঃখের বোঝা বাড়িয়ে গেল। আজ বুঝতে পারি, তাদের সে জোরটুকু ছিল না, যে জোরে দূরকে করা যায় নিকট। যার সে জোর থাকে, জীবন-তো তাকেই নিয়ে আবর্তিত হয়। আর সে জন্যই তাদের প্রতীকী উপস্থিতি, দুয়ারে যতই আঘাত হানুক, ভীরু মন তাতে সাড়া দেবে কেন?

ব্যর্থ বাঁশির সুর দুয়ারে আঘাত হেনে ফিরে যায়, প্রতিধ্বনিত হয় সেই ব্যাকুলতা, স্মৃতির পাতায় তাকেই অক্ষয় করে রাখার যে অনুভূতি, আজো এই গোধূলি আকাশ কোনে খুঁজে ফিরি শেষ হয়েও শেষ না হওয়া সেই সূরের মুৰ্ছনা।

প্রান্তিক রায় বেদনার মধ্যে তাদের অস্তিত্ব খুঁজে পায়। ভালবাসা নামক রূপক পৃথিবীতে তাদের বিচরণ অবাধ। মায়াবী আলোয় ফিরে পায় হারানো সুরের রেশ। সমুদ্র তাদের টানে জীবনের এক ঘেয়েমীকে মুক্তি দিতে, পাহাড় জাগায় উদ্যমতা। আবার এই সমতলের বিষণ্ণতায় নতুনের স্বপ্ন দেখে জীবনের পাতায় পাতায়। তাইতো শেষ কথা বলার সময় আসেনি এখনো।

অশ্রুকণার জন্য একটা আলাদা অনুভূতি জাগে মনের মধ্যে। জানিনা এই অনুভূতির কোন আলাদা নাম আছে কিনা। যদি থাকেও তবু সে নামের সাথে আমার কোন পরিচয় নেই। অশ্রুকণাকে ভাল লাগে কারণ, অনেক অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে সে তার সাবলীল উপস্থিতি আর সমবেদনা দিয়ে আমাকে উদ্দীপ্ত করেছে অনেকবার। কিন্তু অশ্রুকণার এই যে নিতান্ত অসহায় এক গাঁয়ের ছেলেকে উপযাচক হয়ে সমবেদনা জানানো, পছন্দ নয় কলেজের অনেকের। ছেলেরা কতটা প্রতিক্রিয়াশীল জানা না গেলেও মেয়েরা যে সুযোগ পেলেই আমাকে অপদস্ত করতে পিছপা নয় সে অভিজ্ঞতা এই সামান্য দিনে বেশ কয়েকবার হয়ে গেছে। তাই তাদের এড়িয়ে চলার চেষ্টা করি।

কিন্তু আমি প্রান্তিক দূর থেকে এতদিন দেখে এসেছি অকাকে। ভীরুতা আমাকে বাধা দিয়েছে কাছে যেতে, তাইতো এড়িয়ে চলছি প্রতিমুহূর্তে। এই কো-এডুকেশান কলেজে পড়তে এসে, গ্রামের লাজুকতা যে তখনো ছাড়তে পারেনি তার পক্ষে কেমন করে সম্ভব ঐ সব দূর আকাশের তারাদের মুখোমুখি দাঁড়াবার। তবু এরই ফাঁকে অশ্রুকণার উপযাচক হয়ে কাছে আসার নৈকট্য আমাকে ভাল লাগার এক মরুদ্যানে পৌঁছে দেয়। কিন্তু তাতে কি? মরুদ্যানের সিগ্ধতা যারা কেড়ে নিতে চায় তারাতো সক্রিয়। তাদের অবাধ বিচরণকে ঠেকাবে কে? তাইতো আবারও একদিন মুখোমুখি হয়ে যেতে হয় তমালীর, নিতান্ত নিরুপায় হয়ে। এই যে গাঁয়ের ছেলে কোথায় চললে একা একা? তমালীর সঙ্গে ঝাক বেধে আসা অনুতপা, মুক্তি, শিরা খিল খিল করে হেসে ওঠে। ওদের ঐ প্রাণোচ্ছলতা আমাকে যেন মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে চায়। পারিনা চোখ তুলে তাকাতে। কিন্তু যাদের প্রাণে আনন্দের উচ্ছ্বসিত জোয়ার, তারা তা মানবে কেন? যেকোন ভাবেই হোক আনন্দকে তো জয় করতে হবে। তাই আমার অসহায়তা, ভীরুতা, লাজুকতাকে তারা মূল্য দেবে কেন? এরপর অপমানের শুল আরো তীব্রভাবে হেনে শিপ্রা বলে, কিগো ভাই কানাই কোন রাধিকার খোঁজে চলেছে এই পথে একলা একলা? মুক্তি বলে, আমরা রাধিকা না হতে পারি, কিন্তু তার সহচরীতো বটে। ভালবাসার ঐ চোখ দুটি তুলে তাকাও না একবার, বলতে বলতে খিলখিল করে হেসে ওঠে সবাই এক সাথে। তাতেই ক্ষান্ত না হয়ে কেউ কেউ আমার হাতে একটা চিমটি কাটে, কেউ জামা ধরে টানে, কেউবা আমার বই খাতার সস্তাদামের ব্যাগটা টেনে ছুঁড়ে ফেলে দেয় দূরে। আমার রাগ হয় খুব, কিন্তু কোন ভাবেই তা প্রকাশ করতে পারিনা। গাঁয়ের ছেলে সত্যি। তাই বলে তার কথা উল্লেখ করে অপমান করতে হবে? এটাই বুঝি শহরের ভদ্রতা। ওদের ওই অরুচিকর কথার উত্তরে শুধু আস্তে আস্তে বললাম, কেন এই ভাবে আপনারা আমায় বিরক্ত করছেন, আমার তাড়া আছে পথ ছাড়ন।

তমালী বলে ওঠে দেখ দেখ, আমাদের কিছুতেই ও বন্ধু বলে মানবেনা। ক্লাশের বন্ধুদের কেমন আপনি করে বলছে দেখ। মুক্তি বললো, ওকে ঐ পুকুরের জলে ডোবানো দরকার, যদি তাতে ওর নতুন জন্ম হয়। তমালী বলে নারে, তাতে আবার শ্রীরাধিকার মান হতে পারে। ওকে নিয়ে ডোবার অধিকারতো তার। তার চেয়ে ছেড়ে দে, আমরা শ্রীরাধিকাকে বলি। এই যে ভাই অশ্রুকণা তোমার কানু অপেক্ষা করছে ঐ পুকুর পাড়ে কৃষ্ণচূড়ার নীচে। আবারও খিল খিল করে হেসে ওঠে একসাথে। তারপর হাসতে হাসতে দল বেঁধে চলে যায় ওরা। মনে মনে ভাবি কি রকম ফাজিল মেয়ে সব। লজ্জা সরমও নেই।

কিন্তু আমি এখন কি করব। ওটুকু সময়ের মধ্যে যা যা করার সবই করেছে ওরা। টানাটানিতে জামার একটা অংশ ছিঁড়ে গেছে। সেলাই না করে ওটা পরে আর কলেজে আসা যাবেনা। বইগুলো যে কোথায় কোথায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কে জানে? খুঁজে দেখতে হবে। টানা হ্যাঁচড়ায় হাতের কবজিতে ব্যাথা এখনো টনটন করছে। যে ভাবে চুল ধরে টানাটানি করেছে, তাতে মাথা নাড়াতেই কষ্ট হচ্ছে। কি অপরাধ আমার? কলেজে আসি, আবার ফিরে যাই আপন মনে। অন্যান্য ছেলে মেয়েরা যখন আড্ডা মারে, আমি তাতে যোগ দিইনা। ডালে লাগেনা তাই। কিন্তু এটাও তো সত্য, ওরাতো কোনদিন ডাকেনি আমাকে। হা একদিন বলেছিল বটে, কলেজের প্রায় ১০/১২টি ছেলেমেয়ে একসঙ্গে কলেজ ক্যান্টিনে বসে চা খাচ্ছিল, আমার ভীষণ খিদে পেয়েছিল তাই পকেটের পয়সা গুনে নিয়ে সামান্য কিছু খাওয়ার জন্য ক্যান্টিনে ঢুকেছিলাম। ক্যান্টিনের বিশুদা, পুরো নাম জানিনা ঐ নামে সবাই ডাকে–আমাকে বলল কি খাবে প্রান্তিক?–আমি বললাম, ৫০ পয়সা আছে তাতে যা হয় দাও। আমি বিশুদাকে দিতে বলে, পিছনের একটা ফাঁকা সিট দেখে এগিয়ে চলেছি। কলেজ বন্ধুদের

মধ্যে একজন, নাম মনে হয় বিমল, আমাকে বলল, আরে প্রান্তিকবাবু যে এসো এসো, আজ তোমার ঘাড় ভেঙে আমাদের চা খাওয়া হবে। বলেই তমালী শিপ্রাদের বলল, একটু সরে বসতো তোরা, প্রান্তিকবাবুকে বসতে দে। আমি বললাম, না ভাই আপনারা আরাম করে বসুন। আমি পিছনের সিটে বসব। তমালী ফোড়ন কেটে ওঠে কেন ভাই আমাদের সঙ্গে বসলে কি আপনার জাত যাবে? শিপ্রা বলল, না ভাই আপনাকে খাওয়াতে হবে না, আমরাই খাওয়াব। বসুন না, আমাদের সঙ্গে বসে এক কাপ চা না হয় খেলেনই। আমি বললাম, আমি চা খাইনা। একথা বলেই ওদের কথার আর কোন উত্তর না দিয়ে পিছনে গিয়ে বসলাম। বিশুদা একটু পরেই ২ খানা হাতে করা রুটি এবং খানিকটা ছোলার ডাল দিয়ে গেল। আমি কোন ভাবে খেয়ে উঠে পড়লাম। শুনতে পাচ্ছি তখনো আমাকে নিয়ে ওরা হাসাহাসি করছে। মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে যায়। কিন্তু উপায়ই বা কি।

তখনো সন্ধ্যে হয়নি। একটা খাতা খুঁজেই পাওয়া গেলনা। ওতে আমার বেশ কিছু জরুরী নোটস্ ছিল। এত খারাপ লাগছে যে, বাড়ী ফিরতেও আর ইচ্ছে করছেনা। চুপচাপ বসে আছি শান বাধানো পুকুর ঘাটের বেদীতে। ভাবছি সন্ধ্যার আঁধার নেমে এলে আস্তে আস্তে চলে যাব।

এরইমধ্যে কেটে গেছে বেশ কয়েকটা দিন। একা একা পথ চলতে ভয় হয়। গ্রামের স্কুলে যখন পড়তাম হেডমাষ্টাব, মশাই ভীষণ ভালবাসতেন। আমি মোটামুটি লেখা পড়ায় খুব একটা খারাপ ছিলাম না বলে গ্রামের সকলে আমাকে ভালবাসতেন।

তখন ১১ ক্লাসে উচ্চমাধ্যমিক ছিল। টেষ্টে ভাল নম্বর পেয়ে প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হওয়ার পরে হেডস্যার বললেন; তাঁর এক ছাত্রী থাকে কলকাতায়। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই চাকরি করে। ওদের কোন সন্তান নেই। তোমার কথা বলেছি ওদের। তুমি কলকাতার কলেজে গিয়ে ভর্তি হও। ওরাই সব ব্যবস্থা করে দেবে, তোমার কোন আপত্তি নেই তো। হেডস্যারের ছাত্রী মানে গ্রামের সম্পর্কে আমাদের নীলাঞ্জনা পিসি, মাঝে মাঝে গ্রামের উৎসবে আসেন গ্রামের বাড়ীতে। মাঝে মাঝে ডেকে কথাও বলেন। কিন্তু তবু যেন মনে হয় কত দূরের মানুষ। কেন্দ্রীয় সরকারের একজন জুনিয়ার একাউন্টস অফিসার নীলাঞ্জনা পিসি, পিসির বর পরিমলদাও ভাল চাকরি করেন। তবে প্রাইভেট ফার্ম। ওদের একটাই দুঃখ, কোন সন্তান। হয়নি। আমার বয়সটা ঠিক ওদের সন্তানের বয়সের মতো নয়।

কলকাতায় হেডস্যারই আমাকে নিয়ে এসেছিলেন নীলাঞ্জনা পিসির কাছে। আসার কথা ব্যক্ত করে নীলাঞ্জনা পিসিকে বললেন যে, তোমার যদি কোন অসুবিধা হয়, তাহলে বল। পিসি বললেন, আমাদেরতো কোন অসুবিধা নেই, বরং ও থাকলে আমাদের কিছু সুরাহাই হবে।

সারাদিনের ক্লান্তির পরে আমরা যখন ফিরি, জীবনের সবকিছু একঘেয়েমি বলে মনে হয়। ও থাকলে অন্তত কিছুটা হলেও একঘেয়েমির ছন্দপতন হতে পারে। উত্তরে হেডস্যার বললেন একটা কথা বলব নীলু?–বলুন। আজকাল তো চিকিৎসা বিজ্ঞান অনেক উন্নত, তোমরা চেষ্টা করছনা কেন? চেষ্টা করা হয়েছে স্যার, কিন্তু ঈশ্বর যা চায়নি তা কি জোর করে পাওয়া যায়? তারপর বললেন তা হলে অরফ্যান হোম থেকে তো দত্তক নিতে পার? না স্যার, দত্তকের কথা ভাবিনি কখনো। আরো দু-এক জন যে বলেনি তা নয়, কিন্তু বিষয়টি আমাদের বিবেচনার মধ্যে নেই স্যার। আর তাছাড়া দোষ যখন আমার, তখন পরিমলকে আমি কেন আমার ভাগ্যের সঙ্গে জড়াব। বুঝতে পারলাম না তুমি কি বলতে চাইছো? নীলাঞ্জনা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে, তারপর ধীরে ধীরে বলে যে, আমি ওকে আবার বিয়ে করতে বলেছি। অবাক হয়ে হেডস্যার বলেন, সেকি কথা নীলু! তুমি এর পরিনাম জানো? জানি স্যার। একদিন হয়তো ওর ঘরে আমার আর জায়গা হবে না। কিন্তু ওতো সুখী হবে, পূর্ণ হবে ওর পিতৃত্ব।

হেডস্যার নিশীথরঞ্জন সরকার এর আর কি উত্তর দেবেন। তবু তার মনে হয় নীলাঞ্জনার এ এক হঠকারি সিদ্ধান্ত। ও কোন ভাবেই ঠিক করছেনা। তাই আর ও প্রসঙ্গ না বাড়িয়ে আমার প্রসঙ্গে বললেন, তা হলে তোমাদের এখানে প্রান্তিককে রাখা বোধহয় ঠিক হবে না! কেন স্যার? তোমাদের মানসিক এই অবস্থার মধ্যে ও একটা বোঝা হয়ে উঠবে। নীলাঞ্জনা পিসি বলল, আপনি ঠিক বলছেন না স্যার। প্রান্তিক আপনার স্কুলের কৃতী ছাত্র এটা যেমন ঠিক, তেমনি ওতো আমারও গ্রামের ছেলে, সম্পর্কে আমার ভাইপো। হয় তো এই কলকাতা শহরে এ সম্পর্কের কোন মূল্য নেই। কিন্তু এতদিনেও গ্রামের বন্ধন যখন কাটাতে পারিনি তখন এ সত্যকে অস্বীকার করব কি করে? না স্যার ওর কোন অসুবিধাই হবেনা। আমি পরিমলকে বলেছি ও হাসি মুখে মেনে নিয়েছে। ওর আসার সময় হয়ে গেছে, আপনি আরেকটু অপেক্ষা করুন। হেডস্যার বললেন, কিন্তু নীলু। আমার যে সময় নেই একদমও। আমাকে উঠতেই হবে। নীলাঞ্জনা আর কি করবে? হেডস্যার যাওয়ার আগে বললেন, তোমরা আমাকে নিশ্চিন্ত করলে। আশীর্বাদ করে হেডস্যার চলে গেলেন। আমি রয়ে গেলাম। তা আমিও এখানে আছি বেশ কিছুদিন হয়ে গেছে পিসি ও পিশেমশাইর মধ্যে আন্ডারস্ট্যান্ডিংএর কোন অভাব আছে বলে আমার কখনো মনে হয়নি। বলতে গেলে ওনারা আমাকে ওদের পরিবারের একজন হিসাবে হাসিমুখে মেনে নিয়েছেন। ওবাড়ীতে আমাকে কোন কড়া অনুশাসনেও রাখা হয়নি বরং বাস ভাড়া এবং সামান্য টিফিনের পয়সা আমাকে নিয়মিত দিতে কোনদিন ভুল করেন না। আমার সারাদিন যা ব্যয় হয় তারপর বাকী পয়সা ওনাদের ফিরিয়ে দিই। ওরা ফিরিয়ে নিতে চান না। তবু আমি তা ফিরিয়ে দিই। সুতরাং আমার কাছে অতিরিক্ত ব্যয় করার মত পয়সা থাকে না।

আজ ওরা ব্যস্ত হয়ে বেরিয়ে গেছেন। আমায় পয়সা দিতে সম্ভবত ভুলে গেছেন। সুতরাং কোন টিফিনই খাওয়া হয়নি। তারপর আসার সময় যেমন হেঁটে এসেছি, যেতেও হবে হেঁটে, পথ অনেকটা। তাই একটু তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে চলছিলাম। অসম্ভব ক্লান্তি নিয়ে পুকুরের ঘাটে বেদীর ওপরে বসে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম মনে নেই।

অন্ধকার নেমে এসেছে। বাইরের পৃথিবীকে, তা আরো ঘন কালো যবনিকায় ঢেকে দিয়েছে, উপরন্তু সন্ধার অন্ধকারে ২/১টি মশার কামড়ও টের পাচ্ছি। ঘুম ভেঙে যায়। এ পথ নির্জন। পুকুরের জলে ভাল করে চোখমুখ ধুয়ে, হাঁটতে আরম্ভ করি। কিন্তু পা চলতে চাইছেনা। অথচ এতটা পথতে হাঁটতেই হবে। সামনের ঐ বাড়ীতে হয়তো রেহানা থাকে। রেহানা রহমান। সারা কলেজের সহপাঠীদের মধ্যে ওর সঙ্গেই আমার ২/১টি কথা হয়। আসলে কলেজে আমরা একই ক্লাসে পড়ি। আমাকে কিছু নোট দিয়ে ও সাহায্য করেছিল, দূর্ভাগ্য সে খাতাটিই আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

ওর সঙ্গে কলেজ করিডোরে যেদিন প্রথম দেখা হয়েছিল, আমি ক্লাসরুম খুঁজছিলাম। ইতস্ততঃ করছি দেখে ও আমায় জিজ্ঞাসা করেছিল আপনি তো প্রান্তিক রায়? আমি হ্যাঁ বলাতে, ও বলেছিল, আমাকে চিনতে পারছেন না তাইনা? তারপর নিজেই নিজের পরিচয় দিয়ে বলেছিল, আমি রেহানা রহমান। যেদিন কলেজে ভর্তি হন সেদিন আপনাকে দেখেছিলাম। ভর্তির ফর্ম থেকে আপনার নামটাও জেনে নিই, সেই সময়। কিছু মনে করবেন না, সহপাঠীদের সঙ্গে আমি কিন্তু বেশীক্ষণ আপনি করে কথা বলতে পারিনা। তুমি বললে আপত্তি করবেন না তো! সরল আর সহজ স্বীকারোক্তি, ভীষণ ভালই লেগেছিল কারণ তাতে কোন অহংকার নেই। তাই আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম ওর দিকে। আমাদের গ্রামের স্কুলেও গুটি কয়েক ছাত্র-ছাত্রী ওদের সম্প্রদায় ভুক্ত ছিল। ছেলেরা আমাদের সঙ্গে অবাধে মেলামেশা করলেও মেয়েরা একটু দূরত্ব বজায় রেখে চলতো। হয়তো কোন ধর্মীয় সঙ্কোচ তাদের এভাবে চলতে বাধ্য করতো। কিন্তু রেহানার সাবলীলতায় সে ভুল যেন ভেঙে গেল আমার। বললাম না আপত্তি কিছু নেই। ও বলল, কিন্তু একটা শর্ত আছে, আমাকেও কিন্তু আপনি বলা চলবেনা। বললাম, চেষ্টা করব। ও প্রতি উত্তরে মৃদু হাসল শুধু। একেবারে প্রথমেই যে তাকে তুমি বলতে পেরেছিলাম তা কিন্তু নয়। তবে ধীরে ধীরে একদিন সেই জড়তা ভেঙে গিয়েছিল এবং রেহানাকে তুমি বলতে খুব একটা অসুবিধা হয়নি। তবে তার সঙ্গে কথাবার্তা হতো কালে ভদ্রে এবং খুব সামান্য। মনে মনে ভাবতাম রেহানাও তো শহরের মেয়ে, তবুও ওদের সঙ্গে কত পার্থক্য। মনে পড়ে সপ্তাহ দুয়েক আগে এই পথেই ফিরছিলাম। রেহানা একটা বাড়ীর বারান্দা থেকে আমাকে ডাকলো। এই যে প্রান্তিক! আমি তাকিয়ে দেখি একটা বাড়ীর বারান্দা থেকে রেহানা ডাকছে। খুব হাসিখুশী, গোধূলির রক্তিমাভায় ভীষণ সুন্দর লাগছিল ওকে। আমি থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম, ও বারান্দা থেকে নেমে এসে আমার পাশে দাঁড়িয়ে বলল, এটা আমাদের বাড়ী, চলনা! কিন্তু! কিন্তু কি? তারপর কি মনে হতে হেসে ফেলল, ও আমি তোমাদের স্বধর্মের লোক নই বলে তোমার সঙ্কোচ হচ্ছে? না ঠিক তা নয়। তবে অত ইতস্তত করছ কেন? চলনা ভিতরে। বলে হাত ধরে প্রায় জোর করে টেনে নিয়ে গেল। আমার কোন প্রতিবাদই সে শুনল না।

বাড়ীতে ওর একটা আলাদা পড়ার ঘর আছে। বাইরে থেকে ঠিক বোঝা যায় না। কিন্তু ঘরগুলো ভীষণ ছিমছাম এবং সুন্দর ভাবে সাজানো। ও আমাকে ওর পড়ার ঘরে বসিয়ে রেখে ভিতরে চলে গেল। একটু পরে এক ভদ্রমহিলা এসে দাঁড়ালেন আমার সামনে। বললেন আমি রেহানার! ও বলছিল তুমি নাকি ভিতরে আসতে চাও নি। কিন্তু কেন? কিসের সঙ্কোচ? আমি আর কি বলব। আমি উঠে ওঁনাকে প্রণাম করলাম, কোন বাধা দিলেন না। ওনার প্রশ্নের উত্তরে বললাম ঠিক তা নয়, আসলে আমার খুব তাড়া আছে। কেন? জানতে চাইলেন ভদ্রমহিলা। আমি বললাম আপনি হয়তো জানেন না। আমি গ্রামের সম্পর্কে এক পিসিমার কাছে থাকি, বলেছিলেন একটু তাড়াতাড়ি ফিরতে তাই আর কি? ভদ্রমহিলা পাশের একটা চেয়ারে বসে বললেন, দাঁড়িয়ে আছ কেন বোসনা। আমি বসলাম। ভদ্রমহিলা বলে চললেন, তোমার কথা শুনেছি রেহানার কাছে। তুমি তোমার এক আত্মীয়ার বাড়ীতে থাক তাও বলেছে আমায়। প্রায় দিনই তোমার কথা বলে। আমার কথা? অবাক হয়ে বলি, কিন্তু ওর সঙ্গেতো কলেজে আমার কোন কথাই হয় না বলতে গেলে। আমার কথা বোজ কি করে বলবে? ভদ্রমহিলা বললেন ও সেই কথাই বলে, যে তোমার সঙ্গে রোজ দেখা হয় অথচ তুমি ওকে এড়িয়ে চল, কোন কথাই বলতে চাওনা। আমি ওকে বলেছিলাম, একদিন ছেলেটাকে নিয়ে আয়না আমাদের বাড়ীতে। ভদ্রমহিলার কথা শুনতে শুনতে আমার বিস্ময় যেন আর কাটেনা। আমাদের কথা বলার মাঝে রেহানা একটা প্লেটে কিছু খাবার এবং চা নিয়ে ঘরে ঢুকলো। কিন্তু আমি যে কেন ওর দিকে সোজাসুজি তাকাতে পারছি না কে জানে? ভদ্রমহিলা বললেন, তোমরা কথা বল, আমি দেখি সেলিনা এখনো আসছেনা কেন? সেলিনা, রেহানার ছোট বোন, আগামীবার উচ্চমাধ্যমিক দেবে।

আমি চুপচাপ বসে আছি দেখে রেহানা বলল, তুমি কি কথা বলবেনা বলে ঠিক করেছ নাকি? চমকে উঠে তাকালাম ওর দিকে। না ঠিক তা নয় আসলে আমি একটা কথা ভাবছিলাম। কি? আমি জানতে চাইলাম তুমি কি রোজ কলেজে যা যা ঘটে সব বাড়ীতে এসে বল?–কেন? না, এমনিই জিজ্ঞেসা করছি। –তবু? মানে মাসিমার তো আমাকে চেনার কথা নয়। তাই ভাবলাম, তুমি না বললে জানবেন কি করে।

ও তাই বল, খিল খিল করে হেসে উঠলো রেহানা আর আমি স্পষ্ট সোজাসুজি তাকলাম ওর দিকে। ওকি লজ্জা পেল? কি জানি। বলল অমন করে তাকিয়ে আছো কেন? নারীর স্বাভাবিক লজ্জায় খানিকটা যেন নুয়ে আসে রেহানা।

লাল রোদ্দুর ফিকে হয়ে ধূসর আঁধার নামার অপেক্ষায়। রেহানার আফরোজ বেগম, তাঁর ঘর থেকে চিৎকার করে বলেছন সেলিনাতো এখনো ফিরলনা, একবার দেখবি রাস্তার মোড়ে গিয়ে? রেহানা বলল কি যে তুমি ব্যস্ত হও রোজ রোজ, ও কবে আর এত সকালে ফেরে? না ফিরলে চিন্তা হয় না। এত চিন্তা করার কি আছে? তোমার মেয়েতো একাই কেবল ফেরেনা তা নয়, ওদের ক্লাসের অনেকেই ফেরেনা।–কেন ফেরেনা কেন? আফরোজ বেগমের কণ্ঠে উদবিগ্নতার ছোঁয়া।–ফিরবে কি করে মা। ওরা ক্লাস শেষ হলে এক জায়গায় পড়তে যায় তাইতো দেরি হয়। ৭টার মধ্যে না ফিরলে আমি যাব যেখানে ওরা পড়ে। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল–কই কি যেন বলছিলে? না কিছু না, বলে চায়ের কাপটা মুখে তুলে নিলাম। আলদা প্লেটের খাবারগুলোও একটু একটু করে খেয়ে নিলাম। তারপর বললাম, আজ তাহলে উঠি রেহানা। আচ্ছা বলে উঠে দাঁড়ায় রেহানা। তারপর বলে, তুমি তো এই পথেই হেঁটে গিয়ে বাস ধর তাইনা?–হ্যাঁ? তাহলে তো যে কোনদিন আসতে পারো? হ্যাঁ তা পারি। তাহলে কাল আসবে বল? চেষ্টা করব। ও আর কিছু বললনা। আমিও বেরিয়ে আসি ওদের বাড়ী থেকে।

অনেক কথাই ওকে জিজ্ঞাসা করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু পারলামনা কোন কথাই বলতে। পরের দিন থেকে পারত পক্ষে, ওই রাস্তাটি এড়িয়ে চলেছি। এটা কি ভিতরের কোন ভয়, না আশঙ্কা। তা না হলে ওদের বাড়ীর পাশ দিয়ে কম দূরত্বের সোজা পথ ছেড়ে বেশী দূরত্বের ঘুরপথে বাস স্টজে যাবো কেন? রেহানা বুঝতে পারলেও আমাকে কোন প্রশ্ন করে অস্বস্তিতে ফেলতে চায়নি হয়তো। আজ আবার অন্যমনস্ক ভাবে এই রাস্তায় এসে পড়েছি। সব বাড়ীর আলো জ্বলে উঠেছে। একটু আগে সন্ধ্যার অন্ধকার গম্ভীর হয়ে নেমে এসেছে পৃথিবীতে।

রেহানার ঘরে আলো জ্বলছে। রাস্তার দিকে পিছন ফিরে সামনের মেয়েটির দিকে তাকিয়ে কি যেন বলছে আর হাসছে। এ সময় ওদের বাড়ী গেলে কিছু মনে করবে নাতো! তবু বেল দিলাম। আমাকে বোধ হয় সামনে বসা মেয়েটি আগেই দেখেছে কারণ তা না হলে বেল দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই দরজা খুলতো না। মেয়েটি কোন কথা না বলে আমার দিকে তাকিয়ে আছে! নীরবে বোধহয় জানতে চাইছে আমি কে। বললাম, আমি প্রান্তিক, রেহানা আছে? রেহানাও কখন যেন ওর পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে। বলল, কি ব্যাপার প্রান্তিক, তোমার শরীর খারাপ? এমন শুকনো শুকনো লাগছে কেন? কলেজতো অনেকক্ষণ ছুটি হয়ে গেছে, এতক্ষণ কোথায় ছিলে? এসো এসো ভিতরে এসো। এক নাগাড়ে এতগুলো প্রশ্ন করায় আমি খানিকটা বিভ্রান্ত। আমার অবচেতন মনে হয়তো রেহানার কথা বারবার মনে হয়েছে। আবার একথাও ঠিক যে সচেতন ভাবে আমি রেহানার কথা ভেবে ওদের বাড়ী আসিনি। তাই খানিকটা ইতস্তত করে বললাম, না আজ থাক রেহানা, আজ আমি একটা বিশেষ প্রয়োজনে এসেছিলাম তোমার কাছে। বেশতো বলনা কি প্রয়োজন? এত লজ্জা করছ কেন? বলল রেহানা। আমি ইতস্তত করছি দেখে সঙ্গের মেয়েটি বলল,–আপা, আমি থাকলে বোধহয় উনি কিছু বলবেন না। আমি বরং চলে যাচ্ছি। ও হাসতে হাসতে চলে গেল ভিতরের দিকে। রেহানা নিজেই বলল, আমার বোন সেলিনা। তুমি ওর কথায় কিছু মনে করোনা। ও ঐ রকমই। অফুরন্ত প্রাণশক্তিতে সারদিনই হৈ হুল্লোড় আর আনন্দে মেতে আছে। তারপর বলল বলনা কি বলবে? আসলে আমি আমার ম্যানিব্যাগটা ফেলে এসেছি, তারপর কলেজ থেকে বেরিয়ে এমন একটা ঝামেলায় জড়িয়ে পড়লাম যে, অনেক দেরি হয়ে গেল। পিসিমা হয়তো ভাবছেন। ও আর কোন প্রশ্ন করল না। জানতেও চাইলনা কিসের ঝামেলা। শুধু বলল, তুমি ভিতরে এসো। আমি সঙ্কোচের সঙ্গে বললাম, এমনিতে অনেক দেরি হয়ে গেছে, ভিতরে গেলে আরো দেরি হয়ে যাবে। আমি বরং এখানে অপেক্ষা করছি। রেহানা ভিতরে গিয়ে আবার ফিরে এলো, তারপর পাঁচটি টাকা আমার হাতে দিয়ে বলল, আশাকরি এতে হয়ে যাবে। আমি ওকে ধন্যবাদ দিয়ে বেরিয়ে এলাম। শুনতে পেলাম সেলিনার কথা রেহানাকে বলছে, বেচারা! তারপর বলল তুইকি জানিস আপা, কড়ি দিয়ে কিনলাম এর সতী, দীপুকে কি বলেছিল? কি? তাও জানিসনা। তবে শোন, সতী বলেছিল, আমি জানি তুমি আমার কাছে কিছু চাইবে কিন্তু সে যে টাকা …। রেহানা ধমক দিয়ে বলে ইয়ার্কি করিসনা সেলিনা ওর কানে গেলে ও কি ভাববে বলতো। সেলিনা উত্তরে কি বলেছিল ভাল করে শোনা গেলনা, তাছাড়া ওদের কথা শুনবার সময়ও আমার নেই। এরপর বাড়ীতে যখন পৌঁছালাম, তার অনেক আগেই পিসি এবং পিসেমশাই অফিস থেকে ফিরে এসেছেন। পিসি বললেন, এত দেরি হল যে, কোথায় গিয়েছিলে? আমি আর কি বলব। খিদেতে পেট জ্বলছে তার সঙ্গে যোগ হয়েছে অপমানের জ্বালা। কোন কথাই বলতে ভাল লাগছেনা, শুনতে তো নয়ই। তবু অন্যের বাড়ী। উত্তরতো একটা দিতেই হবে। বললাম কলেজে ছুটির পরে এক বন্ধুর বাড়ী গিয়েছিলাম, দেরি হয়ে গেছে। পিসি বললেন এতদেরি করবেনা। চিন্তা হয় না? যা তাড়াতাড়ি হাত মুখ ধুয়ে খেতে এস।

ডাইনিং টেবিলে পিসেমশাই পরিমল বাবু আসেননি। পিসি আর আমি অনেকক্ষণ তার জন্য অপেক্ষা করে করে শেষ পর্যন্ত নিজেরা টিফিন খেয়ে উঠে পড়েছি। একবার মনে হয়েছিল আজকের সব ঘটনা খুলে বলি পিসিকে। কিন্তু কেন যেন বলতে পারলামনা। হয়তো লজ্জায় বা ভয়েও হতে পারে।

নিজের টেবিলে পড়তে বসেছি। শুনতে পাচ্ছি পিসেমশাই বলছেন, শেষ পর্যন্ত তুমি কি ঠিক করলে? কিসের? বা সব ভুলে গেলে? তোমাকে তো কয়েকদিন ধরে বলছি। বেশী দেরি করলে সব ভুল হয়ে যাবে। বুঝলাম দেরি করলে ভুল হয়ে যাবে। কিন্তু ব্যপারটি কি? পিসেমশাই বললেন একটা বাচ্চাকে দত্তক নেওয়ার। কিছুক্ষণ চুপচাপ উভয়ে, তারপর ধীরে ধীরে পিসি বললেন, আমার মত নেই। দত্তক যাকেই নাওনা কেন তাতে তোমার রক্তের অধিকার থাকবেনা, আর যেখানে তোমার রক্তের অধিকার থাকছেনা, তাকে আমার পক্ষে মেনে নেওয়া কষ্টকর। তাহলে তুমি কি চাও? আমি যা চাইব তাই তুমি করবে? চেষ্টা করব। তাহলে তুমি আরেকবার বিয়ে কর। নীলু, তোমাকে বার বার বলেছি এ অসম্ভব। কেন তুমি বোঝনা কেন? বুঝি যে না, তা নয়। কিন্তু আমি তোমায় ভালবাসি পরিমল। আমি যে তোমায় পিতৃত্বের স্বাদ থেকে বঞ্চিত করছি, তারজন্য আমার মনের যে অবস্থা তা তুমি বোঝনা। তুমি কি আমায় একটুও বিশ্বাস করতে পারছনা? এটা বিশ্বাসের প্রশ্ন নয় নীলু। বাস্তবতার প্রশ্ন। তারপর বললেন আমি না হয় মেনেই নিলাম, তুমি সব কিছু মেনে নেবে। কোন প্রতিবাদ করবে না। কিন্তু যে আসবে সে যদি তোমাকে মেনে না নেয়? তাতেও আমার দুঃখ থাকবেনা, যদি সে তোমাকে অন্তত ভালবাসে। কিন্তু তার ভালবাসার খেসারত দিতে গিয়ে যদি তোমাকে হারাতে হয়? তাতেও আমার কোন দুঃখ থাকবে না। আমি হাসিমুখে তোমার জীবন থেকে সরে যাবো। পরিমল বাবু বললেন জীবনটাকি এত সহজ ভাবে চলে নীলু? আর তা ছাড়া তুমি তোমার নিজের কথা ভাবছো। আমার কথা এক দম : ভাবছো না। আমার মন যদি তোমাকে হারানো সহ্য করতে না পারে। আগে আগে এসব কথা ভাবছ কেন? আমি যদি তাকে আমার ছোট বোনের মত ভালবাসি, সে কেন আমাকে অস্বীকার করবে? আর যদি করেও সেদিনকার পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নতুন ভাবে চিন্তা ভাবনা করব। তুমি না করোনা লক্ষ্মীটি। এ যেন এক নতুন আবিস্কার আমার কাছে। মনে হয় পিসি যেন আত্মত্যাগে এক মহীয়সী নারী।

কেটে যায় আরো বেশ কিছু দিন। একদিন পরিমলবাবু তাঁর এক অফিস সহকর্মীকে নিয়ে বাড়ীতে আসেন। সেদিন আমার কলেজ যাওয়া হয়নি। শরীরটা ভালো ছিল না। পিসি অফিস থেকে ফেরেননি। পরিমলবাবু বললেন, তুমি আজ কলেজে যাওনি প্রান্তিক। না, শরীরটা ভালো নেই। ও ঠিক আছে। তারপর সঙ্গের ভদ্রমহিলার সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, আমার অফিস সহকর্মী, মিনতি সেন, আর এর নাম প্রান্তিক, নীলাঞ্জনার ভাইপো, আমাদের এখানে থেকে পড়াশুনা করে, খুব ভালো ছেলে। মিনতি সেন তাকালেন আমার দিকে। কি ভাবলেন, তা তিনিই জানেন। পরিমলবাবু বললেন, চল ভিতরের ঘরে গিয়ে বসি। মিনতি সেন মৃদু আপত্তি জানিয়ে বলেন, এখানেই বসিনা। তারপর জানতে চাইলেন তা তোমার গিন্নি কখন আসবেন? সাতটা নাগাদ। সাতটা নাগাদ! সে তো অনেক দেরি। না, এতক্ষণ দেরি করা সম্ভব হবে না। আমি বরং আরেক দিন আসব। আমি বুঝতে পারছি না এসময় পরিমলবাবু মিনতি সেনকে নিয়ে বাড়ীতে এলেন কেন? এসময় তো কারো বাড়ীতে থাকার কথা নয়। পরিমলবাবু বললেন, আমার যে তোমার সাথে কিছু কথা আছে মিনতি? প্রান্তিক এখানে বসে পড়াশোনা করছে। ওর পড়াশোনার ডিস্টার্ব হবে, তার থেকে চল ভিতরে গিয়ে বসা যাক। প্রান্তিক এখানে পড়াশোনা করছে এ ব্যপারটা বুঝতে পেরে মিনতি আর কোন রকম দ্বিধা না করে পরিমলবাবুর পিছু পিছু ভিতরের ঘরের দিকে পা বাড়ান।

আমার মনে হলো আমার কলেজে না যাওয়াটা বোধ হয় পিসেমশাই ভাবতে পারেননি। সুতরাং যে কোন অজুহাতে বেরিয়ে পড়াই উচিৎ। কিন্তু কোথায় যাওয়া যায়? সকালে পিসি, কলেজে যাওয়ার খরচ দিয়ে গেছেন। সিনেমায় যাওয়া যেতে পারে। যদিও বলে কোথাও যাওয়াটা পিসির পছন্দ নয়। তবু বেরিয়ে পড়ি আমি। যাওয়ার আগে পিসেমশাইকে বলে যাই, আমি একটু বেরুচ্ছি। কোথায়? আমার এক বন্ধু কিছু কলেজ নোট দেবে বলেছিলো, ওখানেই যাব। কখন ফিরবে? তাড়াতাড়ি ফিরে আসব। ভিতর থেকে মিনতি সেন বেরিয়ে এসে বললেন, আপনি কোনদিকে যাবেন? বললাম, কলেজ স্ট্রীটের দিকে। একটু দাঁড়ান আমিও যাব। তারপর পরিমলবাবুকে উদ্দেশ্য করে বলেন, আজ আমি আসি পরিমল। তোমার বাড়ীতে চিনেই গেলাম, এরপর একদিন একলাই চলে আসব।

বুঝতে পারছি এই ফাঁকা ঘরে অস্বস্থি বোধ করছেন মিনতি সেন। তবু বললাম, আপনি একটু অপেক্ষা করে যাননা। পিসির সঙ্গে দেখা করে যান। উনি বললেন, সে আরেকদিন হবে ভাই। আপনি একটু দাঁড়ান, উনি ব্যাগটা নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন আমার সাথে, পরিমলবাবুর কোন অনুরোধকে গুরুত্ব না দিয়েই।

রাস্তায় এসে বললেন, আপনি কলেজ স্ট্রীট কোথায় যাবেন? আমি তাঁকে বাধা দিয়ে বললাম। আমাকে তুমিই বলবেন। বেশ তাই হবে। ওখানে তুমি কোথায় যাবে? হিন্দু হোষ্টেলে যাব। বেশ যেও, আপাতত চলল না সামনের ওই রেস্টুরেন্টটায়, বেশ খিদে পেয়েছে। আমি ইতস্তত করছি দেখে উনি বললেন লজ্জা করছে? না ঠিক তা নয়? তাহলে? বেশ চলুন।

সামনের জলযোগ রেস্টুরেন্টে ঢুকে একটা কেবিনে আমরা আমাদের জায়গা করে নিলাম। উনি বললেন কি খাবে? আমার একদম খিদে পায়নি। আপনি যা খাবেন খান, আমি আপনাকে সঙ্গ দিচ্ছি।

উনি দুটো মোগলাই পরটা এবং দু কাপ কফির অর্ডার দিলেন। কাটা চামচ দিয়ে মোগলাই টুকরো করতে করতে জিজ্ঞাসা করলেন, নীলাঞ্জনা তোমার কেমন পিসি? সত্যি কথাই বললাম, আমাদের একই গ্রামে বাড়ী সেই সম্পর্কে পিসি,–তাহলে নিজের নয়? না। এখানে তোমার আর কোথাও থাকবার জায়গা নেই? ঠিক জানি না, তবে প্রথম থেকেই তো এখানে আছি, অসুবিধাতো কিছু নেই।

উনি বোধ হয় বুঝতে পারছেন, এত কৌতূহল বোধ হয় ঠিক হচ্ছেনা। তাই বললেন, তুমি কিছু মনে করো না ভাই, আসলে চুপচাপ বসেতো খাওয়া যায় না, তাই কিছু বলা দরকার বলেই বলা। আমি বললাম, না আমি কিছু মনে করছিনা, আপনি যা কিছু জিজ্ঞাসা করতে পারেন।

উনি বললেন, আমার সম্পর্কে তোমার জানতে ইচ্ছে করেনা কে আমি? কেন এসেছিলাম আর কেনই বা তোমার সঙ্গে চলে এলাম।

হঠাৎ বাইরের দিকে চোখ পড়তে দেখি অশ্রুকণা ও অনুতপা। একটাও কেবিন খালি নেই তাই ওরা দাঁড়িয়ে আছে। আমি ওদের ডাকতে গিয়েও চুপ করে গেলাম। মিনতি সেন বললেন ওরা কারা? আমার কলেজ বন্ধু। ডাকনা ওদের। এই কেবিনেতো চারজনের সিট, আমরা তো দুজন। কেন ওরা দাঁড়িয়ে থাকবে?

কিন্তু ডাকতে আর ওদের হল না। আমাকে দেখতে পেয়ে হাসতে হাসতে আমাদের কেবিনের সামনে এসে দাঁড়ালো। আমি বললাম ভিতরে এসো। তারপর মিনতি সেনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললাম, আমার পিসি মিনতি সেন। আর ওরা অশ্রুকণা এবং অনুতপা। মিনতি সেন বললেন বা সুন্দর নাম তো তোমাদের অশ্রুকণা, আর অনুতপা। ওরাও হাসতে হাসতে বলে, আপনার বিচারটা বড্ড এক পেশে পিসি ওর নামটাও কি রোমান্টিক তাইনা? কি সুন্দর নাম প্রান্তিক রায়। আর সঙ্গে সঙ্গে সকলে একসঙ্গে হেসে উঠলো এবং ভিতরে এসে বসল। মিনতি সেন বেল বাজিয়ে আরো ২টো মোগলাই এবং কফির অর্ডার দিলেন।

আস্তে আস্তে জানা গেল অনুতপা এবং মিনতি সেন দক্ষিণ কলকাতার ঢাকুরিয়ার দিকে থাকেন। তারা এক সময় উঠে পড়লো। আমি কাছেই থাকি, অশ্রুকণাকে ওখানে থেকে বাসে বরানগরের দিকে যেতে হবে। তখনো সন্ধ্যে হতে ঢের বাকি। অশ্রুকণা জিজ্ঞাস করলো, আজ কলেজ যাওনি কেন? তুমি কি করে জানলে আমি কলেজ যাইনি? বা এতে জানাজানির কি আছে? তুমি যাওনি এতো আর মিথ্যে নয়। না ঠিক তা বলছিনা, তোমার খোঁজ করছিলাম, তাই জানতে পারলাম। আমার খোঁজ করছিলে? কেন? এমনি। যা এমনি এমনি কেউ কাউকে খোঁজ করে নাকি? বলে হাসতে থাকি আমি।

হঠাৎ কথা ঘুরিয়ে অশ্রুকণা বলল, তোমার পিসি কিন্তু সুন্দর। সুন্দর না সুন্দরী? দুটোই।–তার মানে? সুন্দর তার মন, আর সুন্দরী তিনি রূপে? বিয়ে করেননি কেন? বলছিলেন, কোথায় যেন চাকরি করেন, কোথায় চাকরি করেন?–এক মার্চেন্ট ফার্মে। তারপর বললাম আচ্ছা অশ্রু…ও আমাকে বাধা দিয়ে বলল না না অশ্রু নয়, আমায় তুমি কণা বলেই ডেকো! তারপর বলল চল বেরিয়ে পড়ি। উত্তরে বললাম বেশ চল। তারপর লাজুক হেসে বললাম, কণা তুমিও কিন্তু খুব সুন্দর। ও শুধু বলল ধ্যাৎ, বাসস্টান্ডে এসে ওকে বাসে তুলে দিলাম। বাসটা ফাঁকাই ছিল। উঠেই বসতে পেরেছিলো। বলল, কাল কলেজে আসছে তো! হ্যাঁ যাবে। বাসটা ছেড়ে দিল।

কে এই মিনতি সেন? কেন এসেছিলেন তিনি? আর এলেন যখন, তখন আবার আমার সঙ্গে চলে এলেন কেন? তবে একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে মিনতি সেন সত্যি সুন্দরী। আর তার সৌন্দর্যে আছে অন্যকে আপন করে নেওয়ার এক মাদক আকর্ষণ। পরিমলবাবু বলেছেন, তিনি তার সহকর্মী। তাই-কি? কি জানি। পরিমলবাবুকে যেন এখন আর ততটা বিশ্বস্ত মনে হয় না।

আমাকে একা পেয়ে নীলাঞ্জনা পিসি বললেন, কাল তোমার পিসেমশাইয়ের এক অফিস কলিগ এসেছিলেন। আর এসেই তোমার সঙ্গে বেরিয়ে গেলেন। উনি কে? আমি অবাক হয়ে তাকাই পিসির দিকে। বললাম, বললেন তো একই অফিসে কাজ করেন। তা তোমার সঙ্গে বেরিয়ে গেলেন যে বড়! তুমি নিশ্চয়ই আগে চিনতে! সন্দেহ তার কণ্ঠে। একে? এই কি সেই নীলাঞ্জনা পিসি যিনি তার স্বামীকে দ্বিতীয়বার বিয়ে দিতে উঠে পড়ে লেগেছেন, শুধু একটা নতুন শিশুর জন্য। আমি বললাম, আমার সঙ্গে আগে কোন পরিচয় ছিল না। তবে আমার কলেজ স্ট্রীটের দিকে যাওয়ার কথা শুনে বললেন, উনিও যাবেন। আমি অবশ্য দেরি করে তোমার সঙ্গে দেখা করে যেতে বলেছিলাম। কিন্তু তিনি বললেন, পরে একদিন আসবেন।

পিসি আর বেশী কথা বাড়ালেন না। শুধু বললেন এলেনই যদি একটু দেরি করতে পারলেন না।

অনুমান করতে পারি মিনতি সেনকে নিয়ে স্বামী-স্ত্রীতে একটা ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। এতে আমার পিসিকে খুব একটা দোষী মনে হয় না। কারণ পরিমলবাবুর যদি মনে কোন ইচ্ছে থেকেও থাকে তা স্পষ্ট করে বলতে পারতেন। তা না করে তিনি যেমন গোপনে তাকে নিয়ে এলেন এবং মিনতি সেনও আসতে রাজী হয়ে গেলেন তা ঠিক স্বাভাবিক পর্যায়ে পড়ে না।

দিনকয়েক পরে নীলাঞ্জনা পিসি একদিন মিনতি সেনকে অফিসে ফোন করেন। মিনতি সেন সেদিন অফিসে আসেননি। এবং কবে আসবেন তা জানাতে পারেননি। সন্দেহ ঘনীভূত হয়। কারণ গতকালই পরিমলবাবু ৭ দিনের জন্য অফিসের কাজে বাইরে গেছেন।

রাতে পিসি জানতে চাইলেন আমি মিনতি সেনের বাড়ী চিনি কিনা বা তার ঠিকানা জানি কি না? বললাম বাড়ী চিনিনা, তবে ঠিকানা জোগাড় করে দিতে পারি। কিভাবে? আমাদের এক সহপাঠি ওদের ওদিকে থাকে আর মিনতি সেনকেও চেনে। কি নাম? অনুতপা। একদিন নিয়ে আসবে ওকে? পিসি যেন একটা ফয়সালা চান এ ঘটনার।

পরের দিন কলেজে গিয়ে জানলাম, অনুতপা কলেজে আসেনি। কিন্তু অনুতপাকে আমি খুঁজছি এই সামান্য ব্যাপার নিয়ে অনেক আজে বাজে আলোচনা আরম্ভ হয়ে গেল। এরই মাঝে অশ্রুকণা এগিয়ে এসে বলল তুমি ওকে খুঁজছিলে কেন?

আলোচনা এমন একটা বিশ্রী আর কদৰ্য্যরূপ নিয়েছে যে, আমার কারো কথা শুনতে ভালো লাগছিল না। বললাম, প্রয়োজন আছে তাই। আমার কণ্ঠে উম্মা প্রকট হয়ে ওঠে। অশ্রুকণা কিন্তু রাগল না। বলল তোমার এই গেঁয়ো গোঁয়ারতুমি আমার একদম ভালো লাগে না প্রান্তিক। আমি বিশ্বাস করি অনুতপাকে তোমার সত্যি কোন দরকার আছে। আমাকে বলা যায় না কি দরকার। সত্যিকারের সহমর্মীর মতো জানতে চায় অশ্রুকণা।

না, এর মধ্যে তো কোন কৌতূহল নেই, নেই কোন কুটিলতা। বললাম, ওকে একবার আমার পিসির প্রয়োজন তাই। এবার অবাক চোখে তাকালো অশ্রুকণা। বলল, কে? মিনতি সেন? আমি বেফাঁস বলে ফেললাম, তুমি ওকে চেন নাকি? বা তুমিই তো সেদিন পরিচয় করিয়ে দিলে উনি তোমার পিসিমা, অনুতপাদের ওদিকেই তো থাকে না। অনুতপা কয়েকদিন ধরেই কলেজে আসছে না। জ্বর হয়েছে। যাবে নাকি? আমি যাচ্ছি ওকে দেখতে।

কি যেন ছিল অশ্রুকণার এই আবেদনে। আমি না করতে পারলাম না।

ওদের ওখানে যখন পৌঁছালাম তখন সন্ধ্যে হয়ে গেছে। অনুতপা বোধ হয় ভাবতেই পারেনি আমরা ওদের ওখানে যেতে পারি। ওর জ্বর কমেছে। কাল স্নান করেছে। শরীর বেশ কাহিল, খুবই ক্লান্ত লাগছিল ওকে দেখে। ওর বাবা অফিস থেকে ফেরেননি। দাদা কেন্দ্রীয় সরকারে চাকরি নিয়ে বাইরে থাকেন। বাড়ীতে শুধু ওর মা আছেন। আমাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয় অনুতপা। বলে আমার যে কি ভাল লাগছে তোমরা এসেছো বলে। কদিন বাড়ীতে থেকে একেবারে হাঁফিয়ে উঠেছি। মনে মনে শুধু ভেবেছি তোমরা কেউ এলে ভাল লাগতো। তোমাদের কাউকে যে সংবাদ দেব সে উপায়ও নেই। তা তোমরা জানলে কি করে? অশ্রুকণা বলে আজই সংবাদ পেলাম। প্রশান্ত বলেছে। প্রশান্ত? নামটা অশ্রুকণার মুখে শুনে অবাক হয় অনুতপা। প্রশান্তকে তো চেনার কথা নয় অশ্রুকণার। তবু সেটা আচরণে প্রকাশ না করে বললো, ওর সঙ্গে তোমার দেখা হল কোথায়? কি একটা কাজে আজ কলেজে গিয়েছিলো। হঠাৎ মনে হল তোর সংবাদ ও জানতে পারে। তাই জিজ্ঞাসা করাতে বললো, তোর বেশ কয়েকদিন ধরে জ্বর।

একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে অনুতপা বলে, অথচ দেখ, আমার বেশ কয়েকদিন ধরে জ্বর এ সংবাদ রাখে অথচ একবার আসতে পারেনা। এরা সব এই রকমই। অনুতপার মা আমাদের জন্য মিষ্টি নিয়ে আসেন। বলেন, তোমরা কলেজ থেকে আসছ এই মিষ্টিটা খেয়ে নাও। আমি তোমাদের জন্য খাবার করছি। আমরা না না করে উঠলাম। কিন্তু উনি তখন আর ওখানে নেই।

অশ্রুকণা বলল, আমরা যদি আগে জানতে পারতাম অবশ্যিই আসতাম। যাকগে সে কথা। এ কদিনে কি কেউ আসেনি? অনুতপা বলে, একবোরে কেউ আসেনি বলা ঠিক হবে না, প্রান্তিকের পিসি মিনতি সেন এসেছেন একদিন অন্তর একদিন। অফিস থেকে ফেরার পথে যেদিনই এসেছেন, ফল ইত্যাদি নিয়ে এসেছেন। বসতেন বেশ কিছুক্ষণ। অনেক গল্প করে আবার ফিরে যেতেন। আমি অবাক হয়ে তাকাই অনুতপার দিকে। অশ্রুকণা বলে, কি এত গল্প করেন উনি? তার কলেজ জীবনের কথা। সেদিন ছেলেরা কি ভাবে ওনাদের পিছনে লাগতেন এইসব আর কি? তোদের বাড়ীর কাছে থাকেন বুঝি! এইতো মোড়টা ঘুরলে ২৫/২ নং বাড়ীতে। মিনতি পিসি যে এত ভালো, পরিচয় না হলে বুঝতেই পারতাম না। তারপর আমার দিকে ফিরে বললেন, সত্যি প্রান্তিক তোমার প্রতি আমার কৃতজ্ঞ থাকা উচিৎ তোমার পিসির সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য। উনি শেষ কবে এসেছিলেন, জিজ্ঞাসা করে অশ্রুকণা। এই তো কালকেই এসেছিলেন। তার মানে আজ আর আসবেনা। তারপর আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল, চল না প্রান্তিক আমরা তোমার পিসির ওখান থেকে ঘুরে আসি। আমি বললাম আজ থাক কশা, বাড়ীতে চিন্তা করবে। মনে মনে হিসাব মিলিয়ে নিয়েছি পরিমলবাবুর সঙ্গে মিনতি সেন যাননি। অনুতপা বলল, সে কি কথা প্রান্তিক, আমাদের এখানে এসে না গেলে উনি জানতে পারলে দুঃখ পাবেন। হয়তো মনে মনে আমাকেই দায়ী করবেন যে আমিই তোমাকে যেতে দিইনি।

অগত্যা যেতে হয়। সত্যি খুব কাছেই মিনতি সেনদের বাড়ী। ছোট্ট বাড়ী। কিন্তু বেশ সাজানো গুছানো। আমরা বেল দিতেই এক বুড়ো মতো ভদ্রলোক বেরিয়ে আসেন। জানিনা ভদ্রলোক মিনতি সেনের কে হন। কিন্তু ঠিক পিছনে পিছনে মিনতি সেন আমাকে দেখতে পেয়েই ভদ্রলোককে বললেন, বাবা, তুমি আবার উঠে এলে কেন? আমি তো আছি, যাও তুমি ভিতরে যাও। তারপরে আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন–প্রান্তিক ভালো আছো। তো? পাশে অশ্রুকণাকে দেখে বললেন, তুমিও ভালো আছো তো অশ্রু? ও এগিয়ে গিয়ে মিনতি সেনকে প্রণাম করতে গেলে মিনতি সেন বাধা দিয়ে বললেন, এসব কি করছ? বা গুরুজনদের প্রণাম করব না?

আমরা ভিতরে গিয়ে বসলাম। মিনতি সেনকে জিজ্ঞাসা করলাম কাল অফিসে যাননি? না কেন বলো তো। এমনি? এমনি এমনি তো কিছু হয় না প্রান্তিক? তারপর বললেন কাল কি আমাকে খুঁজতে আমার অফিসে গিয়েছিলে? না তবে নীলাঞ্জনা পিসি আপনাকে কাল অফিসে ফোন করেছিলেন। কেন? তাতো জানিনা। খুব দরকার বুঝি? তারপর অবশ্য বললেন, আমাকে তো আগে কখনো ফোন করেনি। ঠিক আছে আমি কাল অফিসে যাব। যদি খুব দরকার থাকে আমাকে ফোন করতে বলল। তারপর অশ্রুকণার দিকে ফিরে জানতে চাইলেন তোমরা আমার কাছে এসেছে না অন্য কোথাও গিয়েছিলে? অশ্রুকণা বলল, আসলে কদিন ধরে অনুতপা কলেজে যাচ্ছেনা তো, তাই প্রান্তিককে বললাম, তোমার পিসি তো ঐ দিকেই থাকেন, চলনা, অনুতপাকেও দেখা হবে, আবার তোমার পিসির বাড়ী থেকেও ঘুরে আসা যাবে।

আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠতে দেখলাম মিনতি সেনের ভাসাভাসা দুটি চোখকে। বললেন খুব ভালো করেছে। আমি একদিন অন্তর একদিন ওদের বাড়ীতে গেছি। কথায় কথায় জিজ্ঞাসা করেছি তোমার কলেজ বন্ধুরা কেমন? এতদিন কলেজ যাচ্ছনা, অথচ কেউ তো তোমাকে দেখতে এলনা। আমাদের সময়ে আমরা এত অবাধ মেলামেশা করতে পারতাম না ঠিকই কিন্তু কেউ আমরা হঠাৎ অনুপস্থিতি হয়ে গেলে কেউ না কেউ ঠিকানা খুঁজে খুঁজে উপস্থিত হয়ে যেতাম। তারপর ওকে জিজ্ঞাসা করলাম প্রান্তিককে সংবাদ দেব?

অনুতপা বারণ করেছিল, তাই আর তোমাদের সংবাদ দেওয়া হয়নি। এবার তো আমার বাড়ী চেনা হয়ে গেছে মাঝে মাঝে এস কিন্তু। এটা ওটা কথা বলতে বলতে মিনতি সেন আমাদের জন্য খাবার তৈরি করলেন, কফি দিলেন, অনেক অনুরোধে মিষ্টিও খেতে হল। যতক্ষণ ওবাড়ীতে ছিলাম মিনতি সেন বেশীক্ষণ অশ্রুকণার সঙ্গেই কথা বললেন আমার সঙ্গে সামান্য ২/১ টি কথা ছাড়া প্রায় এড়িয়েই চললেন। জানিনা কেন মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল, তবে পরে ভেবেছি, মিনতি সেনের এই ব্যবহারের পিছনে একটা কারণ ছিল, এবং তা যথেষ্ট যুক্তি গ্রাহ্য।

পথে বেরিয়ে এসে অশ্রুকণা বলল, তোমার পিসি এত সুন্দর যে আমার কি মনে হয় জান?–কি? আমি উৎসুক দৃষ্টিতে তাকাই ওর দিকে। ও বলে, আমি যদি ছেলে হতাম, নির্ঘাৎ ওর প্রেমে পড়ে যেতাম। আমি হাসতে হাসতে বললাম, ভাগ্যিস মিনতি সেন আমার পিসি, কিন্তু তা না হয়ে যদি মিনতি সেন আমার কাকু হতেন তবে নির্ঘাৎ কপালে দুঃখ ছিল। ধ্যাৎ বলে চোখে যে কটাক্ষ হেনে তাকালো আমার দিকে, তাতেই আমার অবস্থা কাহিল। আমি আর কোন কথা বলতে পারলামনা। বাস স্টান্ডে দাঁড়িয়ে আছি। আমাদের নর্থের বাস আর আসছে না। আস্তে আস্তে রাত বাড়ছে। বাড়ীর লোকেরা নিশ্চয়ই চিন্তা করছে। অশ্রুকণা বলল, না বাস আর আজ আসবে না, চল বরং ট্রেনেই ফিরে যাই। অগত্যা আমরা আবার হাঁটতে হাঁটতে রেল স্টেশনের দিকে এগিয়ে চললাম। অশ্রুকণা বলল, আমার কি মনে হচ্ছে যান?–কি? যদি আমাদের এই পথ চলা আর শেষ না হতো। আমি হেসে উঠলাম। হাসলে যে! না ভাবছি তোমার এই স্বপ্নের খেয়া কোথায় গিয়ে শেষ হবে। ওকে দেখে খুব চিন্তিত মনে হল, তাই জানতে চাইলাম, তোমার কি হয়েছে বলতো কণা? ও আমার কথার কোন উত্তর না দিয়ে গুন গুন করে গেয়ে উঠলো আমার এই পথ চলাতেই আনন্দ, গানটা ভারি সুন্দর, বাধা দিতে পারলামনা। অবাক হয়ে ভাবছিলাম, এমন জনারণ্যের মাঝে যে এমন গাইতে পারে, না জানি সুর তার হৃদয়ের কোন উৎস থেকে উৎসারিত হয়। কিন্তু পথ যে সামান্য। আর সামান্য পথ বলেই হয়তো পথ শেষ না হওয়ার এই আকুলতা। প্লাটফরমে ঢুকতেই শিয়ালদহ গামী ট্রেন এসে দাঁড়ালো। টিকিট কাটার কোন অবকাশই হয় না। বিনা টিকেটেই ট্রেনে উঠে পড়ি।

বাড়ীতে যখন ফিরেছি তখন রাত ১০টা বাজে। নীলাঞ্জনা পিসি এঘর ওঘর করছেন। আমাকে দেখে আশ্বস্ত হলেন ঠিকই, কিন্তু ক্ষেপে গেলেন তার থেকে বেশী। বললেন এমন ইচ্ছেমত যদি চলতে চাও তাহলে যেখানে খুশী যেতে পারো। প্রান্তিক আমার এখানে তোমার থাকার দরকার নেই। ভেবে দেখেছে কিছু একটা হয়ে গেলে গ্রামের বাড়ীতে কি জবাব দেব?

অত্যন্ত কঠিন আঘাত সন্দেহ নেই, তবু কিছু বলতে পারলামনা। কারণ আমার বার বার মনে হয়েছে আমাকে আঘাত দেওয়া তার উদ্দেশ্য নয়। আমার জন্য যে তার সীমাহীন দুশ্চিন্তা তাই ফুটে উঠেছে তার দেওয়া আঘাতের মধ্য দিয়ে। আমি চুপ করে তার বকুনিকে মেনে নিলাম।

খাওয়ার টেবিলে জিজ্ঞাসা করলেন, কোথায় গিয়েছিলে? আমি বললাম তোমাকে জানতেই হবে? বা আমাকে জানতে হবে না, এত রাত পর্যন্ত তুমি কোথায় কি করে বেড়াচ্ছ? একটা কিছু হয়ে গেলে তো আমাকেই কৈফিয়ত দিতে হবে। আমি সত্যি কথা বলব কিনা ভাবছি, উনি আবার বললেন কি হল, জবাব দিচ্ছনা কেন? আমি বললাম তোমাকে বলব কিনা তাই ভাবছি। এমনকি গোপন কথা যা আমাকে বলা যাবে না। আমি পিসিকে রাগিয়ে দেওয়ার জন্য বললাম, আমি তো বড় হয়েছি পিসি। কিছু গোপনতা তো আমার থাকতেই পারে। পিসি কি বুঝলেন কে জানে। বললেন, লুকিয়ে লুকিয়ে জল খাওয়া হচ্ছে? ওসব চলবেনা আমি স্পষ্ট বলে দিচ্ছি।

নারী মনের কৌতূহল, সব বয়সেই তা একই রকম। ঈশ্বর বোধ হয় এই সীমাহীন কৌতূহল দিয়েই তাদের পাঠিয়েছেন। আস্তে আস্তে আমার বিছানায় এসে বসলেন উনি। আমি নিবিষ্ট মনে বইয়ের পাতায় ডুবে গেলাম। যদিও জানি একটা লাইনও আমার মাথায় ঢুকছেনা। আড়চোখে একবার তাকালাম পিসির দিকে। পিসি সুন্দরী। প্রায় ১০ বছরের বিবাহিত জীবনে শরীরের কোথাও এতটুকু টোল খায়নি। পাশাপাশি মিনতি সেন। কে বেশী সুন্দরী। অশ্রুকণার কথায়, যদি সে ছেলে হতো তাহলে সে মিনতি সেনের প্রেমে পড়ে যেতো। আসলে এই কথা বলে সে কি বোঝাতে চাইছে, সেকি চাইছে আমি যেন মিনতি সেনের সঙ্গে আর না মিশি? কেন যে ছাই মিনতি সেন আমার পিসি এই পরিচয় দিতে গেলাম ওদের কাছে। আমি তো বলতেই পারতাম আমার পিসির বন্ধু বা অন্য কিছু। কিন্তু এখন যা হয়েছে তাতে আর ফিরিয়ে নেওয়া যাবে না।

পিসি বললেন, বই পড়ছ না পাতার পর পাতা উল্টিয়ে যাচ্ছো? বললাম পড়ছি তো। ছাই পড়ছে। তার চেয়ে শুয়ে পড়। বললাম ঘুম আসছেনা। কথা লুফে নিয়ে পিসি বললেন সারাদিন এই রকম টোটো করে ঘুরলে কি আর ঘুম আসবে? না আসলে কি করব? শুয়ে শুয়ে ভেড়া গোন দেখবে এক সময় ঠিক ঘুম এসে যাবে। আমি বললাম, তুমি ঘুমাচ্ছনা কেন? আমারও ঘুম আসছেনা।–কেন তোমার ঘুম আসছেনা কেন? তুমিতো আর সারাদিন আমার মতো টোটো করে ঘোরনি। পিসি বললেন আমার যে কেন ঘুম আসছেনা

সে তুমি বুঝবে না প্রান্তিক। আমার মত অবস্থায় পড়লে হয়তো বুঝতে পারতে। বড় অসহায় মনে হয় পিসির কণ্ঠস্বর। উত্তরে বললাম না তা হয়তো ঠিক বুঝব না, পিসি, তবে খানিকটা অনুমান করতে পারি। কি অনুমান করতে পারো? বললাম, তোমার অসহায়তা, তোমার নিঃসঙ্গতা, তোমার আশা ও কামনার দোদুল্যমানতা। কিন্তু পিসি মিথ্যে দুশ্চিন্তা করে কিছু লাভ হয়কি? তুমি যা ভাবছ তা হয়তো সত্যি নয়, অথচ মিথ্যে ভেবেই তুমি হয়তো তোমারই ক্ষতি করছ। সব কিছুকে স্বাভাবিক ভাবে গ্রহণ কর, দেখবে কোথাও কোন অসুবিধা নেই। মনেও শান্তি পাবে।

অবাক হয়ে তাকান নীলাঞ্জনা পিসি আমার দিকে। আমি যে এমন কথা বলতে পারি তা উনি ভাবতেই পারেননি। উনি কাত হয়ে আমার বিছানায় শুয়ে পড়েছিলেন এবার উঠে বসলেন। বললেন, তুমি কাউকে ভালোবাস প্রান্তিক। বললাম হ্যাঁ? কাকে? আমার পরিচিত যারা, সকলকে। আমি তা জানতে চাইনি প্রান্তিক, আমি শুধু জানতে চাইছি এই সকলের মধ্যে আলাদা করে কাউকে ভীষণ আপন করে ভালবাস কি না। হঠাৎ পিসির এ ধরনের প্রশ্নে অবাক হয়ে যাই।

কি বলব। আমার জীবনে তখনো আসেনি ভালোবাসার কোন আলাদা আকাঙ্খ। স্পষ্ট করে ছুঁয়ে যায়নি হৃদয়কে কেউ। বুঝতে পারি অশ্রুকণা বা রেহানা একটু আলাদা দৃষ্টিতে দেখে আমাকে। আলাদা করে কথা বলতে আনন্দ পায়। কিন্তু তাকে ভালোবাসা বলে কিনা জানিনা। অন্তত আমি নিজে ওদের কাউকে আলাদা করে ভাবিনি এখনো। তাই পিসিকে ভড়কে দিতে বললাম, আমার এই ছোট্ট জীবনে একজনকে আমি ভীষণ ভাবে ভালোবাসি পিসি, যদি তাকে ভালোবাসা বলে। কাকে জানতে চান নীলাঞ্জনা। আমি বলে চললাম যেন আমাকে বলার নেশায় পেয়েছে এমনি ভাবে। তার কথা আমি প্রতি মুহূর্তে ভাবি, তার হাসি আমাকে হাসায়, তার কান্না আমাকে কাঁদায়। তার দুশ্চিন্তা আমার কাছে বোঝার মত মনে হয়। তার নিঃসঙ্গতাকে পারলে কানায় কানায় ভরে দিতে ইচ্ছে হয়। তার চপলতায় আমি চঞ্চল হই। তাকে বুঝতে চাই, কিন্তু বুঝতে পারিনা। তাকে ধরতে চাই, যদিও ধরা ছোঁয়ার বাইরে তার অবস্থান। কখনো তাকে মনে হয় বন্ধু, কখনো বা শুভাকাঙ্খী, কখনো বা আপন মনে কথা বলি তার সাথে, সান্ত্বনা দিতে চাই তার সব হারানো ব্যথার জায়গায়, তবু তাকে দূরের বলে মনে হয়। কখনো মনে হয়না, নিজেকে তার যোগ্য বলে। নীলাঞ্জনা পিসি অবাক আর বিস্ময় ভরা দৃষ্টি নিয়ে তাকান আমার দিকে। মনে হয় তার মনে কিসের যেন এক ঢেউ খেলে যাচ্ছে। আমার এমন গুছিয়ে কথা বলাতে অবাক হন ভীষণ। জানতে চাইলেন কে সেই ভাগ্যবতী যে তোমার এতটা সময় চুরি করে নিয়েছে। তোমার জীবন থেকে। কণ্ঠে কি হতাশা না কৌতূহল? আমার ভীষণ মজা লাগছে পিসির এই অসম কৌতূহলের জন্যে। তাকিয়ে দেখি তার বুকের ওঠা নামা। চোখের পরে চোখ রেখে বললাম, সত্যি তোমাকে জানতে হবে পিসি? অভিমানী কণ্ঠে বললেন, যদি বিশ্বাস করতে না পার নাইবা বললে। আমি চুপ করে আছি দেখে বললেন, তার মানে আমাকে তোমার বিশ্বাস হয় না। তা তুমি আমায় বিশ্বাস না করলেও আমি জানি কে তোমার শুধু মনটাই নয় জীবনটাই ধরে নাড়া দিয়েছে। আমার কৌতূহল আরো বেড়ে যায়। বলি বলতো কে? পিসি হাসতে হাসতে বলল রেহানা। এবার আমার অবাক হওয়ার পালা। রেহানা বা অশ্রুকণার নাম পিসি শুনে থাকতে পারেন, তাই বলে তাদের মধ্যে রেহানা আমার জীবনে জড়িয়ে আছে, এমন কোন ঘটনা ঘটেছে বলেতো মনে করতে পারছি না। আমি বললাম এ তোমার অলীক কল্পনা পিসি। তাছাড়া রেহানা নামের মেয়েটিকে তুমি দেখওনি। তার কোন কথা তোমার সাথে কোন দিন বলেছি বলেও তো মনে হয়না। আমার মুখের কথা লুফে নিয়ে পিসি বললেন, সেই জন্যইতো আমার মনে হয়–রেহানা আছে তোমার জীবনব্যাপী। আর এমন নিবিড় তোমাদের সম্পর্ক যে, গোপনতার সেই মধুরতা তুমি কাউকে প্রকাশ করতে চাওনা। না হলে তুমি তোমার কলেজের কত ছেলে বন্ধু মেয়ে বন্ধুর কথা বল, কিন্তু কোনদিনই রেহানার নাম ভুলেও উচ্চারণ করো না, কিন্তু কেন? সেকি তোমার একান্ত একার বলে? হাসতে থাকেন নীলাঞ্জনা পিসি ভাসা ভাসা চোখ দুটি কৌতূকে উজ্জ্বল।

আমি হাতড়িয়ে দেখি কথাটা হয়তো সত্যি। আসলে রেহানার সাথে আমার সম্পর্ক কেমন জানিনে। কথাও বেশী হয় না নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া। বললাম, বেশ তোমার কথাই সত্যি, আমি তার কথা তোমাকে বলিনা, অবশ্যি বলার কিছু নেই বলেই বলিনা, কিন্তু তুমি তার নাম জানলে কি করে। হাসছেন পিসি। এই সঘন রাতের আলো আধারিতে পিসি যেন মায়া লোকের অঙ্গরির মত। হাসলে এত সুন্দর দেখায় পিসিকে। নিকষকালো ঘণ এলায়িত চুল, দুই ভূর মাঝে সবুজ টিপ, দেহের কোন অংশেই নেই বাহুল্য মেদ, সঙ্গে সুউন্নত পীন পয়োধর, এক নেশা জাগানো আকর্ষণ যেন, অথচ কেবল ভালোলাগা ছাড়া সে আকর্ষণের অন্য কোন ভূমিকা নেই।

হঠাৎ মনে পড়ে যায় মিনতি সেনের কথা, মিনতি সেন সম্পর্কে নীলাঞ্জনা পিসি যা ভাবেন তা সত্যি কিনা জানিনা। অন্তত আজ পর্যন্ত মিনতি সেনের কোন আচরণে এমন কিছু ধরা পড়েনি, যাতে অন্য কিছু ভাবা যায়, শুধু এক অপরাহ্নে পরিমল বাবুর সাথে তার অকারণ আগমন ছাড়া। যদিও প্রশ্নটা থেকেই যায়, শূন্য বাড়ী জেনেও তিনি কেন এসেছিলেন পরিমলবাবুর সাথে?

অকারণ কৌতূক যেন উপছে পড়ছে নীলাঞ্জনা পিসির চোখ দিয়ে। বললেন, কি দেখছ ওমন করে আমার দিকে তাকিয়ে। ভেবে দেখলাম চোখ যদি হঠাৎ নামিয়ে নিই, ভুল মানে হতে পারে। বললাম তেমনি চোখের পর চোখ রেখে, পিসি তুমি এত সুন্দর না, আগে কোন দিন ভাল করে দেখিনি তোমায়।

নীলাঞ্জনা পিসি নারী। নারীর স্বাভাবিক ধর্ম তার লজ্জা,তাকে তিনি অস্বীকার করবেন কি করে? তাছাড়া কোন নারীকে যদি কোন পুরুষ, সে যে বয়সেরই হোকনা কেন, সুন্দর বলে, তাহলে একটা গোপন অনুভূতি তার হবেই। কিন্তু আমার এ স্তুতিতে মনে হয় তার চিন্তা অন্য খাতে বইতে আরম্ভ করে। বললেন প্রান্তিক, আমার সুন্দরের বয়স আমি পেরিয়ে এসেছি অনেক আগে। হয়তো তুমি আমার মাঝে অন্য কাউকে খুঁজে বেড়াচ্ছো, তাই এত ভালো লেগে গেছে। কি ঠিক কিনা? আমি তাকে বাধা দিয়ে বললাম, না পিসি না। কি না? তুমি যা ভাবছো তা মোটেই নয়। তবে কি সত্যিই তুমি রেহানাকে ভালোবাসনা? না পিসি না। তাহলে তুমি কাকে ভালবাস? আমার মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল, তোমাকে পিসি–তোমাকে, শুধু তোমাকে আর কাউকে নয়।

উনি তাকালেন আমার দিকে। আমি মাথা নীচু করলাম, পিসি বোধ হয় এমন একটা উত্তরের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। উঠে পড়লেন। আমার সঙ্গে আর কোন কথা না বলে নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়লেন। তার এই বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় আমি ভীষণ অবাক হয়ে যাই। আমার উত্তরে তিনি আঘাত পেয়েছেন কিনা জানিনা। কিন্তু পিসির ঐ ভাবে চলে যাওয়া আমার একদম ভালো লাগেনি। চেয়ারে সেই ভাবে বসে আছিতো বসেই আছি। চোখে ঘুম নেই। আবোল তাবোল অনেক কথা ভাবতে ভাবতে রাত শেষ হয় এক সময়।

সকালে উঠে পিসি দেখেন যে আমি সেই ভাবে বসে আছি একই জায়গায়। ঘুম জড়ানো চোখে আমার পিছনে এসে দাঁড়ান তিনি। তার পর আমার মাথার চুলে অঙ্গুলি সঞ্চালন করতে করতে বললেন, তুমি কাল রাত থেকে সেই একই ভাবে বসে আছো? ঘুমাও নি কেন? না কোন রাগ নয়, কোন বিদ্বেষও নয়। কোন এক সহমর্মীর আপন করার অনুভূতি যেন। আর তাতেই আমার ভিতরেব ক্ষোভ যেন গলে যেতে লাগলো। কিন্তু আমি নড়ার কোন লক্ষণ দেখালামনা। এবার তিনি আমার মাথাটা ঘুরিয়ে আমার মুখটা তার কবোষ্ণ বুকের পরে রেখে বললেন, আমার উপর রাগ করেছো প্রান্তিক! ছি, এতবড় ছেলের চোখে জল।

আর সত্যি সত্যি আমার দুচোখের জলে তার বুকের আঁচল ভিজে যেতে থাকে। কিন্তু তিনি আমার চোখের জল মোছাবার বিন্দুমাত্র চেষ্টা করলেন না। তারপর এক সময় বললেন, তুমিতো আমায় ভালোবাস প্রান্তিক, তাই না!–কিন্তু তুমিতো আমায় ভালবাসনা। কে বলেছে?–তাহলে ওভাবে তুমি পালিয়ে গেলে কেন?

পিসি আস্তে আস্তে বললেন, আমার কথা শুনতে তোমার ভালোলাগবে?–তোমার সব কথা আমার ভালোলাগে, মনে হয় সর্বক্ষণ কেবল তুমি আমার সাথেই কথা বল। সঙ্গে সঙ্গে পিসি আমার কথা শেষ না হতেই বললেন, তাই ভয় হয় প্রান্তিক, আর আজ কেন পালিয়ে গেছি এখনি হয়তো তা বুঝতে পারবেনা, কিন্তু জীবনেব অভিজ্ঞতা যখন আর একটু বাড়বে তখন বুঝতে পারবে, আমার পালিয়ে না গিয়ে উপায় ছিল না। এত বিষণ্ণ আর অবসন্ন লাগছে পিসিকে যে তার জন্য ভীষণ দুঃখ হয় আমার।

উত্তরে বললাম, সে আমি জানি পিসি। জান?–হ্যাঁ জানি। এরপরেও জানতে চাও তোমাকে ভালবাসি কিনা। হ্যাঁ আমি তোমার মুখ থেকেই শুনতে চাই। পিসি তার বুক থেকে আমার মাথাটি তুলে দিয়ে বললেন, ছেলে মানুষি করো না। সব প্রশ্নের উত্তর সোজাসুজি দেওয়া যায় না। তার চেয়ে আজ কলেজে গিয়ে রেহানাকে বলবে, আমি তাকে একবার দেখতে চাই।–কেন? বাঃ তোমার বন্ধুরা কেমন আমি দেখব না, দেখতে ইচ্ছে হতে পারে না?–রেহানাতো আমার একমাত্র বন্ধু নয়। জানি। –তাহলে? তাহলেও ওর যদি আমাদের এখানে আসতে কোন অসুবিধা না হয় তাহলে একবার আসতে বলবে। একথা বলে আমাকে ছেড়ে দিয়ে ফিরে যাচ্ছেন দেখে আমি আবারও ডাকলাম, পিসি। কি? আমি কিন্তু আমার উত্তর পাইনি। পিসি এগিয়ে এলেন। আমার পাশে। তারপর আস্তে আস্তে আমার মুখটা তুলে নিলেন ধীরে ধীরে তার মুখের কাছে। তারপর কাঁপা কাঁপা ওষ্ঠাধরে একটা চুম্বন একে দিয়ে দ্রুত পালিয়ে গেলেন। কিন্তু কই আমার মধ্যে তো কোন শিহরণ জাগল না। বুঝতে পারিনি আমি, পিসির কাছে আমি এটাই চেয়েছিলাম কিনা। আমার চাওয়ার বিনিময়ে তিনি যা দিলেন তা আমার ভালবাসার প্রতিদান না তার স্নেহ উপহার তাও বুঝতে পারলাম না। বিনিময়ের জন্য অপেক্ষা করেননি তিনি, পালিয়ে গেছেন। অপেক্ষা করলে, আমি কি করতাম তা আমি নিজেই জানিনা। আমার শিরায় শিরায় যে কম্পন শিহরণ জাগার কথা –কোথায় সেই শিহরণ! আমার বিশ বছরের যৌবনে নারীর প্রথম যৌবন স্পর্শ। হোকনা সে যৌবন আমার ধরা ছোঁয়ার বাইরে। হোকনা পিসি আমার গুরুজন। তবু নারীতো। যে নারীর যৌবন আজো তার দেহের কানায় কানায় জোয়ারের জলে উচ্ছলিত। এক অলস মধ্যাহ্নে তাই আমার মনে হয়, এমনি করেই হারিয়ে যাই আমরা–আমাদের যৌবন . বিক্রি হয়ে যায় ফেরি ঘাটে। তাই কি? পিসির ভালবাসাকে কি আমি ফেরিঘাটের সঙ্গে তুলনা করতে পারি? না পারিনা। অপ্রাপ্তি যে প্রাপ্তির থেকেও অনেক মূল্যবান।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *